চৈতন্য সাহা বিপদ দেখতে পেলো। তার পথেঘাটে চলা কঠিন হয়ে উঠেছে। শুধু নিজের গ্রামেনয়, আশেপাশের দু’পাঁচখানা গ্রামেও তাকে দেখলে ছেলেরা। হো-হো করে করে হাসে, বড়োরাও সে-হাসিতে পরোক্ষে যোগ দেয়, দু’এক জায়গায় অভিযোগ করতে গিয়ে ফল উল্টো হয়েছে।
সকালে উঠে রামচন্দ্রর সঙ্গে জড়িত বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটে গেলো। তার প্রথম ইচ্ছা হয়েছিলো দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে যে-ঘরে দলিল আছে, আর দুষ্প্রাপ্য পণ্যগুলি। ভয় কমলে নিজের পাড়ার দু’একজনের সঙ্গে কথাও হয়েছিলো, তাদের একজন পুলিসকে খবর দিতে বলেছিলো। এ প্রস্তারে সহসা সে রাজী হতে পারেনি। তার বাবার সময়ে জমি-জিরাতের ব্যাপার নিয়ে এমন লাঠি ধরেছে কেউ-কেউ, তাদের দরুন পুলিসে খবর দেয়নি মহাজনপক্ষ। আছে, অস্ত্র আছে, যাকে মহাজনি চাল বলে।
চৈতন্য সাহার একজন কর্মচারীদা দিয়ে কুচনোতামাকে চিটেগুড় মিশিয়ে বিষ্ণুপুর বালাখানা লেখা একটি টিনে তুলেছিলো, তার উপর লক্ষ্য রাখতে রাখতে চৈতন্য সাহা চিন্তা করছিলো এমন সময়ে সে তহসিলদারের মুখ দেখতে পেলো। বয়স্ক কোনো তহসিলদার নয়, কাল পর্যন্ত মুঙ্লাদের দলে খেলেছে এমন এক ছোকরা। তবু সঙ্গে তার তক্মা-আঁটা পাইক দেখে সসম্ভ্রমে তাকে বসতে দিয়ে সে বললো, দ্যাখেন ভাই, সবই আমার লোকসান। খাজনা দিবো কি, এক পয়সা লাভ হয় নাই। যখন ওরা না-খায়ে মরে তখন খাবার জন্যি টাকা দিলাম, তার শোধ নিলো ভগোবান। এমন নিমকহারাম ভগোবান, জমি চষলো না ওরা।
খাইখালাসি জমি চবি এমন বাধ্যবাধকতা নাই।
তাও গত সন আগাম মজুরি নিয়ে চাষ করলিও করছিলো, এ সন জমি ছুঁলো না।
গত সনে ওরা ঠক্ছিলো।
চৈতন্য সাহা মাথা নেড়ে বললো, ইছ্-ইছ্। আমাক ঠকালো। যে-জমিতে দশ মণ আমন উঠতো, উঠলো করা। বেলা ডোবার দিকে চায়ে-চায়ে দিন কাটাইছে।
কিন্তুক, লাভ হোক, লোকসান হোক, খাজনা দেওয়ার দায় আপনার। আপনার খাইখালাসির লিস্টি আনেন, আমার জমার বই রেডি। টাকা এখন না-দেন, হিসাব হোক; বৈকালে আসে টাকা নেবোনে। আর না-হয় দলিল দেখান, চাষীরা খাজনার দায়িক কিনা দেখি।
অস্-অস্, দু’এক মাস সবুর করলি হয় না। চৈতন্য সাহার মুখের সম্মুখভাগে একটামাত্র হলুদ রঙের দাঁত অবশিষ্ট ছিলো। সেটাকে সে ঘন ঘন চুষতে লাগলো।
তহসিলদারের সম্ভবত ব্যক্তিগত কিছু অপ্রীতি ছিলো, সে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়েই বললো, লিস্টি ধরেন, লিস্টি। কত বিঘে জমি রাখছেন খাইখালাসিতে?
একশ কি পাঁচশ। সে যৎসামাইন্ন।
তাহলি বছরে আড়াই হাজার নিরিখে কম করেও পাঁচ হাজার। কী ভয়ঙ্কর, আমার চাকরিটাই যাবি। আর নজর, নজরের কী ব্যবস্থা? আমাদের তহুরির?
আজ্ঞে, খাইখালাসিতে নজর তহুরি কীসের?
সাজিমশাই, মরা জিনিসের কারবার করেন, তাজা জিনিসের মর্ম কী বুঝবেন! জমি হতেছে তরতাজা। তহুরির ব্যবস্থা না করলি আমরা শোনবো কেন? এ মরা জিনিসের কারবার না।
বার বার মরা জিনিস কি কন? আপনি কি চাষীদের মতন মনে করেন আমি হাড় চালান দেই?
তহসিলদারের হাসি পেলো। মুঙ্লার গান সেও শুনেছে, কিন্তু আদায় তহসিল করতে এসে হাসাহাসি করা যায় না। সে বললো, তা ধরেন যে, আলকাতরাও তো মরা জিনিস। আর দেরি করেন না।
একটুক চিন্তা করার সময় দেন।
সময় সময় করে আর সময় কাটায়েন না। ছোটোবাবুর কড়া হুকুম : তিনদিনের মাথায় সব খাজনা শোধ, না হলি কোট কাছারি হবি।
ছোটোরাবু? ঐটুক গ্যাদা ছাওয়াল?
তোমার আমার ছাওয়াল না, সাজিমশাই। খোদ নায়েবেক হুকুম করছে-প্রজা হয়ে দেখা করে না, কত বড়ো সে মহাজন, আমি দেখবো। অবশ্য খাজনা না দেন লোকসান নাই, লাভ আছে।
তহসিলদার চলে গেলে চৈতন্য সাহা শূন্য দেখলো পৃথিবী। তহসিলদার নতুন কিছু বলেনি ভাবা যেতো, যদি সে খাজনা আদায়ের উপরেই জোর দিতো। কিন্তু সে বলে গেছে, খাজনা না দিলেই সুবিধা, আসলে ওরা মামলা করতেই চায়।
চিন্তা করতে গিয়ে সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। তার সবটুকু রাগ গিয়ে পড়লো রামচন্দ্র, তার জামাই মুঙ্লা আর তার সঙ্গীদের উপরে। না-খাওয়ার দিনে ধান দিলাম, টাকা দিলাম, তার এই শোধ, না? অন্য দেশ থেকে কৃষক এনেছি তাদের উপরেও জুলুমবাজি। বেআইনি কাজ করে তার উপরে লাঠিবাজি। ঐ রামচন্দ্র বেটাকে পুলিসে দেবো। একটা গারদে গেলে আর সব কটা শায়েস্তা হয়।
রাগের মাথায় উঠে দাঁড়িয়ে সে কনক দারোগার থানার দিকে ছুটলো।
থানায় এজাহার দিয়ে সে গ্রামের দিকে ফিরছিলো। সকাল থেকে, এখন প্রায় সন্ধ্যা পার হলো, একই ব্যাপার নিয়ে নানা রকম ভেবেছে সে। এখন রাগটা পড়ে আসছে, থানায় এজাহার দেওয়ার পরিণতিও যে একটা মামলা তা সে বুঝতে পারছে। সাক্ষীসাবুদের প্রয়োজন। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে মনে হলো ভালো মজবুত সাক্ষী দিতে হবে। নিজ গ্রামের লোকদের দিয়ে ভরসা নেই। গ্রামের বাইরে তার টাকা লেনদেনের ব্যাপারে যাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে, তারা হচ্ছে চরনকাশির আলেফ সেখ ও সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের ছেলে। এদের বলে রাখা দরকার। ধানের কারবারে সে বছর এরা সহায়তা করেছিলো।
কখন চরনকাশিতে এসে পড়েছে তা সে খেয়াল করেনি। একসময়ে সে দেখলে সে মাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর পরই আলো হয়েছে। সেই আলোতে শুকনো খটখটে বন্ধ্যা মাঠ চারিদিকে ছড়ানো। তার মনে হলো এগুলিও তার কাছে বন্ধক রাখা জমি, নতুবা চাষের জমি কেন এমন পড়ে থাকবে। আর এরই জন্য কিনা জমিদার খাজনা চায়! লোকসান, লোকসান, কী আহাম্মুখি হয়েছে এই জমি রেখে! নিজেকে বিদ্রূপ করে সে বললো, দিগরের সব ধান ঘরে উঠবি, ধানের রাজা হবা? হবা না?
সম্মুখে কে যেন ছাতি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, সন্ধ্যার পর তার ছাতি মাথায় দেওয়ার মতো বিশিষ্ট ব্যাপারটাও লক্ষ্যে আনতে পারলো না। চৈতন্য। সে বললো, এও বুঝি, এ সবই বুঝি চৈতন্য সার খাইখালাসি?
ছাতিমাথায়, সজে রঙের আচকান জাতীয় পোশাক পরা লোকটির মুখ দেখা গেলো না; এক বুক শাদা দাড়ি দেখা গেলো,কী কন! চৈতন্য সার খাইখালাসি?
লোকটি চৈতন্য সাহার চারিপাশে একটি অদৃশ্য বৃত্ত রচনা করে ঘুরে এলো ধীরে ধীরে।
কী কলেন? এর নাম চরনকাশি। কে জাগে?–না, আলেফ সেখ। আপনে? তা বেশ গান বাঁধেছে ওরা। চিতিসা–চিত্তিসাপ, আমন ধানের বিষ।
লোকটি সুর করে গান ধরলো। যেন ঘুরে ঘুরে নাচবেও।
চৈতন্য সাহা আর দাঁড়ালো না। এই তার সাক্ষী, এই তার সম্ভাব্য সহায়! রাগ করতে গিয়ে কান্না পেলো তার। ছুটো পালানোর ভঙ্গিতে সে চরনকাশির আলেফ সেখকে ছাড়িয়ে এলো।
আলেফ সেখ গদগদ করে হেসে উঠলো।
দু দিন গুম মেরে থেকে আর এক সন্ধ্যার পর সে বেরুলো তখন সে অন্য মানুষ। রামচন্দ্রর পাড়ায় যেতে তার সাহস হলো না। নিজের বাড়ির কাছাকাছি যেসব চাষী ছিলো, তাদের দু’একজনের কাছে গেলো।
শুনছ না? তোমরাও গেলে, আমিও গেলাম। জমিদার বাকি খাজনার নালিশ করবি। জমি তো সবই খাস হবি।
কন কী?
তাই হলো। তোমরা চাষ করলা না। কত কলাম, বাবা সোনা, মজুরি নেও, জমিতে চাষ দেও। যদি বা দিলা চাষ, সে ঠুগযুগ। ফসল উঠলো উনা। কিন্তু এখন, এখন আমি খাজনা শোধবো কেন?
আমরা খাজনা দিবো আর আপনি জমি খাতে থাকবেন, এমন কাগজ করা হয় নাই।
আমি খাজনা দিবার পারি কনে? খেতের ফসল উঠবের চায় না ঘরে, রামচন্দ্র লাঠি নিয়ে ধাওয়া করে। টাকা আমার অমনি গেছে মিছামিছা আর জমিদারের খাজনা শুধি কেন। দুই সনে জমিদারের পাওনা–পাঁচ হাজার।
কথাটা কানাঘুষো চলছিলোই, এবার সত্যের রূপ নিয়ে রাষ্ট্র হলো। জমিদার লোক পাঠাচ্ছে সদরে চৈতন্যের নামে বাকি খাজনার মামলা দায়ের করতে। কিছু লোক চৈতন্য সাহার কাছে। গেলো, কিছু গেলো রামচন্দ্রর কাছে। যারা ব্যাপারটির গুরুত্ব বোঝে তারা দিশেহারা হয়ে গেলো। কিন্তু বিশেষ করে ছেলেছোকরার দল তাদের পুরনো যুক্তি আবার তুলো, চৈতন্য সা জমি খাবি? তা খাক না, কত খাবি ঐ একটা দাঁত দিয়ে। জমি খাস হয়, বরগা চায়ে চষবো।
কিন্তু রামচন্দ্র জানে খাজনা বন্দোবস্ত জমি ও বরগার জমি এক নয়। অনেকক্ষেত্রেরই পিতৃপুরুষের সঞ্চিত পরিশ্রমের ফলে খাজনায় বন্দোবস্ত হয়েছিলো, সে জমি চলে গেলে ভূমিহীন হয়ে বরগা বন্দোবস্তের জমি নেওয়া এই মাঝবয়সে শৈশবে ফিরে যাওয়া নয় শুধু, পিতৃপিতামহের পরিশ্রমকেও মূল্যহীন করে দেওয়া।
একদিন সকালে রামচন্দ্র ক্লিষ্টমুখে দাওয়ায় উবু হয়ে বসে তামাক খাচ্ছে। গত সন্ধ্যার কথাগুলি মনে অনেকটা থিতিয়ে গেলেও সমস্যার মতো হয়ে আছে। প্রভাতটা আজ তাকে স্নিগ্ধ করেনি। এখনই হয়তো লোকজন কেউ এসে পড়বে আর সঙ্গে করে আনবে তাদের সমস্যা। কাল সন্ধ্যায় কথাটা জানা গেছে, হালদারপাড়ার আরও ছ’ঘর লোক চলে যাবে। তা প্রায় পঞ্চাশটি প্রাণী হবে, ছেলে-বুড়ো ধরে। এদের সঙ্গে রামচন্দ্রর প্রত্যক্ষ জানাশোনা ছিলো না। তাহলেও গ্রামের লোক, চিকন্দিরই নোক তো বটে। ভক্ত কামার কী পথই দেখালো! রামচন্দ্র জানে হালদার অর্থাৎ জেলেরা একরকমের যাযাবর। পদ্মার মাছের সঙ্গে তাদের চলাফেরা। পদ্মা যখন চিকন্দির দিকে মাটি ফেলে ফেলে সরে যেতে লাগলো, তখন–এখন থেকে প্রায় দু পুরুষ আগে–জমিতে মন দেয় এরা। কিন্তু জাত-চাষী হয়ে উঠতে পারেনি। খেতে-খামারে এমন কিছু বাড়বাড়ন্ত হয়নি। আমসি আর ভাত খেয়ে ঝোড়ো বাদলায় দিনরাত জলে স্যাঁতসেঁতে হাতপা নিয়ে মাছ ধরে টাকা উপায় করে ঘরে ফিরে এসে দু’দিনে সে টাকা ফুরিয়ে হা অন্ন হা অন্ন করতে করতে জলের দিকে ছোটা এদের রক্তে। খেত-খামার করার সময়েও তাই করেছে। কিন্তু শত হলেও গ্রামের লোক, তাদের চলে যাবার কথায় বেদনা বোধ হয়।
কিন্তু যে লোকটি তখনই এলো তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য রামচন্দ্র প্রস্তুত ছিলো না। পরিচ্ছন্ন কাপড়জামা পরা একজন প্রৌঢ়।
আপনে রামচন্দ্র?
জে। আপনে?
আমি চরনকাশির আলেফ সেখের ভাই এরফান সেখ।
রামচন্দ্রর বুকটা ধকধক করছিলো, হয়তো-বা থানার লোক ভদ্রবেশে এসেছে। ভয়টা কেটে যেতে সে আগন্তুককে উপলক্ষ্য করে অজস্র হেসে ফেলো। কথা বলার আগে সুচারুরূপে গোঁফের কোণদুটি পাকিয়ে সে বললো, আসেন মিঞাসাহেব, এমন সৌভাগ্যি কেন্!
এরফান বললো, বড়োভাই কলে যে, যা এরফান একবার চিকন্দি, সেখানে চাষীরা নাকি জমি-জিরাত ছিটায়ে-ছড়ায়ে দিতেছে।
কে, তা দেয় কেন্?
তারা বলে চলে যাতেছে?
আপনেরাও তাই শুনেছেন?
হয়, ভাবলাম, খানটুক জমি যদি ধরা যায়।
রামচন্দ্রর মনে হলো সে বিদ্রূপ করে বলবে–জমি কি পদ্মার ভাসা কাঠ, ধরলিই তোমার হলো। কিন্তু আগন্তুকের প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হয় বলে সে সংযত হলো, বললো, শুনছি ওরা কে-কে যাবি। তা খোঁজ নেন, কিন্তু সেসব জমি খাইখালাসি বাঁধা, জব্দ-সামিল।
এরফান ঘনিষ্ঠ হওয়ার ভঙ্গিতে হেসে বললে, খাইখালাসি ছাড়াও তো কিছু কিছু আছে, তাইলে আর আপনার কাছে আসছি কেন?
ইঙ্গিতটা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারলো না রামচন্দ্র, কিন্তু কথাটি যে ইঙ্গিত-প্রাণ তা বুঝতে পেরে মণ্ডলী কায়দায় বললে, আচ্ছা সেরকম যদি খোঁজ পাই কব আপনেক।
এরফান সেখ কুমোরপাড়ার দিকে চলে গেলো। তখন ইঙ্গিতটার অর্থ ধরা দিলো রামচন্দ্রর কাছে। সে স্বগতোক্তি করলো, কেন রে, আমার জমি বুঝি ধরতে আসছিলো? একটা অপমান বোধ হলো তার।
কোনো কোনো দিন মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব বেদনা নিয়ে আসে। সারাদিন ধরে রামচন্দ্র যে ক্লেশটা অনুভব করলো সেটা কোনোভাবেই নির্দিষ্ট করা গেলো না।
দুপুরের ঠিক পরেই হালদারপাড়ার লোকরা চিরকালের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে গেলোমলিন শীর্ণ কতকগুলি নরনারী শিশু। তাদের যাবতীয় পার্থিব সম্পদ ছোটো ছোটো মলিন কথা ও কাপড়ের পুঁটুলিতে বাঁধা। তাদের যাওয়ার পথ রামচন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে। একটা কান্নার মতো শব্দ হচ্ছিলো। খবর পেয়ে রামচন্দ্র দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যারা চলে যাচ্ছিলো তারা সকলেই মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিলো, যেন সম্মুখের পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল।
রামচন্দ্র ছটফট করে ঘর বার করতে লাগলো। কারণে-অকারণে অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্যগুলিতে তার চোখ গিয়ে পড়লো। আকাশের সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তার বাড়ির সম্মুখে গাছগুলির মাথা দিয়ে ঘেরা আকাশটুকুকে সীমা-সরহদ্দযুক্ত জমির মতোই আপনার বলে বোধ হতে লাগলো।
সন্ধ্যায় আর একজন লোক এলো তার কাছে। এ লোকটি তার পরিচিত। সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের ছেলে ছমির মুন্সি। লোকটির সঙ্গে রামচন্দ্রর আবাল্য একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব আছে–পাঠশালা থেকে চাষীজীবন পর্যন্ত। দিনকাল যখন এ দেশের ভালো ছিলো, রামচন্দ্র তাই সানিকদিয়ারের কোল ঘেঁষে জমি নেবার চেষ্টা করতে আর ছমির চেষ্টা করতে চিকন্দি অনুপ্রবেশের। এ ব্যাপারটা নিজেদের অজ্ঞাতেই হতো মাঝে মাঝে।
ছমির হাঁক দিয়ে বললো, কে, রামচন্দ্র আছে?
কে, ছমিরভাই না?
হয়। বারাও দেখি।
কী মনে করে?
রামচন্দ্র বারান্দায় এসে ছমিরকে বসতে দিলো।
ছমির রামচন্দ্রর দেওয়া তামাকের কলকেটি নিঃশেষ করে বললো, ওপারে কবে যাবা?
যাবো একদিন, সেদিন খবর পাবা; হরিধ্বনি দিবে।
আরে, সে পার না; মিলে কবে যাবা?
মিলে? তুমি বুঝি জমির খোঁজে আসছো?
তা দেখ, তোমাক কওয়া থাকলে ভাই, যে যা-ই দিক, তার উপর বিঘায় পাঁচ টাকা দাম ধাই থাকলো আমার। তোমার জমিগুলে সোনা। আর কেউ না জানুক আমি জানি।
জমির প্রশংসায় রামচন্দ্রর মন নরম হলো। ছমিরের জমি কেনার কথায় যে জ্বালা শুরু হয়েছিলো তার কিছুটা প্রশমিত হলো।
রামচন্দ্র বললো, তামুক দি?
ছমির চলে গেলে জমির প্রশংসাসূচক কথা কয়টি খানিকটা সময় রামচন্দ্রর মন জুড়ে রইলো। অনেকদিন জমির দিকে এমন অনুভবটা হয়নি, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুর্দম্য ক্ষোভ এলো তার মনে। মুঙ্লা পাটের সুতলি পাকাচ্ছিলো, তাকে লক্ষ্য করে রামচন্দ্র বললো, কেন্ রে, এ কি ভাগাড়, শকুন উড়ে?
কথাটা বুঝতে না পেরে মুঙ্লা মুখ তুলো, ততক্ষণ রামচন্দ্র সরে গেছে।
রাত্রিতে রামচন্দ্রর স্ত্রী বললো, কথা কই তোমাক।
কও।
তুমি কি যাবাই?
কী করি কও, বুঝি না। থাকে কী করি, যায়ে কী করি?
বৈষ্ণবী আসছিলো কাল, কয় যে তুমি চলে গেলে কার ভরসায় গাঁয়ে থাকবো।
হুম।
আর কয়, সেখানে মিয়েছেলের লজ্জা-হায়া থাকে না। পচ্ছিমাদের তাড়ি খাওয়া আছে। সেখানে নাকি তুলসী বোনার জায়গা নি। জলে কাদায় থিকথিকে।
রাত্রিতে ঘুম হলো না রামচন্দ্রর। ওরা যখন প্রস্তাব করেছিলো তখন সে বলিষ্ঠভাবে কিছু বলতে পারেনি–নিজের এই দুর্বলতাকে এখন অতলস্পর্শী বলে মনে হলো তার, আর এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবার জন্যে তার মন অধজাগ্রত অবস্থায় আঁকুপাঁকু করতে লাগলো।
এরফান সেখ এবং ছমির মুন্সির কথা মনে হলো। জমি, জমি। বুকের হাড় ভেঙে নিতে চায় ওরা। হায় ভগোমান, হায় ভগোমান! এখন হয়েছে কি, চাষবাস রামচন্দ্রর কাছে শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের হেতুমাত্র নয়। জীবনের উদ্দেশ্যও বটে। রোজ তার মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, আজ হলো।
ধান উঠেছে, নতুন গোলা একটা বাঁধা হয়েছে। তার মেয়ের আবদার রাখার জন্যে সে গোলাটাকে বেতের কারুকার্য দিয়ে সাজিয়েছে। একদিন হাট থেকে ফিরে দেখলো জামাই মুঙ্লা রং গুলে রাঙাচ্ছে গোলার গায়ের বেতের বাঁধনগুলো। হুকুমটা দিয়েছে এ বাড়ির মেয়ে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
সে কাছেই ছিলো, ছুটে এসে বলেছিলো–কে বাবা, লক্ষ্মীর ঝাপির মতন হয় নাই?
