১২. কিছুই ভালো লাগছিল না

চার-পাঁচ দিন কেটে গেছে। মাল্যবানের কেমন যেন—কেন যেন কিছুই ভালো লাগছিল না।

চলো, আজ একটু বেড়িয়ে আসি—

কোথায়?

চলো আজ একটু গড়ের মাঠের দিকে যাই—মাল্যবান বললে।

থাক।

চলো, ভরসাঁঝে এ-রকম একা-একা বসে থাকলে মন খারাপ লাগবে—

উৎপলা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বড় বাতাসে ফুল ধরা বাবলার মতো হুড়মুড় করে কেঁপে পাক খেয়ে হেসে উঠে বললে, এই যে ছিরঙ্গ-ঠাকুরপো একটা বেহালা এনেছ দেখছি—

শ্রীরঙ্গ এসে বললে, হা, কিছুদিন থেকে শিখছি—আচ্ছা, দ্যাখ, কেমন বাজাই।

আমি এক-আধটা কেত্তন গাইতে পারি—বেহালার কী বুঝি।

আচ্ছা, কেত্তনের সুরই ধরছি।

কোচে বোসো ঠাকুরপো। বাঃ, দাঁড়িয়ে কেন?

আমি দাঁড়িয়েই সুবিধে পাই; দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে নবনী মল্লিক বেহালা বাজায়। আমায় শিখিয়েছে সে।

নবনী? পুরুষ, না, মেয়ে? মাল্যবান জিজ্ঞেস করল।

অবনী যদি পুরুষ হয়, তাহলে নবনী কী হবে? আড় চোখে মাল্যবানের দিকে একবার তাকিয়ে বিদ্যুতের ভরা ব্যাটারির মতো সম্পন্ন সফল দৃষ্টিতে উৎপলার দিকে তাকাল শ্রীরঙ্গ।

অবনী নবনী দুভাই? নবনীবাবু আপনার দাদা? মাল্যবান বললে।

আমি তো মল্লিক নই।

তবে?

পলা-বৌদি জানে আমার কূলের খবর—

ওরা রামবাগানের দত্ত। উৎপলা বললে।

উৎপলা শ্রীরঙ্গকে জিজ্ঞেস করলে, নবনী কি মল্লিকবাড়ির মেয়ে, রাজেন মল্লিকের–

হবে এক মল্লিকের; ব্যাটা ছেলে নয় নবনী, মেয়ে বটে। পলা-বৌদি, বেহালাটা বাজাই তাহলে? ঘাড় কাত্ করে গোলাপজাম কামরাঙা লটকান বনের কেমন এক অমায়িক হলুদ পাখির মতো জিজ্ঞেস করল শ্রীরঙ্গ।

বাজাও বাজাও।

কেত্তনের সুর?

বাজাও।

না, কেত্তনের সুর নয়—উৎপলা নিজেকে তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বললে।

কেন?

বেহালায় তা বাজবে না। তুমি একটা অন্য সুর বাজাও শ্রীরঙ্গ-ঠাকুরপো। যাকে বলে বেহালার সুর—

শ্রীরঙ্গ বেহলা কাঁধে গুণীর মতো দাঁড়িয়েছিল। এবারে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল-বাঁ পা পিছনের দেয়ালে ঠেকিয়ে। বায়লার সুর মানে?

মনোমোহন বায়লাদারকে চিনতে তুমি? উৎপলা বললে।

না তো। কোথাকার?

চব্বিশ পরগণার। আমি তাকে একটা চমৎকার সুর ভাঁজতে বলতাম। কোনো গানের সুর সেটা নয়। সেটা বায়লার সুর। মনোমোহন মন্ত্রী লোকটার নাম।

ঐ একই সুর বাজাত?

একই সুর।

বরাবর?

বারো মাস। আমাদের দেশের বাড়িতে শীত পৃড়লে আসত। কার্তিক মাসটা কাটিয়ে যেত। লোকটার নাম যা বললাম, মনে আছে তোমার?

একটা শামুক, না, কী যাচ্ছে, দেখবার জন্যে হাঁসের মতো ঘাড় কাত্ করে শ্রীরঙ্গ ঘাড়টাকে আবার সোজা করে নিয়ে বললে, মনে আছে : মনোমোহন মন্ত্রী। এইবার বাজাই?

বাজাও। বাজাও। আয় মনু, আয়। নবনী মল্লিক রাজেন মল্লিকের বাড়ির, না?

না।

তবে?

ওদের বাড়ি জলপাইগুড়ি না, কোথায় যেন ছিল; এখন কলকাতায়ই থাকে। ও হল কেষ্ট মল্লিকের মেয়ে, টালিগঞ্জের।

বড়-সড় মেয়ে?

মনুর চেয়ে বড়, তোমার চেয়ে ছোট, বেশ সোমখ মেয়ে। ভারি সুন্দর। টলমলে মাকালের মতো যেন তেল চুয়ে পড়ছে চামড়ার থেকে; হাত বুলিয়ে নিলে ঘাসের শিশির উঠে আসে যেন ভোরবেলায়। ভালো বাজিয়ে। মোক্ষম গাইয়ে, মাইরি। আমি ওকে আমার গাইয়ে-বৌ বলি—

ওকে বিয়ে করেছ তুমি?

না। এম্নিই মস্করা করে বলি।

শ্রীরঙ্গ বললে, বেয়ালার আর্টিস্ট কাউকে বিয়ে করে না। অবিশ্যি তোমার মতন। কাউকে পেলে বিয়ে করে, কি, না করে—বছরে কত দিন শনি-মঙ্গলবার নিয়ে টের পাইয়ে দিত আমাকে—কিন্তু কাউকে কোথাও পেলুম না—দেখলুম না তো তোমার মত।

এরকম কথা শুনে নাক-মুখ লাল হবার বয়েস না থাকলেও সেই বয়েসের যে রক্ত এখন আছে উৎপলার; চলকে উঠছিল।

সেই মাঠকোঠা নেবুতলা শোভাবাজার পাথুরেঘাটা কুমারটুলি আহিরিটোলা বৌবাজার চিৎপুর হাতিবাগান রাজাবাজার ধর্মতলা—সমস্ত কলকাতা আমার পায়ের নিচে পলা বৌদি—কিন্তু তোমার মতন এমন হাতি খেতে কাউকে তো দেখলুম না।

উৎপলা এক হাত পেছিয়ে চমকে উঠে বললে, হাতি খেতে?

হ্যাঁ, সেই অনেক দুরের সমুদ্রে শ্ৰীমন্ত সদাগর যেমন দেখেছিলেন—

উৎপলা খানিকটা বিলোড়িত হয়ে উঠে বললে, তুমি বুঝি শ্ৰীমন্ত সদাগর?

বেহালায় একবার ছড়ি টেনে উৎপলার দিকে চোখ তুলে শ্রীরঙ্গ বললে, আর তুমি দাঁড়িয়ে আছ পথের ওপরে, কিন্তু হাতি খাচ্ছ কেন, বলো তো কামিনী

কমলে কামিনী বলো, উৎপলা ফোড়ন দিয়ে বললে। কামিনী নয়। কামিনী নয়। দেখছ না ওঁরা সব দাঁড়িয়ে আছেন—

একটু এগিয়ে চাপা গলায় বললে শ্রীরঙ্গকে।

শ্রীরঙ্গ বেহালায় এবার একটা সুরই ভাজতে লাগল—খুব মন দিয়ে, কিন্তু তার চেয়েও নিবিদ নিবেশে মননের অপর বস্তুতে লেগে থাকতে চেয়ে; বুঝছিল উৎপলা; অনুভব করছিল অপর বস্তুতে লেগে থাকতে চেয়ে; বুঝছিল উৎপলা; অনুভব করছিল একটু দুরে দাঁড়িয়ে থেকে মাল্যবান। কিন্তু বাজাতে-বাজাতে হঠাৎ মাঝখানে থেমে গেল শ্রীরঙ্গ।

অনেক দুরের এক সাগর; দেখা যাচ্ছে নিরালা জল, রোদ। সেখানে পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছে : শ্ৰীমন্ত সদাগর দেখলেন। শ্রীরঙ্গ চোখ বুজতে-বুজতে চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, কিন্তু তুমি হাতি খাচ্ছ কেন, পলা?

কী খাব তাহলে? শীরঙ্গের দিকে তাকিয়ে, মাল্যবান যে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা জানতে না চেয়ে নিজেকে একটু বেশি ছেড়ে দিয়ে বললে যেন উৎপলা।

শ্রীরঙ্গ হঠাৎ চারিদিকে চোখ ফিরিয়ে বললে, ওঃ, এই যে মাল্যবানবাবুর; এখানে দাঁড়িয়ে আছেন দেখছি; আমার চোখেই পড়েনি। আচ্ছা, আমি বাজাই বেশ দুর্দান্ত একটা গৎ। শো-মনু, শোনো মনুর-মা, শুনুন মাল্যবানবাবু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *