গরমের ছুটিতে বিষ্ণু তার বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে গেল দার্জিলিং। বাদলকে সে সঙ্গে নিয়ে যাবেই! বিষ্ণু তার বাবা-মায়ের নয়নের মণি, তার কোনও ইচ্ছেই অপূর্ণ থাকে না। বিষ্ণু তার মাকে বলল, মা, বাদল কিন্তু আমাদের সঙ্গে যাবে। না হলে আমি যাব না।
বিষ্ণুর মা ঠান্ডা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, বেশ তো চলুক না! বাদল, তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?
বিষ্ণুর মা বাদলকে যে খুব অপছন্দ করেন, তা নয়। তবে কিছু কিছু রমণী থাকেন এ রকম, যাঁরা নিজের সন্তানের ওপর এত বেশি স্নেহ দিয়ে ফেলেন যে অন্যদের জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বেশি বয়সের ওই এক ছেলে বিষ্ণু, তাই অন্নপূর্ণার আর অন্য কোনও দিকে চোখ নেই। অন্নপূর্ণা বাদলকে বললেন, তুই তোর বাবা-মাকে বলে রাখিস, আমরা আসছে সোমবার যাব। পনেরো দিন থাকব কিন্তু, তোর মা’র জন্য মন কেমন করবে না তো?
বিষ্ণু আর বাদল তখন বসে গেল পরিকল্পনা আঁটতে। বাদল এ-পর্যন্ত কোনও পাহাড় দেখেনি। সমুদ্রও দেখেনি। বড় বড় নদী দেখেছে অতি শৈশবে, মনে আছে অস্পষ্ট। যে কখনও কোনও পাহাড় দেখেনি, তার কল্পনায় যে-কোনও পাহাড়ই হিমালয়ের চেয়েও বিশাল। সেই পাহাড়ের ওপর দার্জিলিং শহর, বাদলের চোখে তা স্বর্গের চেয়েও সুন্দর। বিষ্ণু প্রত্যেক ছুটিতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যায়, এমনকী দার্জিলিংয়েও আগে একবার গেছে, সেখানে ওদের একটা বাড়ি আছে। বিষ্ণুরা একাই যাবে, রেণুরা বা অন্য কাকা কাকিমারা ছেলে-মেয়েরা যাবে না।
বিষ্ণু তাকে শোনাতে লাগল পথের বর্ণনা। বড় ট্রেনের পর ছোট ট্রেন। সেই ছোট ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে বালি ছড়ায় অনবরত, ট্রেনটা খেলনার মতন এঁকেবেঁকে ওঠে পাহাড়ের গা দিয়ে, জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই পাহাড় ছোঁয়া যায়। দাজিলিংয়ে পৌঁছেই ওরা ঘোড়ায় চড়বে। বাদল ঘোড়ায় চড়তে জানে না তো! তাতে কী হয়েছে, এক দিনেই শিখে যাবে। এবার দার্জিলিংয়ে গিয়ে বিষ্ণু একটা কাজ করবেই, বাদলকে সঙ্গে নিয়ে সে চলে যাবে দূরে কোনও একটা অচেনা পাহাড়ে। দুজনে মিলে তার চূড়ায় উঠবে। আগে কারোকে কিছু বলবে না–চূড়ায় পৌঁছে একটা ফ্ল্যাগ পুঁতে দিয়ে নেমে এসে সেই কীর্তির কথা বলে সবাইকে অবাক করে দেবে। বিষ্ণুর কল্পনাপ্রবণ মন এইসব চিন্তায় দারুণ আনন্দ পায়।
বাদলকে শীতের জামাকাপড় নিয়ে যেতে হবে অনেক। তার যদি কোট না থাকে সেজন্য কোনও চিন্তা নেই, বিষ্ণুর দুটো অলেস্টার আছে–একটা সে বাদলকে দিয়ে দেবে। বিষ্ণুর দস্তানাও আছে তিন জোড়া। পাহাড়ে উঠতে গেলে দস্তানা তো লাগবেই। বাদল তক্ষুনি বিষ্ণুর দস্তানা হাতে দিয়ে দেখল, ফিট করে কিনা।
শেষ পর্যন্ত বাদলের যাওয়া হল না। বাড়িতে এসে মাকে বলতেই মা বললেন, তুই দার্জিলিং যাবি কী করে? সে তো অনেক দূর! পঁাড়া, তোর বাবা আসুক, জিজ্ঞেস করে দেখ–
বাদল অনুনাসিক আবদারের সঙ্গে বলল, না, বাবাকে তুমি বলবে। আমি ঠিক যাব বিষ্ণু বলেছে কোনও অসুবিধে হবে না!
মা বললেন, তুই অতদিন ধরে ওদের সঙ্গে থাকতে পারবি? তুই কখনও কোথাও একা থেকেছিস?
বাদল অতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, থাকতে পারব, খুব থাকতে পারব।
কিন্তু দার্জিলিং যেতে তো অনেক টাকা লাগে। অত টাকা আসবে কোত্থেকে?
ন’ বছরের ছেলের পক্ষে টাকার ব্যাপারটা বোঝা অবশ্য কঠিন। সে অবাক হয়ে বলল, বাঃ, টাকা লাগবে কীসে, আমি তো বিষ্ণুদের সঙ্গেই যাব!
সঙ্গে গেলেই বা, ট্রেনের টিকিট কাটাতে হবে না? তা ছাড়া অতদিন বাইরে থাকা—
বাবা বাড়ি না-ফেরা পর্যন্ত জেগে বসে রইল বাদল। ঘুমে চোখ টেনে আসছে, তবু ঘুমোবে না। চিররঞ্জন খেতে বসার পর বাদল সামনে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, বাবা, আমি দার্জিলিং যাব।
চিররঞ্জন মুখ তুলে বললেন, ইস্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে বুঝি?
না, বিষ্ণুদের সঙ্গে যাব। বিষ্ণুর বাবা-মা যাচ্ছেন।
বিষ্ণু কে?
মা বললেন, ওই যে গো রেণু, সেই যে গঙ্গার ঘাটে হারিয়ে গিয়েছিল, তার খুড়তুতো ভাই। বেশ ভালো ছেলে!
চিররঞ্জন ভুরু কুঁচকে বললেন, ওদের সঙ্গে যাবে কী করে? ওদের সঙ্গে কি আমাদের খাপ খায়!
মা বললেন, এত করে যেতে চাইছে, যাক না। কোথাও তো বেড়ানো হয় না! ওর বন্ধুরা যায়–
আশ্চর্যের ব্যাপার, বিকেলবেলা মা বাদলকে দার্জিলিং যাওয়ার বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দিচ্ছিলেন, এখন তিনিই স্বামীর সামনে ছেলের পক্ষ নিয়ে নিলেন। বোঝাতে লাগলেন অনেক করে। কিন্তু চিররঞ্জন মানলেন না। বাদলকে বললেন, সময় তো অনেক পড়ে আছে। বড় হও, লেখাপড়া করো, তারপর নিজেই ওই রকম অনেক জায়গায় বেড়াতে পারবে।
হিমানী রেগে উঠে বললেন, আমি যে এত করে বলছি, সেটা বুঝি তোমার কানে যাচ্ছে না? ছেলেটা এত করে বলছে-কী হয় গেলে? তোমার কোনও ক্ষতি হবে! এমনিতে তো সারা দিনে ছেলের একবার খোঁজও নাও না!
চিররঞ্জন ক্লান্ত ভাবে বললেন, কিন্তু আমি এখন ওকে পাঠাব কী করে? আমার হাতে তো একদম টাকা নেই?
ওদের সঙ্গে একসঙ্গে যাচ্ছে। ওরা কি আর টাকা নেবে?
ওরা টাকা না নিলেও আমি টাকা না দিয়ে আমার ছেলেকে পাঠাব কী করে? আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
হিমানী তখন হাত থেকে দু’ জোড়া সোনার চুড়ি খুলে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে বললেন, তোমার হাতে তো কোনও সময়েই টাকা থাকে না। তা বলে আমার কোনও সাধ আহ্লাদ নেই? তুমি আমার গয়না বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসো!
তখন ঝগড়া লেগে গেল স্বামী-স্ত্রীতে। বাদল আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়াল দরজার কাছে। চিররঞ্জন পুরোটা না খেয়েই উঠে পড়েছেন। বাদলের কান্না পেতে লাগল, তার জন্যই এইসব হচ্ছে। এর আগে সে তো কখনও বোঝেনি টাকা জিনিসটা এ রকম জরুরি। বাবা আর মায়ের ঝগড়ার মধ্যে বেশ কয়েক বার টাকা কথাটার উচ্চারণে তার মাথার মধ্যে ঘা মারতে লাগল। এতকাল তার ধারণা ছিল, টাকা জিনিসটা ছোটদের কাছে থাকে না, শুধু বয়স্কদের কাছে থাকে। তার বাবাও তো বয়স্ক লোক, অথচ বাবার কাছে নেই কেন? ছোট ছেলেরা যেমন মার্বেলগুলি নিয়ে ঝগড়া করে, তেমনই তার বাবা-মাও ওই সাহেবের মুন্ডু ছাপ দেওয়া রূপোর গোল গোল জিনিসগুলোর জন্য ঝগড়া করছে। সে একবার ভাবল, বড়বাবুর কাছে চাইলেই হয়, বড়বাবুর তো অনেক টাকা। আবার সে তীব্র অভিমানের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল, বড় হয়ে সে অনেক অনেক টাকা রোজগার করবে তখন সে প্রত্যেক বছর দার্জিলিং যাবে–তখন তো কেউ কিছু বলতে পারবে না! ·
এদিকে বিষ্ণু বেঁকে বসল, বাদল না গেলে সে কিছুতেই যাবে না। তখন বাধ্য হয়ে বিষ্ণুর মা নিজেই একদিন এলেন এব্রাড়িতে, বাদলের মাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করাতে। তাতেও কোনও ফল হল না। হিমানী কৃত্রিম হেসে অন্নপূর্ণাকে বললেন, না দিদি, বাদল না হয় অন্য কোনও বার তোমাদের সঙ্গে যাবে। এবার কী করে পাঠাই। বটঠাকুর বলছেন, এবার আমাদের সবাইকে নিয়ে কাশী যাবেন–এখনও ঠিক হয়নি অবশ্য, তবু যদি যাওয়া হয়, তা হলে বাদলকে না নিলে…
বাদলের সামনেই এই আলোচনা হচ্ছিল, অথচ বাদল জানে ওকথা সত্যি নয়। প্রিয়রঞ্জনের দেশভ্রমণের বাতিক নেই–তার মতে ওসব নেহাত বাজে খরচ। বড়বাবু মাঝে মাঝেই বেড়াতে যান, কিন্তু একা। একবার বেরোলে কবে ফিরবেন তা-ও বলে যান না। আর চিররঞ্জন ট্রেনে চেপে কোথাও যাবার বদলে কলকাতায় পথে পথে অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরে বেড়াতেই বেশি ভালোবাসেন। প্রিয়রঞ্জন তাঁর ব্যবসার কোনও সংকটের সময় কাশী বিশ্বনাথের কাছে কিছু একটা মানত করেছিলেন সংকট কেটে যাওয়ায় এখন তিনি বিশ্বনাথকে পুজো দিতে যাবেন। প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে যাবার জন্য। বাড়ির কেউ কেউ বায়না তুলেছে কিন্তু প্রিয়রঞ্জন তাতে রাজি নন!
বিষ্ণুরা চলে যাবার পর বাদল কিছু দিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াল। সবাই মিলে তার কাছ থেকে একটা স্বর্গ কেড়ে নিয়েছে। এতদিন তার কল্পনায় দার্জিলিয়ের কোনও অস্তিত্ব ছিল না–কিন্তু বিষ্ণুর সঙ্গে সেখানে বেড়াতে যাবার সব পরিকল্পনা করে ফেলার পরও না-যাওয়া যে কী মর্মান্তিক, তা আর কেউ বুঝবে না। বালকের যুক্তিহীন মনের গহন অভ্যন্তরে যে-বেদনা-অভিমানের আলোছায়া ঘোরে তার মর্ম বোঝার সাধ্য আর কারও নেই। বাদল একা একা চিলেকোঠায় গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলে, টবের ফণীমনসার গাছের কাছে তার দুঃখ জানায়, ট্যাঙ্কের জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করতে করতে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। গঙ্গাজলের ট্যাঙ্কে বহু দিনের মাটি জমেছে এবং আশ্চর্যের বিষয় দুটি ছোট ছোট কাকড়া সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। অন্য সময় বাদল লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কাঁকড়াদুটোকে মারার চেষ্টা করে, কিন্তু এখন সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে যেন ওরা ছাড়া তার আর বন্ধু নেই।
ছেলের মনমরা ভাব দেখে চিররঞ্জন একদিন বললেন, দেওঘরে যাবি? ফ্রেস এয়ার ক্যাম্পের সঙ্গে? দেওঘর খুব সুন্দর জায়গা–বৈদ্যনাথের মন্দির, তপোবন, পাহাড়ও আছে ওখানে–। যদি যাস তো অসীমদাকে বলে দেখি–
চিলড্রেন্স ফ্রেস এয়ার অ্যান্ড এক্সকারশান সোসাইটি নামে একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান ছিল তখন। ধনী ব্যক্তিদের দানে ধন্য এই প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর গরিব ছেলেদের বেড়াতে নিয়ে যেত কোনও স্বাস্থ্যকর জায়গায়। প্রত্যেকের খরচ হত মাত্র পাঁচ টাকা– পড়াশুনোয় যারা ভালো অথচ গরিব, শুধু তাদেরই জন্য। দরখাস্ত পড়ত অনেক, কিন্তু এই ক্যাম্পের যিনি ইনচার্জ থাকতেন সেই স্কাউট মাস্টার অসীম দত্তর সঙ্গে কী সূত্রে যেন চেনা ছিল চিররঞ্জনের।
চিররঞ্জন ছেলেকে দেওঘর পাঠাবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। কিন্তু কী কারণে যেন সেটাও শেষ পর্যন্ত সার্থক হল না। আসলে, চিররঞ্জন নিজেও চেষ্টা করেছিলেন ওই দলের সঙ্গে কোনও ছুতোয় ভিড়ে পড়তে, সেটাতেই অসুবিধে দেখা দেয়। দুর্বল ধরনের মানুষ চিররঞ্জন, ছেলেকে একলা কোথাও পাঠাবার মতন মনের জোর তাঁর নেই। দেওঘর যাওয়া হল না, চিররঞ্জন বুঝতেও পারলেন না, ছেলের কাছ। থেকে তিনি আর একটি স্বর্গ কেড়ে নিলেন। বাদল এর মধ্যেই দার্জিলিংয়ের কথা অনেকখানি ভুলে মনে মনে দেওঘর নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। বিশেষত দেওঘরে তপোবন আছে শুনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিল সে। ওই নাম শুনেই সে মানসচক্ষে দেখতে শুরু করেছিল বাল্মিকীর তপোবন, আহা, বিষ্ণু বেচারা দেখতে পাবে না। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ছোট রামায়ণ’ তখন বাদলের পুরো মুখস্থ। সে একা একা আবৃত্তি করত:
বাল্মীকির তপোবন তমসার তীরে
ছায়া তার মধুময়, বায়ু বহে ধীরে,
সুখে পাখি গায় গান ফোটে
কত ফুল,
কিবা জল নিরমল, চলে কুল–কুল।
মুনির কুটিরখানি গাছের তলায়,
চঞ্চল হরিণ খেলে তার আঙিনায়।…
দেওঘর যাওয়া হল না, সেই তপোবন বাদলের কাছে আরও সুদূরসুন্দর হয়ে রইল।
রেণুদের বাড়িতে গেলেও আর বিশেষ খেলা জমে না। বিষ্ণু নেই, সেই কথাটা সব সময় খচখচ করে। অন্য ছেলেমেয়েরাও অনেকেই এ বছর বেড়াতে গেছে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। রেণুর অসুখ বলে ওরা যেতে পারেনি, কিন্তু সুপ্রকাশদা বন্ধুদের সঙ্গে গেছেন উটকামন্ড।
হৈমন্তী কাকিমার ঘরটা তালাবন্ধ হয়েই পড়ে থাকে। আগে হৈমন্তী কাকিমার সঙ্গে গল্প করতেও কত ভালো লাগত। বিষ্ণু একদিন ফিসফিস করে বাদলকে বলেছিল, জানিস, হৈমন্তী কাকিমা হারিয়ে গেছে?
বাদল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় হারিয়ে গেছে?
বিষ্ণু বলেছিল, সেটাই তো কেউ জানে না। কাকিমা কারোকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে গেছেন। বাপেরবাড়িতেও নেই।
এই বিশাল পৃথিবীতে হারিয়ে যাবার কথা শুনলেই কী রকম যেন অসহায় লাগে। বাদলের খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে সে আর বিষ্ণু ঠিক হৈমন্তী কাকিমাকে খুঁজে বার করবে।
রেণু প্রায়ই অসুখে ভোগে, ঘুরে ফিরেই তার জ্বর হয়। জ্বরে বিছানায় শুয়ে থাকে কয়েক দিন, একটু সেরে উঠলেই আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। গত কয়েক মাসে বেশ রোগা হয়ে গেছে রেণু, শীর্ণ মুখে দুটি টলটলে চোখ, মাথায় সিল্কের মতন কোঁকড়া চুল।
এ বাড়িতে এখন ছেলেমেয়ে মাত্র তিন জন। রেণু, তার ওপরের ভাই অংশুমান আর ওদের জ্যাঠতুতো বোন দীপ্তি। এর মধ্যে দীপ্তি বারো ছেড়ে তেরোয় পা দিয়েছে এবং ফ্রক ছেড়ে প্রায়ই শাড়ি পরে। শরীরেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে দীপ্তির। কিন্তু তার মনটা এখনও অপরিণত রয়ে গেছে। তাই এই নতুন রকমের শরীর নিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারে না। পড়াশুনোয় তার মন নেই বলে ইস্কুল ছেড়েই দিয়েছে প্রায়, তা ছাড়া সে ‘আটক’ করা মেয়ে, অর্থাৎ শোভাবাজারের বোসদের বাড়ির একটি ছেলের সঙ্গে অতি শৈশব থেকেই তার বিয়ে ঠিক করা আছে। সেই ছেলে এখন বিলেতে, আগামী বছর বিলেত থেকে ফিরলেই দীপ্তির বিয়ে হয়ে যাবে। দীপ্তি এসব জানে বলেই তার ব্যবহারটা একটু পাকা পাকা। সে এখন বিকেলবেলা গা ধুয়ে ছাদে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে তাকায় উদাস চোখে, পাড়ার ছেলেরা তার দিকে ইশারা ইঙ্গিত করে। গত বছর বিষ্ণুর জন্য যে মাস্টারমশাই রাখা হয়েছিল, সেই মাস্টারটি নাকি দীপ্তির প্রতি রসস্থ হয়ে কী একটা কাণ্ড করে ফেলেছিল, যে জন্য অবিলম্বে তার চাকরি যায়।
আগে দশবারো জন ছেলেমেয়ে মিলে যে খেলা খেলত, তার অধিকাংশই ছিল ছুটোছুটির খেলা। এখন তিন-চার জনে মিলে খেলার ধরনটা বদলে যায়। এখন হয় বসে বসে ক্যারাম-পেটা অথবা দোকান-দোকান খেলা। তারপরই এসে যায় বর-বউ খেলা। এই খেলাটা দীপ্তিই ওদের শেখায়। দীপ্তি বাদলের হাতটা টেনে ধরে বলে, তুই বেশ বর, আমি বেশ তোর বউ, তারপর বর-বউ কী করে জানিস তো? হি-হি-হি! দীপ্তি হেসে লুটোপুটি খায়, বাদল তার মানে বুঝতে পারে না! তার মনের মধ্যে একটা অস্পষ্ট ধারণা আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে থাকে, একটি ছেলের সঙ্গে একটি ছেলে, আর একটি মেয়ের সঙ্গে একটি ছেলে-এর মধ্যে কী যেন একটা তফাত আছে। মেয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয় না, ছেলের সঙ্গে ছেলের বিয়ে হয় না–শুধু ছেলে আর মেয়েতেই বিয়ে হয়–এটা একটা ঘোর রহস্যময় ব্যাপার। চড়াক চড়াক করে তার মাথার মধ্যে কয়েকটা দৃশ্য ঘুরে যায়। সূর্যদা একদিন বড়দির ঠোঁট কামড়ে দিয়েছিল অথচ বড়দি হাসছিল, এর মানে কী? তার বাবা একদিন তার মাকে–।
অংশুর সঙ্গে বাদলের কিছুতেই বনে না। বয়সের তুলনায় বাদল একটু বেশি লম্বা হয়ে গেছে, তাকে অংশুর চেয়ে বড় দেখায়। অংশু একটু স্বার্থপর ধরনের, আর সব সময় খালি নালিশ করে। খেলতে খেলতেই চেঁচিয়ে ওঠে, মা দেখো, বাদল আমার বই নিয়েছে! মা, বাদল আমার লেত্তি ছিঁড়ে দিল! নালিশ শুনে রত্নপ্রভা এসে ছেলেকেই বকুনি দেন, অংশু তবু খেলার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া করে উঠে চলে যায়। তখনই দীপ্তি বলে, ও যায় যাক! আয় রে আমার বর বউ খেলি! তুই আমার এইখানটায় হাত দে! হি-হি-হি-হি–।
বাদল একলা রাস্তায় বেরোয় না, এ-বাড়িতে আসে সে চাকরের সঙ্গে। চাকরটি বড় ফাঁকিবাজ। অনেক দিন সে বেশ খানিকটা দূর থেকেই বলে, এইবার দাদাবাবু তুমি সোজা চলে যাও! যেতে পারবে তো? আমি দাঁড়িয়ে রইছি, আমাকে আবার বাজার যেতে হবে তো! এই পথটুকু বাদল একা একা হেঁটে আসবার সময় খানিকটা স্বাধীনতার স্বাদ পায়। একদিন দুটো বয়স্ক ছেলে তাকে রেণুদের বাড়ির কাছেই দাঁড় করাল। তারপর বলল, এই খোকা শোন, একটা কাজ করতে পারবি?
বাদলের কাঁধে হাত দিয়ে দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ওরা নানা কথা জিজ্ঞেস করল। রেণুদের বাড়িতে এখন কে কে আছে, বাবা-কাকারা কে কখন বাড়িতে থাকে ইত্যাদি। বাদলের কথায় এখনও একটু একটু বাঙাল টান আছে। ছেলেদুটি সেটা অবিলম্বে বুঝে গেল। একজন আর একজনকে বলল, এ রে মাইরি, এ যে বাঙাল দেখছি! বাঙালের বুদ্ধি তো, সবকিছু না গুবলেট করে দেয়। আর একজন বলল, এই ছোঁড়া, তোকে যা বলব, তাই করবি! এই গল্পের বইটা দীপ্তিকে দিবি, খবরদার অন্য কেউ যেন দেখতে না পায়! কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও কিন্তু কিছু বলবি না। যদি না পারিস, তা হলে কিন্তু কান মুলে দেব!
বাদল বইটা হাতে নিয়েই বুঝল সেটা বড়দের বই। কেন না ছোট ছোট অক্ষর, আর ভেতরে কোনও ছবি নেই, দীপ্তি কি বড়দের বই পড়তে পারে? বইটার মধ্যে একটা আলাদা সাদা কাগজে কী সব হাতে লেখা, বোধহয় চিঠি, বাদল সেটা পড়ার সাহস পেল না। কিন্তু ছেলেদুটির ব্যবহার দেখেই সে বুঝেছিল, এর মধ্যে কিছু অন্যায় আছে। আর কোনও দিন সে চাকরকে না নিয়ে একলা আসবে না।
দীপ্তি বইখানা পেয়েই ঝট করে লুকিয়ে ফেলল। তারপর বাদলের কাছে তার হাজার। প্রশ্ন। বাড়িতে ঢোকার পর বাদলকে কেউ দেখেছে কিনা। বিশেষ করে ছোটকাকা। বইটা বাদলকে কে দিয়েছে, কল্যাণ না সত্যেন? বাদল কারওরই নাম জানে না। দু’জন ছেলে একসঙ্গে ছিল? কী রকম চেহারা বল তো?
যাই হোক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিল দীপ্তি। বাদলের ওপর খুব খুশি হয়ে সে বলল, কী ভালো ছেলে রে! তারপর ফটাস করে সে দিয়ে ফেললে বাদলের গালে একটা চুমো। বাদল ভ্যাবাচাকা খেয়ে গালে হাত দিয়ে দেখল, সেখানে থুতু লেগে আছে। তার ঘেন্না করতে লাগল! দীপ্তিটা একটা কী রকম যেন!
রেণু যখন বেশ কয়েক দিন টানা জ্বরে ভোগে, তখন বাদল গেলে রত্নপ্রভা বলেন, বাদল, লক্ষ্মী ছেলে আমার–আজ তোমরা এই ঘরেই বসে খেলো। তোমরা অন্য। কোথাও গেলে রেণুও উঠে যেতে চাইবে! কিংবা রেণুকে তোমরা গল্প শোনাও নাও বেচারি অ্যাদ্দিন ধরে বিছানায় শুয়ে আছে।
দীপ্তি কিংবা অংশু বেশীক্ষণ বসে না, যে-যার ইচ্ছে মতন উঠে চলে যায়। বাদল রেণুর মাথার পাশে বসে বই পড়ে শোনায়। টম কাকার কুটির’, ‘রবিনহুড’, হেমেন্দ্রকুমারের যখের ধন’, সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’, অ্যান্ডারসনের ‘রূপকথা’।
রেণু তার জ্বর-ছলছল চোখ মেলে একমনে গল্প শোনে। গোটা একখানা বইনা শুনলে বাদলকে কিছুতেই যেতে দেয় না। কান্নাকাটি করে, ওষুধ খেতে চায় না। রত্নপ্রভা বাদলদের বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়ে দুপুরে তাকে সেখানেই খাইয়ে দেন প্রায়ই।
রেণু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে রামায়ণের গল্প শুনতে। বার বার শুনেও তার তৃপ্তি হয় না। বাদল তখন চোখ বুজে আবৃত্তি করে:
দুঃখিনী সীতার কথা শুন তারপর
মায়ের চোখেতে জল ঝরে ঝরঝর
ময়লা কাপড়ে মাতা পড়িয়া ধূলায়
এমন সময়
হনু আইল সেথায়।
হনু বলে, ‘শুন মাগো, মরিল রাবণ
মুছ মা চোখের জল, উঠগো এখন।‘
সুখেতে সীতার মুখে কথা নাহি সরে
পাবেন রামের দেখা এতদিন পরে!
হায় রে দুঃখের কথা কি কহিব
আর–
সেই রাম না করিল আদর সীতার!
কুটি করিয়া তিনি কহিলেন
তাঁরে,
যেথা ইচ্ছা যাও সীতা, চাহি না তোমারে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রত্নপ্রভাও শোনেন। এই অনাত্মীয় বালকটির একমনে কবিতা পাঠ শুনে তার মনের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের মায়া এসে যায়। মনে মনে বলেন, আহা, এ-ছেলেটির ভালো হোক, জীবনে উন্নতি হোক!