দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১
একদিন রাজু পাঁড়ে কাছারিতে খবর পাঠাইল যে বুনো শূকরের দল তাহার চীনা ফসলের ক্ষেতে প্রতিরাত্রে উপদ্রব করিতেছে, তাহাদের মধ্যে কয়েকটি দাঁতওয়ালা ধাড়ী শূকরের ভয়ে সে ক্যানেস্ত্রা পিটানো ছাড়া অন্য কিছু করিতে পারে না-কাছারি হইতে ইহার প্রতিকার না করিলে তাহার সমুদয় ফসল নষ্ট হইতে বসিয়াছে।
শুনিয়া নিজেই বৈকালের দিকে বন্দুক লইয়া গেলাম। রাজুর কুটির ও জমি নাঢ়া-বইহারের ঘন জঙ্গলের মধ্যে। সেদিকে এখনো লোকের বসবাস হয় নাই, ফসলের ক্ষেতের পত্তনও খুব কম হইয়াছে, কাজেই বন্য জন্তুর উপদ্রব বেশি।
দেখি রাজু নিজের ক্ষেতে বসিয়া কাজ করিতেছে। আমায় দেখিয়া কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিল। আমার হাত হইতে ঘোড়ার লাগাম লইয়া নিকটের একটা হরীতকী গাছে ঘোড়া বাঁধিল।
বলিলাম-কই রাজু, তোমায় যে আর দেখি নে, কাছারির দিকে যাও না কেন?
রাজুর খুপড়ির চারিদিকে দীর্ঘ কাশের জঙ্গল, মাঝে মাঝে কেঁদ ও হরীতকী গাছ। কি করিয়া যে এই জনশূন্য বনে সে একা থাকে! এ জঙ্গলে কাহারো সহিত দিনান্তে একটি কথা বলিবার উপায় নাই-অদ্ভুত লোক বটে!
রাজু বলিল-সময় পাই কই যে কোথাও যাব হুজুর, ক্ষেতের ফসল চৌকি দিতেই প্রাণ বেরিয়ে গেল। তার ওপর মহিষ আছে।
তিনটি মহিষ চরাইতে ও দেড়-বিঘা জমির চাষ করিতে এত কি ব্যস্ত থাকে যে সে লোকালয়ে যাইবার সময় পায় না, একথা জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলাম-কিন্তু রাজু আপনা হইতেই তাহার দৈনন্দিন কার্যের যে তালিকা দিল, তাহাতে দেখিলাম তাহার নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ না থাকার কথা। ক্ষেতখামারের কাজ, মহিষ চরানো, দোয়া, মাখনতোলা, পূজা-অর্চনা, রামায়ণ-পাঠ, রান্না-খাওয়া-শুনিয়া যেন আমারই হাঁপ লাগিল। কাজের লোক বটে রাজু! ইহার উপর নাকি সারারাত জাগিয়া ক্যানেস্ত্রা পিটাইতে হয়।
বলিলাম-শূকর কখন বেরোয়?
-তার তো কিছু ঠিক নেই হুজুর। তবে রাত হলেই বেরোয় বটে। একটু বসুন, দেখবেন কত আসে।
কিন্তু আমার কাছে সর্বাপেক্ষা কৌতূহলের বিষয়-রাজু একা এই জনশূন্য স্থানে কি করিয়া বাস করে। কথাটা জিজ্ঞাসা করিলাম।
রাজু বলিল-অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, বাবুজী। বহুদিন এমনি ভাবেই আছি-কষ্ট তো হয়ই না, বরং আপন মনে বেশ আনন্দে থাকি। সারাদিন খাটি, সন্ধ্যাবেলা ভজন গাই, ভগবানের নাম নিই, বেশ দিন কেটে যায়।
রাজু, কি গনু মাহাতো, কি জয়পাল-এ ধরনের মানুষ আরো অনেক আছে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে-ইহাদের মধ্যে একটি নূতন জগৎ দেখিলাম যে জগৎ আমার পরিচিত নয়।
আমি জানি রাজুর একটি সাংসারিক বিষয়ে অত্যন্ত আসক্তি আছে, সে চা খাইতে অত্যন্ত ভালবাসে। অথচ এই জঙ্গলের মধ্যে চায়ের উপকরণ সে কোথায় পায়, এই ভাবিয়া আমি নিজে চা ও চিনি লইয়া গিয়াছিলাম। বলিলাম-রাজু, একটু চা করো তো। আমার কাছে সব আছে।
রাজু মহা আনন্দে একটি তিন-সেরী লোটাতে জল চড়াইয়া দিল। চা প্রস্তুত হইল, কিন্তু একটি মাত্র কাঁসার বাটি ব্যতীত অন্য পাত্র নাই। তাহাতেই আমায় চা দিয়া সে নিজে বড় লোটাটি লইয়া চা খাইতে বসিল।
রাজু হিন্দি লেখাপড়া জানে বটে, কিন্তু বহির্জগৎ সম্বন্ধে তাহার কোনো জ্ঞান নাই। কলিকাতা নামটা শুনিয়াছে, কোন্ দিকে জানে না। বোম্বাই বা দিল্লির বিষয়ে তার ধারণা চন্দ্রলোকের ধারণার মতো-সম্পূর্ণ অবাস্তব ও কুয়াশাচ্ছন্ন। শহরের মধ্যে সে দেখিয়াছে পূর্ণিয়া, তাও অনেক বছর আগে এবং মাত্র কয়েক দিনের জন্য সেখানে গিয়াছিল।
জিজ্ঞাসা করিলাম-মোটর গাড়ি দেখেছ রাজু?
-না হুজুর, শুনেছি বিনা গোরুতে বা ঘোড়ায় চলে, খুব ধোঁয়া বেরোয়, আজকাল পূর্ণিয়া শহরে অনেক নাকি এসেছে। আমার তো সেখানে অনেক কাল যাওয়া নেই, আমরা গরিব লোক, শহরে গেলেই তো পয়সা চাই।
রাজুকে জিজ্ঞাসা করিলাম সে কলিকাতা যাইতে চায় কি না। যদি চায়, আমি তাহাকে একবার ঘুরাইয়া আনিব, পয়সা লাগিবে না।
রাজু বলিল-শহর বড় খারাপ জায়গা, চোর গুণ্ডা জুয়াচোরের আড্ডা শুনেছি। সেখানে গেলে শুনেছি যে জাত থাকে না। সব লোক সেখানকার বদমাইশ। আমার এ-দেশের একজন লোক কোন্ শহরের হাসপাতালে গিয়েছিল, তার পায়ে কি হয়েছিল সেই জন্যে। ডাক্তার ছুরি দিয়ে পা কাটে আর বলে, তুমি আমাকে কত টাকা দেবে? বললে দশ টাকা দেব। তখন ডাক্তার আরো কাটে! আবার বললে-এখনো বল কত টাকা দেবে? সে বললে-আরো পাঁচ টাকা দেব, ডাক্তারসাহেব আর কেটো না। ডাক্তার বললে-ওতে হবে না-বলে আবার পা কাটতে লাগল। সে গরিব লোক, যত কাঁদে, ডাক্তার ততই ছুরি দিয়ে কাটে-কাটতে কাটতে গোটা পা-খানাই কেটে ফেললে। উঃ, কি কাণ্ড ভাবুন তো হুজুর!
রাজুর কথা শুনিয়া হাস্য সংবরণ করা দায় হইয়া উঠিল। মনে পড়িল এই রাজুই একবার আকাশে রামধনু উঠিতে দেখিয়া আমাকে বলিয়াছিল-রামধনু যে দেখেছেন বাবুজী, ও ওঠে উইয়ের ঢিবি থেকে, আমি স্বচক্ষে দেখেছি।
রাজুর খুপরির সামনের উঠানে একটি বড় খুব উঁচু আসান-গাছ আছে, তারই তলায় বসিয়া আমরা চা খাইতেছিলাম-যেদিকে চাই, সেদিকেই ঘন বন-কেঁদ, আমলকী, পুষ্পিত বহেরা লতার ঝোপ; বহেরা ফুলের একটি মৃদু সুগন্ধ সান্ধ্য বাতাসকে মিষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। আমার মনে হইল এসব স্থানে বসিয়া এমন ভাবে চা খাওয়া জীবনের একটা সৌন্দর্যময় অভিজ্ঞতা। কোথায় এমন অরণ্যপ্রান্তর, কোথায় এমন জঙ্গলে-ঘেরা কাশের কুটির, রাজুর মতো মানুষই বা কোথায়? এ অভিজ্ঞতা যেমন বিচিত্র, তেমনই দুষ্প্রাপ্য।
বলিলাম-আচ্ছা রাজু, তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এস না কেন? তোমার আর তা হলে কষ্ট করে রেঁধে খেতে হয় না।
রাজু বলিল-সে বেঁচে নেই। আজ সতের-আঠারো বছর মারা গিয়াছে, তার পর থেকে বাড়িতে মন বসাতে পারি নে আর!
রাজুর জীবনে রোমান্স ঘটিয়াছিল, এ ভাবিতে পারাও কঠিন বটে, কিন্তু অতঃপর রাজু যে গল্প করিল, তাহাকে ও-ছাড়া অন্য নামে অভিহিত করা চলে না।
রাজুর স্ত্রীর নাম ছিল সর্জু (অর্থাৎ সরযূ), রাজুর বয়স যখন আঠারো ও সরযূর চৌদ্দ-তখন উত্তর-ধরমপুর, শ্যামলালটোলাতে সরযূর বাপের টোলে রাজু দিনকতক ব্যাকরণ পড়িতে যায়।
রাজুকে বলিলাম-কতদিন পড়েছিলে?
কিছু না বাবুজী; বছরখানেক ছিলাম, কিন্তু পরীক্ষা দিই নি। সেখানে আমাদের প্রথম দেখাশুনো এবং ক্রমে ক্রমে-
আমাকে সমীহ করিয়া রাজু অল্প কাশিয়া চুপ করিল।
আমি উৎসাহ দিবার সুরে বলিলাম-তারপর বলে যাও-
-কিন্তু, হুজুর, ওর বাবা আমার অধ্যাপক। আমি কি করে তাঁকে এ-কথা বলি? একদিন কার্তিক মাসে ছট্ পরবের দিন সরযূ ছোপানো হলদে শাড়ি পরে কুশী নদীতে একদল মেয়ের সঙ্গে নাইতে যাচ্ছে, আমি-
রাজু কাশিয়া আবার চুপ করিল।
পুনরায় উৎসাহ দিয়া বলিলাম-বল, বল, তাতে কি?
-ওকে দেখবার জন্যে আমি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। এর কারণ এই যে ইদানীং ওর সঙ্গে আমার আর তত দেখাশুনো হত না-এক জায়গায় ওর বিয়ের কথাবার্তাও চলছিল। যখন দলটি গাইতে গাইতে-আপনি তো জানেন ছট্ পরবের সময় মেয়েরা গান করতে করতে নদীতে ছট্ ভাসাতে যায়!-তারপর যখন ওরা গাইতে গাইতে আমার সামনে এল, ও আমায় দেখতে পেয়েছে গাছের আড়ালে। ও-ও হাসলে, আমিও হাসলাম। আমি হাত নেড়ে ইশারা করলাম, একটু পিছিয়ে পড়-ও হাত নেড়ে বললে-এখন নয়, ফেরবার সময়ে।
রাজুর বাহান্ন-বছর বয়সের মুখমণ্ডলে বিংশবর্ষীয় তরুণ প্রেমিকের লাজুকতা ও চোখে একটি স্বপ্নভরা সুন্দর দৃষ্টি ফুটিল এ-কথা বলিবার সময়-যেন জীবনের বহু পিছনে প্রথম যৌবনের পুণ্য দিনগুলিতে যে কল্যাণী তরুণী ছিল চতুর্দশ-বর্ষদেশে-তাহাকেই খুঁজিতে বাহির হইয়াছে ওর সঙ্গীহারা প্রৌঢ় প্রাণ। এই ঘন জঙ্গলে একা বাস করিয়া সে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। এখন যাহার কথা ভাবিতে তাহার ভালো লাগে, যাহার সাহচর্যের জন্য তার মন উন্মুখ-সে হইল বহু কালের সেই বালিকা সরযূ, পৃথিবীতে যে কোথাও আর নাই।
বেশ লাগিতেছিল ওর গল্প। আগ্রহের সঙ্গে বলিলাম-তারপর?
