একটি লতা, আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে থাকে গাছটাকে– নবিতুন বুঝি তেমনি এক লতা। আঁকড়ে থাকে, আগলে রাখে কদমকে।
দিনগুলোও কেমন ফুরফুর করে চলে যায়। নবিতুনের মনে হয় বড় তাড়াতাড়ি কাটে দিন। আর দিন যত ফুরোয় উদ্বেগ বুঝি বেড়ে যায় নবিতুনের। নবিতুনের লতায় বাঁধনটা আরো শক্ত করে ঘিরে রাখে কদমকে।
প্রথমেই ঘরের কাজে হাত দিয়েছে কদম। নতুন চাল তুলেছে। চালের উপর নতুন ছন বিছিয়েছে। ঘুণে খাওয়া পালাগুলো পাল্টিয়ে নতুন পালা লাগিয়েছে।
পাকা বাঁশের বেড়া। দশ বছরেও তার কিছু হবার কথা নয়। তবু এখানে সেখানে দু-চারটি মেরামত লাগে। মেরামত করে আর তাজ্জব বনে যায় কদম। পাঁচটি বছরে একবারও কি ঘরটি মেরামত করার দরকার মনে করেনি নবিতুন? ভাগ্যিস একেবারে ঠেসে চার-পাঁচ আস্তর ছন লাগিয়ে গেছিল কদম। নইলে এমনি ছাউনি তো দুবছরের বেশি টেকে না।
নিজের কাজকর্মগুলো সেরে নবিতুনও আসে। ছুঁড়ে দেয় ছনের গোছা, বেতের আঁটি, এগিয়ে দেয় দা-টা, কঞ্চিটা।
হ্যাঁ রে নবিতুন। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি বলেই তো জানতাম। চালের উপর থেকে নামতে নামতে বলে কদম।
বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নবিতুন।
চালগুলো সব পচে ঝুরঝুর করছে। ঘুণে খেয়েছে পালাগুলো ঝাঁঝরা হয়ে রয়েছে। মাটির তলায় গোড়াগুলো গেছে পচে। এ ঘর তো যে কোন দিন ভেঙে পড়তে পারত তোর মাথায়? ছেনি দিয়ে বেতের বুকটা আলগা করে আর বলে কদম।
নবিতুন একটা বেত দুফার করে এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
ঘরটা মেরামত করিসনি কেন রে? হঠাৎ শুধায় কদম।
কিছুই বলে না নবিতুন।
ওকে নিরুত্তর দেখে মুখ তুলে তাকায় কদম। একটা গোটা বেতের মুখ দার বুকে রেখে আস্তে-আস্তে ঠেলে চলেছে নবিতুন। বেতটা দুফার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দুদিকে। কাজে বুঝি গভীর মনোযোগ নবিতুনের।
কিছুক্ষণ ওর নিবিষ্ট মুখটাকে দেখল কদম। বলল, এত টাকা পাঠালাম, আসল কামটাই করাসনি তুই?
আয় আয় কুক কুক তি-তি-তি। হাতের কাজটা ফেলে মোরগগুলোকে ডাকতে উঠে যায় নবিতুন। মোরগগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কেমন ধন্ধ লেগে যায় কদমের। টাকারই যদি কমতি পড়ত তবে লিখে জানায়নি কেন নবিতুন? এসব নিয়ে আরো দুএকদিন আলাপের চেষ্টা করেছে কদম। আজকের মতোই অন্য কাজের বাহানায় নিরুত্তরে উঠে গেছে নবিতুন।
এও এক ধন্ধ– কদমের একটা চিঠিও পায়নি নবিতুন। এমন হয়নি কোন বার। এবার কেমন করে হলো ভেবে পায় না কদম। পোস্টমাস্টারকে শুধিয়েছিল কদম। মুখের ভ্যাংচি কেটে উলটো শুধিয়ে ছিল পোস্টমাস্টার, মিঞা, ঠিকানা ঠিক লিখেছিলে তো?
আমার বাড়ির ঠিকানা, আপনার বরাবর। তাতে ভুল হবে? বলেছিল কদম। ঠিক বাক্সে ফেলেছিলে তো? আবারও শুধিয়েছিল পোস্টমাস্টার। পোস্টমাস্টারের বে-আক্কুলে কথায় চটে গিয়েছিল কদম। চটে গিয়ে বলেছিল, এত বছর বিদেশ করলাম, পোস্টবার চিনব না?
তবে চিঠি আসবে না কেন?
আলবত এসেছে। তোমার মাগটারে শুধিয়েছ? সে কি কয়?
সে তো কয় না কিছু। তবে চিঠি পায়নি, এটা বোঝা যায়।
ও, কয় না কিছু, তাই না? চোখটাকে কি এক বাঁকা ঠারে নাচিয়ে নেয় আর হাসিটাকে ঠোঁটের বাঁকা রেখায় কেমন করে ধরে রাখে পোস্টমাস্টার। আচমকা গায়ে যেন কাঁটা ফোটে কদমের।
কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিল কদম। গেছিল লুন্দর শেখের সাথে দেখা করতে।
এলি অনেক দিন পর আরাম-টারাম করে নে। তারপর ধীরে-সুস্থে সব কথাই হবে। সালামালেক, পান-তামাকের পর বলেছিল লুন্দর শেখ। কি সব কথা? ধন্ধ লেগে গেছিল কদমের। পোস্টমাস্টারের চোখের বাঁকা ঠার যেন লুন্দর শেখের মুখেও।
কি সব কথার পর টাকার কথা, চিঠির কথা শুধায়নি কদম। উঠে আসবার সময় বলেছিল লুন্দর শেখ– যাচ্ছি শহরের মামলার তদবিরে। মাসেক বোধহয় থাকতে হবে। ফিরে এসে হবে সব কথা। আর বলেছিল, বৌটার ওপর একটু নজর রাখিস।
নজর? নবিতুনের ওপর নজর রাখবে কদম? কদমের মনে হয়েছিল ওর মাথার ভেতর কি যেন এক হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে চলেছিল সেদিন।
লুন্দর শেখের কি সব কথার আভাস, পোস্টমাস্টারের বাঁকা ঠারের, হুম, কদমের মনের ধন্ধটা শুধু বাড়িয়ে দেয়। কি যেন ঘোঁট পাকিয়ে উঠেছে চারদিকে। ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে না কদম।
নবিতুনকে শুধায় কদম– হ্যাঁরে বৌ, আমার চিঠি না হয় পাসনি তুই, তা বলে তুই চিঠি দিলি না কেন?
নারকেল কোরাচ্ছিল নবিতুন। কোরানির আগার দিকেই চোখ জোড়া নিবদ্ধ ওর। সারেংয়ের কথাটা শুনে চমকে গেল। ওর আনত মুখটা আরো ঝুঁকে গেল কোরানির দিকে। কিছুই বলে না নবিতুন।
নবিতুন ভাবে, কেন এমন নিষ্ঠুর ঠাট্টা করে লোকটা?
স্থির নজরে ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে কদম। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে যেমন করে দেখত সাগরটাকে। হঠাৎ কি যেন মনে করে মনে-মনেই হেসে উঠে কদম। নরম স্বরে শুধায় আবার– আমার চিঠি না পেয়ে গোসা করেছিলি বুঝি?
এবারও নীরব নবিতুন।
কদমের মনে হলো চোখ জোড়া যেন তুলতুলিয়ে এসেছে নবিতুনের! একটু পরেই অবশিষ্ট নারকেল মালাটা আর কোরানিটা হাতে লয়ে চলে গেল নবিতুন।
কী এক অভিমানে ভার ভার নবিতুনের চলা। পেছন থেকে মনে হয়, একটু যেন মোটাও হচ্ছে ও। ওর সেই ভারি ভারি পা চলার দিকে তাকিয়ে এবারও হাসি পেল কদমের। এত রাগও করতে জানে নবিতুন? গোসা করে এতটা বছর চিঠি দেয়নি ওকে?
কিন্তু ধন্দটা যায় না কদমের মন থেকে। ধন্ধটা যেন ক্রমেই ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে মনের ভেতর।
ধন্দটা কেবলি ঘোঁট পাকায় কেননা অনেকের নেপথ্য কথা কানে এসে ধাক্কা খায়। সব কথা যা বলেনি লুন্দর শেখ, কোটনা-কুটনীর চোখের ঠারে বাঁকা হাসিতে ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে সে সব কথাই ধন্দটা কেবলি ঘোঁট পাকায় কেনো নবিতুন রেগে ওঠে না, প্রতিবাদ করে না। নবিতুন নীরব।
একদিন রেগেই গেল কদম। রেগেমেগেই বলল, মাইনষে যে এত কথা বলে কানে যায় না তোর। তুই কি বয়ড়া?
নিরুত্তর নবিতুন। মাইনষে কি বলে না বলে ওতে যেন কিছুই আসে যায় না ওর। পাটিপাতা রঙ মুখের কাজল রঙ দুটো চোখ। চকিতে বুলিয়ে যায় কদমের মুখটা। যেন শুধায়, তুমি কি বলো? তারপর চলে যায় নিজের কাজে।
ধন্দাটা বুঝি কেবলি ঘোঁট পাকিয়ে যায় কদমের মনের ভেতর।
হাঁস-মুরগির ময়লা সাফ করতে করতে ভাবে নবিতুন, সাগর পাড়ের সেই বিদেশিনীরা এবার সত্যি সত্যিই তুক করেছে ওর সারেংকে। নইলে একি নিষ্ঠুর তামাশা সারেংয়ের? অথবা সাগরের পানিতে এবার কাণ্ডজ্ঞানটাকেই বুঝি ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে লোকটা।
ছিলে নেয়া বেতগুলো আঁটি করে বাঁধল কদম। আঁটিগুলো সরিয়ে রেখে ডাকল আককিকে, আককি, তোর মাকে বল আমি গোসল করতে চললাম। গোসল সেরে খেতে বসল কদম। খেতে বসে সেই বদনা আর সেই বর্তনগুলোর কথাই আবার মনে পড়ে কদমের।
বাড়ি এসে প্রথম প্রথম কিছুই লক্ষ্য করেনি কদম। ক্রমেই ওর মনে হতে লাগল কি যেন নেই যা ছিল। নেই পেতলের বদনাটা। নেই ওর সখের কেনা এক জোড়া চীনামাটির বর্তন। নেই এনামেলের বাটিটা। ঘি রঙের গামলাটাও নেই।
এক একবার বিদেশ করে ফেরার সময় সময় এক একটা জিনিস নিয়ে আসত কদম। এমনি করে এই সখের সম্পত্তি জমেছিল ওর। সেই সখের জিনিসগুলো না দেখে ক্ষুব্ধ হয়, তাজ্জব হয় কদম।
বাড়িতে কি চোর ঢুকেছিল? শুধায় কদম।
আল্লায় না করুক, চোর ঢুকতে যাবে কেন? বলল নবিতুন।
তবে জিনিসগুলো কোথায়?
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে নবিতুন আর এক করসুল সালন তুলে দেয় কদমের পাতে।
কোন জিনিসগুলোর কথা বলছে বাপজান সেটা ধরে উঠতে বোধহয় একটু সময় লাগে আককির। ধরতে পেরেই পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে — ওমা, ওগুলো যে বিক্রি করেছে। চৌধুরীবাড়ি… কথাটা শেষ করতে পারে না আককি। দাঁত কটমটিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছে নবিতুন।
বিক্রি? কেনরে? আককির কাছ থেকেই যেন উত্তরটা চায় কদম। মায়ের মেয়ে আককি। বাপের প্রশ্ন গ্রাহ্যেই আনে না ও।
পাতের ভাতটা নীরবে শেষ করে উঠে যায় কদম।
শুধু ঘোঁট পাকিয়ে চলেছে মনের ধন্দ। কোন মীমাংসা পায় না কদম। সাগরের কোলে ফেরার দিনটাও বুঝি এগিয়ে আসছে কদমের! আর কঠিন হচ্ছে নবিতুনের পাটিপাতা চিকন হাতের বাঁধনটা। ওকে আগলে রাখে নবিতুন, চোখের বাইরে যেতে দেয় না।
সাগরের মানুষ কদম। ডাঙার মানুষের মতো হুট করে কিছু করে না, ফস করে রাগে না। মনের ধন্দটাকে নাড়াচাড়া করে মনের ভেতর। নানাজন ডাকে, মিঞা যে একেবারে বৌর মধুতে ডুবে রইলে? আস না পান তামাকটা খেয়ে যাও। যাবে বলেও যায় না কদম। নবিতুনের নরম লতার বাঁধনটা ছিঁড়ে ঘরের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না ওর।
কিন্তু ঘরের ভেতরেও যে অনেক কথা কানে এসে লাগে। কিছু আসে বাতাসে ভেসে। কিছু আসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে। এ কান দিয়ে শোনে কদম। বের করে দেয় ও কান দিয়ে। তবু সব কথাই কি বেরিয়ে যায়? অনেক কথাই যে গেঁথে থাকে বুকের ভেতর।
হুট করে কিছু করে না কদম, ফস করে রাগে না– সবই সত্য। কিন্তু বুকের ভেতর কি যেন পাক খেয়ে ওঠে। পাক খেয়ে খেয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাইয়ের তলায় আগুনের মতো।
ছেলেটার হাত ধরে হাসতে হাসতে আসে শরবতি। নবিতুনের সুখে যেন ওরই সুখ। হাসিটাকে পড়তে দেয় না ঠোঁট থেকে।
এত হাস কেন? শুধায় নবিতুন।
হাসি তোমার রঙ্গ দেখে।
শরমে মাটির সাথে মিইয়ে যায় নবিতুন। নবিতুনের সাজগোজ, পাউডার স্নো-গন্ধতেল– এসব নিয়েই বুঝি ওকে লজ্জা দিচ্ছে শরবতি।
কিন্তু না, শরবতি ওদিক দিয়েই গেল না। শরবতি বলছে, বলি লোকটাকে কি গুণ করলে। নাকি তাবিজ-টাবিজ নিলে। লোকটা যে ঘর থেকেই বের হয় না।
খুশি হয়ে ওর পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় নবিতুন।
নাগো বুয়া, ঠাট্টা নয়। তুমি একটা তাবিজ নাও, ওকেও একটা দাও। আর কতকাল বিদেশে ঘুরবে? এবার বেশ ভারিক্কি হলো শরবতি। শরবতির কথায় নবিতুনের মনে চাপা দেওয়া উদ্বেগটাই বুঝি খচ করে ঘাই মারে। যতই দিন ফুরাচ্ছে ততই তো ঘনিয়ে আসছে সারেংয়ের যাবার দিনটি।
এক ফকির আছে আমার শ্বশুরবাড়ির কাছে। বড় নাম-ডাক। তাবিজ তার মোক্ষম। বলো তো আনিয়ে দেই একজোড়া। নির্দিষ্ট একটা প্রস্তাবই দিয়ে ফেলল শরবতি।
শুনি না শুনি করে চুপ করে গেল নবিতুন। সারেংয়ের যাবার প্রসঙ্গটা উঠলেই মুখ দিয়ে কথা সরে না ওর। অনেক সিংগি মাছের কাঁটা যেন ঘাই মেরে চলে বুকের ভেতর। ব্যথায় যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে ওঠে বুকটা। রসিকঘরও বটে ঢেঁকিঘরও বটে– বড় ঘরের সেই অংশটা, ওটাকে আলাদা করছে কদম। পৃথক ভিটিতে নতুন চাল নতুন ঘর বানিয়েছে ও। বড় ঘর হলো শোবার ঘর, থাকার ঘর। তার আলাদা ইজ্জত। কাজ-কামের ঘর, সে থাকবে পৃথক, একটু দূরে। সেটাও একটা ইজ্জত। দেখতেও সুন্দর। দুটো ঘরই পাশাপাশি। ব্যবস্থাটা পছন্দ হয়েছে নবিতুনের। বড় হিস্যার কাছে ওর মুখটা আর ছোট হয়ে থাকবে না।
নতুন ঘরটার বেড়া বাঁধছে কদম। কদম ঘরের ভেতর। বাইরে ফুটো দেখে দেখে বেতের মুখগুলো ঘুরিয়ে দিচ্ছে আককি।
দুটো ঘর হলো– বেশ হলো, না? নবিতুনের দিকে মুখটা ফিরিয়ে বলল কদম।
ঘর লেপছে নবিতুন। মুখটা না তুলেই সংক্ষেপে বলল, হুঁ।
বেড়ার ওপারে আককি ভাবল কথাটা বুঝি তার উদ্দেশ্যে! ও বলল, খুব ভালো হয়েছে বাবা। বুচি খালি খোঁটা দিত আমায়।
বুচি বড় হিস্যার শরবতির ভাই-ঝি।
এবার হলো দুটো। পরের বার হবে তিনটি। গাই কিনে দেব তোকে। তার জন্য একটা গোয়ালঘর লাগবে না? নবিতুন যদি কিছু বলে সে জন্য একটু থামল কদম। থেমে বেত বাঁধতে বাঁধতে আড়চোখে একবার তাকাল ওর দিকে।
নবিতুন কিছু বলে না। একমনে ভেজা ন্যাতাটা বুলিয়ে চলেছে মাটির ওপর।
তার পরের বার যখন আসব তখন তুলব আর একটি ঘর। মোট হবে চারটে। বেশ হবে। কথার ভেতর খুশি ঢেলে দিল কদম।
না। নবিতুনের মুখ দিয়ে যেন আচমকা একটা বাজি ফুটে গেল।
না কেনরে? অবাক হয়েই শুধায়ে কদম।
কেনর কোন জবাব দেয় না নবিতুন। আঙুল দিয়ে মাটির দলাগুলো ভাঙে। পানির ছিটা দেয়। কাদা কাদা মাটিটা সমান করে লেপে দেয় ভিটির গায়ে। তারপর ভেজা ন্যাতাটা জোরে জোরে টেনে চলে। ওর হাতের স্পর্শে সুন্দর মসৃণ হয়ে ওঠে লেপা মাটির মুখটা।
মা, মা, তুমি আস এবার– বেড়ার উলটো দিক থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ করছে আককি। সেই কখন থেকে বেত এগিয়ে দিচ্ছে, বেড়াটাকে ঠেলে রাখছে, বাঁশের লম্বা লম্বা কঞ্চিগুলোকে। হাত দিয়ে চেপে রাখতে হচ্ছে ওকে। বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আককি।
এই বেড়াটাকে চেপে ধর। ঘরের ভেতর থেকে বলল কদম।
দুহাতের ঠেলা দিয়ে বেড়াটাকে চেপে রাখল আককি।
পাল্লার উপর পা রেখে মাথাটাকে পেছনে হেলিয়ে যতটা জোরে সম্ভব বেতের দুদিকের আগা ধরে টান দিল কদম। কাঁককড় করে বাঁকিয়ে গেল তরজার বেড়াটা। ঠুস করে ছিঁড়ে গেল বেতটা।
ধুস শালা। পিছন দিকে পড়তে পড়তে সামলে নেয় কদম।
বেড়ার ওদিক হাসি চাপতে গিয়ে কুক কিক কিক বিচিত্র সব শব্দ বেরিয়ে আসে আককির গলা দিয়ে।
কিরে হাসিস কেন? এদিক থেকে শুধায় কদম।
শালা কাকে বলবে বাবা? এবার আর হাসিটা চেপে রাখতে পারে না আককি।
তোর মামাকে। বলে কদম। তারপর বাপ-ঝিয়ে গলা মিলিয়ে হাসে। বাপে ঝিয়ের হাসিতে যোগ দেয় নবিতুন। নবিতুন চুপ। ঘর লেপা ন্যাতা আর অবশিষ্ট মাটিটুকু বাইরে রেখে এলো ও। আড়চোখে নবিতুনের গম্ভীর মুখখানা একবার দেখে নিল কদম। আককির সাথেই কথাটা জারি রাখল কদম, জানিস মা? আমাদের চারখানি ঘর উঠুক তোর মার সেটা একটুও পছন্দ নয়!
কোন্ পক্ষে থাকা উচিত বুঝতে না পেরে আককি সংক্ষেপে বলে, হিঁ। ডাকে মাকে, আমি আর পারি না, আস না মা?
চার ঘর দিয়ে কামটা কি, শুনি? এক ঘর, তাতেইবা থাকে কে? ঘর তোলারও দরকার নেই, বিদেশ গিয়েও কাম নেই। হঠাৎ বাঁশ-চেরা আওয়াজ তুলে যায় নবিতুনের গলাটা।
কেমন যেন ফুঁসে ফুঁসে উঠছে নবিতুন। কাঁপছে ওর মুখের পেশিগুলো। চোখ বেয়ে এখনি যেন ঢল নামবে। তাজ্জব চোখ করে ওকে দেখে কদম। এমন বিস্ফারিত অভিমানে নবিতুনকে কখনও দেখেনি ও।
তার চেয়ে এককানি জমি কেন। স্বরটাকে এতক্ষণে শান্ত করে নিয়েছে নবিতুন।
এবার আসল কথাটা শুনে হেসে দেয় কদম। জমি আর গেরস্তির সেই পুরনো নেশা নবিতুনের। জমির টান দিয়ে ও বেঁধে রাখতে চায় কদমকে। গেরস্তির নেশা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চায় কদমের সমুদ্রের নেশাটা।
ধুৎ। বছর বছর নগদা আয় ফেলে জমিতে কে যায় রে? জমি কি আর আগের জমি আছে। জমি এখন বাঁজা গাছ। ওতে লাভ নেই। সব সময় যে উত্তরটা দেয় কদম, আজও তাই দিল।
মেয়েটাকে এবার ছাড় না? সেই কখন থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ করছে। জমির কথাটা আর বাড়াল না নবিতুন। জমির কথাটা নিয়ে বেশি টানাটানি করলে কেমন একরোখা হয়ে যায় সারেং। বরাবরই লক্ষ্য করেছে নবিতুন। আর একরোখা সারেংকে বড় ডর ওর।
বেশ, তুই আয়। যারে আককি যা। ছুটি পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আককি। নবিতুন এসে এগিয়ে দেয় বেতের মাথা।
একটার পর একটা বান বেঁধে যায় কদম। পালার সাথে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় নতুন বেড়া। কদম বেরিয়ে আসে দাওয়ায়।
তোমার সাথে কথা ছিল একটা। অনেকক্ষণ পর বলল নবিতুন।
হাতের ছেনিটা মাটিতে রেখে উন্মুখ হলো কদম। উন্মুখ ওর সব কয়টি ইন্দ্রিয়। খাড়া হলো ওর চোখ, ওর কান। বলল কদম, বল, বল নবিতুন। আমি যে তোর মুখ দিয়েই শুনতে চাই। বল তুই।
বলল নবিতুন। কিন্তু কদম যে কথা শোনার জন্য উদগ্রীব সে কথা নয়, অন্য কথা। নবিতুন বলল, মেয়েটা যে বিয়ের লায়েক হলো!
ও, এই কথা? কদম যেন ধপ করে বসে পড়ল।
কি যে কাণ্ড তোমার! কথাটা একদম গায়ে মাখলে না। আমি বলছি, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে এবার তোমার বিদেশে যাওয়া হবে না। বেশ জোর নবিতুনের কথায়।
কদম ভাবে ওকে দুটো দিন বেশি আটকে রাখবার এও এক ফন্দি নবিতুনের। মুখে বলে, এত জলদির কিরে?
লোকটা হিসেব-টিসেব কিছুই রাখে না? নবিতুনের বুঝি রাগ ধরে যায়। নবিতুন বলে, জলদি কি বলছ গো? এগারো পেরিয়ে বারোয় পা দিতে চলেছে মেয়ে।
কদম কি যেন ভাবল। বেতের টুকরো-টাকরি চেরা বাঁশের আগাছার মতো হাবিজাবিগুলো সরিয়ে ফেলে দিল বাইরে। তারপর একটা পিঁড়ি টেনে জুত হয়ে বসল কদম। বলল, মেয়েটাকেও পাঠিয়ে দিবি পরের বাড়ি। আমিও চলে যাব। কষ্ট হবে না তোর?
কদমের মুখেও যাবার কথা? এত সকালে? মুখটা ঘুরিয়ে নেয় নবিতুন। বুকের ভেতর সেই সিংগি মাছের কাঁটার ঘাই। সেই খচখচে যন্ত্রণা।
কিছুটা সময় চলে যায় চুপচাপ ছেনিটা লয়ে অকারণেই একটা মাটির ঢেলা কুপিয়ে চলে কদম। সরু এক ফালি বেত আঙুলে প্যাঁচায় নবিতুন। নবিতুনই ওর নীরবতাটা ভাঙল। আস্তে-আস্তে বলল, শরবতি বলছিল ওর চাচাতো দেওরের কথা। ঘর-গেরস্তি ভালই। দুভাই, এক শরিক। জমি আছে চার কানি, তুমি কি বলো? আমি বলি হলে সম্বন্ধটা খুবই…। থেমে যায় নবিতুন। আককি এসে পড়েছে দাওয়ায়। বেতুন পাকাচ্ছে আককি। বেতুন ভর্তি বাসনটাকে আর একটা বাসন দিয়ে ঢেকে ঝুকুর ঝুক ঝাঁকিয়ে চলেছে আর ছড়া বলছে ও :
আম পাকে জাম পাকে
মামা বাড়ির বেতুন পাকে।
হো হো করে হেসে দেয় কদম–দেখ তোমার মেয়ের কাণ্ড। মামা দেখল না জীবনে, কিন্তু মামা বাড়ির বেতুন পাকিয়ে চলেছে।
বাপের হাসিতে যেন উৎসাহটা বেড়ে যায় আককির। আরো জোরে ঝাঁকুনি দেয় ও, ঝুকুর ঝুক ঝুকুর ঝুক। আর ছড়া বলে :
আম ভালো জাম ভাল
তেঁতুল বড়
টক
বাপের বাড়ি হাত গেল পিঠ
গেল
মামা বাড়ির
পিঠায় বড় ঢক।
ঝুক ঝুক ঝুকুর ঝুক।
শুনছ বাপের বাড়ির কেমন বদনাম করছে মেয়েটা? হাত পিঠ সবই নাকি গেল মেয়ের।