জুন মাস। নয় তারিখ।
আকাশ মেঘশূন্য। গতকাল সন্ধ্যায় বেশ কিছুক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে বৃষ্টির আর্দ্রতা আছে। জুন মাসের উত্তাপ নেই।
মায়ানগরের প্রধান ফটক কিছুক্ষণের মধ্যেই খোলা হবে। ফটকের বাইরে ইয়াকুব সাহেব অপেক্ষা করছেন। ইয়াকুব সাহেবের সঙ্গে তাঁর নাতনী এলেন। এলেনের কাঁধে হাভারসেক। হাতে মিকিমাউস বটল। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে স্ট্র লাগিয়ে মাঝে মাঝে বোতলে চুমুক দিচ্ছে। ইয়াকুব সাহেবের দিকে তাকিয়ে সে ইংরেজিতে বলল, আমরা কি কারোর জন্যে অপেক্ষা করছি?
ইয়াকুব সাহেব না সূচক মাথা নাড়লেন। গেটের ডান দিকে তাকালেন। সেখানে অনেক মানুষের জটলা। এলেনের মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু গাড়ি থেমে আছে–আরো গাড়ি আসছে। ইয়াকুব সাহেব বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা বোধ করছেন। তার হার্টে পেসমেকার লাগানো আছে উত্তেজনা তার জন্যে ভালো না। তবু উত্তেজনা কমাতে পারছেন না। এলেন বলল, আমি কি জানতে পারি কেন আমরা ভেতরে যাচ্ছি মা? ইয়াকুব সাহেব নাতনীর প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাসানের দিকে তাকিয়ে তাকে কাছে আসতে ইশারা করলেন। হাসান এগিয়ে এল। ইয়াকুব সাহেব বললেন, থ্যাংক য়্যু, তুমি যথাসময়ে শেষ করেছ।
হাসান কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ছেলেকে আসতে বলেছিলাম। সে কোথায়? আমি বলেছিলাম আমার একপাশে থাকবে এলেন। আরেক পাশে তোমার পুত্র। যতদূর মনে পড়ে তার নাম–অন্তু।
হাসান চুপ করে আছে। ইয়াকুব সাহেবের আনন্দযাত্রায় মৃত্যুর খবর সে দিতে চাচ্ছে না। অন্তু মারা গেছে মাদ্রাজে। কফিনে করে তার মৃতদেহ দেশে এসেছে। হাসান পুত্রের মৃতদেহ দেখতে যায় নি। ইচ্ছা করেনি। সেই সময় সে কাজ করেছে গোলক ধাঁধার। একটা বাচ্চা কাঁদবে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। সুন্দর একটা খেলা। অন্তুও কাঁদছে কেউ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, হাসান আমরা কি ঢুকব?
অবশ্যই স্যার।
তুমি যাচ্ছ না সঙ্গে?
জি না। ভেতরে গাইড আছে সে সব দেখাবে। সবচে ভালো হয়। গাইড ছাড়া যদি নিজে নিজে ঘুরে বেড়ান।
তুমি সঙ্গে যাবে না কেন?
কোনো প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে যাবার পর তার প্রতি আমার আর কোনো উৎসাহ থাকে না।
ইয়াকুব সাহেব কয়েক সেকেন্ড অপলকে হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলেটা ভালো আছে তো হাসান?
হাসান জবাব দিল না।
ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মায়ানগরের বিশাল তোরণ খুলে যাচ্ছে। মাইক্রফোন সিস্টেমে নানান জায়গা থেকে একসঙ্গে ট্রাম্পেটের বাজনা বেজে উঠল। এলেন গেটের ভেতর প্রথম পা দিয়ে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করল–
Oh my God. What is it।
ইয়াকুব সাহেব ঢুকেছেন। তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তিনি গাঢ় স্বরে ডাকলেন–হাসান, হাসান। হাসান কোথায়?
হাসান ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে। সে এখন বাসায় যাবে। বাসায় কেউ নেই। নাজমা মেয়েকে নিয়ে চিটাগাং-এ তার ভাইয়ের বাসায় চলে গেছে। হাসানকে সে খুবই নরম ভাষায় একটি চিঠি লিখেছে। চিঠিতে জানিয়েছে হাসানের সঙ্গে জীবন যাপন করা তার সম্ভব হচ্ছে না। হাসান যেন ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেয় এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়। নাজমা লিখেছে–তোমাকে দেখলেই আমার অন্তর কথা মনে পড়বে। অদ্ভু তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও হাত বাড়িয়ে বাবাকে খুঁজেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। বাবা কোথায়? Where is my dad? তুমি তখন ব্যস্ত ছিলে তোমার স্বপ্ন নিয়ে। এই কথা আমি তোমার পুত্রকে বলতে পারি নি। আমি শুধু বলেছি চলে আসবে। যে কোনো সময় চলে আসবে। আমি এইসব স্মৃতির। ভেতর দিয়ে যেতে চাই না। কাজেই তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছি। তুমি কিছু মনে করো না।
হাঁটতে হাঁটতে হাসান আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কে জানে আজও হয়তো বৃষ্টি হবে।
হাসানের ইচ্ছা করছে কোনো জনমানব শূন্য দ্বীপে নতুন কোনো প্রজেক্ট শুরু করতে। দ্বীপটার নাম দেয়া যাক মায়া দ্বীপ। সেই দ্বীপে শুধুই কদম গাছ থাকবে। বর্ষায় ফুটবে কদম ফুল।
কোনো এক আষাঢ় সন্ধ্যায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। হাসান বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কদম বনে ঘুরে বেড়াবে। সে খুঁজে বেড়াবে তার প্রিয় মুখদের। যেহেতু দ্বীপের নাম মায়াদ্বীপ কাজেই খুঁজলেই সব প্রিয়জনদের সেখানে পাওয়া যাবে। তাদের খুব কাছে যাওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের পায়ের শব্দ পাওয়া যাবে। প্রিয় পদরেখা দেখা যাবে। শোনা যাবে তাদের চাপা হাসি। হাসান যখন ডাকবে— বাবা অন্তু তুমি কোথায় গো? তখন কোনো কদম গাছের আড়াল থেকে অন্তু বলবে, আমি এখানে।
হাসান আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে বৃষ্টি ও মেঘমালা।