কনি চলে যাওয়ার পরও শাজাহান হোটেলের দৈনন্দিন জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এই হোটেলে প্রতিদিন যারা আসে এবং চলে যায়, কনি তো তাদেরই একজন। কত মানুষই তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে হাজির হচ্ছেন। আগন্তুকরা কদিনই বা থাকেন। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ তিনদিন, কেউ বা মাত্র একদিন। কয়েক ঘণ্টা থাকেন এমন অতিথিরও অভাব নেই। একভাবেই চলেছে। ওয়েলকাম এবং ফেয়ারওয়েল, রিসেপশন এবং গুড্রাই, সাদর অভ্যর্থনা ও বিদায় অভিনন্দন যেন গায়ে গায়ে, হাতে হাত দিয়ে জড়াজড়ি করে শাজাহান হোটেলে বসে রয়েছে। আসার মধ্যে তবু সামান্য প্রত্যাশা আছে, কিন্তু যাওয়ার মধ্যে কিছুই নেই। কেউ সেদিকে নজর দেয় না।
বোসদা বলেছেন, গড়ে তিন দিন থাকেন আমাদের অতিথিরা। এঁদের মধ্যে কেউ যদি পনেরো দিন থাকেন তা হলে মনে হয় যেন যুগযুগান্ত ধরে তিনি আমাদের মধ্যে রয়েছেন। আর দুএকজন, যারা এখানেই মাসিক হারে থাকেন, তারা তো আমাদেরই একজন হয়ে যান।
কিন্তু তিনি তো আর অতিথি নন। যাদের জীবন হোটেল অতিথিদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে সে তো তাদেরই একজন। সে যদি আমাদেরই দলে হয় তবে তার বিদায় নিশ্চয়ই আমাদের হৃদয়হীন জীবনেও ছাপ রেখে যাবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।
বোসদা ছাদে বসে দাড়ি কামাতে কামাতে আমাকে বলেছিলেন, আমরা হোটেলের লোকরা বড় উদাসী। কিন্তু আমাদের থেকেও অনাসক্ত এই বাড়িটা। কনি কেন, কাউকে মনে রাখে না, আমাদেরও মনে রাখবে না, দেখে নিও। এই যে আমরা বছরের পর বছর সুখে-দুঃখে ভোর থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত নীরবে পান্থশালায় বিলাসী পথিকদের সেবা করে গেলাম, ইতিহাসের এই উদাসী প্রাসাদ তাও মনে রাখবে না। আমরা যখন থাকব না, তখও সে নতুন রং এবং নতুন চুনসুরকির স্নো পাউডার মেখে কলকাতার এই রাজপথে বিদেশিদের মনোরঞ্জনের জন্য আপন মনেই দাঁড়িয়ে থাকবে। একবারও আমাদের কথা মনে পড়বে না।
আমার মনটা বোসদার কথায় কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। বোসদা বলেছিলেন, নিজের কথাটাই শুধু ভাবলে চলবে কেন? এই অনুরাগহীন নির্লিপ্ততার আর একটা দিক। এই যে আমরা এখন কাজ করছি, আমাদেরও আগে এমনি করেই তো আরও অনেকে শাজাহান হোটেলের সেবা করে গিয়েছেন। আরও অনেক নিত্যহরিবাবু বালিশ বগলে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ছোটাছুটি করেছেন, আরও অনেক স্যাটা বোস দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অতিথিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের খবরাখবর নিয়েছেন। আরও অনেক কনি তাদের শুভ্র নগ্নদেহের লীলায়িত নৃত্যভঙ্গিতে প্রমোদ-কক্ষকে মোহময় করে তুলেছে, আরও অনেক প্রভাতচন্দ্র গোমেজ তাদের শব্দ-যন্ত্রে নিস্তব্ধ রাত্রিকে মুখর করে তুলেছে। কিন্তু কেউ তাদের মনে রাখেনি। মনে রাখবার কথাও নয়।
ভাবছ কাব্য করছি, তাই না? বোসদা হেসে বলেছিলেন, হবস সায়েব তো তোমাকে অত ভালোবাসেন। পুরনো কলকাতা সম্বন্ধে তো ওঁর অত আগ্রহ, সেকালের সঙ্গে একালের একটা যোগৃসত্ৰ উনিই তো রক্ষে করেছেন, উনিও বলেন-টু-ডে অ্যান্ড টুমরো; আজ আর আগামী কাল; এই নিয়েই আমাদের হোটেল। বিগতযৌবনা ইয়েস্টারডের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। গতকাল সম্বন্ধে আমাদের একটুও মাথাব্যথা নেই।
বোসদা দাড়ি কামানো শেষ করে ব্লেডটা তোয়ালেতে মুছতে মুছতে বলেছিলেন, আমার যে সাহিত্য আসে না। মাতৃভাষায় দখল থাকলে মনের ভাব কত সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতাম। সোজা বাংলায় বলতে গেলে আমাদের গুড মর্নিং শুরু হয় টু-ডে দিয়ে। দিনের শেষে রাত্রের অন্ধকারে টু-ডের তলানিটুকু যখন ডাইনিং হল-এ পড়ে থাকে, তখন আমরা টুমরোর জন্যে পরিকল্পনা করতে বসি। টু-ডেটাই যে কখন ইয়েস্টারডে হয়ে জীবনের বোঁটা থেকে ঝরে পড়ে তার খোঁজই রাখি না।
শুধু শাজাহান হোটেলের কর্মচারী কেন, শাজাহানের পৃষ্ঠপোষকরাও ইয়েস্টারডের খবরাখবর নিতে ভালোবাসেন না। খবরের কাগজে নতুন নর্তকী আসছে, তার বিজ্ঞাপন পড়েই তারা আবার খোঁজখবর করতে লাগলেন। কনি যে কোথায় গেল তা কেউ একবার ভুলেও জিজ্ঞাসা করলেন না। এবার মধ্য এশিয়া থেকে আর-এক নর্তকী আসছেন।
আমাদের বিজ্ঞাপন পড়েই ফোন আসতে শুরু করেছে। হ্যালো, শাজাহান হোটেল? হ্যাঁ মশায়, এতদিনে তাহলে আপনাদের সুমতি হল। এতদিনে একটা বেলি-ডান্সার আনাচ্ছেন! আমি বলেছি, হ্যাঁ, আপনারা আনন্দ পাবেন।
ফোনের দিক থেকে উত্তর এসেছে, দেখবেন মশায়, জেনুইন বেলি-ডান্সার তো? যা ভেজালের যুগ পড়েছে, কিছুই বিশ্বাস নেই। আমি ভদ্রলোকের কথার অর্থ বুঝতে পারছিলাম না। পাশেই বোসদা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলেন। বললেন, হ্যাঁ স্যার, এটা শাজাহান হোটেল। এটা কলকাতার সস্তা রেস্তোরাঁনয় যে, রাজাবাজারের জিনিস ইজিপ্সিয়ান বলে চালিয়ে দেব।
ভদ্রলোক বোধহয় একটু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, আমাদের কী দোষ মশায়? ঠকে ঠকে আমরা শিখেছি। জেনুইন বেলি-ডান্সার বলে টিকিট কিনে দেখি প্যাকিং বাক্সর মতো চৌকো মেয়ে নাচছে। বডির কোনো মুভমেন্ট নেই। জানেন, একটা জেনুইন বেলি-ডান্সারের পেটের মাল প্রতি মিনিটে কতবার মুভ করে? বোসদা বিরক্ত হয়ে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। কিন্তু টেলিফোন নামিয়ে রাখলেই মুক্তি পাওয়া যায় না। চোখ বন্ধ করে থেকে বেচারাহরিণ যেমন ভেবেছিল শিকারির হাত থেকে ছাড়া পাবে, আমরাও তেমনি মাঝে মাঝে ভাবি টেলিফোন ছেড়ে দিলেই রক্ষা পাওয়া যাবে।
একটু পরেই আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল। বোসদা বললেন, আমি আর ধরছি না, তুমি ম্যানেজ করো। শাজাহান হোটেলে এতদিন চাকরি করে কেমন ওস্তাদ হয়েছ দেখি।
টেলিফোন তুলেই বুঝলাম, সেই পুরনো ভদ্রলোক। কিন্তু আমার ভাগ্য ভাল। উনি বললেন, ব্যাপার কী মশাই? হঠাৎ কথা বলতে বলতে লাইন কেটে গেল। বললাম, ভেরি স্যরি। মাঝে মাঝে কেন যে এমন হয়। ভদ্রলোক বললেন, টেলিফোনে কমপ্লেন করে দিন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললাম, তা হলে স্যার, আপনি কবে আসছেন?
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, আগামী কালের জন্য দুটো চেয়ার রেখে দিন।
আমি বললাম, আমাদের নতুন নিয়ম স্যার, টেলিফোনে টেবিল রিজার্ভ ফাস্ট উইকে সম্ভব নয়। কাউকে পাঠিয়ে টিকিটটা কাটিয়ে নিয়ে যাবেন।
ভদ্রলোক আমার ইঙ্গিতের অর্থ বুঝলেন। বললেন, হেভি ডিমান্ড বুঝি? তা তো হবেই। জেনুইন বেলি-ডান্সার হলে ক্যালকাটার লোকরা অ্যাপ্রিসিয়েট করবেই।
টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই বোসদা বললেন, হবে। চেষ্টা করলে এ-লাইনে তুমি টিকে থাকতে পারবে।
আমরা তো চেষ্টা করেও টিকে থাকতে পারছি না। কে বোসদার কথার সূত্র ধরেই মন্তব্য করলেন। চেয়ে দেখি বুশ-শার্টপরা এক ভদ্রলোক। একটা সিগারেট ধরিয়ে ভদ্রলোক হাসছেন।
আরে কী সৌভাগ্য! অনেকদিন অধমদের মনে করেননি, কী ব্যাপার? বোসদা ভদ্রলোককে প্রচুর খাতির করে বললেন।মনে করেও কী হবে? যা কৃপণ মানুষ আপনারা। হাজার সাধ্যসাধনা করেও আপনার হাত দিয়ে জল গলবে না। কিছুতেই মুখ খোলেন না। বোসদার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন। বোসদা সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বললেন, গরিবকে এবং শাজাহান হোটেলকে যদি মারতে চান, তাহলে মারুন। আপনার যা ইচ্ছে হয় তাই বলুন। তবে একটা কথা অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন, এই দাসানুদাস আপনাদের সেবার জন্যে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।ভদ্রলোকউফুল্ল হয়ে বললেন, যাক, আপনার শাজাহানী বিনয় ছাড়ুন। কোনো ইন্টারেস্টিং মাল এসেছে নাকি?
আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনো গোপন রহস্য আছে নাকি? কিসের জন্যে বোসদা এত আগ্রহের সঙ্গে কথা বলছেন, লেনদেনই বা কিসের? বোসদা একটু চিন্তা করলেন। তারপর পেন্সিলটা কানে খুঁজে বললেন, না, এখন একটাও ইন্টারেস্টিং কেস নেই। কাল বোধহয় আসছে।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, না, মিস্টার বোস, আমি প্রফেশন্যাল লোক। আপনার বেলি-ডালার লায়লা-তে ইন্টারেস্টেড নাই। বোসদা হাসতে হাসতে বললেন, না না, ওসব নয়। আমরা কি আর মানুষ চিনি না? আপনি যাতে ইন্টারেস্টেড, এমন কিছুই কাল আসছেন।
ভদ্রলোক এবার চলে গেলেন। বোসদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী, অমন বোকার মতো চেয়ে আছ কেন? ভদ্রলোককে খাতির করবে। উনিও আমার মতো মিস্টার এস বোস। খবরের কাগজের নামকরা রিপোর্টার। মাঝে মাঝে খবরের খোঁজে আসেন। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন সুন্দর ব্যবহার। এখান থেকেই কত খবর জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছেন। আমাদের চোখের সামনেই খবরগুলো ঘটেছে অথচ বুঝতে পারিনি। পরের দিন মিস্টার বোসের রিপোর্ট পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছি। মিস্টার বোস বলেন, ইন্ডিয়ার আট আনা খবর তো এখন এয়ারপোর্ট এবং হোটেলে তৈরি হচ্ছে। ভদ্রলোক কাল হয়তো আবার আসতে পারেন। যদি আসেন সাহায্য কোরো।
কী সাহায্য করব?আমার মনে ছিল না। কিন্তু দেখলাম সত্যসুন্দরদার মনে আছে। তিনি বললেন, কেন, কালই না পাকড়াশীদের অতিথিরা করবী দেবীর গেস্টরুম এসে হাজির হচ্ছেন!
পাকড়াশীদের অতিথির কথা আবার মনে পড়ে গেল। কলকাতায় তাদের দিনপঞ্জীর বিবরণ করবী দেবীর অনেক আগেই পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। নতুন আগন্তুকদের আবির্ভাব প্রতীক্ষায় শ্রীমতী করবী গুহ নিশ্চয়ই তার গেস্টহাউস যথাযথভাবে সাজিয়ে ফেলেছেন।
তদন্তের জন্যে টেলিফোনে দুনম্বর সুইটকে ডাকলাম। করবী দেবী টেলিফোনে ধরলেন।কে? শংকরবাবু? বা আপনি তো বেশ লোক। এক ঘর থেকে আর এক ঘরে টেলিফোনে করছেন। তবু আসবেন না।
বললাম, আপনারই তো খবর দেবার কথা ছিল। তা ছাড়া এখন আপনার কোনো অতিথি থাকতে পারেন। করবী দেবী বললেন, কবে যে মুক্তি হবে জানি না।কবে পৃথিবী থেকে বিজনেস ট্রানজাকসন উঠে যাবে বলতে পারেন? বললাম, হঠাৎ এ-সব প্রশ্ন করছেন কেন? বিজনেস ট্রানজাকসন, সাংস্কৃতিক সফর, আন্তর্জাতিক সম্মেলন এ-সব যদি উঠে যায়, তাহলে আমাদের তো আবার পথে দাঁড়াতে হবে।
করবী দেবী বললেন, হয়তো আপনাদের চাকরি থাকবে না। কিন্তু শান্তি পাবেন। আমার দুএকটা অতিথির নমুনা যদি দেখতেন।
আজকাল আমার সাহস বেড়ে গিয়েছে। বললাম, কেন, আপনার তো সিলেকটেড গেস্ট। আমাদের মতো সার্বজনীন পুজোর নৈবেদ্য তো আপনাকে সাজাতে হচ্ছে না। করবী দেবী বললেন, গেস্টরুমে চলে আসুন। তখন আপনার সঙ্গে কথা হবে।
আমার হাতে কাজ ছিল না। আমার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছে। আট ঘণ্টা ধরে অতিথিদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা এবং বিমর্ষ মুখে বিদায় জানিয়েছি। একটা টি-পার্টির ব্যবস্থা করেছি। এমন চা-চক্র আমাদের এখানে লেগেই আছে। আমাদেরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মাইক ঠিক করে দেওয়া, যিনি পার্টি দিচ্ছেন তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সাহায্য করা, এ-সব আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। এবার একটু বিশ্রাম মন্দ লাগবে না। সুতরাং আর কথা না বাড়িয়ে করবী দেবীর সুইটে এসে হাজির হলাম।
করবী দেবীর তখন সান্ধ্যস্নান শেষ হয়ে গিয়েছে। মূল্যবান এবং দুর্লভ ফরাসি সেন্ট দেহে ছড়িয়ে করবী দেবী একটা রকিং চেয়ারে বসেছিলেন, আমাকে দেখেই তার দোদুল্যমান দেহ থমকে দাঁড়াল। ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ওঁর বয়স বুঝতে ভুল করেছিলাম। আগে যা ভেবেছি উনি তত বয়সিনী নন। করবী দেবী বললেন, সমস্ত দিনটা আজ যেভাবে গিয়েছে, তা ভাবতে আমার গা বমি বমি করছে।
আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। করবী দেবী বললেন, আপনাদের স্বাধীন ভারতবর্ষে কয়েকটা জিনিস খুব বেড়েছে। কন্ট্রাক্ট, কন্ট্রাক্টর, পারচেজ অফিসার, অ্যাকাউন্টস অফিসার—এঁদের জন্যেই যেন পৃথিবী এখনও সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মিস্টার আগরওয়ালাকেই বা কী বলব। অতিথি নির্বাচনে তার কোনো রুচি নেই। যারা হোটেলের ভিতর দেখেনি কোনোদিন, যারা কোনদিন ড্রিঙ্কের ড শোনেনি, তাদেরও তিনি দুনম্বর সুইটে নেমন্তন্ন করছেন, তাদেরও তিনি বার-এ ঢোকাচ্ছেন।
করবী দেবী এবার রকিং চেয়ার থেকে উঠে পড়ে, কফি তৈরি করবার জন্য হিটারে জল চড়িয়ে দিলেন। সুইচটা অন করে দিয়ে করবী দেবী একবার ড্রেসিং আয়নায় নিজের দেহটাকে যাচাই করে নিলেন। নিজের রাঙানো ঠোঁটটা আয়নাতে একটু খুঁটিয়ে দেখলেন। মাথার খোঁপায় যে রজনীগন্ধা ফুলগুলো সযত্নে সাজানো ছিল সেগুলো অবহেলাভরে খুলে খুলে টেবিলের উপর রাখতে লাগলেন। তারপর দুঃখ করে বললেন, ছুরি কাঁটা ধরতে জানে না, চা কিংবা সুপ খেতে গিয়ে চো চো করে আওয়াজ করে, খাওয়ার শেষে বিশ্রী শব্দ করে ভেঁকুর তোলে, এমন সব লোকদের আগরওয়ালা স্যার স্যার করেন। আশ্চর্য!
আমি কোনো উত্তর না-দিয়ে কফির অপেক্ষায় বসে রইলাম। করবী দেবী বললেন, আবার এক-একজন ম্যানারে দুরস্ত। কিন্তু কি ধাতু দিয়ে যে ভগবান ওঁদের তৈরি করেছেন তা আজও বুঝতে পারি না। আমি গম্ভীরভাবে বললাম, যে-দিন আমরা এই ধাতুর রহস্য বুঝতে পারব, সেদিন শাজাহান হোটেল আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠবে। সেদিন হয়তো মিস্টার আগরওয়ালা আপনাকে ধরে রাখতে পারবেন না।
করবী দেবী বললেন, যদি অদৃশ্য কোনো ফুটো দিয়ে দিন কয়েকের জন্য আমার এই ঘরের দিকে নজর রাখেন তবে মানুষ সম্বন্ধে আপনার কিছুই জানতে বাকি থাকবে না। আমার যদি লেখার ক্ষমতা থাকত, তা হলে এতদিন আরও একখানা মহাভারত তৈরি হয়ে যেত।
করবী দেবী বললেন, অথচ ছোটবেলায় ভাবতাম মানুষ কত মহৎ। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেইঈশ্বর বিরাজ করছেন। এখন কী ধারণা হয়েছে জানেন? হিটারের সুইচটা বন্ধ করে দিতে দিতে করবী দেবী প্রশ্ন করলেন।
বললাম, আপনি হয়তো ভাবছেন মানুষ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।করবী দেবী হেসে ফেললেন।
বললেন, আমার এখন ধারণা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ঈশ্বর থাকুন–থাকুন, একজন ঘাঘু পারচেজ অফিসার নিশ্চয়ই আছেন। তিনি সংসারের সব কিছু পারচেজ দাম না দিয়ে করতে চান। শুধু স্যাম্পেল আর নমুনা ব্যবহার করে করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবার বুদ্ধিতে এঁরা অদ্বিতীয়।
করবী দেবী এখনও হাসছেন। কফির কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে বললেন, আজ যে ভদ্রলোককে মিস্টার আগরওয়ালা এনেছিলেন, তিনি বেশি কথা বলেন না। মদ খাবার লোভও আছে, অথচ মাতাল হবার ভয় আছে। মদও খেলেন। তারপর এখন অন্য এক হোটেলে ক্যাবারে দেখতে গিয়েছেন, মিস্টার আগরওয়ালা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কারণ ভদ্রলোক দক্ষিণদেশ থেকে মাঝে মাঝে আসেন, আর প্রচুর মাল কিনে নিয়ে যান। তা তোমাকে মাল গছাবার জন্য ওঁরা খাওয়াচ্ছেন, খাও, গেস্টরুমে নিয়ে এসেছেন থাক, কিন্তু তাই বলে ভণিতাগুলো! বিশ্বাস করবেন না, ভদ্রলোক ড্রিঙ্কের মধ্যেই একবার জুতো খুলে আহ্নিকটা সেরে নিলেন। মিস্টার আগরওয়ালা তাকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে বললেন, মিস্টার রঙ্গনাথন, আপনার কাছে এইটাই শেখবার। যেখানেই থাকুন গড়কে কিছুতেই ভুলতে পারেন না।রঙ্গনাথনের তখন নেশা ধরেছে। আহ্নিকে বসবার আগে পর্যন্ত ক্যাবারে মেয়েদের নাচ সম্বন্ধে খবরাখবর নিচ্ছিলেন। আগরওয়ালার কথা শুনে বললেন, আমার ওয়াইফের ভয়ে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ফিয়ারফুল লেডি। সন্ধেবেলায় পুজো না করলে আমাকে খেতে দেবে না ।
রঙ্গনাথনের নাম শুনে আমি একটু অবাক হলাম। মনে পড়ে গেল, মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জি একবার মমতাজ রেস্তোরাঁয় ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। করবী দেবী বললেন, ফোকলার সঙ্গে ওর সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে মিস্টার রঙ্গনাথন এখন মিস্টার আগরওয়ালার স্কন্ধে ভর করেছেন। মিস্টার আগরওয়ালা আমাকে টেলিফোনে মনে করিয়ে দিলেন রঙ্গনাথন বড় শক্ত বাদাম, কিছুতেই ভাঙতে চায় না। মাঝে মাঝে ওকে শুধু কজার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। এক লক্ষ কজার অর্ডার ওর হাতে রয়েছে। তাছাড়া এই অর্ডারটা বাগাতে পারলে রিপিট অর্ডার আসতে বাধ্য।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে করবী দেবী বললেন, এক এক সময় খুব মজা লাগে। জানেন, আগরওয়ালা বলে রঙ্গনাথন একটা শাইলক। ব্যাটাচ্ছেলে সব বোঝে। মার্কেটের ওঠা-নামা ওর নামতার মতো মুখস্থ। এই মালটা যে বাজারে অনেক রয়েছে তা রঙ্গনাথন জানে। তাই আগরওয়ালাকে পিষে যত পারে রস বের করে নেবার চেষ্টা করছে। আগরওয়ালা সুবিধে করতে না পেরে, শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে আমার এখানে পাঠিয়েছে।
করবী গুহ এবার শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিলেন। বললেন, এই জন্যেই মনে হয় পৃথিবীতে বেচা এবং কেনার হাঙ্গামাটা না থাকলেই ভাল হত।
আমি প্রশ্ন করলাম, মিস্টার রঙ্গনাথন কী বললেন?
রাজি হয়ে গিয়েছেন। আগরওয়ালার সমস্ত স্টকটাই কিনে নেবার ব্যবস্থা হয়ে গেল। রঙ্গনাথন যাবার সময় কী বললেন জানেন? বললেন, ক্যালক্যাটা, বোম্বে এই কারণেই ফ্লারিশ করছে। বিজনেস এই দুই গ্রেট সিটিতে অনেক সাইন্টিফিক লাইনে রান করছে। ক্যালকাটাওয়ালা এবং বোম্বেওয়ালারা জানে কী করে সেল করতে হয়। এখানকার বিজনেসম্যানরা মুদিখানার দোকান থেকে সেলসম্যানশিপ শেখেনি। রঙ্গনাথনের নেশা হয়েছিল।
রঙ্গনাথনকে আউট করবার জন্যে কী ড্রিঙ্ক আনিয়েছিলেন? জন হেগ? আমি কফির কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলাম।
করবী দেবী হেসে বললেন, রংয়ের সঙ্গে রং মিলিয়ে যেমন আমি লিনেন ব্যবহার করি, তেমনি যেমন লোক তেমন ড্রিঙ্ক সিলেক্ট করবার চেষ্টা করি। ওঁর জন্যে আনিয়েছিলাম ওল্ড স্মাগলার। ওল্ড স্মাগলারের রঙিন নেশায় ভদ্রলোক বোল্ড আউট হয়ে যাননি। কিন্তু টলমল করছিলেন। সেই অবস্থায় বলেছিলেন, মিস্টার আগরওয়ালা, আপনি একটা ইস্কুল খুলুন। এই ক্যালকাটার বহু বিজনেসম্যান সেল করতে জানে না। তাদের সঙ্গে ডিল করতে গেলে আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়, মনে হয় ঠিক যেন আমার ওয়াইফের সঙ্গে ডীল করছি।
রঙ্গনাথন থেকে আমরা মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের অতিথিদের কথায় ফিরে এলাম। করবী গৃহ বললেন, অভ্যর্থনার সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। এখন কেবল ফোন করে ঠিক করে নেওয়া। মিস্টার অনিন্দ্য পাকড়াশীকে আপনি চেনেন নাকি?
বললাম, সামান্য পরিচয় আছে।
আগে থেকেই ওঁকে চিনতেন? করবী দেবী প্রশ্ন করলেন।
না, এইখানেই আলাপ হয়েছিল, আমি উত্তর দিলাম।
আচ্ছা। এই হোটেলে? উনি কি এখানে আসেন? কেমন লোকটি বলুন তো?
আমি বললাম, কেন বলুন তো?
করবী দেবী হেসে বললেন, আছে, প্রয়োজন আছে। ওঁর সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার। করবী দেবী এবার ওঁর টেলিফোনটা তুলে ধরলেন।
টেলিফোনে আবার অনিন্দ্য পাকড়াশীর খবর পাওয়া গিয়েছিল। পাকড়াশী জুনিয়র আজকাল অনেক কাজ করছেন। মাধব ইন্ডাস্ট্রিজ নামে শিল্প সাম্রাজ্যের সিংহাসনে তাকে একদিন বসতে হবে। তার জন্যে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষা নয়, অগ্নিপরীক্ষা—একদিন অনিন্দ্য পাকড়াশী নিজেই আমাদের বলেছিলেন।
অনিন্দ্য পাকড়াশীকে আপনারা দেখে থাকবেন। দেশের তরুণতম শিল্পপতিদের তিনি একজন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক কনফারেন্সের পর ফিনান্সের উত্তাপে অনেকক্ষণ সেদ্ধ করা তার মুখের যে ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না এই অনিন্দ্য পাকড়াশীই একদিন আমাদের সঙ্গে সরল প্রাণে গল্প করবার জন্যে সুযোগ খুঁজতেন। লুকিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতেন আমাদেরই এই শাজাহান হোটেলে। বলতেন, সিগারেট খাওয়াও আমার বারণ। মা মোটেই পছন্দ করেন না।অনিন্দ্য বলতেন, আমার বাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না। বাবা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে, ট্রেডে, কমার্সে শান্তি নেই। তার ইচ্ছে ছিল, আমি আরও কয়েক বছর স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করি; ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্যের দেশে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই। তারপর রুটিনের ঘানিতে একদিন তো বাঁধা পড়তেই হবে। কিন্তু মা রাজি হলেন না।
একটু থেমে পাকড়াশী জুনিয়র বলেছিলেন, জানেন, আমার ছবি আঁকতে এত ভাল লাগে, অথচ একটুও সময় পাই না। গাড়ি করে যেতে যেতে যখন দেখি গড়ের মাঠেসবুজ ঘাসের উপর বসেবসে কোনো শিল্পী ছবি আঁকছে, তখন আমার মনটা উদাস হয়ে ওঠে। এলিয়ট, অডেন আর পাউন্ডের কবিতা পড়া আমার নেশার মতো ছিল। বাংলাও পড়তাম। জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন এঁদের কবিতাও আমার খুব ভাল লাগত। সমর সেন পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে আমার খুব দুঃখ হত। আমাদের দেশের লোকরা সত্যিই এত কষ্ট পায়?জানেন, মাকে, একদিন জিজ্ঞাসাও করেছিলাম।মাতখন ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। মা বললেন, ওঁরা যে কবি। হয়তো জীবনে ওঁদের যথেষ্ট সুখ আছে, শান্তি আছে, তবুও লেখবার সময় চোখের জল ফেলতে হয়। কাব্যের নিয়মই এই। পৃথিবীতে যারা সামান্য একটু সুখে আছে, স্বাচ্ছন্দ্যে আছে, দারিদ্র্যের আদালতে তাদের অভিযুক্ত না করলে, সাধারণ লোক পয়সা দিয়ে ওঁদের কবিতার বই কিনে পড়বে কেন? ওঁদের সঙ্গে যদি আলাপ হয়, দেখবে এঁরা আমাদেরই মতো সাধারণ জীবন যাপন করছেন।
এই অনিন্দ্যকে আমি চিনতাম। আবার আমার থেকে অনেক বেশি চিনতেন শ্ৰীমতী করবী গুহ।
করবী দেবী একদিন বলেছিলেন, ধনীর দুলাল এখনই পান্থশালা পরিদর্শনে আসছেন! বিদেশি অতিথিদের জন্যে ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না দেখবেন। নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ করবার জন্যে হুকুম দেবেন হিয়া কামাটি হুয়া ফোঁকো, আর হুঁয়া কা মাটি হিঁয়া ফোঁকো। এঁদের কাছে আমাদের শিখতে হবে কেমন করে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়!
ঝলমলে টি-শার্ট আর কাঠকয়লা রংয়ের ট্রপিক্যাল ট্রাউজার পরে এবং একটা টেনিস র্যাকেট হাতে নাচাতে নাচাতে অনিন্দ্য পাকড়াশী একটু পরেই নিউ আলিপুর থেকে এসে হাজির হলেন। করবী দেবী অনিন্দ্যকে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, খাতায় কলমে যদিও সুইট, আসলে এটা হোটেলের একটা উইং। বেশ কয়েকজন গেস্টকে আমি অ্যাকোমোডেট করতে পারি।
অ্যাকোমোডেট নয়, আশ্রয় বলুন। অনিন্দ্য হেসে উত্তর দিলেন। ঘরের ব্যবস্থাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, বিশ্বাস করবেন, আমি কখনও হোটেলে থাকিনি! মা মোটেই পছন্দ করেন না। এই কবছর তো বোম্বাই ব্রাঞ্চে ছিলাম, তা সহজেই হোটেলে থাকতে পারতাম। মা কিন্তু মাসিমার ওখানে ব্যবস্থা করে দিলেন। মেসোমশাই ওখানকার এজেন্ট। ওঁর আন্ডারেই আমার চাকরি।
অনিন্দ্য ছো্টোছেলের মতো হেসে বললেন, যারা আসছেন এঁরা জার্মানির এক বিরাট কারখানার মালিক। এঁদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। বাবা সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে বসে আছেন। এখন কোথাও পান থেকে চুন খসলে, আমাকেই তার জন্যে দায়ী হতে হবে। সুতরাং কী করি বলুন? এ-সবের আমি কী বুঝি? বাবার কাছে আমার যাতে মুখ রক্ষে হয়, সে ব্যবস্থা আপনাদেরই করতে হবে।
অনিন্দ্য কিছুই দেখলেন না। আমাদের ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। করবী দেবীর রকিং চেয়ারে বসে পড়ে অনিন্দ্য বললেন, সামনের কয়েকটা দিন আমার কাটলে হয়। মা বলেছিলেন, বাবার তখন তেমন অবস্থা ভাল নয়। এক বিলিতি কোম্পানির এজেন্সি পাবার জন্যে বাবাকে নাকি পর পর তিনদিন লাঞ্চ ড্রপ করতে হয়েছিল।আমার ভাগ্যে আবার দেখা যাক কী আছে; কিন্তু লাঞ্চ ড্রপ করতে আমার মোটেই ভাল লাগে না।
করবী গম্ভীরভাবে বললেন, এখন দিনকাল পালটিয়েছে। অনিন্দ্য বললেন, ঠিক বলেছেন। মাকে আমি কথাটা শুনিয়ে রাখব। কাল ভোরে আমি এবোডড্রামে যাব, সেখান থেকে এখানে আসব, ওঁদের সঙ্গে আঠার মতো লেগেও থাকব। তারপর যা-হয় তা হবে।
আমি উত্তর দিলাম, এর পরে আপনার মায়ের আর কিছু বলবার থাকবে। তবে আগে থেকে আপনার বক্তব্যটা জানিয়ে রাখা মন্দ নয়! অনিন্দ্য পাকড়াশী আমার সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। বললেন, আমার মাকে আপনি চেনেন না। মা ভাববেন, কাজলের আমার কাজে মন বসেনি। ও-হরি আপনাদের বলাই হয়নি, কাজল আমার ডাক নাম। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার বন্ধুরা আমাকে কাজলা দিদি বলে রাগাত। দেখা হলেই দূর থেকে চিৎকার করত-বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো, আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই। করবী গম্ভীর হয়ে রইলেন। আমি কিন্তু হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম, আপনি বুঝি খুব শ্লোক আওড়াতেন?
মোটেই নয়। মাঝে মাঝে শুধু কোটেশন দিতাম। কবিতায় উত্তর দিতে আমার খুব ভালো লাগত। এখন কিন্তু আমি কাঠ হয়ে যাচ্ছি। বাবার হোটেলে থাকা এক জিনিস, কিন্তু বাবার আপিসে চাকরি—রিগারাস ইমপ্রিজমেন্ট। মায়ের ইচ্ছে ছিল, আমি আরও কিছুদিন বাইরে থাকি। বাইরে কাজ করলে ট্রেনিং ভালো হয়, মায়ের ধারণা। না হলে, নিজের পেটের ছেলেকে কে আর বাইরে রাখতে চায়, বলুন। বাবা আগে দুএকবার আমাকে নিয়ে আসবার কথা তুলেছেন, মা মত দেননি। এবার, বাবা প্রায় জোর করলেন। বাবার ধারণা, মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের ঘরানা শিখে নেবার সময় এসেছে। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিজের এখন দুটি প্রবল শত্রু জানেন তো। কথাটা কিছু আমার নিজের নয়। আমার বাবা প্রায়ই বলেন—পাবলিক সেকটর আর করোনারি থ্রম্বসিস।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনিন্দ্য বললেন, এবার উঠি। মায়ের অর্ডার, ক্লাবে গিয়ে একটু টেনিস খেলতে হবে।
আজও মনে পড়ে, সেদিন অনিন্দ্য বিদায় নেবার পর, আমরা দুজন অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসেছিলাম। নাম কাজল, কিন্তু আসলে যেন শুভ্র। অনিন্দ্য আমাদের হোটেলের এই অশুচি পরিবেশে যেন স্নিগ্ধশুচিতার পাউডার ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। করবীও চুপ করে থাকতে পারলেন না। আস্তে আস্তে বললেন, চমৎকার। এমন ছেলেকে মিসেস পাকড়াশী কেমন করে যে বছরের পর বছর বাইরে রেখেছিলেন!
ভাবী রাজার মায়ের মতো, ভাবী ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের মাকেও অনেক স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। আমি উত্তর দিলাম।
করবী নিজের অজান্তেই বলে উঠলেন, আশা করি তাই যেন হয়।
সেদিন আমি মনে মনে আনন্দিত হয়েছিলাম। যাক, কিছু ভালও দেখলাম। হোটেল মানে তো শুধু খারাপ নয়। এখানে অনেক ভালোও আসে।
পরের দিন ভোরে আমি উঠে পড়েছিলাম। তখন রাতের অন্ধকার কাটেনি। ছাদের উপর নিশ্চল পাথরের মতো একটা লোক তখনও বসেছিলেন। তার নাম প্রভাতচন্দ্র গোমেজ। ওই ভোরবেলাতেই প্রভাতচন্দ্র গোমেজ যে ব্রাহমের প্রদর্শিত পথে কালো তিক্ত কফি নিজে হাতে তৈরি করে পান করেছেন, তা তাঁর পাশে শূন্য কাপটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখন ছাদের কোণে ওইভাবে কিসের অপেক্ষায় বসে আছেন কে জানে?
প্রভাতচন্দ্র আমাকে দেখতে পেলেন, ইশারায় কাছে ডাকলেন। বললেন, আমার জীবনে এই একটাই বিলাসিতা আছে। সূর্যের জন্য পূর্বদিগন্তে তাকিয়ে থেকে আমি নুতন চিন্তার খোরাক পাই।
বললাম, আপনার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। শুধু একটা গেঞ্জি পরে বসে আছেন। প্রভাতচন্দ্র গোমেজ আমার কথায় যেন কান দিলেন না। নিজের মনেই বললেন, ঠান্ডা লেগে এখান থেকে আমি বিদায় নিলে পৃথিবী একটুও গরিব হবে না। অনেকদিন আগে একজন মানুষ ঠান্ডাকে অবহেলা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেদিন কিন্তু পৃথিবী সত্যিই গরিব হয়ে গিয়েছিল। আজও সে ক্ষতি পূরণ হয়নি।
প্রভাতচন্দ্রের কথার মধ্যে এমন এক বিষণ্ণ ঝংকার আছে যা আমার মতো বেসুরো মানুষকেও সহজে আকৃষ্ট করে। প্রভাতচন্দ্র বললেন, তিনি সঙ্গীতের সেক্সপিয়র; তার নাম বীঠোফেন। আমার যদি সামর্থ্য থাকত, আমার যদি তেমন একটা রেকর্ড লাইব্রেরি থাকত, তাহলে আজ এই মুহূর্তে আপনাকে শোনাতাম বীঠোফেনের নাইনথ সিমফনি—the most gigantic instrumental work extant.
আমি বললাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদে একদিন আপনার যেন সব হয়।
তার আশীর্বাদ, তাঁর বিচার? প্রভাতচন্দ্র গোমেজ প্রসন্ন হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেললেন। তাহলে হান্ডেল এবং বা কি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন? তাহলে কি বীঠোফেন কালা হয়ে যান? মানব সভ্যতার এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে আর একজনও বীঠোফেন সৃষ্টি হয়নি। যদি আপনি পৃথিবীর মধুরতম সিমফনি শুনতে চান তাহলে বীঠোফেন যে নটি রেখে গিয়েছেন তাই আপনাকে শুনতে হবে; যদি আপনার এমন পিয়ানো ফোর্ট সোনাটা শোনবার লোভ থাকে যার কোনো তুলনা নেই, তাহলে বীঠোফেনের বত্রিশটার মধ্যেই একটা পছন্দ করতে হবে। আর স্ট্রিং কোয়ার্টেট? সেখানেও আপনার ভরসা তাঁর সতেরোটি রচনা। আর অতি সাধারণ উপায়ে যদি অসাধারণ শব্দঝংকার সৃষ্টির রহস্য আপনি আবিষ্কার করতে চান, তাহলে ঘরের মধ্যে তালা দিয়ে নির্জনে বসে বসে আপনাকে হান্ডেলের পুজো করতে হবে। একবারে তিনি হয়তো আপনাকে অনুগ্রহ করবেন না। কিন্তু আপনাকে হতাশ হলে চলবে না। ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হবে। তারপর একদিন এমনই কোনো অন্ধকার এবং আলোর মিলন মুহূর্তে আপনি বুঝতে পারবেন বীঠোফেন কেন বলেছিলেন–Go and learn of Handel how to achieve great effects with simple means.
প্রভাতচন্দ্র হঠাৎ চুপ করে গেলেন। তার পারিপার্শ্বিককে সম্পূর্ণ ভুলে তিনি আবার পূর্বদিগন্তের দিকে তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে সরিয়ে নিলেন। সহজ পথে অসাধারণকে পাবার গোপন মন্ত্রটি যেন ওই আকাশের এক কোণে কোথাও অদৃশ্য কালিতে লেখা রয়েছে।
আমি আর কোনো কথা না বলেই, ঘরে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিয়েছি। হোটেলের সবাই তখনও গভীর ঘুমে ড়ুবে রয়েছে। কিন্তু আমার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। করবী দেবীরও। তিনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন। মার্কোপোলোর সঙ্গে তার এবং আগরওয়ালার কথা হয়েছে। কদিন আমাকে বিশেষ অতিথিদের জন্যে বিশেষ ডিউটি দিতে হবে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার কিন্তু শুধু প্রভাতচন্দ্রের কথা মনে হচ্ছিল। সহজ পথে মহানকে পাবার জন্যেই যেন আমরা সবাই কাঙালের মতো রাস্তায় পাতা পেতে বসে আছি।
করবী দেবীর ঘরে টোকা মারতেই, তিনি দরজা খুলে দিলেন। তাঁর অতিথিশালা তখন অতিথি অভ্যর্থনার জন্যে প্রায় প্রস্তুত। ঘরের কোণে এবং টেবিলে কেমন সুন্দর ফুলের গুচ্ছ সাজিয়ে দিয়েছেন করবী দেবী। রংয়ের সঙ্গে রং মিলেছে। করবী বললেন, এক এক সময় ভাবি, ইনটিরিয়র ডেকরেটরের কাজ করব। কেমন দেখছেন? বললাম, চমৎকার করবী বললেন, বেচারা ন্যাটাহারিবাবুকে কাল খুব খাটিয়েছি। যে রংয়ের পর্দা এনে দেখান তাই আমার পছন্দ হয় না।
শেষে ন্যাটাহারিবাবু নিবেদন করলেন, মা জননী, যদি অপরাধ না নেন, তা হলে একটা কথা বলি। আমি তো লাটসায়েবের বিছানাও করেছি। রয়েল ফ্যামিলির মেম্বাররা যখন ইন্ডিয়ায় এসেছেন, তখনও বিছানা বালিশের জন্যে এই ন্যাটাহারি ভট্টচায্যিকেই ডাকতে হয়েছে। এই অধমের হাতে তৈরি বিছানাতেই শুয়ে লর্ড রিডিং এমন সুখ পেয়েছিলেন যে, ঘুম থেকে উঠতে এক ঘণ্টা দেরি করেছিলেন। সকালের সমস্ত প্রোগ্রাম একঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। আর এমনই অদৃষ্ট আমার যে, এখন দুটো জার্মান সায়েবের জন্যে ঘর সাজাবার পর্দা পছন্দ করাতে পারছি না। করবী তখন বলেছিলেন, এই সব ব্যবস্থার উপর একজন ভদ্রলোকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে—খারাপ কিছু ঘটলে তাঁর বাবার কাছে তিনি ছোট হয়ে যাবেন।
ন্যাটাহারিবাবু তখন কান থেকে পেন্সিলটা খুলে বলেছিলেন, ব্যাপার যদি এতই গুরুতর হয়, তাহলে মা জননী একটা কথা বলি। ঘরের পর্দা, টেবিলের কাপড়ের জন্যে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। সমস্ত নজরটা বিছানার উপর দিন। ফর্টি ইয়ার লিনেনের কাজ করে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি, তাতে বলছি, বিছানাটা হোটেলের সবচেয়ে ইম্পর্টান্ট আইটেম। বিছানাটা যদি ভালো পায়, খারাপ খাবার হলেও লোকে কিছু বলবে না। বিছানা এমনভাবে করতে হবে, যাতে সবাই ভাবে সে নিজের চেনা বিছানাতেই শুয়ে আছে। দোষ দিতে পারেন না, মা জননী। লাইফের সবচেয়ে ইম্পর্টান্ট সেন্টার এই বিছানা। এই বিছানাতেই আমরা হাসি, এই বিছানাতেই শুয়ে শুয়ে আমরা কাঁদি, এই বিছানাতেই আমাদের জন্ম, এই বিছানাতেই আমাদের মৃত্যু। অথচ মা লক্ষ্মী, আজকালকার আপনারা এ-দিকটা একেবারেই নজর দেন না। ন্যাটাহারি যখন থাকবে না তখন এই হোটেলের যে কী হবে!
ন্যাটাহারিবাবু তারপর তার যত রংয়ের পর্দা আছে, তার এক একটা নমুনা মাথায় করে করবীর ঘরে হাজির হয়েছিলেন। এবং তার মধ্যে থেকেই তিনি একটা পছন্দ করেছেন।কেমন দেখছেন?করবী আমাকে এক কাপ চা দিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন। আমার মাথায় তখনও হান্ডেল ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বললাম, সহজ অথচ সুন্দর হয়েছে।করবী হাসলেন।সব সৌন্দর্যের রহস্যই তোওই। এই যে অনিন্দ্য পাকড়াশী। ওঁর জন্যেই বা আমরা দুজনে এত পরিশ্রম করছি কেন? উনি সহজ অথচ সুন্দর বলে, তাই না?
সেদিন ব্রেকফ্রাস্টের একটু আগেই দমদম বিমানঘাঁটি থেকে দুজন বিদেশি অতিথিকে নিয়ে মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের বিরাট ক্রাইসলার গাড়ি শাজাহান হোটেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।ডক্টররাইটার এবং মিস্টার কুর্টের আকার বিশাল,এবং গুরুত্ব ততধিক।
করবী আজ মুর্শিদাবাদ সিল্কের একটা শাড়ি পরেছেন। মাথার খোঁপা রজনীগন্ধার গোছায় ভরিয়ে দিয়েছেন। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। অনেকদিন আগে সরস্বতী পুজোর দিন আমার অলকাদিকে এমনি দেখাত। এমনি সহজ অথচ গম্ভীর বেশে অলকাদি গার্লস কলেজের পূজামণ্ডপে যেতেন।
করবী গুহ আমাদের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। অতিথিদের দেখে ভারতীয় প্রথায় হাতজোড় করে অভ্যর্থনা জানালেন। অনিন্দ্য আমার ঘাড়ে ওঁদের মালপত্তরের দায়িত্ব চাপিয়ে করবী দেবীকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
পোর্টারের মাথায় সব মালগুলো চাপিয়ে, আমি যখন দুনম্বর সুইটে এসে হাজির হলাম, তখন চমকে যাবার অবস্থা। দুনম্বর সুইটের মেঝেয় করবী কখন আলপনা এঁকে ফেলেছেন। ওঁরা বলছেন, এ-গুলো কী? অনিন্দ্য বলছেন, আমাদের ট্রাডিশনাল পেন্টিং। সম্মানিত অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্যে আমাদের গৃহবধুরা এই আলপনা দিয়ে থাকেন। ডক্টর রাইটার বললেন, বাঃ চমৎকার!তারপর তিনি নিজের ক্যামেরা মেঝের উপর ফোকাস করতে আরম্ভ করলেন। ছবি ভোলা শেষ করে রাইটার বললেন, অ্যামেচার ঘরের মেয়েরা এমন আর্ট ওয়ার্ক করতে পারে। কোনো প্রফেশনাল শিল্পী এগুলো করেননি?
অনিন্দ্য বললেন, মোটেই না। অবশ্য মিস্ গুহকে আপনি একজন ট্যালেন্টেড শিল্পী বলতে পারেন।
মিস্টার কুর্ট জুতোর ডগা নাড়তে নাড়তে বললেন, মে আই হ্যাভ এ গ্লাস অফ বিয়ার?অনিন্দ্য বললেন, নিশ্চয়ই! কিন্তু আমাকে নিতান্ত দুঃখের সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে হল, আজ ড্রাই ডে।
হোয়াট? অসন্তুষ্ট মিস্টার কুর্ট প্রশ্ন করলেন।
অনিন্দ্য ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পেরে গিয়েছেন। বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আপনারা খারাপ দিনে কলকাতায় এসে হাজির হয়েছেন। প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন আমাদের এই স্টেটে মদ বিক্রি বন্ধ। সেদিন বার এবং রেস্তোরাঁর ম্যানেজাররা সব স্পিরিচুয়াস লিকার তালাবন্ধ করে রাখেন।
মিস্টার কুর্ট এমন কোনো সংবাদ জীবনে শোনেননি। বললেন, ইউ মিন টু সে, একদিন তোমরা পুরোপুরি ড্রাই! ইচ্ছে করে ইন্ডিয়ার নরম্যাল লাইফ একদিনের জন্যে তোমরা পঙ্গু করে দাও? এবং তুমি বলতে চাও, এইভাবে, এই সব লাস্ট সেঞ্চুরির পচে যাওয়া আইডিয়া নিয়ে তোমাদের কান্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের সূচনা করবে?
এই অশুভ সূচনায় অনিন্দ্য যে বেশ ঘাবড়ে গেলেন, তা তার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম। কিন্তু তখন কে জানত, আরও অনেক কিছু বাকি রয়েছে।
অনিন্দ্য তাঁর দেশের সব অপরাধ যেন নিজের মাথায় তুলে নিয়ে বিদেশি অতিথিদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন বাংলা দেশকে তার হুকুমেই সপ্তাহে একদিন ড্রাই করে দেওয়া হয়। মাথা নিচু করে বিরক্ত অতিথির কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
ডক্টর রাইটার এবার তার বন্ধুকে একটু শান্ত করবার চেষ্টা করলেন। ইংরেজিতেই বললেন, কলকাতা তবু তো মন্দের ভাললা। ভারতের পশ্চিমে, আরব সাগরের তীরে বোম্বাই বলে একটা শহর আছে, সেখানে প্রত্যেক দিনই শুকনো দিন। শুনেছি, এক বোতল বীয়ারের জন্যেও সেখানে তোমাকে পারমিট নিতে হবে।
মিস্টার কুর্ট এবার হতাশ হয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। করবী এই অবস্থা দেখেই বোধহয় ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হল, অনিন্দ্য যাতে তার সামনে বিব্রত বোধ না করেন সেই জন্যেই তিনি সরে গিয়েছেন। কিন্তু আমার ভুল ভাঙল একটু পরেই। করবী একটা নরম রবারের চটি পরে, বেণী দুলিয়ে আবার ড্রইংরুমে এসে ঢুকে অতিথিদের ভারতীয় প্রথায় নমস্কার করলেন।
ওঁরা দুজনেই অবাক হয়ে করবীর মুখের দিকে তাকালেন। ওঁর পিছনে ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে দুটো ডাব। বিদেশি দুজন জীবনে এমন অদ্ভুত ফল দেখেননি। ডক্টর কুর্ট একটু অবাক হয়ে বললেন, কী জিনিস? করবী হেসে বললেন, নেচার আমাদের জন্যে ইন্ডিয়াতে এই ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা করেছেন। ডাব।
ড্যাব! নেভার হার্ড অফ ইট! ডক্টর রাইটার বলে উঠলেন। করবী দুটো ডাব ওঁদের দিকে এগিয়ে বললেন, গ্রিন কোকোনাট কি তোমরা এর আগে দেখোনি? ইন্ডিয়ানরা প্রচুর পরিমাণে এই ডাব খেয়ে থাকে। অনিন্দ্য তার অতিথিদের মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন।
করবী মোহিনী হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, এই ডাব ড্রিঙ্ক করাও একটা আর্ট। ইচ্ছে করলে এর জল গ্লাসে ঢেলে আপনাদের দিতে পারতাম। কিন্তু তা আমি চাই না। আমি চাই, আমাদের গ্রামের লোকেরা যেভাবে ড্রিঙ্ক করে আপনারা সেইভাবে খান।
কুর্ট একটু উৎসাহ বোধ করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে ড্রিঙ্ক করতে হবে বলো? করবী হাসতে হাসতে বললেন, আমাদের গ্রামের লোকরা এমনভাবে ফুটোতে মুখ রেখে খায় যে, একফোঁটা জল গায়ে বা জামায় পড়ে না। কিন্তু সেটা বেশ শক্ত ব্যাপার।
কুর্ট সঙ্গে সঙ্গে করবীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। ডাব মুখ দিয়ে তিনিও যে খেতে পারেন, তা প্রমাণ করবার জন্যেই যেন ডাবটা এক মিনিটের জন্যে করবীর হাতে দিয়ে নিজের কোট খুলে ফেললেন। করবী এবার বললেন, মিস্টার কুর্ট, যথেষ্ট হয়েছে। এইভাবে খেতে গিয়ে তোমার জামায় দাগ হবে, এবং আমাদের দেশের দুর্নাম হবে। আমি তোমাদের জন্যে স্ট্র পাইপের ব্যবস্থা করে রেখেছি।
ডক্টর রাইটার বললেন, আমাকে একটা পাইপ দাও। যে-বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই, সে-বিষয়ে তোমাদের কাছ থেকে নো হাউ নিতে আমার মোটেই আপত্তি নেই। মিস্টার কুর্ট বললেন, হে ভারতীয় সুন্দরী, আমরা জার্মান—অত্যন্ত গোঁয়ার। মাথায় যখন খেয়াল চেপেছে তখন আমি ট্রাই করবই।
করবী বললেন, হে বিদেশি পুরুষ, তোমার প্রশংসার জন্যে ধন্যবাদ; কিন্তু তোমার গোঁয়ার্তুমির জন্যে আমার বকুনি রইল।
কুর্ট এবার ভারতীয় প্রথায় ডাব খেতে গিয়ে গণ্ডগোল বাধিয়ে বসলেন। প্রথমে এক ঝলক জল এসে তার জামা-কাপড় ভিজিয়ে দিল। তারপর ভদ্রলোক বিষম খেয়ে কাশতে লাগলেন।করবী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে কুর্টের হাত থেকে ডাবটা কেড়ে নিলেন। কুর্ট তখন কাশছেন এবং কাশতে কাশতে হাসছেন। করবী বলছেন, আর নয়, অনেক হয়েছে। শেষে হয়তো রটে যাবে, ইন্ডিয়াতে আপনাদের মেরে ফেলবার ফন্দি আঁটা হয়েছিল।
কুর্ট এতক্ষণে সামলে নিয়েছেন। ভিজে জামার দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। একটু লজ্জিত হয়েই বললেন, মিস গুহ, আমি সত্যিই দুঃখিত। ঘরে ঢুকেই প্রথমে ড্রিঙ্কের জন্যে মাথা গরম করা উচিত হয়নি। ডক্টর রাইটার গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার দুর্ব্যবহারের জন্যে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছ। হয়তো মিস ওহ আরও শাস্তির ব্যবস্থা করছেন।
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। এবার কুর্ট এবং রাইটার বিশ্রামের জন্যে নিজেদের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ওঁরা চলে যেতেই অনিন্দ্য যেভাবে করবী গুহের দিকে কৃতজ্ঞ নয়নে তাকিয়ে ছিলেন তা আজও আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমারই সামনে অনিন্দ্য বলেছিলেন, সত্যি, আপনার তুলনা নেই। প্রথমেই আমাদের সম্পর্কটা একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল। আপনি কী আশ্চর্যভাবে অবস্থার মোড় ফিরিয়ে দিলেন।
করবী মুহূর্তের জন্য লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন। শাড়ির খুঁটটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বললেন, আপনি কি এখন কিছু খাবেন? ওঁদের তো তৈরি হতে সময় লাগবে। অনিন্দ্য বলেছি, রাজি আছি, এক শর্তে। ওঁরা নিজেদের ঘরে বিশ্রাম করুন। আমরা চলুন মমতাজে গিয়ে কিছু খেয়ে নিই।
করবী একটু লজ্জা পেলেন। কিন্তু জোর করে না বলতে পারলেন না। অনিন্দ্য আমাকে বললেন, আপনিও চলুন। খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাবে।আমি বলেছিলুম, ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমার কাজ আছে।
অনিন্দ্য হয়তো সরল মনেই আমার কথা বিশ্বাস করতেন। কিন্তু করবী দেবী সব ফাঁস করে দিলেন। বললেন, না, ওঁর খাবার অসুবিধে আছে। হোটেলের কর্মচারী তো। গেস্টদের সঙ্গে একসঙ্গে চেয়ারে বসে খাবে কী?
অনিন্দ্য বললেন, হোটেলের স্টাফ তো কী হয়েছে? উনি তো আমার গেস্ট।
করবী বললেন, তা হয় না। গেস্টদের সঙ্গে অতটা মেশামেশি ম্যানেজমেন্ট পছন্দ করে না।
অনিন্দ্য তাঁর তখনকার ছেলেমানুষি নিয়ে বলেছিলেন, তা কিছুতেই হয় না। আমি এখনই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছি।
যে-অনিন্দ্য সেদিন সামান্য একজন হোটেল কর্মচারীর অপমানে বিচলিত হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, তিনি আজ কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন কে জানে! আজ তার বক্তৃতা পড়লে মনে হয়, মানুষ সম্বন্ধে সব শ্রদ্ধা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তার এখন ধারণা, পৃথিবীর সাধারণ মানুষরা যেন মাধব ইন্ডাস্ট্রিকে ঠকাবার জন্যে সর্বক্ষণ ষড়যন্ত্র করছে। তারা শুধু শিল্পপতিদের কাছে মাইনে নেয়, টিফিন খায়, ওভারটাইম পায়, বোনাস আদায় করে, কিন্তু প্রতিদানে কিছুই দিতে চায় না। গবর্নমেন্টের প্রশ্রয় পেয়ে, এবং ক্যুনিস্টদের উস্কানিতে সমস্ত কান্ট্রি যেন ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।
এই অনিন্দ্যই হোটেলে বসে বসে একদিন করবী এবং আমাকে বই বের করে শুনিয়েছিলেন–
মানুষেরা বারবার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে
নব-নব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে,
তবুও কোথায় সে অনির্বচনীয়
স্বপ্নের সফলতা-নবনীতা–
শুভ্র মানবিকতার ভোর?
করবী বলেছিলেন, দাঁড়ান, আপনার মাকে টেলিফোন করে বলে দেব। কাজে মন না দিয়ে ছেলে ব্যাগে করে কবিতার বই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অনিন্দ্য বলেছিলেন, আপনাকে আমি বাছাই-করা কবিতার বই দিয়ে যাব। তারপর দেখব আপনি কেমন না কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠেন।
কাজের অছিলায় আমি বেরিয়ে এসেছি।ওঁরা দুজনে সোজা মমতাজ-এ চলে গিয়েছেন, ব্রেকফাস্টের জন্যে।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওঁরা দুজন আবার সুইটে ফিরে গিয়েছেন। একটু পরেই অনিন্দ্য বেরিয়ে এসে আমাদের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, ওঁরা দুজনেই এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। একটু পরে যা হোক করা যাবে। এখন আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে হবে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এর পর কত সময়ই তো অনিন্দ্য নষ্ট করেছেন। আমরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে গিয়েছি, উনি চুপচাপ দেখে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে বলেছেন, সত্যি, অদ্ভুত চাকরি আপনাদের। কত রকমের মানুষকে দেখবার সুযোগ পান আপনারা। এখন বুঝছি, ইংরেজি উপন্যাসে হোটেল থাকলে তা কেন সহজে জমে যায়।
সত্যসুন্দরদা বলেছিলেন, মিস্টার পাকড়াশী, একটা নতুন হোটেল করুন না। সম্পূর্ণ ভারতীয় কায়দায় এমন হোটেল, যার কোনো তুলনা থাকবে না। সেখানে ক্যাবারের বদলে দেশি নাচ হবে, ভারতীয় সঙ্গীতের জনপ্রিয় শিল্পীরা অতিথিদের সঙ্গীতে আপ্যায়িত করবেন। বড় বড় শিল্পীদের অনেকেই তো আমাদের হোটেলে এসে ওঠেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা সাহায্য করতে প্রস্তুত।
অনিন্দ্য ম্লান হেসে বলেছিলেন, এখন বাবার নজর ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে। অনিন্দ্য হয়তো আরও কথা বলতেন। কিন্তু করবী হঠাৎ লাউঞ্জে হাজির হলেন। পাকড়াশীকে বললেন, আপনি বেশ লোক তো। আমি নিজের বেডরুমে একবার ঢুকেছি, আর বলা নেই কওয়া নেই আপনি বেরিয়ে এসেছেন! অপ্রতিভ অনিন্দ্য বললেন, আপনারও তো একটু বিশ্রাম দরকার।
আমার? এই সকাল বেলায়?করবী যেন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন, কষ্ট করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের ঘর মনে করে সব সময়েই আপনি ওখানে বসে থাকতে পারেন।
অনিন্দ্য এর উত্তরে যা বলেছিলেন, তা যে করবীকে এমনভাবে আঘাত দেবে বুঝতে পারিনি। অনিন্দ্য বলেছিলেন, এইজন্যেই হোস্টেস হিসেবে আপনার এত সুনাম। করবী গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর টানা টানা চোখ দুটো ধীরে ধীরে ওপরের দিকে তুলে বলেছিলেন,হোস্টেস বলেই বুঝি আপনাকে ভিতরে বসতে বললাম?
অনিন্দ্য বুঝতে পারেননি। কিন্তু আমি ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম, করবী দুঃখিত হয়েছেন। সওদাগরী প্রতিষ্ঠানের সদাহাস্যময়ী অভ্যর্থনাকারিণী মুহূর্তের জন্যে ভুলে গিয়েছেন যে, তিনি ডিউটিতে রয়েছেন। কিন্তু কাজের কথা মনে পড়তে অন-ডিউটি মেয়েদের বেশিক্ষণ সময় লাগে না। করবী বললেন, আপনার অতিথিরা প্রস্তুত। এঁদের নিয়ে এখন নিশ্চয়ই বেরোচ্ছেন। কিন্তু লাঞ্চের সময় ফিরবেন কি?
অনিন্দ্য বলেছিলেন, লাঞ্চের প্রয়োজন নেই। বাবাও ক্লাবে আসবেন, সেখানে নিয়ে যাব।
ওঁরা চলে গেলে বোসদা আমাকে বলেছিলেন, আগেকার দিনে রাজারা আসতেন; এখন বাণিজ্য প্রতিনিধিরা আসেন। খাতির এঁদের রাজাদের থেকেও বেশি। কারণ এঁদের ব্যাগের ভিতর সাত রাজার ধন এক মানিক সেই নো-হাউ আছে।
আমি বোসদার মুখের দিকে তাকাতে, তিনি হাসতে আরম্ভ করলেন। বুঝলে না? হাউ মাউ খাঁউ-এর নো হাউ! আলিবাবার রত্নশালার চাবিকাঠি। গতর আর বুদ্ধি খাটিয়ে এই চাবি তৈরি করে নেবার মতো উদ্যম আমাদের নেই। তাই ধার করে, অন্য লোকের চাবি নিয়ে দরজা খোলবার চেষ্টা করছি আমরা। আমি বোসদার মুখের দিকে আবার তাকালাম। বোসদা বললেন, ভয় নেই। শাজাহান হোটেলের পক্ষে ভালো। সব ঘর বোঝাই হয়ে থাকবে। আমরা আবার রেট বাড়িয়ে দিতে পারব। বেলি-ডান্সারদের পিছনে আরও টাকা ঢালতে পারব।
একটু থেমে বোসদা বলেছিলেন, মনে থাকে যেন, পুলিস রিপোর্টগুলো আজই পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়।
বিকেলের দিকে অনিন্দ্য তাঁর অতিথিদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কোনো বাড়ি থেকে বোধহয় ওঁদের প্রচুর মদ খাইয়ে এনেছিলেন। ফলে ওঁদের দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। ওঁরা টলতে টলতে কোনোরকমে নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
পুলিস রিপোর্টের ফর্মগুলো নিয়ে আলোচনার জন্যে আমিও করবীর সুইটে হাজির হয়েছিলাম।
করবী প্রশ্ন করলেন, কেমন কাজকর্ম হল?অনিন্দ্য বললেন, খুব। এখান থেকে অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আধ ঘণ্টা পরেই মিসেস চাকলাদারের ফ্ল্যাট। আমি জানতাম না,কলকাতায় এমন অনেক গৃহস্থবাড়ি আছে যা ড্রাই-ডে-তে হঠাৎ বার-এ পরিবর্তিত হয়। সেখান থেকে এঁরা এই উঠলেন। আমি জানতাম না। আমার মামা ফোকলা চ্যাটার্জি খবর দিলেন। উনিই মিসেস চাকলাদারকে ফোনে জানিয়ে দিলেন। উনি আবার অজানা পার্টিকে আপ্যায়ন করেন না।
করবী আর কোনো কথা বললেন না। অনিন্দ্য এবার নিজের মনেই বললেন, আপনাকে বলতে সাহস হচ্ছে না। একটু চা খাওয়াবেন?
আমি বললাম, এতে লজ্জার কী আছে? এখনই বেয়ারাকে দিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি। করবী বাধা দিলেন।হোটেলের মধ্যেও যে ঘর থাকে, এবং সেখানে যে ঘরোয়া চা পাওয়া যায় তা আজ প্রমাণ করে দিই।
করবী চা করে অনিন্দ্যকে দিয়েছিলেন। সেই চা শেষ করতে করতে তারা যে অনেক গল্প করেছিলেন, তা আমি পরে শুনেছিলাম। সে-সব আমার শোনবার কথা নয়, কিন্তু একদিন এই নাটকের সবটুকুই আমাকে শুনতে হয়েছিল।
চা-এর শেষেকরবী বলেছিলেন, আপনার অতিথিদের সঙ্গে দেখা করবেন না?
অনিন্দ্য বলেছিলেন, এখন আমি গাড়ি নিয়ে নদীর ধারে চলে যাব। বাবা এবং মা জানবেন, ছেলে সায়েবদের সঙ্গে ঘুরছে। আমি ততক্ষণ দিনের কলকাতা কেমন করে রাতের মোহিনী-মায়া ধারণ করে তাই দেখব। আলোর গয়না পরা এই কলকাতাকে কে যেন সারা দিন সযত্নে বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। করবী বলেছিলেন, এত গয়নার কথা কোথা থেকে শিখলেন?
কেন, বিয়ে করিনি বলে গয়নার কথা জানব না?
এ সব কথা করবী নিজেই আমাকে বলেছিলেন। আমার শোনবার কথা নয়, কিন্তু তিনি নিজেই বোধহয় কাউকে বলবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
করবী হঠাৎ যেন আনন্দে ঝলমল করছিলেন। গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা বলেই তাঁকে জানতাম। কিন্তু এখন তিনি অনেক কথা বলতে চাইছেন। আমাকে বলেছিলেন, বসুন এখনই কোথায় যাবেন?
আমি বলেছিলাম, এখন একবার কাউন্টারে গিয়ে বসতে হবে, উইলিয়ম ঘোষকে কথা দিয়েছি।
উইলিয়মের ডিউটির সময় আপনি বসতে যাবেন কেন?
বিশেষ করে রিকোয়েস্ট করেছে। তাই দু-ঘণ্টা ওর হয়ে ডিউটি দেব কথা দিয়েছি। আমি বললাম।
এর বেশি আমার কিছু বলবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু করবীর জেরাতে তাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। উইলিয়ম আজ রোজিকে নিয়ে ডিনারে যাচ্ছে। অনেক দিনের সাধ্যসাধনায় এই পরমাশ্চর্য সুযোগ পেয়েছে। শাজাহান হোটেলের দুই কর্মী চৌরঙ্গীর কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে রাতের ডিনার সেরে আসবে।শাজাহানে ওরা দুজনেই ফ্রি খেতে পারত। তবু বেচারা উইলিয়ম পকেট থেকে পয়সা খরচ করতে রাজি হয়েছে।
করবী সামান্য হেসে বলেছিলেন, তাহলে এখনই যান। যদি পারেন ছাদে ওঠবার আগে একবার দেখা করে যাবেন।
উইলিয়ম ঘোষ আমার জন্যেই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিল। আমাকে দেখে বেচারা আশ্বস্ত হল। বেরোবার সময় সে লজ্জিত কণ্ঠে বললে, তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু যার জন্যে ডিউটি করছি তিনি কোথায়?উইলিয়ম কানে কানে বললে, তিনি কিছুতেই আমার সঙ্গে বেরোবেন না। আমার জন্যে গ্র্যান্ডের তলায় অপেক্ষা করবেন। এখান থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি ধরব, তারপর পার্ক স্ট্রিটে যাবার পথে তাঁকে তুলে নেব।
আমি বললাম, অতি উত্তম পরিকল্পনা।
হাতমুখ ধুয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার পথে উইলিয়ম আর একবার কাউন্টারে এসে দাঁড়াল। আমাকে চুপি চুপি বললে, একটা রিকোয়েস্ট-কেউ যেন ঘুণাক্ষরে না জানতে পারে। একবার যদি ব্যাপারটা জিমির কানে ওঠে, তা হলে কী হবে তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ।আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, সব জানি। এখন আমি তোমার জন্যে একটি আনন্দময় সন্ধ্যা কামনা করছি।
প্রতি কাজেরই একটা নেশা থাকে, হোটেলের কাজে তো বটেই। তাতে মেতে গেলে আর কিছুই মনে থাকে না। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শাজাহানের অতিথিস্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ওদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। খেয়াল হল যখন দেখলাম, রোজি আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে সোজা লিফটের ভিতরে ঢুকে গেল। রোজিকে রাত্রের ফ্লোরেসেন্ট আলোয় আজ যেন অন্যরকম দেখাচ্ছিল।
প্রায় আরও পনেরো মিনিট পরে উইলিয়ম ফিরে এল। বললে,হেকাণ্ডারী, অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আমাকে হাল ধরতে দাও।
তোমার এত দেরি? আমি প্রশ্ন করলাম।
রোজি কিছুতেই একসঙ্গে আসতে দিল না। বললে, আমি ঢোকবার পাক্কা সিকি ঘণ্টা পরে তুমি আবার শাজাহান হোটেলে নাক গলাবে। তাই সেন্ট্রাল অ্যাভির ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিনামূল্যে সান্ধ্য বায়ু সেবন করছিলাম।
উইলিয়মকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমি আবার করবীর সুইটের সামনে হাজির হলাম। এমন সময়ে ওঁর সুইটে যাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কথা দিয়েছি, হয়তো আমার জন্যেই জেগে বসে রয়েছেন।
টোকা মারতেই করবী মৃদু কণ্ঠে বললেন, আসুন। ঘরের মধ্যে আলো ও অন্ধকারের মরণ-বাঁচন যুদ্ধ যেন এইমাত্র শেষ হয়ে গিয়েছে। সম্মুখসমরে পরাজিত আলো যেন মুমুর্ষ অবস্থায় টেবিলের এক কোণে ধুকছে। ঘরের আর সবটুকু জুড়ে আঁধারের রাজত্ব। আলোর সেই মৃত্যুপথযাত্রী দেহের সামনে চোখে হাত দিয়ে টেবিলের উপর ঝুকে বসে রয়েছেন করবী গুহ।
আমার সঙ্গে কথা বলবার জন্যেই করবী দেবী বোধহয় আস্তে আস্তে মুখ ঘোরালেন। ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। এইকঘণ্টায় করবী একেবারে পাল্টে গিয়েছেন। যাকে দুনম্বর সুইটে রেখে আমি উইলিয়ম ঘোষের ডিউটি দিতে গিয়েছিলাম তিনি যেন আর নেই। এ যেন অন্য কেউ।
দুনম্বর সুইটের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশও আমার নাকের ডগায় কয়েক ফেঁটা ঘাম জমে উঠল। করবী কেন এমনভাবে বসে আছেন?
করবী আমাকে বসতে বললেন না। শুধু আমার দিকে একবার তাকালেন। তার চোখটা এবার ঘরের কোণে রাখা টেলিফোনের দিকে ঘুরে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন? বোধহয় তার কিছু বলবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় চিন্তায় মত পরিবর্তন করলেন। বললেন, না। একবার ভাবছিলাম ওঁকে ফোন করতে বলব। কিন্তু ভাবছি, ফোন না করাই ভাল।
আমি ফিসফিস করে প্রশ্ন করলাম, আপনার অতিথিরা কোথায়?
করবী বললেন, ওঁরা আবার মিসেস চাকলাদারের বাড়িতে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মিসেস চাকলাদার ওঁদের নিতে পারলেন না–কয়েকজন হোমরা-চোমরা সরকারি অফিসার এ-বেলায় আগে থেকে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এঁদের দুজনকে মিসেস চাকলাদার তবুও জায়গা করে দিতে পারতেন; কিন্তু কন্ট্রাক্টর মিস্টার কানোরিয়া রাজি হলেন না। উনি তার অতিথিদের কথা দিয়েছেন, মিসেস চাকলাদারের বাড়িতে তারা ছাড়া বাইরের কেউ উপস্থিত থাকবেন না। যা দিন-কাল পড়েছে। কাগজের রিপোর্টাররা যে-ভাবে লোকের পিছনে লাগছে, হয়তো সার্কুলেশন বাড়াবার জন্যে একতক্তা লিখেই দিলে। অফিসাররা তাই আজকাল অনেক সাবধান হয়ে গিয়েছেন। একটু থেমে করবী গুহ বললেন, তোমাকে একটা কথা হয়তো বলতে হবে। কিন্তু এখন নয়। আজকের মতো আমি নিজেই ম্যানেজ করে নিয়েছি।
করবীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। বললাম, আমার তেমন ভালো লাগছে না। যদি আপনার কোনো উপকারে লাগি তা হলে বলতে দ্বিধা করবেন না। কিন্তু করবী কিছু বললেন না!
ছাদের উপরে আমার আপন বিশ্বে ফিরে এসেছি। ইলেকট্রিক আলোটাও আজ গুড়বেড়িয়া নিভিয়ে দিয়েছে। আকাশে আজ সংখ্যাহীন তারার উজ্জ্বল সমারোহ ড্রাই-ডে-র রাত্রে কোনো অরসিক নভঃলোকবাসী যেন আকাশ-হোটেলে ব্যাংকোয়েটের ব্যবস্থা করেছেন।
ড্রাই-ডে-র রাতে হোটেল কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রভাতচন্দ্র গোমেজের চোখে কিন্তু ঘুম নেই। একটা টুল নিয়ে নিজের ঘরের সামনে তিনিবসে আছেন। আমার মনটা ভালোনয়।করবী আমাকে বেশ চিন্তিত করে তুলেছেন; এমন রহস্যময় উদ্বেগের মধ্যে রেখে তিনি বিদায় দিলেন কেন?
অবাক লাগছে আমার। দুনম্বর সুইটের রঙ্গমঞ্চে যেন কোনো নাটক অভিনীত হচ্ছে, আরও অনেকের মতো আমিও তার একজন নীরব দর্শক। শাজাহানের ঘরে ঘরে, রাত্রির অন্ধকারে, লোকচক্ষুর অন্তরালে আরও কত নাটক এমনই ভাবে অভিনীত হচ্ছে কে জানে? কে তাদের খবর রাখে?
যাঁদের আমি চিনি না, জানি না, তাঁদের জীবননাট্য বিয়োগান্ত না মিলনান্ত, তা নিয়ে আমার চিন্তা নেই। কিন্তু দুনম্বর সুইট? সেখানে এই মুহূর্তে করবীকে কোনো বিয়োগান্ত নাটকের নায়িকা ভাবতে আমার মন অজানা ভয়ে শিউরে উঠল।
প্রভাতচন্দ্র গোমেজ ইশারায় আমাকে ডাকলেন। ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, এখনও জেগে রয়েছেন!
প্রভাতচন্দ্র হাসলেন।ঘুম আসে না। রাত্রিটাকে দিনের মতো ব্যবহার করে করে অভ্যাসটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। ড্রাই-ডের রাত্রিটা তাই তারাদের সঙ্গে ভাব করে কাটিয়ে দিই। বেশ লাগে।
আমি আর একটা টুল নিয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। প্রভাতচন্দ্র বললেন, আপনাদের বয়স কম, এখন ঘুমের প্রয়োজন। বয়স বাড়লে আপনাকেও ঘুমের জন্যে সাধ্যসাধনা করতে হবে। আমি নীরবে হাসলাম। বললাম, মিস্টার গোমেজ, আপনি তো এত চিন্তা করেন। রাত্রের নক্ষত্র, ভোরের সোনালি সূর্য তো একান্তে আপনার মনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। বলতে পারেন, আমাদের জীবনে কেন সাসপেন্সের সৃষ্টি হয়েছিল? কেন আমরা অনাগত আশঙ্কায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি?
গোমেজ বললেন, শুনেছি, হিন্দুদের শাস্ত্রে এর উত্তর আছে। কিন্তু আমি অশিক্ষিত খ্রিস্টান বাজনদার, তার খবর রাখি না। আমি আপনাকে গানে উত্তর দিতে পারি। সামান্য ছায়াছবির গান, কিন্তু সেখান থেকেই আমি আমার জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছিলাম–কে সারা সারা।
মানে? আমি প্রশ্ন করলাম।
মানে, গোমেজ এবার মৃদুকণ্ঠে ইংরেজি গান ধরলেন, কে সারা সারা। The future is not ours to see-যা হবার তা হবে। গান শেষ করে গোমেজ বললেন, একজন আমেরিকান ভদ্রলোক এই হোটেলে এসেছিলেন। তিনি আমাকে এই গানের রেকর্ডটা দিয়ে যান। একদিন আপনাকে শুনিয়ে দেব। আমি শিখেছি, ভবিষ্যতের খোঁজ নেওয়া আমাদের কাজ নয়—কে সারা সারা।
গোমজের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সত্যিই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। রাত্রের তারারা যেন গোমজের কণ্ঠের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছে-কে সারা সারা।
অনিন্দ্য পরের দিন আবার এসেছিলেন। সেদিন ভোরেই তিনি করবীকে একলা পেয়ে বলেছিলেন,যদি আপনি কিছু না মনে করেন, তবে একটি বিশেষ ব্যাপারে আপনার অনুমতি প্রার্থনা করি। করবী বলেছিলেন, আপনাদের বন্ধু মিস্টার আগরওয়ালার আমি হোস্টেস। সুতরাং বলতে গেলে আপনারই স্টাফ আমি। সুতরাং অনুরোধ নয়, হুকুম করুন।
অনিন্দ্য এমন উত্তরের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু একটু পরেই হেসে বললেন, ও বুঝেছি, আপনি কালকের প্রতিশোধ নিলেন। কিন্তু আমি রাগ করছি না। কালকে এখান থেকে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে বেশিক্ষণ বসিনি। সোজা দোকানে চলে গিয়েছিলাম। একলা হোটেলে বন্দি হয়ে থাকেন, তাই ভাবলাম, আমার প্রিয় কবিদের বইগুলো হয়তো আপনাকে আনন্দ দেবে।
এসব কথা করবীই পরে আমাকে বলেছিলেন। ওঁরা দুজনে যখন কথা বলছিলেন, তখন সেখানে অন্য কেউ ছিল না। করবীরও সাহস বেড়ে গিয়েছিল। বইগুলো হাতে নেবার আগে অনিন্দ্যর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিলেন, আপনার প্রিয় কবি যে আমারও প্রিয় কবি হবে, সেটা কেমন করে ধরে নিলেন অনিন্দ্যবাবু?
অনিন্দ্য হেসে বললেন, এর উত্তর জীবনানন্দ বা সমর সেন কেউ দেননি। কিন্তু আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়া খুবই সহজ। স্পেকুলেশন।ব্যবসাদার লোক আমরা, ফাটকায় সিদ্ধহস্ত।করবী বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের সেবা করলে আপনি সত্যিই অনেক কাজ করতে পারতেন।
দাঁড়ান, এখন এই জার্মান সায়েবদের সেবা করে মাধব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মঙ্গল করি।অনিন্দ্য হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছিলেন, তবে জেনে রাখবেন, চিরকাল আমি এমন থাকব না। এই সব হুজুগ থেকে মুক্তি পেয়ে আমিও একদিন নিজের খুশিমতো কবিতা আর ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকব।
সেদিন সকালেই খবর কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় কলকাতায় জার্মান শিল্প প্রতিনিধি এই শিরোনামের বিশিষ্ট অতিথিদের যে সংবাদ ছাপা হয়েছিল, তাতে মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের নামও প্রকাশিত হয়েছিল। মাধব পাকড়াশী শারীরিক অসুস্থতার জন্যে যে দমদম বিমানঘাঁটিতে উপস্থিত থাকতে পারেননি এবং অসুস্থ স্বামীর সেবার জন্য শ্রীমতী পাকড়াশীও যে দমদম পর্যন্ত যেতে পারেননি, তাও খবরের কাগজ পড়ে জানা গেল।
কাগজ পড়তে পড়তে করবী যখন অনিন্দ্যর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন আমিও সেখানে বসে রয়েছি। করবী দেবীই আমাকে জোর করে সেখানে রেখে দিয়েছিলেন। অনিন্দ্য বললেন, আমি জানি না, ওসব মায়ের নিজের পরিকল্পনা—আমাদের পি-আর-ও সেনকে ডেকে নিজেই প্রেসনোট তৈরি করে দিয়েছেন। বাবা বলেছিলেন, তিনি দমদমে যাবেন। কিন্তু মা বললেন, আমাকে সুযোগ দিতেই হবে। সুতরাং ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন—বাবার অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না।
করবীর ইচ্ছা ছিল আমি দুনম্বর সুইটের ড্রইং রুমে তার সঙ্গে বসে থাকি। কিন্তু আমার অন্য কাজ আছে। দুনম্বর সুইটে আমার স্পেশাল ডিউটি থাকলেও প্রতিদিনের কাজ থেকে একেবারে ছুটি পাইনি।
কাউন্টারে ফিরে এসে কাজ আরম্ভ করেছি। এমন সময় রিপোর্টার মিস্টার বোসের আবির্ভাব ঘটল। মিস্টার বোস বললেন, কেমন আছেন? আপনার গুরুদেব মিস্টার স্যাটা বোসই বা কোথায়? ওই জার্মান পার্টি সম্বন্ধে কিছু নতুন খবর চাই-ই।
আমি বললাম, মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের জনসংযোগ অফিসার নিশ্চয়ই তাদের বিজ্ঞপ্তি যথাসময়ে আপনাদের অফিসে পাঠিয়ে দেবেন।
সেই বিজ্ঞপ্তির উপর নির্ভর করে কাগজ চালাতে পারলে মালিকরা আর আমাদের মতো রিপোর্টারদের মাইনে দিয়ে রাখতেন না। বনস্পতি নয়, আসল ঘি চাই আমি। এখন সেই নির্ভেজাল খবরের উৎসব কোথায় বলে দিন।
আমি চুপকরে রইলাম। মিস্টার বোস কিন্তু নীরবহলেন না। তিনি যে অনেক খবর রাখেন তা পরের কথা থেকে বুঝলাম। মিস্টার বোস প্রশ্ন করলেন, আপনাদের ডিলাক্স সুইটের মিস গুহ যদি ইচ্ছে করেন আমাকে খবর দিয়ে বড়লোক করে দিতে পারেন।
বললাম, ওঁর ঘরে এখন বাইরের লোক আছে। যদি একটু পরে আসেন। কোনো আপত্তি নেই। আমি ততক্ষণ এসপ্ল্যানেডে রেলের পাবলিসিটি অফিসে একটু ঢুঁ মেরে আসি।
মিস্টার বোস যেতেই করবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম।বিখ্যাত হবার এই সুযোগ। সংবাদপত্র প্রতিনিধি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। করবী বললেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি না, আপনি সুইটে চলে আসুন।
ওখানে অনিন্দ্য তখনও বসে রয়েছেন। আমার কথা শুনে করবী বললেন, হোস্টেসদের সব সময় নেপথ্যে থাকতে হয়। প্রেসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন অনিন্দ্যবাবু।
কাগজের নাম শুনেই অনিন্দ্য একটু ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, পি-আর-ওকে সামনে না রেখে বাবা কিংবা মা কেউ কাগজের লোকদের সঙ্গে কথা বলেন না। আমার ভয় লাগছে।
করবী দেবী বললেন, ভয়ের কিছুই নেই। আমি তো থাকব।
মিস্টার বোসকে করবী কিন্তু দুনম্বর সুইটে আসবার অনুমতি দেননি। যে কয়েকজন তোক সোজা দুনম্বর সুইটে এসে ঢুকতে পারেন, তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। লাউঞ্জের এক কোণে মিস্টার বোসের সঙ্গে ওঁরা দুজন সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমাকে ডেকে করবী বলেছিলেন, প্লিজ, আমাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করুন না।
চায়ের অর্ডার দিয়ে আমি কাউন্টারে ফিরে আসতে আসতে শুনেছিলাম, করবী বলছেন, মিস্টার পাকড়াশী নতুন ইন্ডাস্ট্রিতে আসছেন। বাংলা দেশকে তিনি ভালোবাসেন। এই ভারত-জার্মান শিল্পসহযোগিতার উপর আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে।
অনিন্দ্য বললেন, আপনারা যদি এই অতিথিদের সম্বন্ধে ভালো করে লেখেন, আমাদের সুবিধা হয়। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের এই কারখানা চালু হলে আমরা অনেক বেকার যুবককে চাকরি দিতে পারব—সেই সব বেকার যুবক, যাদের দুঃখের কথা আপনারা কাগজে লিখে থাকেন।
যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিস্টার বোস সেদিন বিদায় নিয়েছিলেন। পরের দিন তিনি সত্যিই তার কথামতো কাজ করেছিলেন। কলকাতার অন্যতম প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের মুখপাত্র শ্রীঅনিন্দ্য পাকড়াশীর সঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারের সুদীর্ঘ বিবরণ ডবল কলম শিরোনামায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সেই কাগজ হাতে অনিন্দ্য প্রায় লাফাতে লাফাতে শাজাহান হোটেলে এসে হাজির হয়েছিলেন। করবীকে উচ্ছ্বসিতভাবে বলেছিলেন, বাবা এবং মা দুজনেই অবাক হয়ে গিয়েছেন। ওঁরা ভাবছেন, খোকা কী করে এমন পাবলিসিটি করলে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছি এখানে। কেন জানেন? যে মহিলার দূরদর্শিতায় এই প্রচার সম্ভব হয়েছে, তাকে।
আপনার ধন্যবাদ জানাতে, তাই তো? করবী অনিন্দ্যর মুখ থেকে কথাটি ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই শেষ করে দিলেন।
অনিন্দ্য হেসে বললেন, আমাকে এতই অন্তঃসারশূন্য ভাবছেন কেন? অন্তরের কৃতজ্ঞতা এবং অভিনন্দন জানাবার ইচ্ছে আমাদের হয় না?
করবী চুপ করে গেলেন। অনিন্দ্য জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অতিথিরা নিশ্চয় আপনাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে!
মোটেই নয়। আমাকে যে সব দেশি ভি-আই-পিদের সেবা করতে হয়, সে তুলনায় এঁরা ডেমি-গড। বার-এ গিয়ে ড্রিঙ্ক করেন, ক্যাবারে নাচ দেখেন, তারপর নিজেরাই ঘরে এসে শুয়ে পড়েন। নিজের খেয়ালে নিজেরা থাকেন, আমাকে বড় একটা জ্বালাতন করেন না।
অনিন্দ্য বললেন, এখন তাদের দেখছি না কেন?
হল্-এ ব্রেকফাস্ট করছেন। করবী বললেন।
অনিন্দ্য খুশি মেজাজে বললেন, যাক, আমি আর চিন্তা করি না। এ কদিন সব সময় এঁদের কথাই ভাবতে হচ্ছিল। আজ থেকে নরম্যাল হয়ে যাবার চেষ্টা করব। তারপর যেদিন ওঁরা আমাদের সঙ্গে এগ্রিমেন্টে সই করবেন, সেদিন থেকে আমি তো মুক্তবিহঙ্গ।
সারা দিনের কাজ শেষ করে সবেমাত্র নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বিছানায় শুয়েছিলাম। এমন সময় দরজায় টোকা মেরে করবী যে আমার ঘরে ঢুকবেন, তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
করবী আমার ঘরের চেয়ারে এসে বসলেন। দেখলাম দুশ্চিন্তায় তার মুখ কালো হয়ে উঠেছে। কী ব্যাপার? আমি প্রশ্ন করলাম। আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতেন।
করবী তখনও হাঁপাচ্ছেন। না, নিজেই চলে এলাম। আমার ঘরে বসে আপনার সঙ্গে কথা বলা চলত না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার কী করা উচিত বলুন তো?
করবীর দেহ কাঁপছে মনে হল। কোনোরকমে বললেন, সেদিন বুঝতে পারিনি। সন্দেহ হয়েছিল অবশ্য। কিন্তু তখন ভেবেছিলাম, মিস্টার পাকড়াশীর জন্যে মিস্টার আগরওয়ালা আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
করবীর কাছেই শুনলাম, দুনম্বর সুইটের মালিক মিস্টার আগরওয়ালা তাকে ফোনে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, খুবই গোপন—টপ সিক্রেট। রাইটার এবং কুর্টের উপর একটু নজর রাখতে হবে। ওঁদের মনের অবস্থা কেমন বুঝছ?
করবী বলেছিলেন, বিজনেস ব্যাপারে ওঁদের সঙ্গে কথা বলিনি।
বলতে হবে; না-হলে সুন্দরী হোস্টেস রেখে আমার কী লাভ হল? আগরওয়ালা উত্তর দিয়েছিলেন।
করবী তখনও ভেবেছিলেন, মাধব পাকড়াশীর জন্যেই মিস্টার আগরওয়ালা খোঁজখবর নিচ্ছেন। ফোন নামিয়ে রাখবার আগে আগরওয়ালা বলেছিলেন, এঁদের সেবা-যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়, এঁদের খুশি থাকার উপর ভবিষ্যতে অনেক কিছু নির্ভর করবে।
করবীর কথার তখনও কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। করবীবললেন,এই মাত্র ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আগরওয়ালা এঁদের সঙ্গে আলাদা দেখা করবার মতলবভাজছেন। মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের ভিতরের খবরাখবর জেনে নিয়ে উনি এখন নিজেই আসরে নামতে চান। পাকড়াশীর পরিবর্তে আগরওয়ালার সঙ্গে কারখানা তৈরি করলে জার্মানদের ক্ষতি কী? সবার অলক্ষ্যে আগরওয়ালার আসবার ইচ্ছে। যখন পাকড়াশীদের কেউ থাকবে না, তখন গোপনে এঁদের সঙ্গে দেখা করে নিজের কাজ হাসিল করতে পারলে ভালো হয়। আমাকে কয়েকবার ফোন করে আগরওয়ালা জানতে চেয়েছিলেন অনিন্দ্য কতক্ষণ হোটেলে থাকে। গত কালও ফোন করেছিলেন আজকের প্রোগ্রাম জানবার জন্যে। আমি মিথ্যে করে বলেছিলাম, যতদূর জানি রাত্রে অনেকক্ষণ থাকবেন। কিন্তু বোধহয় ধরা পড়ে গিয়েছি। মিস্টার আগরওয়ালাকে গোপন খবরাখবর দেবার জন্যে কে একজন মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জি আছেন। তিনি বলেছেন, অনিন্দ্য যাতে সন্ধেয় হোটেলে না যায় তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। মিস্টার আগরওয়ালা বলেছেন, সেজন্য যা খরচ হয় তা তিনি দেবেন। বাগানবাড়ি, মদ এবং অন্য কিছুর জন্যে মিস্টার চ্যাটার্জি যেন কার্পণ্য না করেন।
কী নাম বললেন, ফোকলা চ্যাটার্জি?আমি প্রশ্ন করলাম। হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম।করবী দেবী বললেন।এখন কী করি বলুন তো? এমন অবস্থায় আমি কখনও পড়িনি। এতদিন ভাবতাম যাঁর চাকরি করি, আমি তার। অনিন্দ্যবাবুর দেওয়া কবিতার বইগুলো পড়ে মনে হচ্ছে আমারও নিজের সত্তা আছে। আমার সব কাজের জন্যে অন্তরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে গিয়ে করবী হাঁপাতে লাগলেন। বললেন, আমার সাহস হচ্ছে না । আপনি একবার ওঁকে ফোন করবেন?
বললাম, আমি ফোন ধরে দিতে পারি, কিন্তু আপনাকেই কথা বলতে হবে।
ফোনে আর একটু দেরি হলে অনিন্দ্যকে আর পাওয়া যেত না। অনিন্দ্য বললেন, ব্যাপার কী? বললাম, এখানে মিস গুহর সঙ্গে কথা বলুন।
করবীকে অনিন্দ্য বললেন, আজ আর হোটেলে আসছি। তার বদলে মামার সঙ্গে বেরবো। মামা বলেছেন, কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। উনি স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনাবেন। তারপর গঙ্গার ধারে যাব। মামার হঠাৎ কবিতা শোনবার ইচ্ছে হয়েছে। আমি পড়ে যাব, মামা শুনবেন। মামা যা কাঠ-খোট্টা মানুষ—এমন সুযোগ আর কখনও না আসতে পারে।
করবীর ঠোঁট কাঁপছে। বললেন, ও-সব অন্য একদিন হবে। আজ আপনি এক্ষুনি, এই মুহূর্তে চলে আসুন।
কী বলছেন আপনি?
আপনাকে আমার এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে। করবী এবার টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। উত্তেজনায় তার সমস্ত দেহ ম্যালেরিয়া রোগীর মতো ঠকঠক করে কাঁপছে।
করবী আর কালবিলম্ব না করে নীচে নেমে গেলেন। আমিও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলাম না। কাউন্টারে গিয়ে উইলিয়মের সঙ্গে গল্প করতে আরম্ভ করলাম। উইলিয়ম এখন আমার উপর সদয়-আমাকে সে খুশি করতে চায়। যদি আবার কোনোদিন ডিনারে শ্রীমতী রোজির সঙ্গ পাবার সম্ভাবনা থাকে, তখন কে তার বদলে ডিউটি দেবে?
আমাদের সামনেই যে ব্যাপারটা ঘটে যাবেতা বুঝতে পারিনি। কারণ অনিন্দ্য এবং মিস্টার আগরওয়ালা প্রায় একই সঙ্গে হোটেলের মধ্যে এসে ঢুকলেন। বেশ খুশি মনে আগরওয়ালা হোটেলে আসছিলেন, কিন্তু অনিন্দ্যকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন। নাভির তলায় ঝুলেপড়া প্যান্টটাকে কোমরের উপর তুলতে তুলতে আগরওয়ালা প্রশ্ন করলেন, আপনি?
অনিন্দ্যও একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, অতিথিদের খোঁজখবর করতে। আগরওয়ালা ঢোক গিলে বললেন, কিছু প্রয়োজন ছিল না। আপনাদের আশীর্বাদে আগরওয়ালার গেস্টরুমে কোনো অতিথিরই কষ্ট হয় না। মিস গুহকে এ রুপিয়া তলব আমি কি বাজে বাজে দিচ্ছি?
অনিন্দ্য বললেন, আপনাকে কী করে যে ধন্যবাদ দেব। কলকাতার কোনো হোটেলে ভাল সুইট খালি ছিল না। অর্ডিনারি রুমে তো এঁদের রাখা যেত না। বাবা নিজেই আপনাকে ফোন করে কথা বলবেন।
আগরওয়ালা যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন। বললেন, আরে, কী যে বোলেন। বিজনেসে হামরা যদি এক কোনসার্ন আর এক কোনসানকে না দেখি, তাহলে চলবে কী করে? আপনার ফাদার হচ্ছেন আমাদের ওল্ড ফ্রেন্ড।
অনিন্দ্য এবার আগরওয়ালার আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অবলীলাক্রমে আগরওয়ালা বললেন, আমি এক বন্ধুর খোঁজে এসেছি। তার বার-এ বসে থাকবার কথা। তাকে নিয়ে এখনি বেরিয়ে যাব। আপনার অতিথিদের কোনো ডিফিকাল্টি হলে আমাকে জরুর জানাবেন।
অনিন্দ্য আর সময় নষ্ট না করে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। আগরওয়ালা সোজা লাউঞ্জের টেলিফোন বুথে ঢুকে কারুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। তারপর কাউন্টারে এসে বললেন, আমি মিস্টার আগরওয়ালা আছি। তারপর নিবেদন করলেন, মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জি যদি তার সন্ধানে এখানে আসেন, তাহলে বলে দেবেন, মিস্টার আগরওয়ালা মিসেস চাকলাদারের ওখানে চলে গিয়েছেন।
মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জি কিছুক্ষণ পরেই শাজাহান হোটেলে এসে হাজির হয়েছিলেন। কাউন্টারে এসেই বললেন, স্যাটা! আর পারা যায় না। এই বৃদ্ধ বয়সে একটা দশটা-পাঁচটার চাকরি পেলে বেঁচে যেতাম।
বোসদা বললেন, ব্যাপার কী মিস্টার চ্যাটার্জি?
ফোকলা বললেন, সে সব পরে বলছি। এখন তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। একটু মাল আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন?
বোসদা বললেন, কেন লজ্জা দিচ্ছেন? জানেনই তো অধমদের হাত-পা বাঁধা, লাউজে ড্রিঙ্ক সার্ভ করবার হুকুম নেই।
এ-শ্লা গভরমেন্ট কবে যে ডকে উঠবে! এই শ্লাদের জন্যেই কি আমরা স্বদেশি করেছিলাম। ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, বাঘা যতীন, মাস্টারদা কি এদের জন্যেই প্রাণ দিয়েছিলেন? ফোকলা যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলেন। বোসদা ঈষৎ হেসে নিজের কাজ করতে লাগলেন। ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন, শ্লা মাল বিক্রি হচ্ছে তাতে দোষ নেই, কিন্তু খোলা জায়গায় খাওয়া চলবে না, শিবুঠাকুরের দেশে এ কী আইন রে বাপু। আপনাদের জন্যে সত্যি আমার দুঃখ হয়। ভদ্রলোকের ছেলে, এ-লাইনে এসেছেন, অথচ ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই শুনে রাখুন, ব্যাটাচ্ছেলেরা কোনদিন বলল বলে যে, ল্যাভেটরি ছাড়া অন্য কোথাও ড্রিঙ্ক করা চলবে না।
বোসদা বললেন, আপনাদের সঙ্গে অনেকের তো জানাশোনা আছে, তাদের প্রতিবাদ করতে বলুন না।
ফোকলা বললেন, তাহলেই হয়েছে। সব ব্যাটা মালের সাপোর্টে লুকিয়ে গজগজ করে, কিন্তু পাবলিকলি একটা কথা বলবে না। রাস্তায় সব ব্যাটা ঘোমটা দিয়ে ভাটপাড়ার বিধবা সাজবে। এ-ব্যাটারা এমন, যদি গভরমেন্ট কাল হুকুম দেয় তো এরা ল্যাভেটরিতে বসে বসেও ড্রিঙ্ক করে চলে যাবে, তবু একটি রা কাটবে না। একটি লোক পারত, সে আমার দিদি, মাধব পাকড়াশীর ওয়াইফ। কিন্তু দিদি আমার একদম সেকেলে। ড্রিঙ্ক জিনিসটা মোটেই দেখতে পারে না।
বোসদা বললেন, তাই বুঝি?
ফোকলা বললেন, দিনরাত শুধু মহিলা সমিতি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, নৈতিক স্বাস্থ্যরক্ষা সমিতি, আর না হয় পুজো নিয়ে পড়ে রয়েছেন। দিদি যদি একবার বলত, লুকিয়ে মদ খাওয়ার থেকে খোলাখুলি মদ খাওয়া ভাল, তা হলে হয়তো গভরমেন্ট একটু কান দিত।
স্যাটা বোস বললেন, আপনার কষ্ট হচ্ছে, বার-এ চলে যান। ফোকলা বললেন, উপায় নেই, মশায়। এক ভদ্রলোকের জন্যে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আমি বললাম, আপনি কি মিস্টার আগরওয়ালার কথা বলছেন? তিনি আপনার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গিয়েছেন। ফোকলা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওঁর জন্যেই অপেক্ষা করছি। ফোন করেছিলেন আমাকে, অথচ আমি ছিলাম না। বলেছেন, এখনই যেন শাজাহান হোটেলে চলে আসি। সত্যসুন্দরদা বললেন, মিস্টার আগরওয়ালা মিসেস চাকলাদার-এর ওখানে গিয়েছেন।
মিসেস চাকলাদার। ফোকলা হা হা করে হাসতে লাগলেন।কাঙালকে শাকের ক্ষেত দেখাতে নেই, মশায়। এই শর্মা, দিস ফোকলা চ্যাটার্জিই আপনাদের আগরওয়ালাকে মিসেস চাকলাদারের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। মশাই, গেরস্ত বাড়ি শান্তিতে একটু ড্রিঙ্ক করবার সুযোগ ছিল। আমাদের মতো মাতালদের শান্তিনিকেতন। রেট একটু বেশি। ড্রাই ডে-তে মিনিমাম অ্যাডমিশন চার্জ কুড়ি টাকা। তা এরা লেবুকচলিয়ে কচলিয়ে তেতো করে দেবে। আগরওয়ালারা অন্য দিনেও গেস্ট নিয়ে যেতে শুরু করেছে। দুনিয়ার যত কন্ট্রাক্ট, যত লাইসেন্স, সব একজন চাইলে চলবে কী করে? রোজ রোজ যাচ্ছে, কোনদিন কাগজের লোকদের নজরে পড়ে যাবে। মধুচক্র ফাঁস হয়ে যাবে। ফোকলা চ্যাটার্জি ঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, চিরকাল শুধু পরের বোঝা বয়ে বেড়ালাম। আমার থু দিয়ে এন্টারটেন করিয়ে কলকাতার কত ব্যাটাছেলে বিজনেসে লাল হয়ে গেল। আমার মশাই লাভের মধ্যে হয়েছে খারাপ লিভার। ফ্রি মাল গিলেছি, আর মাঝে মাঝে দুচারশ টাকা পেয়েছি। ক্যাপিটাল নেই যে। থাকলে দেখিয়ে দিতাম। অ্যাদ্দিনে কত বেকার শিক্ষিত ছেলে ফোকলা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজে চাকরি পেয়ে যেত।
আমি বললাম, মিস্টার আগরওয়ালা আপনার জন্যে ওখানে অপেক্ষা করবেন।
পেটের ছেলে কিছু পড়ে যাচ্ছে না—একটু দাঁড়াক না। ফোকলা চ্যাটার্জি রেগে গিয়ে বললেন। কপালে হাত দিয়ে কী ভাবলেন। তারপর নিবেদন করলেন, কিছু মনে করবেন না, বেঙ্গলি মেয়েগুলো যে গুন্ ফর নাথিং। মেয়েদের সাহায্য না পেলে কোনো জাত বড় হয় না। আমরা কেন, স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, নারীজাতিই আমাদের শক্তির উৎস। কিন্তু বাঙালি মেয়েরা একটুও কষ্ট করবে না। মিস্টার রঙ্গনাথনকে তো মনে আছে। ভদ্দরলোকের হাতে লাখ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট। বেঙ্গল সম্বন্ধে ওঁর বেশ শ্রদ্ধা ছিল। খুব ইচ্ছে ছিল, কোনো বাঙালি মেয়ের সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করেন। সব খরচা দিতে রাজি। তা আপনাকে দুঃখের কথা বলব কী, কাউকে রাজি করাতে পারলাম না। হলও তেমনি, মিসেস কাপুর ওঁর সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করলেন। যে অর্ডারটা আমরা পেতে পারতাম সেটা মিস্টার কাপুর পেয়ে গেলেন। অথচ কাগজ খুলে দেখুন, শুধু দুঃখ আর দুঃখ।
ফোকলা চ্যাটার্জি নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই, ঘুরে আসি। যেতে গিয়ে হঠাৎ ফোকলা চ্যাটার্জি ঘুরে দাঁড়ালেন। অনিন্দ্যকে দেখেছেন?
বোসদা আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললাম, আজ্ঞে, উনি জার্মান অতিথিদের দেখতে এসেছেন।
হুঁ, ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন। একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, কিছুক্ষণ আগে এখান থেকে কেউ কি অনিন্দ্যকে ফোন করেছিল?
ফোকলা চ্যাটার্জির চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আমার কেমন ভয় হতে লাগল। বললাম, হ্যাঁ, ডক্টর রাইটার ফোন করেছিলেন।
সিওর? ফোকলা প্রশ্ন করলেন।
আমার এখান থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করেছিলেন। আমি উত্তর দিলাম।
আই সি। ফোকলা উত্তর দিলেন। আমার যেন মনে হল কেউ বাঙলায় কথা বলছে।
আমি উত্তর দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কোনোরকমে বললাম, ঠিকই ধরেছেন। প্রথমে আমি কথা বলেছিলাম। ডক্টর রাইটার আমাকেই সংযোগ করে দিতে বললেন। ফোকলা চ্যাটার্জি উত্তর দিলেন, আচ্ছা। . ফোকলা চ্যাটার্জি চলে যেতে আমি আশ্বস্ত হলাম। আর কিছুক্ষণ প্রশ্ন করলেই
আমি কী যে বলে ফেলতাম কে জানে।
বোসদা এবার আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার মুখের ভাব থেকেই তিনি সব বুঝে নিলেন। তিনি জানেন, ডক্টর রাইটার বিকেল থেকে একবারও কাউন্টারে আসেননি। তবু তিনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করলেন না! আমি এবার কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক সেই সময়েই বোসদা খাতার মধ্যে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বললেন, হোটেলজগতের গুরুদেবরা লিখে গিয়েছেন—বৎস, তোমার এবং তোমার অতিথির মধ্যে একটা কাউন্টার রয়েছে, একথা সর্বদা মনে রাখবে। নিজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে সীতা রাবণের হাতে পড়েছিলেন।
সেই রাত্রে করবীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ভেবেছিলাম ফোকলা চ্যাটার্জির কথা তাঁকে বলব। কিন্তু পারলাম না। দেখলাম, তিনি চুপচাপ বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়েছি। অনিন্দ্যবাবুচলেগিয়েছেন, এবং ওঁরাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন আগরওয়ালা এলেও আর কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। করবীর কাছেই শুনলাম, অনিন্দ্য এমনভাবে ডেকে পাঠাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। করবী উত্তর দিতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, আপনাকে প্রয়োজন আছে। এঁদের দুজনকে সামলানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠত।
আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে করবী ঘেমে উঠছিলেন।আবার আসবেন উনি কাল সকালে। ওঁকে কিছুতেই ছাড়া হবে না। আমার কেমন ভয় ভয় করছে।
বোসদার সাবধানবাণী তখনও আমার কানে বাজছিল। হোটেলে চাকরি করতে এসে, আমি জড়িয়ে পড়তে রাজি নই। তবু আমাদের চোখের সামনে আগরওয়ালা পাকড়াশীদের সর্বনাশ করবেন তা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না।
আমাদের জানবার কথা নয়। কিন্তু কিছুদিন পরে জানতে পেরেছিলাম, পাকড়াশী বাণিজ্য সাম্রাজ্য বাইরে থেকে যতটা মনে হত ততটা শক্তিশালী ছিল না। এই জার্মান সহযোগিতা না পেলে হয়তো তাদের প্রাসাদের ভিত নড়ে উঠত। করবী তখন আনন্দে চোখের জল ফেলছিলেন। অনিন্দ্য জানে না, কিন্তু তাকে সর্বদা কাছে কাছে রেখে, আগরওয়ালার হাত থেকে তিনি পাকড়াশীদের রক্ষে করতে পেরেছিলেন।
কাগজে সেদিন ছবি বেরিয়েছিল। জার্মান সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছেন মাধব পাকড়াশী। তার বাঁদিকে শ্রীঅনিন্দ্য পাকড়াশীকে দেখা যাচ্ছে।
এই ছবিটার দিকে তাকিয়েই করবী আনন্দের অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন।
এইখানেই শেষ হতে পারত। শাজাহান হোটেল এবং করবীর জীবন থেকে অনিন্দ্য পাকড়াশী এইখানেই সরে যেতে পারতেন। অন্তত সেইটাই স্বাভাবিক হত। কিন্তু, সবার অলক্ষ্যে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে এমন ঘটনা ঘটবে তা কারুর হিসাবের মধ্যে ছিল না।
আমি কেবল অনিন্দ্যর ব্যবহারে আশ্চর্য হয়েছিলাম। করবীর সজাগ দৃষ্টির বাইরে থাকলে, মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবর্তে যাঁর ছবি কাগজে বের হত তার নাম মিস্টার আগরওয়ালা। কিন্তু কই, অনিন্দ্য তো একবারও মনের সেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেলেন না? আর সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, করবীও সে জন্যে একটুও দুঃখিত হলেন না। ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন, অন্তত আমার কাছে মনের দুঃখ প্রকাশ করতে দ্বিধা করবেন না। কিন্তু কই?
আসলে তখনও আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। বুঝলাম, যেদিন সন্ধের একটু পরেই কালো চশমায় চোখ দুটো ঢেকে, সিল্কের শাড়ি পরে এবং সাদা ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে মিসেস পাকড়াশী হোটেলে এসে ঢুকলেন। অনেকদিনতাকে হোটেলে আসতে দেখিনি। হয়তো জার্মান অতিথিদের উপস্থিতির জন্যই তার আসা সম্ভব হয়নি। এখন তারা বিদায় নিয়েছেন। পুত্র অনিন্দ্যকে নিয়ে মাধব পাকড়াশী হয়তো বোম্বাই কিংবা দিল্লিতে রওনা হয়েছেন। আর সৌভাগ্যক্রমে আমাদের এক নম্বর সুইটও খালি রয়েছে।
মিসেস পাকড়াশী কাউন্টারে আমাকে দেখে বোধহয় একটু হতাশ হলেন। বললেন, মিস্টার বোস কোথায়?
ওঁর ডিউটি শেষ হয়েছে। এখন নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমার দ্বারা যদি আপনার কোনো কাজ হয়।
মিসেস পাকড়াশী বললেন, ওঁর সঙ্গেই দেখা করতে চাই।
বোসদাকে ডেকে নিয়ে এলাম। বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বোসদা বললেন, কখন ঘর চান জেনে নিলেই পারতে। আমাকে আবার ভোলা কেন? বললাম, আপনার কাস্টমার। আমাদের সঙ্গে লেনদেন করতে চান না।
বোসদাকে দেখেই মিসেস পাকড়াশী কাউন্টার থেকে এগিয়ে এলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওঁরা দুজনে কীসব কথাবার্তা বললেন। তারপর কাউন্টারে ফিরে এসেই আমাকে বললেন, এক নম্বর সুইটের চাবিটা দাও তো।চাবি হাতে করে ওঁরা দুজনেই উপরে উঠে গেলেন।
ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে, আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, অথচ ওঁদের দুজনের কারুরই দেখা নেই। প্রায় এক ঘণ্টা পরে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে আহত সপিণীর মতো ফোস ফোস করতে করতে মিসেস পাকড়াশী হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনি চলে যেতেই বেয়ারার হাতে স্লিপ দিয়ে বোসদা আমাকে ডেকে পাঠালেন।
বোসদা বললেন, বোসো। আমি বসলাম। বললাম, মিসেস পাকড়াশীর জন্যে কোনো স্পেশাল ব্যবস্থা করতে হবে?
না, ও-সবের কিছুই করতে হবে না, বোসদা চিন্তিত হয়ে বললেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপারটা কী? তুমি নিশ্চয়ই জানো। অথচ আমাকে বলোনি। আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা বললেন, করবী এবং অনিন্দ্যর কথা জিজ্ঞাসা করছি। এরা এতদূর এগোবার সময় পেলে কখন?
মানে? আমি প্রশ্ন করলাম।
তুমি নিশ্চয়ই সব দেখেছ, সুতরাং তোমার কাছে চেপে রেখে লাভ নেই, অনিন্দ্য করবীকে বিয়ে করতে চায়। শাজাহান হোটেলের দুনম্বর সুইটের হোস্টেসের জন্যে মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রিন্স-অফ-ওয়েলস পাগল হয়ে উঠেছে।
কেন জানি না, প্রথমেই আমার মনের মধ্যে আনন্দের শব্দহীন উল্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনিন্দ্য এবং করবী! মন্দ কী? সংসারের সব উত্তাপ থেকে করবী নিশ্চয় অনিন্দ্যকে রক্ষা করবেন। আর অনিন্দ্য যদি করবীর শুষ্ক মনের মরুভূমিতে জল সিঞ্চন করে ফসল ফলাতে পারে, তা হলে আমাদের পরিচিত পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
বোসদা বললেন, বিপদ হলো আমাদের। এমন ফ্যাসাদে কখনও পড়িনি। মিসেস পাকড়াশীর ধারণা অনিন্দ্যকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে করবী। তার ছেলেমানুষি, তার সরল নিস্পাপ মনের সুযোগ নিয়ে হয়তো মুহূর্তের কোনো অধঃপতন ঘটিয়েছে এবং এবার সে তা চড়া দামে ভাঙাতে চাইছে।
আমি প্রশ্ন করলাম, এর মধ্যে আমরা আসছি কী করে?
মিসেস পাকড়াশী আমাদের স্নেহ করেন। যে কারণেই হোক এই হোটেলের উপর তাঁর দুর্বলতা আছে। তাছাড়া এখন বিপদে পড়ে এসেছেন। বিপদে পড়লে পরম শত্রুকেও সাহায্য করতে হয়।
সাহায্য? আমি বোসদাকে প্রশ্ন করলাম।
উনি অনুরোধ করছিলেন, আমরা যদি কেউ করবীর সঙ্গে কথা বলি। আমি বলেছি, সেটা মোটেই শোভন নয়, সম্ভবও নয়। উনি এখন নিজেই করবীর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
আমি চুপ করে রইলাম। বোসদা বললেন, আমি বলে ফেলেছি। এই হোটেলে একমাত্র তোমার সঙ্গেই করবী কথাবার্তা বলেন।
কেন, ন্যাটাহারিবাবু তো রয়েছেন, বয়োজ্যেষ্ঠ লোক। আমি নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফল হল না।পাগল হয়েছ? বোসদা বললেন। ব্যাপারটা তুমি, আমি, মিসেস পাকড়াশী এবং করবী ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ যেন না জানতে পারে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে রাজি হতে হয়েছিল। করবী তখন দুনম্বর সুইটে একলা চুপচাপ বসেছিলেন। তার কোলের উপর একখানা কবিতার বই পড়ে ছিল। পাখির নীড়ের মতো চোখদুটি তুলে বনলতা-সেন-ভঙ্গিতে করবী প্রশ্ন করলেন, এতদিন কোথায় ছিলেন?
হেসে বললাম, কোথায় আর থাকব? শাজাহানের একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত ওঠা-নামা করছি।
করবী বললেন,আমি অনেকদিন পরে একটু শান্তিতে রয়েছি। আমার এখন একজনও অতিথি নেই। পাকড়াশীদের কুপোকাত করতে না পেরে, মনের দুঃখে আগরওয়ালাও এ-দিক মাড়াচ্ছেন না। ফোন করেছিলাম। শুনলাম, ব্লাড-প্রেসার এবং ডায়াবিটিস একই সঙ্গে আক্রমণ করেছে। সুতরাং এখন কয়েকদিন আমি চুপচাপ বসে বসে পরম আনন্দে কবিতা পড়ব, গান গাইব, বাইরে বেড়াতে যাব, যা খুশি তাই করব।
এবার আমাকে নিজের কথায় আসতে হল। আপনার কাছে একটা প্রস্তাব পেশ করব।
প্রস্তাব? করবী দেবী আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, কিংবা না করবার স্বাধীনতা আপনার। কিন্তু একটা শর্ত আছে। বিষয়টা কাউকে, এমনকি অনিন্দ্যবাবুকেও বলতে পারবেন না।
অনিন্দ্যর নাম শুনেই করবীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। কোনোরকমে বললেন, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, তবে আমি দিব্যি করছি তোমার শর্ত পালন করব।
আমিও তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু মিসেস পাকড়াশী আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।
মিসেস পাকড়াশী বলেছিলেন, শাজাহান হোটেলে নয়। অন্য কোথাও ওঁরা দুজন সাক্ষাৎ করবেন। করবী রাজি হননি। হোটেলের বাইরে যেতে তিনি অভ্যস্ত নন, একথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। শুনে মিসেস পাকড়াশী টেলিফোনেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন। আই সী! এখন আমার বিপদ, তিনি যা বলবেন তাই শুনতে আমি বাধ্য। কিন্তু ব্যাপারটা সে গোপন রাখবে তো?
আপনার প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো? করবীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
আমরা প্রখ্যাত হোটেলের কুখ্যাত হোস্টেস। মারোয়াড়ির চাকরি করে মা-ভাই-বোনদের প্রতিপালন করি, আমাদের কথার কীই-বা মূল্য থাকতে পারে। করবী দেবী দুঃখিত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন।
মিসেস পাকড়াশীর হোটেলে আসবার সেই দিনটি স্মৃতির পর্দায় আবার যেন দেখতে পাচ্ছি। যে-করবী কত স্বনামধন্যকে অবলীলাক্রমে অভ্যর্থনা জানিয়ে অপরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করেছেন, তিনি সেদিন কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, আমার ভাল লাগছে না। কথাবার্তার সময় আপনি থাকবেন।
তা কখনও হয়? আমি বললাম। বরং আমি বাইরে আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।
নিজের গাড়িতে নয়, একটা ট্যাক্সিতে চড়ে মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শাজাহান হোটেলে হাজির হয়েছিলেন। ঢোকবার মুখেই, রিপোর্টার মিস্টার বোসের সঙ্গে যে ওঁর দেখা হয়ে যাবে তা তিনি আশা করেননি। মিস্টার বোস বললেন, কী ব্যাপার? পি টি আই-এর খবরে দেখলাম প্যারিসের সমাজসেবা সেমিনারে যাবার কর্মসূচি আপনি শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করলেন?
মিসেস পাকড়াশী মৃদু হাস্য করে উদাসভাবে বললেন, চিন্তা করবেন না মিস্টার বোস। বোম্বাই-এর মিসেস লক্ষ্মীবতী প্যাটেল আমার অনুরোধে শেষ মুহূর্তে ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে রাজি হয়েছেন।
মিস্টার বোস বললেন, সে তো অন্য কথা। ক্যালকাটার যে-গৌরব আপনি প্যারিসে গিয়ে বাড়িয়ে দিতেন, তার তো কোনো ক্ষতিপূরণ হবে না।
মিসেস পাকড়াশী বললেন, আপনাদের প্রতি এবং ভালবাসার জোরেই তো এতদিন দাঁড়িয়ে রয়েছি। প্রার্থনা করুন, আমার শরীরটা যেন তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠে।
রিপোর্টারকে বিদায় করে, চিন্তিত মুখে মিসেস পাকড়াশী আমাকে প্রশ্ন করলেন, দুনম্বর সুইটের অসভ্য মেয়েটি আছে তো?
মাত্র দশ মিনিট কিংবা বোধহয় তাও নয়। দুনম্বর সুইটের দরজা খুলে মিসেস পাকড়াশী আবার বেরিয়ে এলেন। সত্যসুন্দরদা তাকে হোটেলের বাইরে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে বোসদা বললেন, করবীকে বোলো, মিসেস পাকড়াশীর কথা না শুনলে তাকে কষ্ট পেতে হবে। ভদ্রমহিলা আমাকে জানিয়ে দিতে বললেন।
করবী আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। এই বিশাল জগতে করবী একা, আপনজন বলতে তার কেউ নেই। পুরুষের একাকিত্ব মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এই বিদেশি পরিবেশে করবীর অবস্থা দেখে আমার মন খারাপ হয়ে উঠল। বেশ তো ছিলেন, কেন শুধু শুধু এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়লেন? আর উপদেশ নেবার লোক পেলেন না তিনি? শাজাহান হোটেলের কনিষ্ঠতম কেরানি জীবনের বৃহত্তম সমস্যায় করবীকে কী পরামর্শ দেবে?
করবী আমার দিকে একবার তাকালেন, তারপর আর নিজেকে চেপে রাখতে পারলেন না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, এ আমার কী হলো?
কোনো অনুরাগজর্জরিতা আত্মীয়বন্ধু-বিহীনা মহিলার নিরাশ হৃদয়ের কান্না কখনও শুনেছেন কি? দুঃখজর্জরিত আমাদের এই সংসারে এমন কিছু দুর্লভ দৃশ্য নয় সেটি। আমি অনেকবার শুনেছি, এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, তারা সম্পূর্ণ এক। দীর্ঘশ্বাস এবং অভিযোগ মেশানো সেই কান্নার বর্ণনা দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। একমাত্র কোনো বেঠোফেন, মোৎসার্ট বা ভাগনার সুরের মূৰ্ছনায় তার রূপ দিতে পারতেন; কোনো শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা ডিকেন্স হয়তো কানে শুনলে কলমে তার বর্ণনা দিতে পারতেন। সে আমার সাধ্যের অতীত।
শাজাহান হোটেলের দুনম্বর সুইটের দেওয়ালের ইটগুলো যেন সভয়ে প্রতিধ্বনি তুলল, এ আমার কী হল?
কী হল? তুমি ভালবেসেছিলে, সবার অগোচরে তুমি এক সুদর্শন নিৰ্মলপ্রাণ যুবককে তোমার মন দিয়েছিলে। তুমি আন্দাজ করেছিলে সেও হয়তো তোমার প্রতি সামান্য অনুরক্ত, অন্তত তার মনের কোথাও তোমার জন্যে সামান্য কোমল স্থান আছে। কিন্তু কেবল সেই পর্যন্ত। তারপর? তারপর যে এতদুর এগিয়েছে, তা তো জানা ছিল না। অনিন্দ্য যে বাড়িতে বলেছে সে এগিয়ে যেতে মনস্থির করেছে, তা তো সে নিজেও বলেনি। মিসেস পাকড়াশীই অজান্তে করবী গুহকে সেই পরম আশ্চর্য, পরম প্রিয়, পরম মধুর সংবাদটি দিয়ে গেলেন!
সাবধান। পাকড়াশী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের সামান্যতম ক্ষতিও আমি সহ্য করব না। অনিন্দ্যর বয়স কম, সে বোঝে না। ছিঃ, তাই বলে তুমি! তুমি না মেয়েমানুষ? তোমার অন্তর বলে কোনো জিনিস নেই? মিসেস পাকড়াশী প্রশ্ন করেছিলেন।
মিসেস পাকড়াশী বলেছিলেন, কেন যে জার্মানদের এখানে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। এখন কত টাকা হলে ছাড়বে বলো?
করবী গুহ ফ্যালফ্যাল করে মিসেস পাকড়াশীর দিকে তাকিয়েছিলেন। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, টাকা?
হ্যাঁ হ্যাঁ। যার জন্যে আমার এই অশান্তির সৃষ্টি করেছ। যার জন্যে আমার প্যারিস যাওয়া হলো না। মিসেস পাকড়াশী উত্তর দিয়েছিলেন।
মিসেস পাকড়াশী উঠে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, মনে থাকে যেন তুমি কথা দিয়েছ, অনিন্দ্য এসবের কিছুই জানবে না। আর যেহেতু আমি নিজেই তোমার দরজায় এসেছি, সেই জন্যে টাকার অঙ্কটা বাড়িও না। একটু ভেবে দেখো। আমি আবার খবর নেব।
করবী গুহ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অনিন্দ্য পাকড়াশী অন্তত তার কথা চিন্তা করেছেন। সব গাম্ভীর্য হারিয়ে ছেলেমানুষের মতো করবী গুহ সেদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। কই, আমাকে তো এখনও বলেননি? আমার সঙ্গে একবার পরামর্শ করা উচিত ছিল না? আমি যে রাজি হব, সেকথা তিনি ধরে নিলেন কেমন করে?
হয়তো আপনার চোখেই তা ধরা পড়ে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম।
ওঁর চোখেও আমি তা দেখেছিলাম, কিন্তু সাহস হয়নি।করবীতখন কেবল অনিন্দ্যর কথাই ভাবছেন, মিসেস পাকড়াশীর সাবধানবাণী তাঁর মাথাতেই আসছে না।
আমি কোনো উপদেশ দিতে পারিনি। পাকড়াশীদের ক্ষমতার কথা আমার জানা আছে। অনাগত ভবিষ্যতে করবীকে কিসের সঙ্গে যে পরিচিত হতে হবে কে জানে। আমি ঘর থেকে সোজা ছাদে চলে গিয়েছিলাম। গোমেজের ঘরে গ্রামোফোন বাজছে। সেখানে তখন সুরের শিশুরা খেলা শুরু করে দিয়েছে। গোমেজের ঘর থেকে কলহাস্যে বেরিয়ে পড়ে মানব সমুদ্রের উপকূলে তারা যেন ছোটাছুটি করছে। এমন সময় গোমেজ যে ঘরে শুয়ে থাকতে পারেন আশা করিনি।
আমাকে দেখে বললেন, শরীরটা অসুস্থ, বাজাতে যেতে পারিনি।প্রায়ই বমি আসছে। তাই শুয়ে শুয়ে মোসার্টের ভায়োলিন কনসার্টো শুনছি। প্রকৃত ভায়োলিন কনসার্টো তিনি মাত্র পাঁচটি রচনা করে গেছেন। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে প্রভাতচন্দ্রের দেহ পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার খেয়াল নেই। শুয়ে শুয়েই বলতে লাগলেন, পাঁচটাই সালসবুর্গে সৃষ্টি, ১৭৭৫ সালে। পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করবে যে, একজন ঊনিশ বছরের ছেলে এই ভায়োলিন কনসার্টো রচনা করেছেন?
আমি বললাম, আপনি উত্তেজিত হবেন না, একটু বিশ্রাম নিন।
শোনো, ফিসফিস করে গোমেজ বললেন। যদি বসুন্ধরার গোপনতম বেদনাকে আবিষ্কার করতে চাও, তবে কান পেতে মোসার্টের ভায়োলিন কনসার্টো শোনো।
রেকর্ডের গান শোনবার সেদিন আমার প্রয়োজন ছিল না। আমি কান পেতে দুনম্বর সুইটে একটু আগেই হৃদয়ের বেদনাময় কান্না শুনে এসেছি।
ন্যাটাহারিবাবু পরের দিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন,কী ব্যাপার, মশাই?দুনম্বর সুইটের মা জননী আমার আজ আর লিনেন পছন্দ করলেন না, ফুলওয়ালাকেও বকুনি দিলেন না।
বললাম, জানি না। ন্যাটাহারিবাবু মাথা নাড়লেন। উহু, ভাল লাগছে না আমার। শাজাহান হোটেলে এত বছর কাটিয়ে আমি এখন সব আগে থেকে বুঝতে পারি। বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমি গন্ধ পাই।
ফোকলা চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আগরওয়ালার গেস্ট হাউসের অফিসারটি মেয়েমানুষ না কেউটে সাপ? কাউকে মানে না। খোদ আগরওয়ালার স্লিপ নিয়ে এক ভদ্রলোকের জন্যে এসেছিলাম। সোজা ভাগিয়ে দিল। ইন্ডিয়ান ফার্মদের মশায় এই মুশকিল ডিসিপ্লিন বলে কিছুই নেই। আমেরিকায়, বিলেতে এমন তো কত গেস্ট হাউস আছে। সেখানকার কোনো কল গার্ল এমন সাহস করবে?
সত্যসুন্দরদা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছু বুঝছ?
বলেছিলাম, কেউ বোধহয় কিছু বুঝতে পারছে না।
করবীও কিছু বুঝতে পারছিলেন না। চুলগুলো আঁচড়াবার সময় পর্যন্ত তিনি পাননি আমাকে ঘরের মধ্যে পেয়ে করবী ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করলেন—কেউ যদি আমাকে ভালবাসে এবং আমি যদি তাকে ভালবাসি, তাহলে তাকে বিয়ে করবার মধ্যে অন্যায় কী? আমি চুপ করে রইলাম। করবী নিজের মনেই বললেন, কে কী বলবে, তাতে আমাদের কী এসে যায়?আবার পর মুহুর্তেই তিনি স্তিমিত হয়ে এলেন।লোকে খারাপ বলবে। আগরওয়ালার হোস্টেসকে বিয়ে করেছে পাকড়াশী সাম্রাজ্যের রাজপুত্র।
একটু ভাবলেন করবী গুহ। লোকেরা যা খুশি ভাবুক, কী বলেন? আর অনিন্দ্যর মা, তিনি কেন আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা গলাচ্ছেন? তার ছেলেকে সুখী করবার দায়িত্ব, সে তত আমি নিচ্ছি। চুপকরে আছেন কেন, কথা বলুন,করবী এবার অভিযোগ করলেন। আমার মুখে এখনও কথা নেই। করবী বললেন, কারুর কথা শুনব না আমি। আমরা এগিয়ে যাব।
এই প্রগম্ভ করবীর সঙ্গে কি আমার এতদিনের পরিচয় ছিল?
আবার দেখা হয়েছে। মিস্টার আগরওয়ালার গেস্ট হাউসে অতিথিদের যাতায়াত বন্ধ। আমাকে দেখেই করবী মৃদু হাসলেন। শুনেছেন, মিসেস পাকড়াশী আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আগরওয়ালাকে বলে আমার চাকরি যাবার ব্যবস্থা করাতে পারেন জানিয়েছেন এবং আরও অনেক কিছু করতে পারেন। এবার হাসিতে ভেঙে পড়লেন করবী। বললেন, আপনিই আমাকে বিপদে ফেলেছেন। না-হলে আমি সব ঠিক করে ফেলতে পারতাম।
হ্যাঁ, আপনিই তো আমাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিয়েছেন অনিন্দ্যকে এ-ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।
দিব্যি ভাঙুন না, আমার কী?
তা কখনও হয়? অনিন্দ্যর যে তাতে ক্ষতি হবে। করবী গম্ভীরভাবে বললেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখতে দেখতে করবী বললেন, ভয় দেখালেই আমার মাথার ঠিক থাকে না। ছোটোবেলা থেকে কেউ আমাকে ভয় দেখিয়ে জব্দ করতে পারেনি। অনিন্দ্য এসেছিল, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, এত মন খারাপ কেন? আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
ভয় দেখিয়েছিলেন মিসেস পাকড়াশী, সত্যি কথা। কিন্তু সেই রাত্রে তাঁকে নিজেই সত্যসুন্দরদার কাছে আসতে হল। মুখ শুকিয়ে কালি। করবী টেলিফোনে শাসিয়েছে তার হাতেও জিনিস আছে। তার হাতেও এমন আণবিক বোমা আছে, যা মিসেস পাকড়াশীর সোনার সংসার মুহুর্তে খুঁড়ো করে দেবে।
মিসেস পাকড়াশী আর যেন সেই গরবিনী মহিলা নেই। করবীর আণবিক বোমায় তিনি যেন ইতিমধ্যেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। মিসেস পাকড়াশীও সেদিন ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়েছিলেন। শাজাহান হোটেলের এক নম্বর সুইট ভূত হয়ে তাকে মাঝে মাঝে কেন টেনে এনেছিল। মিসেস পাকড়াশী বলেছিলেন, কাউকে কোনোদিন আর বিশ্বাস করা চলবে না।
বোসদা পাথরের মতো নির্বাক হয়ে বসেছিলেন। কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
সেই রাত্রে করবী গুহ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খুশিতে ঝলমল করছেন তিনি।
মিসেস পাকড়াশী একটু আগেই তার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন জানি। করবীর হাতে একটা ছবির খাম। নিজেই বললেন, রাজি হয়েছেন! রাজি না–হয়ে উপায় ছিল না। স্বামী, ছেলে, মেয়ে, জামাই; সংসার এদের কাছে না হলে মুখ দেখাবেন কী করে? বলেছিলেন, তিনি আর কোনো বাধা দেবেন না। প্রথমে ওঁর একটু সন্দেহ ছিল, ভেবেছিলেন আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তারপর দেখালাম। করবী এবার খামটা নাড়ালেন! আপনাকেও দেখাতে পারব না। এক নম্বর সুইটের ঘরের ভিতরে তোলা ছবির নেগেটিভ।
মিসেস পাকড়াশী প্রথমে চমকে উঠলেন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তার গোপন অভিসারের অমন সর্বনাশা দলিল কী করে করবীর হাতে এল। ভয়ে ভয়ে করবীকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ও লর্ড, এ-সব কোথা থেকে এল?
সোজাসুজি উত্তর না-দিয়ে করবী বলেছিলেন, পাঁচজনের হাতে ঘোরার চেয়ে একজনের কাছে থাকাই কি ভাল নয়?
আমি বললাম, সত্যি, কোথা থেকে পেলেন? বন্ধ ঘরের ভিতরকার এমন ছবি যে কেউ তুলে রাখতে পারে তা আমার জানা ছিল না।
করবী বললেন, এই হোটেলেরই কেউ আমাকে দিয়েছে। না-হলে পেলাম কেমন করে? মিসেস পাকড়াশী আমাকে ভালবাসেন না বলে কেউ কি আমার জন্যে চিন্তা করে না? করবী এবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন। রাজি হয়েছেন। ভুলেও তিনি আর আমার পথে বাধা দেবেন না।
এবার কী বলুন তো? করবী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন।
অনভিজ্ঞের মতো আমি বলেছিলাম, এবার শাজাহান হোটেল ছেড়ে নিউ আলিপুর।
করবী আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন। আপনি থেকে হঠাৎ তুমি হয়ে গেলাম। আমাকে তোমরা একেবারে ভুলে যাবে। তোমরা কোনোদিন তো আমাকে শাজাহান হোটেলের সহকর্মী বলে মনে করোনি।
আপনি নিজেই ভুলে যাবেন।ডিনারবা ব্যাংকোয়েটে কোনোদিন শাজাহান হোটেলে এলেও আপনি একবারও কাউন্টারের দিকে তাকাবেন না, বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে সোজা হ-এ চলে যাবেন। আমরা কিন্তু তখনও রসিদ কাটব, বিল তৈরি করব, খাতায় লেখালেখি করব, টেলিফোন ধরব, স্টুয়ার্ডের বকুনি খাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমারও ভেরিকোজ ভেনগুলো হয়তো ফুলে উঠবে।
তোমার এ-চাকরি ভাল লাগে না? করবী বলেছিলেন।
মোটেই না। একটা দশটা-পাঁচটার চাকরি কোথাও করে দেবেন তো?তখন কত বড় বড় চাকরি তো আপনার হাতে থাকবে।
সব দেব। আমার জন্যে এত করেছ তুমি, আর এইটুকু করব না!
আমি বলেছিলাম, গুড নাইট।
করবী বলেছিলেন, গুড নাইট!
ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে সামান্য কিছুক্ষণ হয়তো ঘুমিয়েছিলাম। রাত্রি অনেক হয়েছে। হঠাৎ গুড়বেড়িয়া দরজায় ধাক্কা দিলে। দুনম্বর সুইটের মেমসায়েব আমাকে ডাকছেন।
চোখে একটু জল দিয়ে আবার নেমে গেলাম। দেখলাম, করবী যেন কেমন হয়ে গিয়েছেন। তার সমস্ত দেহটা থরথর করে কাঁপছে।
নিজের মাথাটা চেপে ধরে করবী গুহ বললেন, একি করলাম আমি। আমাকে বাঁচাও ভাই।হিস্টিরিয়া রোগীর মতোকরবীর চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
শান্ত করবার চেষ্টা করে বললাম, ছিঃ, এমন করতে নেই।কী হয়েছে বলুন? একটু আগেও তো আপনাকে দেখে গেলাম। তখন তো কিছুই বললেন না।
ভয়ার্ত শিশুর মতো করবী বললেন, ভেবেছিলাম, কাউকে বলব না, যে যাই বলুক, অনিন্দ্যকে আমি ছাড়তে পারব না। জীবনে কিছুই তো পাইনি; একজন যদি আমাকে ভালবাসা দেয়, কেন আমি নেব না?
করবী এবার একটু থামলেন। তারপর বললেন, মিসেস পাকড়াশীর অত চিন্তা কেন? আমি কি ওঁর ছেলেকে যত্ন করব না, না তাকে ভালবাসব না? আমাকে সামনে রেখে কোনো অদৃশ্য আদালতে করবী যেন সওয়াল করলেন। করবীকে শান্ত করবার চেষ্টা করে বললাম, হঠাৎ এই কথা ভাবছেন কেন?
ভাবব না! অনিন্দ্যর মা যখন আমার ঘর থেকে শুকনো মুখে চলে গেলেন, তখন আপনি তাকে দেখেননি, তেজপাতার মতো তার দেহটা কাপছে। আমি বলেছিলাম, আপনি আর কোনো বাধা দেবেন না তো? উনি বলেছিলেন, না। আরও বলেছিলেন, হয়তো খোকার চেয়ে তোমার বয়স একটু বেশি। তবু কিছু বলবনা।তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন তিনি। মিনতি জানিয়ে বলেছিলেন, আমার ছবির নেগেটিভটা বিয়ের আগে ছিড়ে ফেলবে তো? আমার হাতটা চেপে ধরে বলেছিলেন, কাউকে বলবে না তো?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। করবী দেবী কাঁদ কাঁদ হয়ে বললেন, এমনভাবে বিয়ে করবার কথা তো ছিল না। শাশুড়িকে ভয় দেখিয়ে, তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনিন্দ্যর মতো ছেলের গলায় মালা দেবার কথা তো ছিল না।
করবী এবার খামের মধ্যে হাত দিয়ে দেখলেন ছবি আছে কি না। তারপর কী ভেবে আমার সামনেই সমস্ত খামটা কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেললেন। তারপর অকস্মাৎ নিজের সর্বস্ব হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, অসম্ভব! আমার শ্বশুর, আমার শাশুড়ি, তারা গুরুজন। এমনভাবে, নোংরা পথে আমি অনিন্দ্যর বাড়িতে উঠতে পারব না। আমার পাপ হবে, অনিন্দ্যর অমঙ্গল হবে।
চোখের জল মুছে করবী এবার সহজ হবার চেষ্টা করলেন। বললেন, মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। এখানে আমার কেউ যে আপনজন নেই। তাই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলুম।
ঘৃণা ও গ্লানি করবীর মনে কোন সর্বনাশা চিন্তার জন্ম দিয়েছে তখনও বুঝতে পারিনি। পরের দিন একটু দেরিতে ঘুম ভেঙেছিল আমার। তখন হোটেলে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। দুনম্বর সুইটে করবীর প্রাণহীন দেহ তখন পুলিস দরজা ভেঙে উদ্ধার করেছে।
ন্যাটাহারিবাবু বললেন, মা জননী আমার এক শিশি ঘুমের ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে ফেলেছে।
করবীর মৃতদেহ যখন হোটেল থেকে বার করে মর্গে পাঠানো হয়েছিল, তখনও আমি যাইনি।
ন্যাটাহারিবাবু ফিরে এসে বললেন, একবার গুম্বাই করে এলেন না? আমি মশাই সবচেয়ে ভাল চাদরটা পুলিসের গাড়িতে দিয়ে দিয়েছি। মা জননী আমার কেন যে হোটেলে এসেছিল! সেই প্রথম যেদিন ওঁকে দেখেছিলুম, সেদিনই আমি সবাইকে বলেছিলুম, এ তো হোটেলের মেয়ে নয়, এ আমার মা জননী। তখন আমার কথায় কান দেওয়া হয়নি। এখন বোঝো। নিজের মনেই বকবক করতে করতে ন্যাটাহারিবাবু বেরিয়ে গেলেন।