১২. ইঞ্জিন বসানো ছিপছিপে ধরনের নৌকা

ইঞ্জিন বসানো ছিপছিপে ধরনের নৌকা। মাথার উপর একচিলতে ছাদ। ছাদের নিচে ইঞ্জিন। দেখলে বিশ্বাস হয় না। এরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু মাঝি যখন বলছে তখন বিশ্বাস করতে হবে।

নৌকায় বাংলাদেশি ফ্ল্যাগ উড়ছে। সেন্ট মার্টিন যেতে হলে বাৰ্মার আকিয়ার শহরের পাশ দিয়ে যেতে হয়। জলযানগুলিতে সে কারণেই পতাকা ওড়াতে হয়। যাতে দূর থেকে বোঝা যায়—কোন নৌকা বাংলাদেশের, কোনগুলি বার্মার।

নৌকার মাঝি চিটাগাংয়ের প্রায় দুর্বোধ্য ভাষায় বোঝাল—ইয়ান নাফ নদী, ইয়ানর অর্ধেক আঁরার, অর্ধেক বার্মার।

মোতালেব বলল, অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা—নদীর আবার অর্ধেক অর্ধেক ভাগাভাগি কী? নদী হচ্ছে প্রেমিকার মতো। প্রেমিকার আবার ভাগাভাগি! এটা কি মগের মুল্লুক?

মাঝি দাঁত বের করে বলল, ইয়ান মগের মুল্লুক। বাৰ্মাইয়ারা বেগগুন মগ।

আনুশকা বলল, ঢেউ কেমন?

আছে, ছোড ছোড গইর।

কী বলছেন, বাংলা ভাষায় বলুন—ছোড় ছোড গাইর মানে কী?

মাঝি আনন্দিত গলায় বলল, অল্প বিস্তর ঢেউ।

ঢেউ যা উঠছে তাকে অল্প বিস্তর বলাটা ঠিক হচ্ছে না। নীরা মুখ কালো করে ঢেউ দেখছে।

মুনা বলল, কী নীল পানি দেখছেন আপা? নদীর পানি এত নীল হয়? আশ্চর্য!

নীরা জবাব দিল না। নাফ নদীর নীল পানি তাকে অভিভূত করতে পারছে না। হঠাৎ তার মনে পড়েছে, সে সাঁতার জানে না। সে রানার দিকে তাকাল।

রানা খুব ব্যস্ত হয়ে নৌকায় জিনিসপত্র তুলছে। মালামালের সঙ্গে প্রচুর ডাবও যাচ্ছে। রানা কোথেকে যেন সস্তা দরে আঠারোটা ডাব কিনেছে। সাগরে মিষ্টি পানির সাপ্লাই।

মোতালেব রানাকে সাহায্য করছে। বল্টু দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। বল্টুর মন খুব খারাপ। ট্রেনে ওঠার পর থেকে মুনা তার সঙ্গে একটা কথাও বলে নি। এর মানে সে বুঝতে পারছে না।

মুনার পুরো ব্যাপারটাই সবসময় তার কাছে এক ধরনের রহস্য। মেয়েটা তাকে পছন্দ করে, না করে না? তাকে সে একটা স্যুয়েটার কিনে দিয়েছে। ধরে নেয়া যেতে পারে, পছন্দ করে বলেই দিয়েছে। কিন্তু কথাবার্তায় কিংবা আচারআচরণে তার কোনো প্ৰমাণ নেই।

বল্টুর একবার ধারণা হয়েছিল, তার বড় ভাই উপস্থিত বলেই মুনা তার সঙ্গে কথা বলছে না। মেয়েরা আড়াল পছন্দ করে। কিন্তু সঞ্জু তো কাল রাতেই চলে গেছে। এর পরেও মুনা কথা বলবে না কেন? বল্টু নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে আজ ভোরবেলা কথা বলার চেষ্টা করেছে। মুনাকে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছে–মুনা, চা খেতে যাবি? একটা দোকানে দেখলাম গুড়ের চা বানাচ্ছে।

মুনা বলল, গুড়ের চা খাবার জন্যে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে আছি আপনাকে কে বলল? চিনির চা-ই খাই না, তো গুড়ের চা।

চা না খেলে না খাবি-চিল, হেঁটে আসি।

আপনার সঙ্গে হাঁটতে যাব?

হ্যাঁ। অসুবিধা আছে?

অবশ্যই অসুবিধা আছে। বাঁটকু লোকের সঙ্গে আমি হাঁটি না। লোকজন দেখে ফিক ফিক করে হাসে। তারা মনে মনে বলে-লম্বা মেয়েটা এই বাঁটকুটার সঙ্গে হাঁটছে কেন?

বল্টুর মন এই কথায় অত্যন্ত খারাপ হলো। এই জাতীয় কথা কি কেউ বলতে পারে? বলতে পারা কি উচিত? মুনার দেয়া স্যুয়েটার সে এখন পরে আছে। ইচ্ছা! করছে স্যুয়েটারটা খুলে টেকনাফের নদীতে ফেলে দিতে। দরকার নেই শালার স্যুয়েটারের!

রানা বিরক্ত গলায় বলল, তোরা সব হাবার মতো তীরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাদের কি রওনা দেয়া লাগবে না? জোয়ার-ভাটার ব্যাপার আছে। যাকে বলে সমুদ্রযাত্রা। এক্ষুনি রওনা দিতে হবে। নো ডিলে।

নীরা নিচু গলায় বলল, আমি যাচ্ছি না।

রানা হতভম্ব হয়ে বলল, আমি যাচ্ছি না মানে?

আমি সাঁতার জানি না।

আমরা তো সাঁতরে যাচ্ছি না। নৌকায় কয়ে যাচ্ছি।

আমার ভয় লাগছে। আমি যাব না।

রানা অনেক কস্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করল–ঢেউ যা একটু নদীতেই দেখা যাচ্ছে–নৌকা সমুদ্রে পড়লেই সব শান্ত। তাই না মাঝি?

মাঝি হাসিমুখে বলল, উল্টা কথা ন-কাইও। সাগরে ডাঙ্গর ডাঙ্গর গইর ঢেউ। তুঁই ন-জানো?

নীরা বলল, অসম্ভব, আমি যাব না। আমাকে বঁটি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেললেও যাব না।

আনুশকা বলল, শোন নীরা, তীৰ্থস্থানে সবার যাবার সৌভাগ্য হয় না। অনেকেই খুব কাছ থেকে ফিরে যায়….

নীরা আনুশকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যারি, এক সময় আমি এরকম কথা বলেছিলাম। আমি সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি যাব না। প্লিজ, না।

নীরার গলায় এমন কিছু ছিল যে সবাই বুঝল নীরা যাবে না। কেউ কিছু বলল না। দীর্ঘ সময় সবাই চুপচাপ। রানার চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না।

জরী বলল, নীরা, সত্যি যাবে না?

না জরী। আমি যাব না। নৌকায় উঠলেই আমি ভয়ে মরে যাব। আমি পানি অসম্ভব ভয় পাই। তোদের সঙ্গে ঠিক করেছি। কিন্তু আসল কথাটাই কখনো মনে আসে নি।

মুনা বলল, তাহলে কী হবে?

আমাকে নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। আমি একটা বাস ধরে কক্সবাজার চলে যাব। সেখান থেকে ঢাকা।

আনুশকা বলল, এটা একটা কথা হল?

আমি যা করছি খুব অন্যায় করছি। আমি সেটা জানি।

ভয়কে জয় করতে হয় নীরা।

সব ভয় জয় করা যায় না।

রানা বলল, এখন তাহলে কী করা? নীরাকে একা একা যেতে দেয়া যায় না। একজন-কাউকে নীরার সঙ্গে যেতে হবে। কে যাবে?

বল্টু বলল, আমি। আমি নিয়ে যাব।

মুনা অবাক হয়ে বল্টুর য় আছে। কী বলছে এই মানুষটা? সে কি মুনার ওপর রাগ করে বলছে? এত রাগ কেন? মুনার সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল—অয়ন ভাই, আপনি যাবেন না। প্লিজ, প্লিজ। আমি নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ে। আপনিও হতদরিদ্র একজন মানুষ। কোনোদিন যে আবার আমরা সমুদ্রের কাছে আসতে পারব—আমার মনে হয় না। কী সুন্দর একটা সুযোগ্য! আমার ওপর রাগ করে আপনি এই সুযোগটা নষ্ট করবেন। না। আমি জানি, আমি নানাভাবে আপনাকে কষ্ট দিই। আপনাকে আহত করি। কেন করি আমি নিজেও জানি না। প্রতিবার কষ্ট পেয়ে আপনি যখন মুখ কালো করেন তখন আমার ইচ্ছা করে খুব উচু একটা বিল্ডিং-এ উঠে সেখান থেকে লাফিয়ে রাস্তার পড়ে যেতে। অয়ন ভাই, বলুন তো আমার স্বভাবটা উলটো হলো কেন? কেন আমি আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলাম না? আমার ধারণা, আমি খুব বাজে ধরনের একটা মেয়ে। আপনার এই ধারণা সত্যি নয়। খুব ভুল ধারণা। আমি যে কত ভালো একটা মেয়ে সে জানে শুধু আমার মা। একদিন আপনিও জানবেন। সেই দিনটির জন্যে আমি কত যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি! অয়ন ভাই, আমাদের আর্থিক অবস্থাটা যে কত খারাপ সেটা তো আপনি জানেন—তার পরেও মার সংসার-খরচের টাকা চুরি করে আপনার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনলাম। আপনার একটাই স্যুয়েটার। সেটাও অনেকখানি ছেড়া। ছেড়া ঢাকার জন্যে আপনি সবসময় স্যুয়েটারের উপর একটা শার্ট পরেন। একদিন আমাকে বললেন-মানুষ কেন যে শার্টের উপর স্যুয়েটার পরে আমি জানি না। কী বিশ্ৰী লাগে দেখতে! মনে হয় শার্টের উপর একটা ভারি গেঞ্জি পরে আছে।

আপনার কথা শুনে আমি সেদিন কী কষ্ট যে পেয়েছিলাম! সারা রাত কেঁদেছি আর বলেছি, কেন একজন মানুষ আপনার মতো দরিদ্র হয়—আর কেন আরেকজন হয় শুভ্ৰ ভাইয়ার মতো ধনী?

নানা ধরনের কস্টের মধ্যে আমি বড় হচ্ছি। একধরনের আশা নিয়ে বড় হচ্ছি-গভীর রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ মনে হয়—হয়তো সামনের দিনগুলি অন্যরকম হবে।

অয়ন ভাই, আমি একটা ঘোরের মধ্যে আপনার সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। সবাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল। আমি কিন্তু একটুও লজ্জা পেলাম না। মনে মনে বললাম—এই ব্যাপারটা নিয়তি সাজিয়ে রেখেছে। নিয়তি চাচ্ছে আমি যাই আপনার সঙ্গে।

রাতে একসময় আপনারা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি কিন্তু জেগে রইলাম। জেগে জেগে ঠিক করলাম দারুচিনি দ্বীপে নেমে আমি কী করব। কী করব জানেন? আমি আপনার কাছে গিয়ে বলব—অয়ন ভাই, আসুন তো আমার সঙ্গে। আমি এক সময় বলব, আমার কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে। আপনি আমার হাতটা একটু ধরুন তো! আপনি হাত ধরবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি বলব।–অয়ন ভাই, আমি আপনাকে নিয়ে এত ঠাট্টা-তামাশা করি। আমি জানি আপনি খুব রাগ করেন। কিন্তু আমি যে আপনাকে কতটা ভালোবাসি তা কি আপনি জানেন? এই সমুদ্রে যতটা পানি আছে, বিশ্বাস করুন অয়ন ভাই, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা তারচে অনেক অনেক গুণ বেশি। অয়ন ভাই, এখন যদি আপনি চলে। যান তাহলে আমি কথাগুলি কীভাবে বলব?

মুনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানা নীরার সুটকেস নামিয়ে দিচ্ছে। রানা বলল, মুনা, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? উঠে আয়। মুনা উঠে এল।

নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের ভট্‌ ভট্ শব্দ হচ্ছে। ভালো দুলুনি হচ্ছে। নীরা হাত নাড়ছে। বল্টু হাত নাড়ছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

আনুশকা বলল, যেভাবে মানুষজন কমছে। শেষ পর্যন্ত কজন গিয়ে দারুচিনি দ্বীপে পৌঁছব কে জানে?

নদীর মোহনা ছেড়ে নৌকা সাগরে পড়ল। গাঢ় নীল সমুদ্র।

যেন এক জীবন্ত নীলকান্ত মণি। শুভ্ৰ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, এত সুন্দর! এত সুন্দর!

বড় বড় ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। নৌকা খুবই দুলছে। রানা ভীত গলায় বলল, আমরা সবাই কি মারা পড়ব নাকি? ভয়াবহ অবস্থা দেখি! জরী, তোমার ভয় লাগছে?

জরী বলল, না।

এক-একটা বড় ঢেউ আসছে। পাগলী মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছে। আনুশকা বলল, এই মেয়েটার একটা নাম দেয়া দরকার। কী নাম দেয়া যায়? মোতালেব, একটা নাম বলো তো!

মোতালেব বলল, নিজে বেঁচে থাকলে তারপর অন্যের নাম। অবস্থা যা দেখছি। বাঁচব বলে তো মনে হয় না। মাঝি ভাই, বলেন তো নৌকা ডোবে কখনও?

মাঝি সহজ, গলায় বলল, ড়ুবে। আকছার ড়ুবে।

নিশ্চয় ঝড়-তুফানের সময় ডোবে। আজ ঝড়-তুফান নেই। তাই না মাঝি?

আশ্বিন মাসে সাগর মাঝেমইধ্যে বিনা কারণে পাগলা অয়। তখন বড়ই সমস্যা।

আজ কি সাগর পাগলা হয়েছে?

হেই রকমই মনে লয়।

রানা বলল, ফিরে যাবার আইডিয়াটা তোমাদের কাছে কেমন মনে হচ্ছে আনুশকা?

খুব খারাপ মনে হচ্ছে। যে ফিরে যেতে চায় তাকে ফিরতে হবে সাঁতার দিয়ে।

মোতালেব বলল, ভয় যে পরিমাণ লাগছে—ভয়ের চোটে একটা কেলেঙ্কারি না করে ফেলি—কিংবা কে জানে হয়তো ইতোমধ্যেই কেলেঙ্কারি করে ফেলেছি। শরীরটা হালকা হালকা লাগছে।

জরী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ভয়ের মধ্যেও তোমার সেন্স অব হিউমার যে নষ্ট হয় নি সেটা খুব ভালো লক্ষণ না।

আনুশকা বলল, আচ্ছা, আমরা এই মেয়েটার কেউ কোনো নাম দিচ্ছি না। কেন? শুভ্ৰ, তুমি এর একটা নাম দাও—

আমি ওর নাম দিলাম–ঊৰ্মি। ঢেউ।

জরী, তোর মাথায় কি কোনো নাম আসছে?

না, আমার মাথায় কোনো নাম আসছে না। আমার এখন কেমন জানি ভয়ভয় লাগছে। মাঝি, নৌকা উল্টাবে না তো?

সবই আল্লাহর ইচ্ছা আম্মা।

ঢেউয়ের পানি পাহাড়ের মতো সারি বেঁধে ছুটে আসছে। শুভ্ৰ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, কি সুন্দর, অথচ কী ভয়ংকর!

মাঝি চেঁচিয়ে বলল, নৌকা ধর, গরি ধরিঅরে বইয়। অবস্থা ভালো। ন দেকির।

শুভ্ৰ নৌকা ধরল না। সে চেঁচিয়ে বলল, দেখো দেখো, সমুদ্র-সারস। সমুদ্র-সারস। তারা নৌকাকে ঘিরে বাক বেঁধে উড়ছে। মনে হচ্ছে তারা যাচ্ছে কোনো-এক অজানা দারুচিনি দ্বীপে।

আনুশকা বলল, দ্বীপটা কি দেখা যায়?

মাঝি আঙুল তুলে দেখাল। হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে। ঐ তো দেখা যায়। এত সুন্দর! আশ্চৰ্য, এত সুন্দর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *