দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
স্কুল হইতে বাহির হইয়া কাজল রিপন কলেজে ভর্তি হইল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে খুব ভালো ফল করিয়াছিল—বিশেষত ইংরেজিতে। যে কোনো অধিকতর অভিজাত কলেজে সহজেই সে ভর্তি হইতে পারিত, কিন্তু একরকম জিদ করিয়াই রিপনে ভর্তি হইল।
কাজল একদিন আদিনাথবাবুকে প্রণাম করিতে গেল। আদিনাথবাবু আদর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন। কাজল বলিল—আশীর্বাদ করুন সার, যেন মানুষ হতে পারি। সবাই বলছে রিপনে ভর্তি না হয়ে প্রেসিডেন্সি বা অন্য কোথাও যাওয়া উচিত ছিল।
আদিনাথবাবু চশমা খুলিয়া কোঁচার প্রান্তে কাচ পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন—মানুষ হওয়া তোর কেউ আটকাতে পারবে না অমিতাভ। অনেকদিন ধরে শিক্ষকতা করছি, চুল পেকে গেছে-আমি মানুষ চিনি। তোর মধ্যে ক্ষমতা আছে, সেটা নষ্ট হতে দিস্ না। চশমা মুছিবার পর, না পরিয়া অনেকক্ষণ সেটা হাতে ধরিয়া রাখিলেন। অন্যদিকে তিনি তাকাইয়া আছেন। হঠাৎ তাহাকে যেন বেশি বৃদ্ধ দেখাইতে লাগিল। কাজল ভাবিল—বড্ড বুড়ো হয়ে গেছেন সার, বয়সের তুলনায়। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। একা মানুষ, কত আর খাটবেন!
মুখ ফিরাইয়া আদিনাথবাবু বলিলেন-কত আশা ছিল বড়ো হবো, নাম করবো। সেই ভাবেই জীবনটাকে তৈরি করবার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর সংসারের ঘানিকলে বাঁধা পড়ে ঘুরছি তো ঘুরছিই। বিলেত যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। সে কথা মনে পড়ে হাসি পায়। কত চিন্তা করেছি, রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি পালিয়ে চলে যাই। কিন্তু ততদিনে বড় খোকা হয়েছে। আটকা পড়ে গেছি। আর যাওয়া হল না।
নিঃশ্বাস ফেলিয়া আদিনাথবাবু বলিলেন—জীবন তো প্রায় শেষ হয়ে এলো অমিতাভ।
কাজল জানে মাস্টারমশাই খুব দুঃস্থ–মেয়ের বিবাহে সব টাকা জোগাড় করিতে না পারিয়া চড়া সুদে ধার করিয়াছিলেন, এখনও তাহা শোধ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বামুনপাড়ার মতি মুখুজ্যে টাকাটা মাসিক দুই আনা সুদে ধার দিয়াছিল মওকা বুঝিয়া। আদিনাথবাবু অনুরোধ করিয়াছিলেন সুদের হার এক আনা করিতে-মতি মুখুজ্যে শোনে নাই। ইস্কুলে কে যেন তাহাকে বলিয়াছিল কথাটা। মতি মুখুজ্যের পাশাপাশি তাহার রামদাস বোষ্টমের কথা মনে পড়িল—দুইটি চরিত্রের অদ্ভুত বৈপরীত্যের জন্য।
আদিনাথবাবু কাজলের আপত্তি না শুনিয়া তাহাকে পেট ভরিয়া জলযোগ করাইয়া ছাড়িলেন।
কলেজ সম্বন্ধে কাজলের বিরাট ধারণা ছিল। স্কুলে সে ব্যোমকেশ ছাড়া মনের মতো সঙ্গী পায় নাই। ভাবিয়াছিল কলেজে তো কত ভালো ছাত্র পড়িতে আসে দূর দূরান্ত হইতে, একজনও কি তাহার পছন্দমত হইবে না? প্রতাপ বলিয়াছিল, এই মফঃস্বলে তোর বন্ধু হবে না কাজল কলকাতার কলেজে যখন পড়বি, দেখবি কত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আছে দেশে।
–ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র দিয়ে কী করবো মামা? আমি চাই এমন বন্ধু, যে আমার মনের কথা বুঝতে পারবে, আমার মতো যে চিন্তা করবে।
-হলে কলকাতাতেই হবে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখিল তাহা হইতেছে না। ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই নিরীহ, গোবেচারা। দুএকটি বড়লোকের ছেলে আছে—তাহারা গরমে আদ্দির পাঞ্জাবি, শীতে সার্জের কোট পরিয়া কলেজে আসে, কথায় কথায় সিগারেট খায় এবং পরস্পরের পিতার কাজকর্ম লইয়া আলোচনা করে। তাহাদের সহিত কথা বলিতে গিয়া কাজল বোকা বনিয়া ফিরিয়াছে, কাজলকে তাহারা গ্রাহের মধ্যে আনে নাই। মোটর উপর কাজল দেখিল গত কয়েক বৎসরে তাহার মানসিক বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে হইয়াছে, ফলে তাহার চারিধারে বহুদূর অবধি লোকজন নাই। অগত্যা সে লাইব্রেরিতে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ছেলেবেলায় বাবার কাছে রিপন কলেজের লাইব্রেরির গল্প শুনিয়াছিল। প্রত্যেকটা বইয়ে যেন বাবার স্পর্শ লাগিয়া আছে। নানা বিষয়ে কৌতূহল থাকার দরুন লাইব্রেরির ভিতর সে যেন দিশাহারা হইয়া ওঠে। কোন বইটা ছাড়িয়া কোটা পড়িবে ঠিক করিতে পারে না। কতকগুলি পছন্দসই বই-এর লিস্ট করিয়া ফেলিল সে, এক এক করিয়া পড়িবে। এই ব্যাপারে তাহার কিছু সুবিধা ছিল, এমন সব বইয়ের সে স্লিপ দিত, যাহা সাধারণত কেহ নেয় না। দপ্তরী তাক হইতে বই পাড়িয়া তাহার হাতে আনিয়া দিলে সে ফু দিতে দিতে বলে, বাব্বাঃ, বেজায় ধুলো জমে গেছে দেখছি।
দপ্তরী হাসিয়া বলিত-বহুকাল বাদে বেরুলো তো বাবু।
কাজল অবাক হইয়া যায়। এত ভালো বই কেহ পড়ে না কেন? তাহাকে যদি লাইব্রেরিতে থাকিতে দিত, দিনরাত সে মাদুর পাতিয়া বসিয়া বই নামাইয়া নামাইয়া পড়িত। চাকরি হইলে সে টাকা জমাইয়া ভালো লাইব্রেরি করিবে-বাড়িতে। মৌপাহাড়িতে গিয়া থাকিবে তখন, সেখানকার স্কুলে মাস্টারি কবিবে। কলিকাতা হইতে বই কিনিয়া একটা ঘর সে ভর্তি করিয়া ফেলিবে। দেওয়াল দেখা যাইবে না, শুধু আলমারি। সারাদিন বইয়ের মধ্যে কাটানোউঃ! এত বেশি আনন্দ আর কীসে পাওয়া যাইতে পারে?
একবার কাজলের উর্দু শিখিবার শখ হইল। কী একটা বই পড়িতে পড়িতে সে মির্জা গালিবের দুইটা লাইন পাইয়াছিল। লাইন দুইটা তাহার এত ভাল লাগিল যে, ক্রমশ উর্দু কবিতা সংগ্রহ করা তাহার বাতিকে দাঁড়াইয়া গেল। কলেজে এক সহপাঠীকে সে উর্দু কবিতা আবৃত্তি করিয়া শোনাইতেছিল, ছেলেটি তাহাকে উর্দু শিখিবার উপদেশ দেয়। কথাটা মনে ধরিল। অনেক সন্ধানের পর এক বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোককে পাওয়া গেল, তিনি সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যায় কাজলকে উর্দু পাঠ দিতে বাজি হইলেন। সন্ধ্যাবেলা খাতা হাতে কাজল তার কাছে গিয়া হাজির হয়। মালতীনগরের প্রান্তে এক মসজিদে তিনি থাকেন, সবাই মৌলবী সাহেব বলিয়া ডাকে। কাজল গেলে মৌলবী সাহেব হাসিয়া বলেন—সেলাম আলেক। ইহার প্রত্যুত্তরও কাজল তাহার নিকট হইতে শিখিয়া লইয়াছে— সে মাথা বুকাইয়া বলে, ওআলেক সেলাম। মৌলবী সাহেব বুঝাইয়া বলিলেন, এটা হচ্ছে শুভেচ্ছা জানান, ভগবানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। একজন বলছে—তোমার ওপর ভগবানের আশীর্বাদ নেমে আসুক। অন্যজন বলছে—তোমার ওপরও ভগবানের আশীর্বাদ নেমে আসুক।
মৌলবী সাহেবের ছোট ঘরে মোমবাতি জ্বলে, মাদুরের উপর বসিয়া কাজল মনোযোগ দিয়া আপাত-বৈসাদৃশ্যহীন উর্দু অক্ষরের পার্থক্য বুঝিবার চেষ্টা করে। মৌলবী সাহেব হাঁ-হাঁ করিয়া বলেন–নেহি, নেহি-এয়সা করকে লিখ্খো, ইয়ে হম্জা নেহি হুয়া।
কখনও কখনও তিনি মূল ফারসী হইতে কাজলকে ওমর খৈয়াম পড়িয়া শোনান। বলেনএই কবিতা অনেক গোঁড়া মুসলমান অপছন্দ করে। এতে নাকি অধর্মের কথা, ভোগবিলাসের কথা লেখা আছে। আমি কিন্তু তা মানি না, যা ভালো কবিতা, তা না পড়ে আমি থাকতে পারি না।
ওমর খৈয়াম শুনিয়া কাজলের এত ভালো লাগিল যে, সে একখানা ফিটজেরালড় অনূদিত রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম কিনিয়া ফেলিল, কেননা ফারসী বুঝিবার ক্ষমতা তাহার নাই। ওমর খৈয়ামের স্বপ্নিল জীবনরহস্য, মধ্যপ্রাচ্যের অতীত দিনগুলির রোম্যান্টিক অনুভূতি কাজলকে মুগ্ধ করিল। কী সুন্দর এক একটি ছোট কবিতা—
They
say the Lion and the Lizard keep
The Courts where Jamshyd gloried and drank deep;
And Bahram, that great hunter-the Wild Ass
Stamps oer his Head, but cannot break his sleep.
অনিবার্যভাবে মৃত্যু আসিয়া দাম্ভিক নৃপতি এবং বলদর্পী শিকারীকে চিরকালের মতো ঘুম পাড়াইয়া গিয়াছে, তাহাদের সমাধির উপরে বাড়িয়া ওঠা জঙ্গলের বন্য গর্দভের মাতামাতিও আর তাহাদের ঘুম ভাঙাইতে পারে না।
মৌলবী সাহেব বলেন–তাড়াতাড়ি শিখতে চেষ্টা করো, উর্দু সাহিত্যের ভেতরে ঢুকলে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া উর্দু হয়ে গেলে ফারসী শেখাও বিশেষ আর কষ্টকর হবে না।
মেজাজ ভালো থাকিলে তিনি বলেন–আজ পড়া থাক—এসো, তোমাকে কিছু শের শোনাই। সম্রাট বাহাদুব শাহের লেখা কবিতা শুনবে? একেবারে শেষ জীবনে লেখা, শোনো
উমরে দরাজ মাকর লায়ে থে ইয়ে চার রোজ।
দো আরজুমে কাটগয়ে, দো ইজারমে।
***
কিতনা হ্যায় বদনসীব জাফর দনেকে লিয়ে।
দো গজ জমিন না মিল সকি ইস কুয়েয়ার মে।
কিছুদিন যাতায়াত করিয়া কাজলের উর্দু শিখিবার উৎসাহ চলিয়া গেল। জটিল ব্যাকরণ এবং ততোধিক জটিল লিখন প্রণালী সে কিছুতেই আয়ত্ত করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। অবশ্য উর্দু সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ তাহার থাকিয়াই গেল।
কলেজ হইতে ফিরিবার সময় একদিন কাজল কী কাজে কলেজ স্ট্রীটে গিয়াছিল। একটা পুরাতন বইয়ের দোকানে নজরে পড়িল, ডস্টয়েভস্কির ব্রাদার্স কারামাজখানা। কাজল নগদ দেড় টাকা মূল্যে বইখানি হস্তগত করিয়া বাড়ি ফিরিল। খুব নাম শুনিয়াছে বইখানার—কিন্তু পড়িয়া ওঠা হয় নাই। বাড়ি ফিরিয়া সন্ধ্যায় অন্যদিনের মতো বেড়াইতে বাহির না হইয়া সে বিছানায় শুইয়া হ্যারিকেন কাছে টানিয়া পড়া শুরু করিল।
সে ভাবিয়াছিল নাম করা উপন্যাস যখন, প্রথম পাতা হইতেই গল্প খুব জমিবে। তাহা হইল না। পাতার পর পাতা পড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু রস যাহাকে বলে, তাহা ঠিক জমিতেছে না। শতখানেক পৃষ্ঠা পড়িয়া সে বিরক্ত হইয়া বই মুড়িয়া তুলিয়া রাখিয়া দিল। মাস আটেকের মধ্যে আর সে হাত দেয় নাই। একদিন কি খেয়াল হওয়ায় তাক হইতে নামাইয়া নূতন করিয়া পড়িতে শুরু করিল।
জমিয়া গেল।
কষ্ট করিয়া, তেতো ওষুধ খাইবার মতো করিয়া দুইশত পৃষ্ঠা পড়িবার পর বই আর হাত হইতে নামাইতে পারিল না। বৃহৎ পটভূমিতে জীবনকে এমনভাবে অঙ্কন করিতে সে অন্য কোনো শিল্পীকে দেখে নাই। বিশেষত দিমিত্রির চরিত্র তাহার কাছে অসাধারণ সৃষ্টি বলিয়া মনে হইল।
দিমিত্রির উন্মত্ততা, জীবনকে আকুল হইয়া জড়াইয়া ধবিবার চেষ্টা—এসব সত্ত্বেও দিমিত্রির পরিণতিতে কাজল কেমন মুহ্যমান হইয়া পড়িল। মনে হইল, জীবনটা এক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাহা ঈশ্বর না, মানবিক কিছু নহে—বরং মানবিকতা বিরোধী।
জীবনকে ভালোবাসিবার পরিণতি যদি এই হয়, তবে বাঁচিয়া লাভ কী? ব্রাদার্স কারামজভ জীবনকে নূতন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিতে শিখাইল।