-তারপর ফেরবার পথে দেখা হোলো। ও একটু পিছিয়ে পড়ল দলের থেকে।
আমি বললাম-সরযূ, আমি বড় কষ্ট পাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখাশোনাও বন্ধ, আমার লেখাপড়া হবে না জানি, কেন মিছে কষ্ট পাই, ভাবছি টোল ছেড়ে চলে যাব এ মাসের শেষেই। সরযূ কেঁদে ফেললে। বললে-বাবাকে বলো না কেন? সরযূর কান্না দেখে আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। এমনি হয়তো যে কথা কখনো আমার অধ্যাপককে বলতে পারতাম না, তাই বলে ফেললাম একদিন।
বিয়ে হওয়ার কোনো বাধা ছিল না, স্বজাতি, স্বঘর। বিয়ে হয়েও গেল।
খুব সহজ ও সাধারণ রোমান্স হয়তো-হয়তো শহরের কোলাহলে বসিয়া শুনিলে এটাকে নিতান্ত ঘরোয়া গ্রাম্য বৈবাহিক ব্যাপার, সামান্য একটু পুতুপুতু ধরনের পূর্বরাগ বলিয়া উড়াইয়া দিতাম। ওখানে ইহার অভিনবত্ব ও সৌন্দর্যে মন মুগ্ধ হইল। দুইটি নরনারী কি করিয়া পরস্পরকে লাভ করিয়াছিল তাহাদের জীবনে, এ-ইতিহাস যে কতখানি রহস্যময়, তাহা বুঝিয়াছিলাম সেদিন।
চা-পান শেষ করিতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া আকাশে পাতলা জ্যোৎস্না ফুটিল। ষষ্ঠী, কি সপ্তমী তিথি।
আমি বন্দুক লইয়া বলিলাম-চল রাজু, দেখি তোমার ক্ষেতে কোথায় শূকর।
একটা বড় তুঁতগাছ ক্ষেতের এক পাশে। রাজু বলিল-এই গাছের ওপর উঠতে হবে হুজুর। আজ সকালে একটা মাচা বেঁধেছি ওর একটা দো-ডালায়।
আমি দেখিলাম, বিষম মুশকিল। গাছে ওঠা অনেক দিন অভ্যাস নাই। তার উপর এই রাত্রিকালে। কিন্তু রাজু উৎসাহ দিয়া বলিল-কোনো কষ্ট নেই হুজুর। বাঁশ দেওয়া আছে, নিচেই ডালপালা, খুব সহজ ওঠা।
রাজুর হাতে বন্দুক দিয়া ডালে উঠিয়া মাচায় বসিলাম। রাজু অবলীলাক্রমে আমার পিছু পিছু উঠিল। দুজনে জমির দিকে দৃষ্টি রাখিয়া মাচার উপর বসিয়া রহিলাম পাশাপাশি।
জ্যোৎস্না আরো ফুটিল। তুঁতগাছের দো-ডালা হইতে জ্যোৎস্নালোকে কিছু স্পষ্ট কিছু অস্পষ্ট জঙ্গলে শীর্ষদেশ ভারি অদ্ভুত ভাব মনে আনিতেছিল। ইহাও জীবনের এক নূতন অভিজ্ঞতা বটে।
একটু পরে চারিপাশের জঙ্গলে শিয়ালের পাল ডাকিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা কালোমতো কি জানোয়ার দক্ষিণ দিকের ঘন জঙ্গলের ভিতর হইতে বাহির হইয়া রাজুর ক্ষেতে ঢুকিল।
রাজু বলিল-ঐ দেখুন হুজুর-
আমি বন্দুক বাগাইয়া ধরিলাম, কিন্তু আরো কাছে আসিলে জ্যোৎস্নালোকে দেখা গেল সেটা শূকর নয়, একটা নীলগাই।
নীলগাই মারিবার প্রবৃত্তি হইল না, রাজু মুখে ‘দূর দূর’ বলিতে সেটা ক্ষিপ্রপদে জঙ্গলের দিকে চলিয়া গেল। আমি একটা ফাঁকা আওয়াজ করিলাম।
ঘণ্টা দুই কাটিয়া গেল। দক্ষিণ দিকের সে জঙ্গলটার মধ্যে বনমোরগ ডাকিয়া উঠিল। ভাবিয়াছিলাম দাঁতওয়ালা ধাড়ী শূকরটা মারিব, কিন্তু একটা ক্ষুদ্র শূকর-শাবকেরও টিকি দেখা গেল না। নীলগাইয়ের পিছনে ফাঁকা আওয়াজ করা অত্যন্ত ভুল হইয়াছে।
রাজু বলিল-নেমে চলুন হুজুর, আপনার আবার ভোজনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি বলিলাম-কিসের ভোজন? আমি কাছারিতে যাব-রাত এখনো দশটা বাজে নি-থাকবার জো নেই। সকালে কাল সার্ভে ক্যাম্পে কাজ দেখতে বেরুতে হবে।
-খেয়ে যান হুজুর।
-এর পর আর নাঢ়া-বইহারের জঙ্গল দিয়ে একা যাওয়া ঠিক হবে না, এখনই যাই। তুমি কিছু মনে করো না।
ঘোড়ায় উঠিবার সময় বলিলাম-মাঝে মাঝে তোমার এখানে চা খেতে যদি আসি বিরক্ত হবে না তো?
রাজু বলিল-কি যে বলেন! এই জঙ্গলে একা থাকি, গরিব মানুষ, আমায় ভালোবাসেন তাই চা চিনি এনে তৈরি করিয়ে একসঙ্গে খান। ও কথা বলে আমায় লজ্জা দেবেন না বাবুজী।
সে সময়ে রাজুকে দেখিয়া মনে হইল রাজু এই বয়সেই বেশ দেখিতে, যৌবনে সে যে খুবই সুপুরুষ ছিল, অধ্যাপক-কন্যা সরযূ পিতার তরুণ সুন্দর ছাত্রটির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া নিজের সুরুচির পরিচয় দিয়াছিল।
রাত্রি গভীর। একা প্রান্তর বাহিয়া আসিতেছি। জ্যোৎস্না অস্ত গিয়াছে। কোনো দিকে আলো দেখা যায় না, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা-এ যেন পৃথিবী হইতে জনহীন কোনো অজানা গ্রহলোকে নির্বাসিত হইয়াছি-দিগন্তরেখায় জ্বলজ্বলে বৃশ্চিকরাশি উদিত হইতেছে, মাথার উপরে অন্ধকার আকাশে অগণিত দ্যুতিলোক, নিন্মে লবটুলিয়া বইহারের নিস্তব্ধ অরণ্য, ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে পাতলা অন্ধকারে বনঝাউয়ের শীর্ষ দেখা যাইতেছে-দূরে কোথায় শিয়ালের দল প্রহর ঘোষণা করিল-আরো দূরে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের সীমারেখা অন্ধকারে দীর্ঘ কালো পাহাড়ের মতো দেখাইতেছে-অন্য কোনো শব্দ নাই কেবল এক ধরনের পতঙ্গের একঘেয়ে একটানা কির্-র্-র্- শব্দ ছাড়া; কান পাতিয়া ভালো করিয়া শুনিলে ঐ শব্দের সঙ্গে মিশানো আরো দু-তিনটি পতঙ্গের আওয়াজ শোনা যাইবে। কি অদ্ভুত রোমান্স এই মুক্ত জীবনে, প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ নিবিড় পরিচয়ের সে কি আনন্দ! সকলের উপর কি একটা অনির্দেশ্য, অব্যক্ত রহস্য মাখানো-কি সে রহস্য জানি না-কিন্তু বেশ জানি সেখান হইতে চলিয়া আসিবার পরে আর কখনো সে রহস্যের ভাব মনে আসে নাই।
যেন এই নিস্তব্ধ, নির্জন রাত্রে দেবতারা নক্ষত্ররাজির মধ্যে সৃষ্টির কল্পনায় বিভোর, যে কল্পনায় দূর ভবিষ্যতে নব নব বিশ্বের আবির্ভাব, নব নব সৌন্দর্যের জন্ম, নানা নব প্রাণের বিকাশ বীজরূপে নিহিত। শুধু যে-আত্মা নিরলস অবকাশ যাপন করে জ্ঞানের আকুল পিপাসায়, যার প্রাণ বিশ্বের বিরাটত্ব ও ক্ষুদ্রত্বের সম্বন্ধে সচেতন আনন্দে উল্লসিত-জন্মজন্মান্তরের পথ বাহিয়া দূর যাত্রার আশায় যার ক্ষুদ্র তুচ্ছ বর্তমানের দুঃখ-শোক বিন্দুবৎ মিলাইয়া গিয়াছে…সে-ই তাঁদের সে রহস্যরূপ দেখিতে পায়। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ…
এভারেস্ট শিখরে উঠিয়া যাহারা তুষারপ্রবাহে ও ঝঞ্ঝায় প্রাণ দিয়াছিল, তাহারা বিশ্বদেবতার এই বিরাট রূপকে প্রত্যক্ষ করিয়াছে…কিংবা কলম্বাস যখন আজোরেস্ দ্বীপের উপকূলে দিনের পর দিন সমুদ্রবাহিত কাষ্ঠখণ্ডে মহাসমুদ্রপারের অজানা মহাদেশের বার্তা জানিতে চাহিয়াছিলেন-তখন বিশ্বের এই লীলাশক্তি তাঁর কাছে ধরা দিয়াছিল-ঘরে বসিয়া তামাক টানিয়া প্রতিবেশীর কন্যার বিবাহ ও ধোপা-নাপিত করিয়া যাহারা আসিতেছে-তাহাদের কর্ম নয় ইহার স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করা।
২
মিছি নদীর উত্তর পাড়ে জঙ্গলের ও পাহাড়ের মধ্যে সার্ভে হইতেছিল। এখানে আজ আট-দশ দিন তাঁবু ফেলিয়া আছি। এখনো দশ-বারো দিন হয়তো থাকিতে হইবে।
স্থানটা আমাদের মহাল হইতে অনেক দূরে, রাজা দোবরু পান্নার রাজত্বের কাছাকাছি। রাজত্ব বলিলাম বটে, কিন্তু রাজা দোবরু তো রাজ্যহীন রাজা-তাহার আবাসস্থলের খানিকটা নিকটে পর্যন্ত বলা যায়।
বড় চমৎকার জায়গা। একটা উপত্যকা, মুখের দিকটা বিস্তৃত, পিছনের দিক সংকীর্ণ-পূর্বে পশ্চিমে পাহাড়শ্রেণী-মধ্যে এই অশ্বক্ষুরাকৃতি উপত্যকা-বন্ধুর ও জঙ্গলাকীর্ণ, ছোট বড় পাথর ছড়ানো সর্বত্র, কাঁটা-বাঁশের বন, আরো নানা গাছপালার জঙ্গল। অনেকগুলি পাহাড়ি ঝরনা উত্তর দিক হইতে নামিয়া উপত্যকার মুক্ত প্রান্ত দিয়া বাহিরের দিকে চলিয়াছে। এইসব ঝরনার দু-ধারে বন বড় বেশি ঘন, এবং এতদিনের বসবাসের অভিজ্ঞতা হইতে জানি এইসব জায়গাতেই বাঘের ভয়। হরিণ আছে, বন্য মোরগ ডাকিতে শুনিয়াছি দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে। ফেউয়ের ডাক শুনিয়াছি বটে, তবে বাঘ দেখি নাই বা আওয়াজ পাই নাই।
পূর্ব দিকের পাহাড়ের গায়ে একটা প্রকাণ্ড গুহা। গুহার মুখের প্রাচীন ঝাঁপালো বটগাছ-দিনরাত শন্শন্ করে। দুপুররোদে নীল আকাশের তলায় এই জনহীন বন্য উপত্যকা ও গুহা বহু প্রাচীন যুগের ছবি মনে আনে, যে-যুগে আদিম জাতির রাজাদের হয়তো রাজপ্রাসাদ ছিল এই গুহাটা, যেমন রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষের আবাস-গুহা। গুহার দেওয়ালে একস্থানে কতকগুলো কি খোদাই করা ছিল, সম্ভবত কোনো ছবি-এখন বড়ই অস্পষ্ট, ভালো বোঝা যায় না। কত বন্য আদিম নরনারীর হাস্যকলধ্বনি, কত সুখদুঃখ-বর্বর সমাজের অত্যাচারের কত নয়নজলের অলিখিত ইতিহাস এই গুহার মাটিতে, বাতাসে, পাষাণ-প্রাচীরের মধ্যে লেখা আছে- ভাবিতে বেশ লাগে।
গুহামুখ হইতে রশি-দুই দূরে ঝরনার ধারে বনের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় একটি গোঁড়-পরিবার বাস করে। দুখানা খুপরি, একখানা ছোট, একখানা একটু বড়, বনের ডালপালার বেড়া, পাতার ছাউনি। শিলাখণ্ড কুড়াইয়া তাহা দিয়া উনুন তৈয়ারি করিয়াছে আবরণহীন ফাঁকা জায়গায় খুপরির সামনে। বড় একটা বুনো বাদামগাছের ছায়ায় এদের কুটির। বাদামের পাকা পাতা ঝরিয়া পড়িয়া উঠান প্রায় ছাইয়া রাখিয়াছে।
গোঁড়-পরিবারের দুটি মেয়ে আছে, তাদের একটির ষোল-সতের বছর বয়স, অন্যটির বছর চোদ্দ। রং কালো কুচকুচে বটে, কিন্তু মুখশ্রীতে বেশ একটা সরল সৌন্দর্য মাখানো- নিটোল স্বাস্থ্য। মেয়ে দুটি রোজ সকালে দেখি দু-তিনটি মহিষ লইয়া পাহাড়ে চরাইতে যায় আবার সন্ধ্যার পূর্বে ফিরিয়া আসে। আমি তাঁবুতে ফিরিয়া যখন চা খাই, তখন দেখি মেয়ে দুটি আমার তাঁবুর সামনে দিয়া মহিষ লইয়া বাড়ি ফিরিতেছে।
একদিন বড় মেয়েটি রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া তার ছোট বোনকে আমার তাঁবুতে পাঠাইয়া দিল। সে আসিয়া বলিল-বাবুজী, সেলাম। বিড়ি আছে? দিদি চাইছে।
-তোমরা বিড়ি খাও?
-আমি খাই নে, দিদি খায়। দাও না বাবুজী একটা, আছে?
– আমার কছে বিড়ি নেই। চুরুট আছে – কিন্তু সে তোমাদের দেব না। বড় কড়া, খেতে পারবে না।
মেয়েটি চলিয়া গেল।
আমি একটু পরে ওদের বাড়ি গেলাম। আমাকে দেখিয়া গৃহকর্তা খুব বিস্মিত হইল- খাতির করিয়া বসাইল। মেয়ে দুটি শালপাতায় ‘ঘাটো’ অর্থাৎ মকাই-সিদ্ধ ঢালিয়া নুন দিয়া খাইতে বসিয়াছে। সম্পূর্ণরূপে নিরূপকরণ মকাই-সিদ্ধ। তাদের মা কি একটা জ্বাল দিতেছে উনুনে। দুটি ছোট ছোট বালক-বালিকা খেলা করিতেছে।
গৃহকর্তার বয়স পঞ্চাশের উপর। সুস্থ, সবল চেহারা। আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিল তাদের বাড়ি সিউনী জেলাতে। এখানে এই পাহাড়ে মহিষ চরাইবার ঘাস ও পানীয় জল প্রচুর আছে বলিয়া আজ বছরখানেক হইতে এখানে আছে। তা ছাড়া এখানকার জঙ্গলের কাঁটা-বাঁশে ধামা চুপড়ি ও মাথায় দিবার টোকা তৈরি করিবার খুব সুবিধা। শিবরাত্রির সময় অখিলকুচার মেলায় বিক্রি করিয়া দু’পয়সা হয়!
জিজ্ঞাসা করিলাম-এখানে কতদিন থাকবে?
-যতদিন মন যায়, বাবুজী! তবে এ-জায়গাটা বড় ভালো লেগেছে, নইলে এক বছর আমরা কোথাও একটানা থাকি না। এখানে একটা বড় সুবিধা আছে, পাহাড়ের ওপর জঙ্গলে এত আতা ফলে-দু-ঝুড়ি করে গাছপাকা আতা আশ্বিন মাসে আমার মেয়েরা মহিষ চরাতে গিয়ে পেড়ে আনতো-শুধু আতা খেয়ে আমরা মাস-দুই কাটিয়েছি; আতার লোভেই এখানে থাকা। জিজ্ঞেস করুন না ওদের?
বড় মেয়েটি খাইতে খাইতে উজ্জ্বল মুখে বলিল- উঃ একটা জায়গা আছে, ওই পুবদিকের পাহাড়ের কোণের দিকে, কত যে বুনো আতাগাছ, ফল পেকে ফেটে কত মাটিতে পড়ে থাকে, কেউ খায় না। আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি তুলে আনতাম।
এমন সময় কে একজন ঘন-বনের দিক হইতে আসিয়া খুপরির সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল- সীতারাম, সীতারাম-জয় সীতারাম-একটু আগুন দিতে পার?
গৃহকর্তা বলিল-আসুন-বাবাজী, বসুন।
দেখিলাম, জটাজূটধারী একজন বৃদ্ধ সাধু। সাধু ইতিমধ্যে আমায় দেখিতে পাইয়া একটু বিস্ময়ের ও বোধ হয় কথঞ্চিৎ ভয়ের সঙ্গে, সঙ্কুচিত হইয়া একপাশে দাঁড়াইয়া ছিল।
আমি বলিলাম-প্রণাম, সাধু বাবাজী-
সাধু আশীর্বাদ করিল বটে, কিন্তু তখনো যেন তাহার ভয় যায় নাই।
তাহাকে সাহস দিবার জন্য বলিলাম-কোথায় থাকা হয় বাবাজীর?
আমার কথার উত্তর দিল গৃহস্বামী। বলিল-বড্ড গজার জঙ্গলের মধ্যে উনি থাকেন, ওই দুই পাহাড় যেখানে মিশেছে, ওই কোণে। অনেক দিন আছেন এখানে।
বৃদ্ধ সাধু ইতিমধ্যে বসিয়া পড়িয়াছে। আমি সাধুর দিকে চাহিয়া বলিলাম-কতদিন এখানে আছেন?
এবার সাধুর ভয় ভাঙ্গিয়াছে, বলিল-আজ পনের-ষোল বছর, বাবুসাহেব।
-একা থাকা হয় তো? বাঘ আছে শুনেছি এখানে, ভয় করে না?
-আর কে থাকবে বাবুসাহেব? পরমাত্মার নাম নিই-ভয়ডর করলে চলবে কেন? আমার বয়স কত বল তো বাবুসাহেব?
ভালো করিয়া লক্ষ্য করিয়া বলিলাম-সত্তর হবে।
সাধু হাসিয়া বলিল-না বাবুসাহেব, নব্বইয়ের উপর হয়েছে। গয়ার কাছে এক জঙ্গলে ছিলাম দশ বছর। তারপর ইজারাদার জঙ্গলের গাছ কাটতে লাগল, ক্রমে সেখানে লোকের বাস হয়ে পড়ল। সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। লোকালয়ে থাকতে পারি নে।
-সাধু বাবাজী, এখানে একটা গুহা আছে, তুমি সেখানে থাক না কেন?
-একটা কেন বাবুসাহেব, কত গুহা আছে, এ-পাহাড়ে। আমি ওদিকে যেখানে থাকি সেটাও ঠিক গুহা না হলেও গুহার মতো বটে। মানে তার মাথায় ছাদ ও দু-দিকে দেয়াল আছে-সামনেটা কেবল খোলা।
-কি খাও? ভিক্ষা কর?
-কোথাও বেরুই নে বাবুসাহেব। পরমাত্মা আহার জুটিয়ে দেন। বাঁশের কোঁড় সেদ্ধ খাই, বনে এক রকম কন্দ হয় তা ভারি মিষ্টি, লাল আলুর মতো খেতে, তা খাই। পাকা আমলকী ও আতা এ-জঙ্গলে খুব পাওয়া যায়। আমলকী খুব খাই, রোজ আমলকী খেলে মানুষ হঠাৎ বুড়ো হয় না, যৌবন ধরে রাখা যায় বহুদিন। গাঁয়ের লোক মাঝে মাঝে দর্শন করতে এসে দুধ, ছাতু, ভুরা দিয়ে যায়। চলে যাচ্ছে এই সবে এক রকম করে।
-বাঘ ভালুকের সামনে পড়েছ কখনো?
-কখনো না। তবে ভয়ানক এক জাতের অজগর সাপ দেখেছি এই জঙ্গলে-এক জায়গায় অসাড় হয়ে পড়ে ছিল-তালগাছের মতো মোটা, মিশ্কালো, সবুজ রাঙা আঁজি কাটা গায়ে। চোখ আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। এখনো সেটা এই জঙ্গলেই আছে। তখন সেটা জলের ধারে পড়ে ছিল, বোধ হয় হরিণ ধরবার লোভে। এখনো কোনো গুহাগহ্বরে লুকিয়ে আছে। আচ্ছা যাই বাবুসাহেব, রাত হয়ে গেল।
সাধু আগুন লইয়া চলিয়া গেল। শুনিলাম মাঝে মাঝে সাধুটি এদের এখানে আগুন লইতে আসিয়া কিছুক্ষণ গল্প করিয়া যায়।
অন্ধকার পূর্বেই হইয়াছিল, এখন একটু মেটে মেটে জ্যোৎস্না উঠিয়াছে। উপত্যকার বনানী অদ্ভুত নীরবতায় ভরিয়া গিয়াছে। কেবল পার্শ্বস্থ পাহাড়ি ঝরনার কুলুকুলু স্রোতের ধ্বনি ও ক্বচিৎ দু-একটা বন্য মোরগের ডাক ছাড়া কোনো শব্দ কানে আসে নাই।
তাঁবুতে ফিরিলাম। পথে বড় একটা শিমুলগাছে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি জ্বলিতেছে, ঘুরিয়া ঘুরিয়া চক্রাকারে, উপর হইতে নিচু দিকে, নিচু হইতে উপরের দিকে- নানারূপ জ্যামিতির ক্ষেত্র অঙ্কিত করিয়া আলো-আঁধারের পটভূমিতে।
৩
এইখানে একদিন আসিল কবি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ। লম্বা, রোগা চেহারা, কালো সার্জের কোট গায়ে, আধময়লা ধুতি পরনে, মাথার চুল রুক্ষ ও এলোমেলো, বয়স চল্লিশ ছাড়াইয়াছে।
ভাবিলাম চাকুরির উমেদার। বলিলাম-কি চাই?
সে বলিল-বাবুজীর (হুজুর বলিয়া সম্বোধন করিল না) দর্শনপ্রার্থী হয়ে এসেছি। আমার নাম বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ। বাড়ি বিহার শরীফ, পাটনা জিলা। এখানে চক্মকিটোলায় থাকি, তিন মাইল দূর এখান থেকে!
-ও, তা এখানে কি জন্যে?
-বাবুজী যদি দয়া করে অনুমতি করেন, তবে বলি। আপনার সময় নষ্ট করছি নে?
তখন আমি ভাবিতেছি লোকটা চাকুরির জন্যই আসিয়াছে। কিন্তু ‘হুজুর’ না-বলাতে সে আমার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিল। বলিলাম-বসুন, অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছেন এই গরমে।
আর একটি বিষয় লক্ষ্য করিলাম-লোকটির হিন্দি খুব মার্জিত। সে-রকম হিন্দিতে আমি কথা বলিতে পারি না। সিপাহী পিয়াদা ও গ্রাম্য প্রজা লইয়া আমার কারবার, আমার হিন্দি তাহাদের মুখে শেখা দেহাতী বুলির সহিত বাংলা ইডিয়ম মিশ্রিত একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার। এ-ধরনের ভদ্র ও পরিমার্জিত, ভব্য হিন্দি কখনো শুনি নাই, তা বলিব কিরূপে? সুতরাং একটু সাবধানের সহিত বলিলাম-কি আপনার আসার উদ্দেশ্য বলুন।
সে বলিল-আমি আপনাকে কয়েকটি কবিতা শুনাতে এসেছি।
দস্তুরমতো বিস্মিত হইলাম। এই জঙ্গলে আমাকে কবিতা শোনাইতে আসিবার এমন কি গরজ পড়িয়াছে লোকটির, হইলই বা কবি?
বলিলাম-আপনি একজন কবি? খুব খুশি হলাম। আপনার কবিতা খুব আনন্দের সঙ্গে শুনব। কিন্তু আপনি কি করে আমার সন্ধান পেলেন?
-এই মাইল-তিন দূরে আমার বাড়ি। পাহাড়ের ঠিক ওপারেই। আমাদের গ্রামে সবাই বলছিল কলকাতা থেকে এক বাঙালি বাবু এসেছেন। আপনাদের কাছে বিদ্যার বড় আদর, কারণ আপনারা নিজে বিদ্বান্। কবি বলছেন-
বিদ্বৎসু সৎকবির্বাচা লভতে প্রকাশং
ছাত্রেষু কুট্মলসমং তৃণবজ্জড়েষু।
বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ আমায় কবিতা শোনাইল। কোনো-একটা রেললাইনের টিকিট চেকার, বুকিং ক্লার্ক, স্টেশন-মাস্টার, গার্ড প্রভৃতির নামের সঙ্গে জড়াইয়া এক সুদীর্ঘ কবিতা। কবিতা খুব উঁচুদরের বলিয়া মনে হইল না। তবে আমি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের প্রতি অবিচার করিতে চাই না। তাহার ভাষা আমি ভালো বুঝি নাই-সত্য কথা বলিতে গেলে, বিশেষ কিছুই বুঝি নাই। তবুও মাঝে মাঝে উৎসাহ ও সমর্থনসূচক শব্দ উচ্চারণ করিয়া গেলাম।
বহুক্ষণ কাটিয়া গেল। বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ কবিতাপাঠ থামায় না, উঠিবার নাম করা তো দূরের কথা।
ঘণ্টা দুই পরে সে একটু চুপ করিয়া হাসি-হাসি মুখে বলিল-কি রকম লাগলো বাবুজীর?
বলিলাম-চমৎকার! এমন কবিতা খুব কমই শুনেছি। আপনি কোনো পত্রিকায় আপনার কবিতা পাঠান না কেন?
বেঙ্কটেশ্বর দুঃখের সহিত বলিল-বাবুজী, এদেশে আমাকে সবাই পাগল বলে। কবিতা বুঝবার মানুষ এ-সব জায়গায় কি আছে ভেবেছেন? আপনাকে শুনিয়ে আমার আজ তৃপ্তি হোলো। সমঝদারকে এসব শোনাতে হয়। তাই আপনার কথা শুনেই আমি ভেবেছিলাম একদিন সময়মতো এসে আপনাকে ধরতে হবে।
সেদিন সে বিদায় লইল কিন্তু পরদিন বৈকালে আসিয়া আমায় পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল তাহাদের গ্রামে তাহাদের বাড়িতে আমায় একবার যাইতে। অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তাহার সহিত পায়ে হাঁটিয়া চক্মকিটোলা রওনা হইলাম।
বেলা পড়িয়াছে। সম্মুখে গম যবের ক্ষেতে বহুদূর জুড়িয়া উত্তর দিকের পাহাড়ের ছায়া পড়িয়াছে। কেমন একটা শান্তি চারিধারে, সিল্লী পাখির ঝাঁক কাঁটা-বাঁশঝাড়ের উপর উড়িয়া আসিয়া বসিতেছে, গ্রাম্য বালকবালিকারা এক জায়গায় ঝরনার জলে ছোট ছোট মাছ ধরিবার চেষ্টা করিতেছে।
গ্রামের মধ্যে ঠাসাঠাসি বসতি। চালে চালে বাড়ি, অনেক বাড়িতেই উঠান বলিয়া জিনিস নাই। মাঝারিগোছের একখানা খোলা-ছাওয়া বাড়িতে বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ আমায় লইয়া গিয়া তুলিল। রাস্তার ধারেই তাঁর বাড়ির বাইরের ঘর, সেখানে একখানা কাঠের চৌকিতে বসিলাম। একটু পরে কবি-গৃহিণীকেও দেখিলাম-তিনি স্বহস্তে দইবড়া ও মকাইভাজা আমার জন্য লইয়া যে চৌকিতে বসিয়াছিলাম তাহারই একপ্রান্তে স্থাপন করিলেন বটে, কিন্তু কথা কহিলেন না, যদিও তিনি অবগুণ্ঠনবতীও ছিলেন না। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হইবে, রং তত ফর্সা না হইলেও মন্দ নয়, মুখশ্রী বেশ শান্ত, সুন্দরী বলা না গেলেও কবিপত্নী কুরূপা নহেন। ধরন-ধারণের মধ্যে একটি সরল, অনায়াসশিষ্টতা ও শ্রী।
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিলাম- কবিগৃহিণীর স্বাস্থ্য। কি জানি কেন এদেশে যেখানে গিয়াছি, মেয়েদের স্বাস্থ্য সর্বত্র বাংলা দেশের মেয়েদের চেয়ে বহুগুণে ভালো বলিয়া মনে হইয়াছে। মোটা নয়, অথচ বেশ লম্বা, নিটোল, আঁটসাঁট গড়নের মেয়ে এদেশে যত বেশি, বাংলা দেশে তত দেখি নাই। কবিগৃহিণীও ওই ধরনের মেয়েটি।
একটু পরে তিনি একবাটি মহিষের দুধের দই খাটিয়ার একপাশে রাখিয়া সরিয়া দরজার কবাটের আড়ালে দাঁড়াইলেন। শিকল নাড়ার শব্দ শুনিয়া বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ উঠিয়া স্ত্রীর নিকটে গেল এবং তখনই হাসিমুখে আসিয়া বলিল- আমার স্ত্রী বলছে আপনি আমাদের বন্ধু হয়েছেন, বন্ধুকে একটু ঠাণ্ডা করতে হয় কিনা তাই দইয়ের সঙ্গে বেশি করে পিপুল শুঁট ও লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো রয়েছে।
আমি হাসিয়া বলিলাম- তা যদি হয় তবে আমার একা কেন সকলের চোখ দিয়ে যাতে জল বের হয় তার জন্যে আমি প্রস্তাব করছি এই দই তিনজনেই খাব। আসুন- । কবিপত্নী দরজার আড়াল হইতে হাসিলেন। আমি ছাড়িবার পাত্র নই, দই তাঁহাকেও খাওয়াইয়া ছাড়িলাম।
একটু পরে কবিপত্নী বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলেন এবং একটা থালা হাতে আবার আসিয়া খাটিয়ার প্রান্তে থালাটি রাখিলেন; এবার আমার সামনেই চাপা, কৌতুকমিশ্রিত সুরে আমাকে শুনাইয়া বলিলেন- বাবুজীকে বল এইবার ঘরের তৈরি প্যাঁড়া খেয়ে গালের জ্বলুনি থামান।
কি সুন্দর মিষ্টি মেয়েলি ঠেঁট হিন্দি বুলি!
বড় ভালো লাগে এ-অঞ্চলের মেয়েদের মুখে এই হিন্দির টানটি। নিজে ভালো হিন্দি বলিতে পারি না বলিয়া আমার কথ্য হিন্দির প্রতি বেজায় আকর্ষণ। বইয়ের হিন্দি নয়-এইসব পল্লীপ্রান্তে, পাহাড়তলিতে, বনদেশের মধ্যে, বিস্তীর্ণ শ্যামল যব গম ক্ষেতের পাশে, চলনশীল চামড়ার রহট্ যেখানে মহিষের দ্বারা ঘূর্ণিত হইয়া ক্ষেতে ক্ষেতে জল সেচন করিতেছে, অস্তসূর্যের ছায়াভরা অপরাহে¦ দূরের নীলাভ শৈলশ্রেণীর দিকে উড়ন্ত বালিহাঁস বা সিল্লী বা বকের দল যেখানে একটা দূরবিসর্পী ভূপৃষ্ঠের আভাস বহন করিয়া আনে-সেখানকার সে হঠাৎ-শেষ-হইয়া-যাওয়া, কেমন যেন আধ-আধ, ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ক্রিয়াপদযুক্ত এক ধরনের ভাষা, যাহা বিশেষ করিয়া মেয়েদের মুখে সাধারণত শোনা যায়-তাহার প্রতি আমার টান খুব বেশি।
হঠাৎ আমি কবিকে বলিলাম- দয়া করে দুএকটা কবিতা পড়ুন না আপনার?
বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের মুখ উৎসাহে উজ্জ্বল দেখাইল। একটি গ্রাম্য প্রেমকাহিনী লইয়া কবিতা লিখিয়াছে, সেটি পড়িয়া শুনাইল। ছোট্ট একটি খালের এ-পারের মাঠে এক তরুণ যুবক বসিয়া ভুট্টার ক্ষেত পাহারা দিত, খালের ওপারের ঘাটে একটি মেয়ে আসিত নিত্য কলসি-কাঁখে জল ভরিতে। ছেলেটি ভাবিত মেয়েটি বড় সুন্দর। অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া শিস দিয়া গান করিত, ছাগল গোরু তাড়াইত, মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে চাহিয়া দেখিত। কত সময়ে দুজনের চোখাচোখি হইয়া গিয়াছে। অমনি লজ্জায় লাল হইয়া কিশোরী চোখ নামাইয়া লইত। ছেলেটি রোজ ভাবিত, কাল সে মেয়েটিকে ডাকিয়া কথা কহিবে। বাড়ি ফিরিয়া সে মেয়েটির কথা ভাবিত। কত কাল কাটিয়া গেল, কত ‘কাল’ আসিল, কত চলিয়া গেল- মনের কথা আর বলা হইল না। তারপর একদিন মেয়েটি আসিল না, পরদিনও আসিল না; দিন, সপ্তাহ, মাস কাটিয়া গেল, কোথায় সে প্রতিদিনের সুপরিচিতা কিশোরী? ছেলেটি হতাশ হইয়া রোজ রোজ ফিরিয়া আসে মাঠ হইতে- ভীরু প্রেমিক সাহস করিয়া কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে না- ক্রমে ছেলেটিকে দেশ ছাড়িয়া অন্যত্র চাকুরি লইতে হইল। বহুকাল কাটিয়া গিয়াছে। কিন্তু ছেলেটি সেই নদীর ঘাটের রূপসী বালিকাকে আজও ভুলিতে পারে নাই।
দূরের নীল শৈলমালা ও দিগন্তবিস্তারী শস্যক্ষেত্রের দিকে চোখ রাখিয়া প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় এই কবিতাটি শুনিতে শুনিতে কতবার মনে হইল, এ কি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদেরই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা? কবি-প্রিয়ার নাম রুক্মা, কারণ ঐ নামে কবি একটি কবিতা লিখিয়াছে, পূর্বে আমাকে তাহা শুনাইয়াছিল। ভাবিলাম এমন গুণবতী, সুরূপা রুক্মাকে পাইয়াও কি কবির বাল্যের সে দুঃখ আজও দূর হয় নাই?
আমাকে তাঁবুতে পৌঁছিয়া দিবার সময়ে বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ একটি বড় বটগাছ দেখাইয়া বলিল- ঐ যে দেখছেন বাবুজী, ওর তলায় সেবার সভা হইয়াছিল, অনেক কবি মিলে কবিতা পড়েছিল। এদেশে বলে মুসায়েরা। আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। আমার কবিতা শুনে পাটনার ঈশ্বরীপ্রসাদ দুবে-চেনেন ঈশ্বরীপ্রসাদকে?- ভারি এলেমদার লোক, ‘দূত’ পত্রিকার সম্পাদক-নিজেও একজন ভালো কবি-আমায় খুব খাতির করেছিলেন।
কথা শুনিয়া মনে হইল বেঙ্কটেশ্বর জীবনে এই একবারই সভাসমিতিতে দাঁড়াইয়া নিজের কবিতা আবৃত্তি করিবার নিমন্ত্রণ পাইয়াছিল এবং সে দিনটি তাহার জীবনের একটা খুব বড় ও স্মরণীয় দিন গিয়াছে। এতবড় সম্মান আর কখনো সে পায় নাই।