১২. গুরুকুলবাস : মন্বন্তর

গুরুকুলবাস : মন্বন্তর

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোয়াট সাহেবকে চিঠি লিখি–দুটি কথা জানিয়ে। প্রথম– কারাবাসের খবর। দ্বিতীয় আই. এ. পাস করে ইংরাজি না পড়ে ইতিহাসে অনার্স পড়তে প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে যাব ভাবছি। এসব সত্ত্বেও ডাফ হস্টেলে জায়গা হবে কি? উত্তর পেলাম, “My dear boy, you belong to us. Of course you can come back.” ছোট চিঠিটি আন্তরিক উষ্ণতায় ভরা। যে-মানুষটিকে চিনি বলে ধারণা ছিল, তার সঙ্গে এই পত্রলেখকের কোনও মিল খুঁজে পেলাম না।

১৯৪৩ সনের জুলাই মাসে কলকাতা ফিরে গেলাম। ওই বছরে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা হল। এক, প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠ শুরু—এক সানন্দ উত্তেজনার অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়, মন্বন্তরের বিভীষিকা, যার বীভৎসতা বর্ণনা করতে পারে এমন বিশেষণ আমি খুঁজে পাইনি।

স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তে ভাল লেগেছিল, সন্দেহ নেই। বিশেষত মোয়াট সাহেব এবং অধ্যাপক সুধীর দাশগুপ্তর কাছ থেকে সাহিত্যবোধের যে প্রথম পাঠ পাই তা জীবনের মূল্যবান সম্পদ হয়ে আছে। কিন্তু ‘৪০-এর দশক অবধি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া এক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। তার প্রথম কারণ, কয়েকজন অত্যন্ত খ্যাতনামা অধ্যাপকের পড়ানো। ইতিহাসে সুশোভন সরকার (এর অল্পদিন আগে অধ্যাপক জ্যাকারায়া), ইংরাজিতে তারক সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ সেনগুপ্ত, তারাপদ মুখার্জি, অর্থনীতিতে ডক্টর ঘোষাল, ভবতোষ দত্ত, সংস্কৃতে গৌরীনাথ শাস্ত্রী, শিবনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ অধ্যাপকদের নাম স্কুলে পড়ার সময় থেকে শুনে আসছি। অধ্যক্ষদের মধ্যে র্যাংলার বি এম সেন, প্রশান্ত মহলানবীশ, অপূর্ব চন্দ শিক্ষাজগতে প্রবাদপুরুষ। দ্বিতীয় কারণ, ওখানকার ছাত্ৰমণ্ডলী। ম্যাট্রিক বা আই. এ. পরীক্ষায় যারা প্রথম বিশটি স্থান অধিকার করত, তাদের সম্ভবত নব্বই শতাংশ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হত। বাকি ছাত্ররাও রীতিমতো উঁচুমানের। পরে পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেও এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছি যে, শিক্ষার উচ্চতম আদর্শের মাপকাঠিতে বিচার করলেও ‘৪০-‘৫০-এর দশকের প্রেসিডেন্সি কলেজ পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির শিক্ষায়তনগুলির একটি বলে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে।

এক সময় ইংল্যান্ডের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণার কেন্দ্রস্থলে ছিল জ্ঞান-অর্জন এবং বিতরণ, গবেষণা না। পাণ্ডিত্যখ্যাতি শুধু ছাপানো বই বা প্রবন্ধের তালিকার উপর নির্ভর করত না। নির্ভর করত পাণ্ডিত্যের গভীরতা আর ব্যাপ্তির উপর। পণ্ডিতসমাজ ছিল স্বল্পায়তন। বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে যারা চর্চা করতেন তারা প্রায় সবাই সবাইকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চিনতেন। কার বিদ্যার দৌড় কত দূর, বিদগ্ধ মহলে তা সকলেরই জানা ছিল। শুধু বিদ্যা না, পারস্পরিক আলোচনা বা বক্তৃতার ভিতর দিয়ে ব্যক্তিবিশেষের ধী বা উদ্ভাবনীশক্তির চমৎকারিত্ব সম্পর্কেও সবাই অবহিত ছিলেন। যে পাণ্ডিত্য ও মেধার ঔজ্জ্বল্য হাতে ধরাছোঁয়া যায় না, বা যার বিচার লিখিত বই আর প্রবন্ধের তালিকার দৈর্ঘ্য মেপে নিরূপণ করা চলে না, পণ্ডিতমহলে পাণ্ডিত্যখ্যাতি তার উপরই নির্ভর করত। উনিশ বা বিশ শতকে পাণ্ডিত্যর যে-আদর্শ কলকাতা বা বৃহত্তর বাংলায় বহাল ছিল, তা কতকটা ওই অক্সব্রিজীয় ধ্যানধারণার প্রতিবিম্ব। বলা প্রয়োজন, আমাদের সনাতন শিক্ষাভাবনার সঙ্গে এই ধারণার মূলগত সাদৃশ্য ছিল। কাড়ি কাড়ি বই লেখা, বছরে বারোটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা পাণ্ডিত্যের চরম নিদর্শন বলে কখনও ধরা হত না। বিদ্যার গভীরতা আর অসামান্য ধী-শক্তিই ছিল বৈদগ্ধ্য বিচারের মাপকাঠি। লেখা ছাপাবার মার্কিনি ব্যাকুলতা ইউরোপ বা ভারত কোথাওই বৌদ্ধিক জীবনের অঙ্গ ছিল না।

প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপকরা ওই প্রাচীন শিক্ষাদর্শের আধুনিক প্রতিনিধি ছিলেন। ‘Publish or perish’—এই মন্ত্র তারা জপতেন না। ইংরাজির খ্যাতনামা অধ্যাপকদের মধ্যে এক শ্রীকুমারবাবু আর সুবোধবাবু ছাড়া কেউই কিছু বিশেষ লিখে ছাপাতেন না। প্রবাদপুরুষ প্রফুল্ল ঘোষ তো নয়ই। ইতিহাসে জ্যাকারায়া সাহেব বা সুশোভনবাবুও ওঁদের মেধা ও পাণ্ডিত্যের অনুপাতে অতি সামান্যই লিখেছেন। পঠন-পাঠন, বিদ্যারসসম্ভোগ, মানুষের জ্ঞান এবং সংস্কৃতির দীপশিখা এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে হস্তান্তর করা—সে যুগের শিক্ষাবিদদের ধ্যানধারণার কেন্দ্রে ছিল এই প্রচেষ্টা। অল্প কিছু বিদ্বান মানুষ জ্ঞানের জগতে নতুন অবদান গবেষণা এবং তার প্রকাশন তাদের কর্মসূচির অঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু বই বা প্রবন্ধ না ছাপালে শিক্ষকজীবন ব্যর্থ হল, এমন চিন্তা সে যুগের সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল না।

প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের মধ্যেও লেখাপড়ার ব্যাপারে অসাধারণ উচ্চাশার লক্ষণ চোখে পড়ত। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন শিক্ষিত বাঙালি যুবকের বিশ্বগ্রাসী জ্ঞানপিপাসা সম্পর্কে সশ্রদ্ধ মন্তব্য করেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে জগৎ-জিজ্ঞাসা বিশেষ প্রকট ছিল। আমাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড়দের মধ্যে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত (ইনি প্রেসিডেন্সি না, স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন), অমলেশ ত্রিপাঠী, দিলীপ বিশ্বাস, অমল ভট্টাচার্য প্রমুখ আর বয়ঃকনিষ্ঠদের মধ্যে সুখময় চক্রবর্তী, অমর্ত্য সেন, শিপ্রা সরকার, অশীন দাশগুপ্ত, পার্থসারথি গুপ্ত এঁরা ছাত্র অবস্থায়ই ডাকসাইটে পণ্ডিত হিসাবে খ্যাত ছিলেন। পরীক্ষায় ভাল ফল পাওয়ার চেষ্টা আর এঁদের জ্ঞানান্বেষণের মধ্যে কোনও অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল না। ছাত্রদের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় সব সময়ই একটা বৌদ্ধিক উত্তেজনার উত্তাপ ছিল। ফলে ক্লাসের চার দেওয়ালের ভিতরে যে জ্ঞানার্জন হত, কফি হাউসের আড্ডায় তার চেয়ে কিছু কম হত না।

কিন্তু সে যুগেও প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা নিছক কণ্টকহীন পুষ্পশয্যা ছিল না। আমি পেশায় শিক্ষাজীবী, ফলে অন্য শিক্ষাজীবীদের জীবনের বহুমুখী সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই ব্যক্তিবিশেষের নিন্দা থেকে বিরত থাকব। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কলকাতার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান যুগের ‘অধঃপতন’ তুলনা করে যে-হাহাকার শোনা যায়, তা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত নয়—এ কথাটা বলা দরকার।

তখন ইতিহাস অনার্সে তিনটি আবশ্যিক (compulsory) এবং তিনটি নির্বাচন-ভিত্তিক (Optional বা Special) ‘পেপার’ পড়তে হত। পরে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ‘মধ্যযুগ’ নিয়ে পড়াশুনোর ইচ্ছা থাকায় আমি ইউরোপীয় মধ্যযুগ, মুর-শাসিত স্পেন এবং আকবরের শাসনকাল বিষয়ক ‘পেপার’গুলি পড়া সিদ্ধান্ত করি। কিন্তু সত্যি বলতে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সুশোভনবাবুর কাছে পড়া। আমি যে তিনটি স্পেশ্যাল পেপার বেছে নিই, তার একটাও উনি পড়াতেন না। সেটা দুঃখের ব্যাপার ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও আরও দুঃখের ব্যাপার ছিল। দুটি স্পেশ্যাল পেপার যাঁরা পড়াতেন তারা একদিনও পড়াননি। কথাটি অসম্ভব মনে হলেও আক্ষরিক অর্থে সত্যি। একজন স্যার আশুতোষের আমলের নানা কুটকচালি নিচু গলায় বলে যেতেন, হঠাৎ একদিন সম্ভবত বিভাগীয় প্রধান সুশোভনবাবুর মৃদু ধমকানি খেয়ে মায়ার্স-এর ‘মিডল এজেস’ থেকে শার্লামেন-এর চরিত্রবর্ণনা পড়ে শোনাতে শুরু করলেন। তিন-চার লাইন পড়ে হঠাৎ শার্লামেনের সঙ্গে নিজের চরিত্রের তুলনামূলক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। ইউরোপীয় মধ্যযুগ বিষয়ে অন্য কোনও আলোচনা ওঁর মুখে আমরা শুনিনি। আর আকবর এবং স্পেনে আরব শাসনের ইতিহাস যিনি পড়াতেন তার একটিই আলোচ্য বিষয় ছিল : ডডওয়েলের আমলে ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’। ওই বিষয়ে যে-জ্ঞান অর্জন করি তার ভিত্তিতে বেশ একটি প্রামাণ্য বই লেখা যায়। লিখলে বিশেষ করে ডডওয়েল সাহেবের সিগার-বিষয়ক পরিচ্ছেদটি বেশ জ্ঞানগর্ভ হত। এখানেই বলি, এঁদের দু’জনের শিক্ষাপ্রণালী সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল। অনার্স এবং পাস দুই শ্রেণিতেই আর সবাই যত্ন করে পড়াতেন। শুধু ইংরাজি পাস ক্লাসে যিনি বাইবেল পড়াতেন তাঁর শিক্ষণপদ্ধতির রহস্য আমরা ভেদ করতে পারিনি। উনি দু-তিনটি লাইন পড়ে, একটি বিশেষ জায়গা নির্দেশ করে বলতেন ‘পুট আ ডট’। আবার ক’লাইন পড়ে নতুন নির্দেশ, ‘পুট আ ড্যাশ’। ডট আর ড্যাশে-খচিত বাইবেলখানা বিচিত্র রূপ ধারণ করেছিল। আমার বিশ্বাস, বেচারা ভদ্রলোকের কিঞ্চিৎ মাথার গোলমাল ছিল।

এই রকম কিছু উৎকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা বাদ দিলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার স্মৃতি নিরবচ্ছিন্ন উজ্জ্বল আনন্দের। ইতিহাস বিষয়ে চিন্তা করতে যদি কিছুমাত্র শিখে থাকি, তা প্রধানত সুশোভনবাবুর ক্লাস লেকচার্স শুনে। যে-কোনও জটিল বিষয়ের উনি একটা পরিচ্ছন্ন খসড়া তুলে ধরতেন। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের এ রকম স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তি আর কোথাও পাইনি। রণজিৎদা (‘সাবঅলটার্ন’-গুরু রণজিৎ গুহ) বলতেন, “ওঁর কাছে আমরা ইতিহাসের অ্যানাটমি বুঝতে শিখেছি।” কথাটা সুশোভনবাবুর শিক্ষাপ্রণালীর সুষ্ঠু বর্ণনা। এই মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ক্লাসে কিন্তু কখনও মার্কসবাদ উত্থাপন করেননি।

বিশুদ্ধ কাব্যরসের স্বাদ পাই দু’জন শিক্ষকের পড়ানো থেকে। তারকবাবু পড়াতেন ‘টুয়েলফথ নাইট’ আর তারাপদবাবু ‘জুলিয়াস সিজার’। দুটি ভিন্নধর্মী শেকসপিয়রের নাটক দুই ভিন্ন সুরে এরা পড়াতেন। তারাপদবাবুর পড়ানোয় ট্র্যাজেডির বিয়োগান্ত আবেগ ফুটে উঠত। তারকবাবুর লেকচারে বিদ্যা আর উজ্জ্বল বুদ্ধির ঝকমকি। ওঁদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে হত—কেন ইংরাজি পড়লাম না।

প্রেসিডেন্সি কলেজেই জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান কয়েকটি বন্ধুত্বর সূচনা, ইংরাজি অনার্সের ছাত্র অমল দত্ত, ইতিহাসের অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ দাশগুপ্ত, রণজিৎ গুহ, ইকনমিক্সের অম্লান দত্ত, কবি অমলেন্দু গুহ, হীরেন রায়ের সঙ্গে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় থেকে যে-ঘনিষ্ঠতা জন্মায় তা বাকি জীবন অটুট থাকে। এঁদের কারও কারও সঙ্গে সম্পর্কে নানা কারণে ওঠা-পড়া ঘটেছে। কিন্তু প্রথম যৌবনের উষ্ণ আবেগ কোনও ক্ষেত্রেই ঠান্ডা হয়ে যায়নি।

আমাদের আড্ডাক্ষেত্র ছিল তিনটি কফি হাউস, রায়মশায়ের চায়ের দোকান এবং ডবল-হাফ কাপ চা-বিখ্যাত বসন্ত কেবিন।

ডবল হাফের রহস্য বোধ হয় বর্তমান প্রজন্মের জানা নেই, তাই ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। বসন্ত কেবিনের দুধ-চিনি সহ পুরো এক কাপ চায়ের দাম ছিল চার পয়সা। তার অর্ধেক হল হাফ কাপ—দাম দু’পয়সা। আর রহস্যমণ্ডিত ডবল হাফে চায়ের জলটা পুরোই থাকত, কিন্তু দুধ-চিনি অর্ধেক দাম তিন পয়সা। হুঁশিয়ার খদ্দেররা ‘বড় কড়া করে ফেলেছ’, ‘এ যে একদম পানসে’ ইত্যাদি নানা ধান্দা তুলে দুধ এবং চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে নিতেন। ডবল হাফ বস্তুত ফুল কাপ হয়ে যেত, তিন পয়সা দিয়ে চার পয়সার চা সম্ভোগ করা যেত। এই এক পয়সার লড়াইয়ে দক্ষ যোদ্ধাদের আমরা বিশেষ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতাম। পাঠিকা/পাঠক স্মরণ রাখবেন তখন লেকচারারদের মাইনে মাসে বড় জোর দুশো টাকা, ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ছাত্ররা মাসিক জলপানি পেত চল্লিশ টাকা। সুতরাং টাকার চৌষট্টি ভাগের এক ভাগ যে এক পয়সা, তা নিতান্ত মূল্যহীন ছিল না। ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ায় যে-বিরাট গণ-আন্দোলন হয়েছিল তা থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। আমরা এখনও বেশ গরিব। কিন্তু তখন আরও কত গরিব ছিলাম এ কথা স্মরণ করলে বাঙালি মধ্যবিত্তর আত্মবিলাপ হয়তো কিছুটা কমতে পারে। স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রের একমাত্র মোগ্য স্থান আঁস্তাকুড় এই ধারণার কিঞ্চিৎ পুনশ্চিন্তনও হতে পারে।

বসন্ত কেবিনের গৌরবের একমাত্র ভিত্তি ডবল হাফ—এ কথা ভাবলে ভুল হবে। ওদের আর একটি বিশিষ্ট অবদান ছিল চার পয়সা দামের টোশ অর্থাৎ টোস্ট। রাঁধুনিটি ছিল টোস্ট শিল্পে নোবেলবিজেতা। আর আজকাল যে ‘বাছবার অধিকার’ বা ‘চয়েস চয়েস’ করে বিলেতের প্রধানমন্ত্রী মাথা খুঁড়ছেন, ওই রন্ধনশিল্পীর সে দিকেও নজর ছিল। টোস্ট দুই রূপে পরিবেশিত হত—চিনি দিয়ে বা গোলমরিচ মাখিয়ে। এমন সুব্যবস্থা অন্য কোনও টোস্টভোজী সংস্কৃতিতে চোখে পড়েনি। তার অসাধারণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে গরিব বাঙালি, জ্যাম জেলি মারমাইটের কাজ স্বল্পমূল্য চিনি আর গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে সেরে নিয়েছে।

সস্তায় বিলাসের জায়গা বসন্ত কেবিনে ভিড় বড্ড বেশি হত। ওটা পা ছড়িয়ে আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। সে প্রয়োজন মেটাত কফি হাউস, যদিও ভোগ্যবস্তুর দাম সেখানে তুলনায় কিছু চড়া। এক কাপ কফি চার আনা কলেজ স্ট্রিট থেকে ঢাকুরিয়া লেক পর্যন্ত যাওয়া-আসার ভাড়া। প্রেসিডেন্সি কলেজের অনেক ছাত্ররই যা কিছু শিক্ষাদীক্ষা তা ওইখানেই হয়েছে, রাস্তা পার হয়ে উলটো দিকের বাড়িটায় ঢুকবার কোনও প্রয়োজন হয়নি। কলেজসংলগ্ন রায়মশায়ের কাফেতেও অনেকে সময় কাটাতেন। কিন্তু দু-চারজন স্বর্ণমণ্ডিত বখা একটু বাড়াবাড়ি করে রায়মশায় মারফত বিয়ার আমদানি শুরু করায় ভদ্রলোক বিতাড়িত হলেন। বখাদের অন্যত্র ঘাঁটি গাড়তে হল।

কফি হাউসের আড্ডায় নিছক অলস গালগল্প হত, এমন নয়। উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনা, জ্ঞানপিপাসু তরুণদের সাহিত্য-দর্শনের জগতে নিত্যনতুন গুরু আবিষ্কার, পশ্চিমি চিত্রশিল্পের পোস্টকার্ড সাইজের প্রতিলিপি দেখে প্রচণ্ড উত্তেজনা, কখনও কোনও খ্যাতনামা মনীষী বা রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হলে তাঁকে ঘিরে নানা সমস্যার বিশ্লেষণ—এ সবই কফি হাউস সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। অম্লানদা (অম্লান দত্ত) তখনই আপসহীন বিশ্লেষণপ্রবণ মানুষ। দলবল নিয়ে কোনার একটি টেবিলে বসে মৃদুস্বরে ধ্বনি তুলতেন, “আজ আমরা কী নিয়ে আলোচনা করব?” বাজে গালগল্পে ওঁর রুচি ছিল না, যদিও উনি মোটেই রামগরুড়ের ছানাজাতীয় কিছু ছিলেন না। উনি বলনে, জ্ঞানের চর্চা তো অনেকেই করেন এবং করছেন। উনি চান চিন্তা করতে। কফি হাউসের আড্ডা ওঁর সেই চিন্তাচর্চার অন্যতর মঞ্চ ছিল। কখনও কখনও ওঁদের আড্ডায় মানবেন্দ্রনাথ রায় উপস্থিত থাকতেন। আমরা সম্ভ্রমের সঙ্গে দুর থেকে দেখতাম। আমি নিজে বরাবরই ছ্যাবলা প্রকৃতির মানুষ। বেশিক্ষণ গুরুগম্ভীর আলোচনা শুনলে এখনও মাথা ধরে। অম্লানদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সংকটের মুহূর্তে ওঁর গভীর মানবতাবোধ আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু ওঁর কফি হাউসের আড্ডার নিরঙ্কুশ গাম্ভীর্য আমার সহ্য হত না। আমার সঙ্গে সম্পর্কে ওঁর কৌতুকপ্রবণতা, ঝকমকে বুদ্ধির লঘু প্রকাশটাই বেশি দেখতাম।

কফি হাউসে আর দুটি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। তাঁদের একজন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই, অগ্নিযুগের বিখ্যাত বিপ্লবী। উনি খুব গর্ব করে বলতেন যে, উনিই সেই মানুষ যাঁর বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্মের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসাবে ওঁকে ঘানি। টানতে হয় এবং সেই উপলক্ষে বাঙালি মহিলারা রত্নগর্ভাজ্ঞানে ওঁর মাকে অভিনন্দন জানান। উনি নাকি মাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “মা, তুমি বিবেকানন্দের মা হয়েও এই সম্মান পাওনি।”আদি যুগের কমিউনিস্ট ডক্টর দত্ত লেনিনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ওঁকে মাঝে মাঝে বক্তৃতা করতে ডাকতাম। উনি শুধুই ডায়লেকটিকাল মেটিরিয়ালিজম নিয়ে বক্তৃতা করতেন, ওঁর দেশের বা রাশিয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলতে চাইতেন না। সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে উনি শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন বলে আমার ধারণা। বলতেন, “ওসব খুদের পাদের গল্প শুনে কী করবে? যেসব গল্প চালু আছে তার বেশির ভাগই ডাহা মিথ্যে কথা।” বিশেষ করে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রতি ওঁর অত্যন্ত অভক্তি ছিল। তাঁর বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্ম সম্বন্ধে যেসব কথা বলতেন, তা লিখলে ওঁর ভক্তরা মানহানির মকদ্দমা করতে পারে। যখন আমার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়, ভূপেনবাবু তখন দারিদ্রের শেষ সীমায় পৌঁছেছেন মনে হত। ওঁর পরনে থাকত একটি আধময়লা ধুতি আর এক মটকার পাঞ্জাবি। ওই একটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পাঞ্জাবি ওঁর সম্ভবত ছিল না। কফি হাউসে এসে এক কাপ কফি নিয়ে উনি অনেকক্ষণ বসে থাকতেন। আমরা এসে ওঁর জন্যও স্যান্ডউইচ বা আর কিছু জলখাবার অর্ডার দিলে বেশ খুশি হতেন। বারবারই মনে হয়—আদর্শের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এইসব মানুষ যাঁরা বিনা দ্বিধায় অন্তহীন দুঃখ বরণ করেছিলেন, তাঁদের ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও কেন আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক জীবনে অবশিষ্ট রইল না? সেই দুঃখবরণের প্রয়োজনীয়তা কি সত্যিই আমাদের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেছে? সমাজ এবং রাজনৈতিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে-অনাচার আজ আমাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতা, তার থেকে মুক্তি তা হলে কোন পথে আসবে? যাঁরা সেই আদর্শে আজও অনুপ্রাণিত, তাদের প্রায় সকলেরই কর্মক্ষেত্র ক্ষমতাবর্জিত প্রতিবাদে সীমিত।

দ্বিতীয় যে-লোকটির সঙ্গে কফি হাউসের আড্ডায় পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল, তিনিও অন্য এক অর্থে আদর্শবাদী মানুষ। শিবরাম চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পরিচিত নাম। ওঁর স্বতঃস্ফূর্ত বাধাবন্ধহীন ফুর্তির উৎস যে-জীবন, সেখানে কিন্তু আরাম বা স্বাচ্ছন্দ্যের বিশেষ চিহ্ন ছিল না। তখনকার যুগের লেখক এবং বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই গভীর দারিদ্রের মধ্যে বাস করতেন। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণেই এর ফলে তাঁদের জীবন ও চরিত্রে একটা তিক্ততা নজরে পড়ত, যার অন্যতর প্রকাশ ছিল পারস্পরিক ঈর্ষা, বিদ্বেষ আর দলাদলি। এইসব ব্যাধি থেকে মুক্ত সদানন্দ মানুষ অল্প যে ক’জন দেখেছি, শিবরাম বা শিব্রাম তাঁদের একজন। যেসব লোক এক কাপ কফি নিয়ে অনেকটা সময় কফি হাউসে কাটাতেন, উনি ছিলেন তাঁদের একজন। তার বেশি খরচ করার রেস্ত এঁদের ছিল না। অল্প ব্যয়ে বেশ কিছুটা সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঠান্ডা একটা ঘরে বসে থাকাই এঁদের জীবনে স্বচ্ছন্দ বিশ্রাম আর বিলাসের স্বাদ বয়ে আনত। ওঁর জন্যে কিছু খাবার ফরমাস করতে গেলে উনি বাধা দিতেন। বলতেন, “ভাই, রিটার্ন দেব, এমন রেস্ত তো আমার নেই”। আমরা বলতাম, “দাদা, আপনার লেখা এত লোককে এত আনন্দ দেয়, তার পরিবর্তে আপনাকে আমরা সামান্য কিছু খাওয়াতে পারি না?” একটু কাঁচুমাচু হয়ে উনি রাজি হতেন, কিন্তু বেশি কিছু খেতে চাইতেন না। বোধ হয় ওঁর আত্মসম্মানে বাধত।

.

প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে মধ্যবিত্ত সমাজের সব স্তরেই আদর্শবাদী মানুষের সাক্ষাৎ মিলত–যাঁদের বিশ্বাস আর জীবনযাত্রার মধ্যে কোনও গরমিল ছিল না। সব রাজনৈতিক দলেরই শক্তির উৎস ছিল আদর্শনিষ্ঠ কর্মী। প্রেসিডেন্সি কলেজে দেখতাম, স্বর্ণমণ্ডিত তরুণরাও বিলাসব্যসনের ব্যাপারে একটু সামলে চলতেন। কলেজে গাড়ি চেপে খুব কম লোকই আসতেন। আর প্রায় সব ছাত্ররই পরিধেয় ছিল ধুতি বা পায়জামা-পাঞ্জাবি। এমনকী পার্ক স্ট্রিটের দক্ষিণাঞ্চল বা আলিপুরনিবাসী ধনী সন্তানরাও ধুতি বা পায়জামাই পরতেন। অবশ্যি তখন ধুতি পরে ট্রামবাসে চড়লে লজ্জানিবারণ দুঃসাধ্য ছিল না। সেই অবস্থার পরিবর্তনের ইতিহাস বিষয়ে আমাদের সহপাঠী এক শৌখিন কলকাতিয়া ফুলবাবু সম্পর্কে একটি মোক্ষম কাল্পনিক কাহিনি চালু ছিল। এই ব্যক্তি কোঁচানো ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি পরে ট্রামে বাসে চলাফেরা করতেন। কোন মন্ত্রবলে জানি না, যেবাসের সিঁড়িতে জীবন বিপন্ন করে যাত্রীরা ঝুলে আছে, তা থেকেও তিনি অক্ষত-ইস্তিরি পাঞ্জাবি, অপর্যদস্ত কোঁচানো ধুতি নিয়ে স্মিত বদনে নেমে আসতেন। কোন জাদুমন্ত্রে এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হত তা আমার জানা নেই। পরে দেখেছি—এই জাদুবিদ্যায় কবি বিষ্ণু দে-ও সার্থকসাধন ছিলেন। অবশ্যি উনি বলতেন যে, ওঁর পিতাঠাকুর কোঁচানো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরে শুতে যেতেন। সকালবেলা যখন শয্যাত্যাগ করলে তখন নাকি জামাকাপড়ে একটি ভাঁজও চোখে পড়ত না। অর্থাৎ বিষ্ণুবাবুর বক্তব্য, এ ব্যাপারে ওঁর কোনও ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ছিল না। ক্ষমতাটা জন্মসূত্রে জিল্স মারফত পাওয়া। সে কথা যাক, আমাদের সেই ধুতিবিলাসী সহপাঠীটি ট্রামে বাসেও সযত্ন কুঞ্চিত কোঁচার মুঠিটি এক হাতে ধরে চলাফেরা করতেন। একদিন কোঁচা হস্তে বাস থেকে নেমেছেন। পিছনে প্রচণ্ড হইহই, রীতিমতো জনবিক্ষোভ। কারণ ওঁর হস্তপ্ত কোঁচাটি ওঁর নয়, অন্য কোনও যাত্রীর। এই কাহিনি চালু হওয়ার পর তিনি ধুতির বদলে পায়জামা পরতে শুরু করেন। কাহিনিটিতে কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের এক করুণ পরিচ্ছেদের ছায়া আছে। পরিচ্ছেদটির নাম—’কেন বাঙালি ফিরিঙ্গিবেশ ধারণ করল?’

এর চেয়েও করুণ এক ইতিহাস আছে, কেননা কিছু বাঙালি তরুণ রবীন্দ্রনাথের ভাষা ত্যাগ করে ‘হাই ইয়ার’ মার্কা টেঁশু ইংরিজিকে মাতৃভাষা বলে বরণ করেছে। সেই মর্মন্তুদ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করি এমন মনোবল আমার নেই। শুধু বলি, চল্লিশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে অত্যন্ত ব্যাংরেজ পরিবারের ছেলেদেরও ইংরিজিতে আলাপ করতে কখনও দেখিনি। ওই অনাচার দুটি মিশনারি কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যখন অধ্যক্ষ অপূর্ব চন্দর উৎসাহে কলেজে মেয়েরা পড়তে এলেন, তখন কিন্তু দেখেছি ওই মিশনারি কলেজের মেয়েরাও বাংলাই বলতেন। স্বাধীনতা লাভের আগে মাতৃভাষা ছেড়ে শাসক জাতির ভাষা বলাটা বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ লজ্জার ব্যাপার মনে করত। এখন যেমন আমরা লজ্জা ঘৃণা সব ত্যাগ করে মুক্তির আনন্দে হাবুডুবু খাচ্ছি, বিদেশি শাসনের যুগে ঠিক এতটা আত্মসম্মানবোধহীন নির্লজ্জ আমরা হয়ে উঠতে পারিনি।

‘৪৩ সনে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে একটা ব্যাপারে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। আমি যে-মফস্বল শহরে বড় হয়েছি, সেখানকার ছাত্রসমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা প্রবল ছিল। অনেক ছাত্রই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা কর্মী ছিলেন। যাঁরা ছিলেন না তাঁদের মধ্যেও অনেকেরই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন আবার শুরু হলে তাতে যোগ দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ, যেখানে বাংলার সব চেয়ে মেধাবী ছাত্ররা পড়তে এসেছিলেন, সেখানে তার তুলনীয় কোনও চেতনার পরিচয় পাইনি। সবাই নিজের পড়াশুনো, ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশ বা বৃহত্তর সমাজ বলে কোনও সত্তা আছে, অথবা তার প্রতি শিক্ষিত তরুণদের কোনও কর্তব্য আছে, সে চেতনা যেন নিতান্তই ক্ষীণ ছিল। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন অল্প কিছু কমিউনিস্ট এবং তার চেয়েও অল্পসংখ্যক কংগ্রেসপন্থী ছাত্র। দ্বিতীয়োক্তরা ফেডারেশনের আওতায় নিজেদের মত ও বিশ্বাস তরুণদের মধ্যে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ছিলেন। কমিউনিস্টরা আগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। তাই আমরা জাতীয়তাবাদী ছাত্ররা ওঁদের সন্দেহের চক্ষে দেখতাম। কিন্তু এদের আদর্শনিষ্ঠা এবং নির্দ্বিধায় আত্মত্যাগ শ্রদ্ধা না করে উপায় ছিল না। বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদ আমাদের প্রজন্মে পশ্চিমবঙ্গে তুলনীয় চরিত্রের শিক্ষিত তরুণদের খুব বেশি আকর্ষণ করতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের পর এই রাজ্যে কংগ্রেসি রাজনীতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ বোধ হয় এই।

কলেজে পড়ার সময় একজন জাতীয়তাবাদী নেতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসবার সুযোগ হয়। তিনি আমার আত্মীয়, কিরণশঙ্কর রায়—আমার ছোট পিসিমা পদ্মকে উনি বিয়ে করেছিলেন। এক সময় দেশবন্ধুর শিষ্য তথা সহকর্মী এবং সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই মানুষটি পরবর্তী জীবনে বাংলা কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতাদের প্রথম সারিতে থেকে বিধান রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রকৃতির এই মানুষটির সঙ্গে বয়স, সম্পর্ক এবং অবস্থার প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য বৈষম্য সত্ত্বেও এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল যার কারণ আমি আজও ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেই অসম বন্ধুত্ব আমার জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ হয়ে রয়েছে। কিরণশঙ্করবাবুর মতো মানুষ এক সময় আমাদের সমাজে বহু সংখ্যায় ছিলেন কি না জানি না, কিন্তু পরবর্তী যুগের সামাজিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ওঁকে নানা দিক থেকেই অ-সাধারণ মনে হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে অক্সফোর্ডে পড়া এই মানুষটির রক্ষণশীলতায় এডওয়ার্ডীয় যুগের উচ্চবর্গীয় ইংরাজের মানসিকতার ছাপ ছিল। শ্রেণিবৈষম্য শুধু ওঁর রাজনৈতিক আদর্শের অঙ্গ না, নিত্যকার জীবনচর্যার ভিত্তি ছিল বললে অতিরঞ্জন হবে না। স্বাধীনতা আমলোকের সুবিধার্থে নয়, ভদ্রলোকের ন্যায্য দাবি—এ বিষয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এই কারণে কমিউনিস্টরা ওঁর চক্ষের বিষ ছিল (এরই প্রতিক্রিয়ায় বোধ হয় ওঁর ছেলে কল্যাণশঙ্কর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়)। যখন ফজলুল হক সাহেব লাঙ্গল যার জমি তার এই নারা তোলেন, কিরণশঙ্করবাবু মন্তব্য করেন, “এর পর আপনি বলবেন, ‘পালকি যার, বউ তার’।” কিন্তু ইংরাজ আমলে বিদ্বিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে ওঁর তৎপরতার অভাব ছিল না। কলকাতার অ্যাসেমব্লি প্রাঙ্গণে ইংরাজের পুলিশ যখন জ্যোতিবাবুকে গ্রেফতার করে, তখন বিরোধী দলের নেতার ভূমিকায় উনিই প্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন। অথচ একই মানুষ পশ্চিমবঙ্গের গৃহমন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। রাজনীতির অন্যতর উদ্দেশ্য যে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করা, সে সম্পর্কে ওঁর কোনও সঙ্কোচ বা দ্বিধা ছিল না। এই এডওয়ার্ডীয় বাঙালি ভদ্রলোকটি সমাজে পুরুষের আধিপত্য সম্বন্ধেও নিঃসঙ্কোচ ছিলেন। মেয়েদের প্রতি ওঁর একটা অবজ্ঞার ভাব ছিল। তিন মেয়েরই সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। এক মেয়ের জীবনে প্রেমের আবির্ভাব ঘটায় তার প্রেমিককে জানান যে, লুকিয়ে বিয়ে তারা করতে পারে, কিন্তু পরদিন মেয়েকে কচুকাটা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হবে, সে জন্য যেন তারা প্রস্তুত থাকে।

সত্যিতে উনি কন্যাবধ করতেন কি না জানি না, কিন্তু এ অবধি যা লিখেছি তা পড়লে মনে হতে পারে যে, কিরণশঙ্কর রায় ভয়াবহ, এমনকী বর্বর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সত্যিকার মানুষটি কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি, সুরুচি, কৌতুকবোধ আর গভীর মানবিকতার সমন্বয়ে এক অলোকসামান্য পুরুষ ছিলেন। ওঁর চলাফেরা ব্যবহারে সবচেয়ে প্রকট গুণটি ছিল আভিজাত্য।

অভিজাত কথাটা গত কয়েক দশক ধরে বাংলা ভাষায় কিছুটা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার হয়েছে। তিরিশ বা চল্লিশের দশকে বাংলা সিনেমায় নায়িকার পিতারা—যাঁরা সাধারণত সময় অসময় বিবেচনা না করে সব সময়ই ড্রেসিং গাউন পরে থাকতেন—শব্দটির অপব্যবহারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পার্ক স্ট্রিটের দক্ষিণ দিকের অঞ্চল বা আলিপুর নিবাসী নতুন বড়লোক, বিদেশি কোম্পানির বাদামি বর্ণ মেজ সাহেব/ ছোট সাহেব, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাক্ষিণ্যে রাজা উপাধি পাওয়া মুৎসুদ্দি বা গোমস্তার পুত্র-প্রপৌত্র, কর্ণবালিস সাহেবের কৃপায় জমিদার বনে যাওয়া দালাল বা কেরানির বংশধর—বিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিকরা এঁদের সবাইকেই অভিজাত শ্রেণিতে প্রোমোশন দিয়েছেন। সাবেকি অর্থে অভিজাত বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ সামন্ত শ্রেণির বংশধরেরা, অল্প কয়েক ঘর রাজা-জমিদার বাদ দিলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর সূর্যাস্ত আইনের কৃপায় বাঙালি সমাজ থেকে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। এ নিয়ে আফসোস করার কোনও হেতু নেই, কিন্তু আমাদের আত্মপরিচয় বোঝার জন্য ব্যাপারটা মনে রাখা ভাল। উত্তর কলকাতার বনেদি বড়লোক পরিবারগুলি, ইস্তক জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, অধিকাংশই কোনও অর্থেই অভিজাত না, লুটেরা ইংরাজ কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ায় ফুলেফেঁপে ওঠা বেনিয়ান-মুৎসুদ্দির বংশধর মাত্র। যেবংশে কিরণশঙ্করবাবুর জন্ম, সেই তেওতার জমিদার পরিবারও এই নিয়মের ব্যতিক্রম না। কিন্তু বেশ কয়েক প্রজন্ম সম্পদ, ক্ষমতা আর নতুন ধারার শিক্ষাদীক্ষার ফলে এইসব পরিবারে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস আর কৃষ্টির ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। আধুনিক বাঙালি জীবনে আভিজাত্য বলতে সামন্ততান্ত্রিক আচারব্যবহার নয়, এই নতুন বুর্জোয়া সংস্কৃতিই বোঝায়। তবে জমিদার পরিবারগুলিতে, এমনকী উনিশ শতকের কলকাতার বাবু কালচারে, সেকেলে বড়লোকি অর্থাৎ নবাবি বা সামন্তশ্রেণির ধরনধারণের অনুকরণ কিছুটা থাকায় বাঙালি বুর্জোয়া সংস্কৃতিতে পুরনো আভিজাত্যের ছোঁয়াচ লেগেছিল।

কিরণশঙ্করবাবুর ব্যক্তিত্বে বুর্জোয়া সংস্কৃতি আর পুরনো আভিজাত্যের সম্মিলন ঘটেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার অক্সফোর্ডে ডিগ্রি পাওয়া মানুষটি আচার-ব্যবহারে বনেদি বাঙালি পরিবারের ধরনধারণ থেকে এক চুলও সরে যাননি। নানাভাবে অত্যন্ত কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও উনি একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা বজায় রেখেছিলেন। বাড়িতে টেবিল-চেয়ারে খাওয়া বা কাঁটাচামচের ব্যবহার কখনও চালু হয়নি। আহার ব্যাপারটা মাটিতে পিড়ি পেতে বসে বড় বড় কাঁসার থালায়ই সম্পন্ন হত। অত্যন্ত ভোজনপ্রিয় মানুষটি দেশি-বিদেশি নানা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার বাড়িতে আনাতেন, কিন্তু ওঁকে কখনও রেস্তোরাঁয় যেতে দেখিনি। আসলে ওঁর মনে সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে প্রচণ্ড দম্ভ ছিল। আমরা অতি প্রাচীন সভ্য জাতি। আমরা কেন বর্বরদের মতো অন্যের অনুকরণ করতে যাব? ওঁর গভীর দেশপ্রেমের পিছনেও এই আত্মাভিমানই কাজ করত বলে আমার বিশ্বাস। দেশে ফেরার পর বোধ হয় আর কখনও বিদেশি পোশাক গায়ে ওঠেনি। না, কথাটা পুরো সত্যি নয়। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছিলেন। সুতরাং সকলের প্রত্যাশা মেটাতে একদিন ধরাচূড়া পরে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ব্যস, ওই এক দিনই। স্টিফ কলার পড়লে ওঁর দম আটকে আসে এই দুর্লঙ্ঘ্য কারণে আর কখনও হাইকোর্টমুখো হননি।

তার চেয়েও বড় আর একটা কারণ ছিল। উনি বলতেন, ভদ্রলোকে পয়সা রোজগার করে না। ওটা সা-শুড়িদের কাজ। খাঁটি ভদ্রলোক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ভোগ করে সভ্য জীবন যাপন করে। তাতে যদি ভাগ্যে দারিদ্র জোটে, ক্ষতি নেই, তা বলে আমলোকের মতো কাজ করে পয়সা রোজগার করা চলে না। কিছু মানুষের অন্তহীন অবসরের ভিত্তিতেই নাকি মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ উনি গ্রিসের দাসত্বপ্রথা আর আমাদের ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির কথা বলতেন। এই দুই সমাজের একটিতেও সভ্য মানুষ সত্যিতে কাজ বলতে যা বোঝায় তা কেউ করতেন না। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ অবসরভোগী কোনও শ্রেণি না থাকলে সভ্যতার বিবর্তন সম্ভব নয়। অবশ্যই এ ধরনের সমাজব্যবস্থা ন্যায়ের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল না। কিন্তু সভ্য সমাজ শুধু ন্যায়ের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ক্ষমতা এবং ধনবৈষম্য সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার না হয়, সেইটুকু দেখা দরকার। কারণ অত্যাচারের আতিশয্য ঘটলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। উদাহরণ ফরাসি বিপ্লব। ওঁর মতে ওই বিপ্লবের একমাত্র সুফল নেপোলিয়নের আবির্ভাব। এরকম আপসহীনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল মতামত আমি আর কোনও মানুষকে প্রকাশ করতে শুনিনি।

কিন্তু ওঁর মতামত আর জীবনচর্যার মধ্যে কোনও অসঙ্গতি ছিল না। জীবনের অধিকাংশ সময় আপেক্ষিক অর্থে ওঁর দারিদ্রের মধ্যেই কেটেছে। কিন্তু ওঁকে অভাব নিয়ে হা-হুঁতাশ করতে কখনও শোনা যায়নি। জটিল রাজনীতির জগতে বাস করেও ওঁর সাংস্কৃতিক চেতনা সাহিত্য, ইতিহাস আর সঙ্গীতের রসে মগ্ন থাকত। একটা কথা থেকে ওঁর সত্যিকার মূল্যবোধের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। উনি ওঁর জীবনের গভীরতম আনন্দের দিনটি আমার কাছে বর্ণনা করেছিলেন। সে দিনটি ছিল পূর্ণিমা। ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনের বাড়িতে অতিথি সেদিন রবীন্দ্রনাথ। জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়ির পুকুরপাড়ের পিঁড়িতে বসে কবি গান করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা ওঁর জীবনে প্রায় ইন্দ্রিয়াতীত এক তীব্র সুখানুভূতির স্বাদ এনে দিয়েছিল। তুচ্ছ সুখ-দুঃখ অভাব-অভিযোগের মুহূর্তে তার স্মৃতি ওঁকে অবিচলিত রাখত। মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে সিনিক মনে হলেও আসলে মনেপ্রাণে রোমান্টিক ছিলেন। ওঁর সবুজপত্রে প্রকাশিত সাতটি গল্প ‘সপ্তপর্ণ’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়। উৎসর্গ-পত্রে ছিল ইয়েটসের একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি

Had I the Heaven’s embroidered cloths
        I would have spread them under your feet

আমরা পরে জেনেছি উনি একজনকে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু ভিক্টোরীয় সংস্কৃতি আর প্রচণ্ড নীতিবোধ এই ভালবাসা প্রকাশের কোনও পথ রাখেনি। তারাখচিত স্বর্গীয় গালিচাটি কার পদতলে উনি বিছাতে চেয়েছিলেন, ওঁর প্রেমাস্পদা বা অন্য কোনও মানুষ তা জানবার সুযোগ পাইনি। উনি স্ত্রীকে বলতেন, “দেশকে আমি কী দিয়েছি জানো? আমার চরিত্র।” নিজেকে উনি হেরে যাওয়া মানুষদের একজন বলেই গণ্য করতেন। মাঝে মাঝেই বলতেন, “উই দি ফেলিওরস অফ দি ওয়ার্লড।” কিন্তু ওঁর রোমান্টিক চেতনা ওঁর কৌতুকবোধকে কখনও আচ্ছন্ন করেনি। ওঁর একটি গল্প বিশেষ স্মরণীয়। তখন আই.এ. পড়েন। বিপ্লবীদের সঙ্গে মেলামেশার অপরাধে জ্যাঠামশায় ওঁকে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছেন। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, ভাইপো কিছুই করছে না, বসে বসে ভেরেন্ডা ভাজছে। ডেকে বললেন, “কিছু না করে বসে আছিস? আর কিছু না পারিস, দু-চারটে কবিতাও তো লিখতে পারিস। দ্বিজুর ভাই কবিতা লিখে বেশ দু’পয়সা করছে।” পাঠিকা/পাঠক, চিনলেন দ্বিজুর ভাইকে? কিরণশঙ্কর কখনও কবিতা লেখেননি এমন নয়। সবুজপত্রে প্রকাশিত গল্পগুলির একটিতে এক অসাধারণ প্রাণীর পয়ারে বর্ণনা ছিল

“নিবারণ [?] নামে প্রাণী অতি বুদ্ধিমান
         সর্বাঙ্গ আছয়ে তার আর দুটি কাণ।”

ওঁর কাছে অক্সফোর্ডের গল্প শুনে শুনেই আমার ওই জায়গাটি সম্বন্ধে প্রথম কৌতূহল জন্মায়। শহিদ সুরাবর্দি আর অপূর্ব চন্দ অক্সফোর্ডে ওঁর সহপাঠী ছিলেন। একদিন নাকি সুরাবর্দি সাহেব মত প্রকাশ করেন যে, সবুজ শার্টের সঙ্গে নীল টাই পরা সম্পূর্ণ শাস্ত্রসঙ্গত। বীতশ্রদ্ধ হয়ে মিস্টার চন্দ নিচু গলায় মন্তব্য করলেন, “দ্যাট শোজ দা মিল হি কামস ফ্রম!” এমন অশাস্ত্রীয় কথা চন্দ সাহেব কখনও শোনেননি। এর পর থেকে আমরা কারও প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করতে হলে বলতাম, “দ্যাট শোজ দা মিল হি কামস ফ্রম”। আর একটি গল্প আমার খুব মনে ধরেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ যেদিন শুরু হয়, উত্তেজিত ছাত্ররা গ্রিক ইতিহাসের শিক্ষকের ঘরে গিয়ে বলে, “গ্রেট ওয়ার শুরু হয়ে গেছে।” সেদিনকার টাইমস পত্রিকায়ও ওই মর্মেই হেডলাইন ছিল। কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর ছাত্রদের শান্ত হতে বলে বইপত্র নামালেন। তার পর নানা নজির দেখিয়ে বোঝালেন যে, গ্রেট ওয়ার শুরু হতে পারে না। বলো, কেবল ওয়ার শুরু হয়েছে। কারণ গ্রেট ওয়ার বলে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পেলোলোনেসীয় যুদ্ধকে। কিরণশঙ্করবাবু যখন ছাত্র তখনও নিউ কলেজের প্রবাদপুরুষ ডিন স্পনার অবসরগ্রহণ করেননি। কথাবার্তা সব ওলটপালট করে ফেলতেন বলে ওঁর নামে ইংরাজি অভিধানে একটি শব্দ যোজনা করা হয়েছে, নারিজম। কিরণবাবুর কাছে শুনারিজমের একটি উদাহরণ শুনি, যা অন্য কোথাও পাইনি। ক্লাসে ঢুকে শুনার দেখলেন ডেস্কের উপর একটি চিঠি পড়ে আছে। কেউ চিঠিটা ডাকে দিতে ভুলে গেছে আর কী। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন, “হু হ্যাজ পিচ্চু দা মোস্ট?” বলতে চেয়েছিলেন, “হু হ্যাজ মিড় দা পোস্ট?”

আবেগপ্রবণ মানুষটি সাহিত্যে আবেগপ্রবণতা সহ্য করতে পারতেন না। তাই ডিকেনস উনি অপছন্দ করতেন। রোম্যাঁ রলাঁর জাঁ ক্রিস্তফ উনি বেশি বাক্যবহুল মনে করতেন, অস্কার ওয়াইন্ডের ‘ডি ফান্ডিস’ ওঁর কাছে অনুভূতির ভড়ং বলে মনে হত। বঙ্কিমের ভক্ত হয়েও আনন্দমঠের যে দৃশ্যে সত্যানন্দ সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভবানন্দকে কোলে নিয়ে বসলেন সে দৃশ্যটি ওঁর অসহ্য লাগত। ওঁর প্রিয় ইংরাজ ঔপন্যাসিক ছিলেন থ্যাকারে আর ফিল্ডিং। ফরাসি লেখক আনাতোল ফ্রাঁসের লেখা পড়তে উনিই প্রথম আমাকে উৎসাহ দেন। ওঁর প্রিয় উপন্যাস ‘দা ক্রাইম অফ সিলভে বনার’ পড়ে ওঁর চরিত্রের একটি দিক সম্বন্ধে সচেতন হই। বনার অকৃতদার বৃদ্ধ অধ্যাপক, একটি বিশেষ ল্যাটিন পুঁথি নিয়ে তাঁর গবেষণা। বিদ্যাচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এই বৃদ্ধ তাঁর যৌবনের ব্যর্থ প্রেমের নায়িকার মেয়েটিকে ক্যাথলিক কনভেন্ট থেকে উদ্ধার করেন। এই তাঁর শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ক্রাইম। রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত চার সন্তানের পিতা ঘোর রক্ষণশীল এই বাঙালি ভদ্রলোক কোথাও কি নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ফরাসি পণ্ডিতটির জীবনবোধ আর মানবিক অর্থে নিজের মৌলিক

নিঃসঙ্গতার মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন? আমার সঙ্গে ওঁর নিতান্ত অসম বন্ধুত্ব কি সেই নিঃসঙ্গতারই অন্যতম ফল? ইতিহাসে ওঁর প্রিয় নায়ক ছিলেন নেপোলিয়ন। কিন্তু নেপোলিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বারেবারেই উনি পরাজিত নেপোলিয়নের কথায় ফিরে আসতেন। উঁচু তারে বাঁধা ওঁর মনে ব্যর্থতাবোধ এক অসম্ভব সম্ভাবনার সঙ্গে জড়ানো ছিল। বলতেন, “দ্যাখ, আমরা কী নিকৃষ্ট জীব। মানুষ হয়ে জন্মে আমরা যে বুদ্ধ বা শেকসপিয়ার হলাম না, তার জন্য ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ যে, যথেষ্ট টাকা হল না অথবা মেয়েটার আর একটু ভাল বিয়ে হতে পারত।” অন্তিম অসুখের সময়ে বারবারই বলতেন, “এই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা কী গ্লানিকর দ্যাখ। আমাদের বুদ্ধ-সক্রেটিসের প্রজাতিতে জন্ম। ডুশ দিয়ে, ক্যাথিটার দিয়ে আমাদের পশুর স্তরে নামিয়ে আনে।” ওঁর নৈরাশ্যবোধ চেতনার যে-স্তরে স্থিতি পেয়েছিল, সেখানে আটপৌরে সান্ত্বনার ভাষা পৌঁছায় না। বলতে পারেন—এ ধরনের ব্যর্থতাবোধ মেগালোম্যানিয়ারই নামান্তর। কিন্তু আমার ধারণা যে, এই সরলীকরণ জটিল মনোভঙ্গির ফাস্ট ইয়ারি অপব্যাখ্যা মাত্র। একটি অসাধারণ মানুষের অলোকসামান্য ব্যর্থতাবোধের পরিচয় পেয়েছিলাম, আমার ব্যক্তিজীবনের এ এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।

একটি কথার এখানে পুনরাবৃত্তি করি। বর্তমান রচনাটি অনেকাংশেই বিস্মৃত বা লুপ্ত এক জগতের কাহিনি। লুপ্ত কী অর্থে? যে ধরনের মানুষ এক সময়ে দেখেছি, সেই ধরনের মানুষ তাঁদের বিশিষ্ট জীবনচর্যা, মনোভঙ্গি আর বিশ্বচেতনা নিয়ে পৃথিবী থেকে সরে গেছেন। তাঁদের পরে যাঁরা এসেছেন তাঁদের সঙ্গে পূর্বগামীদের সাদৃশ্য কম। এটা ভালমন্দ বিচার বা উন্নতি/অবক্ষয়ের কথা না। গভীর অথচ প্রায় অদৃশ্য সামাজিক পরিবর্তনের ইতিহাস। কিরণশঙ্কর রায়, অন্তত আমাদের মূল্যবোধ নিয়ে বিচার করলে, কোনও অর্থেই আদর্শ পুরুষ ছিলেন না। কিন্তু তিনি আক্ষরিক অর্থেই অসাধারণ মানুষ ছিলেন। পরস্পরবিরোধী নানা দোষগুণের সমষ্টি ওই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করা যায়, পরবর্তী প্রজন্মে এমন মানুষের সাক্ষাৎ আমি পাইনি। তাই বিগত কালের বর্ণনা করতে গিয়ে ওঁর চরিত্রচিত্ৰণ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হল।

আমাদের প্রজন্মেও কিছু লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়েছিল, যাঁদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন মানুষের সাক্ষাৎ পরবর্তীকালে আমি পাইনি। এখানেও আবার বলি, তাঁরা অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন এমন দাবি আমি করছি না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের মূল্যবোধে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। যাঁদের কথা বলব তাঁরাও দোষে-গুণে ভরা রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মূল্যবোধ আজকের জীবনে বিশেষ দেখতে পাই না। ফলে তাঁদের জীবনচর্যার ধারাও লুপ্ত হয়ে গেছে মনে হয়।

যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন পরবর্তী কালের ডাকসাইটে আই এ এস অফিসার অমল দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে পরিচয় পরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। অমল ছিল জাত-রোমান্টিক মানুষ। জীবনের সব কিছুতেই সে এক উজ্জ্বলতর সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেত। প্রেমে পড়বার জন্য উন্মুখ এই তরুণ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হয়ে প্রথম সাক্ষাতেই তার ভাবী পত্নী অরুণার প্রেমে পড়ে। প্রথম সন্তানটি ছ’বছর বয়সে ব্রেন ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর অরুণা উন্মাদ হয়ে যায়। দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই উন্মাদ স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করেও অমলের জীবনরস কখনও শুকিয়ে যায়নি। চাকুরি জীবনের প্রথম দিকে সে তার উপরিওয়ালা আই সি এস অফিসার কমিশনার সাহেবের অনাচারের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ আইনসঙ্গতভাবেই। হাইকোর্টে নালিশ করে। কমিশনার তিরস্কৃত হন। ফলে দীর্ঘদিন ওর ন্যায্য পদোন্নতি বন্ধ থাকে। মহাত্মা গাঁধীর জীবন নিয়ে ছবি করতে গিয়ে চিত্রপরিচালক অ্যাটেনবরো তখনকার সংস্কৃতিসচিব অমল দত্তর সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁর বর্ণনায় ‘ফরমিডেবল মিস্টার ডাট’ অনেক বাধাবন্ধ উপেক্ষা করে ছবিটি তৈরি করতে ওঁকে সাহায্য করে। কিন্তু তার ফলে ওর প্রিয় সংস্কৃতি দফতর ওকে ছাড়তে হয়। শেষ জীবনে চির-রোমান্টিক অমল অরুণার মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করে। সেও এক উন্মত্ত প্রেমের বিবাহ। গভীর ট্র্যাজেডির মধ্যে অমলের জীবন শেষ হয়। কিন্তু ষাট বছর বয়সেও ওর রোমান্টিক চেতনা আর গভীর জীবনানুভূতি অক্ষুণ্ণ ছিল। প্রচণ্ড পৌরুষের অধিকারী চিরকিশোর এই মানুষটির সমগোত্রীয় দ্বিতীয় কোনও চরিত্রর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি।

অমল এবং আমার অন্যান্য যেসব সহপাঠী প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা চাকরিতে যোগ দেয়, তারা স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে এইসব ক্যাডারে প্রথম ব্যাচের চাকুরে। শিক্ষিত বাঙালি তখনও সরকারি চাকরির চেয়ে বড় সৌভাগ্য কিছু কল্পনা করতে পারত না। আর হঠাৎ এই জাতীয় চাকরি বেশি সংখ্যায় খালি হওয়ায় ভাল ছাত্রদের মধ্যে নতুন আশার উদ্দীপনা দেখা দেয়। এদের মধ্যে অনেকেই যৌবনসুলভ আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ ছিলেন, যে আদর্শের মুল কথা জাতীয়তাবোধ বা স্বজাতিপ্রেম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার প্রকাশ চমকপ্রদ আত্মত্যাগে নয়, গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে দৈনন্দিন কর্তব্য পালন করায়। আমাদের রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র অনাচার এই আদর্শভিত্তিক কর্তব্যবোধকে ক্রমে ধ্বংস করেছে। কিন্তু এক সময়ে বোধটা কত বাস্তব ছিল অমলের জীবন থেকে তা বুঝতে পারি। আই এ এস-এর চাকরি নেবার আগে নবগঠিত ইউ, এন-এ অমল কাজ পেয়েছিল। সে কাজ ও নেয়নি। না নেওয়ার কারণ হিসাবে ও বলে সারাজীবন বিদেশে কাটালে জীবনের বাস্তব ভিত্তি বোধ হয় শিথিল হয়ে যায়। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। এখন এখানে অনেক কিছু করার আছে। অনেক ধাক্কা খেয়েও শেষ অবধি ওর এই বিশ্বাস অটুট ছিল।

সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ আমাদের আর একজন সহপাঠী, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ও আই এ এস-এ যোগ দিয়ে ওড়িশায় চাকরি নিয়েছিলেন। আমাদের ক্লাসের ‘ফার্স্ট বয়’ ঈশান স্কলার অশোক হাকিম হওয়ার জন্য জন্ম নেয়নি। ওর অসাধারণ প্রতিভার এটাই সুষ্ঠু ব্যবহার, এমন কথা কারও কেন মনে হয়েছিল বলতে পারি না। অশোক সাবেকি অর্থে যাকে স্কলার বা পণ্ডিত বলে তা ছিল না। অর্থাৎ ইতিহাসের ছাত্র হয়েও দলিল-দস্তাবেজ বা পুঁথি-অনুশাসনে মুখ গুঁজে জীবন কাটানোর সম্ভাবনা ওকে উদ্দীপ্ত করত না। ওর প্রতিভা, যার আভিধানিক অর্থ ‘নব নব উন্মেষশালিনী বুধী’, বর্তমান জগৎ আর সমাজকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। ওর যদি আর কয়েক বছর পরেও জন্ম হত, তবে ও হয়তো সাংবাদিক হত এবং বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণের পথে এগিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্লেষকদের একজন বলে গণ্য হত। অনার্স ক্লাসের সেমিনারে ওর পড়া ফরাসি বিপ্লবের উপরে একটি প্রবন্ধ মনে পড়ে। সুশোভনবাবু প্রবন্ধটি শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। আদর্শবাদ আর বাস্তব অবস্থার পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত আলোচনা করতে গিয়ে ও দেখায় যে, রুশো-ভলতেয়ারের চিন্তা এক দিকে যেমন বিশিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি, তেমনই তার প্রভাবও সেই অবস্থা দিয়েই নির্ধারিত ও সীমিত হয়েছিল। চল্লিশের দশকে এই ধরনের চিন্তা আর কেউ করেছিলেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত সমাজে বাঁধা সরকারি চাকরির সম্ভাবনা থাকলে অনিশ্চয়তায় ভরা অন্য কোনও জীবিকার কথা কেউ ভাবত না। অশোকের চাকুরিজীবন সাফল্যমণ্ডিতই ছিল। রাষ্ট্রপতি জৈল সিংহের একান্ত সচিব হয়ে ও কাজ থেকে অবসর নেয়। কিন্তু বিশুদ্ধ বুদ্ধির চর্চা যার স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্র ছিল, তাকে শাসনযন্ত্রের ঘানিতে জুড়ে দিয়ে একটি অসাধারণ সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনাশ করা হয়েছিল।

অবস্থার চাপে পথভ্রষ্ট আমাদের প্রজন্মের আর একটি মানুষের কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করব। ব্যক্তিটি শৈলেন সেন, আমার ভগ্নিপতি। ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেনের ছেলে শৈলেন সাম্প্রতিক জগৎ, বিশেষত আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে গভীর পড়াশুনো করেছিল। সে-আমলের এক ডাকসাইটে সাংবাদিকের কাছে সুরেনবাবু পরামর্শ চেয়েছিলেন। ভদ্রলোক তাঁর চুরুটটি ঠোঁটের এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করলেন, “যদি ছেলে উপোস করে এই দেখতে চান, তা হলে সাংবাদিকতা করতে বলুন।” ভদ্রলোক নিজে অবশ্যি ঠিক উপবাস করেননি। এমনকী যথাস্থানে তৈল নিকেশ করে ইংরাজ সরকারের কৃপায় নাইটহুডও পেয়েছিলেন। কিন্তু জিনিয়াসদের বেলা নিয়ম আলাদা, এ কথা কে না জানে? শৈলেন তার কর্মজীবনের প্রস্তুতি হিসাবে অক্সফোর্ডে পড়বে ঠিক হয়েছিল। মহাপুরুষের উপদেশ অনুযায়ী সে আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে ও আয়কর বিভাগে চাকরি পায়। সে কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গেই করে। আর সততা এবং কর্মদক্ষতার জন্য প্রচুর সুনাম নিয়ে চাকরিতে যতদুর ওঠা সম্ভব তা উঠে অবসর নেয়। কিন্তু ওই কাজ ওর কাছে বিষবৎ ছিল। সমস্ত অবসর সময় পড়াশুনোয় কাটিয়ে ও প্রায় হাজার ছয়েক বই সংগ্রহ করেছিল। ইচ্ছে ছিল অবসর নেওয়ার পর ঐতিহাসিক গবেষণা করবে। যে দিন অবসর নিল তার পরদিন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শৈলেন মারা যায়। ওর পথিক দুরাশা লক্ষ্যে পৌঁছবার কোনও সুযোগ পেল না।

স্বাধীনতালাভের আগে শিক্ষিত ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুর জীবনে জীবিকা উপায়ের পথ কত সীমিত ছিল আজকের প্রজন্মের পক্ষে তা কল্পনা করা কঠিন। দীর্ঘ দিন বেকার থাকা বা জীবনের অধিকাংশ সময় অতি সামান্য রোজগারে পরিবার প্রতিপালন করা শিক্ষিত বাঙালির প্রত্যাশা এর উপরে যেত না। যেসব লোক মাঝারি বা ছোট সরকারি চাকরি পেতেন তাঁদের সবাই বিশেষ ভাগ্যবান মনে করতেন। আর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও ক্যাডারভুক্ত চাকরি অথবা অপেক্ষাকৃত মোটা মাইনের বেসরকারি কোম্পানিতে যাঁরা চাকরি পেতেন তাঁদের ইন্দ্রলোকপ্রাপ্তি হয়েছে বলে সবার ধারণা ছিল। এই শ্রেণির ভাগ্যবানদের অনেকেই অনিবার্যভাবেই ‘আমি কী হনু রে’ এই চিন্তায় মশগুল থাকতেন। এইসব হনুদের সহ্য করা কঠিন ছিল, কিন্তু বেচারিদের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। দেশব্যাপী দুরবস্থার সমুদ্রে এঁদের জীবনযাত্রা সাচ্ছল্যের ছোট ছোট দ্বীপ হয়ে ভেসে থাকত। ভাগ্য যাঁদের প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি তাঁদের সম্বন্ধে সহানুভূতি থাকার মতো সুরুচি বা সত্যিকার শিক্ষা এঁদের অনেকেরই ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন জীবিকা উপায়ের সুযোগ-সুবিধা যে আগের তুলনায় বেড়েছে এবং বাড়ছে, এ উপলব্ধি মানুষের হয়নি। ফলে অনেকেই গতানুগতিক পথেই জীবিকার সন্ধান করেছে। ক্ষমতা বা প্রতিভার সুষ্ঠু বিকাশের সুযোগ পায়নি। অশোক বা শৈলেনের মতো প্রতিভাশালী মানুষ বিদেশি শাসনের যুগের মনোভাব বা আশাপ্রত্যাশার শিকার।

আমাদের প্রজন্ম জাতীয় জীবনের দুই ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে—প্রথম ৪৩ সালের মন্বন্তর। দ্বিতীয় ‘৪৬ সনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বর্তমান পরিচ্ছেদে প্রথম ঘটনাটি বিষয়ে কিছু বলব। ইতিহাসে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নজির হিসাবে বিশেষ মূল্য দেওয়া হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই সমসাময়িক বর্ণনা কোনও অর্থেই ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ নয়। এই সত্য আধুনিকতাপরবর্তী’ বা পোস্ট-মডার্নিস্ট ঐতিহাসিকরা তথ্যপ্রমাণ দিয়েই সম্যকভাবে প্রমাণ করেছেন। সোজা কথায় বলতে গেলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় সমসাময়িকরা কোনও ঘটনাবিশেষ বা ঘটনাপ্রবাহের কতটা সত্যিকে প্রত্যক্ষ করেন? ‘প্রত্যক্ষদর্শন’ অনেক সময়ই অন্য লোকের মুখে শোনা কথা। তার উপর নিজের মত ও বিশ্বাস—যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিতরণে ব্যক্তিবিশেষের অবস্থানের উপর অনেকটাই নির্ভর করে–দেখা ঘটনা এবং শোনা কথার কী ব্যাখ্যা হবে তার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। মোট কথা, প্রত্যক্ষদর্শী হলেই ঘটনাবিশেষ সম্পর্কে তার বক্তব্য বেদবাক্য হয়ে দাঁড়ায় না।

‘৪৩ সালের মন্বন্তর আমি যেটুকু স্বচক্ষে দেখেছি তা ‘রোমন্থন’-এ সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি, এখানে তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

‘৪৩-এর জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কলকাতা ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হই। যতদূর মনে পড়ে, নভেম্বর মাস নাগাদ শহরের রাস্তায় এক নতুন দৃশ্য চোখে পড়তে থাকে। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহর থেকে দলে দলে লোক এসে রাস্তা বা ফুটপাথে বাসা বাঁধতে শুরু করে। কলকাতার রাস্তায় ভিখারি কিছু নতুন দৃশ্য নয়। কিন্তু এই নবাগতরা অন্য ধরনের মানুষ। এক—এদের দেখলেই বোঝা যেত যে, ভিক্ষাবৃত্তি এদের স্বাভাবিক পেশা না। অনেক সময়েই দেখা যেত মা-বাপ-ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা পুরো পরিবার এসে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। কলকাতায় ভিক্ষাবৃত্তির এটা সাধারণ লক্ষণ নয়। দ্বিতীয় কথা–প্রথম প্রথম এরা ভিক্ষা চাইত না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। বোঝা যেত এরা গৃহস্থ মানুষ। সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে ভিক্ষা করতে পারছে না। কখনও কখনও শহরবাসীরা এদের দুরবস্থা দেখে নিজের থেকেই কিছু ভিক্ষে দিয়ে যেত। কিন্তু তখন চালের দাম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মন প্রতি তিন/সাড়ে তিন টাকা থেকে বেড়ে মন প্রতি চল্লিশে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দুঃস্থ পরিবারগুলির সবচেয়ে যা প্রয়োজন সেই চাল দেওয়ার মতো অবস্থা বেশি লোকের ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই রাস্তায় মৃত বা মৃতপ্রায় মানুষের শরীর চোখে পড়তে লাগল। আর ফুটপাথবাসীর সংখ্যা যেন রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠল। রাস্তায় বের হলেই মৃত মানুষ পড়ে আছে দেখা নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। এরকম কতজন মৃত বা অর্ধমৃত মানুষ দেখেছি যদি জিজ্ঞেস করেন তো সঠিক উত্তর দিতে পারব না। তবে তার সংখ্যা ছ’-সাত সপ্তাহে পাঁচ-ছ’ হাজারের কম হবে মনে হয় না। দুঃস্থ মানুষের ভিড় সবচেয়ে বেশি দেখা যেত চৌরঙ্গি অঞ্চলে। তখন বিদেশি সৈন্যের ভিড়ে কলকাতা শহর সরগরম। ওইসব অল্পবয়সি ছেলেরা বোধহয় ভিক্ষে দেওয়ার ব্যাপারে মুক্তহস্ত ছিল। কিন্তু পয়সা দিয়ে কী হবে? বাজারে চাল কোথায়? মার্কিন সৈন্যদের জন্য টিনে করে খাবার আসত। ওইসব খাদ্য সামান্য দামে রাস্তায় বিক্রি হতে দেখেছি। আমরাও কিনতাম। কখনও কখনও জি, আই-রা ভিক্ষে হিসাবে টিনগুলি দিত। কিন্তু কোনও দুঃস্থ মানুষকে বহুদিনের সংস্কার কাটিয়ে উঠে ওই সব খাদ্য খেতে কখনও দেখিনি। ক্রমে শহরের পথে সেই অবিস্মরণীয় আবেদন শোনা যেতে লাগল। চাল ভিক্ষা করা বৃথা জেনে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ। অন্য সুর ধরল : “ফ্যান দাও গো, ফ্যান দাও।” ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর আর কখনও বুভুক্ষু বাঙালি ফ্যান খেয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করেছে এমন নজির ইতিহাসে নেই। কিছু কিছু জনহিতকারী সংস্থা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য লঙ্গরখানা খোলে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা নিতান্তই। মরুভূমিতে জলবিন্দুর শামিল হয়ে দাঁড়ায়। ‘৪৩-এর দুর্ভিক্ষে ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। তার একটা বড় অংশ কলকাতার রাস্তায়। এই বিপর্যয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো সত্যিকার কোনও চেষ্টা সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রকৃতপক্ষে কেউই করেনি।

সামাজিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আর একটি উল্লেখযোগ্য কথা এখানে বলা প্রয়োজন। মনে করি। ‘৪৩-এর কলকাতা রীতিমতো ‘বুম টাউন’। চৌরঙ্গি অঞ্চলের রাস্তায় নানা বর্ণের সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা এবং তা তারা মুড়ি-মুড়কির মতো খরচা করছে। নতুন নতুন সব রেস্তোরাঁ আর ক্যাবারে হয়েছে। শহরের অলিতে-গলিতে মাসাজ পার্লারেরও সমারোহ, যদিও এই ব্যবসা সত্যিতে জমে ওঠে দেশ ভাগ হওয়ার পর। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে কিছু সন্ধানী ব্যক্তি যাঁরা মাসাজ পার্লারে যাওয়া-আসা করতেন, তাঁদের কাছে শুনতাম যে, ওইসব প্রতিষ্ঠানে ভোগ্যবস্তু কলকাতার রাস্তা থেকেই সংগ্রহ করা, তবে তারা ভদ্র ঘরেরই মেয়ে। মানে পার্লারের স্ত্রীরত্নরা মোটেই দুঙ্কুলাৎ নয়। মোট কথা কলকাতার ফুর্তি-আমোদে দুর্ভিক্ষের জন্য একটুও ভাঁটা পড়েনি, বরং ফুর্তির জোয়ার কেঁপে ফুলেই উঠেছিল। চাল এবং আর সব ভোগ্যবস্তুর দাম বাড়ায় কালোবাজারের কৃপায় অনেকের পকেটেই প্রচুর কাঁচা পয়সা। সে পয়সা নানা বিলাসব্যসনে খরচ করার উপায় শহর কলকাতায় অজস্র। রেস্তোরাঁর কথাই ধরুন না কেন। কোনও রহস্যজনক কারণে চালের দাম হু-হু  করে বাড়া সত্বেও রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম প্রায় একই ছিল। এমনকী ফারপোর সেই বিখ্যাত তিন পদ লাঞ্চের দাম দুর্ভিক্ষ যখন চরমে তখনও মাত্র তিন টাকা। হ্যাঁ, আমাদের মতো মিচকি মোবারক ব্যক্তিরাও সেই বিলাস থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলাম না। রোমন্থন’ এ লিখেছি পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ডে একজন ডাক্তারের অ্যালবামে পাশাপাশি দুটি জিনিস দেখেছিলাম। প্রথমটি ফারপোর এক স্পেশ্যাল লাঞ্চের মেনু ন টাকায় সাত পদ। তার পাশে একটি ফোটো—দুর্ভিক্ষপীড়িত মৃতপ্রায় কিছু মানুষ ফারপোর দরজার কাছে শুয়ে বসে রয়েছে। চৌরঙ্গি অঞ্চলের রেস্তোরাঁগুলির সামনে দুঃস্থ মানুষের ভিড় কিছু বেশি হত, কারণ ওখানে ভিক্ষেটা একটু মোটা অঙ্কের হওয়ার সম্ভাবনা। মোট কথা বাড়ির দরজার বাইরে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই না খেতে পেয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে মরছে, এবং তারা সংখ্যায় একজন-দু’জন না, বিশ-ত্রিশ লক্ষ, এই দৃশ্য দেখে বা এই তথ্য জেনে সাহেব বলুন, দেশি লোক বলুন কারওই গলায় ভাত আটকে যায়নি। আমাদের গতানুগতিক জীবনযাত্রা তথা ফুর্তি-আমোদেও কোনও বাধা পড়েনি। হস্টেলের ছেলেরা দু’-এক বেলা উপোস করে সেই ভাত দুর্ভিক্ষপীড়িতদের দিয়েছি এবং ফলে নিজেদের মানবিকতায় মুগ্ধ হয়ে বেশ আত্মপ্রসাদ উপভোগ করেছি। ওই কাজ করতে গিয়ে প্রসঙ্গত বুঝতে পারি আমাদের মতো ভাগ্যবান মানুষের সঙ্গে সত্যিকার হতভাগ্যদের কত তফাত। অনভিজ্ঞ হাতে সমাজসেবা করতে গিয়ে আমরা বুভুক্ষুদের বেশ এক পেট লপসি খাইয়ে দিই। ফলে যারা দীর্ঘ দিন খেতে পায়নি তাদের অনেকেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেদবমি হয়ে মারা যায়। অনেক দিন না খেতে পেলে মানুষের শরীর যে আহার কী করে গ্রহণ করতে হয় সে কথা ভুলে যায়, এ তথ্য আমরা দুবেলা পেট ভরে খেতে পাওয়া মানুষ কী করে জানব? আমাদের শুভেচ্ছাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় আমরা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।

এতক্ষণ যা লিখেছি, তা তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা। এ থেকে ঘটনার স্বরূপ বা কার্যকারণ কিছু বোঝা যায় না। তার বীভৎসতার হয়তো কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। সত্যিতে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ইতিহাস লেখা হয়নি। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আংশিক বিশ্লেষণ হয়েছে ঠিকই, অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের অর্থনৈতিক পটভূমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। জনৈক মার্কিন গবেষক এক চমকপ্রদ কাহিনি শুনিয়েছেন। মেয়েরা ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে স্বেচ্ছায় কম খাওয়ার ফলেই নাকি দুর্ভিক্ষে অত লোক মারা যায়। সীতা-সাবিত্রীর দেশ বলে কথা! এমন বিচিত্র ব্যাখ্যা শুধু সেই দেশেই সম্ভব যেখানে বুশের মত জীব প্রচুর ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। সে কথা যাক। দিল্লির বি. এম. ভাটিয়া সাহেব তাঁর দুর্ভিক্ষের ইতিহাসে বাংলার মন্বন্তর নিয়েও আলোচনা করেছেন। আরও বিশদ আলোচনা পাওয়া যায় মম্বন্তরের অল্প পরে সংকলিত স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায়। বছর দুই আগে ডক্টর বিক্রমজিৎ দে তাঁর অক্সফোর্ডের পি.এইচ. ডি, থিসিসে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসাবে ইংরাজ সরকারের অবদান বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এইসব ছড়ানোছিটানো নানা বিশ্লেষণের ফলাফল একত্র করে মন্বন্তরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার সময় হয়েছে।

আবার প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আমরা যারা সেই চরম দুর্ভাগ্যের সময় জীবিত ছিলাম, কেন কী ঘটছে তা জানার বা বোঝার আমাদের বিশেষ কোনও সুযোগ। ছিল এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। আমরা শুধু দেখতাম চালের দাম হু-হু  করে বেড়ে যাচ্ছে আর নানা দিক থেকে খেতে না-পাওয়া মানুষ কলকাতার রাস্তায় ভিক্ষান্নর আশায় জড়ো হচ্ছে। সে ভিক্ষান্ন না জোটায় হাজারে হাজারে লাখে লাখে লোক রাস্তায় পড়ে মরছে। কেন এমন হচ্ছে তা নিয়ে অনেক মন্তব্য কানে আসত। তার সত্যাসত্য বিচার করার উপায় আমাদের ছিল না। শুনতাম যুদ্ধের প্রয়োজনে ইংরাজ সরকার চাষিদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেছে, কিন্তু সেই শস্য বন্টনের সুব্যবস্থা কিছু হয়নি। আর চালের দাম বাড়ছে দেখে কালোবাজারিরা সব চাল লুকিয়ে ফেলায় দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

কোথাও কোথাও নাকি এক মন চাল একশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সরকারের সংগৃহীত খাদ্যশস্য শিবপুরের বোট্যানিকাল গার্ডেনে স্থূপীকৃত পড়ে আছে। তা বণ্টনের ব্যবস্থা ঠিকমতো করা হয়ে উঠছে না। এই অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে যেসব লোক ফায়দা উঠাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশ কিছু নামী-দামি লোকেরও নাম শোনা যেত৷ আরও শুনতাম–দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ এতই নির্জীব হয়ে পড়েছে যে, তাদের চোখের সামনেই কালোবাজারিরা চড়া দামে চাল বিক্রি করছে দেখেও তারা নিষ্ক্রিয় থাকছে। পূর্ব বা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও একটি চালের গুদাম বা মুদির দোকান লুট হয়নি।

পরবর্তী গবেষণা থেকে যা জানা গেছে তাতে মনে হয় ‘৪৩-এর মন্বন্তর কোনও অর্থেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নৈর্ব্যক্তিক অর্থনৈতিক শক্তির টানাপড়েনের ফল নয়। ওই ভয়াবহ ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই মানুষের তৈরি। ইংরাজ সরকারের অবিশ্বাস্য গাফিলতি আর কিছু দেশি মানুষের অন্তহীন লোভের পরিণাম এই দুর্ভিক্ষ। বছরের গোড়া থেকেই কতগুলি জেলার অধিকর্তারা চেতাবনি পাঠাচ্ছিলেন যে, সরকারের খাদ্যসংগ্রহ এবং জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে অবলম্বিত কিছু ব্যবস্থার ফলে গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। সরকারের খাদ্যসংগ্রহ নীতির পিছনে দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথম উদ্দেশ্য—যেন পূর্ব সীমান্তে যুযুধান ফৌজদের কখনও খাদ্যের অভাব না হয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যর পিছনে ছিল তথাকথিত ‘ডিনায়াল পলিসি’। অর্থাৎ জাপানিরা ভারত আক্রমণ করলে তাদের পক্ষে খাদ্যসংগ্রহ এবং যানবাহনের অভাবে চলাচল যাতে কঠিন হয়ে ওঠে তার ব্যবস্থা নেওয়া। জাপানিদের সত্যিতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারত আক্রমণের কোনও মতলব কখনওই ছিল না। ইংরাজের গোয়েন্দা বাহিনী এই তথ্য আবিষ্কার করতে পারেনি। পারলে তাদের অনেক অকারণ উদ্বেগ এবং মিথ্যা শ্রম বেঁচে যেত। তার চেয়েও বড় কথা, ‘৪৩-এর মন্বন্তর সম্ভবত ঘটত না। কারণ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইংরাজের যুদ্ধপ্রচেষ্টার অঙ্গ ডিনায়াল পলিসি’র একটি কার্যক্রম ছিল পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চল থেকে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় যানবাহন সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেশি লোকদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া। এই নীতির ফলে গ্রামবাসীর কাছে অল্পস্বল্প খাদ্যশস্য যা রয়ে গিয়েছিল তা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। নিরন্ন গ্রামবাসীর পক্ষে খাদ্য সংগ্রহের কোনও উপায় থাকে না। তা ছাড়া যাদের জীবিকা নির্ভর করত নৌকা চলাচলের উপর, যেমন জেলেরা, তাদের উপার্জনের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। এই শেষের শ্রেণির মানুষই দুর্ভিক্ষর প্রথম শিকার হয়।

বিক্রমজিতের গবেষণায় যে-তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা সত্যিই ভয়াবহ। ভারতে এখনও যাঁরা ইংরেজ রাজত্বের উৎকর্ষ স্মরণ করে দশাপ্রাপ্ত হন, এই তথ্যগুলি তাঁদের বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্ত বাংলায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রথা নামেই চালু ছিল। সমস্ত ক্ষমতা গুটিকয়েক সরকারি-বেসরকারি ইংরেজের কুক্ষিগত হয়। এরা মন্ত্রীদের তোয়াক্কা রাখতেন না। এমনকী এঁদের পরামর্শে লাট সাহেব প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হককে গ্রেফতার করার হুকুম পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এক সময়ে দেশবন্ধুর সহকর্মী এবং শিষ্য হক সাহেবের প্রথম থেকেই চেষ্টা ছিল কংগ্রেস এবং হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ শাসন করা। নীতিগত কারণে কংগ্রেস ওঁর বাড়ানো হাত গ্রহণ করেনি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, যদি করত তবে বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত হত না এবং সম্ভবত পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যেত না। হক সাহেবই মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন এ কথা ঠিক। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থ যে দাঁড়াবে ভারতবিভাগ, তখন জিন্না সাহেবও এমন কথা চিন্তা করেননি। কিছুদিন লিগের সঙ্গে সহযোগিতায় মন্ত্রিসভা চালিয়ে হক সাহেব শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা করেন। যখন দুর্ভিক্ষের চরম অবস্থায় মেদিনীপুরে সর্বধ্বংসী বন্যা হয়, তখন ইংরাজ বড় আমলারা বেশ কিছুদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। বন্যার খবরটাও কিছুদিন চাপা থাকে। লাটসাহেব ঘটনার তিন সপ্তাহ পরে উড়োজাহাজ থেকে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করে তাঁর কর্তব্য শেষ করেন। মন্ত্রীরা মেদিনীপুর পরিদর্শনে গেলে তাঁদের পদে পদে বাধা দেওয়া হয়। মেদিনীপুর আগস্ট আন্দোলনের এক প্রধান ঘাঁটি ছিল। আমলাতন্ত্রের সৎমা-সুলভ নীতির পিছনে যে মেদিনীপুরবাসীদের শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে কাজ করছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও কারণ নেই। কিন্তু যেসব ঐতিহাসিক ইংরাজ সরকারের দলিলপত্র বেদবাক্য বলে মনে করেন, এ কথা তাঁরা স্বীকার করবেন না। কারণ সাহেবরা তো কোথাও লিখে যাননি যে, তাঁরা বিপ্লবীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মেদিনীপুরে সময়মতো সাহায্য পাঠাননি। আর সময়মতো পাঠাননি, এও তো কুলোকের কথা। কেলে মন্ত্রীগুলো ওইরকমই বলেছে বটে। কিন্তু ভারতীয় নেতারা যে মিথ্যা ছাড়া সত্য বলে না, এ কথা তো সর্বজনবিদিত। পাঠিকা/পাঠক এই যে কথাগুলি লিখলাম, মনে করবেন না এগুলি শুধু আমার বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য। এই ধরনের ঐতিহাসিক আলোচনা আমার স্বকর্ণে শোনা।

ইংরেজ সেক্রেটারি আর বেসরকারি ফোঁপরদালালদের পেজোমি অসহ্য হয়ে ওঠায় শ্যামাপ্রসাদ শেষ অবধি পদত্যাগ করেন। বাংলা ক্যাবিনেটের মিটিং যখন বসত তার এক কৌতুকজনক বিবরণ বিক্রমজিৎ আবিষ্কার করেছেন। এইসব মিটিংয়ে গভর্নর এবং সেক্রেটারিরা এমন ব্যবহার করতেন যে, মনে হত নির্বাচিত মন্ত্রীরা সেখানে উপস্থিত নেই। হক সাহেব উত্ত্যক্ত হয়ে ছোট ছোট কাগজের টুকরোয় শ্যামাপ্রসাদকে বাংলায় নোট পাঠাতেন। শ্যামাপ্রসাদ তা পড়ে দলামোচড়া করে মেঝেয় ফেলে দিতেন। এইসব নোট ইংরাজের টিকটিকিরা সযত্নে সংগ্রহ করে অনুবাদ সহ হুজুরকে পেশ করতেন। একটি চিরকুটে লেখা ছিল, “সুভাষ আসতেছে। এগুলার পিঠের ছাল ছালাইয়া নেবে।”

ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য শ্যামাপ্রসাদের ছিল না। উনি পদত্যাগ করে ব্যবস্থাপক সভায় যেবক্তৃতা দেন তা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পিসেমশায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে অ্যাসেম্বলি হলে বিতর্ক শুনতে যেতাম। সুরাবর্দি আর হক সাহেবের বাচনভঙ্গি বিশেষ ভাল লাগত। কিন্তু তাঁর পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে শ্যামাপ্রসাদবাবুর বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা হয় এমন আর কোনও ভাষণ আমি কখনও শুনিনি। উনি ফজলুল হক সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন যে, তাঁর সঙ্গে কাজ করতে কখনও কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আত্মসম্মান বজায় রেখে কারও পক্ষে গুটিকয় সেক্রেটারি আর তাদের স্যাঙাত কিছু বেসরকারি ইংরাজ ফোঁপরদালালদের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। উনি নানা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দুর্ভিক্ষের জন্য এইসব লোকগুলির দায়িত্ব প্রমাণ করেন, আর কীভাবে তারা পদে পদে মন্ত্রীদের কাজে বাধা দিয়েছে তাও দেখান। এই বিশ্লেষণ অসহ্য বোধ হওয়ায় সভার এক মনোনীত ইংরাজ সভ্য চেঁচিয়ে ওঠে, “তুমি তোজোর কাছে যাও। সেই তোমার রক্ষাকর্তা।” (গো টু তোজো। হি ইজ ইওর সেভিয়ার।) শ্যামাপ্রসাদ উত্তর দিলেন, “দুশো বছর শাসনের পর এই যদি তোমাদের অবদান হয়, তবে তোজো আমাদের রক্ষাকর্তা কি না জানি না, কিন্তু তোমরা যে নও, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।” (আই ডু নট নো ইফ তোজো ইজ আওয়ার সেভিয়ার, বাট ইফ আফটার টু হানড্রেড ইয়ারস্ অফ ব্রিটিশ রুল, দিস ইজ হোয়াট ইউ হ্যাভ গিভন আস, আই নো ফর সার্টেন দ্যাট ইউ আর নট।)

ত্রিশ লক্ষ লোকের প্রাণ নিয়ে, কিছু মানুষকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে ‘৪৩-এর মম্বন্তর হঠাৎই একদিন শেষ হয়ে গেল। স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের গো-মহিষের এক-তৃতীয়াংশও ওই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। ফলে ওই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে বহু বছর লাগে। অঞ্চলটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা যে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল, তা থেকে সম্পূর্ণভাবে আরোগ্য আজও হয়েছে কি না, এ বিষয়ে কারও কারও সন্দেহ আছে।

‘৪৩ থেকে ৪৫—এই দুই বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। লেখাপড়া যেটুকু শিখেছি তার ভিত ওইখানেই হয়েছিল। এবং এর জন্য আমার ব্যক্তিগত ঋণ মুখ্যত একটি মানুষের কাছে। তাঁর নাম সুশোভন সরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *