এবারে কিছু পুরোনো আমলের গালগল্প করা যাক।
দিল্লীর বাদশাহের সনদ নিয়ে খান জাহান আলী নামে একজন সেনাপতি এসেছেন যশোর শাসন করতে। এই খান জাহান আলীকে অবশ্য আমাদের বিশেষ প্রয়োজন নেই, আমাদের আগ্রহ তাঁর এক কর্মচারী সম্পর্কে। তবু খান জাহান আলীর উল্লেখের প্রয়োজন হলো, কারণ এই ব্যক্তিটির নাম আছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়, ইনি মারা যান ১৪৫৮ খৃষ্টাব্দে, তখনও চৈতন্যদেব জন্মাননি।
তৎকালে বাঙালীদের নামের সঙ্গে কোনো পদবী যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ ছিল না। গোত্র এবং গ্রামের পরিচয়েই মানুষের পরিচয়। খান জাহানের সেই কর্মচারীটির সঠিক নামও আমরা জানি না। সে ব্ৰাহ্মণের ছেলে। নবদ্বীপের কাছে পিারল্যা গ্রামে তার জন্ম। সে এক সুন্দরী মুসলমান রমণীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হলো। সেই প্ৰণয় এমনই তীব্ৰ যে তার জন্য সে জাত ধর্মবিসর্জন দিতেও প্ৰস্তুত। হিন্দু ধর্ম এমনই কঠোরভাবে গণ্ডীবদ্ধ যে সেখানে অন্য ধর্মের মানুষের কোনোক্রমেই প্রবেশ অধিকার নেই। ব্ৰাহ্মণের ছেলে যবনী বিবাহ করলে তার স্ত্রীকে তো কোনোক্রমেই হিন্দুত্বে বরণ করা যাবে না, বরং সে ছেলেটিরই জাত যাবে। সুতরাং প্রণয় পরিণামে এই ব্ৰাহ্মণ সন্তানটি জাতিভ্ৰষ্ট হলেও তার নতুন নাম হলো মামুদ তাহির। সে পিারল্যা গ্রাম থেকে এসেছে বলে আগে তাকে পিরালীয়া বলে ডাকা হতো, এই নামটিরও একটি চমৎকার মুসলমানী রূপ পাওয়া গেল, পির আলী।
হিন্দু ধর্ম নতুন কারুকে গ্ৰহণ করে না বরং নিজের লোকদেরই পরধর্মের দিকে ঠেলে দেয়, পৃথিবীর অপর ধর্মগুলি কিন্তু নবাগতদের সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। এমনকি অনেক সময় কিছু কিছু পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করে। ধর্মান্তরিত হবার পর পির আলী তার প্রভুর নেকনজরে পড়লো এবং বখশিস হিসেবে পেয়ে গেল একটি পরগণা। সেই পরগণাটির নাম চেঙ্গুটিয়া।
ক্রমে এই পরগণাদার পির আলী বেশ একটি মান্যগণ্য লোক হয়ে উঠলো এবং প্রায়ই ধুমধাম করে নানারকম উৎসবের আয়োজন করতো।
কথায় বলে, নতুন মুসলমান গোরু খাওয়ার যম। পির আলী নিজে তো খেতেনই, উপরন্তু সকলকে গো-মাংস ভক্ষণের উপকারিতা বিষয়ে নানা কথাবার্তা শোনাতেন। কিন্তু চেঙ্গুটিয়া পরগণাটি হিন্দুপ্রধান এবং এখানে বেশ কিছু ব্ৰাহ্মণের বাস। সুতরাং পির আলীর মতামত সহজে জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা ছিল না।
কামদেব ও জয়দেব নামে দুই ব্ৰাহ্মণ দেওয়ানী করতো। এই পির আলীর অধীনে। একদিন তারা তাদের সহৃদয় প্রভুর সঙ্গে একটি অপ্রত্যাশিত রসিকতা করে ফেললো। সেইটিই তাদের জীবনের মহত্তম ভুল। অথবা, ভুলই বা বলছি কেন, এইসব ঘটনাই তো ইতিহাসের কৌতুক।
রোজার মাস, উপবাসী পির আলী তাঁর পাত্ৰমিত্রদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করছেন, তাঁর হাতে একটি গন্ধ লেবু। মাঝে মাঝে সেটি নাকের কাছে এনে শুকছেন তিনি। এমন সময়ে কামদেব ও জয়দেবের মধ্যে একজন কেউ বললো, উজির সাহেব, আপনার আজকের রোজা তো ভঙ্গ হয়ে গেল!
বিস্মিত পির আলীকে সে আরও বুঝিয়ে দিল যে, তাদের শাস্ত্ৰমতে ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম। সুতরাং রোজার মাসের নিয়মরক্ষা হলো না।
এই শুনে পির আলী হাসলেন। সেই হাসির মধ্যে গভীর মতলব ছিল।
এরপর একদিন পির আলী তাঁর দরবারে বহু হিন্দুকে নিমন্ত্রণ করে কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ ভৃত্যদের কী এক ইঙ্গিত করলেন। অমনি ভৃত্যরা অনেকগুলি জ্বলন্ত উনুন নিয়ে এলো সভাকক্ষে, সেইসব উনুনের ওপর কড়াইতে গো-মাংস রান্না হচ্ছে। লোকশ্রুতি এই, সেদিন পির আলী এক শত গো বধ করেছিলেন।
গো-মাংসের গন্ধ পেয়ে অনেক হিন্দু নাকে কাপড় দিলেন, অনেকে সভা ছেড়ে পালালেন। কিন্তু পির আলী চেপে ধরলেন কামদেব আর জয়দেবকে। তিনি বললেন, তোমরা পালাচ্ছে কেন? তোমাদেরই শাস্ত্ৰমতে তোমাদের অর্ধেক ভোজন হয়ে গেছে এবং সেই অনুযায়ী তোমাদের জাত গেছে। সুতরাং আর চক্ষুলজ্জা রেখে লাভ কী? আমার পাশে বসে বাকি ভোজনটাও সেরে নাও!
ধর্মান্তরিত হবার পর কামদেব আর জয়দেবের নাম হলো কামালউদ্দিন ও জামালউদ্দিন। এবং উপহার পেল জায়গীর। কিন্তু ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনের মতন, হিন্দু পরিবারের অর্ধেক মুসলমান হলে বাকি অর্ধেকও নিষ্কৃতি পায় না। কামদেব, জয়দেবের আর দুই ভাই ছিল, তাদের নাম রতিদেব আর শুকদেব। সমাজ খড়গহস্ত হলো এদের প্রতি, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে জল-অচল হলো এবং পির আলীর নামের সুবাদে এদের পরিবারের নামের সঙ্গে পিরালী অপবাদ যুক্ত হয়ে গেল। লোকে এদের পুরোপুরি ব্ৰাহ্মণ বলে না, বলে পিরালীর বামুন।
আত্মীয়স্বজনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এই দুই ভাইয়ের মধ্যে রতিদেব গৃহত্যাগ করলো। খুব সম্ভব তার কোনো পুত্রকন্যা ছিল না, তাই বৈরাগ্য গ্ৰহণ তার পক্ষে সহজ হয়েছিল। কিন্তু শুকদেব পড়লো মহা বিপদে।। তার নিজের বিবাহযোগ্য কন্যা রয়েছে। এক ভগ্নীরও তখনো পর্যন্ত বিবাহ দেওয়া হয়নি। পরিবারে খুঁত লেগে গেছে বলে এই দুই কন্যার বিবাহের জন্য কোনো পাত্র পাওয়া যায় না। তখন শুকদেব সমাজের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলো তার শেষ অস্ত্ৰ, যার চেয়ে অমোঘ অস্ত্র আর হয়। না। টাকা দিয়ে সে কিনে ফেললো দুজন ব্ৰাহ্মণকে। শুকদেবের ভগ্নীর বিবাহ হলো ফুলে গ্রামের মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং কন্যার স্বামী হলো পিঠাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারী। যৌতুক হিসেবে উভয়েই পেল প্রচুর জমি ও ধন। পরবর্তীকালে শুকদেব, মঙ্গলানন্দ, জগন্নাথদের সন্তানসন্ততিরা সকলেই পিরালীর ব্ৰাহ্মণ বলে চিহ্নিত হয়ে রইলো।
সকলের কথা থাক, আমরা শুধু জগন্নাথ কুশারীকেই অনুসরণ করি। যেমন গাঙ্গুল গ্রামের ব্ৰাহ্মণের গাঙ্গুলী, সেইরকমই কুশ গ্রামনিবাসীরা কুশারী। এই কুশ গ্রামটি বর্ধমান শহরের কাছে। ক্রমে এই কুশারীরা বাঁকুড়ার সোনামুখী, খুলনার পিঠাভোগ এবং ঢাকার কয়কীর্তন গ্রামেও বসতি নেয়। অথবা বলা যায়, সেইসব গ্রামের গ্রামীণ বা গাঞী হয়। আমাদের এই কাহিনীতে, পিঠাভোগের কুশারীদের গুরুত্ব অনেকখানি।
এই কুশারীরা সুদীর্ঘ বংশগীরব দাবী করতে পারে। আদিশূর নামে গৌড়ের জনৈক রাজা, যিনি পৌরাণিক না ঐতিহাসিক তা বলা শক্ত, (আমরা এ পরিচ্ছেদের শুরুতেই এসব কাহিনীকে গালগল্প বলে অভিহিত করেছি) কনৌজ থেকে পাঁচজন খাঁটি ব্ৰাহ্মণ আনিয়েছিলেন। ধরে নেওয়া যায়, গৌড় বাংলা তখন ছিল অনার্য অধ্যুষিত। এই পঞ্চ ব্ৰাহ্মণ থেকেই শাণ্ডিল্য, ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, বাৎস্য এবং সাবর্ণ গোত্রের উদ্ভব। উত্তরকালে এইসব গোত্র বিভাগ প্রচুর জটিলতার সৃষ্টি এবং অনাসৃষ্টি করেছিল।
শাণ্ডিল্য গোত্রের প্রথম পুরুষ ক্ষিতীশের এক পুত্রের নাম ভট্টনারায়ণ, যিনি প্রখ্যাত সংস্কৃত নাটক বেণী সংহারের রচয়িতা বলে অনেকের ধারণা। সেই ভট্টনারায়ণের বংশধর আমাদের আলোচ্য কুশারীরা। মূল শাণ্ডিল্য গোত্রের জন্য এদের বন্দ্যঘটী বা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু গাঞী নিরিখে এঁরা কুশারী।
এমত বংশগৌরব থাকলেও যবন সংসৰ্গ হেতু পিঠাভোগের কুশারীদের পিরালী নাম অর্শে গেল। ধর্ম ও সমাজপতিদের অত্যাচার তাদের সইতে হয়েছে বহু প্ৰজন্ম ধরে। অনেক কাল পরে তারা এর শোধ নেয়।
এবার কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে আসা যাক। ঐ কুশারী বংশেরই এক সন্তান পঞ্চানন এবং তাঁর খুল্লতাত শুকদেব আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাদ করে স্বগ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্যান্বেষণে। ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এসে পৌঁছেলেন গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কাছে। খাটো জাতের ব্ৰাহ্মণ হলেও তাঁদের সাজ-পোশাকের কোনো ত্রুটি ছিল না। পরিধানে পট্টবস্ত্ৰ, মাথায় স্কুল শিখা এবং ললাটে চন্দন, গাত্রবর্ণ অতিশয় গৌর। দেখলেই ব্ৰাহ্মণ বলে চেনা যায়। গোবিন্দপুরের খাঁড়ির পাশে তখন শুধু কয়েক ঘর জেলে, মালো, কৈবর্তের বাস। ব্ৰাহ্মণ দেখে তারা ষষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করলো এবং সেখানেই অধিষ্ঠিত হবার অনুরোধ জানালো। গ্রামের মধ্যে ব্ৰাহ্মণদের আশ্রয় দেওয়া একটি বড় পুণ্যকর্ম।
সেই গোবিন্দপুরের খাঁড়ির নামই ইদানীং আদি গঙ্গা বা টালির নালা। গোবিন্দপুর, সুতানটি এবং কলকাতা নামে তিনটি গ্রাম জুড়ে ইংরেজরা তখন নতুন একটি শহরের পত্তন করছে। এই খাঁড়ি দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য এটিকে কেটে প্রশস্ত করা হচ্ছে এবং গ্রামের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য সাহেবরা যখন আসে তখন গ্রামের জেলেরা নিজেরা কথা বলার সাহস না পেয়ে ব্ৰাহ্মণ দুজনকে এগিয়ে দেয়। ব্ৰাহ্মণ দেবতুল্য, তাই গ্রামের মানুষ তাঁদের ঠাকুর বলে ডাকে। সাহেবরা সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না বলে, তারা বলে টেগোর। কুশারী ও পিরালী পরিচয় মুছে ফেলে পঞ্চানন ও শুকদেব ঠাকুর হয়ে গেলেন।
এই ঠাকুররাই কলকাতার আদিযুগের স্টিভেডর এবং কন্ট্রাক্টর। প্রথম প্রথম পঞ্চানন ও শুকদেব সাহেবদের জাহাজে মালপত্র সরবরাহ করতেন। তারপর সাহেবদের সঙ্গে ভালোমতন পরিচয় হয়ে যাওয়ার ফলে আরও নানারকম কাজের ভার পেতে লাগলেন তাঁরা। নতুন শহরে তখন অনেক প্রকার কর্মোদ্যম চলছে। বর্গীর হাঙ্গামা থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাটা হলো মারহাট্টা ডিচ। সিরাজউদৌল্লা হঠাৎ এসে কলকাতার কেল্লা গুড়িয়ে দেবার পর ইংরেজরা ময়দানের ফাঁকা জায়গায় মজবুত করে তৈরি করে নতুন কেল্লা বা ফোর্ট উইলিয়াম। এইসব কাজের ঠিকাদারির ভার পায় ঐ দুই ঠাকুরের পুত্ৰ ও পৌত্রেরা। ঠাকুরদের তখন এতই ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, শোনা যায় দুৰ্গম বন জঙ্গল সাফ করে তাঁরা যেখানে একটি বাগানবাটি প্রস্তুত করেন, পরে সেখানেই তৈরি হয়েছিল ঐ নতুন কেল্লা। পরবর্তীকালে এই বংশের আর দুই উল্লেখযোগ্য ভ্রাতার নাম নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ। দুজনেই যথেষ্ট ধনাঢ্য, তবে নীলমণি অনেক বেশী কর্মবীর। গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কিনারা ছেড়ে ঠাকুরেরা এখন চলে এসেছেন মেছোবাজারের পাথুরিয়াঘাটা নামের অভিজাত পল্লীতে। ছোট ভাইকে সংসার দেখাশুনোর ভার দিয়ে নীলমণি প্রায়ই বাইরে বাইরে কাটান। ইংরেজ কোম্পানীর সঙ্গে তিনি চাকুরিসূত্রে আবদ্ধ। কখনো তিনি যান চট্টগ্রামে, কখনো উড়িষ্যায়। অথোপার্জনের উদ্দেশ্য ছাড়াও তাঁর চরিত্রে দুঃসাহস ছিল যথেষ্ট। দেওয়ানি কাজে সেকালে অথাগম হতো বিস্তর। সমস্ত টাকা নীলমণি পাঠিয়ে দিতেন ছোট ভাইয়ের কাছে।
এক সময় চাকরি ত্যাগ করে নীলমণি গৃহে ফিরলেন। সেখানে তাঁর জন্য এক বিরাট অশান্তি অপেক্ষা করে ছিল। তাঁদের গৃহে তখন অতুল বৈভব। কিন্তু ছোটভাই দর্পনারায়ণ দাবী করলেন যে এর অধিকাংশই তাঁর নিজের উদ্যোগ ও বিচারবুদ্ধির ফল, এর মধ্যে নীলমণির অংশ সামান্যই। নীলমণি বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছেন বটে, কিন্তু দর্পনারায়ণই নিজ কৃতিত্বে সম্পত্তি বহুগুণ করেছেন।
ভ্ৰাতৃবিরোধ এক সময় এমনই চরমে উঠলো যে এক বিষরি রাতে নীলমণি তাঁর স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার হাত ধরে এবং গৃহদেবতা নারায়ণশিলা সঙ্গে নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আর কোনোদিন ফিরবেন না। দর্পনারায়ণ তাঁর দাদার হাতে নগদ এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছেন এবং তাঁকে দিয়ে স্বীকার করে নিইয়েছেন যে বসতবাটি এবং ভুসম্পত্তির ওপর নীলমণির আর কোনো অধিকার রইলো না।
বৃষ্টিময় অন্ধকার রাতে নীলমণিকে অবশ্য সপরিবারে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হলো না। ব্ৰাহ্মণকে ভূমিদানের পুণ্য অর্জনের জন্য তাঁদের আশ্রয় দিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত ধনপতি। এর নাম শেঠ বৈষ্ণবচরণ। এ বৈষ্ণবচরণ ধনী হয়েছিলেন গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে। হিন্দুদের বিবাহ থেকে শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত, এবং প্রতিদিনের পুজোআচ্চায় গঙ্গাজলের প্রয়োজন, এমনকি আদালতেও শপথ নেবার সময় গঙ্গাজল স্পর্শ করতে হয়। মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি ভর্তি গঙ্গাজল চালান যেত গঙ্গাবর্জিত অঞ্চলে। দুধে ভেজাল মিশ্রণের চল না হলেও তখনই নিশ্চিত গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে নানারকম কারচুপি ছিল, যে-কারণে অন্যান্য গঙ্গাজল ব্যবসায়ীদের তুলনায় শেঠ বৈষ্ণবচরণের নামাঙ্কিত শিলমোহর করা গঙ্গাজলই ছিল বেশী বিশ্বাসযোগ্য। এমন কি সুদূর তেলেঙ্গানার রাজাও গঙ্গাজল নিতেন এঁর কাছ থেকে।
জোড়াসাঁকো অঞ্চলে শেঠ বৈষ্ণবচরণ প্রদত্ত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ঠাকুর বংশের দ্বিতীয় শাখাঁটি। নিজে আরও জমি কিনে ক্রমে ক্রমে নীলমণি সেখানে তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব প্ৰাসাদ।
নীলমণির তিনটি সন্তান। জ্যেষ্ঠের নাম রামলোচন। পিতার মৃত্যুর পর রামলোচনের ওপর পড়লো সংসারের ভার এবং তিনি দক্ষতার সঙ্গেই সে কার্য সম্পন্ন করতে লাগলেন। ছোট দু ভাইয়ের পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণও করেন তিনি। এবং কিছু কিছু জমিদারি কিনে তিনি আস্তে আস্তে কলকাতার ধনী সমাজে নিজের স্থান করে নেন। রামলোচন ছিলেন শৌখিন এবং বিলাসী পুরুষ। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও অপরাহ্নে তিনি একবার, হাওয়া খেতে বের হবেনই। পরনে লম্বা কোতা দোপাট্টা ও তাজ, অর্থাৎ মুকুটের মতন পাগড়ি। গৃহের সামনে নিজস্ব তাঞ্জাম প্রস্তুত, সেই তাঞ্জামে চড়ে তিনি ময়দানের দিকে যান বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করার জন্য। পরিচিত আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবরাখবর নেওয়াও ছিল তাঁর অভ্যোস। ততদিনে দুই ঠাকুর পরিবারের বিবাদ মিটে গেছে, রামলোচন প্রায়ই যান পাথুরিয়াঘাটের বাড়িতে, পিতৃপুরুষের ভদ্রাসন দেখে আসেন। আসা-যাওয়ার পথে যতগুলি দেবালয় পড়ে, সব জায়গাতেই নেমে তিনি ভক্তিভরে প্রণামী দেন।
মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে বসে মজলিশ। রামলোচন ঠাকুরের সাংস্কৃতিক রুচি সমসাময়িক ধনীদের চেয়ে অনেক উন্নত। শুধু বাঈ-নাচ দেখে প্ৰমোদ করার বদলে তিনি কালোয়াতি গায়কদেরও ডেকে আনেন, কোনোদিন বা দাঁড়া-কবি বা বসা-কবিদের নিয়ে আসার জমান। রাম বসু, হরু ঠাকুরের মতন কবিগণও এই আসরে এসেছেন।
রামলোচনের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। এক কন্যা জন্মেছিল, সেও অকালমৃত। পত্নী অলকাসুন্দরীর সম্মতি নিয়ে তিনি তাঁর মেজ ভাইয়ের একটি ছেলেকে দত্তক হিসেবে গ্ৰহণ করেন। তাঁর সাধ ছিল ছেলেটিকে তিনি নিজের আদর্শে গড়ে তুলবেন। কিন্তু উপযুক্ত সময় পেলেন না, একদিন হঠাৎ পীড়িত হয়ে পড়ে তিনি বুঝলেন যে তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। পুত্রটির যখন তের বছর বয়স, তখন রামলোচন ঠাকুর ইহধাম থেকে প্ৰস্থান করলেন।
রামলোচনের সেই দত্তক পুত্রের নাম দ্বারকানাথ। পালিকা মাতা অলকাসুন্দরী এবং নিজের বড় ভাই রাধানাথের তত্ত্বাবধানে দ্বারকানাথ মানুষ হতে লাগলেন। তখনো হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়নি। জোড়াসাঁকোতেই ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে শেরবোর্ন নামে একজন সাহেব একটা স্কুল খুলে বসেছিলেন। শেরবোর্নও পুরোপুরি সাহেব নন, এঁর মা ছিলেন ব্রাহ্মণী এবং সেকথা তিনি প্রকাশ্যে সগৰ্বে সকলকে জানাতেন। এই শেরবোর্নের ইস্কুলে দ্বারকানাথ পড়তে লাগলেন এনফিল্ডস স্পেলিং, রীডিং বুক, তুতিনামা বা তোতা কাহিনী, ইউনিভাসিলি লেটার রাইটিং, কমপ্লিট লেটার বুক এবং রয়াল ইংলিশ গ্রামার। আঠারো বছর বয়েস পূর্ণ হলেই দ্বারকানাথ স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পথ প্রস্তুত করতে উদ্যত হলেন।
পালক পিতার কাছ থেকে দ্বারকানাথ জমিদারী সম্পত্তি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার আয় খুব বেশী কিছু নয়। সেই ছোট জমিদারী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মতন মন নিয়ে তিনি জন্মাননি। এ মানুষ অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কাছাকাছি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন। সরকারের অধীনে তিনি দেওয়ানের চাকরি করেছেন, জমিদারদের মামলা-মোকদ্দমায় তিনি ল এজেণ্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং বাড়িয়েছেন পরগণার পর পরগণায় নিজস্ব জমিদারী।
জমির মালিকানার প্রতি বঙ্গবাসীদের আকর্ষণ অত্যধিক, কিন্তু দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন যে ভূমিরূপ ধন যক্ষে আগলালেও লক্ষ্মীর আনাগোনা চলে বাণিজ্যেই। বহু রকম ব্যবসায় দ্বারকানাথ নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন, ব্যাংকিং, ইন্সিওরেন্স, রেশম, নীল,কয়লা এবং জাহাজ চলাচল। দ্বারকানাথের পূর্বপুরুষ জাহাজে মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজে ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন, দ্বারকানাথ স্বয়ং জাহাজ কিনে দেশ বিদেশে মালপত্র আমদানী রপ্তানি করতে লাগলেন। এমনকি স্বাধীনভাবে ইংরেজদের সঙ্গে অংশীদার হয়ে স্থাপন করলেন এক কোম্পানি। নেটিভদের পক্ষে এটা একটা চমকপ্ৰদ ঘটনা। দ্বারকানাথের উদ্যম ও ব্যক্তিত্বে এমনই ঔজ্জ্বল্য, যে কার টেগোর কোম্পানির প্রতিষ্ঠার পর মহামান্য বড়লাট বাহাদুর লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক এক চিঠি লিখে দ্বারকানাথকে অভিনন্দন জানালেন যে ইংরেজ ও দেশীয় লোকরা মিলে যৌথ কারবার পরিচালনায় আপনিই প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
অবশ্য একটু ভুল করেছিলেন বেণ্টিঙ্ক। এ ব্যাপারে দ্বারকানাথ প্রথম নন, দ্বিতীয়। বাণিজ্য ক্ষেত্রে তখন তাঁর একজন মাত্র যথার্থ প্ৰতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাঁর নাম রুস্তামজী কাওয়াসজী। এরও প্রধানত জাহাজেরই ব্যবসা। কলকাতা বন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য বিখ্যাত, রুস্তামজী একের পর এক জাহাজ তৈরি করিয়ে জলে নামাচ্ছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে রুস্তামজী টানার অ্যাণ্ড কোং খুলে ফেলেছেন। বেণ্টিঙ্কের অভিনন্দন বার্তাটিকে সংবাদপত্রের লেখকরা একটু সংশোধন করে নিল। দ্বারকানাথ হিন্দুদের মধ্যে প্রথম। রুস্তমজী হিন্দু নন। তিনি ইরাণের অগ্নি উপাসক পারসী জাতীয়। আরবী মুসলমানরা ইরান দখল করে নেবার পর অনেক পারসী এসে আশ্রয় নেয় ভারতের পশ্চিম উপকূলে, তাদেরই বংশধর এই রুস্তমজী বোম্বাই থেকে জাহাজযোগে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এই নতুন শহরে, যে শহর ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভারতের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় স্থান। রুস্তমজী ব্যবসায়ীদের মধ্যে শীর্ষস্থানে উঠে গেলেন, একদিকে চীন, অন্য দিকে আফ্রিকা পর্যন্ত যাতায়াত করে তাঁর কোম্পানির জাহাজ। নতুন নতুন জিনিস উৎপাদনের দিকেও তাঁর ঝোঁক আছে। কলকাতা শহরের জন্য বরফ আনাতে হয় আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে, এজন্য বরফ এখানে অগ্নিমূল্য। রুস্তামজী কলকাতায় বরফ প্ৰস্তুত করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
কোনো ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হয়ে দ্বারকানাথের সুখ হয় না। তাই দ্বারকানাথ তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন রুস্তমজীর দিকে। যথা সময়ে অবশ্য রুস্তামজীও ধরাশায়ী হয়েছিলেন।
ব্যবসাক্ষেত্রে এসে দ্বারকানাথ দু রকম ইংরেজের সন্ধান পান। তাঁর শ্ৰদ্ধেয় বন্ধু রামমোহনই এদিকে প্ৰথম তাঁর মনোযোগ ফিরিয়ে দিলেন। এই ইংরেজ দেশ শাসন করে, তারা রাজার জাত, তারা প্ৰভু। কিন্তু এরা ইংলণ্ডের একটি ছোট শ্রেণী মাত্র, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার এবং তাদের বেতনভুক কৰ্মচারীগণ। এছাড়াও অন্য ইংরেজ আছে। যারা ভাগ্যান্বেষণে এসেছে ভারতবর্ষে, তাদের আছে স্বাধীন পেশা, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে তাদেরও স্বার্থের সংঘাত হয়, আদর্শগত বিভেদ দেখা দেয়। এদের মধ্যে অনেকে অর্থপিশাচ, অনেকে নারীলোলুপ, অনেকে নীতিহীন নরপশু। আবার কেউ কেউ মুক্তমনা, উদার, একতরফা শোষণের প্রতিবাদকারী। তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ দেশের ভাষা ও প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে, শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহ দেখায়, সংবাদপত্রে সরকারী নীতির সমালোচনা করে।
রামমোহন ও দ্বারকানাথ দুজনেই বুঝেছিলেন অরাজক এবং নীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি ভ্ৰষ্ট ভারতের পক্ষে ইংরেজের শাসন আশীর্বাদ স্বরূপ। তবে, ইংরেজ যেন ভারতীয়দের আত্মসম্মানে আঘাত না দেয়। রামমোহনের তুলনায় দ্বারকানাথ আরও বেশী বুঝেছিলেন যে, ইংরেজদের কাছে ভারতীয়রা ক্রীতদাস। ভারতবাসী বহুকাল ধরে যুদ্ধবিদ্যায় অনভ্যস্ত, তাদের পক্ষে ইংরেজদের বিরোধিতা করা বাতুলতা। সেইজন্যই ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব ধন মান প্ৰাণের অধিকার আদায় করতে হলে ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজদের সাহায্য নিতেই হবে।
ইওরোপ ভ্ৰমণে গিয়ে দ্বারকানাথ এই সত্য আরো বেশী উপলব্ধি করলেন। ভারতে ইংরেজ-রাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের অন্য শ্রেণীর ইংরেজদের অনেক প্ৰভেদ। ভৃত্য বা প্রজার মতন নয়, তারা দ্বারকানাথের সঙ্গে ব্যবহার করেছে সমান সমান মানুষের মতন, কিংবা তারও বেশী সম্রামের সঙ্গে। স্বয়ং ইংলণ্ডেশ্বরী তাঁকে পাশে স্থান দিয়েছেন। বড় বড় ডিউক, লর্ড থেকে শুরু করে ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স পর্যন্ত দেখা করে গেছেন তাঁর বাড়িতে এসে।
ভারত থেকে ইংলণ্ডবাসীদের জন্য নানান উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। ইংলণ্ড থেকেও তিনি ভারতীয়দের জন্য বিশেষ একটি উপহার নিয়ে এলেন একটি মানুষ। এর নাম টমসন। এই টমসন পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ লড়াই-এ প্রস্তুত। এর আগে তিনি আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে অগ্নিস্রাবী ভাষণ দিয়ে এসেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সেজন্য তাঁর প্ৰাণ বিপন্ন হবার সম্ভাবনা ছিল বারবার। এই বিশেষ মানুষটিকে দ্বারকানাথ ভারতে আমন্ত্রণ করে আনলেন এক গূঢ় উদ্দেশ্যে।
এক শীতের ভোরে দ্বারকানাথের জাহাজ এসে ভিড়লো কলকাতা বন্দরে। আগে থেকেই খবর পেয়ে শত শত ব্যক্তি সেই সকালেই সেখানে এসে সমবেত হয়েছেন তাঁকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্য। জেটিতে জাহাজটি স্পর্শ করার পর দ্বারকানাথ তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন পোর্ট সাইড থেকে। তাঁর মুখখানি এক অদ্ভুত হাস্যে সমুজ্জ্বল। সকল অবিশ্বাসীরা এবার দেখুক! বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে অনেকেই তাঁকে বলেছিল যে ইওরোপীয় জল হাওয়া ভারতবাসীর সহ্য হয় না। সেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরে না, যেমন রামমোহন ফেরেননি।
দ্বারকানাথ হাত তুলে বললেন, আমি বেঁচে আছি।