জালালুদ্দিন বললেন, কে?
তিনি বারান্দায় এসে আছেন। সকাল নটার মত বাজে। বাড়িতে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। মিনু গেছেন বাজারে। তিথি কোথায় গেছে। তিনি জানেন না। যাবার আগে তাকে বলে যায়নি। হীরু গত রাতে বাড়ি ফিরেনি। টুকু অবশ্যি রাতে বাড়িতেই ছিল। ভোরবেলা কোথায় বেরিয়ে গেছে। এই ছেলে কখন আসছে কখন যাচ্ছে কোনো ঠিক নেই। শক্ত মারধব করতে পারেন না। এই একটা সমস্যা। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় মায়ের দায়িত্বটা তাকেই নিতে হবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নিতে হবে।
টুকু থাকলে সুবিধা হত। এই যে লোকটা এতক্ষণ এসেছে। কথাবার্তা বলছে না দাঁড়িয়ে আছে, তার ব্যাপারটা কি তা টুকু চট করে ধরে ফেলত। লোকটা কোনো বদ মতলবে এসেছে কিনা কে জানে।
জালালুদ্দিন আবার বললেন, কে?
লোকটি এইবার কথা বলল। তার গলার স্বর নরম এবং সে ইতস্তত ভঙ্গিতে কথা বলছে। কাজেই লোকটা সম্ভবত খারাপ না। খারাপ লোক এইভাবে কথা বলে না।
আমার নাম দবির। আমার ছোটখাটো ব্যবসা আছে। আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়নি।
দেখা হলেও চিনতাম না। আমি চোখে দেখি না।
তাই নাকি?
জালালুদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বিরাট যন্ত্রণায় আছি ভাই। আপনি বাইরের মানুষ। ভেতরের কথা আপনাকে কি বলব? সামান্য চিকিৎসা করালেই অসুখ সারে। সেটা কেউ করাবে না। আপনি কার কাছে এসেছেন?
দবির ইতস্তত করে বললেন, পরী কিংবা তিথি বলে কেউ কি এখানে থাকেন?
পরী বলে কেউ থাকে না। তবে তিথি আছে। আমার দ্বিতীয় কন্যা। ভাল নাম ইশরাত জাহান। ও কোথায় যেন গেছে।
কোথায় গেছে জানেন?
জি না। আমাকে কিছু বলে যায়নি। আগে বলত এখন আর বলে-টলে না। সম্ভবত ওর মাকে বলে গেছে। বসুন, ওর মা এসে পড়বে। ওর মা কাঁচার বাজারে গেছে। ঘরে কাজের লোক নেই। নিজেদেরই সব করতে হয়। ঐখানে একটা জলচৌকি আছে। টেনে নিয়ে বসুন। ঘরের ভেতর চেয়ার আছে, ঘরে তালা দিয়ে গেছে এই জন্যে চেয়ার দিতে পারছি না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
দবির বললেন, আমি বসব না। কাজ ফেলে এসেছি। আপনি দয়া করে তিথিকে বলবেন, আমি এসেছিলাম। নাম বললেই হবে। আমার নাম দবির তাকে একটু বলবেন যেন আমার বাসায় যায়। আমার স্ত্রীর কিছু কথা আছে তার সঙ্গে। জরুরি কথা।
বলব। অবশ্যই বলব। বাসার ঠিকানা কি তিথি জানে?
জি জানে। তাছাড়া এই কার্ডটাও রেখে গেলাম। কার্ডে ঠিকানা আছে।
বলব। তিথি আসলেই বলব। তা এসেছেন যখন খানিকক্ষণ বসেই যান। আমার স্ত্রী এসে পড়বেন। তখন চা খেতে পারবেন। কষ্ট করে এসেছেন। শুধু মুখে যাবেন। এটা কেমন কথা।
জি না। আজ আর বসব না।
জালালুদ্দিন খানিকক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত থেকে বললেন, ভাইসাব আপনার কাছে সিগারেট আছে? প্যাকেটটা রয়েছে ভেতরে। আমার স্ত্রী ঘরে তালা দিয়ে চলে গেলেন। চাবিটাও নেই। থাকলে আপনাকে বলতাম না।
দবির বললেন, সিগারেট তো আমি খাই না। তবে এনে দিচ্ছি।
তাহলে দরকার নেই। বাদ দেন। সঙ্গে থাকলে ভিন্ন কথা।
কোনো অসুবিধা নেই।
জালালুদ্দিন, এই অপরিচিত লোকটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। লোকটা এক প্যাকেট ফাইভ ফাইভ এবং একটা দিয়াশলাই কিনে দিয়ে গেছে। শুধু তাই না। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে গেছে। এরকম একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে তার মেয়ের পরিচয় আছে ভাবতেই ভাল লাগছে। এমন চমৎকার একজন মানুষকে চা খাওয়ানো গেল না। এই দুঃখে তিনি খুবই কাতর হয়ে পড়লেন, পরের বার এলে চা এবং চায়ের সঙ্গে দু’টা মিষ্টি দিতে হবে। এইটুকু ভদ্রতা না করলে খুবই অন্যায় হবে।
মিনু চলে এসেছেন। তাঁর পায়ের শব্দ কানে যেতেই জালালুদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে ফেললেন। মেয়েদের মন থাকে সন্দেহে ভরা। হাজারটা প্রশ্ন করবে। কি দরকার? তিনি উৎসাহের সঙ্গে বললেন, বাজার কি আনলে মিনু?
