১২. কলকাতার ঐতিহাসিক বাড়িঘর প্রতিষ্ঠান

কলকাতার ঐতিহাসিক বাড়িঘর প্রতিষ্ঠান

কলকাতা শহরের অন্তত শতাধিক প্রাচীন ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস এখনও লেখা যায়। তার থেকে এই অধ্যায়ে কয়েকটির বিবরণ (প্রায় তিরিশটি) দেওয়া হল, যেগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশি। এই গ্রন্থের ‘টাউন কলিকাতার কড়চা’ অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়’ ‘সাহেব নবাবদের টাউন’ এই প্রসঙ্গে পঠিতব্য।

১। পুরাতন কেল্লা (Old Fort)

যোব চার্নক ভাগীরথীর পূর্বতীরে যে স্থানটিতে তৃতীয়বার ও শেষবার তাঁর ঘাঁটি ও বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন, স্বভাবতঃই তার কাছাকাছি অঞ্চলে পুরাতন কেল্লাটি নিরাপত্তার জন্য গড়ে উঠেছিল। চার্নকের মৃত্যুর পর তাঁর জামাই চার্লস আয়ার ১৬৯৭ সালে এই কেল্লা নির্মাণ করেন এবং তৃতীয় উইলিয়ামের (William III) নামে এর নাম হয় ‘ফোর্ট উইলিয়াম’। যেখানে এই কেল্লা গড়ে ওঠে সেই অঞ্চলটি হল লালদীঘির (ডালহৌসি স্কয়ার) পশ্চিম দিকে, উত্তরে ফেয়ারলি প্লেস থেকে দক্ষিণে কয়লাঘাট স্ট্রীট পর্যন্ত। বর্তমানে এই অঞ্চলটিতে জেনারেল পোস্ট অফিস, ক্যালকাটা কালেকটোরেট, কাস্টমস হাউস, রেলওয়ে অফিস প্রভৃতি আছে। এই পুরাতন কেল্লার মধ্যে গবর্ণরের বাসভবন ছিল, যার গড়নসৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হ্যামিলটন সাহেব বলেছিলেন-‘the best and most regular piece of architecture that I ever saw in India’, এত সুন্দর বাড়ি নাকি ভারতবর্ষে আর কোথাও ছিল না, অন্তত সাহেবের চোখে পড়েনি। ডক্টর উইলসন ১৮৯১-৯২ সালে, প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো, এই অঞ্চল খোঁড়াখুঁড়ি করে পুরাতন কেল্লা, গবর্ণরের বাসভবন প্রভৃতি নিদর্শন আবিষ্কার করেন। রেভারেণ্ড ফার্মিঙ্গার বলেছেন-the result of his labours was to confirm Hamilton’s high praise of the piece of architecture.’

কলকাতা শহরে ঘাঁটি স্থাপন করে, জমিদার ও বণিকের বেশ ধরে ধীরে ধীরে ইংরেজরা বেশ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছেন দেখে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য কলকাতা আক্রমণ করেন (১৬ জুন, ১৭৫৬)। কেল্লার ভিতরে গবর্ণরের বাড়ি, শোরার গুদামঘর, হাতীশালা, ঘোড়াশালা, হাসপাতাল, জেলখানা কাছারিবাড়ি প্রভৃতি তো ছিলই, বাইরেও ইংরেজদের বেশ কিছু বসতবাড়ি গড়ে উঠেছিল। কাছে সেণ্ট অ্যানির গির্জা ছিল, বর্তমান মহাকরণের পশ্চিম কোণে। কেল্লার চারপাশে বাড়িঘর গির্জা ইত্যাদি থাকা প্রতিরক্ষার অনুকূল নয়, কারণ আক্রমণকারীরা বড় বড় বাড়ির উপরে কামান বসিয়ে কেল্লা লক্ষ্য করে সোজা গুলিবর্ষণ করতে পারে। এ বিষয়ে ইংরেজরা সচেতন ছিলেন, এবং তাই নিয়ে কাউন্সিলে আলোচনাও হয়েছে। কলকাতা আক্রমণের সময় সিরাজের সৈন্যরা সত্যিই তাই করেছিল। ১৮ জুন ১৭৫৬ সিরাজের সৈন্যদের সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় বর্তমান ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্ট্রীটের কাছে, তখন নাম ছিল রানীমুদি গলি। আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে ইংরেজরা কেল্লার আশপাশের গির্জা ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করেন। অবশেষে কলকাতা ছেড়ে যেতেও তাঁরা বাধ্য হন। বিজয়ী সিরাজ কলকাতার নাম বদলে আলিনগর নাম রাখেন এবং কেল্লার প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে যেখানে তিনি তাঁর প্রধান শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন তার নাম আলিপুর। পরে ইংরেজরা কলকাতা পুনর্দখল করেন (জানুয়ারি ১৭৫০), এবং পলাশির যুদ্ধে (জুন, ১৭৫৭) নবাব সিরাজের চরম ভাগ্যবিপর্যয় হয়। বেইমান মীরজাফরের আদেশে ‘আলিনগর’ নাম বদলে পুনরায় ‘কলকাতা’ নাম রাখা হয়। আলিনগর নামটি লুপ্ত হয়ে গেলেও, আলিপুর নামটি আজও পুরনো দিনের স্মৃতি বহন করছে।

পুরাতন কেল্লাটিকে ক্লাইভ প্রথমে প্রতিরক্ষার উপযোগী করার চেষ্টা করেন। তার জন্য কেল্লার চারদিকে বেষ্টন করে ৩০ ফুট চওড়া, ১২ ফুট গভীর একটি গড়খাই কাটা হয় এবং আশপাশের বড় বড় বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করার পরের বছর ১৭৫৮ সালে নতুন কেল্লা (New Fort William) নির্মাণ আরম্ভ হয়। নতুন কেল্লার স্থানটি নির্বাচন করা হয় প্রাচীন ‘গোবিন্দপুর’ গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দাদের যথেষ্ট জমিজমা অর্থ ক্ষতিপূরণ দিয়ে, উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রধানত শোভাবাজার কুমোরটুলি ও তারাতলা অঞ্চলে, স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭৫৮ সাল থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত নতুন কেল্লা নির্মাণের প্রথম পর্ব শেষ হয়, খরচ হয় কমপক্ষে ২৯ লক্ষ স্টার্লিং।

২। ক্লাইভের বাসভবন

পুরনো রয়েল এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং (১৯১৫ সালে ভেঙে ফেলা হয়) ক্লাইভের বাসভবন বলে কথিত এবং কার্জন কর্তৃক একটি ট্যাবলেট দ্বারা চিহ্নিতও ছিল। বাড়িটি ছিল ‘best house in the town’ এবং ‘behind the Play House’ শ্রীমতী রেশিনডেন লিখেছেন : ‘ক্লাইভ মনে হয় আয়ারের বাড়িটিতে (‘Mr Eyre’s house’) বাস করতেন, তাঁর প্রথম তিন শাসনকালে। কিন্তু আয়ারের বাড়ি ও তার পাশাপাশি অন্যান্য বাড়ি ১৭৫৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়, কেল্লা ও কুটির সামনে প্রশস্ত খোলা জায়গার (Esplanade) জন্য। ক্লাইভের বাড়িটি কোথায় ছিল তা Public Consultations-এর এই উক্তি থেকে (২২ সেপ্টেম্বর, ১৭৬০) পরিষ্কার বোঝা যায় :

The Sea Custom Master reports to the Board that he has pitched upon the Dwelling House belonging to Huzzroomull, lately possessed by Colonel Clive, as the most proper place for a Custom House.

যে জায়গায় কাস্টমস হাউস স্থাপিত সেখানে হজুরিমলের বাড়ি ছিল। পরে এই বাড়ির মালিক ও বাসিন্দা হন ক্লাইভ। দমদমে ক্লাইভের বাগান বাড়ির অবশেষ এখনও আছে।

৩। গবর্ণমেণ্ট হাউস

এই গ্রন্থের ‘টাউন কলিকাতার কড়চা’র ‘সাহেব-নবাবদের টাউন’ অধ্যায়ে পুরাতন গবর্ণমেণ্ট হাউসের ইতিহাস পাওয়া যাবে না। নতুন গবর্ণমেণ্ট হাউস (বর্তমান ‘রাজভবন’) ওয়েলেসলির আমলে তৈরি হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৭৯৯, নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৮০২ সালে; ২৭ জানুয়ারি, ১৮০৩ গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে ‘splendid entertainment’-এর ব্যবস্থা করা হয় এবং ফোর্ট উইলিয়াম, গঙ্গার ঘাটের জাহাজ, এসপ্লানেড প্রভৃতি অঞ্চল ‘were all brilliantly illuminated’. ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে বড়লাট কার্জন এই আনুষ্ঠানিক গৃহ প্রবেশের শতবর্ষপূর্তি উৎসব মহাসমারোহে পালন করেন। সেই উপলক্ষে এলাহি বলনাচের ব্যবস্থা করা হয় এবং নিমন্ত্রিত অতিথিদের অনুরোধ করা হয়, ওয়েলেসলির আমলের পোশাক পরে উৎসবে যোগ দিতে।

নতুন লাটভবনের স্থপতি ছিলেন কাপ্টেন উইয়াট (Captain Wyatt)। মোট খরচ হয় ১৩ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। বর্তমান মুদ্রামূল্যে (১৯৭৫) অন্তত এর তিরিশ গুণ, অর্থাৎ প্রায় চার কোটি টাকার মতো। লর্ড ভ্যালেনসিয়া ১৮০৩ সালে কলকাতার রূপ দেখে লিখেছিলেন :

The town of Calcutta is at present well worthy of being the Seat of our Indian Government, both from its size and from the magnificent buildings which decorate the part of it inhabited by Europeans. The citadel of Fort William is a very fine work, but greatly too large for defence. The Esplanade leaves a grand opening, on the edge of which is placed the new Government House, erected by lord Wellesley, a noble structure, although not without faults in the architecture and upon the whole not unworthy of its distinction. On a line with this edifice is a range of excellent houses, chunamed and ornamented with Verandahs. Chowringhee, an entire village of palaces, runs for a considerable length at right angles with it and altogether forms the finest view beheld in any city

চৌরঙ্গি অঞ্চলকে ‘প্রাসাদময় গ্রাম’ বলেছেন ভ্যালেনসিয়া তার কারণ তখন চৌরঙ্গিতে ইংরেজদের কয়েকটি বড় বড় বাড়ি ও বাগানবাড়ি ছিল, বাকি কুড়েঘর, এঁদোপুকুর, খানাডোবা ও জঙ্গলে ভরা গ্রাম। চৌরঙ্গির উন্নয়ন প্রসঙ্গে পূর্বের ‘লটারি কমিটির রিপোর্ট’ (১৮১৭-২১) অধ্যায় দ্রষ্টব্য। ‘Black Town’ বা এদেশীয়দের বসতি অঞ্চল সম্বন্ধে ভ্যালেনসিয়া লিখেছেন :

The Black Town is as complete a contrast to this as can be well conceived. Its streets are narrow and dirty, the houses of two stories, occasionally brick and generally mud, and thatched, perfectly resembling the cabins of the poorest class in Ireland.

লাটভবন নির্মাণ ও ওয়েলেসলির নবাবি বিলাসিতার বিবরণ উইলিয়াম হিকি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত ১ম খণ্ডে ‘সূতানুটি সমাচার’ দ্রষ্টব্য)।

৪। রাইটার্স বিল্ডিংস

১৮৪১ সালের একটি পুরনো গেজেটিয়ারে ‘লায়ন্স রেঞ্জ’ রাস্তাটি সম্বন্ধে বলা হয়েছে কোম্পানি কেরানি কা বাড়ি কা উত্তর রাস্তা’। কোম্পানির (ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির) কেরানিদের (Writers বা Junior Servants বলা হত) বসবাসের বাড়ি বলেই Writers’ Buildings নাম। বহুদিন পরে রাইটার্স বিল্ডিংস সরকারি দফতরখানা হলেও,[১] আজও তার কেরানিপ্রাধান্যের জন্য পুরাতন ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ আছে। অবশ্য জন কোম্পানির আমল আর নেই, তার পরিবর্তে নতুন আমল প্রবর্তিত হয়েছে।

কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা ও ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠির প্রথম এজেণ্ট যোব চার্নক (Job Charnock) যদিও ‘reigned more absolutely than a Raja’, মাত্র দেড় বছর (আগস্ট ১৬৯০ থেকে জানুয়ারি ১৬৯২) রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাই চার্লস আয়ার এজেন্ট হবার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কাঁচা বাড়িটি (অর্থাৎ মাটির) আগুন লেগে পুড়ে যায়, তারপর পাকা ইটের বাড়ি তৈরি হয়। কিন্তু এই নতুন বাড়িটিও কুঠি (factory) থেকে দূরে বলে, নিলেমে বিক্রি করে ফেলা হয় ৫৭৫ টাকায়। এজেন্ট মানে গবর্ণর, অতএব ১৬৯২ সালে কলকাতায় ইংরেজদের প্রথম লাটভবন ৫৭৫ টাকায় নিলেমে বিক্রি হয়। আদি লাটভবনটি কেমন ছিল, মোটামুটি তার মূল্য থেকে অনেকটা অনুমান করা হয়। ১৬৯৫ সালের ২৫ জুন প্রচণ্ড ঝড়ে আয়ার নির্মিত অন্যান্য ঘরবাড়িও ভেঙেচুরে উড়ে যায়, এবং তার মধ্যে কোম্পানির ‘servant’-দের ‘lodging rooms’ পর্যন্ত। এই লজিং রুমগুলিকেই আদি রাইটার্স বিল্ডিংস বলা হয়। ১৭০৭ সালে পুরনো কুঠিঘরটি ভেঙে ফেলে নতুন একতলা পাকাবাড়ি তৈরি করা হয় কোম্পানির কেরানি কর্মচারীদের জন্য। এইটিকে দ্বিতীয় রাইটার্স বিল্ডিংস বলা যেতে পারে। পুরাতন কেল্লার সীমানার মধ্যেই ছিল এই প্রথম ও দ্বিতীয় রাইটার্স বিল্ডিংস, বর্তমান মহাকরণের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। লালদীঘির উত্তরে যেখানে বর্তমান রাইটার্স বিল্ডিংস অবস্থিত, সেখানে তখন কোনো বাড়িঘর ছিল না, পোড়ো জমি (‘waste ground’) ছিল। এই পোড়ো জমি টমাস লায়নসকে (Thomas Lyons) কলকাতার কালেক্টর ১৭০৬ সালে লীজ দেন, কোম্পানির জুনিয়ার কর্মচারীদের বাসগৃহ নির্মাণের জন্য। স্টার্নডেল তাঁর কলকাতা কলেক্টরেটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (R. C. Sterndale; An Historical Account of “The Calcutta Collectorate” etc : Calcutta. 1885) কালেক্টরের পাট্টাটি, ‘which was so faded as to be undecipherable, but was restored by the aid of a solution of nutgalls’–উদ্ধৃত করেছেন :

A pottah is hereby granted unto Mr. Thomas Lyons for the purpose of erecting a range of buildings for the accomodation of the junior servants of the company for two pieces or parcels of waste ground to the north of the Great Tank, the Court-house and the new Playhouse, and separated by the south front of the Courthouse to the Salt Water Lake, and known by the name of Great Bungalo Road…

In the Cutcherry of the Calcutta Division, this eighteenth day of November 1776,

জমির পরিমাণ কতটা তাও ১৭৮৭ সালের ‘deed of trust’ -এ উল্লেখ করা হয়েছে :

All those two several pieces or parcels of ground situate, lying, and being on the north side of the Great Thank in the town of Calcutta, containing by estimation 16 bighas 17 cottahs and 8 chittacks… all that new row or range of buildings there lately erected and built upon the most northern of the two said several pieces of land containing 19 messuages or tenements or separate sets of apartments with the outhouses thereto…

১৭৭৬ সালে টমাস লায়নস ‘কোম্পানি কা কেরানি কা বাড়ি’ তৈরির জন্য পাট্টা পান এবং তিনি উনিশটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেন। ১৭৮৯ সালের দলিলপত্র থেকে দেখা যায় যে এই সম্পত্তি রিচার্ড বারওয়েলকে (Richard Barwell) হস্তান্তরিত করা হয়। কিন্তু কিভাবে হস্তান্তরিত হল, স্টার্নডেল লিখেছেন, কলেক্টরেটের দলিলপত্রের মধ্যে তার হদিশ তিনি পাননি। এটা তাঁর কাছে একটা সমস্যা ছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান এইভাবে করা যেতে পারে। টমাস লায়নসকে লীজ দেওয়া হয়েছিল পাঁচ বছরের জন্য। এই সময়ের মধ্যে লায়নস উনিশটি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে কোম্পানির ‘কেরানিদের’ বসবাসের জন্য ভাড়া দেন। পাঁচ বছর পরে তিনি এই সম্পত্তি রিচার্ড বারওয়েলকে বিক্রি করেন। বারওয়েল ট্রাস্টিদের হাতে (এলিজা ইম্পে একজন ট্রাস্টি ছিলেন) এই সম্পত্তির অভিভাবকত্ব অর্পণ করেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য। লায়নস তাঁর উনিশটি অ্যাপার্টমেণ্টের জন্য কোম্পানির কাছ থেকে মাসে ৩৮০০ টাকা ভাড়া পেতেন। বর্তমান রাইটার্স বিল্ডিংসের প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত।

১৭৯২ সালে জরিপ করে আপজন (Upjohn) কলকাতার মানচিত্র প্রকাশ করেন। এই মানচিত্রে পরিষ্কার তিনটি সারিবদ্ধ বাড়ি দেখা যায়, সাদামাটা ব্যারাকের মতো। পরবর্তী বাড়িগুলি বারওয়েলের নির্দেশে নির্মিত হয়, স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ার অবশ্য টমাস লায়নস। এর জন্য লায়নস সাহেব ৪০,০০০ টাকা পান। বাড়িগুলিকে ‘range of boutiques’ বলা হয়েছে। ‘boutique’ ফরাসি শব্দ, অর্থ হল ছোট দোকানঘর। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষে রাইটার্স বিল্ডিংস দেখতে ছিল ছোট ছোট সারিবদ্ধ দোকানঘরের মতো। ১৮২০-২১ সাল থেকে মহাকরণের বর্তমান অলংকৃত (Ornamental) রূপায়ণ আরম্ভ হয়। শ্রীমতী ব্লেশিনডেন তাঁর Calcutia Past and Present গ্রন্থে লিখেছেন :

The costly champagne suppers of Writers’ Building were famous, and long did the walls echo to the ‘Joyous song and loud rehearsing tallyhoes’ of many generations of writers, Gradually, howerver, there came a change; the age for entering the Company’s Civil Service was raised, the period of a Writer’s stay in Calcutta was reduced, and, at last, writers were no longer provided with quarters, but lived with friends or in lodgings at their own expense. For some years Writers’ Buildings remained deserted; then the sets of appartments were let to private individuals or for offices. The next change saw them occupied as Government offices; and lastly came alterations and additions which crowned the old bare range with domes, and masked it with a stately facade, ihe Writers’ Buildings were lost in the Bengal Secretariat.

একদা যখন জন কোম্পানির তরুণ কেরানিরা রাইটার্স বাসভবনে বাস করতেন, তখন সান্ধ্যভোজের আসরে শ্যাম্পেন-মদিরাদির ফোয়ারা ছুটত এবং তাঁদের পানোন্মত্ত হৈহুল্লোড়ের শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হত তার দেয়ালে দেয়ালে। তারপর ধীরে ধীরে তার পরিবর্তন হতে থাকে। কোম্পানির চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ানো হয়, তাঁদের কলকাতার বসবাসের মেয়াদও কমানো হয় এবং শেষে তাঁদের বাসস্থানের দায়িত্বও আর কোম্পানি নিতে চান না। কিছুদিন রাইটার্স বাসভবন প্রায় জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে, পরে লোকজনের বসবাসের জন্য ও আফিসের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। আরও কিছুদিন পরে সরকারী আফিস বা দফতরগুলির কাজ এখানে আরম্ভ হয়। এই সময় তার সামনের দিকে চেহারার পরিবর্তন করতে হয় এবং বহিরাঙ্গিক অলংকরণের কাজ আরম্ভ হয়। পুরনো রাইটার্স বিল্ডিংস নতুন ‘বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটের’ মধ্যে তার পুরনো ইতিহাস হারিয়ে ফেলেছে।

‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় (১৮২১) রাইটার্স বিল্ডিংসের এই বহিরাঙ্গিক অলংকরণ ও নবরূপায়ণের সংবাদ প্রকাশিত হয় :

The Writers’ Buildings, from being remarkable only for the nakedness of their appearance, which conveyed the idea of a warehouse or a range of warehouses, have been ornamented with three pediments in front, supported on colonnades, which from handsome verandahs. The lower floor contains the lecture rooms of the college, and the second has been fitted up for the college library.

এই সংবাদ থেকে বোঝা যায়, ১৮২১-২২ সালে রাইটার্স বিল্ডিংস ‘বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে’ পর্যবসিত হয়নি। কলেজটি হল ১৮০০ সালে স্থাপিত ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’। কোম্পানির ইংরেজ অফিসার ও কর্মচারীদের এদেশীয় ভাষা ইত্যদি শিক্ষা দিয়ে আদর্শ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরূপে গড়ে তোলার জন্য এই কলেজ ওয়েলেসলির আমলে স্থাপিত হয়। ১৮৩০ সালে কলেজটি তুলে দেওয়া হয়। এই কলেজের লাইব্রেরি (প্রায় ৪০০০ বই ছিল) থেকে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে ওঠে এবং পরে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি ও তারপরে বর্তমান ন্যাশনাল লাইব্রেরি।

রাইটার্স বিল্ডিংসের উত্তরে লায়ন্স রেঞ্জ রাস্তাটি তৎকালের কলকাতার বিখ্যাত ‘architect’ ও ‘house-builder’, টামাস লায়ন্সের স্মৃতি বহন করছে। কলকাতার অনেক ঐতিহাসিক বাড়ির স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন টমাস লায়ন্স। ১৭৯৯ সালে মে মাসে তাঁর মৃত্যু হয় বহরমপুরে।

৫। বেলভেডিয়ার হাউস। হেস্টিংস হাউস

‘Belvedere’ কথাটি স্থাপত্যবিদ্যার কথা। অর্থ হল, কোনো বাড়ির উপরের অংশ ‘turret’ ‘cupola’ বা ‘gallery’ অথবা কোনো উঁচু জায়গায় তৈরি বাড়ি, যেখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত চারিদিকের দৃশ্য দেখা যায়। রোমের ভ্যাটিকানে ‘বেলভিডিয়ার গ্যালরী’ এবং ভিয়েনায় ‘বেলভেডিয়ার প্রাসাদ’ আছে। কলকাতার ‘বেলভেডিয়ার হাউস’ এরকম একটি প্রাসাদোপম অট্টালিকা, একদা তো বটেই, আজও যার উপর থেকে চতুর্দিকের দৃশ্য বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ২৫০ বৎসর আগে, আলিপুরের বনজঙ্গলাকীর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে, এই ভবনটি কোন ব্যক্তি নির্মাণ করেছিলেন, কেন করেছিলেন, তারপর কেমন করে সেটি, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, বাংলার ছোটলাটদের বাসভবন এবং তারপর বড়লাটের প্রাসাদ হল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ব্যাস্টিড, কটন, ব্লেশিনডেন, ফার্মিঙ্গার এবং অন্যান্য যাঁরা কলকাতার অতীত ইতিহাস নিয়ে বিশেষভাবে অনুশীলন করেছেন, তাঁরা বেলভেডিয়ার হাউসের প্রতিষ্ঠা, মালিকানা এবং ক্রমিক ইতিহাস সম্বন্ধে একমত নন। এখানে আমরা এঁদের সকলের মতামত বিচার-বিবেচনা করে, ঐতিহাসিক দলিলপত্র-তথ্যাদির সাহায্যে, বেলভেডিয়ার হাউসের ইতিহাস উদ্ঘাটনের চেষ্টা করব।

বেলভেডিয়ার ভবনের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক হিসেবে যাঁদের নাম ঐতিহাসিকরা করেছন তাঁরা হলেন : আজিমউশ্বান, নবাব মীরজাফর আলি খাঁ, ভেরেলস্ট, বারওয়েল, কাটিয়ের, ওয়ারেন হেস্টিংস ও কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম টালি। কেউ বলেন এটা আজিমউশ্বানের বাগানবাড়ি, অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় তিনি তৈরি করেন। কেউ বলেন, মীরজাফর কিছুকাল এখানে বাস করেছেন। আশপাশের কয়েকটি অঞ্চলের মুসলমানি নাম এবং মুসলমান প্রধান বসতি দেখে কেউ কেউ মনে করেন একথা সত্য হতে পারে। কিন্তু একথা সত্য নয়, ভিত্তিহীন অনুমান মাত্র। কলকাতা শহরের বাইরে একটি অখ্যাত গ্রামে আজিমউশ্বানের পক্ষে বাগানবাড়ি নির্মাণ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নবাবের প্রাসাদও এখানে থাকতে পারে না। লটারি কমিটির রিপোর্ট (১৮১০-২১) থেকে জানা যায়, নবাবের কলকাতার বাসস্থান উত্তর কলকাতার চিৎপুরে, বর্তমান পোস্তার বাজারের কাছে ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই নবাবপ্রাসাদ ভেঙে ফেলা হয় এবং লটারি কমিটি তার ভগ্নাবশেষ, অর্থাৎ ইঁট চূণ সুরকি ইত্যাদি, কলকাতার পথঘাট নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করবেন বলে কিনতে চান। তার জন্য মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে তাঁরা আবেদন করেন। অতএব কলকাতার দক্ষিণে, শহর-সীমানার বাইরে, আলিপুরের মতো পল্লি অঞ্চলে, নবাবের বসবাসের প্রাসাদ ছিল এবং সেই প্রসাদ বেলভেডিয়ার ভবন, এরকম অনুমান ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন।

এখন প্রশ্ন হল, ভেরেলস্ট বারওয়েল কার্টিয়ের হেস্টিংস টালি প্রমুখ সেকালের বিখ্যাত ইংরেজদের সঙ্গে বেলভেডিয়ার ভবনের মালিকানা ইত্যাদি ব্যাপারে কতটা কি ধরনের সম্পর্ক ছিল। সেকালের একাধিক ইংরেজের কলকাতায় প্রচুর ভুসম্পত্তি ছিল। ভ্যানসিটার্ট, ক্যামাক, শর্ট, জনসন, ডেভিড হেয়ার এবং আরও অনেকের নাম করা যায়। লটারি কমিটির রিপোর্ট থেকে ইংরেজ ভূস্বামীদের একটি নামের তালিকাও তৈরি করা যায়। ওয়ারেন হেস্টিংস কেবল যে প্রাচ্যবিদ্যানুরাগী ছিলেন তা নয়, অর্থকড়ি ভূসম্পত্তি সম্বন্ধেও অতিশয় সজাগ ছিলেন। হেস্টিংসের ভূসম্পত্তি বেশির ভাগ ছিল আলিপুর অঞ্চলে। ১৭৬৩ সালে কাউন্সিলের কার্যবিবরণের মধ্যে দেখা যায় :

Mr. Hastings requests permission of the Board to build a bridge over the Collighuat Nulla on the road to his garden house agreed that his request be complied with (proceedings of the Council of Fort William, 20 June 1763).

কালীঘাটের নালার (অর্থাৎ আদিগঙ্গার) উপর যে ছোট সেতুটি দিয়ে ‘হেস্টিংস হাউস’ ও ‘বেলভেডিয়ারে’ যেতে হয়, সেই সেতু নির্মাণের কথা এখানে বলা হয়েছে। কিন্তু হেস্টিংস হাউস ওয়ারেন হেস্টিংস নির্মাণ করেন ১৭৭৬ সালে। তা হলে ১৭৬৩ সালে কোন বাগানবাড়িতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি কালীঘাটের নালার উপর সেতু করার অনুমতি চেয়েছেন কাউন্সিলের কাছে? ‘হেস্টিংস হাউস’ তৈরি হবার আগেও তা হলে তাঁর একটা বাগানবাড়ি এই অঞ্চলে ছিল। কোথায় ছিল সেই বাগানবাড়ি? ‘বেলভেডিয়ার হাউস’ আর ‘হেস্টিংস হাউসের’ মধ্যে ব্যবধান বেশি নয়, কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। হেস্টিংসের আমলে সমস্ত অঞ্চলটি একটি ভূখণ্ড ছিল, যার মধ্যে আজকের মতো কোনো পথঘাট ছিল না। এই অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের মালিক ছিলেন হেস্টিংস এবং তাঁর প্রথম বাগানবাড়ি বেলভেডিয়ার হাউস, দ্বিতীয়টি হেস্টিংস হাউস।

ডাচ অ্যাডমিরাল স্টেভোরিনাস (Stavorinus) ১৭৬৯ সালে কলকাতায় আসেন। তাঁর লেখা থেকে মনে হয় এই সময় গবর্ণর ভেরেলস্ট বেলভেডিয়ারে থাকতেন। তিনি লিখেছেন যে ডাচ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হুগলির ডিরেক্টর একদিন ভেরেলস্টের বাগানবাড়িতে সান্ধ্যভোজে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং এই বাড়িতে কলকাতা থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগে হেঁটে যেতে। তিনি একথাও লিখেছেন যে ভেরেলস্টের শাসনকালে মহারাজা নন্দকুমারের যথেষ্ট প্রভাব ছিল, কারণ তিনি প্রায় তখন বেলভেডিয়ারে যাতায়াত করতেন (‘he often went to Belvedere…’) ভেরলস্টের পরে কার্টিয়ের গবর্ণর হয়। কার্টিয়েরও বেলভেডিয়ারে থাকতেন মনে হয়, কারণ স্টেভোরিয়াস লিখেছেন (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৭০) যে কার্টিয়ের ডাচ কোম্পানির ডিরেক্টরকে তাঁর ‘country seat Belvedere’-এ তাঁর অশ্বযানে করে নিয়ে যান, কলকাতা থেকে প্রায় দুই ডাচ-মাইল দূরে, এবং সেখানে তাঁকে ‘an excellent concert performed by amateurs and an elegant supper’ এ আপ্যায়ন করেন। কার্টিয়েরের পর ফোর্ট উইলিয়ামের প্রথম গবর্ণর-জেনারেল হন ওয়ারেন হেস্টিংস। হেস্টিংস লিখেছেন যে ২৩ এপ্রিল ১৭৭৫ বেলভেডিয়ার ভবনে তাঁর সঙ্গে নন্দকুমারের বিচারের অন্যতম সাক্ষী কামালুদ্দিনের দেখা হয়। হেস্টিংসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিপ ফ্রান্সিসের (Phillip Francis) শ্যালক ও সেক্রেটারি আলেকজাণ্ডার ম্যাকরাবি (Alexander Macrabie) লিখেছেন যে একদিন (ফেব্রুয়ারি ১৭৭৬) ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর বেলভেডিয়ারের বাগান বাড়িতে একটি কনসার্টপার্টিতে তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কাজেই বেলভেডিয়ার হাউস একদা যে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগানবাড়ি ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু আগেকার বিবরণের মধ্যে একটু সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। ১৭৬৩ সালে, যখন ‘হেষ্টিংস হাউস’ তৈরি হয়নি তখন, এখানকার কোন বাগানবাড়িতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য হেস্টিংস কালীঘাটের গঙ্গায় নালার উপর দিয়ে সেতু নির্মাণের অনুমতি চেয়েছিলেন বোর্ডের কাছে? বেলভেডিয়ারই হবার কথা। তা যদি হয় তাহলে ভেরেলস্ট, কার্টিয়ের, এঁরা বেলভেডিয়ারকে বাগানবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন কি ভাবে? এমন হতে পারে যে হেস্টিংস মধ্যে মধ্যে তাঁর বাগানবাড়ি ভাড়া দিতেন, এবং কোম্পানির ভি. আই পি-দের সামাজিক অভ্যর্থনাদির জন্য ব্যবহার করতে দিতেন।

১৭৮৪ সালে দেখতে পাই হেস্টিংস আলিপুরে তাঁর একটি বাড়ি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, এবং ১৫ই জুন (১৭৮৪) তাঁর স্ত্রীকে লিখছেন : ‘I have ordered an advertisement to be made for the sale of Alipore and Rishera and shall clear myself as speedily as I can of other encumbrances.’ আবার ২১ জুন তারিখে লিখছেন : ‘I have actually advised the sale of it, Allipore in three lots, the old house and garden forming one, the new house and outhouses the second and the paddock the third.’ হেস্টিংসের এই উক্তির মধ্যে দেখা যায়, ‘পুরাতন’ ও ‘নতুন’ দুটি বাড়ির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। ‘নতুন’ বাড়িটি হেস্টিংস হাউস। কিন্তু ১৭৮৪ সালে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপিত ‘পুরাতন’ বাড়ি কোনটি? বেলভেডিয়ার হাউস নয়, কারণ ১৭৮০ সালে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার কাপ্টেন টালি (Tolly) বেলভেডিয়ার হাউস কিনে নেন। তাহলে কি আলিপুরে হেস্টিংসের আরও বাড়ি ছিল? থাকতে পারে, আলিপুরে হেস্টিংসের প্রচুর সম্পত্তি ছিল। ক্যাপ্টেন ট্যালি, বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ‘টালির নালা’ নামে খ্যাত আদিগঙ্গার খাতটি কেটেছিলেন এবং কালীঘাটের দক্ষিণ অঞ্চলের টালিগঞ্জ নাম যাঁর নামে হয়েছে।

১৭৮০ সালে বেলভেডিয়ার হাউস কিনে ক্যাপ্টেন টালি পাশ্চাত্য রীতিতে বাড়িটি পুনর্গঠন করেন। ১৭৮২ সালে টালি ক্যাপ্টেন থেকে লেফটন্যাণ্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৭৮৪ সালে ইংলণ্ড যাত্রাকালে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। ২৮ অক্টোবর ১৭৮৪, কলকাতার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় : ‘To be Let or Sold : Belvedere House. Apply to the Bank of Bengal.’ কিন্তু তার পর বেশ কয়েক বছর বাড়িটির আর কোনো খবর পাওয়া যায় না, মনে হয় বিক্রি হয়নি, ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮০২ ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় বেলভেডিয়ার হাউস ও তার সংলগ্ন সম্পত্তি বিক্রির একটি দীর্ঘ নোটিশ প্রকাশিত হয় :

‘‘To be sold by public auction, by Bring and Co, at their Auction room.” On Wednesday, the 24th March next, by order of Richard Johnson Esq, Attorney to the Administratrix of the late Colonel William Tolly, the undermentioned house, premises and land, belonging to his Estate.

Lot I. That large commodious and well-known house, called ‘Belvedere House’ with 72 Bighas, 8 Cottahs and 4 Chittaks of land, more or less, thereto belonging to William Augustus Brooke, Esq, at the yearly rent of $350, payable at the house of Messrs. William Paxton and Coy. of London (the house and premises to be kept in good repair at Mr. Brooke’s expenses) determinable on the 1st August, 1802.

Lot 11. A piece of ground about 81 Bighas and 14 Chittacks, more or less situated to the westward of the road leading from Belvedere Bridge to Belvedere House

Lot III. A piece of ground, about 39 Bighas, 10 Chittacks, more or less, to the eastward of the said road.

টালি সাহেবের সম্পত্তির বিবরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বেলভেডিয়ার সংলগ্ন চারিদিকের বিশাল ভূসম্পত্তির (প্রায় ১৯৩ বিঘা) তিনি মালিক ছিলেন, এবং মনে হয় একদা এই সম্পত্তি ও তার সঙ্গে হেস্টিংস হাউস ছিল হেস্টিংসের। প্রথম ‘লট’ অর্থাৎ কমবেশি ৭২ বিঘা জমিসহ বেলভেডিয়ার ভবন প্রথমে কেনেন নিকলাস নুজেন্ট (Nicolas Nugent), তারপর তাঁর কাছ থেকে কেনেন (১৮১০) বার্চ (John Brereton Birch)। বার্চের পর কিছুদিন ভারতের প্রধান-সেনাপতি এডওয়ার্ড প্যাজেট (১৮২২-২৫) বাড়িটির মালিক ও বাসিন্দা হন। তিনি তাঁর স্ত্রী হ্যারিয়েট প্যাজেটকে লেখেন : ‘It is most cheerful, clean and gentlemanlike and I would not change it for the Government House’. পরে বাড়িটি আবার বিক্রি হয়ে যায় এবং একসময় দেখা যায়, খ্যাতনামা সাংবাদিক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই বাড়ির মালিক ছিলেন (১৮২৭)। শম্ভুচন্দ্রের কাছ থেকে বোধ হয় আরও হাত ঘুরে প্রিনসেপ (Prinsep) পরিবারের হাতে যায়। প্রিনসেপদের কাছ থেকে ১৮৫৪ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কিনে নেন, বাংলার সরকারি লাটভবন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। বাংলার প্রথম লেফটন্যান্ট গবর্ণর ফ্রেডারিক হ্যালিডে এই সরকারি লাটভবনের প্রথম বাসিন্দা। হ্যালিডের সঙ্গে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক ছিল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যাসাগর শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার জন্য হ্যালিডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন, এবং যে স্থানে যেতেন সেই স্থানটি যে বেলেভেডিয়ার হাউস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হয় বিদ্যাসাগর পালকিতে চড়েই যেতেন।

বস্তুত বেলভেডিয়ার হাউসের জীবনী যে-কোনো বিচিত্র মানুষের জীবন-কাহিনির চেয়েও বিচিত্রতর। জানি না, কলকাতা শহরে এতজন মালিকের (অধিকাংশই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক পুরুষ) হাত ঘোরা, এতদিনের প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন-স্বরূপ; দ্বিতীয় আর কোনো গৃহসম্পত্তি, বেলভেডিয়ার হাউসের মতো আছে কিনা। বেলভেডিয়ার হাউসের বর্তমান যে গড়ন ও রূপায়ণ আমরা দেখতে পাই, তা প্রধান বাংলার লেফটন্যাণ্ট গবর্ণরদের আমলেই হয়েছে। বেলভেডিয়ারের উন্নয়নে প্রথম মনোযোগী হন উইলিয়াম গ্রে, তাঁর শাসনকালে (১৮৬৭-৭১)। রিচার্ড টেম্পল যখন ছোটলাট ছিলেন (১৮৭৪-৭৭) তখন বেলভেডিয়ারের পরিবেশ কিরকম ছিল, তার একটি সুন্দর বর্ণনা তিনি দিয়েছেন :

The official mansion is named Belvedere and well it deserves the name, being situated in a richly wooded suburb where the bamboos grow in fine profusion and throw up their tall stems tapering to the most delicate springs and gracefully bending so as to overarch the roads and lanes. ..In the middle of the park, studded with groups of trees, stands Belvedere House. Its terrace overlooks a rich expanse of verdure, its flights of steps environed by flowering creepers, its ponds covered with lotus and water lilies. Its gardens encircled with various trees, the banyan, the almond, the bamboo, the cotton tree, and even, by some specimens of the peerless Amherstia.

বেলভেডিয়ারের চারপাশে তখন প্রচুর বাঁশঝাড় ছিল, এবং লম্বা লম্বা বাঁশের ধনুকের মতো নুয়ে-পড়া সৌন্দর্যে টেম্পল মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ভিতরে অনেক পুকুর ছিল, তাতে জলপদ্ম নালফুল ফুটে থাকত। কলাগাছ বাদামগাছ তুলাগাছ এবং আরও নানারকমের গাছ ও লতাপাতায় ঘেরা ছিল বেলভেডিয়ার ভবন।

বেলভেডিয়ার হাউসের উত্তরদিকে সিঁড়ি, মধ্যিখানের বল-রুমের (নাচঘরের) কাঠের মেঝে ইত্যাদি তৈরি হয় অ্যাশলে ইডেনের (Ashley Eden) লাটত্বকালে (১৮৭৭-৭৯)। বেউলির (Stewart Colvin Bayley) আমলে (১৮৭৯-৮২ ও ১৮৮৭-৯০) উত্তর পূর্ব দিকের ‘Wooden glazed supper-room’ তৈরি হয়, এবং এলিয়টের আমলে তৈরি হয় (১৮৯০-৯৩) পশ্চিমদিকের দোতালার ঘরগুলি। অ্যালেকজাণ্ডার ম্যাকেনজির আমলে (১৮৯৫-৯৭) বেলভেডিয়ার ভবনে ইলেকট্রিক আলো জ্বলে, এবং তার কিছুকাল পরে পূর্বদিকের বিশাল নাচঘর ও দরবারহল তৈরি হয়, দৈর্ঘে প্রায় ১১৪ ফুট। এইভাবে বাংলার ছোটলাটদের আমলে, ১৮৫৪ সালের পর থেকে, বেলভেডিয়ার ভবনের বর্তমান আঙ্গিক রূপায়ণ হয়েছে। কেবল মালিকানার পরিবর্তনের দিক থেকে নয়, তার স্থাপত্যরূপ ও গৃহবিন্যাসের পরিবর্তনের দিক থেকেও মনে হয় ‘বেলভেডিয়ার হাউস’ (বর্তমানে যেখানে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠিত) কলকাতা শহরে একটি অদ্বিতীয় ঐতিহাসিক ভবন। এই প্রসঙ্গে একথাও মনে হয় যে এই বেলভেডিয়ারে ওয়ারেন হেস্টিংস অথবা ভেরেলস্ট কার্টিয়েরের রাজত্বকালে, তাঁদের যে বাগানবাড়িটি ছিল, এবং কর্নেল টালি যে বাড়িটিকে প্রথম পাশ্চাত্ত্যরীতিতে পুনর্গঠন করেন, তার চেহারা বা আকারপ্রকার কেমন ছিল।

৬। ঠাকুর (Tagore) পরিবারের বাড়িঘর

কলকাতা শহরের প্রাচীন বনেদি পরিবারের মধ্যে ঠাকুর-পরিবার নিঃসন্দেহে অন্যতম। এই বংশের আদিপুরুষ পঞ্চানন (ঠাকুর) যশোহর জেলা থেকে যোব চার্নকের সময়ে কলকাতায় এসে গোবিন্দপুরে (যেখানে ফোর্ট উইলিয়ম স্থাপিত) বাস করেন। আরও অনেকের মতো তিনিও ভাগ্যান্বেষণে আসেন। তাঁকে সকলে ‘ঠাকুর মশাই’ বলে ডাকত। তাই থেকে এই পরিবারের উপাধি ‘ঠাকুর’ হয়, যার ইংরেজি রূপ হল ‘Tagore’। পঞ্চাননের বংশধর জয়রাম পলাশির যুদ্ধের আগে মারা যান (১৭৫৬)। কলকাতার প্রথম জরীপের সময় (১৭০৭) আমিনের কাজ করে তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন। জয়রামের বংশধরদের মধ্যে নীলমণি (মৃত্যু ১৭৯১) ও দর্পনারায়ণ (১৭৩১-১৭৯৩) প্রধান। নীলমণির পুত্র রামমণি (১৭৫৯-১৮৩৩), রামমণির পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)। দেবেন্দ্রনাথের পিতা এবং রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ।

পাথুরিয়াঘাটা জোড়াসাঁকো ও বেলগেছিয়া, উত্তর কলকাতার এই তিনটি অঞ্চলে ঠাকুর পরিবারের বাড়িগুলি স্থাপিত। ঠাকুর পরিবারের আদি বাসভবন পাথুরিয়াঘাটা। দর্পনারায়ণের পুত্ররা পৃথক হলে, নীলমণির পরিবার জোড়া-সাঁকোয় উঠে যান এবং ঠাকুরবংশ দুটি প্রধান শাখায় ভাগ হয়ে যায়। দর্পনারায়ণের ধারা গোপীমোহন, প্রসন্নকুমার, যতীন্দ্রমোহন, সৌরীন্দ্রমোহন, জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং নীলমণির ধারায় দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, গনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ। ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন, সেইটাই দ্বারকানাথের ভদ্রাসন বাড়ি। ১৮২৩ সালে এই বাড়িতে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে দেশি গান ও ইংরেজি বাদ্যনৃত্য হয়। ইংরেজ ও বাঙালি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উৎসবে আমন্ত্রিত হন। নৃত্যগীতাদির শেষে ভাঁড়েরা সং সেজে আমোদ করেন এবং একজন ভাঁড় গো-বেশ ধারণ করে ঘাস চর্বণ করতে থাকলে দর্শকরা বাহবা দেন। এই বাড়ির ভিতরের ও বাইরের রূপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভিতরের দিকে অনেক খোলা জমি, বাগান ও পুকুর ছিল। পরিবারের একটি বালক সেই পুকুরে ডুবে মারা যাওয়াতে সেটা বুজিয়ে ফেলা হয়। তত্ত্ববোধিনী সভার প্রথম অধিবেশন হয় বাহির-বাড়ির একটি পুকুরের কেনো কুঠুরিতে। সেই পুকুর বুঝিয়ে ফেলে ৬ নং বাড়ির দক্ষিণের বাগান হয়। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে এই বাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

৬ নম্বরের ভদ্রাসন বাড়ির সামনে ৫ নং বাড়ি হল বৈঠকখানা বাড়ি। এই বাড়িও দ্বারকানাথ ঠাকুর তৈরি করেন। বেলগেছিয়ার বাগানবাড়িতে ইংরেজদের সঙ্গে আহার বিহার ও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের জন্য দ্বারকানাথ এই বৈঠকখানা বাড়ি নির্মাণ করতে বাধ্য হন। দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ির কথা দেবেন্দ্রনাথ আত্মজীবনীতে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসের’ ব্রাহ্মণকাণ্ডের ষষ্ঠ অংশে এই বাড়ি তৈরির কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথম জীবনে দ্বারকানাথের দেবদ্বিজে বিশেষ ভক্তি ছিল। প্রত্যহ তিনি হোম তর্পণ জপ করতেন, গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলার নিত্য পূজাও করতেন। তারপর যখন সাহেব-মেমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, বেলগেছিয়ার বাগানবাড়িতে খানাপিনা চলতে লাগল, তখন প্রথম প্রথম দ্বারকানাথ খানাটেবিলে বসতেন না, দূরে দূরে থাকতেন, এবং খানার শেষে গঙ্গাজলাদি স্পর্শ ও বস্ত্র ত্যাগ করে শুদ্ধ হতেন। কিন্তু পরে যখন সাহেব অতিথিদের অনুরোধে তাদের সঙ্গে খানাপিনায় যোগ দিলেন, তখন থেকে নিজে আর তিনি দেবপূজা করতেন না, তার জন্য বেতন দিয়ে ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করেছিলেন। শোনা যায়, তাঁর এরকম ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সংখ্যা ১৮ জন ছিল। দ্বারকানাথের জ্ঞাতিকুটুম্বরা তাঁকে পরিত্যাগ করা স্থির করেন। এই সময় তিনি তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসনের পাশে একটি বৈঠকখানা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেই নতুন বাড়িতেই বাস করতে থাকেন।

দ্বারকানাথ প্রথম যখন বিলাত যাত্রা করেন তখনও তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী তাঁকে পরিত্যাগ করার ভয় দেখান। তখন সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রা শাস্ত্রসম্মত নয় বলে হিন্দুদের কাছে নিষিদ্ধ ছিল। বিলেত থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি বৈঠকখানা বাড়িতে পৃথকভাবে বাস করতেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনস্থ এই বৈঠকখানা বাড়িতেই পরে দ্বারকানাথের পুত্র গিরীন্দ্রনাথের বংশধর বিখ্যাত শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ বাস করতেন।

বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি। বেলগাছিয়া রোডে দ্বারকানাথ তখনকার দিনে প্রায় দুই লক্ষ টাকার বেশি খরচ করে তাঁর বিখ্যাত বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন। নিমক মহলের দেওয়ানি করে এবং অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্বারকানাথের ধনদৌলত ও সামাজিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। উচ্চপদস্থ ইংরেজ ও দেশীয় লোক সকলেই তাঁকে সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি বলে সম্মান করতেন। নিজের বৈষয়িক স্বার্থরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য তিনি এই সকল সম্ভ্রান্ত লোককে তাঁর বাগানবাড়ি বেলগাছিয়া ভিলায় প্রায়ই নিমন্ত্রণ করতেন। ইংরেজ শাসকমহলে দ্বারকানাথের এমন প্রতিপত্তি ছিল যে সাহেবরা তাঁর সাহচর্য লাভ করে নিজেদের কাজকর্মের সুবিধা করে নিতেন। তখনকার দিনে বেলগাছিয়া ভিলায় নিমন্ত্রিত হননি, অথবা দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচিতি হবার সুযোগ লাভ করেননি, একথা বলতে বড় বড় সাহেবরাও মর্যাদার হানিকর বলে মনে করতেন।

বেলগাছিয়া ভিলার মতো সুসজ্জিত বাগানবাড়ি কলকাতা শহরে বা শহরতলিতে দ্বিতীয় ছিল না। ‘মোতি ঝিল’ নামে সুন্দর একটি খাল সমস্ত বাগানটির ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যেত। ঝিলের মধ্যে নীলপদ্ম লালপদ্ম এবং অন্যান্য নানারকমের ফুল সর্বদা ফুটে থাকত। এছাড়া বাগানে ফুলের সমারোহ ছিল অপূর্ব। বাগানে একটি বিশাল বৈঠকখানা ছিল, সেকালের নতুন ইউরোপীয় আসবাবে, চিত্রে ও ভাস্কর্যে সাজানো। বৈঠকখানার পিছনে ছিল একটি মার্বেল পাথরের ফোয়ারা। ঝিলের মাঝখানে ছিল একটি দ্বীপ এবং সেই দ্বীপের ওপর একটি Summer House। তাতে যাবার জন্য দুটি সেতু ছিল, একটি কাঠের সেতু, আর একটি ঝুলানো লোহার সেতু। দ্বীপের এই গৃহটি ছিল আমোদপ্রোমাদের নিভৃত স্থান। এই বাগানবাড়িতে দ্বারকানাথ অনেক বড় বড় ভোজ দিয়েছেন এবং ভোজ উপলক্ষে অজস্র অর্থব্যয় করেছেন। সেকালের সংবাদপত্রে ও সাময়িকপত্রে বেলগাছিয়া ভিলার একাধিক ভোজের বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি উদ্ধৃত করছি :

বেলগাছিয়া ভিলা

৩ ডিসেম্বর ১৮৩৬। শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যানে মহাভোজ ও তামাসা।-গত সোমবার রজনীতে শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বীয় অত্যুত্তম উদ্যানে শ্রীল শ্রীযুক্ত গবরনর জেনালের বাহাদুর ও অন্যান্য নূন্যাধিক তিন শত সাহেব ও বিবি সাহেব লোককে মহাভোজন করাইয়া পরমসন্তোষজনক তামাসা দর্শাইলেন। বিশেষতঃ নৃত্যগীত বাদ্য ও বহ্নুৎসবজনক ও অত্যুৎকৃষ্ট বহুবিধ ভোজ্য সমগ্রী প্রস্তুত ছিল। রাত্রি অষ্টম ঘটিকার পরেই নিমন্ত্রিত মহাশয়দের সমাগম হইতে লাগিল। অনন্তর বাদ্য বাদনারম্ভ হইয়া বাজিতে অগ্নি দেওয়া গেল। ঐ ব্যাপার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত হইল তাহার দর্শনে সমাগত সকলই অতিপ্রশংসা করিলেন। তৎপরে আরো গীত বাদ্য হইয়া যে অধঃকোষ্ঠে বিবিধ ভোজ্য দ্রব্যাস্বাদন করা গিয়াছিল তাহার কিঞ্চিৎ সকলই ভোজন পান করিলেন; অনন্তর মহানাচ আরম্ভ হইল। গবর্ণমেণ্ট হৌস হইতে সমাগত মহাশয়েদের অতিরিক্ত সুপ্রিম কোর্টের তিনজন শ্রীযুত জজ ও শ্রীযুত মাকালি সাহেব ও জনের দুই জন সেনাপতি সাহেব এবং কলিকাতাবাসি প্রায় তাবৎ বিশিষ্ট মহাশয়েরা তত্র সমাগত হয়েছিলেন। ঐ সদাশয় নিমন্ত্রিকবাবু নিমন্ত্রিতদের সন্তোষার্থে যাহা ২ প্রস্তুত করিয়াছিলেন তাহাতে সকলেই পরমাহ্লাদ জ্ঞাপন করিলেন।-সমাচার দর্পণ।

এই বেলগাছিয়া ভিলাতে দ্বারকানাথ একবার লাটভগিনী মিস ইডেনের সম্মানার্থে নাচ ও সান্ধ্যভোজের অনুষ্ঠান করেন (২৫ ফেব্রুয়ারী ১৮৪১)। অনুষ্ঠানে স্বভাবতঃই বিদেশি ও এদেশীয় শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা সকলেই প্রায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বাগানবাড়ির ঘরগুলি আলোতে আরশিতে, মির্জাপুরি কার্পেটে, লাল জাজিমে, সবুজ রেশমে, পুষ্পশোভিত মার্বেলের টেবিলে সাজানো হয়েছিল। হলঘরে বারান্দায় সিঁড়িতে নানারকমের লতাপাতা অর্কিড ও বাহারে গাছ বসানো হয়েছিল। ফুললতাপাতা, দেবদারু পাতার মালা এবং নানা রঙের পতাকা দিয়ে সেতু ও সামার-হাউসটিকে সাজানো হয়েছিল। হাজার হাজার রঙিন আলোয় ঝলমল করছিল বাগানবাড়ির পরিবেশ। হলঘরের ভিতরে বাজনা বাজছিল অবিরাম। মধ্যরাত্রের পরেও নাচের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বাইরে চলছিল ঘনঘন বিচিত্র সব আতশবাজির খেলা। দর্শক ও আমন্ত্রিতরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে এরকম জমকাল ভোজ কলকাতা শহরে পূর্বে তাঁরা আর কখনও দেখেননি (Calcutta Courier, 26 Feb 1841)। বেঙ্গল হরকরা, ক্যালকাটা কুরিয়ের প্রভৃতি পত্রিকায় ১৮৪০-১৮৪১ সালে বেলগাছিয়া ভিলায় দ্বারকানাথের এরকম অনেক ভোজ ও নাচের খবর পাওয়া যায়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ বেলগাছিয়ার বাগানে একটি জমকাল বলনাচ ও ভোজ হয়। অনেক হিন্দু ভদ্রলোক তাঁদের হিন্দুত্বের গোঁড়ামির জন্য কেবল নাচগান বাজনা ও বাজি পোড়ানো দেখে চলে আসেন, খানার টেবিলে বসেন না। তাঁদের বিদ্রূপ করে বেঙ্গল হরকরা লেখেন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০) :

There were a great many native gentlemen present on the occasion. Many of them remained to witness the exhibition of the fireworks only, and then returned, no doubt to escape the steam of the supper table.

এদিকে যাঁরা ভোজের লোভ সামলাতে না পেরে গোপনে খানা খেয়ে আসেন তাঁদের বিদ্রূপ করে বাংলা কাগজে ছড়া ছাপা হয়। যেমন

 বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরিকাঁটার ঝনঝনি,

 খানা খাওয়ার কত মজা, আমরা তার কি জানি?

 জানেন ঠাকুর কোম্পানি।

বেলগাছিয়া ভিলা বিক্রয়। ১৮৫৬ সালে দ্বারকানাথের এই বিখ্যাত বাগানবাড়ি বেলগাছিয়া ভিলা বিক্রি হয়ে যায়। সংবাদটি একটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় :

‘হা, যে উপবন প্রস্তুত করণে দ্বারকানাথ বাবু দুই লক্ষ টাকার অধিক ধন বিসর্জন করিয়াছিলেন এবং যে কাননে এক ২ রজনীতে ইংরাজাদি ভোজনে দশ বিশ সহস্র উড়িয়া গিয়াছিল গত শনিবারে সেই বাগান বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। শ্রীযুক্ত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ও শ্রীযুক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ৫৪ চুয়ান্ন সহস্র মুদ্রায় তাহা ক্রয় করিয়াছেন। দ্বারকানাথ বাবুর ধন কি অশুভক্ষণে উপার্জন হইয়াছিল, উদ্যানখানিও বিদ্বান সন্তানদিগের ভোগার্থে রহিল না, কাহার বিষয় কে ভোগ করেন কিছুই নিশ্চয় নাই। এক সময়ে বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর কলিকাতা নগরে সিংহ প্রতাপ প্রকাশ করিয়াছিলেন, সময়ান্তরে তাঁহার উদ্যানে সিংহ বাহদুরেরা সিংহ প্রতাপ দেখাইলেন। এই বাগান ক্রয়ার্থে ইংরাজ, বাঙালি সাধারণ বহুজন উপস্থিত ছিলেন, ঈশ্বর সহায়তায় প্রতাপ সিংহ প্রতাপে সকলেই হত প্রতাপ হইলেন কেহ ৪০ কেহ ৫০ একজন সাহেব তিপপান্ন হাজার পর্যন্ত ডাকিয়াছিলেন রাজদল যখন চুয়ান্ন হাজার ডাকিয়া বসিলেন তখন আর কেহ অধিক ডাকিতে পারিলেন না পরমেশ্বর করুন এই রম্যকানন পঞ্চানন ভোগে চিরকার থাকুক।”-সম্বাদ, ভাস্কর, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৫৬।

ট্যাগোর কাসল (Tagore Castle)। পাথুরিয়াঘাটার আদি ঠাকুব-বাড়ির সামনে ট্যাগোর কাসল। ১৮৯৫ সালে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর তাঁর বৈঠকখানাবাড়ি ও গ্রীষ্মাবাসটিকে ইয়োরোপীয় দুর্গের মতো গড়ে তোলা মনস্থ করেন। বড়লোকের খেয়ালই বড়। ম্যাকিনতোশ বার্ন কোম্পানি ইংলণ্ড থেকে এই বাড়ির ডিজাইন ও প্ল্যান করে নিয়ে আসেন। বাড়ির সম্মুখভাগ ইংলণ্ডের Castle-এর মতো, মধ্যকার Tower হবে Windsor Castle-এর মতো, একশো ফুট দীর্ঘ, মাথায় পতাকাদণ্ড। এই বাড়ি নির্মাণ সম্বন্ধে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় (Oct. 24, 1895) একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি এই :

Maharaja Sir Jatindro Mohan Tagore has made a new departure in the way of buildings for the residence of native noblemen in India by having his old Baitakhana or Summer residence changed so as to represent an English castle. The design and plan have been specially brought from England by Messrs. Mackintosh Burn and Co, who have the contract and the work for demolition and construction is being carried out fast. The entire frontage will be a representation of a castle in accordance with the engineer’s plan and the centre tower will represent that of Windsor Castle, and will be a hundred feet in height with a flag-staff on the top. There will be a clock-tower at the entrance with an illuminated chiming clock which is being brought out by Messrs Martin and Co. The building is to be named Tagore Castle’ and will be the Summer residence of the Maharaja. When completed ‘Tagore Castle’ which, of course will be appropriately furnished, will be one of the show-places of Calcutta.

৭। মার্বেল প্যালেস (মল্লিক প্রাসাদ)

কলকাতা শহরের একটি দর্শনীয় ভবন ‘মার্বেল প্যালেস’, মর্মর প্রাসাদ বলে নয়, চিত্রভাস্কর্যাদির একটি বিচিত্র সংগ্রহশালা হিসেবে। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিখ বাহাদুর (১৮১৯-৮৭) এই প্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক চোরবাগানের মল্লিকবংশের সন্তান। যখন তাঁর ষোল বছর বয়স তখন তিনি মর্মর প্রাসাদ নির্মাণ আরম্ভ করেন, ১৮৩৫ সালে, এবং পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ১৮৪০ সালে নির্মাণ শেষ হয়। শ্রীনরেন্দ্রনাথ লাহা লিখিত ‘সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে (১৯৪২ সাল) রাজেন্দ্র মল্লিকের জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে মর্মর প্রাসাদের যে বর্ণনা আছে, এখানে তা উদ্ধৃত হল :

”বিস্তীর্ণ ভূমির উপর এই প্রাসাদ নির্মিত ও উহার চতুর্দিক উচ্চ রেলিং দিয়া ঘেরা। উহার উত্তর ও পশ্চিমদিকের উদ্যান বৃক্ষবীথিকা, পুষ্পকুঞ্জ, প্রতিমূর্তি ও দুষ্প্রাপ্য পক্ষীর দ্বারা গঠিত পক্ষিশালায় শোভিত। প্রাসাদের অভ্যন্তর ভাগ বিশিষ্ট ঐশ্বর্যের পরিচায়ক-মেঝে মর্মর আবৃত এবং ছাদ সোনালি রঙে গিলটি করা। প্রবেশপথে ও বারান্দায় ইতালি ও ফ্রান্স হইতে সমানীত ব্রঞ্জধাতু ও মর্মরনির্মিত প্রতিমূর্তি শোভা পাইতেছে। এই প্রাসাদকে সুসজ্জিত করিবার জন্য রাজা রাজেন্দ্র মল্লিখ বাহুদুর প্রভূত অর্থ ব্যয় করিয়াছেন এবং ছবি ও প্রতিমূর্তির একটি দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি প্রত্যেক দেশের প্রতিভাবান ও খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পিগণের অঙ্কিত চিত্র ও খোদাই প্রতিমূর্তি সংগ্রহ করিয়া স্বীয় গৃহে স্থাপন করিয়া গিয়াছেন।

”উদ্যানের উত্তরদিকে অনেকগুলি মর্মর প্রতিমূর্তি চোখে পড়ে। এই সমস্ত মূর্তি প্রসিদ্ধ শিল্পী কর্তৃক গঠিত। এই স্থানের অদূরে মর্মর-ঝর্না বর্তমান, উহাতে চারিটি মূর্তি অধিষ্ঠিত-এই মূর্তিগুলি বসন্ত, শীত, গ্রীষ্ম ও শরৎ কালের দ্যোতক। ইহাতে উক্ত স্থানের দৃশ্য-সৌন্দর্য বহুগুণ বর্ধিত হইয়াছে। উদ্যানের পশ্চিমপ্রান্তে প্রথমেই মাইকেল এঞ্জেলোর পূর্ণাবয়ব মূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়; উহার অদূরে স্নানরতা ভেনাসের প্রতিমূর্তি ও একটি পূর্ণদেহ ব্রিটিশ গাভীর মূর্তি রহিয়াছে। গাভীর মূর্তিটি ব্রঞ্জ ধাতু দ্বারা গঠিত এবং ইহা প্রাচীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সার ইলাইজা ইম্পে রাজা বাহাদুরকে উপহার দিয়াছিলেন। প্রাসাদে উঠিবার সিঁড়ির উপর ডিস্কোবোলাস, মিনার্ভা, ব্যাকাস, ডিমস্থিনিস, সিংহপৃষ্ঠে উনা, ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে এরেনা প্রভৃতির মূর্তি বিরাজিত। উত্তর দিকের মর্মর-গৃহে মস্তকে কণ্ঠক-মুকুটধারী যীশুখ্রীষ্টের আবক্ষ মূর্তি দেখা যায়। পূর্বমুখে অবস্থিত সাইকি, ভেনাস, মার্কারির প্রতিমূর্তি সহজেই দর্শককে আকৃষ্ট করে। এতদ্ভিন্ন কুমারী মেরীর আবক্ষ মূর্তি শোভমান। রক্তমর্মর গঠিত গৃহে মহারানী ভিক্টোরিয়ার অভিষেক সময়ের পোশাকে সজ্জিত মূর্তি অত্যন্ত মনোহর। প্রাসাদের মধ্যস্থিত প্রাঙ্গণের চারিকোণে চারিটি মূর্তি আছে; উহারা চারিটি মহাদেশের প্রতীক। এইস্থানে বিরাজিত অ্যপোলোর মূর্তি রোমের পোপের প্রাসাদে অবস্থিত মূর্তির অনুকরণে গঠিত।

”তৈলচিত্রের মধ্যে ইতালীয় চিত্রকরের অঙ্কিত খ্রীষ্টের ‘মিশরে পলায়নে’র চিত্র সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘ক্রশ হইতে অবতরণ’ ও অন্য একটি বাইবেলের বিষয়ে অঙ্কিত চিত্র; উহা অ্যান্তোয়ার্প গির্জায় অবস্থিত চিত্রের প্রতিরূপ। লর্ড নর্থব্রুক ‘সেণ্ট ক্যাথারিনের বিবাহ’ বিষয়ক চিত্র গভর্ণমেণ্ট আর্ট স্কুলে উপহার দিয়াছিলেন; উহাও কালক্রমে মর্মর-প্রাসাদের অভ্যন্তরে স্থানলাভ করিয়াছে। এতদ্ভিন্ন ‘সিবিল’, ‘সেণ্ট সিবাষ্টিয়ানের আত্মবলি’, ‘ডায়েনা ও এণ্ডিমিয়ন’, ‘প্রভুর শেষ ভোজন,’ ‘আলিওয়ালের যুদ্ধে ষোড়শ ল্যান্সারের আক্রমণ’ প্রভৃতি চিত্রও উল্লেখযোগ্য। এতদ্ভিন্ন চিত্রশালায় আরও অনেক সুন্দর চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়।

‘অনেক বিদেশীর পর্যটক এই চিত্রশালা ও প্রাসাদ দর্শনে আগমন করিয়া থাকেন। ১৯১২ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে ভারতের রাজপ্রতিনিধি লর্ড হার্ডিঞ্চ, লেডি হার্ডিঞ্জ ও লেডি জেঙ্কিন্সের সমভিব্যাহারে এই প্রাসাদ দর্শনে আগমন করিয়াছিলেন।”

৮। আলিপুর পশুশালা

আলিপুর পশুশালা (Zoological Gardens) স্থাপিত হয় ১৮৭৬ সালে। এই প্রসঙ্গে রাজেন্দ্র মল্লিকের পশুপ্রীতি উল্লেখ্য। পূর্বোক্ত গ্রন্থে মল্লিক মহাশয়ের পশুপ্রীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘প্রাকৃতিক ইতিহাসের ছাত্ররূপে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুর পশুবিজ্ঞানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। তিনি নিজের বাড়িতে পশুশালা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং তাহাতে বহু মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য পশুপক্ষী স্থান পাইয়াছিল। কলিকাতা ও মফস্বলের বহু সম্ভ্রান্ত ও সাধারণ লোক প্রত্যহ এই পশুশালা দর্শন করিয়া প্রীতি লাভ করিত। তৎকালে তাঁহার পশুশালাই কলিকাতার মধ্যে একমাত্র পশুশালা ছিল। আলিপুর পশুশালা তখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তিনিই প্রথম অগ্রণী হইয়া আলিপুর পশুশালা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন এবং নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বহু মূল্যবান পশু উক্ত পশুশালায় দান করিয়াছিলেন। তাঁহার এই দানের স্মৃতি স্বরূপ আলিপুর পশুশালার উদ্যানে যে প্রথম গৃহ নির্মিত হয়, তাহার নামকরণ করা হইয়াছিল ‘মল্লিকস হাউস’।’

১৮৭৬ সালে যখন আলিপুর পশুশালা স্থাপিত হয়, তখন তার নিয়মকানুন কীরকম ছিল, সেই বিষয়ে ধারণা হবে এই বিজ্ঞপ্তিটি পাঠ করলে :

Zoological Gardens

Alipore

Rates of Admission

Rates of Admission

Pleasure boats may be hired at Re. 1 the hour.

Restaurants for both Europeans and Natives now open.

Members and Doners with their families have free admissions with carriages every day.

 H. M. Tobin

 Honorary secretary

আলিপুর পশুশালার শতবর্ষ পূর্ণ হয় ১৯৭৬ সালে। তখন অবশ্য ১৮৭৬ সালের দর্শক যাত্রীদের নানারকমের শৌখিন ঘোড়াগাড়ি, পালকি অথবা ঘোড়ার সমাবেশ আর দেখা যায়নি।

৯। আলিপুর মানমন্দির (Observatory)

আলিপুর মানমন্দিরের বয়স প্রায় একশো বছর পূর্ণ হতে চলল। প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস সর্বক্ষেত্রে মানুষের নিরাপত্তা ও সাবধানতার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার জন্য যে বৈজ্ঞানিক প্রস্তুতির প্রয়োজন তা সহজসাধ্য নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণের সূচনা হয় কলকাতা শহরে। ১৮৫৩ সাল থেকে পার্ক স্ট্রীটের সার্ভে অফিসে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের কাজ নিয়মিতভাবে আরম্ভ হয়। পার্ক স্ট্রীটের এই মানমন্দির থেকে বন্দরের জাহাজ চলাচলের সংকেত দেওয়া হত। ১৮৬৪ সালে অক্টোবর মাসে কলকাতায় যে প্রবল সাইক্লোন হয়, তারই ফলে বলা চলে, ভারতে এবং বাংলা দেশে আবহবিদ্যায় (Meterology) অনুশীলন আরম্ভ হয়। সাইক্লোনের সঙ্গে হুগলি নদীতে ভয়ংকর তুফান ওঠে। প্রায় ৮০,০০০ লোক ডুবে যায় ও মারা যায়, এবং বন্দরের অধিকাংশ জাহাজ নষ্ট হয়ে যায়। ১৮৬৫-১৮৭৪ সালের মধ্যে ভারতর্ষের, পাঁচটি প্রাদেশিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ-কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং বাংলার কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ১৮৬৭ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্ল্যাণ্ডফোর্ড (H. H. Blandford) তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন।

১৮৭৪ সালে English Meterological Council-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ নতুন পরিকল্পনা অনুসারে গড়ে ওঠে এবং ব্ল্যাণ্ডফোর্ড Imperial Reporter নিযুক্ত হন। ১৮৭৫ সালে তিনি একটি পরিকল্পনা রচনা করেন এবং তদনুযায়ী আলিপুর মানমন্দির স্থাপিত হয়। এর পর সার্ভে আফিসের আবহাওয়া বিভগের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্ল্যাণ্ডফোর্ডের পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস (Daily Weather Reports)। ১৮৭৭ সাল থেকে কলকাতার ‘দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ প্রকাশিত হতে থাকে।

১০। কৃষি-উদ্যান ‘সমাজ’

(Agri-Horticultural Society)

ব্যাপটিস্ট মিশনারি রেভারেণ্ড উইলিয়াম কেরী কৃষি-উদ্যান সমাজের প্রতিষ্ঠাতা। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮২০ টাউনহলে একটি জনসভায় উইলিয়াম কেরী এই ‘সমাজ’ (Society)  প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। সংস্থার উদ্দেশ্য ঘোষণা করে বলা হয় যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য, জমিজমার ও ফুল-ফল-ফসলের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করাই হবে এর প্রথম কাজ। তার জন্য একটি প্রশ্নপত্র রচনা করে বিভিন্ন স্থানে পাঠনো হয় এবং তার উত্তরগুলি সোসাইটির ট্র্যানজ্যাকসন্স ও জার্নালে প্রকাশিত হয়। সংস্থার অন্যতম কাজ হয় বিদেশ থেকে বাছাই-করা বীজ আমদানি করে এবং এদেশের বীজ ও গাছগাছড়ার চাষের উন্নতি করে ফল-ফুল-ফসলের ফলন ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা। সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সাত বৎসর পরে বজবজ রোডে বিভিন্ন ফলের গাছ নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য একটি নার্সারি স্থাপন করা হয় এবং আখড়াতে প্রায় ৫০০ বিঘার একটি বাগান করা হয় তামাক তুলা ও আখের উন্নত চাষের জন্য। কিন্তু কিছুদিন পরে এই বাগানগুলি ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৮৩৬ সালে শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে ছয় বিঘার মতো জমিতে মরিশাস থেকে নিয়ে আসা আখের চাষ করা হত। পরে এখানে আরও কিছু জমি নিয়ে ফুলফলেরও বাগান করা হয়। কিন্তু ১৮৬৬ সালে গবর্ণমেন্ট বোটানিক্যাল গার্ডেনের আয়তন বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত করেন এবং তার ফলে সোসাইটির কোনো বাগান ছিল না। ১৮৭৯ সালে আলিপুরে, বেলডেভিয়ার হাউসের পাশে প্রায় ৬৪ বিঘা জায়গা নিয়ে সোসাইটির বাগান করা হয়। এখনও সোসাইটির বাগান এইখানেই আছে।

১১। পুরাতন টাকশাল

(Old Mint)

পলাশির যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর সিরাজউদ্দৌলা ও ক্লাইভের মধ্যে চুক্তি হয় যে কলকাতার ইংরেজরা মুর্শিদাবাদের মতো সিক্কা টাকা তৈরি করতে পারবেন। কলকাতার টাকশাল (Mint) তৈরির পরওয়ানা দেন নবাব মীরজাফর ১৭৬০ সালে। ১৭৬২ সালে ইংরেজরা প্রথম কলকাতায় টাকা খোদাই করেন। তার একদিকে মোগল বাদশাহের মাথা এবং অন্যদিকে ফার্সি লিপি ছিল। প্রথম কয়েক বছর জন প্রিনসেপের (Jogn Prinsep) সঙ্গে চুক্তি করে ফলতাতে টাকা খোদাই করা হত। ১৭৮৪ সালে প্রিনসেপ তাঁর খোদাইয়ের যন্ত্রপাতি গবর্ণমেন্টকে দিয়ে দেন। ১৭৯১ সালে কলকাতায় প্রথম টাকশাল স্থাপিত হয়। এই প্রথম টাকশালটি ছিল সেন্ট জনস চার্চের একটু পশ্চিমে, যেখানে পরে স্ট্যাম্প স্টেশনারি আফিস স্থাপিত হয় (চার্চ লেনে)।

কলকাতায় দ্বিতীয় টাকশাল স্থাপিত হয় স্ট্র্যাণ্ড রোডে। বস্তুত দুটি টাকশাল এখানে স্থাপিত হয়, একটি রূপার মুদ্রার জন্য, আর একটি তামার মুদ্রার জন্য। প্রথমটি তৈরি করতে ছয় বছর সময় লাগে, খরচ হয় প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা। এই টাকশালের স্থাপত্য গ্রীসীয়ান ডোরিক স্টাইলের এবং স্ট্র্যাণ্ড-মুখী সামনের স্তম্ভগুলি এথেন্সের বিখ্যাত মিনার্ভা মন্দিরের অনুকরণে গঠিত। ১৮২৪ সালে এই টাকশালের ভিত স্থাপন করা হয়, ১৮৩০ সালে নির্মাণের কাজ শেষ হয় এবং ১৮৩১ সালে মিল্টের কাজ আরম্ভ হয়। ১৮৬৫ সালে তাম্রমুদ্রার টাকশালটি তৈরি হয়। স্ট্র্যাণ্ড রোডের এই টাকশাল ভবন কলকাতার প্রাচীন স্থাপত্যের একটি অন্যতম নির্দশন। কলকাতার তৃতীয় একটি টাকশাল আলিপুরে স্থাপিত হয়েছে।

১২। মেয়র্স কোর্ট। সুপ্রীম কোর্ট। হাইকোর্ট

১৭২৭ সালের এক রাজকীয় সনদ অনুযায়ী কলকাতায় ‘মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন’ গঠিত হয়। (বর্তমান কর্পেরেশন নয়)। একজন মেয়র (Mayor) ও ন’জন অল্ডারম্যান নিয়ে গঠিত এই কর্পেরেশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয় ইংরেজদের দেওয়ানি-ফৌজদারি-ধর্মীয় মামলা বিচারের। তার জন্য গবর্ণমেন্ট ডালহৌসি স্কয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি বাড়ি ভাড়া করেন। এই বাড়িতে মেয়রের আদালত (Mayyor’s court) বসত। এই আদালতই পুরাতন আদালত বা ওল্ড কোর্ট নামে পরিচিত এবং ‘ওল্ড কোর্ট হাউস’ রাস্তাটি এখনও সেই নামেরই স্মৃতি বহন করছে। ১৭৭৪ সালে যখন সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হয়, তখন মেয়র্স কোর্ট উঠে যায় এবং কিছুদিন পরে বাড়িটিকে ভেঙে ফেলা হয়। সেই স্থানটিতে পরে St. Andrews Church গঠিত হয় ১৮১৫ সালে। ১৭৭৪ সালে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হলে তার কোনো নিজস্ব ভবন না থাকার জন্য, কিছুদিন মেয়র্স কোর্ট ভবনেই আদালতের অধিবেশন হয়। মহারাজা নন্দকুমারের তথাকথিত অপরাধের বিচার হয় এই পুরাতন মেয়র্স কোর্ট ভবনে, ১৭৭৫ সালের ৮ জুন থেকে ১৬ জুন। প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে মহারাজা নন্দকুমারের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। নন্দকুমারের ফাঁসি হয় ৫ আগস্ট, ১৭৭৫। আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে।

বর্তমান হাইকোর্ট যেখানে অবস্থিত, সেই স্থানেই সুপ্রীম কোর্টের নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হয় ১৭৮০-৮৪ সালে। সেই বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন হাইকোর্ট ভবন তৈরি হয় ১৮৪২ সালে। বেলজিয়ামের Ypres-এর টাউন হলের মডেলে গথিক (Gothic) স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হাইকোর্ট। স্থপতি ওয়াল্টার গ্রান ভিলে (Walter Granville)। হাইকোর্টের টাওয়ারটির উচ্চতা ১৮০ ফুট।

১৩। টাউন হল

(Town Hall)

পুরাতন এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের মধ্যে, গবর্ণমেন্ট হাউসের পশ্চিমে ‘টাউনহল’ অবস্থিত। ‘টাউনহল’ নির্মাণের জন্য কলকাতায় প্রথম ‘লটারি কমিটি’ গঠিত হয় এবং এই কমিটি প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ কলকাতার রাস্তাঘাট ট্যাঙ্ক ইত্যাদির উন্নয়নের ও নির্মাণের কাজে লিপ্ত থকেন। আগে এই কমিটির কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। টাউনহল তৈরি করতে প্রায় সাত বছর সময় লাগে (১৮০৬-১৩); ওয়েলেসলীর পরিকল্পনা মিন্টের শাসনের শেষ বছরে (১৮১৩) বাস্তবে রূপায়িত হয়। নির্মাণের জন্য খরচ হয় প্রায় সাতলক্ষ টাকা (বর্তমানে অন্তত এককোটি টাকার সমান)। ভবনটি ডোরিক (Doric) স্থাপত্য রীতিতে গঠিত। ডিজাইনার কর্নেল গ্যারিসন ও ক্যাপ্টেন অওব্রে ইঞ্জিনিয়ার গাস্টিন। এই গাস্টিনের নামেই ‘গাস্টিন প্লেস’ রাস্তা, যেখানে পুরাতন রেডিও আফিস ছিল।

‘টাউনহল’ ভবনটি দ্বিতল, উত্তরে ও দক্ষিণে প্রশস্ত দীর্ঘ সিঁড়ি। দ্বিতল প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু এবং দুটি তলাতেই প্রায় ১৬২ ফুট × ৬৫ ফুট হলঘর আছে। হলঘরে অন্তত হাজার লোকের বসার জায়গা আছে। ১৬০ বছরের বেশি প্রাচীন এই টাউনহলের ইতিহাস আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ও অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এই টাউনহলের বিভিন্ন সভায় যাঁরা ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য হলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, কেশবচন্দ্র সেন, নবগোপাল মিত্র, এবং বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। পরিতাপের বিষয় এই যে টাউনহলের এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও গৌরব আজ শহিদ মিনারের চারিদিকের উন্মুক্ত ‘ময়দান’ কর্তৃক অপহৃত।

১৪। ঐতিহাসিক লরেটো হাউস (মিডলটন রো)

মিডলটন রো-তে লরেটো হাউসের গায়ে একটি প্রস্তরফলকে লেখা আছে :

This house was the graden-house of Mr. Henr Vansittart, Governor of Bengal 1760-64. It was occupied by Sir Elijah Impey, the first Chief justice of the supreme Court, Calcutta 1774-82, and also by Bishop Heber a few months in 1824

বাগান এবং সম্ভবত বাড়িটিরও মালিক ছিলেন উইলিয়ম ফ্র্যাংকল্যাণ্ড ১৭৪৯ সালে। সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা অভিযানের সময় পুরাতন কেল্লায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে এই ফ্র্যাংকল্যাণ্ড একজন। অবশ্য কেল্লা থেকে জাহাজে চড়ে তিনি পলায়ন করেন। তবে এই বাগান ও বাড়িটি যে তাঁর ছিল তার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায় Bengal Public Consultations-এর একটি প্রস্তাবে (৫ জানুয়ারী ১৭৬১)। প্রস্তাবটি এই :

There being no garden-house for .the refreshment of the Governor when the Lord of Business will permit him to retire and we being convinced the Hon’ble Company will have no objection to so reasonable an indulgence. Agreed we purchase the garden-house formerly belonging to Mr. Frankland for that use, at the price of ten thousand Arcot rupees, which we esteem it is well worth.

কোম্পানির কর্তারা অবশ্য এই প্রস্তাবে সম্মত হননি। ডিরেক্টরদের কাছে লিখিত ৩০ অক্টোবর ১৭৬২ তারিখের একটি চিঠিতে দেখা যায়, ভ্যান্সিটার্ট অবশেষে নিজের টাকা দিয়েই বাগান বাড়িটি কেনেন।

এই বাগানবাড়ির পরবর্তী বাসিন্দা সুপ্রীমকোর্টের চীফ জাস্টিস স্যার এলিজা ইম্পে (১৭৭৪)। বিশাল বাগানটিতে হরিণের দল ঘুরে বেড়াত বলে এটিকে ‘deer park’ বলা হত এবং বাগান তখন চৌরঙ্গি থেকে প্রায় ক্যামাক স্ট্রীট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাগানের চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল এবং বন্দুক কাঁধে করে সিপাইরা রাতে পাহারা দিত, যেহেতু ডাকাতদের তো বটেই, বাঘ ও অন্যান্য বন্য জন্তুদেরও উপদ্রব তখন যথেষ্ট ছিল চৌরঙ্গিতে। এলিজা ইম্পের এই ‘হরিণ-পার্ক’, থেকে ‘পার্ক স্ট্রীট’ নাম হয়েছে। পার্ক স্ট্রীটের আরও একটি পুরানো নাম ছিল ‘Burying Ground Road’- ‘গোরস্থান কা রাস্তা।’ পুবদিকের ‘South park street Cemetry’ জন্যই এই রাস্তাটিকে গোরস্থানের রাস্তা বলা হত।

কয়েক মাসের জন্য এই বাড়িতে বিশপ হেবারও বাস করেছিলেন (১৮২৪)। বাড়িটি যে কি বিশাল বাড়ি ছিল তা বিশপের নিজের কথা থেকেই বোঝা যায়। হেবার লিখেছেন : ‘I feel almost lost in a dining room sixty-seven feet long, a drawing room of the same dimensions, a study supported by arcades, and though low in proportion to its size, forty-five feet square’ এতবড় বিশাল বাড়িতে বিশপ হেবার বাস করতে বেশ অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। সেইজন্য তিনি ৫ নং রাসেল স্ট্রীটের বাড়িতে চলে যান (১৮২৪-২৫)।

১৫। ইণ্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন

আগেকার ‘রয়াল’ (Royal) কথাটি বাদ দিয়ে, ১৯৫০ সাল থেকে ‘ইণ্ডিয়ান’ নাম হয়েছে। ১৭৮৭ সালে বোটানিক গার্ডেন স্থাপিত হয়, আর বারো বছর পরে দুশো বছর পূর্ণ হবে। এর আদি পরিকল্পক রবার্ট কীড (Robert Kyd), যাঁর নামে ‘কীড স্ট্রীট’ রাস্তা আছে। কীড উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন না, কোম্পানির সেনাবিভাগের একজন অফিসার ছিলেন। কিন্তু গাছপালার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল, এবং যা সহজলভ্য নয় এরকম সব গাছগাছড়ার চাষ করার ব্যাপারে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন। কলকাতার সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে একখানি চিঠিতে তিনি লেখেন (১ জুন, ১৭৮৬) :

I take this opportunity of suggesting to the Board the propriety of establishing a Botanical Garden not for the purpose of collecting rare plants (although they have their use) as things of mere curiosity or furnishing article for the gratification of Luxury, but for establishing a stock for disseminating such articles as may prove beneficial to the inhabitants, as well as the natives of Great Britain and ultimately may tend to the extension of national Commerce and Riches; and this I conceive can best be effected by Government procuring from the different parts of India and establishing a Nursery Stock from which private individuals may be supplied gratis, who may think themselves qualified to adventure on a general cultivation of the innumerable articles which our posseesions will furnish the means of raising with success.

ইংলণ্ড থেকে কোম্পানির কর্তারা কীডের প্রস্তাব অনুমোদন করে উদ্যান স্থাপনের নির্দেশ দেন। শিবপুরে কমবেশি ৩০০ একরের মতো জমি নিয়ে বাগান করা হয়। এবং তার প্রথম ‘সুপার’ (Superintendent) হন কীড সাহেব। কীডের মৃত্যুর পর (১৭৯৩) বিখ্যাত ডঃ উইলিয়াম রক্সবার্গ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন। বাগানের মধ্যে গৃহ নির্মাণ করে (১৭৯৫) রক্সবার্গ সেখানেই বাস করতে থাকেন। পরবর্তীকালে এই গৃহই অধ্যক্ষদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিছুদিন উইলিয়ম কেরীও অস্থায়ী অধ্যক্ষের কাজ করেন। বাঙালি শিল্পীদের দিয়ে রক্সবার্গ দু’হাজারের বেশি তরুলতাগুল্মের রঙিন চিত্র আঁকিয়েছিলেন এবং সেগুলি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক রঙে অংকিত। সেগুলি বোটানিক গার্ডেনের গ্রন্থাগারের অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনকরূপে রক্সবার্গ সুপরিচিত। তাঁর পরবর্তী অধ্যক্ষ ডাঃ নাথানিয়েল ওয়ালিচ, আসামের চা আবিষ্কার যাঁর প্রধান কীর্তি এবং কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলে যিনি উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তারপর ফকনার, টমকস, জর্জ কিঙ প্রমুখ প্রখ্যাত উদ্ভিদতত্ত্ববিদরা বোটানিক গার্ডেনের অধ্যক্ষ হন, এবং উনিশ শতকের শেষে জর্জ কিঙের অধ্যক্ষতাকালে বাগানের অনেক উন্নতি হয়।

১৬। প্রেসিডেন্সি জেনারেল (পি.জি.) হাসপাতাল

কলকাতার আদি হাসপাতলটি ছিল সেন্ট জনস গির্জার পাশে, বর্তমান ১ নং গ্যাস্টিন প্লেস ও তার সংলগ্ন স্থানে। হাসপাতালটি অবশ্য সাক্ষাৎ যমালয়ের চেয়েও ভয়াবহ স্থান ছিল। শ্রীমতী ব্লেশিনডেন এই ভাষায় তার বর্ণনা দিয়েছেন :

It was a veritable death-trap to those unfortunates who were driven to seek its shelter, and had been the subject of constant complaint for years. At last, in 1768, a house was purchased from a native gentleman for the purpose of a hospital. It stood to the south of the maidan, practically in the country. This house, with various alterations and addition, including two other buildings created in 1795, remained in use as the Presidency General Hospital.

কোনো ‘নেটিভ’ ভদ্রলোকের কাছ থেকে বাড়িটি কেনা হয়েছিল, শ্রীমতী ব্লেশিনডেনের একথা বোধহয় ঠিক নয়। পুরাতন পি.জি. হাসপাতালের মধ্যস্থলের ব্লক (Central Block) বিখ্যাত মিশনারি কিয়েরনাণ্ডারের (J. Z. Kiernander)-যিনি মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা-বাগানবাড়ি ছিল। কলকাতার কাউন্সিল এই বাড়িটি ৯৮,০০০ আর্কট টাকা মূল্যে কেনেন হাসপাতালের জন্য (Consultations, April 26, 1768)। এই ব্লকের পশ্চিমে ও পূবে নতুন ব্লক নির্মাণ যখন আরম্ভ হয়, তখনও কিয়েরনাণ্ডার মধ্যের ব্লকে থাকতেন। ২০ জুন, ১৭৬৯ তিনি এই মধ্যের ব্লকটি হস্তান্তরিত করেন এবং তাঁর একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে নতুন তৈরি পশ্চিমের ব্লকে রুগি আসতে থাকে ২ এপ্রিল, ১৭৭০ থেকে : “The first house or central building was delivered up and taken possession of on june 20, 1769 … the west wing was begun to be inhabited by sick people on April 2, 1770” (Letter, dated May 7, 1770)। এইজন্য পি. জি. হাসপাতালটিকে কলকাতার সবচেয়ে পুরাতন হাসপাতাল বলা যায়, বয়স ২০৬ বছর (১৯৭৫ সালে) পূর্ণ হল।

১৭। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

‘মেডিক্যাল কলেজ’ স্থাপিত হয় ১৮৩৫ সালে (পরবর্তী ২৬ নং বিষয় দ্রষ্টব্য), এবং তার সংলগ্ন ‘হাসপাতাল’ স্থাপিত হয় ১৮৭৮ সালে। বড়লাট ডালহৌসি ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৪৮ হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হাসপাতাল-ভবন নির্মাণ করতে চার বছর সময় লাগে। ১ ডিসেম্বর ১৮৫২ আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতালের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। (ছবি দ্রষ্টব্য)। হাসপাতালের ভিত্তিস্থাপন অনুষ্ঠানের বিবরণ বিলাতের বিখ্যাত Illustrated London News পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (২০ জানুয়ারী ১৮৪৯)। ভিত্তিপ্রস্তরের পাদদেশে লেখা আছে :

This Hospital is founded for the Relief of the Sick poor of all classes and creeds in the city of Calcutta, and particularly for those afflicted with Epidemic Disease.

মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের প্রধান প্রবেশপথের (সিঁড়ির) উপরে দুটি শিলালিপি আছে। একটিতে লেখা আছে যে ‘Fever Hospital and Municipal Committee’ ১৮৩৫ সালে কলকাতার ‘নেটিভ হাসপাতালের’ (ধর্মতলা স্ট্রীটে ছিল) সার্জেন মার্টিনের (J. R. Martin) প্রস্তাব অনুযায়ী গঠিত হয়। এই কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হল, কলকাতা ও শহরতলির স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে কমিটি একটি বিস্তারিত রিপোর্ট রচনা করা। প্রায় দশ-এগার বছর ধরে অনুসন্ধান করে কমিটি একটি বিস্তারিত তথ্যবহুল রিপোর্ট দাখিল করেন এবং ”For the establishment of a great certain hospital in Calcutta this Committee collected the sum of Co’s Rs. 61,248-7-10” এই শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে-“To the above origin is, in a great measure, due the existence of the present hospital.” অর্থাৎ মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এই পুরাতন ‘ফিভার হসপিটাল অ্যাণ্ড মিউনিসিপাল কমিটি’ সর্বপ্রথম করেন। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার জে. পি. গ্র্যান্ট। চেয়ারম্যানসহ কমিটির রিপোর্টে স্বাক্ষর ছিল ষোল জনের। তাঁদের মধ্যে চারজন ভারতীয় এবং এই চারজনের মধ্যে তিনজন বাঙালি : রসময় দত্ত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রুস্তমজী কাওয়াজী।

দ্বিতীয় শিলালিপিতে প্রথমে হাসপাতাল-ভবন নির্মাণের ‘Fund’ বা তহবিল সংগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে :

পুরাতন ফিভার হসপিটাল সংগৃহীত ৬১,২৪৮ টাকা-৭-১০

নতুন ফিভার হসপিটাল সংগৃহীত ৬১,৭৫১ টাকা-৮২

লটারি কমিটির তহবিলের ‘ব্যালান্স’ ৫৭,৭৭১ টাকা-১৩-১১

প্রতাপচন্দ্র সিংহ মহাশয়ের দান ৫০,০০০ টাকা

গৃহনির্মাণের অর্থ সংগ্রহের কথা উল্লেখ করে শিলালিপিতে বলা হয়েছে :

The building was designed by

MESSRS, BURN AND CO, ARCHITECTS,

and constructed under the superintendence of

MAJOR HUGH FRASER, OF THE

BENGAL ENGINERS;

the pain for supplying the building with water

was furnished by

colonel forbes, of the same corps,

the foundation stone was laid by

The most Nobel the Marquis of Dalhousie, K.T.

governor-general of India,

on the 30th September, 1848,

in the 12th year of the reign of

her most gracious majesty queen

victoria.

the building was opened for the reception of

the sick

on the 1st December, 1852.

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনার যখন সূত্রপাত হয়, ১৮৪৫-৪৬ সালে, তখন কলকাতার ধনবান বণিক মতিলাল শীল বেশ বড় একখণ্ড মূল্যবান জমি দান করেছিলেন। সুতরাং এই হাসপাতাল নির্মাণে যাঁরা ভূমিদান বা অর্থদান করেছেন তাঁদের মধ্যে মতিলাল শীলকে অগ্রগণ্য বলা যায়। কেউ কেউ বলেন যে তখনকার দিনে এই জমির মূল্য ছিল প্রায় বারো হাজার টাকা। জমির আয়তন এই মূল্য থেকেই বোঝা যায়।

১৮। জেনারেল পোস্ট অফিস (জি.পি.ও)

ডালহৌসির পশ্চিমদিকে ‘বড় ডাকঘর’ (জি.পি.ও) ভবনটির নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৮৬৮ সালে। যে স্থানটিতে এই ডাকঘর নির্মিত তার বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এইজন্য যে এইখানেই ছিল ব্রিটিশ আমলের প্রথম ও পুরাতন কেল্লা (Old Fort), গঙ্গার তীরে, যেহেতু বর্তমানে স্ট্র্যাণ্ড রোডের অনেকটা জুড়ে তখন গঙ্গা প্রবাহিত ছিল। জি.পি.ও ভবনের দুপাশে বিভিন্ন ফলকে কেল্লার অবস্থানের কথা উল্লেখ করা আছে।

১৯। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

কার্জনের মানস-প্রাসাদ ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে’র স্থান নির্বাচন, স্থাপত্যরীতি ইত্যাদি নিয়ে ১৯০২ সাল থেকেই বিতর্ক ও আলোচনা হতে থাকে। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় (১৯০২-০৩) সম্পাদকীয় আালোচনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশেষে সর্বদিক বিবেচনা করে বর্তমান স্থানটি (যেখানে পুরাতন ‘প্রেসিডেন্সি জেল’ ছিল) নির্বাচন করা হয় এবং পঞ্চম জর্জ যখন যুবরাজ ছিলেন তখন তিনি কলকাতায় এসে ৪ জানুয়ারি ১৯০৬ তারিখে মেমোরিয়াল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় পনেরো বছর সময় লাগে নির্মাণের কাজ শেষ হতে। পরবর্তী যুবরাজ ২৮ ডিসেম্বর ১৯২১ তারিখে আনুষ্ঠানিক-ভাবে মেমেরিয়াল ভবনের দ্বার উদ্ঘাটন করেন।

মেমোরিয়ালের বহিরঙ্গ গঠিত হয়েছে যোধপুর রাজ্যের মাকরানা মার্বেল পাথরে। স্থপতি হলেন স্যার উইলিয়াম ইমার্সন (Sir William Emerson)। নির্মাণকার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেসার্স মার্টিন অ্যাণ্ড কোম্পানিকে। তাঁরা পর্যবেক্ষক স্থপতি (Superintendent Architect) V. J. Each-এর তত্ত্বাবধানে নির্মাণের কাজ করেন। স্থাপত্যরীতিকে প্রধানত ‘রেনাসাঁস স্টাইল’ বলা যেতে পারে, যদিও স্যারাসেনিক (Saracenic) রীতির প্রভাবও কিছু লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ রাজত্বকালে বহু মূল্যবান নিদর্শন, চিত্র দলিলপত্র ইত্যাদির মিউজিয়াম বলা যায়। এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে, ব্রিটিশ যুগের ইতিহাসের গবেষণার দিক দিয়ে যার মূল্য অস্বীকার করা যায় না।

প্রা চী ন শি ক্ষা – সং স্কৃ তি র প্র তি ষ্ঠা ন

২০। এশিয়াটিক সোসাইটি

প্রাকৃতিক ও মানবিক যাবতীয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও অনুশীলনের জন্য কলকাতা শহরে এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয় ১৫ জানুয়ারি ১৭৮৪। আর নয় বছর পরে সোসাইটির দুইশত বৎসর পূর্ণ হবার কথা। একমাত্র এই উদ্দেশ্যে স্থাপিত ‘ব্যাটেভিয়ান সোসাইটি’ (Bataviaasch Genootschap van Kunsten Wetenschappen, 1779) ছাড়া, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে কলকাতার তথা বাংলা দেশের এশিয়াটিক সোসাইটিকে প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বলা যায়। মধ্যে সোসাইটির নামের আগে ‘রয়্যাল’ ও ‘বেঙ্গল’ কথা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু পুনরায় এশিয়াটিক সোসাইটি তার আদি আসল নামটিই গ্রহণ করেছে।

এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৩ সালে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি মনোনীত হয়ে কলকাতায় আসেন। প্রাচ্যবিদ্যা ও বিভিন্ন প্রাচ্যভাষায় জোন্স নিজে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই বিষয়ে অনুসন্ধান অনুশীলনের জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন মনস্থ করেন, ১৫ জানুয়ারী ১৭৮৪ সুপ্রীম কোর্টের (তখন বর্তমান হাইকোর্টের স্থানটিতে ছিল) Grand Jury-র কক্ষে তিরিশ জন প্রাচ্য বিদ্যানুরাগী ইউরোপীয়কে একটি সভায় মিলিত হতে আহ্বান করেন। সভায় আলোচনার পর, জোন্সের প্রস্তাব অনুযায়ী, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ স্থাপিত হয়। সভার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে জোন্স বলেন, “…the bounds of its investigation will be the geographical limits of Asia and within these limits its enquiries will be extended to whatever is performed by man or produced by nature.” সভার কাজকর্ম কিছুকাল সুপ্রীমকোর্ট ভবনেই চলতে থকে। তারপর ১৮০৫ সালে চৌরঙ্গি-পার্কস্ট্রীটের সংযোগস্থলে সরকার গৃহ নির্মাণের জন্য ভূমি দান করেন। ক্যাপ্টেন লক-এর নকশা অনুযায়ী ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার জ্যাঁ জ্যাক পিসোঁ (Jean Jack Pichon) গৃহ নির্মাণের কাজ শেষ করেন ১৮০৮ সালে। এই পুরাতন সোসাইটি-ভবন নতুন গৃহের পাশে এখনও আছে।

প্রাচ্যবিদ্যা ভারতবিদ্যা বিজ্ঞান উদ্ভিদবিদ্যা নৃতত্ত্ব ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের অনুশীলনের দিক দিয়ে বিচার করলে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’কে নিঃসন্দেহে একটি সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বলা যায়। কেবল কলকাতার বা বাংলার অথবা ভারতের গৌরব নয়, এশিয়াটিক সোসাইটি সারা পৃথিবীর গৌরব। দুষ্প্রাপ্য পুঁথিপত্র পুস্তকাদির সংগ্রহের দিক দিয়ে সোসাইটির গ্রন্থাগার অদ্বিতীয়।

২১। কলকাতা মাদ্রাসা

কয়েকজন সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত মুসলমান ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গবর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান যে তাঁরা এমন একজন পণ্ডিত মৌলবীর সন্ধান পেয়েছেন, যাঁর অধীনে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এবং সেই মাদ্রাসায় মুসলমান আইনকানুন শিখে ছাত্ররা সরকারি কাজের উপযুক্ত হতে পারে। এই পণ্ডিত মৌলবীর নাম হল মজিদউদ্দীন। ওয়ারেন হেস্টিংস এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং অক্টোবর মাসে (১৭৮০) মজিদউদ্দীনের উপর একটি স্কুল চালাবার ভার দেন। অক্টোবর থেকে এপ্রিল ১৭৮১ পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রায় ৬২৫ টাকা নিজে খরচ করে হেস্টিংস এই স্কুলটি চালান। কিছুদিন পরে বৈঠকখানার (শিয়ালদহ) কাছে পদ্মপুকুরে ৫৬৪১ টাকা দিয়ে একখণ্ড জমি হেস্টিংস স্কুলের গৃহ নির্মাণের জন্য কেনেন। ১৭৮১ সালের এপ্রিল মাসেই তিনি বোর্ডের কাছে প্রস্তাব করেন যে স্কুলের ব্যয়ভার ও তার গৃহনির্মাণের খরচপত্রের দায়িত্ব গবর্ণমেন্টের নেওয়া কর্তব্য। বোর্ড এই প্রস্তাবে সম্মত হন। ১৭৮২, ৩ জুনের একখানি সরকারি কাগজে প্রকাশ, ৩০ এপ্রিল ১৭৮১ থেকে পরের বছরের মে মাস পর্যন্ত মাদ্রাসার হিসেবনিকেশ বোর্ডের কাছে পেশ করে হেস্টিংস নিজের খরচপত্র বাবদ ১৫,২৫২ টাকা, এবং বৈঠকখানার কাছে পদ্মপুকুরে যে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল তার মূল্য বাবদ ৫৬৪১ টাকা পরিশোধ করার জন্য বোর্ডকে অনুরোধ করেন। বোর্ড টাকা শোধ করে দেন। দেখা যাচ্ছে, ১৭৮২ সালের জুন মাসের আগেই মাদ্রাসা তৈরি হয় এবং বউবাজারের দক্ষিণে, আগে যে বাড়িতে চার্চ অফ স্কটল্যাণ্ডের জেনানা মিশন প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেখানেই মাদ্রাসা স্থাপিত হয়।

কিন্তু উক্ত স্থানের পরিবেশ ছাত্রদের শরীর ও মনের অনুকূল নয় বলে শেষ পর্যন্ত কলিঙ্গতে (বর্তমান ওয়েলেসলি স্কয়ার অঞ্চল) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়। কলিঙ্গ অঞলের মুসলমান-প্রাধান্যও এই স্থান নির্বাচনের অন্যতম কারণ। ১৮২৩ সালের জুন মাসে এই সিদ্ধান্ত করা হয়। এবং জমির মূল্য ও গৃহ নির্মাণ বাবদ সরকার ১৪০৫৩৭ টাকা ব্যয় করেন। ১৫ জুলাই ১৮২৪, বর্তমান মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়। গৃহ নির্মাণে সময় লাগে তিন বছর। ১৮২৭ সালের আগস্ট মাস থেকে নিয়মিতভাবে মাদ্রাসার কাজকর্ম চলতে থাকে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সংবাদ ‘সমাচার দর্পণ’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয় (২৪ জুলাই ১৮২৪) :

সংপ্রতি শুনা গেল ১৫জুনাই বৃহস্পতিবার শহর কলিকাতাতে এক মহম্মদী মদরসা অর্থাৎ পাঠশালার মূলপ্রস্তর সংস্থাপন হইয়াছে এবং মেসনরি সংপ্রদায়ের সাহেবরা পার্ক স্ট্রীটে ৩৮ নম্বরের গ্রাণ্ডলার্ড নামে গৃহে একত্র হইয়া বাদ্যোদ্যম করত ধারানুসারে সেখান হইতে গমন করিয়া ঐ পাঠশালার মূল প্রস্তর সংস্থাপন করিলেন পরে ঐ সংপ্রদায়ের ধর্মাধ্যক্ষ তদ্বিষয়ে সর্বস্রষ্টা সর্বব্যাপী পরমেশ্বরের স্তব করিলেন। পরে রূপ্যময় কৌটাতে করিয়া যব ও দ্রাক্ষরস ও তৈল লইয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিয়া তদুপরি অর্পণ করিলেন। ঐ সময় নগরস্থ অনেক লোক তদ্দশার্থ সে স্থানে একত্র হইয়াছিল।

ওয়েলেসলি স্কয়ারের উত্তরদিকে কলকাতা মাদ্রাসার এই পুরাতন ভবনটির এখনও অস্তিত্ব আছে।

২২। হিন্দু কলেজ (প্রেসিডেন্সি কলেজ)

সম্ভ্রান্ত ধনিক হিন্দুদের দানে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কলকাতার তথা বাংলার তথা ভারতেরও প্রথম পাশ্চাত্ত্যবিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজ। তারই উত্তর-প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজ। ৩০৪ নং চিৎপুর রোডের গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে প্রথমে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয় এবং পাঠ আরম্ভ হয় ১৮৭১ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে। ‘মহাপাঠশালা’ ও ‘মহাবিদ্যালয়’ও বলা হত হিন্দু কলেজকে। কলেজ পরিচালনার জন্য গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গানারায়ণ দাস ও হরিমোহন ঠাকুরকে নিয়ে প্রথম ম্যানেজিং কমিটি গঠিত হয়। কলেজের গভর্ণর ছিলেন গোপীমোহন ঠাকুর ও বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র। ১৮১৯ সালে ডেভিড হেয়ার কলেজের ‘ভিজিটার’ বা পরিদর্শকের পদ গ্রহণ করেন। চন্দননগর নিবাসী ডি’ আনসেলম মাসিক ২০০ টাকা বেতনে প্রথম হিন্দু কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অধিকাংশ ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু, যাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, তাঁরা হিন্দু কলেজের ছাত্র। গোলদীঘির ‘সংস্কৃত কলেজ’ ভবন সংলগ্ন ছিল হিন্দু কলেজ ও স্কুল (পরবর্তী ২৩ নং বিষয় ‘সংস্কৃত কলেজ’ দ্রষ্টব্য)।

প্রেসিডেন্সি কলেজের উৎপত্তি হিন্দু কলেজ থেকে, এবং একথাও বলা যায় যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৮৫৭) উৎপত্তি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। নতুন শিক্ষাবিধান অনুসারে ১৮৫৪ সালের জুন মাস থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়, এবং হিন্দু কলেজ-ভবনেই তার শিক্ষাদানের কাজ চলতে থাকে। স্থানাভাবে কলেজের কয়েকটি ক্লাস হত দেওয়ান রামকমল সেনের বাড়িতে এবং তারই দোতালায় থাকতেন তখন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপটেন রিচার্ডসন। অ্যালবার্ট হল প্রথমে এই বাড়িতেই স্থাপিত হয়। পরে এই বাড়ি ভেঙে ফেলে অ্যালবার্ট বিল্ডিংস তৈরি হয়েছে (এখন যেখানে কফি হাউস ও বইয়ের দোকান আছে)। বর্তমান কলেজ-ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেন বড়লার্ট নর্থব্রুক ১৮৭২ সালে এবং ছোটলাট ক্যাম্বেল নতুন ভবনের দ্বার উদ্ঘাটন করেন ১৮৭৪ সালের মার্চ মাসে। ১৯৫৪-৫৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের শতবর্ষ পূর্ণ হলেও, ১৯৭৪ সালে কলেজ ভবনের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিন্দু স্কুল পূর্বের হিন্দু কলেজের ‘জুনিয়ার’ বিভাগের উত্তর-প্রতিষ্ঠান, যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজ ‘সিনিয়ার’ বিভাগের। এই চৌহদ্দির মধ্যস্থিত হেয়ার স্কুলও শতবর্ষের বেশি প্রাচীন।

২৩। সংস্কৃত কলেজ

সংস্কৃত কলেজের গৃহ নির্মাণের জন্য কলেজ স্কয়ারের (গোলদীঘি) উত্তর-দিকের সমস্ত জমি (৫ বিঘা ৭ কাঠা) কেনা হয়। জমির মালিক ডেভিড হেয়ার ৫০০ টাকা কাঠা মূল্যে জমি বিক্রি করেন। হেয়ার সাহেব যথেষ্ট ভূসম্পত্তি করেছিলেন কলকাতায় (আগের লটারি কমিটির বিবরণ দ্রষ্টব্য) এবং দরিদ্র এদেশীয় বালক যারা তাঁর পালকির পিছনে ছুটত, তাদের পয়সা কড়ি ও বিদ্যা বিনা পয়সায় দান করলেও জমিজমা বিশেষ দানধ্যান করতেন না। হিন্দু কলেজ তখন সরকারের অধীনে এসেছে এবং সংস্কৃত কলেজ সরকারি কলেজ। হিন্দু কলেজের নিজস্ব গৃহ ছিল না। তাই ঠিক হয়, সংস্কৃত কলেজ সংলগ্ন হিন্দু কলেজেরও গৃহ একত্রে নির্মাণ করা হবে। কলেজভবন নির্মাণের জন্য গবর্ণমেন্ট একলক্ষ কুড়ি হাজার টাকা মঞ্জুর করেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪ সংস্কৃত কলেজ-ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। নির্মাণের কাজ শেষ হতে প্রায় আড়াই বছর সময় লাগে। ১ মে ১৮২৬ সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ-স্কুল-সহ নবনির্মিত গৃহে প্রবেশ করে। এই কলেজ-ভবনের শতবর্ষ সবেমাত্র পূর্ণ হয়েছে। পুরাতন ভবনের অস্তিত্ব এখনও আছে, এবং যে কক্ষটিতে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম অধ্যক্ষের কাজ করেছেন, বিধবাদের পুনর্বিবাহের সমর্থনে প্রাচীন শাস্ত্রের পুঁথিপত্রের পাতা মধ্যরাত পর্যন্ত অনুসন্ধান করেছেন, তা এখনও দেখা যায়। এই গৃহের পাশে নতুন একটি কিম্ভুতকিমাকার স্থাপত্যরীতিতে (যাকে Functional Style বলে) বিশাল অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে এবং দৈবক্রমে পুরাতন গৃহটি রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেনেট হল’ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে এবং তার পরিবর্তে সেখানে functional style-এর একটি কুৎসিত ইমারৎ তৈরি হয়েছে। ‘সেনেট হল’ ধূলিসাৎ না করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামপাসে এ রকম ইমারত তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এদেশের বিদ্যা যাঁরা দান করেন এবং বিদ্বানদের তৈরি করেন তাঁদের ইতিহাস-ঐতিহ্যবোধ বলে কিছু যে থাকবেই এমন কোনো কথা শাস্ত্রে লেখা নেই।

২৪। মেডিকাল কলেজ

সংস্কৃত কলেজে ও কলকাতা মাদ্রাসায় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষা দেওয়া হত। ১৮২৪ সালের অক্টোবর মাসে একটি Native Medical Institution-ও খোলা হয়। ১৮৩৫ সালে মেডিকাল কলেজ স্থাপিত হয়। নতুন মেডিকাল কলেজ স্থাপিত হবার আগে ১৮২৫ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে, ‘নেটিভ মেডিকাল ইনস্টিটিউশন’ থেকে ১৬৬ জন চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষা পান। তাঁদের ‘Native Doctor’ বলা হত। ১৮৩৩ সালে উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক এদেশে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা কি অবস্থায় আছে, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেন। কমিটি ১৮৩৪ আক্টোবরে একটি দীর্ঘ রিপোর্ট দাখিল করেন। ২৮ জানুয়ারি ১৮৩৫ বেণ্টিঙ্ক একটি আদেশ জারি করেন (G. O. No. 28, 1835) সংস্কৃত কলেজ, মাদ্রাসা ও নেটিভ মেডিকাল ইনস্টিটিউশনে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা বন্ধ করে দেন এবং মেডিকাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এই আদেশে বলা হয়-

“The instruction be given through the medium of the English language.”

That all foundation pupils be required to learn the principles and practice of the medical science in strict accordance with the mode adopted in Europe.”

এখন যেখানে মেডিকাল কলেজ স্থাপিত, আগে সেখানে Petty Court Jail ছিল। এই জেলখানাতেই প্রথম মেডিকাল কলেজের কাজ আরম্ভ হয়। নেটেভ মেডিকাল ইনস্টিটিউশনের বৈদ্য শ্রেণির অধ্যাপক পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (নিজেও বৈদ্য), সংস্কৃত কলেজের দু’জন শিক্ষক (বৈদ্যশ্রেণির) সরকারি নিয়ে নতুন মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। আসিস্টাণ্ট সার্জেন ব্রামলি (M. J. Bramley) কলেজের প্রথম সুপারিনটেনণ্ডেণ্ট নিযুক্ত হন এবং তাঁর সহকারি হন গুডিভ (Asst. Surgeon. H. H. Goodeve)। ১৮৩৫, ৫ আগস্ট থেকে ব্রামলি অধ্যক্ষ (Principal) হন, সুপারিনটেনডেন্টের পদ তুলে দেওয়া হয় এবং গুডিভ Professor of Medicine and Anatomy নিযুক্ত হন। পরে অ্যাসিস্টান্ট সার্জেন William B.O. Shaughnessy রসায়ন ও মেটিরিয়া মেডিকার অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

২০ ফেব্রুয়ারি (১৮৩৫) থেকে কলেজের ক্লাস আরম্ভ হয়। কোনো লাইব্রেরি নেই, মিউজিয়াম নেই, হাসপাতাল নেই, যন্ত্রপাতি নেই, এই অবস্থায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিদ্যার সূচনা হয় কলকাতায়। অ্যানাটমির বিভিন্ন জিনিসপত্তরের সঙ্গে দুটি নরকঙ্কাল ইংলণ্ড থেকে, বাথগেট কোম্পানির মাধ্যমে, কিনে আনা হয় ১৫০০ টাকা মূল্যে। ডক্টর গুডিভ অ্যানাটমির ক্লাসে যেদিন একটি শবদেহ তাঁর লেকচার-টেবিলের উপর নিয়ে আসেন, সেদিন ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে রীতিমত কৌতূহল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ১০ জানুয়ারি ১৮৩৬ পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, তাঁর চারজন সাহসী ছাত্রদের নিয়ে খুব গোপনে অধ্যাপক গুডিভের সঙ্গে কলেজ-গৃহের পাশের একটি আউটহাউসে যান এবং সেখানে নিজের হাতে শবব্যবচ্ছেদ (dissection) করেন। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু, সমস্ত ধর্মীয় সংস্কার নিষেধ থেকে মুক্ত হয়ে, প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতো শবব্যবচ্ছেদ করেন। এইজন্য এই দিনটি, এবং পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, ভারতের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন ও নাম। তাঁর সঙ্গে যে চারজন ছাত্র ছিলেন তাঁদের মধ্যে উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, রাজকৃষ্ণ দে এই তিনজনের নাম জানা যায়, আর একজনের নাম জানা যায়নি। ছাত্রদের মধ্যে রাজকৃষ্ণ দে প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ করেন। মধুসূদন গুপ্তের শব-ব্যবচ্ছেদের ঐতিহাসিক দিনটির কথা স্মরণ করে, পরে ১৮৫০ সালে, বেথুন সাহেব মেডিকাল কলেজ বেলনস (Belnos) অংকিত মধুসূদন গুপ্তের একটি চিত্র দান করেন।

২৫। ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম

ভারতীয় যাদুঘরের (Indian Museum) বর্তমান চৌরঙ্গির ভবনটি একশো বছর আগে ১৮৭৫ সালে নির্মিত। কিন্তু মিউজিয়ামের উৎপত্তি তারও প্রায় ষাট বছর আগে ১৮১৪-১৫ সালে, এশিয়াটিক সোসাইটিতে। ১৮১৪ সালে বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ওয়ালিচ এই ধরনের একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারপর এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক ভূতাত্ত্বিক নানাবিধ দুষ্প্রাপ্য পদার্থের সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। ১৮৩৫ সালে ভারত সরকার এদেশের খনিজ সম্পদের অনুসন্ধানে মনযোগী হন এবং Economic Geological পদার্থাদি সংগ্রহের জন্য একটি মিউজিয়াম খোলেন ১৮৪০ সালে। ১৮৫৮ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেন এই মর্মে যে সোসাইটি কর্তৃক সংগৃহীত বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহগুলি নিয়ে একটি সর্বভারতীয় মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হোক। সরকার এই প্রস্তাবে সহজে সম্মত হননি। অনেক দিন ধরে এই বিষয়ে চিঠিপত্র লেখালেখি হয়, প্রায় ১৮৬৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপর ১৮৬৬ সালে Museum Act পাস হয় এবং স্থির হয় যে এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ামের যাবতীয় সংগ্রহ নতুন মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত হবে। ১৮৭৫ সালে নতুন মিউজিয়াম ভবন নির্মিত হবার পরে সোসাইটি সংগৃহীত নিদর্শনগুলি সেখানে স্থানান্তরিত হয়। তারপর গত একশো বছরে প্রত্নতাত্ত্বিক নৃতাত্ত্বিক ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানলব্ধ পর্যাপ্ত নিদর্শন মিউজিয়ামের সম্পদ-সম্ভার বৃদ্ধি করেছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় অনেক মিউজিয়াম আছে, কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব শিল্পকলা ভূতত্ত্ব প্রাণিতত্ত্ব নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের নিদর্শনের এরকম বিচিত্র বিশাল সংগ্রহ আর কোথাও নেই। সম্প্রতি মিউজিয়ামের নিদর্শনগুলিকে আরও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পুনবিন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে গবেষক থেকে সাধারণ দর্শক সকলেরই দেখার ও বোঝার সুবিধা হয়।

২৬। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স

কলকাতার ৯২ নং আপার সার্কুলার রোডে ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি’ স্থাপিত হবার (১৯১৪-১৬) প্রায় চল্লিশ বছর আগে, ১৮৭৬ সালে, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের (মেডিকাল কলেজের দ্বিতীয় M.D., প্রথম M.D. ডাক্তার চন্দ্রকুমার দে) উদযোগে-‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স’ স্থাপিত হয় বৌবাজারে (বর্তমান যাদবপুর নতুন ভবনে স্থানান্তরিত)। বাংলা দেশে নয়, শুধু ভারতে বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন অনুশীলন আলাচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে মহেন্দ্রলালের এই বিজ্ঞানসভার দান অতুলনীয়। মহেন্দ্রলালের জীবনেরও এটি অবিস্মরণীয় কীর্তি। মহেন্দ্রলাল এই বিজ্ঞানসভা স্থাপনের প্রস্তাব করেন Calcutta Journal of Medicine-এ একটি প্রবন্ধ লিখে। বিজ্ঞানীমহলে প্রস্তাবটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয় এবং সরকার শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। বৌবাজার-কলেজ স্ট্রীটের সংযোগস্থলে যে ভাড়া বাড়িতে সভার কাজ আরম্ভ হয় সেই বাড়ি বিজ্ঞানসভা পরে তিরিশ হাজার টাকা মূল্যে কিনে নেন। পরে নতুন ভবনও তৈরি হয়। বিজ্ঞানসভার নতুন ভবনের ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেন বড়লাট রিপন ১৮৮২ সালে, এবং ল্যাবোরেটরি ইত্যাদি সাজসরঞ্জাম সহ বাড়ি তৈরি হয় ১৮৯০ সালে। ভারতের অন্যতম অগ্রগণ্য পদার্থবিদ (Physicist) সি. ভি. রামন (C.V. Raman) তাঁর গবেষণাগার (আলোক-বিকিরণতত্ত্ব)। কাজ এই বিজ্ঞানসভার ল্যাবোরেটরিতে করেন এবং তার জন্য নোবেল-পুরস্কারে সম্মানিত হন। উত্তর-দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, এবং ভারতের বাইরে থেকেও অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষক বৌবাজারের মহেন্দ্রলালের এই বিজ্ঞানসভায় গবেষণা করতে এসেছেন। বাৎসরিক রিপোর্ট ছাড়াও মহেন্দ্রলালের এই ‘ভারতীয় বিজ্ঞানসভা’ থেকে Indian Journal of Physics প্রকাশিত হয়, যে পত্রিকায় আন্তর্জাতিক মর্যাদা আজ নিঃসন্দেহে সুপ্রতিষ্ঠিত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে মহেন্দ্রলাল সরকারের এই ‘ভারতীয় বিজ্ঞানসভার’ ঐতিহাসিক স্থান ও ভবনটি আজ শুধু যে লুপ্ত তা নয়, অতিশয় কুৎসিত এক বাজারের পরিবেশের মধ্যে সমাধিস্থ। যাদবপুরের নবনির্মিত ভবনটি মনোরম বটে, কিন্তু ইতিহাসের অতীত স্মৃতির কোনো সৌরভ তার মধ্যে নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি সন্দেহ নেই, আজ তাঁর নামে বৌবাজার স্ট্রীট। অথচ ‘বৌবাজার’ অতিপ্রাচীন এদেশীয় নাম এবং পৌরসভার কর্তারা বোধহয় জানেন যে এটা কোনো ইংরেজ সাহেবের নাম নয়। নাম পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন ছিল না, মৃত বিপিনবিহারীকে অন্য যে কোন স্থানে স্বচ্ছন্দে ‘অমর’ করে রাখা সম্ভব হত। আর তা না হলেও ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ব্যতীত আর দ্বিতীয় কোনো স্মরণীয় ব্যক্তি বাংলা দেশে আছেন কিনা জানি না যিনি ‘বৌবাজার’কে নিজের নামে আত্মসাৎ করতে পারেন।

২৭। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ

১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে শোভাবাজার রাজবংশের বিনয়কৃষ্ণ দেবের ভবনে Bengal Academy of Literature নামে সাহিত্যসভা স্থাপিত হয়। পরের বছর (১৮৯৪) এপ্রিল মাসে এই সভার বাংলা নাম হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’। প্রতিষ্ঠাকাল ২৯ এপ্রিল ১৮৯৪, বাংলা ১৭ বৈশাখ ১৩০১। একাশী বছর বয়স হল সাহিত্য পরিষদের। প্রথম সভাপতি রমেশচন্দ্র দত্ত, এবং সহকারি সভাপতি দুজন-নবীনচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পাদক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুসন্ধান ও অনুশীলনই পরিষদের আদর্শ। ১৯০১ সালে কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী পরিষদের গৃহনির্মাণের জন্য প্রায় সাত কাঠা জমি দান করেন। এই জমির উপর বর্তমান পরিষদ-ভবন নির্মিত। ১৯০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর নতুন ভবনে পরিষদ ১৩৭/১ কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ভাড়াবাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়। পরিষদের গ্রন্থাগার ও পুথিসংগ্রহ অমূল্য সম্পদ বিশেষ। গ্রন্থাগারে যে কয়েকজন বিশিষ্ট মনীষীর ব্যক্তিগত পুস্তকসংগ্রহ সংরক্ষিত, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রমেশচন্দ্র দত্ত, বিনয়কৃষ্ণ দেব, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নাম উল্লেখ্য। ‘রমেশ ভবনে’ সংরক্ষিত পুরাকীর্তির নিদর্শনগুলিও মূল্যবান।

২৮। অ্যালবার্ট হল (ইনস্টিটিউট)

কলেজ স্ট্রীটে প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকে তাকালে এখনও ‘অ্যালবার্ট বিল্ডিংস’ দেখা যায়, কিন্তু এই ভবনে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘অ্যালবার্ট হলটি’ আর দেখা যায় না, তার পরিবর্তে দেখা যায় জমজমাট ‘কফি হাউস’। অ্যালবার্ট হলের পরিকল্পক-প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন। তাঁর পিতামহ রামকমল সেনের বাড়িতে অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা হয় ২৫ এপ্রিল ১৮৭৬। প্রথম সম্পাদক কেশবচন্দ্র। কেশবচন্দ্রের পিতামহ ও খুল্লতাতের জমি-বাড়ি (এক বিঘার কিছু বেশি) ২৩,১৩০ টাকায় ইনস্টিটিউটের জন্য কেনা হয়, টাকা কেশবচন্দ্র সংগ্রহ করে দেন। পরে এখানে বিশাল ‘অ্যালবার্ট হল’ তৈরি হয় এবং এই ইনস্টিটিউট ও ‘হল’ বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সুরেন্দ্রনাথ-আনন্দমোহন পরিকল্পিত ভারত সভা (Indian Association) এই অ্যালবার্ট হলেই স্থাপিত হয় (২৬ জুলাই ১৮৭৬) এবং এখানেই কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে জাতীয় সম্মেলনের (National Conference) অনুষ্ঠান হয়। রাজনীতি সমাজ শিক্ষা ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে অ্যালবার্ট হলঘরে যাঁরা ভাষণ দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় সুরেন্দ্রনাথ, আনন্দমোহন, সিস্টার নিবেদিতা, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু এবং আরও অনেকে।

২৯। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট

অ্যালবার্ট ‘হল’ বা ‘ইনস্টিটিউট’ প্রসঙ্গে ‘ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের’ কথা বলতে হয়, কারণ কেশবচন্দ্রর অন্যতম সহকর্মী ও জীবনীকার প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিকল্পক ও প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯১ সালের ৩১ আগস্ট ‘কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট’ স্থাপিত হয়। কলকাতার তরুণ ছাত্রদের কেবল বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, তাদের শারীরিক মানসিক ও নৈতিক স্বাস্থ্য গঠনও শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য প্রয়োজন। প্রতাপচন্দ্রের সভাপতিত্বে এই উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ১৮৯১, ১৩ আগস্ট একটি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় যাঁরা যোগদান করেন, তাঁদের মধ্যে স্বনামধন্য হলেন মহেন্দ্রলাল সরকার, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনটি বিভাগ থাকবে-(১) ব্যায়াম বিভাগ, (২) সাহিত্য বিভাগ-সভাপতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (৩) নৈতিক বিভাগ-সভাপতি প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ইনস্টিটিউটের উদবোধন সভা হয় ‘টাউন হলে’ ৩১ আগস্ট ১৮৯১ এবং সম্পাদক হন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ৬ এপ্রিল, ১৯১৬ ইনস্টিটিউটের বর্তমান ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠান হয়।

৩০। জাতীয় গ্রন্থাগার (National Library)

১৮৩৫ সালে স্থাপিত ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’ থেকে ধীরে ধীরে ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’ এবং বর্তমান ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’র বিকাশ হয়েছে। ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপিত হয় (১৮৩৫) এসপ্লানেড রো-তে ডক্টর এফ.পি. স্ট্রঙের (F.P. Strong) বাড়িতে। এই বাড়িতে জুলাই ১৮৪১ পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি ছিল, তারপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের (রাইটার্স বিল্ডিংস) একাংশে স্থানান্তরিত হয় জুন ১৮৪৪ পর্যন্ত। সেখান থেকে মেটকাফ হলের (Metcalf Hall) দোতলায় লাইব্রেরির পুনরায় স্থানান্তরিত হয় (হেয়ার স্ট্রীট ও স্ট্রাণ্ড রোডের মোড়ে)। পরে লাইব্রেরির বই ও বাড়ি সরকার অধিকার করেন ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে, এবং ১৯০২ সালের Imperial Library Act অনুযায়ী পুনর্গঠিত ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’ ১৯০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সাধারণের ব্যবহারের জন্য খোলা হয়। ১৯২২ সালে ‘মেটকাফ হল’ থেকে এসপ্লানেডে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি স্থানান্তরিত হয় এবং সেখান থেকে ভারত স্বাধীন হবার পরে, বর্তমান বেলডেভিয়ার হাউসে।

এই অধ্যায়ের বিষয় প্রসঙ্গে কয়েকটি উল্লেখ্য বই ও রচনা :

Charles Lushington : The History, Design and Present State of Religious, Benevolent and Charitable Institutions, founded by the British in Calcutta and its vicinity : Calcutta 1824.

Rev. W. K. Firminger : Notes on Old Calcutta : I, II & III: The statesman, 3, 17 and 24 June, 1917.

A.F. M. Abdul Ali (Keeper of imperial Records) : Social Life of Old Calcutta : The Statesman, Feb. 25, March 4 and

11, 1934.

William S Birney : Belvedre, Bengal’s Stateliest Mansion : The Statesman, 11 Sept. 1938.

 . বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট ১৮৫৪ সালে ১নং কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটে ছিল, তাঁর বছর দুই পরে হেস্টিংস স্ট্রীট ও স্ট্র্যাণ্ডের সংযোগস্থলে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭০-এর দশকে দুটি বাড়িতে সেক্রেটারিয়েটের কাজ হত, একটি চৌরঙ্গিতে, একটি সদর স্ট্রীটে। ১৮৮০ সালের পর থেকে বর্তমান রাইটার্স বিলিডিংসে সেক্রেটারিয়েটের কাজ আরম্ভ হয়।-বি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *