১২. ইরতাজুদ্দিন সাহেব নীতুকে সঙ্গে নিয়ে

ইরতাজুদ্দিন সাহেব নীতুকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। তাঁর মন বিষণ্ণ। ভুরু কুঁচকে আছে। তিনি দুই নাতনীকে সঙ্গে নিয়েই বেড়াতে বের হতে চেয়েছিলেন। শাহানা আসতে রাজি হয়নি। তার মুখের উপর কেউ না বলবে এতে তিনি এখনো অভ্যস্ত হননি যদিও এই ব্যাপারটি এখন হচ্ছে।

শ্রাবণ মাসের সকাল। আকাশে চকচকে রোদ। রোদ তাদের কাবু করতে পারছে। কারণ তারা যাচ্ছে ছায়ায় ছায়ায়। তারপরেও দুজন লোক দুটা ছাতা হাতে পেছনে পেছনে আছে।

নীতুর শরীর ভাল না। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে গেছে। সর্দি হয়েছে–নাক বন্ধ। মনে হয় একটু জ্বরও এসেছে। জ্বরের কথা সে কাউকে বলেনি। নিজের অসুখবিসুখের কথা তার কাউকে বলতে ভাল লাগে না। ছায়ায় ছায়ায় হাঁটতে তার বেশ মজা লাগছে–শুধু কাদার জন্যে পা নোংরা হয়ে গা ঘিনঘিন করছে এইটুকুই কষ্ট। গ্রামের একটা জিনিশই তার খারাপ লাগে–কাদা।

ইরতাজুদ্দিন বললেন–এই গ্রামের জমিজমা যা দেখছিস সবই একসময় ছিল। আমাদের।

নীতু বলল, এখন আমাদের না?

না।

না থাকাই ভাল। আমার জমিজমা একদম ভাল লাগে না। আমার ভাল লাগে সমুদ্র। সমুদ্র যদি কেনা যেত তাহলে আমি একটা ছোটখাট সমু্দ্র কিতাম।

ইরতাজুদ্দিন সাহেবের ভুরু আরও কুঁচকে গেল। মেয়েটা প্রাকটিক্যাল হয়নি। বাস করেছে ঘোরের মধ্যে। নীতু বলল, দাদাজান, আমিন গম্ভীর হয়ে আছেন কেন?

আমি সবসময়ই গম্ভীর।

একা একা থাকেন তো, এই জন্যেই গম্ভীর হয়ে পড়েছেন। একা একা থাকলেই মানুষ গম্ভীর হয়, বদমেজাজী হয়।

একা থাকা ছাড়া আমার উপায় কি?

ঢাকায় চলে আসুন। আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমাদের বাড়িটা তো অনেক বড়–আপনাকে আলাদা একটা ঘর দেয়া হবে। আপনি চাইলে আপনার ঘরটা আমি সুন্দর করে সাজিয়ে দেব। আমার ঘরটা আমি নিজে সাজিয়েছি।

সুন্দর করে সাজিয়েছিস?

হ্যাঁ! খুব সুন্দর। আমার ঘরে দোতলা খাট আছে।

দোতলা খাট আবার কি?

খাটটার দুটা ভাগ আছে, একটা নিচে, একটা উপরে।

তুই কোথায় ঘুমাস, নিচে না উপরে?

আমি নিচে। দাদাজান, আপনি কি এসে থাকবেন আমাদের সঙ্গে?

না।

না কেন?

তোর বাবাকে আমি পছন্দ করি না। তোর বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধাগুলির মধ্যে একটা।

বাবা শ্রেষ্ঠ গাধা কেন?

ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত মুখে বললেন–কোন ছেলে যদি বাবার ভুল ধরতে চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে গাধা। ছেলে যদি কখনো তার বাবাকে বলে–আপনি কোনদিন আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনার মুখ দেখতে চাই না, তাহলে বুঝতে হবে সেই ছেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধা।

নীতু সহজ গলায় বলল, আপনি তো খুব বড় অন্যায় করেছেন এই জন্যে বাবা এইসব কথা বলেছেন। আপনি অন্যায় না করলে বাবা কখনো এইসব কথা বলতেন না। বাবা আপনাকে দারুণ পছন্দ করে।

ইরতাজুদ্দিন স্তম্ভিত হয়ে বললেন, আমি অন্যায় করেছি?

নীতু সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ।

যেন এই ব্যাপারে তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ইরতাজুদ্দিন বললেন, আমি কি অন্যায় করেছি সেটাও কি তোর বাবা বলেছে?

হ্যাঁ বলেছেন। একবার না, অনেকবার বলেছেন।

ও আচ্ছা! আর কি বলেছে?

আর বলেছেন মানুষ মাত্রই ভুল করে–তার ভুল বুঝতে পারে। তোমার দাদাজান একমাত্র ব্যক্তি যে ভুল করে কিন্তু ভুল করেছে তা বুঝতে পারে না।

তোর বাবা ভুল করে না?

নিশ্চয়ই করেন–ছোটখাট ভুল করে আপনার মত বড় ভুল করেন না।

ইরতাজুদ্দিন অনেক কষ্টে রাগ সামলালেন। বাচ্চা একটা মেয়ের সঙ্গে তর্কে-বির্তকে যাওয়ার কোন প্রশ্ন উঠে না। মেয়েগুলির শিক্ষা ঠিকমত হচ্ছে না। শিক্ষায় ত্রুটি আছে। মুরুব্বীদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় যে সামান্য আদব-কায়দা রাখতে হয় তাও তারা জানে না। মনে যা আছে ফট করে বলে ফেলে। মনের কথা চেপে রাখতে পারাও বড় গুণের একটি।

ইরতাজুদ্দিন সাহেবের স্বাস্থ্য এই বয়সেও বেশ ভাল, তারপরেও তিনি খানিকটা ক্লান্তিবোধ করছেন। পিপাসা বোধ হচ্ছে। কোথাও বসে ডাবের পানি খেতে পারলে হত। বসার জায়গা নেই। কোন এক বাড়ির সামনে দাঁড়ালে তারা ছুটাছুটি করে চেয়ারের ব্যবস্থা করবে–তার ইচ্ছা করছে না। গ্রামের কোন বাড়িতে তিনি যান না, বসে গল্পগুজবের তো প্রশ্নই উঠে না।

ক্লান্ত হয়েছিস নাকি রে নীতু?

না। পা খোব দাদাজান, পায়ে কাদা লেগেছে।

ইরতাজুদ্দিন নাতনীর হাত ধরে নৌকা-ঘাটার দিকে যাচ্ছেন। নৌকা-ঘাটায় কয়েকটা নৌকা বাঁধা আছে। তার একটাতে উঠেই মেয়ে পা ধুতে পারবে। ফেরার পথে হেঁটে না ফিরে নৌকায় ফিরলেই হবে। নৌকা থামবে বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ঘাটে।

নৌকা ঘাটায় যারা ছিল তাদের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য দেখা দিল। সবাই ছুটে এসে বিনীত ভঙ্গিতে ইরতাজুদ্দিনকে ঘিরে দাঁড়াল। পঁচজন মানুষের সবাই আলাদা আলাদাভাবে বলল স্লমালিকুম। ইরতাজুদ্দিন তাদের সালামের জবাব না দিয়ে বললেন–তোদের খবর কি?

বুড়ো এক লোক হাত কচলাতে কচলাতে বলল–জ্বে খবর ভাল।

বড় ঐ নৌকটা কার?

বছিরের নৌকা।

বছিরকে বলিস ওর নৌকা নিয়ে যাচ্ছি। আমার বাড়ির ঘাটে, নৌকা যাবে, আমাদের নামিয়ে দিয়ে তারপর চলে আসবে।

বলাবলির কিছু নাই বড় সাব–লইয়া যান।

তোদের কারোর সঙ্গে যাবার দরকার নেই–আমার মাঝি আছে।

জ্বে আচ্ছা। জ্বে আচ্ছা।

সবাই ব্যস্ত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে নৌকার পাটাতনে পাটি পেতে দিল। তেল-চিটটিটে দুটা বালিশ জোগাড় হল। ইরতাজুদ্দিন কাউকে কিছু বলেননি—তারা ডাব কেটে নিয়ে এল। নীতু বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা গ্লাস দিতে পারবেন?

বুড়ো মাঝি বলল, ডাবের পানি গেলাসে ঢাললে গুণ নষ্ট হইয়া যায় গো মা। উপুত কইরা টান দেন।

উপুত কইরা টান দেন। কি অদ্ভুত বাক্য! ডাব খেতে গিয়ে ডাবের পানিতে নীতু তার স্কার্টটা পুরো ভিজিয়ে ফেলল– সবাই তাতে খুব মজা পেল। হাসতে হাসতে এক একজন কুটি কুটি।

নৌকায় উঠা নিয়েও এক কাণ্ড। কাদা ভেঙে নৌকায় উঠতে হয়। বুড়ো মাঝি ছুটে এসে নীতুকে বলল, আম্মা আসেন আপনেরে কোলে কইরা পার কইরা দেই।

এত বড় একটা মেয়ে হয়ে সে কারোর কোলে উঠবে ভাবতেই কেমন লাগে–কিন্তু মানুষটা এমন আগ্রহ করে হাত বাড়িয়েছে–না বলতে নীতুর খারাপ লাগল। বুড়ো মাঝি নীতুকে কোলে নিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল–আম্মাজীর শইল্যে কোন ওজন নাই। পাখির মতন শইল।

এটা এমন কোন হাসির কথা না অথচ সবাই হাসছে।

নৌকায় উঠেই নীতু বলল, এরা আপনাকে খুব সম্মান করে। তাই না দাদাজান?

ইরতাজুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন–না করার কোন কারণ নেই। সবাই তো তোর বাবার মত না।

বাবার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন?

ইরতাজুদ্দিন জবাব দিলেন না। আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। নৌকা তীর ঘেঁসে ঘেঁসে যাচ্ছে–গ্রামে কি খবর হয়ে গেছে? নানান বাড়ি থেকে বৌ-ঝিরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একদল ছেলেমেয়ে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে তীরে তীরে ছুটছে। নীতুর খুব মজা লাগছে।

নীতু বলল, দাদাজান, আপনি মন খারাপ করে বসে থাকবেন না। আপনার মন খারাপ দেখে আমারও খারাপ লাগছে। দেখেছেন দাদাজান, বাচ্চাগুলি কি মজা করছে?

ইরতাজুদ্দিন অস্পষ্টভাবে কি যেন বললেন। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন–নীতু শোন, আমাদের এই কাঠের দোতলা অনেক দূর থেকে দেখা যায়। চারদিকে হাওড়, আশেপাশে কোন দোতলা বাড়ি নেই। সারা রাতেই অনেকগুলি বাতি জ্বলে…

নীতু তাকিয়ে আছে। দাদাজান কি বলতে চাচ্ছেন সে বুঝতে পারছে না। দাদাজানের কথা শুনতে এখন তার ভাল লাগছে না– ছুটতে ছুটতে যে বাচ্চাগুলি যাচ্ছে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভাল লাগছে। এরা এত মজা করছে, আশ্চর্য! একজন আবার ইচ্ছা করে একটু পর পর কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছে–

নীতু।

জি।

আমাদের এই বাড়িতে অনেক বড় বড় মানুষ এসেছেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এসেছিলেন পাখি শিকারে। দেশবন্ধু সি. আর. দাস এসেছিলেন। একবেলা থাকবেন বলে এসে চারদিন ছিলেন। আমার বাবা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন–অনেকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শান্তিনিকেতন শুরু করেন তখন তিনি তার ফান্ডে পাঁচ হাজার এক টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। সেই সময় পাঁচ হাজার এক টাকা–অনেক টাকা।

পাঁচ হাজারের সঙ্গে আবার এক কেন দাদাজান?

আল্লাহ বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন, এই জন্যে দান-টান করলে বেজোড় সংখ্যায় দিতে হয়।

ও আচ্ছা।

পাখি শিকারের জন্যে বাবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও দাওয়াত করেছিলেন। উনি পাখি শিকার পছন্দ করেন না বলে আসেননি। উনি খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে জবাব দিয়েছিলেন। সেই চিঠি তোর বাবার কাছে আছে।

বাবার কাছে নেই দাদাজান। বাবা সেই চিঠি বাংলা একাডেমীতে দিয়ে দিয়েছেন।

তোর বাবার বুদ্ধি বেশি তো–সবকিছুতে মাতব্বরি করবে। ব্যক্তিগত একটা চিঠি বাংলা একাডেমীকে দেয়ার কি আছে? যাই হোক, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে–আমাদের এই বাড়ি ছিল বিখ্যাত এক বাড়ি–হাওড় অঞ্চলের এই বাড়ি সবার চোখে পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক। একাত্তর সনের মে মাসে পাকিস্তানী মিলিটারী যখন গানবোট নিয়ে হাওড় অঞ্চলে ঢুকল তাদের চোখেও এই বাড়ি পড়ল। তারা তো অন্ধ না। তাদের চোখ আছে।

নীতু মনে মনে হাসল। দাদাজান কি বলতে চাচ্ছেন সে এখন বুঝতে পারছে। কিন্তু তাঁকে সে কিছু বুঝতে দিল না–এমন ভাব করল যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইরতাজুদ্দিন বললেন, ওরা গানবোট নিয়ে আমার বাড়ির ঘাটে ভিড়ল। আমি দেখা করতে গেলাম। ওরা আমার সঙ্গে খুবই ভদ্র ব্যবহার করল। আমার বাড়িতে উঠে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম করতে চাইল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একদল মানুষ। বিশ্রাম করতে চাইলে আমি কি বলব–না, বিশ্রাম করা যাবে না? ওরা তো খালি হাতে আসেনি–অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে এসেছে। নিরস্ত্র মানুষের মুখের উপর না বলা যায়, অস্ত্রধারী মানুষের মুখের উপর না বলা যায় না। এই সত্য পৃথিবীর সবাই জানে–শুধু তোর বাবা জানে না। এই জন্যেই তোর বাবাকে আমি শুধু গাধা বলি না, বলি শ্ৰেষ্ঠ গাধা।

নীতু লক্ষ্য করল, তার দাদাজান অসম্ভব রেগে গেছেন। তার ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে–তিনি অল্প অল্প কাঁপছেন।

ইরতাজুদ্দিন বিলের পানিতে একদলা থুথু ফেলে বললেন, কেউ বলুক দেখি এই গ্রামের কোন মানুষ মিলিটারী মেরেছে কি না। কেন মারেনি? আমার জন্যেই মারেনি। এত কিছু তোর বাবা জানে–এটা জানে না? তার কতবড় সাহস–সে সে সে…

ইরতাজুদ্দিন কথা শেষ করলেন না, টকটকে লাল চোখে তাকালেন। নীতু কিছু বলবে না বলবে না করেও শান্ত স্বরে বলল, দাদাজান, বাবা আমাদের বলেছেন যে মিলিটারী এই গ্রামের কাউকে মারেনি… কিন্তু…

কিন্তু আবার কি?

বাবা বলেছেন এই গ্রামের ছটা মেয়েকে মিলিটারী ধরে নিয়ে এসেছিল–আমাদের এই বাড়িতেই তাদের রেখেছিল। মিলিটারী চলে যাবার সময় তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরে এই মেয়েগুলির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ইরতাজুদ্দিন তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না। নীতু তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

ঘাটে নৌকা ভিড়েছে। ইরতাজুদ্দিন নামলেন। তার পা খানিকটা টলতে লাগল। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের পেছনে পেছনে নীতু নামল। নৌকার মাঝি দুজন মাথা নিচু করে বসে আছে। একবারও মাথা তুলছে না। তীরে নেমে নৌকার মাখা শক্ত করে ধরা দরকার এ কথাও তাদের মনে নেই।

মাঝিরা নৌকা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে–উত্তরের নৌকা, ঘাটায় নৌকা রেখে আসবে। মাঝিদের একজন অস্পষ্ট গলায় বলল–এক আঙুল মেয়ে কিন্তু কি সাহস! এইটা হইল কশের গুণ–কত বড় বংশ দেখন লাগব না? জোকের মুখে এক মুঠ লবণ দিয়া দিছে। আচানক ব্যাপার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *