১২. জানাযার নামায

১২. জানাযার নামায

মাইয়্যেতের সাথে সর্বোত্তম আচরণ

রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোনো রোগীর জীবনের ব্যাপারে নিরাশ হতেন তখন বলতেন

(আরবী******************)

অর্থ: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং অবশ্যি আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাবো।”

তিনি এ ধরনের রোগীকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন, অসিয়ত করতে বলতেন, তওবা করতে বলতেন এবং ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর একত্বের ঘোষণা সম্বলিত এই সর্বোত্তম বাক্যটি বারবার উচ্চারণ করতে বলতেন, যাতে করে ঈমানের এই ঘোষণই হয় তার জীবনের সর্বশেষ উচ্চারণ।

কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তিনি তার ব্যাপারে সর্বোত্তম কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতেন। মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তাঁর আচরণ ছিলো সর্বাধিক কল্যাণধর্মী। মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তাঁর প্রবর্তি কর্মনীতি ছিলো মৃত ব্যক্তির দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর, তার আত্মীয় স্বজনদের জন্য সান্ত্বনা দায়ক এবং জীবিত লোকদের উপদেশ ও শিক্ষামূলক।

তিনি মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনও মহান আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন।

তিনি মৃত ব্যক্তির জন্য সালাত জানাযার [সালাত মানে দু’আ। ‘সালাতে জানাযা’ মানে মৃত ব্যক্তির জন্য দু’য়া করা। সালাতে জানাযাকে আমরা ‘জানাযার নামায’ বলে থাকি। এটা মূলত মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আর অনুষ্ঠান।] পদ্ধতি চারূ করেন।

তিনি মৃত ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে দাঁড়াতেন। সাহাবযে কিরাম তাঁর পিছে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতেন। তারা তাঁর সাথে আল্লাহর প্রশংসা করতেন। মৃতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তার জন্য আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করতেন এবং তার পরকালীন মুক্তির জন্য দু’আ করতেন। কফিনের সাথে কবর পর্যন্ত যেতেন। উত্তম পদ্ধতিতে তাকে কবরস্থ করতেন। তারপর তিনি এবং তাঁর সাথিগণ কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার জন্য পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে মুক্তির প্রার্থনা করতেন। কারণ মৃত্যুর পর পরবর্তী অধ্যায়গুলোর মুক্তিই তার জন্য বেশি প্রয়োজন।

অতপর তিনি মাঝে মধ্যে গিয়ে তার কবর যিয়ারতের রীতি চালু করেন এবং যিয়ারতকালে তাকে সালাম দেয়া এবং তার জন্য দু’আ করার রীতি চালু করেন। এ যেনো জীবিতকালে প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাত করতে যাওয়া, তাকে সালাম দেয়া, এবং তার কুশল মঙ্গল কামনা করা।

-মৃতের জন্যে তিনি চিৎকার করে কান্না, বুক চাপড়ানো, মুখ কাপড় ছেড়া, মাথা কামানো এবং উচ্চস্বরে বিলাম করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছেন।

-পক্ষান্তরে তিন মৃতের জন্য শোক সন্তপ্ত হওয়া, নিরবে কান্নাকাটি করা ও হৃদয় ভারাক্রান্ত করার রীতি চালু করেছেন।

-মৃত ব্যক্তির জন্য তিনি এসবই করতেন। তিনি বলতেন মৃত ব্যক্তির জন্য চক্ষু অশ্রুপাত করবে, হৃদয় ভারাক্রান্ত হবে এবং যবানে তাই উচ্চারিত হবে যাতে আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন।

মাইয়েতের গোসল ও কাফন

রসূল (ﷺ) এর সুন্নত ছিলো, যে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তিনি তাকে গোসল করিয়ে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতেন। তার গয়ে আতর ও সুগন্ধি লাগাতেন। সাদা কাপড় নিয়ে কফিন করাতেন। তাঁর নির্দেশে সাহাবয়ে কিরাম এভাবেই মৃত ব্যক্তিকে সাজাতেন। তারপর তিনি তার জন্য সালাতে জানাযা পড়তেন।

তিনি সাধারণত জানাযা মসজিদে পড়তেন না। তবে দু’ একবার মসজিদে পড়ার প্রমাণও আছে। দু’ভাবে পড়াই বৈধ। তবে মসজিদের বাইরে পড়াই উত্তম।

মৃতকে চুমু খাওয়া

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নত হলো, মৃত্যুর সাথে সাথে মাইয়্যেতের লাশকে সোজা করে দেয়া। তার চোখ বন্ধ করে দেয়া এবং তার মুখভ ও শরীর ঢেকে দেয়া।

তিনি কখনো কখনো মাইয়্যেতকে চুমু খেতেন। তিনি উসমান ইবনে মাযইন রা. এর মৃত্যুর পর তাকে চুমু দিয়েছিলেন এবং তাঁর জন্য কেঁদেছিলেন।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের পর আবু বকর সিদ্দিক রা. তার কফিনের উপর উপুড় হয়ে তাকে চুমু খেয়েচিলেন।

শহীদদের গোসল ও জানাযা নেই

যারা আল্লাহর পথে শহীদ হতো তিনি তাদের গোসল দেয়াতেন না। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (ﷺ) শহীদদের গোসল দেয়াতে নিষেধ করেছেন।

শহীদদের হাতিয়ার ও চামড়ার পরিধেয় খুলে নিয়ে তাদের বাকি সব পোশাক সহই তাদের দাফন করতেন।

তিনি শহীদদের জানাযাও পড়তেন না। কারণ শাহাদাতের মাধ্যমেই শহীদদের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

যানাযার আগে ঋণ আদায়

তাঁর কাছে যখন জানাযার জন্যে কোনো মাইয়্যেতকে আনা হতো, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করতেন এই ব্যক্তির কোনো ঋণ আছে কি? যদি মৃত ব্যক্তির দেনাদার না হতো তবে তিনি তার জানাযা পড়াতেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তি যদি দেনাদার হতো তবে তিনি নিজে জানাযা পড়াতেন না। সাহাবায়ে কিরামকে বলতেন তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জানাযা পড়ে নাও। আসলে রসূলুল্লাহর জানাযা ছিলো মৃত ব্যক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ। তারা সুপারিশ অবশ্যি কবুল হতো। অথচ ঋণী ব্যক্তির ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে যাবেনা। তাই আল্লাহ তাআলা যখন তাকে স্বচ্ছলতা দান করেন, তখন তিনি নিজেই মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করে তার জানাযা পড়াতেন এবং তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি তার ওয়ারিশদের দিয়ে দিতেন।

তিনি কিভাবে সালাতুল জানাযা পড়াতেন?

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নত ছিলো, তিনি মাইয়্যেত পুরুষ হলে তার মাথা বরাবর আর মহিরা হলে তার শরীরের মাঝখানে বরাবর দাঁড়াতেন।

তিনি আল্লাহু আকবার বলে জানাযার নামায শুরু করতেন। তারপর আল্লাহর হাম ও সানা পাঠ করতেন।

-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. একবার জানাযা পড়াতে গিযে তাকবীরের পর উচ্চস্বরে ফাতিহা পাঠ করেন। তিনি বলেন, আমি এজন্য এরকম করেছি যাতে করে তোমরা জানতে পারো- জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা সুন্নত।

-একইভাবে আবু উমাম ইবনে সাহল রা. বলেছেন, জানাযার প্রথম তাকবীরের পরে সূরা ফাতিহা পাঠ করা সুন্নত। তার সূত্রে নবী করীম (ﷺ) থেকে সূরা ফাতিহার কথা বর্ণিত হয়েছ। তবে এই হাদিসটির সনদ (সূত্র) বিশুদ্ধ নয়।

আমাদের শাইখ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, জানাযপার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব নয়, তবে সুন্নত।

-আবু উমাম ইবনে সাহল রা. একদল সাহাবীর সূত্রে বর্ণনা করেছন, জানাযার নামাযে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি সালাত (দরূদ) পাঠ করতে হবে।

-উবাদা ইবনে সামিতে রসূলুল্লাহ (ﷺ) জানাযার নামায কিভাবে পড়তেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দেন:

আল্লাহর শপথ আমি অবশ্যি বলবো তিনি কিভাবে জানাযার নামায পড়তেন। তুমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামায শুরু করবে, অতপর নবী করীম (ﷺ) –এর প্রতি সালাত (দরুদ) পাঠ করবে। অতপর মৃত ব্যক্তির জন্য এভাবে দু’আ করবে:

(আরবী******************************)

অর্থ: হে আল্লাহ! তোমার এই দাস তোমার সাথে শিরক করতোনা। আর তুমিইতো তার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানো। এই ব্যক্তি যদি পুণ্যবান হয়ে থাকে, তবে তুমি তার পুণ্য আরো বাড়িয়ে দাও। আর সে যদি পাপী হয়ে থাকে তবে তার পাপগুলো ক্ষমা করে দাও। আয় আল্লাহ! তার পুরষ্কার থেকে আমাদের বঞ্চিত করোনা। তার পরে আমরা যারা বেচে আছি তুমি তাদের বিপথগামী করোনা।”

দু’আর কথা লোকেরা যেভাবে মুখস্থ রেখেছে, সূরা ফাতিহা ও দরূদ এর কথা সেরক বেশি মুখস্থ রাখেনি।

-তিনি মাইয়্যেতের জন্য নিম্নরূপ দু’আ করতেন বলেও বর্ণিত আছে:

(আরবী*****************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! এই মাইয়্যেতকে ক্ষমা করো, তার প্রতি রহম করো এবং তার প্রতি কোমল হও। তার আগমনকে সম্মানজনক করো। তার প্রবেশ পথকে প্রশস্ত করো। তাকে ঠান্ডা ও পানি বরফ দ্বারা ধুয়ে দাও। তার গুনাহখাতা এমনভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দাও যেভাবে সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন করা হয়। তার ঘরের চাইতে উত্তম ঘর তাকে দাও, তার পরিজন থেকে উত্তম পরিজন তাকে দাও। তার সাথি থেকে উত্তম সাথি তাকে দাও। আর তাকে তুমি জান্নাতে স্থান দাও। তাকে কবর আযাব ও জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও।”

-তিনি নিম্নরূপ দু’আ করেছেন বরেও বর্ণিত আছে:

(আরবী*******************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, ছোট ও বড়, পুরুষ ও নারী এবং উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলকে ক্ষমা করে দাও। আমাদের মধ্যে যাদেরকে তুমি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তাদেরকে ইসলামের উপর রাখো। আর যাদেরকে মৃত্যু দিতে চাও তাদেরকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দাও। আয় আল্লাহ! তার সওয়াব থেকে আমাদের বঞ্চিত করোনা এবং তার পরে আমাদের জীবিতদেরকে কোনো পরীক্ষায় ফেলোনা।”

রসূলুল্লাহ (ﷺ) জানাযপার নামাযে মহিলাদের জন্যে নিম্নরূপ দু’আ করেছেন বলেও প্রমাণিত আছে:

(আরবী****************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! তুমি এই মহিলাটির প্রভু। তুমিই তাকে সৃষ্টি করেছো। তুমিই তাকে ইসলমের হিদায়াত দান করেছো। আর এখন তুমিই তার রূহ কবয করেছো। আমরা তার জন্য তোমার দরবারে সুপারিশ করতে এসেছি। তুমি দয়া করে তাকে ক্ষমা করে দাও।”

রসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃতদের জন্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দু’আ করতে আদেশ করেছেন।

জানাযার তাকবীর কয়টি?

রসুরুল্লাহ (ﷺ) চার তাকবীরে জানাযা পড়তেন। তিনি পাঁচবার তাকবীর বরেছৈন বলেও সহীহ সূত্রে জানা যায়।

তার ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কিরাম কেউ চার, পাঁচ এবং কেউ ছয় তাকীরে জানাযা পড়েছেন।

যায়েদ ইবনে আরকাম পাঁচ তাকবীরে জানাযা পড়েছেন। তিনি বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) পাঁচ তকবীরে জানাযা পড়তেন। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ মুসলিমে।

আলী রা. সহল ইবনে হানিফের নামাযে জানাযা ছয় তাকবীরে পড়েছেন। তিনি বদরী সাহাবীদের জানাযা ছয় তাকবীরে পড়াতেন। অন্যান্য সাহাবীদের জানাযা পাঁচ তাকবীরে পড়াতেন। এছাড়া অন্যান্য লোকদের জানাযা চারতাকবীরে পড়তেন। একথা বর্ণা করেছেন ইমাম দারু কুতনি।

সায়ীদ ইবনে মনসুর হাকাম থেকে এবং তিনি ইবনে উয়াইনা থেকে বর্ণনা করেছন যে সাহাবায়ে কিরাম বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীগনের নামাযে জানাযা পাঁচ, ছয় ও সাত তাকবীরে পড়তেন।

এসবই সাহাবায়ে কিরাম থেকে প্রমাণিত বিশুদ্ধ আসার। এর মধ্যে যে কোনো পদ্ধতিই অবলম্বন করা বৈধ। এর কোনোটিকেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ চারের অধিক তাকবীর বলেছেন।

যারা চার তাকবীরের অধিক বলতে নিষেধ করেন, তরা ইবনে আব্বাস রা. –এর হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন। তাতে ইবনে আব্বাস রা. বলেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবনের শেষ জানাযা চার তাকবীরে পড়েছেন। তাদের মতে কোনো বিষয়ে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবনের শেষ কাজই সে বিষয়ের চূড়ান্ত ফায়সালা।

যে সূত্রে ইবনে আব্বাস রা. থেকে এ হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে তা খুবই দুর্বল এবং একেবারে ত্রুটিপূর্ণ। ইমাম আহমদ বলেছেন, এই বক্তব্য মিথ্যা এবং এর কোনো ভিত্তি নেই। এ হাদিসের সূত্রে (সনদে) মিথ্যা হাদিস রচনাকারী ব্যক্তি রয়েছে।

জানাযার নামাযে কয়টি সালাম?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) জানাযার নামাযে একটি সালাম বলতেন বলে বর্ণিত আছে। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় দু’টি সালামের কথাও আছে।

-ইমাম বায়হাকি প্রমুখ মাকবারীর সূত্রে আবু হুরাইরা রা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) একবার চার তাকবীর ও এক সালামে জানাযা পড়েছেন।”

-ইমাম আহমদ বলেছেন, এই হাদিসটি মওদূ।

তবে ইমাম আহমদ সহীহ সূত্রে এক সালামের কথাও বর্ণনা করেচেন এবং দুই সালামের কথাও বর্ণনা করেছেন।

-সাহাবায়ে কিরাম এক সালামেও জানাযা শেষ করেছেন, দুই সালামেও জানাযা শেষ করেছেন।

জানাযায় রফে ইয়াদাইন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) কি জানাযায় রফে ইয়াদাইন করতেন? এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ী বলেছেন: ঐতিহ্য এবং নামাযে রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর সুন্নতের উপর কিয়াস করে ধরে নিতে হবে, জানাযায় রফে ইয়াদা্ন করতে হবে। কারণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় প্রত্যেক তকবীরের সাথে রফে ইয়াদাইন করতেন।

ইবনে উমর ও আনাস রা. জানাযায় প্রত্যেক তাকবীরের সাথে রফে ইয়াদাইন করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে।

বায়হাকি বর্ণনা করেছেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম তাকবীরে রফে ইয়াদাইন করতেন এবং ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখতেন।

তিনি কবরে জানাযা পড়েছেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর রীতি ছিলো, তিন যদি কারো কবর দেয়ার আগে জানাযার নামায পড়তে না পারতেন, তবে কবর দেয়ার পর কবরে গিয়ে তার জানাযা নামায পড়তেন।

একবার এক ব্যক্তি কবর দেয়ার এক রাত্রি পরে তিনি তার কবরে গিয়ে জানাযার নামায পড়েছেন। একবার একটি কবরে দাফন করার তিনদিন পর জানাযার নামায পড়েছেন। আরেকটি কবরে একমাস পর পড়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করেননি।

ইমাম আহমদ বলেছেন, কবরে জানাযার নামায পড়ার ব্যাপারে কার সন্দেহ আছে? যেখানে বনী করীম (ﷺ) কারো জানাযার নামায বাদ পড়লে তার কবরে গিয়ে জানাযার নামায পড়তেন বলে বর্ণিত আছে, সেক্ষেত্রে সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে ছয়টি সূত্রে হাদিস বর্ণিত রয়েছে। সবগুলো সূত্রই হাসান (উত্তম)।

-ইমাম আহমদ কবরে জানাযা পড়ার সময়সীমা একমাস নির্ধারণ করেছেন।

-ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, লাশ পঁচে গলে বিকৃত হবার আগ পর্যন্ত কবরে জানাযা নামায পড়া যাবে।

-ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালিক মৃত ব্যক্তির অভিভাবক ছাড়া আর কারো জন্যে কবরে জানাযার নামায পড়া সঠিক মনে করেননি। তাঁরা বলেছেন, কবরস্থ করার পূর্বে অলি (অভিভাবক) অনুপস্থিত থঅকলে তিনি ফিরে এসে কবরে জানাযা পড়তে পারবেন।

শিশুর জানাযা

বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা শিশুর জানাযা নামায পড়বে।

সুনানে ইবনে মাজাহতে মরফূ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: তোমরা শিশুদের জানাযার নামায পড়বে। কারণ তারা তোমাদের আগে পাঠানো নেক আমল। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, গর্ভচ্যুত শিশুর বয়েস চার মাস হলে তার জানাযা পড়তে হবে।

আত্মহত্যাকারী, প্রতারক ও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির জানাযা

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) আত্মহত্যাকরিীর জানাযা নামায পড়তেন না।

-তিনি গণীমতের মাল আত্মসাৎকারীর জানাযার নামাযও পড়তেন না।

-তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির জানাযার নামায পড়েছেন কিনা সে ব্যাপারে মতভেদ আছে।রসূল সু. দেনাদার, আত্মহননকারী ও আত্মসাৎকারীর জানাযা না পড়লেও সাহাবীগণকে পড়তে বলেছেন। ফকীহগণ বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানরেই জানা পড়া হবে। -ফিকহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড।]

কফিনের সহগামী হওয়া রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর রীতি ছিলো তিনি কোনো মাইয়্যেতের জানাযার নামায পড়ার পর কফিনের সাতে কবর পর্যন্ত যেতেন। এ সময় তিনি পায়ে হেঁটে কফিনের আগে আগে চলতেন।

তাঁর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতও এটিই ছিলো।

-তিনি এই রীতিও চালু করেন, যারা যানবাহনে করে কফিনের সাথে যাবে, তারা কফিনের পিছে থাকবে। আর যারা পায়ে হেঁপে যাবে, তারা কফিনের নিকটবর্তী চারপাশে থাকবে- সামন পিছে ও ডানে বামে।

-তিনি কফিন নিয়ে দ্রুত চলতে বলতেন। তাই সাহাবায়ে কিরাম কফিন নিয়ে দ্রুত কবরের দিকে এগিযে যেতেন।

আজকাল কফিন নিয়ে কবরে যেতে যে ধীর গতি অবলম্বন করা হয় তা বিদআত, মাকরূহ, সুন্নতের খেলাফ এবং ইহুদী খ্রিস্টানদের অনুসৃত নীতি। কফিনের সাথে কাউকে ধীরে চলতে দেখলে আবু বকর রা. তার প্রতি ছড়ি উত্তোলন করে বলতেন: তুমি কি দেখনি আমরা রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর সাথে কফিন নিয়ে কত দ্রুত চলতাম।

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কফিন নিয়ে কবরের দিকে যেতেন, তখন পদব্রেজে চলতেন। তিনি বলতেন ফেরেশতারা পদব্রেজে চলছে, আমি কি করে বাহনে করে যেতে পারি।

-মাইয়্যেতকে দাফন করে ফেরার সময় তিনি কখনো পদব্রেজে ফিরতেন কখনো বাহনে করে ফিরতেন।

কফিনের সাথে মাইয়্যেতকে যমীনে রাখার আগ পর্যন্ত তিনি বসতেন না।

গায়েবানা জানাযা

বহু মুসলিম দূরে বিভিন্নস্থানে মৃত্যু বরণ করায় তাদের জানাযার নামায পড়া হয়নি। সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, বাদশা নাজ্জাশীর মৃত্যুর পর রসূলুল্লাহ (ﷺ) তার গায়েবানা জানাযা পড়েছেন। এ বিষয়ে তিনটি মত সৃষ্টি হয়েছে।

১. একটি মত হলো, রসূলুল্লাহ (ﷺ) গায়েবানা জানাযার বিধান চালু করেছেন। তাই দূরের মাইয়্যেতৈর জন্যে গায়েবানা জানাযা পড়া উম্মতের জন্যে সুন্নত। এমত হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী রহ.। এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদেওর এটাই মত।

২. ইমাম আবু হানীফা রহ. ও ইমাম মালিক রহ. বলেছেন, রসুলুল্লাহ (ﷺ) যে নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছেন, তা কেবল নাজ্জাশীর জন্যেই খাস ছিলে। এটা অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রসূলুল্লাহ (ﷺ) নাজ্জাশী ছাড়া আর কারো গায়েবা জানাযা পড়েছেন বলে প্রমাণ নেই। তাঁর গায়েবানা জানাযা পড়ার প্রমাণ মাত্র একটি, আর না প্রমাণ অনেক। তাই গায়েবানা জানাযা পড়া যেমন সুন্নত, তেমনি না পড়াও সুন্নত।

৩. ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে এ ব্যাপারে উত্তম পন্থা হলে, কেউ যদি এমন কোথাও মারা যায়, এবং সেখানে তাঁর নামাযে জানাযা পড়া না হয়ে থাকে, তবে তার গায়েবানা জানা পড়তে হবে। যেমন নবী করীম (ﷺ) নাজ্জাশীর জানাযা পড়েছিলেন। কারণ তিনি অমুসলিম দেশে মারা গিয়েছিলেন এবং তাঁর নামাযে জানাযা পড়া হয়নি। পক্ষান্তরে কেউ যদি এমন কোথাও মারা যায়, যেখানে তার নামাযে জানাযা পড়া হয়েছে, তবে তার জন্যে গায়েবানা জানাযা পড়া যাবেনা। কারণ, তার জানাযা পড়ার যে ফরয মুসলমানদের উপর বর্তিয়েছিল, তা আদায় হয়ে গেছে। নবী করীম (ﷺ) গায়েবানা জানাযা পড়েছেন, আবার বর্জনও করেছেন। তাই তা পড়া এবং না পড়া দুটোই সুন্নত। তাঁর গায়েবানা জানাযা পড়ার ক্ষেত্র ছিলো আলাদা, আর না পড়ার ক্ষেত্রেও ছিলো আলাদা।

দাফন ও কবর সংক্রান্ত অন্যান কথা

-মাইয়্যেতকে যখন কবরে রাখা হতো, তখন রসূলুল্লাহ (ﷺ) এই কথাগুলো উচ্চারণ করতেন:

(আরবী**************)

অর্থ: আল্লাহর নামে আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর রসূলের আদর্শের উপর তাকে কবরস্থ করছি।”

অপর বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে, এসময় রসূল (ﷺ) নিম্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করতেন:

(আরবী*******************)

অর্থ: আল্লাহর নামে, আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর রসূলের আদর্শের উপর তাকে দাফন করছি।”

-একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, মাইয়্যেতকে কবরে রাখার পর রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ হাতে মাটি তুলে কবরে দিয়েছেন। তিনি তিন মুষ্টি মাটি দিয়েছেন। মাথার দিক থেকে মাটি দেয়া শুরু হতো।

দাফন শেষ হলে তিনি তাঁর সাথিরা কবরের উপর দাঁড়িয়ে মাইয়্যেতৈর জন্যে তাসবীতের প্রার্থনা করতেন। [অর্থাৎ- কবরে সওয়াল জওয়াবের সময় যেনো অবিচলিত থেকে জওয়াব দিতে পারে, সেজন্যে প্রার্থনা করতেন।] তিনি তাঁর সাথিদেরকে মাইয়্যেতের জন্যে তাসবীতের প্রার্থনা করতে বলতেন।

-কবর বাঁধানো, উঁচু করা, এবং কবরের উপর সৌধ বচা গম্বুজ নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। রসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আলীকে পাঠিয়ে এ ধরনের কবর গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) কবরকে সাজদার স্থল বানাতে নিষেধ করেছেন। তিনি কবর সামনে রেখে নামায পড়তেও নিষেধ করেছেন।

-তিনি কবরে বাতি দিতে নিষেধ করেছেন।

-তিনি কবরকে উরুছ, আস্তানা, মেলা ও আখড়াস্থল বানাতে নিষেধ করেছেন। এসব কাজ যারা করবে তিনি তাদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন।

-তাঁর সুন্নত এটাই চিলো যে, কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যাবেনা এবং কবরকে অবমাননাও করা

যাবেনা।

-তিনি মহিলাদের কবরস্থানে গিয়ে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। এমনটি যারা করবে তাদের অভিসম্পাত করেছেন।

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন বরক যিয়ারত করতেন, তা করতেন তাদের জন্যে দু’আ করার উদ্দেশ্যে, তাদের প্রতি রহমত প্রার্থনার জন্যে, তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থতনার উদ্দেশ্যে এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ করার উদ্দেশ্যে।

কবর যিয়ারতের সময় তিনি সাহাবীগণকে একথাগুলো বলতে বলেছেন:

(আরবী********************)

অর্থ: হে মুমিন ও মুসলিম ঘরবাসী! তোমাদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ আমরা অবশ্যি তোমাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আমাদের ও তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

-তাঁর এ রীতি ছিলো যে, তিনি মৃত্রে পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন। তাদের আল্লাহর ফায়সালা মেনে নিয়ে সবর করতে বলতেন।

[আলহামদুলিল্লাহ রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর নাময সংক্রান্ত এই মূল্যবান প্রমাণিত গ্রন্থটির অনুবাদ এখানেই শেষ হলো। রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর নাময পড়ার পদ্ধতি থেকে মহিলাদের জন্যে নামায পড়ার ভিন্ন কোনো পদ্ধতি জানা যায় না। তিনি মহিলাদেরকে ভিন্ন পদ্ধতিতে নামায পড়তেহ বলেছেন বলেও কোনো প্রামাণ পাওয়া যায় না। তাই সুন্নত অনুযায়ী পুরুষ ও মহিলাদের নামায পড়ার পদ্ধতি একই।]

— সমাপ্ত —

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *