খোঁকা ভালো আছে তবে সোময়টো খারাপ
আমার কথাটো রাখলে। কত্তা পরের দিনই শহরে গেল খোঁকার খবর আনতে। কাল রেতে খোঁকার কথা মনে হবার পর থেকে আমার বুকের ভিতর কি যি করছিল সি আমিই জানি। এই একটো জায়গায় খেয়াল করি, ক আমার মনের কথাটো ঠিকই বুঝতে পারে। রাগ-ঝাল যা-ই করুক, কথা শুনে কখনো কখনো মনে হবে, বুঝি মানুষ লয়, পাষাণ–কিন্তু আসল কাজটো শ্যাষ পয্যন্ত ঠিকই করবে।
কত্তা গেল সকালে আর ফিরে এল সাঁঝের টেরেনে। এবার দেখি, মুখে তার হাসি ধরছে না। পেথমে সে খবর দিলে বড় খোঁকা ভালোই আছে। আর বেশি কিছু বললে না। তাপর রেতে য্যাকন সোমায় হলো কত্তা বললে, খোঁকার কাছে যখুনই যাই, কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে যাই সে তো তুমি জাননা। এবার আর তেমন কিছু না নিয়ে শহরের দোকান থেকে এক হাঁড়ি মেঠাই কিনে নিয়ে গেলাম। খোঁকাকে দেখে ভালো লাগল। বোধ হয় নিজের যত্ন নিজে নিতে একটু শিখেছে। হাফ-প্যান্ট আর হাফ-শার্ট পরে আছে, সে দুটি বেশ পরিষ্কার। মনে হয় সেদিনই কাচা। কিন্তু কেচে দেবে কে? তাহলে কি সে নিজেই কেচে নিয়েছে। নিজের হাতে কোনো কাজ তো তোমরা ওকে করতে দাও নাই–ছেলেকে অকম্ম করে রেখেছ। সেই ছেলে শহরে গিয়ে নিজের কাজ নিজে করছে এ কি কম আনন্দের কথা! খোঁকার টেরি-কাটা ছিমছাম চেহারা দেখে খুব ভালো লাগল। আবার একথাও মনে হলো ছেলে বড় হলেই আলাদা মানুষ–সে কি তখন আর বাপ-মায়ের থাকে? খোঁকাও বড় হচ্ছে, চুপ করে থাকলে কেমন গম্ভীর লাগছে।
মেঠাইয়ের হাঁড়ি তার হাতে দিয়ে বলোম, খেয়ো যেন, না খেলে তোমার মা বাড়িতে বসেই জানতে পারবে। মেঠাই তো, ঠিকমতো রাখলে দু-একদিন তা থাকবে। আমার কথায় সে মাথা হেলিয়ে বললে, খাব। জানি তো ওকে, মুখে কথা খুব কম, আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারে না। যাই হোক, আর দু-একটি কথা বলে চলে এলাম, বাইরে এসে খানিক দূরে গিয়েই মনে হলো, এই যাঃ, ভুলে গেলাম খোঁকার হাতে তো কিছু টাকা দিয়ে আসা হলো না! জানি টাকা সে নিজের জন্য কিছুই খরচ করবে না। তবু বাড়ি থেকে দূরে একা থাকে, ওর ছোট চাচা এখন থাকে না। কখন কি লাগে না লাগে এইসব ভেবে কটি টাকা দিতে আবার খোঁকার বোর্ডিংয়ে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি ঘরে সি এক লন্ডভন্ড কাণ্ড। সারা বোর্ডিংয়ের সব কটি ছেলে এসে ঢুকেছে খোঁকার ঘরে। চৌকির ওপর মেঠাইয়ের হাঁড়িটা খোলা–এক-একটি ছেলে আসছে, থাবা দিয়ে মেঠাই নিয়ে মুখে ভরছে, কতক খাচ্ছে, কতক পড়ছে। সে কি হুল্লোড়, সবাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা ঘর জুড়ে আর এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার খোঁকা এইসব দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। সে নিজে কিন্তু তখনো মিষ্টিতে হাত দেয় নাই। বন্ধুরা আনন্দ করে এই মেঠাই খাচ্ছে। তাতেই তার সুখ।
আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই একদম চুপ, যেন পাথর হয়ে গিয়েছে আর তোমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মুখ ভয়ে নীল। আমার দিকে সে তাকিয়ে আছে, তার দুই চোখে যেন পলক পড়ছে না। জানো, খোঁকার ঐ চাউনিটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, সাথে সাথে আমার মনে হলো, আর ভাবনা নাই, ছেলে মানুষ হতে পেরেছে। ওর কাছ থেকে দুনিয়ার কোনো মানুষের কখনো কোনো ক্ষতি হবে না। বি.এ. এম.এ. পাশ দিক আর না দিক।
তাড়াতাড়ি করে আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম, মাথায় হাত দিয়ে বলোম, ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। ভুল তো আমারই হয়েছে, আগে ওরাই খাবে। আমারই বলে যাওয়া উচিত ছিল সবাইকে ঘরে ডেকে নিয়ে আগে খাওয়াতে। তারপরে তো তুমি খাবে। তুমিই ঠিক করেছ, আমার ভুল হয়েছিল। আমি এই কথা বলতেই কি যে একটি হাসি ফুটে উঠল খোঁকার মুখে সে আর কি বলব! সব ছেলে তখন খোঁকাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে–মিষ্টির হাঁড়ি যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। শেষে একটি ছেলে এগিয়ে এসে এক থাবা মিষ্টি নিয়ে খোঁকার মুখে তুলে দিলে। আমিও আর দেরি না করে চলে এলাম। এই হলো যেয়ে তোমার খোঁকার গপ্পো।
কথা শুনে আমার ভাবনা গেল বটে কিন্তুক ই কেমন ছেলে তা নিয়ে আবার ভাবতে বসি। ই তো কিছুই নিজের লেগে রাখবে না, সব দিয়ে দেবে! তাই যেদি সে সারা জেবন করে, তাতে নিন্দে হবে
বরং লোক তার মায়েরই গুণগান করবে এমন ছেলে প্যাটে ধরেছি বলে। কিন্তুক অ্যাকন সে কি যি করে বসে তা কি করে জানব? কত্তা আর কবার যায়? বরং আমার ভাশুর আর ল-দ্যাওরই বেশি যায় খোঁকার কাছে এটো-ওটো নিয়ে। ভাশুরের ছেলেপুলে নাই, দ্যাওরের এখনো বিয়ে-থা হয় নাই, তারা পেরায়ই যেচে ছেলের কাছে। যা-ই নিয়ে যাক, খাবার কি পরার জিনিশ–সিসব তাহলে সে কিছুই নিজের লেগে রাখে না! এইসব কথা ভেবে আমার ভারি দোনোমানো হতে লাগল। একবার মনে হচে এতটো ভালো লয়, শুদু কি জিনিসপত্তরই দেবে, শ্যাষ পয্যন্ত ছেলে সব্বস্ব দিয়ে দেবে! সেই যি সিদিন রেতে কত্তা বললে খোঁকারই বয়েসি কে অ্যাকটো মেয়ে কোথা বন্দুক চালিয়ে বিটিশ মারতে মারতে ধরা পড়ে যেছিল বলে কঠিন বিষ খেয়ে মরেছিল, আমার খালি থেকে থেকে সেই কথা মনে পড়তে লাগল। কি কাল এল মা? দ্যাশ, দ্যাশের লোক চালাইছে, না বিদেশীরা চালাইছে, তা তো ঘরের ভেতর থেকে কিছু বুঝতে পারি না। কে চালালে ভালো হয় আর কে চালালে মন্দ হয়, সি পাল্টাপাল্টি না চালাইলে বুঝবই বা কেমন করে? কত্তা যাকন বলে, তোমার সোংসার তুমি না চালিয়ে আর একজনা ফোপরদালালি করে চালিয়ে দিলে তুমি কি মানবে? ত্যাকন মনে হয়, তাই তো, একবেলা খেচি, আধবেলা খেচি, নিজের খেচি–আর একজনা দরদ দেখিয়ে কোর্মা-পোলাও দিলেই কি ভালো লাগবে? সি কোর্মা-পোলাও কি বিষ-বিষ লাগবে না? আমার হয়ে আর একজন আমার ছেলেকে ভালোবাসলে কি আমার জান ভরবে? লোকে বলে না–সেই যি ভিখ করার নাম করে ডানবুড়ি বাড়িতে ঢুকে লোভ করে ছেলের দিকে চায়, ভিস্থ নিয়ে চাইতে চাইতে চলেও যায় কিন্তু তার পর থেকেই ডাগর-ডোগর ছেলে দিনদিন যি কেমন শুকিয়ে যেচে? ডানের চোখ পড়েছে আর কি রক্ষা আছে? ছেলে শুকুইচে, পেত্যেকদিন শুকুইচে, শুকিয়ে বাঁশপাতা হেন, শ্যাষে বিছেনার সাথে মিশে একদিন দুনিয়া থেকে চলে গেল। ডানের চোখ এমনি, মিছে মায়ের চোখে তাকাইলে কি হবে? ত্যাকন মনে পড়ল দ্যাশের দিকে বিদ্যাশিদের বিলাতিদের তাকানো তাহলে ডানের তাকানো! কত্তার কাছে শুনেছেলম, জানকে জান মনে করে নাই, কতো লোক–সায়েব মারতে গেয়েছে, সায়েব হয়তো মরেছে, হয়তো মরে নাই–নিজের নিজের জান বিলিয়ে দিয়েছে যেন খোলামকুচি। উদিকে যি সায়েব মরেছে কি লোভে সি সাত সমুদ্র পেরিয়ে ই দ্যাশে এয়েছে তা কে বলবে? তা সি-ও তো কুনো না কুনো মায়ের পুত, সেই মা-ও তো একদিন জানবে যি তার বুকখালি হয়েছে!
যিদিন কত্তা আমাদের সবারই লেগে খুব মোটা কাপড় এনে দিলে পরার জন্যে, সিদিন ভারি অবাক হয়েছেলম। খুব দামি কাপড় বাড়িতে আনা হত তা লয়, তবে ওরই মদ্যে এট্টু হালকা-মিহি সুতোর শাড়ি আমরা পরতম। কিন্তুক ই যি ভারী চব্বর, ভিজলে যি গায়ে নিয়ে টানতেই পারব না। কেউ লিকিন আর বিদ্যাশের কুনো জিনিশ ব্যাভার করবে না। কতো জায়গায় বিটিশদের জিনিশ ভঁই করে পুড়িয়ে ফেলছে। এরা বেনে বেসাতির জাত, শ্যাষ পয্যন্ত সব কিছুই উদের ব্যাবসা। সেই ব্যাবসা জব্দ করতে হবে বলে উদের জিনিশ আর কেউ কিনছে না। দিশি জিনিশ খাব, দিশি জিনিশ পরব। মোটা ভাত, মোটা কাপড়। সেই লেগেই এই কাপড়। এই আমাদের পরতে হবে। তা পরছি সেই কাপড়, কত্তারাও পরছে মোটা খদ্দর। তাই বলে বাড়িতে আর চরকায় সুতো কাটতে পারি নাই। যাকগো, কতো হুজুগ দেখলম এই বয়সে।
মাঝে মাঝে মনে করতম, সবকিছু তো আমার লয়, কুনো কুনোটি আমার। সব্বার ছেলে তো আমার লয়, আমারটোই শুদু আমার। আজকাল পেরায়ই মনে হচে কুনো কিছুই শুধু আমার লয়। আমার ছেলেটিও আমার শুদু লয়। ঐ যি মেয়েটি ধরা পড়ার পর মানের ভয়ে কঠিন বিষ খেয়ে মরল, ঐ মেয়েটি কার? উ কি শুদু ওর বাপ-মায়ের? উ কি আমারও মেয়ে লয়? উ আমার হলে দোষ কি। উকেই যেদি জিঙ্গাসা করা হতো, তুমি মেয়েটি কার গো, তাইলে সি মেয়ে কি জবাব দিত? মরবার আগে সি কি বলত, কারু মেয়ে সি লয়, সি ই দ্যাশের সব মানুষের মেয়ে–সি সারা পিথিমির মেয়ে!
ভাবতে ভাবতে কোথা থেকে কোথা চলে অ্যালম, আমার গা শিউরে উঠল। অ্যাতো অস্থির লাগছে ক্যানে? সবকিছু অস্থির। আমাদের গাঁয়ের স্কুলের ছেলেরাও লিকিনি দুদিন পড়া ছেড়ে বেরিয়ে গেয়েছে। দ্যাশে অ্যাকন রাজার আইন না মানা চলছে। স্কুলের কতোটুকুন কতোটুকুন ছেলে–তারাও আইন মানছে না। তাইলে তো শহরেও ইসব হচে। কই কত্তা তো কিছু বললে না। খোঁকা কি তাইলে আবার কত কি ভাবলম। একবার ভাবলাম, খোঁকা এইটুকুন ছেলে, শান্ত–ঠান্ডা। উ আবার কি করতে যাবে? আবার ভাবলম, করলে করুকগো, উ নিয়ে ভাবতে যাই ক্যানে?
তা বললেই কি ভাবনা যায়? দ্যাওর আর ভাইটি অ্যাকন আর শহরে থাকে না। আর ল্যাখাপড়া হলো না তাদের। দ্যাওর বললে, তার আর পড়ায় মন যেচে না, একটো চাকরি-বাকরি পেলে বরং কত্তার পাশে দাঁড়াতে পারবে। সারা জেবন ভাই কি সংসারের বোঝাই শুদু বইবে! সে আর তা হতে দেবে না। এইসব বলে সে। বাড়িতে অ্যাকন বসে আছে। দ্যাওরের এই কথা, কিন্তুক ছোট ভাইটির খুব ইচ্ছা আরও পড়া। তার মাথা ভালো, পড়লে অনেক ওপরে উঠতে পারত। তা হলে হবে কি–খরচ জোগাবে কে? একবার তো এই নিয়ে বাপের সাথে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়েছিল। আর দরকার নাই। তাই সে কত্তার কাছে এসে বললে, কলেজে আর সি ভত্তি হবে না–একটো কুনো চাকরি-বাকরি হয় কিনা চেষ্টা করবে। সি-ও অ্যাকন মামার বাড়িতে ফিরে গেয়েছে।
ঠিক এই সোমায়েই একদিন খবর এল–যা ভয় করেছেলম, তাইখোঁকা স্কুলের আর সব ছেলেদের সাথে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। আইন মানবে না বলে কিসব করতে গিয়েছিল রাস্তায়, সিখান থেকে তাদের দলসুদু ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছে!