নিশাতের মনে হল আজ কোনো কারণে জহির রেগে আছে। জহির খুব সহজে রাগ আড়াল করে রাখতে পারে। প্রচণ্ড রাগ নিয়েও সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে। বিয়ের প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে নি। এখন পারে। চেহারা দেখে বলে দিতে পারে জহির রেগে আছে কি রেগে নেই।
এখন যেমন পারছে। তবে রাগের কোনো কারণ নিশাত ধরতে পারছে না। গত কাল অনেক রাত পর্যন্ত তারা ও-বাড়িতে ছিল। জহির খুব আগ্রহ নিয়ে দুলাভাইয়ের সঙ্গে গল্প করেছে। দুলাভাইয়ের অতি তুচ্ছ রসিকতাতেও খুব শব্দ করে হেসেছে। জহিরের জন্যে ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। তবে বোঝা গেছে সে খুব আনন্দে আছে। আজ এই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কী হল? অফিসে কোন গণ্ডগোল হয়েছে? অফিসের গণ্ডগোলে বিচলিত হবার লোক তো জহির নয়।
নিশাত নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। স্বামীকে লক্ষ করতে লাগল দূর থেকে। জহির অফিসের কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় চা খেতে এল। এটা তার রুটিন। পরপর দু কাপ চা নিঃশব্দে খাবে। কোনো রকম কথা বলবে না। চোখের সামনে থাকবে খবরের কাগজ কিংবা কোনো গল্পের বই। আজ রুটিনের ব্যতিক্রম হল। জহির চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে বলল, বাবার চিঠি পেলাম। আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না। নিশাত, তুমি একটু পড়ে দেখবে?
নিশাত বলল, যে-চিঠির আগামাথা তুমি বোঝ নি, আমি কী করে বুঝব? আমার কি এত বুদ্ধি?
বাবা লিখেছেন, তুমি নাকি তাঁর কাছে একটা চাকরি চেয়েছ। চা-বাগানের চাকরি।
আমার নিজের জন্যে না, অন্যের জন্যে।
কার জন্যে জানতে পারি?
পার। পুষ্পের স্বামীর জন্যে। ঘটনা প্রকাশ হয়ে গেলে ও বেচারা থাকতে পারবে। না। নিরিবিলি কোন জায়গায় তাদের চলে যেতে হবে।
জহির কথা বলছে না। চায়ের কাপেও চমক দিচ্ছে না। সে রাগ সামলাবার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে কি না কে জানে। নিশাত বলল, তোমার চা কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জহির চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে কাপ সরিয়ে রাখল। নিচু গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় না, তুমি সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করছ?
না, তা মনে হয় না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে।
মনে হলে কিছু করার নেই।
ব্যাপারটা তুমি কি ভুলে যেতে পার না? অনেক কিছু তো করলে, আর কেন?
আমি কিছুই করি নি। চিঠিটা পড়ে দেখি।
আমার কোটের পকেটে আছে।
নিশাত উঠে চিঠির খোঁজে ভেতরে গেল। চিঠি নিয়ে এসে আবার বসল জহিরের – সামনে। মানুষটা কী কঠিন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে খাম খুলল।
নিশাত ভেবে পাচ্ছে না তার চিঠির উত্তরে উনি জহিরকে কেন লিখবেন। চাকরি কি দিতে পারবেন না? এই কথা সরাসরি জানাতে সঙ্কোচ করছেন?
শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে নিশাতের সম্পর্ক খুব ভালো নয়। ওদের সবই যেন কেমন আলগা-আলগা। নিশাতের শ্বশুর ইসমাইল সাহেব দশ মিনিট কখনন কারো সঙ্গে কথা বলেন না। নিশাতের সঙ্গে কথাবার্তা হ্যা-র মধ্যে রেখেছেন। তবে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, নববর্ষ—এইসব উপলক্ষে লোক মারফত একটা বড় প্যাকেট এসে। উপস্থিত হয়। সঙ্গে ইংরেজিতে একটা নোটার সারমর্ম, এই আনন্দ তোমার জীবনে অক্ষয় হোক।
জহিরের কাছের চিঠিটিও ইংরেজিতে লেখা। টাইপ করে পাঠিয়েছেন। এই চিঠিরও নিশ্চয়ই কয়েকটি কপি আছে, ফাইল কপি, অফিস কপি। নিশাত চিঠি পড়ল–
প্রিয় জহির,
নিশাত সম্প্রতি আমার কাছে চা-বাগানের একটি চাকরি চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চাকরি কার জন্যে এবং সেই চাকরিপ্রার্থীর অভিজ্ঞতা কী তা লেখে নি। আমি নিজে যাচাই না করে কাউকে চাকরি দিই না। তবে নিশাতের জন্যে একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তোমার স্ত্রীকে আমি খুব পছন্দ করি। তার অনুরোধ নিশ্চয়ই রাখব। তোমাকে এই চিঠি লেখার কারণ হচ্ছে তুমি আমাকে চাকরিপ্রাথী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেবে। সে যেন চা-বাগানে চাকরি চেয়ে একটি দরখাস্ত করে। দরখাস্ত অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হতে হবে। তোমার কাছ থেকে চিঠি। পাবার পর আমি নিশাতকে চিঠি দেব।
ইতি
মোহাম্মদ ইসমাইল।
কাজের চিঠি। তুমি কেমন আছ জাতীয় একটা বাক্য পর্যন্ত নেই। যেন চিঠিটা কোনো মানুষের লেখা নয়, যন্ত্রের লেখা। নিশাত তাকাল জহিরের দিকে। রাগের কঠিন ভঙ্গিগুলি এখন আর জহিরের চেহারায় নেই। সে নিজেকে সামলে ফেলেছে। এখন সে বেশ সহজ ভঙ্গিতে কথা বলবে, যেন দু জনের মধ্যে কখনো কিছু হয় নি।
জহির খবরের কাগজ ভাঁজ করে রেখে হাসিমুখে বলল, চিঠি পড়লে?
হ্যাঁ।
পরে এই চিঠির ব্যাপার নিয়ে আলাপ করব। এখন বল তোমার প্রোগ্রাম কি?
আমার প্রোগ্রাম দিয়ে কী করবে?
তোমার দুলাভাই সবাইকে নিয়ে বড় কোন জায়গায় খেতে চান। নির্ভর করছে। তোমার প্রোগ্রামের উপর। যা ব্যস্ত তুমি। আজ সন্ধ্যায় সময় হবে?
হবে।
ভালো। তোমার দুলাভাই মানুষটি খুব চমৎকার। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আর আমার বোন?
তিনি তোমার মতোই।
আমার মতো বলতে কী মিন করছ? আমি মন্দ না ভালো।
কখনো-কখনো ভালো। কখনো মন্দ।
উদাহরণ দাও। আমি কখন ভালো কখন মন্দ।
কারো সাতে-পাঁচে থাক না। নিজের মতো জীবন যাপন কর। এটা খুব ভালো। আবার কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বাইরের জিনিস নিয়ে মাতামাতি কর, এটা মন্দ।
পুষ্পের ব্যাপারটার কথা বলছ?
হ্যাঁ।
এই ঝামেলা এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের কেইস। খুব দ্রুত হয়। পুলিশ আজকালের মধ্যে চার্জশিট দিয়ে দেবে। বাকি রইল শুধু এক জন। ভালো উকিল।
পাও নি এখনো?
পেয়েছি, আজ কথা হবে।
জহির মুখ নিচু করে হাসছে। নিশাত বলল, হাসছ কেন? হাসির কী বললাম?
তোমার দুলাভাই বলছিলেন, তোমার কিছু করবার নেই, তাই বাইরের যন্ত্রণা নিয়ে মাতামাতি করছ। তোমার দু-একটা ছেলেপুলে থাকলে এটা করতে না। আমাকে
এই লাইনে কিছু সৎ পরামর্শ দিলেন।
পরামর্শ তোমার মনে ধরেছে?
হ্যাঁ। চল একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসি।
নিশাত বাইরের দিকে তাকাল। কী চমৎকার একটা কথা বলেছে—একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসি। একমাত্র বাবা এবং মা এই দুজনে মিলেই অদৃশ্য, অচেনা, রহস্যময় জগৎ থেকে একটা শিশুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন।
কী ব্যাপার নিশাত, এরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার মত নেই?
নিশাত কোমল স্বরে বলল, আমার মত আছে।
বলেই তার কেমন যেন লজ্জা লাগল। চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। লজ্জা ঢাকার জন্যে উঠে বারান্দায় চলে গেল। খুব ইচ্ছা করছে পুষ্পের বাচ্চাকে ধরে এনে কিছুক্ষণ আদর করতে। সময় নেই। উকিলের খোঁজে যেতে হবে। সরদার এ. করিম। ক্রিমিন্যাল আইনের ওস্তাদ লোক। তার হাতে এক বার ব্যাপারটা তুলে দিতে পারলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়।
নিশাত!
কি?
তোমার গোলাপের উবগুলির অবস্থা দেখছ? সবগুলি গাছে পোকা ধরেছে। গত সপ্তাহে তুমি ইনসেকটিসাইড দাও নি, তাই না?
ভুলে গিয়েছিলাম।
তাই দেখছি। জগৎ-সংসার ভুলে যেতে বসেছ। কয়েক দিন পর দেখা যাবে আমার কথাও তোমার মনে নেই।
নিশাত কিছু বলল না। গোলাপগাছগুলির অবস্থা সত্যিই কাহিল। পানিও দেওয়া হয় না। টব শুকিয়ে খটখট করছে। সত্যি খুব অন্যায় হয়েছে। তৃষ্ণায় এদের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল, অথচ পানির কথা কাউকে বলতে পারে না। নিশাত গাছগুলিতে পানি দিল। ওষুধ স্প্রে করে দিল। এই ওষুধটা দেওয়ার সময় কেন জানি তার গা কাঁপে। কঠিন বিষ। অথচ কী সুন্দর সোনালি রঙ। ইচ্ছা করে পরিষ্কার ঝকঝকে একটা গ্লাসে ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে দিতে।
নিশাত।
বল।
চল রওনা হওয়া যাক।
ডিনারের দাওয়াত, এত তাড়া কিসের।
একটু সকাল-সকালই যাওয়া যাক। গল্পগুজব করে ধীরেসুস্থে আবার রওনা হব।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় নিশাত শুনল পুষ্প কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। নিশাতের ব্যাপারটা ভালো লাগল না। কান্না হচ্ছে একটি খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনভাবে কাঁদা উচিত নয় যে অন্য কেউ তা টের পেয়ে ফেলে। কে যেন বলেছিল কথাটি-তুমি যখন হাস তখন দেখবে অনেকেই তোমার সঙ্গে হাসছে, কিন্তু তুমি যখন কাঁদ তখন দেখবে কেউ তোমার সঙ্গে কাঁদছে না। এটা কার কথা? রামকৃষ্ণ পরমহংস, নাকি কবিরের দোঁহা?