1 of 2

১২. কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে

কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে পাঠশালার বারান্দায় দুটো লোক জবুথুবু হয়ে বসে আছে। আজ একেবারে রক্তজমানো ঠান্ডা। থেকে থেকে উত্তুরে হাওয়া মারছে, তাতে ভিতরের প্রাণবায়ুটা পর্যন্ত যেন নিবু নিবু হয়ে আসে। জ্যোৎস্নায় দেখা যায়, নদীর বুকটা খাঁ খাঁ করছে, শুকনো আর সাদা। একধার দিয়ে শুধু নালার মতো একটা জলধারা কষ্টেসৃষ্টে বয়ে যাচ্ছে। নদীর খাত আগে গভীর। ছিল। এখন মাটি আর বালি জমে জমে তা প্রায় মাঠঘাটের সমান উঁচু হয়ে এল। বর্ষার প্রথম চোটেই জলের ঢল উপচে মাঠঘাট ভাসায়, পাঠশালায ক্লাসঘরে গোড়ালিড়ুব জল দাঁড়িয়ে যায়। তাই এখন গ্রীষ্মের বদলে পাঠশালায় বর্ষার লম্বা ছুটি দেয়।

এই পাঠশালা, এই নদী, চারদিকের মাঠঘাট এসব কিছুর সব গল্পই জানে নিতাইখ্যাপা। খুব যত্নে ছোট কলকেয় গাঁজা সাজতে সাজতে বলল, এ জায়গার একটা নেশা আছে। থাকো কিছুদিন, টের পাবে। মেরে তাড়ালেও যেতে চাইবে না।

ধুর! এ তো ব্যাকওয়ার্ড জায়গা।

নিতাই ইংরিজি কথাটা বুঝল না। তবে আন্দাজে ধরল, নিন্দের কথাই হবে। একটু চড়া স্বরে বলল, এ জায়গার মাটির তলায় কী আছে জানো? বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ। তাকে জড়িয়ে আছে সাতটা জ্যান্ত সাপ। মাকালতলার মোড়ে যে বটগাছ আছে, ঠিক তার দেড়শো হাত নীচে। একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে, তা দিয়ে যাওয়া যায়। তবে সুড়ঙ্গের হদিশ কেউ জানে না।

যত সব গুলগপ্পো।

নিতাইখ্যাপা এবার খেপে গিয়ে বলে, আর চাঁদে যে মানুষ গেছে সে গপ্পোটা কী? সেটা গুল নয়? হিমালয় পাহাড়ে মানুষ ওঠার গল্প গুল নয়? নিতাই সব জানে। বেশি বকিয়ো না।

সরিৎ হাসে। বলে, এখানে আর কী কী আছে?

সে অনেক আছে। শুনলে মহাভারত। থাকো, জানতে পারবে।

বলে নিতাই কলকেটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ধরাও। অগ্রে ব্রাহ্মণং দদ্যাৎ। প্রসাদ দিয়ো।

আমার পৈতে নেই, ব্রাহ্মণ-টাহ্মণ আবার কী?

ও বাবা, গোখরো সাপের বিষাত উপড়ে ফেললেই সেটা তেঁাড়া হয়ে যাবে নাকি? পৈতে থাক থাক ব্রাহ্মণ বলে কথা।

কলকেটা নিয়ে সরিৎ সন্দেহের গলায় বলে, খুব কড়া নয় তো! মাথাটাথা ঘুরে গেলে মজা দেখাব।

আরে না। মিহিন ধোঁয়া, ভারী মিষ্টি, শরীরটা গরম হবে, মাথাটা হালকা লাগবে। একটার বেশি টান দিয়ো না, ধোঁয়াটা বেশিক্ষণ ধরে রেখো না।

রাখলে কী হবে?

নেশা করেছ টের পেলে তোমার দিদি আমাকে ঠেঙিয়ে তাড়াবে।

তা তুমি তো হিমালয়ে চলেই যাচ্ছ। তাড়ালে ভয় কী?

সে তো যাবই। খাঁটি জিনিস এখনও সেখানেই পাওয়া যায়। আমাকে এক পোটকা সাধু এসে ভেজাল মাল দিয়ে গেছে। মন্ত্রে তেমন কাজ হচ্ছে না।

সরিৎ খুব আস্তে ন্যাকড়া জড়ানো কলকেয় টান দিল। মিষ্টি, মাতলা ধোঁয়া। ধক করে গলায় লাগল না, কিছু তেমন টেরই পাওয়া গেল না। ফলে আর-একটা জোর টান মেরে ধোয়াটা ধরে রাখল বুকে।

হাত বাড়িয়ে নিতাই কলকেট নিয়ে বলে, সাবধান কিন্তু। ধরা পড়লে আমার নাম কোরো না।

আরে না!–বলে ধোঁয়াটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয় সরিৎ।

নিতাই কলকেটা জুতমতো ধরে বলে, নিতাইয়ের কপালটা খুব ভাল কিনা! যেখানে যত খারাপ ব্যাপার হবে সবাই ধরে নেয় এ নিশ্চয়ই নিতাইয়ের কাজ। তোমার ভেঁপো ভাগনেটা কোথা থেকে খারাপ খারাপ কথা শিখে এসেছে, সে দোষটা পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চালান করল মদনা।

বাণ মারতে পারো না! বাণ মেরে সব ফিনিশ করে দাও।

নিতাই অভিমানভরে বলে, বাণমারা নিয়ে সবাই আমাকে খ্যাপায়। তুমিও নতুন এসেই পেছুতে লাগলে?

সরিৎ বাঁশের ঠেকনোয় মাথা রেখে কুয়াশামাখা আধখানা চাদের দিকে চেয়ে বলল, খ্যাপাব কেন? বাণ মারা জানলে আমিও বিস্তর লোককে বাণ মারতাম।

নিতাই শ্বাসটা সম্পূর্ণ ছেড়ে কলকেয় একটা চুমু খেয়ে মুখ লাগাল, তারপর হাপরের শব্দ করে টেনে নিতে লাগল ধোঁয়া। ধিইয়ে উঠল কলকের আগুন। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বলল, আমিও মারি। কিন্তু মদনা শালা মরে না।

মদনটা কে বলো তো?

ঠিকাদারবাবুকে চেনো না? ভুশুণ্ডির কাক। দেখলেই চিনবে। মল্লিবাবুর সঙ্গে খুব মাখামাখি ছিল।

সরিৎ খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল, মল্লিবাবু লোক কেমন ছিল?

নিতাই আবার টান মেরেছে। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল না। তারপর নাক দিয়ে দুটো সাদা সাপ ছেড়ে দিয়ে বলল, যারা বিয়ে করে না তারা লোক খারাপ হয় না। পুরুষদের খারাপ করে তো মেয়েছেলেরা। যাদের এগারো হাতেও কাছা হয় না।

মেয়েছেলের ওপর তোমার অত রাগ কেন বলো তো?

মা বোন পর্যন্ত মেয়েছেলেরা ভাল। যেই বউ হল অমনি সর্বনাশ।

সরিতের নেশা হয়েছে কি না তা বুঝতে পারছে না। তবে মাথাটা হালকা লাগছে, টলমল করছে। শরীরে তেমন ঠান্ডা টের পাচ্ছে না। বরং একটা যেন হাঁসফাঁস লাগে। তবু সেজদির বাড়ির রহস্যটা জানবার একটা আগ্রহ সে এসে থেকেই বোধ করছে। গত সাত দিনে সে শুধু রহস্যটা টের পেয়েছে। বোঝেনি। এ ব্যাপারে কাউকে প্রশ্নও করা যায় না। কেবল নিতাইখ্যাপার কথা আলাদা।

সরিৎ খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল, মল্লিবাবু বিয়ে করল না কেন?

বিয়ে করেনি তাতে কী? ভালই ছিল। অনেক মেয়েমানুষ ছিল তার। লাইনের ওধারে মঙ্গলহাটের চামেলীর কাছে খুব যাতায়াত ছিল, কলকাতাতেও তো ছিলই শুনি। ফুর্তিতে থাকত। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কোনও বাঁধাবাঁধি নেই।

বিয়ে করবে না তো এত সব সম্পত্তি করতে গিয়েছিল কেন? কার ভোগে লাগবে?

ও হচ্ছে পুরুষ মানুষের একটা নেশা। রোজগার করবে, সম্পত্তির মালিক হবে, এ না হলে পুরুষ কিসের? ভোগের কথা যদি বলল তো ভোগ মল্লিবাবু একাই কিছু কম করেনি।

এত লোক থাকতে সেজো জামাইবাবুকেই বা সম্পত্তি দিয়ে গেল কেন, জানো?

সে অনেক গুহ্য কথা আছে। থাকলে টের পাবে। তবে সম্পত্তি তোমার ভগ্নিপোতের নয়, দিদির।

তাও জানে সরিৎ। সেই শশাকেই কি জামাইবাবু বাড়ি থেকে অনেকটা বাইরের দিকে আলাদা ঘরে পর-মানুষের মতো বসবাস করছে? সেজদির সঙ্গে জামাইবাবুর কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই হয়। এ বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো একটু নির্জীব যেন। গাছপালা, পুকুর, আলো-হাওয়া, প্রচুর খাবার-দাবার সত্ত্বেও বাড়িটায় যেন আনন্দ নেই।

খ্যাপা নিতাই আর কী বলে শোনার জন্য উৎকণ্ঠ হয়ে থাকে সরিৎ।

নিতাই বোম ভোলানাথের মতো চোখ বুজে থাকে খানিক। তারপর গদগদ স্বরে বলে, জয় কালী।

সরিৎকেও গাঁজাটা বেশ ধরেছে। চোখে অনেক ঝিকিমিকি দেখছে সে। শরীরের মধ্যে দে দোল দোল ভাব। চিন্তাশক্তি ঠিক থাকছে না, একটু একটু গুলিয়ে যাচ্ছে বোধভাষ্যি।

কী খাওয়ালে গো নিতাই! বাড়ি যেতে পারব তো! পা টলবে না?

আরে দূর দূর। খুব পারবে বাড়ি যেতে। অত ভয় খেলে কি নেশা করে সুখ আছে? চেপে বসে থাকো, চারদিককার কাণ্ডকারখানা দেখো আর হাসতে থাকো। জয় কালী!

নিতাইয়ের দেখাদেখি চোখ বুজে ধ্যানস্থ হতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তন্দ্রা এসে যায় সরিতের। হালকা মাথাটা বাঁশের ঠেকনোয় কিছুতেই আটকে থাকতে চায় না। ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে।

ঝিমুনি কাটিয়ে চোখ চাইতেই বুঝতে পারে, নিতাই তাকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে।

কী বলছ?

বলি, দিদি তোমাকে মালদা থেকে এখানে আনাল কেন?

কী জানি। লিখেছিল এখানে কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

তা কে জানে! জমিজিরেত সম্পত্তির ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না।

নিতাই একটা শ্বাস ফেলে বলে, শ্রীনাথবাবুও বোঝেন না। বোঝেন বটে তোমার দিদি। জঁহাবাজ মেয়েমানুষ। মল্লিবাবু ঠিক লোক চিনত, তাই শ্রীনাথবাবুর নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যায়নি। গেলে এতদিন পুরোটা ফুঁকো হয়ে যেত।

কেন বলো তো?

সে আর বলে কাজ নেই। শ্রীনাথ কর্তা মল্লিবাবুর দোষগুলো পুরোমাত্রায় পেয়েছেন, গুণগুলো পাননি। এবার বুঝে নাও। আমি এই ছোট মুখে বড় কথা বলতে চাই না বাবা। তবে ঠাকরোনের সঙ্গে ওঁকে মানায় না।

সরিৎ হেসে বলে, তা আমার দিদিও তো মেয়েমানুষ, তারও এগারো হাতে কাছা হয় না।

আ ছি ছি, তোমার দিদির কথা এখানে হবে কেন? ওসব কথা এলেবেলে মেয়েছেলে সম্পর্কে খাটে। ঠাকরোন কি তেমনধারা মেয়েমানুষ?

তবে কেমনধারা?

নিতাই একটু ফাঁপরে পড়ে গিয়ে বলে, তোমার দিদিকে আসলে কেউ আমরা মেয়েছেলে বলে ভাবিই না। সবাই যমের মতো ভয় খাই।

সরিৎ মৃদু-মৃদু হাসে। সেজদিকে কুমারী অবস্থাতেও লোকে একটু সমঝে চলত। লম্বা সুগঠিত চেহারার সেজদির দিকে নজর দিত অনেকেই, কিন্তু ভিড়তে ভয় পেত। একবার সেজদির সঙ্গে রাস্তায় যেতে পিছনে একদঙ্গল ছেলের মন্তব্য কানে এসেছিল সরিতে, এ যা ফিগার মাইরি, সাতটা মিলিটারিও ঠান্ডা করতে পারবে না।

কথাটা শ্লীল নয়, শুনে সরিৎ লজ্জাও পেয়েছিল বটে। কিন্তু কথাটা মিথ্যেও নয়। বলতে কি সেজ জামাইবাবুর আদুরে মোলায়েম চেহারার পাশে সেজদিকে মানায় না। ভাই হিসেবে তার কথাটা ভাবা উচিত নয়, তবু তার মাঝে মাঝে ইদানীং সন্দেহ হচ্ছে, নরম-সরম জামাইবাবু তার পাঞ্জাবি মেয়ের মতো ফিগারওলা সেদিকে ঠান্ডা করতে পারে কি না। কথাটা এই নেশার ঘোরে মনে হওয়ায় হাসিটা চাপতে পারল না সরিৎ। ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। বিয়ের আসরে সেজদি আর জামাইবাবুকে দেখে মুখ-পাতলা বড় জামাইবাবু বলেই ফেলেছিল, এ যে প্রশান্ত মহাসাগরে একটা কাঁচকলা। কথাটা মনে হওয়ায় সরিৎ আবার হাসে। হাসতেই থাকে।

খ্যাপা নিতাই চোখ খুলে গম্ভীর গলায় বলল, হাসছ যে!

একটা কথা ভেবে।

কী কথা?

সে আছে!

নেশাটা খুব ধরেছে তোমায়। বাড়িতে গিয়ে খানিকটা দুধ খেয়ে নিয়ো। নইলে এ নেশায় শরীর শুকিয়ে যায়।

আর কী হয়?

ব্রেন খুব কাজ করে। লোকে গাঁজাখোরকে গাঁজাখোর বলে বটে, কিন্তু মগজকে এমন তরতরে করার মতো জিনিস আর নেই। গাঁজা হচ্ছে কুলোর মতো, ঝেড়ে ঝেড়ে আজেবাজে চিন্তা মগজ থেকে ফেলে দেয়। কাজের জিনিসগুলো রাখে।

কুলোর উপমায় সরিৎ আবার ফিক করে হাসে। বুঝতে পারে, হাসিটা কিছুতেই সে সামলাতে পারছে না। খুব ডগমগ লাগে ভিতরটা। সেজদিকে এখানকার এরা সবাই ভয় খায় জেনেও তার হাসি আসতে থাকে। সে বলে, সেজদিকে তোমরা যে মেয়েমানুষ বলে মনে করো না সেই কথাটা আমি আজই সেদিকে বলে দেব।

নিতাই আবার ফঁপরে পড়ে গিয়ে বলে, তাই কি বললাম নাকি?

তাই তো বললে!

দূর বাপু, তুমি সব কথারই সোজা মানেটা ধরো। এ কথার মধ্যে একটা প্যাঁচ আছে, সেটা তো বুঝবে।

প্যাঁচটা আবার কী?

নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তখন মল্লিবাবু বেঁচে। গুঁতে নামে একটা বিখ্যাত চোর ছিল এ তল্লাটে। গুণী লোক। তার হাত খুব সাফ ছিল। তো সে একবার এ রকম মাঘের রাত্তিরে। তোমাদের দক্ষিণের ঘরে হানা দিয়েছিল। সে ঘরে ঠাকরোন আর তার মেয়েরা শোয়। শ্রীনাথবাবু তখন কলকাতায়। সজলখোকা তখনও হয়নি।

গল্পটা বলতে বলতে নিতাই একবার আঁধারভেদী বেড়ালচক্ষুতে সরিতের মুখখানা দেখে নেয়। শালা শুনছে তো ঠিক? প্যাঁচটা ধরতে পারছে তো?

সরিৎ শুনছে। মন দিয়েই শুনছে। এসব কথাই তো সে শুনতে চায়।

সরিৎ বলল, হুঁ।

নিতাই থুঃ করে কৃত্রিম থুথু ফেলে বলে, তা ঘরে ঢুকতে অবশ্য গুঁতেকে কষ্ট করতে হয়নি। ঠাকরোন বুঝি বাইরে গিয়েছিলেন দরজাটায় শেকল দিয়ে। গুঁতে তক্কেতক্কে ছিল, সেই ফাঁকে গিয়ে ঢুকে মেয়েদের গলার হার, হাতের বালা হাতাচ্ছে।

তুমি তখন কোথায় ছিলে?

আমি তখনও সাধু হইনি। গোলাঘরের পাশে মল্লিবাবু একটা কাঁচা ঘর করে দিয়েছিলেন, সেইখানে মড়ার মতো পড়ে ঘুমোতাম।

তো কী হল?

গুঁতে যখন বেরোতে যাচ্ছে সেই সময় ঠাকরোন উঠোন পেরিয়ে ফিরে আসছিলেন।

উঠোন পেরিয়ে কেন? কলঘর কি তখন উঠোনের অন্যধারে ছিল?

নিতাই একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল। যাক বাবা, ছেলেটা একেবারে গাড়ল নয়। ঠিক ঠিক শুনছে, জায়গামতো প্যাঁচটা ধরতেও পারছে।

নিতাই একটু আমতা আমতা করে বলল, ঠিক তা নয়। ঠাকরোন হয়তো বাড়িটা চক্কর মারতে বেরিয়েছিলেন। খুব ডাকাবুকো মানুষ তো। ভূত-প্রেত চোর-ডাকাত কাউকে ভয় নেই।

উঠোনের এধারে কে থাকত?

নিতাই অবাক হওয়ার ভান করে বলল, কে আবার থাকবে? তখন তো এত ঘর ওঠেনি। উত্তরধারে মল্লিবাবুর সেই ঘর এখনও আছে, উনিই থাকতেন।

সরিৎ মৃদু হাসে। গোলমালটা সে আগেই আন্দাজ করেছিল, এখন ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে। গাড়ল নেতাইটা বুঝতে পারছে না যে, গুহ্যকথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

সরিৎ বলল, তারপর?

ঠাকরোনের হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ছিল। চোখধাঁধানো আলো হত সেটাতে। গুঁতে যেইমাত্র চৌকাঠ ডিঙিয়েছে অমনি ঠাকরোন টর্চটা মারলেন। এঁতে এক লাফে উঠোনে নেমেই ঠাকরোনের হাতের টর্চটা কেড়ে নিয়ে উঠোনে ফেলে দিয়ে দু’হাতে মুখ আর হাত চেপে ধরে বলল, টু শব্দ করলে মেরে ফেলব। গুঁতে ভেবেছিল, মেয়েমানুষকে আর ভয় কী? মতলব ছিল,ঠাকরোনকে ঘরে ভরে দিয়ে বাইরে থেকে শেকল টেনে পালাবে। অন্য সব মেয়েমানুষ হলে তা পারতও। ওই অবস্থায় বেশির ভাগ মেয়েছেলেরই দাঁত কপাটি লাগার কথা। কিন্তু ঠাকরোনের ধাত অন্য। এক ঝটকায় গুঁতের হাত ছাড়িয়ে এমন এক চড় কষালেন গুঁতে সেইখানে বসে পড়ল। আশ্চর্য যে ঠাকরোন কাউকে ডাকাডাকি করেননি, হাল্লাচিল্লা ফেলেননি। সেইখানে পুঁতেকে ধরে লম্বা টর্চখানা দিয়ে এমন উত্তম কুস্তম পেটালেন যে, তার ধাত ছাড়ার জোগাড়।

সাংঘাতিক তো। সেজদির এই সাহসে সরিৎ ভারী বিস্মিত হয়।

সেই তো কথা। কাণ্ডটা মল্লিবাবু তার ঘর থেকে আগাগোড়া দেখেছিলেন।

সে কী? দেখেও বেরোননি?

বেরোননি কেন তার কারণ আছে। পরে বলেছিলেন, আমি তৃষার সাহস আর বীরত্বটা দেখছিলাম। স্বীকার করতে হয়, হ্যাঁ, মেয়েমানুষ বটে। এরকম একজন ঘরে থাকলে পুরুষমানুষের আর চিন্তা-ভাবনা থাকে না।

সেজদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন বুঝি মল্লিবাবু?

খুব। শুনিয়ে শুনিয়েই বলতেন, শ্রীনাথের বউ যেন গোবরে পদ্মফুল। দেখেছ তো মল্লিবাবুকে?

অনেকবার। দারুণ চেহারা ছিল। মিলিটারির মতো।

তবে বলো ঠাকরোনের পাশে মানাত কাকে? ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবু বলি শ্রীনাথ কর্তাকে একেবারে গোবরগণেশ লাগে ঠাকরোনের পাশে। মল্লিবাবুর ঊচেগোটে জম্পেশ চেহারাখানা ছিল। কার্তিকঠাকুরটি নন, রীতিমত খাঁটিয়ে-পিটিয়ে শরীর।

সে কথা ঠিক।

তবেই বোঝে মল্লিবাবু কেন ঠাকরোনের নামে সম্পত্তি দিয়ে গেলেন। জানতেন, এঁর কাছ থেকে লোকে ভয় দেখিয়ে নিতে পারবে না।

লোকে কি চেষ্টা করেছে?

করে আবার নি! বিস্তর করেছে। তবে ঠাকরোনের সঙ্গে এটে ওঠেনি কেউ। গুঁতেকে যেমন হাজতবাস করিয়ে দেশছাড়া করেছিলেন তেমনি আরও অনেক কীর্তি আছে। থাকো, শুনবে।

দু’-চারটে বলল না শুনি।

সে অনেক আছে। লোকে সাধে কি ঠাকরোনকে মেয়েছেলে বলে ভাবে না।

কেউ ভাবে না?

নিতাই আবার মুখটা দেখার চেষ্টা করল। ছেলেটা ল্যাজে খেলাচ্ছে না তো? ভাল মানুষের মতো বলল, ঠাকরোনের সমান সমান পাল্লা টানার মতো মরদ কে আছে বলো! একমাত্র ছিলেন মল্লিবাবু। তার সামনে ঠাকরোন মাথা উঁচু করে কথা বলতেন না।

বটে! বটে!–সরিৎ নড়েচড়ে বসে।

মরদ এ তল্লাটে ওই একজনই ছিল। আর দিনে কালে আর একজনও হয়তো হয়ে উঠবে।

কে? কার কথা বলছ?

সজল খোকাবাবু।

সরিৎ একটু ধাঁধায় পড়ে যায়। সজলকে নিয়ে সে কখনও কিছু ভাবেনি। এখন হঠাৎ ভাবনাটা শুরু হল। ঝিম হয়ে খানিক এলেবেলে চিন্তা ও টলোমলো মাথায় সে সজলের মুখটা ভাববার চেষ্টা করল। তারপরই তার মনে হল, সজলের চেহারাটা বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। হাড়গুলো মজবুত এবং কাঠামোেটাও শক্ত, ভারী জেদি ছেলে। মায়ের শাসনে মিনমিনে হয়ে থাকে বটে, কিন্তু ওর ধাত তা নয়। পরশু কি তার আগের দিনই হবে, সজল মুরগির ঘর থেকে একটা মস্ত মোরগ চুরি করে নিয়ে যায় এবং তার বাবার দাড়ি কামানোর জার্মান ক্ষুর দিয়ে সেটাকে জবাই করে। সেই অবস্থাতেই ফেলে রেখেছিল পুকুরের ধারে। হুলো বেড়ালটা মুখে করে সেটাকে নিয়ে গোলাঘরের পিছনে ঘেঁড়াঘেঁড়ি করছিল। স্বপ্ন দেখতে পেয়ে চেঁচামেচি করায় ঘটনাটা ধরা পড়ে। প্রথমে সজলকে কেউ সন্দেহ করেনি। কিন্তু সেজদি সহজে ছেড়ে দেয়নি, সবাইকে প্রশ্ন করে অবশেষে ঠিক আসামিকে ধরতে পারে। সজল কবুল করেছে সে মাংস খাওয়ার জন্য মোরগটা চুরি করেনি। তবে? তার কোনও জবাব নেই।

খ্যাপা নিতাই বলল, ঠিক মল্লিবাবুর মতো।

কে?

সজল খোকাবাবু।

কথাটার মানে কী নিতাই?

সরিতের গলার স্বরটা হঠাৎ কঠিন হয়ে ওঠায় নিতাই সাবধান হয়ে বলে, কোনও মানে-টানে নেই বাপু। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।

নেশাটা যত জোর ধরেছে বলে ভেবেছিল সরিৎ ততটা নয়। হঠাৎ এই সং-সাজা ভাড়টার ওপর তার রাগ হল প্রচণ্ড। টাপে টোপে বলছিল সে এক রকম কিন্তু এ তো পষ্টাপষ্টি সেজদির কলঙ্ক রটানো।

সরিৎ মালদায় বিস্তর মারপিট করেছে। অনেকগুলো কাজিয়া ছিল না-হক খামোখা। অনেক সময় নির্দোষ লোককেও মেরেছে। আজ একটা মতলববাজ হারামজাদাকে মারলে কেমন হয়?

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ উঠে একটা লাথি চালায় সরিৎ, এই শালা! যত বড় মুখ ন তত বড় কথা।

নিতাই পোঁটলার মতো গড়িয়ে পড়েছে বারান্দা থেকে। পড়েই চেঁচাল, মেরে ফেললে! মেরে ফেললে!

সরিৎ লাফিয়ে নামে। মাথায় আগুন ধরে গেছে। পর পর কয়েকখানা লাথি ঝাড়ল কঁকালে। বলল, শব্দ করলে মেরে চরে পুঁতে ফেলব।

কে শোনে কার কথা। মাটিতে পড়ে খ্যাপা নিতাই গড়ায় আর জটাজুটে ধুলো মাখে আর প্রাণপণে চেঁচাতে থাকে, নির্বংশ হবি। অন্ধ হয়ে যাবি। কুষ্ঠ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *