কালপ্রবাহে কমলাসুন্দরীর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু রূপের বিশেষ হেরফের হয়নি। তার বর্ণ কালো, কিন্তু সেই বৰ্ণই তার বৈশিষ্ট্য। এ দেশে সৌন্দর্যের প্রথম লক্ষণই হলো গাত্রবৰ্ণ কতখানি গৌর, তবু সকলে এক কথায় স্বীকার করে যে কমলাসুন্দরীর মতন রূপসী কাচিৎ দেখা যায়। তার চিকণ কালো মুখখানি যেন পাথরে খোদা, এবং এমনই মসৃণ যেন মনে হয় মাছি বসলে পিছলে। যাবে।
কৈশোরোদগমের পর রামকমল সিংহের নজরে পড়ায় তার ভাগ্য ফেরে। সামান্য অবস্থা থেকে তুলে এনে রামকমল সিংহ তাকে বারবণিতা সমাজের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রামকমল সিংহ তাকে এত বড় বাড়ি দিয়েছেন, দেশের নানাস্থানে ঘুরিয়ে এনেছেন এবং পশ্চিমাঞ্চল থেকে শিক্ষক আনিয়ে তাকে নৃত্যে পটিয়সী করিয়েছেন।
কমলাসুন্দরী সত্যিই তার দেহ-মন-প্ৰাণ সমৰ্পণ করেছিল রামকমল সিংহকে। সেই আমোদপ্ৰিয়, বিলাসী পুরুষটির হৃদয় ছিল বড় নরম, কখনো কারুর মনে আঘাত দিয়ে কথা কননি। রামকমল সিংহের মৃত্যুর পর দশদিক শূন্য দেখেছিল কমলাসুন্দরী এবং প্রকৃত বৈধব্য যাপন করেছিল কিছুদিন। এমনটি আর কেউ কখনো দেখেনি কিংবা শোনেনি। কিন্তু সব কিছুতেই একটা মাত্রা আছে। এক সুন্দরী, নর্তকী, বারাঙ্গনা কতদিন আর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবে? সে নিজে চাইলেও লোকে তাকে থাকতে দেবে কেন?
কমলাসুন্দরী এখন শহরের সবচেয়ে নামকরা অবিদ্যা।
তার বয়েস হয়েছে, কিন্তু নর্তকী বলেই বোধহয় তার শরীরের চমৎকার গড়ন এখনো অটুট আছে। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য সে খানিকটা স্ফীতোদরা হয়েছিল, আবার সচেতন হয়ে, পরিশ্রম করে মেদ করিয়ে ফেলেছে। এখনও সে এক একদিন নাচের আসরে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।
হীরা বুলবুলের নাম রসিক ব্যক্তিরা এরই মধ্যে ভুলে যেতে বসেছে। হীরার নাম আর শোনা যায় না। বরং কিছু নতুন নাম এখন সদ্য হাওয়ায় ভাসছে। যেমন, রওশানকুমারী, শারদা মনজিলওয়ালী, রেশমা ঘুংঘটওয়ালী। লক্ষ্ণৌয়ের রাজ্যচ্যুত নবাব কলকাতায় এসে বসতি নেবার পর লক্ষী, এলাহাবাদ, বারাণসী থেকে কিছু কিছু ভাগ্যসন্ধানী নর্তকী-গায়িকা-গণিকারাও কলকাতায় আসছে। নবাবের সঙ্গে দলটিও কম বড় নয়।
এই লক্ষ্ণৌয়ের নবাবের প্রসঙ্গেই একটা বেশ কৌতুক হয়েছিল।
রামকমল সিংহের সেই গৃহ কমলাসুন্দরী কিছুতেই ছাড়েনি। তার এখন পয়সা হয়েছে। এ রকম দু-তিনখানা বাড়ি সে অনায়াসেই কলকাতায় হাঁকাতে পারে। কিন্তু এই গৃহ থেকেই তার সৌভাগ্যের উদয়, এখানেই রামকমল সিংহ তার কোলে মাথা রেখে দেহরক্ষা করেছেন, এ গৃহ সে কোনোক্রমেই পরিত্যাগ করবে না।
বিধুশেখর মুখুজ্যে এবং মুনশী আমীর আলীর মতন দুই ধুরন্ধর উকিল মিলেও হটাতে পারেনি তাকে। মোকদ্দমা চলেছিল টানা চার বৎসর, তারপর ওঁরাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কমলাসুন্দরী নিজে যথেষ্ট বুদ্ধিশালিনী, তা ছাড়া তাকে মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে পরামর্শ দেবার জন্যও আছে তার দুজন অনুরাগী। একজনের নাম ফটিকচাঁদ মল্লিক, লোকে তার নাম দিয়েছে ফুটে মল্লিক। অন্যজন নুটুবিহারী সরকার, লোকের মুখে মুখে তার নাম ছোট নুটু, যদিও বড় নুটুটি যে কে, তা ঠিক জানা যায় : না। ফুটে মল্লিক। আর ছোট নুটু পালা করে নিয়মিত আসে। কমলাসুন্দরীর কাছে। চপলা, তরঙ্গিনী আর চন্দনবিলাসী নামে তিনটি মেয়েও থাকে। এখানে, কমলাসুন্দরী তাদের নাচ-গান শিখিয়ে তৈরি করে নিয়েছে।
একদিন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের কাছ থেকে এক দূত এলো তার কাছে। নবাব এত্তেলা পাঠিয়েছেন। এর মধ্যেই কমলসুন্দরীর নৃত্যকলার খ্যাতি তাঁর কানেপৌঁছেচে। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই শহর, জন্ম থেকেই যার কোনো রাজাবাদশা নেই, আছে বিদেশী সরকার। সেই শহরের লোকজনও যে খানদানী নৃত্য বা সঙ্গীত বোঝে, এ সম্পর্কে নবাবের কোনো ধারণাই ছিল না। তাই নবাব দেখতে চান কলকাত্তাওয়ালীর নাচ।
নবাবের দূতের চেহারা, পোশাক, কথাবার্তা সবই অন্য প্রকারের। কমলাসুন্দরী প্রথম বুঝতেই পারেনি প্রস্তাবটা। যখন বুঝলো, তার বুক কেঁপে উঠলো। এ যে বিরাট সম্মান! অতবড় একজন নবাব তাকে দেখতে চেয়েছেন!
এ কোনো উটকা নবাব কিংবা বাদশা নয়, কত বড় বংশের মানুষ ইনি। হিন্দুস্তানের বুকের মণি যে আওয়ধ, সেখানকার শেষ স্বাধীন নবাব।
কমলাসুন্দরী শুধু তো দেহপসারিণী নয়, সে শিল্পীও বটে। শিল্পী সব সময় খোঁজে শিল্পরসিককে। টাকা পয়সা ছড়িয়ে অনেকেই এসে কমলাসুন্দরীর নোচ দেখে যায়। তার মধ্যে প্রকৃত সমঝদার কজন? সকলেই জানে, সারা হিন্দুস্তানে নৃত্য-গীতের শ্রেষ্ঠ সমঝদার ঐ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। তিনি ডেকেছেন কমলাসুন্দরীকে।
বিকেলে ফুটে মল্লিক আসতেই কমলাসুন্দরী চোখ মুখ উদ্ভাসিত করে বললো, আজ কী হয়েচে, জানো? বলো দিকিনি আজ কে এয়েচেন?
ফুটে মল্লিকের মুখ শুকিয়ে গেল। আবার কে উৎপাত করতে এসেছিল কে জানে! কোনো নামকরা লোক, সমাজের মাথা? নাকি তার চেয়েও আট দশ গুণ বড় কোনো নির্বোধ ধনী? বাঙালি
ছড়ায়, সেগুলোর সঙ্গে পারা যায় না।
ফুটে মল্লিক বললো, সঙ্কালে এয়েছেল সে আবার কেমন ধারা মানুষ? নিশ্চয়ই কেতা জানে না। রাতের চিড়িয়ার কাচে সক্কালে কেউ আসে? আর তুই অমনি দেকা দিলি? তখুন তোর চুলে কিলিপ ছেল? চোকে সুমা দিইচিলি?
কমলা বললো, ওগো, যে এয়েচেল, সে আসল নয় গো, আসল নয়। সে দূত। আমায় শনিবার যেতে বলেচে। কার দূত বলো দিকিনি?
চপলা, তরঙ্গিণী, চন্দনবিলাসীরাও কমলাসুন্দরীকে ঘিরে বসে আছে। মজলিশ ঘরে। এখনো তাদের সাজ-পোশাক, প্ৰসাধন হয়নি। আসর বসবে রাত আটটার আগে নয়।
ফুটে মল্লিক প্রায়ই আগে আগে আসে গল্প-গুজব করতে। ফুটে মল্লিক মধ্য বয়সী, বেঁটেখাটো গোলগাল ধরনের মানুষ, মাথায় সুবৃহৎ টাক, গায়ের রঙ টুকটুকে ফস এবং তার টাকটিকে আরও বেশী ফস দেখায়। সে সব সময় সাদা রঙের পোশাক পরিধান করে বলে একটু দূর থেকে তাকে মনে হয় একটি রসগোল্লার মতন। মানুষটি গল্প-গুজব এবং হাস্য পরিহাস ভালোবাসে এবং তাই নিয়েই সময় কাটায়। লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে সেও একজন নিষ্কমা ধনী। তার পিতামহ উত্তরবঙ্গে একটি জমিদারি ক্রয় করেছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে সে ঐ জমিদারির দুই-তৃতীয়াংশের মালিক। নিজের দেখাশুনো করারও প্রয়োজন হয় না। গত দশ বৎসরের মধ্যে সে নিজের জমিদারিতে একবারও স্বশরীরে উপস্থিত হয়নি। নায়ের-গোমস্ত মারফৎ নিয়মিত তার কাছে টাকা আসে।
ফুটে মল্লিক বললো, কার দূত রে বাবা? আমি, আমি তো কিচুই বুঝচিনি!
অনেক রঙ্গ-রহস্যের পর কমলাসুন্দরী নবাবের কথা জানালো।
সে কথা শুনে ফুটে মল্লিকের চোখ এমনই বিস্ফারিত হয়ে গেল যে মনে হলো যেন ভিতরের গোলক দুটি ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে!
আর্তনাদ করে সে বলে উঠলো, তোর কি মরবার সাধ হয়েচে নাকি রে, কমলা? অ্যাঁ? তুই সাধ করে ঐ নবাবের গভূভরে পা দিবি!
কমলাসুন্দরী কিছুই বুঝতে পারলো না। সে সরল বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলো, কেন, কী হয়েচে?
—তুই শুনিসনি কিচুই। নবাবের কীত্তি-কাহিনীর খবরে যে শহর একেবারে ম ম কচ্ছে! নবাবটি যে একেবারে কাঁচাখেগো দেবতা, মেয়েমানুষ পেলেই একেবারে চিবিয়ে খেয়ে ফ্যালে!
—যাঃ, অতবড় একটা মানী লোক।
—মানী লোকেরা কি মেয়েমানুষের মাতা খায় না? মেটেবুরুজের চত্বরেও এদানি কোনো মেয়েমানুষ যায় না!
—কী যে বলো আশা কতা পাশ কতা। আমার তবলা বাজনাদার বললে যে নবাব খুব নাচ গান ভালোবাসেন। ভালো নাচ দেখলে ভাবের ঘোরে উনি নিজেও উঠে নাচতে শুরু করেন।
–নাচ ভালোবাসেন তো বটেই। নাচ দেকে একেবারে মোহিত হয়ে যান, তোর নাচও একবার দেকবেন, তারপর তোকে খেয়ে একেবারে হজম করে ফেলবেন।
—এমন অদ্ভুত কতা কখনো শুনিনিকো। নবাব পাগল, না তুমি পাগল?
—এসব কতা আমি স্বকৰ্ণে শুনিচি!
ফুটে মল্লিক আরও নানারকম ভয়াবহ গল্প শুনিয়ে কমলাসুন্দরীকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কমলাসুন্দরীর ঠিক বিশ্বাস হলো না। ফুটে মল্লিক হিংসাতেও একথা বলতে পারে।
পরদিন সে নুটুবিহারীকে খবর পাঠালো।
নুটুবিহারী কমলাসুন্দরীর চেয়ে বয়েসে কিছু ছোটো। সম্প্রতি তার পিতৃবিয়োগ হওয়ায় হাতে অঢেল পয়সা এসেছে। ফুটে মল্লিকের মতন সে একেবারে নিষ্কম নয়, সে আইন শিক্ষা করে কিছুদিন ওকালতি শুরু করেছিল, তা ছাড়া সে দুটি কয়লাখনিও দেখাশুনো করে। তার পিতা অতি কড়া ধাতুর লোক ছিলেন, সেইজন্য পিতা ধরাধাম ত্যাগ করার পর স্বাধীন হয়ে সে কিছুদিন শরীরের আড়-মোড়া ভেঙে নিচ্ছে।
নুটুবিহারী বেশ লম্বা ও সুদেহী। মাথা ভর্তি বাবরি চুল, অনেকটা সেনাপতি সেনাপতি ধরনের চেহারা। কিন্তু শরীরের তুলনায় তার কণ্ঠস্বরটি অস্বাভাবিক রকমের মিনমিনে। পিতার ধমক খেয়েই বোধহয় সে তার কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে তুলতে পারেনি।
ফুটে মল্লিকের তুলনায় ইদানীং নুটুবিহারীই কমলাসুন্দরীর বেশী ঘনিষ্ঠ। নাগর হলেও ছোট নুটুকে সে যেন খানিকটা মেহের চক্ষেও দেখে।
ছোট নুটু ফুটে মল্লিকের ঠিক বিপরীত। নবাবের কাছ থেকে আহ্বান এসেছে শুনে সে উল্লসিত হয়ে উঠলো। কমলাসুন্দরীর সম্মান যেন তার নিজেরই সম্মান। সে স্বয়ং কমলাসুন্দরীকে মেটেবুরুজে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আশা কমলাসুন্দরী বললে, নবাব কেমন ধারা মানুহ গো? ফটিকচাঁদ কেমন সব উলটো কথা
ফটিক চাঁদের নাম শুনেই জ্বলে উঠলো নুটুবিহারী।
—ঐ ফুটে মল্লিকটা কী জানে? ওটা একটা ছাচি কুমড়ো! ও ব্যাটা নবাবীর কী মর্ম বোঝে? লক্ষ্মেীয়ের নবাব, নাম শুনলেই মাতা হেঁট হয়ে যায়। হাতি দিয়ে পড়লেও হাতি। নবাব দিয়ে পড়েচোন বটে। কিন্তু নবাবী মেজাজ একটুও নষ্ট হয়নিকো! রাহিসী কায়দা পুরোপুরি বজায় রেকেচেন।
—তবু বাপু তুমি একটু খপর নেও না! শুনলে কেমন ভয় ভয় করে। নবাব ডেকেচোন, সে ডাক উপিক্ষেও কত্তে পারি না, আবার চাল-চলন-সহবতে যদি কিচু ভুল হয়, নবাব যদি হাতে মাতা কাটার হুকুম দেন—
— যেতে হবে তো শনিবার? এখনো চারদিন রয়েচে। আমি সব খোঁজ এনে দিচ্চি তোমায়। লক্ষীয়ের নবাব কলকাতায় এসে আর কারুকে ডাকেনি, শুধু তোমায় এত্তেলা দিয়েচেন, তার মানে বুঝলে, কমলা, এক ডাকে তোমায় সবাই চেনে! ঐ ফুটে মল্লিকটার হিংসেয় বুক ফাটচে!
দুদিন বাদে ছোট নুটু সব খোঁজখবর নিয়ে এলো। কথা বলার বদলে সে ক্ৰন্দন করতে শুরু করলো কমলাসুন্দরীর হাত চেপে ধরে।
কমলাসুন্দরী হতভম্ব হয়ে বললো, ও মা, এ কী? এ কী?
ছোট নুটু হাপুসা নয়নে থেমে থেমে বললো, কমলা, কত দাও, তুমি কিচুতেই মেটেবুরুজে যাবে না! নবাব তোমায় যতই হীরে-মোতির মালার লোভ দেখাক!
—কেন গো? সত্যিই কি নবাব বাহাদুর মেয়েমানুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলেন নাকি?
—না গো, তা নয়! ব্যাপার আরও ভয়ংকর। নবাবী প্রাসাদে কেউ ঢুকলে আর বেরুতে পারে না।
নবাব সবাইকে শাদী করে ফেলেন!
-অ্যাঁ?
–হ্যাঁ গো, আমি সব খপর এনিচি!
—এসব কত কে শোনালে তোমায়!
—মেটেবুরুজে। সব্বাই বলাবলি কচ্চে যে! সেখেনে কত মানুষের ভিড়, যত সব ফড়ে আর দালাল, গুড়ের লোভে লোভে যেমন পিঁপড়ে আসে। আর জুটেচে যত রাজ্যের পাখিওলা। নবাবের খুব পাখি কেনার শক, আর ঐ শক বিয়ে করার।
—কী বললে গো তুমি? কতা নেই, বাত্রা নেই, যাকে দেকবে, তাকেই ধরে ধরে বে করবে? এ কি অলুক্ষ্মণে লখনৌয়ের আইন?
—নবাব ধন্মে হলেন গে শিয়া! ওরা যত খুশী মুত-আ কত্তে পারে।
—মুত্-আ কী গো?
—ঐ যে বললুম, বিয়ে বল, শাদী বল, নিকে বল, সবই ঐ মুত-আ। নবাবের যাকে পছন্দ হয়, অমনি তাকে মুতু-আ করে ফেলেন। একজন কী বললে জানো? এক কম বয়েসী ভিশতিনী মাগী অন্দর মহলে জল দিতে যেত, তাকে হঠাৎ নবাবের চোখে লেগে গেল। আর অমনি তাকে মুত-আ করে ফেললেন নবাব। সে ভিশতিনী এখন বেগম!
ছোট নুটুর গলা কাঁদো কাঁদো, কিন্তু কমলাসুন্দরী হেসে গড়িয়ে পড়লো একেবারে। এ যেন রূপকথা, নবাবের নেক নজরে পড়ে এক ভিশতিনী রাতারাতি হয়ে গেল বেগম সাহেব!
ছোট নুটু বললো, শুধু কি ভিশতিনী নাকি, এক ঝাড়ুদারনীকেও অমনি মুত্-আ করে বেগম বানিয়েচেন নবাব। তার নাম আবার মুসফফা বেগম।
—তার মানে কী?
—কে জানে? শুনাচি নবাব রোজই একটা করে শাদী কচ্চেন, অ্যাদিনে প্ৰায় শখানেক বেগম হয়ে গ্যাচে। আগে আরও কত ছেল কে জানে! তোমার মতন আগুনের খাপরাকে দোকলে নবাব কী আর ছাড়বেন! জোরজার করে অমনি মুত-আ করে নেবেন!
কমলাসুন্দরী ঠোঁট টিপে হেসে বললো, তা একবার নবাবের বেগম হয়ে দেকালে মন্দ হয় না!
ছোট নুটু হাত জোড় করে বললো, কমলা, তুমি এমন কতা বললে? জাত ধম্মো বিসজন দেবে?
—আমাদের আবার জাত কী?
—ওঃ, এই তোমার মনে ছেল? তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে চাও? আমরা কি তোমার পায়ে পড়ে থাকিনি? এখুন তোমার পায়ে মাতা কুটবো, কমল।
—আরে, আরে, করে কী, করে কী, মিনসেটা! সত্যি সত্যি কি আমি ধেই ধেই করে নবাবের বেগম হতে যাচ্চি নাকি? আর গেলেই বা কি। অমনি জোর করে মুত-আ করবে? এ কি মগের মুলুক নাকি রে। বাবা!
—হাঁ, সেই কতাই তো সবাই বলচে। নিজের রাজ্য রক্ষা কত্তে পাল্লেন না, নবাব এখন মেয়েমানুষ জয় কচ্চেন! সুন্দরপানা কোনো মাগ নবাবের প্রাসাদে একবার ঢুকলে আর বেরুতে পারে না। মুত্-আ করার পর বেগম বানাবে। সে ঐ নামেই বেগম, সে আর কোনোদিন দেকতে পাবে না বাইরের আলো-বাতাস, বুঝলে?
কমলাসুন্দরী ডাকলো চপলা, তরঙ্গিনী আর চন্দনবিলাসীকে। সব বৃত্তান্ত শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী লো, তোরা কেউ নবাবের বেগম হতে চাস নাকি? এমন সুযোগ আর কখুনো পাবিনি!
তিনজনেই সমস্বরে বলে উঠলো, ও মা গো, রক্ষে করো!
ছোট, নুটু বললো, ঠিক বলিচিস। কেন নবাব মহলে গিয়ে বন্দিনী হবি? আমরা কি তোদের কম খাতির করি?
কমলাসুন্দরী বললো, তা হলেও বেগম বলে কতা!
চপলা বললো, ওফ, ভাবতেও বুক কাঁপে! প্যাঁজ রসুনের গন্ধ, আর নবাবের নাকি হুমন্দো হুমন্দো কাফ্রি খোজা রয়েচে।
নবাব সম্পর্কে এই সব চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর গল্প চলতে লাগলো। দু-তিনদিন ধরে। আমন্ত্রণ পেয়েও কমলাসুন্দরী যাবে না বলে নবাব যদি রাগ করেন এবং জোর করে ধরে নিয়ে যান, সেই ভয়ে ছোট নুটু একটা বজরা ভাড়া করে ওদের সকলকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য গঙ্গাবক্ষে বিহারের প্রস্তাব দিল।
অতি উত্তম কথা, কমলাসুন্দরী সানন্দে রাজি।
কিন্তু যাত্রার আগের দিন সন্ধে থেকে তরঙ্গিনীকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। পরদিনও সন্ধান মিললো না তার। কমলাসুন্দরীর বজরা ভ্ৰমণে বেরিয়ে গেল। এবং ফিরে আসার পর শুনতে পেল, তরঙ্গিনী ঝাড়ুদারনীর ছদ্মবেশে নবাবের মহলে ঢুকেছিল এবং নবাবও তাকে মুতু-আ করে বেগম বানিয়ে ফেলেছেন।
অবশ্য এটা ঘটনা না রটনা, তার সত্য মিথ্যে জানার কোনো উপায় নেই।