আপিস ঘরে বারী আর ভাইয়ানকে রেখে ওপরে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা রাখতেই মিস্টার আলির মাথায় বিদ্যুতের মতো বুদ্ধিটা খেলে যায়। এত সহজ বুদ্ধিটা আগে কেন মাথায় আসে নি, ভেবে তিনি অবাক হন। তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে নাহারকে ফিসফিস করে বলেন, ইয়াসমিনের কথা তোলার দরকারই নেই। মাহজাবীনকে দেখিয়ে দাও।
কী বলছ?
আহ, অসুবিধে কী?
বীনার বয়স মাত্র পনের। ওকে তুমি বিয়ে দেবে?
তা নয়, তা নয়। মেয়ে দেখতে এসেছে, মেয়ে দেখে যাক। অসহিষ্ণুভাবে আলি হাত নাড়েন। বুদ্ধিটা নিজের কাছেই এত ভালো লেগেছে, মুক্তি পাবার এত নির্বিঘ্ন পথ পেয়ে গেছেন, যে সেটাকে ব্যবহার না করা পর্যন্ত তার ভেতরে উত্তেজনা কাটছে না। তিনি বলেন, মাহজাবীনকে এখন বিয়ে দেব কেন? দেখে যাবার পর জানিয়ে দেব, ছেলে আমার পছন্দ হয় নি।
এবার কথাটা কিছু মনঃপুত হয় নাহারের। আবার সন্দেহও দেখা দেয়।
মেয়ের নাম তো ছেলে জানে।
কী আর জানে? অত কি আর লোক খেয়াল রাখে? একবার দুবার শোনা? ভাববে, বড় বোন ছোট বোনের নাম গুলিয়ে ফেলেছে। নাও চটপট কর। আমি ওদের ওপরে নিয়ে আসি। মাহজাবীনকে বল, চা ও-ই দেবে।
বীনা যদি বেঁকে বসে।
আহ, ওকে এসব বলতে যাবে কেন? ও কিছুই জানবে না। চা-টা দেবে, একটু কথা বলবে, হয়ে গেল। এ কি আর দেশের মেয়ে দেখা যে সাজিয়ে গুছিয়ে দেখান? আর সে রকম তো কোনো কথাও ছিল না। ছেলে আসবে, সবার সঙ্গে দেখা হবে, সেই সঙ্গে মেয়েকেও দেখবে, আমরাও ছেলে দেখব, এইতো?
তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যান আলি।
ভেতরে এসে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অপ্যায়নের হাসি ফুটিয়ে বলেন, আপনারা তাহলে ওপরে আসুন। একটু চা খাবেন।
আপিস ঘর বন্ধ করেন না আলি। ভেতর থেকে শুধু হাতল-তালাটা ঘুরিয়ে দেন। ইচ্ছেটা, ওদের ওপরে বসিয়ে নিচে নেমে আসবেন। এখনো আপিস বন্ধ করবার সময় হয় নি, তাছাড়া, তিনি একটা মিথ্যের ভেতরে উপস্থিত থাকাটা ভালোও বোধ করছিলেন না।
ওপরে নিজেদের শোবার ঘরটাই বসবার ঘর। সেখানে বারী আর ভাইয়ানকে বসিয়ে নাহারকে ডেকে আনেন। আলাপ করিয়ে দেন।
তুমি ওদের চা-টা দাও। মেয়েদেরও ডাক, তারাও বসুক। আপনারা বসুন, আমার আবার ক্লায়েন্ট একজন আসবে। নিচে থাকতে হয়। চা খেয়ে নিচেই আসুন তাহলে। আপনাদেরও তো সময় নেই বলছিলেন।
ভাইয়ান বলে, না, সময়, সময় আর কী।
আলি চাইছিলেন তাড়াতাড়ি বিদায় করতে। ভাইয়ানের মুখে অনির্দিষ্ট কথাটা শুনে মুহূর্তের জন্যে ভয় হয় তার। যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণই বিপদ। হেসে তিনি বলেন, তা বেশ, বেশ তো। স্ত্রীকে বলেন, এদিকে শোন।
রান্নাঘরে নাহারকে তিনি বলেন, মাহজাবীনকে ডাকবার আগে, ডাক্তারকে বোলো, মেয়েকে আমরা বলি নি কিছু। তাই, সে রকম আভাষ যেন না দেয়। আর মাহজাবীনকেও বেশিক্ষণ সামনে থাকতে দিও না। বুঝলে?
স্ত্রীকে সাগরে ফেলে তিনি নিচে নেমে যান।
পেছন থেকে নাহার বলে, তুমি চা খাবে না?
বড় আকুল শোনায় তার কণ্ঠস্বর। স্বামী থাকলে সে ভরসা পেত। তাই শেষ চেষ্টা করে। আলি শুনেও কোনো উত্তর না দিয়ে আপিস ঘরে গিয়ে ঢোকেন। ভেতরটা ভয়াবহ রকম শূন্য লাগে তার। কোথায় যেন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ব্যর্থতাবোধ বাদুরের মতো ঝুলে থাকে। দুহাতে মাথার দুপাশ ধরে তিনি কতক্ষণ বসে থাকেন, চেতনা থাকে না। তারপর হঠাৎ যখন বাস্তবে ফিরে আসেন, ইয়াসমিনের জন্যে প্রচণ্ড একটা ব্যথা অনুভব করেন তিনি। কোথায় তিনি ভুল করেছেন? কী তিনি মেয়েকে দিতে পারেন নি? কোন তীব্রতর আকর্ষণে সে তাকে ত্যাগ করল? যদি বা চলেই গেল, খবর দিল না কেন? তাকে তিনি স্নেহ দেন নি? শিশুকালে বুকের পরে রেখে রাত কাটিয়ে দেন নি? ইয়াসমিন কি বোঝে না, সে ভালো আছে কি না শুধু একটু জানার ভেতরে এখন তার পিতার জন্যে সমস্ত সঞ্জীবন?
খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো তার চোখের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে সরে যায়। সাতষট্টি সালে প,আই.এ-র লন্ডন আপিসে বদলী হয়ে এলেন। প্লেন থেকে নামছেন। বিয়ের পর সেই তার একা এতদূর ভ্রমণ। নাহারের জন্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি শূন্য বোধ করতেন ইয়াসমিন আর মাহজাবীনের জন্যে। মাহজাবীন তখন তিন, ইয়াসমিন পাঁচ। করাচিতে ফেলে এসেছিলেন তিনি। তারপর, বাসা গুছিয়ে নেবার পর, ওরা এল। মাসটা ছিল। ডিসেম্বর। কড়া শীত। সকলেই নিষেধ করেছিল, এ সময়ে ওদের আনবেন না। আলি সে পরামর্শ গ্রাহ্য করেন নি। পাছ প্লেন থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত যেতেই শীতে কষ্ট হয়, তিনি স্ত্রী আর দুমেয়ের জন্যে গরম কোট কিনে হিথরো এয়ারপোর্টে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসে। পি.আই.এ-র পাশ থাকবার দরুণ একেবারে ভেতর পর্যন্ত গিয়েছিলেন তিনি। মায়ের কোলে ছিল মাহজাবীন, আর পাশে টুরটুর করে হেঁটে আসছিল ইয়াসমিন। আলি দৌড়ে গিয়ে খপ করে কোলে তুলে নিয়েছিলেন তাকে।
হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরে।
কাঁধের পরে কোমল একটি হাত অনুভব করেন তিনি। একাত্তর সালে পি.আই.এ-র চাকরি থেকে বিদায় নেবার পর এই ঘরে এই আপিসে নিজের এজেন্সি যখন গড়ে তুলছেন, তখন ইয়াসমিন একেকদিন পা টিপে টিপে পেছনে এসে দাঁড়াত।
চোখ ফিরিয়ে দেখেন, নাহার।
মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেছেন তিনি আজীবন। ইয়াসমিন যখন পা টিপে আসত, মেয়েটির কি ইচ্ছে করত, বাবার গায়ে হাত রাখে? সাহস পেত না? তিনি তিরস্কার করতেন, যদি হাত রাখত?
স্বামীর বিরল চেহারা দেখে নাহার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, তুমি কিচ্ছু ভেব না। সব ঠিক আছে।
আলি যেন এক মুহূর্তের জন্যে কিছুই বুঝতে পারেন না।
চা খেয়ে নিয়েছে। এখন এক মুশকিল হয়েছে।
কী, কীসের মুশকিল?
বীনাকে নিয়ে ওরা একটু বেরুতে চাইছে। সঙ্গে নাসরিনও যাবে।
মাহজাবীনকে পছন্দ করে ফেলল নাকি? দেখতে ওকেও তো সতের আঠার লাগে।
কী যে তুমি বল! বীনা যে ছেলেমানুষ। ওরা কী গাড়ি করে এসেছে, কত মাইল স্পীডে এসেছে, এই সব গল্প তুলে বীনা বেশ মাতিয়ে রেখেছে, এরই মধ্যে শুনি ডাক্তার বলছে, বেশ তো গাড়ি করে ঘুরিয়ে আনি। বীনা রাজি হয়ে গেল আমাকে জিগ্যেস না করেই। আমি আর কী করি, নাসরিনকে সঙ্গে নিতে বললাম। যাবে আর আসবে।
এ আবার কোন বিপদ হলো? আলি আবার সাগরে গিয়ে পড়েন।
নাহার বলে, যেতে না দিলে খারাপ দেখাবে। বীনাকে অবশ্য আমি রান্নাঘরে ডেকে সব বলে দিয়েছি। নাহার ওপরের দিকে শংকিত দৃষ্টিপাত করে ফিসফিস করে বলে, মেয়েকে না বলে আর রাখা গেল না। মেয়েটি তোমার ভালো। ঘুনাক্ষরেও ওরা জানতে পারবে না। ইয়াসমিনের কথা।
তবু ছেলেমানুষ।
না, না। বীনা নিজে আমাকে বলল, সে জানতেই দেবে না। বোনের জন্যে ওরও তো একটা কষ্ট আছে। কীসে সুনাম, কীসে দুর্নাম, তা কি বোঝে না? কী সুন্দর আলাপ করছে, দেখে আমিই অবাক।