মিনু জবাব দিলেন না। স্বামীর প্রশ্নের জবাব দেয়া তিনি ইদানীং ছেড়েই দিয়েছেন।
মাছ-টাছ কিছু পাওয়া গেল?
মিনু সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন। না। বাজার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। জালালুদ্দিন তাতে মন খারাপ করলেন না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, এক ফোঁটা চা দিও তো মিনু। বুকে কফ বসে গেছে। চা কফের জন্যে খুবই উপকারী। আমার কথা না। বড় বড় ডাক্তাররা বলেন।
মিনু এই কথায় ঝাঝিয়ে উঠলেন না। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। হয়ত চা পাওয়া যাবে। চা এলে চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট ধরাতে হবে। সব জিনিসের একটা অনুপান আছে। চায়ের অনুপান হচ্ছে সিগারেট। দৈ-এর অনুপান মিষ্টি।
তিথির অবাক হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
কিছুতেই সে এখন আর অবাক হয় না। হীরু যদি তাকে কোনোদিন এসে বলে, দেখ তিথি আমি এখন আকাশে উড়তে পারি। এবং সত্যি সত্যি যদি খানিক্ষণ উড়ে দেখায়, তাহলেও বোধ হয়। তিথি অবাক হবে না।
অথচ দাবির উদ্দিনের রেখে-যাওয়া কার্ড দেখে সে অবাক হল। এই লোক তার ঠিকানা পেল কোথায়? সে তো কোনো ঠিকানা রেখে আসেনি। তার ঠিকানা জানার কথা নয়! দবির উদ্দিনের স্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে চান। এই খবরটিও অবাক হবার মত। তাতে তিথি অবাক হল না। ভদ্রমহিলা অসুস্থ, তার নিশ্চয়ই সময় কাটে না। গল্পগুজব করবার জন্যে তার কিছু মজার চরিত্র দরকার। তিথির মত মজার চরিত্র তিনি আর কোথায় পাবেন।
ঐ বাড়িতে তিথির যেতে ইচ্ছা করছে না। তবু সে হয়ত যাবে। দবির উদ্দিন নামের ঐ লোক তার ঠিকানা কোথায় পেল এটা জানার জন্যেই তাকে যেতে হবে। আর যেতে যখন হবে তখন আজি গেলে কেমন হয়?
তিথি কাপড় বদলাল।
হালকা রঙের একটা শাড়ি পরল। চুলে বেণী করল। আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবল একটু কাজল কি দেবে? চোখের পল্লব ঘেঁষে হালকা রেখা যা চোখে পড়বে না। আবার পড়বেও।
মিনু ঘরে ঢুকে দেখলেন তিথি খুব সাবধানে চোখে কাজল দিচ্ছে। তিথি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিথি বলল, তুমি কিছু বলবে?
না।
তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলে যাও।
মিনু ক্ষীণ স্বরে বললেন, তুই কি আমাকে দেখতে পারিস না। তিথি? তিথি মার দিকে না। তাকিয়ে বলল, না। পারি না।
আমি কি করেছি? আমার দোষটা কী?
তোমাকে কি আমি কোনো দোষ দিয়েছি? দোষ ছাড়াই তোমাকে দেখতে পারি না।
মিনু খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আগের চেয়েও ক্ষীণ গলায় বললেন, অরু চিঠি দিয়েছে।
তিথি কিছু বলল না।
মিনু বললেন, তোর টেবিলের উপর রেখেছি।
আমার টেবিলের উপর রেখেছ কেন? আমি ঐ সব চিঠি-ফিঠি পড়ব না। ভাল্লাগে না।
মিনু চলে গেলেন। তিথি অবশ্যি ঘর থেকে বেরুবার আগে বোনের চিঠি পড়ল। একবার না। দুবার পড়ল। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। মার কাছে লেখা।
মা,
আমার সালাম নিও। আমি বুঝতে পারছি, তোমাবা ওর টাকাটা দিতে পারছ না কিংবা দিচ্ছ না। আমি ঐ নিয়ে আর কিছু বলব না। কিন্তু মা তোমার পায়ে পড়ি আমাকে কিছু দিন তোমাদের কাছে এনে রাখ। এখানে আমি মরে যাচ্ছি। হীরুকে পাঠাও মা, আমাকে নিয়ে যাক।
তোমার অরু।
এত সংক্ষিপ্ত চিঠি অরু কখনো লেখে না। তার চিঠি হয় দীর্ঘ। চিঠির শেষের দিকে এসে বাবার বাড়ির সবার সম্পর্কে কিছু না কিছু লেখা থাকে। এই চিঠিতে সে সব কিছু নেই। তিথি ভাবতে চেষ্টা করল। বড়। আপা কি ধরনের কষ্টে আছে? কষ্টের নমুনাটা কি? বড় আপার কষ্টের সঙ্গে তার নিজের কষ্টের কি কোনো মিল আছে? সম্ভবত নেই। সে যে জাতীয় যাতনা বোধ করছে বড় আপার সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, ধারণা থাকার কথাও না। তার বয়স তখন কত? পনেরো কি ষোল? এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তখনো রেজাল্ট হয়নি। বাবা তাকে পাঠালেন। মনজুর সাহেবের কাছে। বাবার দূর-সম্পর্কের ভাই। তিথি তাকে কখনো দেখেনি। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এ জি অফিসে কাজ করেন। থাকেন সরকারি কোয়ার্টারে। তাকে একটা চিঠি দিতে হবে। চিঠিটা বাবার জবানীতে লিখেছে। তিথি। চিঠির বিষয়বস্তু খুবই সাধারণ জালালুদ্দিন সাহেব তাঁর ফুফাতো ভাইকে জানাচ্ছেন যে তিনি সাময়িকভাবে খুবই অসুবিধায় পড়েছেন। যদি দুশ টাকা তাকে দেয়া হয় তাহলে তিনি চির কৃতজ্ঞ থাকবেন। টাকাটা তিনি সামনের মাসে যে করেই হোক ফেরত দেবার ব্যবস্থা করবেন। তিনি নিজেই আসতেন ইদানীং চোখের একটা সমস্যার জন্যে আসতে পারছেন না।
চিঠি নিয়ে যাবার কথা হীরুর। সে গম্ভীর গলায় বলল, এটা তো ভিক্ষা চাওয়া চিঠি। যাকে বলে বেগিং। আমি বেগিং বিজনেসে থাকতে পারব না। জালালুদ্দিন কিছুতেই তাকে রাজি করাতে পারলেন না। শেষটায় মেয়েকে বললেন, তুই যাবি তিথি? গভৰ্মেন্ট কোয়ার্টার। খুঁজে বের করতে কোনো অসুবিধা হবে না। পারবি মা?
তিথি বলল, উনি যদি চিনতে না পারেন?
বলিস কি তুই? চিনতে পারবে না। মানে! পরিচয় পেলে দেখবি কত খাতির-যত্ন করে।
টাকা যদি না দেন তাহলে তো বাবা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
তোর কিসের লজ্জা? তুই তো আর টাকা চাসনি। আমি চেয়েছি। লজ্জা হলে আমার হবে।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি খুব খারাপ ব্যবহার করবেন! বিরক্ত হবেন।
আহা গিয়ে দেখি না। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
যদি চিনতে না পারেন?
মনজুর সাহেব তাকে চিনতে পারলেন। হাসিমুখে বললেন, তোমাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছি। তোমার মনে নেই। তবে তোমার বড় বোনের নিশ্চয়ই মনে আছে। কি নাম যেন তার? অরুমিনা না?
জি। ডাকনাম অরু।
তোমার বাবার তো আমার খুব কাব্যিক নাম রাখার বাতিক। তোমার নাম কি?
তিথি।
বাহ খুব সুন্দর নাম। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেন। তিথিদের অবস্থা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন এবং আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, এই সাময়িক সাহায্য তো কিছু হবে না। স্থায়ী কিছু করতে হবে। কিভাবে করা যায় সেটা হচ্ছে কথা। তোমার ভাইকে পাঠিয়ে দিও। আমার কিছু জানাশোনা আছে দেখি কোথাও লাগিয়ে দেয়া যায় কি-না। তিথির মনে যে চাপা উদ্বেগ ছিল তা দূর হয়ে গেল। বাবার এই ফুফাতো ভাইকে তার পছন্দ হল। ছোটখাটো মানুষ। সারাক্ষণ পান খাচ্ছেন। একটু পরপর পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। সরুয়া টানার মত সেই রস টেনে নিচ্ছেন। মাথায় এক গাছিও চুল নেই। চকচকে টাকা। কিছুক্ষণ পরপর টাকে হাত বুলাচ্ছেন। তখন তাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হয় টাকে হাত বুলিয়ে তিনি খুব আরাম পাচ্ছেন। তিথি খানিক গল্পগুজবও করল। সহজ স্বরে বলল, বাসায় আর কেউ নেই কেন? চাচী কোথায়?
ও থাক, গফরগাঁয়ে। ছেলেমেয়েরা ঐখানেই স্কুলে-কলেজে পড়ে। ঢাকার এত খরচ চালান কি সোজা ব্যাপার। সরকারি বাসা পাওয়ায় রক্ষা হয়েছে। অর্ধেক সাবলেট করে দিয়েছি। আমি দু’টা ঘর নিয়ে থাকি।
একা একা খারাপ লাগে না আপনার?
না। সপ্তাহে সপ্তাহে যাই। বৃহস্পতিবারে দুপুরে চলে যাই শনিবার সকালে আসি। খানিকটা কষ্ট হয়। কি আর করা বল।
খাওয়া-দাওয়া কোথায় করেন?
বেশির ভাগ সময় নিজেই রাঁধি। বাইরেও খাই।
তিনি তিথিকে সুজির হালুয়া রেঁধে খাওয়ালেন। দু’শ টাকা দিয়ে নিজে এসে একটা রিকশা ঠিক করে রিকশা ভাড়াও দিয়ে দিলেন। তিথিকে বললেন, একা একা ঢাকা শহরে ঘোরাফিরা করা ঠিক না। তোমার বাবাকে বলবে। আর যেন তোমাকে এ ভাবে না পাঠান।
তিথিকে পরের মাসে আবার আসতে হল। এবারের আবেদন একশ টাকার। যে করেই হোক দিতে হবে।
মনজুর সাহেব টাকা দিয়ে দিলেন এবং সেদিনও সুজির হালুয়া রোধে খাওয়ালেন। তবে ঐ দিনের মত গল্পগুজব হল না বা এগিয়ে এসে রিকশা ঠিক করে দিলেন না।
তার পরের মাসে তিথি আবার এল। সারাপথ কাঁদতে কাঁদতে আসল। টাকা চাইতে হবে এই দুঃখে তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। বাসে বসে তার মন চাইছিল একটা ট্রাকের সঙ্গে এই বাসটার অ্যাকসিডেন্ট হোক। সেই অ্যাকসিডেন্টে সে যেন মারা যায়। সে মরল না। এক সময় মনজুর সাহেবের বাসার কড়া নাড়ল। মনজুর সাহেব দরজা খুললেন তবে তাকে দেখে খুব অবাক হলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কি খবর? তিথি মাথা নিচু করে বলল, বাবা একটা চিঠি দিয়েছেন।
আবার চিঠি। এস ভেতরে এস। তিথি ভেতরে এসে বসল। মনজুর সাহেব বললেন, এইবার কত টাকা চেয়েছে?
একশ।
তিথির ধারণা ছিল এবারে তিনি টাকা দেবেন না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তিনি পঞ্চাশ টাকার দু’টা নোট তিথির হাতে দিলেন এবং বললেন, ঘেমে-টেমে কি হয়েছে ফ্যানের নিচে বস। বিশ্রাম কর।
জি-না। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। টুকুর খুব জ্বর। ডাক্তার আনতে হবে।
দুতিন মিনিট বসে গেলে ক্ষতি হবে না। তিনি হাত ধরে তিথিকে তার পাশে বসলেন। পরমুহুর্তেই তিথিকে জড়িয়ে ধরলেন। তিথি ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। কোনোমতে বলল, ছাডুন চাচা। আমাকে ছেড়ে দিন।
তিনি আহ্ বলে বিরক্ত প্রকাশ করলেন। তিথিকে ছাড়লেন না। তিথি চিৎকার করতে চেষ্টা করলেন, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সিগারেটের গন্ধ ভরা, পান খাওয়া একটা মুখ তার মুখের ওপর লেপ্টে রইল। দু’টি হাত মাকড়সার মতো তার সারা শরীরে কিলবিল করতে লাগল। এর পর কি কি ঘটল। সে মনে করতে পারছে না। শুধু যা মনে আছে তা হচ্ছে সে বেতের সোফায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মনজুর সাহেব একটা বাটিতে হালুয়া বানিয়ে তাকে বললেন এই তিথি, নাও হালুয়া খাও। এর পরেও অনেকবার তিথিকে তার কাছে আসতে হয়েছে। প্রতিবারেই মনজুর সাহেব তাকে টাকা দিয়েছেন। এবং বলেছেন, দরকার হলেই আসবে। কোনো অসুবিধা নেই।
তিথি বড় আপার চিঠি টেবিলে রাখতে রাখতে মৃদু স্বরে বলল, তুমি তো সুখেই আছ আপা। কত সুখে আছ তুমি জানো না। জানলে এ রকম চিঠি লিখতে না।
এ হচ্ছে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলা। নিজের সঙ্গে কথা বলার এই অদ্ভুত অসুখ তিথির ইদানীং হয়েছে। মনে মনে ভাবা কথাগুলি সশব্দে বের হয়ে আসে। রিকশায় আসতে আসতে একবার এরকম হল। রিকশাওয়ালা তিথির বিড়বিড় শুনে চমকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, কি কন আফা? এগুলি কি পাগল হবার লক্ষণ? এক সময় সে কি পাগল হয়ে যাবে? হয়ত হবে। কিংবা কে জানে এখনি হয়ত সে খানিকটা পাগল।
বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে হীরুর সঙ্গে দেখা! হীরু বলল, তিথি যাচ্ছিস কোথায়? তোর সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে, ভেরি আর্জেন্ট।
তিথি বলল, আমার কোনো জরুরি কথা নেই। বিরক্ত করিস না তো?
হীরু সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। তিথি বলল, কেন বিরক্ত করছিস?
তুই আমাকে থ্রি থাউজেন্ড টাকা জোগাড় করে দিতে পারবি?
না।
এর জন্যে তুই আমাকে তোর পা ধরতে বলিস। আমি তোর পা ধরে বসে থাকব। টাকাটা আমার খুবই দরকার।
দরকার হলে চুরি কর। ছিনতাই কর। কানে দুল পরে মেয়েরা যায়। ঐ দুল টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যা।
তুই পাগল হয়ে গেলি তিথি? আমি ভদ্রলোকের ছেলে না?
হ্যাঁ, ভদ্রলোকের ছেলে। তুই ভদ্রলোকের ছেলে, আমি ভদ্রলোকের মেয়ে। আমি টাকা কিভাবে আনি তুই জানিস? নাকি তোর জানা নেই?
হীরু চুপ করে গেল। তিথি বলল, আমি কিভাবে টাকা আনি সেটা কেউ জানে না, আবার সবাই জানে। মজার একটা খেলা। তুই আমার পেছন পেছন আসবি না। যদি আসিস তাহলে ধাক্কা দিয়ে নর্দমায় ফেলে দেব।
হীরু দাঁড়িয়ে পড়ল। তিথিকে বিশ্বাস নেই। এই কাণ্ড সে সত্যি সত্যি করে বসতে পারে। একবার নর্দমায় পড়ে গেলে চৌদবার গোসল করলেও গন্ধ উঠবে না। হীরুর মন খারাপ হয়ে গেল। তিথির কাছ থেকে সে টাকা পাবে না এটা জানত। টাকা চাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন। হীরুর ধারণা ছিল টাকার কথা শুনেই তিথি বলবে এত টাকা দিয়ে তুই কি করবি? তখন হীরু কারণটা ব্যাখ্যা করবে।
কারণটা বেশ অদ্ভুত।
আজ হাঁটতে হাঁটতে সে পীর সাহেবের কাছে গিয়েছে। খালি হাতে গিয়েছে, এই জন্যে সে আর তার সঙ্গে দেখা করল না। উঠোনে মাথা কামানো এক লোকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। মাথা কামানো লোকটির নাম সবুর। তার বাড়ি কালিয়াকৈর। মাস তিনেক আগে বিয়ে করেছে। গত সপ্তাহে তার বৌ হঠাৎ পালিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খোঁজখবর করেও সে কোনো সন্ধান না পেয়ে পীর সাহেবের কাছে এসেছে। পীর সাহেবের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নি। হীরু বলল, ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন ভাইজান। মোটেই চিন্তা করবেন না, এক মিনিটের মামলা। পীর সাহেব ফড়ফড় করে সব বলে দেবেন।
সত্যি?
সত্যি মানে? আমার নিজের ইয়ং ব্রাদার মিসিং হয়ে গেল। তার নাম টুকু। পীর সাহেবকে বললাম। উনি বললেন–চিন্তা করিস না। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরবে।
ফিরল এক সপ্তাহের মধ্যে?
ফিরবে না মানে? পীর সাহেবের সঙ্গে ইয়ার্কি চলে না। ডাইরেক্ট অ্যাকশান। আপনি খালি হাতে আসেননি তো?
একশ টাকা এনেছি, গরিব মানুষ।
টাকা-পয়সা পীর সাহেব নিবেন না। টাকা-পয়সা উনার কাছে তেজপাতা। সিগারেট দিতে হবে, বিদেশী সিগারেট।
বিদেশী কি সিগারেট?
ধরেন ডানাহিল, বেনসন। মোড়ের দোকানে গিয়ে বললেই হবে–পীর সাহেবের সিগ্রেট। ওরা জানে। বাজারের চেয়ে কম রেইটে পাবেন। যান সিগ্রেট নিয়ে আসেন। পীর সাহেবকে কদমবুসি করে সিগ্রেটের প্যাকেটটা বাম দিকে রাখবেন।
সবুর মিয়া সিগ্রেট আনতে গেল আর তখনি বাড়ির ভেতর থেকে পীর সাহেব খালি পায়ে বের হয়ে এলেন। বারান্দায় এবং উঠোনে এতগুলি লোক বসা, কাউকে কিছু না বলে হীরুকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। হতভম্ব হীরু ছুটে গেল। পীর সাহেব বললেন, তুই বিসমিল্লাহ বলে একটা ব্যবসা শুরু কর। ব্যবসা তোর তরক্কি হবে। স্বয়ং নবী করিম ব্যবসা করতেন। হীরু কাঁপা গলায় বলল, কিসের ব্যবসা করব? পীর সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, তোর ব্যবসা হবে গরম জিনিসের। একটা চায়ের দোকান দিয়ে দে। এই বলেই পীর সাহেব। আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। আর কি আশ্চর্য যোগাযোগ তার পরদিনই যে কল্যাণপুরের বশীর মোল্লার চায়ের দোকানে চা খেতে গেছে, বশীর মোল্লা বলল, দোকান বেচে দিব। হীরু ভাই। খদ্দের যদি পান একটু বলবেন।
হীরু গম্ভীর হয়ে বলল, বেচবেন কেন? চালু দোকান।
চালু কোথায় দেখলেন? দিনে পঞ্চাশ কাপ চা বেচতে পারি না। বিশ-পাঁচিশ কাপ পাড়ার ছেলেরা খায়। দাম চাইলে বলে খাতায় লিখে রাখেন।
দাম কত চান দোকানের?
দশ হাজার পাইলে রাখমু না।
দশ হাজার? দোকানে আপনার আছে কি? দুইটা কেতলী, পনের-বিশটা কাপ। হাজার তিনেক হলে আমাকে বলবেন ক্যাশ দিয়ে নিয়ে যাব। নো প্রবলেম।
বশীর মোল্লা আর কিছু বলল না। চিন্তিত মুখে দাঁত খুঁচাতে লাগল। এই সবই হচ্ছে যোগাযোগ। এরকম যোগাযোগ আপনা-আপনি হয় না। উপরের নির্দেশ লাগে। পীর সাহেবের দোয়ায় অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। এরা হচ্ছেন অলি মানুষ এদের দোয়া কোরামিন ইনজেকশনের মত। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন।
হীরুর ইচ্ছা ছিল টাকা চাওয়ার উপলক্ষে পুরো ঘটনাটা তিথিকে বলবে। তিথি সেই সুযোগ দিল না। পীর সাহেবের দোয়ার ফল তো সে একা ভোগ করবে না। সবাই মিলে ভোগ করবে। তার টাকা-পয়সা হলে সে কি ভাই বোন ফেলে দিবে? অবশ্যই না। ভাই-বোন, ফাদার-মাদার এরা থাকবে মাথার উপরে।