১২. একবার একা আসবার অনুমতি

একবার একা আসবার অনুমতি পাবার পর, যে কোনও ছুটিতে রাণুর কলকাতা কিংবা শান্তিনিকেতনে চলে আসতে অসুবিধে হয় না। মাঝে মাঝে কবির কাছ থেকেও ডাক আসে, তখন আর আপত্তি করেন না রাণুর বাবা। কারুকে না কারুকে সঙ্গী পাওয়াই যায়।

এবারে বিসর্জনের মহড়া শুরু হয়েছে পুরোদমে, শান্তিনিকেতনেনয়, জোড়াসাঁকোয়। এর মধ্যে অনেকটা তৈরি হয়ে নিয়েছে রাণু। পার্ট সব মুখস্থ, অভিব্যক্তির তালিম দেন কবি নিজে। শিক্ষক হিসেবে তিনি কড়া, বকুনি দিতেও ছাড়েন না। রাণুর সবচেয়ে মুশকিল, সে ভেবে পায় না কী করবে হাত দুটো নিয়ে। কেমন যেন শক্ত হয়ে পাশে ঝুলে থাকে। কবি তার হাত ধরে বুঝিয়ে দেন, কি জয়সিংহ— কোথা জয়সিংহ—কেহ–কেহ নাই এ সংসারে বলতে বলতে ডান হাত ছুড়তে হবে জোরের সঙ্গে। বাঁ হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা ফুলের সাজি।

জয়সিংহ ও অপর্ণার একটি দৃশ্যের মহড়া যে কতবার হল তার ইয়ত্তা নেই।

কবি : কেবলি একেলা! দক্ষিণ বাতাস যদি
বন্ধ হয়ে যায়, ফুলের সৌরভ যদি
নাহি আসে, দশদিক জেগে ওঠে যদি
দশটি সন্দেহ সম, তখন কোথায়
সুখ? কোথা পথ? জানো কি একেলা কারে
বলে?

রাণু : জানি। বসে আছি ভরা মনে
দিতে চাই, নিতে কেহ নাই।

কবি : সৃজনের
আগে দেবতা যেমন একা। তাই বটে!
তাই বটে! মনে হয় এ জীবন বড়ো
বেশি আছে- যত বড় তত শূন্য, তত
আবশ্যকহীন

রাণু : জয় সিংহ, তুমি তুমি
একা! তাই দেখিয়াছি, কাঙাল যে-জন
তাহারো কাঙাল তুমি! যে তোমার সব
নিতে পারে, তারে তুমি খুঁজিতেছ যেন…

কবি : আয় সখী
চিরদিন চলে যাই দুই জনে মিলে
সংসারের পথ দিয়ে, শূন্য নভস্তলে
দুই লঘু মেঘখণ্ড সম…

এ বাড়িতে সব সময় জনসমাগম, তাই রিহার্সাল হয় পাশের বাড়িতে। কবির খুড়তুতো ভাইরা ব্রাহ্ম হননি, গগন, অবন, সমর তিনজনেই ভাল শিল্পী, রবিকাকার যে কোনও কাজে তারা যোগ দেন, নাটকের ব্যাপারে খুবই উৎসাহ। রাণু রিহার্সালের ফাঁকে ফাঁকে আইসক্রিম কিনে খাবার জন্য পালিয়ে যায়। তা নিয়ে খুব মজা করেন তিন ভাই! এক একজন হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেন, অপর্ণা কোথায়, অপর্ণা পালিয়েছে! অপর্ণা উধাও।

তখন তাকে খুঁজে আনবার জন্য কয়েকজনকে পাঠাতে হয়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে আসেন মহড়া দেখতে। সকলেরই বেশ দৃষ্টি পড়ে থির বিজুরির মতন অপরূপ রূপ লাবণ্যবতী এই কিশোরীটির দিকে। জগদীশচন্দ্র বসু ডেকে জিজ্ঞেস করেন তার পিতৃপরিচয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাশে বসিয়ে একদিন এমন গল্প করতে লাগলেন রাণুর সঙ্গে যে রাণুর পার্ট এসে গেছে, তাকে ডাকাডাকি করা হচ্ছে, শরৎচন্দ্র তবু তাকে ছাড়ছেন না।

মহড়া শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ গল্পগুজব ও পানাহার চলে। কিন্তু কবি আর সেখানে নিজে থাকেন না, রাণুকেও থাকতে দেন না।

তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন নিজের ঘরে।

সে রকম ফেরার পথে কবি একদিন বললেন, এবারে তোমার কী যেন একটা পরিবর্তন দেখছি রাণু। তোমাকে যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে।

রাণু বলল, আমাকে আবার অন্যরকম দেখাচ্ছে কী করে? আমি তো সেই একই রকম আছি।

কবি বললেন, তোমাকে দেখে অনায়াসে বলা যায়, ওগো, তুমি পঞ্চদশী, পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।

রাণু বলল, আমি বুঝি চাঁদ? আগে কেউ আমার চাঁদপানা মুখ বললেই আমার রাগ হত।

কবি বললেন, না, তুমি চাঁদ নও। তুমি তুমিই।

মৃদুস্মিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে। কচিৎ জাগরিত বিহঙ্গ কাকলি তব নব যৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে। রাণু, শুধু যেন তাই-ই নয়। তোমাকে আরও অন্যরকম লাগছে।

রাণু বলল, ভানুদাদা, আমি সারাজীবনে তোমার কাছে একটুও বদলাব না। একই রকম থাকব।

মূল অভিনয়ের দু’দিন আগে হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেল রাণুর। বাড়াবাড়ি রকমের রিহার্সালে কাবু হয়ে পড়ল, কবি বললেন, আজ রিহার্সাল না দিলেও চলবে। তুমি চুপটি করে শুয়ে থাকো, খবর্দার উঠবে না একবারও।

জোড়াসাঁকোর বাড়ির তিনতলায় একটি ঘরে শুইয়ে রাখা হল রাণুকে। কেউ তাকে ডাকবে না, বিরক্তও করবে না।

রক্তপদ্ম রঙের শাড়ি পরে আছে রাণু, শুয়ে আছে পাশ ফিরে, এক রাশ চুল বিছানার ওপর মেলা। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ঘরের মধ্যে আধো-অন্ধকার। একজন নাপতেনি হেঁটে আসছে দালান দিয়ে, জানলার ফাঁকে সেই ঘরের মধ্যে চোখ পড়তেই সে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, ওমা!

অন্য একজন দাসী তাই শুনে কাছে আসতেই সে কাপতে কাঁপতে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখো দ্যাখো,নতুন বউঠান!নতুন বউঠান এসে শুয়ে আছেন।

আরও কয়েকজন এসে উঁকিঝুঁকি মারল। তারাও বলল, হ্যাঁ আচমকা দেখে নতুন বউঠান মতনই মনে হয় বটে। ভয় পাবারই কথা।

কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল রাণুর, সে কিছুই বুঝতে পারল না।

রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই পল্লবিত হয়ে কবির কানে ঘটনাটি পৌঁছোল।

তিনি এসে দেখলেন, রাণু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ একজন বিজলি বাতি জ্বেলে দিয়েছে। নিশীথ কুসুমের মতন তার মুখখানি স্বপ্ন মাখা।।

কবি তার শিয়রের কাছে বসলেন।

একই রকম মাথার চুল। সে রকমই ললাট। ভুরু ও চোখ দুটিও যেন অবিকল। নাক…তবে ঠোঁটের তলা থেকে অন্যরকম। রাণুর চিবুক আর নতুন বউঠানের চিবুকে কোনও মিল নেই। সব মেয়েদের শুয়ে থাকার ভঙ্গিই কি একরকম? ঘুম আর জাগরণের সময় মেয়েদের চেহারাও অনেক বদলে যায়। ঘুমন্ত নারী যেন মায়া দিয়ে গড়া।

কবি মনে মনে ফিরে গেলেন তার সদ্য যৌবনের দিনগুলিতে। যে নক্ষত্রের আলো তাকে উদ্দীপিত করেছিল সেই সময়, তা লুপ্ত হয়ে গেছে বহুকাল। তাঁর জীবনের এই সন্ধ্যালগ্নে সেই নক্ষত্রই যেন আবার ফিরে এসেছে।

তিনি নিম্ন স্বরে উচ্চারণ করলেন, এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারার বেশে…

রাণু চোখ মেলে দেখল, ভানুদাদা তার একটি হাত ধরে বসে আছেন। মুখখানি বিধুর। যেন ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছেন খুব।

ধড়মড় করে উঠে বসে সে বলল, কী হয়েছে ভানুদাদা?

কবি বললেন, কিছু হয়নি তো। তোমাকে দেখছি।

রাণু আবার জিজ্ঞেস করল, খানিক আগে জানলার কাছে কয়েকজন কী যেন বলাবলি করছিল। কী হয়েছে, বলুন না?

কবি বললেন, আমার আগে ওরাই ঠিক বুঝে ফেলেছে। আমারও একটু একটু মনে হচ্ছিল। তুমি তো হঠাৎ বেশ বড় হয়ে গেছ, এখন তোমার সঙ্গে নতুন বউঠানের মুখের অনেকখানি আদল।

রাণু জানতে চাইল, নতুন বউঠান কে?

কবি বললেন, আমার এক অতি আপন বউঠান, তুমি আর তার কথা জানবে কী করে? সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গেছেন অনেকদিন আগে। তিনি প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন খুব কম বয়েসে, আমিও তখন ছোট, দুজনে একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছি। এ বাড়িতে আমার সঙ্গেই ছিল তার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব। জ্যোতিদাদা কাজেকর্মে খুব ব্যস্ত থাকতেন, আমরা দুজনে একসঙ্গে সময় কাটাতাম, কত গান, কত কবিতা, কত খেলা। আজ হঠাৎ মনে হল, সেই নতুন বউঠানই যেন তোমার মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছেন আমার কাছে।

রাণু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, মোটেই আমি নতুন বউঠানের মতন নই। আমি রাণু, আমি ঠিক আমার মতন!

কবি বললেন, তা ঠিক। তুমি শুধু নতুন নও, তুমি অভিনব!

রাণুর কপালে তিনি হাত রাখলেন। বেশ জ্বর এসেছে তার।

বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে টিকিট বিক্রি করে এম্পায়ার থিয়েটারে বিসর্জনের অভিনয় হবে তিন দিন। ডেঙ্গু জ্বরের জন্য প্রথম দিনটিতে রাণুর অভিনয় করা হল না, অন্য একজনকে দিয়ে কাজ চালিয়ে দেওয়া হল।

দ্বিতীয় দিনে রাণু জেদ ধরল, সে স্টেজে নামবেই। জ্বর গায়েই সে স্নান করল, ভাত খেল। মেকআপম্যান দুজন, নন্দলাল বসু আর সুরেন কর। তাঁরা আগে কবিকে সাজালেন। জাদুবলে যেন সেই ষাট বৎসর বয়স্ক কবি হয়ে উঠলেন নবীন যুবা, একেবারে দেবদুর্লভ কান্তি। সবার সামনে রাণু কবিকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, আমার ভানুদাদাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! এমনটি আর কেউ নেই!

দিনু ঠাকুর হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, রাণুর ভানু! রবিদাদা, সাবধান! অভিনয়ের সময় এ মেয়ে যেন তোমায় ভানুদাদা বলে ডেকে না ওঠে!

রাণু বলল, মোটেই আমার সে রকম ভুল হবে না।

অবন বললেন, যদি হয়ও, থেমে গিয়ে যেন জিভ কেটে ফেলোনা! গড়গড় করে চালিয়ে যাবে!

কোমরবন্ধ ঠিক করতে করতে কবি নন্দলালকে বললেন, এককালে আমিও ছবি-টবি আঁকতুম। রাণুকে আমি নিজে সাজাব, কেমন হয় তোমরা দেখো!

রাণুকে তিনি নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। তার গালে রঙের পোঁচ দিতে দিতে কবি বললেন, রোজ তুমি আমার চুল আঁচড়ে দাও, আজ আমি তোমার চুল আঁচড়ে কেমন সুন্দর খোঁপা বেঁধে দেব দেখবে।

রাণু বলল, খোঁপা বাঁধতে হবে না, চুল খোলা থাক।

কবি বললেন, এত বড় চুল, খোলা রাখলে তুমি বসবার সময় নিজের চুলের ওপরেই বসে পড়বে। তারপর হঠাৎ উঠতে গিয়ে পড়বে ধড়াম করে!

রাণু বলল, না। আমি সাবধানে থাকব। গ্রামের মেয়েরা তো চুল খোলাই রাখে!

কবি বললেন, তুমি যেন কত গ্রামের মেয়ে দেখেছ!

কবি আবার তার খোঁপা বাঁধলেন, আবার খুলে দিলেন। খোলা চুলেই রাণুকে মানাচ্ছে ভাল।

মুখ ও ওষ্ঠ রঞ্জিত করে, ভুরু এঁকে কবি তাকে বললেন, নাও, এবার শাড়ি পরে নাও। কুঁচি দিও না।

নাটক তো জমজমাট হল বটেই, ঘনঘন করতালি ধ্বনি থামতেই চায় না। টিকিট কেটে বিশিষ্ট দর্শকরা তো শুধু ‘বিসর্জন’ দেখতে আসেনি, অনেকেই এসেছে শুধু কবির অভিনয় দর্শন করতে। কিন্তু অপর্ণাবেশী রাণুও কম হাততালি পেল না, এ মেয়েটি ঢুকলেই যেন মঞ্চ আলোকিত হয়ে যায়। সবাই কানাকানি করে, এই মেয়েটি কে? ঠাকুরবাড়ির কারও কন্যা?

অভিনয় শেষে কৌতূহলীরা ঘিরে ধরলেন রাণুকে। অল্পবয়েসী ছেলেরা তার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

কবি তার সময় দিলেন না, রাণুকে নিয়ে থিয়েটার হল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি। একটা হুড খোলা হাওয়া গাড়িতে ফিরতে লাগলেন জোড়াসাঁকোয়।

কবি বললেন, সবাই তোমার এত প্রশংসা করেছিল, তাতে খুব গর্ব হচ্ছিল আমার। আজ তোমার পার্ট রিহার্সালের চেয়েও অনেক ভাল হয়েছে।

রাণু বলল, ভাল আবার কী! আপনার এত সুন্দর লেখা সব লাইনগুলো শুনলেই তো লোকের ভাল লাগবে। হ্যাঁ, বলতে পারেন,

পার্ট ভুলে যাইনি!

কবি বললেন, লেখা যেমনই হোক, নাটকে অভিনয় ভাল না হলে, মানুষের মর্ম ছোঁয় না।

রাণু বলল, সবই তো আপনার শেখানো!

কবি বললেন, শেখালেই কি সবাই ঠিকঠাক পারে? নিজস্বতাও থাকা চাই। তোমার যে জ্বর হয়েছিল, বোঝা যায়নি একটুও। মুখখানা জ্বলজ্বল করছিল, কী রকম আপনি আপনি কাঁদলে! তবে, একবার চুলের ওপর বসে পড়েছিলে!

রাণু বলল, আছাড় তো খাইনি।

তারপর সে জিজ্ঞেস করল, আপনি যে নতুন বউঠানের কথা বলছিলেন, তিনি কখনও আমার মতন নাটকে অভিনয় করেছেন আপনার সঙ্গে?

কবি বললেন, হ্যাঁ। একবার অলীকবাবু প্রহসনে আমি সেজেছিলাম অলীকবাবু, আর নতুন বউঠান হেমাঙ্গিনী। আর একবার মানময়ী’ নাম দিয়ে একটা গীতিনাট্য হয়েছিল, তাতে আমি মদন, আর উনি উর্বশী।

রাণু বলল, উর্বশী? খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন বুঝি?

কবি বললেন, তোমারই মতন।

রাণু আবার জিজ্ঞেস করল, তিনি গান গাইতে পারতেন?

কবি বললেন, সেটাও তোমার মতন। গান ভালবাসতেন খুব, তেমন গানের গলা ছিল না।

রাণু কবির চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করল, অভিনয় কেমন করতেন? আমি তাঁর থেকে ভাল করিনি? ভানুদাদা, বলুন, আমি বেশি ভাল করিনি?

কবি হাসতে লাগলেন প্রাণখুলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *