১২
গেটের ভেতর পা দিয়ে মিসির আলি চমকে উঠলেন। তাঁর মন বলতে লাগল—কিছু একটা আছে এখানে, কিছু একটা আছে। এখানকার পরিবেশ অন্য রকম। বাতাস পর্যন্ত যেন অন্য রকম। বাগানের জোছনাও এক ধরনের ভয় তৈরি করছে। ন’টা বিরাটাকার কুকুর চেন দিয়ে বাঁধা। তারা একসঙ্গে চাপা গর্জন করছে। সেই গর্জনও কেমন অন্য রকম শোনাচ্ছে।
তন্ময় বলল, মাস্টার সাহেব এখনো আছেন। তিনি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, আমি বুঝতে পারছি।
‘তোমার মাস্টারের নাম কি তন্ময়?’
‘নাম জানি না।’
‘নাম জান না তার কারণ তার কোনো নাম নেই—কারণ সে নিজেই নেই। তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি একা যাব। তারপরে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’
‘স্যার আপনি যাবেন না।
‘আমাকে যেতেই হবে।’
‘স্যার, মাস্টার সাহেবের অনেক ক্ষমতা।’
‘এই ক্ষমতা তুমি তাঁকে দিয়েছ। ক্ষমতা কেড়ে নেবার সময় হয়েছে। তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।’
.
মিসির আলি এগিয়ে গেলেন। চাঁদের আলোয় দোতলা বারান্দা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মিসির আলি রেলিঙে হেলান দিয়ে একজন নগ্ন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তামাকের কটু গন্ধও পেলেন। মিসির আলি দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছায়ামূর্তি শীতল গলায় বলল, কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?
‘ভালো।’
‘আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি।’
‘আমি আছি না নেই?
‘আপনি নেই।’
‘তা হলে দেখছেন কী করে?’
‘আমার দৃষ্টি বিভ্রম হচ্ছে। শারীরিক দিক থেকে আমি খুবই অসুস্থ। তার ওপর তন্ময়ের গল্প আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে বলেই হেলুসিনেশন হচ্ছে।’
‘বাহ্, যুক্তি সাজিয়েই এসেছেন!’
‘আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষ, মাস্টার সাহেব।’
‘আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবার খুব শখ ছিল—আপনি আমার ছাত্রের সমস্যা এত দ্রুত এবং এত সহজে ধরবেন তা আমি বুঝতে পারি নি। আমি আপনার চিন্তাশক্তির প্রশংসা করছি।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘একটি মজার জিনিস কি আপনি লক্ষ করেছেন মিসির আলি সাহেব? আপনি তন্ময়ের শিক্ষক। আমিও তার শিক্ষক। আমি তাকে তার সমস্যা থেকে রক্ষা করার জন্যে আছি। আপনারও একই ব্যাপার।
‘তাই তো দেখছি।’
‘আমি প্রচুর সিগারেট খাই আপনিও খান। খান না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উঠে আসুন না। নাকি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’
মিসির আলি বললেন, আমি যদি আপনাকে ভয় পাই, তা হলে লজিক বলছে— আপনিও আমাকে ভয় পাবেন।
‘হ্যাঁ, লজিক অবিশ্যি তাই বলে। হ্যাঁ মিসির আলি সাহেব, আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি।’
মিসির আলি সিঁড়ির গোড়ার কাঁটাতারের গেটে হাত দিলেন এবং মনে মনে বললেন, তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। You do not exist. তিনি আবারো তাকালেন। বারান্দায় কেউ নেই। ফাঁকা বারান্দায় সুন্দর জোছনা হয়েছে। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস আসছে। তিনি উঁচু গলায় ডাকলেন, তন্ময় এস!
তন্ময় আসছে। সে আগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। এখন আর হাঁটছে না। সে দোতলায় উঠে এল। সে দাঁড়িয়ে আছে মিসির আলির কাছে। দেব-শিশুর মতো কী সুন্দর মুখ! ঘন কালো চোখ, দীর্ঘ পল্লব।
মিসির আলি মনে মনে বললেন, প্রকৃতি অসুন্দর সহ্য করে না। তারপরেও অসুন্দর তৈরি করে, অসুন্দর লালন করে। কেন করে?
তন্ময় কাঁদছে। তার চোখ ভেজা। মিসির আলির ইচ্ছা করছে ছেলেটিকে বলেন, তুমি কাছে এস, আমি মাথায় হাত রেখে তোমাকে একটু আদর করি।
তিনি বলতে পারলেন না। গভীর আবেগের কথা তিনি কখনো বলতে পারেন না। মিসির আলি তাকালেন উঠোনের দিকে—কামরাঙা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা গলে গলে পড়ছে। কী অসহ্য সুন্দর!