১২. এমদাদ এবং তার নাতনী

এমদাদ এবং তার নাতনীকে থাকার জন্যে যে ঘরটা দেয়া হয়েছে সে ঘর এমন্দাদের খুবই পছন্দ হল। সে তিনবার বলল, দক্ষিণ দুয়ারী জানালা লক্ষ্য করে দেখ। ঘুম হবে তোফা। পুতুল শুকনো গলায় বলল, ঘুম ভাল হইলেই ভাল। আরাম কইরা ঘুমাও।

খাটিও দুইটা আছে। একটা তোর একটা আমার। ব্যবস্থা ভালই। কি কস পুতুল?

পুতুল চুপ করে রইল। এমদাদ বলল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম বুঝলি। কিছুই বলা যায় না। যদি চাকর বাকরের ঘর দিয়া বসে। দিয়া বসতেও তো পারে। মানী লোকের মানতো সবাই দেখে না। আরে আরো কারবার দেইখ্যা যা। ঘরের লগে পেসাবখানা। এলাহী কারবার।

আনন্দে এমদাদের মুখ ঝলমল করছে। শুধু পুতুল মুখ কাল করে রেখেছে। কিছুতেই তার মন বসছে না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হবার কষ্ট ও যন্ত্রণা সে তার ক্ষুদ্র জীবনে অনেকবার ভোগ করেছে। এখন আবার শুরু হল। ইচ্ছা মৃত্যুর ক্ষমতা যদি মানুষের থাকতো তাহলে বড় ভাল হত। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হত না।

७ श्रृंङ्गल।

কি দাদাজান?

ঘর ভালই দিছে ঠিক না?

হুঁ।

এখন খেয়াল রাখবি সবের সাথে যেন ভাল ব্যবহার হয়। যে যা কয় শুনবি আর মুখে বলবি— জ্বি কথা ঠিক। এই কথার উপরে কথা নাই। গেরাম দেশে লোক বলে মুখের কথায় চিড়া ভিজে না–মিথ্যা কথা, মুখের কথায় সব ভিজে। তোর মুখ এমন শুকনা দেহায় ক্যানরে পুতুল?

এইখানে কদিন থাকবা?

আসতে না আসতেই কদিন থাকবা? থাকা না থাকা নিয়া তুই চিন্তা করবি না। এইটা আমার উপড়ে ছাইড়া দে। যা হাত মুখ ধুইয়া আয় চাইরডা দানাপানি মুখে দেই। এই বাড়ির খাওয়া খাদ্যও ভাল হওনের কথা।

এমন্দাদের আশঙ্কা ছিল হয়ত চাকর বাকিরদের সঙ্গে মেঝেতে পাটি পেতে খেতে দেবে। যদি দেয় তাহলে বেইজাতির সীমা থাকবে না। দেখা গেল খাবার টেবিলেই খেতে দেয়া হয়েছে। বাড়ির কত্রী স্বয়ং তদারক করছেন। চিকন চালের ভাত, পাবদা মাছ, একটা সজি, মুগের ডাল। খাওয়ার শেষে পায়েস। তোফা ব্যবস্থা। মিনু বললেন, পেট ভরেছে তো এমদাদ সাহেব? ঘরে যা ছিল তাই দিয়েছি। নতুন কিছু করা হয়নি।

কোন অসুবিধা হয় নাই। শুধু একটু দৈ থাকলে ভাল হইত। খাওয়ার পর দৈ থাকলে হজমের সহায়ক হয়। তার উপর আপনার ছোটবেলা থাইক্যা খাইয়া অভ্যাস।

ভবিষ্যতে আপনার জন্য দৈায়ের ব্যবস্থা রাখব।

আলহামদুলিল্লাহ্। এখন মা জননী অবস্থা পইড়া গেছে। একটা সময় ছিল খোন্দকার বাড়ির সামনে দিয়া লোকজন ছাতা মাথায় দিয়া যাইত না। নিয়ম ছিল না। জুতা খুইল্যা হাতে নিতে হইত বুঝলেন মা জননী।

তাই বুঝি!

জি। এবার কি হইল শুনেন মা জননী। খোন্দকার বাড়ির সামনে দিয়ে এক লোক যাইতেছে হঠাৎ খ্যক করে কােশ ফেলল। সাথে সাথে দারোয়ান ঘাড় ধরে নিয়া আসল–বলল হারামজাদা এত বড় সাহস। খোন্দকার বাড়ির সামনে কাশ ফেলস। নাকে খত দে। মাটিতে চাটা দে–তারপরে যা যেখানে যাবি।

পুতুলের এইসব কথা শুনতে অসহ্য লাগে। না শুনেও উপায় নেই। দাদাজান যেখানে যাবে সেইখানেই এইসব বলবে। পুতুলের ধারণা সবই মিথ্যা কথা। সে খাওয়ার মাঝ পথে উঠে পড়ল। এমন্দাদের তাতে সুবিধাই হল। সে জরুরি একটা কথা বাড়ির কত্রীর সঙ্গে বলতে চাচ্ছে।

পুতুল থাকায় বলতে পরছে না। এখন সুযোগ পাওয়া গেল।

মা জননীকে একটা কথা বলতে চাইতেছিলাম।

বলুন।

বলতে শরম লাগছে। আবার না বলেও পারতেছি না। তারপর ভেবে দেখলাম আপনাদের না বললে কাদের বলল? আপনারা হইলেন বটবৃক্ষ।

ব্যাপারটা কি?

ট্রেইন থাইক্যা নামার সময় বুঝলেন মা জননী পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়া দেখি পকেট কাটা।

পকেট কাটা মানে?

ব্লেড দিয়ে পকেট সাফা করে দিছে। মানিব্যাগে চাইরশ তেত্ৰিশ টাকা ছিল, সব শেষ। এখন পকেটে একটা কানা পয়সা নাই। কি বেইজ্জতী অবস্থা চিন্তা করেন মা জননী।

আচ্ছা ওর একটা ব্যবস্থা হবে।

হবে তাতো জানিই। বটবৃক্ষতো শুধু শুধু বলি না। চাইলতা গাছও তো বলতে পারতাম। পারতাম না।

আপনাকে কি মিষ্টি দেব? ঘরে মিষ্টি আছে।

দেন। আমার অবশ্য ডায়াবেটিস। মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। এত নিষেধ। শুনলে তো আর হয় না। কি বলেন মা জননী? মিষ্টি খাইতে পারব না, ভালমন্দ খানা খাইতে পারব না, সিগ্রেট খাইতে পারব না–তাইলে খামুটা কি? বাতাস খামু?

দীর্ঘদিন পর এমন্দাদের খুব চাপ খাওয়া হয়ে গেল। পেট দম সম হয়ে আছে। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এদের বাড়ি ঘর, লোকজন সবার সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার। সে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। নাতনীটাকে এ বাড়িতে গছিয়ে যেতে হবে। কাজেই পরিবারে সদস্যদের নাড়ি নক্ষত্র জানা থাকা প্রয়োজন। তার কাছে অবশ্যি বেশির ভাগ সদস্যকেই বোকা কিসিমেরে বলে মনে হচ্ছে। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। যে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক থাকে বোকা সেই পরিবার সাধারণত সুখী হয়।

এমদাদ ফরিদের ঘরে উঁকি দিলে। ফরিদ চিন্তিত মুখে বিছানায় বসে আছে। ছবির পরিকল্পনা ভেঙে যাওয়ায় তার মন খুবই খারাপ। এমদাদ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলর, বাবাজী কি জেগে আছেন?

ফরিদ কড়া চোখে তাকাল। থমথমে গলায় বলল, আপনি কি এর আগে কাউকে চোখ মেলে বসে বসে ঘুমুতে দেখেছেন যে আমাকে এরকম একটা প্রশ্ন করলেন। দেখেছেন। এইভাবে কাউকে ঘুমুতে?

এমদাদ প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। সহজ গলায় বলল, জ্বি জনাব দেখেছি। চোখ মেলে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ঘুমাতে দেখেছি।

কাকে দেখেছেন?

ঘোড়াকে। ঘোড়া দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ঘুমায়।

লোকটির স্পধাঁয় ফরিদ হতভম্ব।

আমাকে দেখে আপনার কি ধারণা হয়েছে যে আমি একটা ঘোড়া?

জি না।

আপনি বয়স্ক প্ৰবীণ একজন মানুষ বলেই আমি এই দফায় আপনাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আর করা হবে না।

জ্বি আচ্ছা।

আপনি কখনো আমার ঘরে ঢুকবেন না।

জ্বি আচ্ছা।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলে যান।

একটা সিগারেটের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। বাবাজী কি সিগারেট খান।

খাই কিন্তু আপনাকে সিগারেট দেয়া হবে না। আপনি যেতে পারেন।

জি আচ্ছা। জিনিসটা অবশ্য স্বাস্থ্যের জইন্যেও খারাপ।

এমদাদ বের হয়ে এল। ফরিদের ঘরের ঘটনা তাকে খুব একটা বিচলিত করল না। বরংচ সে খানিকটা মজাই পেল। বড় ধরনের বেকুব সংসারে থাকা ভাল। যে সংসারে বড় ধরনের কোন বেকুব থাকে সেই সংসারে কখনো ভয়াবহ কোন সমস্যা হয় না। বোকাগুলি কোন না কোনভাবে সমস্যা পাতলা করে দেয়। এমদাদ রাস্তায় বের হল। চা খাওয়ার পর তার একটা সিগারেট দরকার।

অপরিচিতি মানুষের কাছে টাকা চাওয়া সমস্যা কিন্তু সিগারেট চাওয়া কোন সমস্যা না। এমদাদ আধা ঘণ্টার মধ্যে ছটা সিগারেট জোগাড় করে ফেলল। তার টেকনিকটা এ রকম–সিগারেট ধরিয়ে কোন ভদ্রলোক হয়ত আসছে–এমদাদ হাসি মুখে এগিয়ে যাবে।

স্লামালিকুম ভাইসাব।

অপরিচিত ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, আমাকে কিছু

বলছেন?

জ্বি।

বলুন-

আমার হার্টের অসুখ। ডাক্তার সিগারেট বন্ধ করে দিয়েছে। লুকিয়ে চুকিয়ে যে একটা টান দিব সেই উপায় নাই। ঘর থেকে একটা পয়সা দেয় না। ভাই এখন আপনি যদি একটা সিগারেট দেন জীবনটা রক্ষা হয়।

ডাক্তার যখন নিষেধ করেছে তখন তো সিগারেট খাওয়া উচিত হবে না।

কয়দিন আর বাঁচব বলেন? এখন সিগারেট খাওয়া না খাওয়া তো সমান।

এরপর আর কথা চলে না। অপরিচিত ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করেন। এমদাদ হাসি মুখে বলে, দুটা দিয়ে দেন ভাই সাহেব। রাতে খাওয়ার পর একটা খাব।

 

এমদাদ যখন সিগারেটের সঞ্চয় বাড়াতে ব্যস্ত তখন বাড়ির ভেতর ছোট্ট একটা নাটক হল। মিনু তিনশ টাকা হাতে নিয়ে পুতুলকে বললেন, মা এই টাকাটা তোমার দাদাকে দিও। পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের টাকা?

উনার মানিব্যাগ পকেটমার হয়ে গেল। উনি বলছিলেন।

পুতুল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কই দাদাজানের কোন টাকা পকেটমার হয় নাই। ঐতো দাদাজানের মানিব্যাগ।

তবু তুমি টাকাটা রাখা।

না না— আমি টাকা রাখব না।

মিনু বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন— পুতুলের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি বেশ অবাক হলেন। মিনু কোমল গলায় বললেন, কি ব্যাপার পুতুল? পুতুল ধরা গলায় বলল— দাদাজান মিথ্যা কথা বললে আমার বড় কষ্ট হয়।

হয়ত মিথ্যা কথা না। হয়ত উনি ভুলে গেছেন।

না। উনি ভুলেন নাই। উনি সহজে কিছু ভুলেন না। পুতুলের কান্নার বেগ ক্রমেই বাড়তে লাগল। মিনু পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলেন। এই মেয়েটা মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য রকম। তিনি নিতান্ত অপরিচিত এই মেয়েটির প্রতি এক ধরনের মমতা অনুভব করলেন।

 

নিরিবিলি বাড়িতে ক্রাইসিস তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না। রাত আটটা দশ মিনিটে একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়ে গেল। অবশ্যি এটা যে একটা ক্রাইসিস শুরুতে তা বোঝা গেল না। রাতের টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। সোবাহান সাহেব হাত ধুয়েছেন। তাঁর প্লেটে বিলু ভাত দিতে যাচ্ছে তিনি বললেন, স্টপ।

বিলু বলল, ভাত দেব না। বাবা?

না।

প্লেট বোধহয় ভাল করে ধোয়া হয়নি। তাই না?

ওসব কিছু না।

সোবাহান সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। মিনু বললেন, শরীর খারাপ লাগছে? সোবাহান সাহেব অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ করলেন। এই শব্দের কোন অর্থ নেই।

রাত সাড়ে নটার দিকে জানা গেল ক্ষুধার প্রকৃত স্বরূপ কি তা জানার জন্যে তিনি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আগামী দশদিন তিনি পানি ছাড়া কিছুই খাবেন না।

বিলু বাবাকে বোঝানোর জন্যে তার ঘরে গেল। হাইপারটেনসনের রুগীকে অনিয়ম করলে চলে না। বিলুর সঙ্গে সোবাহান সাহেবের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল।

বিলু : বাবা তুমি ভাত খাবে না।

বিলু : না।

বিলু : ভাত খাবে না। কারণ তোমাকে ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে হবে?

বাবা : হ্যাঁ।

বিলু : কেন বলতো? ক্ষুধার স্বরূপ বুঝে তোমার হবেটা কি? তুমি যদি একজন কবি হতে তাহলে একটা কথা হত। ক্ষুধা সম্পর্কে কবিতা লিখতে। গদ্যকার হলে আমরা ক্ষুধার অসাধারণ বর্ণনা পেতাম। তুমি যদি রাজনীতিবিদ হতে তাহলেও লাভ ছিল, গরিব দুঃখীদের কষ্ট বুঝতে— তুমি বলতে গেলে কিছুই না। তাহলে তুমি কেন কষ্ট করছ?

বাবা : তুই ঘর থেকে যা। তুই বড় বিরক্ত করছিস।

বিলু : তুমি যদি কিছু না খাও তাহলে মা-ও খাবে না।

বাবা : সেটা তার ব্যাপার। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।

বিলু : না খেয়ে কতদিন থাকবে?

বাবা : যত দিন পারি।

বিলু : অনশনে যাবার এই বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে বাবা? দোতালার আনিস সাহেব?

বাবা : হ্যাঁ।

বিলু : আমিও তাই ভেবেছিলাম।

বিলু দোতলায় উঠে এল। তার মুখ থম থম করছে।

আনিসের দুটি বাচ্চাই শুয়ে আছে। দুজনের চোখই বন্ধ। কোন সাড়াশব্দ করছে না। কারণ আনিস ঘোষণা করেছে। সবচে বেশি সময় যে কথা না বলে থাকতে পারবে সে পাঁচ টাকা পুরস্কার পাবে। পুরস্কারের পাঁচটা টাকা খামে ভর্তি করে টেবিলের উপর রেখে দেয়া আছে। আনিসের ধারণা পুরস্কারের লোভে চুপ করে থাকতে থাকতে দুজনই এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে। যদিও লক্ষণ তেমন মনে হচ্ছে না। টগর এবং নিশা মুখে কথা বলছে না ঠিকই কিন্তু ইশারায় কথা বলছে। দুজনই হাত ও ঠোঁট নাড়ছে। এই সব কীর্তিকলাপ বিলুকে ঢুকতে দেখে থেমে গেল। দুজনই চোখ বন্ধ করে মরার মত পড়ে রইল। যেন ঘুমুচ্ছে।

বিলু বলল, আনিস সাহেব, আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?

আনিস হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। কোমল গলায় বলল, অবশ্যই পারেন।

আপনার সঙ্গে আমার ফরম্যাল পরিচয় হয়নি— আমার নাম….

আনিস বলল, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আপনার হয়ত মনে নেই। আপনার নাম বিলু, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে পড়েন। একবার ছাদে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন। আপনি বসুন।

না। আমি বসার জন্য আসিনি।

ঝগড়া করতে এসেছেন?

হ্যাঁ।

আনিস হাসতে হাসতে বলল, এটা অদ্ভুত ব্যাপার যে সবাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে। এতদিন পর্যন্ত এ বাড়ি আছি। অথচ এখন পর্যন্ত একজন কেউ এসে বলল না, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।

বিলু আনিসের হালকা কথাবাতাঁর ধার দিয়েও গেল না। কঠিন গলায় বলল, আপনি কি বাবাকে উপোষ দিতে বলেছেন?

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

আপনি কি বাবাকে বুঝিয়েছেন ক্ষুধার স্বরূপ বোঝার জন্য না খেয়ে থাকার প্রয়োজন।

আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কি না খেয়ে আছেন না-কি?

হ্যাঁ।

কি সর্বনাশ। আমি শুধুমাত্ৰ কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম যে আমরা যারা সৌখিন সমস্যাবিদ তারা মূল সমস্যা নিয়ে ভাসা ভাসা কথাবার্তা বলি। কারণ মূল সমস্যা আমরা জানি না। ক্ষুধা যে কি ভয়াবহ ব্যাপার তা আমরা অর্থাৎ তথাকথিত মধ্যবিত্ত সমস্যা বিশারদরা জানি না। কারণ আমাদের কখনো ক্ষুধার্তা থাকতে হয় না। রোজার সময় বেশ কিছু সময় ক্ষুধার্ত থাকি সেও খুবই সাময়িক ব্যাপার। তখন আমাদের মনের মধ্যে থাকে সূৰ্যটা ড়ুবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর খাদ্য দ্রব্য চলে আসবে। কাজেই ক্ষুধার স্বরূপ…

বিলু আনিসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে হাত জোর করে অনুরোধ করছি আপনার এই সব চমৎকার থিওরী দয়া করে নিজের মধ্যেই রাখবেন। বাবাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন না। উনি সব কিছুই খুব সিরিয়াসলি নেন। নিজের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেন, আমাদের জন্যেও সমস্যা সৃষ্টি করেন। আমি কি বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন?

জ্বি পারছি।

সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তখন আরো একটা কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছি। কথাটা হচ্ছে–আপনি যে আপনার বাচ্চাদের মাধ্যমে আমাকে প্ৰেম নিবেদন করেছেন এতে আমি শুধু অবাক হয়েছি। তাই না-দুঃখিত হয়েছি, রাগ করেছি, বিরক্ত হয়েছি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা আমি পছন্দ করি না বলেই এতদিন চুপচাপ ছিলাম। আজ বলে ফেললাম।

আনিসেকে একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিলু নিচে নেমে গেল। আনিস ডাকল, টগর টগর। টগর জেগে আছে। তবু কথা বলছে না। কথা বললেই বাজিতে হারিতে হয়। আনিস বলল, টগর কথা বল এখন কথা বললে বাজির কোন হেরফের হবে না। টগর।

জি।

বিলু মেয়েটিকে তুমি কি বলেছ?

আমি কিছু বলিনি— নিশা বলেছে।

নিশা, তুমি কি বলেছে?

আমার মনে নেই।

মনে করার চেষ্টা কর। তুমি কি বলেছ?

নিশা কোন শব্দ করল না। টগর বলল, নিশা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা। আনিস বলল, তোমার কি মনে আছে নিশা কি বলেছে?

মনে আছে।

বলতো শুনি।

নিশা উনাকে বলেছে— আব্বু আপনাকে বিয়ে করবে। তখন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তখন আমরা আপনাকে আম্মু ডাকব।

আনিস হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেক কষ্টে বলল, ভদ্র মহিলা নিশার কথা শুনে কি বলল? সে তখন বলল, টগর–তোমার বাবা এই সব কথা তোমাদের বলেছেন? আমি বললাম— হুঁ।

তুমি হুঁ বললে?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমি তো কখনো এ রকম কথা বলিনি–তুমি হুঁ বললে কেন?

আর বলব না বাবা।

নিশা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমিও বলব না। বাবা। এতক্ষণ সে জেগেই ছিল! কোন পর্যায়ে কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করবে। এইটাই শুধু বুঝতে পারছিল না।

 

একটা মানুষ ক্ষুধা কেমন এটা জানার জন্যে না খেয়ে আছে। এই ব্যাপারটা পুতুলকে অভিভূত করে ফেলেছে। সে কয়েকবার দাদাজানের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করলা–এমদাদ কোন পাত্তা দিল না। এমিতেই তার মেজাজ খারাপ, পকেট মারের ব্যাপারটায় উল্টাপাল্টা কথা বলে মেয়েটা তাকে ড়ুবিয়েছে। শুরুতেই বেইজ্জত হতে হল। এটাকে যে কোন ভাবেই হোক সামলাতে হবে। কি ভাবে সামলাবে তাই নিয়ে এমদাদ চিন্তা ভাবনা করছে— এর মধ্যে পুতুল ঘ্যান ঘ্যান করছে। সোবাহান সাহেবের না খাওয়া নিয়ে। এই মেয়েটাকে কড়া একটা ধমক দেয়া দরকার। ধমক দিতেও ইচ্ছা করছে না! ও দাদাজান ঘুমাইলা?

না!

কেমন আশ্চর্য মানুষ দেখলা দাদাজান? ক্ষুধা কেমন জিনিস এইটা জাননের জইন্যে না খাইয়া আছ।

দুনিয়াডা ভর্তি বেকুবে—এইডাও বেকুবির এক নমুনা।

ছিঃ দাদাজান–এমন কথা কইও না।

এই বুড়া বেকুব তো বেকুবই, তুইও বেকুব। তুই আমার সাথে কথা কইস না।

আমি কি দোষ করলাম দাদাজান?

চুপ, কোন কথা না।

বুড়ো বয়সের ব্যধি রাতে ঘুম হয় না। এমদাদ রাত দেড়টায় ঘুমের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে বসে থাকতেও আরাম। মশা না থাকলে পাটি পেতে বারান্দায় ঘুমানোরই ব্যবস্থা করা যেত কিন্তু বডড মশা।

মিনু দরজা বন্ধ করতে এসে দেখেন এমদাদ সাহেব বারান্দার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে আছেন। হাতে সিগারেট। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, কে এমদাদ সাহেব না?

জ্বি মা জননী।

এত রাতে এখানে কি করছেন?

মনটা খুব খারাপ। ঘুম আসে না।

মন খারাপ কেন?

বাড়ির কর্তা না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। এই জন্যেই মনটা খারাপ মা জননী! আমার হইলাম গোরামের মানুষ, ক্ষুধা পেটে কেউ ঘুমাইতে গেছে শুনলে মনটা খারাপ হয়?

ঐসব নিয়ে ভাববেন না। বিলুর বাবার এই রকম পাগলামী আছে। সকালে দেখবেন ঠিকই নাশতা করছে।

শুনে বড় ভাল লাগছে মা জননী।

আসুন ভেতরে চলে আসুন। আমি দরজা বন্ধ করে দেব।

এমদাদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আরেকটা বিষয় আপনেরে বলা হয় নাই মা জননী— মানিব্যাগের বিষয়ে! মানিব্যাগ ছিল পুতুলের কাছে। মাইয়া খুব সাবধানতো— গুছায়ে রাখছে। এদিকে আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ছিল রুমাল। পকেটমার সেই রুমাল নিয়ে চলে গেছে। হা হা হা।

মিনু বললেন, টাকা পয়সার প্রয়োজন হলে বলবেন। সংকোচ করবেন না।

আলহামদুলিল্লাহ। কোন সংকোচ করব না— আপনারা হইলেন বটবৃক্ষ।

যান। ঘুমুতে যান।

জ্বি আচ্ছা। ঘুম আসবে না। তবু শুইয়া থাকব। বাড়ির আসল লোক দানাপানি খায় নাই— এরপরেও কি ঘুম আসে কন মা জননী?

এইসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। সকাল হলেই দেখবেন খাওয়া দাওয়া শুরু করছে। উদ্দেশ্যে তো আর কিছু না। উদ্দেশ্য হলো আমাকে যন্ত্রণা দেয়া!

এই কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না মা জননী – ক্ষুধা কি যে বুঝতে চায় সে কি সাধারণ লোক? সে তো বলতে গেলে আল্লাহর অলি। ঠিক বলছি না— মা জননী?

মিনু জবাব দিলেন না। এই লোক কি মতলবে এসেছে কে জানে। বিনা কারণে আসে নি বোঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বড় কোন সমস্যা। সমস্যা টেনে টেনে তিনি এমন ক্লান্ত ও বিরক্ত। আর ভাল লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *