৫৬.
কাঠটগর গাছের পাতাগুলো আলকেউটে সাপের ফণার চেয়েও চওড়া। এই গাছটার কাছে দাঁড়ালে সুর্যার মনে হয় প্রখর রৌদ্র দিনেও ছাতার কোনো প্রয়োজন হবে না। এর মোটা পাতাগুলোর শিরা-উপশিরা দেখা যায় স্পষ্ট। ঈষৎ কালচে সবুজে মেশান পাতাগুলো বুঝি রঘুনাথের গায়ের রঙকে মনে করিয়ে দেয়।
রঘুনাথের কথা মনে পড়তেই সাক্ষর মনের ভেতরে কেমন একটা অপরাধবোধ জেগে উঠল। পরীক্ষার ব্যস্ততায় রঘুনাথের সঙ্গে অনেকদিন তার যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। মীনাক্ষীও চান না তার ছেলে বখাটে হয়ে যাওয়া ধাওড়াপাড়ার ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। রঘুনাথকে তিনি ভেবেছিলেন নিষ্পাপ সরল সাধাসিধে একজন ছোকরা। ধীরে ধীরে তার সব গুণ প্রকাশ হল। গ্রামে থাকলে সব কথা কানে আসে তার। আর আসবেই না কেন? রঘুনাথ যে এখানে দুচারবার রাত্রিবাস করে গিয়েছে। গ্রামের মানুষ চোখ বুজে থাকে না। সুযোগ বুঝে তারাই সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
নীলাক্ষবাবুর বাড়িতে যে ডাকাতিটা হল তাতে সবাই ধরে নিয়েছে এর পেছনে রঘুনাথের হাত কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। গুয়ারামের মারের বদলা সে না নিয়ে ছাড়বে না। এটা হল সেই বদলা। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকায় থানা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
সেই থেকে বুক ফুলিয়ে বাঁধের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে রঘুনাথ। তার মনে থানা পুলিশ নিয়ে আর কোনো ভয় ডর নেই। সৎপথে থাকলে আবার ভয় কিসের?
সূর্যাক্ষ সাইকেলটা নিয়ে গেটের বাইরে আসতে গেলেই মীনাক্ষী গলা উঁচিয়ে বললেন, রোদে রোদে এখন আবার যাচ্ছিস কোথায়?
কি উত্তর দেবে সূর্যাক্ষ এক মূহুর্ত ভেবে নিল। রঘুনাথের গ্রামে যাচ্ছি এটা বলা উচিত হবে না। রঘুনাথের নামটায় মীনাক্ষীর গায়ে আমবাত বেরিয়ে যাবে–এসব ভেবে সূর্যাক্ষ বলল, গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসি মা। ওদিকটায় অনেকদিন যাওয়া হয়নি।
-নৌকায় যেন চাপবি না। মীনাক্ষী সতর্ক করলেন, বল্লভপাড়ার ঘাটে ফেরি উল্টে গিয়ে তেরোজন মারা গিয়েছে–শুনেছিস নিশ্চয়ই। এখনও অনেকের দেহ পাওয়া যায়নি।
-যারা ডুবে গিয়েছে তারা সাঁতার জানত না।
–সাঁতার জানলেও জলের কাছে কোনো বিদ্যে খাটে না। মীনাক্ষী অসন্তুষ্ট হলেন। যাচ্ছিস যখন যা। তবে দুপুরের আগে চলে আসবি। আমি ভাত নিয়ে বসে থাকতে পারব না।
ঘাড় নেড়ে সাইকেলে চাপতে গেলে মীনাক্ষী গেটের সামনে এসে বললেন, ফেরার পথে তোর জ্যাঠাকে দেখে আসবি। কাল কমল এসে বলছিল ওঁর শরীরটা ভালো নেই। ডাকাতরা যেভাবে ওকে মেরেছে ওভাবে কেউ গোরু-ছাগলকে মারে না।
সূর্যাক্ষর ঠোঁটের কাছে একটা মোক্ষম উত্তর চুলবুল করছিল, কিন্তু সে চেপে গেল। তার জ্যাঠামশাই গুয়ারামের অকাল প্রয়াণের কারণ এটা সে ভালোভাবে জানে। কেউ যদি কারোর মৃত্যুর কারণ হয় তাহলে তাকে সে কারণের জন্য উপযুক্ত খাজনা দিয়ে যেতে হয়। এই জীবনের পাপ অন্য জীবনে পরিশোধ হবে এখন আর তেমন হিসাব খাটে না।
সাইকেল নিয়ে সোজা বাঁধের উপর উঠে এল সুর্যাক্ষা বাঁধের উপর দাঁড়ালে পুরো আকাশটাকে মনে হয় কত আপন! নীল রঙটা তার খুব পছন্দ। দ্বীপীর মন ভালো থাকলে গালে টোল ফেলে সে বলে, তুই নীল রঙের জামা পরলে তোকে মনে হয় ফুলে বোঝাই অপরাজিতা লতা। এক একটা রঙ, এক এক জনকে দারুণ মানায়।
কি তাকে মানায়–এসব নিয়ে ভাবে নি সে। তবে দ্বীপীর কথাগুলো তার শুনতে ভালো লাগে। দ্বীপী তাকে কালীগঞ্জ বাজার থেকে একটা নীল রঙের রুমাল কিনে দিয়েছে। সেই রুমালটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে সূর্যা। কলকাতায় পড়তে গেলে রুমালটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
রোদ মাথায় নিয়ে গাধারের ঝাউগাছগুলো যেন হাতের ইশারা করে ডাকছে সূর্যক্ষকে। সূর্যাক্ষ আপন মনে হেসে উঠল। সাহেব মাঠে আখ কাটা শেষ। মাঠ এখন ফাঁকা। আলসে পুড়িয়ে দেবার পর পড়ে আছে কালো কালো ছাইয়ের পাহাড়। গা-পালানো হাওয়া এলে সেই ছাই হয়ে যায় এক একটা রাগী ক্রোধী ভোমরা। মাথা সমান উঁচুতে উঠে তারা হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকে, তারপর শূন্যে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
এই বাঁধের উপর সূর্যাক্ষর মায়াটা যত দিন যাচ্ছে তত যেন ঘনীভূত হচ্ছে। এই গ্রাম, এই বাঁধ এই চেনা পরিবেশ ছেড়ে সে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। পরীক্ষা দিতে গিয়ে মাত্র পনের দিনে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। দুচোখ যেন খুঁজত কাউকে। কাকে খুঁজত সেটা টের পেল ফিরে আসার দিন। বাঁধে বাঁধে ফেরার সময় কত হালকাবোধ হচ্ছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল যেন নিজের চেনা বিছানায় শোওয়ার জন্য এই উন্মুক্ত প্রকৃতি সব রকম ব্যবস্থা করে রেখেছে–যা দেবগ্রামে ছিল না। তাহলেও নির্জন ছাদে বসে ঘন অন্ধকারে দ্বীপীর সঙ্গে রকেটবাস দেখার অভিজ্ঞতার কথা তার দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
প্রথম রাতে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় রাত্রে সফল হয়েছিল তারা। লম্বা বাসটার মাথায় সাইরেন আর সার্চ লাইট। তার গতি পখীরাজ ঘোড়ার মতো। রাতের স্তব্ধতাকে খানখান করে বাসটা, ছুটে যাচ্ছিল শিলিগুড়ির দিকে। বাসটা চলে যাওয়ার পর একরাশ শূন্যতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের দুজনের মাঝখানে। দ্বীপী মন খারাপ করা গলায় বলেছিল, বাসটাকে দেখতে না পেলে বুঝি ভাল হত।
-কেন?
–জমিয়ে রাখা আগ্রহটা গলে জল হয়ে গেল।
-মানছি। তবে কৌতূহল শেষ হলে নতুন কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। আর এই প্রসেসটা না থাকলে পৃথিবী একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যেত।
-সূর্য, একটা কথা বলব। রাগ করবি না। ধণী গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, পণ্ডিত বিলেরতলায় কি আমরা জানি না। জেনে গেলে কি ভালো লাগবে বল? তেমনি আমরা দুজন যদি দুজনকে জেনে যাই তখন ভাললাগাটা কি আগের মতো কাজ করবে? তোর কি মনে হয়?
মানুষকে জানা-চেনা এক জীবনেও সম্ভব নয়। আমার মা বলে–মানুষ সমুদ্রের চেয়েও বিশাল। পৃথিবীর সব চাইতে মজার আর কঠিন পাঠ মানুষকে পাঠ করা। সূর্যাক্ষ পূর্ণতার হাসি হাসল, তাই বলছিলাম কি প্রতি মুহূর্তে মানুষ নিজেকে সবদিক থেকে বদলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। রোদ্দুরের ভাষা যেমন বোঝা যায় না, তেমনি মনুষ্য চরিত্রও অবোধ্য।
হুম। দ্বীপী খাস ছেড়ে বলেছিল, শেষ পর্যন্ত তুই কি গোরাসাধুর মতন আধ্যাত্মিক লাইনে চলে যাবি?
-আমি একদিন আগে কি হবে তাই জানি না। অত বছর পরের কথা বলব কি করে? আমার লক্ষ্য কি জানিস? আমার হাতের মুঠায় যে দিনটা আছে সেই দিনটাকে শুধু উপভোেগ করা, চিনে রাখা।
হলদিপোঁতা ধাওড়ার চেহারাটা মাঠ কুড়োনীর চুলের চেয়ে এলোমেলো। খড় পচে যাওয়া ঘরগুলোয় কত শান্তি আদৌ তা বোঝা যায় না। পাকুড় তলায় গোল্লাছুট খেলছিল ছেলে-মেয়েরা। সূর্যাকে সাইকেল থেকে নামতে দেখে ওরা খেলা থামিয়ে তাকাল।
টগরী সাহস করে এগিয়ে এসে বলল, তুমি রঘুদাকে খুচ্ছো তাই না? রঘুদা ঘরে আচে-যাও। একটু আগে পাকুড়তলা থেকে সে ঘরে গেল।
পুরো পাড়াটায় মাকড়সার জালের মতো অভাব তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। ভাঙা বেড়াটা সারিয়ে নেবার ক্ষমতা বুঝি রঘুনাথের ছিল না। ঘরে বসে সে ভাবছিল-সামনের দিনগুলো চলবে কি ভাবে? আখ কাটার পর ফাঁকা মাঠে এখন কোনো কাজ নেই। ট্রাক্টর দিয়ে লাঙলের কাজটা সারছে মালিকরা। এক কোপে অনেকগুলো রোজ বরবাদ হয়েছে মানুষের। দুলাল গালে হাত দিয়ে বলছিল, আর বাঁচা যাবে না। গাঁয়ে থাকা তো ভাগ্যে হল না, এবার ভাবছি শহরে পেলিয়ে যাব।
এই আক্ষেপ নিয়ে বছরের পর বছর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। রঘুনাথ নিজের ভবিষ্যৎ-এর কথা ভাবতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিল। দুর্গামণি ইদানীং খুব কম কথা বলছে তার সঙ্গে। গুয়ারাম গত হবার পর থেকে মনটা তার ভালো নেই। সে একটা দম দেওয়া পুতুলের মতো হয়ে গেছে। হাসি শুষে নিয়েছে শোক। জীবনে কোনো ছন্দ নেই। বেঁচে থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।
রঘুনাথ এক কাপ চায়ের জন্য উশখুশ করছিল, বাবু-ভদ্রলোকের নেশাটা তার ভেতরেও শেকড় চারিয়েছে। চায়ের কথা বলতেই দুর্গামণি ফুঁসে উঠল না কিন্তু এমন ভাবে তাকাল যাতে অবজ্ঞা ফুটে উঠল চৈত্রের রোদ্দুর হয়ে। রঘুনাথ অবাক করা চোখে তাকাল মায়ের দিকে। দুর্গামণি বিতৃষ্ণার মুখ তুলে বলল, ঘরে চা-পাতাও নেই। গুঁড়া দুধও নেই। চিনি ছিল, তা-ও শেষ। চা-কি হাত-পা সিজিয়ে বানিয়ে দেব?
এমন কথা বলা দুর্গামণির উচিত নয়, সামান্য এক কাপ চায়ের জন্য এত কথা? রঘুনাথ সব বুঝতে পেরেও চুপ করে রইল।
দুর্গামণি কি ভেবে বলল, চা খেতে যখন মন হয়েছে, করে দিচ্চি। যাই, বারির কাছ থিকে চা-পাতা উধার লিয়ে আসি।
ঘর থেকে বেরতেই সূর্যাকে দেখতে পেল দুর্গামণি। অমনি পুরনো রাগটা হোবল মারল মাথার ভেতর। মুখে কড়া শব্দ এসে জড়ো হল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। কোনো কথা না বলে আগড় খুলে বেরিয়ে গেল দুর্গামণি।
সূর্যাক্ষকে এ সময় দেখতে পাবে স্বপ্নেও আশা করেনি রঘুনাথ। উঠে দাঁড়িয়ে সে তাকে ডাকল, আয়, ভেতরে আয়।
বাইরে রোদ ফুটেছে কড়া ধাতের। হাওয়া থাকলেও তার জোর নেই একফোঁটা। ওমোট হয়ে আছে চারপাশ। এ সময় বাঁধের উপর ধুলো ওড়ে। শুষ্ক দেখায় মাঠঘাট। এমন কী গাছের পাতায় সবুজভাবটা ফিকে হতে থাকে। পণ্ডিতবিলে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়।
সূর্যাক্ষর প্রথম কথাটা অভিমানের স্তর ছুঁয়ে এল, হ্যাঁ রে রঘু, তুই একবার দেবগ্রামে যাওয়ার সময়ও পেলি না। আমি ভাবছিলাম আর কেউ না আসুক অন্তত রঘু আসবে।
রঘুনাথ আফসোসের সঙ্গে বলল, যেতে তো মন চেয়েছিল কিন্তু যাই কি করে বল তো? হাত বেবাক খালি। পায়ে হেঁটে গেলেও এই খরানীতে তোকে এট্টা ডাবও কিনে দিতে পারতাম নি।
–তাতে কি হয়েছে, তুই যেতে পারতিস।
–খালি হাতে যেতে মন টানল না। রঘুনাথ শুকনো মুখে বলল, বড়ো টানাটানি চলচে রে! কবে যে এ অভাব ঘুচবে মা শীতলাবুড়িই জানে।
সূর্যাক্ষ সব শুনল মন দিয়ে, তার মুখে কোনো ভাষা নেই। সাহেব মাঠে পুরো দমে কাজ শুরু না হলে ধাওড়া পাড়ায় কাবোর মুখে হাসি ফুটবে না। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে অভাব ইকরাবে।
চা খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। একটা চারা জামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রঘুনাথ জিজ্ঞেস করল, হারে দ্বীপী কেমন আছে রে?
দ্বীপীর প্রসঙ্গ উঠতেই চমকে উঠল সূর্যাক্ষ। আজ লহরীকে দেখতে বেলডাঙা থেকে পাত্রপক্ষের লোক আসবে। দ্বীপী বলেছিল, আজ তাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতে।
বেমালুম ভুলে গিয়েছে সূর্যাক্ষ। কাকা-কাকিমা কি ভাববেন? দ্বীপীই বা কি ভাববে? এত দূর এসে ফিরে যাওয়া পোষায় না। সূর্যাক্ষ নিজেকে চাপমুক্ত করে বলল, কুশল মাস্টারের সঙ্গে তোর কি আর দেখা হয়েছে?
কথা শেষ হল না, রঘুনাথ মন খারাপ করা গলায় বলল, মাস্টরকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
তার মানে? সূর্যাক্ষর ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল।
রঘুনাথ সংক্রামিত হল না, ঠাণ্ডাভাবেই বলল, কেসনগরের পুলিশ তাকে ধরেচে। মারধোর করেছে শুনেছি। কিন্তু গিয়ে যে দেখে আসব তেমন সুযোগ আর হয়নি।
-মনে হচ্ছে এভাবেই সরকার আন্দোলনটাকে শেষ করে দেবে? বিড়বিড়িয়ে উঠল সূর্যাক্ষ। রঘুনাথ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, কি রে কী হল তোর?
-না, কিছু না। অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। সূর্যাক্ষ প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল, জানিস রঘু, রেজাল্ট বেরলে আমি আর গ্রামে থাকব না। হয় কোলকাতা, না হয় বহরমপুর চলে যাব।
-ভালো কথা। রঘুনাথের মন খারাপ হয়ে গেল, তখন তোর সাথে আর দেখা হবে না।
মাঝে মাঝে আসব, তখন দেখা হবে।
এরকম অনেকেই বলে, পরে ভুলে যায়।
–আমি সবার মতো নই, আমি আলাদা। সূর্যাক্ষ জোর দিয়ে বলল।
রঘুনাথ বিষণ্ণ চোখে তাকাল, দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি হয়।
ফিরে আসার সময় সূর্যাক্ষ লিসা করল, আমাদের বাড়িতে কবে আসবি রঘু?
-যাব না রে, তোর মায়ের সামনে কুন মুখ নিয়ে যাব, বল?
–মা সব ভুলে গিয়েছে।
–এসব কথা কেউ কোনোদিন ভোলে না। ভালো কথা সবাই ভুলে যায়। রঘুনাথের গলার স্বর আর্দ্র হয়ে উঠল। মন খারাপের মোড়ক কেটে বেরিয়ে এল সে।
দ্বীপীদের বাড়িতে সূর্যাক্ষর জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময়। বড়ো মেয়েকে দেখতে এসে হীলীকে পছন্দ করে গেল পাত্রপক্ষ। লহরী সেই যে ঘরে ঢুকেছে লজায় আর বেরচ্ছে না।
নিজেকে অপরাধী ভেবে দ্বীপীও বসে আছে মুখ গোমড়া করে। সূর্যাকে দেখে অভিমানে ভেঙে পড়ল সে, তোর এখন সময় হল আসার? এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?
-ধাওড়াপাড়া থেকে ফিরে যেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
–বাঃ, বেশ ভালো। দ্বীপী কথা দিয়ে খোঁচা মারল, এই না হলে ঘরের ছেলে।
–ভুল হয়ে গিয়েছে, প্লিজ আর কিছু বলিস না।
দ্বীপী ঠোঁট শক্ত করে বলল, তুই যদি থাকতিস হয়ত এমনটা হত না।
-যা হবার তা হয়েছে, ভেবে আর কি হবে বল?
–ভাবছি না, তবু ভাবনাটা জোর করে এসে যাচ্ছে। দ্বীপী বড়ো অসহায়, তার চোখ দুটো দুখ আর আক্ষেপে ভরে আছে।
সূর্যাক বলল, তোর কি মত?
–আমি এখনও কিছু ভাবিনি। তবে আগে আমি চাকরি করব তারপর অন্য কিছু।
গ্রামের মেয়েরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই খোকটা তোর মধ্যেও আছে। সূর্যাক্ষ ম হাসল।
দ্বীপী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে সবাই পারে। তুই খুব সাধারণ। আমি ভাবতাম তুই বুঝি বৃত্তের বাইরে।
-তোর কথাটা ঠিক বুঝলাম না? কি বলতে চাইছিস?
–তোকে আর কিছু বলার নেই। দ্বীপী দীর্ঘশ্বাস ভাসাল, তুই জলে নামবি অথচ চুল ভেজাবি–এই তো?
তার মানে?
–মানেটা বুঝে নে। দ্বীপী অবাক চোখে চেয়ে রইল, আচ্ছা সূর্য, তুই কাউকে ভালোবাসিস?
হ্যাঁ ভালোবাসি।
–কি নাম তার?
–তোকে কেন সব কথা বলব? সময় আসলে সব জানতে পারবি।
আশাহত দ্বীপীর চোখে মেঘ এসে জড়ো হল। কাঁদতে পারল না, বুকে চেপে রইল কান্না, তুই এখন যা। আমাকে একা থাকতে দে।
একা থাকলে কী আরও বাড়বে।
–আমার সব সহ্য করার ক্ষমতা আছে। জোর দিয়ে বলতে গিয়ে গলা ব্যানবেনিয় উঠল পীর। চোখেমুখে হাত চেপে সে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
বহু সাধ্য সাধনার পর দরজা খুলল লহরী। সে দ্বীপীকে খুঁজছিল। না দেখতে পেয়ে রাগে-ঈর্ষায় জ্বলে উঠল তার চোখ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মা, ওকে ডাকো। ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।
মুখ ঝুঁকিয়ে ঘরে ঢুকল দ্বীপী, ভয়ে তার বুক হাপর টানহে, সবার সামনে এসে বোবার চোখে তাকাল। তাকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠল লহরী, ওই সময় তোর না গেলে কি চলত না হওয়া কাজটা তোর জন্য সব ভেস্তে গেল।
দ্বীপী ভেবেছিল সে কিছু বলবে না, শুধু চুপচাপ শুনে যাবে, কিন্তু অসহ্য লাগতেই মৃদু স্বরে বলল, মা আমাকে বলল, যা সন্দেশগুলো দিয়ে আয়, আমি তাই ঢুকেছিলাম। যদি দোষ হয়ে থাকে তুই আমাকে ক্ষমা করে দে দিদি।
-ক্ষমা? কিসের ক্ষমা। তুই কোনো দোষই করিসনি। সব বুঝতে পেরে লহরী কামার মতো করে বলল কথাগুলো, ভালোই হয়েছে অমন সম্বন্ধ না হয়ে। ওরা তো রূপের পূজারী, মেয়েদের দুঃখ বুঝবে কি করে? যারা হৃদয়হীন হয় তাদের তো পাথরের সঙ্গে আত্মীয়তা করা উচিত। দ্বীপী, তুই এবার যা সূর্য এসেছে। ওর সাথে কথা বল।
বুকের ভার লাঘব হতেই দ্বীপী আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখ ক্রমে ভরে যাচ্ছিল জলে। তার দুঃখটা যে কোথায় তা যদি সে সূর্যাকে বুঝিয়ে বলতে পারত।
রামনগর থেকে ফিরে এসে চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন কপোতাক্ষ। জানলা দিয়ে হাওয়া কহিল তবু কলকল করে ঘেমে যাচ্ছিলেন তিনি। মীনাক্ষী কাসার মাসে জল এনে তার সামনে দাঁড়ালেন, কী গো, এত ঘামছে যে।
-পেটটা পাকমোড়া দিয়ে উঠছে, প্রচণ্ড ব্যথা।
–এত সাইকেল চালালে ব্যথা তো হবেই। রামনগর তো কম রাস্তা নয়। মীনাক্ষী বুঝিয়ে বললেন, শরীর খারাপ যখন কদিন বিশ্রাম নিতে পারতে।
-বিশ্রামের কথা এখন ভাবলে অন্যায় হবে।
শরীর পারছে না তবু তুমি দৌড়াবে।
–আমার উপর যে সম্মেলনের সব কিছু নির্ভর করছে। আমি বিছানা নিয়ে নিলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। কপোতাক্ষ বুঝিয়ে বললেন, বাইরের জেলা থেকে অন্তত একশ জন ডেলিগেটস আসবে। তাদের খাওয়া-থাকার সব কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে আমাদের লোকাল কমিটির বদনাম হবে। জান তো এখনও সব কালেকশন করে উঠতে পারিনি।
পার্টি নিয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন মীনাক্ষী। এই পার্টি তাঁর এখন সতীনতুল্য। ঘরের খেয়ে মানুষটা বনের মোষ তাড়াক-এটা তার পছন্দ নয়। পাটির নেশা না তাড়ালে ঘরে আর শান্তি ফেরার কোনো আশা নেই।
পেটের ব্যথায় মাঝে মাঝে কাবু হয়ে যান কপোতাক্ষ। কালীগঞ্জের বড়ো ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বললেন, বেটার আপনি একবার সদরে গিয়ে দেখিয়ে নিন। পেট বলে কথা। অবহেলা করবেন না, প্লিজ।
সদরের ডাক্তার পাঁচরকমের পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই তবে একটা অপারেশন করতে হবে। আপনার মাস খানিকের বিশ্রাম প্রয়োজন। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
শুধু মীনাক্ষী নয়, কপোতাক্ষকে নিয়ে চিন্তায় আহে সূর্যাও। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে সে কৃষ্ণনগর ছুটছে এটা-সেটা টেট করানোর জন্য। দুহাতে টাকা উড়হে তবু ব্যথা কমার কোনো লক্ষণ নেই। সদর হাসপাতালের আরবাবু বললেন, অপারেশন মা। আগামী শুক্রবার আপনারা তৈরি হয়ে আসুন। দুবোতল রাড দরকার হলেও হতে পারে।
অপারেশনের দিন মীনাক্ষীকে হাসপাতালে নিয়ে এল বিদুর আর লাবণী।
সামান্য হলেও ওরাও ঘাবড়ে আছে। কপোতাক্ষর সুস্থ হওয়ায় প্রয়োজন আছে গ্রামের জন্য। এই গ্রামের কথা কেউ ভাবে না, একমাত্র তিনি ছাড়া। গ্রামের নিম্ন বর্গীয় মানুষরা তার চোখের মণি, আরাধ্য দেবতা। এদের অবহেলা করলে নিজেকেই অবহেলা করা হয়।
একমাস পরে গ্রামে ফিরে এলেন কপোতাক্ষবাবু। সুস্থ হয়ে ফিরলেও তাঁকে আরও একমাস বিশ্রাম নিতে হবে। পেটে অপারেশনের কাটা দাগ, দুমাস সাইকেল চালান বারণ। কথা না শুনলে বিপদ ঘটতে পারে যে কোনোসময়।
ঘুরে বেড়ান মানুষ, ঘরে বসে থাকলে ছটফট করে মন। হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি, পুরনো বইয়ের পাতা ঘেঁটে তিনি খুঁজতে থাকেন সাম্যবাদের মন্ত্র।
সুর্যাক্ষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়, বাবা, তোমার কোনো কাজ থাকলে আমাকে বলল, আমি করে দেব।
কপোতাক্ষ হাসেন, আমার কাজটা তোক দিয়ে কি হবে রে? যার কাজ তাকেই করতে হয়, না হলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
–সে আমি জানি। তবু…
–তোর রেজাল্ট কবে বেরবে? ভালোভাবে পাশ করবি তো?
সুর্যাক্ষ মাথা নাড়ল, ভালোভাবে পাশ করলে আমি আরও পড়তে চাই। রুদ্রদার মতো আমারও ইচ্ছে কোলকাতায় গিয়ে পড়ব।
–সবই হত কিন্তু তোর জ্যাঠা আমাকে সর্বশ্রান্ত করে দিয়েছে। এখন যা আছে তাতে সংসারটা কোনোমতে চলছে। কপোতাক্ষ বোঝালেন, যদি কোলকাতায় পড়তে চাস তাহলে আমাকে জমি বিক্রি করতে হবে। আর জমিও তো বেশি নেই, বিক্রি করলে খাব কি?
মনোক্ষুণ্ন হলেও নিরুত্তর থাকল সূর্যাক্ষ। ঘটনাটা সত্যি। নীলাক্ষ তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে নিয়েছেন। তিনি এমনভাবে কায়দা করে ঠকিয়েছেন যাকে বলে পেছন থেকে চাকু মারা।
মন খারাপ হয়ে গেল সূর্যাক্ষর। পাশ করেই তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে চাকরির খোঁজে। চাকরি ছাড়া কোনো গতি নেই। গ্রামে পড়ে থাকলে হাঁড়ি ঠনঠনাবে। মায়ের দুঃখী মুখ সে দেখতে পারবে না। প্রাচুর্যের মধ্যে যাদের দিন কেটে গেছে হঠাৎ অভাবের ঝড় তাদের টলিয়ে দিলেও আভিজাত্যের রং চটে না। সূর্যাক্ষ চেষ্টা করবে আগের সেই সোনালী দিন ফিরিয়ে আনার। ধুলা মাখা গ্রামের মায়া ভুলে সে পাড়ি দিতে চায় শহরে। কষ্ট হবে, তবু কষ্টের মধ্যে থেকে সে খুঁজে নিতে চায় জীবনের রসদ।
.
৫৭.
গরমে আইঢাই করছিল চারপাশ। আগুন হাওয়া ধুলো উঠিয়ে নেয় শুনে, তারপর সেই লাটখাওয়া ধুলোকে আছড়ে ফেলে দেয় নির্জন কোন প্রান্তরে। গোল চরকাটা এই ধুলোকে অনেকে বলে ভূতঘূর্ণি। ছোট বেলায় ভূত ঘুরছে বলে ভয় পেত সূর্যা। এখন আর সেই অবাস্তব ভয় মনের কোণে বিন্দুমাত্রও নেই।
এখন প্রায় রাতেই সূর্যাক্ষ স্বপ্ন দেখছে পরীক্ষার। কখনও ভয়ের কখনও বা আনন্দের সেই সব স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। দ্বীপীর কাছে গেলে পরীক্ষার চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা ওদের গ্রাস করে না। প্রায়ই দ্বীপী মুখ শুকনো করে বলে, আর ভালো লাগছে না রে, বড়ো হাঁপিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে কোথাও ঘুরতে গেলে মনের এই গুমোটটা কাটত।
দ্বীপী ঘরে বসে থাকলেও সকালে-বিকালে টিউশনি করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সে নিয়ম করে পড়তে বসায়। দেবোত্তর বলেছেন, কাজের মধ্যে থাক, মন ভালো থাকবে।
মন ভালো না থাকলেও সময়টা দিব্যি কেটে যায়। গ্রামের টিউশনিতে পয়সা খুব কম। তবু যেটুকু উপার্জন হয় সেটুকুই এই অভাবের সংসারে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।
প্রথম মাসের টাকাটা দ্বীপী বাবার হাতে তুলে দিতে চাইলে দেবোত্তর স্মিত হেসে বলেন, মেয়ের উপার্জনের পয়সা আমি হাতে নেব না। তোর টাকা তুই সযত্নে শুছিয়ে রাখ। শুনছি–আর কদিনের মধ্যেই তোদের রেজাল্ট বেরবে, তখন টাকাগুলো তোর ভর্তির কাজে লাগবে।
সূর্যাক্ষ এলে দ্বীপীর মনে এক ঝাঁক টাটকা বাতাস হুটোপুটি লাগিয়ে দেয়। তার গুছিয়ে রাখা রক্ষণশীল মনটা এলোমেলো হতে শুরু করে। ভালোলাগার স্নায়ুগুলো অদ্ভুত দক্ষতায় দ্বীপীর সরল সুন্দর মুখে আনন্দের ঢেউ বইয়ে দেয়।
সূর্যাক্ষ পরীক্ষার কথা ভুলে দ্বীপীকে সম্মোহনী গলায় বলে, আমি শুনেছি, বেথুয়াডহরীতে ববি বই দিয়েছে। যাবি দ্বীপী?
শিবানী টকিজে সিনেমা দেখার মজাটাই আলাদা। দ্বীপী মাত্র দুবার সিনেমা দেখেছে ওখানে। আর প্রতিবারই দিদিদের সঙ্গে। আগে দল বেঁধে মেয়েরা মাসের কোনো এক রবিবারে সিনেমায় যেত ঘটা করে। তার প্রস্তুতি চলত একমাস আগে থেকে। যে যার জমানো পয়সা নিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে যেত সিনেমায়। পড়ুয়াদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দ্বীপীর তাই যাওয়া হত । মায়ের মন না ভিজলে অনুমতি পাওয়া যাবে না। এ কাজে মাত্র দুবার সক্ষম হয়েছে সে।
সূর্যাক্ষর প্রস্তাবটা অন্তর দিয়ে লুফে নিল দ্বীপী। মনে হল তীব্র খরায় এ যেন হঠাৎ মুষল ধারায় বৃষ্টি। দ্বীপী তার আগ্রহ বশে রাখতে পারল না, ফুটন্ত দুধের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল তার মন, হ্যাঁ রে সূর্য, কখন যাবি? খুব ভালো হয়। চল না রে–
–যাব বলেই তো তোর কাছে এলাম। সূর্যাক্ষর কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে নিচু হয়ে এল, শোন, ঘরে সত্যি কথা বলে গেলে হবে না। বলবি দেবগ্রামে যাচ্ছি ফটো তুলতে। রেজাল্টের পর ফর্ম ভরার সময় কাজে লাগবে।
–ভালো যুক্তি। দ্বীপী লাফিয়ে উঠল।
সূর্যাক্ষ ওকে সতর্ক করল, আনন্দে কাসি হারিয়ে ফেলিস নে। যতক্ষণ না যাচ্ছি, ততক্ষণ কোনো বিশ্বাস নেই। যা বললাম-মনে থাকবে তো?
-হ্যাঁ, তাঁ। বেশ মনে থাকবে। তুই কখন আমাকে নিতে আসবি?
–আমি ঠিক এগারটায় আসব। তুই খেয়ে-দেয়ে তৈরি থাকবি। সূর্যাক্ষ চলে গেল।
ঠিক এগারটার সময় সে এসে হাজির হতেই লহরী মুখ গম্ভীর করে বলল, তোরা কি ভেবেছিস বল তো? এখন আবার ফটো তোলার কি হল?
ফটো না হলে কোনো কাজ হবে না, দিদি। এমপ্লয়মেন্ট একসচেঞ্জের কার্ড করাতে গেলেও ফটো লাগবে, আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া-। সূর্যাক্ষ আরও কিছু ফিরিস্তি দিতে যাচ্ছিল লহরী বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
উর্মি পাশে দাঁড়িয়ে বলল, সাবধানে যাবি। যা রোদ। দ্বীপীর তত রোদে বেরলে গলা শুকিয়ে যায়।
-তোমার কোনো চিন্তা নেই, ঊর্মিদি। আমি ওকে লেবু লজেন্স কিনে দেব। লেবু লজেন্স চুষলে গলা ভেজা থাকবে। সূর্যাক্ষ বুঝিয়ে বলল।
চন্দ্রিকার মন ছিল না মেয়েকে এভাবে একা ছাড়ার। ঊর্মিকে তিনি বলেছিলেন সঙ্গে যাওয়ার জন্য। দ্বীপী তা মেনে নেয়নি। মাকে বুঝিয়ে বলেছে, সেজদি গেলে আমাদের সবাইকে হেঁটে যেতে হবে। একটা সাইকেলে তিন জনের হবে না। সূর্য তিনজনকে নিয়ে এই রোদে সাইকেল চালাতে পারবে না। হাঁপিয়ে উঠবে ও।
দ্বীপীকে সমর্থন করল ঊর্মি। তা ছাড়া বোনকে নিয়ে দেবগ্রামে ফটো তুলতে যাওয়ার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্র ছিল না। শুধু শুধু সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে কোনো লাভ হবে না জেনে সে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি যাওয়ার জন্য।
ধুলো ওড়া দুপুরে সাইকেলের সামনের রডে পা ঝুলিয়ে বসেছিল দ্বীপী। সূর্যাক্ষর শরীরের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল সে। এই সুখ আর কদিন তার ভাগ্যে লেখা আছে কে জানে। রেজাল্ট বেরলেই ছিটকে যেতে হবে দুজনকেই। কার ভাগ্যে যে কি লেখা আছে কেউ জানে না। একটা দায়িত্বের ভূত সূর্যাক্ষ বয়ে বেড়াচ্ছে কমাস থেকে। পড়ার সুযোগ না পেলে ঘরে বসে সে কি করবে? চাকরি তো ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে চাইলেই পেয়ে যাবে। চাকরির জন্য পড়াশোনার দরকার। এই সামান্য যোগ্যতায় কোথায় সে পা রাখবে? সাইকেল চালাতে গিয়ে নানান চিন্তায় টনটনিয়ে ওঠে সূর্যাক্ষের কপাল। হঠাৎ সাইকেল থেকে নেমে পড়ল সে। দ্বীপী অবাক চোখে তাকাল, কি হল তোর?
সূর্যাক্ষ সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বলল, কিছু হয়নি। ঘরের কথা মনে পড়তেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল।
-কাকা কেমন আছেন? অনেকদিন তাকে দেখিনি।
–দেখবি কি করে? বাবাকে ডাক্তারবাবু সাইকেল চালাতে নিষেধ করেছেন।
উনি যা মানুষ, এ নিষেধ তার পক্ষে মানা তো খুব কষ্টের হবে।
-কষ্ট হলেও জীবনের জন্য তা মানতে হবে। সূর্যাক্ষ হঠাৎ পণ্ডিত যিলেরর পাড়ে সাইকেল থামিয়ে দ্বীপীর মুখের দিকে উদাস হয়ে তাকাল, জানিস দ্বীপী, আমার মনে হয় আর পড়া হবে না। বাবা বলছিল–আমাদের অবস্থা আগের মতো নেই।
–সে কি রে, তোদের এত জমিজমা বিষয় সম্পত্তি।
–সব জেঠু তার নিজের নামে করে নিয়েছেন।
–এটা কি করে সম্ভব?
-সম্ভব। বাবা যা খামখেয়ালি মানুষ। সংসারের উপর একটুও নজর নেই। মা প্রায়ই রাগারাগি করে। মাকে এখন প্রায়ই কাঁদতে দেখি। এর আগে আমি কোনো দিন মায়ের চোখে জল দেখিনি। কথাগুলো বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল সূর্যা।
দ্বীপী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কোনো কিছুই আর ঠিক হবে না দেখিস। যা হারিয়ে যায়, তা আর চট করে কি পাওয়া যায় রে?
আমি তো আছি, তুই ভাবছিস কেন? ঘোরের মাথায় কথাগুলো দ্বীপ ফসকে বেরিয়ে এল, না, বলছিলাম কি-তোর পাশে আমি সবসময় থাকব।
-সে তো তোকে থাকতেই হবে। প্রকাশ্য দিনের আলোয় জল সাক্ষী রেখে দ্বীপীর হাতটা চেপে ধরল সূর্যা।
দ্বীপী হাতটা সরিয়ে নিল না, সরে এল আরও পাশে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সে বলল, তোকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে আমি জানি না।
–আমি জানি।
–তুই জানিস।
–হ্যাঁ।
–তাহলে বল।
সব কথা বলা যায় না। কিছু কথা আছে যা ঝিনুকের পেটে মুক্তোর মতো লুকিয়ে রাখতে হয়।
-দ্বীপীর গলার স্বর মধুর হয়ে এল, আমারও কিছু কথা আছে–যা সময় এলে বলব।
কালীগঞ্জ বাজারে সাইকেল রেখে ওরা বাস ধরল বেথুয়াডহরী যাওয়ার। বারোটার বাসে ঠাসা ভিড় থাকে। তবু বসার একটা জায়গা পেয়েছে দ্বীপী। সূর্যক্ষ বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখোমুখি। কালীগঞ্জ জায়গাটাকে সূর্যাক্ষের ভালো লাগে, হৈ-চৈ নেই অথচ সব কিছুই হাতের কাছে ছড়িয়ে আছে। এত বড়ো বারোয়ারীতলা আশেপাশে আর কোনো গ্রামে নেই। দোতলা পাকাঘরগুলো তাদের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আজও। বাঁধের ধারে গম পেষা মেসিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ এখনও কানে লেগে আছে সূর্যাক্ষর। অনেকটা রূপকথার মতো মনে হয় তার এই গ্রামটাকে। এই গ্রাম হাতে ধরে টেনে আনছে উন্নয়নকে। এর সংস্কারমুক্ত ভাবনাটা অনুভব করতে পারে সূর্যা।
বাস ব্ৰহ্মাণীতলা ছাড়িয়ে যাবার পর নিজের সিট ছেড়ে দ্বীপীর কাছে উঠে এল ঐশী। ওর সারা গায়ে চিকেন পকসের দাগগুলো জম্মতিলের মতো বিছিয়ে গেছে। ডালডা ঘিয়ের চেয়েও উজ্জ্বল ত্বকে সেই ছিটিয়ে যাওয়া তিলগুলো অন্য একটা সৌন্দর্য এঁকে দিয়েছে। ঐশী ওর টানা চোখের জ্ব কুঞ্চিত করে সাদা শাপলার মতো হাসল, কোথায় যাচ্ছিস, দ্বীপী? আঃ, কত দিন পরে তোর সাথে দেখা হল। ঐশীর গলা কাঁপিয়ে ঝরে পড়ল আন্তরিকতার ঝর্ণা।
দ্বীপী মেয়ে হয়েও মুগ্ধ চোখে দেখছিল ঐশীর পেখমতোলা রূপ। শুধু সে নয়, বাসের প্রত্যেকেই চোরাচোখে ঐশীকে স্পর্শ করছিল বারবার।
পাল কোম্পানীর এই বাসটা কৃষ্ণনগর যাবে দেবগ্রাম ছুঁয়ে। এ সব নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না দ্বীপীর। সঙ্গে সূর্যাক্ষ থাকলে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে সে বড়ো বেশি মাথা ঘামায় না।
ঐশী এতক্ষণ সূর্যাক্ষকে দেখতে পায়নি, চোখাচোখি হতেই আনন্দে টগবগিয়ে উঠল যে, ওঃ, তুইও এ বাসে আছিস, বাঃ কি মজা। দারুন ভালো লাগছে। কোথায় যাবি রে সূর্য?
বেথুয়া। ফটো তুলতে।
–কি ব্যাপার হঠাৎ ফটোর দরকার পড়ল?
–এমপ্লয়মেন্ট একসচেঞ্জে নাম লেখাতে হবে। পাশ করার পর আমার ইচ্ছে চাকরি করার। সূর্যাক্ষ লাজুক গলায় বলল, ভাবতেই খারাপ লাগছে যে আর কোনোদিন আমার পড়া হবে না।
-হঠাৎ যে চাকরির কথা ভাবলি? ঐশীর গলায় চাপা জিজ্ঞাসা।
সূর্যাক্ষ উদাস হয়ে বলল, না ভেবে উপায় নেই ঐশী।
-আমি তো শুনেছিলাম তোদের অবস্থা গ্রামের মধ্যে ভালো।
–হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তবে সব শোনা কথা কোনো না কোনো সময় আর সত্যি থাকে । সময়ের সাথে সাথে মানুষের অবস্থারও বদল ঘটে। সেই যে বলে না-নামে তালপুকুর, অথচ ঘটি ডোবে না। এর মানে এই নয় যে কথাটা মিথ্যে। আগে হয়ত তালপুকুরে ঘাট ডুবত, এখন হয়ত ডোবে না। সূর্যাক্ষ বেশ ধীরে ধীরে ঐশীকে বুঝিয়ে বলল কথাটা।
ঐশী সমব্যথীর চোখে তাকাল, সব ঠিক হয় যাবে, ওই নিয়ে ভাবিস না। তোর সাথে কি দ্বীপী যাচ্ছে?
-হ্যাঁ, ও আর কার সাথে যাবে? এতদিন তো আমিই ওকে বয়ে বেড়াচ্ছি।
–একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? দ্বীপীর সঙ্গে তোর কি কোনো।
সূর্যাক্ষ হাত নেড়ে থামিয়ে দিল ঐশীকে, যা, ঠিকই অনুমান করেছিস। দ্বীপী আমাদের গ্রামের মেয়ে। আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়।
অপ্রস্তুত ঐশী আশেপাশে তাকাল। উত্তর শুনে লজ্জা পেয়েছে সে। তবু নিচু গলায় বলল, তোদের মেলামেশা দেখে আমি অন্যরকম ভাবছিলাম।
-এটা তোর অন্যায় নয়, সবাই ভাবে।
–তুই খুব ম্যাচিওরড হয়ে গেছিস। ঐশী ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসল।
-হব না, আঠার বছরে পা দিলাম। এখনও ছোট বললে লোকে নাক টিপে দেখবে দুধ বেরচ্ছে কিনা। সূর্যাক্ষ উঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, আমার কথা বাদ দে এবার তোর কথা বল।
-আমার কথা? আমার কথা লম্বা কথা। বাসের মধ্যে বলা যাবে না। সবাই শুনছে। ঐশীর চোখের তারায় খুশির আলো নেচে গেল, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, জানিস, ও এসেছে। এই বাসেই আছে।
–আকাশদা এসেছে? কই? দেখতে পাচ্ছি না তো?
ড্রাইভার কেবিনে বসে আছে। নামলে দেখতে পাবি। ঐশীর সারা শরীরে খুশির ঢেউ। সে তার আবেগ বাঁধ দিতে পারল না কিছুতেই, আমার অসুখের খবর পেয়ে ও এসেছিল। তারপর পনের দিন থেকে ও আবার দিল্লি ফিরে গেল। এবার এসেছে-কোলকাতায় কি একটা কাজ আছে সেই জন্য। এতদূর এসে বাড়ি আসবে না তা কি হয়?
-তা ঠিক। তোরা এখন কোথায় যাচ্ছিস?
ঐশী হাসল, সিনেমায়। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী। দারুণ বই। যা গান আছে না!
-ওঃ! তুই কি এর আগে দেখেছিস?
–হ্যাঁ, মার সাথে একবার এসেছিলাম। আজ আবার ওর সঙ্গে আসতে হল। উপায় নেই।
ঐশী কেমন চোখে তাকাল।
সূর্যাক্ষ দেখল দ্বীপী মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। ফসল শূন্য মাঠে সাদা বক গায়ে থান জড়িয়ে বসে আছে। রোদ নৃত্য করছে তার সামনে। পুকুরের জলে মেঘ ভাসছে, কত রকমের মেঘ। দ্বীপী কি এসবই দেখছে নাকি অন্য কিছু ভাবছে। মেয়েদের কপালের রেখা কুঁচকে গেলে ওদের ভাবনার গভীরে হিংসা ঢুকে পড়ে। তখন আর স্বাভাবিক দেখায় না তাদের।
সূর্যাক্ষ দ্বীপীর ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য ঘাবড়ে গেল। আজকাল পান থেকে চুন খসলে রেগে যায় দ্বীপী। তখন ও যে কি বলে ঠিক থাকে না নিজেরই।
দ্বীপীর মাথা গরম হয়ে গেলে অস্বাভাবিক ব্যবহার করে। তখন ওকে কিছুতেই বোঝানো যায় না।
সূর্যাক্ষ ভয় পেয়ে আস্তে করে মুখ নামিয়ে ডাকল, দ্বীপী।
-এ্যা! চমক ভেঙে দ্বীপী বাসের মধ্যে তাকাল, কিছু বলছিস?
–তোর কি ঘুম পাচ্ছে?
–ধ্যাৎ! দুপুরবেলায় আমি কোনোদিন ঘুমাই না বুঝলি?
–তা ঠিক। তবে অনেকের বাসে বসলে ঘুম পায়। বাসের দুলুনীতে ঘুমপাড়ানী ছন্দ আছে।
–কবিত্ব রাখ তো। দ্বীপী বিরক্তিতে উষ্ণ হয়ে উঠল।
ঐশী মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আমি হয়ত তোদের ডিস্টার্ব করে দিলাম।
-না, তা কেন? দ্বীপী জোর করে বলল, আজ কালের মধ্যে রেজাল্ট বেরবে। এই সময় সব পরীক্ষার্থীই ডিস্টার্ব থাকবে। রেজাল্ট বেরনোর টেনশানটাই আলাদা। বিডিও অফিস পেরিয়ে বাস বেথুয়াডহরীতে ঢুকল। ঐশী ঢিল ফেলা পুকুরের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল, আমি যাই, ও নাহলে খুঁজবে।
ড্রাইভার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। কে বলবে মাস তিনেক আগেও এই মেয়েটা অসুস্থ হয়ে মশারির মধ্যে বন্দী ছিল।
.
৫৮.
সপ্তাহের শেষে রেজাল্ট বেরিয়ে গেল সূর্যাক্ষর। দ্বীপী ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। দুর্ভাগ্য, সূর্যাক্ষ মাত্র দশ নাম্বারের জন্য ফাস্ট ডিভিশন পেল না। মন খারাপ করে দেবগ্রাম থেকে ফিরে এল সে। খবরটা শুনে দ্বীপী নিজের আনন্দ চেপে সূর্যাকে বলল, রেজাল্টই সব কথা নয়, তুই ভালো ছেলে এটা সবাই জানে। মন খারাপ করিস না। তুই গম্ভীর হয়ে গেলে আমার চারপাশ গুমোট হয়ে ওঠে।
সূর্যাক্ষ চেষ্টা করছিল স্বাভাবিক হতে, কিন্তু পারল না। দ্বীপী কিছু বলার আগে কপোতাক্ষ বললেন, পাশ করেছিস আনন্দ কর। তোরা ইস্কুলের প্রথম সায়েন্সের ব্যাচ। সবাই যে রেজাল্ট করেছে তাতে ইস্কুলের সুনাম হবারই কথা।
যেমনটা আশা করেছিলাম তেমন হল না, বাবা! সূর্যাক্ষর দীর্ঘশ্বাস বিচলিত করল কপোতাক্ষকে। তিনি সুর্যাকে শান্ত করার জন্য বললেন, আমি সেকেন্ড ডিভিশনে প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ। তোর জ্যাঠার খবর তো সব জানিস। এরপরে তোর মন খারাপ করা অন্যায়। যা, টাকা দিচ্ছি দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আয়। দ্বীপী তুই এখানে খেয়ে যাস। তুই আমাদের গ্রামের গর্ব। এই গ্রাম থেকে আগে কেউ ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। আজ তোর বাবা-মায়ের সব চাইতে আনন্দের দিন।
–আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি। মা-বাবাকে খবরটা দিয়ে আবার আসব। দ্বীপী সূর্যাক্ষর দিকে তাকাল, সূর্য, তুইও আমার সঙ্গে চল। আমাদের ঘরে গেলে তোর আর কোনো কষ্ট থাকবে না। মন ভালো হয়ে যাবে।
দ্বীপীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সূর্যাক্ষর মনে পড়ল রঙিন প্রজাপতির কথা।
যে কোনো পাশের একটা শক্তি থাকে।
দেবোত্তর চক্রবর্তী দ্বীপীর পাশ করার সংবাদে খুশি হয়েছেন। চন্দ্রিকা মেয়ের চিবুক হয়ে বলেছেন, আমি জানতাম আমার সোনা মেয়ে কিছু একটা করবেই। তবে তোর এই পাশের পেছনে সূর্যর খুব হাত আছে। ও পাশে না দাঁড়ালে হয়ত এত ভালো রেজাট তোর হত না।
দ্বীপী কৃতজ্ঞতার ঘাড় নাড়ল। সেবোর চক্রবর্তী বললেন, সায়েন্স বইয়ের যা দাম, আমি তো বই কিনে দিতেই পারিনি। বলতে গেলে মেয়েটা সূর্যর বই নিয়ে পড়েছে। সত্যি, সূর্য সাহায্য না করলে দ্বীপী হয়ত পাশ করত, কিন্তু এত ভালো নাম্বার পেত না।
চন্দ্রিকা সমর্থন করলেন এক বাক্যে। দেবোর চক্রবর্তী গত চারদিন হল মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। মেয়েদের পড়িয়ে কি লাভ হবে, সেই তো পরের ঘরে তুলে দিতে হবে। পরমুহর্তে অন্য ভাবনা তাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। না, এসব কথার কোনো অর্থ হয় না এখনকার দিনে। ধীপীকে যে করেই হোক পড়াতে হবে। একটা গাছ বাড়ছে তাকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেওয়া উচিত। তার ডালপালা কেটে দেওয়া ঠিক হবে না।
দেবোক্তর চক্রবর্তী চন্দ্রিকাকে বললেন, দ্বীপীকে কলেজে ভর্তি করাব, এতে তোমার কি মত?
-এতে মতের কি দরকার। দ্বীপী পড়বে। জানি ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। আমার কিছু গয়না আছে, ওগুলো বেচে দাও। সহজ মনে চন্দ্রিকা বললেন।
-গয়না বেচে পড়ালে অন্য মেয়েদের কি দেবে? দেবোত্তর চক্রবর্তী কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, তিনটে মেয়েই তো আমাদের কাছে সমান। সবাই তোমার পেটে জন্মেছে, কেউ তো পিঠে আসেনি।
-হ্যাঁ, ঠিক। তবে… দুর্ভাবনায় কথা আটকে গেল চন্দ্রিকার।
দেবোত্তর চক্রবর্তী আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, দেখি কি করা যায়। তবে কিছু একটা ব্যবস্থা তো হবেই।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে লহরী আর ঊর্মি বাবা-মায়ের আলোচনা শুনছিল। লহরী স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বলল, বাবা, আমাদের জন্য ভেবো না, দ্বীপীকে এগিয়ে যেতে দাও। আমরা কিছু করতে পারিনি। ও বড়ো হলে শুধু তোমাদের মাথা নয়, আমাদের সবার মাথা উঁচু হয়ে যাবে। গ্রামের মানুষ তখন বোনের জন্য আমাদের সমীহ করে চলবে।
-তা যা বলেছিস। দেবোত্তর ভরসা পেলেন। চন্দ্রিকা বললেন, আমি জানতাম তোরা এই কথা বলবি। আমার মেয়েরা যে অন্য ধরনের সেটা লোক জানুক।
সূর্যাক্ষ যাবে ফর্ম আনতে কৃষ্ণনগরে। গর্ভমেন্ট কলেজে ভর্তি হলে পড়ার খরচ একটু কম হবে। উইমেল কলেজটাও খারাপ নয়। শহর থেকে একু দূরে এই আর কি।
দ্বীপীর শরীরটা ভালো ছিল না। সূর্যাক্ষ বলল, তুই থাক। আমি যাচ্ছি। যদি ফর্ম দেয় তাহলে আমিও ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করব। তবে আমার যা নাম্বার তাতে অনার্স পাওয়া যাবে না।
চাকরি খোঁজার সময় দরকার। অতদিন ঘরে বসে থাকা কি ভালো দেখায়। মীনাক্ষী বলেছেন, তোকে পড়তে হবে সূর্য। ঘরে বসে থেকে বাবার মতো পার্টি করবি–এসব আমার সহ্য হবে না।
কপোতাক্ষ চুপচাপ শুনেছেন। ইদানীং মীনাক্ষীর মুখের উপর তিনি কোনো কথা বলছেন না। তাছাড়া মীনাক্ষী যা বলছে–সেটা তো তারও মনের কথা। ঘরের একমাত্র ছেলেটা পড়াশোনা না করে টো-টো করে ঘুরবে, বাউন্ডুলে হয়ে যাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। চাকরি উঠোনে বাঁধা নেই যে যখন খুশি তাকে উঠিয়ে নিয়ে মনের বাসনা চরিতার্থ করা যাবে। চাকরি এক কুহেলিকা, কুয়াশা। তার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন।
কপোল সূর্যাক্ষকে কাছে ডেকে বললেন, আজই কৃষ্ণনগরে গিয়ে ফর্ম তুলে নিয়ে আয়। তোর মায়ের কাছে টাকা রাখা আছে, নিয়ে যাবি।
-তাহলে চাকরি খোঁজার কি হবে?
চাকরি তো মুখের কথা নয়, তার জন্য তপস্যার প্রয়োজন। কপোতাক্ষ বিরক্ত হবেন।
সূর্যাক্ষ সংকোচ না করে বলল, বাবা, তুমি তো কত মানুষকে সুগার মিলে কাজ পাইয়ে দিয়েছ, আমার জন্য একটু বলে দেখ না। ..
-এখন আর তা হয় না সূর্য। তাছাড়া নিজের জন্য আমি কারোর কাছে হাত পাতি নি। যারা চাকরি পেয়েছেন তারা তাদের নিজের যোগ্যতায় পেয়েছেন। সেখানে হয়ত আমার ভূমিকা ছিল সলতে পাকানোর। মান হেসে কপোতা ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন।
-তাহলে তুমি বলছ আমি কৃষ্ণনগরে যাব? সূর্যাক্ষ নিশ্চিত হতে চাইল।
-হ্যাঁ, অবশ্যই যাবি। তোর বাবা এখনও মরে যায়নি। তুই পড়। যতদূর মন চায়–তুই পড়। বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বললেন কপোতাক্ষ।
মীনাক্ষী তার সেই কথার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিলেন, তোর উপর আমাদের অনেক আশা। আমরা কখনও জোর করিনি তোকে ফাস্ট ডিভিশনেই পাশ করতে হবে। তুই পাশ করেছিস এতেই আমরা খুশি। তুই মানুষ হ, এর বেশি আমাদের কিছু চাওয়ার নেই।
মীনাক্ষীর কথাগুলো সূর্যাক্ষের অন্তরে গিয়ে বিধল। কপোতাক্ষর জীবনযাত্রা সে নিজের চোখে কাছ থেকে দেখছে। শুধু মানিকডিহিতে নয়, আশেপাশের দশটা গ্রামে তাঁর সুখ্যাতি কানে এসেছে সূর্যাক্ষর। বাবার জন্য গর্ববোধ হয় তার।
ইচ্ছে ছিল সকাল সাড়ে সাতটার বাসে সরাসরি কৃষ্ণনগরে যাবে সে কিন্তু দেবগ্রামে বাস পৌঁছাতেই পেছনের একটা চাকা বাস্ট হয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে সব যাত্রীরা নেমে এল চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়কে।
বাস ছাড়তে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে। ড্রাইভার কন্ডাক্টর চা খাবে। সকালের টিফিনটা দেবগ্রামে সেরে বাসে উঠবে। সূর্যাক্ষ ভাবছিল কি করা যায়, তখনই লিটন এসে তার পিঠের উপর হাত রাখাল, কোথায় যাচ্ছিস রে সূর্য?
-ফর্ম আনতে কৃষ্ণনগর যাব।
-বাঃ, ভেরি গুড। চল এক সাথে যাওয়া যাক। লিটন বলল, কলেজ মাঠে মিলিটারিতে লোক নেবে। আমি অতনু আর বীরু যাচ্ছি লাইন দিতে।
-তোরা আর পড়বি না? ফ্যাকাসে গলায় জিজ্ঞাসা করল সূর্যাক্ষ।
নিঃশব্দ হাসি খেলে গেল লিটনের ঠোঁটে, চাকরি পেলে কেউ আবার পড়ে নাকি? আকাশদাকে দেখলি না চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেল। আরে, চাকরি হল দিল্লিকা লাড়ু। এই দিল্লির লাড়ু বাগাতে হবে বলে তো পড়াশোনা করা।
-তা ঠিক। তবে।
-দেখ সূর্য, আমরা তোর মতন অত ভালো ছেলে নই। আমরা সো-সো। মিলিটারিতে না হলে পুলিশে ঠিক মাথা গলিয়ে দেব। এখন পুলিশের চাকরিতেও বিয়ে করা যায় বুঝলি? পাশ করার পর লিটনের কথা বলার গতিবেগ আরও বেড়ে গিয়েছে। সে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখন পাঁচ ফুট আট, ওজন সিটি টু। চেস্ট পার্টি ফোর প্লাস। ছুটতে পারি, হাই জাম্প লং কাপ মারতে পারি তাহলে মিলিটারিতে যাওয়ার আর অসুবিধা কোথায়?
-তুই যা যা বললি, আমারও তো তই আছে। সুর্যাম কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবল, তাহলে তোদের সঙ্গে আমার যেতে আপত্তি কোথায়?
তোর বাবা-মা মিলিটারিতে হড়বে? মিলিটারি মানে এক বুলেটে জীবন বাঁধা। বাড়ির একমাত্র ছেলে তুই। ডিসিশন নেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে দেখ। লিটনের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল।
সূর্যাক্ষ অস্থির হল না তার কথায়, শুধু অবজ্ঞায় ঠোঁট ওন্টাল, যুক্তি দেখিয়ে বলল, তুইও তো ঘরের এক ছেলে। তোর বাবা যদি তাকে পাঠাতে পারে তাহলে আমার যেতে অসুবিধা কোথায়?
-তোর বাবা শিক্ষিত। আমার বাবা মূর্ধ। মুখ বাবারা মিলিটারি কি, পুলিশ কি তা বোঝে না। তারা দেশসেবা বোঝে না, বোঝে চাকরি।
-তাহলে তোর কি মত?
-মন চাইলে চল। আমি বাধা দেব না। লিটন ঠাণ্ডা মাথায় বলল, অবশ্য গেলেই যে হবে তার কোনো মানে নেই। হাজার হাজার ছেলে আসবে লাইন দিতে। মাপজোক ঠিক হলে একটা চাল থাকবেই।
-তাহলে চল বাস ধরি। অতনু আর বীরুকে তো দেখছি না?
–ওরা বাথরুমে গিয়েছে। আসল বলে। চল চা খাই।
তখনই একটা বহরমপুর-কৃষ্ণনগর বাস এসে দাঁড়াল জাতীয় সড়কে। সূর্যাক্ষ অস্থির হয়ে বলল, থ্রু বাসে গেলে ভালো হত।
-তোর মাথা খারাপ? বাসে কেন যাব? যে পয়সা বাস ভাড়া দেব, ট্রেনে গেলে সেই পয়সায় হোটেলের খরচটা হয়ে যাবে।
-অর মানে?
লালগোলা ট্রেন তো মামার ট্রেন। মামার ট্রেনে ভাড়া লাগে নাকি?
–যদি স্পেশাল চেকিং থাকে?
-ওসব আগে থেকে জানা যায়, বুঝলি? কলেজে ভর্তি হলে তুই ভেবেছিস আমি মাহলি করব-কখনো নয়। ডবলু-টিতে যাব আর আসব।
ডবলু টি?
ডবলু টি বুঝিস না? উইদাউট টিকিট।
সূর্যাক্ষ চেহারায় বড়ো হলেও ওর ভেতরে একটা ভয় আছে। অন্যায় করা তার ধাতে সয় না। হয়ত এই কারণে দ্বীপী তাকে ভীরু বলে। তার ধারণায় ভীরু মানুষ পাপ করতে গেলে হাজারবার ভাববে। ভীরুরা নিঠুর হতে পারে না, যার জন্য ওরা সবখানে সমালোচিত। সূর্যাক্ষ ঢোঁক গিলল। বীরু তাকে দেখে বলল, গুরু কি ব্যাপার? কানের পাশ দিয়ে তোর ফার্স্ট ডিভিশনটা বেরিয়ে গেল। তোর বাবা নিশ্চয়ই বহুৎ ঝেড়েছে তোকে।
-মোটেই না। প্রতিবাদ করল সূর্যাক্ষ।
বীরু কেমন মিইয়ে গেল, মাইরি বলছি–আমার বাবাটা না একটা মক্ষিচোষ। কোথায় পড়াবে, তা না ঠেলে পাঠিয়ে দিল লাইন দিতে।
অতনু বলল, আমার মনে হয় মেসোমশাই ঠিক করেছেন। তুই যা মাল, থার্ড ডিভিশনে পাশ করে কোথায় ভর্তি হবি?
-আরে শালা, আর্টসে থার্ড ডিভিশন পাওয়া আর সায়েন্সে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া একই কথা। ভাবিস না একেবারে বেফালতু। আমাদের জন্য বেলডাঙ কলেজের গেট খোলা আছে।
-এই নাম্বারে বেলডাঙাতেও চাল হবে না।
–তুই দেখছি সবজাভা দাড়িওয়ালা! চুপ কর বে। আজ যদি লাগিয়ে দিতে পারি তাহলে কিস্তিমাত। তাহলে আর কষ্ট করে বইয়ের পাতা ওল্টাতে হবে না। তখন ওই থুতু লাগিয়ে টাকা গুনব।
বাস-স্ট্যান্ডের দোকানে চা খেল ওরা। উজ্জ্বল রঙের রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছিল পথের ধুলোয়। মাত্র কয়েক হাত দূরে টেলিফোনের তারে কাক বসে ডাকছিল কা-কা স্বরে। সূর্যাক্ষর মনটা বিষিয়ে উঠছিল সেই ডাক শুনে।
সকালবেলায় চৌরাস্তার মোড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে মানুষের আনাগোনায়। দোকান-পাট গা ঝাড়া দিয়ে চেষ্টা করছে পথচারীর নজর কাড়ার। এ সময় শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে লরি বোঝাই হয়ে আনারস আসে। প্রমাণ সাইজের আনারসগুলোর স্বাস্থ্য চোখে লাগার মতো। লরি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে মাল আনলোড কছে দুজন কুলি। মালিক চিৎকার করে গুনছে আনারসের সংখ্যা।
কৃশানুর বারুইপাড়ায় ঘর। অল্প বয়স থেকে বিড়ি টেনে তার ঠোঁট জোড়া এখন সেদ্ধ করা পাঠার মেটের রং। জামার পকেট থেকে কলেজ বিড়ি বের করে সে জিজ্ঞাসা করল, খাবি নাকি?
দেখতে ধানী লঙ্কার মতো, গুণেও কম যায় না। সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিল লিটন, দে, ধোঁয়া না গিললে পেট ফেঁপে যাচ্ছে। নেশা করার মহাফ্যাসাদ, মন আনচান করে।
বীরু বলল, বিড়ি রাখ। আজ একটা শুভ দিন। অন্তত আজকের জন্য সিগারেট খা। কি খাবি? নাম্বার টেন না চারমিনার?
-সিজার খাওয়াবি তো বল। পাছায় তুলো দেওয়া হতে হবে।
-ঠিক আছে, তাই খাওয়াব। দাঁড়া। বীরু রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল বটতলায়। আর একটু হলে একটা স্টেটস ওকে পিষে দিত। বীরু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল। ড্রাইভার অনুচ্চ স্বরে গালি দিয়ে বাস হাঁকিয়ে দিল কৃষ্ণনগরের দিকে। সিগারেট নিয়ে বীরু ফিরে আসতেই সাক্ষ ওকে ধমকাল, এখনই মায়ের ভোগে লেগে যেতিস! একটু সাবধানে রাস্তা পার হবি তো?
বীরু দোষ করেছে, তাই কোনো উত্তর করল না। অতনু বলল, বীরু চলে গেলে আমাদের কে সিগারেট এনে খাওয়াত বল তো? আর যাই বলিস–ওর মনটা কিন্তু ভালো। জান বাজী রেখে যেভাবে ও রাস্তা পার হল তাতে মনে হচ্ছে বীরুর চান্স এক্কেবারে পাকা।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে। পরিমল হাসতে হাসতে বলল। সকালবেলায় ঠাকুরের গান চালিয়েছে রেডিও দোকানের মালিকটা। গালে হাত দেওয়া শিশুর সাইনবোর্ডটা রোদে ঝকঝক করে হাসছে। পাশে একটা রেডিওর ছবি,তার নিচে বড়ো বড়ো করে লেখা মারফি রেডিও।
সূর্যাক্ষ দেবগ্রামে এলে এই সাইন বোর্ডটার দিকে একবার তাকাবেই। রেডিও দোকান থেকে ছিটকে আসা ধুপের গন্ধে ম-ম করছে বাসরাস্তা। পাশে হোটেলের মাছ ধুচ্ছে রান্নার জন্য। বাস-লাইনের লোকেরা ওই হোটেলের বাঁধা খদ্দের। একেবারে ঘরের মতো রান্ন। ঢেকুর বা গ্যাস-অম্বল হবার কোনো সুযোগ নেই।
ওরা রাস্তা পেরিয়ে রিকশা-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়াল। এখানে দাঁড়ানো মানে রিকশাওয়ালারা হাঁ-করে তাকাবে। আশ্চর্য, আজ আর ওদের দেখে রিকশাওলাদের কোনো উৎসাহ বা ডাকাডাকি নেই। ওরাও বুঝে গিয়েছে ওরা রিকশায় চড়ার পাবলিক নয়। এরা ফুটো পাটি।
লিটন একটা ফাঁকা রিকশার দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হাসল, দেখলি ওদের আশায় কেমন জল ঢেলে দিলাম।
–আগে তো তুই এত খচ্চর ছিলিস না? সূর্যাক্ষ না থাকতে পেরে বলল।
হাসি থামল না লিটনের, গা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি হলাম মানববিদ্বেষী। বুঝলি? গরিব হয়ে গরিবের মন যুবি, তাই এই বিকৃত খেলা।
-চুপ কর। ধরনী ফেটে গিয়ে সীতার মতন পাতালে ঢুকে যাবি। অতনু খেঁকিয়ে উঠল।
পরিমল হঠাৎ করে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, ঐশী বেশি সুন্দরী না গীতা বেশি সুন্দরী? চোখ বন্ধ করে কৃশানু উত্তর দিল, সীতা।
-কেন? পরিমল জানতে চাইল।
পরিমল সহজভাবে বলল, সীতা লাঙলের ফলায় উঠেছিল। লাঙলের ফলায় পেঁড়ি গুগলি খোলামকুচি ছাড়া আর কি ওঠে বল? মাটির মেয়ে ঐশীর মতো সাজার জিনিস পাবে কোথায়?
-ফাইন! বীরু শেষ পর্যন্ত আক্ষেপ করল, মাইরি, আমার জীবনের একটা সাধ পূরণ হল না। ঐশীকে দেখার পর ভেবেছিলাম ওর সাথে লাইন মারব। কিন্তু আমি বড়ো হওয়ার আগেই আকাশদা ওকে বুক করে নিল। তবে অসম লাভ। দুইয়ে দুইয়ে চার হবে কিনা ডাউট আছে।
অসম ভালোবাসায় রোমাঞ্চ বেশি। লিটন বলল, গ্রামের ভালো ভালো মেয়েগুলোর সব বিয়ে হয়ে যাবে। আমরা শালা হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। আর কপাল বাড়িয়ে দেব ভাইফোঁটা নেওয়ার জন্য। ছ্যাঃ, এটা একটা জীবন!
–তাহলে কি চাস তুই? পঙ্খীরাজ ঘোড়াসমেত রাজকন্যা? পরিমলের ঠাট্টায় রেগে গেল লিটন, তোর শালা মধ্যযুগীয় মনোভাব আর যাবে না। বাইরের বই না পড়ে পড়ে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে গেলি! জীবনটাকে চাখলি কোথায়, যে স্বপ্ন দেখবি?
খোলা তরোয়ালের মতো চুপচাপ শুয়ে আছে টানা রেললাইন, রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ছে আত্মহত্যার জন্য। রোদের এই স্বভাব নজর এড়িয়ে যায় সবার। দুরে তাল গাছ, রঘুনাথের ঝাঁকড়া চুলের মাথার মতো। সিগন্যাল পোস্টটা দাঁড়িয়ে আছে অলস ভঙ্গিতে। মাথা ঝুঁকিয়ে আছে বাধ্য ছেলের মতো। টিকিট কাটার ঘণ্টা হয়ে গেছে কখন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লালগোলা ঢুকবে। সিগন্যাল হয়ে গেছে। ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম, কোনো আব্রু নেই তবু বেশ কিছু মানুষের ব্যস্ততা ঠেলে উঠল বুক চিরে।
সুর্যাক্ষ শেষবারের মতো টিকিট কাটার কথা বলতেই চরম গালি দিয়ে উঠল লিটন। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল সূর্যাক্ষ কিন্তু সঙ্গীরা মজা পেয়ে হেসে উঠল গলা ফাড়িয়ে।
লিটন বলল, তোর যদি টাকা সস্তা হয়ে থাকে আমাকে দিয়ে দে। আমার কাজে লাগবে।
সূর্যাক্ষ কোনো কথা বলল না, কিন্তু অপমানটা বিঁধে রইল ওর মনের ভেতর। পরিমল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, বন্ধুদের কথায় কিছু মনে করতে নেই। মনটাকে জিয়ানো মাছের মতো সাভারের জন্য রেখে দিতে হয়। মন মরে গেলে এ জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে–মনে রাখিস?
–তুই দেখছি উত্তরকুমারের ডায়লগটা ঝেড়ে দিলি! লিটন হাসতে হাসতে বলল। পরিমল উৎসাহিত হল, এটা উত্তমকুমারের ডায়লগ নয় রে, এটা কালীগঞ্জ বাজারের.ডায়লগ! সব জায়গার কিছু স্পেশ্যাল ডায়লগ থাকে।
এই মনোযোগটা পড়াশুনায় দিলে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে যাতিস। তোর মধ্যে স্পার্টস ছিল। শুধু ব্রেক আর ক্ল্যাচ না থাকায় টসকে গেলি! লিটন বাহাদুরী নেওয়ার জন্য তাকাল। দুর্ভাগ্য তাকে কেউ বেশি গুরুত্ব দিল না।
অতনু এগিয়ে গিয়ে পাগলা চীর দিকে তাকাল। কুলী পাকানো ধোয়া নজরে পড়ল তার। বুক হালকা করে বলল, এই, সাবধান ট্রেন আসছে। শোন, হটোপুটি করবি না। সবাই মিলে এক কামরায় উঠব তাহলে চেকার আমাদের কিছু বলতে সাহস পাবে না।
লিটন বলল, টিকিট চাইলে বলবি স্টুডেট। দেখবি তাহলে আর কিছু বলবে না।
-যদি আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চায়? সূর্যাক্ষ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল।
সবাই মুখ শুকিয়ে আছে, লিটন বলল, বলবি ফাস্ট ইয়ার। আইডেনটিটি কার্ড এখনো কলেজ থেকে দেয়নি।
–যদি বলে কোন কলেজে পড়ো-তাহলে?
লিটন সঙ্গে সঙ্গে বলল, বলবি কমার্স কলেজে। কমার্স কলেজের ছাত্রদের নাম আছে। ওদের চট করে কেউ ঘাঁটাবে না।
সূর্যাক্ষ কথাগুলোকে মুখস্থ করার চেষ্টা করছিল। একটা উত্তেজনা ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছিল তার ভেতরে। অস্বাভাবিক গরম লাগতে সে বুঝতে পারল কপালে তার অবাঞ্ছিত ঘাম জমেছে।
নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য কপা এগিয়ে এল সে। ট্রেনের শব্দটা বাড়ছে ক্রমশ। টানা হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। যেন মনে হচ্ছে বাঁশি থেমে গেলেই খেলা শুরু হবে।
কপালের ঘাম মুছে নিয়ে সিমেন্টের বেঞ্চিটার দিকে তাকাল সূর্যাক্ষ। অন্ধকার গায়ে মেখে তখনও কজন মানুষ বসে আছে ঝিম ধরে। ট্রেন আসছে বলে ওদের কোনো হেলদোল নেই। অদ্ভুত নির্বিকার ওরা।
মাটি কাঁপিয়ে ট্রেন ঢুকে আসতেই প্ল্যাটফর্মের ওপর বেড়ে ওঠা কলকে ফুলের গাছ থেকে উড়ে গেল জোড়া শালিক। কটা পাতিকাক চেঁচিয়ে উঠল তারস্বরে।
বাতাস নোংরা হয়ে উঠছে ধোঁয়া আর চিৎকারে। যেন ঝাল লেগেছে স্টিম ইঞ্জিনটার, শুধু ঝোল টানার হিসহাস শব্দ। ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরতেই সূর্যাক্ষর মনে পড়ল দ্বীপীর মুখটা। যেন একটা রাজহংসী পুকুরের পাড়ে গায়ে রোদ লাগিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ট্রেন চলার শব্দে অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে যা অক্ষয়কুমার বড়াল বা জসিমুদ্দিনের কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। চলমান বাংলার ছবি ট্রেনের জানলার ভেতর দিয়ে দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে যায় সূর্যাক্ষর। ভালো কিছু দেখলেই চকিতে দ্বীপীর মুখটা রূপালি কোনো মাছের মতো মনের জলাশয়ে ঘাই দিয়ে হারিয়ে যায়।
নানা ধরনের গল্পে মেতে উঠেছে লিটনরা, বিশ্বপ্রকৃতির খোলামেলা চেহারা দেখার তাদের ফুরসৎ নেই। রেল লাইনের দু-পাশে ফসলের মাঠ, ছোট ছোট ডোবা-পুকুর, বাঁশঝাড়, ঘরবাড়ি, গোরু-ছাগল, ঝোপঝাড় সব যেন শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত ছবি।
অনেকক্ষণ পরে লিটন তার সিট থেকে উঠে এসে সূর্যাক্ষর পাশে এসে বসল, কিরে, একা-একা গালে হাত দিয়ে কি ভাবছিস? সুকান্ত হয়ে গেলি নাকি?
সূর্যাক্ষর চমক ভাঙল, অপ্রস্তুত চোখে তাকাল সে; বাইরের দৃশ্যগুলো কত চমৎকার–তাই বল? চোখ আটকে যায়, ভীষণ ভালো লাগে রে। কেমন সন্দেহের মন নিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকাল লিটন, তারপর চিৎকার করে অতনুদের ডাকল, এ্যায়, দেখ রে, এ শালা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গিয়েছে। দেখ মাইরি, কবিতা করছে।
শুধু অতনু নয়, পরিমল আর বীরু উঠে এল ওদের সঙ্গে। প্রত্যেকের ঠোঁটে লেপটে আছে শব্দময় হাসি। অতনু সূর্যাক্ষর চোখের দিকে ম্যাটম্যাট করে তাকাল, কি হয়েছে রে সূর্য? পাগলের মতো কি সব বলছিস শুনলাম?
-না রে, বাইরের দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে–তাই বলছিলাম। এরা না পেছনে লেগে মাথাটা খারাপ করে দেবে। সূর্যাক্ষ নিরীহ গলায় বলল।
অতনু হাসল না, বেশ গম্ভীর হয়ে গেল কথা শুনে, তোকে দেখছি গরীবের ঘোড়ারোগে ধরেছে। ভাইরে, এ রোগ বড়ো ডেঞ্জারাস। সারে না, বুকের ভেতরে টিবির জীবাণুর মতো বাসা বাধে। অবশ্য তোর দোষ নেই। তোর ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তোর বাবা তো ঝোলা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় দেশান্ধারের জন্য।
অতনু এমন ভঙিতে কথাটা বলল যে দুঃখ পেল সূর্যা। সূর্যাক্ষ মুখ ফুটিয়ে কোনো প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করে কি হবে? তাহলে ওরা বাক্যবাণে আরও অস্থির করে ছাড়বে। আসলে ওরা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। জানে না কখন কি বলতে হবে।
লালগোলা মুড়াগাছা ছাড়ার পর ট্রেন পাত কাঁপিয়ে ছুটছে। বেথুয়াডহরীর জংগলমহল দুচোখ ভরে দেখল সূর্যা। আহা, কত যে গাছ আছে ওখানে, যদি সব গাছের নাম সে জানত তাহলে দ্বীপীকে সঙ্গে নিয়ে গল্পের ছলে চিনিয়ে দিতে পারত। প্রকৃতির পাঠশালায় সে এখন নিতান্তই শিশুশ্রেণীর ছাত্র।
লিটন ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল, আমরা কৃষ্ণনগর অবধি যাব না, বাহাদুরপুরে নেমে যাব। কৃষ্ণনগরে প্রায় দিন চেক থাকে। ওখানে নামা রিসকের হবে। ওখানকার মামাগুলো ভাগনেদের কোনো ক্ষমা করবে না। ধরতে পারলে ভাগনে আদরে একেবারে শ্রীঘরে ভরে দেবে। তাছাড়া যদি ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং থাকে তাহলে তো আর কথা নেই। স্টুডেন্ট বলেও কেঁদে কেটে, হাতে পায়ে ধরে পার পাওয়া যাবে না। তোরা সব রেডি হয়ে নে, ধুবুলিয়ার পরই বাহাদুরপুর ঢুকবে।
সূর্যাক্ষ বোকার মতো আফসোস করে বলল, তাহলে খড়ো নদীর ব্রিজটা দেখা যাবে না?
-কেন, ওখানে কি তোর ইয়ে থাকে? দাঁত বের করে খিঁচিয়ে উঠল লিটন, এ মাইরি দেখছি একেবারে ভাবুক সাগর! কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। শালা, যারা মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেশে তারাই দেখছি কেমন মেয়েলী হয়ে যায়।
লিটনের কথা বলার ভঙ্গিতে হাসির ফোয়ারা গড়িয়ে পড়ল ট্রেনের কামরায়। সেই হাসির ধাক্কায় মুখটা শুকিয়ে গেল সূর্যাক্ষর, কোনোমতে ঢোঁক গিলে সে বলল, বড়ো বকবক করছিস, দেখা যাবে। মেয়েরা না হলে ছেলেদের এক-পাও চলে না। মেয়েরা হল ছেলেদের ভিটামিন, অনুপ্রেরণা।
-এই রে, কি সব কঠিন কঠিন কথা বলছে, শুনলি? লিটন সবাইকে দলে টানতে চাইল।
পরিমল তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ওসব অনুপ্রেরণা-ফেরনা এখনকার বাজারে আর চলে না। এখন ইয়াহিয়ার জামানা। ধরো আর জবাই করো। মেয়েদের সাথে মেশো, আর ব্লটিং পেপারের মতো মধু চুষে নিয়ে ছেড়ে দাও। এই তোরা ববি দেখেছিস, হাম তুম এক কামরা মে বনধ হো। পরিমল ঘাড় নাড়িয়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে খি-খি করে হাসল।
লিটন না থাকতে পেরে বলল, তোরা মাইরি, একেবারে যাচ্ছেতাই। মেয়েদের নিয়ে এমন ভাবা অন্যায়।
–আহা রে, কোথাকার কোন রামমোহন এসে গেলেন? পরিমল খোঁচা মারতে ছাড়ল না, পিতামহ ভীষ্মের নাম শুনেছিস। মহাভারতে আছে পড়ে নিস। ওঁর জীবনে কত মেয়ে আসল, একটারও হাত ধরল না। একেবারে টাটা স্টিলের মতো ক্যারেকটার। যাই বলিস, লোকটার ক্যালি ছিল। সারা জীবন মেয়ে ছাড়া কাটিয়ে দিল। তোরা পারবি? তোদের বুকে অত দম নেই।
ধুবুলিয়া পেরতেই গেটের কাছে চলে এল ওরা। লিটন সতর্ক করে বলল, মোটে হড়বড় করবি নে। হড়বড় করলেই গড়বড়। শালা, লালগোলা ট্রেন হল অজগরের হাঁ-এর মতো, নিঃশ্বাসে টেনে নেয় মাইরি! একবার তলায় ঢুকে গেলে ডাইরেক্ট যমনগরের টিকিট কাটা হয়ে যাবে।
ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল বাহাদুরপুরে। মাঠের মধ্যে ছোট স্টেশন। কোনো আভিজাত্য নেই, মাঠকুড়োনী মেয়ের মতো সাদাসিধে। ডান পাশে নয়, বাঁ পাশের দরজা দিয়ে নেমে এল ওরা। প্ল্যাটফর্ম না থাকাতে নামতে বড় অসুবিধা। বিশেষ করে মেয়েরা নামতে গেলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে রাস্তা, দুপাশে ঝোপঝাড় আর ঘাসহীন জায়গা। এখানকার মাটির রঙ ঘিয়ে বর্ণ। অদ্ভুত দৃষ্টি আকর্ষণী ক্ষমতা রাখে এই রং। চোখে নেশা ধরায়। একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে পথের মাঝখানে শিবঠাকুর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সূর্যাক্ষ। একটা বাস এসে থেমেছে পাকা রাস্তায়। পিলপিল করে লোক ছুটে যাচ্ছে বাসটাকে ধরবার জন্য। কেউ উঠতে পারল, কেউ আবার পারল না। দূরে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগল না সূর্যাক্ষর। দৌড়াল না সে, ধীরে ধীরে হেঁটে এল রাস্তা পর্যন্ত। লিটন খোঁচা দিয়ে বলল, এমন হাঁটছিস যেন তুই নমাসের প্রেগনেন্ট। আজ তোর কি হয়েছে বল তো?
সূর্যাক্ষ হালকাচালে বলল, কি আর হবে? বলতে পারিস বাড়ি থেকে প্রথম একা একা বাইরে আসা। মনটা হঠাৎ করে খাঁচা ভাঙা পাখি হয়ে গেল, তাই মনের আনন্দে উড়ছি।
একটা স্টেটবাস এসে থামল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাইন বোর্ডটার কাছে। হুড়মুড়িয়ে সবার সাথে উঠে এল সূর্যাক্ষ। বেশ লম্বা বাস। পিছনের সিটে বসার জায়গা পেয়ে গেল ওরা। বারুইপাড়ার কৃশানু হাতে টাকা নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে, তারপর জোর করে হেসে বলল, কাকু, টিকিট না দিলেও চলবে। আমরা গভমেন্ট কলেজের মাঠের সামনে নেমে যাব।
জলঙ্গী নদীর ব্রিজটা বেশ সুন্দর। লোহার ব্রিজ দিয়ে ট্রেন গেলে বিয়ে বাড়ির ব্যান্ডপার্টির মতো ঝর ঝর শব্দ হয়। বাস যাতায়াতের ব্রিজটা যেন বোবা মেয়ে, শত অত্যাচারে ওর মুখে কোনো কথা নেই, শুধু পিষ্ট হওয়ার ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে। হাত পঁচিশ নিচে জল কখনো কাজলাবরণ, কখনো বা স্বচ্ছ জলে হাবুডুবু খায় মেঘের সংসার। খুব ভালো করে দেখলে জলের শ্যাওলা-ভেজা শরীর মনটাকে আরও সবুজ করে দেয়।
মহিলা কলেজ থেকে দ্বীপীর জন্য ফর্ম নিয়ে সূর্যাক্ষ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল কলেজমাঠে। ছোটখাটো মেলার মতো ভিড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাঠের উপর। সামনের চার্চটা মাথা তুলে স্পর্শ করতে চাইছে আকাশ।
প্রায় কুড়িটা যুবক ছুটতে ছুটতে মাঠের এক প্রান্তে গিয়ে থামল। ওরা হাঁপাচ্ছিল। ওদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে বেছে নিলেন অফিসার। ওরা চেস্ট মেজারমেন্টের সেকশনে গিয়ে দাঁড়াল।
মাঠের মাঝখানে টাঙানো হয়েছে খাকি রঙের তাবু। এছাড়া রোদ আটকানোর জন্য মাঠের মাঝখানে পোঁতা হয়েছে বিরাট বৃত্তের রঙিন ছাতা। এর বড়ো, এত সুন্দর ছাতা সূর্যাক এর আগে দেখেনি। সত্যি, শহর কত আজব জায়গা, এখানে এলে কত কি যে দেখা যায়!
ছাতার নিচে টিনের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন জলপাই রঙের পোষাক পরা চারজন অফিসার। মোচসমেত মুখগুলোয় গাম্ভীর্য এবং কাঠিন্য যেন একটা মূল্যবান প্রসাধন। কেটলিতে করে চা-দিয়ে বেড়াচ্ছে জলপাই পোষাক পরা একজন সৈনিক। মাটির ভাড় ফেলার জন্য তাবুর সামনে রাখা হয়েছে অস্থায়ী একটা ডাস্টবিন। উচ্চতা মাপার মেজারিং বারটা রাখা হয়েছে তাঁবুর পাশে। ওর ঠিক হাত পাঁচেক দূরে ওয়েট-মেসিন। লাল রঙের একটা রেজিস্টার নিয়ে পেনের ঢাকনা খুলে বসে আছেন একজন ফৌজি অফিসার। লাইন দিয়ে একে একে এগিয়ে যাচ্ছে যুবকরা। ওদের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে হাফ-প্যান্ট। কারোর পরনে আবার শুধু গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট। একজন ফৌজি চিৎকার করে রিডিং বলছে, অন্যজন তা লিখে রাখছে রেজিস্টারে।
চেস্টে এক ইঞ্চি কম হওয়াতে বাদ চলে গেল অতনু। দৌড়ে বাদ গেল লিটন। পরিমলের ওজন কম দু-কেজি। পাকা কলা আর চিড়ে খেয়েও সে ওজন বাড়াতে পারল না। আক্ষেপে মাথার চুল আঁকড়ে বলল, পারলাম না। হেরে গেলাম। মাঠ জুড়ে জমে উঠেছে চাকরির খেলা। এ-ও এক আজব খেলা যে খেলার কোনোদিন শেষ নেই। রান দিয়ে এসে গাছের ছায়ায় হাঁপাচ্ছিল সূর্য। পরপর তিনজন বাদ যাওয়াতে ওর মনটা খারাপ হয়ে আছে তখন থেকে। দশজনের মধ্যে দৌড়ে রান থেকে ছিটকে গেল লিটন। সেভেনথ হয়েছে সে। সূর্যান্য সবার আগে, ফাস্ট। ঘর থেকে বড়োগঙ্গার ঘাট রোজ সকালে দৌড়ে যেত সে। তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে ভেজা শরীরে দৌড়ে দৌড়ে ফেরা। কোনো কাজ বুঝি বিফলে যায় না, আজকের ঘটনা তাই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করে ছাড়ল।
মন খারাপ কাটিয়ে লিটন এল গাছের ছায়ায়, ওর চোখে-মুখে আর কোনো দুঃখ বা আফসোস নেই। সূর্যাক্ষর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, সাবাস বন্ধু, সাবাস! গ্রামের মুখ রাখলি তুই আর কৃশানু। আমরা পারলাম না, তার জন্য কোনো দুঃখ নেই। তাদের আনন্দটাই আমরা সবাই মিলে ভাগ করে নেব। সূর্যাক্ষর খারাপ লাগছিল, তবু সে জোর করে বলল, মন খারাপ করিস নে। তোদের জন্য হয়ত আরো ভালো চাকরি অপেক্ষা করছে।
-হাসালি! ওদের কি হবে জানি না, কিন্তু আমার কপালে চাকরি নেই। লিটন কষ্ট করে হাসল।
বিকেল ঢলছে পশ্চিমে, মাঠ ফাঁকা হচ্ছে ধীরে ধীরে। মোট ত্রিশ জন এই মাঠ থেকে ট্রেনিংয়ে যাবে পুনেতে। অফিসার-ইন-চার্জ স্পষ্ট বাংলায় বললেন, যাদের নাম ডাকা হল তারা সবাই সিলেকটেড। বাড়িতে চিঠি যাবে। চিঠিতে সব জানতে পারবে।
সূর্যাক্ষ আর কৃশানুর পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল লিটন। মন খারাপের ঘোর কাটিয়ে সে বলল, চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিল। ভেবেছিলাম চাকরিটা পেলে বাবাকে আর চুল কাটতে দেব না। মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। ছ্যাঁ!
.
৫৯.
খাঁ-খাঁ করছে মাঠ, বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। ধুলোর ঝড়ে যেন ঢাকা পড়ে যাবে পুরো পৃথিবী। মাঠ থেকে ফিরে রঘুনাথের আর ভালো লাগছিল না কিছু। শেয়ালকাঁটা গাছের মতন মনটা এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে। হাতে টাকা না থাকলে পুরুষ মানুষের কিছু ভালো লাগে না, আঁধার হয়ে যায় দুনিয়া। নিজেকে হীন মনে হয়। চেয়ে চিন্তে আর যাই হোক, সংসার চলে না।
চুনারাম দিন দশেক হল উঠতে পারে না বিছানা ছেড়ে। গা-হাত-পা ফুলে গিয়েছে, শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে প্রচণ্ড। কাশলে টিন পোনোর শব্দ হয় বুকের ভেতর। সকালবেলায় রঘুনাথকে কাছে ডেকে বলল, দাদুরে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না। খাসির মানসো খেতে মন করছে, দেখ না যদি হাট থেকে আনতে পারিস।
গাঁয়ে খাসি কেটেছিল হপ্তাখানিক আগে। লাঠি নিয়ে কি একটা দরকারে চুনারাম গিয়েছিল গ্রামের ভেতর। রাস্তার ধারে কাটা খাসিটা তার লোভ বাড়িয়ে দেয়। হল হাড়ান তাগড়াই মিটার সারা শরীরে তখন রক্তের ঘাম। থিরথির করে নড়ছিল লালচে মাংসগুলো। অত একটা গন্ধ এসে টোকা মারছিল নাকে। এমন চেনা গন্ধ জল এনে দেয় জিভে। যার খাসি সে হাড়-কৃপণ। মোটও ধার দেবে না। এমন কি নাড়িভুঁড়িটা ফেলে দেবে, শ্যাল-কুকুর খাব তবু হতে তুলে চুনারামকে দেবে না। আজকাল নাড়ি-ভুড়িও মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। গরম জলে সিজিয়ে নিয়ে সাফসুতরো করে কাটলে একটা ভুড়িতে কমের উপর সের খানিক ছালচামড়া হবেই হবে। গোল আলু দিয়ে ঝোল রাঁধলে তার স্বাদও ভোলা যায় না।
গাঁ থেকে ফিরে এল চুনারাম, কিন্তু লোভটা তার সঙ্গে এল। দুপুরবেলায় ভাত আর কুমড়োর ঘাট খেতে গিয়ে জবাফুলের চেয়ে টকটকে লাল মাংসর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার, আর তখনি সেই অদ্ভুত গন্ধটা ছড়িয়ে গিয়েছিল তার চারপাশে। জিভে জল চলে এল তার।
রঘুনাথ পাশে বসে মুখ লুকিয়ে খাচ্ছিল। তখনই মাংসর গল্পটা লোভে পড়ে বলে দেয় চুনারাম। তার এই আব্দার শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট উল্টায় দুর্গামণি। রঘুনাথ খাওয়া থামিয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকায়। শেষবেলায় নোলা বাড়ে মানুষের। চলে যাবার আগে আশ মিটিয়ে যেতে চায় সবাই।
যে করেই হোক সের খানিক মাংস আনতে হবে রঘুনাথকে। হাতে টাকা থাকলে কালই হাট থেকে মাংস কিনে আনত সে। কিন্তু টাকা না থাকলে মনের জোর তলানীতে গিয়ে ঠেকে। তাছাড়া এ বাজারে কেউ খালি হাতে ধার দেয় না। বাঁধের উপর হাবুল চোরের সঙ্গে দেখা হল তার সেদিন। হাবুল চোর আফসোস করে বলল, আর দিন চলছে না গো, এবার মনে হয় শুকিয়ে মরতে হবে। হাতে কাজ না থাকলে পুরো দেশ-দুনিয়া আমার কাছে মরুভূমি মনে হয়।
তখনই ঠিক হয় কাঁসারিদের বাড়িতে আজ রাতেই সিঁদ কাটবে রঘুনাথ। হাবুল চোর তার পাশে থাকবে সাহায্য করার জন্য। যা হবে আধাআধি ভাগ। চোরাই মাল জলপথে চলে যাবে কাটোয়ায়। সেখানে মাল বেচার কোনো অসুবিধা নেই। কাটোয়া হাবুল চোরের পুরনো জায়গা। মহাজনরা সব তার জানাশোনা।
সিঁদ কাটতে গিয়ে ঘরের চাল কাটল রঘুনাথ। পুরনো দিনের মাটির ঘর, দেওয়াল আড়াই হাত চওড়া। কাঁসারিবাড়ির মাটি যেন পাথরের খাদান।
শব্দহীন পায়ে এক বোঝা দড়ি নিয়ে খড়ের চালে উঠে গিয়েছিল রঘুনাথ। তেঁতুলগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাবুল চোরের বুক এখন ধুকধুক করছে ভয়ে। বিড়ি ধরাবে সে ক্ষমতাও তার নেই। বিড়ির ধোঁয়া যদি কাঁসারি বুড়ার নাকে গিয়ে লাগে তাহলে কেস গুবলেট হয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার নব্বই ভাগ সম্ভাবনা।
রাতের বেলায় রঘুনাথ কারোর কথা শুনতে রাজি নয়। হাবুল চোর ঘরের চালে ওঠার আগে কী যেন বোঝাতে চেয়েছিল তাকে, রঘুনাথ তার কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল, তুমি থামো তো ওস্তাদ, আমাকে চড়তে দাও। সিদ কেটে ঘরে ঢোকার চাইতে চাল কেটে ঢোকা আরও সহজ।
কথা হল কাঁসার থালা বাসন বস্তায় ভরে দড়ি বেঁধে উঠিয়ে দেওয়া হবে ওপরে, তারপর কুয়ো থেকে জল ভোলার মতো টেনে তুলে নিলেই হবে।
আজ বেশি নয়, মাত্র দুবা হলে কাজ মিটে যাবে। চুনারামের জন্য খাসির মাংস এসে যাবে তার পরের দিন। শুধু মা শীতলবুড়ির দয়া চাই। তার দয়া ছাড়া গাছের পাতাও নড়বে না। রঘুনাথ ধার কাস্তে দিয়ে চাল কেটে দেয়াল বেয়ে কায়দা করে নেমে এল নীচে। বাদুড়ের চিৎকারে ঘাবড়ে গেল সে। এ ঘরটা দিনের বেলায় জমজমাট থাকে কর্মীদের ভিড়ে। সন্ধে সাতটার পর কাঁসা-ছিলা বন্ধ করে দেয় কাঁসারি বুড়া।
শুনসান ঘরে থরে থরে সাজানো কাঁসার থালা বাটি মাস। ছাঁট কাঁসা ভরা আছে কুইন্টাল মাপের বস্তায়। ওদিকে নজর দিল না রঘুনাথ। ছাঁটের দাম কম, খাটুনির মূল্য পোযাবে না। তার চেয়ে তৈরি জিনিস ঢের ভালো। রঘুনাথ ব্যস্ত হাতে ভরতে লাগল বাসন-পত্র।
এক বস্তা ভরে দড়ি ছুঁড়ে দিল কাটা চালের ভেতর দিয়ে। প্রস্তুত ছিল হাবুল চোর। সামান্য শব্দে সে খরগোসের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল। চালের উপর উঠে গিয়ে দড়ি ধরে টান মারল।
ভারী বস্তা ওঠাতে ঘাম ছুটল হাবুল চোরের। তবু সে বহু কষ্টে বস্তা টেনে নিয়ে গেল তেঁতুলতলায়। ছেলেটার এলেম আছে বলতে হবে। এ লাইনে আর দু-পাঁচ বছর থাকলে ঝানু হয়ে যাবে। গাছের পাতা নড়া দেখে বুঝতে পারবে হাওয়া কোনদিকে বইছে।
দ্বিতীয় বস্তাটা ওঠাতে গিয়ে অসাবধানে হাত ফসকে পড়ে গেল মেঝেয়। আর একটু হলে রঘুনাথ চাপা পড়ত তার তলায়। কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে।
কিন্তু সেই স্বস্তির নিঃশ্বাস কাল হয়ে দাঁড়াল তার কাছে। সারিবুড়া বস্তা আছড়ে পড়ার শব্দে হৈ-চৈ না করে ধীর পায়ে এগিয়ে এল ঘরের দরজার কাছে। আগেভাগে ভেজান ছিল দরজা। হাত বাড়িয়ে নিঃশব্দে শেকল তুলে দিল কাসারিবুড়া। আশে-পাশের বাড়িতে গিয়ে মানুষ জনকে জাগিয়ে তুলল সে।
বিপদ বুঝে বস্তা ফেলে পালিয়ে গেল হাবুল চোর। রঘুনাথ দড়ির সাহায্যে চালের উর উঠে এল কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ইট-পাথরের আঘাতে খড়ের চালে শুয়ে পড়তে বাধ্য হল সে। চারজন মিলে তাকে যখন খড়ের ছাদ থেকে নামাল তখন তার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। মাথা ফেটে রক্তে ভরে গিয়েছে মুখ। চুয়ানো রক্ত জমাট বেঁধে লাল কেঁচোর মতো নড়ছে শরীরের কাঁপুনিতে। শুধু মাথা নয়, আঘাত জমাট বেঁধে আছে চোখের নীচে, ফলে বাঁ পাশের চোখটা নারকেল কুলের মতো ফুলে আছে মোটা হয়ে। কিছুটা জায়গা আম ছ্যাচার মতো হেঁচে গিয়ে অনবরত চুঁইয়ে যাচ্ছে রক্ত। কালসিটে দাগটা অন্ধকারেও দেখা যায় স্পষ্ট।
রঘুনাথের দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতা ছিল না, তবু অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় সে সুযোগ খুঁজছিল পালিয়ে যাওয়া যায় কিনা, কিন্তু কোনো উপায় না দেখে ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে নিল সবার সহানুভূতি পাওয়ার জন্য। সহানুভূতি দূরে থাক রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্রোধ বাড়ছিল মানুষের।
দুজন মই নিয়ে এসে পায়ে দড়ি বাঁধল রঘুনাথের। সেই দড়ি ধরে টানতেই প্রায় দশ হাত উছু ছাদ থেকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রঘুনাথ। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কাটা তালগাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে গেল কিছুটা,তারপর এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। আর তখুনি শুরু হল শাবল আর লাঠির বেদম প্রহার। শেষ রাতের বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল রঘুনাথ। সেই চিৎকার পৌঁছে গেল সূর্যাক্ষর দোতলার শোওয়ার ঘরে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। ঘুম জড়ানো চোখে সে শুনতে পেল মানুষের স-উল্লাস চিৎকার, বুনো পাড়ার রঘু ধরা পড়েছে গো….।
একবার নয়, বারবার ভেসে এল সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর। আতঙ্ক আর দুঃশ্চিন্তায় ঘুম ছুটে গেল সূর্যাক্ষর। টেবিল ল্যাম্পের সলতে উসকে সে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সতর্ক হতেই শুনতে পেল উন্মাদ মানুষের কণ্ঠস্বর, ঢ্যামনাটাকে শেষ করে দে। ওকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। বড়ো হলে এ নির্ঘাৎ হাফিজ ডাকাত হবে।
শাবল আর লাঠির আঘাত শুরু হল পর্যায়ক্রমে। বাতাস বিদীর্ণ করে ভেসে এল আর্তস্বর, মরে গেলাম গো, আর মেরোনি গো-ও-ও-ও। মরে যাবো গো-ও-ও-ও। তবু প্রহারের শব্দ স্তব্ধ হল না।
সূর্যাক্ষ অস্থির হয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। পুকুরপাড়ে সময়মতো না পৌঁছাতে পারলে ওরা রঘুনাথকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। দশের মার একা সে কঁহাতক সহ্য করবে?
দরজা খুলতে গিয়ে বাধা পেল সূর্যা। রঘুনাথ ধরা পড়ার পর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মীনাক্ষীর। কপোতাক্ষকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে ছুটে এসেছিলেন দোতলায়। শেকল তুলে দিয়ে নেমে গেছেন চুপিসারে। কেন না তিনি জানতেন আর একটু পরেই পুকুরপাড়ে বিচার করার জন্য হাজির হবেন নীলাক্ষ এবং সেই বিচার যে কত নির্মম হবে তা মীনাক্ষীর অজানা নেই। এ সময় ঘর থেকে সূর্যাক্ষ বেরিয়ে গেলে বিপদ আসন্ন। সূর্যাক্ষ বাধা দিলে মোটও খুশি হবেন না নীলাক্ষ। এর প্রভাব এসে পড়বে দুটি পরিবারে। মীনাক্ষী দরজায় শেকল তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মনে মনে অনুতপ্ত হলেও তার এই যন্ত্রণার কথা তিনি ঘরের মানুষটিকে ছাড়া আর কাউকেই বলে বোঝাতে পারবেন না।
দোতলা থেকে নেমে তিনি থরথর করে কাঁপছিলেন। কপোতাক্ষ বিস্ময়ে শুধোলেন, তোমার কি হল? তুমি কেন কাপছ?
–ওরা রঘুটাকে মেরে ফেলবে গো।
-মারুক। মেরে মেরে শেষ করে দিক। একটা চোরকে আমি কখনও সাপোর্ট দেব না। ওই অত রাতে রাগে-উত্তেজনায় সিগারেট ধরালেন কপোতাক্ষ। ধোঁয়া ছেড়ে সেই উড্ডীয়মান ধোয়ার কুলির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তখনই দোতলার দরজায় সজোরে ধাক্কা মারল সূর্যাক্ষ, মা, দরজা খোল। তাড়াতাড়ি দরজা খোল মা। ওরা রঘুকে মেরে ফেলবে। দরজা খোল। শুধু চোখ নয়, মীনাক্ষীর সমস্ত শরীর দুলে উঠল সেই বিধ্বংসী আওয়াজে। একটু বিলম্ব হতেই দরজাতে দুমদুম লাথি মারছিল সূর্যাক্ষ। এরই মধ্যে ভেসে আসছিল রঘুনাথের প্রাণ কাঁপানো আর্তস্বর। কিছু মাতব্বর স্থানীয় মানুষ বদ্ধপরিকর তারা আজ রঘুনাথের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবেন–তাতে যদি থানা-পুলিশ হয় তো হোক। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীকে আরও বেশি তাতিয়ে দিচ্ছিল নীলাক্ষবাবুর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, মেরে ফেল তোরা। জাতসাপের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। সুযোগ পেলে এ আবার ছোবল মারবে।
সূর্যাক্ষ দরজা খুলতে না পেরে পাগলের মতো হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল, মা, শেষবারের জন্য বলছি-দরজা খোল। যদি দরজা না খোল তাহলে ভোরবেলায় আমার মরা মুখ দেখতে পাবে। শুনে রাখো–আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব। মরব বলেছি যখন মরবই।
সূর্যাক্ষর এই হুমকি কানে যেতেই অস্থির হয়ে উঠলেন মীনাক্ষী। পরের জন্য নিজের সন্তানকে তিনি হারাতে চান না। সত্যি, এ কী বোকামি তিনি করেছেন? জোয়ান ছেলেকে ঘরে শিকল তুলে রাখা তার উচিত হয়নি। যৌবন এই পরাধীনতা মানবে না। আর কদিন পরে সূর্যাক্ষ বাড়ি ছেড়ে চাকরির জন্য ট্রেনিং নিতে মহারাষ্ট্রে চলে যাবে। ঈশ্বরের কৃপায় সব এখনও পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছে। নিজের ভুলের জন্য মীনাক্ষী তা ধ্বংস করে দিতে পারেন না।
এখন আর দরজায় আঘাত করছে না সূর্যাক্ষ। শুধু ভোর রাতের বাতাসের বুকে বান মারার মতো কথাগুলো আছড়ে পড়ছে মীনাক্ষীর কানে। সেই হুমকিভরা কথা শুনে কপোতাক্ষর চোখ ভয়ে ছোট হয়ে এল। মীনাক্ষীকে ঠেলা দিয়ে তিনি বললেন, যাও, ঘরের শেকলটা খুলে দিয়ে আসো। মানুষের জন্য মানুষের মন কাঁদবেই। তুমি শেকল তুলে ভাবছ এটা আটকে দেবে? অসম্ভব।
মীনাক্ষী ত্রস্ত পায়ে উঠে এলেন দোতলায়। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ফুঁসছিল সুর্যাক্ষ। হাত বাড়িয়ে শেকলটা খুলে দিতেই কাঠের দরজায় ঘটাং করে শব্দ হল। আর ঠিক তখন তীরের বেগে মীনাক্ষীকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সূর্যাক্ষ।
ঘরের পেছনের বাঁশবাগানের পথটা সোজা চলে গিয়েছে পুকুরধারে। এক মুহূর্ত সময় আর নষ্ট করতে চায় না সূর্যাগ। রঘুনাথকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। চুরি করার শাস্তি ও পাক, কিন্তু এভাবে কেন? মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কতক্ষণ?
নীলাক্ষবাবু ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন পুকুরপাড়ে, তাঁর দুহাত পিঠের নিম্নদেশে শক্ত করে ধরা। আটপৌরে ধুতি হাঁটুর নিচে লুটানো। গায়ে হাতওয়ালা ধবধবে গেঞ্জি। গেঞ্জির ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল নোংরা হয়ে যাওয়া মোটা পৈতেটা। পাকা গোঁফ নাচিয়ে তিনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন, মার, মেরে শেষ করে দে। আর দেরি করিস না।
ভেঙে পড়া গাছের ডালের মতো সূর্যাক্ষ ছুটে গিয়ে সারা শরীর দিয়ে আঁকড়ে ধরল ক্ষত-বিক্ষত রঘুনাথকে। কাউকে কোনো সুযোগ না দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার, ওকে তোমরা আর মারবে না। যদি মারতে হয় আমাকে মারো। দুহাত বাড়িয়ে নিজের শরীর দিয়ে রঘুনাথকে প্রাণপণে আড়াল করতে চাইছিল সূর্যাক্ষ। যারা প্রহারের কাজে হিংস্র হয়ে উঠছিল তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নীলাক্ষবাবুর দিকে তাকাল।
নীলাক্ষবাবু এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আদৌ তৈরি ছিলেন না। তিনি জানতেন বুনো পাড়ার রঘুনাথের সঙ্গে তার ভাইপোর জানাশোনা আছে, কিন্তু সেই জানাশোনা যে এতদূর তলায়-তলায় বন্ধুত্বের জাল বিছিয়েছে সেটা তাঁর ক্ষুদ্রবুদ্ধির হিসাবের মধ্যে ছিল না।
ভাইয়ের সোমত্ত ছেলের গায়ে হাত তোলা যে উচিত হবে না এই সিদ্ধান্ত তিনি চোখ বুজে নিয়ে ফেললেন। প্রায় ঘণ্টাখানিকের প্রহারে রঘুনাথের উঠে দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতা ছিল না। সূর্যাক্ষ পাগলের মতো রঘুনাথকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, ওঠ, রঘু-ওঠ। ঘর যাবি না? এখানে থাকলে এরা তোকে মেরে ফেলবে।
সূর্যাক্ষর কথাগুলো সম্ভবত কানে গিয়েছিল রঘুনাথের। রক্তে ঢাকা চোখ মেলে বহু কষ্টে সে তাকাবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। তার চোখের পাতা যেন ইটের চেয়েও ভারী হয়ে গিয়েছে, তাই চোখ খুলতে গিয়ে রক্তমাখানো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল দু-চোখের কোণ ভিজিয়ে।
ওর শরীরের রক্ত মাটি ভিজিয়ে জমাট বেঁধে আছে পুকুরধারে। ভোর হয়ে আসছে। গাছের ডালে কাক-পক্ষীদের চিৎকার। পাশের কর্মকার বাড়ির হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকতে ডাকতে পুকুরধারে এসে রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল। মুখ নামিয়ে ওরা সেই জমাটবাঁধা রক্ত পুঁচপুঁচ করে খেতে লাগল। সূর্যাক্ষ চিৎকার করে হাঁসগুলোকে তাড়াতে গিয়ে দেখল জেদি হাঁসগুলো তখনও মন দিয়ে জমাট বাঁধা রক্তগুলো খেয়ে যাচ্ছে। শিউলিফুলের বোঁটার মতো ওদের ঠোঁটগুলো ভরে উঠেছে রক্তের দাগে। ভোরের কুসুম ফোঁটানো আলোয় রঘুনাথকে আঁকড়ে ধরে শেষবারের মতো গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সূর্যাক্ষ, খবরদার, তোমরা কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না। যদি হাত দাও তাহলে পুরো গাঁয়ে আমি আগুন ধরিয়ে দেব।
আগুন শব্দটায় ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। ভোরের বাতাস তাকে বুকে নিয়ে ছুটে যায় গাঙধারে। গাধার থেকে হলদিপোঁতা ধাওড়া হয়ে পণ্ডিত বিল। সেখান থেকে দোয়েম হরিনাথপুর হাটগাছা হয়ে একেবারে চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়কে। ঢেউ ছুটতে থাকে গ্রাম পেরিয়ে শহরের দিকে। বাতাস পদাবলি গায়, আগুনের পদাবলি।