১২. জ্ঞানদানন্দিনীর বিলেতবাস
ব্রাইটনে প্রথম খ্রিসমাসের সন্ধ্যাটা বেশ আনন্দে কাটল জ্ঞানদার। অনেকদিন বাড়িছাড়া। কাছের লোকেরা কেউ নেই। তবুদীর্ঘ রোগভোগ ও সন্তানশোকের কালো দিনগুলো পেরিয়ে অনেকদিন পর ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হাসলেন জ্ঞানদা। যাঁর চিকিৎসায় সেরে উঠলেন সেই ডক্টর জোসেফ লিস্টারকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই নিজের ভাড়াবাড়িতে ছোট্ট পার্টি ডেকেছেন তিনি। অতিথিদের মধ্যে আর আছেন পাশের বাড়ির মিসেস ডনকিনস, বিলেতবাসী জ্ঞানেন্দ্র ঠাকুর ও তার মেয়েরা। বিলেতের প্রবাস জীবনে এঁরা কয়েকজনই তার কাছের মানুষ।
সমুদ্রতীরে নিরালা একটি জায়গায় সার সার কতগুলো বাড়ির নাম মেদিনা ভিলা, তারই একটিতে বাচ্চাদের নিয়ে সংসার পেতেছেন জ্ঞানদানন্দিনী। ভিলা অবশ্য নামেই, ছোট ছোট বাড়ি, সামনের বাগানে দু-চারটি গাছগাছালি। দেশের তুলনায় ঘরগুলো ছোট ছোট, ছাদ নিচু, চারদিকে জানলা বন্ধ করে রাখা শীতের ভয়ে। একটু বাতাস আসার ফাঁক নেই, শুধু জানলাগুলো কাঁচের বলে আলো আসতে বাধা নেই। নিজস্ব গৃহিণীপনায় ছোট ছোট ঘরগুলোকেই চমৎকার বিলিতি কায়দায় সাজিয়ে নিয়েছেন জ্ঞানদা।
তবে এ-সব সাজানো-গোছানো তত বাইরের ঠাট বজায় রাখার জন্য। মন ভাল রাখতেও এ-সব নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন জ্ঞানদা। কিন্তু আসলে তিনি মোটেই ভাল নেই। তিনটি শিশুকে নিয়ে বিদেশ বিভুইয়ে একা বসবাস করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। উপরন্তু তিনি এখন অন্তঃসত্ত্বা। জ্ঞানদার মাঝে মাঝে রাগ হয় সত্যেনের ওপর, এরকমভাবে কেউ নির্বাসনে পাঠায়? মাঝে মাঝে তার কান্না পায়, কেন যে সত্যেনের কথা শুনে এখানে চলে এলেন! সত্যেন ভাবুক মানুষ, সংসার সম্বন্ধে তার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। বউ যে। এখানে অথই জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে বোধটাও তার নেই।
ভরসা বলতে রামা চাকর আর দু-একজন প্রতিবেশিনী মেমসাহেব। ব্রাইটনে আসার আগে আরও দু-চারবার বাড়ি বদল করতে হয়েছে তাকে। জাহাজ থেকে নেমে প্রথমে উঠেছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ত্যাজ্যছেলে জ্ঞানেন্দ্রর বাড়িতে। জ্ঞানেন্দ্র খ্রিস্টান হয়ে রেভারেন্ড কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়েকে বিয়ে করে বাপের বিরাগভাজন হয়েছেন। সেই থেকে বিলেতেই বাসা বেঁধেছেন সপরিবারে। জাহাজ থেকে বাচ্চাকাচ্চাসহ জ্ঞানদাকে একা নামতে দেখে তিনিও চমকে উঠে ভেবেছিলেন, এটা সত্যেন কী করল!
জ্ঞানেন্দ্র কিছুদিন পর অন্য বাড়ি ভাড়া করে জ্ঞানদার থাকার ব্যবস্থা করলেন। জ্ঞানেন্দ্রর দুই তরুণী মেয়ে সতু আর বালা মাঝে মাঝেই জ্ঞানদার কাছে চলে আসেন, ওঁকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোন। জ্ঞানদাও ওঁদের আসার পথ চেয়ে বসে থাকেন।
বিলেতের ভাড়া বাড়িতে বাড়িওলির সঙ্গে খাবার জোগানের চুক্তি থাকে বলে জ্ঞানদাকে রান্নাবান্নার ঝামেলায় যেতে হয়নি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা অসুখ-বিসুখ সামলাতেই এসে অবধি নাজেহাল হয়ে পড়ছেন তিনি। তার ওপর কিছুদিনের মধ্যেই তীব্র শীত এসে পড়ল।
জানলা দিয়ে প্রথম বরফ পড়া দেখে জ্ঞানদা দারুণ উত্তেজিত। সব লোকজন রাস্তায় নেমে পড়ে বরফ গায়ে মাখছে। আনন্দে তিনিও ছুটে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন, গায়ে তখন শুধু একটা পাতলা সিল্কের শাড়ি। বাড়িওলি বারণ করলেও না শুনে তিনি আনন্দে বরফ কুড়োতে লাগলেন। তারপর রাত থেকে ধুম জ্বর, গা ব্যথা। ক্রমশ জ্বর বাড়তে লাগল আর হাত ফুলে লাল হয়ে গেল। রামা চাকর ডাক্তার ডেকে আনলেও খুব একটা উন্নতি হল না। হাতে ঘা হয়ে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে লাগলেন জ্ঞানদা।
বাচ্চাদের কান্না শুনে একদিন পাশের বাড়ির মিস ডনকিনস দেখতে এলেন। জ্ঞানদার বিপন্ন দশা দেখে অবাক ডনকিনস জিজ্ঞেস করেন, তুমি একা একা বাচ্চাদের নিয়ে এদেশে এলে কেন?
জ্ঞানদা কাতরস্বরে বলেন, আমার স্বামী আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বিলিতি আদবকায়দা শেখার জন্য। বাচ্চাদের এখানকার স্কুলে পড়াতে চাই আমরা।
তাই বলে এভাবে একা একা অচেনা দেশে বাস করা যায়? তুমি তো ভাল করে ইংলিশ বলতেও পারছ না! গরমজামা না পরে কীভাবে বরফের মধ্যে নেমে গেলে? পুয়োর লেডি!
ডনকিনসের মায়া হয় এই ভারতীয় মহিলার জন্য। যে নিজেকে বাঁচাতে জানে না, সে বাচ্চাদের বাঁচাবে কী করে? তিনি হাল ধরতে এগিয়ে না এলে সে-যাত্ৰা জ্ঞানদা বাঁচতেন কি না সন্দেহ। ড. জোসেফ লিস্টার নামে এক মেধাবী চিকিৎসককে ডেকে আনলেন ডনকিনস, যিনি তখন অ্যান্টিসেপটিক আবিষ্কারের জন্য বিলেতে খুব সমাদৃত।
লিস্টার এসে জ্ঞানদার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। ফ্রস্টবাইট থেকে ঘা হয়ে সেপটিকের দিকে যাচ্ছে। প্রবল জ্বর, রোগিণী প্রলাপ বকছে। ঘটনাচক্রে লিস্টার ইতিমধ্যে ফেনল অর্থাৎ কার্বলিক অ্যাসিডের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন বিশল্যকরণী অ্যান্টিসেপটিক। জ্ঞানদাকে পেয়ে নিজের ওষুধগুলি পরীক্ষানিরীক্ষার আরও একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি মন দিয়ে জ্ঞানদার শরীরের ঘা খুঁটিয়ে দেখেন।
পরপুরুষের প্রথম স্পর্শে জ্ঞানদা কিন্তু ঘোরের মধ্যেও শিউরে ওঠেন। হলই বা ডাক্তার, পুরুষ তো বটে। সুদর্শন মাঝবয়সি এই ডাক্তারকে জ্ঞানদার বেশ পছন্দও হয়। ঠাকুরবাড়িতে নেহাত বিপর্যয় না হলে মেয়ে-বউদের জন্য সাহেব ডাক্তার ডাকা হয় না, জ্ঞানদার সেই অভিজ্ঞতা নেই। তবে লিস্টারের চিকিৎসায় কাজ হল, অল্প অল্প করে সেরে উঠতে লাগলেন জ্ঞানদা। এরকম গভীর অসুখের সময় সত্যেন পাশে নেই, আপনজন কেউ নেই। একটা চিঠি লিখলে একমাস পরে পৌঁছয়। জ্ঞানদার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।
লিস্টার জানতে চান, ব্রেভ লেডি, তুমি কাঁদছ কেন? তুমি যেরকম একা একা এখানে এসে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার করছ, আমি কোনও ইংরেজ মহিলার মধ্যেও এমন দুঃসাহস দেখিনি। তুমি সেরে উঠবে।
জ্ঞানদার মনে হয় লিস্টার যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবদূত। যা কখনও ভাবেননি এমন কাণ্ড করে বসেন তিনি, লিস্টারের হাত চেপে ধরে বলেন, সেভ মি, ইউ আর মাই এঞ্জেল!
ওহ নো! লিস্টার হেসে বলেন, আই অ্যাম আ ডক্টর। ইউ থ্যাঙ্ক মিসেস ডনকিনস ফর ব্রিঙ্গিং মি হিয়ার।
জ্ঞানদা মিসেস ডনকিনসের দিকে তাকিয়ে বলেন, উনি থাকলে তো আমি বিদেশ বিভুঁইয়ে কবে মরে যেতাম।
ডনকিনস জ্ঞানদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, নো গানাদা, তুমি কখনও মৃত্যুর কথা বলবে না। ব্রাইটনে এসে একজন ইন্ডিয়ান লেডি বিনা চিকিৎসায় মরে গেলে আমাদের লজ্জায় মুখ ঢাকতে হবে। আমরা ইংরেজ মেয়েরা পরস্পরকে সাহায্য করেই বেঁচে থাকি। ইউ আর লাকি যে ডক্টর লিস্টার এসে গেছেন।
জ্ঞানদা বিড়বিড় করে বলেন, এঞ্জেল! এঞ্জেল! প্লিজ সেভ মি।
লিস্টার বললেন, মিসেস টেগোর, তোমার ফ্রস্টবাইট ইনফেকটেড হয়ে গেছে, তাই অন্য ডক্টর সারাতে পারেননি। আর আমি এতদিন ধরে গবেষণা করছি কী করে উড ডিস-ইনফেকটেড করা যায় তাই নিয়েই। ফলে আমি যে ওষুধ দেব, অন্য ডক্টর তা দিতে পারতেন না। ইউ আর রিয়েলি লাকি।
ডনকিনস বলেন, ডক্টর, তুমি যে ওর ওপর এক্সপেরিমেন্ট করছ নিজের ইচ্ছেমতো, এইসব ড্রাগ তো এখনও অ্যাপ্রুভড নয়, কোনও ইংরেজ মহিলার ওপর এই এক্সপেরিমেন্ট করার পারমিশন সহজে পাবে না। এতে কোনও রিস্ক নেই তো!
লিস্টার চটে যান, তোমাদের যদি আমার ওপর ট্রাস্ট না থাকে, আমি চলে যাচ্ছি। তোমার কোনও ধারণা নেই আমি রোজ এই পদ্ধতিতে কত রোগীর চিকিৎসা করি। অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আমার আবিষ্কার অ্যাপ্রুভড তো বটেই, অলরেডি মাচ ডিসকাসড। উন্ড-ড্রেসিংয়ে কার্বলিক অ্যাসিড ব্যবহার করে আমি অ্যামপুটেশন পেশেন্টদের ডেথরেট কত কমিয়ে দিয়েছি তুমি জানো? জানো আমার নামে এ বছরের যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার লিস্টারিন। মাউথওয়াশের নাম রাখা হয়েছে? আমার নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার নাম রাখা হয়েছে লিস্টারিয়া? তোমার ট্রাস্ট না থাকে, রুটিন ড্রাগ লিখে দিচ্ছি, দেখো মিসেস টেগোরকে বাঁচাতে পারো কি না। কিন্তু ইউ হ্যাভ নো রাইট টু ইনসাল্ট মি। আমি চললাম।
লিস্টারকে রাগ করতে দেখে জ্ঞানদা ভয় পেয়ে যান, দুর্বল শরীরে উঠে বসে লিস্টারের হাত আঁকড়ে ধরেন, ডোন্ট লিভ মি এঞ্জেল! তুমি চলে গেলে আমি আর বাঁচব না। দেখো এই দুর্বল বিদেশিনিকে ফেলে তুমি চলে যাবে? তুমি যে ওষুধ দেবে, তাই খাব। যা বলবে করব। প্লিজ ডোন্ট ডেসার্ট মি।
ডনকিনসও তাড়াতাড়ি বলেন, আমি তা বলিনি ডক্টর, প্লিজ ডোন্ট মিসানডারস্ট্যান্ড মি। আমি ভয় পাচ্ছি গানাডার কিছু হলে ওর বাড়ির লোকেরা আমাকে দুষবে। বাট আই ট্রাস্ট ইউ সেজন্যেই তো ডেকে এনেছি।
লিস্টার কিছুটা নরম হন। এদিকে তার ইন্ডিয়ান পেশেন্ট বিছানায় শুয়ে পড়েছেন আবার, হঠাৎ উত্তেজনার ধকল সামলাতে চেষ্টা করছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, ডোন্ট লিভ মি, প্লিজ ডোন্ট লিভ মি এঞ্জেল।
বিছানায় মিশে থাকা শীর্ণ বিদেশিনির ইথারিয়াল সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে লিস্টারের মায়া হয়, যেন কোন অচিনপুরের রাজকন্যা রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলার জন্য ডাক পাঠাচ্ছে তাকে। লিস্টার আলতো করে জ্ঞানদার গালে টোকা দিয়ে বলেন, মাই ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস, আমি তোমাকে সারিয়ে না তুলে কোথাও যাব না। রোজ সকালে এসে তোমাকে দেখে যাব আমি।
লিস্টারের আঙুলগুলি নিজের গালে চেপে ধরে পরম নিশ্চিন্তে চোখ বোজেন জ্ঞানদা, তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।
সত্যেনের কাছে জ্ঞানদার অসুখের খবর জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন জ্ঞানেন্দ্রর মেয়েরা। সত্যেনের এরকম হঠকারিতার ফল ভুগতে হচ্ছে বেচারি জ্ঞানদাকে, সকলেই এজন্য সত্যেনের ওপর বিরক্ত।
মিসেস ডনকিনসের এ ব্যাপারে প্রখর মতামত। তিনি বলেন, গানাডা, কিছু মনে কোরো না, পুরুষরা এমনিতেই দায়িত্বজ্ঞানহীন। আর তোমার স্বামীটি তো দেখছি ইরেসপন্সিবলের চূড়ামণি।
জ্ঞানদার স্বামীর ওপর প্রবল অভিমান, তবু মিসেস ডনকিনসের মুখে পতিনিন্দা তার ভাল লাগে না। তাড়াতাড়ি বলেন, না না মিসেস ডনকিনস, তিনি খুব কেয়ারিং। আমাকে স্বাবলম্বী করার জন্যই একা একা পাঠিয়ে দিয়েছেন, এজন্য আমাদের কত বিরোধিতা সহ্য করতে হয়েছে জানো!
তা হোক, ডনকিনস বলেন, তুমি জানো না গানাডা, পুরুষেরা বউকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নেয়, মানুষ বলে মনে করে না। তুমি জানো, আমাদের ফেমিনিস্ট মেয়েরা ১৮৪০ সাল থেকে ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করছে, এখনও পর্যন্ত আমরা সেই দাবি আদায় করতে পারিনি। দেশটা কি শুধু ছেলেরা চালায়? আমরা মুখের কাছে খাবার জোগান না দিলে, সাজিয়ে গুছিয়ে অফিসে না পাঠালে, হোম ম্যানেজমেন্ট না করলে ওরা সব অচল হয়ে যাবে। তবু ওরা আমাদের নাগরিক অধিকার দেবে না?
জ্ঞানদা বলেন, আমাদের দেশে তো ছেলেরাও ভোট দেয় না, ইংরেজ শাসকদের বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ দেওয়া হয় না আমাদের। তোমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক তাই এ-সব ভাবতে পারছ।
তোমাকেও ভাবতে হবে গানাডা, ডনকিনস উত্তেজিত হন, অনেকরকম পলিটিক্স আছে, তার মধ্যে ওল্ডেস্ট পলিটিক্স হল নারী-পুরুষে। বছর দুয়েক আগে জন স্টুয়ার্ট মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন বইটা বেরিয়ে আমাদের দেশে তো হুলুস্থুলু পড়ে গেছে। মেয়েদের কথায় ওরা কান দেয়নি কিন্তু এখন মেয়েদের পক্ষ নিয়ে একজন পুরুষ এরকম ধারালো যুক্তি দেওয়ায় পুরুষেরা খুব বেকায়দায় পড়ে গেছে আর মেয়েরা উজ্জীবিত। আমি তোমাকে পড়তে দেব।
আমি পড়ে কী করব? জ্ঞানদা বলেন, আমার স্বামী সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও আমার মধ্যে স্ত্রীস্বাধীনতার প্রকাশ দেখতে চান, সেটা যে আমাদের সমাজে কত কঠিন কাজ তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমাদের মধ্যে নারী পুরুষে কোনও পলিটিক্স নেই।
ডনকিনস বিরক্ত হন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না গানাডা, এটা তোমার বা আমার একার স্বাধীনতার বিষয় না, একসঙ্গে সব মেয়েরা যেদিন রাষ্ট্রে ভোটাধিকার পাবে, পরিবারে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পাবে, পুরুষের সমকক্ষ হবে, সেদিন বলা যাবে স্ত্রীস্বাধীনতা এসেছে। তোমরা যখন স্ত্রীস্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করছ, মিলের লেখা তোমাকে অবশ্যই পড়তে হবে আর তোমার স্বামীকেও পড়াতে হবে।
পরদিন ডক্টর লিস্টার জ্ঞানদাকে দেখতে এসে খুশি হয়ে উঠলেন, বাঃ, আজ তোমাকে দেখে সত্যি প্রিন্সেস মনে হচ্ছে। তুমি তো প্রায় সেরেই গেছ।
জ্ঞানদাও লিস্টারের পথ চেয়ে বসে ছিলেন যেন, সত্যি বলছ ডক্টর? আমি সত্যি সেরে উঠব?
না না, আমাকে ডক্টর বলে ডাকলে তো সারবে না, লিস্টার মজা করে বলেন, কই আজ আমাকে এঞ্জেল বলে ডাকলে না তো!
ওষুধে কাজ হয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে ডক্টরের উপস্থিতির টনিক। জ্ঞানদা দ্রুত সেরে উঠতে থাকেন।
কিন্তু একদিন রাতে তার হঠাৎ ব্যথা উঠল। এখনও সময় হয়নি, তবু ব্যথায় ছটফট করতে করতে তার জল ভাঙল। রামা চাকর পাশের বাড়ি থেকে ডনকিনসকে ডেকে নিয়ে এল। ডনকিনস অত রাতে ডক্টর ডাকবেন কোত্থেকে, কোনওরকমে এক প্রতিবেশিনী মিডওয়াইফ দাইকে ডেকে আনলেন।
কিন্তু শেষপর্যন্ত জ্ঞানদার বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। অসুখের ফলে তার বাচ্চাটি ছিল রুগণ ও অপরিণত। জন্মের পর জ্ঞানদার কোলেই সে মারা গেল। সেদিন জ্ঞানদার হাপুস কান্নার সময়ে ডনকিনস ছাড়া পাশে কেউ ছিল না।
প্রবাদ আছে বিপদ কখনও একা আসে না। এর কিছুদিন পরেই রামা চাকরের সঙ্গে সমুদ্রতীরে রোদের মধ্যে ছুটোছুটি করে জ্বর বাধাল ছোটছেলে চোবি, চিকিৎসার বিশেষ সুযোগ পাওয়া গেল না, দুদিনের জ্বরে সে মারা গেল। একসঙ্গে দুই সন্তানের মৃত্যুশোকে পাথর হয়ে নির্জন ঘরে একা একা বসে রইলেন জ্ঞানদা।
যেদিন লিস্টার দেখা করতে এলেন, জ্ঞানদা তাঁর সামনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। মার কান্না দেখে ছোট বিবি ও সুরেন মাকে জড়িয়ে ধরে। লিস্টার বিবিকে কোলে নিয়ে বলেন, সুইটি পাই, হোয়াই ডোন্ট ইউ সিং আ সঙ! শুনি কী গান শিখেছ স্কুলে, তোমার মায়ের মন ভাল হয়ে যাবে।
সত্যিই বিবির রিনরিনে সুরেলা গলায় ঘরের বাতাসে খুশির ছোঁয়া লাগে। বিবির হাত ধরে নাচতে থাকেন লিস্টার।
তারপর নাচ থামিয়ে জ্ঞানদার পাশে বসে বলেন, ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস, ইটস এ পিটি যে তোমার বাচ্চাটিকে বাঁচানো গেল না। ইংলন্ডে কোন বাচ্চাদের জন্মের সময়ে মারা যাবার রেট বেশি জানো, শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবে, যারা হসপিটালে সার্জেনের হাতে জন্মায়। তুলনায় যারা মিড-ওয়াইফের হাতে হয় তাদের বেঁচে থাকার রেট বেশি।
সেকী, জ্ঞানদা সত্যি অবাক হন, মিড-ওয়াইফরা তো আধুনিক বিজ্ঞানের কিছুই জানে না? আমি তো ভাবছিলাম ডক্টর ডাকতে পারলে আমার বাচ্চাটা বেঁচে যেত, দাইয়ের হাতে বলেই মারা গেছে।
না প্রিন্সেস, জোসেফ বলেন, সার্জেনদের হাত ধোয়ার অভ্যেস নেই। অনেক সময়েই হসপিটালের একজন রোগীর ঘায়ে ওষুধ লাগিয়ে হাত না ধুয়েই আর একজনের বাচ্চা ডেলিভারি করতে চলে যায়। এ থেকেই ইনফেকশন। কিন্তু মিডওয়াইফদের বারবার হাত ধোয়ার বাতিক আছে, তাই ওদের হাতে মরে কম। তোমার ক্ষেত্রে দাইয়ের বোধহয় কোনও দোষ ছিল না, তোমার অসুখের ধকল বাচ্চাটা নিতে পারেনি। লেট আস প্রে ফর হিজ পিসফুল আফটার লাইফ।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর লিস্টার জ্ঞানদার দিকে একটা সুন্দর রঙিন গিফট প্যাক বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, প্রিন্সেস, তোমার জন্য আজ আমি ওয়াইন আর চকলেট এনেছি, লেট আস সেলিব্রেট ইয়োর গুড হেলথ। ওয়াইন পান স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।
একটি রক্তাক্ত হৃদয় সেইমুহূর্তে আর-একটি হৃদয়ের কাছে কিছুক্ষণের নীড় খুঁজে পেল। দুটি রক্তিম ওয়াইন গ্লাস আকাশে পরম্পরকে চুম্বন করল। সেদিনের সেই বেদনামধুর সন্ধ্যাটির রেশ খুঁজতেই যেন ডিসেম্বরে লিস্টারকে ঘিরে বড়দিনের পার্টি সাজালেন জ্ঞানদা।
.
আরও কয়েকমাস পরে দু-তিনবার জাহাজ বদল করে আলেকজান্দ্রিয়া, প্যারিস, লন্ডন হয়ে ব্রাইটন পৌঁছলেন রবি ও সত্যেন। সময় লাগল প্রায় দিন কুড়ি। মেদিনা ভিলায় পৌঁছে দীর্ঘদিন পরে প্রিয়মুখ দেখার আশায় কড়া নাড়লেন সত্যেন্দ্র, কিন্তু বাড়ির দরজা খুললেন ইংরেজ ল্যান্ডলেডি।
রবি ও সত্যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকতে অবশ্য বেশ মজা হল। জ্ঞানদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেজেগুজে অপেক্ষা করছিলেন। বিবি ও সুরেন ইতিমধ্যে স্কুলে যাচ্ছে, কলকাতার স্মৃতি কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। কয়েকদিন ধরেই তারা শুনছে পাপা আসছে, পাপা আসছে।
বিবির ধারণা ছিল তাদের পাপা তার স্কুলের বন্ধুদের পাপাদের মতোই হ্যাটকোট পরা সাহেব মানুষ। কিন্তু সত্যেনকে দেখে তার সেই ধারণায় ধাক্কা লাগল প্রথমেই। সত্যেন ফুটফুটে পরির মতো বিবিকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই সে ছুটে পালিয়ে গেল।
দরজার আড়ালে লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিবি বলল, দ্যাটস নট মাই। পাপা! হি ইজ নট হোয়াইট!
সত্যেন বুঝলেন বিলেতের সব শিক্ষাই ভাল নয়, এখানকার চাপা বর্ণভেদ শিশুর অবোধ মনের গভীরে ঢুকে পড়েছে। এই অন্ধকার তাড়ানোই হবে তার প্রথম কাজ। মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে অনেক সময় ব্যয় হল।
আমার বিলিতি বউও কি পালটে গেছে? কালো বরকে আদর করবে। তো? সত্যেন মজা করে জানতে চান জ্ঞানদার দিকে তাকিয়ে।
জ্ঞানদা তখন যত্ন করে ডিনার সাজাচ্ছেন। বিলেতে কায়দাকানুন কতটা শিখেছেন দেখিয়ে চমকে দিতে হবে না সত্যেনকে! কটাক্ষ করে তিনি স্বামীকে বললেন, খুব তো একা একা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন আবার ঠেস দেওয়া হচ্ছে! মরেই যেতাম, নেহাত ডক্টর লিস্টার মরতে দিলেন না, তাই। এখন কত সাহেব ইলোপ করার জন্য সাধাসাধি করছে তা জানো?
কে তোমাকে ইলোপ করতে চায় একটু শুনি, সত্যেন মজা পেয়ে জানতে চান, সেই তোমার ডক্টর লিস্টার নাকি!
আহা, তার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই! জ্ঞানদা ব্লাশ করেন। সত্যেন অবশ্য বউয়ের গালের সেই ঈষৎ লালিমা লক্ষ করেন না।
ধন্যি মেয়ে তুমি মেজোবউঠান, রবি চারদিকে তাকিয়ে বলেন, কোথায় লোকলশকরে ভরা কলকাতার বাড়ি আর কোথায় এই নিরালা ভিলায় একলা থাকা, তুমি বলেই পারলে। আমাকে এমন একা ছেড়ে দিলে কবে পালিয়ে যেতুম। এত কষ্ট কেন করলে বলো তো?
বা রে, ছেলেমেয়েদের বিলিতি কেতা শেখাতে হবে না? জ্ঞানদা বললেন, তা ছাড়া তোমার মেজদাদা আমাকে মেমসাহেবি কায়দাকানুন শেখাতে চেয়েছিলেন, ঘরের কোণের বাঙালি বউ তার পছন্দ নয়। এখানে এসে না থাকলে এতসব শিখব কী করে?
দেখি এখন কী শিখলে? জ্ঞানদার কাঁধে হাত রেখে সত্যেন বলেন, তোমাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়ে আমি যে এতদিন একা একা থাকলাম, সেই কষ্টটা উসুল করে নিতে হবে না এবার!
আমার ল্যান্ডলেডিটি বেশ ভাল, জ্ঞানদা জানান, তিনি আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছেন। এখানে বাড়িঘরে কোনও ধুলো থাকা চলবে না, সব ঝকঝকে করে সাজিয়ে রাখা চাই। কিন্তু আমাদের দেশের মতো জল ব্যবহার করা যায় না, গৃহিণীর পকেটে একটি বড় ন্যাপকিন থাকে, সেই সর্ব-পরিষ্কারক ন্যাতা দিয়ে টেবিল চেয়ার আসবাব থেকে খাবার প্লেট পর্যন্ত সবই পরিষ্কার হয়, তারপর আবার ময়লা সমেত সেটা ঢুকে যায় গৃহিণীর পকেটে। আমাকে উনি বলেছেন সবসময়ে কোটের পকেটে ন্যাপকিন খুঁজে রাখাই গৃহপরিচ্ছন্নতার মূল মন্ত্র। চলবে ফিরবে আর যেখানে ধুলো দেখবে ন্যাপকিনে মুছে ফেলবে।
রবি হা হা করে হেসে ওঠেন, মেজোবউঠান, তুমি কি সেই সর্বশোধক। ন্যাপকিনে পরিষ্কার করা প্লেটেই আমাদের বিলিতি ডিনার দিচ্ছ নাকি?
পাগল! জ্ঞানদা হেসে ওঠেন, আমি রামা চাকরকে দিয়ে আচ্ছা করে গরমজল দিয়ে সব বোয়ামোছা করাই। জল না দিলে আমার কিছুই পরিষ্কার হয় না।
তবে আর কী শিখলে বউঠান, জল না দিয়ে পরিষ্কার করাই তো এখানকার ম্যাজিক! রবি ঠাট্টা করেন, তুমি তো সেই বাঙালি বউ রয়ে গেলে।
সত্যেন বলেন, রবি জানিস তো, এখানে সর্দিকাশি হলে সাহেবরা ন্যাপকিনে নাক ঝাড়েন, ন্যাপকিনেই কফথুতু ফেলেন, আবার সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন পরেরবারের জন্য।
ছিঃ! রবির গা শিউরে ওঠে ঘেন্নায়। বলেন, আমাদের দেশের মতো এরা বাড়িতে পিকদান রাখলেই পারে, তাতে পকেট নোংরা হয় না।
জ্ঞানদা মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে বললেন, না না রবি, ওদের চোখে পিকদান খুব ন্যাস্টি দৃশ্য। অমন নোংরা জিনিস ওরা ঘরে রাখবে না, পকেটের ন্যাপকিন তো দৃশ্যমান নয়। এখানে চোখের পরিচ্ছন্নতা সবার আগে। এরা খেয়ে উঠে কুলকুচো করে না কারণ মুখ থেকে জল পড়া দেখতে খারাপ। সাহেবদের শোকবস্ত্রও সুদৃশ্য করে তৈরি।
ডিনার টেবিলে বসে খাওয়া শুরু করে রবি বলেন, দেখে শুনে যা বুঝছি মেজোবউঠান, এদের ঘরে শ্ৰী আছে কিন্তু পরিচ্ছন্নতা নেই। এরা সুশ্রী কিন্তু নোংরা। এই শেখার জন্য আমাদের প্রবাসে আসতে হল!
না রবি, সত্যেন প্রতিবাদ করেন, এদের অনেক ভাল স্বভাব আছে, সেই গুণগুলো আয়ত্ত করার জন্যই আমরা এখানে এসেছি। ওদের ভালর সঙ্গে আমাদের ভালটা মিশিয়ে নিতে পারলেই আমাদের পূর্ণাঙ্গ পরিশীলন হবে। জ্ঞানদার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, তবে তোমার বিলিতি ডিনারটা বেশ এনজয় করছি।
রবি ফোড়ন কাটেন, হ্যাঁ, বেশ আলুনি আর আঝালি। বউঠান, তুমি এ-সব আলুসেদ্ধর সুপ আর পাউরুটি রান্না করতে করতে আসল রান্নাগুলো যে ভুলে যেয়ো না।
রোস্ট, চিকেনটা আমি বেঁধেছি, বাকি সব ল্যান্ডলেডির কিচেন থেকে, জ্ঞানদা বললেন, শোনো রবিঠাকুরপো, তোমার ভয় নেই, আমি এ-সব বিশেষ রাঁধছি না। খাবার সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব বাড়িওলির। তার কল্যাণেই রোজ আমাদের প্রকৃত ইংলিশ ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার জুটবে।
ওরে বাবা, রবি আঁতকে ওঠেন, তা হলে তো আমাকে শিগগির পালাতে হবে বউঠান।
পালাব বললেই হল! সত্যেন ধমকে ওঠেন, চারদিকে ঘুরে দেখ রবি কত বঙ্গযুবক এই ইংরেজ বাড়িওলির সঙ্গ পেয়ে ধন্যবোধ করছে। কোট হ্যাট গাউন পরা জলজ্যান্ত বিবিসাহেবদের এত কাছে আসার সৌভাগ্যে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সে তো জাহাজেই নমুনা পেয়েছি মেজদাদা। রবি হেসে বলেন, জানো বউঠান, জাহাজে কয়েকটি ভারী মজার ইঙ্গবঙ্গ যুবক ছিল। তারা জাহাজের ইংরেজ চাকরদের হুকুম করার বদলে স্যার বলে ডাকেন। নামার সময়ে ইংরেজ গার্ড এসে সাহায্য করলে বঙ্গযুবারা আহ্লাদে গলে পড়েন। সাহেবগার্ডের একটি সেলামের বদলে এক শিলিং বখশিস দিয়ে ধন্য হন। আমার এক সহযাত্রীর কাছে শুনেছি ল্যান্ডলেডির সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা। কার্পেট পাতা, ছবি টাঙানো, ফুলভরা ফুলদানি সাজানো, পিয়ানো শোভিত ভাড়া ঘরে ঢুকেই তো প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন, এত দামি ঘরে থাকবেন কী করে? তিনি তখনও জানেন না যে বিলেতের সব ঘর এরকম, বরং কোনও মাদুরপাতা চৌকি দেওয়া ঘরই দুষ্প্রাপ্য। তার ওপর যখন ইংরেজ বাড়িওলি এসে বিনীত স্বরে গুড মর্নিং বললেন, তখন তো তার দিশাহারা অবস্থা।
জ্ঞানদা হেসে গড়িয়ে পড়েন, তারপর তার সেই বাড়িওলির সঙ্গে ভাব হল কি না? এখানে তো ল্যান্ডলেডির কেয়ারেই জীবন সঁপে দিতে হয়।
রবি হাসতে হাসতে জানান, ক্রমশ ল্যান্ডলেডির সঙ্গে তার এতই আলাপ জমে উঠল যে এখন তার মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট করা পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন তিনি।
সকলের সমবেত হাসির মধুর উত্তাপের মধ্য দিয়ে সেদিনের মতো ডিনার শেষ হল।
পরদিন থেকে ব্রাইটনের জীবন ঢিমে তালে গড়িয়ে চলল। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠা, তারপর স্নান। রবি রোজ ঠান্ডা জলে আপাদমাথা ভিজিয়ে স্নান করেন, এখানকার রীতি মতো শুধু গরমজলে গা মুছে নেওয়া তার পোষায় না। ল্যান্ডলেডি ব্রেকফাস্ট পাঠান নটায়। টোস্ট ওমলেট দুধ পরিজের ইংলিশ ব্রেকফাস্টের পর কিছুক্ষণ নিজের নিজের কাজ, পড়াশোনা, সুরেন বিবির সঙ্গে খেলাধুলার পর বেলা দেড়টায় লাঞ্চ। দিন শুরু বলতে গেলে নটার আগে হয় না, আবার চারটের মধ্যে আলো মরে আসে। রবির মনে হয়, এখানকার দিনগুলো যেন দশটা পাঁচটার অফিসবাবু। আর রাতগুলো ঘোড়ায় চেপে আসে আর পায়ে হেঁটে ফেরে, যেন ফেরার ইচ্ছেটাই কম। বিকেলে একবার কেক বিস্কিট সহযোগে চা পাওয়া যায় তারপর রাত আটটায় এলাহি ডিনার।
ব্রাইটনের সমুদ্রতীর তখন খুব উপভোগ্য। অক্টোবরে শীত তেমন পড়েনি, ব্রেকফাস্টের পর বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ প্রায়দিনই ওঁরা সি-বিচে চলে আসেন। ঝকঝকে রোদে সাহেবমেমরা মহানন্দে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রুগণ আর বৃদ্ধদের হুইলচেয়ারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির লোকেরা। মেয়েদের নানারকম সাজপোশাক দেখে রবির তাক লেগে যায়। কী সহজ স্বচ্ছন্দ এই সাগরপারের মেয়েগুলি! রবির মনে পড়ে যায় ঘরে ফেলে আসা প্রিয়মুখটি। আহা আমার নতুনবউঠান যদি এমন স্বাধীন আনন্দে সাগরপাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারতেন!
সুরেন আর বিবির ছুটোছুটির সঙ্গে জ্ঞানদা পেরে ওঠেন না, রামা চাকর যত তাদের পেছনে দৌড়য় তত তারা রবির গায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রবি ওদের নিয়ে ঝিনুক কুড়োতে শুরু করেন। রংবেরঙের ছাতার নীচে শুয়ে-বসে আছে স্বল্পবাস সুন্দরীরা, ইতালীয় ভিখারি তাদের সামনে অর্গান বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছে। রবি মজা পেয়ে বলেন, দেখো বউঠান, ওই ভিখারিরা কেবল মেয়েদের সামনেই ঘুরঘুর করছে কেন?
জ্ঞানদা বললেন, মনে হচ্ছে ওরা সৌন্দর্যের ভিখারি, টাকাপয়সা না হলেও চলবে। তবে ওদের আর কী দোষ, তুমিও তো ঘুরেফিরে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছ রবিঠাকুরপো!
বউঠান, তোমার কাজলটানা ভারতীয় নয়নেও যে সুইমস্যুট পরা গোরাসাহেবদের রূপ ধরা পড়ছে না এমন কথা তো বলতে পারছি না।
কী যে বলো, ছি! অমন রূপ দেখলে আমার চোখ জ্বালা করে। ঝাঁঝিয়ে ওঠেন জ্ঞানদা, ওইরকম উলঙ্গপনার চেয়ে পোশাকের সৌন্দর্য অনেক বেশি, এটা যে এরা কবে বুঝবে। ভারতীয় রুচি অনেক পরিশীলিত।
রবি হাসেন, তা হলে তো এখানে এসে তুমি আরও বেশি বেশি বাঙালিনি হয়ে যাচ্ছ, কোথায় তোমাকে বিলিতি কালচার শেখাতে আনা হল, আর তুমি দিনকে দিন আরও কট্টর ইংরেজবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছ! আমি তো কল্পনা করেছিলাম এখানে এসে কেতাদুরস্ত গাউন শোভিত হ্যাট পরিহিত মিসেস টেগোরকে মিট করব, আর সেই তুমি কিনা বাংলার বালুচরী পরে ব্রাইটনের সমুদ্রতীরে রোদ পোয়াচ্ছ?
মিষ্টি হেসে জ্ঞানদা বলেন, আমার এই ভাল, দেখছ না সবাই ঘুরে ঘুরে কেমন আমাকেই দেখছে! আমার গায়ে আমার দেশের পতাকা লাগানো আছে।
আজকাল মাঝে মধ্যেই ডিনার বা বল ডান্স বা ইভনিং পার্টির নেমন্তন্ন থাকছে। ইংরেজ সমাজে ওঁদের মেশামেশির পালা শুরু হল একটি সান্ধ্য নিমন্ত্রণে। এতদিন জ্ঞানদা একা ছিলেন, এখন তার স্বামী যোগ দেওয়ায় প্রতিবেশী ইংরেজদের আনাগোনা, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ শুরু হয়েছে।
ডক্টর মারলোর বাড়ির সান্ধ্যপার্টিতে অনেক নারী পুরুষ জড়ো হয়েছেন সেদিন। ঘরে ঢুকেই হোস্ট ও হোস্টেসকে অভিবাদন জানানোর পালা। তারপর বাকিদের সঙ্গে আলাপ। ঘরে জায়গা কম তাই সবার বসার চেয়ার নেই। মহিলারা কৌচে বসে গল্প শুরু করলেও পুরুষরা অধিকাংশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছেন। নতুনদের সঙ্গে আলাপ শুরু ওয়েদার টক দিয়ে।
এ-সব আসরে পোশাক আসাকের ফ্যাশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষদের সান্ধ্য পোশাকের শার্ট হতে হবে ধবধবে সাদা, তার ওপর বুক খোলা কালো ওয়েস্টকোটের ওপর থেকে সাদা শার্টের কলার উঁকি দেবে। গলায় সাদা নেকটাই। সবার ওপরে সামনে কোমর পর্যন্ত কাটা টেল কোট। রবি ও সত্যেন ইংরেজদের স্টাইলে টেল কোট পরে গেলেও জ্ঞানদা শাড়িই পরলেন। তার মেরুন বালুচরী ও পশমিনা শাল নিয়ে ইংরেজ মহিলারা উচ্ছ্বসিত হয়ে নানা প্রশ্ন শুরু করলেন। মিসেস মারলোর মতে সেলাই করা গাউনের চেয়ে জ্ঞানদার ভাঁজে ভাঁজে বিন্যস্ত শাড়ি আরও লালিত্যময়।
ডক্টর লিস্টারকে দূর থেকে এগিয়ে আসতে দেখে জ্ঞানদার মনে উত্তেজনার ছোঁয়া লাগে। লিস্টার তাকে নাচে আহ্বান করলে জ্ঞানদা সত্যেনের দিকে তাকান।
সত্যেন সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, যাও না জ্ঞানদা, ডক্টর লিস্টার তোমাকে পার্টনার হতে ডাকছেন, ইটস আ অনার!
জ্ঞানদা ও লিস্টারের নৃত্যরত জুটিকে বেশ মানিয়েছে। সত্যেনের মনে কি একটু খোঁচা লাগছে! তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন, মনে মনে কিছুতেই হারবেন না, দুনিয়ার পুরুষদের সঙ্গে মিশে দেখে নিক জ্ঞানদা, তার পরেও যদি পুরুষ হিসেবে জ্ঞেনুর চোখে তিনি আকর্ষণীয় থাকেন, তবেই তার পৌরুষের জিত।
কবে এলেন ব্রাইটনে? লিস্টারকে জিজ্ঞেস করেন জ্ঞানদা। জোসেফ লিস্টার স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় চিকিৎসা এবং অধ্যাপনা করেন, মাঝে মাঝে ব্রাইটনে আসেন, যেমন কিছুদিন ছিলেন জ্ঞানদার অসুখের সময়ে।
লিস্টার জ্ঞানদাকে বলেন, ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস, আমি অনেক রোগীর চিকিৎসা করি কিন্তু তোমাকে সারিয়ে তুলে যেরকম আনন্দ পেয়েছি, সেটা স্পেশাল।
আপনি ব্রাইটনে থেকে যাচ্ছেন না কেন? জ্ঞানদা আবদার করেন বালিকার মতো, তা হলে অসুখ করলেই আপনার দেখা পাওয়া যেত। আপনাকে দেখলেই আমার শরীর মন সব ভাল হয়ে যায়।
তা কি হয় প্রিন্সেস, তুমি যেমন একটা নির্দিষ্ট জীবনে বাঁধা, আমিও তেমনি, লিস্টার হেসে বলেন, ওখানেই আমার স্ত্রী অ্যাগনেস, ওখানে আমার কাজ, আমার রোগীরা। ওখানে কাজ করেই আমার সম্মান স্বীকৃতি সব। সে-সব ছেড়ে কি আসা যায়? তুমিই কি পারবে তোমার স্বামী ছেড়ে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও সেটল করতে? কেন করবেই বা!
আপনি স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন? জ্ঞানদা জানতে চান।
লিস্টার বলেন, অ্যাগনেস আমার সব কাজের সঙ্গিনী, আমার ঘরের গৃহিণী, আমার ল্যাবের অ্যাসিস্টান্ট।
উনিও কি আপনার মতো ডক্টর? জ্ঞানদা অবাক হন। বিলেতেও মহিলা ডক্টর খুব বেশি দেখা যায় না এখনও।
উনি মেডিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী, আমার গুরুকন্যা। লিস্টার জানান, অ্যাগনেস ভাল ফরাসি জানে, ওর অনুবাদ করা লুই পাস্তুরের থিয়োরি পড়েই জার্ম ইনফেকশনের ব্যাপারে আমার চোখ খুলে যায়।
বাঃ, জ্ঞানদা সত্যি খুশি হন, স্বামী স্ত্রীর এরকম জুটি তো আদর্শ। আমাদের দেশে এরকম যে কবে হবে তাই ভাবছি। আর কোনওদিন দেখা হবে কি না জানি না, তোমাদের কথা আমার সবসময়ে মনে থাকবে।
দেখা হোক বা না হোক, লিস্টার গাঢ়স্বরে বলেন, আমার প্রিন্সেস যেখানেই থাক, যেন সবসময়ে ভাল থাকে। কোনও দুঃখ যেন তোমার হাসি মুছে দিতে না পারে।
রবির সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে আসে এক সুন্দরী বিলেতবালা আর সবার চোখ ঘুরে আসে সেইদিকে। এখানে রূপের পূজা হয় সাড়ম্বরে, রূপসির চারপাশে স্তাবকেরা ঘুরঘুর করে একটু হুকুম তামিল করার জন্য। রূপ এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে না। মিস মিলি রবির সঙ্গে কথা বলছেন আর তখনই কত ইংরেজ যুবক তাকে নাচের সঙ্গী হতে ডাক দিচ্ছেন।
এরপর শুরু হল গানবাজনার আসর। গৃহকর্তা এক সুসজ্জিতা মেমসাহেবকে অনুরোধ করতেই তিনি পিয়ানো বাজাতে বসলেন আর পিয়ানোর রিডের ওঠানামার সঙ্গে তার দশ আঙুলের আংটি ঝিকমিকিয়ে উঠতে লাগল। যেন পিয়ানো বাজানোর জন্যেই তিনি আঙুলগুলি সাজিয়েছেন। কিছু পরেই রবির বিপদ ঘনিয়ে এল। তাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করে বসলেন বাড়ির গৃহিণী। রবি জানেন এরা ভারতীয় গানের কদর বোঝে না, এদের সামনে গান গাওয়ার কোনও মানে হয় না। তবু চারদিক থেকে অনুরোধ আসতে থাকায় তিনি এড়াতে পারলেন না।
কিন্তু রবি গাইতে শুরু করতেই ক্রমশ সমবেত ইংরেজ নারীপুরুষদের ঠোঁটের কোনায় হাসি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কোনও কোনও মহিলা হাসি চাপতে না পেরে নিচু হয়ে রুমাল কুড়ানোর ছলে হেসে নিলেন। কেউ আবার বান্ধবীর পিঠে মুখ লুকিয়ে হাসলেন। যাঁরা হাসি চাপতে সক্ষম হলেন তাদের চোখে চোখে যেন টেলিগ্রাফ চলতে লাগল। পিয়ানোবাদিকা মহিলার মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখে রবির গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল। এমনকী মিলির। মুখেও হাসি লেগে আছে দেখে রবি যেন মরমে মরে যাচ্ছিলেন। গান গেয়ে এমন অপদস্থ আর কখনও হননি৷ কোনওরকমে গান শেষ করে রবির মুখচোখ লাল হয়ে উঠল।
ঘরে মৃদু প্রশংসাধ্বনি উঠলেও অত হাসির পর রবি আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করলেন না। ঘরের আবহাওয়ায় তার অসুস্থ লাগছিল। মিলি এগিয়ে এসে গানের মানে জিজ্ঞেস করলে রবি প্রেমের কথা আর বোলো না অনুবাদ করে বোঝাতে চাইলেন। তাতে কেউ মন্তব্য করলেন তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি?
জ্ঞানদা রবির এরকম হেনস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তার হাত ধরে টেনে নৈশভোজের ঘরে নিয়ে গেলেন। এখানে সবাই একসঙ্গে খেতে যাচ্ছে না, তা হলে পার্টির রস বিঘ্নিত হয়। জোড়ায় জোড়ায় হাত ধরে কয়েকজন পালা করে খাবারঘরে যাচ্ছে।
জ্ঞানদা ফিসফিস করে রবিকে বললেন, এরা নিজেদের কালচারের বাইরে সবকিছু নিয়ে হাসাহাসি করে, আসলে এরাই অশিক্ষিত। তোমার অপূর্ব গানটির মর্ম বুঝতেই পারল না, আজ তুমি খুব ভাল গেয়েছ রবি।
মেজোবউঠানের সান্ত্বনায় রবির চোখ চিকচিক করে ওঠে। বলেন, এরা যে রাজার জাত বউঠান, রাজদণ্ডের জোরে অন্যের সভ্যতাকে উপহাস করার স্পর্ধা রাখে। তবে মেজোবউঠান, আমি ভাবছি আমি ওদের গান আয়ত্ত করেই একদিন ওদের অপমানের জবাব দেব।
সত্যি রবি, জ্ঞানদা বলেন, এই যে বিলিতি মেয়েরা আমাদের গান শুনে হাসাহাসি করছিল, এরা প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানে না। আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের ঘরকন্না শিখিয়ে আর লেখাপড়া না শিখিয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়, এখানেও তেমন মেয়েদের পালিশ চলে বিয়ের বাজারে বিকোবার জন্য। বিয়ের জন্য যতটুকু লেখাপড়া দরকার ততটুকুই শেখানো হয়। একটু গান, একটু পিয়ানো, একটু সেলাই, একটু ভাল করে নাচা, একটু-আধটু ফরাসি ভাষা জানলেই বিয়ের বাজারের জন্য তৈরি।
রবি হেসে বলেন, তার মানে আমাদের মেয়েরা দিশি পুতুল আর এখানকার গোরিমেমরা বিলিতি পুতুল, তুমি বলছ এটুকুই তফাত! আমাদের মেয়েরা আর এদের মেয়েরা দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্য তৈরি! তা হলে আর সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে কী শিখতে এলে মেজোবউঠান?
এখানে এসে এইটুকু তো শিখলাম, জ্ঞানদা বলেন, না এলে ভাবতাম এদেশের মেয়েরা কত-না স্বাধীন, কত-না শিক্ষিত।
হ্যাঁ বউঠান, রবি বলেন, যা দেখছি, এখানেও পুরুষেরাই হর্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগত। স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো চালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টাকে এখানকার স্বামীরাও তাদের ভগবানদত্ত অধিকার মনে করেন। তবে বড়লোকদের ফ্যাশনি মেয়েদের চেয়ে সাধারণ গেরস্থঘরের মহিলাদের আমার বেশি ভাল লাগে। তাদের অনেক কাজ করতে হয় ঘরে-বাইরে। গৃহিণীপনা তাক লাগিয়ে দেয়। লেখাপড়া বেশি না শিখলেও এদেশের মেয়েদের বুদ্ধি পরিষ্কার। অনেক বিষয় জানেন। কথাবার্তায় জ্ঞানলাভ করা যায়। এঁরা চার দেওয়ালে বদ্ধ নন। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়দের সভায় কোনও বিষয়ে স্পষ্ট মতামত জানাতে পারেন।
জ্ঞানদা ডেসার্টের দুটি প্লেট হাতে নিয়ে এসে একটি রবিকে দিতে দিতে বললেন, আমার ভাল লাগে এদের পারিবারিক সম্পর্কটা। সারাদিন পর কর্তা বাড়ি ফিরলে আগুনের চারধারে জড়ো হয়ে বসে পুরো পরিবার খোলামেলা কথাবার্তা, গানবাজনা হয়। কী সুন্দর।
রুপোর চামচ দিয়ে ক্যারামেল পুডিং মুখে তুলতে তুলতে রবি বলেন, এখানে নারীপুরুষের সম্পর্কটাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয় না বলেই তা এত ভোলামেলা ডানা মেলেছে। আপিস থেকে বাড়ি ফিরে যেমন পোশাকি কাপড়জামা ছেড়ে হাঁফ ছেড়ে বসে লোকে, তেমনি আনুষ্ঠানিক ব্যবহারের খোলস ছেড়ে মন খুলে আপনজনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তখনও কেন বউয়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে হবে, পাছে পাশের ঘর থেকে শ্বশুর-ভাশুর শুনে ফেলেন! স্ত্রীর গলা বা হাসি শোনা গেলে কেন মহাভারত উলটে যাবে! এজন্য বিলিতি বাঙালিরা দেশে ফিরে খুঁতখুঁত করে যে আমাদের কোনও হোম নেই, বিলেতেই যথার্থ হোম আছে। কারণ বিলেতের পরিবারে একটা স্বাধীন উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়। সারাদিনের পরে বাপ মা ভাই বোন স্ত্রী সন্তান মিলে বাড়ির মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের চারধারে আনন্দের উৎস তৈরি হয়।
হ্যাঁ রে রবি, সত্যেন এসে যোগ দেন ওদের আলাপে, এদেশে এরা কী পরিবারের ভেতর কী বাইরে, নারীপুরুষের মেলামেশাটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। সেজন্য এখানকার মেয়েরা স্বাধীন না হয়েও নিজেদের প্রাণের স্ফুর্তি মেলে ধরতে পারে। স্বামীকে সবার সামনে শাসন করতেও পারে আবার চুমুও খায় নিঃসংকোচে।
রবি ও জ্ঞানদার খাওয়া শেষ হয়েছে তাই সত্যেন খাবার ঘরে এসেছেন। সবাই একসঙ্গে খেতে চলে আসা ঠিক হবে না বলেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু তাকে পেয়ে ওদের পারিবারিক আড্ডা যেন জমে উঠল।
এরকম সান্ধ্য চা-সভা, নৈশভোজ, নাচের আসর, বল, লন পার্টি লেগেই থাকে রবিদের জীবনে। এ যেন এক অন্য জীবন, কোথায় কলকাতার গানে কবিতায় ভরপুর সৃষ্টির উন্মাদনা আর কোথায় এখানে সভাশোভন হয়ে ওঠার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! রবির হতাশ লাগে মাঝে মাঝেই।
অলস দিনেরবেলায় এবাড়ি-ওবাড়ি ভিজিট পালটা ভিজিট করাও এখানকার প্রথা। রবি লক্ষ করেছেন, বড়ঘরের মহিলাদের সামাজিক আলাপচারিতে একরকম দক্ষতা আছে, অনেক অতিথি থাকলে গৃহিণী তাঁর বাক্য ও হাসির অমৃত সকলকে সমানভাবে বিলিয়ে দিতে জানেন। বিশেষ কারও সঙ্গে বেশি বেশি গল্প করা চলবে না, তাতে অন্যেরা ক্ষুণ্ণ হবেন।
জ্ঞানদার সঙ্গে দু-একটি ভিজিটে গিয়ে রবি দেখলেন, গিন্নিরা একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথা বলেন, তারপরেই সকলের দিকে তাকিয়ে হাসেন আবার পরের কথাটা অন্য একজনকে বলেন, বলতে বলতে হয়তো সকলের দিকে চোখ ঘুরিয়ে আনেন।
আসরের মধ্যমণি গৃহিণী মিসেস জনসন একজনকে বললেন, লাভলি মর্নিং, ইজনট ইট! তারপর সে কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই আর-একজনের দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিলেন, কালরাতের সংগীতশালায় ম্যাডাম নীলসন গান করছিলেন, ইট ওয়াজ এজুইজিট!
অন্য সব মহিলারা তার কথার পিঠে এক-একটা করে বিশেষণ জুড়ে দিতে লাগলেন পরম উৎসাহে, কেউ বললেন চার্মিং, কেউ বললেন সুপার্ব।
আর-একজন বাকি ছিলেন, তিনি বললেন, ইজনট ইট!
রবি ফিসফিস করে জ্ঞানদাকে বলেন, দেখো বউঠান, কথাগুলো যেন তাসের আসরের তাস চালার মতো করে সবার দিকে গড়িয়ে দেওয়া। এমন তাড়াতাড়ি এত দক্ষতার সঙ্গে কথা ঘুরছে যে বোঝা যায় এদের হাতে অনেক তাস গোছানো আছে।
জ্ঞানদা চোখ ঘুরিয়ে বলেন, কিংবা কথার লড়াই। সকালবেলা উঠে মুগুর ভাজা।
মিসেস ডনকিনস জ্ঞানদার সঙ্গে গল্প করতে এগিয়ে আসেন, জানতে চান, মিসেস টেগোর, তোমাদের দেশে কি এরকম সোশাল ভিজিট হয় যেখানে নারীপুরুষ সবাই থাকেন? তোমরা সেখানে কী কথা বলো?
আমাদের বাড়িতে হয়, জ্ঞানদা জানান, কিন্তু সাধারণভাবে অভিজাত হিন্দু পরিবারে এরকম চল নেই। আমাদের মেয়েরা এখনও সকলের সামনে বেরোয় না।
হাউ হরিবল, ডনকিনস বলেন, তোমরা এখনও পরদার আড়ালে মনুষ্যেতর জীবনযাপন করছ। দিস শুড বি চেঞ্জড।
জ্ঞানদা বলেন, আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়, মনুষ্যেতর জীব? আমি যেরকম একা একা বাচ্চাদের নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে এতদূর এসেছি, তুমি পারবে? তোমাদের দেশের কজন মেয়ে সেটা পারবে?
ডনকিনস জ্ঞানদার হাত ধরে বলেন, ওঃ গান ডার্লিং ডোন্ট টেক ইট পারসোনালি। আমি জানি তুমি ব্যতিক্রম, তোমার মতো সাহসী মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। আই অ্যাডোর ইউ।
.
এর কিছুদিন পর সত্যেন জ্ঞানদা ও রবি ছেলেমেয়েদের নিয়ে লন্ডন যাত্রা করলেন। সেখান থেকে ট্রেন্টব্রিজ ওয়েলস, ডেভনশায়ার ঘুরে রবি লন্ডনে একটি পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। এত ঘোরাঘুরির মধ্যেও রাতে শোবার সময়ে তার মনে পড়ে নতুনবউঠানকে। প্রায় রোজ তাকে চিঠি লেখেন রবি। চিঠি হয়তো একদিনেই শেষ হয় না, কাটাকুটিও হয় অনেক। কিন্তু রবি তাকে প্রতিদিন চিঠি লেখেন, প্রতিরাত।
.
ইংলন্ডে আসবার আগে আমি নির্বোধের মত আশা করেছিলেম যে, এই ক্ষুদ্র দ্বীপের দুই হস্ত-পরিমিত ভূমির সর্বত্রই গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতা, ম্যাক্সমূলরের বেদব্যাখ্যা, টিভ্যালের বিজ্ঞানতত্ত্ব, কার্লাইলের গভীর চিন্তা, বেনের দর্শনশাস্ত্রে মুখরিত। সৌভাগ্যক্রমে তাতে আমি নিরাশ হয়েছি। মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে, সংসার যেমন চলে থাকে তেমনি চলছে, কেবল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে কোলাহল শোনা যায়। মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে গিয়েছিলে কি না, কনসর্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নূতন অ্যাক্টর এসেছে, কাল অমুক জায়গায় ব্যান্ড হবে ইত্যাদি। পুরুষেরা বলবে, আফগান যুদ্ধের বিষয় তুমি কী বিবেচনা কর, Marquis of Lorneকে লন্ডনীয়েরা খুব সমাদর করেছিল, আজ দিন বেশ ভালো, কালকের দিন বড়ো মিজরেবল ছিল। এ-দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোয়ায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা অনাবশ্যক মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে। এদেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক। টেমপারেন্স মীটিং, ওয়ার্কিং মেনস্ সোসাইটি প্রভৃতি যত প্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে। পুরুষদের মতো তাদের আপিসে যেতে হয় না, মেয়েদের মতো ছেলেপিলে মানুষ করতে হয় না, এদিকে হয়তো এত বয়স হয়েছে যে বল-এ গিয়ে নাচা বা ফ্লার্ট করে সময় কাটানো সংগত হয় না, তাই তাঁরা অনেক কাজ করতে পারেন, তাতে উপকারও হয়তো আছে।
এখানে দ্বারে দ্বারে মদের দোকান। আমি রাস্তায় বেরোলে জুতোর দোকান, দরজির দোকান, মাংসের দোকান, খেলনার দোকান পদে পদে দেখতে পাই কিন্তু বইয়ের দোকান প্রায় দেখতে পাই নে। আমাদের একটি কবিতার বই কেনবার আবশ্যক হয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে বইয়ের দোকান না দেখে একজন খেলনাওয়ালাকে সেই বই আনিয়ে দিতে হুকুম করতে হয়েছিল– আমি আগে জানতেম, এ দেশে একটা কসাইয়ের দোকান যেমন প্রচুররূপে দরকারি, বইয়ের দোকানও তেমনি।
ইংলন্ডে এলে সকলের চেয়ে চোখে পড়ে লোকের ব্যস্ততা। রাস্তা দিয়ে যারা চলে তাদের মুখ দেখতে মজা আছে– বগলে ছাতি নিয়ে হুস হুস করে চলেছে, পাশের লোকদের উপর ভ্রূক্ষেপ নেই, মুখে যেন মহা উদবেগ, সময় তাদের ফাঁকি দিয়ে না পালায় এই তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। সমস্ত লন্ডনময় রেলোয়ে। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর এক-একটা ট্রেন যাচ্ছে। লন্ডন থেকে ব্রাইটনে আসবার সময় দেখি প্রতি মুহূর্তে উপর দিয়ে একটা, নীচে দিয়ে একটা, পাশ দিয়ে একটা, এমন চারি দিক থেকে হুস হাস করে ট্রেন ছুটেছে। সে ট্রেনগুলোর চেহারা লন্ডনের লোকদেরই মতো, এদিক থেকে ওদিক থেকে মহা ব্যস্তভাবে হাঁসফাস করতে করতে চলেছে। দেশ তো এই এক রত্তি, দু-পা চললেই ভয় হয় পাছে সমুদ্রে গিয়ে পড়ি, এখানে এত ট্রেন যে কেন ভেবে পাই নে। আমরা একবার লন্ডনে যাবার সময় দৈবাৎ ট্রেন মিস করেছিলেম, কিন্তু তার জন্যে বাড়ি ফিরে আসতে হয়নি, তার আধ ঘণ্টা পরেই আর-এক ট্রেন এসে হাজির।
.
জোড়াসাঁকোর তেতলার ঘরে তখন একাকিনী কাদম্বরী বিছানায় এলোচুল ছড়িয়ে শুয়ে আছেন। চারদিকে ছড়ানো চিঠি কাগজ পানের বাটা। মাঝে মাঝে চিঠি তুলে নিয়ে পড়ছেন আবার উদাস হয়ে কী ভাবছেন। কোনও চিঠি এসেছে লন্ডন থেকে, কোনওটা ডেভনশায়ার। রবি লিখেছেন
‘…ক্রমে ক্রমে এখানকার দুই-এক জন লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হতে চলল। একটা মজা দেখছি, এখানকার লোকেরা আমাকে নিতান্ত অবুঝের মতো মনে করে। একদিন Dr.-এর ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েছিলেম। একটা দোকানের সম্মুখে কতকগুলো ফোটোগ্রাফ ছিল, সে আমাকে সেইখানে নিয়ে গিয়ে ফোটোগ্রাফের ব্যাখ্যান আরম্ভ করে দিলে আমাকে বুঝিয়ে দিলে যে, একরকম যন্ত্র দিয়ে ঐ ছবিগুলো তৈরি হয়, মানুষে হাতে করে আঁকে না। আমার চার দিকে তোক দাঁড়িয়ে গেল। একটা ঘড়ির দোকানের সামনে নিয়ে, ঘড়িটা যে খুব আশ্চর্যযন্ত্র তাই আমার মনে সংস্কার জন্মাবার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল। একটা ঈভনিং পার্টিতে মিস– আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি এর পূর্বে পিয়ানোর শব্দ শুনেছি কি না। এ-দেশের অনেক লোক হয়তো পরলোকের একটা ম্যাপ এঁকে দিতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষের সম্বন্ধে যদি একবিন্দুও খবর জানে। ইংলন্ড থেকে কোনো দেশের যে কিছু তফাত আছে তা তারা কল্পনাও করতে পারে না। ভারতবর্ষের কথা দূরে থা– সাধারণ লোকেরা কত বিষয় জানে না তার ঠিক নেই।‘
.
কোনও চিঠিতে ফ্যান্সিবল পার্টির চমৎকার বর্ণনা পড়ে রূপকথার সিন্ডারেলার কথা মনে পড়ে যায় কাদম্বরীর–
‘আমরা সেদিন ফ্যান্সি বলে অর্থাৎ ছদ্মবেশী নাচে গিয়েছিলেম– কত মেয়ে পুরুষ নানারকম সেজেগুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল। প্রকাণ্ড ঘর, গ্যাসের আলোয় আলোকাকীর্ণ, চার দিকে ব্যান্ড বাজছে ছ-সাত শ সুন্দরী, সুপুরুষ। ঘরে ন স্থানং তিল ধারয়েৎ চাঁদের হাট তো তাকেই বলে। এক-একটা ঘরে দলে দলে স্ত্রীপুরুষে হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নাচ আরম্ভ করেছে, যেন জোড়া জোড়া পাগলের মতো। এক-একটা ঘরে এমন সত্তর আশি জন যুগলমূর্তি; এমন ঘেঁষাঘেঁষি যে কে কার ঘাড়ে পড়ে তার ঠিক নেই। একটা ঘরে শ্যাম্পেনের কুরুক্ষেত্র পড়ে গিয়েছে, মদ্যমাংসের ছড়াছড়ি, সেখানে লোকারণ্য; এক-একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে। একজন মেম তুষার-কুমারী সেজে গিয়েছিলেন, তাঁর সমস্তই শুভ্র, সর্বাঙ্গে পুঁতির সজ্জা, আলোতে ঝকমক করছে। একজন মুসলমানিনী সেজেছিলেন; একটা লাল ফুলো ইজের, উপরে একটা রেশমের পেশোয়াজ, মাথায় টুপির মতো– এ কাপড়ে তাকে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। একজন সেজেছিলেন আমাদের দিশি মেয়ে, একটা শাড়ি আর একটা কাঁচুলি তাঁর প্রধান সজ্জা, তার উপরে একটা চাদর, তাতে ইংরেজি কাপড়ের চেয়ে তাকে ঢের ভালো দেখাচ্ছিল। একজন সেজেছিলেন বিলিতি দাসী। আমি বাংলার জমিদার সেজেছিলেম, জরি দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি দেওয়া মখমলের পাগড়ি প্রভৃতি পরেছিলেম। ‘