চতুর্থ বিভাগ — আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন
দ্বাদশ অধ্যায় — আপেক্ষিক উদ্বৃত্তমূল্যের ধারণা
শ্রম-দিবসের যে-অংশটি কেবল ততটা মূল্যই উৎপাদন করে, যতটা মূল্য ধনিক তার শ্রমশক্তির জন্য দিয়ে থাকে, সেই অংশটিকে এই পর্যন্ত আমরা একটা স্থির রাশি বলেই গণ্য করে এসেছি এবং উৎপাদনের বিশেষ অবস্থায় ও সমাজের অর্থ নৈতিক বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে ব্যাপারটা বাস্তবিকই তাই থাকে। আমরা দেখেছি, এম দিবসের এই অংশটির অতিরিক্ত তথা তার আবশ্যিক শ্রম-সময়ের অতিরিক্ত, শ্রমিক ২, ৩, ৪, ৬ কিংবা আরো বেশি ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে পারে। উত্তমূল্যের হার ও শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে কাজের ঘন্টা কতটা দীর্ঘতর করা যায়, তার উপরে। আমরা দেখেছি আবশ্যিক শ্রম-সময় স্থির রেখেও কিন্তু সমগ্ৰ শ্ৰম-দিবসের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করা যায়। এখন ধরা যাক, আমাদের সামনে আছে এমন একটি এম-দিবস যার দৈর্ঘ্য এবং আবশ্যিক শ্রম ও উত্ত-শ্রমের মধ্যে যার ভাগাভাগি সুনির্দিষ্ট। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ক গ তথা ক —গ এই গোটা লাইনটি হচ্ছে একটি ১২ ঘণ্টাব্যাপী এম-দিবসের রেখা-রূপ এবং তার মধ্যে ক অংশটি ও গ অংশটি হচ্ছে যথাক্রমে ১০ ঘণ্টাব্যাপী আবশ্যিক শ্রমের ও দু ঘণ্টাব্যাপী উওএমের রেখারূপ। এখন ক গ-কে দীর্ঘতর না করে তথা নিরপেক্ষ ভাবে উত্ত মূল্যের উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যেতে পারে অর্থাৎ কিভাবে উত্তমকে দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে?
যদিও ক গ-এর দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট রয়েছে, তবু খ গ-কে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব, প্রান্ত-বিন্দু গ-এর বাইরে যদি তাকে সম্প্রসারিত করা না-ও যায়, তবু সর্বক্ষেত্রেই তার সূচনা-বিন্দু থেকে এ-কে ক-এর দিকে ঠেলে পিছিয়ে দিয়ে তা করা সম্ভব। ধরা যাক, — রেখায় এখন অর্ধেক খ গ-এর সমান।
কিংবা এক ঘণ্টার এমসময়ের সমান। এখন যদি ক। রেখায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার এম-দিবসে, আমরা খ-কে বিন্দুতে সরিয়ে দেই, তা হলে খগ হয় খগ, উক্ত এম অর্ধেক বৃদ্ধি পেয়ে ২ ঘণ্টা থেকে দাড়ায় ৩ ঘণ্টা—যদিও শ্রম-দিবসটি থাকে আগের মতই ১২ ঘণ্টা। খগ-থেকে খগ, ২ ঘণ্টা থেকে ৩ ঘণ্টা অবশ্য শ্রম-দিবসের এই সম্প্রসারণ স্পষ্টতই অসম্ভব যদি সেই সঙ্গে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে কখ-থেকে ক, ১ ঘণ্টা থেকে ৯ ঘণ্টায় সংকুচিত করা না হয়। উত্তমের সম্প্রসারণ মানে হল আবশ্যিক এম-সময়ের সংকোচন। বস্তুতঃ পক্ষে যার তাৎপর্য হল শ্রমিকের নিজের স্বার্থে শ্রমিক আগে যে শ্রম-সময় ভোগ করত, তারই একটা অংশ ধনিকের স্বার্থে নিয়োজিত শ্রম-সময়ে রূপান্তরণ। এর ফলে এম-দিবসের দৈর্ঘ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না কিন্তু পরিবর্তন ঘটবে আবশ্যিক শ্রম-সময়ে ও উত্ত-সময়ে তার ভাগাভাগিতে।
অন্য দিকে এটা স্পষ্ট যে, যখন এম-দিবসের দৈর্ঘ্য এবং শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট, তখন উত্তমের স্থায়িত্বকালও নির্দিষ্ট। শ্রমশক্তির মূল্য, তথা শ্রমশক্তি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়, নির্ধারণ করে দেয় উক্ত মূল্যের পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এ-সময়ের পরিমাণ। যদি একটা শ্রম-ঘণ্টা মূর্ত হয় ছয় পেন্সে এবং এক দিনের শ্রম শক্তি মূর্ত হয় পাঁচ শিলিংয়ে, তা হলে তার শ্রমশক্তির জন্য মূলধন তাকে যে মূল্য দেয়, সেই মূল্যের পুনঃসংস্থান করতে কিংবা তার দৈনিক গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদির মূল্যের সম-মূল্য সামগ্রী উৎপাদন করতে শ্রমিককে অবশ্যই দিনে ১০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হবে। গ্রাসাচ্ছাদনের এই উপকরণাদির মূল্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার শ্রমশক্তির মূল্যও নির্দিষ্ট থাকবে[১] এবং তার শ্রমশক্তির মূল্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার আবশ্যিক শ্রমসময়ের স্থায়িত্বকালও নির্দিষ্ট থাকবে। কি। উত্তমের স্থায়িত্বকাল হিসাব করতে হয় সমগ্র ম-দিবসটি থেকে আবশ্যিক এম সময়কে বিয়োগ করে। বাবো ঘণ্টা থেকে দশ ঘণ্টা বিয়োগ, করলে থাকে দুখটা এক এটা বোঝা সহজ নয় যে, কিভাবে নির্দিষ্ট অবস্থায় উত্তমকে দুই ঘণ্টার বেশি বাড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধনিক ঐ শ্রমিককে পাঁচ শিলিং না দিয়ে চার শিলিং ছয় পেন্স, এমন কি আরো কমও দিতে পারে। চার শিলিং ছয় পেন্সের এই মূল্যের পুনরুৎপাদনের জন্য নয় ঘণ্টার এমসময়ই যথেষ্ট; কাজে কাজেই দুই ঘণ্টার পরিবর্তে তিন ঘণ্টার শ্রম-সময় ঘনিকের হাতে যাবে এবং উত্ত মূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়াবে আঠারো পেন্স। কিন্তু এই ফলপ্রাপ্তির জন্য শ্রমিকের মজরি কমিয়ে আনতে হবে তার এম-শক্তির মূল্যের নীচে। যা উৎপাদন করতে তার লাগে নয় ঘণ্টা, সেই চার শিলিং ছয় পেন্স নিয়ে, সে তার গ্রাসাচ্ছাদনের উপকরণাদির জন্য পূর্বে যা পেত, তা থেকে পাচ্ছে এক-দশমাংশ কম এবং ফলতঃ যথাযথ পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা পঙ্গু হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে উদ্ধ-শমকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে তার স্বাভাবিক মাত্রাকে অতিক্রম করে; তার এলাকাকে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের এলাকার একটি অংশকে জবর-দখল করে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও আমরা এখানে তার আলোচনা থেকে বিরত থাকছি, কেননা আমরা ধরে নিয়েছি যে, শ্রমশক্তি সমেত সমস্ত পণ্য দ্রব্যেরই ক্রয়-বিক্রয় হয় তাদের নিজ নিজ পূর্ণ মূল্যে। এটা মেনে নিলে, শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় তার এম-শক্তির মূল্যের নীচে শ্রমিকের মজুরির পতন ঘটিয়ে হ্রাস করা যায় না, হ্রাস করা যায় কেবল খোদ ঐ মূল্যেরই পতন ঘটিয়ে। শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উদ্ধও-এমকে দীর্ঘায়িত করতে হলে অবশ্যই তা করতে হবে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস সাধন করে; শেষোক্তটির উদ্ভব পূর্বোক্তটি থেকে ঘটতে পারে না। আমাদের গৃহীত দৃষ্টান্তটিতে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে যদি এক-দশমাংশ কমাতে হয় অর্থাৎ যদি দশ ঘণ্টা থেকে নয় ঘণ্টা করতে হয় এবং, ফলত, উত্ত-এমকে দুই ঘণ্টা থেকে দীর্ঘায়িত করে তিন ঘণ্টা করা যায়, সেজন্য শ্রমশক্তির মূল্য বস্তুতই এক দশমাংশ হ্রাস হওয়া প্রয়োজন।
শ্রমশক্তির মূল্যে এই হ্রাস-প্রাপ্তির মানে অবশ্য দাঁড়ায় যে, আগে জীবনধারণের যেসব প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদিত হত দশ ঘণ্টায়, সেগুলি এখন উৎপাদিত হয় নয় ঘণ্টায়। কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া এটা অসম্ভব। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতির সাহায্যে একজন জুতো-নির্মাতা বারো ঘণ্টার একটি এম দিবসে এক জোড়া জুতো তৈরি করে। যদি তাকে একই সময়সীমার মধ্যে দুই জোড়া জুতো তৈরি করতে হয়, তা হলে তার শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণ বাড়াতে হবে; আর তা করা যায় না, যদি তার যন্ত্রপাতিতে বা তার কাজের পদ্ধতিতে বা দুটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন না ঘটানো যায়। অতএব উৎপাদনের অবস্থাদিতে অর্থাৎ তার উৎপাদনের পদ্ধতিতে এবং খোদ শ্রম-প্রক্রিয়াটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দ্বারা আমরা বোঝাই, সাধারণ ভাবে, এম-প্রক্রিয়ার এমন ধরণের এক পরিবর্তন, যার ফলে একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাৰে। আবশ্যক শ্রম-সময় হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম অধিকতর পরিমাণ ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের ক্ষমতাসমম্বিত হয়।[২] এই পর্যন্ত শ্রম-দিবসের সরল সম্প্রসারণ থেকে উদ্ভূত উত্তমূল্য সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা উৎপাদন পদ্ধতিকে ধরে এসেছি নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় বলে। কিন্তু যখন আবশ্যিক শ্রমকে উদ্ধৃত্ত-শ্রমে রূপান্তরিত করে উত্তমূল্য উৎপাদন করতে হয়, তিনি ইতিহাসের ধারাক্রমে প্রাপ্ত শ্রম-প্রক্রিয়াটিকে তুলে নেওয়া এবং সেই প্রক্রিয়াটির স্থায়িত্বকে দীর্ঘায়িত করাই মূলধনের পক্ষে কোনক্রমে যথেষ্ট নয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতা যাতে বাড়ানো যেতে পারে, তাই আগে ঐ প্রক্রিয়াটির কারিগরি ও সামাজিক অবস্থালীর এবং, ফলত, স্বয়ং উৎপাদন-পদ্ধতিটির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেবল সেই উপায়েই শ্রমশক্তির মূল্যকে তলিয়ে দেওয়া যায় এবং উক্ত মূল্য পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের হ্রাস করা সম্ভব। হয়।
শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করে যে উত্তমূল্য উৎপাদিত হয়, তাকে আমি বলি অনাপেক্ষিক উত্তমূল্য। অপর পক্ষে, আবশ্যিক শ্রম-সময়কে হ্রাস করে এবং শ্রম-দিবসের দুটি অংশের দৈর্ঘ্যে প্রয়জনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব হয়, তাকে আমি বলি আপেক্ষিক উদ্বমূল্য।
শ্রমশক্তির মূল্যে হ্রাস ঘটাতে হলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে শিল্পের সেই সব শাখায়, যেসব শাখার উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে অর্থাৎ যেসব দ্রব্যসামগ্রী, হয়, গ্রাসাচ্ছাদনের মামুলি উপকরণগুলির শ্রেণীভুক্ত আর, নয়তো, ঐসব উপকরণের স্থান গ্রহণে সক্ষম। কিন্তু কোন পণ্যের মূল্য কেবল সেই পরিমাণ শ্রমের দ্বারাই নির্ধারিত হয় না, যা শ্রমিক সেই পণ্যটির উপরে প্রত্যক্ষ ভাবে অর্পণ করে। সেই সঙ্গে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মধ্যে যে শ্রম বিধৃত থাকে, তার দ্বারাও নির্ধারিত হয়। যেমন, এক জোড়া জুতোর মূল্য কেবল সংশ্লিষ্ট পাদুকাকারের এমের উপরেই নির্ভর করে না, সেই সঙ্গে চামড়া, মোম, সুলতা ইত্যাদির উপরেও নির্ভর করে। সুতরাং শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং তার ফলে শ্রমের উপায় উপকরণ ও কাঁচামাল সরবরাহকারী শিল্পগুলির পণ্যসমূহের মূল্যহ্রাসের লক্ষণও এম শক্তির মূল্যহ্রাস ঘটে; শ্রমের এইসব উপায়-উপকরণ ও কাঁচামাল জীন-ধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থির মূলধনের বস্তুগত উপাদান। কিন্তু শিল্পের যেসব শাখা জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী কিংবা সেগুলি উৎপাদনের উপায় উপকরণ কোনটাই সরবরাহ করে না, সেখানে যদি এমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, তাতে শ্রমশক্তির মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
অবশ্য, পণ্যের মূল্যহ্রাসের ফলে এম-শক্তির মূল্য কেবল আনুপাতিক ভাবেই হ্রাস পায় শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনে উক্ত পণ্য যে অনুপাতে নিয়োজিত হয়, সেই অনুপাতেই শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাস ঘটে। যেমন সার্ট, জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে একটি। অবশ্য, জীবনধারণের জন্য আবশ্যিক দ্রব্যসম্ভার সমগ্রভাবে নানাবিধ পণ্যের দ্বারা গঠিত প্রত্যেকটি পণ্য একটি স্বতন্ত্র শিল্পের উৎপাদন এবং এই বহুবিধ পণ্যের প্রত্যেকটিরই মূল্য শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে একটি উপাদান হিসাবে প্রবেশ করে। নিজের পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এম-সময় হ্রাস পেলে এম-শক্তির মূল্যও হ্রাস পায় শ্রমশক্তির মোট মূল্যহ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে সংশ্লিষ্ট বিবিধ ও বিভিন্ন শিল্পে শ্রম-সময়ে যে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ হ্রাস-প্রাপ্তি ঘটে, সেই সমস্ত হ্রাস-প্রাপ্তির মোট যোগফল। এই সাধারণ ফলটিকে এখানে এমনভাবে গণ্য করা হচ্ছে যেন তা ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ছিল প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্দিষ্ট আশু ফল। যেমন, যখনি কোন ব্যক্তিগত ধনিক একাই শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে সার্টের মূল্য হ্রাস করে, তখন তার কোনক্রমেই উদ্দেশ্য থাকেনা যে সে এম-শক্তির মূল্য হ্রাস করবে। কিন্তু উল্লিখিত ফল সংঘটনে সে শেষ পর্যন্ত যতটা অবদান যোগায়, কেবল ততটা পর্যন্তই সে উদ্ধ মূল্যের সাধারণ হার বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।[৩] মূলধনের সাধারণ ও আবশ্যিক প্রবণতাগুলিকে অবশ্যই তাদের অভিব্যক্তির রূপগুলি থেকে আলাদা করে দেখতে হবে।
যে-পন্থায় ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি ব্যক্তিগত মূলধন-সম্ভারের জঙ্গমতায় আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে তারা প্রতিযোগিতার বাধ্যতামূলক নিয়মাবলী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে এবং কাজ-কারবারের নির্দেশক উদ্দেশ্য হিসাবে ব্যক্তিগত ধনিকের মনেও চেতনায় প্রতিভাত হয়, তা নিয়ে এখানে আলোচনা করার ইচ্ছা আমাদের নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, মূলধনের আন্তরপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা না করে প্রতিযোগিতার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। যেমন, ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে অদর্শনীয় অন্তরীক্ষচারী সত্তাসমূহের যথার্থ গতি-প্রকৃতির সঙ্গে অপরিচিত ব্যক্তির পক্ষে তাদের বা গতিপ্রকৃতি বোধগম্য নয়। যাই হোক, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন সম্পর্কে আরো ভালভাবে ধারণা করার জন্য, আমরা এখানে কয়েকটি কথা বলতে পারি। যে কথাগুলি বলতে গিয়ে আমরা ইতিমধ্যে যে ফলাফল ধরে নিয়েছি, তার বেশি কিছু ধরে নিচ্ছি না।
যদি এক ঘণ্টার এম ছয় পেন্সে মূর্ত হয়ে থাকে, তা হলে বারো ঘণ্টার একটি এম দিবসে উৎপন্ন হবে ছয় শিলিং পরিমাণ মূল্য। ধরা যাক, শ্রমের বর্তমান উৎপাদন শীলতার অবস্থায়, এই ১২ ঘণ্টায় উৎপন্ন হয় ১২টি জিনিস। ধরা যাক, প্রত্যেকটি জিনিসে ব্যবহৃত উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য ছয় পেন্স। এই অবস্থায় একটি জিনিসের মূল্য পাড়ায় এক শিলিং : উৎপাদনের উপায়-উপকরণের জন্য ছয় পেন্স এবং ঐ উপায়-উপকরণ কাজে লাগিয়ে নোতুন সংযোজিত মূল্য ছয় পেন্স। এখন ধরা যাক, কোন এক ধনিক শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণ করার এবং ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবসে ১২টির জায়গায় ২৪টি জিনিস উৎপাদন করার ব্যবস্থা করল। উৎপাদনের উপায় উপকরণের মূল্য অপরিবর্তিত থাকায়, প্রত্যেকটি জিনিসের মূল্য কমে দাড়াবে নয় পেন্স –উৎপাদনের উপায়-উপকরণের জন্য ছয় পেন্স এবং শ্রমের দ্বারা নোতুন সংযোজিত মূল্য তিন পেন্স। এমের দ্বিগুণিত উৎপাদনশীলতা সত্ত্বেও, গোটা দিনের শ্রম সৃষ্টি করে আগেরই মত ছয় শিলিং পরিমাণ নোতুন মূল্য, তার বেশি নয়; অবশ্য, তা এখন বিস্তৃত হয় আগের তুলনায় দ্বিগুণ-সংখ্যক জিনিসে। এই মূল্যের মধ্য প্রত্যেকটি জিনিস এখন ধারণ করে ১/১২ অংশের বদলে ১/২৪ অংশ, ছয় পেন্সের বদলে তিন পেন্স, যার মানে বাড়ায় যে, এখন যখন উৎপাদনের উপায়-উপকরণগুলি একটি করে জিনিসে রূপান্তরিত হয়, তখন একটি পুরো এক ঘণ্টার এম-সময়ের জায়গায় কেবল অর্ধ ঘণ্টার এম-সময় সেগুলির সঙ্গে সংযযাজিত হয়। এইসব জিনিসের ব্যক্তিগত মূল্য এখন তাদের সামাজিক মূল্য থেকে কম; অন্যভাবে বলা যায়, গড় সামাজিক অবস্থায় উৎপাদিত ঐ একই জিনিসের সুবিপুল পরিমাণের তুলনায় এইগুলিতে ব্যয় হয় অল্পতর শ্রম-সময়। প্রত্যেকটি জিনিসে এখন গড়ে ব্যয় হয় এক শিলিং এবং বিস্তৃত হয় ২ ঘণ্টার সামাজিক শ্রম। কিন্তু পরিবর্তিত উৎপাদন-পদ্ধতিতে এই ব্যয় হয় কেবল নয় পেন্স অর্থাৎ বিস্তৃত হয় ১২ ঘণ্টার সামাজিক প্রম। একটি পণ্যের আসল মূল্য কিন্তু তার ব্যক্তিগত মূল্য নয়, সামাজিক মূল্য; অর্থাৎ আসল মূল্য প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে জিনিসটির জন্য উৎপাদনকারীর কত ব্যয় হল তার দ্বারা মাপা হয় না, মাপা হয় তার উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় এম-সময়ের দ্বারা। সুতরাং নোতুন পদ্ধতি প্রয়োগকারী ঐ ধনিক ব্যক্তিটি যদি তার পণ্য তার সামাজিক মূল্যে অর্থাৎ এক শিলিংয়ে বিক্রয় করে, তা হলে তার ব্যক্তিগত মূল্যের তুলনায় তিন পেন্স বেশিতে সেটি বিক্রয় করছে এবং এইভাবে অতিরিক্ত তিন পেল উত্তমূল্য হিসাবে হস্তগত করছে। অন্য দিকে, তার কাছে ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের প্রতিনিধিত্ব করছে এখন আর ১২টি জিনিস নয়, ২৪টি জিনিস। অতএব, একটি এম-দিবসের উৎপন্ন জিনিস থেকে অব্যাহতি পেতে হলে, চাহিইতে হবে আগের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থাৎ বাজার হতে হবে দ্বিগুণ বিস্তৃত। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, তার পণ্যসম্ভার একটি বিস্তৃততর বাজার পেতে পারে, যদি সেগুলির দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং সে তখন সেগুলিকে বিক্রি করবে সেগুলির সামাজিক মূল্যের উপরে কিন্তু ব্যক্তিগত মূল্যের নীচে, ধরুন, প্রত্যেকটি ছয় পেলে। এইভাবে সে প্রত্যেকটি জিনিস-পিছু বাড়তি উত্তমূল্য নিঙড়ে নেয়। উত্তমূল্যের এই বৃদ্ধিও তার পকেটে যায়—এম-শক্তির সাধারণ মূল্য নির্ধারণে জীবনধারণের যে সমস্ত আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী অংশগ্রহণ করে, সেই দ্রব্যসামগ্রীর শ্রেণীতে তার পণ্য পড়ুক কি নাই পড়ুক। অতএব, এই শেষোক্ত পরিস্থিতি থেকে নিরপেক্ষ ভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তিগত ধনিকেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে তার পণ্যের মূল্য হ্রাস করার।
যাই হোক, এমনকি এই ক্ষেত্রেও উত্তমূল্যের বর্ধিত উৎপাদনের উদ্ভব ঘটে আবশ্যিক শ্রমময়ের হ্রাস-সাধন থেকে এবং উত্তমের আনুষঙ্গিক দীর্ঘায়ন থেকে। ধরা যাক, আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাপ হচ্ছে ১০ ঘণ্টা, এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে পাঁচ শিলিং, উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় ২ ঘণ্টা এবং দৈনিক উত্ত মূল্য এক শিলিং। কিন্তু ঐ ধনিক এখন উৎপাদন করছে ২৪টি জিনিস, যা সে প্রত্যেকটি বিক্রি করছে ১০ পেন্স করে এবং মোট পাচ্ছে ২০. শিলিং। যেহেতু উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য হল ১২ শিলিং, সেহেতু এই জিনিসগুলির ১৪ ২/৫ ভাগ আগাম দেওয়া স্থির মূলধনের পুনঃ সংস্থান করতে। ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে বাকি ৯ ৩/৫ জিনিস। যেহেতু শ্রমশক্তির দাম হচ্ছে ৫ শিলিং, সেই হেতু আবশ্যিক শ্রম-সময়ের প্রতিনিধি করে ৬টি জিনিস এবং উত্তমের প্রতিনিধিত্ব করে ৩ ৩/৫ ভাগ জিনিস। গড় সামাজিক অবস্থায় উদ্ধত্ত-এমের সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের যে অনুপাত থাকে ৫:১, সেই অনুপাত এখন দাঁড়ায় কেবল ৫:৩। নিম্নলিখিত উপায়েও এই একই ফলে উপনীত হওয়া যায়। ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের উৎপাদনের মূল্য ২০ শিলিং। এই ২০ শিলিংয়ের মধ্যে ১২ শিলিং হচ্ছে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য—এমন একটি মূল্য যার কেবল পুনরাবির্ভাব ঘটে। বাকি ৮ শিলিং, যা হল টাকার অঙ্কে অভিব্যক্ত উক্ত শ্রম-দিবসটিতে নব-সৃষ্ট মূল্য। একই ধরনের গড় সামাজিক ম যে-অকে অভিব্যক্ত হয়, এই অঙ্কটি তার তুলনায় বৃহত্তর : গড় সামাজিক শ্রমের ১২টি ঘণ্টা অভিব্যক্ত হয় কেবল ৬ শিলি হিসাবে। অসাধারণ ভাবে উৎপাদনশীল যে শ্রম, তা কাজ করে নিবিড় শ্রম হিসাবে। সমপরিমাণ সময়সীমার মধ্যে নিবিড় শ্রম গড় সামাজিক শ্রমের তুলনায় অধিকতর মূল উৎপাদন করে ( বাংলা প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য পৃঃ ৮)। কিন্তু ধনিক সেই আগের হারেই পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য বাবদ পাঁচ শিলিং হিসাবে। সুতরাং এই পরিমাণ মূল্য উৎপাদন করতে শ্রমিকের আগে যেখানে লাগত ১০ ঘণ্টা, এখন সেখানে লাগে মাত্র ৭ ১/২ ঘণ্টা। অতএব, তার উত্তম বৃদ্ধি পায় ২ ১/২ ঘণ্টা এবং সে যে উত্তমূল্য উৎপাদন করে, তা ১ শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ শিলিং। সুতরাং যে-ধনিক উন্নততর উৎপাদন-পদ্ধতি প্রয়োস করে, সে তার সম-ব্যবসায়ীদের চেয়ে শ্রম-দিবসের অধিকতর অংশ উদ্ধৃত্ত-শ্রমের জন্য কাজে লাগায়। আপেক্ষিক উত্তমূল্য উৎপাদনে নিয়োজিত বাকি সমস্ত ধনিকের দল যৌথ ভাবে যা করে, তা সে ব্যক্তিগত ভাবেই করে থাকে। অন্য পক্ষে, যেইমাত্র এই নতুন উৎপাদন-পদ্ধতি সাধারণত্ব প্রাপ্ত হয় এবং তার ফলে হ্রাসমূল্য পণ্যটির ব্যক্তিগত মূল্য এবং তার সামাজিক মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্যটি লোপ পায়, সেই মাত্র এই অতিরিক্ত উত্তমূল্য লুপ্ত হয়ে যায়। শ্রম-সময়ের দ্বারা মূল্য নির্ধারণের নিয়মটি— এমন একটি নিয়ম যা নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতি-প্ৰয়োগকারী ব্যক্তিগত ধনিককেও তার দ্রব্যসামগ্রীকে তাদের সামাজিক মূল্যের নীচে বিক্রয় করতে বাধ্য করে তাকে আপন আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসে সেই নিয়মটিই প্রতিযোগিতার জবরদস্ত নিয়ম হিসাৰে কাজ করে, তার প্রতিযোগীদের বাধ্য করে নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতিটিকে গ্রহণ করতে।[৫] সুতরাং উদ্বৃত্ত-মূল্যের সাধারণ হারটি শেষ পর্যন্ত কেবল তখনি সমগ্র প্রক্রিয়াটির দ্বারা প্রভাবিত হয়, যখন শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতা উৎপাদনের সেইসব শাখায় আত্ম বিস্তার করে, যেসব শাখা এমন সমস্ত পণ্যের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেগুলিকে সস্তা করে দিয়েছে, যে-সমস্ত পণ্য জীবনধারণের অত্যাবশ্যক উপকরণসমূহের অংশ এবং স্বভাবতই এম-শক্তির মূল্যের উপাদানও বটে।
পণ্যের মূল্য এমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে বিপরীতভাবে আনুপাতিক। এবং শ্রমশক্তির মূল্যও তাই, কারণ তা পণ্যের মূল্যের উপরেই নির্ভরশীল। উলটো দিকে, আপেক্ষিক উত্তমূল্য কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে, আপেক্ষিক উত্তমূল্যও বৃদ্ধি পায় এবং প্রথমটি হ্রাস পেলে দ্বিতীয়টিও হ্রাস পায়। টাকার মূল্য স্থির ধরে নিলে, ১২ ঘণ্টার একটি গড় সামাজিক এম-দিবস সব সময়ে সেই একই নোতুন মূল্য—৬ শিলিং উৎপাদন করে, এই নোতুন মূল্য কিভাবে উক্তমূল্য ও মজুরির মধ্যে ভাগাভাগি হয়, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু যদি বর্ধিত উৎপাদনশীলতার ফলশ্রুতি হিসাবে, জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাস পায় এবং তারা একদিনের শ্রমশক্তির মূল্য পাঁচ শিলিং থেকে তিন শিলিংয়ে হ্রাস পায়, তা হলে উত্তমূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়ায় তিন শিলিং। উক্ত এম-শক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য আগে লাগত ১০ ঘণ্টা আর এখন লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা। ৪টি ঘণ্টাকে মুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে উদ্ধত্ত-শ্রমের এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং মূলধনের মধ্যে নিহিত থাকে একটা অবিচল প্রবণতা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে একটা ঝোঁক, যাতে করে পণ্যকে সস্তা করা যায় এবং এইভাবে পণ্যকে সন্তা করে স্বয়ং শ্রমিককেই সস্তা করা যায়।[৬]
কোন পণ্যের নিছক মূল্যে ধনিকের কোন আগ্রহ থাকে না। যাতে সে আগ্রহী হয়, তা হল ঐ পণ্যে অবস্থিত উত্তমূল্য। উত্তমূল্যের আয়ত্তীকরণের সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই জড়িত থাকে অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্য প্রত্যর্পণের ব্যাপারটি। এখন, যেহেতু আপেক্ষিক উত্তমূল্য বৃদ্ধি পায় শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে, যখন, অন্যদিকে পণ্যের মূল্য হ্রাস পায় একই অনুপাতে, যেহেতু এক ও অভিন্ন এই প্রক্রিয়া পণ্যকে সস্তা করে এবং তার মধ্যে বিস্তৃত উত্তমূল্যকে বৃদ্ধি করে, আমরা এখানে পেয়ে যাই আমাদের ধাধার সমাধান : কেন ধনিক, যার একমাত্র ভানা হচ্ছে বিনিময়মূল্যের উৎপাদন, সেই ধনিক নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায় পণ্যের বিনিময় মূল্যকে দাবিয়ে রাখতে? এটা এমন একটা ধাধা যার সাহায্যে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠানে কেনে তাঁর বিরোধীদের উত্যক্ত করতেন এবং যে ধাধাটির কোনো উত্তর তাদের জানা ছিল না। তিনি বলতেন, আপনারা স্বীকার করেন যে, উৎপাদনের ক্ষতি না ঘটিয়ে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন শ্রমের খরচ ও ব্যয় যত বেশি কমানো যায়, তত বেশি এই কমতি সুবিধাজনক হয়, কেননা তা তৈরি জিনিসটির দাম কমিয়ে দেয়। এবং তবু আপনারা বিশ্বাস করেন যে, এমকারী মানুষের শ্রম থেকে যার উদ্ভব সেই সম্পদের মানে হচ্ছে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়মূল্যের বৃদ্ধি সাধন।[৭]
সুতরাং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে, যখন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তার সাশ্রয় ঘটানো হয়, তখন তার যা লক্ষ্য থাকে তা কোন মতেই এম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধন নয়।[৮] লক্ষ্য থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের হ্রস্বতা-সাধন। শ্রমিকের শ্রমের উৎপাদনশীলতা যখন বর্ষিত হয়, তখন যে সে, ধরুন, আগের তুলনায় ১০ গুণ পণ্য উৎপাদন করে এবং এইভাবে প্রত্যেকটি পণ্যপিছু এক দশমাংশ শ্রম-সময় ব্যয় করে, এই ঘটনা কোন মতেই তাকে আগের মতই ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে এবং এইভাবে ঐ ১২ ঘণ্টায় ১২টির বদলে ১২টি জিনিস উৎপাদন করা থেকে তাকে বিরত করে না। এমনকি, অধিকন্তু, তার এম দিবসকে ঐ সময়ে আরো দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে, যাতে করে তাকে ১৪ ঘণ্টায় ১,৪০০টি জিনিস তৈরি করতে বাধ্য করা যায়। সুতরাং ম্যাককুলো, উরে সিনিয়র এবং ওঁদের ছাঁচের এক গাদা অর্থনীতিবিদের গ্রন্থগুলিতে আমরা এক পৃষ্ঠায় যখন পড়ি যে, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের দৈর্ঘ্য হ্রাসের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে মূলধনের কাছে সকৃতজ্ঞ ভাবে ঋণ-স্বীকার করা উচিত, তখন পরের পৃষ্ঠাতেই পড়ি যে, দশ ঘণ্টার পরিবর্তে ভবিষ্যতে ১৫ ঘণ্টা কাজ করে তার উচিত কৃতজ্ঞতা স্বীকারের প্রমাণ দেওয়া। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের চতুঃসীমার মধ্যে শ্রমের উৎপাদন শীলতা বিকাশের সমস্ত ব্যবস্থারই উদ্দেশ্য হচ্ছে এম-দিবসের সেই অংশটির দৈর্ঘ্য হ্রাস, করা, যে অংশটিতে শ্রমিককে অবশ্যই কাজ করতে হবে তার নিজের স্বার্থের জন্য এবং এইভাবে এই অংশটির দৈর্ঘ্য হ্রাস করে শ্রম-দিবসের বাকি অংশটিতে সে ধনিকের স্বার্থে মুফতে কাজ করে যাবার স্বাধীনতা ভোগ কৱে। পণ্যের মূল্য না কমিয়ে এই ফলপ্রাপ্তি কতদূর সম্ভব, তা বোঝা যাবে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের বিশেষ পদ্ধতিগুলি পর্যালোচনা করলে এবং সেই পর্যালোচনার দিকেই এখন আমরা অগ্রসর হব।
————
১. “বাচার জন্য, শ্রম করার জন্য, প্রজনন করার জন্য শ্রমিকের যা যা চাই, তার বারাই নির্ধারিত হয় তার গড় দৈনিক মজুরির মূল্য। (উইলিয়ম পেটিঃ “পলিটিক্যাল অ্যানাটমি অব আয়াণ্ড, ১৬৭২, পৃঃ ৬৪)। “এমের দাম সব সময়েই গঠিত হয় আশিক দ্রব্যসামগ্রীর দামের দ্বারা। যখনি শ্রমজীবী লোকটির মজুরি, শ্রমজীবী লোক হিসাবে তার নিম্ন পদ ও অবস্থান অনুযায়ী তার পরিবারের ভরণ-পোষণে অক্ষম হয়, তাদের অনেকেরই ভাগ্যে প্রায়ই যা হয়, তখনি বুঝতে হবে সে উচিত মজুরি পাচ্ছে না। (জ্যাকব ভ্যাঙারলিন্ট : “মানি অ্যানসারস অল থিংগস, ১৭৭৪, mi se )”Le simple ouvrier qui n’a que ses bras et son industrie, n’a rien qu’autant qu’il parvient a vendre a d’autres sa peine… En tout genre de travail il doit arriver, et il arrive en effet, que le salaire de l’ouvrier se borne a ce qui lui est necessaire pour lui procurer sa subsistance (Turgot : “Reflexions &c” Oeuvres, ed. Daire t. I, P. 10) জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রীর দামই হল আসলে এম-উৎপাদনের ব্যয়” (ম্যালথাস, “ইনকুইরি ইনটু রেন্ট ইত্যাদি”, লণ্ড ১৮১৫, পৃঃ ৪৮ টাকা)।
২. “Quando si perfezionano le arti che non e altro che la scoperta di nuove vie, onde si possa compiere una manufattura con meno gente o ( che e lo stesso ) in minor tempo di prima” (Galiani : “Della Moneta”, P. 159 ), “L”, economie sur les frais de production ne peu donc etre autre chose que l’economie sur la quantite de travail employe pour produire” (Sismondi, «Etudes”, t.I, P. 22).
৩. “ধরা যাক ম্যানুফ্যাকচারকারীর উৎপন্ন সামগ্রী মেশিনারির উৎকর্ষ সাধনের ফলে দ্বিগুণিত হয়।”…..সমগ্র উৎপাদনের একটি ক্ষুদ্রতর অংশের সাহায্য সে তার কর্মীদের পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতে পারবে এবং এই ভাবে তার মুনাফা উন্নীত হবে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় দ্বারা তা প্রভাবিত হবে না।” (ব্যামসে “অ্যান এসে অন দি ডিষ্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ”, ১৮৩৬, পৃঃ ১৬৮, ১৬৯)।
৪. একজন মানুষের মুনাফা অন্যান্য মানুষদের এম-ফলের উপরে তার নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে স্বয়ং শ্রমের উপরে তার নিয়ন্ত্রণের উপর। যখন তার কর্মীদের মজুরি অপরির্তত থাকে, তখন সে যদি তার জিনিস উচ্চতর জানে বিক্রয় করতে পারে, তা হলে সে স্পষ্টভাবে উপকৃত হয়। সে যা উৎপাদন করে তার একটি ক্ষুদ্রতর অনুপাতে সেই এমকে গতিশীল করার পক্ষে যথেষ্ট হয়। সুতরাং একটি বৃহত্তর অনুপাত তার নিজের কাছে থেকে যায়।” (আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৩২, পৃঃ ৪৯, ৫০)।
৫. “যদি আমার প্রতিবেশী অল্প শ্রম দিয়ে বেশি তৈরি করে সস্তায় বিক্রি করতে পারে, আমিও এমন ব্যবস্থা করব যাতে তার মত সস্তায় বিক্রি করতে পারি। সুতরাং প্রত্যেক কৌশল, বৃত্তি, বা ইঞ্জিন, যা অল্পতর সংখ্যক কর্মীর শ্রমের সাহায্যে কাজ করে, অতএব, সস্তায় কাজ করে, তা অন্যান্যদের মধ্যে একই কৌশল, বৃত্তি বা ইঞ্জিন ব্যবহারের কিংবা অনুরূপ কিছু উদ্ভাবনের, আবশ্যিকতা বা প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, যাতে করে প্রত্যেকটি মানুষই তার উপযুক্ত স্থানে দাড়াতে পারে এবং কেউ তার প্রতিবেশীর চেয়ে সস্তায় বিক্রি না করতে পারে (“দি অ্যাডভানটেজেস অব দি ইষ্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড টু ইংল্যাণ্ড, লণ্ডন ১৭২০, পৃঃ ৬৭)।
৬. একজন শ্রমিকের ব্যয় যে অনুপাতেই কমুক না কেন, সেই একই অনুপাতে তার মজুরিও কমানো হবে, যদি শিল্পের উপরে আরোপিত নিয়ন্ত্রণগুলি তুলে নেওয়া হয়।” (“কনসিডারেশনস কনসার্নিং টেকিং অফ দি বাউন্টি অন কর্ণ এক্সপোর্টেড”, লন, ১৭৫৩, পৃঃ ৭)। “ব্যবসার স্বার্থ দাবি করে যে, শস্য এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য যথাসম্ভব সস্তা হবে; কেননা যা কিছু তাকে মহার্ঘ করবে, তা শ্রমকেও মহার্ঘ করবে যেখানে শিল্পের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমন সমস্ত দেশেই, খাদ্য-দ্রব্যের দাম অবশ্যই এমের দামকে প্রভাবিত করবে।” এটা সব সময়ই কম হবে যখন জীবনধারণের। দ্রব্যাদি সস্তা নয়। (ঐ, পৃঃ ৩)। “যে অনুপাতে উৎপাদনের ক্ষমতাগুলি বৃদ্ধি পায়, সেই অনুপাতে মজুরি হ্রাস পায়। এটা সত্য, মেশিনারি জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদিকে সস্তা করে, কিন্তু শ্রমিককেও সস্তা করে।” (“এ প্রাইজ এসে অন দি কমপ্যারাটিভ মেরিটস অব কমপিটিশন অ্যান্ড কো-অপারেশন”, ১৮৩৪, পৃঃ ২৭)।
৭. “Ils conviennent que plus on peut, sans prejudice, epargner de frais ou de travaux dispendieux dans la fabrication des ouvrages des artisans, plus cette epargne est profitable par la diminution des prix de ces ouvrages. Cependant ils croient que la production de richesse qui resulte des travaux des artisans consiste dans l’augmentation dela valeur venate de leurs ouvrages.” (Quesnay : “Dialogues sur le commerce et les Travauxdes Artisans, pp. i88, 189)
৮. “Ces speculateurs si economes du travail des ouvriers qu’il faudrait qu’ils payassent.” (J. N. Bidaut: “Du Monopole qui s’etablit dans les arts industriels et le commerce.“ Paris, 1828, p. 13.) নিয়োগকর্তা সব সময়েই সচেষ্ট থাকবে সময় ও শ্রম কমাতে (ভুগাড় স্টয়ার্ট : স্যার ডবলিউ. হামিলটন সম্পাদিত গ্রন্থ, এডিনবরা খণ্ড ৮, ১৮৫৫, “লেকচারস অন পলিটিক্যাল ইকনমি” পৃষ্ঠা-৩১৮। “তাদের (ধনিকদের) স্বার্থ এই যে, তারা যে শ্রমিকদের নিয়োগ করে, তাদের উৎপাদিকা ক্ষমতা যেন সর্বাধিক হয়। ঐ ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে তাদের মনোযোগ নিবিষ্ট, একান্ত ভাবে নিবিষ্ট, থাকে।” (আর- জোন্স, টেকস্টট বুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশন, খটফোর্ট ১৮৫২ “লেকচার-৩”)