–হইছে।
একদিন এই গোলার পাশে বসেই কথা হচ্ছিলো।
মেয়ে বললো–এত ধান দিয়ে কী হবি, বাবা?
–বেচবো। রামচন্দ্র বললো।
–বেচলা যেন, তারপর?
–জমি কিনবো।
–তারপর কী হবি?
–আরো ধান।
–আরো ধান? তাও যেন বেচবা, তারপর কী করবা?
–আরও জমি নিবো।
মেয়ে হেসে বললো–সব জমি নেওয়া হলি, তারপর?
এবার রামচন্দ্র ভাবলো। একটু ভেবে বললোমনে কয় চরে খানটুক জমি নিবো। মুঙ্লা দড়ি পাকাচ্ছিলো লাটাইয়ে, সে বললো হাসিহাসি মুখে–তারপর আবার ধান।রামচন্দ্র কলকেতে তামাক ভরতে ভরতে বলেছিলো–সে ধান তুমি তুলবা, বাপ। আমি তখন কাশী যাবো।
চাষের কথায় এমন দৃশ্য মনে পড়ে যায়। মেয়েটা মনের অন্ধকারে একলা কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। যেন সেই নিঃসঙ্গতায় ভয় পেয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চাপা গলায় বাবা বাবা’ৰ্বলে ডাকে। রামচন্দ্রর মনের আধখানা সব সময়েই তাকে সঙ্গ দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। প্রাত্যহিক দিনের চাষবাস করতে নামলে যেন তাকে অশ্রদ্ধা করা হবে।
রামচন্দ্রর দু চোখে উষ্ণ জল লবণাক্ত হয়ে উঠলো।
অহহ, কী করবো। কী করি।
পরদিন সকালে দেখা গেলো রামচন্দ্র লাঙল কাঁধে নিয়ে বার হয়েছে; একটা বলদ ও একটা বুড়ি গাইকে মুঙ্লা বাঁচিয়ে রেখেছিলো, সে-দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে সে খেতের দিকে যাচ্ছে।
কিছুদূর যাবার পর লজ্জায় যেন তার মাথাটা নুয়ে আসতে লাগলো। কী বলবে লোকে? গ্রামের সব মাঠ যখন আগাছায় ঢেকে আছে, তখন ভাঙা নড়বড়ে লাঙল নিয়ে সে বেরিয়েছে। বেহালের গোরু বলদে ভুই চাষ করতে! এত বড়ো শোকটাও কি তবে তার লাগেনি? ম্লান প্রাণে আকাশের দিকে মুখ তুলে সে অনুচ্চারিত সুতীব্র কণ্ঠে বলতে লাগলো, কী উপায় আছে কও, যাবের পারবো না যে।
কিন্তু জমির উপরে লাঙলনামিয়ে গোরু বলদকে জোয়ালে জুড়তে জুড়তে হঠাৎ তার শিরা উপশিরাগুলো বিস্ফারিত হয়ে গেলো আরো গভীর রক্তপ্রবাহের পথ করে দিতে। মুঠি দিয়ে দৃঢ়ভাবে লাঙলটা চেপে ধরা নয় শুধু, আরও কঠিন করে ভূমিকে পীড়িত করতে লাঙলের পিছন দিকের বাঁকা অংশটিতে পায়ের চাপ দিতে লাগলো রামচন্দ্র। তার মনোভাবটাকে রুদ্ধ আক্রোশের কাছাকাছি বলা যায়, কিন্তু যত না আক্রোশ তার চাইতে বেশি অভিমান। এই মাটি তার মা না হয়ে জারমুখী হয়েছে।
একটু বেলা হতেই রামচন্দ্রর পাড়ার লোকরা দেখলো, রামচন্দ্রর একটা জমির আধাআধি লতাঘাসের জঙ্গল উপড়ে গিয়ে কালো কালচে জমি বেরিয়ে পড়েছে।’হোক নাবলা, মণ্ডল চাষ দিছে–বৈশাখের বাতাসের মতো খবরটা হাল্কা হয়ে উড়তে লাগলো।
মুঙ্লা সকালেই বেরিয়েছিলো, আজকাল প্রায়ই তার সঙ্গে একটি ছোটো সমবয়সী মানুষের দল থাকে। সেই দলটি নিয়ে সে এসে দাঁড়ালো ক্ষেতের ধারে। দৃশ্যটার বিস্ময় কাটলে মুঙ্লা বললো, শুনছনা বাবা, চৈতন সা পুলিসে খবর দিছিলো, পুলিস আসেনা। জমিদার সদরে লোক পাঠাইছে নালিশের জন্যি। জমি খাস, ট্যাকা জব্দ।
তারপর?
কয় চৈতন সা–বাপ-সকল এই এক বছর তোমরা খাইখালাসিগুলা নিজের জমি মনে করে চষে দাও; এক বছরের ফসল শুধু আমি নিবো, তোমাদের সব দেনা ওয়াসিল; জমিদারের খাজনা শোধ করবো।
আমরা যে খাটবো তার দাম? হেদি। তারপর?
কলাম, লেখো নতুন দলিল। তিরিশ টাকায় তিন বছর খাইখালাসি, বিশ টাকা ওয়াসিল পাইছো লেখো। নতুন দলিলে শুধু দশ টাকার কথা থাকবি।
সে তো অমনি ফিরবি। ডানি ডানি। এক বছর পর তো জমি আপনি ফিরবি। তারপর কী হলোকও।
কলাম। ছিদামও কলে; এক সন তোমার জমিতে খাটবো-খাটবো, খাবার ধান দিবা।
কস কী? হেদি ভোর।
কলে–রাজী, রাজী। কলে বাপ-সকল, আর এক কথা–গান করবা না।
রামচন্দ্র গাঁক গাঁক করে হেসে উঠলো।
মুঙ্লা যথাসাধ্য গম্ভীর মুখে তার বিজয়কাহিনী বর্ণনা করলো, কলাম, কিন্তুক সাজিমশাই, ঢোল তোলা থাকবি ঘরে, রামশিঙা গোঁজা থাকবি বাতায়।কয় যেহবি, সব হবি। বাপ-সকল, গান থামাও। আলেফমিঞাও দাড়ি ভাসায়ে নাচেনাচে গান শুনায়।কয়, আমাক হাড় চুষে খাতে দেখেছে।
রামচন্দ্র বজ্রের মতো ফেটে পড়লো হাসিতে, যেমনভাবে আকাশ ফেটে বৈশাখী ধারাবর্ষণ শুরু হয়।
কিন্তু। দুপুরে বাড়িতে ফিরে খেতে বসেছিলো রামচন্দ্র। মুঙ্লা পাশে বসেছে। আর দুদিন পরে নীলের গাজন। মুঙ্লা সেই উৎসবের কথা বলছিলো।বর্ষশেষের এই উৎসবে দুঃখদুর্দশা শেষ করতে সে বদ্ধপরিকর। সে নিজে বুঝতে পারছে না কেন, কিন্তু অনুভব করছে চৈতন্য সাহা অতঃপর কৃষকদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবে। সে কথাও আলোচনায় আসছিলো। সহসা ভাতের দলাটা মুখে তুলতে গিয়ে রামচন্দ্রর হাত অসাড় হয়ে গেলো। হাউহাউ করে কেঁদে উঠে পরমুহূর্তে কান্না থামানোর চেষ্টায় সে আহার্য ফেলে উঠে গেলো।
রাত্রিতে স্ত্রীকে কথায় কথায় সে বললো, অমন কান্নাকাটি করে লাভ নাই। কিন্তু আমার মনে হলো আমার মিয়ে কনে। সে খায় নাই।