১২. ঝিরঝিরে বৃষ্টি

১২.

একটু আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। লেকের জলের ধারে ঘাসের ওপর বর্ষাতি পেতে চুপ করে বসে আছি। মেঘ ভেঙে অল্প রাঙা শেষবেলার রোদ উঠল ওই। ফ্যাকাসে গাছপালা যেন রূপকথার রাজ্যে জেগে উঠল হঠাৎ। জল উঠল ঝিলমিলিয়ে। জীবন এ রকম। কখনও মেঘ, কখনও রোদ।

ক্ষণা আসবে। আমার আর ক্ষণার মধ্যে এখন গোপনীয়তা তৈরি হয়েছে। যেন পাতালের নদী। বাড়ির বাইরে আমরা আজকাল লুকিয়ে দেখা করি।

ক্ষণার ভিতরে আজকাল আর-এক ক্ষণা জন্ম নিচ্ছে। সে অন্য এক রকম চোখে নিজেকেও দেখে আয়নায়। বেরোবার সময়ে ক্ষণা বলে দিয়েছিল, লেকে থেকো। আমি সিনেমার নাম করে বেরোব। পৌনে ছ’টায় দেখা হবে।

আমি জলে একটা ঢিল ছুড়ি। ঢেউ ভাঙে। কিছু ভাবি না। কিছু মনে পড়ে না। শুধু জানি, ক্ষণা আসবে। বর্ষাতির পকেটে লুকোনো টেপ-রেকর্ডার উন্মুখ হয়ে আছে।

ঘড়িতে পাঁচটা চল্লিশ। পিচের রাস্তাটা দ্রুত পায়ে পার হয়ে ক্ষণা ঘাসে পা দিয়েই হাসিমুখে ডাকল, এই।

পলকে মুখে হাসির মুখোশ পরে তাকিয়ে বলি, এসে গেছ?

 দেরি করেছি? বলো!

না। একটুও না। বলে বর্ষাতিটা বড় করে পাতি। টেপ-রেকর্ডার চালু হয়।

ক্ষণা কাছ ঘেঁষে বসল। গায়ে গা ছোঁয়-ছোঁয়। বলল, ঠিক বেরোবার আধ ঘণ্টা আগে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি দেখে আমার যা কান্না পাচ্ছিল না! কখন থেকে তুমি এসে বসে আছ। আর আমি যদি বেরোতে না পারি!

খুব না-ভেবেই বলি, ঝড় বৃষ্টিতে কি কিছু আটকাত ক্ষণা? তোমাকে আসতেই হত।

ক্ষণা পাশমুখে আমার দিকে তাকায়। বড় প্রকট হয়ে আছে ওর আজকের সাজ। চোখের পাতায় আউটার আই ক্রিম লাগানো, কাজল, ম্যাসকারা, মুখে মেক-আপ, কপালে মস্ত টিপ, কানে ঝুমকো, চুল ফাঁপিয়ে আঁচড়ান, রেশমি বুটির দামি শাড়ি পরেছে কচি কলাপাতা রঙের। ঠোঁটে রক্ত-গাঢ় রং। আধবোজা মদির এক রকম চোখের দৃষ্টি খানিকক্ষণ ঢলে রইল আমার দিকে।

তারপর বলল, তুমি কী করে বুঝলে?

তারপর একটা ছোট্ট শাস ফেলে বলল, ঠিক। আমাকে আসতেই হত। কেন আসতে হত বলো তো!

কেন ক্ষণা?

ক্ষণা অকপটে চেয়ে থেকে বলল, তোমাকে ভালবাসি বলে।

সত্যিই ভালবাসো ক্ষণা?

কী করে বোঝাব বলো? সারা দিন কেবল তোমার কথা মনে আসে। সারা দিন। ঘুমিয়েও তোমার কথা ভাবি। ঘুম থেকে যেই চোখ মেলি অমনি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করো।

আমার অবস্থা তোমার চেয়ে ভাল নয় ক্ষণা। আমার সমস্ত মাথা জুড়ে তুমি। শুধু তুমি।

শোনো।

উ!

ক্ষণা খুব কাছে ঘেঁষে আসে। ও বেহেড। সম্মোহিত। ওর চেতনা নেই যে, এখনও দিনের আলো ফটফট করছে। যে-কেউ, চেনা বা আধচেনা লোক আমাদের দেখে ফেলতে পারে। অবশ্য দেখে ফেললে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি। যত স্ক্যান্ডাল, তত পাবলিসিটি। যত পাবলিসিটি তত সুবিনয়ের সুবিধে। আমি এও জানি, আজ লেকে সুবিনয় সাক্ষী হিসেবে কয়েকজনকে হাজির রেখেছে। তারা কে আমি চিনি না। কিন্তু আছে আশেপাশে। দেখছে। আমাকে আজ খুব ভাল অভিনয় করতে হবে।

ক্ষণা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, তুমি ছাড়া আর কেউ কখনও আমাকে এত সুন্দর দেখেনি। কখনও বলেনি, তুমি বড় সুন্দর।

তুমি সুন্দর ক্ষণা। বলে ক্ষণার কোমরের দিকে হাতটা আলতোভাবে জড়াই। বলি, সকলের কি সৌন্দর্য দেখবার চোখ থাকে?

ক্ষণা অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল একটু। তারপর বলল, তোমার বন্ধু কখনও আমাকে সুন্দর দেখে না। ও আমাকে দেখলই না ভাল করে, নিলও না। বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ও বড় কাজের মানুষ। আমরা হানিমুনে যাইনি, এমনকী সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কিছু নয়। এই সেদিন প্রথম সিনেমায় নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজে এল না, তোমাকে পাঠাল। চিড়িয়াখানাতেও তাই। ও কেন এ রকম বলো তো!

গম্ভীর থেকে বলি, মহৎ মানুষরা ও রকমই হয় বোধহয়। আমি সে তুলনায় কত সামান্য।

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল, না। তুমি সামান্য নও। যদি তাই হতে তো তোমাকে এত ভালবাসলাম কী করে? তোমার ভিতর একটা কী যেন আছে, ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু সুন্দর কী যেন আছে। তুমি নিজে বোঝো না?

অবাক হয়ে বলি, না তো!

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল, আছে।

ফের একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, কিন্তু আমি অত কাজের মানুষ, মহৎ মানুষকে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম কেন বলো তো! শুনি, ওর নাকি পৃথিবীজোড়া নাম। শুনে ভয় পাই। আমার তো অত বড় মানুষের বউ হওয়ার যোগ্যতা ছিল না! আমি আরও অনেক বেশি সাধারণ কারও বউ হলে কত ভাল হত বলো তো!

কথায় কথায় বেলা যায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকে। আজ বৃষ্টি বাদলা গেছে। লেক তাই বেশ নির্জন। আর এই ঘনায়মান অন্ধকার ও নির্জনতায় আমি ঠিকই টের পাই, আমাদের চারধারে ছায়া ছায়া কিছু মানুষ ঘোরাফেরা করছে। নজর রাখছে আমাদের দিকে। কারও হাতে কি ফ্ল্যাশগান লাগানো ক্যামেরা আছে? কথা ছিল, থাকবে।

ঝিরঝির একটু বৃষ্টি হেঁটে গেল চারপাশে। গাছের পাতায় পাতায় সঞ্চিত জলের বড় বড় ফোঁটা নামল। গ্রাহ্য করলাম না। ঘাস ছেড়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চে উঠে বসেছি দু’জনে, বর্ষাতিটা দু’জনের গায়ের ওপর বিছানো। বর্ষাতির নীচে আমাদের শরীর ভেপে উঠছে, ঘামছে।

ক্ষণা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওর তো দিল্লি থেকে ফেরার সময় হল।

আমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, কী করবে ক্ষণা?

কী আর করব? যত যাই হোক, ওর ঘরই তো আমাকে করতে হবে!

 শিউরে উঠে বলি, তা কেন ক্ষণা? আমি তোমাকে নিয়ে যাব এখান থেকে।

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলে, তা কি হয়?

কেন হবে না?

আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে যে!

তাতে কী! নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করবে? সুবিনয়ও দেখো একদিন বিদেশে বড় চাকরি পেয়ে চলে যাবে। আর আসবে না, খোঁজও করবে না। সেদিনের জন্য তৈরি থাকা ভাল ক্ষণা।

ক্ষণা আমার হাত ধরেই ছিল। সেই ধরা হাতটা একটু শক্ত হয়ে উঠল শুধু। ও বলল, তুমি কিছু শুনছ নাকি?

শুনেছি।

ক্ষণা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমারও কখনও কখনও ও রকম মনে হয়। মনে হয়, ও যেন বিদেশের মানুষ। মনে হয়, ও একদিন খুব দূরে সরে যাবে।

সময় থাকতে তুমি কেন সাবধান হচ্ছ না ক্ষণা? আমি— আমি তোমাকে ভালবাসি।

বলতে বলতেও আমার উৎকর্ণে কোনও একটা অস্পষ্ট কাশির শব্দ পৌঁছয়। সংকেত। আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমার অভ্যন্তরে ক্ষণার জন্য একটুকু ভালবাসা নেই। তৈরি হয়নি। তবু কাজটা আমাকে করতেই হবে।

বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ ক্ষণা। আমি ভাল এক্সপোজারের জন্য বর্ষাতিটা গা থেকে ফেলে দিই। তারপর গাছের ছায়ায় গভীর অন্ধকার নির্জনে ওকে জড়িয়ে ধরি। বাধা দেওয়ার কথা নয়। দিলও না ক্ষণা। আমার বিবেক এই অবস্থায় সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আড়াল থেকে তার ঘন ঘন কাশির আওয়াজ শুনতে পাই। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য সে কয়েক বার তার বাদ্যযন্ত্রটা বাজাল। আমি পাত্তা দিলাম না। আমি ক্ষণাকে যথেষ্ট, যত দূর সম্ভব আবেগে চুমু খাই। কষ্টকর, ভয়ের চুমু। আমি তো জানি আমরা একা নই। জানি, ক্ষণার স্বামীও দৃশ্যটা দেখছে। বড় বিস্বাদ চুমু। তবু ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে অপেক্ষা করছি ফ্ল্যাশগানের ঝলকটার জন্য। অপেক্ষা করছি। অনন্ত সময় বয়ে যাচ্ছে।

চমকাল। ফ্ল্যাশের আলো নীল বিদ্যুতের মতো ঝলসে দিয়ে গেল আমাদের। পর পর দুবার।

 ক্ষণা চমকে চোখ চেয়ে বলে, কী গো?

 বিদ্যুৎ।

ও।

 আবার সংলগ্ন হই। দক্ষ লোকদের হাতে ক্যামেরা আরও একটু পর পর চমকে চমকে উঠল।

তটস্থ ক্ষণা সোজা হয়ে বসে বলে, কে টর্চ ফেলছে?

টর্চ নয় ক্ষণা। আকাশে মেঘ চমকাল।

ক্ষণা আমার দিকে চেয়ে অন্ধকারে একটু চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ বলে, শোনো, মনে হচ্ছে কারা যেন লুকিয়ে থেকে দেখছে আমাদের।

আমার টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট শেষ হয়ে আসছে। আমি হঠাৎ ওকে কাছে টেনে বলি, কেউ নয়। লেক হচ্ছে মুক্ত অঞ্চল, সবাই প্রেম করতে আসে। কে কাকে দেখবে? শোনো ক্ষণা, তুমি সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?

ক্ষণা নিজের চুল ঠিক করছিল। একটু চনমনে হয়ে চার দিকে তাকাচ্ছে। বিপদ। আমি ওকে টেনে নিই কাছে। ও বাধা দেয় না। বরং চোখ বুজে থাকে। অস্ফুট গলায় বলে, আমাকে বহুকাল কেউ আদর করে না উপল। একটু আদরের জন্য আমার ভিতরটা মরুভূমি হয়ে থাকে।

আমার রেকর্ডারের ফিতে ফুরিয়ে আসছে। সময় নেই।

বলি, বলো ক্ষণা, সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?

 তেমনি অস্ফুট গলায় ও বলে, তুমি কি আমাকে একেবারে চাও?

চাই।

 ভালবাসবে আমাকে চিরকাল?

 বাসব ক্ষণা। বললা, ডিভোর্স করবে?

ও যদি বাধা দেয়! যদি মারে তোমাকে?

মারবে না ক্ষণা। ও আমাকে ভয় পায়। বাধা ও দেবে না।

ঠিক জানো?

হ্যাঁ।

আমার ছেলেমেয়ে কার কাছে থাকবে?

আমাদের কাছে।

তা হলে করব ডিভোর্স।

কথা দিলে?

দিলাম।

আদরের ছলে আমি ওকে ফের চুমু খেতে খেতে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসি। অন্য হাতে ওর চোখ চেপে রেখে বলি, দেখো না। আমাকে দেখো না।

সামনে থেকে, পিছন থেকে, পাশ থেকে আরও তিন বার ক্যামেরার আলো ঝলসায়। অন্ধকারে ছায়া-ছায়া মূর্তি ঝোপের আড়ালে সরে যায়। আবার অন্য দুটো ছায়া দৌড়ে এক ধার থেকে অন্য ধারে সরে গেল। ফ্ল্যাশ চমকাল ফের। ক্ষণার শরীরের ঠিক কোথায় আমার হাত রয়েছে তার নির্ভুল ছবি তুলে নিল।

ক্ষণা বলল, চোখ ছাড়ো। কী করছ?

 আমার সর্বাঙ্গে ঘাম। বুকের ভিতরে অসম্ভব দাপাদাপি। হাত-পা অবসাদে খিল ধরে আসে। বর্ষাতির পকেটে টেপ-রেকর্ডার থেমে গেছে। ক্যাসেট শেষ।

আমি দাঁড়িয়ে বললাম, চলো ক্ষণা।

 বোসো আর-একটু। আমার তো সিনেমার শো ভাঙার পরে ফিরলেও চলবে। কী সুন্দর দিন ছিল আজ, ফুরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।

লজ্জা, ভয়, ক্লান্তি ও অনিচ্ছায় আমার মাথাটা বেভুল লাগে। আর বসে থাকার মানে হয় না। ক্লান্তির বোঝা বাড়বে কেবল।

তবু অনিচ্ছায় বসে থাকতে হয়।

ক্ষণা বলল, তুমি আমাকে খুব ভালবাসো। আমাকে, দোলনাকে, ঘুপটুকে। ওরা তো অবোধ।

আমার ভিতরকার অনিচ্ছার ভাবটা ঠেলে আসে গলায়। বমির মতো। আমি যতটুকু করার করেছি। টেপ শেষ হয়ে গেছে। ক্যামেরা নিয়ে সরে গেছে লোকজন। এখন আর প্রেমের কথা আসে না। ফাঁকা লাগে, নিরর্থক লাগে।

.

রাত্রে সুবিনয় টেপ শুনছিল। তেমনি আধখানা ছায়া, আধখানা আলোয় পাথুরে মুখ দেখা যাচ্ছে। তবে ওর মুখে আজকাল অনেকগুলি নতুন গভীর রেখা পড়েছে। টেপ শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ঘাড় এলিয়ে দিচ্ছে। আবার সোজা হয়ে বসছে কখনও। অস্থির। সিগারেট খানিক খেয়েই প্রায় আস্ত গুজে দিচ্ছে আশট্রেতে।

আস্তে আস্তে ঘুরে টেপ শেষ হয়। সুবিনয় নিঃশব্দে উঠে ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে নীট হুইস্কি ঢক ঢক করে জলের মতো তিন-চার ঢোক খেয়ে একটা হেঁচকি তুলল।

খুব আস্তে মড়ার মতো একখানা মুখ ফেরাল আমার দিকে। দু’চোখে একটা অনিশ্চয়তার ভাব। যেন বা ভয়।

খুব আস্তে করে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি? ইউ আর এ বর্ন লেডি-কিলার। এ ডেমন! এ ড্রাগন!

চুপ করে থাকি। সুবিনয়ের দিক থেকে একটা মস্ত মোটা আর ভারী নোটের বান্ডিল উড়ে এসে কোলে পড়ল।

ফাইভ থাউজ্যান্ড। ইউ হ্যাভ আর্নড ইট।

এ কথা যখন বলছিল সুবিনয় তখন ওর গলায় কোনও আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভয় পাওয়া মানুষের মতো গলা।

মাথা নিচু করে টাকাটার দিকে চেয়ে থাকি। অনেক টাকা। দারিদ্র্যের মুক্তিপণ।

সুবিনয় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে ছিল। আমার দিকে চাইছে না। সেইভাবেই থেকে বলল, আই ডোন্ট বিলিভ ইট। ইয়েট দি ইম্পসিবল হ্যাজ হ্যাপেনড বাডি।

আমি টাকা থেকে মুখ তুললাম।

সুবিনয় এসে সোফায় তার প্রিয় চিতপাত ভঙ্গিতে বসল। নিজের সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বলল, আমার ধারণা ছিল, ক্ষণা আমার সঙ্গে পুলটিশের মতো সেঁটে গেছে। কখনও ওকে সরানো যাবে না। অ্যাডামেন্ট ওয়াইফ।

হুইস্কির আধ গেলাস টেনে নিয়ে তীব্র অ্যালকোহলের যন্ত্রণায় গলা চেপে বুম হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আলোছায়াময় মুখ তুলে অদ্ভুত হেসে বলল, ইউ হ্যাভ ডান ইট বাডি। কংগ্রাচুলেশনস।

আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। যখন দরজার কাছ বরাবর পৌঁছে গেছি তখন ও ডেকে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি, ইউ আর ইন লাভ উইথ হার। গোয়িং টু ম্যারি হার বাডি, হোয়েন আ’ল বি অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার?

আমি চুপ করে রইলাম। তারপর মাথা নাড়ালাম। না।

 লাভ হার বাডি। প্লিজ।

আমি ওর দিকে তাকালাম। স্পষ্ট টের পাই, আমার চোখ বাঘের মতো জ্বলছে। সমস্ত গায়ে শিরশির করে উঠছে রাগ। কিন্তু মাতাল সুবিনয় আমাকে লক্ষই করল না। বলল, আই অ্যাম গোয়িং হোম টুনাইট। ওয়েট বাডি, আই ক্যান টেক ইউ হোম।

.

রাতে আমি ফের বারান্দায় শুয়েছি। প্যাকিং বাক্সগুলি একটু নড়বড় করে বিছানাটা বড্ড শক্ত আর স্যাঁতস্যাঁতে ঠেকে। এ সবই ক’দিন সুবিনয়ের পুরু গভীর বিছানায় শোওয়ার অভ্যাসের ফল। শুয়ে জেগে থাকি। সুবিনয়ের ঘর থেকে কোনও শব্দ আসে না। ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

কাত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। ক্ষয়া একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। বড় ভাল লাগে। চেয়ে থাকি। ভিতরটা বিস্বাদে ভরে আছে। চাঁদ বড় ভাল লাগে। চাঁদ কোনও কাজে লাগে না, ব্যবহার হয় না। শুধু অকারণে আকাশে ঝুলে থাকে। চাঁদ তাই বড় ভাল।

বুড়ো বিবেক আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, পাপ হল লঙ্কার মতো। যেমন ঝাল তেমনি স্বাদ। না উপল?

হ্যাঁ বিবেকবাবা।

কাঁদছ নাকি?

না বিবেকবাবা। চেষ্টা করে দেখেছি, আজকাল কান্না আসে না।

বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, কাঁদলে ভাল লাগত।

জানি। কিন্তু সব সময়ে কি আসে?

 বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, পেটে অম্বল জমলে যেমন বমি করলে আরাম হয়, কান্নাও তেমনি। তোমার কোনও দুঃখের কথা মনে পড়ে না? কিছু একটা মনে করে দেখো। কান্না এসে যাবেখন।

আসে না। আমি মাথা নেড়ে বলি, অনেক দিন বাদে এই প্রথম একটা কাজ আমি শেষ করেছি বিবেকবাবা। মেলা ঝামেলা কোরো না। তুমি যাও।

বিবেক চলে যায়।

সে যেতে না যেতেই ছুঁচোর চিড়িক ডাক আসে অন্ধকার বারান্দার কোথা থেকে যেন। চমকে উঠে বসি। বহুকাল কি ছুঁচোটা আসেনি? না কি আমিই লক্ষ করিনি ওকে, নিজের অন্যমনস্কতায় ড়ুবেছিলাম বলে ওর ডাক কানে আসেনি?

চকিতে মনে পড়ল, বিষ আনতে বার বার ভুল হয় বলে ক্ষণা আজ নিজেই কিনে এনেছে। শোওয়ার আগে আটার গুলিতে বিষ মাখিয়ে বারান্দায় আর বাথরুমে ছড়াচ্ছিল। আর তখন একবার আমার খুব কাছে এসে চাপা স্বরে বলেছিল, ও এসেছে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কী করে যে আর একটা রাতও থাকব! পারছি না, একদম পারছি না। তুমি আমার কী করলে বলো তো! আমি কি নষ্ট হয়ে গেলাম? এ কি ভাল হল?

আমি উঠে বাতি জ্বালি। মুখ ধোওয়ার বেসিনের নীচে এঁটো বাসনের ওপর ছুঁচোটা তুরতুর করছে। আমাকে দেখে মুখ তুলল। দুটো চোখ আলোয় আলোময়। ওর অল্প দূরেই সেই বিষ মাখানো আটার গুলি। আমি নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিই।

লোভে আমার পায়ের কাছে ছুটে আসে ছুঁচোটা। করুণ মুখ তুলে যেন বলে, দাও। বড় খিদে।

আমি তাকে পাত্তা দিই না। তড়িৎগতিতে আমি বারান্দা আর বাথরুম থেকে আটার গুলি তুলে নিতে থাকি। ছুঁচোটা আমাকে আর ভয় পায় না। পায়ে পায়ে ঘোরে আর ডাকে। চিড়িক স্বরে যেন বলে, দাও। আমার বড় খিদে। আমাদের দর্শন-বিজ্ঞান নেই, সুখ-দুঃখ নেই, প্রেম-ভালবাসা নেই। আছে শুধু খিদে দাও।

আমি হাঁটু গেড়ে তার মুখোমুখি বসে বলি, আমিও কি নই তোমাদের মতো? সব কিছু খেতে নেই। আমারও চারধারে কত বিষ মাখানো খাবার ছড়িয়ে রেখেছে কে যেন। মাঝে মাঝে খেয়ে ফেলি। বড় জ্বালা।