প্রথম ভাগ
দ্বিতীয় ভাগ

১২. একজেকিউটিভ কাউন্সিলে লীগের যোগদান

দ্বাদশ অধ্যায়

একজেকিউটিভ কাউন্সিলে লীগের যোগদান

অন্তবর্তী সরকার নির্দিষ্ট সময়ে, অর্থাৎ দুসরা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, কার্যভার গ্রহণ করেন। কংগ্রেস খুবই উল্লসিত। পট্টভি সিতারামিয়া ঘোষণা করেন, ক’বছরের মধ্যেই ভারতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ আসুক না আসুক –তাতে কিছু যায় আসে না। কাফেলা চলতেই থাকবে। এখন আমাদেরকে এ ভূখন্ডের শাসন মনে করতে হবে। (I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan, p.277)

ভারতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ভারত এবং বৃটেনের বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেন। জিন্নাহ ২৫শে আগষ্ট অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এক বিবৃতি দান করেন। তিনি ভাইসরয়ের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, মুসলিম লীগকে যে নিশ্চয়তা দান করা  হয়েছিল এবং যে সব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল
, তার সিদ্ধান্ত সে সবের সাথে অসামঞ্জস্যশীল। নতুন সরকার যে দিন কার্যভার গ্রহণ করেন সেদসি মুসলমানগণ সমগ্র ভারতে তাদের গৃহে ও দোকানে কালো পতাকা উড্ডীন করেন।

বৃটেনের স্যার উইনস্টোন চার্চিল সরকারী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গৃহযুদ্ধ ব্যতীত সফল হবেনা। হিন্দুদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য ক্রিপস অন্যায়ভাবে তার প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন। পরে তিনি বলেন, বর্ণহিন্দু মিঃ নেহরুর উপর ভারত সরকারের দায়িত্ব অর্পণ মৌলিক ভুল হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম প্রণেতা লর্ড টেম্টল উড একটি মাত্র সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় সরকার গঠনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। লর্ড স্কার বরো ভবিষ্যদ্বানী করেন যে একটি দলেন হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে ভারত থেকে বৃটিশ সরকারের উপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করা হবে এবং তিনি আশা করেন যে তা প্রতিহত করা হবে। লর্ড ক্রাসবর্ণ জুন মাসে মুসলমানদের সাথে কৃত ওয়াদা ভংগ করে আগষ্টে কংগ্রেসকে সরকার গঠনের অনুমতি দেয়ায় সরকারের তীব্য সমালোচনা করেন। এভাবে বৃটেনের বিভিন্ন মহল থেকে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। (I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan, pp.277-278

অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর এক মাস অতিক্রান্ত হতে না হতে মুসলিম লীগ উপলব্ধি করে যে, সরকারের বাইরে অবস্থান মুসলিম স্বার্থের চরম পরিপন্থী। নীতিগতভাবে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ নীতি বলবৎ থাকবে। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং সেইসাথে দেশে শত্রুভাবাপন্ন একটি হিন্দু সরকার প্রতিষ্ঠা লীগকে তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করে। যতোদিন মুসলিম লীঘ বাইরে থাকবে, ততোদিন মুসলমানগণ দুর্গতি ভোগ করতে থাকবে। আইন শৃংখলার অবনতি ঘটছে এবং বহু অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নির্মূল হওয়ার আশংকা রয়েছে। কংগ্রেসের কোন মাথা ব্যথা নেই। হিন্দু সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে দুষ্কৃতিকারিগণ উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে। অতএব এমতাবস্থায় মুসলিম ভারত রক্ষার উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগকে অবশ্যই সরকারে যোগদান করতে হবে। জিন্নাহর মতে কোয়ালিশন সরকারের বাইরে থাকার চেয়ে ভেতরে থেকে ভালোভাবে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাস চালাতে পারবেন।

কোয়ালিশন সরকারে মুসলিম লীগকে পাওয়ার জন্যে ভাইসরয় স্বয়ং বড়ো আগ্রহান্বিত ছিলেন। কারণ তিনি ভবিষ্যৎ সংকট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ কারণে দীর্ঘ জটিল আলাপ আলোচনা চলতে থাকে একদিকে জিন্নাহ ও নেহরুর মধ্যে এবং অপরদিকে জিন্নাহ ও ভাইসরয়ের মধ্যে। অবশেষে ২৫ শে অক্টোবর ১৯৪৬, একজেকিউটিভ, কাউন্সিল নিম্নরূপে পুনর্গঠিত হয়ঃ-

কংগ্রেস

জওহরলাল নেহরু –(External Affairs and Common wealth Relations)

বল্লভ ভাই প্যাটেল –(Home, Information & Broadcasting)

মি. রাজা গোপালাচারিয়া –(Education & Arts)

আসফ আলী –(Transport & Railway)

জগজীবন রাম –(Labour)

মুসলিম লীগ

লিয়াকত আলী খান –(Finance)

আই আই চুন্দ্রিগড় –(Commerce)

আবদুর রব নিশতার –(Communications)

গজনফর আলী খান –(Health)

যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল –(Legislative)

সংখ্যালঘু

জন ম্যাথাই –(Industries & Supplies)

সি এইচ ভবা –(Works, Mines & Power)

বলদেব সিং –(Defence)

নেহরু কোয়ালিশস সরকারে মুসলিম লীগের যোগদান ভালো চোখে দেখেননি। তদুপরি দপ্তর বন্টনেও তিনি চরম একগুঁয়েমির পরিচয় দেন। ভাইসরয় চাচ্ছিলেন তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর যথা External Affairs, Home and Defence –এর যে কোন একটি মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। নেহরু এর চরম বিরোধিতা করেন। অবশেসে যে পাচটি দপ্তর মুসলিম লীগকে দেয়া হয় তার মধ্যে অর্থ (Finance) একটি। কংগ্রেস অর্থ বিভাগের দপ্তরটি মুসলিম লীগকে দিতে এ জন্যে রাজী হয়েছিল যে, তাদের বিশ্বাস ছিল এ দপ্তর চালাতে মুসলিম লীগ অপারগ হবে –বরঞ্চ চালাতে গিয়ে বোকা সাজবে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের এ সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তার সহকর্মীদের এ এক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উপভোগ্য আলোচনা করেছেন তা উপভোগ করার জন্য পাঠকবৃন্দের জন্য পরিবেশন করছি।

মাওলানা আজাদ বলেনঃ

যেহেতু লীগ সরকারে যোগদান করতে সম্মত হয়েছে, কংগ্রেসকে সরকার পুনর্গঠিত করতে হবে এবং এতে মুসলিম লীগ প্রতিনিধিদের স্থান করে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন কে কে সরকার থেকে সরে দাঁড়াবেন। মনে করা হলো যে, শরৎ চন্দ্র বসু, স্যার শাফায়াত আহমদ খান এবং সৈয়দ আলী জহির লীগ নমিনীদের স্থান করে দেয়ার জন্যে ইস্তাফা দেবেন। ভাইসরয়ের প্রস্তাব ছির যে স্বরাষ্ট্র বিভাগ মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। সর্দার প্যাটেল এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। আমার ধারণা মতে আইন শৃংখলা অবশ্যম্ভাবী রূপে একটি প্রাদেশিক বিষয় কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার যে চিত্রটি সামনে রয়েছে তাতে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সামান্য কিছুই করার আছে। অতএব নতুন সরকার কাঠামোতে কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। এ কারণে আমি লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবের পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু প্যাটেল একেবারে নাছোড়বান্দা। তিনি বল্লেন, আমি বরঞ্চ সরকার থেকে বেরিয়ে যাব কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়বনা।

আমরা তখন বিকল্প চিন্তা করলাম। রফি আহমদ কিদওয়াই প্রস্তাব করেন যে অর্থ মন্ত্রণালয় মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। তিনি আরও বলেন, এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কিন্তু এ একটি উচ্চমানের টেকনিকাল বিষয় এবং মুসলিম লীগের মধ্যে এমন কেউ নেই যে এ বিভাগ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবে। কিদওয়াইয়ের ধারণা মুসলিম লীগ এ দপ্তর গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। এতে কংগ্রেসের কোন ক্ষতি নেই। আর এ দপ্তর গ্রহণ করলে পরে তারা বোকা প্রমাণিত হবে।

প্যাটেল লাফ মেরে প্রস্তাবটির প্রতি তার অতি জোরালো সমর্থন জানান (Patel jumped at the proposal and gave it his strongest support)। আমি এ কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম যে অর্থ মন্ত্রণালয় হলো একটি সরকারের চাবিকাঠি এবং এ মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদেরকে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। প্যাটেল আমার বিরুদ্ধাচারণ করে বল্লেন যে, লীগ এ বিভাগ চালাতে পারবেনা এবং এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে বাধ্য হবে। আমি এ সিদ্ধান্তে খুশী হতে পারিনি। তবে সকলে যখন একমত, আমাকে তা মেনে নিতে হলো।

লর্ড ওয়াভেল জিন্নাহকে প্রস্তাবটি সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি পরের দিন জবাব দেবেন বলেন।

জিন্নাহরও সংশয় ছিল যে কেবিনেটে লীগের প্রধান প্রতিনিধি লিয়াকত আলী এ বিভাগটি চালাতে পারবেন কিনা। অর্থ বিভাগের কতিপয় মুসলমান অফিসার এ বিষয়টি জানার পর জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। তারা বলেন যে, কংগ্রেসের এ প্রস্তাব অচিন্তনীয় পাকা ফলের মতো এবং এতে লীগের বিরাট বিজয় সূচিত হয়েছে। …অর্থ বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ফলে সরকারের প্রতিটি বিভাগে লীগের কর্তৃত্ব চলবে। তারা জিন্নাহকে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে তার ভয়ের কোন কারণ নেই। লিয়াকত আলীকে সর্বপ্রকারে সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি তারা দেন যাতে যথাযথভাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

কংগ্রেস শীঘ্রয় উপলব্ধি করেছিলেন যে অর্থ বিভাগ লীগকে দিয়ে বিরাট ভুল করা হয়েছে। (Abul Kalam Azad: India Wins Freedom, pp.177-179)

এ প্রসংযগে চৌধুরী মুহাম্মদ আলী বলেনঃ

জুন মাসে যখন সর্বপ্রথম একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তখন কায়েদে আজম লীগের সম্ভাব্য দপ্তরগুলো সম্পর্কে আমার সাথে আলোচনা করেন। তিনি স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা (Home & Defence) বিভাগ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বল্লাম, আইন শৃংখলা ও পুলিশ প্রাদেশিক বিষয় যার উপর কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কংগ্রেস প্রদেশগুলো লীগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন পরোয়াই করবেনা। অনুরূপ মুসলিম লীগ প্রাদেশিক সরকারগুলো তার উপদেশ গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করবেনা। আমি বল্লাম যে প্রতিরক্ষা দপ্তর অবশ্যই লাভজনক। কিন্তু যদি লীগ প্রতিটি বিভাগে সরকারের নীতি-পলিসি প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে তার অর্থ বিভাগ নেয়া দরকার। আমি তখন তাকে অর্থ বিভাগের কৌশলগত গুরুত্ব বুঝাতে পারিনি। কিন্তু এখন ঘটনাচক্রে অর্থদপ্তর লীগের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আমাকে যখন পুনরায় ডেকে পাঠানো হয় তখন অত্যন্ত জোরালোভাবে আমার পূর্ব পরামর্শের পুনরাবৃত্তি করি। লীগের প্রধান প্রতিনিধি হিসাবে লিয়াকত আলীর উপর অর্থ বিভাগ অর্পিত হওয়ায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আমি সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার প্রস্তাব দিলা এবং কায়েদে আজম ও লিয়াকত আলী খান উভয়কেই সাফল্যজনক পরিণামের নিশ্চয়তা দান করলাম। আমার প্রস্তাব গৃহীত হলো এবং লিয়াকত আলী অর্থমন্ত্রী হলেন। (Chowdhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.84)।

কোয়ালিশন সরকার

লীগের প্রতি কংগ্রেসের পূর্ণ অনাস্থা ও বৈরাচরণেল কারণে কংগ্রেস চাইছিল নেহরুকে গোটা কেবিনেটের নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে। লীগ তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে লিয়াকত আলী খান স্পষ্টভাষায় বলেন, নেহরু কেবিনেটে কংগ্রেস দলের নেতা ব্যতীত আর কারো নেতান নন। সাংবিধানিক অর্থে সম্মিলিত দায়িত্ব অস্বীকার করলেও তিনি বলেন, লীগ মন্ত্রীগণ তাদের সহকর্মীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন শুধু মুসলমাদের স্বার্থেই নয়, বরঞ্চ ভারতের সকল অধিবাসীদের স্বার্থে।

সাম্প্রদায়িক হানাহানি বেড়েই চলছিল বিধায় ঐক্য ও সহযোগিতার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব বাংলার নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় গোলযোগ শুরু হয় এবং মাস শেষ হবার পূর্বেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। গভর্ণর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ সরেজমিনে তদন্তের পর এ মন্তব্য করেন যে সেখানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণের কোন আক্রমণাত্ম অভিযান ছিলনা। গুন্ডাপ্রকৃতির লোকদের দ্বারা এ গোলযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। লেফটন্যান্ট জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস টুকার, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং ইন চীফ কমান্ড, নিহতের সংখ্যা তিনশতের কম বলেন। কিন্তু বিকারগ্রস্ত হিন্দুপ্রেস ইচ্ছাকৃতভাবে ভয়াব্হ ও লোমহর্ষক কল্পকাহিনী রচনা করে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। এসব প্রচারনা বিহার ও ইউপি-র হিন্দুদের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদগ্র লালসা সৃষ্টি করে। [E.W.R. Lumby : The Transfer of Power in India -1945-47 (London George Allen and Unwin, 1954), p.120;Sir Francis Tuker, While Memory Server (London-Casell,1950) p.176; Choudhury Mohammad Ali The Emergence of Pakistan, p.85]।

নবেম্বরে পয়লা হপ্তার পরিকল্পিত উপায়ে বিহারে মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। ছ’চল্লিশের সকল ভয়ংকর দাংগার মধ্যে বিহারের হত্যাযজ্ঞ ছিল সর্বাপেক্ষা লোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক। এর সবচেয়ে কাপুরুষোচিত দিক হচ্ছে এই যে হিন্দু জনতা পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল প্রস্তুতিসহ হঠাৎ মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব মুসলমান ও তাদের পূর্বপুরুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর সাথে বসবাস করে আসছিল। এ দাংগায় নিহত নারী, পুরুষ ও শিশুর সংখ্যা ছিল সাত আট হাজার। (Sir Francis Tuker: While Momory Server, pp.181-82; Choudhury Mohammad Ali Emergency of Pakistan, p.86)।

ভাইসরয় এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবর্গ হিন্দু ও মুসলিম উপদ্রুত অঞ্চল সফর করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির জন্য আবেদন জানান। বিহারের ঘটনা জানা সত্ত্বেও গান্ধী নোয়াখালীর পথে তখন কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন। কংগ্রেসী মুসলমানগণ গান্ধীকে বার বার অনুরোধ করেন বিহার গিয়ে রক্তপিপাসু হিন্দুদের নিবৃত্ত করার জন্যে। এতদসত্ত্বেও গান্ধী বিহারমুখী না হয়ে নোয়াখালী গমন করে চার মাস অবস্থান করেন।

অবশেষে সাতচল্লিশের মার্চ মাসে বিচারে যাওয়ার জন্য গান্ধীকে রাজী করা হয়। এবার গান্ধীর চোখ খুলে যায়। প্রদেশের মন্ত্রীসভা ছলচাতুরী করে সবকিছু এড়িয়ে চলেন এবং তাদেরকে মোটেই অনুতপ্ত দেখা যায় না। জেনারেল টুকার বলেন, আমাদের অফিসারদের কাছে যেটা সবচেয়ে বিস্ময়কর মনে হয়েছে তা এই যে, হিন্দু মন্ত্রীগণ নৃশংস হত্যাকান্ডকে কি করে শান্তভাবে গ্রহণ করলেন। তারা বলেন যে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গান্ধী যখন বলেন যে, এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি, তখন প্রধানমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিনহা ভয় প্রকাশ করে বলেন যে এর থেকে লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবে।

বিহার হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো মজবুত যে কারো পক্ষে বিভ্রান্তি সৃষ্টি সম্ভব নয়। পিয়ারীলাল তার ‘মহাত্মা গান্ধী দি লাস্ট ফেজ’ –গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন –The veil lifted. এতে তিনি বলেন যে, ছেচল্লিশের বিহারের দাংড়া অখন্ড ভারতের স্বপ্নসাধ ভেঙে দিয়েছে। এ হত্যাকান্ড হিন্দুর সহজাত শান্তিবাদ (Pacifism) –এর প্রতিও গান্ধীর বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। এ সময় থেকে তার মধ্যে একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পূর্ববর্তীকালে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাংগায় তার প্রধান উদ্বেগ চিল হিন্দুদের রক্ষা করা। এখন তিনি মুসলমাদের রক্ষার জন্যেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সমগ্র ভারতের উপর হ্নিদুর রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সত্ত্বেও, তিনি রক্তপাত এড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার মানবিক আবেগ জাগ্রত হয়েছিল এবং জীবন দিয়ে এর মূল্য তাকে দিতে হয়।

বিহার হত্যাকান্ডের কিছুদিন পর ইউপি প্রদেশের গড়মুক্তেশ্বরে আর একটি মুসলিম নিধনযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রতিবছর হিন্দু মেলা হয়। কিচু সংখ্যক মুসলমান ব্যবসায়ী মেলায় দোকানপাট খুলে বসে। হঠাৎ তাদের উপর হামলা করা হয়। জেনারেল টুকার বলেন,

প্রত্যেক মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের কোন সংবাদ লৌহ যবনিকা ভেদ করে বহির্জগতে পৌঁছতে পারেনি। প্রাদেশিক সরকার হিন্দু প্রশাসনযন্ত্রের সহযোগিতায় হিন্দুদের এ হত্যাকান্ডকে পর্দার আড়াল করে রাখেন। হিন্দু পত্র-পত্রিকায় ইচ্ছাকৃতভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, মুসলমানরা কয়েকগুণে প্রতিশোধ নিয়েছে। এটা করা হয় হিন্দুদের অপকর্ম ঢাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত প্যান্ট ঘোসনা করেন যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হবে। কিন্তু কোন কিছুই করা হয়নি। (Sir Francis Tuker: While Memory Server; pp.196-201; Chowdhury Mohammad Ali –Emergence of Pakistan, p.87)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *