1 of 2

১২. ঘাটের পৈঠায় বসে একটা নিম ডাল চিবিয়ে

ঘাটের পৈঠায় বসে একটা নিম ডাল চিবিয়ে দাঁতন করছে রবি। ঊষালগ্ন পার হয়নি, অতি নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে দিগবলয়ে, এখনও প্রকাশিত হননি সূর্যদেব। কয়েকদিন অবিশ্রাম বৃষ্টিধারার পর প্রাচীনা গঙ্গা নদীকে আজ মনে হচ্ছে পূর্ণযৌবনা। ছলচ্ছল স্রোতের শব্দের মধ্যে রয়েছে একটা চাপা সঙ্গীত। রবি কান পেতে সেই সুরটা ধরার চেষ্টা করছে।

রবি পরে আছে বিলেত থেকে আনা গাঢ় নীল রঙের সুইমিং ট্রাঙ্ক, খালি গা, দু’চোখে সদ্য ঘুম ভাঙার সামান্য রেশ। তার একুশ বছরের শরীরে এখন পূর্ণ যৌবন, প্রশস্ত বুক, নির্মেদ কোমর, দীর্ঘ বাহু, গৌর বর্ণ, যদিও জ্যোতি দাদার তুলনায় অনেকেই তাকে কালো বলে। বাড়িতে আর কেউ জাগেনি, এমনিতেই সবাই রাত করে ঘুমোয়, কাল ফেরা হয়েছে অনেক রাতে, গুণেন্দ্রনাথের বাগানবাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। কিন্তু যত রাতেই ঘুমোতে যাক, রবি প্রতিদিনই ভোর হবার আগেই জেগে ওঠে। আকাশে সূৰ্য উঠে গেলে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না রবি।

গুণোদাদার বাড়িতে পার্টি মানেই বিশাল হইচই। আমুদে ও মজলিশি গুণেন্দ্রনাথ ছোট আকারের কিছু ভাবতে পারেন না। এই সব পার্টি তেমন পছন্দ করে না রবি। প্রথম দিকটায় বেশ ভালো, রবি নিজেও উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয়, গানবাজনা হয়, হাসি-ঠাট্টার ফোয়ারা বয়ে যায়, কিন্তু মদ্যপান শুরু হলে আর থামতেই চায় না, তখন লোকে চেঁচিয়ে কথা বলে, অকারণে তর্ক তোলে, একই কথা বারবার বলে। সেই সময় রবির হাই উঠতে থাকে। রবি নিজে মন্দ স্পর্শ করে না, ছেলেবেলা থেকে সে মাতলামি অনেক দেখেছে, রাজনারায়ণ বসুর মুখে ইয়ং বেঙ্গল দলের মদ্যপানের বাড়াবাড়ির প্রচুর গল্প শুনেছে। এ দেশে আগে যে সুরা বা সোমরস ছিল না, তা নয়। কিন্তু ইংরেজরা আসার পর মদ্য পান করা যেন সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে, বাবামশাইয়ের মতন মহৰ্ষিতুল্য মানুষও এক সময় নৈশভোজের আগে সুরা পান করতেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, রবি ইংল্যান্ডে গিয়ে দেখেছে, অনেক ইংরেজ কিন্তু মদ্যপান করে না। কোনও নেশার প্রতিই আসক্তি নেই রবির, তার প্রয়োজন হয় না। যুব সমাজের অনেকেই হুঁকোয় তামাক খায়, যেখানে সেখানে থুতু ফেলে, তা দেখে রবির শরীর ঘৃণায় কুঁকড়ে ওঠে। হুঁকো-তামাক দুরে থাক, সিগারেট টানতেও প্রবৃত্তি হয় না তার।

নিমের ডালটা ফেলে দিয়ে রবি গঙ্গার জলেই মুখ ধুয়ে নিল। ওপারের গাছপালা একটু একটু অন্ধকার লেগে ছিল, কোথা থেকে যেন তরল আলো এসে মুছে দিচ্ছে সেই কালিমা। কিংবা এমনও মনে হতে পারে, যামিনী যেন আঁচল গুটিয়ে সরে যাচ্ছে অন্তরালে। রবির একটা কথা মনে পড়ল। ভগ্নহৃদয় কাব্যে সে এক জায়গায় লিখেছিল ‘অস্তমান যামিনী’, তাতে এক সমালোচক ভৎসনা করে লিখেছেন, যামিনী আবার অস্ত যায় নাকি। এ যে ভাষার ওপর একরূপ জবরদস্তি। সমালোচকের ওই কথাই কি সত্যি? একজন কবির যদি মনে হয়, যামিনী অন্ত যাচ্ছে, তা হলে সেই মনে হওয়াটাও কি কবিতার সত্য নয়? নায়িকার মুখের সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদের তুলনা দেন যে কবি, সেও তো কবির কল্পনা। বাস্তবে চাঁদের মতন গোল চকচকে মুখ যদি হয় কোনও নারীর, তা হলে তো অতি বিশ্ৰী দেখাবে। চাঁদ নয়, উপমাটা চাঁদের সুষমার সঙ্গে।

আকাশে ছিন্ন মেঘ, এলোমেলো বাতাস জলপূৰ্ণ, বেশ শীত শীত ভাব। এই বাতাসকে মলয়পবন বলা যায় না। স্নিগ্ধ সমীর? না, বায়ুর হিল্লোল, না। পাগলা হাওয়া বাইলে যেমন হয়? এরকম কত কথাই মনে আসে, আবার হারিয়ে যায়।

স্নান করে নিতে হবে, কিন্তু জল বেশ ঠাণ্ডা। শরীর গরম করার জন্য কয়েকবার বৈঠক দিতে লাগল রবি।

পেছন থেকে একজন ভৃত্য বলল, তেল মাখিয়ে দেব, বাবুমশাই।

রবি পেছন ফিরে একবার দেখে নিয়ে বলল, দে।

সে সর্ষের তেলের বাটি সঙ্গে নিয়েই এসেছে। রবি আবার পা ছড়িয়ে বসল, লোকটি দু’হাতে জবজবে তেল নিয়ে আচ্ছাসে দলাই মলাই করে দিতে লাগল রবিকে।

একজন লোক তেল মাখিয়ে দিচ্ছে, রবিকে এদিক ওদিক শরীর নাড়াতে হচ্ছে, কিন্তু তার মন সেখানে নেই। সারাদিন এ রকম তুচ্ছ বাস্তবতার মধ্যে অনেকবারই থাকতে হয়, অকারণে কত কথা বলতে হয়, কিন্তু রবি যখন তখন তার মন এসব থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

এতক্ষণে সূর্য উঠছেন, ঠিক রবির কোনাকুনি, জল থেকে হঠাৎ লাফিয়ে, এখনও যেন তাঁর গায়ে লেগে আছে জলকণা। প্রাচীন ঋষিরা এই সূর্যকে বলেছেন জবাকুসুম সঙ্কাশং। জবা ফুলের লাল আর এই নতুন সূর্যের লাল ঠিক এক নয়। জবার লাল বেশি টকটকে, এই লাল নরম রক্তিম। অনেক ডিমের কুসুমের রং এরকম হয়। ইংরেজরা ডিমের পোচ বানাবার সময় বলে, সানি সাইড আপ! কিন্তু ডিমের কুসুমের সঙ্গে নবোদিত সূর্যের তুলনা দেওয়া চলে নাকি? টিয়া পাখির মসৃণ মাথার মতন বুট জুহোর ডগা বলা যায়? এ রকম তুলনা দিলে রসাভাস হয়।

একটু পরেই সূর্যের রং বদল হল। এখন মনে হচ্ছে ঠিক একটা সোনার থালা। এটা অবশ্য অতি সাধারণ উপমা। বড় বেশি চাক্ষুষ। ফুলের সঙ্গে তুলনাটাই যেন ঠিক, কিন্তু জবা ফুল রবির তেমন পছন্দ নয়। এমন কোনও ফুলের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় না, যা মানুষ কখনও চোখে দেখেনি। অরুণ বরণ পারিজাত।

জলে নেমে রবি টের পেল, এখন ভরা জোয়ার, জলের বেশ টান আছে। তবু সাঁতার কাটতে ভালো লাগছে। দূরে কয়েকটা ডিঙি নৌকো ছাড়া কাছাকাছি কোনও মানুষ নেই। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে একটা স্টিমার, লোকে বলে কলের জাহাজ। এটা একটা প্যাসেঞ্জার লাইন, যাত্রীরা পাটনা-এলাহাবাদ পর্যন্ত যায়। আর একটা ফেরার স্টিমার চন্দননগর কোতোয়ালির ঘাটে ভিড়বে ঠিক সাড়ে আটটার সময়।

সোজাসুজি সাঁতার কাটা যায় না, স্রোতে টানে। খানিকটা ডান দিকে এসে রবি দেখতে পেল বাগানের বড় বড় গাছতলার ফাঁকে একটি নারী মূর্তি। প্রথমে তার মনে হল কোনও দাসী, তারপর একটু নজর করে দেখল নতুন বউঠান। উনিও এত তাড়াতাড়ি জেগেছেন?

রবির আর সাঁতার কাটা হল না। দ্রুত ফিরে এল ঘাটে। তক্ষুনি ভিজে গায়ে বাগানে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু গেল না। বউদিদির সামনেও খালি গায়ে যেতে সে লজ্জা পায়। একজন ভৃত্য তোয়ালে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা গায়ে জড়িয়ে সে দৌড়ে চলে গেল বাড়ির মধ্যে। কলতলায় গিয়ে মাথা মুছে নিল। দুদিন দাড়ি কামানো হয়নি, আজ দরকার। নাপিত আসবে বেলায়, রবি নিজেই গালে সাবান মেখে শেফিল্ডের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামাল বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এ ব্যাপারটায় সে এখনও তেমন রপ্ত হয়নি। মুখের সাবান ধুয়ে ফেলার পর ফটকিরি বুলিয়ে নিল, তারপর ধুপধাপ করে ওপরে উঠে পরে নিল পোশাক, প্যান্টালুন, মোজা, পাম্প শু, একটা পাতলা লম্বা ধরনের সাদা কোট। পরিপাটি করে আঁচড়াল চুল।

আবার তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে এল বাগানে।

সাদা সেমিজের ওপর একটা হালকা নীল রঙের শাড়ি আলগা ভাবে পরা, চূর্ণ চুল এসে পড়েছে মুখে, দুহাতে কোনও অলংকার নেই, শুধু বাঁ হাতের মধ্যমায় একটা কমল হীরের আংটি, খালি পা, খুব মন দিয়ে ফুল কুড়োচ্ছেন। রবি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল। কাদম্বরী এমনই মগ্ন হয়ে আছেন যে রবির পায়ের আওয়াজও শুনতে পাননি।

মোরান সাহেবের এই বাগান বাড়িতে একটা মুক্তির স্বাদ আছে। জোড়াসাঁকোয় অত বড় বাড়িতে কত মানুষজন, সেখানে মেয়েদের বাইরে কোথাও যাবার সুযোগই নেই। সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিষেধের গণ্ড ভেঙে তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে বাইরে বেরিয়েছেন বটে, কিন্তু তা শুধু নিয়ম ভাঙার জন্যই এক দু’দিন নিয়মিত তো নয়! জ্যোতিদাদা নতুন বউঠানকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে রাজপথে বেরিয়েছিলেন পর্যন্ত, তা সকলকে চমকে দেবার জন্য, এখন জ্যোতিদাদার সে শখ মিটে গেছে, তা ছাড়া এখন তিনি সময়ও পান না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বাড়ির মেয়ে-বউদের এখনও বাড়ির মধ্যেই কাটাতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা, বাগানে কিংবা পেছন দিকে যে পুকুর আছে সেখানেও তাদের যাওয়া পছন্দ করেন না দেবেন্দ্রনাথ। একতলায় স্নান ঘরে একটা মস্ত বড় চৌবাচ্চা আছে। তার মধ্যেই হাত-পা ছুঁড়ে মেয়েরা সাতার শেখার চেষ্টা করে। সেই তুলনায় এখানে কত স্বাধীনতা। কাদম্বরীকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবি দু’জনে মিলে সাঁতার শিখিয়েছে গঙ্গায়, এখানে তিনি যখন তখন বাগানে ঘুরতে পারেন, নৌকোয় কিংবা ঘোড়াগাড়ি চেপে বেড়াতে গেলে আপত্তি করার কেউ নেই।

রবি মৃদু গলায় বলল, কেন গো আপন মনে ভ্ৰমিছ বনে বনে।

কাদম্বরী ঈষৎ চমকিত হয়ে মুখ তুলে চাইলেন। রবির আপাদমস্তক দেখে ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, ইস, এই সাত সকালেই একেবারে ফিট বাবুটি সেজেছ দেখছি!

রবি বলল, তুমিও এত ভোরে জেগে উঠেছ যে? সাধের বিছানা ছেড়ে উঠে এলে?

কাদম্বরী বললেন, শুনছ না, একটা চোখ গেল পাখি কেমন ডেকে চলেছে। এত পাখির ডাকে ঘুমোয় কার সাধ্য! একবার জেগে উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, অমনি ফুলের গন্ধের ঝাপটা এসে লাগল নাকে।

দুহাতের অঞ্জলি ভর্তি ফুল দেখিয়ে কাদম্বরী বললেন, দেখ, ভানু, কত বকুল ফুল ঝরে পড়েছে, কী মিষ্টি গন্ধ।

রবি কাছে এসে কাদম্বরীর অঞ্জলির কাছে মুখ নেওয়াল। ঘ্রাণ নিল বুক ভরে। শুধু ফুলের নয়, কাদম্বরীর সান্নিধ্যেরও একটা সৌরভ আছে।

পাশের গাছটার দিকে তাকিয়ে কাদম্বরী বললেন, এ গাছটা একেবারে ফুলে ভরে আছে। তুমি গাছে চড়তে পার? আমায় টাটকা ফুল পেড়ে দেবে?

রবি বলল, গাছে চড়তে নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু এখন যে জুতো-মোজা পরে আছি। এত ফুল নিয়ে কী করবে? কাদম্বরী বললেন, একটা মালা গাঁথব।

নিরাকার ব্ৰহ্মে বিশ্বাসী ব্ৰাহ্ম পরিবার, এঁদের কোনও ঠাকুর-দেবতা নেই, সকালবেলা ফুল নিয়ে পুজো-আচ্চারও পাট নেই। রবির কৌতুহলী চোখ দেখে কাদম্বরী বললেন, মালা গেঁথে একজনকে পরাব।

রবি জিজ্ঞেস করল, কাকে? সারা মুখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে কাদম্বরী ছদ্ম চিন্তার ভান করে বললেন, তাই তো, কাকে? তোমাকে! আজি তোমাকে একটা গাছতলায় বসিয়ে, গলায় মালা পরিয়ে রাজা সাজাব। একটা বেশ খেলা হবে।

রবি বলল, রাজা? তা হলে তো একটা সিংহাসন দরকার।

কাদম্বরী বললেন, তাও আনানো যাবে না হয়। কী রকম সিংহাসন তোমার পছন্দ?

রবি ওঁর চোখে চোখ রেখে বলল, হৃদয়-সিংহাসনের চেয়ে ভালো কোন সিংহাসন তো হতেই পারে না! কাদম্বরী সুর করে বললেন, ইস! শুধু কথার খেলা!

তারপর একটুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে রইলেন। আবার ফুল কুড়োতে কুড়োতে বললেন, আরও ফুল লাগবে, এতে বড় মালা হবে না।

রবি কয়েকবার লাফিয়ে বকুল গাছের একটা ডাল ধরে ফেলে ঝাঁকুনি দিয়ে আরও কিছু ফুল ফেলে দিল মাটিতে। তারপর দু’জনে মিলে কুড়োতে লাগল, ফুলে মগ্ন হয়ে রইল।

কাদম্বরী বললেন, আজ আমরা অনেকক্ষণই বাগানেই থাকিব, কেমন? তোমার আজ লেখা টেখা চলবে না বাপু। নিবিড় মেঘ ছেয়ে আসছে আকাশে, দেখ। তুমি রাখাল রাজা হয়ে গান বাঁধবে।

রবি বুঝল, আজ নতুন বউঠানের মেজাজ বেশ উৎফুল্প। কণ্ঠস্বরে চাপল্যের ভাব। এই কৌতুক-হাসি মাখা মুখখানা দেখতেই তার বেশি ভালো লাগে। এক একসময় তার হাবভাব দুর্বোধ্য হয়ে যায়, তখন কথা বলতেও ভয় হয়, এক কথার অন্য অর্থ করে নেন। কিন্তু খুশির সময় সমস্ত মাধুর্য উজাড় করে দেন কাদম্বরী।

রবি বলল, নতুন বউঠান, তুমি বুঝি আমায় নিয়ে পুতুল খেলা খেলতে চাও?

অমনি গম্ভীর হয়ে গেলেন কাদম্বরী। ঝলমলে হাসি মুছে গিয়ে মুখে পড়ল মেঘের ছায়া। দু’ হাতের ফুল ছড়িয়ে দিতে দিতে আস্তে আস্তে সরে গেলেন অন্যদিকে। রবি অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

কাদম্বরীর শরীরটা যেন ছায়াময় হয়ে গেল, তিনি একটু একটু দুলছেন, তাঁর দৃষ্টি সুদূর। এক সময় রবির দিকে মুখ না ফিরিয়েই তিনি বললেন, একজন বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোবেন, তারপর উঠেই বেরিয়ে যাবেন তাড়াহুড়ো করে। পাবলিক থিয়েটারে তাঁর নাটকের রিহার্সাল, নট-নটীদের শেখাবার জন্য তাঁকে যে থাকতেই হবে সেখানে। আমি তা হলে কাকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলব, রবি?

রবি চুপ করে রইল। এ প্রশ্নের উত্তর সে জানে না। জ্যোতিদাদা সত্যিই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, এখানে থাকার আর মন নেই তাঁর, শিগগিরই আবার জোড়াসাঁকোয় ফিরে যাবার কথা ভাবছেন। চিরকাল বাবুরা সারাদিন বাইরে থেকেছেন, অনেক রাত্তিরেও স্ত্রীদের সঙ্গে দেখা হতো না, তা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এখন নব্য শিক্ষায়, নব্য সভ্যতায়, তাঁরা অনেকে স্ত্রীদের সহধর্মিণী করে নিয়েছেন, জীবন-যাপনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন, বহুদিনের যবনিকা সরিয়ে তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির আলোর ঝিলিক দেখিয়েছেন। সেই সব স্ত্রীরা এখন আর অবহেলা কিংবা একাকিত্ব মানতে রাজি নন। এ যে আধুনিকতার এক দ্বন্দ্ব।

কথা ঘোরাবার জন্য রবি একটা কদমগাছ থেকে ফুল পেড়ে নিয়ে কাছে এসে বলল, নতুন বউঠান, এই নাও, বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল।

কাদম্বরী মুখ ফেরালেন। উদাসীনভাবে বললেন, এটা মোটেই প্রথম কদম নয়। অনেকদিন কদম ফুটেছে, গাছ ভর্তি কদম!

রবি বলল, তবু এটা আমার প্রথম কদম। নাও, তুমি নাও।

ফুলটি নিয়ে কাদম্বরী বসলেন এসে দোলনায়। রবি পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, দুলিয়ে দেব?

কাদম্বরী বললেন, না, তুমি আমার পাশে এসে বসো।

দু’জনে বসল পাশাপাশি। কাদম্বরী পা দিয়ে মাটিতে চাপ দিলেন, দোলনাটা মৃদু লয়ে দুলতে লাগল, বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। কাদম্বরী তন্ময় হয়ে গেছেন, রবি কিন্তু তেমন আবিষ্ট হতে পারছে না, তার শরীরে একটা চঞ্চলতা, সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখছে কতটা বেলা হল।

একসময় কাদম্বরী বললেন, ভানু, তোমার একটা একটা নতুন গান শুনাবে না?

রবি মুহুর্তমাত্র দ্বিধা বা চিন্তা না করে, যেন তৈরিই ছিল, গেয়ে উঠল ; দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি/বল দেব, কার পাণে আগ্রহে ছুটিয়া যায়/সম্মুখে রয়ে তার তুমি প্রেম পারাবার, তোমারি অনন্তহৃদয় দুটিতে মিলিয়ে যায়…

এ গান শুনতে শুনতে কাদম্বরী অসাড়তা কেটে গেল, মুখে ফুটে উঠল আলো, গানটির প্রতিটি শব্দ যেন তার ত্বকে রোমাঞ্চ এনে দিচ্ছে।

রবি কিছুটা ব্যস্তভাবে গানটি শেষ করেই বলল, নতুন বউঠান, কাল সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে এই বাগানে কাটাব। কাল আর কিছু নয়, শুধু গল্প আর গান। আজ আমায় একটু ছুটি দিতে হবে যে!

কাদম্বরী পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার জরুরি লেখা আছে বুঝি? ‘ভারতী’র জন্য কোনও লেখা শেষ করতে হবে? কী লিখবে গো, বউ-ঠাকুরানির সেই গল্পটা, না কবিতা?

রবি বলল, লেখা নয়, আজ আমাকে একবার কলকাতায় যেতে হবে।

কাদম্বরী এবার ভ্রুকুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, কেন, কলকাতায় যেতে হবে কেন? না, যেও না! যেতে হবে না!

রবি বিব্রত হয়ে করুণ স্বরে বলল, যেতে যে হবেই। কথা দিয়েছি!

কাদম্বরী বললেন, কাকে কথা দিয়েছ? কী কথা দিয়েছ? আমায় আগে কিছু বলনি তো?

রবি বলল, তুমি তো জান, রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর বিয়ে। সেই বিয়ের দিনের জন্য আমাকে দুটি গান লিখে দিতে বলেছিলেন। কয়েকজনকে গান দুটো শিখিয়ে দিয়ে আসতে হবে।

কাদম্বরী খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, অন্যদের শিখিয়ে দিতে হবে কেন? তুমি নিজেই গাইলে তো পার। তোমার চেয়ে ভালো আর কে গায়?

রবি বলল, সে বিয়ের দিন তো আমি যেতে পারব না!

কাদম্বরী আরও বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কি! ঋষিমশাইয়ের মেয়ের বিয়ে, তাতে তুমি যাবে না? উনি কত দুঃখ পাবেন। তোমাকে এত ভালোবাসেন।

রবি বলল, ঋষিমশাই নিজেই মেয়ের বিয়েতে যাবেন না। বাবামশাই আমাদেরও যেতে নিষেধ করেছেন!

ব্ৰাহ্মদের তিন শরিকের রেষারেষি এক একটা বিবাহকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সঙ্গে কেশব সেনের নব বিধানের ব্যবধান এখন দুস্তর, মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ। কেশবের দল ভাঙা বিদ্রোহী তরুণ গোষ্ঠী যে সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ স্থাপন করেছে, তার প্রতি বরং আদি ব্রাহ্মসমাজের বটবৃক্ষ দেবেন্দ্রনাথের প্রসন্ন দৃষ্টি আছে। তরুণদের পৃথক প্রার্থনাগৃহ গড়ার জন্য তিনি সাত হাজার টাকা দান করেছেন, কেশবের দলকে দুর্বল করে দেবার জন্য এও এক ধরনের রাজনীতি। হিন্দুদের সঙ্গে ব্ৰাহ্মদের বিবাহ হয় না। হিন্দুরাই বিয়ে দিতে চায় না। আবার তিন শরিকের মধ্যেও বিবাহ-সম্পর্ক বন্ধ হবার উপক্রম। রাজনারায়ণ বসু দেবেন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগত, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতা, তার মেয়ে লীলাবতীর বয়েস সতেরো, তার সঙ্গে বিবাহ হবে কৃষ্ণকুমার মিত্রের। কৃষ্ণকুমার অতি সুপাত্র, আপত্তির কোনও কারণ নেই, যদিও তার বয়েস কিঞ্চিৎ বেশি এখন আটাশ। সম্বন্ধ করা বিয়ে নয়, পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে দেখেছে এবং মনোনীত করেছে। সব কিছুই তো শুভ ছিল, কিন্তু অতি সামান্য ব্যাপারে মনোমালিন্য দেখা দিল। কৃষ্ণকুমার ব্ৰাহ্মদের তৃতীয় দল অর্থাৎ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য, এবং সে জেদ ধরেছে বিবাহ হবে তাদের মতে। কিছুকাল আগে সিভিল ম্যারেজ বিল পাস হয়েছে, এতে জাতি-বিচার নেই, মন্ত্র কিংবা পুরুতের কোনও স্থান নেই, তরুণ ব্রাহ্মের দল এটাই মানে। আদি ব্ৰাহ্মরা আবার এর ঘোর বিরোধী, কারণ রেজিস্ট্রি করে বিয়ে মানে তো নিরীশ্বর বিবাহ, নাস্তিকতা! দেবেন্দ্রনাথ তা শুনেই এ বিয়েতে অসম্মতি জানালেন। রাজনারায়ণ বসু দেখলেন যে তাঁর মেয়ে এই পাত্ৰকেই বিয়ে করতে খুব আগ্রহী, তিনি মেয়ের ইচ্ছেতে বাধা দিলেন না। মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ সৌভাগ্যের অন্তরায় হবেন কেন তিনি! কিন্তু বিয়ের দিন কন্যা পক্ষের কেউ যাবে না, ঠাকুরবাড়ির কেউও যাবে না।

কাদম্বরী যখন বুঝলেন, রবিকে যেতেই হবে, সে সাড়ে আটটার স্টিমার ধরবে, বেশি সময় নেই, তখন তিনি দোলন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কিছু খেয়ে যাবে তো? চল, তোমার জলখাবারের ব্যবস্থা করে দি গে।

কয়েক পা গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, তুমি রাত্তিরে কলকাতায় থেকে যাবে না তো? ফিরে আসবে, কথা দাও!

কোতোয়ালির ঘাট থেকে স্টিমারে চাপাবার পর রবির মন কিছুটা উতলা হয়ে উঠল। এমন ভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি, আজ না গেলেই বা কী ক্ষতি হতো! অন্য কেউ তার গান গাইলে রবির বেশ ভাল লাগে। ব্ৰাহ্মসমাজের উপাসনায় এখন অনেকেই গাইছে। সব সময় নিজেকে গাইতে হয় না, অন্যরা আগ্রহ করে শেখে। ভাগ্নে সত্যপ্ৰসাদ তাকে একদিন বলেছিল, দেহোর মোড়ে কয়েকটি ছাত্রকে সে রবির গান গাইতে শুনেছে। কথাটা শুনে গোপন পুলকের রোমাঞ্চ হয়েছিল রবির, সম্পূর্ণ অচেনা লোকেরাও তার গান পছন্দ করেছে।

বিলেত যাবার আগে পর্যন্ত রবি প্রায় সর্বক্ষণই জ্যোতিদাদা ও নতুন বউঠানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত ফিরত। জ্যোতিদাদা যখন থাকতেন না, তখন মুখোমুখি দুজনে। কত কথা, কত নীরবতা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন মনে এক একটা আলোর বিন্দু। এখন রবিকে লেখার জন্য অনেক সময় দিতে হয়, বাইরের পৃথিবীও ডাকাডাকি করে। তবু নতুন বউঠানের সাহচর্যেই সে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়। গান শোনাতে শোনাতে উৎসুকভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি সামান্য প্রশংসা করলে রবি ধন্য হয়ে যায়। আজ নতুন বউঠানের মনটা ভালো ছিল, পাখির ডাক শুনে জেগে তিনি খুব ভোরে ফুল কুড়োতে নেমেছিলেন, রবিকে নিয়ে অনেকক্ষণ থাকতে চেয়েছিলেন বাগানে। আজই কেন রবিকে চলে যেতে হল!

এখন জোয়ার রয়েছে, স্টিমারের গতি বেশ দ্রুত। ভরা গঙ্গায় ঢেউ তুলে স্টিমারটা এগিয়ে চলল কলকাতার দিকে। নানা জাতের অনেক যাত্রী, কারুর সঙ্গে একটি কথাও বলেনি রবি, অচেনা মানুষদের সঙ্গে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভাব জমাতে পারে না। ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে গান দুটি ভেঁজে নিচ্ছে বারবার। আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষার দৃশ্য তার চক্ষুকে আরাম দেয়।

এক সময় চোখে পড়ল দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির কালী মন্দির। রবির ভুরু একটু কুঁচকে গেল। কালী মন্দির দেখলেই তার চোখে ভাসে একটা হাঁড়িকাঠ আর পাঁঠা বলির পর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা টকটকে রক্ত। তার গা গুলিয়ে ওঠে। জন্ম থেকেই মূর্তিপূজার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ব্ৰাহ্মরা নিজেদের হিন্দুও মনে করে না। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের বিরহর কাহিনী, যমুনা পুলিনে বাঁশি বাজায় এক শ্যামবর্ণ যুবা, বিবাহিতা রাধা উচাটন হয় সেই বাঁশি শুনে। ছুটে আসে সে নীল রাত্রির কুঞ্জবনে, এসব তাকে আকৃষ্ট করে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীকেও তার বেশ পছন্দ। কিন্তু কালী, ওই করাল মূর্তিকেও মানুষ পুজা করে কেন? দেবতার পূজার নামে মানুষ কী করে হিংসায় মাতে, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে পশু বলি দেয়, তা তার বুদ্ধির অগম্য।

রবি সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার গাইতে লাগল, দুই হৃদয়ে নদী একত্র মিলিল যদি…। এক নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছে স্টিমার, রবি গাইছে দুটি নদীর গান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *