দ্বাদশ পর্ব – অধ্যায়-১
সেইসময় পিটার্সবুর্গের উপরমহলে ফরাসি রুমায়ন্তসেভ, জারপন্থী মারিয়া ফীদরভনা ও অন্যদের দলের মধ্যে একটা জটিল সংঘাত ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, আর দরবার মহলের অলস মানুষদের গুনগুনানিতে সেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিটার্সবুর্গের শান্ত, বিলাসবহুল জীবন কেবলমাত্র বাস্তব জীবনের অপচ্ছায়া ও চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত : সে জীবন তার পুরনো পথ ধরেই চলেছে; ফলে রুশ জনগণের বিপদ ও কঠিন অবস্থার কথা। তাদের বোঝানো খুবই শক্ত। সেখানে চলেছে সেই একই অভ্যর্থনা-সভা ও বলনাচের আসর, ফরাসি থিয়েটার, রাজদরকারকে ঘিরে সেই স্বার্থ, চাকরি ও ষড়যন্ত্রের খেলা। কেবলমাত্র একেবারে উচ্চতম মহলে বাস্তব অবস্থার অসুবিধাগুলি স্মরণ করবার চেষ্টা হচ্ছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে দু সম্রাজ্ঞীর ভিন্ন ভিন্ন। ব্যবহারের নানা গল্প সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সম্রাজ্ঞী মারিয়ার একমাত্র চিন্তা তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা নানা দাঁতব্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ; সে নির্দেশ দিয়েছে, ঐসব প্রতিষ্ঠানকে কাজানে সরিয়ে নিতে হবে, আর তাদের জিনিসপত্র বাধাছাদাও হয়ে গেছে। অবশ্য সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল তার কি নির্দেশ, তখন স্বভাবসিদ্ধ রুশ দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় সে জবাব দিল, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ সে দেবে না, কারণ সেটা রাষ্ট্রের ব্যাপার, তবে ব্যক্তিগতভাবে তার কথা হল-সে পিটার্সবুর্গ ছাড়বে একেবারে সকলের শেষে।
২৬শে আগস্ট, ঠিক বরদিনো যুদ্ধের দিনে, আন্না পাভলভনার বাড়িতে একটা সান্ধ্যসম্মিলনীর আয়োজন করা হয়েছে। মহাত্মা সের্গেইয়ের একটি দেবমূর্তি সম্রাটকে পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে মহামান্য বিশপ তাকে যে চিঠিখানি লিখেছে সেটা পাঠ করাই ঐ সম্মিলনীর প্রধান অনুষ্ঠান। বক্তা হিসেবে প্রিন্স ভাসিলির খ্যাতি আছে; চিঠিটা সেই পড়বে। আন্না পাভলভনার সান্ধ্য বৈঠকে এধরনের পাঠের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য সবসময়ই থাকে। সে আশা করছে সেদিন সন্ধ্যায় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত থাকবে; ফরাসি থিয়েটার দেখার জন্য তাদের লজ্জায় ফেলে তাদের মনে দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যেই অনেকে হাজির হয়েছে, কিন্তু যাদের উপস্থিতি সে আশা করছে তারা সকলে এসে না পৌঁছনোয় আন্না পাভলতনা পাঠ শুরু করতে না দিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা শুরু করে দিয়েছে।
পিটার্সবুর্গে সেদিনকার বড় খবর কাউন্টেস বেজুখভার অসুখ। কয়েকদিন আগে সে অপ্রত্যাশিতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে; সাধারণত যেসব বৈঠকের মধ্যমণি হয়ে সে বিরাজ করে সে রকমের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সে হাজির হতে পারেনি, কারো সঙ্গে নাকি দেখাও করছে না, এবং পিটার্সবুর্গের যে সব নামী ডাক্তাররা সাধারণত তার চিকিৎসা করে তাদের বদলে জনৈক ইতালিয় ডাক্তার একটা নতুন অসাধারণ পদ্ধতিতে তার চিকিৎসা করছে।
সকলে ভালো করেই জানে যে একই সঙ্গে দু স্বামীকে বিয়ে করার অসুবিধার ফলেই এই মনোহারিণী কাউন্টেসটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আর ইতালিয় ডাক্তারটির চিকিৎসাই হচ্ছে সেই অসুবিধা দূর করা; কিন্তু আন্না পাভলভনার সম্মুখে সেকথা বলার, এমন কি সেকথা জানার ভাব দেখাবার সাহসও কারো নেই।
সকলেই বলছে বেচারী কাউন্টেস খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলছে তার এনজায়না পেক্টরিস হয়েছে।
এনজায়না? ও, সে যে ভয়ানক অসুখ!
সকলে বলছে, এনজায়নাকে ধন্যবাদ, দু-প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এবার মিলন ঘটেছে…। মহাখুশির সঙ্গে সকলে এনজায়না কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগল।
সকলে বলছে, বুড়ো কাউন্টের অবস্থা শোচনীয়। ডাক্তার যখন বলল যে রোগীর অবস্থা বিপজ্জনক তখন সে শিশুর মতো কেঁদেছে।
ওঃ, কী ভয়ংকর ক্ষতিই না হবে; তিনি তো একটি মনোহারিণী স্ত্রীর।
ঠিক সেইসময় সেখানে হাজির হয়ে আন্না পাভলভনা বলল, আপনারা বেচারী কাউন্টেসের কথা বলছেন? খবর নিতে আমি লোক পাঠিয়েছিলাম, শুনলাম এখন কিছুটা ভালো। ওঃ, তিনি তো অবশ্যই পৃথিবীর মধ্যে সকলের চাইতে মনোরমা নারী। আমরা ভিন্ন দলের লোক, কিন্তু তাই বলে যে প্রশংসা তার প্রাপ্য তা তো জানাতেই হবে। তার ভাগ্যই খারাপ।
বিখ্যাত ডাক্তারদের না ডেকে একজন হাতুড়ে দিয়ে তার চিকিৎসা করানো হচ্ছে বলে একটি অনভিজ্ঞ যুবক বিস্ময় প্রকাশ করল। আন্না পাভলভনা সঙ্গে সঙ্গে তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, আপনি হয়তো আমার চাইতে ভালো খবর রাখেন, কিন্তু খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আমি জেনেছি যে এই ডাক্তারটি খুব জ্ঞানী ও গুণী। তিনি স্পেনের রানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
এইভাবে যুবকটিকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে আন্না পাভলভনা আর একটা দলের কাছে এগিয়ে গেল। সেখানে বিলিবিন অস্ট্রিয়দের নিয়ে কথা বলছে আর একটা রসিকতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
পেত্রপলে বীর উইগেনস্তিন ফরাসিদের কাছ থেকে যেসব অস্ট্রিয় পিটাকা হস্তগত করেছিল সেগুলি ভিয়েনায় পাঠাবার সময় তার সঙ্গে যে কূটনৈতিক চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল তার উল্লেখ করে বিলিবিন বলল, আমি তো মনে করি চিঠির মন্তব্যটি মজাদার।
কী? সেটা কী? আন্না পাভলভনা জানতে চাইল।
নিজের লেখা সেই কূটনৈতিক চিঠির আসল বয়ানটিই সে বলে দিল।
সম্রাট এই অস্ট্রিয় পতাকাগুলি ফেরৎ পাঠাচ্ছেন; বিপথে যাওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ পতাকাগুলিকে ভুল পথের উপর পাওয়া গিয়েছিল, কথাগুলি শেষ করার পরে বিলিবিনের কুঞ্চিত ভুরু আবার সমান হয়ে গেল।
চমৎকার! চমৎকার! প্রিন্স ভাসিলি মন্তব্য করল। প্রিন্স হিপোলিৎত অপ্রত্যাশিতভাবে উঁচু গলায় বলল, ওয়ারস যাবার পথ বোধহয়। কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে সকলেই তার দিকে তাকাল। প্রিন্স হিপোলিতও পুলকিত বিস্ময়ে চারদিকে তাকাল। নিজের কথাগুলির অর্থ সে নিজেও ভালো করে জানে না। কূটনৈতিক চাকরি-জীবনে সে অনেকবার লক্ষ্য করেছে যে এই ধরনের আকস্মিক উক্তিকে সকলেই বুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে করে। যাই হোক, এই সময় আন্না পাভলভনা যার জন্য অপেক্ষা করে আছে সেই দেশাত্মবোধহীন লোকটি ঘরে ঢুকল, আর সেও হেসে প্রিন্স হিপোলিৎতের দিকে একটা আঙুল নেড়ে প্রিন্স ভাসিলিকে টেবিলের কাছে ডেকে নিয়ে গেল; তার হাতে দুটো মোমবাতি ও পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে পাঠ শুরু করতে বলল। সকলেই নীরব হয়ে গেল।
প্রিন্স ভাসিলি পড়তে লাগল : মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান ও সম্রাট! মা যেভাবে আকুল সন্তানদের কোলে টেনে নেন, আমাদের প্রাচীন রাজধানী, নব জেরুজালেম মস্কোও সেইভাবে বরণ করছে তার খৃস্টকে-তার কথাটাকে সে বিশেষ জোর দিয়ে পড়ল–এবং কুয়াশার আবরণের ভিতর দিয়ে আপনার শাসনকালের উজ্জ্বল গৌরব প্রত্যক্ষ করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় গেয়ে উঠেছে, হোসান্না; যিনি আসছেন তিনিই ধন্য!
প্রিন্স ভাসিলি শেষের কথাগুলি উচ্চারণ করল অশ্রুপূর্ণ স্বরে।
বিলিবিন মনোযোগ দিয়ে তার নখগুলি পরীক্ষা করতে লাগল। অন্য অনেককে দেখে মনে হল তারা যেন ভয় পেয়েছে। আন্না পাভলভনা পরবর্তী কথাগুলিকে ফিসফিস করে আগাম বলে দিল : ফ্রান্সের সীমান্ত হতে আগত সাহসী ও উদ্ধত গোলিয়াত…
প্রিন্স ভাসিলি পড়তে লাগল।
ফ্রান্সের সীমান্ত হতে আগত সাহসী ও উদ্ধত গোলিয়াত মৃত্যুবাহী ত্রাস দিয়ে রাশিয়াকে ঢেকে দিক; রুশ ডেভিডের হাতের গুলতিস্বরূপ বিনীত বিশ্বাস সহসা আঘাত করবে তার রক্তপিপাসু গর্বোদ্ধাত শিরে। ঈশ্বরের সেবক এবং প্রাচীনকালে আমাদের দেশের দুর্দিনের ত্রাণকর্তা মহাত্মা সের্গেইর দেবমূর্তিটি ইয়োর ইম্পিরিয়াল ম্যাজেস্টির হাতে অর্পণ করা হল। ঈশ্বরের কাছে আমার এই একান্ত প্রার্থনা, সর্বশক্তিমান যেন এই ন্যায়বান জাতির মাথা উঁচু রাখেন, করুণা করে ইয়োর ম্যাজেস্টির মনোবাসনা পূর্ণ করেন।
কী জোর! কী রচনাভঙ্গি! পাঠক ও লেখক দুয়েরই প্রশংসা-বাক্য উচ্চারিত হতে লাগল।
এই পাঠ শুনে উৎসাহিত হয়ে আন্না পাভলভনার অতিথিরা অনেকক্ষণ ধরে পিতৃভূমির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করল এবং কয়েকদিনের মধ্যেই যে যুদ্ধ হবে তার ফলাফল নিয়ে নানারকম অনুমান করতে লাগল।
আন্না পাভলভনা বলল, ঠিক দেখবেন, আগামীকাল ম্রাটের জন্মদিনেই আমরা খবর পাব। আমার মনের পূর্বাভাস কিন্তু অনুকূল!
.
অধ্যায়-২
আন্না পাভলভনার পূর্বাভাস বাস্তবে রূপায়িত হল। পরদিন সম্রাটের জন্মদিন উপলক্ষে প্রাসাদ-গির্জায় যে প্রার্থনা-অনুষ্ঠান ছিল সেখানে প্রিন্স বলকনস্কিকে গির্জার বাইরে ডেকে এনে প্রিন্স কুতুজভের একটা চিঠি দেওয়া হল। যুদ্ধের দিনেই ততারিনভা থেকে কুতুজভ একটা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। লিখেছে, রুশ সৈন্যরা এক পাও হটে যায়নি, আমাদের চাইতে ফরাসিদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি, আর পুরো তথ্য সগ্রহ না করেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়াতাড়িতে সে এই চিঠি লিখছে। বোঝাই যাচ্ছে যে জয়লাভ হবেই। সঙ্গে সঙ্গে গির্জা ছেড়ে চলে আসার আগেই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো হল তার সহায়তা ও জয়লাভের জন্য।
আন্না পাভলভনার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। সারা সকাল শহরের বুকে একটা সানন্দ উৎসবের হাওয়া বইতে লাগল। সকলেই বিশ্বাস করল যে জয় সম্পূর্ণ হয়েছে, কেউ কেউ নেপোলিয়নের গ্রেপ্তার হওয়া, তার সিংহাসনচ্যুতি এবং ফ্রান্সের নতুন শাসনকর্তা মনোনয়নের কথাও বলতে লাগল।
দরবারের সভাসদদের এই খুশির দুটি কারণ-সম্রাটের জন্মদিনে পাওয়া সংবাদ এবং জয়লাভের ঘটনা। এ যেন একটা সার্থক পরিকল্পনাপ্রসূত বিস্ময়। কুতুজভের প্রতিবেদনে রুশ ক্ষয়-ক্ষতিরও উল্লেখ ছিল; ছিল তুচকভ, ব্যাগ্রেশন ও কুতাসভের নাম। অবশ্য পিটার্সবুর্গ মহলে এই দুঃখজনক ব্যাপারটার একটি মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আলোচনা চলতে লাগল : সেটা কুতাসভের মৃত্যু। প্রত্যেকে তাকে চিনত, সম্রাট তাকে পছন্দ করত, সে ছিল বয়সে নবীন ও আকর্ষণীয়। সেদিন প্রত্যেকের মুখে একটি কথাই শোনা গেল :
কী আশ্চর্য যোগাযোগ! ঠিক প্রার্থনা-অনুষ্ঠানের সময়েই। কিন্তু কুতাসভ কী ক্ষতিটাই না করে গেল। কত যে দুঃখ পেয়েছি!
ভবিষ্যদ্বক্তার গর্ব নিয়ে ভাসিলি বলল, কুতুজভ সম্পর্কে আপনাদের আমি কি বলেছিলাম? আমি আগাগোড়াই বলে এসেছি যে এই একমাত্র লোক যে নেপোলিয়নকে পরাস্ত করতে সক্ষম।
কিন্তু পরের দিন সেনাদল থেকে কোনো সংবাদ এল না। জনসাধারণের মনে উদ্বেগ দেখা দিল। উৎকণ্ঠায় সম্রাটের দুঃখ বাড়তে লাগল; দুঃখ বাড়ল সভাসদদেরও।
সম্রাটের অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন! তারা বলাবলি করতে লাগল; আর আগের দিনের মতো কুতুজভের প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে সম্রাটের এই উৎকণ্ঠার জন্য তাকেই দোষী করল। প্রিন্স ভাসিলিও সেদিন কুতুজভকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করতে পারল না; প্রধান সেনাপতির প্রসঙ্গ উঠলেই চুপ করে থাকল। সন্ধ্যার দিকে আর একটা ভয়ংকর সংবাদ; এই উৎকণ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হল। সেই ভয়ংকর অসুখেই কাউন্টেস হেলেন বেজুখভা হঠাৎ মারা গেছে। বড় বড় জনসমাবেশে সরকারিভাবে সকলেই বলল যে অ্যানজায়না পেক্টোরিসের আক্রমণেই কাউন্টেস বেজুখভার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে বিস্তারিত আলোচনা চলতে লাগল যে স্পেনের রানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিশেষ ফল পাবার জন্য একটি বিশেষ ওষুধ অল্প মাত্রায় খেতে দিয়েছিল; কিন্তু বুড়ো কাউন্ট তাকে সন্দেহ করত বলে এবং স্বামী তার চিঠির কোনো জবাব দিত না বলে (হতভাগ্য, দুশ্চরিত্র পিয়ের) যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে হেলেন হঠাৎ সেই ওষুধটা বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলে এবং তার ফলেই কোনোরকম চিকিৎসার আগেই তীব্র যন্ত্রণায় তার মৃত্যু হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, প্রিন্স ভাসিলি ও বুড়ো কাউন্ট ইতালিয় ডাক্তারটির উপর ক্ষেপে গিয়েছিল, কিন্তু ডাক্তার হতভাগিনী মৃতার এমন সব চিঠি তাদের দেখিয়েছে যে তারা আর এ নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করেনি।
তিনটি দুঃখজনক ঘটনা নিয়েই সর্বত্র আলোচনা চলতে লাগল : সম্রাট কোনো সংবাদ পাচ্ছে না, কুতাসভের মৃত্যু হয়েছে, আর হেলেন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। কুতুজভের প্রতিবেদনের পরবর্তী তৃতীয় দিনে একজন গ্রাম্য ভদ্রলোক মস্কো থেকে এসে পৌঁছলে ফরাসিদের কাছে মস্কোর আত্মসমর্পণের খবর শহরময় রটে গেল। অবস্থা ভয়ংকর! সম্রাটের কী অবস্থা! কুতুজভ বিশ্বাসঘাতক; মেয়ের মৃত্যু উপলক্ষে যারাই প্রিন্স ভাসিলির সঙ্গে দেখা করতে আসছে তাদের কাছেই পূর্বেকার কুতুজভের প্রশংসার কথা ভুলে গিয়ে তার সম্পর্কে সে বলতে লাগল, একটি অন্ধ, অকর্মণ্য বৃদ্ধের কাছ থেকে এছাড়া অন্য কিছু আশা করাই অসম্ভব ছিল।
আমি শুধু এই ভেবে অবাক হই যে এরকম একটা লোকের হাতে রাশিয়ার ভাগ্যকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
যতক্ষণ পর্যন্ত সংবাদটা বেসরকারি স্তরে ছিল ততক্ষণ তবু তাকে সন্দেহ করার একটা সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু পরদিন কাউন্ট রস্তপচিনের কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়া গেল :
প্রিন্স কুতুজভের অ্যাডজুটান্ট আমাকে যে চিঠিটা এনে দিয়েছে তাতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ অফিসাররা যেন সেনাদলকে রিয়াজান রোড ধরে পরিচালিত করেন। তিনি লিখেছেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তিনি মস্কো পরিত্যাগ করে যাচ্ছেন। মহাশয়! কুতুজভের কাজের ফলে রাজধানীর ও আপনার সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ণীত হয়ে গেল! যে নগর রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের কেন্দ্রভূমি, যে নগরে আপনার পিতৃপুরুষের ভস্ম সমাহিত হয়ে আছে, সেই নগর পরিত্যাগের সংবাদ শুনে সারা রাশিয়া শিউরে উঠবে! আমি সেনাবাহিনীকেই অনুসরণ : করব। সবকিছুই সরিয়ে দিয়েছি; এখন পিতৃভূমির ভাগ্যের জন্য অশ্রুজলই আমার একমাত্র সম্বল।
এই চিঠি পেয়ে সম্রাট নিম্নলিখিত আদেশসহ প্রিন্স বলকনস্কিকে কুতুজভের কাছে পাঠাল : প্রিন্স মাইকেল ইলারিয়োনভিচ! ২১শে অগস্টের পরে আপনার কাছ থেকে আর কোনো চিঠি পাইনি, অথচ ১লা সেপ্টেম্বর ইয়ারোস্লাভলের মারফত মস্কোর প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে এই দুঃখজনক সংবাদ আমি পেয়েছি যে আপনি সসৈন্যে মস্কো পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সংবাদের কি প্রতিক্রিয়া আমার উপর হয়েছে তা আপনি নিজেই কল্পনা করতে পারেন; আপনার নীরবতা আমার বিস্ময়কে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সেনাবাহিনীর বর্তমান পরিস্থিতি এবং যে কারণে এই দুঃখজনক সিদ্ধান্ত নিতে আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন সে সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনবার জন্য অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল প্রিন্স বলকনস্কিকে দিয়ে এই চিঠি পাঠালাম।
.
অধ্যায়–৩
মস্কো পরিত্যাগের নদিন পরে সেই ঘটনার সরকারি ঘোষণাপত্র নিয়ে কুতুজভের এক দূত পিটার্সবুর্গে এসে পৌঁছল। ওই ফরাসি দূত মিচদ রুশ ভাষা জানত না; নিজের সম্পর্কে সে বলত, বিদেশী হলেও সে মনে-প্রাণে রুশ।
স্টোন দ্বীপের রাজপ্রাসাদের পাঠকক্ষে সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে দেখা করল। অভিযানের আগে মিচদ কখনো মস্কো দেখেনি, সে রুশ ভাষাও জানে না, তথাপি প্রদগ্ধ মস্কোর আগুনের শিখায় সারা পথ এসে মহামান্য সম্রাটকে মস্কোর ভস্মীভূত হবার কথা জানাতে সে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ল। তার বিষণ্ণ মুখ দেখেই সম্রাট শুধাল, আপনি কি কোনো খারাপ সংবাদ এনেছেন কর্নেল?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ নিচু করে মিচদ বলল, খুব খারাপ খবর মহাশয়। মস্কো পরিত্যক্ত হয়েছে।
সম্রাটের মুখ হঠাৎ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল; সে সঙ্গে সঙ্গে শুধাল, তারা কি বিনা যুদ্ধে আমার রাজধানী ছেড়ে এসেছে?
মিচদ সসম্মানে কুতুজভের বাণীটিই তার কাছে প্রকাশ করল : মস্কোতে যুদ্ধ করা ছিল অসম্ভব; সেনাবাহিনী ও মস্কো দুটোকেই হারানো অথবা শুধু মস্কোকে হারানো মাত্র এই দুটি বিকল্পই সামনে ছিল, আর ফিল্ড-মার্শাল দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছে।
মিচদের দিকে না তাকিয়েই সম্রাট নীরবে তার কথা শুনল।
জানতে চাইল, ফরাসিরা কি নগরে প্রবেশ করেছে?
হ্যাঁ মহাশয়, মস্কো এখন ভস্মে পরিণত হয়েছে। আমি যখন মস্কো ছেড়ে আসি তখন সারা নগর জ্বলছে, দৃঢ়কণ্ঠে মিচদ জবাব দিল, কিন্তু তারপরেই সম্রাটের দিকে তাকিয়ে সে কৃতকর্মের জন্য ভীত হয়ে পড়ল।
সম্রাট শ্বাস টানছে দ্রুত, অতি দ্রুত, তার নিচের ঠোঁটটি কাঁপছে, দুটি নীল চোখ সঙ্গে সঙ্গে জলে ভরে উঠেছে।
কিন্তু সে মুহূর্তের ঘটনা। হঠাৎ তার চোখ ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে উঠল, যেন এই দুর্বলতা প্রকাশের জন্য নিজেকেই দোষী করছে। মাথা তুলে দৃঢ়স্বরে মিচদকে বলল, যা কিছু ঘটছে তা থেকেই বুঝতে পারছি কর্নেল যে আমাদের প্রভূত ত্যাগ স্বীকার করানোই বিধাতার ইচ্ছা।…সর্বব্যাপারে তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে আমি প্রস্তুতঃ কিন্তু মিচদ, আমাকে বলুন, তাদের চোখের সামনে যখন আমার প্রাচীন রাজধানী বিনা যুদ্ধে পরিত্যক্ত হল তখন সেনাদলকে আপনি কি অবস্থায় দেখে এলেন? কোনো সাহসের অভাব কি আপনি লক্ষ্য করেছেন?…
মিচদ যখন দেখল যে মহামান্য নৃপতি শান্ত হয়েছে, তখন সেও শান্ত হল, কিন্তু ম্রাটের সোজাসুজি প্রশ্নের যে সোজাসুজি জবাব দেওয়া দরকার তার জন্য তখনই নিজেকে প্রস্তুত করতে পারল না।
সময় কাটাবার জন্য প্রশ্ন করল, মহাশয়, একজন রাজভক্ত সৈনিকের পক্ষে উপযুক্তভাবে খোলাখুলি কথা বলবার অনুমতি কি আমাকে দেবেন?
সম্রাট জবাব দিল, সবসময় আমি তাই চাই কর্নেল। আমার কাছে কিছুই লুকোবেন না, প্রকৃত অবস্থাটা আমি জানতে চাই।
মনে মনে একটা সদুত্তর তৈরি করে ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে মিচদ বলল, মহাশয়, আমি যখন সেনাদলকে ছেড়ে চলে আসি তখন প্রধানতম ব্যক্তি থেকে নিম্নতম সৈনিকটি পর্যন্ত প্রত্যেককেই দেখেছি এক বেপরোয়া, যন্ত্রণাদীর্ণ আতঙ্কে…
কঠোর ভ্রূভঙ্গিসহকারে সম্রাট তাকে বাধা দিল, সে কি? দুর্ভাগ্য কি আমার রুশ সেনাদলের মনোবলও ভেঙে দেবে?…কখনো না।
নিজের তৈরি-করা কথাগুলি বলার জন্য মিচদ এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল।
সসম্ভ্রমে বলল, মহাশয়, আপনার সরল হৃদয়ের বশে পাছে আপনি সন্ধি করতে সম্মত হন এটাই তাদের একমাত্র ভয়। রুশ জাতির এই প্রতিনিধিটি সগর্বে ঘোষণা করল, যুদ্ধের জন্য এবং তারা যে আপনার প্রতি কত অনুরক্ত, নিজেদের জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করবার জন্য তাদের বুকের মধ্যে আগুন জ্বলছে…।
আঃ। পরম নিশ্চিন্ত হয়ে দুচোখে মমতার আলো ফুটিয়ে সম্রাট মিচদের কাঁধটা চাপড়ে দিল। আপনি আমাকে বড়ই স্বস্তি দিলেন কর্নেল।
মাথা নিচু করে সম্রাট কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপরেই সোজা হয়ে বসে মিচদকে উদ্দেশ করে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল, বেশ, তাহলে সেনাদলে ফিরে যান; যেখানেই যাবেন সেখানেই আমার সাহসী সৈনিক ও ভালো মানুষ প্রজাদের বলবেন, যখন আর একটি সৈনিকও অবশিষ্ট থাকবে না তখন আমি স্বয়ং আমার প্রিয় অভিজাত সম্প্রদায় ও চাষীদের নেতৃত্ব দেব, আমার সাম্রাজ্যের শেষ শক্তিটুকুকেও কাজে লাগাব। ক্রমাগত উজ্জীবিত হয়ে সম্রাট বলতে লাগল, আমার দেশ যে এখনো আমাকে কী দিতে পারে সে ধারণা শত্রুর নেই। আবেগোচ্ছল সুন্দর চোখ দুটি আকাশের দিকে তুলে বলল, কিন্তু বিধাতার যদি এই বিধান হয় যে আমার পিতৃ পুরুষের সিংহাসনে আমার বংশধররা আর বসবে না, তাহলে আমার যথাসর্বস্ব নিঃশেষ করে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত দাড়ি গজিয়ে (বুকের অর্ধেকটা পর্যন্ত দেখাল) আমার দীনতম প্রজার সঙ্গে একসাথে বসে শুধু আলু খাব, তবু আমার দেশের এবং আমার প্রিয় মানুষদের অসম্মানে স্বাক্ষর করব না।
উত্তেজিত কণ্ঠে এই কথাগুলি বলে বুঝি বা নিজ চোখের উদাত অশ্রুকে মিচদের কাছ থেকে লুকোবার জন্যই সম্রাট সহসা মুখটা ঘুরিয়ে ঘরের এক কোণে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সম্রাট মিচদের কাছে ফিরে গেল এবং তার কনুই-এর নিচে ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। সম্রাটের সুদর্শন মুখখানি লাল হয়ে উঠেছে; দৃঢ় সংকল্পে ও ক্রোধে চোখ দুটি জ্বলছে।
কর্নেল মিচদ, আজ যা বললাম সেকথা ভুলে যাবেন না, হয়তো একদিন আনন্দের সঙ্গে কথাগুলি আমরা স্মরণ করতে পারব…হয় নেপোলিয়ন, না হয় আমি, বুকে হাত দিয়ে সম্রাট বলল, দুজন একসঙ্গে আর আমরা রাজত্ব করতে পারি না। তাকে আমি চিনতে পেরেছি; সে আমাকে আর ঠকাতে পারবে না…
ভুরু কুঁচকে সম্রাট থামল।
এইসব কথা শুনে এবং সম্রাটের চোখে দৃঢ় সংকল্পের আভাস দেখে মিচদ-বিদেশী হলেও যে মনে-প্রাণে রুশ-সেই মহামুহূর্তটিকে অনুভব করল যে কথাগুলি তাকে সম্মোহিত করেছে, এবং যে রুশ জাতির প্রতিভূ বলে সে নিজেকে মনে করে তাদের এবং নিজের মনোভাবকে নিম্নোক্ত ভাষায় প্রকাশ করল;
মহাশয়! এই মুহূর্তে ইয়োর ম্যাজেস্টি স্বাক্ষর করলেন জাতির গৌরব ও ইওরোপের মুক্তির দলিলে!
মাথাটা কাত করে সম্রাট তাকে বিদায় দিল।
.
অধ্যায়-৪
আমরা যারা সেইসব দিনগুলিতে বেঁচে ছিলাম না তাদের পক্ষে এটা কল্পনা করা স্বাভাবিক যে অর্ধেক রাশিয়া যখন বিজিত হয়েছে, তার অধিবাসীরা যখন দূর দূর দেশে পালিয়ে যাচ্ছে, পিতৃভূমি রক্ষার জন্য যখন একটার পর একটা বাধ্যতামূলক সেনাদল গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন উচ্চতম থেকে নিম্নতম মর্যাদার সমস্ত রুশ অধিবাসী নিজেদের বিসর্জন দিচ্ছে, পিতৃভূমিকে রক্ষা করছে, আর না হয়তো তার পতনে চোখের জল ফেলছে। সে সময়কার কাহিনী ও বিবরণে ব্যতিক্রমবিহীনভাবে শুধুমাত্র রুশদের আত্মত্যাগ, দেশাত্মবোধ, হতাশা, দুঃখ, বীরত্বের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটা সেরকম ছিল না। আমাদের কাছে সেইরকমই মনে হয় কারণ আমরা শুধু দেখি তঙ্কালীন ঐতিহাসিক স্বার্থ, সমকালীন মানুষের যেসব ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল সেদিকে নজর দেই না। অথচ বাস্তবক্ষেত্রে সেই মুহূর্তের ব্যক্তিগত স্বার্থগুলি সাধারণ স্বার্থকে এত বেশি মাত্রায় ছাড়িয়ে যায় যে তার ফলে সাধারণ স্বার্থগুলিকে আমরা না পারি বুঝতে, না পারি দেখতে। তৎকালীন অধিকাংশ মানুষই ঘটনার সাধারণ অগ্রগতির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে, আর তকালে তাদের কার্যকলাপই ছিল সবচাইতে দরকারি।
যারা সাধারণ ঘটনাপ্রবাহকে বুঝতে এবং আত্মত্যাগ ও বীরত্বের সঙ্গে তাতে অংশ নিতে চেষ্টা করল, তারা সবকিছুকেই দেখল উল্টো করে, আর সাধারণের ভালোর জন্য যা কিছু করল সবই অদরকারি ও নির্বোধের কাজ হয়ে দেখা দিল-যেমন পিয়ের ও মমোনভ-এর রেজিমেন্টগুলি রুশ গ্রামগুলিতে লুঠতরাজ চালাল, আর তরুণীরা ঘরে ঘরে যেসব ব্যান্ডেজ তৈরি করল তা কোনোদিন আহতদের কাছে পৌঁছল না, ইত্যাদি। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে জ্ঞান বৃক্ষের ফলভক্ষণের উপর যে নিষেধাজ্ঞা প্রচলিত আছে সেটাই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। একমাত্র অচেতন কাজকর্মগুলিই ফলপ্রসূ হয়, আর যে মানুষ ঐতিহাসিক ঘটনায় অংশগ্রহণ করে সে কদাপি তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। সে চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়।
তৎকালীন রাশিয়ার ঘটনাবলীর সঙ্গে যে মানুষ যত বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল তার তাৎপর্য সে তত কম বুঝেছে। পিটার্সবুর্গে এবং মস্কো থেকে অনেক দূরবর্তী প্রদেশগুলিতে মহিলা ও অসামরিক ইউনিফর্মধারী ভদ্রজনরা রাশিয়া ও তার রাজধানীর জন্য চোখের জল ফেলল, আত্মত্যাগের কথা বলল; কিন্তু যে সেনাবাহিনী মস্কো ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা মস্কো নিয়ে কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনা থোরাই করেছিল; মস্কোর অগ্নিদগ্ধ ধ্বংসাবশেষ আবার যখন তাদের দৃষ্টিগোচর হল তখন ফরাসিদের উপর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা কেউ নিল না, বরং তারা শুধু ভেবেছিল নিজেদের বেতন, বাসস্থান, মদবিক্রিকারিণী মাত্ৰিস্কা ও অন্য সব অনুরূপ কথা।
যুদ্ধের চাকরিতে লিপ্ত হবার পরে নিকলাস রস্তভও দেশরক্ষার কাজে ঘনিষ্ঠভাবে দীর্ঘদিন ধরে অংশ নিল, কিন্তু তার মনে আত্মত্যাগের কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় রাশিয়ার ঘটনাবলীকে সে দেখেছে নৈরাশ্যহীনভাবে, আর তা নিয়ে সে নিজে কোনোরকম মাথাও ঘামায়নি। তার বক্তব্য, মাথা ঘামাবার জন্য তো কুতুজভ ও অন্যরাই রয়েছে।
এইরকম মানসিক অবস্থার মধ্যেই সে জানতে পারল যে তার ডিভিশনের জন্য ঘোড় কিনতে তাকে ভরোনেঝ পাঠানো হবে। খবর পেয়ে যুদ্ধে যোগনো দিতে না পারার জন্য কোনোরকম দুঃখ তো তার হলই না, বরং সে খুব খুশিই হল; আর সেকথা সে গোপনও করল না।
বরদিনোর যুদ্ধের কয়েকদিন আগে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা ও ক্ষমতাপত্র হাতে পেয়ে কয়েকজন হুজারকে আগাম পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ডাক-ঘোড়ার সঙ্গে ভরোনেঝ যাত্রা করল।
সেনাদল কর্তৃক অশ্বাদি পশুর খাদ্যসংগ্রহের কার্যকলাপ, খাদ্যবাহী ট্রেনের চলাচল ও হাসপাতালসমাকীর্ণ অঞ্চল থেকে দূরে চলে যেতে পারার কী অপার আনন্দ যে নিকলাস পেল তা শুধু সেই বুঝবে যার নিজের সে অভিজ্ঞতা হয়েছে–অর্থাৎ একাদিক্রমে কয়েকটা মাস যাকে কাটাতে হয়েছে অভিযান ও যুদ্ধের পরিবেশের মধ্যে। সৈন্য, মালগাড়ি ও শিবিরের নোংরা পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে সে যখন গ্রামের মধ্যে পৌঁছে গেল, দেখতে পেল চাষী স্ত্রী-পুরুষ, ভদ্র লোকদের পল্লীভবন, মাঠে মাঠে গরু-মোষ চরছে, ডাকঘরে স্টেশন মাস্টাররা ঘুমচ্ছে, তখন তার এত আনন্দ হল যেন এসব বস্তু সে এই প্রথম দেখছে। অনেক সময় পর্যন্ত যা তাকে বিশেষভাবে বিস্মিত ও আনন্দিত করল তা হল–স্বাস্থ্যবতী তরুণীদের পিছনে ডজন-ডজন অফিসার এখানে ঘুরঘুর করছে না; বরং একজন অফিসার পথে যেতে যেতে তাদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করায় তারা বেশ খুশিই হচ্ছে।
খুব খুশি মনে রাতের বেলা নিকলাস ভরোনেঝ-এর একটা হোটেলে উঠল, শিবির-জীবনে অনেকদিন যেসব জিনিস পায়নি তার হুকুম দিল, এবং পরদিন পরিষ্কার করে কামিয়ে অনেকদিন পরে পুরো ইউনিফর্ম পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেল।
বেসামরিক বাহিনীর কমান্ডার একজন বৃদ্ধ জেনারেল; নিজের সামরিক খেতাব ও পদমর্যাদায় খুব খুশি। বেশ গুরু-গম্ভীর ভঙ্গিতে সে নিকলাসের কাছ থেকে যুদ্ধের খবরাখবর জেনে নিল। নিকলাসও খোশ মেজাজে ছিল বলে তার এই ব্যবহারে সেও বেশ মজাই পেল।
সেখান থেকে সে গেল শাসনকর্তার কাছে। লোকটি ছোটখাট, সরল, অমায়িক। নিকলাসকে একটা আস্তাবলের খবর দিল, শহরের একজন অশ্বব্যবসায়ী ও শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরের জনৈক ঘোড়ার মালিক জোতদারের নাম বলে দিল এবং সর্বপ্রকারে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিল।
বিদায় দেবার সময় শাসনকর্তা বলল, আপনি কাউন্ট ইলিয়া রস্তভের ছেলে? আমার স্ত্রী আপনার মার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার আমরা সকলে মিলিত হই-আজই তো বৃহস্পতিবার, কাজেই দয়া করে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন।
সেখান থেকে ফিরেই ডাক-ঘোড়া ভাড়া করে, স্কোয়াড্রন কোয়ার্টার-মাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে নিকলাস চৌদ্দ মাইল দূরের জোতদার ভদ্রলোকের বাড়ির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
জোতদার ভদ্রলোক অবিবাহিত, প্রাক্তন অশ্বারোহী সৈনিক, অশ্বানুরাগী, ক্রীড়াবিদ; বেশ কিছু একশ বছরের পুরনো ব্র্যান্ডি ও কিছু পুরনো হাঙ্গেরীয় মদের মালিক।
সামান্য কথাবার্তার পরেই নিকলাস ছহাজার রুবল দামে সতেরোটি বাছাই ঘোড়া কিনে ফেলল। আহারাদির পরে একটু বেশি মাত্রায় হাঙ্গেরীয় মদ পেটে ঢেলে নিকলাস বিদায় নিল। এর মধ্যেই লোকটির সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বিদায়ের আগে পরস্পরকে চুমো খেয়ে নিকলাস সেই শোচনীয় রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে দিল। কোচয়ানকে বারবার তাগাদা দিতে লাগল যাতে যথাসময়ে শাসনকর্তার মজলিসে পৌঁছনো যায়।
পোশাক ছেড়ে, মাথায় জল ঢেলে, আতর মেখে নিকলাস যখন শাসনকর্তার বাড়িতে পৌঁছল তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে; ঢুকতে ঢুকতেই বলল, একেবারে না আসার চাইতে দেরিতে আসাও ভালো।
বলনাচের আসর নয়, নাচের কথা ঘোষণাও করা হয়নি, কিন্তু সকলেই জানে যে ক্যাথারিন পেত্ৰভনা ক্ল্যাভিকর্ডে ভালস ও একোসাস বাজাবে, নাচও হবে; তাই সকলেই সেজন্য তৈরি হয়েই এসেছে।
১৮১২ সালের মফঃস্বলের জীবনযাত্রা যথাপূর্বভাবেই চলেছে; শুধু তফাতের মধ্যে মস্কো থেকে অনেক সম্পন্ন পরিবার সেখানে চলে আসায় জীবনযাত্রা অধিকতর প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে এবং রাশিয়ার অন্য সব জায়গার মতোই একটা বিশেষ রকমের বেপরোয়া যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন ভাব দেখা দিয়েছে; ফলে সাধারণ কথাবার্তায় আবহাওয়া ও কুশল-বিনিময়ের পরিবর্তে স্থান পেয়েছে মস্কো, সেনাদল ও নেপোলিয়ন।
ভরোনেঝের সেরা মানুষরাই শাসনকর্তার বাড়িতে জমায়েত হয়েছে।
হুজার ইউনিফর্মে সজ্জিত হয়ে চারদিকে আতর ও মদের সুগন্ধ ছড়িয়ে যেমুহূর্তে নিকলাস ঘরে ঢুকল এবং মুখে উচ্চারণ করল একেবারে না আসার চাইতে বিলম্বে আসাও ভালো আর অন্য অনেকের মুখে কথাটার পুনরাবৃত্তি হল, সঙ্গে সঙ্গেই সকলে তাকে ঘিরে ধরল; সকলেরই দৃষ্টি তার উপর। নিকলাসের মন বলল, এখানে এসে যথাযোগ্য স্থানটি সে পেয়েছে–সকলেরই প্রিয়পাত্র হয়েছে : দীর্ঘ কৃসাধনের পরে এ পরিস্থিতি বড়ই মনোরম, একেবারে নেশা ধরিয়ে দেবার মতো। ডাক-ঘাঁটিতে, সরাইখানায়, জোতদারের ঘরে–সর্বত্রই কুমারীরা তাকে দর্শন করে কৃতার্থ হয়েছে; এখানে শাসনকর্তার মজলিসেও বিবাহিত-অবিবাহিত অসংখ্য সুন্দরী তরুণী একটুখানি চোখের চাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রথম দিনেই নারী ও বালিকারা তার সঙ্গে হাসি-খেলায় মেতেছে, আর এই সুদর্শন বেপরোয়া হুজার যুবকটিকে কেমন করে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করা যায় তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। তাদের মধ্যে শাসনকর্তার স্ত্রীও একজন; সে তো প্রথম থেকেই প্রস্তভকে নিকট আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করে তাকে নিকলাস বলে ডাকতে শুরু করেছে।
সত্যি সত্যি ক্যাথারিন পেত্ৰভনা ভালস ও একোসাস বাজাল এবং নাচও চলল। সে নাচে অংশ নিয়ে নিকলাস তার সাবলীল দেহভঙ্গিতে মফঃস্বল শহরটিকে আরো বেশি মুগ্ধ করে ফেলল। এমন কি নিকলাস নিজেও সে রাতে নিজের নাচ দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এত ভালো তো সে মস্কোতেও কোনো দিন নাচেনি।
সারা সন্ধ্যা নিকলাসের মনোযোগ কেড়ে নিল একটি নীলনয়না, মোটা-সোটা, মনোরমা সুন্দরী; মফঃস্বলের জনৈক পদস্থ অফিসারের স্ত্রী। অপর লোকের সব স্ত্রীরাই যুবকদের জন্য সৃষ্ট হয়েছে-খুশি-খুশি যুবক-মনের এই সরল প্রত্যয়ের বশেই রস্তভ কখনো সেই মহিলাটির সঙ্গ ছাড়ল না, আর তার স্বামীর সঙ্গে এমন ভাব জমিয়ে তুলল যে মুখে না বললেও তারা দুজনেই বুঝতে পেরেছে যে নিকলাস ও এই মহিলাটির মধ্যে ভাবটা বেশ জমবে। স্বামীটি কিন্তু মোটেই এ প্রত্যয়ের অংশীদার হল না; অতীব বিষণ্ণভাবেই সে । রস্তভের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল। কিন্তু নিকলাসের দিলখোলা ব্যবহার এতই বাঁধ-ভাঙা হয়ে দেখা দিল যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে বারকয়েক নিকলাসের হাসি-তামাশায় যোগ দিতে হল। সন্ধ্যার শেষের দিকে অবশ্য স্ত্রীর মুখ যতই রক্তিম ও উচ্ছ্বসিত হতে লাগল, স্বামীটির মুখ ততই বিষণ্ণ ও গম্ভীর হতে থাকল; যেন তাদের দুজনের জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রাণ-শক্তির বরাদ্দ আছে, আর তাই স্ত্রীর প্রাণ-শক্তি যত বাড়তে থাকে, স্বামীর প্রাণ-শক্তি ততই হ্রাস পায়।
.
অধ্যায়-৫
নিকলাস একটা হাতল-চেয়ারে ঈষৎ ঝুঁকে বসেছে সুন্দরী মহিলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে; মুখের হাসিটি অক্ষুণ্ণ রেখে মহিলাটির পৌরাণিক যুগসুলভ স্তুতিভাষণে মুখর হয়ে উঠেছে।
আঁটো রাইডিং-ব্রিচেস পরা পা দুটিকে নাচাতে নাচাতে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে নিকলাস জানাল, এই ভরোনেঝের একটি মহিলাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার তার বড় সাধ।
কোন মহিলা?
মহিলা মনোরমা, স্বর্গীয়া। চোখ দুটি নীল, মুখখানি প্রবাল ও হস্তিদন্তের মিশ্রণ, আর ডায়ানার দেহসৌষ্ঠব…।
স্বামীটি এগিয়ে এসে বিষণ্ণকণ্ঠে জানতে চাইল, সে কি বিষয়ে কথা বলছে।
আরে, নিকিতা আইভানিচ! সবিনয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিকলাস চেঁচিয়ে বলল; তারপর যেন নিকিতা আইভানিচকে তার ঠাট্টার অংশীদার করার বাসনায়ই তাকে জানাল যে একটি সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবে।
দুজনই হেসে উঠল–স্বামী বিষণ্ণভাবে, স্ত্রী খুশিতে। শাসনকর্তার ভালোমানুষ স্ত্রীটি অসম্মতিসূচক দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এল।
আন্না ইগনাতয়েভনা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন নিকলাস। চলে এস। তুমি তো জান, তোমাকে নাম ধরে ডাকবার অধিকার তুমিই আমাকে দিয়েছ।
তা তো বটেই মাসি। কিন্তু তিনিটি কে?
আন্না ইগনাতয়েভনা মালভিসেভা। তার কোন বোনঝিকে তুমি নাকি বাঁচিয়েছ…মনে করতে পার কি?
আমি তো অনেককেই বাঁচিয়েছি! নিকলাস বলল।
তার বোনঝির নাম প্রিন্সেস বলকনস্কয়া। সেও মাসির সঙ্গে ভরোনেঝ এসেছে। ও হো! তোমার মুখটা দেখছি লাল হয়ে উঠেছে। সেকি, তুমি কি তাহলে…
দাঁড়ান! দয়া করে ওভাবে কথা বলবেন না মাসি!
ঠিক আছে ঠিক আছে!…আ, আচ্ছা মানুষ বটে তুমি!
শাসনকর্তার স্ত্রী তাকে একটি লম্বা, মজবুত গড়নের বৃদ্ধা মহিলার কাছে নিয়ে হাজির করল। মহিলাটির মাথায় নীল ওড়না, শহরের গণ্যমান্যদের সঙ্গে সবে তাস খেলা শেষ করেছে। এই মহিলাটিই মালভিসেভা, প্রিন্সেস মারির মাসি; ধনবতী নিঃসন্তান বিধবা, ভরোনেঝেই থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তাস খেলার হিসেব নিকাশ করছিল। যে জেনারেলটি তার কাছ থেকে অনেক টাকা জিতে নিয়েছে তাকে তিরস্কার করতে করতেই সে চোখ তুলে কড়া চোখে তাকাল।
নিকলাসের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, খুব খুশি হলাম বাবা, দয়া করে বাড়িতে এসে দেখা করো।
প্রিন্সেস মারি, তার স্বর্গত পিতা ও প্রিন্স আন্দ্রুর খোঁজখবর নেবার পরে আর একবার নিকলাসকে তার বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে মহিলাটি তাকে ছেড়ে দিল।
মালভিসেভার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিকলাস আবার নাচে যোগ দিতেই যাচ্ছিল, এমন সময় শাসনকর্তার স্ত্রীটি এসে তার আস্তিনে হাত রেখে বলল যে তার সঙ্গে সে কিছু কথা বলতে চায়; তারপর তাকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই সেখানে অন্য যারা ছিল তারা বেরিয়ে গেল।
মমতাভরা ছোট মুখখানিতে গাম্ভীর্যের ভাব এনে শাসনকর্তার স্ত্রী বলতে শুরু করল, তুমি কি জান বাবা যে সেই হবে তোমার উপযুক্ত পাত্রী : ব্যবস্থা করে ফেলব কি?
আপনি কি বলতে চাইছেন মাসি? নিকলাস শুধাল।
প্রিন্সেসের সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেব। ক্যাথারিন পেত্ৰভনা অবশ্য লিলির কথাই বলছে, কিন্তু আমি বলেছি, না–প্রিন্সেস! ব্যবস্থা করে ফেলি, কি বল? আমি জানি, তোমার মা এজন্য আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। সত্যি, মেয়েটি খুবই মনোরমা! আর একেবারে সাদাসিধেও নয়।
মোটেই না, নিকলাস সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল। কি বলছে সেটা না বুঝেই বলে উঠল, তবেই কি জানেন মাসি, একজন সৈনিক হিসেবে নিজেকে কারো উপর চাপিয়ে দিতেও চাই না, আবার ফিরিয়ে দিতেও চাই না।
ঠিক আছে; মনে রেখ যে এটা তামাশা নয়!
মোটেই না!
ঠিক, ঠিক, যেন নিজের মনেই শাসনকর্তার স্ত্রী বলল। কিন্তু বাবা, একটা কথা, আর যাই হোক ওই সুন্দরীটির প্রতি তুমি বড় বেশি মনোযোগ দিচ্ছ। সত্যি, স্বামীটির জন্য দুঃখ হয়…
সরল মনে নিকলাস বলল, না, না ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। তার মাথায় এটা ঢুকল না যে তার কাছে যেটা মজার খেলা, অন্যের কাছে সেটা মজার ব্যাপার নাও হতে পারে।
আহারের সময় হঠাৎ নিকলাসের মনে হল, শাসনকর্তার স্ত্রীকে কী সব বাজে কথা বলে দিলাম। তিনি হয়তো সত্যি সত্যি বিয়ের ব্যবস্থা করে বসবেন…আর সোনিয়া…? বিদায় নেবার সময় শাসনকর্তার স্ত্রী যখন আর একবার হেসে বলল, তাহলে মনে থাকে যেন! তখন নিকলাস তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল।
দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি মাসি…
কি ব্যাপার বাবা? এস, এখানেই বসা যাক।
সহসা নিকলাসের মনে হল, এই অপরিচিতা নারীটির কাছে তার অত্যন্ত গোপন কথাগুলি (যা সে তার মা, বোন, বা বন্ধুর কাছেও বলেনি,) বলা দরকার। পরবর্তীকালে এই ঘটনাটি মনে পড়লেই সেভাবে নেহাৎ খেয়ালের বশেই সে খোলাখুলিভাবে কথাগুলি বলেছিল : অথচ সেই দিলখোলা মনের উস ও আরো কিছু তুচ্ছ ঘটনা মিলে তার ও তার পরিচারের সকলের উপর একটা প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কি জানেন মাসি, মামণির অনেক দিনের ইচ্ছা যে আমি একটি ধনবতী উত্তরাধিকারিণীকে বিয়ে করি, কিন্তু টাকার জন্য বিয়ে করার ব্যাপারটাই আমার কাছে ঘৃণাই বলে মনে হয়।
আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি, শাসনকর্তার স্ত্রী বলল।
কিন্তু প্রিন্সেস বলকনস্কয়ার ব্যাপারটা আলাদা। সত্য কথাই আপনাকে বলব। প্রথমত, আমি তাকে খুব পছন্দ করি, তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করি; তার উপরে এই পরিস্থিতিতে এমন অদ্ভুতভাবে তার সঙ্গে দেখা হবার পরে আমার তো প্রায়ই মনে হয়েছে : এটাই নিয়তি। বিশেষ করে যদি মনে রাখেন যে মামণি অনেকদিন থেকেই এটা ভাবছে; কিন্তু আগে তো কখনো তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি; যেভাবেই হোক না কেন দেখাসাক্ষাটা ঘটে ওঠেনি। যতদিন পর্যন্ত আমার বোনের সঙ্গে তার দাদার বিয়ের কথা ছিল ততদিন অবশ্য তাকে বিয়ে করার কথা ভাবার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আর কী আশ্চর্য, নাতাশার বিয়েটা ভেঙে যাওয়া মাত্রই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল…আর সবকিছুই…কাজেই বুঝতেই পারছেন…আপনাকে ছাড়া আর কাউকে একথা বলিনি, কোনোদিন বলবও না।
শাসনকর্তার স্ত্রী সকৃতজ্ঞভাবে তার কনুইটা চেপে ধরল।
আমার জ্ঞাতি বোন সোনিয়াকে আপনি জানেন? আমি তাকে ভালোবাসি, বিয়ে করব বলে কথা দিয়েছি, বিয়ে করবও…কাজেই বুঝতেই পারছেন ও বিয়ের কোনো প্রশ্নই… মুখ লাল করে নিকলাস অসংলগ্নভাবে কথাগুলি বলল।
এটা কীরকম দৃষ্টিভঙ্গি বাবা! তুমি তো জান সোনিয়া নিঃসম্বল, আর তুমি নিজেই বলছ যে তোমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। আর তোমার মা? এ যে হবে তার মৃত্যুর সামিল। এই গেল এক দিক। আর সোনিয়ার জীবনটাই বা কি রকম হবে-যদি তার হৃদয় বলে কোনো পদার্থ থাকে? তোমার মা হতাশায় ভেঙে পড়বে, তোমরা সকলে সর্বস্বান্ত হবে…না বাবা, তোমার ও সোনিয়ার এটা বোঝা উচিত।
নিকলাস চুপ করে রইল। যুক্তিগুলো শুনতে তার ভালো লাগল।
একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, যে-কোনো অবস্থাযই এটা অসম্ভব মাসি। তাছাড়া, প্রিন্সেসই কি আমাকে গ্রহণ করবে? আরো কথা, এখন তো তার শোকের সময়। এ সময় কি ওসব কথা ভাবা যায়!
শাসনকর্তার স্ত্রী জবাব দিল, কিন্তু তুমি কি ভাবছ যে আমি এখনই তোমার বিয়ে দিচ্ছি। সব কাজেরই তো একটা সঠিক সময় আছে।
তার হাতটায় চুমো খেয়ে বলল, কী ভাবল ঘটকী আপনি মাসি…
.
অধ্যায়-৬
রস্তভের সঙ্গে দেখা হবার পরে মস্কো পোঁছে প্রিন্সেস মারি দেখল তার ভাইপো এবং তার শিক্ষক সেখানেই আছে, আর প্রিন্স আন্দ্রুর একটা চিঠি পেল যাতে কীভাবে তার মাসি মালভিসের সঙ্গে ভরোনেঝে দেখ করা যাবে সেই নির্দেশ জানানো হয়েছে।
প্রলোভনের সামিল যে অনুভূতি বাবার অসুখের সময় তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, তার মৃত্যুর পর থেকে, বিশেষ করে রস্তভের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে যাত্রার আয়োজন, দাদার জন্য উৎকণ্ঠা, নতুন বাড়িতে সংসার পাতা, নতুন লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা, এবং ভাইপোর লেখাপড়ার দিকে নজর রাখা, প্রভৃতি নানা কাজে সে অনুভূতি যেন চাপাই পড়ে গিয়েছিল। এখন শান্ত পরিবেশে একটি মাস কাটাবার পরে সে আবার নতুন করে বাবাকে হারাবার দুঃখ এবং তার সঙ্গে জড়িত রাশিয়ার সর্বনাশের বেদনা অনুভব করছে। আপনজন বলতে তার তো এখন একমাত্র দাদাই অবশিষ্ট আছে; তাই তার বিপদের আশংকায় সে এখন অনবরত উত্তেজনা ও যন্ত্রণা বোধ করছে। সে যে ভাইপোটির লেখাপড়া ভালোভাবে চালাতে পারছে না তা নিয়েও তার দুশ্চিন্তার অবধি নেই-তথাপি অন্তরের গভীরে সে এখন শান্তি পেয়েছে-রস্তভের সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে যেসব ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও বাসনা তার মধ্যে জেগে উঠছিল তাদের স্তব্ধ করে দিতে পারার চেতনা থেকেই সে শান্তির উদ্ভব।
শাসনকর্তার স্ত্রী পরদিনই মালভিসেভার কাছে গিয়ে হাজির হল এবং মাসির সঙ্গে তার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শেষ করে বলল, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক বাকদানের কথা ভাবাও যায় না, তবু দুটি যুবক-যুবতাঁকে এমনভাবে কাছাকাছি আনা দরকার যাতে তারা পরস্পরকে বুঝতে পারে। মালভিসেভা সম্মতি জানালে শানসকর্তার স্ত্রী মারির সামনেই রশুভের কথা বলতে শুরু করে দিল; তার প্রশংসা করল, প্রিন্সেস মারির নাম উল্লেখ করামাত্রই যে তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল সেকথাও বলল। প্রিন্সেস মারির মনে কিন্তু আনন্দের বদলে দেখা দিল বিষাদ-তার মনের শান্তি নষ্ট হল, নতুন করে দেখা দিল বাসনা, সন্দেহ, আত্ম ধিক্কার ও আশা।
রস্তভ আসার আগের দুটি দিন প্রিন্সেস মারি অবিরাম ভাবতে লাগল, সে এলে তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবে। একবার ভাবল সে যখন মাসির সঙ্গে দেখা করবে তখন সে নিজে বৈঠকখানায় যাবেই না, কারণ এই শোকের সময় কোনো অতিথির সঙ্গে দেখা করা তার পক্ষে উচিত হবে না; আবার ভাবল, সে মানুষটি তার জন্য যা করেছে তার পরে সেটা তার প্রতি খুবই রূঢ় আচরণ হবে।
কিন্তু রবিবারে গির্জা থেকে আসার পরে পরিচারক যখন বৈঠকখানায় এসে জানাল যে কাউন্ট রস্তভ এসেছে, তখন প্রিন্সেস মোটেই বিচলিত বোধ করল না, শুধু তার গালে লাগল একটু রঙের ছোঁয়া, চোখ দুটি খুশিতে ঝলমল করে উঠল।
রস্তভ ঘরে ঢুকলে প্রিন্সেস একমুহূর্তের জন্য চোখ দুটি নামিয়ে নিল যাতে অতিথি মাসির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়; তারপরেই নিকলাস তার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই সে মাথাটা তুলে চকচকে চোখে তার দিকে তাকাল। মর্যাদা ও কমনীয়তার সঙ্গে মুখে খুশির হাসি ফুটিয়ে সে অর্ধেক উঠে দাঁড়াল, সুন্দর হাতখানি বাড়িয়ে দিল, আর এমন স্বরে কথা বলতে লাগল যাতে এই প্রথম লাগল নারীত্বের প্রথম স্পন্দন। মাদময়জেল বুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাল। সে নিজে প্রেমকলায় যথেষ্ট পারদর্শিনী, তবু যে পুরুষকে আকর্ষণ করতে চায় তার সঙ্গে দেখা হলে সে নিজেও এর চাইতে ভালোভাবে ব্যাপারটাকে সামাল দিতে পারত না।
হয় কালো রংটা তাকে বিশেষভাবে মানায়, অথবা আমার অজান্তেই সে প্রভূত উন্নতি করে ফেলেছে। মাদময়জেল বুরিয়ে ভাবল।
সেই মুহূর্তে প্রিন্সেস মারির যদি চিন্তা করার ক্ষমতা থাকত তাহলে নিজের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে সে হয়তো মাদময়জেল বুরিয়ে অপেক্ষাও বেশি আশ্চর্য হত। সেই পরিচিত প্রিয় মুখখানিকে চেনামাত্রই একটা নতুন জীবনীশক্তি যেন তাকে পেয়ে বসল, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে কথা বলতে ও কাজ করতে বাধ্য করল। রস্তভ ঘরে ঢুকতেই তার মুখটা সহসা বদলে গেল। যেন একটা খোদাই-করা চিত্রিত লণ্ঠনের আলো হঠাৎ জ্বেলে দেওয়া হল, আর সহসা যা কিছু এতক্ষণ ছিল অন্ধকার, স্কুল ও অর্থহীন, তাই প্রকাশ পেল অপ্রত্যাশিত ও উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্যে। যে পবিত্র, আত্মিক ও আন্তরিক বেদনার ভিতর দিয়ে এতকাল সে চলে এসেছে তার যেন এই প্রথম বাইরে প্রকাশ পেল।
রস্তভের চোখেও এসবই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল, যেন সেও তার সারা জন্মের চেনা। রশুভের মনে হল, যে মানুষটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে তার পরিচিত অন্য সকলের চাইতে স্বতন্ত্র ও ভালো, এমন কি তার নিজের চাইতেও ভালো।
কথাবার্তা যা হল তা খুবই সরল ও সাধারণ। যুদ্ধ নিয়ে কথা হল, আর অন্য সকলেরই মতোই তা নিয়ে নিজেদের দুঃখকে তারা অযথা বাড়িয়ে বলল; তাদের শেষ দেখা, শাসনকর্তার স্ত্রী, নিকলাসের আত্মীয়স্বজন এবং প্রিন্সেস মারির কথা নিয়েও তারা আলোচনা করল।
আলোচনার ফাঁকে একসময় নিকলাস প্রিন্স আন্দ্রুর ছোট্ট ছেলেটির দিকে নজর দিল, তাকে আদর করে জানতে চাইল সে একজন হুজার হতে চায় কিনা। ছেলেটিকে হাঁটুর উপর বসিয়ে তার সঙ্গে খেলা করতে করতে প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাল। যে শিশুটিকে সে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসার মানুষটির কোলে দেখে প্রিন্সেস মারি সুখী, ভীরু চোখে সেইদিকে তাকিয়ে রইল। নিকলাসও সেটা বুঝতে পেরে খুশিতে লাল হয়ে খেলার ছলে শিশুটিকে চুমো খেতে লাগল।
শোকের সময় চলছে বলে প্রিন্সেস মারি সমাজে বের হয় না, আর নিকলাসও পুনরায় তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা উচিত বলে মনে করছে না; অবশ্য গভর্নরের স্ত্রী তার ঘটকালির কাজ চালিয়েই যাচ্ছে প্রিন্সেস মারির স্তুতি-বাক্যগুলি পৌঁছে দিচ্ছে নিকলাসের কানে, আর তার স্তুতি-বাক্য পৌঁছে দিচ্ছে প্রিন্সেসের কানে, আর নিকলাসকে বার বার বলছে বিয়ের কথা ঘোষণা করতে। সেজন্য মাস-অনুষ্ঠানের আগে বিশপের বাড়িতে দুজনের সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করল।
রস্তভ শাসনকর্তার স্ত্রীকে বলল সে প্রিন্সেস মারিকে বিয়ের কথা কিছু বলবে না, কিন্তু সেখানে যাবে।
তিলসিটে যেমন সকলে যা ঠিক বলে মনে করেছে তাতে রস্তভ কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশ করেনি, এখানেও তেমনই সে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির হাতেই নিজেকে ছেড়ে দিল, যদিও সেই দুর্বার শক্তি যে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তাও সে জানে না। সে জানে, সোনিয়াকে কথা দেবার পরে প্রিন্সেস মারির কাছে মনের কথা প্রকাশ করাটা হবে খুবই নিচ কাজ। সে আরো জানে যে কোনোরকম নিচ কাজ সে কদাপি করবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে সে কথাও জানে (অন্তত মনেপ্রাণে অনুভব করে) যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার হাতে এবং যারা তাকে চালাচ্ছে তাদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে সে কোনো অন্যায় করছে না, বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে–জীবনে যত কিছু কাজ করেছে সে সবকিছুর চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিন্সেস মারির সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তার বহিরঙ্গ জীবন আগের পথেই চলতে থাকলেও আগে তার যা কিছু ভালো লাগত এখন আর তা ভালো লাগে না; প্রায়ই সে প্রিন্সেসের কথাই ভাবে। কিন্তু আগে আগে যুবতী মহিলাদের সম্পর্কে, এমন কি একসময় অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সোনিয়া সম্পর্কেও সে যেভাবে ভাবনা-চিন্তা করত, প্রিন্সেস মারি সম্পর্কে চিন্তাটা ঠিক সেরকম নয়। ঐ সব যুবতীদের সে দেখত যেমন সব সৎ অন্তঃকরণের যুবকরা দেখে থাকে; অর্থাৎ তাদের দেখত সম্ভাবিত স্ত্রীরূপে, কল্পনায় তাদের মানিয়ে নিত বিবাহিত জীবনের পরিবেশের সঙ্গে : শাদা ড্রেসিং-গাউন, চায়ের টেবিলে স্ত্রী, স্ত্রীর গাড়ি, বাচ্চারা, মামণি, বাপি, তাদের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, ইত্যাদি আর ভবিষ্যতের সেইসব ছবি তাকে আনন্দ দিত। কিন্তু যে প্রিন্সেস মারির সঙ্গে সকলে তার বিয়ে দিতে চেষ্টা করছে তাকে ভবিষ্যৎ বিবাহিত জীবনের ছবির সঙ্গে সে মোটেই জড়াতে পারছে না। সে চেষ্টা করলেও ছবিগুলি হয়ে উঠছে সামঞ্জস্যবিহীন ও মিথ্যা। তা দেখে সে ভয় পায়।
.
অধ্যায়-৭
বরদিনোর যুদ্ধের সংবাদ এবং নিহত ও আহতদের ব্যাপারে আমাদের ক্ষয়-ক্ষতির ভয়াবহ সংবাদ, আর তার চাইতেও ভয়ংকর মস্কো পরিত্যাগের সংবাদ ভারোনেঝে পৌঁছল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। প্রিন্সেস মারি দাদার আহত হবার সংবাদ জেনেছে গেজেট থেকে; কিন্তু তার সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট খবর জানতে না পেরে প্রিন্স আন্দ্রুর খোঁজে নিজেই যাত্রা করার জন্য তৈরি হয়েছে।
বরদিনোর যুদ্ধ এবং মস্কো পরিত্যাগের খবর শুনে রশুভের মনে হতাশা, ক্রোধ, প্রতিহিংসার বাসনা, অথবা কোনোরকম অনুভূতিই জাগল না; শুধু ভরোনেঝের যা কিছু সবই তার কাছে একঘেয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে উঠল; লজ্জা ও অকর্মণ্যতার একটা অস্পষ্ট অনুভূতি তাকে পেয়ে বসল। সব আলোচনাই তার কাছে আন্তরিকতাবিহীন বলে মনে হতে লাগল; কেমন করে সবকিছুর বিচার করবে তাও সে জানে না; তার মনে হল, একমাত্র রেজিমেন্টে ফিরে গেলেই সবকিছু আবার তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ঘোড়া কেনার ব্যাপারে তাড়াহুড়া শুরু করে দিল, সএবং অকারণেই চাকর ও স্কোয়াড্রন কোয়ার্টার-মাস্টারের উপর রাগারাগি করতে লাগল।
তার যাত্রার কয়েকদিন আগে রুশদের জয়লাভ উপলক্ষে ভজনালয়ে একটা বিশেষ ধন্যবাদজ্ঞাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। নিকলাসও সেখানে উপস্থিত ছিল। শাসনকর্তার কিছুটা পিছনে দাঁড়িয়ে সে নানান বিষয়ে চিন্তা করছিল। অনুষ্ঠান শেষ হলে শাসনকর্তার স্ত্রী তাকে ইশারায় ডাকল।
মাথা নেড়ে বিপরীতদিকে দাঁড়ানো মহিলাটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, প্রিন্সেসকে দেখেছ?
নিকলাস সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সেস মারিকে চিনতে পারল; অবগুণ্ঠনের আড়ালে তার রেখাচিত্র দেখে যতটা নয় তার চাইতে বেশি তার উদ্বেগ, ভীরুতা ও করুণার ভাব দেখে। প্রিন্সেস মারি নিজের চিন্তায়ই ডুবে ছিল; গির্জা থেকে যাবার আগে শেষবারের মতো সে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল।
নিকলাস অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। আগে যে মুখ সে দেখেছে সেই একই মুখ, সেই একই পরিশীলিত আত্মিক সাধনার প্রকাশ, কিন্তু এখন সেই মুখ সম্পূর্ণ অন্যভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সে মুখে দুঃখ, প্রার্থনা ও আশার এক সকরুণ প্রকাশ। নিকলাস নিজের থেকেই তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল যে তার দুঃখের কথা সে শুনেছে, আর সর্বান্তঃকরণে তার সহানুভূতি জানাচ্ছে। তার কণ্ঠস্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রিন্সেস মারির মুখে যেন একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠে তার দুঃখ ও আনন্দ দুকেই উজ্জ্বল করে তুলল।
রস্তভ বলল, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল প্রিন্সেস। আপনার দাদা প্রিন্স আন্দ্রু নিকলায়েভিচ যদি বেঁচে না থাকত তাহলে সে খবর সঙ্গে সঙ্গে গেজেটে ঘোষণা করা হত, কারণ সে একজন কর্নেল।
তার কথা সম্যক বুঝতে না পারলেও তার মুখের সক্ষেদ সহানুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করে প্রিন্সেস মারি রশুভের দিকে তাকাল।
নিকলাস বলতে লাগল, এমন অনেক ঘটনার কথা আমি জানি যেখানে বোমার একটা টুকরোর আঘাত (গেজেটে বলা হয়েছে গোলা) হয় সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক হয়েছে, অথবা খুবই তুচ্ছ হয়েছে। আমরা তো ভালটাই আশা করব; আমি নিশ্চিত জানি…।
প্রিন্সেস মারি তার কথায় বাধা দিল।
ওঃ, সে যে কী ভয়ংকর… আবেগের আতিশয্যে সে কথা শেষ করতে পারল না; সাবলীল ভঙ্গিতে মাথাটা নিচু করে পরে সকৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারি মাসির সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় নিকলাস বাইরে বের হল না; ঘোড়া-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হিসেবপত্র মেটাবার জন্য ঘরেই থাকল। সেকাজ যখন শেষ হয় তখন যতটা রাত হয়েছে তাতে না বাইরে যাওয়া চলে, না ঘুমতে যাওয়া চলে; অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘরময় পায়চারি করতে করতে সে নিজের জীবনের কথাই ভাবতে লাগল; অথচ একাজটা সে কদাচিৎ করে থাকে।
স্মোলেনস্ক প্রদেশে যখন প্রিন্সেস মারিকে দেখেছিল তখন তাকে রস্তভের খুব ভালো লেগেছিল। এখন ভেরোনেঝ-এ দেখা হবার পর তার প্রভাব যে প্রীতিপদ হয়েছে তাই নয়, সেটা বেশ শক্তিশালী হয়েই দেখা দিয়েছে। এখানে তার মধ্যে যে বিশেষ নৈতিক সৌন্দর্য নিকলাস দেখতে পেয়েছে তাতে সে মুগ্ধ হয়েছে। অবশ্য সে এখন যাত্রার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত; তাই তার সঙ্গে পুনরায় দেখা হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করার কথাটা তার মাথায়ই আসেনি। কিন্তু সেদিন গির্জায় তার সাক্ষাৎটা নিকলাসের মনে এত গভীর দাগ কেটেছে যে তার মানসিক শান্তির পক্ষে সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। সেই ম্লান, বিষণ্ণ, পরিশীলিত, মুখ, সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি, সেই শান্ত শোভন ভঙ্গিমা, আর বিশেষ করে তার সারা অঙ্গে ফুটে ওঠা গভীর বেদনা তাকে উদ্বেলিত ও সহানুভূতিশীল করে তুলেছে। পুরুষ মানুষের মধ্যে উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীবনের প্রকাশকে সে সহ্য করতে পারে না (সেইজন্যই প্রিন্স আন্দ্রুকে তার পছন্দ নয়), তাকে সে দার্শনিকতা ও স্বপ্নালুতা বলে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উল্লেখ করে থাকে, কিন্তু সেই একই দুঃখ যখন প্রিন্সেস মারির ক্ষেত্রে তার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটি গোটা আধ্যাত্ম জগৎকে প্রকাশ করে দিল তখন সেটাই এক অনিবার্য আকর্ষণ হয়ে দেখা দিল।
নিজের মনেই বলল, সে এক আশ্চর্য নারী। সত্যিকারের দেবদূত! কেন আজ আমি স্বাধীন নই? সোনিয়াকে নিয়ে এত তাড়াহুড়া করেছিলাম কেন? আপনা থেকেই দুজনের তুলনা জাগল তার মনে : একজনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার তিলমাত্র নেই, আর অপরজনের মধ্যে আছে তার প্রাচ–এই আধ্যাত্মিকতার সম্পদ নিজের মধ্যে নেই বলেই সেটা তার কাছে আরো বেশি মূল্যবান। আজ যদি সে স্বাধীন থাকত তাহলে কি ঘটতে পারত সেই ছবিটাই তার সামনে দেখা দিল। প্রিন্সেসের কাছে সে বিয়ের প্রস্তাব করতে পারত, সেই হতে পারত তার স্ত্রী। কিন্তু না, সে কল্পনাও আজ সে করতে পারে না। সে ভয় পেল, মনের সামনে কোনো স্পষ্ট ছবিই ফোঁটাতে পারল না। অনেকদিন আগেই সোনিয়াকে নিয়ে ভবিষ্য জীবনের একটা ছবি সে দেখেছে; সে ছবি স্পষ্ট ও সরল, কারণ সোনিয়াকে সে ভালো করে চেনে, কিন্তু প্রিন্সেস মারিকে নিয়ে ভবিষ্যতের ছবি দেখা অসম্ভব, কারণ তাকে সে চেনে না, শুধুই ভালোবাসে।
সোনিয়াকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার মধ্যে একটা মজা আছে, একটা ফুর্তির ব্যাপার আছে, কিন্তু প্রিন্সেস মারিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা সব সময়ই শক্ত, কিছুটা ভীতিপ্রদ।
সে ভাবতে লাগল, আহা কী তার প্রার্থনার ধরন! তার সমস্ত অন্তর যেন সেই প্রার্থনার মধ্যে ডুবে যায়। হ্যাঁ, সেই প্রার্থনাই তো পাহাড় টলাতে পারে; আমার নিশ্চিত বিশ্বাস তার প্রার্থনার উত্তর সে পাবে। হঠাৎ তার মনে হল, আমি যা চাই তার জন্য প্রার্থনা করছি না কেন? আমি কি চাই? স্বাধীন হতে, সোনিয়ার হাত থেকে মুক্তি পেতে…তিনি তো ঠিকই বলেছেন, শাসনকর্তার স্ত্রীর কথাগুলি মনে পড়ে গেল : সোনিয়াকে বিয়ে করলে তার ফলে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। গোলমাল, মামণির দুঃখ…সম্পত্তি নিয়ে অসুবিধা…গোলমাল, ভয়ংকর গোলমাল! তাছাড়া তাকে আমি ভালোবাসি না-যেমন ভালোবাসা উচিত। হে ঈশ্বর! এই ভয়ংকর জটিল পরিস্থিতি থেকে আমাকে উদ্ধার কর! সহসা সে প্রার্থনা করতে শুরু করল। হ্যাঁ, প্রার্থনা পাহাড় টলাতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস থাকা চাই, ছেলেবেলায় নাতাশা ও আমি যে প্রার্থনা করতাম তা নয়, বরফ যেন চিনি হয়ে যায়-আর সত্যি তাই হয়েছে কিনা দেখতে আমরা উঠোনে ছুটে যেতাম। না, কোনো তুচ্ছ জিনিসের জন্য এখন আমি প্রার্থনা করছি না। পাইপটা এক কোণে রেখে দুহাত জোড় করে সে দেবমূর্তির সামনে বসল। প্রিন্সেস মারির স্মৃতিতে বিগলিত হয়ে অনেক দিন পরে সে প্রার্থনা করতে লাগল। তার চোখ জলে ভরে উঠল, গলা আটকে গেল, আর তখনই দরজা খুলে লাভ্রুশকা ঘরে ঢুকল কিছু কাগজপত্র নিয়ে।
হঠাৎ নিজের মনোভাব পাল্টে ফেলে নিকলাস চিৎকার করে উঠল, বোকার ডিম! না ডাকতেই ঘরে ঢুকেছ কেন?
ঘুম-ঘুম গলায় লাভ্রুশকা বলল, শাসনকর্তার কাছ থেকে একজন লোক এসেছে একটি চিঠি নিয়ে।
আচ্ছা, ঠিক আছে ধন্যবাদ। তুমি যেতে পার!
নিকলাস চিঠি দুটো নিল; একটা মার চিঠি, অপরটা সোনিয়ার। হাতের লেখা দেখে চিনতে পেরে প্রথমে সে সোনিয়ার চিঠিটাই খুলল। কয়েক লাইন পড়তেই তার মুখটা ম্লান হয়ে গেল, ভয়ে ও আনন্দে চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।
না, এ সম্ভব নয়। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল।
বসে থাকতে পারল না, চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে পায়চারি করতে লাগল। চোখ তুলে তাকাল, আবার পড়ল, আবার, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু কাঁধ সোজা করল, হাঁ করে দুহাত টান-টান করল, দুচোখে স্থির দৃষ্টি। ঈশ্বর তার কথা শুনবে এই বিশ্বাস নিয়ে এইমাত্র যা প্রার্থনা করেছে তাই ঘটেছে; কিন্তু নিকলাস এতদূর বিস্মিত হয়েছে যেন এটা অসাধারণ ও প্রত্যাশিত, আর যেহেতু এত তাড়াতাড়ি এটা ঘটেছে যাতে প্রমাণ হয় যে এটা ঈশ্বরের নির্দেশে ঘটেনি, ঘটেছে ঘটনার সাধারণ যোগাযোগের ফলে।
যে বন্ধন নিকলাসকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল, যার হাত থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না বলে তার ধারণা, সোনিয়ার এই অপ্রত্যাশিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চিঠি তাকে সেই বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। সে লিখেছে, রস্ত পরিবারের মস্কোর প্রায় সব সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কথা, নিকলাস যাতে প্রিন্সেস বলকনস্কয়াকে বিয়ে করে সেই মর্মে কাউন্টেসের উপর্যুপরি ঘোষণার কথা এবং ইদানীংকালে নিকলাসের নীরবতা ও উদাসীনতার কথা-এইসব কিছুর ফলেই সে স্থির করেছে সব প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্তি দিয়ে সে নিকলাসকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এনে দেবে।
সে লিখেছে, যে পরিবার আমার প্রতি এত ভালো ব্যবহার করেছে আমিই তার দুঃখ বা বিরোধের কারণ হব, এ চিন্তাও আমার পক্ষে বেদনাদায়ক। যাদের আমি ভালোবাসি তাদের সুখ ছাড়া আমার ভালোবাসার অন্য কোনো লক্ষ্য নেই; সুতরাং নিকলাস, আমার মিনতি নিজেকে তুমি স্বাধীন বলে বিবেচনা করো; স্থির জেনো, যাই ঘটুক না কেন তোমাকে এত ভালোবাসা আর কেউ দিতে পারবে না যা দিয়েছে —
তোমার সোনিয়া।
দুটো চিঠিই এসেছে ত্রয়সা থেকে। কাউন্টেসের চিঠিতে আছে মস্কোতে তাদের শেষের দিনগুলি, তাদের যাত্রা এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার বিবরণ। চিঠিতে কাউন্টেস আরো জানিয়েছে, আহত অবস্থায় প্রিন্স আন্দ্রু তাদের সঙ্গেই পথ চলেছে; তার অবস্থা খুবই সংকটজনক ছিল, কিন্তু ডাক্তার এখন আশা দিয়েছে। সোনিয়া ও নাতাশাই তার সেবা করেছে।
পরদিন মার চিঠি নিয়ে নিকলাস প্রিন্সেস মারির সঙ্গে দেখা করতে গেল। নাতাশা তার সেবা করেছে এ কথাটার অর্থ কি হতে পারে তা নিয়ে দুজনের কেউই একটা কথাও বলেনি, কিন্তু এই চিঠিটাকে ধন্যবাদ, নিকলাস হঠাই প্রিন্সেসের পরম আত্মীয়ের মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল।
পরদিন প্রিন্সেস মারির ইয়ারোস্লাভল যাত্রার প্রাক্কালে নিকলাস তাকে বিদায় জানাল, আর তার কয়েকদিন পরেই রেজিমেন্টে যোগ দিতে যাত্রা করল।
.
অধ্যায়-৮
নিকলাসের প্রার্থনার উত্তরে এয়সা থেকে লিখিত সোনিয়ার যে চিঠিটা এসেছে তার গোড়াকার কথাটা এই : কোনো ধনবতী উত্তরাধিকারিণীর সঙ্গে নিকলাসের বিয়ে দেবার চিন্তাটা কাউন্টেসকে ক্রমেই বেশি করে চেপে ধরেছে। সে জানে যে সোনিয়াই সে পথের প্রধান বাধা, আর তাই কাউন্টেসের বাড়িতে সোনিয়ার জীবন ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বোগুচারভোতে প্রিন্সেস মারির সঙ্গে নিকলাসের দেখা হয়েছে এই মর্মে তার চিঠি পাবার পর থেকে অবস্থাটা চরমে উঠেছে। সোনিয়ার প্রতি অসম্মানকর বা নিষ্ঠুর উক্তি করতে পারার কোনো সুযোগই কাউন্টেস ছেড়ে দেয় না।
কিন্তু মস্কো ছেড়ে আসার কয়েকদিন আগে নানান ঘটনায় বিচলিত ও উত্তেজিত হয়ে কাউন্টেস সোনিয়াকে কাছে ডাকল; কোনো রকম বকাবকি না করে এবং দাবি না জানিয়ে সাশ্রুনেত্রে তাকে মিনতি জানাল, এই পরিবার তার জন্য যা কিছু করেছে তার প্রতিদানে সে যেন স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিকলাসের সঙ্গে বিবাহসম্পর্কিত সব বন্ধন ছিন্ন করে ফেলে।
যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাকে এই কথা না দিচ্ছ ততক্ষণ আমি শান্তি পাব না।
সোনিয়া হাউহাউ করে কেঁদে উঠল; কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিল যে সে সবকিছু করতে রাজি, সবকিছুর জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কোনো কথা দিল না, কি করবে তা নিজেই স্থির করতে পারল না। যে পরিবার তাকে লালন-পালন করে বড় করে তুলেছে তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে তো হবেই। অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকারই তো সোনিয়ার অভ্যাস। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত যখনই আত্ম ত্যাগের কোনো কাজ সে করেছে তখনই এই সুখের চেতনা তার মনে জেগেছে যে এই কাজের ফলে সে নিজের চোখে এবং অপরের চোখে আরো বড় হয়ে উঠবে, আর তাকে নিকলাসের আরো যোগ্য করে তুলবে; পৃথিবীর অন্য সবকিছুর চাইতে সে যে নিকলাসকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু এখন এরা যে তাকে সেই বস্তুটিকেই বিসর্জন দিতে বলছে যা তার সব আত্ম বিসর্জনের একমাত্র পুরস্কার, তার জীবনের একমাত্র অর্থ। আর এই প্রথম সেই পরিবারটির প্রতি তিক্ততায় তার মন ভরে উঠল যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছিল শুধু একদিন অনেক বেশি যন্ত্রণা দেবার জন্য; নাতাশার প্রতিও ঈর্ষা জাগল তার মনে; এই মেয়েটি কোনোদিন কারো জন্য কোনো কিছু ত্যাগ না করেও সকলের ভালোবাসাই পেয়ে এসেছে। আর এই প্রথম সোনিয়া অনুভব করল যে নিকলাসের প্রতি তার পবিত্র, শান্ত ভালোবাসার ভিতর থেকে জেগে উঠেছে এমন একটি উচ্ছ্বসিত আবেগ যা নীতি, পুণ্য ও ধর্মের চেয়েও শক্তিশালী। সেই আবেগের প্রভাবে সোনিয়া কাউন্টেসকে এড়িয়ে চলতে লাগল, স্থির করল যতদিন নিকলাসের সঙ্গে দেখা না হয় ততদিন অপেক্ষা করবে; উদ্দেশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া নয়, বরং দেখা হলেই তাকে চিরদিনের মতো নিজের সঙ্গে বেঁধে ফেলা।
মস্কোতে শেষের কয়েকটা দিন রস্তভ পরিবারে এমন হট্টগোল ও ভয়ের আবহাওয়া চলল যে সোনিয়ার মনের বিষণ্ণ চিন্তাগুলো চাপা পড়ে গেল। নানা কাজকর্মের মধ্যে ডুবে থাকতে পেরে সে খুশিই হল। কিন্তু যখন সে তাদের বাড়িতে প্রিন্স আন্দ্রুর উপস্থিতির কথা শুনল তখন এই সানন্দ অনুভূতি তাকে পেয়ে বসল যে নিকলাসের কাছ থেকে তার দূরে সরে যাওয়াটা ঈশ্বরের অভিপ্রেতনয়। সে জানত, নাতাশা প্রিন্স আন্দ্রু ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না, তার ভালোবাসায় কখনো ইতি ঘটেনি। সে জানত, এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পুনরায় একত্র হলে আবার তারা পরস্পরের প্রেমে পড়বে, আর সে অবস্থায় নিকলাস আর প্রিন্সেস মারিকে বিয়ে করতে পারবে না, কারণ সেটা সামাজিক বিধিতে নিষিদ্ধ। শেষের কয়েকটা দিন এবং তাদের যাত্রার প্রথম কয়েকটা দিন এই চিন্তায়ই সোনিয়া উল্লসিত হয়ে উঠল যে স্বয়ং বিধাতা তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে।
পথে রস্তভ পরিবার একটি পুরো দিনের জন্য প্রথম যাত্রাবিরতি করল ত্রয়ৎসা মঠে।
মঠের অতিথিশালায় তিনটে বড় ঘর তাদের ছেড়ে দেওয়া হল; তার একটাতে প্রিন্স আন্দ্রুকে থাকতে দেওয়া হল। আহত লোকটির অবস্থা সেদিন অনেকটা ভাল; নাতাশা তার কাছেই বসেছিল। পাশের ঘরে কাউন্ট ও কাউন্টেস সসম্মানে মঠাধিপতির সঙ্গে কথা বলছে; পূর্বপরিচিত মঠের কল্যাণকামী হিসেবেই মঠাধিপতি তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। প্রিন্স আন্দ্রু ও নাতাশার মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা জানবার কৌতূহলে সোনিয়াও সেখানে হাজির হয়েছে। দরজার ভিতর দিয়েই সে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। দরজা খুলে উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে এল নাতাশা। তাকে স্বাগত জানাতে মঠাধিপতি উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতের ঝোলা আস্তিনটা গুটিয়ে নিল; কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে নাতাশা সোনিয়ার কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরল।
কাউন্টেস বলল, নাতাশা, কি চাইছ? এদিকে এস!
আশীর্বাদ লাভের জন্য নাতাশা মঠাধিপতির কাছে এগিয়ে গেল; সে পরামর্শ দিল, ঈশ্বর ও সন্ত প্রভুর কাছে সাহায্য ভিক্ষা কর।
মঠাধিপতি চলে যেতেই নাতাশা বন্ধুর হাত ধরে তাকে নিয়ে খালি ঘরটাতে গেল।
নাতাশা বলল, সোনিয়া, ও কি বাঁচবে? সোনিয়া, আমি কত সুখী, অথচ কত দুঃখী!…সোনিয়া, ছোষ্ট্র পাখিটি, সবই তো যেমনটি ছিল তেমনই আছে। শুধু ও যদি বেঁচে ওঠে! ও তো…না, না, তা হতে পারে না…কারণ….কারণ… নাতাশা কেঁদে উঠল।
সোনিয়া মৃদু গুঞ্জনে বলল, ঠিক! আমি জানতাম! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!
সোনিয়াও ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাতাশাকে চুমো খেল, সান্ত্বনা দিল। ভাবল, শুধু ও যদি বেঁচে ওঠে! দুজনেই কাঁদল, কথা বলল, চোখের জল মুছল, তারপর একসঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাবধানে দরজার খুলে নাতাশা ভিতরে তাকাল; সোনিয়া তার পাশে আধখোলা দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
প্রিন্স আন্দ্রু তিনটে বালিশের উপর উঁচু হয়ে শুয়ে আছে। বিবর্ণ মুখখানি শান্ত, চোখ দুটি বন্ধ, নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের লক্ষণ চোখে পড়ছে।
সঙ্গিনীর হাতটা ধরে দরজা থেকে পিছিয়ে এসে সোনিয়া হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওঃ নাতাশা!
কি হল? কি হল? নাতাশা শুধাল।
ওই যে, ওই যে… সোনিয়া বলল; তার মুখটা শাদা হয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে।
আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সোনিয়াকে নিয়ে নাতাশা জানালার কাছে গেল; সোনিয়ার কথাগুলি এখনো সে বুঝতে পারেনি।
গম্ভীর, ভয়ার্ত মুখে সোনিয়া বলল, তোমার মনে আছে অস্ত্রাদণুতে বড়দিনের সময়…তোমার জন্য যখন আয়নায় তাকিয়েছিলাম…? তোমার কি মনে আছে আমি কি দেখেছিলাম?
বিস্ফারিত চোখে নাতাশা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ!
সোনিয়া বলতে লাগল, তোমার মনে আছে? তখন আমি এটাই দেখেছিলাম আর সেকথা তোমাকে, দুনিয়াশাকে, সক্কলকে বলেছিলাম। দেখেছিলাম, সে বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ দুটি বন্ধ, একটা গোলাপি লেপ দিয়ে ঢাকা, দুহাত এক করা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এইমাত্র সে যা দেখেছে সেটা আয়নায় দেখা ছবির হুবহু অনুরূপ।
আসলে তখন সে কিছুই দেখেনি, যা প্রথম মাথায় এসেছিল তাই বলে দিয়েছিল; কিন্তু তখন যেটা সে বানিয়ে বলেছিল সেটা অন্য যে-কোনো স্মৃতির মতোই এখন তার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে।
নাতাশাও চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, গোলাপি রংই ছিল। তারপর চিন্তিতভাবে বলল, কিন্তু এর অর্থ কী?
তার হাতটা চেপে ধরে সোনিয়া বলল, ওঃ, আমি জানি না, সবই কেমন অদ্ভুত।
কয়েক মিনিট পরে প্রিন্স আন্দ্রু ঘণ্টা বাজাতেই নাতাশা তার কাছে চলে গেল, কিন্তু অসম্ভব রকমের উত্তেজিত ও অভিভূত হয়ে সোনিয়া জানালায় দাঁড়িয়েই যা ঘটেছে তার বিস্ময়করতা নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।
.
সেদিনই সেনাবাহিনীতে চিঠি পাঠাবার একটা সুযোগ ছিল। কাউন্টেস তাই ছেলেকে চিঠি লিখতে বসেছে।
বোনঝিকে যেতে দেখে চিঠি থেকে চোখ তুলে কাউন্টেস বলল, সোনিয়া, তুমি নিকলাসকে লিখবে না? নরম কাঁপা গলায় কথা বললেও কাউন্টেসের মনের কথা সবই সোনিয়া বুঝতে পারল। ঐ দুটি চোখে প্রকাশ পাচ্ছে মিনতি, কোনোকিছু চাইবার লজ্জা, প্রত্যাখ্যানের ভয়, আর প্রত্যাখ্যাত হলে তীব্র বিদ্বেষের জন্য প্রস্তুতি।
কাউন্টেসের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে সোনিয়া তার হাতে চুমো খেল।
বলল, হ্যাঁ মামণি, লিখব।
সেদিন যা কিছু ঘটেছে, বিশেষ করে তার স্বপ্ন-দর্শনের যে রহস্যময় পুনরাবৃত্তি সে এই মাত্র দেখেছে, তাতে সোনিয়ার মনটা নরম হয়েছে, উত্তেজিত হয়েছে। অভিভূত হয়েছে। এখন সে বুঝতে পেরেছে যে নাতাশার সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর সম্পর্কটা নতুন করে গড়ে ওঠায় নিকলাসের পক্ষে প্রিন্সেস মারিকে বিয়ে করার পথে বিপ্ন দেখা দেবে, আর তাই আনন্দিত চেতনায় সেই আত্মত্যাগের মনোভাব আবার ফিরে এসেছে যাতে সে অভ্যস্ত, যা নিয়ে সে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে। আর তাই একটা মহৎ কর্মসাধনের সানন্দ চেতনায় সেই আবেগভরা চিঠিটা সে লিখেছে–যদিও চোখের জল এসে তার পশম-কালো চোখ দুটিকে ভিজিয়ে দিয়ে বারবার বাধা দিয়েছে–যা পেয়ে নিকলাস অবাক হয়ে গেছে।
.
অধ্যায়-৯
অফিসার ও সৈনিকরা পিয়েরকে গ্রেপ্তার করে রক্ষী-ভবনে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ অথচ সসম্মান আচরণ করতে লাগল। তার প্রতি ব্যবহারে তাদের মনে এখনো একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে-লোকটি কে হতে পারে; হয়তো একজন খুব গণমান্য লোকই হবে; আবার তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংঘর্ষের ফলে লোকটির প্রতি শত্রুসুলভ বিদ্বেষও রয়েছে।
কিন্তু পরদিন সকালে যখন রক্ষীদল চলে গেল, তখন পিয়ের বুঝতে পারল যে অফিসার ও সৈনিকসহ নতুন রক্ষীদলের চোখে তার কোনো অভিনবত্ব ধরা পড়ল না; বস্তুত চাষীর কোট-পরা এই শক্ত-সমর্থ লোকটার মধ্যে তারা তো সেই পরাক্রমশালী মানুষটিকে দেখছে না যে লুঠেরা ও প্রহরীদলের সঙ্গে বেপরোয়াভাবে লড়াই করেছিল এবং একটি শিশুকে রক্ষা করার জন্য গম্ভীর কথাগুলি বলেছিল; তারা তার মধ্যে দেখল শুধু ১৭ নম্বরের একটি রুশ বন্দিকে যাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হুকুমে গ্রেপ্তার করে আটক রাখা হয়েছে। তাই সেদিন তাকে অন্যসব সন্দেহভাজন রুশ বন্দিদের সঙ্গে এক ঘরেই রাখা হল, কারণ যে আলাদা ঘরটাতে সে ছিল সেটা জনৈক অফিসারকে দেওয়া হয়েছে।
যেসব রুশদের সঙ্গে পিয়েরকে আটক রাখা হয়েছে তারা সকলেই একেবারে নিম্নশ্রেণীর মানুষ। তাকে ভদ্রলোক বলে চিনতে পেরে, বিশেষত সে ফরাসি ভাষায় কথা বলছে দেখে, তারা তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। তাকে নিয়ে সকলে হাসি-ঠাট্টা করছে দেখে পিয়ের দুঃখ পেল।
সেদিন সন্ধ্যায় সে জানতে পারল, এইসব বন্দিদের (হয়তো সেও তাদের মধ্যে একজন আগুন লাগাবার অভিযোগে বিচার করা হবে। তৃতীয় দিনে অন্য সকলের সঙ্গে তাকেও একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে দুজন কর্নেল ও অন্য ফরাসি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে একজন শাদা গোঁফওয়ালা ফরাসি জেনারেল বসে আছে। অন্য সকলের মতোই পিয়েরকেও জিজ্ঞাসা করা হল সে কে, কোথায় ছিল, কি উদ্দেশ্যে, ইত্যাদি।
পিয়ের জানে এই বিচারের ব্যবস্থাটা পুরোপুরি একটা লোক-দেখানো ব্যাপার। সে জানে, সে এই লোকগুলির মুঠোর মধ্যে পড়েছে, গায়ের জোরে তারা তাকে এখানে এনেছে, সেই গায়ের জোরেই তার কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর দাবি করার অধিকার তারা পেয়েছে, আর তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা। আর যেহেতু তাকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা দুই তাদের আছে, সেইহেতু এই তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থাটা একান্তই অপ্রয়োজনীয়। এটা তো জানা কথা যে জবাব যাই হোক তার শাস্তি হবেই। যখন তাকে প্রশ্ন করা হল গ্রেপ্তারের সময় সে কি করছিল, তখন পিয়ের করুণভাবে বলল যে আগুনের ভিতর থেকে উদ্ধার করে একটি শিশুকে তার বাবা-মার হাতে তুলে দিচ্ছিল। সে লুঠেরাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল কেন? পিয়ের জবাব দিল, একটি স্ত্রীলোককে বাঁচাবার জন্য, আর অসম্মানিত একটি নারীকে রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য, এবং…তারা তার কথায় বাধা দিল, কারণ এসব কথা তারা শুনতে চায় না। সাক্ষীরা তাকে যেখানে দেখতে পেয়েছিল সেই অগ্নিদগ্ধ বাড়িটার উঠোনে সে কেন গিয়েছিল? পিয়ের জবাব দিল, সে মস্কোর অবস্থাটা দেখতে গিয়েছিল। আবার তাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সে কে? আবার সে জানাল যে প্রশ্নের জবাব সে দেবে না।
রেখে দাও, খারাপ…খুব খারাপ, শাদা গোঁফ ও লাল মুখ জেনারেলটি কঠোর গলায় বলে উঠল।
.
চতুর্থ দিনে জুবভস্কি প্রাচীরেও আগুন জ্বলে উঠল।
পিয়ের ও অন্য তেরোজনকে নিয়ে যাওয়া হল ক্রিমিয় সেতুর নিকটবর্তী জনৈক বণিকের বাড়ির গাড়ির আড্ডায়। রাজপথ দিয়ে যেতে যেতে পিয়েরের দম বন্ধ হয়ে এল; সারা শহর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। চারদিকেই আগুন জ্বলছে। মস্কো পুড়ে যাওয়ার তাৎপর্য সে তখনও বুঝতে পারেনি; সভয়ে আগুনের দিকে তাকাল।
ক্রিমিয় সেতুর নিকটবর্তী গাড়ির আড্ডাখানায় সে চার দিন কাটাল। সেখানেই ফরাসি সৈন্যদের কথাবার্তা থেকে সে জানতে পারল, যাদের সেখানে আটক রাখা হয়েছে তাদের সম্পর্কে মার্শালের সিদ্ধান্ত যে-কোনো দিন পৌঁছে যাবে। মার্শালটি যে কে তা পিয়ের জানতে পারল না। স্পষ্টতই তাদের কাছে মার্শাল নিশ্চয়ই একটি খুব বৃহৎ রহস্যময় শক্তি।
৮ সেপ্টেম্বরের আগেকার যে কয়টা দিন ধরে বন্দিদের দ্বিতীয় দফা জেরা চলতে লাগল, পিয়েরের কাছে সেই দিনগুলি ছিল কঠোরতম।
.
অধ্যায়-১০
৮ সেপ্টেম্বর একজন অফিসাররক্ষীরা তাকে যেরকম সম্মান দেখাল তাতেই বোঝা গেল সে একজন গণ্যমান্য লোক-এসে গাড়ির আড্ডায় ঢুকল। হাতে একখানি কাগজ নিয়ে সে উপস্থিত রুশদের সকলেরই নাম ধরে ডাকল; শুধু পিয়েরকে ডাকল একজন লোক যে তার নাম বলেনি বলে। নির্বিকার উদাসভাবে বন্দিদের দিকে তাকিয়ে সে ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে হুকুম দিল, মার্শালের কাছে নিয়ে যাবার আগে এদের যেন ভালো পোশাক পরিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিয়ে যাওয়া হয়। একঘন্টা পরে একদল সৈন্য এসে পিয়ের ও অন্য তেরোজনকে নিয়ে কুমারীক্ষেত্রে হাজির করল। দিনটি সুন্দর, বৃষ্টির পরে রোদ উঠেছে, বাতাসে এক কণা ধুলো নেই। চারদিক ঘেঁয়ায় ঢেকে নেই; শুধু কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে ধোয়া উঠছে। আগুনের শিখা চোখে পড়ছে না, চারদিকেই শুধু ধোয়ার কুণ্ডুলি উঠছে, যতদূর। পিয়েরের চোখ গেল সারা মস্কো একটা প্রকাণ্ড ভস্মীভূত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে পিয়ের অতিপরিচিত অঞ্চলগুলিকেও চিনতে পারল না। এখানে-ওখানে গির্জাগুলো চোখে পড়ল; সেগুলি পোড়ানো হয়নি। ক্রেমলিনকেও ধ্বংস করা হয়নি। গম্বুজ ও মহান আইভানের ঘণ্টাঘরসমেত ক্রেমলিনের শাদা বাড়িটা চকচক করছে। নব কনভেন্টের গম্বুজগুলি ঝিকমিক করছে, ঘণ্টাগুলি স্পষ্ট শব্দে বাজছে। ঘণ্টা শুনে পিয়েরের মনে পড়ল আজ রবিবার, কুমারী উৎসবের দিন। কিন্তু উৎসব পালন করতে কেউ সেখানে হাজির হয়নি। সর্বত্র কালো কালো ধ্বংসস্তূপ; ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত যে দুচারজন ভয়ার্ত রুশকে দেখা যাচ্ছে তারাও ফরাসিদের দেখলেই লুকিয়ে পড়তে চেষ্টা করছে।
এটা পরিষ্কার যে রুশ নীড় ধ্বংস হয়ে গেছে, ভেঙে গেছে, কিন্তু বিধ্বস্ত রুশ জীবনযাত্রার জায়গায় সেই ভাঙা নীড়ের উপর গড়ে উঠেছে একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ফরাসি শৃঙখলা। যে সৈনিকরা তাকে ও অন্য অপরাধীদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের চোখে পিয়ের এই সত্যকে দেখতে পেল; দেখতে পেল দুঘঘাড়ার গাড়িতে চেপে যে গণ্যমান্য অফিসারটি চলেছে তার চোখে। পিয়েরের মনে হল সে যেন একটা তুচ্ছ কাঠের টুকরো, এমন একটা যন্ত্রের চাকার মধ্যে পড়ে গেছে যার কাজকর্ম সে বুঝতে পারে না, কিন্তু যন্ত্রটা বেশ ভালোভাবেই চলছে।
তাকে ও অন্য বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হল কুমারীক্ষেত্রের ডান দিকে মস্ত বাগানওয়ালা একটা বড় শাদা বাড়িতে। প্রিন্স শের্বাতভের বাড়ি; আগে এ বাড়িতে পিয়ের প্রায়ই আসত। সৈনিকদের কথাবার্তা থেকে সে জানতে পেরেছে, এই বাড়িতে এখন একমুলের ডিউক (দাভুত) মার্শাল বাস করে।
ফটকে পৌঁছে তাদের একে একে ভিতরে ঢোকানো হল। পিয়েরের স্থান ষষ্ঠ। কাঁচের ঘর, বাইরের ঘর ও হল ঘরের ভিতর দিয়ে একটা লম্বা নিচু পড়ার ঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন অ্যাডজুটান্ট।
নাকের উপর চশমা রেখে ঘরের একেবারে শেষ কোণে টেবিলের উপর ঝুঁকে বসে আছে দাভুত। পিয়ের তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও একটা কাগজ দেখতে ব্যস্ত থাকায় দাভুত চোখ তুলল না। চোখ না তুলেই নিচু গলায় বলল, কে তুমি?
পিয়ের নীরব, একটা কথাও তার মুখ থেকে বের হল না। সে জানে, দাভুত শুধু একজন ফরাসি জেনারেলই নয়, নিষ্ঠুরতার জন্যও সে কুখ্যাত। দাভুত বসে আছে ছাত্রের জবাব শুনবার জন্য অপেক্ষারত কড়া ধাতের স্কুলশিক্ষকের মতো। তার ঠাণ্ডা মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়ের বুঝতে পারল, জবাব দিতে একমুহূর্ত বিলম্ব ঘটলে তার ফলে তার জীবনটাই চলে যেতে পারে; কিন্তু সে যে কি বলবে তাই জানে না। দাভুত মাথা তুলল, চশমাজোড়াকে কপালের উপর ঠেলে দিল, চোখ কুঁচকে পিয়েরের দিকে তাকাল।
পিয়েরকে ভয় দেখাবার জন্যই মাপা ঠাণ্ডা গলায় বলল, লোকটিকে আমি চিনি।
যে ঠাণ্ডা স্রোতটা এতক্ষণ পিয়েরের পিঠ বেয়ে নামছিল এবার সেটা পাক-সাঁড়াশীর মতো তার মাথাটাকেই চেপে ধরল।
আপনি আমাকে চিনতে পারেন না জেনারেল, আমি কখনো আপনাকে দেখিনি…।
তার কথায় বাধা দিয়ে উপস্থিত অপর একজন জেনারেলকে দাভুত বলল, ও একজন রুশ গুপ্তচর।
দাভুত ঘুরে বসল। অপ্রত্যাশিতভাবে গলা কাঁপিয়ে পিয়ের তাড়াতাড়ি বলে উঠল : না মঁসিয়, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি একজন বেসামরিক অফিসার; মস্কো ছেড়ে যাইনি।
তোমার নাম? দাভুত শুধাল।
বেজুখভ।
তুমি যে মিথ্যা বলছ না তার কি প্রমাণ আছে?
এ কথায় আহত না হয়ে অনুনয়ের সুরে পিয়ের বলল, মঁসিয়!
দাভুত চোখ তুলে একাগ্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তারা পরস্পরকে দেখল, আর সেই দৃষ্টিই পিয়েরকে রক্ষা করল। যুদ্ধ ও আইনের দৃষ্টিতে সেই দৃষ্টি দুটি মানুষের মধ্যে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলল। সেই মুহূর্তে দুজনের মনের মধ্যেও অস্পষ্টভাবে কিছু ঘটে গেল; তারা বুঝল, তারা দুজনেই মানবতার সন্তান, দু-ভাই।
একমুহূর্ত কী ভেবে দাভুত ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যে সত্য কথাই বলছ সেটা আমার কাছে কীভাবে প্রমাণ করবে?
পিয়েরের মনে পড়ে গেল রাম্বেলের কথা; তার নাম, রেজিমেন্ট ও যে রাস্তায় তার বাড়ি সব বলে দিল।
তুমি যা বলছ তা নও, দাভুত আবার বলল।
কম্পিত স্খলিত কণ্ঠে পিয়ের তার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে লাগল। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটি অ্যাডজুটান্ট ঘরে ঢুকে দাভুতকে কি যেন বলল।
সে সংবাদ শুনে দাভুতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে ইউনিফর্মের বোম আঁটতে লাগল। মনে হল, পিয়েরের কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে।
অ্যাডজুটান্টটি বন্দির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সে কুটি করে মাথাটা পিয়েরের দিকে নেড়ে তাকে সরিয়ে নেবার হুকুম দিল। তাকে যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে পিয়ের তা বুঝতে পারল না।
মুখ ফিরিয়ে দেখল, অ্যাডজুটান্টটি দাভুতকে আর একটা প্রশ্ন করছে।
হ্যাঁ, অবশ্য! দাভুত উত্তর দিল, কিন্তু এই ঘা-র যে কি অর্থ তা পিয়ের বুঝতে পারল না।
সে যে কোথায় গিয়েছিল, অনেক দূরে কি না, অথবা কোন দিকে–পরবর্তীকালে এ সবকিছুই পিয়ের স্মরণ করতে পারেনি। তার বুদ্ধিবৃত্তি অবশ হয়ে গেল, কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ল, কোনো দিকে লক্ষ্য না করে অন্যের সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলল, এবং অন্য সকলে যখন থামল তখন সেও থেমে গেল। একটা চিন্তাই তখন তার মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল : কে তার মৃত্যুদণ্ড দিল? যে কমিশন তাকে প্রথম জেরা করেছিল তারা নয়। এমন মানবিক দৃষ্টিতে দাভুত তার দিকে তাকিয়েছিল যে সেও হতে পারে না। আর একমুহূর্ত পরেই দাভুত তার ভুল বুঝতে পারত, কিন্তু তখনই অ্যাডজুটান্টটি এসে তার চিন্তায় বাধা দিল। তাহলে কে তার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তাকে হত্যা করছে, জীবন থেকে তাকে বঞ্চিত করছে-তাকে, পিয়েরকে, অনেক স্মৃতি, আকাক্ষা, আশা ও চিন্তার একটি মানুষকে? একাজ কে করছে? পিয়েরের মনে হল, কেউ না।
একটা ব্যবস্থা মাত্ৰ-ঘটনার একটা সমাবেশ মাত্র।
যে-কোনো রকমের একটা ব্যবস্থা তাকে-পিয়েরকে হত্যা করছে, জীবন থেকে, সবকিছু থেকে বঞ্চিত করছে, তাকে ধ্বংস করছে।
.
অধ্যায়-১১
প্রিন্স শের্বাতভের বাড়ি থেকে বন্দিদের সোজা নিয়ে যাওয়া হল কুমারীক্ষেত্রে-সন্ন্যাসিনীদের মঠের বাঁ দিকে একেবারে সজিবাগানের কাছে। সেখানে একটি খুটি পোঁতা হয়েছে। খুঁটিটা ছাড়িয়ে একটা নতুন গর্ত খোঁড়া হয়েছে, আর খুটি ও গর্তের কাছাকাছি অনেক মানুষ অর্ধবৃত্তাকারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ের মধ্যে আছে অল্প কয়েকজন রুশ আর নেপোলিয়নের অনেক সৈন্যসামন্ত-নানা ইউনিফর্মে সজ্জিত জার্মান, ইতালিয় ও ফরাসি। খুঁটির ডাইনে ও বাঁয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে নীল ইউনিফর্ম, লাল সন্ধত্ৰাণ, উঁচু বুট ও শাকো পরিহিত ফরাসি সৈন্যরা।
তালিকা অনুযারী বন্দিদের পর পর দাঁড় করিয়ে দিয়ে (পিয়েরের স্থান ষষ্ঠ) খুঁটিটার দিকে নিয়ে যাওয়া হল। সহসা তাদের দুদিক থেকে ভেরী বেজে উঠল; সেই শব্দে পিয়েরের মনে হল বুঝি তার মনের একটা অংশকে ছিঁড়ে ফেলা হল। চিন্তা করবার ও বুঝবার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। শুধু শুনতে পাচ্ছে আর দেখতে পাচ্ছে। তখন তার শুধু একটি ইচ্ছা–যে ভয়ংকর জিনিস ঘটতে যাচ্ছে সেটা তাড়াতাড়ি ঘটে যাক। অন্য বন্দিদের দিকে তাকিয়ে পিয়ের তাদের ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগল।
প্রথম দুজন কয়েদি, মাথা কামানো। একজন লম্বা, লিকলিকে, অপর জনের ময়লা রং, লোমশ পেশীবহুল দেহ, চ্যাপ্টা নাক। তৃতীয়জন গৃহ-ভৃত্য, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, ধূসর চুল, নাদুসনুদুস চেহারা। চতুর্থজন চাষী, খুব সুন্দর, হাল্কা বাদামি চওড়া দাড়ি ও কালো চোখ। পঞ্চম একজন কারখানার মজুর, হলদে মুখ, ঢিলে জোব্বা পরা আঠারো বছরের একটি ছেলে।
পিয়ের শুনতে পেল, ফরাসিরা বলাবলি করছে, তাদের আলাদা গুলি করবে, না জোড়ায় জোড়ায়। শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় অফিসার বলল, জোড়ায় জোড়ায়।
চাদর পরিহিত একজন ফরাসি পদস্থ ব্যক্তি বন্দিদের ডানদিকে এসে রুশ ও ফরাসি ভাষায় দণ্ডাদেশ পাঠ করল।
দু-জোড়া ফরাসি সৈন্য অপরাধীদের দিকে এগিয়ে গেল; অফিসারের হুকুমে সারির প্রথমে দাঁড়ানো কয়েদি দুজনকে ধরল। খুঁটির কাছে পৌঁছে কয়েদি দুজন থামল; থলে আনা হল; আহত পশু যেভাবে আগুয়ান শিকারীর দিকে তাকায় তারাও সেইভাবে নিঃশব্দে চারদিকে তাকাতে লাগল। একজন অনবরত কুশ-চিহ্ন আঁকতে লাগল, অপরজন পিঠ চুলকোতে চুলকোতে হাসির মতো করে ঠোঁট নাড়তে লাগল। সৈনিকরা দ্রুত হাতে তাদের চোখ বেঁধে দিল, মাথার উপর দিয়ে থলে দুটি নামিয়ে দিল; আর দুজনকেই খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলল।
বারোজন নিপুণ বন্দুকবাজ বন্দুক নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে সেনাদলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে খুঁটি থেকে আট পা দূরে দাঁড়াল। পাছে আসন্ন ঘটনাটা চোখে দেখতে হয় এই ভয়ে পিয়ের মুখ ফিরিয়ে নিল। হঠাৎ ফটাস করে এমন একটা কুণ্ডলি পাকানো শব্দ কানে এল যেটা যে কোনো ভয়ংকর কামানের শব্দের চাইতেও জোরালো। পিয়ের ঘুরে তাকাল। কিছুটা ধোঁয়া উড়ছে, আর ফরাসি সৈনিকরা বিবর্ণ মুখে ও কম্পিত হাতে গর্তটার কাছে কি যেন করছে। আরো দুজন বন্দিকে আনা হল। একইভাবে একই দৃষ্টিতে তারা দুজনও চারদিকের দর্শকদের দিকে বৃথাই প্রাণরক্ষার নীরব আবেদন নিয়ে তাকাতে লাগল। তাদের ভাগ্যে যে কি ঘটতে চলেছে তাও তারা বুঝতে পারছে না বা বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের কাছে জীবনের যে কি অর্থ তা তারা জানে, আর তাই সে জীবন যে কেউ নিতে পারে এটা তারা না পারছে বুঝতে, আর না পারছে বিশ্বাস করতে।
এবারও পিয়ের এসব দেখতে চাইল না, মুখটা ঘুরিয়ে নিল; কিন্তু আবার সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ তার কানে এল, আর সেই মুহূর্তে সে দেখল ধোয়া, রক্ত, আর বিবর্ণ মুখ ফরাসি সৈন্য; এবারও তারা খুটির পাশে কম্পিত হাতে কি যেন করছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকিয়ে যেন জানতে চাইল এসবের অর্থ কি। যতগুলি চোখের উপর চোখ পড়ল সর্বত্রই ঐ একই জিজ্ঞাসা সে দেখতে পেল।
তার নিজের অন্তরের মধ্যে যে হতাশা, আতঙ্ক ও সংঘাত দেখা দিয়েছে তারই প্রতিফলন সে দেখতে পেল প্রতিটি রুশ ও ফরাসি সৈনিক এবং অফিসারদের মুখে; একটিও ব্যতিক্রম নেই। মুহূর্তের জন্য তার মনের মধ্যে একটি প্রশ্নই ঝলসে উঠল; কিন্তু কে তাহলে এসব করছে? এরা সকলেই তো আমাদের মতো কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে কে সে? কে?
৮৬তম বন্দুকবাজরা, আগে বাড়ো! কে যেন চিৎকার করে বলল।
এবার পিয়েরের ঠিক পূর্ববর্তী পঞ্চম বন্দিটিকে নিয়ে যাওয়া হল-একা। পিয়ের বুঝতে পারল না যে সে বেঁচে গেছে, তাকে এবং অন্যদের সেখানে আনা হয়েছে শুধু এইসব মৃত্যুদণ্ড দেখতে। সে কিন্তু কোনো রকম আনন্দ বা স্বস্তি বোধ করল না; ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের সঙ্গে সবকিছু দেখতে লাগল। ঢিলে জোব্বা পরা সেই কারাখানার ছেলেটিই পঞ্চম বন্দি। তার গায়ে হাত দিতেই সে আতঙ্কে লাফিয়ে একপাশে সরে গিয়ে পিয়েরকে জড়িয়ে ধরল। (পিয়ের শিউরে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।)
ছেলেটি হাঁটতেও পারছে না। দু বগলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তারা তাকে টেনে নিয়ে চলল; সে চেঁচাতে লাগল। খুঁটির কাছে নিয়ে যেতেই সে চুপ করে গেল, যেন হঠাৎ তার মধ্যে একটা বোধ ফিরে এসেছে। সে কি বুঝতে পেরেছে যে আর্তনাদ করা অর্থহীন, অথবা সে কি ভেবেছে যে এরা তাকে খুন করবে এটা একান্তই অবিশ্বাস্য। সে যাই হোক, খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে সে চোখ বেঁধে দেবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল এবং একটা আহত জন্তুর মতো চকচকে চোখ মেলে চারদিকে তাকাতে লাগল।
এবারে পিয়ের মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করতে পারল না। ভিড়ের অন্য সকলের মতোই এই পঞ্চম হত্যাকাণ্ডের সময় তার কৌতূহল ও উত্তেজনাও একেবারে চরমে উঠেছে। অন্য সকলের মতোই পঞ্চম লোকটিও চুপচাপ হয়ে গেছে; ঢিলে জোব্বাটাকে আরো ভালো করে গায়ে জড়িয়ে একটা খালি পা দিয়ে অন্য পাটা ঘষছে।
তারা যখন তার চোখ বেঁধে দিল তখন পিছনের গিটটা মাথায় লাগছিল বলে নিজেই সেটা ঠিক করে নিল; রক্তাক্ত খুঁটিটার গায়ে তাকে ঠেসান দিয়ে দাঁড় করানো হলে সে নিজেই হেলান দিল এবং কিছুটা অস্বস্তি বোধ করায় সোজা হয়ে দাঁড়াল, পা দুটোকে ঠিক করে নিল, আরাম করে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। পিয়ের তার ওপর। থেকে চোখ সরিয়ে নিল না, তার সব গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল।
হয়তো একটা হুকুম দেওয়া হয়েছিল এবং তার পরে আটটা বন্দুকের শব্দও হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে অনেক চেষ্টা করেও গুলির এতটুকু শব্দ শোনার কথা পিয়ের মনে করতে পারত না। সে শুধু দেখেছিল, মজুরটি হঠাৎ তার বন্ধন-দড়ির উপরেই পড়ে গেল, দুটো স্থানে রক্ত দেখা গেল, ঝুলন্ত শরীরটার ভারে দড়িগুলো ঢিলে হয়ে গেল,আর মজুরটি বসে পড়ল, মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে ঝুলে আছে, আর একটা পা ভাঁজ হয়ে আছে। পিয়ের খুঁটিটার দিকে এগিয়ে গেল। কেউ তাকে বাধা দিল না। বিবর্ণ ভয়ার্ত লোকগুলো মজুরটিকে ঘিরে কি যেন করছে। ঘন গোঁফওয়ালা একটি বুড়ো ফরাসি যখন দড়িগুলো খুলছিল তখন তার নিচের চোয়ালটা অনবরত কাঁপছে। শরীরটা পড়ে গেল। সৈনিকরা বিশ্রীভাবে সেটাকে খুঁটির কাছ থেকে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঠেলে দিতে লাগল।
তারা সকলেই নিশ্চিতভাবে জানে যে তারা অপরাধী; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের অপরাধের চিহ্ন সরিয়ে ফেলতেই হবে।
গর্তের ভিতরে তাকিয়ে পিয়ের দেখল, কারখানার ছেলেটি হাঁটু দুটোকে মাথার কাছে নিয়ে পড়ে আছে; একটা কাঁধ অপর কাঁধটার চাইতে বেশি উঁচু হয়ে আছে। সেই কাঁধটা তালে তালে ওঠা-নামা করছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই কোদাল ভর্তি মাটি তার শরীরের উপর চড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। একটি সেনিক ক্রুদ্ধ কণ্ঠে পিয়েরকে চলে যেতে বলল। কিন্তু পিয়ের তার কথা বুঝতে পারল না, খুঁটিটার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তাড়িয়ে দিল না।
গর্তটা ভর্তি হয়ে গেলে আবার একটা হুকুম দেওয়া হল। পিয়েরকে তার জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, খুঁটির দুপাশের দুসারি সৈন্য অর্ধেক ঘুরে গিয়ে মাপা পা ফেলে সেটার পাশ দিয়ে চলে গেল। বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়ানো চব্বিশটি বন্দুকবাজ ছুটে যার যার নিজের জায়গায় চলে গেল।
পিয়ের বিস্ময়বিমূঢ় চোখে বন্দুকবাজদের দিকেই তাকিয়েছিল। একজন ছাড়া আর সকলেই সেনাদলের সঙ্গে ফিরে গেল। এই যুবক সৈনিকটি গর্তের কাছে ঠিক সেই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে রইল যেখান থেকে সে গুলি ছুঁড়েছিল। তার মুখটা মড়ার মতো শাদা, শাকো পিছনের দিকে সরানো, আর বন্দুকটা মাটির উপরে রাখা। সে মাতালের মতো দুলছে; পাছে পড়ে যায় তাই একবার কয়েক পা এগোচ্ছে, আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। একটি বৃদ্ধ নন-কমিশনড অফিসার দলের ভিতর থেকে ছুটে এসে তাকে কনুই দিয়ে জাপটে ধরে দলের দিকে নিয়ে গেল। রুশ ও ফরাসিদের ভিড় কমতে শুরু করেছে। সকলেই মাথা নিচু করে নীরবে চলে যাচ্ছে।
একটি ফরাসি সৈনিক বলল, এ থেকেই ওরা আগুন দেবার উচিত শিক্ষা পাবে।
পিয়ের ঘুরে বক্তার দিকে তাকাল। সৈন্যটি নিজের কৃতকর্মের জন্য কিছুটা স্বস্তি পেতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পাচ্ছেনা। কথা শেষ না করেই সে হাত দিয়ে একটা অর্থহীন ভঙ্গি করে চলে গেল।
.
অধ্যায়-১২
প্রাণদণ্ড-পর্ব শেষ হবার পরে পিয়েরকে অন্য সব বন্দিদের কাছ থেকে আলাদা করে একটা ছোট, বিধ্বস্ত, দুর্গন্ধময় গির্জায় একলা রেখে দেওয়া হল।
সন্ধ্যার দিকে দুটি সৈনিকসহ একজন নন-কমিশনড অফিসার সেখানে ঢুকে বলল যে তাকে ক্ষমা করা হয়েছে এবং এখন তাকে যুদ্ধ-বন্দিদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যারাকে যেতে হবে। তাকে বলা হল না বুঝেই সে উঠে সৈন্যদের সঙ্গে চলল। তারা তাকে নিয়ে গেল মাঠের উঁচু দিকটার শেষ প্রান্তে। সেখানে পোড়া তক্তা, কড়ি ও বরগা দিয়ে কতকগুলি চালাঘর বানানো হয়েছে। তারই একটার মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। অন্ধকারে জনা বিশেক মানুষ পিয়েরকে ঘিরে ধরল। তারা কে, কেন এখানে এসেছে, আর তার কাছেই বা কি চায়-এ সবকিছুই বুঝতে না পেরে সে তাদের দিকে তাকাল। তারা যা বলল তা শুনল, কিন্তু কোনো কথার অর্থ বুঝতে পারল না। তাদের প্রশ্নের জবাব দিল, কিন্তু কারা সে জবাব শুনছে, বা শুনে বুঝতে পারছে কি না তাও ভাবল না। তাদের মুখের দিকে, শরীরের দিকে তাকাল, কিন্তু সবকিছুই অর্থহীন মনে হল।
যে মুহূর্তে সে মানুষের হাতে মানুষের সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড দেখেছে, অথচ তারা কেউ সে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়নি, তখন থেকেই জীবনের মূল উৎসই যেন সহসা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে; সবকিছুই ভেঙে পড়ে একটা অর্থহীন জঞ্জালের স্তূপে পরিণত হয়েছে। নিজের কাছে স্বীকার না করলেও এই জগতের সুষ্ঠু পরিচালনা, মানবতা, নিজের আত্মা, এবং ঈশ্বরের উপর তার যে বিশ্বাস ছিল তা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অভিজ্ঞতা তার আগেও হয়েছে, কিন্তু এখানকার মতো এমন তীব্র অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। এখন তার মনে হচ্ছে, গোটা পৃথিবীটাই তার চোখের সামনে ভেঙে পড়েছে, পড়ে আছে শুধু অর্থহীন ধ্বংসস্তূপ, অথচ এ ব্যাপারে তার নিজের কোনো দোষ নেই। সে অনুভব করছে, জীবনের অর্থকে নতুন করে বিশ্বাস করবার ক্ষমতাও তার নেই।
অন্ধকারে সকলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে; বোঝা যাচ্ছে তার প্রতি তাদের অসীম আগ্রহ। তারা তাকে কি যেন বলছে, কি সব প্রশ্ন করছে। তারা তাকে অন্য কোনোখানে নিয়ে চলল, এবং শেষপর্যন্ত চালাটার এমন একটা কোণে নিয়ে গেল যেখানে চারদিককার মানুষগুলো হাসছে আর কথা বলছে।
আচ্ছা, তাহলে স্যাঙাত্রা…ইনিই সেই প্রিন্স যে… যে শব্দটার উপর বিশেষ জোর দিয়ে চালার অপর দিক থেকে কে যেন বলে উঠল।
দেয়ালে পিঠ দিয়ে একগাদা খড়ের উপর নীরব, নিশ্চল হয়ে বসে পিয়ের একবার চোখ খুলছে, একবার বন্ধ করছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে কারখানার ছেলেটির সেই ভয়ংকর মুখতার সরলতার জন্যই বুঝি বেশি ভয়ংকর-আর সেই সব হত্যাকারীর মুখ যারা আত্মগ্লানির জন্যই যেন আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। আবার চোখ খুলে চারদিককার অন্ধকারের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
তার পাশেই উবু হয়ে বসে আছে একটি ছোটখাট মানুষ। নড়াচড়া করলেই শরীর থেকে ঘামের যে তীব্র গন্ধ আসছে তা থেকেই সে প্রথম লোকটির উপস্থিতি টের পেয়েছে। অন্ধকারে লোকটি নিজের পা নিয়ে কি যেন করছে; তার মুখ দেখতে না পেলেও পিয়ের বুঝতে পারছে যে লোকটি বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে।
অন্ধকারে কিছুটা অভ্যন্ত হবার পরে পিয়ের দেখল, লোকটি তার পায়ের পট্টি খুলছে, আর যেভাবে খুলছে। তাতে পিয়েরের মনে আগ্রহ দেখা দিল।
এক পায়ের পট্টির দড়িটা খুলে সাবধানে সেটাকে পাকে পাকে খুলে সঙ্গে সঙ্গে অপর পায়ের কাজ শুরু করে লোকটি পিয়েরের দিকে তাকাল। এক হাতে দড়িটা ঝুলিয়ে রেখেই আর এক হাতে দ্বিতীয় পায়ের পট্টিটা খুলতে শুরু করল। এইভাবে নিপুণ দক্ষতায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুপায়ের পট্টি খুলে লোকটি মাথার উপরকার একটা গজালে সে দুটো ঝুলিয়ে রাখল। তারপর একটা ছুরি বের করে কি যেন কাটল, ছুরিটা বন্ধ করল, মাথার কাছে বিছানার নিচে রেখে দিল। তারপর পিয়েরের দিকে তাকাল।
আপনি অনেক গোলযোগ পুইয়েছেন, কি বলেন স্যার? ছোট মানুষটি হঠাৎ বলে উঠল।
তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে এত দয়া ও সরলতা ঝরে পড়ল যে পিয়ের জবাব দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোয়াল কাঁপতে লাগল, দুচোখে জল এসে গেল।
পিয়েরের এই বিহ্বলতা প্রকাশের এতটুকু সময় না দিয়ে ছোট মানুষটি সেই একই মনোরম স্বরে সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগল, আরে বাবা, বেজার হবেন না!….বেজার হবেন না বন্ধু-এক ঘণ্টা কষ্ট কর, আর একযুগ বেঁচে থাক! এটাই তো আসল কথা গো বন্ধু। আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এর মধ্যেও আমরা বেঁচে আছি। এইসব মানুষদের মধ্যে যেমন খারাপ লোক আছে, তেমনই ভালো লোকও আছে। কথা বলতে বলতে সে সহজেই হাঁটুর উপর ভর করে উঠে দাঁড়াল, কাশল, তারপর চালাটার অপর দিকে চলে গেল।
অ্যাঁ, ব্যাটা পাজি তুমি!! পিয়ের শুনতে পেল এই লোকটিই ওধারে কথা বলছে। তাহলে তুমি এসেছ, ব্যাটা পাজি। তার তাহলে মনে আছে….ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওতেই হবে!
একটা ছোট কুকুর তার দিকে লাফিয়ে উঠছিল; সেটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সৈনিকটি তার জায়গায় ফিরে এসে বসল। তার হাতে ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো কি যেন রয়েছে।
পুঁটুলি খুলে পিয়েরের দিকে কিছু সিদ্ধ আলু এগিয়ে দিয়ে সে আগেকার মতোই সশ্রদ্ধ স্বরে বলল, এই যে, কিছু খান স্যার। ডিনারে ছিল ঝোল, আর আলু তো চমৎকার!
পিয়ের সারাদিন কিছু খায়নি। আলুর ঘ্রাণ তার খুবই ভালো লাগল। সৈন্যটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে খেতে শুরু করল।
সৈনিকটি হেসে বলল, আচ্ছা, ভালো তো? আপনার তো ভালো লাগা উচিত।
একটা আলু নিয়ে ছুরিটা বের করে হাতের উপরেই সেটাকে দুখণ্ড করে কেটে তাতে একটু নুন ছড়িয়ে দিয়ে পিয়েরের হাতে দিল।
আবার বলল, আলুগলি চমৎকার! এরকম আগে খেয়েছেন!
পিয়েরের মনে হল এর চাইতে বেশি সুস্বাদু কিছু সে কখনো খায়নি।
বলল, আরে, আমি তো ভালো আছি, কিন্তু ওই বেচারিদের ওরা গুলি করল কেন? শেষটির তো বিশ বছরও বয়স হয়নি।
ছোট মানুষটি বলল, চু, চু…! কী পাপ! কী পাপ! আচ্ছা স্যার, আপনি কেন মস্কোতে রয়ে গেলেন?
পিয়ের জবাব দিল, ওরা এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বে ভাবতে পারিনি। হঠাৎই থেকে গেছি আর কি।
আর ওরা আপনাকে গ্রেপ্তার করল কেমন করে বাবা? আপনার বাড়িতে?
না, আমি অগ্নিকাণ্ড দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানেই ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করে, আর আগুন লাগানোর অভিযোগে বিচার করে।
ছোট মানুষটি শুধু বলল, যেখানে আইন আছে, সেখানেই আছে অন্যায়।
আলুর শেষটুকু চিবোতে চিবোতে পিয়ের শুধাল, আপনি কি অনেকদিন এখানে আছেন?
আমি? আমাকে তো গত রবিবারে ধরে এনেছে, মস্কোর একটা হাসপাতাল থেকে।
আরে, আপনি তাহলে একজন সৈনিক?
হ্যাঁ, আমরা আপশেরন রেজিমেন্টের সৈনিক। জ্বরে মরে যাচ্ছিলাম। কেউ কিছু জানায়নি। প্রায় জনবিশেক সেখানে শুয়ে ছিলাম। আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না, কখনো ভাবিও নি।
এখানে কি খুব খারাপ লাগছে? পিয়ের শুধাল।
কিন্তু উপায় কি বলুন বাবা? আমার নাম প্লাতন, উপাধি কারাতায়েভ, পিয়েরের পক্ষে ডাকবার সুবিধা হবে মনে করেই সে নামটা বলল। রেজিমেন্টেসকলে আমাকে ডাকে ছোট বাজপাখি বলে। খারাপ না লেগে কি পারে? মস্কোতে সব শহরের জননী। তার এই অবস্থা দেখলে কি দুঃখ না হয়ে পারে? কিন্তু কথায় বলে পোকা বাঁধাকপির পাতা কেটে ভিতরে ঢোকে, কিন্তু মরে সকলের আগে!
কি? কি বললেন? পিয়ের শুধাল।
কে? আমি? কারাতায়েভ বলল। আমি বলি, ঘটনা তো আমাদের হিসাব মতো ঘটে না, ঘটে ঈশ্বরের হিসেবে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করল, আচ্ছা স্যার, আপনার তো পরিবার আছে, জমিদারি আছে? আর একটা বাড়িও? তার মানে আপনার প্রচুর আছে, কি বলেন? আর গৃহিণীও? আর বুড়ো বাবা-মা, তারা, এখনো বেঁচে আছেন কি?
অন্ধকারে দেখা না গেলেও পিয়ের বুঝতে পারল যে এই প্রশ্নগুলি করার সময় করুণার চাপা হাসিতে সৈনিকটির ঠোঁট দুটি কুঁচকে গেল। পিয়েরের বাবা-মা বেঁচে নেই শুনে, বিশেষ করে মা নেই শুনে সে খুব দুঃখ পেল।
বলল, স্ত্রী পরামর্শ দেয়, শাশুড়ি জানায় আদর, কিন্তু মার মতো আপনজন কেউ নেই! আচ্ছা আপনার ছেলে-মেয়ে আছে তো?
নেতিবাচক জবাব শুনে লোকটি দুঃখ পেল; তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক আছে! আপনার তো অল্প বয়স, ঈশ্বরের দয়া হলেই সন্তান হবে। সবচাইতে বড় কথাই হল মিলেমিশে থাকা….
কিন্তু এখন তো সবই সমান, পিয়ের না বলে পারল না।
কারাতায়েভ বলে উঠল, আহা বাছা! কারাগার অথবা ভিখারীর কথাকে অগ্রাহ্য করবেন না!
বেশ আরাম করে বসে সে একটু কাশল। মনে হল, একটা লম্বা গল্প বলার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছে।
বলতে আরম্ভ করল, দেখুন বাবা, আমি তো বাড়িতেই বাস করছিলাম। আমাদের একটা ভালো বাড়ি ছিল, প্রচুর জমি ছিল, আমরা চাষীরা তো সুখেই ছিলাম, আর বাড়িটার জন্যও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। বাবাকে নিয়ে যখন ফসল কাটতে যেতাম তখন আমরা হতাম সাতজন। ভালোই ছিলাম। সত্যিকারের চাষী ছিলাম। কিন্তু কি যে ঘটল..।
প্লাতন কারাতায়েভ তার দীর্ঘ কাহিনী সূত্রে জানাল-কাঠ কাটতে অন্যের জঙ্গলে ঢুকলে প্রহরী তাকে ধরে ফেলে, বিচার হয়, বেত্রাঘাত হয়, তার পর তাকে সৈন্যদলে চালান করে দেওয়া হয়।
ঈষৎ হাসির সঙ্গে গলার সুর পাল্টে ফেলে সে বলে চলল, দেখুন বাবা, আমরা এটাকে দুর্ভাগ্য বলেই মনে করেছিলাম, কিন্তু সেটাই বড় হয়ে দেখা দিল। আমি সেই পাপকাজ না করলে আমার ভাইকে সৈন্য হতে হত। কিন্তু তার, আমার ছোট ভাইয়ের পাঁচটি সন্তান, আর আমি ফেলে এসেছি শুধু স্ত্রীকে। আমাদের একটি ছোট মেয়ে ছিল, কিন্তু আমি সৈন্যদলে চলে যাবার আগেই ঈশ্বর তাকে নিয়ে নিলেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে কি দেখি তাও বলছি; দেখি তারা আগের চাইতে ভালো আছে। উঠোন-ভরা গরু-মোষ, মেয়েরা সব ভালো আছে, দুভাই বিদেশে মাইনে পাচ্ছে, একমাত্র ছোট ভাই মাইকেল বাড়িতে থাকে। বাবা বলে, আমার কাছে সব সন্তানই সমান; যে আঙুলেই কামড় লাগুক, আঘাত সমানই লাগে। কিন্তু সৈন্য হিসেবে যদি প্লাতনের মাথা কামানো না হত তাহলে তো মাইকেলকেই যেতে হত। বিশ্বাস করুন, বাবা সকলকে কাছে ডেকে এনে আমাদের নিয়ে গেল দেবমূর্তির সামনে। বলল, মাইকেল, ওর পায়ের কাছে নত হও; আর তুমি বৌমা, তুমিও নত হও; আর তোমরা নাতি-নাতনিরা, তোমরাও ওর কাছে নত হও!…বুঝলেন তো ব্যাপারটা? এইরকমই হয়। ভাগ্য একটা মাথা চায়। কিন্তু আমরাই শুধু বিচার করি, এটা ভালো নয়-এটা ঠিক নয়। আমাদের ভাগ্য হচ্ছে টানা-জালের জলের মতো : যতক্ষণ টানবেন ততক্ষণ ফুলে-ফেঁপে উঠবে, কিন্তু যেই জল থেকে টেনে তুলবেন অমনি সব ফাঁকা! এই রকমই হয়!
প্লাতন তার আসনটাকে খড়ের উপর সরিয়ে নিল।
একটু চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়াল।
আচ্ছা, মনে হচ্ছে আপনার ঘুম পাচ্ছে, বলে তাড়াতাড়ি ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে সে বারবার বলতে লাগলঃ
প্রভু যীশুখৃস্ট, মহাত্মা সন্ত নিকলাস, ফ্রোলা ও লাভ্রা! প্রভু যীশুখৃস্ট, মহাত্মা সন্ত নিকলাস, ফ্রোলা ও লাভ্রা! প্রভু যীশুখৃস্ট, আমাদের প্রতি করুণা কর, আমাদের রক্ষা কর! কথা শেষ করে আভূমি নত হল, উঠে দাঁড়াল, দীঘশ্বাস ফেলল, তারপর আবার খড়ের স্থূপের উপর বসে পড়ল। এই তত পথ। হে ঈশ্বর, আমাকে পাথরের মতো শুইয়ে দাও, পাউরুটির মতো জাগিয়ে তোল। বিড়বিড় করে বলতে বলতে কোটটা গায়ে চাপা দিয়ে সে শুয়ে পড়ল।
পিয়ের শুধাল, আপনি কি প্রার্থনা করলেন?
প্রায় ঘুমের মধ্যে প্লাতন অস্ফুটে বলল, অ্যাঁ? আমি কি বলছিলাম। প্রার্থনা করছিলাম। আপনি প্রার্থনা করেন না?
হ্যাঁ, করি, পিয়ের বলল। কিন্তু ওই যে ফ্রোলা ও লাভ্রা বললেন, ওটা কী?
স্নাতন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, এই কথা! ওঁরা হলেন ঘোড়াদের দু সন্ত।
জন্তু-জানোয়ারদের প্রতিও তো করুণা করা চাই। আরে, পাজিটা! বেশ তো কুঁকড়ে গরম হয়ে আছ দেখছি, এই কুকুরির বাচ্চা!
পায়ের কাছে শুয়ে থাকা কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে পুনরায় পাশ ফিরে শুয়ে প্লাতন সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
বাইরে অনেক দূর থেকে কান্না ও আর্তনাদের শব্দে ভসে আসছে, চালাঘরের ফাটল দিয়ে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ভিতরটা শান্ত ও অন্ধকার। অনেকক্ষণ পর্যন্ত পিয়েরের ঘুম এল না, অন্ধকারে চোখ মেলে তাকিয়ে প্লাতনের নাসিকা-গর্জন শুনতে শুনতে তার মনে হল, যে পৃথিবী ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল সেটাই যেন নতুন রূপে, নতুন ও অবিচলিত ভিত্তির উপর নতুন করে গড়ে উঠছে তার আত্মার মধ্যে।
.
অধ্যায়-১৩
যে চালাঘরে পিয়েরকে রাখা হয়েছে সেখানেই রাখা হয়েছে আরো তেইশটি সৈনিক, তিনটি অফিসার ও দুটি কর্মচারীকে। সেখানেই পিয়ের চারটি সপ্তাহ কাটাল।
পরবর্তীকালে সেই দিনগুলির কথা মনে হলে আর সবকিছুই অস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়, একমাত্র প্রাতন কারাতায়েভ ছাড়া, তার মনে প্লাতনের মূর্তিটি সর্বদাই বিরাজ করছে অত্যন্ত স্পষ্ট এক মূল্যবান স্মৃতি হয়ে, রাশিয়ার যা কিছু ভালো ও অখণ্ড তারই প্রতিমূর্তি হয়ে। পরদিন ভোরে পিয়ের যখন তার সেই পার্শ্ববর্তী লোকটিকে দেখল তখন সর্বপ্রথম তার মনে জাগল একটা অখণ্ডতার আভাস : কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ফরাসি ওভারকোট, সৈনিকের টুপি ও কাঠের জুতো পরিহিত প্লাতনের গোটা শরীরটাই যেন এক অখণ্ডতার প্রতিমূর্তি। তার মাথাটা অখণ্ড, তার পিঠ, বুক, ঘাড়, এমন কি সর্বদা আলিঙ্গন-উনুখ দুই প্রসারিত হাত, তার স্মিত হাসি এবং বড় বড় শান্ত দুটি বাদামি চোখ–সবই অখণ্ড।
একজন বুড়ো সৈনিকের ভঙ্গিতে নিজের যেসব অভিযানের কথা সে বলেছে তা থেকেই বোঝা যায় তার বয়স পঞ্চাশ হয়েছে। সে নিজে তার বয়স জানে না, সেটা স্থির করতেও অপারগ। কিন্তু তার ঝকঝকে, উজ্জ্বল, সাদা দুই পাটি অর্ধবৃত্তাকার দাঁত যেমন সুস্থ তেমনই মজবুত, তার দাড়িতে বা মাথায় একটাও সাদা চুল নেই, তার সারা দেহে নমনীয়তা, দৃঢ়তা ও কষ্টসহিষ্ণুতার আভাস।
গ্রেপ্তার হবার পরে প্রথম কয়েকদিন তার শারীরিক শক্তি ও কর্মপটুতা এত বেশি ছিল যে ক্লান্তি ও রোগ কাকে বলে তাই সে জানত না। প্রতি রাতে শোবার আগে সে বলত: প্রভু, আমাকে শুইয়ে দাও পাথরের মতো, আর জাগিয়ে তোল একটুকরো পাউরুটির মতো। আর প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বলত : আমি শুয়েই কুঁকড়ে গিয়েছিলাম, জেগে উঠেই গা ঝাড়া দিয়েছি। সত্যি, শোয়ামাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়ত পাথরের মতো, আর শরীরটাকে একবার ঝাড়া দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত, ঠিক ছোট ছেলেরা যেমন ঘুম থেকে উঠেই খেলার জন্য তৈরি হয়ে যায়। সব কাজই সে করতে পারত, খুব ভালো না পারলেও মন্দও নয়। সে রুটি সেঁকত, রান্না করত, সেলাই করত, জুতো মেরামত করত। সবসময়ই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত, গল্প করত আর গান গাইত শুধু রাতে। শিক্ষিত গায়কের মতো সে গাইত না, গাইত পাখির মতো যখন যেভাবে খুশি।
বন্দি হবার পরে তার মুখে দাড়ি গজাল, মনে হল সামরিক ও অন্য যা কিছু তার চরিত্রের বিপরীত সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সে ফিরে গেছে তার আগেকার চাষীর জীবনে।
এবার সৈনিকের ছুটি-শার্ট থাকছে ব্রিচেসের বাইরে, সে বলত।
সৈনিক জীবনের কথা বলতে তার ভালো লাগত না, অবশ্য সে সম্পর্কে কোনো অভিযোগও তার ছিল না, প্রায়ই বলত যে সারা সৈনিক জীবনে মাত্র একবার তাকে চাবুক খেতে হয়েছে। যখনই কিছু বলত নিজের খ্রিস্টিয় জীবনের (চাষীর জীবনকে সে ঐ নামেই উল্লেখ করত) পুরনো ও মূল্যবান স্মৃতির কথাই বলত।
অন্য সব বন্দিদের কাছে প্লাতন কারাতায়েভ নেহাত্র একজন অতি সাধারণ সৈনিক। তারা তাকে ডাকত ছোট বাজপাখি অথবা প্লাতোশা বলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত, নানা কাজে পাঠাত। কিন্তু পিয়েরের কাছে সে রয়ে গেল প্রথম রাতের দেখা সেই একই মূর্তিঃ সরলতা ও সত্যের এক অপরিমেয় অখণ্ড, শাশ্বত প্রতিমূর্তি।
একমাত্র প্রার্থনা ছাড়া প্লাতন কারাতায়েভ অন্য কিছুই মুখস্থ রাখতে পারত না। কথা বলতে আরম্ভ করে কীভাবে যে শেষ করবে তাও জানত না।
তার কথার অর্থে চমকে উঠে পিয়ের মাঝে মাঝে তাকে কথাটা আর একবার বলতে অনুরোধ করত, কিন্তু একমুহূর্ত আগে যে কথাগুলি বলছে প্লাতন আর একবার তা বলতে পারত না। তার প্রিয় গানঃ স্বদেশ, বার্চগাছ ও আমার রুগ্ন হৃদয়-এর কথাগুলিও সে পিয়েরকে আলাদা করে বলতে পারত না, বললেও গানের বাইরে সে কথাগুলির কোনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যেত না। তার প্রতিটি কথা ও কাজই অজ্ঞাত এক কর্মধারার বহিঃপ্রকাশ–সেই কর্মধারা তারই জীবন। কিন্তু তার জীবনের তো আলাদা করে কোনো অর্থ নেই। এক অখণ্ড সত্তার অংশ হিসেবেই তো তার যার কিছু অর্থ। ফুলের ভিতর থেকে যেমন ভেসে আসে গন্ধ, তেমনই তার কথা ও কাজ তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে অনিবার্য স্বাভাবিকতায়। আলাদা করে কোনো একটি কথা বা কাজের কোনো মূল্য বা তাৎপর্য সে বুঝতে পারে না।
.
অধ্যায়–১৪
প্রিন্সেস মারি যখন নিকলাসের কাছে শুনল যে তার দাদা ইয়ারোস্লাভলে রস্তভদের বাড়িতে আছে তখনই সে সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হল, মাসির কোনো নিষেধই শুনল না, শুধু নিজে নয়, ভাইপোটিকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে বলে স্থির করল। একাজটা কঠিন কি সহজ, সম্ভব কি অসম্ভব, তা সে কাউকে জিজ্ঞাসা করল না, জানতেও চাইল না, দাদা মৃত্যুর পথে, এ সময় তার কাছে থাকা এবং তার ছেলেকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া তার কর্তব্য, তাই সে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু যে নিজে তাকে কিছুই জানায়নি তার কারণ হিসেবে সে ভাবল, হয় তো অত্যধিক দুর্বলতার জন্য সে নিজে চিঠি লিখতে পারছে না, অথবা এই দীর্ঘ পথযাত্রা তার পক্ষে এবং দাদার ছেলেটির পক্ষে যেমন কষ্টকর তেমনই বিপজ্জনক বলেই সে মনে করছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই প্রিন্সেস মারি যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। যাত্রার আয়োজনের মধ্যে আছে একটা বড় পারিবারিক গাড়ি যাতে চড়ে সে ভরোনেঝ গিয়েছিল, একটা আধ-খোলা ছোট এক্কা ও একটা মালগাড়ি। তার সঙ্গে যাচ্ছে মাদময়জেল বুরিয়ে, ছোট্ট নিকলাস ও তার শিক্ষক, বুড়ি নার্স, তিনটি দাসী, তিখন, যুবক পরিচারক ও সংবাদবাহক।
মস্কোর ভিতর দিয়ে প্রচলিত পথে যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। প্রিন্সেস মারিকে বাধ্য হলে লিপেৎক্ত, রিয়াজান, ভাদিমির ও শুয়ার ভিতর দিয়ে যে ঘোরা পথটা বেছে নিতে হল সেটা খুব দীর্ঘ, আর সে পথের সব জায়গায় ডাক-ঘোড়া পাওয়া যায় না বলে খুবই কষ্টসাধ্য, আর যেহেতু রিয়াজনের কাছে ফরাসিরা দেখা দিয়েছে সেজন্য পথটা বিপজ্জনকও বটে।
এই কষ্টকর পথযাত্রায় প্রিন্সেস মারির উদ্যম ও মনের জোর দেখে মাদময়জেল বুরিয়ে, দেসালেস ও চাকরবাকররা অবাক হয়ে গেছে। সকলের পরে সে শুতে যায়, আর ঘুম থেকে ওঠে সকলের আগে, কোনো কষ্টই তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। তার উদ্যম ও কর্মশক্তির ফলেই দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ নাগাদ তারা ইয়ারোস্লাভলের কাছে পৌঁছে গেল।
ভরোনেঝে শেষের দিন কয়টা ছিল তার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন। রস্তভের প্রতি ভালোবাসা আর তাকে যন্ত্রণা দেয় না, বিচলিত করে না। সে ভালোবাসা তার সারা মন জুড়ে আছে, তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, তার বিরুদ্ধে সে আর এখন লড়াই করে না। স্পষ্ট করে নিজেকে না বললেও ইদানীং তার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে সে ভালোবেসেছে এবং ভালোবাসা পেয়েছে।
কিন্তু মনের একদিককার এই সুখ দাদার জন্য দুঃখবোধের পথে কোনোরকম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, উপরন্ত, মনের এই প্রশান্তির ফলে দাদার প্রতি মনোভাবকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
ভ্রমণের সময় যেরকম ঘটে থাকে, প্রিন্সেস মারি শুধু যাত্রার কথাই ভাবতে লাগল, উদ্দেশ্যটা ভুলে রইল। কিন্তু ইয়ারোস্লাভলের যত কাছে এগোতে লাগল ততই সন্ধ্যার মধ্যেই যে দৃশ্যের সম্মুখীন তাকে হতে হবে তার চিন্তা নতুন করে মনে জাগল, তার উত্তেজনাকে চরমে তুলে দিল।
রস্তভরা কোথায় আছে এবং প্রিন্স আন্দ্রু কেমন আছে তা জানবার জন্য সংবাদবাহকটাকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বড় গাড়িটা শহরের ফটক দিয়ে ঢুকলে প্রিন্সেস মারি যখন জানালা দিয়ে মুখটা বের করল তখন তার মুখের ভয়ংকর ফ্যাকাসে ভাব দেখে লোকটি ভয় পেয়ে গেল।
বলল, সব খোঁজ নিয়েছি ইয়োর এক্সেলেন্সিঃ রস্তভরা আছেন স্কোয়ারের ভিতরে বণিক ব্রোনিকভের বাড়িতে, এখান থেকে বেশি দূর নয়, ভলগার একেবারে দক্ষিণ তীরে।
প্রিন্সেস মারি সভয়ে তার দিকে তাকাল, যেকথা সে সব চাইতে বেশি করে জানতে চাইছে তার জবাব লোকটি দিচ্ছে না কেন : তার দাদা কেমন আছে? মাদময়জেল বুরিতেঁই প্রশ্নটা করল।
প্রিন্স কেমন আছেন?
হিজ এক্সেলেন্সি তাদের সঙ্গে এক বাড়িতেই আছেন।
তাহলে বেঁচে আছে, এই কথা ভেবে বলল, সে কেমন আছে?
চাকররা বলছে, একই রকম।
একই রকম মানে কি সেটা প্রিন্সেস মারি জিজ্ঞাসা করল না, সকলের অলক্ষ্যে সাত বছরের নিকলাসের দিকে একবার তাকিয়ে সেই যে মাথা নিচু করল, ভারি গাড়িটা দুলে দুলে ঝাঁকুনি দিতে দিতে সশব্দে চলতে চলতে না থামা পর্যন্ত আর সে মাথা তুলল না। ঝনঝন শব্দে গাড়ির সিঁড়িটা নামিয়ে দেওয়া হল।
গাড়ির দরজা খুলে গেল। বাঁ দিকে জল-একটা বড় নদী–ডান দিকে বারান্দা। ফটকে অনেকে দাঁড়িয়ে আছেঃ চাকরবাকর, আর একটি গোলাপি মেয়ে, মেয়েটি যেন মুখ ভার করে হাসছে। (মেয়েটি সোনিয়া)। প্রিন্সেস মারি সিঁড়ি বেয়ে ছুটে চলল। মেয়েটি তেমনই কৃত্রিম হাসির সঙ্গে বলে উঠল, এই পথে, এই পথে! হলে ঢুকে প্রিন্সেস সামনেই দেখতে পেল প্রাচ্য দেশীয় চেহারার একটি বর্ষীয়সী মহিলাকে। মহিলাটি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল। কাউন্টেস।
প্রিন্সেস মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।
ফরাসিতে বলল, বাছা আমার! তোমাকে কত ভালোবাসি, কতদিন হল তোমার কথা শুনিছ, জানছি।
প্রিন্সেস মারি বুঝতে পারল ইনিই কাউন্টেস, এঁর সঙ্গে কিছু বলা দরকার। ফরাসিতে কিছু সৌজন্যসূচক কথা বলে সে শুধালঃ ও কেমন আছে?
ডাক্তার বলছে আর কোনো বিপদ নেই, কথাগুলি মুখে বললেও দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমনভাবে চোখ তুলে তাকাল যাতে তার কথার প্রতিবাদই বুঝি প্রকাশ পেল।
প্রিন্সেস বলল, সে কোথায়? আমি কি তাকে দেখতে পারি–দেখতে পারি?
একটু দেরি কর প্রিন্সেস, একটু। এটি বুঝি তার ছেলে? দেসেলেসের সঙ্গে ঘরে ঢুকতেই ছোট্ট নিকলাসকে দেখিয়ে কাউন্টেস বলল। বাড়িটা বেশ বড়, সকলেরই জায়গা হয়ে যাবে। আহা, কী চমৎকার ছেলেটি!
কাউন্টেস প্রিন্সেস মারিকে নিয়ে বৈঠকখানায় গেল। সেখানে সোনিয়াও মাদময়জেল বুরিয়ে গল্প করছিল। কাউন্টেস ছেলেটিকে আদর করতে লাগল, আর বুড়ো কাউন্ট এসে প্রিন্সেসকে স্বাগত জানাল। প্রিন্সেস মারি যখন তাকে সর্বশেষ দেখেছিল তারপর থেকে বুড়ো কাউন্ট অনেক বদলে গেছে। তখন সে ছিল চটপটে, ফুর্তিবাজ, আত্মপ্রত্যয়শীল একটি বৃদ্ধ, আর এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটি করুণ, বিভ্রান্ত মানুষ। প্রিন্সেস মারির সঙ্গে কথা বলার সময় সে অনবরত চারদিকে তাকাচ্ছে, যেন জানতে চাইছে তার ব্যবহার ঠিক হচ্ছে কি না। মস্কোর ধ্বংস এবং তার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাবার পরে অভ্যস্ত আশ্রয় থেকে সরে এসে সে যেন নিজের গুরুত্ববোধটাই হারিয়ে ফেলেছে, যেন ধরেই নিয়েছে জীবনে তার আর কোনো স্থান নেই।
সোনিয়ার পরিচয় দিয়ে বলল, এটি আমার জ্ঞাতি বোন-ঝি-তোমার সঙ্গে ওর পরিচয় নেই প্রিন্সেস?
প্রিন্সেস মারি সোনিয়ার দিকে তাকাল, মনের বিরূপ অনুভূতিকে চাপা দেবার চেষ্টা করে তাকে চুমো খেল। কিন্তু এখানকার সকলের মনের অবস্থাই তার থেকে আলদা দেখে তার খুব কষ্ট হতে লাগল।
সকলের দিকে ফিরে সে আবার শুধাল, সে কোথায়?
সোনিয়া লজ্জায় লাল হয়ে বলল, তিনি নিচে আছেন। নাতাশা তার কাছে আছে। তার কাছে লোক পাঠানো হয়েছে। আপনাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে প্রিন্সেস।
বিরক্তিতে প্রিন্সেস মারির চোখে জল এসে গেল। মুখ ঘুরিয়ে কাউন্টেসকে আবার জিজ্ঞাসা করতে যাবে কীভাবে তার কাছে যাবে, এমন সময় দরজায় পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঘুরে তাকিয়ে প্রিন্সেস দেখল নাতাশা প্রায় ছুটে আসছে–অনেকদিন আগে মস্কোতে যাকে দেখে তার মোটেই ভালো লাগেনি সেই নাতাশা।
কিন্তু নাতাশার মুখের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল যে এতক্ষণে একজন সমব্যথী সে পেয়েছে, এই তো বন্ধু। প্রিন্সেস ছুটে নাতাশার কাছে গেল, তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল।
প্রিন্স আন্দ্রুর বিছানার মাথার কাছে বসে প্রিন্সেস মারির আসার সংবাদ শোনামাত্রই সে ছুটে এখানে চলে এসেছে।
ছুটতে ছুটতে সে যখন বৈঠকখানায় ঢুকল তখন তার উত্তেজিত মুখে শুধু একটি লক্ষণই ফুটে উঠেছে-ভালোবাসার লক্ষণ-সীমাহীন ভালোবাসা-প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি, প্রিন্সেস মারির প্রতি, তার প্রেমিকের যারাই নিকটজন তাদের প্রতি, সে মুখে আরো ফুটে উঠেছে করুণা, অন্যের জন্য কষ্টস্বীকার এবং অপরের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করার একান্ত বাসনা। এই মুহূর্তে নাতাশার অন্তরে নিজের চিন্তা অথবা প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে তার সম্পর্কের চিন্তার কোনো স্থান নেই।
নাতাশার মুখের উপর প্রথম দৃষ্টিপাতের ফলেই তীক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্না প্রিন্সেস মারি এসব কথা বুঝতে পেরেছে, তাই তো তার কাঁধে মাথা রেখে দুঃখের সুখে সে কাঁদছে।
চল, ওর কাছে চল মারি, বলেই নাতাশ তাকে অন্য ঘরে নিয়ে চলল।
প্রিন্সেস মারি মাথা তুলে চোখ মুছে নাতাশার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সে বুঝল, এর কাছ থেকেই সে সবকিছু জানতে ও বুঝতে পারবে।
কেমন..প্রশ্ন করতে গিয়েও সে থেমে গেল।
তার মনে হল, কথায় প্রশ্ন করা বা জবাব দেওয়া দুইই অসম্ভব। নাতাশার চোখ-মুখই তাকে সব কথা পরিষ্কারভাবে, গভীরভাবে বুঝিয়ে দেবে।
নাতাশা তার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে, ইতস্তত করছে সব কথা বলবে কি না। হঠাৎ নাতাশার ঠোঁট দুটি কুঁকড়ে উঠল, মুখের চারদিকে বিশ্রী ভাঁজ দেখা দিল, দুই হাতে মুখ ঢেকে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
প্রিন্সেস মারি সব বুঝতে পারল।
তবু আশা ছাড়ল না, সেকথার উপর তার নিজেরই ভরসা নেই সে কথায়ই প্রশ্ন করলঃ কিন্তু তার ঘাটা কেমন আছে? সাধারণ অবস্থাই বা কেমন?
তুমি, তুমি,…নিজেই দেখতে পাবে নাতাশা এর বেশি কিছু বলতে পারল না।
দুজনই আরো কিছুক্ষণ নিচেই বসে রইল, তারপর কান্না থামলে শান্ত মুখে তার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
সমস্ত রোগটা কি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার অবস্থা কি অনেকদিন থেকেই খারাপ? কখন এরকম হল? প্রিন্সেস মারি একে একে খোঁজ নিতে লাগল।
নাতাশা বলল, জ্বর ভাব ও যন্ত্রণার জন্য বেশ বিপদ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু ত্রয়েৎসায় এসে সেটা কেটে গেল, তখন ডাক্তার শুধু গ্যাংগ্রিনের আশংকা করতে লাগল। সে বিপদও কেটে গেছে। ইয়ারোস্লাভল আসার পর থেকে ক্ষতস্থানে পুঁজ হতে শুরু করল, তবে ডাক্তার বলল যে এটা স্বাভাবিক পথেই মোড় নেবে। তারপর দেখা দিল জ্বর, কিন্তু ডাক্তার বলেছে যে জ্বরটা গুরুতর কিছু নয়।
উদগত কান্নাকে চাপা দিয়ে নাতাশা বলল, কিন্তু দুদিন আগে হঠাৎ এটা ঘটেছে। কেন তা জানি না, কিন্তু
সে কি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। শুকিয়ে গেছে? প্রিন্সেস জানতে চাইল।
না, ঠিক তা নয়, আরো খারাপ। নিজেই দেখবে। ও মারি, সে এত ভালো, সে বাঁচতে পারে না, বাঁচতে পারে না, কারণ…
.
অধ্যায়-১৫
পরিচিত ভঙ্গিতে প্রিন্স আন্দ্রুর দরজাটা খুলে নাতাশা যখন তার আগে আগে প্রিন্সেস মারিকে ঘরে ঢুকতে দিল, তখন প্রিন্সেসের বুকের ভিতর থেকে একটা চাপা কান্না ঠেলে উঠছে। অনেক চেষ্টা করে এখন নিজেকে কিছুটা শান্ত করলেও সে জানে যে দাদাকে দেখে সে চোখের জল রাখতে পারবে না।
দুদিন আগে হঠাৎ এটা ঘটেছে, এই কথার দ্বারা নাতাশা কি বোঝাতে চেয়েছিল প্রিন্সেস তা বুঝতে পেরেছে। কথাগুলির অর্থ, সে হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, এভাবে নরম হয়ে যাওয়া, শান্ত হয়ে যাওয়া আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ। দরজায় পা রাখতে গিয়েই কন্নায় সে আর ছেলেবেলার মুখখানি যেন দেখতে পেল। সে নিশ্চিত জানে, মৃত্যুর আগে তার বাবা যেমন বলেছিল আন্দ্রুও তেমনই নরম, মমতাভরা স্বরে তার সঙ্গে কথা বলবে, আর সেও তা সহ্য করতে না পেরে তার সামনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে। কিন্তু আগে হোক পরে হোক, ঘরে তো ঢুকতে হবেই, সে ভিতরে গেল। আন্দ্রুকে যতই স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে, নিজের ক্ষীণ দৃষ্টিতে যতই তার চোখ-মুখ পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠছে, ততই চাপা কান্না তার গলা বেয়ে ঠেলে উপরে উঠে আসছে, তারপরই তার মুখটা সে দেখতে পেল, তার চোখে চোখ পড়ল।
কাঠবেড়ালের লোমের ড্রেসিং-গাউন পরে চারদিকে বালিশ রেখে সে একটা ডিভানে শুয়ে আছে। শীর্ণ, বিবর্ণ চেহারা। সরু, সাদা একটা হাতে একখানা রুমাল, অন্য হাতে নবোদগত গোঁফে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে, ধীরে ধীরে আঙুলগুলি নড়ছে। তারা ঘরে ঢুকতেই একদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
তার মুখখানি দেখে, চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারির গতি সহসা শিথিল হয়ে এল, তার মনে হল, চোখের জল শুকিয়ে গেছে, চাপা কান্না থেমে গেছে। তার চোখ-মুখের ভাষা বুঝতে পেরে সহসা নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হল, একটা ভীরুতা তাকে ঘিরে ধরল।
নিজেকেই শুধাল, কিন্তু কিসে আমি অপরাধী? আর ঠাণ্ডা, কঠোর দৃষ্টি যেন জবাব দিল, কারণ তুমি বেঁচে আছে, জীবিতের কথা ভাবছ, আর আমি…।
তার যে গভীর দৃষ্টি বাইরের পরিবর্তে ভিতরটাকেই দেখতে পায় তাতে ফুটে উঠেছে একটা বিরূপতার আভাস।
বোনের হাতটা নিয়ে তাতে চুমো খেল।
দৃষ্টির মতোই শান্ত ও নিস্পৃহ গলায় বলল, কেমন আছ মারি? এখানেই বা এলে কেমন করে?
আন্দ্রুর গলার স্বর শুনে প্রিন্সেস মারি হতবাক হয়ে গেল। সে যদি যন্ত্রণায় চিৎকার করত তাহলে সে চিৎকারও বুঝি প্রিন্সেস মারি বুকে এতখানি ত্রাসের সঞ্চার করতে পারত না।
সেই একই ধীর, শান্ত গলায় সে আবার বলল, ছোট্ট নিকলাসকে সঙ্গে করে এনেছ কি?
এখন কেমন আছ? প্রশ্নটা করে প্রিন্সেস মারি নিজেই অবাক হয়ে গেল।
সেটা তুমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করো, সে জবাব দিল। পুনরায় স্নেহশীল হবার চেষ্টায় শুধু ঠোঁট দুটি নেড়েই সে ফরাসিতে বলল :
এখানে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
প্রিন্সেস মারি তার হাতটা চেপে ধরল। সে চাপে আর মুখটা ঈষৎ কুঞ্চিত হল। আন্দ্রু চুপ, প্রিন্সেসও জানে না কি বলবে। এখন সে বুঝতে পেরেছে দুদিন আগে আর কি হয়েছে। আন্দ্রুর কথায়, গলার স্বরে, বিশেষ করে তার শান্ত বিরূপ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে বিচ্ছেদ, আর একটি জীবিত মানুষের বেলায় সেটা বড়ই ভয়ংকর। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, অনেক চেষ্টা করে তবে সে জীবিতকে বুঝতে পারছে, কিন্তু আসলে সে বুঝতে পারছে না, বুঝবার শক্তি নেই বলে নয়, আসল কারণ সে বুঝেছে অন্য কিছু–এমন কিছু যাকে জীবিতরা বোঝে না, বুঝতে পারে না-সেই বোধই এখন তার মনকে ভরে রেখেছে।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে নাতাশাকে দেখিয়ে সে বলল, দেখ, কী বিচিত্র পথে ভাগ্য আবার আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে। সে তো সারাক্ষণই আমার দেখাশোনা করছে।
প্রিন্সেস মারি কথাগুলি শুনল, কিন্তু এসব কথা আন্দ্রু বলছে কেমন করে তা সে বুঝতে পারল না। সে অনুভূতিশীল, মমতাময় প্রিন্স আন্দ্রু-কেমন করে তার সামনেই এসব কথা তাকেই বলতে পারল যাকে সে ভালোবাসে আর যে তাকে ভালোবাসে? তার যদি জীবনের আশা থাকত তাহলে এমন আপত্তিজনক সুরে এই কথাগুলি সে বলতে পারত না। সে যদি না জানত যে সে মরতে চলেছে তাহলে সে কি ওকে করুণা না করে পারত? ওর সামনে এমন কথা বলতে পারত? এর একমাত্র ব্যাখ্যা সে আজ উদাসীন, কারণ অন্য কিছু, অনেক বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু, তার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আলোচনা হতে লাগল নিস্পৃহ ও অসংলগ্নভাবে, মাঝে মাঝেই বাধা পড়ল।
মারি এসেছে রিয়াজানের পথে, নাতাশা বলল।
সত্যি? আন্দ্রু শুধাল।
ওরা বলছে যে গোটা মস্কো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আর…
নাতাশা থেমে গেল। কথা বলা অসম্ভব। বোঝা যাচ্ছে যে আ মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।
আন্দ্রু বলল, হ্যাঁ, সকলেই তাই বলছে। বড়ই দুঃখের কথা। অন্যমনস্কভাবে আঙুল দিয়ে গোঁফে টোকা দিতে দিতে সে সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তারপর যেন দুজনের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে কথা বলার বাসনাতেই প্রিন্স আন্দ্রু হঠাৎ বলে উঠল, তাহলে কাউন্ট নিকলাসের সঙ্গে তোমার দেখা হল মারি? সে তো এখানে লিখেছে, যে তোমাকে তার খুব পছন্দ। তোমারও যদি তাকে ভালো লেগে থাকে তাহলে তো তোমাদের বিয়ে হলে বেশ ভালোই হয়।
প্রিন্সেস মারি তার কথাগুলি শুনল, কিন্তু জীবিত সবকিছু থেকে সে যে এখন কতদূরে চলে গেছে তারই প্রমাণ ছাড়া কথাগুলির মধ্যে তার কোনো অর্থই সে খুঁজে পেল না।
আমার কথা কেন বলছ? শান্তভাবে বলে মারি নাতাশার দিকে তাকাল।
নাতাশা বুঝতে পারল, কিন্তু মারির দিকে তাকাল না। তিনজনই আবার নিশ্চুপ।
প্রিন্সেস মারি হঠাৎ কাঁপা গলায় বলে উঠল, আন্দু, ছোট্ট নিকলাসকে দেখবে না? সে তো সবসময় তোমার কথা বলে।
প্রিন্স আন্দ্রু এই প্রথম একটুখানি হাসল, কিন্তু প্রিন্সেস মারি তো তার মুখকে ভালোভাবেই চেনে, সে সভয়ে প্রত্যক্ষ করল, সুখের জন্য বা ছেলের প্রতি স্নেহবশত আন্দ্রু হাসেনি, হেসেছে শান্ত শ্লেষে, কারণ তার মনে হয়েছে যে তাকে জাগিয়ে রাখবার শেষ চেষ্টা হিসেবেই প্রিন্সেস কথাগুলি বলেছে।
হ্যাঁ, তাকে দেখলে আমি খুশি হব। সে বেশ ভালো আছে তো?
ছোট্ট নিকলাসকে যেখন প্রিন্স আন্দ্রুর ঘরে আনা হল তখন সে ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকাল, কিন্তু কাঁদল না, কারণ আর কেউই কাঁদছে না। প্রিন্স আন্দ্রু তাকে চুমো খেল, কিন্তু কি কথা তাকে বলবে তা বুঝতে পারল না।
নিকলাসকে বাইরে নিয়ে যাবার পরে প্রিন্সেস মারি আবার দাদার কাছে গেল, তাকে চুমো খেল, কিন্তু এবার আর চোখের জল রোধ করতে পাল না, কাঁদতে লাগল।
প্রিন্স আন্দ্রু একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
বলল, নিকলাসের জন্য কাঁদছ?
প্রিন্সেস মারি মাথা নেড়ে কাঁদতেই লাগল।
মারি, তুমি কি সুভাষিতাবলী… প্রিন্স আন্দ্রু থেমে গেল।
কি বললে?
কিছু না। এখানে তুমি কেঁদ না, সেই একই নিস্পৃহভাবে প্রিন্সেস মারির দিকে তাকিয়ে সে বলল।
সে কান্না দেখে প্রিন্স আন্দ্রু বুঝতে পারল, ছোট্ট নিকলাস এবার পিতৃহারা হবে সে চিন্তায়ই প্রিন্সেস মারি কাঁদছে। আপ্রাণ চেষ্টায় সে জীবনের পথে ফিরে আসতে চাইল, তাদের মতো করে সবকিছু দেখতে চাইল।
ভাবল, হ্যাঁ, এদের কাছে সেটা দুঃখের। কিন্তু কত সহজ, সরল।
আকাশের পাখিরা বীজ বোনে না, ফসলও কাটে না, তবু তোমাদের পরম পিতা তাদের আহার যোগায়, কথাগুলি সে নিজেকে বলল, আর প্রিন্সেস মারিকেও বলতে চাইল, কিন্তু না, ওরা বুঝবে না, কথাটা ওরা ওদের মতো করে নেবে। ওরা বুঝতে পারে না, যেসব অনুভূতিকে ওরা মূল্য দেয়-আমাদের সেইসব অনুভূতিই অপ্রয়োজনীয়। পরস্পরকে আমরা বুঝতে পারি না। সে চুপ করে রইল।
প্রিন্স আন্দ্রুর ছেলের বয়স সাত। একটু-আধটু পড়তে পারে, কিছুই জানে না। সেদিনের পর থেকে অনেক কিছুর ভিতর দিয়ে সে জীবন কাটিয়েছে, জ্ঞান লাভ করেছে, দেখেছে, অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীকালে যেসব বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী সে হয়েছে সেগুলি যদি সেদিন তার আয়ত্তে থাকত তাহলেও তার বাবা, মারি ও নাতাশার মধ্যে যে দৃশ্যটি অভিনীত হতে সে দেখেছে তার অর্থকে সেদিনের মতো আরো ভালোভাবে বা গভীরভাবে বুঝতে পারত না। সবকিছুই সে বুঝছে, না কেঁদে নাতাশার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে নীরবে তার দিকেই এগিয়ে গেল, সুন্দর চিন্তামগ্ন দুটি চোখ মেলে সলজ্জভাবে তার দিকে তাকাল, তার গোলাপি উপরের ঠোঁটটা কাঁপতে লাগল।
তারপর থেকেই সে দেসালেস ও কাউন্টেসকে এড়িয়ে চলতে লাগল, হয় একাকি বসে থাকে, নয়তো ভীরু পায়ে প্রিন্সেস মারি অথবা নাতাশার কাছে যায়, শান্ত লাজুক ভঙ্গিতে তাদের জড়িয়ে ধরে।
প্রিন্স আন্দ্রুর কাছ থেকে চলে যাবার পরে প্রিন্সেস মারি ভালোভাবেই বুঝতে পারল কি লেখা ছিল নাতাশার মুখে। আন্দ্রুকে বাঁচিয়ে তোলার কোনোরকম আশার কথা সে আর কোনোদিন নাতাশাকে বলেনি। নাতাশার সঙ্গে পাল্লা করে আর সোফার পাশে বসে থাকে, চোখের জল ফেলে না, অনবরত প্রার্থনা করে, একান্ত অন্তরে সেই শাশ্বত ও অপরিময়র দিকেই তাকিয়ে থাকে, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির উপরে যার উপস্থিতির প্রভাব এখন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
.
অধ্যায়-১৬
প্রিন্স আন্দ্রু জানে সে মরবে, শুধু তাই নয়, সে বুঝতে পারছে সে মরতে চলেছে, এখনই অর্ধমৃত। পার্থিব সবকিছু থেকে একটা দূরত্ব বোধ, অস্তিত্বের একটা বিচিত্র আনন্দময় হাল্কাভাবের চেতনা তাকে ঘিরে ধরেছে। কোনোরকম তাড়াহুড়া বা উত্তেজনা ছাড়াই আসন্ন মৃত্যুর জন্য সে অপেক্ষা করছে। যে দুর্লংঘ্য, শাশ্বত, অতিদূর, অজ্ঞাতের উপস্থিতি সে সারাজীবন অনুভব করেছে, আজ সে কাছে এসেছে, একটা বিচিত্র হাল্কা অভিজ্ঞতার মধ্যে সে যেন বোধগম্য হয়ে উঠছে…।
আগে আগে এই পরিণতিকে সে ভয় পেত। ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর-এই পরিণতির–অভিজ্ঞতা তার দুবার হয়েছে, কিন্তু এখন আর সেই ভয়কে সে বুঝতে পারছে না।
একটা গোলা যখন লাটিমের মতো তার সামনে পাক খাচ্ছিল তখনই প্রথম এই ভয় সে পেয়েছিল, শস্যহীন ক্ষেত, ঝোঁপঝাড় ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল যে সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। আহত হবার পরে আবার যখন নিজেকে ফিরে পেল, জীবনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে শাশ্বত, চিরমুক্ত ভালোবাসার কমলটি যখন মুহূর্তের মধ্যে তার অন্তরের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, তখন আর তার মৃত্যুর ভয় রইল না, মৃত্যুর চিন্তাই সে ছেড়ে দিল।
আহত হবার পরে সে যখন নির্জনতা, যন্ত্রণা ও আংশিক বিকারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল তখন সদ্য প্রকাশিত শাশ্বত প্রেমের মধ্যে সে যতই ডুব দিচ্ছিল ততই নিজের অজ্ঞাতে সে পার্থিব জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল। সবকিছুকে, সকল জীবকে ভালোবাসা, ভালোবাসার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার অর্থ কোনো একজনকে ভালোবাসা নয়, পার্থিব জীবনটাকে চালিয়ে যাওয়া নয়। ভালোবাসার এ রীতিতে সে যতই উদ্বুদ্ধ হতে লাগল ততই সে জীবনকে পরিহার করে চলল, ততই জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী প্রাচীরটাকে সে ভেঙে ফেলতে লাগল। সেই সময়ে মৃত্যুর চিন্তা মনে এলেই সে নিজেকে বলত, আরে, তাতে কি হল? সে তো আরো ভালো!
কিন্তু মিতিশচির সেই রাতে অর্ধ বিকারের মধ্যে সে যখন সেই বহুবাঞ্ছিতাকে সামনে দেখতে পেল, তার ঠোঁটের উপর নিজের হাতটা রেখে সেই নারী যখন সুখের অশ্রু ঝরাল চোখে, তখন নিজের অলক্ষ্যেই একটি নারীর প্রতি ভালোবাসা আবার তার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করল, আবার তাকে বেঁধেছিল জীবনের সঙ্গে। একটা সানন্দ উদ্বিগ্ন চিন্তা তার মনে বাসা বাঁধল। অ্যাম্বুলেন্স ঘাঁটিতে কুরাগিনের সঙ্গে দেখা হাবার মুহূর্তটি স্মরণ করতে গিয়ে তখন তার মনের ভাব কি রকম হয়েছিল তা সে মনে করতে পারে না, কিন্তু কুরাগিন বেঁচে আছে কি না সে চিন্তা তাকে কষ্ট দিয়েছিল। সে সম্পর্কে খোঁজ নেবার সাহস পর্যন্ত তার হয়নি।
তার অসুস্থতা স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল, কিন্তু এটা হঠাৎ ঘটল বলতে গিয়ে নাতাশা যে অবস্থার কথা উল্লেখ করেছে সেটা ঘটেছে প্রিন্সেস মারি আসার দুদিন আগে। জীবন ও মৃত্যুর সেই শেষ আত্মিক সগ্রামে মৃত্যুই বিজয়ী হয়েছে। তার থেকে এই অপ্রত্যাশিত উপলব্ধি তার হয়েছে, যে-জীবন নাতাশার প্রতি ভালোবাসার রূপ ধরে তার কাছে উপস্থিত হয়েছে তাকে সে এখনো মূল্যবান মনে করে, আর তাই অজ্ঞাতপূর্ব একটা আতংক তাকে আক্রমণ করেছে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ডিনারের পরে আগের মতোই একটু জ্বরভাব হয়েছে, চিন্তার ধারা হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক রকমের স্বচ্ছ। সোনিয়া বসে আছে টেবিলের পাশে। প্রিন্স আন্দ্রু ঘুমে ঢুলছে। সহসা একটা আনন্দের অনুভূতি জাগল তার মনে।
আঃ, সে এসেছে! সে ভাবল।
আর সত্যি তাইঃ সোনিয়ার জায়গায় নিঃশব্দে এসে বসেছে নাতাশা।
যবে থেকে নাতাশা তার দেখাশোনা করতে শুরু করেছে তবে থেকেই তার উপস্থিতি সে সবসময়ই বুঝতে পারে। তার মুখের উপর থেকে মোমবাতির আলোটাকে আড়াল করে নাতাশা একটা হাতল-চেয়ারে বসে মোজা বুনছে। প্রিন্স আন্দ্রু একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, যেসব বুড়ি নার্স মোজা বোনে তাদের মতো রোগীর শুশ্রূষা কেউ করতে পারে না, মোজা বোনার মধ্যে একটা শান্তভাব আছে, সেই থেকেই নাতাশা মোজা বোনা শিখছে। তার হাতে সূচ চলছে দ্রুতগতিতে, তার চিন্তাম্বিত আনত মূর্তিটা দেখা যাচ্ছে। একটু নড়তেই সুতোর গোলাটা হাঁটুর উপর থেকে গড়িয়ে পড়ল। প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে একবার তাকিয়ে গোলাটা কুড়িয়ে নিয়ে সে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসল।
প্রিন্স আন্দ্রু শোয়া অবস্থাতেই নাতাশার দিকে তাকাল, বুঝতে পারল, একটা ভারি শ্বাস টানবার ইচ্ছা হওয়া সত্ত্বেও তা না করে খুব সাবধানে শ্বাস টানতে লাগল।
এয়ৎসা মঠে অতীতের কথাপ্রসঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশাকে বলেছিল, বেঁচে থাকলে এই ক্ষতের জন্য সে ঈশ্বরকে চিরদিন ধন্যবাদ দেবে, কারণ এই ক্ষতই তাদের দুজনকে আবার মিলিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে তারা কোনোদিন ভবিষ্যতের কথা বলেনি।
নাতাশার দিকে তাকিয়ে ইস্পাতের সূচের শব্দ শুনতে শুনতে সে ভাবল, এ কি হতে পারে, না পারে না? এমন অদ্ভুতভাবে ভাগ্য আমাকে ওর কাছে নিয়ে এসেছে কি শুধু আমাকে মেরে ফেলবার জন্য? …এও কি সম্ভব যে জীবনের সত্যকে আমার কাছে প্রকাশ করা হয়েছে শুধু এটাই বোঝতে যে মিথ্যার পথেই আমি জীবনটাকে কাটিয়েছি? পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে ওকে আমি বেশি ভালোবাসি। কিন্তু ওকে ভালোবেসে আমি কি করব? নিজের অজ্ঞাতেই তার মুখ হতে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে গেল।
সে শব্দ শুনে নাতাশা মোজাটা রেখে তার দিকে ঝুঁকল, হঠাৎ তার চকচকে চোখের দিকে চোখ পড়তেই আস্তে পা ফেলে তার কাছে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল।
তুমি কি ঘুমিয়েছ?
না, অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছি। তোমার আসা আমি টের পেয়েছি। তুমি এলে যে মৃদু প্রশান্তির স্বাদ পাই তা আর কেউ দিতে পারে না।…সে এক আলো। সুখে আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
নাতাশা আরো কাছে এগিয়ে গেল। পরমানন্দে তার ঝিলমিল করছে।
নাতাশা, আমি তোমাকে বড় বেশি ভালোবাসি! পৃথিবীর অন্য সবকিছুর চাইতে বেশি।
আর আমি!–মুহূর্তের জন্য নাতাশা মুখটা ফিরিয়ে নিল। শুধাল, বড় বেশি বললে কেন।
কেন বড় বেশি?…আচ্ছা, তুমি কি মনে কর, তোমার মন কি বলে–আমি বাঁচব তো? তুমি কি মনে কর?
সে বিষয়ে তো আমি নিশ্চিত, সম্পূর্ণ নিশ্চিত! গভীর আগ্রহে তার দুটি হাত ধরে নাতাশা প্রায় চেঁচিয়ে বলল।
প্রিন্স আন্দ্রু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তাহলে কী ভালোই হত!নাতাশার হাতটা নিয়ে তাতে চুমো খেল।
নাতাশার মনে সুখের উচ্ছ্বাস, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, এ চলবে না, আন্দ্রুকে শান্ত হয়ে থাকতে হবে।
আন্দ্রুকে চেপে রেখে বলল, কিন্তু তুমি ঘুমোওনি। ঘুমোতে চেষ্টা কর…দোহাই!
প্রিন্স আন্দ্রু তার হাতটা চেপে ধরে ছেড়ে দিল, নাতাশা ফিরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসল। দুবার তার দিকে তাকাল, দুবার দেখল প্রিন্স আন্দ্রুর উজ্জ্বল চোখ দুটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নাতাশা মোজা বোনায় মন দিল, স্থির করল শেষ না করা পর্যন্ত মুখ ফেরাবে না।
প্রিন্স আন্দ্রুও অচিরেই চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল। বেশিক্ষণ ঘুম হল না, হঠাৎই চমকে জেগে উঠল, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
ঘুমোবার আগেও সে একথাই ভাবছিল–জীবন ও মৃত্যুর কথা, প্রধানত মৃত্যুর কথা। মনে হল, ক্রমেই সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।
ভালোবাসা ভালোবাসা কি? সে ভাবতে লাগল।
ভালোবাসা মৃত্যুকে বাধা দেয়। ভালোবাসাই জীবন। যা কিছু বুঝি, ভালোবাসি বলেই বুঝি। একমাত্র ভালোবাসাতেই সবকিছুর এক হয়। ভালোবাসাই ঈশ্বর, আর মরে যাওয়া মানেই আমি, সেই কিছুটা সান্ত্বনা পেল। কিন্তু সে তো চিন্তা মাত্র। তাতে কিসের যেন অভাব আছে, যথেষ্ট পরিষ্কার নয়, বড় বেশি একপেশে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মস্তিষ্কের বোনা জাল। ফিরে এল আগেকার সেই উত্তেজনা ও অস্পষ্টতা। সে ঘুমিয়ে পড়ল।
স্বপ্ন দেখল, সেই ঘরেই সে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ ও অক্ষত। নানা ধরনের সাধারণ মানুষ তার সামনে এল। সে তাদের সঙ্গে কথা বলল, নানা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। তার যেন কোথায় যাবার জন্য প্রস্তত হচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রু আবছাভাবে বুঝতে পারল, এসবই তুচ্ছ, আরো বড় কাজ তার হাতে আছে, কিন্তু সে কথা বলেই চলল, তার চুটকি কথায় সকলকে তাক লাগিয়ে দিল। ক্রমে সকলেই অলক্ষ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর সব চাইতে বড় হয়ে দেখা দিল রুদ্ধদ্বার ঘরে আলোচনার যোগ্য একটি মাত্র প্রশ্ন। সে উঠে দাঁড়াল, দরজায় ছিটকিনি টেনে তালা লাগাতে এগিয়ে গেল। যথাসময়ে তালাটা লাগাতে পারবে কি না তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। তাড়াতাড়ি যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু পা চলল না, বুঝতে পারল যে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেও সে যথাসময়ে দরজায় তালা লাগাতে পারবে না। একটা যন্ত্রণাদায়ক ভয় তাকে পেয়ে বসল। সে ভয় মৃত্যু-ভয়। মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কিন্তু যেই সে কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল তখনই দরজার ওপারের সেই ভয়ংকর বস্তুটি দরজা ঠেলে জোর করে ঢুকতে চেষ্টা করল। কোনো মানুষ নয়-মৃত্যুই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে, তাকে ঠেকিয়ে রাখতেই হবে। তালা লাগানো আর সম্ভব নয় বলে সে দরজা ঠেলে রাখার শেষ চেষ্টা করল, কিন্তু তার চেষ্টা বড়ই দুর্বল ও এলোমেলো, সেই ভয়ংকর পিছন থেকে দরজায় ধাক্কা দিল, দরজাটা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
আবার সে বাইরে থেকে ঠেলা দিল। আন্দ্রু শেষ মানবিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল, দরজার পাল্লা দুটো নিঃশব্দে খুলে গেল। সে ঢুকল, ঢুকল মৃত্যু, প্রিন্স আন্দ্রু মারা গেল।
কিন্তু যে মুহূর্তে সে মারা গেল সেই মুহূর্তে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে পড়ল যে সে ঘুমিয়েছিল, আর ঠিক যে মুহূর্তে সে মারা গেল তখনই অনেক চেষ্টার পরে সে জেগে উঠেছে।
হ্যাঁ, এই তো মুত্যু! আমি মরে গিয়েছিলাম–আবার জেগে উঠেছি। হ্যাঁ, মৃত্যুই তো জাগরণ। আর সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর আলোকিত হয়ে উঠল, যে যবনিকা অজ্ঞাতকে আড়াল করে রেখেছিল তার আত্নিক দৃষ্টির সম্মুখ থেকে সেটা সরে গেল। মনে হল, যেসব শক্তি এতদিন তার মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে ছিল তারা ছাড়া পেয়েছে, সেই বিচিত্র ভারহীনতা আর কোনো দিন তাকে ছেড়ে যায়নি।
ঠাণ্ডা ঘামের মধ্যে জেগে উঠে সে ডিভানে নড়াচড়া করল তখন নাতাশা কাছে গিয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে। সে কোনো জবাব দিল না, কিছু বুঝতে না পেরে অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রিন্সেস মারি আসার দুদিন আগে এই ঘটনাই ঘটেছিল। ডাক্তারের মতে ক্ষয়কারী জ্বরটা সেদিন থেকেই উকট আকার ধারণ করেছে, কিন্তু নাতাশা ডাক্তারের কথায় কান দিল না, তার চোখে ধরা পড়ল কতকগুলি সুস্পষ্ট ভয়ংকর নৈতিক লক্ষণ।
সেদিন থেকেই ঘুম থেকে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু যেন জীবন থেকেও জেগে উঠতে লাগল। একটা স্বপ্নের সময়কালের সঙ্গে তুলনায় এই জাগরণের গতি মোটেই শ্লথতর নয়।
এই তুলনামূলক ধীরগতি জাগরণের মধ্যে ভয়ংকর বা দুর্বার কিছু ছিল না।
তার শেষের দিনগুলি অতি সাধারণ ও সরলভাবেই কাটতে লাগল। প্রিন্সেস মারি ও নাতাশা কখনো তাকে ছেড়ে যায় না, এটা তারাও বুঝতে পারল। কিন্তু তারা কাঁদল না, ভয়ে শিউরে উঠল না, শেষের কয়টা দিন তারা নিজেরাও বুঝতে পারল যে তারা আর প্রিন্স আন্দ্রুর সেবা করছে না সে এখন আর তাদের মধ্যে নেই,তাদের ছেড়ে গেছে), সেবা করছে তার দেহের। এই অনুভূতি দুজনের মনেই তখন এত প্রবল যে মৃত্যুর ভয়ংকর বহিরঙ্গ দিকটা তাদের আর আঘাত দিতে পারছে না, তাই তাদের মনে শোকও জাগছে না। তার সামনে বা অন্যত্র তারা আর চোখের জল ফেলছে না, তাকে নিয়ে আলোচনাও করছে না। মনে মনে তারাও বুঝছে, নিজেদের বুকের কথাকে তারা মুখের কথায় প্রকাশ করতে পারবে না।
দুজনই দেখছে সে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে মৃত্যুর গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে, দুজনই জানে যে এটা ঘটবেই, আর ঘটাই স্বাভাবিক।
সে দোষ স্বীকার করল, প্রার্থনা করল: সকলেই এসে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল। ছেলেকে যখন তার কাছে নিয়ে গেল তখন সে বালকের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চুঁইয়ে মুখটা ফিরিয়ে নিল, কাজটা কষ্টকর ও দুঃখজনক বলে নয়, তার ধারণা যে শুধু এইটুকুই তার করণীয়, কিন্তু তাকে যখন ছেলেকে আশীর্বাদ করতে বলা হল তখন সে তাও করল, তারপর চারদিকে তাকাতে লাগল, যেন জানতে চাইল তার আর কিছু করণীয় আছে কি না।
আত্মা ছেড়ে যাবার সময় যখন দেহের শেষ খিচুনি দেখা দিল তখনো প্রিন্সেস মারি ও নাতাশা তার পাশেই ছিল।
চোখের সামনে দেহটা ঠাণ্ডা হয়ে এল, কয়েক মিনিটের জন্য একেবারে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। প্রিন্সেস মারি বলল, সব কি শেষ হয়ে গেল? নাতাশা এগিয়ে গেল, মৃত চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল। চোখের পাতা বন্ধ করে দিল, কিন্তু তাতে চুমো না খেয়ে এই একান্ত প্রিয়জনটির শেষ স্মৃতি তার দেহটাকে জড়িয়ে ধরল।
ও কোথায় চলে গেল? এখন কোথায় আছে?…
দেহটাকে ধুয়ে-মুছে সাজিয়ে যখন টেবিলের উপর শবাধারে রাখা হল তখন সকলে এসে তার কাছ থেকে বিদায় নিল, সকলেই কাঁদতেই লাগল। ছোট নিকলাসও কাঁদল, কারণ বেদনাদায়ক বিহ্বলতায় তার অন্তরটা বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কাউন্টেস ও সোনিয়া কাঁদল নাতাশার প্রতি করুণায়, কারণ সে আর নেই। বুড়ো কাউন্ট কাঁদল, কারণ সে জানে যে অচিরেই তাকেও এই ভয়ংকর পথে পা বাড়াতে হবে।
এবার নাতাশা ও প্রিন্সেস মারিও কাঁদল কিন্তু সে কান্না নিজেদের দুঃখে নয়, তাদের চোখের সম্মুখে মৃত্যুর যে সরল গম্ভীর রহস্য উদঘাটিত হল তারই চেতনায় আবিষ্ট মনের শ্রদ্ধায় ও আবেগে তারা কাঁদতে লাগল।