১২. ঝুমুরদের রান্নাঘর বারান্দায়

ঝুমুরদের রান্নাঘর বারান্দায়

ঝুমুরদের রান্নাঘর বারান্দায়। করোগেটেড টিন দিয়ে বারান্দার একটা অংশ আলাদা করে রান্নাঘর। চালে কয়েক জায়গায় ফুটো আছে। বৃষ্টির সময় ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। রাঁধতে শাহেদার খুব যন্ত্রণা হয়। শাহেদা এই মুহূর্তে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। বড়া ভাজার জন্যে তেল চড়িয়েছেন। বৃষ্টির পানি ফুটন্ত তেলে এসে পড়ছে। ফুটন্ত তেলের ছিটা তার মুখে এসে পড়েছে। মুখের খানিকটা তো অবশ্যই পুড়েছে। শাহেদাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তিনি আহু উহু জাতীয় কোনো শব্দ করেন নি। তাঁর ব্যস্ততা চুলাটা নিরাপদ কোনো জায়গায় সরিয়ে নেয়ার দিকে। এই সময় ঝুমুর এসে বলল, বাড়িওয়ালা এসেছে মা।

শাহেদা বললেন, কাল সকালে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে যেতে বল।

বাড়ি ভাড়া নিতে আসেনি মা। বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা। আমরা বাড়ি ছাড়ি নি এই নিয়ে খুব চোঁচামেচি করছে।

শাহেদা নির্বিকার গলায় বললেন, করতে থাকুক।

তিনি কেরোসিনের চুলা দেয়ালের দিকে সরিয়ে দিলেন। সেখানে পানি আরো বেশি পড়ছে। ঝুমুর বলল, মা তুমি আস উনি বিশ্ৰী বিশ্ৰী সব কথা বলছেন। বাড়ির সামনে লোক জমে গেছে।

শাহেদা চুলা থেকে কড়াই নামালেন। মাথার উপর আঁচল তুলে দিলেন। ঝুমুর মা’র সঙ্গে গেল না। তার হাত-পা কাঁপছে। তার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড হতে যাচ্ছে। এমন সময় হচ্ছে যখন আপা বাড়িতে নেই। আপা থাকলে যত ভয়ঙ্কর কাণ্ডই হোক সামাল দিতে পারত। এখন কে সামলাবে? এক ফাঁকে সে গিয়ে কি মবিন ভাইকে নিয়ে আসবে? মাঝে মাঝে একজন পুরুষ মানুষের উপস্থিতির এমন প্রয়োজন পড়ে!

শাহেদা বারান্দার খোলা দরজার পাশে দাঁড়ালেন। বাড়ির উঠানে এবং রাস্তায় এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে তিনি কল্পনা করেন নি। হৈচৈ শুনে এরা জড়ো হয়েছে তাও মনে হচ্ছে না। বৃষ্টি মাথায় করে এতগুলো মানুষ জড়ো হবে না। নিজামউদ্দীন সাহেব মনে হচ্ছে এদের সঙ্গে করেই এনেছেন। ফুটন্ত তেল শাহেদার থুতনির কাছে পড়েছে। জায়গাটা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি জমে ফোঁসকা উঠে যাবে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। শাহেদা বললেন, কী হয়েছে?

নিজামউদ্দীনের গলা শীতল। কণ্ঠস্বরে কোনো রাগ নেই। তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য পরিষ্কার। তিনি কথা বললেন উঁচু গলায় যাতে জড়ো হওয়া প্রতিটি মানুষ তার কথা শুনতে পায়।

কী হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন? কী হয়েছে সেটা তো আপনি বলবেন। একত্রিশ তারিখ বাড়ি ছাড়ার কথা। আজ সাত তারিখ। বাড়ি ছাড়ার কোনো লক্ষণ নাই। বাড়ি ভাড়া দেয়ার সাড়াশব্দ নাই। ভাড়া আমার দরকার নাই। বাড়ি ছাড়েন।

শাহেদা শান্ত গলায় বললেন, ছাড়ব তো বটেই। বাড়ি খুঁজছি। পাওয়া গেলেই ছেড়ে দেব।

আমি খোঁজাখুঁজির কথা শুনতে চাই না। বাড়ি ছাড়বেন। আজ রাত্রেই ছাড়বেন।

আজ রাত্রেই ছাড়তে হবে?

অবশ্যই। ভদ্রপাড়ায় বাস করে দুই মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করবেন সেটা আর হতে দেয়া যায় না।

আপনি কী বলছেন?

গলা বড় করবেন না। আমি বড় গলার ধার ধারি না। ভদ্রলোকের পাড়ায় বাস করে ব্যবসা করবেন আর আমরা চুপ করে থাকব? ঢাকা শহরে খারাপ পাড়ার তো অভাব নাই, সেখানে গিয়ে ওঠেন। ব্যবসাও ভালো হবে। উঠতি বয়সের দুই মেয়ে!

শাহেদা ভাঙা গলায় বললেন, চুপ করুন। আমি আপনার পায়ে ধরছি। চুপ করুন। আজ রাত্রেই আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে দেব। আসুক, মেয়েটা আসুক।

নিজামউদ্দীন হৃষ্ট গলায় বললেন, মেয়ে ট্রিপ দিতে গেছে, এত সহজে কি আসবে? তার আসতে রাত দু’টা-তিনটা বাজবে।

ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলল, চুপ করেন না ভাই, অনেক তো বললেন।

শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে উঠলে ব্যথা কমবে।

নিজামউদ্দীন খড়খড়ে গলায় বললেন, আমি যা বলেছি। সত্য কথা বলেছি। যদি মিথ্যা বলি আমার উপর যেন আল্লাহর গজব পড়ে। তারপরেও বলতেছি–রাতটা থাকেন, পরের দিনটাও থাকেন। ব্যাস। পরশুদিন সকালে যেন দেখি বাড়ি পরিষ্কার। ভাড়া বাকি পড়েছে–দেয়া লাগবে না। মেয়ে খাটা পয়সার আমার দরকার নাই।

নিজামউদ্দীন নেমে যাচ্ছেন। যুদ্ধজয়ীর ভঙ্গিতে নামছেন। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে। বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া লোকজন চলে যাচ্ছে। শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের যন্ত্রণাটা খুব বেড়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

ঝুমুর এসে ডাকল, মা মা। শাহেদা তাকালেন না। বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। মা তুমি বিছানায় এসে শোও।

ঝুমুর মা’র হাত ধরল। শাহেদার ইচ্ছা করল প্ৰচণ্ড ধাক্কা দিয়ে মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। কিন্তু তিনি কোনো জোর পাচ্ছেন না। তাঁর শরীর পাখির পালকের মতো হালকা লাগছে। ঝুমুর হাত ধরে তাকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, মা তুমি এরকম করছি কেন? শাহেদা বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তার হাত-পা ঘামছে। খুব তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। মেয়েকে পানি এনে দেবার কথা বলতে পারছেন না। জিভ ভারি হয়ে গেছে। প্ৰচণ্ড ঘুমাও পাচ্ছে। এই ঘুমাই কি শেষ ঘুম? মেয়েগুলোকে কয়েকটা কথা বলে যেতে চাচ্ছিলেন। বলা বোধহয় সম্ভব হবে না। চোখে আলো লাগছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

আবার যখন চোখ মেললেন তখন করুণ একটা মুখ তার মুখের উপর বুকে আছে। সেই মুখ গভীর মমতায় জানতে চাইল, কেমন আছ মা? চিনতে পারছ না। আমাকে? আমি মিতু।

শাহেদা ক্ষীণস্বরে বললেন, পানি খাব।

মিতু পানির গ্লাস নিয়ে এল। চামচ নিয়ে এল। সে চামচে করে মা’কে পানি খাওয়াতে যাচ্ছে কিন্তু তার হাত এত কাঁপছে যে চামচ থেকে ছলকে পানি পড়ে যাচ্ছে। মিতু কাঁদছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। এত বেশি কাঁদছে যে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শাহেদা বললেন, কাঁদিস না মা। তিনি মাথা ঘুরিয়ে ঝুমুরকে খুঁজলেন। মিতু বলল, ঝুমুরকে পাঠিয়েছি মবিন ভাইকে আনতে।

কয়টা বাজে?

রাত বেশি হয় নি মা, আটটা।

শাহেদা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন, কাঁদিস না।

 

মবিনের ঘরের সামনে ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। ঘর বন্ধ, তালা ঝুলছে। নিচতলার দরজির দোকান খোলা। সেখান থেকে সেলাই মেশিনের খটখটি শব্দ আসছে। ভয়ে ঝুমুর অস্থির হয়ে গেছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি পড়ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁসে। মাথার উপর ছাদের মতো একটু আছে বলে বৃষ্টিতে ভিজছে না। তাতে কি? কতক্ষণ সে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? সে যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে তা দরজির দোকানের লোকটি দেখেছে। মেশিন বন্ধ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। ঝুমুরের মনে হচ্ছে সেই লোকটা উপরে উঠে আসবে। একা আসবে না, দু-একজন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে আসবে।

ঝুমুর এখন কী করবে? বাসায় ফিরে যাবে? বাসায় ফিরে যাবার পথেও তো ঝুমুরকে তারা ধরে ফেলতে পারে। এমন অন্ধকার রাস্তা। তারা যদি রিকশা থামায়। রিকশা থামিয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে নিয়ে যায়? চিৎকার করে উঠলে লাভ হবে না। এখনকার সময় এমন যে চিৎকার শুনলে কেউ আসে না। বরং দূরে সরে যায়।

বৃষ্টি জোরে নেমেছে। ঝুমুরের পা ভিজে যাচ্ছে। নিচের সেলাই মেশিনের খটখটি শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। লোকটা নিশ্চয়ই সেলাই মেশিন বন্ধ করে উপরে উঠে আসছে।

ঝুমুরের গা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তার যে এত ভয়ঙ্কর বিপদ তা কেউ জানতে পারছে না। দরজির দোকানের লোকটা তাকে কোনো একটা খুপড়ি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে–তারপর সারারাত ধরে কুৎসিত কাণ্ডকারখানা করবে। ভোরারাতে গলা টিপে মেরে ফেলে রাখবে ধানক্ষেতে। এই ক্ষেত্রে এরকমই হয়।

বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস দিচ্ছে। ঝুমুর এখন পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে। আসছে, দরজির দোকানের লোকটা আসছে। ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা ঘটতে যাচ্ছে। সে এখন কী করবে? ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবে? সাহস কি তার আছে? এমনও তো হতে পারে যে দরজির দোকানের লোকটা না মবিন ভাই-ই আসছেন। যদি মবিন ভাই হয় সে প্রথমে আনন্দে একটা চিৎকার দেবে এবং ছুটে গিয়ে মবিন ভাইকে জড়িয়ে ধরবে। এতে মবিন ভাই কিছু মনে করলেও তার কিছুই যায় আসে না।

না, মবিন ভাই না। দরজির দোকানের লোকটা। লম্বা কালো, রোগা একটা লোক। কী বিশ্ৰীভাবে সে তাকিয়ে আছে! ঝুমুর প্রায় দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। লোকটা বলল, মবিন সাহেবের খোঁজে আসছেন?

ঝুমুর কোনো উত্তর দিল না। তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে।

বৃষ্টিতে ভিজতেছেন। নিচে বসেন। আসেন।

বদমায়েশ লোকটা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জেনেও ঝুমুর যাচ্ছে। কারণ না গিয়ে সে কী করবে? কী হবে চিৎকার করে?

সাবধানে নামবেন, সিঁড়ি পিছল। ঝুমুর নিশ্চিত হলো সিঁড়ি পিছল এই অজুহাতে লোকটা তার হাত ধরবে। আচ্ছা! ঝুমুর কি পারে না প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সিঁড়িতে ফেলে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে? তার জন্যে খুব বেশি সাহস কি লাগে? আচ্ছা আল্লাহ্ কিছু কিছু মানুষকে এত কম সাহস দিয়ে পাঠান কেন? তাকে যদি একটু বেশি সাহস দিয়ে পাঠাতেন। সামান্য বেশি, তাহলে তাঁর এমন কী ক্ষতি হতো?

ঝুমুর দোকানে ঢুকেছে। দোকানে লোকটা একা না। আট-দশ বছরের একটা ছেলেও আছে। সে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। লোকটা একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসেন।

ঝুমুর বসল। না বসে সে কী আর করবে। লোকটা এখন কী করবে ঝুমুর জানে। কোনো একটা অজুহাতে ছেলেটাকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। তারপর দরজা বন্ধ করে দেবে।

মবিন সাহেব বাসাতেই থাকে। আজ যেন কোথায় গেছে। এসে পড়বে।

ঝুমুরকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলা। পরিস্থিতি শুরুতে একটু স্বাভাবিক করা।

চা খাবেন? ঝুমুর হ্যাঁ না কিছু বলল না। লোকটা পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বলল, ইসমাইল দৌড় দে।

ঝুমুর যা ভেবেছে তাই–ছেলেটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। তার ইচ্ছা করল চিৎকার করে বলে খবরদার তুই যাবি না, তুই বসে থাক।

ছেলেটা ছোট একটা কেতলি হাতে উল্কার মতো বের হয়ে গেল। মনে হয় চা-আনার কাজ তার খুব পছন্দ।

মাথাটা মুছে ফেলেন।

লোকটা একটা তোয়ালে ঝুমুরের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। ঝুমুর বলল, মাথা মুছতে হবে না। লোকটা তোয়ালে রেখে দিয়ে সহজ গলায় বলল, ভয় পাবেন না। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। মবিন সাহেব আসতে দেরি করলে আমি আপনাকে বাসায় দিয়া আসব।

ঝুমুর যা ভেবেছে তা হচ্ছে না। ছেলেটা চলে যাবার পরও লোকটা দরজা বন্ধ করছে না। বরং ছেলেটার ফেলে যাওয়া শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। শার্টের বোতাম লাগানোর কাজগুলো সাধারণত মেয়েরা করে। ছেলেদের এই কাজ করতে দেখলে একটু অস্বস্তি লাগে।

এই দোকানটা কি আপনার?

না, আমি একজন কর্মচারী।

আপনার বাসা কোথায়?

বাস-টাসা নাই।

রাতে থাকেন কোথায়?

দোকানেই থাকি।

হোটেলে খাই।

ঝুমুর খুব অবাক হচ্ছে। কারণ সে লোকটার সঙ্গে কথা বলছে। আগ্রহ করে কথা বলছে। অবশ্য কথা না বলেই বা কী করবে? দু’জন মানুষ তো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তাছাড়া মানুষটাকে তার এখন খুব ভদ্র, খুব বিনয়ী মনে হচ্ছে। ছোট কাজ যারা করে তারাও ভদ্র হতে পারে, বিনয়ী হতে পারে।

ছেলেটা চা নিয়ে এসেছে। তিনটা কাপ বের করল। ছোট ছোট কাপ। কাপের সাইজ যে এত ছোট হতে পারে ঝুমুরের ধারণা ছিল না। তারা তিনজনই চুকচুক করে চা খাচ্ছে। সবচে’ বেশি মজা করে চা খাচ্ছে ছোট ছেলেটা। প্রতিবারই চুমুক দিয়ে আহ্‌ করে উঠছে। বাইরে বৃষ্টির তোড় আরো বেড়েছে। ছোট ছেলেটা দীত বের করে বলল, শহীদ ভাই তুফান আইতাছে। যেন তুফান আসা খুব আনন্দের ব্যাপার। ঝুমুর বলল, আমার মার খুব শরীর খারাপ। এই জন্যে মবিন ভাইকে নিতে এসেছি।

কী হয়েছে?

অজ্ঞান হয়ে গেছে।

জ্ঞান ফেরো নাই?

আমি যখন আসি তখনো ফেরে নাই।

বলেন কী?

ঝুমুরেরও মনে হলো আরো তাই তো! এতক্ষণে একবারও তার মা’র কথা মনে হয়। নি। সে বেশ আরাম করে চা খাচ্ছে। মা কেমন আছে কে জানে। মারা যায় নি তো? ঝুমুর উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণস্বলে বলল, আমি চলে যাব।

শহীদ নামের লোকটা বলল, চলুন আমি সঙ্গে যাই।

ঝুমুর কোনো আপত্তি করল না। লোকটাকে তার ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে।

শহীদ ঝুমুরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই ডাক্তার আনতে গেল। এবং মুহুর্তের মধ্যে ডাক্তার নিয়ে এল। ডাক্তার ব্লাডপ্রেসার মাপলেন। প্রেসার কমাবার ওষুধ দিলেন। শহীদ ওষুধ আনতে গেল। ছাতা নেই, ভিজতে ভিজতে গেল।

মিতু বলল, লোকটা কে রে?

ঝুমুর বলল, আমার চেনা একজন।

চেনা মানে কি? কীভাবে চিনিস? পরিচয় হয়েছে কোথায়?

ঝুমুর জবাব দিল না।

মিতু চিন্তিত গলায় বলল, কত দিনের পরিচয়? ঝুমুর বলল, অনেক দিনের।

অনেক দিনের মানে কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ও কি প্রায়ই আসে। নাকি? কথা বলছিস না কেন? কী করে?

শার্টের বোতাম লাগায়।

তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস?

ফাজলামি করছি না, যা সত্যি তাই বলছি।

বান্দরের মতো দেখতে একটা লোক, তার সঙ্গে তোর এত খাতির কীভাবে হলো?

তুমি এত রাগছ কেন আপা?

না। আমাকে বল এত খাতির কীভাবে হলো?

তোমার হৈচৈ শুনে মা জেগে যাবে আপা।

মিতু বিস্ময় নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর বলল, আপা উনি ওষুধ নিয়ে আসার পর উনাকে রাতে খেয়ে যেতে বলি? বেচারা হোটেলে খায়। হোটেলের কুৎসিত খাবার খেয়ে খেয়ে শরীরের কী হাল করেছে দেখেছ?

তুই খুবই আশ্চর্য একটা মেয়ে রে ঝুমুর।

রাতদুপুরে মবিন ভাই যদি এরকম ছোটাছুটি করত তুমি কি তাকে না খাইয়ে বিদেয় দিতে?

মবিন ভাই আর সে এক হলো?

এক ভাবলেই এক।

মিতু তীব্ৰদূষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর সেই তীব্ৰদৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, চারটা চাল বসিয়ে দেব আপা?

যা ইচ্ছা কর।

বেগুন আছে। বেগুন ভেজে ফেলি?

যা ভাজতে ইচ্ছে করে সব ভেজে ফেল।

মিতু অবাক হয়ে দেখল ঝুমুর সত্যি সত্যি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল?

শহীদ খাবারের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। ঝুমুর বলল, না না করলে হবে না, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। গামছাটা দিয়ে ভালোমতো মাথা মুছে ফেলুন।

আমি খাব না। অন্য কোনো দিন এসে…

আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। না খেয়ে আপনি যেতে পারবেন না।

শহীদ অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। মেয়েটার কাণ্ডকারখানা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মেয়েটা কি পাগল টাইপের?

ঝুমুর বলল, খাবার কিছু নেই–বেগুন ভাজা, ডাল আর আলু ভর্তা। আপনার কষ্ট হবে।

মিতু বলল, উনি খেতে চাচ্ছেন না, তুই এত জোর করছিস কেন?

এত রাতে উনি হোটেলেও কিছু পাবেন না, না খেয়ে থাকবেন নাকি? শহীদ শরমে মরে গিয়ে মিতুর দিকে তাকাল।

মিতু বলল, আপনি খেয়ে যান। ঝুমুর চট করে খাবার দিয়ে দে।

মিতু মা’র ঘরে বসে আছে। দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে–মাথা নিচু করে মানুষটা খাচ্ছে। তার সামনে ঝুমুর বসে আছে। সে খাবার তুলে দিচ্ছে। কী যেন আবার নিচু গলায় বলছে। কী বলছে? বলুক যা ইচ্ছা।

শাহেদার ঘুম ভেঙেছে। শাহেদা বললেন, ছেলেটা কে রে?

মিতু বলল, আমি জানি না মা।

শাহেদা বললেন, যার ইচ্ছা আসছে, খেয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না মা, কিছুই বুঝতে পারছি না।

তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমার মনে হয় না চিন্তার কিছু। তুমি ঘুমিয়ে থাক।

শাহেদা চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়ছে। ঘরে আলো নেই বলে মিতু তা দেখতে পাচ্ছে না।

 

ঝুমুর চাদরে সারা শরীর ঢেকে শুয়ে আছে। মাথাও চাদরের নিচে ঢুকানো। আজ সে একা ঘুমুবে। মিতু ঘুমুবে মা’র সঙ্গে। ঘুমুতে যাবার আগে সে বোনের ঘরে ঢুকল। বিছানায় বসতে বসতে বলল, ঘুমুচ্ছিস নাকি ঝুমুর?

ঝুমুর জবাব দিল না। মিতু বলল, তুই জেগে আছিস আমি জানি। মুখ থেকে চাদর সরা।

ঝুমুর চাদর সরাল। মিতু বলল, ছেলেটা কে?

জানি না।

জানি না মানে? ওর নাম কি?

শহীদ।

তোর সঙ্গে কত দিনের পরিচয়?

আজই পরিচয় হয়েছে।

সে কী!

মবিন ভাইয়ের বাসার নিচে দরজির দোকানে কাজ করে। আমাকে তাদের ঘরে নিয়ে গেল। চা খাওয়াল।

আর তুই তাকে এরকম খাতির-যত্ন করে দিলি। না জানি সে কী ভাবছে?

ঝুমুর লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে সে বলল, পরশুদিন সকালে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে আপা।

পরশুদিন আসুক। তখন দেখা যাবে।

তুমি তো আজকের কাণ্ড দেখ নি–আজকের কান্ত দেখলে তোমার আক্কেলগুডুম হয়ে যেত।

তোর কাণ্ড দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে।

ঝুমুর মাথা নিচু করে খুব হাসছে। হাসি দেখে মিতুর বড় মায়া লাগল। হঠাৎ সে বলল, আয় তো ঝুমুর তোকে একটু আদর করি। ঝুমুর চোখ তুলে তাকাল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আপাকে জড়িয়ে ধরল।

দু’বোন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদল। কেন কাঁদল তারা জানে না।

এক সময় ঝুমুর চোখ মুছে লজ্জিত ভঙ্গিতে ডাকল, আপা!

কি?

আমরা এত কান্নাকাটি করছি কেন?

আমি কী জন্যে কাঁদছি সেটা আমি জানি, তুই কী জন্যে কাঁদছিস সেটা তোর জানার কথা।

আমি জানি না।

না জেনেই ভেউ ভেউ করে কাঁদছিস?

হুঁ। আপা শোন–

বল শুনছি।

পরশু কী হবে বল তো—বাড়িওয়ালা চাচা যখন আসবে তখন তুমি যদি না থাক?

আমি না থাকলে তুই তো থাকবি। তুই সামলাবি।

আমি সামলাব? তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে? কী সব কুৎসিত কথা যে লোকটা বলছিল!

বলুক না। এক সময় বলার কথা শেষ হয়ে যাবে।

লোকজন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। কুৎসিত কুৎসিত কথা বলবে তখন আমি কী করব?

তুই ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হবি। তাতেই কাজ হবে। কিছু মানুষের সিমপ্যাথি পেয়ে যাবি। যদি কাদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাস তাহলে আর দেখতে হবে না। সব লোক তোর পক্ষে চলে আসবে।

কী যে তোমার কথা। আপা!

মিতু হাসতে হাসতে বলল, ইচ্ছা করলে লোকটাকে আমরা কঠিন শাস্তিও দিতে পারি। কীভাবে জনিস?

কিভাবে?

খুব সহজ-কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট একটা অভিনয় করতে হবে। লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে–যখন তখন আমাদের বাসায় আসত। কখনো পেঁপে নিয়ে আসত, কখনো কলা, কখনো আম নিয়ে আসত। একদিন খারাপ একটা ইঙ্গিত করে। আমরা তাকে ঘর থেকে বের করে দেই। তারপর থেকে সে আমাদের তাড়িয়ে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।

কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।

করবে। মানুষের চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে যাই বলা হয় তাই সবাই বিশ্বাস করে।

তুমি বলতে পারবে এমন কথা?

না।

পরশুদিনের কথা ভেবে আমার এমন অস্থির লাগছে!

অস্থির লাগার কিছু নেই। পরশুদিন কেউ আসবে না। আমি ব্যবস্থা করব।

কী ব্যবস্থা করবে? সেটা তোর জানার দরকার নেই। তবে নিশ্চিত থাক। পরশুদিন কেউ আসবে না। কী ব্যবস্থা তুমি করবে। সেটা না জানলে আমি নিশ্চিত হতে পারব না। আমি ঘুমুতে পারব না।

আমার চেনা একজন মানুষ আছে। তাকে জানালেই আর কোনো সমস্যা হবে না।

উনি কি ভয়ঙ্কর কোনো মানুষ?

মোটেই না। আমুদে একজন মানুষ। কিন্তু তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা।

এরকম মানুষকে তুমি চেন কীভাবে? বেঁচে থাকার জন্যে অনেক” মানুষকে চিনতে হয়। অনেক কুৎসিত কাণ্ডকারখানা করতে হয়।

বেঁচে থাকাটা কি এতই জরুরি?

মিতু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থাকা খুব জরুরি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় মোটেই জরুরি না।

কখন তোমার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটা জরুরি?

ঘুম পাচ্ছে–শুয়ে পড়।

না বল–কখন তোমার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটা জরুরি?

মিতু নিচু গলায় বলল, মাঝে মাঝে শুটিং শেষ হবার পর–অনেক রাতে বাসায় ফিরি। পথে মনে হয় তুই আমার জন্যে বারান্দায় চুপচাপ বসে আছিস। পথে কোনো রিকশা দেখলেই চট করে উঠে দাঁড়াচ্ছিস, তখন বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি মনে হয়। মাঝে মাঝে শেষ রাতের দিকে হঠাৎ মনে হয় মা আমার কপালে হাত রেখে দেয়া পড়ছেন, তখন বেঁচে থাকাটা জরুরি মনে হয়। শুধু জরুরি না, অসম্ভব জরুরি মনে হয়।

তুমি আসল কথাটা কিন্তু আপা বল নি। আসল কথাটা এড়িয়ে গেছ।

আসল কথাটা কী?

আমরা কিছু না–মবিন ভাইয়ের কথা তোমার যখনই মনে হয় তখনি বেঁচে থাকাটা তোমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়। ঠিক বলেছি না। আপা?

হয়তো ঠিক বলেছিস।

হয়তো না–আমি জানি এটাই আসল সত্য, বাকি সব নকল সত্য।

বয়সের তুলনায় তুই বেশি বেশি জেনে ফেলছিস। জানা ভালো, তবে বেশি জানা ভালো না।

ঝুমুর বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, খুব দুঃখী মানুষেরও বোধহয় বেঁচে থাকা জরুরি মনে হয় তাই না। আপা?

হয় বোধহয়। নয়তো তারা বেঁচে থাকে কেন?

সবাই তো আর বেঁচে থাকে না। কেউ কেউ আবার মরেও যায়। বিষ খায়। গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। কেন পড়ে?

জানি না কেন?

মবিন ভাইকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম—উনি উত্তর দিতে পারেন নি।

তাকে আবার কখন জিজ্ঞেস করেছিস?

ঐ দিন স্কুল থেকে টিফিন পিরিয়ডে পালিয়ে তাঁর কাছে চলে গেলাম। তাঁর ঘরে কী সুন্দর একটা শীতলপাটি পাতা! আমার সব সময় মনে হয়েছে তার ঘরটায় একা একা হাত-পা ছড়িয়ে শীতলপাটিতে ঘুমুতে পারলে খুব একটা আরামের ঘুম হবে। সেই জন্যে গিয়েছিলাম। তখন প্রশ্নটা করলাম।

মিতু তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ঘুমিয়েছিলি?

হুঁ। মবিন ভাই ঘরের ভেতরে আমাকে রেখে তালা দিয়ে ছাত্র পড়াতে চলে গেলেন। সন্ধ্যাবেলা এসে তালা খুললেন। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। কী শান্তির ঘুম যে ঘুমিয়েছি!

ও আচ্ছা।

তুমি কি রাগ করলে আপা?

না।

কিন্তু তোমার গলার স্বর কেমন কঠিন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ।

পাশের ঘর থেকে শাহেদা ডাকলেন, মিতু, এই মিতু।

মিতু উঠে গেল। ঝুমুর আবার চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ফেলল। চাদর দিয়ে শরীর ঢাকামাত্র আলাদা একটা জগৎ তৈরি হয়ে যায়। সেই জগতে কত কাণ্ড হয়। আধোঘুম জাগরণে ঝুমুর তার রহমস্যময় জগতে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

এখন সে হয়েছে দারুণ বড়োলোকের এক মেয়ে। ঘর থেকে সে পালিয়ে চলে এসেছে। তাকে খোঁজার জন্যে হুলস্থূল পড়ে গেছে। দু’লাখ টাকা পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে, সে অতি সাধারণ একটা জায়গায় লুকিয়ে আছে। একটা দরজির দোকানে। দরজির দোকানের কর্মচারীর নাম শাহেদ। সে রাতে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে এক কোণায় রাজকন্যাদের মতো একটা মেয়ে লুকিয়ে আছে। সে ভয় পেয়ে বলল, কে?

ঝুমুর বলল, আমি নীলাঞ্জনা (রাজকন্যার নাম নীলাঞ্জনা চৌধুরী)

আপনি এখানে কেন? আমি কয়েকদিন লুকিয়ে থাকব। আপনি কি আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন না?

আপনার মতো রূপবতী মেয়েকে আমি কোথায় লুকিয়ে রাখব?

লুকিয়ে রাখতে না চান না রাখবেন, শুধু আজ রাতটা থাকতে দিন, আমি ভোরবেলা চলে যাব।

রাতে কোথায় ঘুমুবেন?

কেন আপনার খাটে ঘুমুব। আপনি একদিকে তাকিয়ে ঘুমুবেন, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ঘুমুব। মাঝখানে একটা বালিশ দিয়ে রাখব যাতে গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়।

আপনি তো ভয়ঙ্কর কথা বলছেন।

আমি মোটেই ভয়ঙ্কর কথা বলছি না। আমি সহজ স্বাভাবিক কথা বলছি।

ঝুমুর নীলাঞ্জনা চৌধুরীর ভূমিকায় অনেক রাত পর্যন্ত অভিনয় করল। তার ঘুম এল শেষ রাতে। তখন মোরগ, ডাকতে শুরু করেছে।

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *