আকাশে ট্রেসার উড়ছে। আকাশ আলো হয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে আলোর নকশা। যেন বারবার কালো আকাশে ঝলমলিয়ে উঠছে উৎসবের হাউই বাতি। তারাবাতির মতো আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে মেশিনগানের মুখ থেকে। বাজির শব্দের মতো গুলি। উৎসব। অন্য ধরনের উৎসব। হত্যা ও ধ্বংসের উৎসব। এই উৎসবের জন্যে কেউ কি তৈরি ছিল? ঢাকার ঘুমন্ত মানুষ ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে জেগে উঠল। কী হচ্ছে? কী হচ্ছে?
সবাই জানে কী হচ্ছে। তারপরেও যেন কেউ কিছু জানে না। ভারী মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ অবলীলায় রাস্তায় চলাচল করছে। সবকটি রাস্তায় না বেরিকেড ছিল? এরা এত দ্রুত বেরিকেড সরালো কীভাবে? অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। ট্যাংক নেমেছে নাকি? ট্যাংক চললে রাস্তায় এমন অদ্ভুত শব্দ হয়? একটানা যে ট্যা ট্যা শব্দ হচ্ছে সেই শব্দ কিসের? তার চেয়েও বিচিত্র আরেক ধরনের শব্দ হচ্ছে–শো শো হুস হুইইই।
ভয় এবং কৌতূহল বোধহয় পাশাপাশি চলে। প্রচণ্ড ভীত মানুষের কৌতূহলও হয় প্রচণ্ড। এরা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছে। দেখতে চেষ্টা করছে কী হচ্ছে বাইরে। কেউ কেউ চলে এসেছে বারান্দায়। চোখের সামনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ দেখার আলাদা মাদকতা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধরনের ঘোর তৈরি হয়। মাথার ভেতরে জগাখিচুড়ির মতো কিছু হয়। তখন মানুষ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমনসব কাণ্ড করে।
এই জাতীয় কাণ্ড কিছু শুরু হলো। কিছু কিছু নিতান্তই নিরীহ ছাপোষা ধরনের মানুষ জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে গলা ফাটিয়ে চোঁচাল। দীর্ঘ আন্দোলনে এদের কেউ হয়তো কোনোদিন রাজপথে নামে নি। কোনো মোগান দেয় নি। অফিসে গিয়েছে, অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে এসেছে। চটের ব্যাগের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছে একটা লাউ, ইলিশ মাছের লেজ। আজ হঠাৎ তাদের কী হয়ে গেল?
ভীত মানুষের কান্না ও চিৎকার শোনা যেতে শুরু করল তারও কিছু পরে। আকাশে তখন ট্রেসারের সংখ্যা কমে এসেছে। কারণ তার প্রয়োজন নেই। সারা ঢাকা শহর আলোকিত। অসংখ্য জায়গায় আগুন জুলছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোয়া। আগে সারা শহরে একসঙ্গে গুলি হচ্ছিল, এখন তা হচ্ছে না। গুলি হচ্ছে অঞ্চল বিশেষে। টেলিফোন কাজ করছে না। রাস্তা শুধু যে জনশূন্য তাই নয়, প্রথমবারের মতো কুকুরশুন্য। কোথায় কী হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কী হলো? তাঁর আঙুলের ইশারায় দেশ চলছিল। এখন তিনি কিছু বলছেন না কেন? ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ বৈঠকের আগে, সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভালো কিছু আশা করছি। খারাপ কিছুর জন্যেও প্রস্তুত আছি। কোথায় তাঁর প্রস্তুতি? নাকি যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কেউ কিছু জানে না।
একদল মিলিটারি ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাদের হাতে শিক্ষকদের তালিকা। তারা মানুষ না, তারা সাক্ষাৎ আজরাইল। মানুষের বেশে জানি কবজ করতে এসেছে।
এটা কার বাড়ি? জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট? হিন্দু মালাউন? বদমাশটার নাম কী? জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা?
মিলিটারি লেফটেনেন্ট বাড়িতে ঢুকে পড়ল। জোয়ানরা বাড়ি ঘিরে আছে। হতভম্ব জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
আপ প্রফেসর সাব হ্যায়?
Yes.
আপকো লে যায়গা।
Why?
হোয়াই প্রশ্নের জবাব দেবার সময় নেই। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা, তার অতি আদরের কন্যা দোলা তখনো বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কী হবে? খালি পায়ে স্বামীকে নিয়ে যাবে? বাসন্তী গুহঠাকুরতা দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন স্যান্ডেল আনতে। এর মধ্যেই জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাইরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে।
তাদের বসার ঘরের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে ড. মনিরুজ্জামানের মৃতদেহ। একটু দূরে আরো তিনজন। একজন ক্ষীণস্বরে বলছে, পানি পানি।
মারা গেলেন দার্শনিক আত্মভোলা অধ্যাপক ড. জি. সি. দেব। জি. সি. দেব। মৃত্যুর আগে প্রায় হাসিমুখে বললেন, আমি হিন্দু। আমার বাড়িতে যারা আছে সবাই হিন্দু।
তিনি হয়তো ভাবলেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি কোনো অত্যাচার করা হবে না। কিংবা অন্য কিছু তখন তার মাথায় খেলা করছিল।
মারা গেলেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান, ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচাৰ্য, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড. মনিরুজ্জামান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল মুকতাদির, অংক বিভাগের অধ্যাপক শরাফত আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম. আর. খান খাদিম, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সিটিউটের শিক্ষক মুহম্মদ সাদিক ও ড. মুহম্মদ সাদত আলী।
মিলিটারিরা ঢুকে পড়ল ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে। তাদের পরিকল্পনা একটি ছাত্রও যেন জীবিত বের হয়ে সেতে না পারে। তোমাদের জয় বাংলা অনেক সহ্য করেছি। আর না।
রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হল। মেয়েদের দুটি হল। হলের মেয়েরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে দেখল, গেট ভেঙে মিলিটারিরা ঢুকছে। আমাদের বাঁচাও বলে চিৎকার করার মতো মানসিক শক্তিও তাদের রইল না। তারা দেখল, পাকিস্তানি জোয়ানরা মার্চ করে হলের দিকে এগুচ্ছে।
সেনাবাহিনী আগুন জুলিয়ে দেয়। ইত্তেফাক অফিসে। দাউদাউ করে আগুন জুলতে থাকে দি পিপলস, গণবাংলা এবং সংবাদ অফিসে। আত্মনিমগ্ন কবি শহীদ সাবের সংবাদ অফিসেই ঘুমাতেন। সংবাদ অফিসই ছিল তাঁর ঘর-বাড়ি। তিনি জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন সংবাদ অফিসেই।
পাকিস্তান মিলিটারি রাত একটায় যে অপারেশন শুরু করে তার নাম অপারেশন সার্চ লাইট।* ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ছিল ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে। অধিনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলি। তিনি শায়েস্তা করবেন। ঢাকা নগরী। মেজর জেনারেল খাদেমের উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা ছাড়া বাকি দেশ শায়েস্তা করার।
ব্রিগেডিয়ার আরবাব ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বেলুচ এবং ৩২ পাঞ্জাবের যৌথ দলকে লেলিয়ে দিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পাঠাল রাজারবাগের এক হাজার পুলিশকে জন্মের শিক্ষা দেবার জন্যে।
পুরনো ঢাকার গাদারদের শায়েস্তা করবে ১৮ পাঞ্জাব।
২২ বালুচের দায়িত্ব পড়ল পিলখানা ইপিআরদের ঠাণ্ডা করা।
১৩ ফ্রিন্টিয়ার ফোর্সকে কোনো কাজে লাগানো হলো না। রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে রেখে দেয়া হলো।
৪৩ হালকা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্টকে পাঠানো হলো তেজগাও বিমানবন্দরের দায়িত্ব দিয়ে।
এক প্লাটুন কমান্ডো পাঠানো হলো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে শেখ মুজিবকে ধরে আনতে।
রাত একটায় ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জাফরের উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো–Big Bird in the cage… others not in the nests…over.
সামরিক বাহিনীর জিপে করে তাকে নিয়ে আসা হলো ক্যান্টনমেন্টে। মেজর জাফর জানতে চাইল জেনারেল টিক্কা কি তাকে চোখের দেখা দেখতে চান? টিক্কা উত্তর দিল–I dont want to see his face.
জেনারেল টিক্কা ২৫ মার্চ রাত নটায় ঢাকা অঞ্চল কমান্ডার মেজর জেনারেল ফরমান আলীর স্টাফ অফিসে ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে নিযুক্ত অফিসারদের হাসতে হাসতে বলেছিলেন–ঢাকা শহরে এমন তাণ্ডব তৈরি করতে হবে যেন আতঙ্কে দুগ্ধবতী মাতার বুকের দুধ জমে দই হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দুষ্ট প্রাণী। ঢাকা হলো সেই প্রাণীর মাথা। আমরা শুধু মাথাটা ভেঙে গুড়ো করে দেব। আমাদের আর কিছু করতে হবে না। ২৭ মার্চ ভোরবেলা আমি কারফিউ তুলে দেব। দেখা যাবে ২৭ মার্চেই ইনশাল্লাহ দেশ ঠিক হয়ে গেছে।
জেনারেল টিক্কা পরম সৌজন্যে টিপট থেকে নিজেই সবার জন্য চা ঢেলে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, শেকসপিয়র তার হ্যামলেটে বলেছিলেন, I have to be cruel only to be kind. VONTAİK FC3orf5 TRICK qKF KKG3 TS21*fr। বাঙালিদের প্রতি দয়া। গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত অংশ শল্যচিকিৎসক কেটে বাদ দেন। তিনি তা করেন রোগীর মঙ্গলের জন্য, রোগী তা বুঝতে পারে না। রোগগ্ৰস্ত বাঙালিকে আমরা বাঁচাব না তো কে বাচাবে? মিটিং-এর শেষ পর্যায়ে তিনি পাঞ্জাবি সৈন্যদের বুদ্ধি-সুদ্ধি নিয়ে একটা রসিকতা করলেন। সেই রসিকতায় এক একজন হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল। একজন জেনারেলের সামনে এভাবে হাসা বড় ধরনের বেয়াদবি, কিন্তু না হেসে পারা যাচ্ছিল না। রসিকতাটা ছিল বড়ই মজার।
জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাৎ হলো গভর্নর হাউসে। ততক্ষণে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়ে গেছে। ভুট্টো খানিকটা উত্তেজিত। অস্থির। তার জানার আগ্রহ, কী হচ্ছে? অপারেশন কোন পর্যায়ে? জেনারেল টিক্কা খান তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। মিলিটারি অপারেশন কী হচ্ছে কীভাবে হচ্ছে তা সিভিলিয়ানদের জানানোর কিছু নেই। উত্তেজিত ভুট্টো রাতেই মিলিটারি কনভয়ের সঙ্গে বের হয়ে শহরের অবস্থা দেখতে আগ্রহী। জেনারেল টিক্কা হাসি হাসি মুখে বলল, No. ভুট্টো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, why no? জেনারেল টিক্কা বলল, Because said no.
ভুট্টো বলল, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
টিক্কা বলল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তিনি এখন পাকিস্তানের পথে।
ভুট্টো আবারো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, এই তথ্যটা আমি কেন জানলাম না? আমিও তো তার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম।
আপনাকে রেখে যাওয়া হয়েছে বিদ্রোহী পূর্ব পাকিস্তানের শান্ত রূপ দেখে যাবার জন্যে। অখণ্ড পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী, কফি খাবেন?
সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী সম্বোধনে ভুট্টোকে খানিকটা তুষ্ট মনে হলো।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সিমন ড্রিং-এর পাঠানো প্ৰত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ঢাকা থেকে পাঠানো প্রথম বিদেশী প্রতিবেদন। তিনি তার দীর্ঘ প্রতিবেদনের এক অংশে লিখলেন–
City lies silent
Shortly before dawn most firing had stopped, and as the sun cane up an eerie silence settled over the city, deserted and completely dead except for the noise of the crows and occasional convoy of troops or two or three tanks rumbling by mopping Up.
At noon again without warning, columns of troops poured into the old section of the city where more than one million fived in a sprawling maze of narrow, winding streets. For the next 11 hours they devasted the old town as it is called.
The lead unit was followed by soldiers carrying cans of gasoline. Those who tried to escape was shot. Those who stayed were burnt alive.
নগরী নীরব
সকাল হবার কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ থেমে গেল, সূর্য উঠল, এক ভৌতিক নীরবতা নগরীকে গ্রাস করল, পরিত্যক্ত ও মৃত এই নগরীতে শুধু শোনা যাচ্ছে কাকের ডাক, মিলিটারি কনভয় ও চলমান ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ।
দুপুরে আচমকা সৈন্যদলের গাড়ি পুরনো ঢাকায় ঢুকে পড়ল, যার গোলকধাঁধার মতো গলিঘুজিতে দশ লাখ মানুষ বাস করেন। পরের এগারোটা ঘণ্টা ধরে চলল ধবংসযজ্ঞ।
অগ্রবর্তী দলের পেছনে পেছনে সৈন্যরা পেট্রোলের টিন হাতে করে যাচ্ছিল। যারা পালাতে চেষ্টা করছিল তাদের গুলি করা হলো। যারা পালালো না তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো।
শাহেদ নিতান্ত অজানা অচেনা এক বাড়িতে আটকা পড়ে আছে। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে সে উপায় না দেখে বিজয়নগরের এই গলিতে ঢুকে পড়েছিল। একতলা একটা বাড়ির বন্ধ গেট টপকে সে প্রাণপণ শক্তিতে বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে উঁকি দিল। ভীত গলায় বলল, কে, কে?
শাহেদ বলল, খুকি, তুমি আমাকে চিনবে না। দরজা খোলো।
দরজা খুলছে না। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি। দরজা খোলো।
খুকির মা দরজা খুললেন। তিনি তার মেয়ের মতোই ভয় পেয়েছেন। তার চোখ-মুখ সাদা। তিনি ভয়ে কাঁপিছিলেন। খুঁকির মা বললেন, বাইরে কী হচ্ছে? শাহেদ বলল, শহরে মিলিটারি নেমে গেছে। সব জানালা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিন। বাতি জ্বেলে রেখেছেন কেন? বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধর শ্লেষ্মাজড়ানো গলা ভেসে এলো, বউমা, দরজা কেন খুললা? তুমি কার সাথে কথা বলো?
শাহেদ বৃদ্ধের কথার জবাব দিতে পারে নি। তার আগেই খুব কাছে কোথাও মটারের গোলা পড়ল। প্রথম গোলার পর দ্বিতীয় গোলা পড়ল। এবারেরটা যেন আরো কাছে। পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো বঁধানো সবকটা ছবি খুলে পড়ে গেল। ঝন ঝন শব্দ হতেই থাকল। কারেন্ট চলে গিয়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। বৃদ্ধ ভয় পেয়ে শিশুর মতো চোঁচাতে লাগলেন, ও বউমা। বউমা।। ও বউমা। তুমি কার সঙ্গে কথা বলো?
বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। গুলির চেয়েও সে অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। নড়বে না। ঘর ভর্তি কাচের টুকরা।
দুঃসময় মানুষকে অতিদ্রুত দলবদ্ধ করে। অরণ্যচারী মানুষ হিংস্ৰ শ্বাপদের ইশারা পেলেই যুথবদ্ধ হতো। সভ্য মানুষের ভেতরেও হয়তো সেই স্মৃতি রয়ে গেছে। আজ এই ভয়াবহ সময়ে তারা চলে এসেছে কাছাকাছি।
মাত্র তিন ঘণ্টা পার হয়েছে–শাহেদ এই পরিবারটির সঙ্গে আছে। এই তিন ঘণ্টায় নিজেকে সে এই পরিবারের একজন সদস্য বলেই মনে করছে। ঢাকা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সানাউল্লাহ সাহেবের স্ত্রীকে তার নিজের ছোটবোনের মতোই মনে হচ্ছে। সানাউল্লাহ সাহেবের বাবাকে সে ডাকছে। চাচাজান। সানাউল্লাহ সাহেবের মেয়েটি সারাক্ষণ তার আঙুল ধরে আছে। মেয়েটির নাম কংকন। সে কংকন বলতে পারে না, নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ককন! মেয়েটির বয়স পাচের কাছাকাছি। এই বয়সে অনুস্বারের উচ্চারণ আয়ত্তে এসে যাওয়া উচিত। মেযেটি মনে হয় কথা বলায় পিছিয়ে আছে। শাহেদ নিতান্তই অপরিচিত একজন তারপরেও সে সানাউল্লাহ সাহেবের শোবার ঘরের খাটে অন্য সবার সঙ্গে বসে আছে।
কংকনের মায়ের নাম এখনো জানা যায় নি। তার শ্বশুর তাকে মানু ডাকছেন। মানু নিশ্চয়ই তার নাম না। বড় নাম ভেঙে আদর করে তিনি হয়তো পুত্রবধূকে ছোট নামে ডাকেন। বৃদ্ধ যে তার পুত্রবধূকে অত্যন্ত পছন্দ করেন তা তার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। তবে তিনি কথার ফাঁকে ফাকে ধমক দিচ্ছেন। কংকনের মা তাতে বিচলিত হচ্ছেন না। কথায় কথায় শ্বশুরের ধমক খেয়ে তার হয়তো অভ্যাস আছে।
ঘরে হারিকেন জ্বালানো হয়েছে। কংকন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি তিনজন তাকিমে আছে হারিকেনের দিকে। অন্ধকারে মানুষ সবসময় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। শুধু ইলেকট্রিক বাতির দিকে তাকায় না। ইলেকট্রিকের আলো চোখে লাগে।
কংকনের মা শাহেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাই, আপনি কি রাতে খেয়েছেন?
শাহেদ বলল, জি না। তবে আমি কিছু খাব না। এই সময় খাওয়ার প্রশ্নই আসে না!
ঘরে খাবার কিছু নেই। গরম ভাত দেই। আর একটা ডিম ভেজে দেই? আমার ক্ষিধে নেই।
বৃদ্ধ খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, বৌমা, আমি তোমার কথাবার্তা, কাৰ্যকলাপে যারপরনাই বিরক্ত। ভাত দেই, ডিম ভেজে দেই,–এইসব কী ধরনের কথা? শুনেছ একটা লোক খায় নাই। তুমি ভাত রোধে, ডিম ভেজে তাকে খেতে ডাকবে। বাড়ির বৌ যদি সভ্যতা-ভব্যতা না জানে কে জানবে? বস্তির মাতারি জানবে?
শাহেদ লজ্জিত গলায় বলল, চাচাজান, আমার একেবারেই ক্ষিধে নেই।
তুমি চুপ কর। গোলাগুলির মধ্যে ক্ষিধা আছে কি নাই বোঝা যায় না। হঠাৎ দেখবে ক্ষিধায় নাড়িতুড়ি জুলছে। বৌমা, তুমি হারিকেন নিয়ে যাও, ভাত চড়াও। একমুঠ চাল বেশি দিও, আমিও চারটা খাব।
কংকনের মা হারিকেন হাতে রান্নাঘরে চলে গেল। শাহেদ বলল, কংকনের বাবা কোথায়?
বৃদ্ধ বিরক্ত গলায় বলল, ঐ গাধাটার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। গাধাটার কথা জিজ্ঞেস করলেই চড়াৎ করে রক্ত মাথায় উঠে যাবে। গাধা গেছে বরিশাল। আমি তাকে বললাম, দেশের অবস্থা ভালো না। এই সময় কোথাও যাবার দরকার নেই। তবু সে গেল।
কোনো জরুরি কাজে গেছেন?
অত্যন্ত জরুরি কাজে গেছে। বন্ধুর বিয়েতে গেছে। আরো গাধা, তোর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার চেয়ে বন্ধুর বিয়ে বড় হয়ে গেল? তোর বউ, মেয়ে, বৃদ্ধ বাবা এইগুলা কিছু না? বউমা বলতে গেলে বাচ্চা একটা মেয়ে। আমি প্রায় পঙ্গু। তুই বসে বসে কোর্মা-কালিয়া খাচ্ছিস আর আমরা খাচ্ছি গুলি। কাণ্ডজ্ঞানহীন শাখামৃগ। তাকে বললাম ট্রানজিস্টারের ব্যাটারি শেষ। ব্যাটারি কিনে দিয়ে যা। সে বলল, জি আচ্ছা বাবা। কিনে দিয়ে গেছে ব্যাটারি? না। উনি ভুলে গেছেন। উনি সবকিছু ভুলে যান, শুধু বন্ধুর বিয়ে মনে থাকে। খা ব্যাটা বিয়ে খা।
বৃদ্ধ হঠাৎ চুপ করে গেলেন। খুব কাছেই গুলির শব্দ হচ্ছে। মানুষের চিৎকার হৈচৈও শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ আতঙ্কিত গলায় বললেন, বৌমা, হারিকেন নিভিয়ে দাও। হারিকেন নিভিয়ে দাও।
কংকনের ঘুম ভেঙে গেছে। সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। বৃদ্ধ বললেন, শাহেদ, মেয়েটার কান্না থামাও। কান্নার শব্দ শুনে মিলিটারি এদিকে চলে আসতে পারে। ওর মুখটা চেপে ধরে।
রাত বাজছে তিনটা পঁচিশ।
কিছুক্ষণের জন্যে গোলাগুলি বন্ধ ছিল। আবারো শুরু হয়েছে। প্রবলভাবেই শুরু হয়েছে। মরিয়মের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আলোয় খেতে বসেছে নাইমুল। সে খুব আগ্রহ করে খাচ্ছে। তারচে অনেক আগ্রহ করে তার খাওয়া দেখছে মরিয়ম। তার শুধু একটাই কষ্ট, নাইমুল খেতে বসে কাঁচামরিচ চেয়েছিল। মরিয়ম কাঁচামরিচ দিতে পারে নি। ঘরে ছিল না। সে ঠিক করে রেখেছে। এরপর থেকে সে নিজের দায়িত্বে কাঁচামরিচ কিনে রাখবে। নাইমুল খেতে বসে কাঁচামরিচ চায়।
মরিয়ম বলল, খেতে ভালো হয়েছে?
নাইমুল জবাব দিল না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। এই মাথা নাড়া দেখতে মরিয়মের ভালো লাগে। সবাই মাথা নাড়ে দুবার। মরিয়মের সম্পূর্ণ নিজের এই মানুষটা তিনবার নাড়ে; মরিয়ম ঠিক করেছে এখন থেকে সে নিজেও মাথা নাড়লে তিনবার নাড়বে। তার সব কিছুই হবে তার নিজের মানুষটার মতো। নাইমুল হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, মরি, বলো তো ঢাকায় সবচে ভালো মোরগপোলাও কোথায় পাওয়া যায়?
মরিয়ম বলল, জানি না।
নাইম বলল, পুরনো ঢাকায় সাইনি পালোয়ানের মোরগপোলাও। তোমাকে একদিন খাওয়াব।
মরিয়ম আদুরে গলায় বলল, কবে?
নাইমুল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি এত সুন্দর! হাসার সময় তার নিজের মানুষটার ঠোঁট কী সুন্দর বাঁকে। তখন ইচ্ছা করে ঠোঁটে হাত দিয়ে ছয়ে দেখতে। এই কাজটা মরিয়ম কোনোদিন করে নি। তবে কোনো একদিন করবে। যদি সে দেখে এতে নাইমুল রাগ করছে না, তা হলে সব সময় করবে। নাইমুল হাসলেই সে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে।
বাইরে গুলির শব্দ হচ্ছে। মরিয়মদের বাড়ি বড় রাস্তার পাশে। রাস্তায় ঘড়ঘড় শব্দে ট্যাংক চলছে। আর তারা কী সুন্দর টুকটাক গল্প করছে! হাসছে। যেন এই পৃথিবীতে তারা দুইজন এবং দুজনের সামনে জ্বলন্ত মোমবাতি ছাড়া আর কিছু নেই।
মরি!
উঁ।
মোরগপোলাওটা যে খাচ্ছি। এটা কে বেঁধেছে?
মা
খুব ভালো হয়েছে। তুমি মোরগপোলাও রাধা শিখে নিও।
আমি কালই শিখব।
নাইমুলের খাওয়া শেষ হয়েছে। সে প্লেটের উপর হাত ধুচ্ছে। মরিয়মের ইচ্ছা করছে হাত ধুইয়ে দিতে। তার লজ্জা এখনো কাটে নি বলে যা যা করতে ইচ্ছা করে তার কোনোটাই করতে পারে না। লজ্জাটা কাটা উচিত।
মরি!
উঁ।
তোমাদের এখানে একটা পাগলা কোকিল আছে। দিনে রাতে সবসময় ডাকে। এখনো ডাকছে।
মনে হয় ভয় পেয়ে ডাকছে, বাইরে গুলি হচ্ছে তো।
ভয় পেয়ে ডাকলে তো কাকদেরও ডাকার কথা। কোনো কাক কিন্তু ডাকছে না।
তাই তো!
পাখিদের মধ্যে সবচে সুন্দর কোন পাখি ডাকে বলো তো?
জানি না। কোন পাখি?
চোখ গেল পাখি। তুমি চোখ গেল পাখির ডাক শুনেছ?
শুনেছি।
চোখ গেল পাখির হিন্দি নাম কী বলো তো?
জানি না।
পিঁউ কাহা।
পিঁউ কাহা তো শুনেছি। এটা যে চোখ গেল পাখি তা জানতাম না।
ইংরেজিতে এই পাখিকে কী বলে জানো?
না।
ইংরেজিতে বলে ব্রেইন ফিভার।
এত কুৎসিত নাম?
কুৎসিত তো বটেই। মরি, তোমার গরম লাগছে না?
লাগছে। একটা কাজ করলে কিন্তু গরমটা কম লাগবে। কী কাজ?
শাড়ি খুলে ফেলো।
মরিয়ম লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল। নাইমুল বলল, আমার সামনে লজ্জা কিসের?
মরিয়ম অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আগে মোমবাতি নেভাও।
নাইমুল বলল, তা হবে না। মোমবাতি জ্বালানো থাকবে। একেক আলোয় মানুষের শরীর একেক রকম দেখায়। ইলেকট্রিকের আলোয় এক রকম, মোমবাতির আলোয় আরেক রকম, আবার মশালের আলোয় সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি দেখতে চাচ্ছি। মোমবাতির আলোয় নগ্ন মরিয়মকে কেমন দেখায়।
আমি পারব না। আগে মোমবাতি নেভাও।
নাইমুল মোমবাতি নেভাল না। মরিয়মের শরীর ঝনঝন করছে। শরীরের প্রতিটি কোষে সাড়া পড়ে গেছে। তারা জেনে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ঙ্কর আনন্দের ঘটনা ঘটবে। মরিয়ম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাতি নেভাও, তোমার দোহাই লাগে। নাইমুল বলল, না। বলেই হাসল। মরিয়মের মনে হলো বাতি না নিভিয়ে ভালোই হয়েছে। বাতি নিভিয়ে ফেললে এত সুন্দর হাসি দেখা যেত না। মরিয়ম হাত বাড়িয়ে নাইমুলের ঠোঁট স্পর্শ করল।