বারো
চেকপোস্টের আগে নেমে পড়ে নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ভেবে খুশি হয়েছিল সোম। যেভাবে শহরের বাইরেও পুলিশভ্যান টহল দিচ্ছে তাতে ওই মারুতি গাড়িতে থাকলে এতক্ষণে মাটির তলার ঘরে চালান হয়ে যেত সে। চেকপোস্টে নিশ্চয়ই ভাল করে গাড়ির আরোহীদের জেরা করা হচ্ছে। সোম নেমে পড়েছিল খানিকটা আগে এবং রাস্তা ছেড়ে উঠে এসেছিল পাহাড়ে। সেখান থেকে রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায় কিন্তু রাস্তা থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না।
তখন প্রায় শেষ রাত। বসে থাকতে থাকতে ঘুম এল। পাহাড়ি পাথরে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঘুম দখল করল তাকে। যখন চোখ খুলল তখন আলো ফুটে গিয়েছে। এবং তখনই তার মনে হল শহরের বাইরে আসায় তার জীবন বেঁচে গেছে বটে কিন্তু আকাশলাল অথবা সেই খবর দিতে আসা লোকটাকে ধরা এখানে থেকে সম্ভব নয়। সে ইচ্ছে করলে পালিয়ে যেতে পারে অনেক দূরে যেখানে ভার্গিসের পুলিশ পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু ওই পালিয়ে থাকা জীবনে কোনও সুখ নেই। এখন শহরে ঢুকতে গেলেই সে ধরা পড়ে যাবে। আর কোনও বোকামিতে সে নেই অথচ তার পক্ষে শহরে ঢোকা খুবই জরুরি।
খোলা আকাশের নীচে রাত কাটিয়ে অথবা টানটান না ঘুমানোর জন্যেই সোমের শরীর এখনও আলস্য পছন্দ করছিল। সে দেখল নীচের রাস্তা দিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। সাধারণত উৎসবের আগের রাত্রে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষজন দলবেঁধে তাদের গ্রাম-দেবতাকে নিয়ে আসে শহরে। শহরের দেবীকে পরিক্রমা করে আবার ফিরে যায় গ্রামে। এইসব দেবতাদের চেহারা অদ্ভুত, অনেকের নামও নতুন ধরনের। রাত্রের ওই গ্রাম্য মানুষের দলে ঢুকে পড়তে পারলে শহরে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে রাত্রের জনতাকে আর খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার ক্ষমতা চেকপোস্টের পাহারাদারদের না থাকারই কথা। কিন্তু সেই সুযোগ নিতে গেলে তাকে মধ্যরাত পর্যন্ত এখানে বসে থাকতে হয়। সারাটা দিন খাদ্য পানীয় ছাড়া এখানে পড়ে থাকা অসম্ভব। সোম মনঃস্থির করতে পারছিল না। সে উঠে পাহাড়ের দিকে তাকাল। এই পাহাড়ের বিভিন্ন ঢালে ছোট ছোট গ্রাম ছড়ানো। আকাশলালের খোঁজে এইসব গ্রামে পুলিশ বারংবার হানা দিয়েছে। এখনও পুলিশের লোক ছড়ানো আছে এখানে ওখানে। গ্রামে তার পক্ষে যাওয়া বিপজ্জনক হবে।
এইসময় একটা লরি এসে দাঁড়াল নীচের রাস্তায়। লরিটা মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশের দরজাটা খুলে একটা মেয়ে লাফ দিয়ে নীচে নামল। নেমে চিৎকার করল, ‘ভালভাবে যাও।’ লরিটা ওপরে উঠে গেলে মেয়েটা চারপাশে তাকাল। তারপর সরে এল পাহাড়ের দিকে যেখানে সোম দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা অত্যন্ত সাধারণ, পোশাক এদেশীয়। সোম কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল কিন্তু মেয়েটাকে দেখতে পেল না। অর্থাৎ মেয়েটা পাহাড়ে ওঠেনি আবার নীচে নেমে যায়নি। সেটা করতে হলে ওকে রাস্তা ডিঙিয়ে যেতে হবে। এই মেয়ের পক্ষে তাকে চেনা সম্ভব নয়। একটু কৌতূহলী হয়েই সোম ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগল। নীচের রাস্তায় নামামাত্র মেয়েটিকে দেখতে পেল সে। রাস্তার ধারে একটা পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে চুপচাপ। সোমকে দেখামাত্র তার চোখ ছোট হয়ে গেল, মুখে সন্দেহ। সোম হাসতে সে হাসার চেষ্টা করল। একটু এগিয়ে এসে সোম জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি শহরে যাচ্ছ না?’
‘উৎসব তো কাল, আজকে গিয়ে কি হবে।’ মেয়েটার কথা বলায় ধরন বেশ। ক্যাটকেটে।
‘তা অবশ্য।’ বলামাত্রই একটা গাড়ির আওয়াজ কানে এল। ওটা যদি পুলিশের গাড়ি হয় তো এভাবে মুখ দেখানো মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। সে চকিতে পাথরের আড়ালে চলে এল। গাড়িটা যখন সামনের রাস্তায় পৌঁছাল তখন দেখা গেল সোমের সন্দেহ ভুল নয়। মেয়েটার দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বন্দুকধারী পুলিশ গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটা এবার তার পেছনে দাঁড়ানো সোমকে দেখল। এই লোকটা যে পুলিশের ভয়ে ওখানে গিয়ে লুকিয়েছে তাতে তার কোনও সন্দেহ নেই। লোকটা কে হতে পারে? চেহারা দেখে চোর-ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না। আবার পালিয়ে বেড়ানো বিপ্লবীদলের কর্মীদের মত চেহারা নয়। সে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে?’
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সোম হাসল, ‘আমি? একজন সাধারণ মানুষ।’
‘সাধারণ মানুষ কখনও পুলিশকে দেখে ভয় পায় না!’
সোম বুঝল তাকে একটা পরিচয় দিতে হবে। সে গল্প তৈরি করবার চেষ্টা করল কিন্তু তেমন জুতসই কিছু না পেয়ে বলল, ‘আমি আমার ভাইয়ের খোঁজে শহরে যেতে চাই।’
‘ভাই?’
‘হ্যাঁ। ও শহরে থাকে। পুলিশ ওকে খুঁজছে।’
‘পুলিশ ওকে খুঁজছে কেন?’
‘কি বলব! ওর জন্যে আমাদের পরিবারের সবাই জেলে গিয়েছে। মানে পুলিশ সবাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম বলে বেঁচে গেছি।’
‘আপনি তাহলে ইন্ডিয়ায় থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি পুলিশকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
‘ওই যে, বললাম তো, পুলিশ আমাকে পেলেও ধরবে। ভাইয়ের খবর নেবে। আমি ধরা না পড়ে ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতে চাই।’ সোম গল্পটা বানাতে পেরে খুশি হল।।
‘পলিশ যেখানে আপনার ভাইকে খুঁজে পাচ্ছে না সেখানে আপনি কী করে পাবেন?’
‘আমি দু-একজনকে চিনি যারা খবরটা দিতে পারে।’
‘আপনি আগে এই শহরে থাকতেন?’
‘হ্যাঁ। বছর দশেক আগে আমি ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছিলাম।’
‘আপনার ভাইয়ের নাম কি?’ মেয়েটা সরাসরি তাকাল।
সোম বিপাকে পড়ল। তারপর সেটা কাটাতে পাল্টা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে? তোমাকে আমি এতসব কথা বললাম কেন? না, না, আমি আর কোনও কথা বলতে পারব না।’
মেয়েটা এবার হাসল, ‘আপনি যদি সত্যি কথা বলেন তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’
‘কীরকম?’ সোম এইরকম কিছু শুনবে বলে অপেক্ষা করছিল।
‘পুলিশের চোখ এড়িয়ে শহরে পৌঁছতে সাহায্য করতে পারি।’
‘বেশ। বলছি। আগে তোমার ব্যাপারটা জানি।’
‘আমি? মেয়েটা পাথর থেকে নেমে দাঁড়াল, ‘আমার নাম হেনা।’ তারপর দৃরের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওইখানে আমাদের গ্রাম। গ্রামে ধোঁয়া উঠছে বলে আমি এখানে বসে আছি। ওটা সংকেত। গ্রামে গোলমাল থাকলে আগুন জ্বেলে আকাশে ধোঁয়া ভোলা হয়।’
‘ও কি ধরনের গোলমাল?’
‘ওখানে না গেলে বলতে পারব না।’
‘তুমি কিভাবে আমাকে সাহায্য করবে?’
‘এখনও ভাবিনি। কিন্তু আপনার ভাইয়ের নামটা বলেননি আপনি।’
মুখে এসেছিল আকাশলালের নামটা কিন্তু শেষমুহূর্তে সামলে নিল। সে গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি জানি না তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কি না!’
‘আপনার সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।’
‘আমার ভাইয়ের নাম ত্রিভুবন।’
‘ও।’ মেয়েটা বড় চোখে তাকাল।
‘তুমি আমার ভাইকে চেনো?’
‘আকাশলালের কাছের লোকদের নাম কে না শুনেছে! কিন্তু শহরে গিয়ে আপনার কোনও লাভ হবে না। চিতা এবং নেকড়েদের খবর স্বয়ং ভগবানও জানেন না।’
‘কিন্তু আমাকে যেতে হবেই।’
‘কেন যাবেন?’
‘আমি ভেবে দেখলাম যেখানে আমার সব আত্মীয়স্বজন জেলে বন্দি সেখানে আমি ইন্ডিয়ায় বসে আরাম করছি এটা ঠিক নয়। আমি ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। সোম এমন আবেগে কথাগুলো বলল যে হেনা খুশি হল, ‘বেশ, আসুন আমার সঙ্গে।’
‘কোথায়?’
‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বারংবার পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকোতে হবে আপনাকে।’ হেনা তার গ্রামের উল্টোদিকের পাহাড়ে উঠতে লাগল। সোম ভেবে দেখল তার মাথায় যখন কিছুই আসছে না তখন মেয়েটাকে বিশ্বাস করাই একমাত্র পথ। মেয়েটার কথাবার্তা থেকে সরাসরি না হলেও আভাসে বোঝা গেছে যে বিপ্লবীদের সঙ্গে ওর যোগায়োগ আছে। শহরে ঢুকতে হলে ওর ওপর নির্ভর করতেই হবে। পাকদণ্ডির পথ ধরে ওপরে উঠতে উঠতে মেয়েটা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনি এখানে এলেন কীভাবে?’
‘এক ডাক্তার ভদ্রলোকের গাড়িতে লিফট নিয়েছিলাম।’
হেনার চোয়াল শক্ত হল। সমতল থেকে পাহাড়ে ওঠার পথে তার ডিউটি ছিল। এক বান্ধবীর পানবিড়ির দোকানে বসেছিল সারাদিন। বিকেলের দিকে ডাক্তারের লাল মারুতিটাকে ওপরে উঠতে দেখে সে-ই খবর পাঠিয়েছিল ওপরে। কিন্তু ডাক্তারের গাড়িতে তো একজন মহিলা ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী গাড়ি?’
‘লাল মারুতি। ইন্ডিয়ার গাড়ি।’ সোম সরল গলায় জবাব দিল।
হেনা মাথা নাড়ল। লোকটা ঠিক বলছে। তাহলে ওঠার সময় পেছনের সিটে লুকিয়েছিল লোকটা তাই দোকানে বসে দেখতে পায়নি সে। ত্রিভুবন আকাশলালের তিন প্রধানসঙ্গীর একজন। সমস্ত দেশে লুকিয়ে থাকা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব ওর ওপরে। আর এই লোকটা যদি ত্রিভুবনের ভাই হয় তাহলে ওকে সাহায্য করা উচিত। ওরা হাঁটতে শুরু করল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সোম জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি হেনা?’
‘দুই ক্রোশ দূরে আমার এক বন্ধু থাকে, তার কাছে।’
‘তোমার বন্ধু?’
‘হ্যাঁ।’
‘মানে বয়ফ্রেন্ড?’
হেনা শব্দ করে হাসল, ‘আঙুল মানেই হাতের আঙুল? পায়ের হয় না?’
‘তা অবশ্য।’
হঠাৎ হেনা দাঁড়িয়ে গেল। দূরের আকাশে তখন পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়া। সে মাথা নাড়ল, ‘না। আর এগোনো যাবে না। ওখানেও গোলমাল শুরু হয়েছে। উৎসবের আগে ওরা সব্বাইকে ঝামেলায় ফেলছে। এতে অবশ্য ভার্গিসের বারোটা বাজতে দেরি হবে না।’
ভার্গিসের নামটা কানে যেতেই একটু শক্ত হল সোম, ‘তুমি ভার্গিসকে দেখেছ?’
‘কে না দেখেছে ওই বুলডগকে?’
অস্বস্তিটা আরও বাড়ল। ভার্গিসকে দেখেছে আর তাকে দ্যাখেনি এমন কি হতে পারে। তার পজিশন ছিল দু-নম্বরে। ওরা জানতে পারলে খুন করতে দ্বিধা করবে না। একদিকে ভার্গিস আর অন্যদিকে বিপ্লবীরা, সসাম দিশেহারা হয়ে পড়ছিল।
হেনা বলল, ‘আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। ওইদিকে চলুন। এখানে একটা ঝরনা আছে। চট করে কারও নজরে পড়বে না।’
ওরা ঝরনার দিকে এগোতেই আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে এল। হেনা দৌড়তে লাগল, ‘তাড়াতাড়ি দৌড়ান। দেখে ফেললে গুলি খাবেন।’
পঞ্চাশ বছর বয়সে যতটা দৌড়ানো সম্ভব সোম ঠিক ততটাই দৌড়াল। জঙ্গলের আড়ালে ঢোকামাত্র বসে পড়ল সে। মাথার ওপর চক্কর খাচ্ছে হেলিকপ্টার। ওগুলো তার চেনা। পাইলট হয়তো এখনও সামনাসামনি দেখলে তাকে স্যালুট করবে। কিন্তু রেইডের সময় যখন ওগুলো ব্যবহার করা হয় তখন নির্দেশ থাকে সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই গুলি করার। গুলি না করে ওগুলো চলে গেল যখন তখন বোঝা যাচ্ছে ওদের চোখ এড়ানো গেছে। সোম উঠল। সামনেই হেনা, হাসছে। বলল, ‘আপনার তো বেশ। ট্রেনিং আছে দেখছি!’
‘না, মানে, মনে হল।’ যেন বিড়বিড় করল।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু এগোতেই ঝরনাটাকে দেখা গেল। পাহাড়ের বুক থেকে নেমে ছায়াছায়া নির্জনে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। সোম বলল, ‘বাঃ, কী সুন্দর!’
‘আপনার খিদে পেয়েছে?’
প্রশ্নটা শোনামাত্র খিদে পেয়ে গেল সোমের। কাল বিকেল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। সারাক্ষণ টেনশনে থেকে খাওয়ার কথা মনেও আসেনি। এখন জল, নির্জনতা এবং ওই প্রশ্নে মনে হল খেতে পেলে আর কিছুই চাইত না সে।
প্রশ্নটা করেই নিজেই উত্তর দিল হেনা, ‘পেলে কিছুই পাবেন না এখানে। তবে!’ সে সোমের দিকে তাকাল, ‘আপনার কাছে রিভলভার আছে?’
অজান্তেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেই মনে মনে খেপে গেল সোম নিজের ওপরে। রিভলভারের কথা স্বীকার করল কেন? সাধারণ মানুষের সঙ্গে রিভলভার থাকে নাকি! গর্দভ!
‘তাহলে একটা পথ আছে। ওই দেখুন, বেশ মোটাসোটা ডাহুক। গুলি করে যদি মারতে পারেন, তাহলে আগুন জ্বেলে রোস্ট করে দিতে পারি! হেনা হাসল।
সংকোচ হচ্ছিল সোমের রিভলভারটা বের করতে। সার্ভিস রিভলভারটাকে দেখলে হেনা কি চিনতে পারবে? সে মৃদু আপত্তি করল, ‘গুলি ছুঁড়লে শব্দ হবে না?’
‘হলে হবে। ওপাশে ধোঁয়ায়, মাথার ওপর হেলিকপ্টার, কেউ শুনলে ভাববে পুলিশের গুলি। এদিকে আর আসবে না তাহলে।’ হেনা বলল।
সোম ডাহুকটাকে দেখল। কমসে কম এককেজি ওজন হবে। হেলিকপ্টারের আওয়াজে বোধহয় একটু ভয় পেয়ে গেছে। সে হেনার দিকে তাকাল। খিদেটাকে বড্ড বেশি মনে হচ্ছে এখন। যা হয় হবে আগে তো খেয়ে নিই, মনে মনে ভাবল সে।
সে রিভলভার বের করে তাগ করল। ডাহুকটা মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকাল। সোম ট্রিগার টিপতেই কানফাটানো আওয়াজ হল। কিছু পাখি উড়ে গেল আকাশে শব্দ করে আর ডাহুকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল যেখানে বসেছিল। হেনা বলল, ‘বাঃ, আপনার টিপ তো দারুণ।’ বলে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনল পাখিটাকে। সোম খুশি হল। একসময় সে ফোর্সে বেস্ট শুটার ছিল।
আওয়াজটা তখনও কানে লেগে ছিল। সোম আকাশে নজর করল। হেলিকপ্টার আপাতত নেই। কিন্তু কাজটা বেশ বোকার মতই করেছে। পুলিশের পক্ষে ওটা গুলির শব্দ তা বুঝতে অসুবিধে হবে না।
‘নিন, ছাড়ান। আমি আগুন জ্বালার ব্যবস্থা করি।’ হেসে পাখিটাকে সোমের হাতে তুলে দিল।
এ ব্যাপারে সোমের কিঞ্চিৎ অভ্যাস ছিল যৌবনের শুরুতে। সেটা মনে করে সে হাত লাগাল। মেয়েটা ইতিমধ্যে শুকনো ডালপালা জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়েছে। ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেটা লক্ষ করে সোম বলল, ‘দূর থেকে দেখলে লোকে ভাববে এখানেও গোলমাল হচ্ছে।’
‘কেন?’ হেনা তাকাল।
‘আপনার আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে।’
‘ভালই তো। গুলির শব্দ, আকাশে ধোঁয়া, কেউ এদিকে আসবে না।’
কিন্তু একটু ভুল হয়ে গেল। ওরা যখন ডাহুকের সেঁকা মাংস আরাম করে চিবোচ্ছে তখন জঙ্গলের মধ্যে চারজন মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। হেনার ঠিক পেছনে গাছের আড়ালে ওরা। চোখ বন্ধ করে খাবারের স্বাদ না নিলে সোম হয়তো কিছুটা দেখতে পেত। হেনা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি সবসময় রিভালভার নিয়ে যাবেন?’
‘সবসময় নয়। এবারই আসার সময় মনে হল সঙ্গে রাখা ভাল।’ সোম হাড় চিবোচ্ছিল।
‘এদেশে কোনও রকম আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখা অপরাধ, ধরা পড়লে দশ বছর জেল।’
‘তুমি না ধরিয়ে দিলে পুলিশের সাধ্য নেই আমাকে ধরে।’
‘আমাকে আপনি চেনেন না, একটু আগে আলাপ হল, হঠাৎ এত বিশ্বাস হয়ে গেল কি করে?’
‘কাউকে কাউকে প্রথম দেখেই এরকম মনে হয়।’
‘আপনার রিভলভারটা একবার দেখব?’
‘নিশ্চয়ই।’ পাশে রাখা রিভলভারটা সোম তুলে দিল হেনার হাতে। হেনা ওটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জঙ্গলে দাঁড়ানো লোকগুলো হেনার মুখ দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেল। সোমকে বিস্মিত করে ওরা বেরিয়ে এল সামনে। দেখামাত্র সোম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু হেনা বলল, ‘আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা আমার বন্ধু।’
সোমের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তার রিভলভার এখন হেনার হাতে। অসহায় চোখে সে লোকগুলোকে দেখল। একজন হেনাকে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। বাকিরা পাথরের মত সোমের সামনে দাঁড়িয়ে। এখান থেকে পালাবার কোনও পথ নেই।’
যে লোকটা হেনার সঙ্গে কথা বলছে সে উত্তেজিত, ‘তুমি এখানে কেন?’
‘গ্রামে ধোঁয়া উঠছিল বলে তোমার গ্রামে যাচ্ছিলাম। ওখানেও গোলমাল মনে হল।’
‘হ্যাঁ। আজ সবজায়গায় পুলিশ হানা দিয়েছে। কিন্তু এই লোকটাকে কোথায় পেলে?’
‘রাস্তায় আলাপ হল।’
‘লোকটাকে তুমি চিনতে পেরেছ?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু ও নিজেকে ত্রিভুবনের ভাই বলে পরিচয় দিয়েছে। ইন্ডিয়ায় থাকে, ত্রিভুবনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। পুলিশ দেখলে ওকে ধরবে বলে শহরে ঢুকতে পারছে না।’
‘বাজে কথা, মিথ্যে কথা।’ লোকটা গর্জে উঠল।
‘আস্তে কথা বল। ব্যাপারটা যে আমরা জানি তা ওকে বোঝাবার দরকার নেই!’
‘কি বলছ তুমি? লোকটা আমাদের ওপর কি অত্যাচার করেছে তা মনে নেই?’
‘আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে কোনও গোলমাল হয়েছে ওর।’
‘কিছুই হয়নি। সব ভাঁওতা। দ্যাখো ওর পেছনে হয়তো পুলিশ আসছে।’
‘না। সেটা হলে এতক্ষণে টের পেতাম। আগে ওর সম্পর্কে খবর জোগাড় করো। যদি কোনও গোলমাল না থাকে তাহলে ব্যবস্থা নিতে অসুবিধে হবে না।’
‘আমি এখনই পাঠাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণ ও কোথায় থাকবে?’
‘তোমাদের গ্রামের কি অবস্থা।’
‘অল ক্লিয়ার। পুলিশ চলে গিয়েছে।’
‘সেখানেই চলো।’
হেনা ফিরে এসে সোমের সামনে দাঁড়াল, ‘আপনার রিভলভার দেখে আমার বন্ধুরা খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে থাকলে এটার প্রয়োজন আপনার হবে না।’
সোম একটু মাটি পেল যেন, ঘাত নাড়ল, ‘ঠিক আছে।’
‘এরাই আমার বন্ধু। ওদের গ্রাম এখন শান্ত। আপনার গুলির শব্দ শুনে দেখতে এসেছিল। চলুন, ওদের গ্রামে গিয়ে বিশ্রাম করা যাক।’ হেনা এগোল। সোমের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এরা তাকে কেন চিনতে পারছে না তাই তার মাথায় ঢুকছিল না। অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার হিসেবে সে অনেক অ্যাকশনে নেতৃত্ব দিয়েছে, অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছে। মনে হয় গ্রামের মানুষ বলেই তাকে সাধারণ পোশাকে চিনতে পারছে না। শহরের লোক অনেক বেশি চালাক হয়।
ওরা একটা পাহাড়ি গ্রামে ঢুকতেই দুটো কুকুর তেড়ে এল। একটা লোক ধমকে তাদের সরিয়ে দিল। আসবার সময় সোম লক্ষ করেছিল হঠাৎ উদয় হওয়া চারজনের মধ্যে একজন তাদের সঙ্গে ফিরছে না। কোথায় গেল লোকটা? জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি তার।
একটু আগে পুলিশ ঘুরে গিয়েছিল বলে গ্রামে উত্তেজনা ছিল। মানুষজন বাইরে দাঁড়িয়ে ওই বিষয়েই আলোচনা করছিল। তারা এদের দেখতে পেল। হেনা মেয়েদের দিকে হাত নাড়ছিল। হঠাৎ একটি প্রৌঢ় চিৎকার করল, ‘ওই যে ওই যে পুলিশ, আমার ছেলেকে মেরেছে, ওকে আমি ছাড়ব না, মার, মার, মার।’ পাগলের মত লাঠি হাতে তেড়ে এল লোকটা।
হেনার সঙ্গীরা লোকটাকে আটকাল, ‘চাচা নিজেকে শান্ত করো। আমরা কষাই নই। বিনা বিচারে ওকে মারা ঠিক হবে না।’
কথাটা কানে যেতেই সোমের মেরুদণ্ড কন্কন্ করে উঠল।