১২
ইয়াদের বাড়ি সবসময় আলোয় আলোয় ঝলমল করে। সন্ধ্যার পর থেকেই এরা বোধহয় সব কটা বাতি জ্বালিয়ে রাখে। আজ ওদের বাড়ি অন্ধকার। গেট থেকে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত রাস্তার দুপাশের বাতিগুলো পর্যন্ত নেভানো। শুধু বারান্দায় বাতি জ্বলছে। আমি গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ নেই নাকি?
‘আপা আছেন।’
‘কুকুর দুটা কোথায়—টুটি-ফুটি?’
‘ওরা বান্ধা আছে। ভয় নাই, যান।’
ভয় নেই বললেই ভয় বেশি লাগে। আমি ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছি। বারান্দায় বেতের চেয়ারে নীতুকে বসে থাকতে দেখলাম। আজ তার গায়ে শাদা রঙের শাড়ি। শাদা শাড়িতে নীল ফুলের সূতার কাজ। গায়ের চাদরটাও শাদা। শাদা রঙ মেয়েদের এত মানায় আজ প্রথম জানলাম। নীতু আমাকে দেখে উঠে এল। সহজ গলায় বলল, আসুন।
‘ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভালো। এখানে বসবেন, না ভেতরে যাবেন?’
‘বারান্দাই ভালো।’
‘হ্যাঁ, বারান্দাই ভালো। আপনি কি লক্ষ করেছেন বেশিরভাগ সময় আমি বারান্দায় বসে থাকি?’
‘আমি লক্ষ করেছি।’
‘আপনার তাড়া নেই তো? আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে। আমি চা দিতে বলি। টুটি-ফুটিকে খাবার দিয়ে আসি। আমি খাবার না দিলে ওরা কিছু খায় না।
নীতু উঠে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ভেবেছিলাম নীতুকে খুব আপসেট দেখব। সেরকম মনে হচ্ছে না। আপসেট যদি হয়েও থাকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমি লক্ষ করেছি ছোটখাটো ব্যাপারে যারা অস্থির হয়, বড় ব্যাপারগুলিতে তারা মোটামুটি ঠিক থাকে।
ঘরে তৈরি সমুচা এবং পটভরতি চা। ট্রে নীতু নিয়ে এসেছে। এই কাজ সে কখনো করে না। খাবার আনার অন্য লোক আছে।
‘সমুচাগুলি এইমাত্র ভাজা হয়েছে, খান। ভালো লাগবে। সঙ্গে টক দেব?’
‘না। টুটি-ফুটিকে খাবার দেয়া হয়েছে?’
‘দেয়া হয়েছে।’
‘ওরাও কি সমুচা খাচ্ছে?
‘না, ওরা সেদ্ধ মাংস খাচ্ছে। হলুদ দিয়ে সেদ্ধ-করা মাংস। দিনে ওরা একবারই খায়।’
আমি সমুচা খেতে-খেতে বললাম, বিলেতি কুকুর একবার খায়, কিন্তু দেশীগুলি সারাক্ষণ খায়—কিছু পেলেই খেয়ে ফেলে।
‘ট্রেনিং দেয়া হয় না বলে সারাদিন খায়। ট্রেনিং দিলে ওরাও একবেলা খেত। চা ঢেলে দেব?’
‘দিন।’
নীতু চা ঢেলে কাপ এগিয়ে দিল। আমি লক্ষ করলাম, শাদা শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নীতু কানে মুক্তার দুল পড়েছে।
‘মিষ্টি হয়েছে? ‘হয়েছে।’
নীতু চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বড় করে নিশ্বাস নিল। মনে হচ্ছে সে এখন কঠিন কিছু কথা বলবে।
‘আপনি গিয়েছিলেন ইয়াদের কাছে?’
‘জি।’
‘তাকে বলেছিলেন পাগলামি বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসতে?’
‘না।’
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। আপনি তাকে দেখে খুব মজা পেয়েছেন। একজনকে শুধু কথায় ভুলিয়ে ভিখিরিদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেয়া তো সহজ কাজ না। কঠিন কাজ। সবাই পারে না। আপনি পারেন।’ নীতু হাই তুলতে তুলতে বলল।
‘আমি ওকে কিছু বলিনি কারণ বলার প্রয়োজন দেখিনি।’
‘কেন প্রয়োজন দেখেননি?’
‘ও ফিরে আসবে। ওর প্রতি আপনার ভালোবাসা প্রবল, সেই ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই।’
‘বড়-বড় কথা বলে আমাকে ভোলাতে চাচ্ছেন?’
‘না। যা সত্যি তাই বললাম।’
‘যা সত্যি তা আপনি কাউকে বলেন না, কারণ সত্যটা কী তা আপনি নিজেও জানেন না। আপনি বিভ্রম তৈরি করতে পারেন বলেই বিভ্রমের কথা বলেন। আমি খুব বিনীতভাবে আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আশা করেছিলাম আপনি আসবেন। আসেননি। ইয়াদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন—তাও আমার কারণে যাননি। ইয়াদকে আপনি কানে মন্ত্র দিয়েছেন—তাকে বলেছেন যে দুজন লোক তার পেছনে লাগানো আছে। যে জন্যে সে ভোররাতে সবার চোখে ধূলা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমি কি ঠিক বলছি না? চুপ করে থাকবেন না। উত্তর দিন।’
আমি বললাম, একটা সিগারট কি খেতে পারি?
নীতু নরম গলায় বলল, অবশ্যই খেতে পারেন। আপনার বন্ধু গাঁজা খেয়ে মাঠে পড়ে ছিল, আপনি সিগারেট খাবেন না কেন? তবে ভাববেন না আপনাকে আমি সহজে ছেড়ে দেব। আপনাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব।
‘কী শাস্তি?’
‘আপনি তো ভবিষ্যৎ বলে বেড়ান। কাজেই আপনি নিজেই অনুমান করুন। দেখি আপনার অনুমান ঠিক হয় কি না।’
‘অনুমান করতে পারছি না।’
‘চা খাবেন আরেক কাপ? পটে চা আছে।‘
‘না, আর খাব না। আমি এখন উঠব। আর আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ইয়াদ চলে আসবে।‘
‘সান্ত্বনার জন্যে ধন্যবাদ।‘
নীতু হাসল। কিন্তু তার চোখ অসুস্থ মানুষের চোখের মতো ঝকঝক করছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নীতু বলল, আপনাকে কী শাস্তি দেব তা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে! অনুমান করতে পারছেন না?
‘না।’
‘একটু চেষ্টা করুন। চেষ্টা করলেই পারবেন।’
‘পারছি না।’
‘আচ্ছা যান।’
নীতু উঠে দাঁড়াল। আমি গেটের দিকে এগুচ্ছি—এবং ভয় পাচ্ছি। অকারণ তীব্র ভয়। মনে হচ্ছে শরীর ভারী হয়ে এসেছে। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। গেটের প্রায় কাছাকাছি চলে যাবার পর বুঝতে পারলাম নীতু কী শাস্তি দিতে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা করল চেঁচিয়ে বলি—না নীতু, না।’
তার সময় পাওয়া গেল না—টুটি-ফুটি উল্কার মতো ছুটে এল। মাটিতে পড়ে যাবার আগে এক ঝলক দেখলাম বারান্দায় আঙুল উঁচিয়ে নীতু দাঁড়িয়ে আছে। ধবধবে শাদা পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে দেবী প্রতিমার মতো। নীতু হিসহিস করে বলল: Kill him. Kill him.