১২. ছোটবেলা থেকেই বিনু শুনে আসছে

ছোটবেলা থেকেই বিনু শুনে আসছে সে বোকা। বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করাবার সময় হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, স্যার আমার এই মেয়েটা বড়ই বোকাআপনার হাতে সোপর্দ করে দিলাম। একটু দেখবেন। বিনুকে নিয়ে তার বাবার সামান্য দুঃখের মতও ছিল। প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন— আমার পাঁচটা না, দশটা না, একটাই সন্তান। সেও হয়েছে বোকা। তার কপালে আল্লাহ পাক কী রাখছেন কে জানে।

স্কুলের বান্ধবীরা অল্প দিনেই জেনে গেল বিনু মেয়েটা হাবা টাইপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। সহজ সাংকেতিক কথাও ধরতে পারে না। ধরিয়ে দিলেও পারে না।

কিটেমন ইটাছিস?

এর অর্থ হল কেমন আছিস। এটাও বিনু ধরতে পারে নি। বিনুর মারও মেয়েকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা ছিল। পুরুষ মানুষ হাবা হলে চলে। মেয়ে মানুষ হাবা হলে চলে না। মেয়ে মানুষের হাতের দশ আংগুলো একশ সুতা থাকে। তাকে চলতে হয় একশ সুতা টেনে।

ক্লাস নাইনে উঠে। হঠাৎ কী যে হল- বিনুর মনে হল তার আসলে অনেক বুদ্ধি। চারপাশে কী ঘটছে। সে যে তা শুধু বুঝতে পারছে তা-না, কেন ঘটছে তাও বুঝতে পারছে। তারচেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার ঘটনাগুলি নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন কিছু না বলে মনে হতে শুরু করেছে। তার পরিচিত বেশ কিছু মানুষকে আগে খুব বুদ্ধিমান মনে হত। বিনুর হঠাৎ করেই মনে হতে লাগল এরা তেমন বুদ্ধিমান না। বুদ্ধিমানের ভাব করছে – এই পর্যন্তই। যেমন তার মা! অ্যাগে মনে হত— কোথায় কী ঘটছে, কেন ঘটছে। এই মহিলা জানেন। ক্লাস নাইনে উঠার পর মনে হল— না, এই মহিলা তেমন কিছু জানেন না। তিনি নিজের স্বার্থটা ভাল বুঝেন। এই পর্যন্তই। এই মহিলার চেয়ে সে অনেক বেশি জানে, অনেক বেশি বুঝে।

বিনু জাহানারার সামনে বসে আছে। সে মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই আছে। জাহানার প্রশ্ন করে তাকে আটকাতে পারবেন না। জাহানারা নামের মহিলাকে বিনু একটা খোলা বই-এর মত পড়তে পারে। মহিলা তাকে পড়তে পারেন না। কোনোদিন পারবেনও না। প্রশ্নোত্তর পর্ব কীভাবে এগুবে তাও বিনু জানে। জাহানার প্রথমে খুব স্বাভাবিক থাকবেন— অতিরিক্ত স্বাভাবিক, যা মোটেই স্বাভাবিক না। এক পর্যায়ে তিনি রেগে যাবেন। চেষ্টা করবেন। রাগটা লুকিয়ে রাখতে। কিছুক্ষণ পারবেন, তারপর আর পারবেন না। থলের বিড়াল বের হয়ে পড়বে। এই ঘটনাগুলি কখন ঘটবে বিনু তা জানে— কিন্তু এই মহিলা জানেন না। বিনু এ বাড়িতে এসেছে গতকাল। গতকাল তেমন কোনো কথা হয় নি। জাহানারা শুধু তাঁর ছেলের লেখা চিঠি পড়তে চেয়েছেন। গতকাল তিনি শুধু ভেবেছেন। কীভাবে বিনুকে আটকাবেন সব ঠিক ঠাক করেছেন। আজ শুরু হবে বাঘবন্দি খেলা।

জাহানারা বললেন, বিনু বোস। তোমার সঙ্গে গল্প করি। আজকের গরমটা কেমন পড়েছে বল দেখি।

বিনু বলল, ভাল গরম পড়েছে।

এক পত্রিকায় পড়েছি, এসির বাতাস খেলে বুকে ক্ৰনিক ব্রংকাইটিস হয়। ব্ৰংকাইটিস খুব খারাপ অসুখ। একবার ধরলে আর যেতেই চায় না।

বিনু কিছু বলল না। এই মহিলা এখন কী করবেন। সে আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। সম্ভাবনা একশ ভাগ যে বলবেন— মাথায় একটু তেল ঘষে দাও তো। অনেক দিন মাথায় তেল দেয়া হয় না। সে মাথায় তেল ঘষতে থাকবে, তিনি প্রশ্ন করতে থাকবেন। সে যেহেতু জাহানারার পেছনে বসবে কেউ কারো মুখ দেখতে পারবে না। কঠিন কঠিন কথা বলার জন্যে এই কায়দাটা ভাল।

বিনু।

জ্বি।

মাথায় একটু তেল দিয়ে দাওতো।

জ্বি আচ্ছা।

বিনু তেলের বাটি নিয়ে বসল। জাহানারা বললেন, মাথায় চুলের জন্যে সবচে ভাল তেল হল অলিভ ওয়েল। এর পর থেকে তুমি আমার মাথায় অলিভ ওয়েল দিয়ে দিবে।

জ্বি আচ্ছা।

মাথার যন্ত্রণার জন্যে সবচে ভাল তেল কী জান?

জ্বি না।

মাথার যন্ত্রণার জন্যে সবচে ভাল তেল হল সরিষার তেল। দুই চামচ পানি, দুই চামচ সরিষার তেল একসঙ্গে মিশিয়ে মাথার তালুতে ঘষলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাথাব্যথা কমবে। এটা আমি শিখেছি আমার এক খালার কাছ থেকে।

বিনু হালকা গলায় বলল, এরপর যদি আপনার মাথা ধরে তাহলে বলবেন— আমি সরিষার তেল দিয়ে দেব।

সরিষার তেলের বাঝ বেশি এই জন্যে সবাই মনে করে এই তেল মাথায় দেয়া যায় না। এতে চুল পড়ে যায়। এটা ঠিক না।

মূল কথায় আসতে জাহানারা এত দেরি করছে কেন- বিনু তা বোঝার চেষ্টা করছে। কথাবার্তা তেলের আশেপাশে ঘুরছে। মূল প্রসঙ্গে আসতে মহিলা সময় নিচ্ছেন, কাজেই এটা মোটামুটি নিশ্চিত তিনি আজ বিনুকে শক্ত করে ধরবেন। কঠিন বাঘবন্দি খেলা হবে।

বিনু।

জ্বি।

তোমার বিয়ে ভেঙে গেলা— মানে কী? বরপক্ষের লোকরা বিয়ে ভাঙল না। তোমাদের পক্ষের লোকরা বিয়ে ভাঙাল?

আমরাই ভাঙলাম।

জাহানারা হালকা গলায় বললেন, আমার ধারণা তুমিই বিয়েটা ভেঙেছ। হঠাৎ কোন কারণে বেঁকে বসেছ।

আপনার এরকম ধারণা হল কেন?

প্রশ্নটা করেই বিনুর মনে হল সে ভুল করেছে। জাহানারা এখন রেগে যাবেন।

এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন। আজে-বাজে কথা শুরু করবেন।

শোন বিনু। তোমার নিজের ধারণা তুমি খুব চালাক। যতটা চালাক তুমি নিজেকে ভাব, ততটা চালাক কিন্তু তুমি না।

মানুষ মাত্রই নিজেকে চালাক ভাবে চাচি। আমি যেমন নিজেকে চালাক ভাবি। আপনিও নিজেকে চালাক ভাবেন। এটা দোষের কিছু না।

জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, তুমি আমাকে দোষ-জ্ঞান দিচ্ছ? তোমার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে কোনটা দোষ, কোনটা দোষ না?

বিনু হাসল। জাহানারা সেই হাসি দেখলেন না। চুলে তেল দিতে দিতে কথা বলার এই এক উপকারিতা। কারো মুখের ভাবই কেউ দেখছে না।

বিনু তুমি আজ আমাকে কয়েকটা সত্যি কথা বলবে? আমি সবসময়ই সত্যি কথা বলি চাচি।

না, তুমি সত্যি কথা বল না, তুমি হাড় বজ্জাত এবং মিথ্যুক। তোমার ধারণা তোমার মিথ্যা কথাগুলি কেউ ধরতে পারে না। এটা ঠিক না। শুভ্র ধরতে পারে না। ও মহাবোকা। কিন্তু আমি ধরতে পারি। দশটা মিষ্টি কথা দিয়ে তুমি শুভ্রকে ভুলাতে পারবে- আমাকে পারবে না।

আমি কাউকেই ভুলাতে চাই না চাচি।

জাহানারা ঘুরে বসলেন। কাজেই চুলে তেল দেয়া পর্বের এখানেই সমাপ্তি। এখন সম্মুখ যুদ্ধ। বিনু মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিল। সে আজ যুদ্ধ করবে। এই মহিলাকে ধরাশায়ী করে দেবে। যাতে ভবিষ্যতে এই মহিলা তার পেছনে না লাগেন। বিনুর ধারণা আজকের যুদ্ধটা এই মহিলার জন্যেও ভাল হবে। তিনি এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করছেন। অনিশ্চয়তা কমবে, অনেক কিছু স্পষ্ট হবে।

তুমি কী বললে বিনু? তুমি কাউকে ভুলাতে চাও না?

জ্বি না।

এত বড় একটা মিথ্যা কথা বলতে তোমার বিবেকে বাধল না! তোমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যইতো শুভ্রকে ভুলানো। শুভ্ৰকে ভুলানোর জন্যে কি তুমি রাতে বিরাতে ওর ঘরে যাও না?

হ্যাঁ, আমি যাই। আমাকে যখন ডাকা হয় তখনই যাই। না ডাকলে কখনো যাই না।

তুমি বলতে চাচ্ছ শুভ্ৰ তোমাকে রাতে ডেকে নিয়ে যায়?

জ্বি।

আমি কি ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করব?

জিজ্ঞেস করলে জিজ্ঞেস করতে পারেন। উনি কখনো মিথ্যা বলেন না। কাজেই আপনি সত্যি উত্তরই পাবেন।

মহিলার দিকে তাকিয়ে বিনুর এখন মায়া লাগছে। কী অসহায়ই না তাঁকে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি নেই।

বিনু বলল, আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?

জাহানারা বললেন, কাল রাতে যে ওর সঙ্গে গল্প করলে ও ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?

জ্বি।

কী বলে ডাকল? তোমাকে বলল, বিনু এসো। সারারাত আমাকে গল্প শুনাও? তোমার গল্প না শুনলে আমি মারা যাব?

বিনু বুঝতে পারছে— মহিলার মাথা এখন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তিনি এখন ছেলেমানুষি কথা বলবেন। হাস্যকর প্রশ্ন করবেন।

জাহানারা বললেন, চুপ করে আছ কেন জবাব দাও।

বিনু হালকা গলায় বলল, উনি বললেন, বিনু তুমি আমার ঘরে এসে বস। আমি তোমার জন্যে চা বানিয়ে আনি। তারপর আমরা চা খেতে খেতে সারা রাত বসে গল্প করব। আমার আজ গল্পের মুডে পেয়েছে।

সে চা বানিয়ে আনল?

জ্বি।

শুভ্ৰ নিজে চা বানিয়ে আনল?

জ্বি। চা বানানোর ব্যবস্থাতো উনার ঘরেই আছে।

জাহানারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। রাগের চেয়ে বিস্ময়বোধ তাঁর কাছে প্রবল হয়ে উঠেছে। শুভ্র চা বানিয়ে এই গ্ৰাম্য ফাজিল মেয়েটাকে খাওয়াচ্ছে, কী বিস্ময়কর ঘটনা!

শুধু যে বিস্ময়কর তা না, অস্বাভাবিক এবং অবশ্যই ভয়ঙ্কর। জাহানারা হঠাৎ লক্ষ করলেন তার হাত পা কাঁপছে। শীত বোধ হচ্ছে। বিনুর সঙ্গে কথা চালিয়ে যাবার শক্তি নিজের ভেতর খুঁজে পাচ্ছেন না। বিনুর কাছে নিজেকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

বিনু।

জ্বি।

জাহানারা শান্ত গলায় বললেন, তোমাদের মধ্যে কী কথা হয়?

মনে করে রাখার কিছু না। উনি গল্প করেন, আমি শুনি। কিছুদিন হল রাতে তাঁর ঘুম হয় না। একা একা জেগে থাকা খুব কষ্টের ব্যাপার বলেই তিনি আমার সঙ্গে গল্প করেন।

কাল রাতে তোমাদের কী নিয়ে গল্প হল? তোমার মনে আছে?

জ্বি মনে আছে।

বল শুনি।

মহাবিশ্ব কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, আবার সব এক জায়গায় হবে – এইসব। মহাবিশ্ব বিগ বেং থেকে শুরু। আবার সেখানেই শেষ হবে।

জাহানারা বুঝতে পারছেন না, তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা উচিত কি-না।

জ্ঞানের গল্প শুভ্র করতেই পারে; করতে পারাটাই স্বাভাবিক। কার সঙ্গে গল্প করছে সেটা জরুরি না। শুভ্র যখন এ ধরনের গল্প করে তখন সে খেয়াল করে না। কে তার সামনে আছে। বিনু বসে থাকলেও যা, এ বাড়ির দারোয়ান বসে থাকলেও তা। মুক্তার মা থাকলেও তা। জাহানারা ঠিক করে ফেললেন তিনি নিজেই এখন থেকে রাত জাগবেন। শুভ্রর জ্ঞানের কথা শুনবেন। মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ার হাবিজাবি শুনতে খারাপ লাগবে না। তাছাড়া শুভ্র যা বলে তাই তার শুনতে ভাল লাগে।

বিনু শান্ত চোখে জাহানারার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। জাহানারা আহত হয়েছেন। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যে রক্ত চোখে দেখা যায় না। তাঁর দিকে তাকাতেই মায়া লাগছে। বিনু বলল, চাচি আসুন আপনার মাথায় তেল দিয়ে শেষ করি। জাহানার আপত্তি করলেন না, ঘুরে বসলেন।

জাহানারা ক্ষীণ গলায় বললেন, তোমার বিয়ে ভেঙে যাবার ঘটনাটা বল। কিছুই গোপন করবে না।

বলার মত কোনো ঘটনা না চাচি। গায়ে হলুদের আগের দিন হঠাৎ উড়ো খবর পাওয়া গেল। ভদ্ৰলোক আগে একবার বিয়ে করেছেন। তার একটা মেয়েও আছে। আমার এক মামা খোঁজ নিতে গেলেন। বরপক্ষের তারাতো কিছু বললই না, উল্টা খুব রাগারগি করল। আমরা না-কি ইচ্ছা করে তাদের অপমান করার জন্যে এইসব কথা নিয়ে দরবার করতে গেছি। আমরা ছোটলোক। আমরা ইতর। এইসব।

জাহানারা আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, এ রকম কিন্তু হয়। বিয়েশাদিতে নানান কথা ছড়িয়ে বিয়ে ভেঙে দেয়া হয়। একদল মানুষ থাকে তারা বিয়ে দিয়ে আরাম পায় আবার আরেক দল থাকে বিয়ে ভাঙিয়ে আরাম পায়। তোমরা উড়ো কথা যা শুনেছি তাকে গুরুত্ত্ব দেয়া ঠিক হয় নি।

বিনু বলল, আমরা গুরুত্ব দেই নি। বিয়ে হয়েই যেত। কিন্তু ঐ মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।

বল কী!

ছেলেপক্ষের ওরা জোর গলায় বলতে লাগল— এই মেয়েকে তারা চিনে না। তাদের অনেক শত্ৰু আছে। শত্রুরা বিয়ে ভাঙার জন্যে এই মেয়েকে লাগিয়েছে। মেয়েটা নাকি বাজারে ঘর নিয়ে থাকে। আজেবাজে মেয়ে।

ও।

কাজেই আমি রাগারগি করে চলে এসেছি। বাবা যদিও চাচ্ছিলেন বিয়েটা হোক।

জাহানারা চুপ করে রইলেন। বিনু ভেবেছিল জাহানারা বলবেন যা করেছি ভালই করেছ। জাহানারা কিছুই বললেন না।

চুলে তেল দেয়া শেষ হয়েছে। বিনু বলল, চাচি আমি যাই। জাহানারা সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না; এখন বাজছে তিনটা। ভদ্রমাসের ঝিম ধরা দুপুর। এই সময়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতে ভাল লাগে। কিন্তু তিনি জানেন আজ তার কোনো কিছুই ভাল লাগবে না। তাঁর কেন জানি হঠাৎ করে তোকমার সরবত খেতে ইচ্ছা করছে। আজকাল প্রায়ই অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস খেতে ইচ্ছা করে। এসব হচ্ছে মৃত্যুর লক্ষণ। মৃত্যু যখন এগিয়ে আসে তখনই বিচিত্র সব ইচ্ছা মনে জাগে। তাঁর মার যেমন জ্যৈষ্ঠ মাসে বরই খাবার ইচ্ছা হল। যাকে পান তাকেই জিজ্ঞেস করেন— বিরই কি পাওয়া যাবে? বরই খেতে ইচ্ছা করছে। আচারের বরই না, গাছপাকা দেশি বরই। জ্যৈষ্ঠ মাস আম কঁঠালের সময়। এই সময়ে কি বরই পাওয়া যায়? বরই বরই করতে করতে এই মহিলা জ্যৈষ্ঠ মাসে মারা গেলেন। অনেক দিন পর মার কথা ভেবে জাহানারার মন কেমন করতে লাগল। বরই বরই করে এই মহিলার জীবনের ইতি হয়েছে বলেই কি-না কে জানে তাঁর কবরে কিছুদিনের মধ্যেই একটা বরই গাছ দেখা গেল। সেই গাছ এখন বিশাল হয়েছে। দুবছর আগে গিয়ে দেখেছেন গাছ ভৰ্তি করে বরই এসেছে। খুব না-কি মিষ্টি। ভয়ে কেউ সেই বরই খায় না। কবরের উপর উঠা ফলের গাছের ফল খেতে নেই। পশুপাখি খেতে পারে। মানুষ পারে না। কেন পারে না এটা নিয়ে কি শুভ্রের সঙ্গে কথা বলা যায় না? শুভ্ৰ কি রাগ করবে? জাহানারা মনস্থির করতে পারলেন না- শুভ্ৰর কাছে যাবেন, না যাবেন না।

 

 

শুভ্ৰর ইজিচেয়ারটা জানালার কাছে। সে গভীর আগ্রহে একটা বই পড়ছে। উদ্ভট বই-–নাম–The 4th Eye. লেখকের নাম R Lampa. তিনি বইটিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন মানুষ চারটা চোখ নিয়ে জন্মায়। দুটি চোখ দৃশ্যমান। দুটি অদৃশ্য। একটি অদৃশ্য চোখ থাকে মাথার পেছনের দিকে। আরেকটি অদৃশ্য চোখ থাকে নাভির ঠিক দুআঙ্গুল নিচে। R. Lampa সাহেবের মতে যে-কোনো লোক এই দুটি চোখের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। তাকে ধৈর্য ধরে কয়েকদিন একটা পরীক্ষা করতে হবে। একজন কেউ ফুলস্কেপ কাগজে বড় বড় করে কোনো একটা সংখ্যা লিখে মাথার পেছন দিকে ধরবে। সেই সংখ্যাটি পড়ার চেষ্টা করতে হবে মাথার পেছনের চোখ দিয়ে। অনেকটা জেনার টেস্টের মত টেষ্ট। একই পরীক্ষা নাভির চোখ নিয়েও করা যায়। লেখক ভদ্রলোক দাবি করছেন যে, একটু চেষ্টা করলেই যে কেউ এটা পারবে। জলের মত সহজ পরীক্ষা। শুভ্রর ইচ্ছা করছে এক্ষুণি পরীক্ষাটা করে ফেলতে। তবে এক্ষুণি না করে পুরো বই শেষ করে তারপর পরীক্ষায় বসা ঠিক হবে।

জাহানারা এসে ছেলের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, কী করছিস রে?

শুভ্র বলল, ইন্টারেস্টিং একটা বই পড়ছি।

কী বই?

বই-এর নাম চতুর্থ চোখ।

বিজ্ঞানের বই?

মিথ্যা-বিজ্ঞানের বই।

মিথ্যা-বিজ্ঞানটা আবার কী?

কিছু কিছু বিষয় এমন করে লেখা হয় যে পড়লে মনে হয় বিজ্ঞান। আসলে বিজ্ঞান না। এদের বলা হয় মিথ্যা-বিজ্ঞান। সব কিছুই একটা মিথ্যা সংস্করণ আছে। মিথ্যা ভালবাসা, মিথ্যা ঘৃণা, মিথ্যা চোখের জল।

জাহানারা ছেলের খাটে বসলেন। শুভ্র বলল— মা এখন তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি বইটা দ্রুত পড়ে শেষ করতে চাই। তুমি থাকলে পড়া হবে না।

পড়া হবে না কেন? তুই তোর পড়া পড়বি! আমি আমার বসা বসে থাকব।

তুমি চুপচাপ বসে থাকবে না। গুটুর গুটুর করে কথা বলবে। আমার ডিসটর্ব হবে।

জাহানার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি লক্ষ করলেন তার চোখ ভিজে উঠেছে। ছেলের সামনে কেঁদে ফেলাটা খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে। অভিমান তাকেই দেখানো যায় যে অভিমান বুঝে। তার ছেলে অভিমান বুঝে না।

মা আগুন গরম এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যেও তো।

জাহানারা বললেন, শুভ্ৰ আমি শুনলাম তুই নিজে নাকি খুব ভাল চা বানাতে পারিস।

শুভ্র বলল, নিশ্চয়ই বিনু বলেছে। আশ্চর্য মেয়েতো! তোমাকে বলছে আমি চা ভাল বানাই, আবার আমাকে বলছে আমি চা বানাতেই পারি না। ওর কোন কথাটা সত্যি? আজ থেকে আমি ওর নাম দিলাম।— মিথ্যাময়ী।

জাহানারা দেখলেন, শুভ্ৰ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। একটু আগেও তো মুখ এমন হাসি হাসি ছিল না। বিনু নামটা মনে আসতেই মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল। তিনি না এসে বিনু যদি এসে বসতো তাহলে কি সে বলতে পারত— বিনু চলে যাও আমার ডিসটার্ব হবে? মনে হচ্ছে না। এ রকম বলত। আবার একটা নামও দিয়ে ফেলেছে মিথ্যাময়ী। মায়ের সামনে মিথ্যাময়ী, আড়ালে নিশ্চয়ই সত্যময়ী।

শুভ্ৰ বলল, মা শোন এখন চা আনার দরকার নেই। আমার বইটার বাকি পাতাগুলি পড়তে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। তুমি একটা কাজ কর— কাঁটায় কটায় এক ঘণ্টা দশ মিনিট পর এক কাপ চা নিয়ে এসো। আমি চা খেতে খেতে তোমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

কী এক্সপেরিমেন্ট?

তোমার তিন নম্বর চোখ এবং চার নম্বর চোখ আছে কি-না এই পরীক্ষা হয়ে যাবে।

জাহানারা আবারো বসে পড়লেন। ছেলে তার সঙ্গে হাসি হাসি মুখে কথা বলছে— এটা শুভ লক্ষণ। এখন নিশ্চয়ই সে বলবে না, মা তুমি চলে যাও আমার ডিসটার্ব হচ্ছে।

জাহানারা আদুরে গলায় বললেন, শুভ্ৰ তোকে খুব জরুরি একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কথাটা আমার প্রায়ই মনে হয়, যখন মনে হয় তুই আশেপাশে থাকিস না বলে জিজ্ঞেস করা হয় না।

শুভ্র বই বন্ধ করতে করতে বলল, বল তোমার জরুরি কথা।

কবরের উপর ফলের গাছ যদি হয় তাহলে সেই ফল খাওয়া কি ঠিক?

অবশ্যই ঠিক। তুমি খাচ্ছ ফল— অন্য কিছুতো খাচ্ছ না। এটাই কি তোমার জরুরি কথা?

হুঁ। তোর নানিজানের কবরে একটা বরই গাছ আছে। খুব মিষ্টি বরই।

মিষ্টি বরই হলে অবশ্যই খাবে। নানিজানের শরীর মাটিতে মিশে গেছে। নানিজানের শরীরের ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্ৰন নষ্ট হয় নি। তার কিছু কিছু অবশ্যই বরই-তে চলে আসবে। তাতে কিছু ফায় আসে না।

কী ভয়ঙ্কর কথা।

ভয়ঙ্কর কেন?

আমার মার শরীরের অংশ যে ফলে চলে এসেছে সেই ফল আমি খাব?

শুভ্ৰ বই-এ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আচ্ছা তুমি খেও না। এখন যাওতো মা! শোন, বিনুকে পাঠিয়ে দাও।

জাহানারা দাঁড়িয়ে আছেন। শুভ্ৰ তাকে বিদেয় করে দিচ্ছে অথচ বিনুকে আসতে বলছে। এর মানে কী? তিনি থাকলে ছেলের ডিসটর্ব হয়। বিনু থাকলে ডিসটার্ব হয় না? বিনু নামের মেয়েটাকে এই মুহুর্তে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জাহানারা ঘর থেকে বের হলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঢুকলেন। শুভ্র বই থেকে মাথা না তুলে বলল, কিছু বলবে মা?

জাহানারা বললেন, শুনলাম তুই ম্যানেজার সাহেবকে বিদেয় করে দিয়েছিস?

কার কাছ থেকে শুনলে?

কার কাছ থেকে শুনলাম এটা জানা কি খুব প্রয়োজন?

হ্যাঁ প্রয়োজন। অফিস থেকে তোমার কাছে খবরাখবর কীভাবে আসে এটা জানা থাকা দরকার।

জাহানারা ছেলের গলার স্বর শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। শুভ্র সম্পূর্ণ অন্যরকম গলায় কথা বলছে। শুভ্ৰকে এমন স্বরে কথা বলতে আগে কখনো শুনেন নি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুই এমন কঠিন গলায় আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন? আমিতো তোর অফিসের কেউ না।

অফিসের কেউ যদি না হও তাহলে অফিস সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।

জিজ্ঞেস করলে সমস্যা কী?

সমস্যা আছে। বাবাকে যেমন তুমি কখনো কিছু জিজ্ঞেস কর নি। আমাকেও করবে না।

তোর বাবাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করি নি কে বলল?

কেউ বলে নি। আমি জানি। বাবার কর্মকাণ্ড নিয়ে তুমি যদি কখনো প্রশ্ন তুলতে তাহলে আজ। আমি একটা বেশ্যাখানার মালিক হতাম না।

তুই এমন একটা বিশ্ৰী শব্দ আমার সামনে বললি? তুই বলতে পারলি? আমি তোর মা! তুই মার সামনে এমন নোংরা শব্দ বললি। তোর জিবে আটকাল না।

শুভ্ৰ বই-এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, জিবে আটকায়নি মা। আমরা নোংরা ব্যবসা করতে পারব, সেই ব্যবসার কথা বলতে পারব না— তা হয় না। দাঁড়িয়ে থেকে না মা। আমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এসো।

শুভ্র!

এ রকম কঠিন গলায় তুমি আমাকে ডাকবে না। এবং অবশ্যই কঠিন চোখে তাকবে না। সারাজীবন পুতুপুতু মহিলা হয়ে ছিলে। এখনো তাই থাকবে।

শুভ্ৰ আমি তোর মা।

তুমি আমার মা এটা অত্যন্ত ভাল কথা। আমার একটা অংশ সব সময় তোমাকে ঘিরে থাকে। কিন্তু অন্য অংশটা তোমাকে যে ঘৃণা করে সেটা না জানাই তোমার জন্যে ভাল।

তুই আমাকে ঘৃণা করিস।

হ্যাঁ করি। বাবাকে যতটা করি তোমাকে তার চেয়ে বেশি করি। কাঁদবে না। মিথ্যা অশ্রু আমার ভাল লাগে না!

শুভ্ৰ হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে হলুদ মার্কার নিল। বইটার কিছু কিছু অংশ দাগ দেয়া দরকার। সে মার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, মা দাঁড়িয়ে থেকে না। চা নিয়ে এসো। তোমার চতুর্থ চোখ আছে কি-না সেই পরীক্ষা হয়ে যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *