১২. খাদ্য যখন রক্ত

১২. খাদ্য যখন রক্ত

আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্সে কাজ করি তখন আমার একজন সহকর্মী ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধ ফেরৎ। একদিন গল্প করতে করতে বলল, “একবার ভিয়েতনামের জঙ্গলে হারিয়ে গেছি–দু’দিন থেকে খাওয়া নেই। তখন একটা গরুকে পেলাম। পেটে ভয়ঙ্কর খিদে তাই গরুর গলার একটা রগ কেটে চুমুক দিয়ে খানিকটা রক্ত খেয়ে নিলাম।” আমি বললাম, “সর্বনাশ! কী বলছ তুমি?” সে বলল, “এত অবাক হবার কী আছে? রক্ত খুব ভালো খাবার, অনেক প্রোটিন।”

কথাটি সত্যি, রক্তে অনেক প্রোটিন। প্রোটিন ছাড়াও রক্তে ধাতব মৌল লোহা থাকে। এই লোহা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে লাল রং ধারণ করে বলে রক্তের রং লাল। কোনো কোনো প্রাণীর রক্তে লোহার বদলে থাকে তামা আর তামা যখন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তখন তার রং হয় নীল। গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া এবং কিছু কিছু মাকড়সার রক্ত এরকম, তার রং নীল। কীটপতঙ্গের রক্তে কোনো ধাতব মৌল থাকে না বলে তাদের রক্ত বর্ণহীন। তেলাপোকা থেঁতলে গেলে যে সাদা বস্তুটা বের হয়ে আসে সেটাই হচ্ছে তার সাদা রঙের রক্ত। তাই সব রক্তই যে লাল সেটা কিন্তু সত্যি নয়।

আমার ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরৎ সহকর্মীর রক্ত খাওয়ার গল্পটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও সেটা কিন্তু পুরোপুরি অবিশ্বাস্য নয়। আফ্রিকার মাসাই সম্প্রদায় গরুর কোনো একটা ধমনি থেকে রক্ত ঝরিয়ে তার সাথে দুধ মিশিয়ে নিয়মিতভাবে খায়। খাবার হিসেবে সেটা চমৎকার!

মানুষ রক্ত খাচ্ছে চিন্তা করলেই আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীর মূল খাবারই হচ্ছে রক্ত। এর মাঝে রয়েছে উকুন, ছারপোকা, এঁটেল পোকা এবং জোঁক।

কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে অনেক মানুষই জোঁককে খুব ভয় পায়, জোঁকের কথা শুনলেই ভয়ে, আতঙ্কে এবং ঘৃণায় তাদের সারা শরীর রি-রি করে ওঠে। কিন্তু কেউ কী জানে একসময় জোঁক ছিল সর্বরোগের চিকিৎসা? জোঁক চিকিৎসার পদ্ধতি হিসেবে এতই জনপ্রিয় ছিল যে 1864 সালে শুধুমাত্র ফ্রান্সেই 2 থেকে 3 কোটি জোঁক ব্যবহার করা হয়েছিল! কেন করবে না? জোঁকের ইংরেজি হচ্ছে Leech আর এটা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় চিকিৎসকের একটা অত্যন্ত প্রাচীন প্রতিশব্দ, যার মানে এক সময় জোঁক ছিল চিকিৎসক।

পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ছয়শ ভিন্ন ধরনের সেঁক রয়েছে, জোঁক একেবারে ছোট কয়েক মিলিমিটার থেকে শুরু করে এক হাত পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। জোঁকের গঠন খুবই সহজ সরল–একটা হচ্ছে মুখ যেদিক দিয়ে খাবার ঢোকে অন্যটা হচ্ছে বহির্গমন পথ! দুটিই আবার চুষনির মতো, শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারে। জোকের চোয়াল তিনটি। সেই তিন চোয়ালে থাকে তিন পাটি দাঁত। কোনো কিছু কামড়ে ধরে যখন সে দাঁত দিয়ে কাটে তখন কাটাটুকু হয় ইংরেজি Y-এর মতো। জোঁকের লালা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় বস্তুর একটি, সেটা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। যখন সে কোনো প্রাণীর চামড়া কামড়ে ধরে রক্ত খাবার জন্যে সেটা কেটে ফেলে সেই প্রাণী কিন্তু মোটেও ব্যথা পায় না। তার কারণ জোঁকের লালায় যে রাসায়নিক দ্রব্য আছে সেটা হচ্ছে ব্যথা নিরাময়কারী, শুধু তাই নয় রক্তের প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্যে সেই লালায় রক্ত যেন জমাট না বাঁধে সেই জিনিসও রয়ে গেছে! জেঁক রক্ত খেয়ে আক্ষরিক অর্থে ঢোল হয়ে যায়। একটা জোক তার শরীরের ওজন থেকে প্রায় নয় গুণ বেশি রক্ত খেয়ে ফেলতে পারে। রক্ত খাওয়া শেষ হবার পর জোঁক তার কামড় ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। ভালো করে এক পেট খাবার পর তার সেগুলো ধীরেসুস্থে হজম করতে হয়।

রক্ত খুব পুষ্টিকর খাদ্য তাই একবার ভালো করে খেলে জেকদের প্রায় কয়েক মাস কিছু খেতে হয় না। (জোঁকের তুলনায় আমরা মানুষেরা নেহায়েতই অগোছালো প্রজাতি–দিনে অনন্ত তিন বার না খেলে আমাদের ভালোই লাগে না!)

জোঁক একই সাথে নারী এবং পুরুষ। নারী দেহে যা থাকা দরকার এবং পুরুষ দেহে যা থাকা দরকার দুটোই তাদের আছে। যখন তাদের সন্তান জন্ম দেবার সময় হয় তখন একটি জোঁক অন্য জোঁককে জড়িয়ে ধরে একজনের ডিম্বাণুকে অন্যের শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত কুরে দেয়। তারপর একটা ছোট গুটলির মতো জায়গায় ডিম পেড়ে কোথাও রেখে দেয়। সেই ডিম ফুটে জোঁকের বাচ্চারা বের হয়ে আসে।

জোঁক নিশ্বাস নেয় তার শরীর দিয়ে। যে সকল জেক পানিতে থাকে তারা পানি থেকে অক্সিজেন নেয়, তাই পানিতে অক্সিজেন কমে গেলে তাদের উপরে উঠে আসতে হয়। নিম্নচাপের সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন একটু কমে আসে বলে জেঁকেরা তখন উপরে ভেসে আসে। প্রাচীন আবহাওয়াবিদরা অনেক সময় এই জোঁকদের দেখে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করত।

তেলতেলে, পিছলে, আঠালো, কিলবিলে জোঁকের জন্য সাধারণ মানুষের ঘেন্নার শেষ নেই, চুষে খাওয়া, শোষণ করা এই ধরনের নেতিবাচক শব্দ তৈরি করতে হলে জোঁকের নামটাই সবার আগে জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে জোঁককে চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারণা করা হয় এটা শুরু হয়েছিল আমাদের এই উপমহাদেশ থেকে। প্রাচীন পৃথিবীতে এই উপমহাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরু ধন্বন্তরীর কাহিনীতে এক হাতে রয়েছে মধু অন্য হাতে জোঁক। প্রাচীন চীনা ছবিতে চিকিৎসার জন্যে জোক ব্যবহারের উদাহরণ আছে। গ্রিক এবং রোমান সভ্যতাতেও চিকিৎসার জন্যে জোঁকের ব্যবহার করা হয়েছে। এত হাজার হাজার বছর থেকে যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে তার মাঝে নিশ্চয়ই কিছুটা হলে সত্যতা রয়েছে এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও সেটা কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছে।

আগে যেরকম সকল রোগের চিকিৎসায় জোক ব্যবহার করা হতো এখন সে রকম নয়! চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন শরীরের ভেতর কী হয় না হয় তার সবকিছু আরও ভালোভাবে জানে তাই জোঁককে সত্যিকার সমস্যা সমাধানে লাগাতে পারে। এরকম একটি সমস্যা হচ্ছে অস্ত্রোপচারে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনঃস্থাপন। 1985 সালে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরে পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চার কান একটা কুকুর কামড়ে আলাদা করে ফেলেছিল। ডাক্তাররা দীর্ঘ সময় ধরে অস্ত্রোপচার করে তার কাটা কানটি পুনঃস্থাপন করেছিল–কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়! রক্ত সঞ্চালনের জন্যে ধমনি শিরা যতটুকু সম্ভব জোড়া দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সেটা ঠিক করে কাজ করে না। ছিন্নভিন্ন ধমনি, শিরা-উপশিরাগুলো থাকে দুর্বল এবং তার ভেতর দিয়ে রক্ত সঞ্চালন হতে চায় না। কাজেই সেখানে রক্ত এসে জমা হয়, সেগুলো কোথাও যেতে পারে না। বস্টনের হাসপাতালের সার্জনেরা তখন বাচ্চার কানে কয়েকটা জোঁক লাগিয়ে দিলেন। ক্ষুধার্ত জোকগুলো জমা হয়ে থাকা রক্ত খেয়ে ক্ষতস্থানটাকে রক্ষা করে দিল। শুধু তাই নয়, জোঁকুগুলো রক্ত টেনে নিচ্ছিল বলে সেখানে রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছিল তাই ক্ষতস্থানটা আরোগ্য লাভ করল অনেক দ্রুত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে অস্ত্রোপচারের পর ডাক্তাররা জোঁক পেলেন কোথায়? তারা কী তাদের অফিসের একজনকে পাশের ডোবায় পাঠিয়ে দিলেন জোঁক খুঁজে আনার জন্যে? সেই মানুষটি কী এঁদো ডোবায় পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জোঁক ধরার জন্যে? যখন জোক ধরল তখন টেনে সেটাকে ছুটিয়ে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলো? আসলে এ রকম কিছু করার প্রয়োজন হয় না, কারণ চিকিৎসায় ব্যবহার করার জন্যে জোঁক কিনতে পাওয়া যায়। বর্তমান বাজার মূল্যে একটা হৃষ্টপুষ্ট (কিন্তু ক্ষুধার্ত) জোঁকের দাম সাত থেকে আট ডলার (প্রায় পাঁচশ টাকা!) চিকিৎসার জন্যে যে জোঁক ব্যবহার করা হয় সেগুলো খুব বড় নয়, তাই একটা জোক দিয়ে হয় না। পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ করতে গোটা পঞ্চাশেক জোঁক লেগে যায়। জোঁক একবার ভালো মতোন রক্ত খেয়ে নিয়ে পরের তিন-চার মাস পর্যন্ত কিন্তু খেতে হয় না বলে একটা জোঁককে বারবার ব্যবহার করা যায় না!

চিকিৎসার কাজে জোঁকের ব্যবহার আবার নূতন করে শুরু হতে যাচ্ছে–এটা আসলে বিচিত্র কিছু নয়। মানুষ অনেক কিছুই প্রাণিজগৎ থেকে শিখেছে কিছু কিছু কাজ এই প্রাণীগুলো মানুষের আধুনিক যন্ত্রপাতি থেকেও অনেক ভালোভাবে করে–কাজেই সেই প্রাণীগুলো ব্যবহার করতে দোষ কোথায়?

মানুষের শরীরের কোথাও যখন পচন ধরে যায় তখন অস্ত্রোপচার করে সেটা পরিষ্কার করা খুব সহজ নয়। তার চাইতে অনেক কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে মাছির ডিম ঢুকিয়ে দেয়া–সেই ডিম থেকে (লার্ভা) কৃমি বের হয়ে, সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে সেগুলো বেছে বেছে পচা মাংস খেয়ে একসময় মাছি হয়ে উড়ে বের হয়ে যায়! বর্ণনা শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিই এটা করা হয়–মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা সত্যিকার ডাক্তাররাই করেন। এই মাছির ডিমও কিনতে হয়– রীতিমতো পয়সা খরচ করে! আমাদের চারপাশের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো, জোঁক যে কত মূল্যবান সেটা যেন কেউ ভুলে না যাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *