ঈশ্বরের লিপির রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব)
‘হায়রোগ্লিফ শিখতে তোমাদের বেশি সময় লাগবে না, তোমাদের জেনারেশনটা ওইদিকেই এগোচ্ছে… না না এগোচ্ছে না, বলা ভালো পিছিয়ে যাচ্ছে।’
মেস থেকে ডিনার করে ঘরে ফিরে পিজির টেবিলে রাখা হাজমোলার শিশিটা খুলে দুটো ট্যাবলেট মুখে পুরে দিলেন ভবেশদা। পুরেই ডান চোখ কুঁচকে মুখে টাক্ করে একটা শব্দ করলেন। তারপরে পিজির খাটটায় বসতে বসতে বললেন কথাগুলো।
আমি বললাম,
‘সুযোগ পেলেই আমাদেরকে খোঁটা দেন। কিন্তু হায়রোগ্লিফিক বোঝার সঙ্গে এই জেনারেশনের মিল নেই কোনো।’
‘কে বলল মিল নেই! আলবাত আছে! হায়রোগ্লিফের গোটাটাই হল ছবি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা। তোমরা তো আজকাল তাই করছ। হোয়াটস অ্যাপে ফেসবুকে দেখি এখন ইমোজির ছড়াছড়ি। ‘‘দুঃখ পেলাম’’ এই দুটো শব্দ না লিখে এখন স্যাড ফেস পাঠাও। ‘‘ভালো লাগল’’ এইটা বলতে কষ্ট হয়, লাইক করো। দিনকে দিন দেখছি আবেগগুলো ন্যারো হয়ে যাচ্ছে। তোমরা তো ওই প্রাচীন যুগেই ফিরে যাচ্ছ একটু একটু করে।’
অকাট্য যুক্তি। অতএব এই নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো। পিজিও মনে হয় বুঝতে পেরেছিল সেটা।
‘আপনি কোলবালিশটা টেনে নিয়ে ভালো করে বসুন, ভবেশদা। আরেকটা হাজমোলা খাবেন?’
‘অত অয়েলিং না করলেও চলবে, তোমার মুখে এমন কথা শুনলেই আমার ভয় লাগে। হায়রোগ্লিফ শিখবে তো? একটা কাগজ পেন নিয়ে এসে বোসো।’
বসলাম সব গুছিয়ে।
‘এবারে মোবাইলে একটা ছবি বের করো দেখি, সার্চ দাও— মেরেরিজ স্টেলা।’
‘এটা আবার কী?’
‘মেরেরি ছিল মিশরের দানদেরা অঞ্চলের পুরোহিতদের নেতা গোছের। এই স্টেলাটা হল ওর কবরে থাকা হায়রোগ্লিফ খোদাই করা পাথর। এখন স্কটল্যান্ডের একটা মিউজিয়ামে আছে। তবে নেটে পেয়ে যাবে ছবিটা।’
‘হুমম এই তো, এটার কথা বলছেন কি?’
‘দেখি, হ্যাঁ এটাই, এবারে এই ছবিটাকে ভালো করে দেখো তো জগাই মাধাই, দেখে বলো কী বুঝতে পারছ।’
আমরা দু-জনে মিলে ছবিটাকে বড়ো করে বেশ খুঁটিয়ে দেখলাম। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকল না।
‘অনেকগুলো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি তো।’
‘হুমম, তার মধ্যে ক-টাকে চিনতে পারছ?’
‘বেশ কয়েকটাই। একটা মানুষ বাঁ-হাতে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সিংহ, একটা পেঁচা, একটা গোরু, দুটো বসে থাকা লোক, একটা কোয়েলের মতো পাখি, একটা হাত, একটা চোখ।’
মেরেরিজ স্টেলা
‘ঠিক বলেছ, বাঁ-দিকের লোকটার ছবিটাই সবচেয়ে বড়ো, তাই না? তার মানে এতে নিশ্চয় ওই লোকটাকে নিয়েই কিছু লেখা আছে, তাই তো?’
‘এই লোকটাই মেরেরি?’
‘হ্যাঁ, মেরেরিকে নিয়ে কয়েকটা ভালো ভালো কথা লেখা আছে এখানে। এবারে ব্যাপারটা হল সেটা পড়া যাবে কী করে। খেয়াল করে দেখো স্টেলাটাতে চারটে কলাম, প্রথম আর দ্বিতীয় কলামটাকে ভাগ করা আছে মেরেরির হাতের লাঠিটা দিয়ে।’
‘হ্যাঁ, এটাও লক্ষ করলাম।’
‘চারটে কলামেই বাকি ছোটো ছোটো ছবিগুলো সাজানো আছে ওপর থেকে নীচে।’
‘ওহ, তার মানে হায়রোগ্লিফ ওপর থেকে নীচেতে পড়তে হয়?’
‘না, তা নয়। হায়রোগ্লিফের খুব বেসিক ক-টা নিয়ম বলে দিই শোনো আগে,
‘এক নম্বর, হায়রোগ্লিফে কোনো অ্যালফাবেট নেই, মানে এ বি সি ডি বা অ আ ক খ বলে ওদের কিছু ছিল না। এই প্রত্যেকটা চিহ্ন আসলে এক একটা উচ্চারণকে বোঝায়। মানে, এগুলো ফোনেটিক সাইনস। যেমন, পেঁচাটা হল ‘‘ম’’ উচ্চারণের জন্য, যেমনটা হয় আম, মা এই শব্দগুলোতে।
‘দু-নম্বর, হায়রোগ্লিফে লেখার সময় ভাওয়েলের দিকে কেউ খেয়াল রাখত না। যেমনটা এখন তোমরা মেসেজ করার সময় করো। যেমন ধরো, তুমি লিখলে, ‘‘ppl cn rd ths’’। মানে, people can read this, তাই তো?’
‘হ্যাঁ, টেক্সট করার সময়, চ্যাট করার সময় তো এরকমই করি।’
‘হায়রোগ্লিফেও তাই হত। ভাওয়েলগুলো বাদই থাকত। কিছু কিছু ভাওয়েলের উচ্চারণের হায়রোগ্লিফিক চিহ্ন আছে যদিও। যেমন অ, আ, ই, উ। দাঁড়াও, এবারে বেসিক হায়রোগ্লিফিক সাইনগুলো লিখে দিই।’
এই বলে ভবেশদা সামনে রাখা খাতাটাতে পেন দিয়ে লিখতে বসলেন, একটা জায়গাতে ‘ইস, ভুল হয়ে গেল’ বলে কেটে আবার লিখলেন। লিখে আমাদেরকে খাতাটা দিয়ে বললেন,
‘এই হল একদম বেসিক লেভেলের হায়রোগ্লিফের কয়েকটা অক্ষর। এবারে এগুলোর সঙ্গে মেরেরির স্টেলার চিহ্নগুলো মিলিয়ে দেখো তো ক-টা মিলছে।’
‘বাহ! অনেকগুলোই চিনতে পারছি তো এবারে, ই, ন, র, ম, ড, চ, ট!’
‘খুব ভালো, এবারে তাহলে তিন নম্বর নিয়মটা বলি।
‘হায়রোগ্লিফ এমন একটা ভাষা যেটা যেমন ডান দিক থেকে লেখা যায় তেমন বাঁ-দিক থেকেও লেখা যায়। আবার ওপর থেকে নীচেও লেখা যায়।’
‘ওরে বাবা, তাহলে পড়ার সময় বুঝব কী করে কোন দিক থেকে শুরু করব?’
ভবেশদা এবারে মুচকি হেসে বললেন,
‘সেটা বোঝা খুব সোজা, মেরেরির স্টেলাতে দেখ কলাম আছে, মানে ওপর থেকে নীচেই যে লেখা সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না। পাশাপাশি লেখা থাকলে খেয়াল করতে হবে কোনো জন্তুর, পাখির বা শরীরের কোনো অংশের ছবি থাকলে তার ফেস বা মুখ কোনদিকে আছে। যেদিক থেকে লেখা শুরু হবে সবকটা চিহ্নের ফেস সেইদিকে থাকবে। যেমন ধরো এই লেখাটা, আমার এঁকে দেওয়া ছবিগুলো মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করো তো দেখি।’
বলেই ভবেশদা খসখস করে একটা কিছু এঁকে আমাদেরকে দেখালেন, দু-জনেই হুমড়ি খেয়ে আঁকাটার সঙ্গে আগের এঁকে দেওয়া চিহ্নগুলো মেলাতে লাগলাম।
‘আরিব্বাস! এই তো পড়তে পারছি! ভ-ব-শ, ভাওয়েল নেই। তার মানে আপনার নাম এটা! ভবেশ!’
‘বাহ! একদম ঠিক বলেছ, এবারে বলো কী করে বুঝলে কোনদিক থেকে পড়তে হবে।’
‘খুব সোজা, ব-এর পা-টা বাঁ-দিকে মুখ করে আছে, লেখাটাও বাঁ-দিক থেকে পড়তে হবে।’
‘ভেরি গুড। এবারে এটা পড়ে দেখো।’
আবার একটা কিছু এঁকে আমাদের দিলেন ভবেশদা, আমরা আবার মেলাতে লাগলাম আগের চিহ্নগুলোর সঙ্গে।
‘পাখির মুখ ডান দিকে, তার মানে ডান দিক থেকে পড়তে হবে। তাহলে হল, ক, ট, ট, উ। কুট্টু লিখলেন নাকি! এটা তো আমার ডাকনাম!’
নিজের নাম হায়রোগ্লিফে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
‘একদম ঠিক বলেছ। বেশ ঝটপট বুঝে গেলে তো ব্যাপারটা। এবারে তাহলে চার নম্বর নিয়মটা বলি।
‘চার নম্বর, হায়রোগ্লিফে লেখা কোনো কোনো শব্দের সঙ্গে আরও একটা এক্সট্রা চিহ্ন থাকে। একে বলে ডিটারমিনেটিভ। মানে, এই চিহ্নগুলোও বুঝতে হেল্প করবে যে কী লেখা আছে শব্দটাতে। যেমন ধরো, একটা বসে-থাকা ছেলে বা মেয়ে বোঝায় শব্দটা রেস্পেক্টিভলি একটা ছেলে বা মেয়েকে বোঝাচ্ছে। আবার একটা বসে থাকা ছেলের মুখে দাড়ি মানে ভগবানের নাম লেখা আছে। তেমন আর কয়েকটা চিহ্ন এঁকে দিই, দাঁড়াও।’
‘আচ্ছা, তাহলে এগুলোকেও লেখার সময়ে ইউজ করা যাবে।’
‘হ্যাঁ, যাবে তো।’
পিজি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবারে বলল,
‘কিন্তু ভবেশদা, তাহলে আমার নামটা কী করে হায়রোগ্লিফে লেখা যাবে? প্র-এর কোনো চিহ্ন আছে নাকি?’
‘এই কথাতেই আমি আসছিলাম, আগের হায়রোগ্লিফিক চিহ্নগুলোতে তোমাদের দেখালাম এক একটা অক্ষরের উচ্চারণের এক একটা চিহ্ন। কিন্তু অনেক সময় আবার একটা হায়রোগ্লিফিক সাইন দিয়েই দুটো বা তিনটে অক্ষরের উচ্চারণ বোঝানো যায়। তেমন অনেক চিহ্ন আছে, সবকটা আমার মনে নেই, কয়েকটা এঁকে দেখাই, দাঁড়াও।’
‘আরিব্বাস! এই তো প্র-এর চিহ্ন আছে!’
‘হ্যাঁ, আছে তো। এবারে তাহলে নিজের নামটা লিখে দেখাও দেখি।’
পিজি এবারে খাতাটা টেনে নিল।
‘হুম, প্র-দী-প-ত… দেখুন তো হয়েছে কি না?’
‘এই তো, একদম পারফেক্ট হয়েছে! এবারে মেরেরির পায়ের কাছে কী লেখা আছে পড়ার চেষ্টা করো তো দেখি।’
‘এই তো, লেখা আছে ম্র-র-র-ই। মানে, মেরেরিরই নাম কি?’
‘বাহ! একদম ঠিক ধরেছ!’
‘তাহলে কি এবারে গোটা স্টেলাতে লেখা সব হায়রোগ্লিফের মানে পড়তে পারব?’
‘দেখো চেষ্টা করে।’
আমরা এতক্ষণের জ্ঞান সম্বল করে আবার মেরেরির স্টেলাটা পড়ার চেষ্টা করলাম।
‘না ভবেশদা, পারছি না তো এখনও। অনেকগুলো চিহ্নই চিনতে পারছি কিন্তু মানে বেরোচ্ছে না তো তার কোনো।’
‘সেটা বেরোবার কথাও না, ভাই। একটা জিনিস তোমরা ভুলে যাচ্ছ। এইটা লেখা আছে কিন্তু বাংলায় বা ইংরেজিতে নয়, প্রাচীন মিশরীয় ভাষায়। যেমন ধরো, দু-নম্বর কলামের এই জায়গাটা। বলো দেখি কী লেখা আছে।’
‘এই তো, চ, ন, ট, ট, তার পরে একটা গোরু, মানে ডিটারমিনেটিভ, তার আগে তিনটে দাগ, মানে অনেকগুলো গোরু।’
‘বাহ! এইটুকুই যে বুঝতে পেরেছ তাতেই তো অনেক। ওই ‘‘চনটট’’ মানে মন্দির। তার মানে, এই শব্দটা বোঝাচ্ছে মন্দিরে যে গবাদি পশুর সম্পত্তি ছিল তাকে।’
‘তাহলে হায়রোগ্লিফের লিপির মানে উদ্ধার হল কী করে?’
‘এটা তো আগের দিনই বললাম, ব্যাক ক্যালকুলেশন করে। এই হায়রোগ্লিফ থেকেই জন্ম হয়েছিল আরেকটা ভাষার। তার নাম কোপ্টিক। এর সঙ্গে গ্রিক ল্যাঙ্গুয়েজের অনেক মিল ছিল। মিশরে আরবদের শাসনের আগে সবাই এই ভাষাতেই কথা বলত। তাই প্রাচীন হায়রোগ্লিফ জানা মানুষ হারিয়ে গেলেও রিলেটিভলি নতুন এই ভাষাটা হারায়নি। অনেকেই এই ভাষা জানত। তাই ওই কোপ্টিক ভাষার হেল্পেই এই হায়রোগ্লিফিক ইনস্ক্রিপশনগুলোর মানে বের করা গিয়েছিল।’
‘বাহ! একটা হারিয়ে যাওয়া ভাষা লুকিয়ে ছিল নতুন আরেকটা ভাষার মধ্যে!’
‘একদম তাই। মেরেরির স্টেলাতে যেটা লেখা আছে তা হল, মন্দিরের গভর্নর মেরেরি, যে কিনা পুরোহিতদের প্রধান এবং মন্দিরের গবাদি পশুর অভিভাবকও বটে, সে পুজো দিচ্ছে দেবতা ওসাইরিসকে। একদম ডান দিকের কোণের ছবিটা দেখো, ওটা ওসাইরিসের চিহ্ন।’
আমি এবারে বললাম,
‘বুঝছি, ভাষাটা মোটেই সহজ কিছু নয়।’
‘একদমই সহজ নয়। আমি তোমাদের যেটুকু শেখালাম সেটুকু টিপ অফ দ্য আইসবার্গ বলতে পারো। বাকিটা আমি নিজেও ভালোভাবে জানি না। তবে এইটুকু জ্ঞান দিয়ে তোমরা টুকটাক ক-টা শব্দ হায়রোগ্লিফে লিখে ফেলতেই পারবে। যাই হোক, অনেক খাটালে আজকে তোমরা আমাকে। ক-টা বাজে দেখো তো।’
সময় যে কোথা থেকে গড়িয়ে গেল খেয়ালই করিনি। মোবাইলের স্ক্রিনে এবারে দেখলাম ভোর চারটে ! সেদিনের মতো আড্ডাটা ওখানেই বন্ধ রেখে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন অবশ্য হোস্টেলে আমরা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলাম। হায়রোগ্লিফে সবার নাম লিখে দিচ্ছিলাম যে!