১২ আগস্ট, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
গত তিনদিন থেকে রুমীর দেখা পাওয়াই দুষ্কর। কখন যাচ্ছে, কখন আসছে, তার ঠিক নেই। পরশুদিন দুপুরে বাসায় খেল দুজন গেরিলা বন্ধুকে নিয়ে–বদি আর জুয়েল। বদি ইকনমিকসে এম. এ. পড়ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্র জুয়েলও নামকরা, তবে ক্রিকেটের মাঠে। খাওয়ার পরপরই ওদের নিয়ে রুমী বেরিয়ে গেল, বলে গেল রাতে ফিরবে না।
গতকাল ধলুরা দুপুরে খেল আমাদের বাড়িতে। চিশতীর ছুটি প্রায় শেষ, ওরা ১৫ তারিখে ইসলামাবাদ ফিরে যাবে। খেতে বসে ধলু জিগ্যেস করেছিল, রুমী কই? খাবে না? বলেছিলাম এসে যাবে এক্ষুণি। আমরা শুরু করে দিই।
কিন্তু রুমীর আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। ততক্ষণে ধলুরা চলে গেছে। বললাম, রুমী, একবার সময় করে খালা-খালুর সঙ্গে দেখা করে আসিস। কালকেও ঘণ্টাখানেক বাড়িতে থেকেই আবার বেরিয়ে গেল। বলল, রাতে ফিরবে না।
কিছুই বলছিনা, বলবার উপায় তো নেই। কিন্তু রাতে ঘুম হচ্ছে না। জামীর আবার জ্বর দুদিন থেকে। ডাক্তার দেখে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে।
আমারও শরীরটা খুব দুর্বল লাগে। সব সময় বুক ধড়ফড় করে। রুমী সব কথা খুলে বললে মনে হয় এতটা অসুস্থ লাগত না।
আজ দুপুরে খাওয়ার পর টেবিলে রুমীর খাবার ঢাকা দিয়ে চৌকিটাতে শুয়েছিলাম। রুমী এল বিকেলে। এসেই বলল, আম্মা, খেতে দাও। বডেড়া খিদে পেয়েছে টেবিলের দিকে তাকিয়ে–বাঃ আগে থেকেই খাবার রেডি! গুড ওল্ড মাম্।
আমি উঠে ঢাকনা খুলে রুমীর প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললাম, কাল বিকেলে ইন্টারকনে ভীষণ কাণ্ড হয়েছে। একেবারে ভেতরে একটা ঘরে বিচ্ছুরা বোমা মেরেছে। জানিস?
জানি। ঘরে নয়, একতলার লাউঞ্জের পাশের একটা বাথরুমে।
তুই ছিলি নাকি?
না।
যারা ছিল, তাদের চিনিস?
আম্মা। রুমীর গলায় অসহিষ্ণু রাগ।
আমিও হঠাৎ রেগে গেলাম। ঠিক আছে, তোকে আর কিছুই জিগ্যেস করব না। তবে জেনে রাখ, আমাদের ম্যালাই সোর্স আছে। এই ঢাকাতে খবর জেট প্লেনের স্পীডে যাতায়াত করে বুঝলি?
রুমী হেসে ফেলল, কিন্তু আমি দুমদুম করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে গেলাম।
খানিক পরে রুমী এসে ঢুকলো বেডরুমে, পাশে বসে বলল, ইন্টারকনের ভেতরে বোমা মারে নি ওটা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ সংক্ষেপে বলে পি.কে।
আমি কথা বললাম না। রুমী বলল, যারা করেছে, তাদের তুমি আগে দেখ নি। আমিও আগে চিনতাম না। মেলাঘরে গিয়ে আলাপ হয়েছে।
আমি চুপ। রুমীও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, ঐ যে পি.কে., এটা না, দেখতে একদম পুটির মতো। হলদে রঙের। বড়ই নিরীহ চেহারার। দেখে মনে হবে ফার্নিচারের দোকানের পুটি-ই।
তবুও কথা বললাম না। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। রুমী যতটুকু বলার ঠিক ততটুকুই বলবে। তার বেশি একটুও না। আমার জিগ্যেস করা বৃথা।
রুমী খানিকক্ষণ আপনমনে শিস দিল, তারপর মৃদুস্বরে আবৃত্তি করতে লাগল :
দেখতে কেমন তুমি? কি রকম পোশাক আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং, ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আতিপাতি! তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর।
আমি উঠে বসে জিগ্যেস করলাম, কার কবিতা এটা?
ঢাকার এক বিখ্যাত কবির। নামটা ভুলে গেছি। শাহাদত ভাই আর আলম মাঝে মাঝে ওঁর কাছ থেকে নিয়ে যায় ওপারে। মেলাঘরে আমরা কবিতাগুলো পড়ি। ভালো লাগলে দুএকটা কপি করে রাখি, তারপর ওগুলো কলকাতায় কার কাছে যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এটা তো তোদের নিয়েই লেখা বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এটার নাম গেরিলা–বাকিটা শোন :
পারলে নীলিমা চিরে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া।
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে বললাম, ঐ শাহাদত আর আলম আর আসে না ঢাকায়?
আসে, আবার চলে যায়। এবার আসেনি?বলেই সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে আবার বললাম, মানে এরপর এলে কবির নামটা জিগ্যেস করে নিস।
রুমী হেসে ফেলল, আম্মা ইউ আর সিম্পলি ইনকরিজিবল। ঐ কবি ঢাকাতেই বাস করছেন। আমি যে নামটা ভুলে গেছি সেটা ওঁর জন্য মঙ্গল। তুমি আবার জানতে চাও কেন? এতে তোমারও বিপদ, কবিরও বিপদ।
এই এক লুকোচুরি খেলা চলছে। রুমী বলছে, সব কথা জানতে চেয়ো না, ধরা পড়লে টর্চারে বলে ফেলতে পার। আমি কখনো লক্ষ্মী মেয়ের মতো, কখনো অভিমানে, রুমীর কথা মেনে নিয়েও খানিক পরে আবার ভুলে গিয়ে প্রশ্ন করে ফেলেছি।
এবার আর রাগ করলাম না। হেসে বললাম, সত্যি, কি জ্বালা। খালি ভুলে যাই। বুড়ো বয়সে সব উলটপুরাণ হয়ে গেছে। এখন তুই বাবা হয়েছিস, আমি তোর ছোট মেয়ে। তাই খুব মনের সুখে বকে নিচ্ছি।