“আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্”
রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে মৃত্যুর কোনো স্বীকৃতি নেই, কারও তিরোধান দিবসেই কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তবু স্বামী বিবেকানন্দর মহানির্বাণের দিনটি (৪ জুলাই) কাছাকাছি এলেই প্রতিবছর তার সম্বন্ধে অনেকের অস্থিরতা ও আগ্রহ ভীষণ বেড়ে যায়। বেঁচে ছিলেন তো মাত্র ঊনচল্লিশ বছর কয়েক মাস, তারই মধ্যে প্রধান সময়টা সহায়সম্বলহীন অবস্থায় দেশ ও বিদেশের পথে পথে কেটেছে। সংখ্যাহীন প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে বিরামহীন লড়তে-লড়তে স্বামীজি কী করে মানুষের জন্যে এত চিন্তা করে গেলেন তা ক্রমশই আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়ের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইদানীং স্বামীজির শরীরের নানা অসুখবিসুখ সম্বন্ধেও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এতরকম ব্যাধি ও শারীরিক যন্ত্রণাকে পরোয়া না করে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কীভাবে এমন বিধ্বংসী ঝড় তুলে গেলেন তাও মানুষের অনুসন্ধানের বিষয়।
স্বামীজির শরীর-স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইতে কিছু লেখা হয়েছে, এ-বিষয়ে আরও একটু ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। স্বামী সারদানন্দকে লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “হারে, দেশের লোকগুলো এত শীঘ্র মরে যায় কেন? যার কথা জিজ্ঞেস করি, খবর নেই, সে মারা গেছে। জাতটা কি মরে বিলোপ পেয়ে যাবে নাকি?…ওরা যে দুখচেটে খায়, তাতে এত শীঘ্র মরে যায়। ওদের খাওয়াটা বদলে দেওয়া দরকার। আমেরিকাতে যখন ছিলুম, তখন কয়েক বৎসরের ভিতর কোনো ব্যামো হয় নাই। কয়েকদিন সামান্য সর্দিকাশি হয়েছিল। ভূতের মতো পরিশ্রম করেছি, তাতে কিন্তু শরীর খারাপ হয় নাই।”
এসব ১৮৯৬ সালের কথা, স্বামীজির ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ ও গুরুভাই স্বামী সারদানন্দ তখন লন্ডনে উপস্থিত। সেই সময়েই কিন্তু স্বামীজির আসন্ন শারীরিক বিপর্যয়ের আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে মহেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে : “একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্বামীজি তাঁহার ঠেসান দেওয়া চেয়ারখানিতে বসিয়া ভাবিতেছিলেন অথবা ধ্যান করিতেছিলেন। ফক্স ও বর্তমান লেখক অপরদিকের দেওয়ালের নিকট পাশাপাশি দুইখানি চেয়ারে বসিয়াছিলেন। হঠাৎ যেন তাঁহার মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল। খানিকক্ষণ পর তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া ফক্সকে বলিলেন, “দেখ ফক্স, আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন। বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল; এইটা আমাদের বংশের রোগ।”
এই সময়ে স্বামীজি যে কোনও ডাক্তারকে পরামর্শ করার সুযোগ পাননি তা বেশ স্পষ্ট। বিদেশে তখন পরের দয়ায় খাওয়া-থাকা, সেই সঙ্গে ঘাড়ে চেপেছে ভাই ও গুরুভাইদের দায়িত্ব।
এবার চলে আসা যাক কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর স্মৃতিকথায়। স্থান কলকাতা, সময় শনিবার ৫ জুলাই, ১৯০২, ঠিকানা দিদিমার বাড়ি, ৭ রামতনু বসু লেন। ভিটেবাড়ি গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট থেকে সময়ে অসময়ে কারণে অকারণে বিতাড়িত হয়ে বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী দেবী অসহায় পুত্রকন্যাদের নিয়ে পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হিসাবে রামতনু বসু লেনে আশ্রয় নিতেন। এই বাড়িতেই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার পরে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ভূপেন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় বলে গিয়েছেন, গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে কেউ কখনও গৈরিক বেশ পরিহিত নরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেখেনি।
ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন : ‘এক সকালে স্বামীজির সেবক ব্রহ্মচারী নাদু (হরেন) স্বামীজির মৃত্যু সংবাদ নিয়ে আসেন। আমি মাকে এবং দিদিমাকে এই শোকসংবাদ জানালাম। মা জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হল, আমি বললাম, “বাবার যা হয়েছিল। তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়লেন, পাড়ার একজন ভদ্রমহিলা এসে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
স্বামীজির প্রথম ও শেষ হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে আরও একটি সামান্য অ্যাটাকের অস্পষ্ট উল্লেখ সংগ্রহ করা গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ তখন কিংবদন্তি ফরাসি গায়িকা মাদাম এমা কালভের অতিথি হয়ে মিস ম্যাকলাউড-এর সঙ্গে মিশর দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। মাদাম কালভে একবার প্রাণঘাতিণী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, বিবেকানন্দর সান্নিধ্যে তিনি নবজীবন লাভ করেন, অতএব অতিথির আদর আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি হওয়ার কথা নয়।
যাত্রীরা অবশেষে কায়রোয় উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে কী ঘটল? এখনও পর্যন্ত হাতে কলমে কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু স্বামীজির পারিবারিক সূত্রে একটা কথা ভেসে বেড়িয়েছে অনেকদিন, ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের নিতান্ত আপনজন এবং পরবর্তীকালে তার প্রকাশক প্রয়াত রঞ্জিত সাহা শুনেছেন, স্বামীজিকে শুধু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়নি, তাকে কায়রোতে সামান্য সময়ের জন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগেই রঞ্জিত সাহা দুর্ভাগ্যক্রমে দেহরক্ষা করেন। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সমস্ত জীবনে কলকাতায় অথবা স্বদেশে কিংবা বিদেশে বারবার অসুস্থতার সংবাদ থাকলেও, কোথাও স্বামীজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। এতদিন পরে কায়রো সূত্রে কোনও খবর পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। খবর কিছু থাকলে তা রয়েছে মাদাম কালভের অথবা মিস ম্যাকলাউডের অপ্রকাশিত কাগজপত্রে।
হাসপাতালের ব্যাপারে যাই হোক, মাদাম কালভে গানের আসর থেকে ফিরে বান্ধবীর কাছে শুনলেন স্বামীজি খুব মনমরা অবস্থায় রয়েছেন এবং যাত্রাভঙ্গ করে দেশে ফিরতে চাইছেন। প্রশ্নের উত্তরে বিষণ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।” এর পরই বিস্ফোরণ। এমা কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।
মাদাম কালভের দেওয়া অর্থে টিকিট কিনে স্বামী বিবেকানন্দ রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন মুম্বইয়ের উদ্দেশে। বান্ধবী সারা বুলকে তখন লেখা মিস ম্যাকলাউডের একটা চিঠির ফুটনোটের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে : “স্বামীজির খবর ভালো নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।” সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আর একটা হার্ট অ্যাটাক’। এর মানে কি এইটাই দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তার মর্ত্যলীলার অবসান?
বোম্বাই হয়ে স্বামীজি আচমকা বেলুড় মঠে ফিরলেন রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০। হাওড়া স্টেশনেও কেউ তাকে রিসিভ করতে যাননি, নিজেই একটা গাড়ি ভাড়া করে বেলুড়ে পৌঁছে, গেট টপকে যখন মঠের ভিতরে ঢুকলেন তখন সন্ন্যাসীদের সন্ধ্যা-আহার শুরু হতে চলেছে। আমাদের চোখে জীবন নাটকের শেষ অঙ্কের শুরু এই দিন থেকেই, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ৪ জুলাই ১৯০২।
প্রশ্ন ওঠে, কেন এবং কীভাবে স্বামী বিবেকানন্দ এত কম সময়ে চলে গেলেন? অতি পরিশ্রমে তিনি কি নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করলেন? না সময়মতো সমকালের সেরা চিকিৎসা তার জন্য জোগাড় করা অনুরাগীদের পক্ষে সম্ভব হল না? না, সচ্ছল পরিবারে পরম স্নেহে লালিত শরীর ভোজনং যত্রতত্র ও শয়নম হট্টমন্দিরের ধাক্কা সহ্য করতে পারল না? না, মৃত্যুকে তিনি স্বেচ্ছায় ডেকে আনলেন নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিতে?
স্বামীজির পৌরুষময় শরীর। রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনায়–মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় শক্তিশালী ও সুদীর্ঘ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), ওজন ১৭০ পাউন্ড। রোলাঁর কলমে–প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে আনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চোখ। তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ আরও কিছু বিবরণ রেখে গিয়েছেন–পায়ের তলার সামনেটা আর পিছনটা মাটিতে ঠেকতো না (খড়ম পা), পাতলা, সরু ও লম্বা এই পা, হাতের আঙুল সরু, লম্বা ও অগ্রভাগ ছুঁচাল, হাতের নখ মুক্তার মতো উজ্জ্বল, কিঞ্চিৎ রক্তাভ। গোল, পুরুষ্ট মুখ, পাতলা ঠোঁট যা ইচ্ছামতো দৃঢ় করতে পারতেন। সিঙ্গি নাক–অর্থাৎ উন্নত, ইচ্ছা করলে নাক কুঁচকে উপরের দিকে তুলতে পারতেন। সুডৌল, সরু লম্বা হাত। মাথার পিছন দিকটা চ্যাপ্টা। মাথার ব্রহ্মতালু উঁচু যা দার্শনিক ও জ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ।
পশ্চিমের লেখকরা অত্যন্ত সাবধানী, রোমাঁ রোলাঁর রায় “অতি পরিশ্রমে” তার সংক্ষিপ্ত জীবন আরও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল। রোমাঁ রোলার অনুসন্ধান অনুযায়ী, পারিবারিক বহুমূত্র রোগের প্রথম লক্ষণগুলি, যখন তার বয়স সতেরো আঠারো, তখনই দেখা যায়। স্বামীজির তরুণ বয়সে ডায়াবিটিসের লক্ষণ সম্পর্কে কোনও তথ্য আমি অন্যত্র খুঁজে পাইনি। প্রথমবার মার্কিন দেশে থাকাকালীন নামী ডাক্তারদের স্নেহসান্নিধ্যও হয়েছে, কিন্তু কোথাও ডায়াবিটিসের উল্লেখ নেই।
স্বামীজির আরও দুটি রোগের উল্লেখ করেছেন রোলাঁবারবার ম্যালেরিয়া রোগে মারাত্মকভাবে পীড়িত হন ও আরেকবার তীর্থভ্রমণকালে ডিপথেরিয়া। ধৈর্য ধরে ইদানীং যে বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করা গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে স্বামীজি অন্তত বত্রিশটি রোগের শিকার হয়েছিলেন। এর তালিকা অচেনা অজানা বিবেকানন্দ বইতে নিবেদন করা গেছে।
স্বামীজি শেষবারের মতো দেশে ফিরে আসার পরে তার শরীরের অবস্থা কেমন সে সম্পর্কে আমরা খোঁজখবর করব।
তার আগে উল্লেখ প্রয়োজন স্বামীজির অসামান্য মনোবলের, যার তেজে রোগজীর্ণ শরীর নিয়েও তিনি অসম্ভব সব কাজ করে যেতে পারলেন।
দ্বিতীয়বার বিদেশ যাওয়ার আগে ১৮৯৭ সালে ২০ মে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে স্বামীজি লেখেন, “তুমি ভয় পাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তত বাতি জ্বললো, এখনও সারারাত্রি গাওনা আছে।”
আর এক গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি লিখছেন, “শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? মরচে পড়া মড়ার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ঢের ভালো। মরে গেলেও হাড়ে ভেলকি খেলবে।” একই বছরে (২৮ এপ্রিল) দার্জিলিং থেকে মেরি হেলকে স্বামীজির চিঠি: “আমার চুল গোছা গোছা পাকতে আরম্ভ করেছে এবং মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে..আমার বয়েস যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। (এই সময় স্বামীজির বয়স ৩৪)।”
পরের মাসে (২৯ মে) প্রিয় শশী ডাক্তাকে আলমোড়া থেকে স্বামীজির চিঠি। “যোগেন কি লিখছে তা হৃক্ষেপ করবে না।” মুখে যাই বলুন, ভিতরে ভিতরে তার চিন্তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ৩ জুন ১৮৯৭ তে আমেরিকান ভক্তকে লেখা চিঠিতে : “যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তা হলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন পারবে তো?”
রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০ সন্ধ্যায় যে-মানুষটি বিদেশ থেকে ফিরে সকলের সঙ্গে প্রাণভরে খিচুড়ি খেলেন তার মধ্যে গুরুভাইরা তেমন কোনও অসুস্থতার লক্ষণ দেখতে পাননি। কিন্তু খেতড়ি নরেশকে বিবেকানন্দ তখনই জানাচ্ছেন, “আমার হার্ট খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে… আমার মনে হচ্ছে, এ জীবনে যা করার ছিল তা শেষ হয়েছে।”
ডিসেম্বরে মায়াবতীতে বসে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে স্বামীজি বললেন, “শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি, তার ফল হয়েছে কি? না জীবনের যেটি সবচেয়ে ভালো সময় সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে।”
পরের মাসেও খবর ভালো নয়। “মঠে যে-মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এ স্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।” মার্চ মাসে ঢাকা ভ্রমণকালে এক বারাঙ্গনা করুণভাবে স্বামীজির কাছে হাঁপানির ওষুধ ভিক্ষা করছে। স্বামীজি সস্নেহে বলছেন, “এই দেখ, মা! আমি নিজেই হাঁপানির যন্ত্রণায় অস্থির। যদি আরোগ্য করার ক্ষমতা থাকত, তাহলে কি আর এই দশা হয়!”
ঢাকা ও কামাখ্যায় স্বামীজির শরীর ক্রমশ কীভাবে খারাপ হয় তার বিবরণ আছে প্রমথনাথ বসুর বিবেকানন্দ জীবনীতে। গৌহাটির স্বাস্থ্যবিপর্যয়ে লক্ষ্য স্থির হল ৩৬ মাইল দূরে শিলং, সেখানকার জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। চিফ কমিশনার স্যর হেনরি কটন অসুখের কথা শুনে স্থানীয় সিভিল সার্জেনকে স্বামীজির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রমথনাথ বসুর সংযোজন, ঢাকা থেকে বহুমূত্রের সঙ্গে হাঁপানির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছিল, শিলং-এ এসে তা আরও ভীষণভাব ধারণ করল। শ্বাসগ্রহণের সময় অসহ্য কষ্ট। কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকের উপর ঠেসে ধরতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে প্রায় একঘণ্টা পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। এইখানেই শিষ্যগণ শুনেছিলেন, তিনি অনুচ্চ স্বরে বলছিলেন, যাক, মৃত্যুই যদি হয় তাতেই বা কী এসে যায়? যা দিয়ে গেলুম দেড় হাজার বছরের খোরাক।
শিলং-এ স্বামীজির শরীরে অ্যালবুমিনও বেড়েছিল, শরীর দ্বিগুণ ফুলে যায় বলে শোনা যায়। এই শিলং-এ যে ছবি তোলা হয়েছিল অদ্বৈত আশ্রমের সংগ্রহে এইটাই এখনও পর্যন্ত স্বামীজির শেষ ফটোগ্রাফ। এই ছবিতে তিনি কিন্তু শীর্ণকায়–শরীর ফুলে ওঠার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ তাই সন্দেহ করেন এই ছবি শিলং-এ নয়, দেওঘরে তোলা।
১২ মে ১৯০১ সালে স্বামজি আবার গৌহাটি হয়ে ট্রেনে কলকাতায় ফেরেন। মঠে অবস্থানকালে সমাজের কোনও ধার না ধরে, স্বামীজি খুশিমতো ঘুরে বেড়াতেন, কখনও চটি পায়ে, কখনও খালি পায়ে, কখনও। গেরুয়া পরে, কখনও বা শুধু কৌপীন এঁটে। অনেক সময় হাতে একটা হুঁকো বা লাঠি থাকত। কিন্তু পা ফুলে শোথের লক্ষণ দেখা দিল, হাঁটতে কষ্ট হতো।
জুন মাসে কবিরাজি চিকিৎসার কথা উঠল। স্বামীজির খুব উৎসাহ ছিল না, কিন্তু স্বামী নিরঞ্জনানন্দের উৎসাহে বউবাজারের মহানন্দ সেনগুপ্ত মহাশয়কে ডাকা হলো। তিনি এসেই লবণ-সংযুক্ত ব্যঞ্জনের ব্যবহার ও জলপান নিষেধ করলেন। যিনি বহুবার জল খেতেন, তিনি অবিশ্বাস্য মনোবলে জলপানের অভ্যাস ত্যাগ করলেন। এই সময় স্বামীজির আহার খুব কমে গিয়েছিল।
অক্টোবরে স্বামীজির অবস্থা আবার আশঙ্কাজনক হয়ে উঠল। বাড়ির বাইরে যেতে পারতেন না। খ্যাতনামা সায়েব চিকিৎসক ডাক্তার সন্ডার্সকে দেখানো হলো, তিনি সবরকম দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম নিষেধ করলেন।
সেই সময় পোষা জন্তু জানোয়ার পাখিদের নিয়ে বেলুড়ে স্বামীজি অন্য জীবন কাটাতে আরম্ভ করলেন। এই সময়ে চিঠিতে তিনি লিখছেন, “আমার চিড়িয়াখানায় মুরগি নেই, ওই জীব এখানে নিষিদ্ধ।”
নভেম্বরের শেষে স্বামীজি চিঠি লিখছেন, “ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না!” চোখের ডাক্তারের কাছে যাবেন, কিন্তু সর্দিতে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন, সেই সঙ্গে হাঁপানির দাপট।
১২ ডিসেম্বর ১৯০১-এর খবর স্বয়ং স্বামীজি দিচ্ছেন সিস্টার ক্রিশ্চিনকে। “তুমি তো জানেনা, গত তিনবছর ধরে আমার প্রায়ই অ্যালবুমিন-ইউরিয়া হচ্ছে। কিডনির স্ট্রাকচারাল কোনও দোষ নেই, কিন্তু তারা প্রায়ই অ্যালবুমিন বার করছেন। ডায়াবিটিসের সুগার বেরনো থেকে এটা অনেক খারাপ। অ্যালবুমিন রক্তকে বিষময় করে, হার্ট অ্যাটাক করে, সেইসঙ্গে আরও নানা ক্ষতি হতে পারে। ঘন ঘন সর্দি লাগার আশঙ্কাও থেকে যায়।” ডান চোখেও স্বামীজি দেখতে পাচ্ছেন না, ডাক্তাররা বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। মাংস খাওয়া বারণ, হাঁটা বারণ, দাঁড়ানো বারণ, এমনকী, লেখাপড়া বারণ।
এক সপ্তাহ পরের রিপোর্ট, “আমি বিশ্রাম নিতে আরম্ভ করলেই অ্যালবুমিন ও সুগার উধাও হয়ে যায়।” জানুয়ারির শেষে শরীরের এমনই উন্নতি হলো যে স্বামীজি জাপান ও চিন যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু মার্চ ১৯০২তে নিবেদিতাকে লেখা চিঠিতে আবার অবনতি সংবাদ। বারাণসী থেকে রোগজর্জরিত বিবেকানন্দ অনুরোধ করছেন, “যদি আমার দেহাবসান হয় (বারাণসীতে সেটা হোক আমি তো চাইব) দয়া করে আমাকে লেখা ক্রিশ্চিনের চিঠিগুলো অবশ্যই তুমি খুলবে, তাকে তুমি অবশ্যই অভ্যর্থনা করবে এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। যদি ওর কাছে টাকা না থাকে, অবশ্যই টিকিট কেটে দেবে–এর জন্য যদি ভিক্ষে করতে হয় তাও করবে। আমি ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের খাওয়া দাওয়া এবং দেনা শোধ করতে লেগে গিয়েছে। যতটুকু আছে তাতে হাত দিতে পারছি না, যে মামলাটা ঝুলে আছে তাতে লেগে যাবে।”
মহানির্বাণের সময় আর দূরে নয়। ২৭ মে ১৯০২ ক্রিশ্চিনকে বেলুড় থেকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, তার লিভারের উন্নতি হয়েছে। সেইসঙ্গে কিছু খারাপ খবর, একটা ছাগলছানা মাছের চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছে।
২১ জুন ক্রিশ্চিনকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, উদ্বেগের বিন্দুমাত্র কারণ নেই। ডাক্তাররা সব কিছু খেতে বলেছেন, কিন্তু স্বামীজি খুব ভেবেচিন্তে খাওয়াদাওয়া করছেন। চিঠির শেষে একটি ‘পুনঃ–”আমার শরীরে চর্বি জমছে বিশেষ করে পেটে। ভয়াবহ দৃশ্য!”
“আমার কথাটি ফুরলো নটে গাছটি মুড়লো” এই ছড়াটির ইংরেজি তর্জমা করে সদ্য ভারতে-আসা ক্রিশ্চিনের সঙ্গে স্বামীজি রসিকতা করেছিলেন। ২১ জুন ১৯০২ তারিখে চিঠিটাই ক্রিশ্চিনের কাছে স্বামীজির শেষ চিঠি।
এই জুন মাসের ২৭ তারিখে রোগজর্জরিত স্বামীজির এক শান্তপ্রসন্ন স্নেহময় ছবি দেখতে পাচ্ছি প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর রচনায়। অফিসের পোশাকেই শিষ্যকে বেলুড়ে দেখে স্বামীজি বললেন, “তুই কোটপ্যান্ট পরিস, কলার পরিস না কেন?” স্বামী সারদানন্দকে ডেকে বললেন, “আমার যেসব কলার আছে, তা থেকে দুটো কলার কাল একে দিস তো।” আরও আধঘণ্টা পরে স্বামীজি ধ্যানস্থ, বাহ্যচেতনাহীন। আরও পরে শিষ্য লক্ষ্য করলেন, “স্বামীজির বদ্ধ পাণিপদ্ম কম্পিত হইতেছে।”
শেষপর্বে স্বামীজির নানা রোগের তালিকায় আর একটি সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া। রোগাক্রান্ত, বিনিদ্র, ধৈর্যচ্যুত, তিতিবিরক্ত যে বিবেকানন্দকে আমরা দেখতে পাই তিনি প্রায়ই প্রিয়জনদের এমনই বকাবকি করেন যে তাদের চোখে জল এসে যায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একবার বলেছিলেন, “তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে দরজা বন্ধ করে কাঁদছি, কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি দরজায় টোকা মারছে, দরজা খুল্লম।…স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করব, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না।
এর পর স্বামীজি তার প্রিয় বন্ধু ও গুরুভাইকে যা বলেছিলেন তা আজও হৃদয়কে নাড়া দেয়। “আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়তো বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলভার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।”
বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর থেকে দেহত্যাগ পর্যন্ত স্বামীজি একান্ত সেবক ছিলেন স্বামী নির্ভয়ানন্দ, পূর্বাশ্রমে নাম কানাই সেন। স্বামীজির প্রধান সমস্যা ছিল বিনিদ্রা, একেবারেই ঘুমোতে পারতেন না। কানাই মহারাজের মুখে শোনা যাক স্নেহময় সন্ন্যাসীর একটি অপ্রচলিত গল্প। “শরীর যাবার কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে একটি স্প্রিং-এর খাট উপহার এসেছিল। এর আগে ক্যাম্প খাটে শুতেন। নতুন খাট দেখে একদিন রহস্য করে বলেছিলাম, মশায় এখন তো আপনি বেশ আরামে ঘুমোচ্ছেন। শুনেই স্বামীজি বললেন, “তবে রে শালা! আজ তোকে এই খাটে শুতে হবে। এই বলে জোর করে আমাকে ওই খাটে শোয়ালেন। কিন্তু আমার কি এতে ঘুম হয়। স্প্রিং-এর খাট, এক একবার নিচে নেমে যাচ্ছে আর আমি লাফিয়ে উঠছি। সকালে স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে কেননা, কাল রাতে তোর কেমন ঘুম হল? বেশ মজা করে ঘুমিয়েছিস তো?” আমি বললাম, “আর বলবেন না।” স্বামীজি, “তবে রে শালা, তুই যে বলেছিলি আমার মজা করে ঘুম হয়! এখন বুঝলি তো?”
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেষ দিনে ঘটনার বিবরণ ইতিমধ্যেই সযত্নে সাজানো হয়েছে। উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইটির শেষ পর্ব পড়ে দেখতে পারেন। ওখানে বলা আছে, বেলুড় বাজার পর্যন্ত দু’মাইল বেড়িয়ে সন্ধ্যায় কয়েকজন সন্ন্যাসীকে চা খেতে দেখে, স্বামীজি নিজে এক কাপ চা চাইলেন।
সেবক কানাই মহারাজের বিবরণ একটু আলাদা। বিকেলে আমি ও হুটকো গোপালের দাদা চা খাচ্ছি, তখন পূজনীয় বাবুরাম মহারাজকে নিয়ে বেলুড় বাজারের দিকে বেড়াতে যাচ্ছিলেন স্বামীজি। আমাদের চা খেতে দেখে কাছে এসে বললেন, “কি কেনো, কি খাচ্ছ?” আমি বললাম, মশায়, একটু চা।’ তাই শুনে বললেন, “আমায় একটু দেবে না?” আমি তো জানি তিনি কিরূপ চা খান। তাই একটু গরম জলের সঙ্গে একটু দুধ মিশিয়ে তার মুখের কাছে ধরলাম। তিনি তাতে দু-এক চুমুক দিয়ে বললেন, “বেড়ে তো।” এই বলেই তিনি কাপটি নিয়ে বেড়াতে গেলেন কিন্তু তাতে যে একটুও চা নেই সেদিকে তাঁর হুঁশই ছিল না।” এই হল কানাই মহারাজের শেষ বিবেকানন্দ সেবা।
নিজের ঘরে সন্ধ্যা সাতটায় জপধ্যান শুরু করলেন স্বামীজি, এবং এক তরুণ সেবক বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে বললেন, আমাকে দু’ছড়া মালা দে, যা বাইরে গিয়ে জপধ্যান কর। না ডাকলে আসবি না।
সন্ধ্যা ৭.৪৫: ব্রজেন্দ্রকে স্বামীজি বললেন, গরম বোধ হচ্ছে, জানলা খুলে দাও। মেঝেতে শুয়ে পড়লেন বিবেকানন্দ, হাতে জপমালা। একটু পরে বললেন, আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দে।
রাত ন’টা: চিত হয়ে শুয়ে থাকা স্বামীজি বাঁ পাশে ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ড তার ডান হাত একটু কাপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফোঁটা। এবার শিশুর মতো কান্না।
রাত ৯.২ থেকে ৯.১৫: গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই স্থির, আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস। মাথা নড়ে উঠল, মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।
এবার শোনা যাক কানাই মহারাজের দুঃখের কথা। “ঐদিনটিতে আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ করায় আমি তার সেবা না করে ব্রজেন বলে একটি নতুন ব্রহ্মচারীকে তাঁর সেবার ভার দিয়েছিলুম। ব্রজেন এসে আমাকে বলল যে শীঘ্র আসুন, দেখুন স্বামীজির কী অবস্থা হয়েছে। তখন দেখলাম স্বামীজি তার ক্যাম্পখাটটিতে দক্ষিণ পাশ ফিরে শুয়ে আছেন এবং তার ডান নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে উপস্থিত সকল মহারাজকে ডেকে আনলাম।”
তখন সময় ৯.৩০। স্বামী বোধানন্দ নাড়ি ধরে কিছুক্ষণ দেখে, দাঁড়িয়ে উঠে কেঁদে ফেললেন। একজন বললেন, যাও মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনো। কদিন তিনিই চিকিৎসা করছিলেন। ডাক্তার মজুমদার থাকতেন নদীর ওপারে বরাহনগরে। স্বামী প্রেমানন্দ ও স্বামী নিশ্চয়ানন্দ সমাধি ভাঙানোর জন্য কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন।
শেষের সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা স্বামী সারদানন্দ কেউ মঠে উপস্থিত ছিলেন না। স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন বলরাম মন্দিরে এবং স্বামী সারদানন্দ বাগবাজার উদ্বোধন অফিসে। কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচল করার চেষ্টা চলল। ডাক্তার মজুমদার ও তারা দু’জন রাত সাড়ে দশটায় প্রায় একসঙ্গে উপস্থিত হলেন। রাজা মহারাজ এসেই দৌড়ে গিয়ে দেহের উপর হুমড়ি খেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
রাত ১২টা : ডাক্তার মজুমদার জানালেন, স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হওয়াই স্বামীজির দেহাবসানের কারণ। পরের দিন সকালে ডাক্তার বিপিন ঘোষ বললেন, সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ হয়েছে। কেউ কেউ বললেন, মাথার ভিতর কোনও শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে।
স্বামীজির ডেথ সার্টিফিকেট খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে কী অসুখের উল্লেখ ছিল তা আর জানবার উপায় নেই। উদ্বোধন পত্রিকায় স্বামীজির দেহাবসানের যে সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছে, তিনমাস ধরে গুরুতর অ্যালবুমেনিউরিয়া রোগে ভুগছিলেন।
স্বামীজির পত্রাবলী ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আমরা শুধু বুঝি, মৃত্যুকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মার্কিন অনুরাগী মিস্টার ফক্সকে তিনি লিখেছিলেন, “আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মহিমকে মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেবার জন্য তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময় চলে যেতে পারি।” এই চিঠি লেখার কারণ ভাই মহেন্দ্রনাথ তখনও উধাও। ইউরোপ থেকে পায়ে হেঁটে দেশে ফিরতে ফিরতে কয়েক বছর তিনি মা ভাই দাদা কাউকে চিঠি লেখেননি। সেজন্য স্বামীজির দুঃখের অন্ত ছিল না। প্যারিস থেকে প্রিয় হরিভাইকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) দুঃখী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম–প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি।”