১২. অলৌকিক ঘটনা আসলে কী?

দ্বাদশ অধ্যায় – অলৌকিক ঘটনা আসলে কী? 

এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আমি জাদু নিয়ে কথা বলেছিলাম এবং অতিপ্রাকৃত জাদু [মন্ত্র পড়ে কোনো ব্যাঙকে রাজকুমারে রূপান্তর করা অথবা কোনো প্রদীপ ঘষে জিনকে ডেকে আনা] আর জাদুর খেলা দেখানোর কৌশলের [মায়া, যেমন কোনো রেশমি রুমাল রূপান্তরিত হয় খরগোশে, অথবা কোনো নারীকে কেটে দুইভাগ করা] মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করেছিলাম। আজকাল কেউই আর রূপকথার জাদু বিশ্বাস করে না। প্রত্যেকেই জানেন শুধুমাত্র সিন্ডারেলার রূপকথার গল্পেই কুমড়াকে ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তর করা যায় এবং আমরা সবাই জানি যে, খরগোশ আপাতদৃষ্টিতে খালি কোনো টুপি থেকে বের হয়ে আসে শুধুমাত্র হাতসাফাই ও জাদুর কৌশলের দ্বারা, কিন্তু কিছু অতিপ্রাকৃত গল্প আছে যাদের এখনো বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয় এবং যে ঘটনাগুলোর বিবরণ তারা দেয় সেগুলোকে প্রায়শই বলা হয়, ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক কোনো ঘটনা। এই অধ্যায়টি অলৌকিক ঘটনাগুলো নিয়ে—অতিপ্রাকৃত নানা ঘটনার গল্প, যা বহু মানুষই বিশ্বাস করেন, এর ব্যতিক্রম রূপকথার জাদুমন্ত্র, যা কেউই বিশ্বাস করে না আর জাদুখেলার কৌশলগুলো, যাদের দেখতে জাদুর মতো মনে হলেও আমরা কিন্তু জানি এগুলো আসলে হাতসাফাই আর অন্যান্য কৌশল মাত্র। 

এইসব গল্পগুলোর কিছু ভৌতিক গল্প, অদ্ভুত শহুরে কিংবদন্তি অথবা রহস্যময় কাকতলীয় ঘটনা; সেই গল্পগুলো, যেমন—’আমি এক বিখ্যাত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখেছি, আমি বহুদিন ধরেই যার কথা একেবারেই ভাবিনি, আর পরের দিন সকালে উঠেই আমি শুনলাম তিনি নাকি গত রাতেই মারা গেছেন।’ পৃথিবীব্যাপী বহু শত ধর্ম থেকে আরো অসংখ্য গল্প এসেছে এবং বিশেষভাবে এগুলোকে প্রায়শই বলা হয় ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক ঘটনা। একটি উদাহরণ নেয়া যাক, একটি কিংবদন্তি আছে, প্রায় ২০০০ বছর আগে, একজন যাযাবর ইহুদি ধর্মপ্রচারক, যাঁর নাম ছিল জিসাস, একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যখন সেখানে মদের সরবরাহ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তিনি কিছু পরিমাণ পানি তাঁর কাছে এনে দিতে বলেন ও অলৌকিক ক্ষমতাবলে সেই পানিকে মদে রূপান্তরিত করেন—খুব ভালো মানের মদ, গল্পটি যেভাবে আমাদের বিষয়টি জানায়। যে মানুষগুলো কোনো কুমড়াকে ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে এমন কাহিনি শুনে অবিশ্বাসে হাসেন, আর যাঁরা খুব ভালোভাবেই জানেন যে রেশমি রুমাল আসলে খরগোশে রূপান্তরিত হয় না, তাঁরা কিন্তু পুরোপুরি আনন্দের সাথেই বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের পরিত্রাতা জিসাস পানিকে মদে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং অন্য একটি ধর্মের অনুসারীরা যেমন ভাবেন, তাঁদের নবী ডানাসহ একটি ঘোড়ায় চড়ে স্বর্গে আরোহণ করেছিলেন। 

গুজব, কাকতালীয় ঘটনা আর লাগামহীন গল্প 

সাধারণত যখন আমরা কোনো একটি অলৌকিক ঘটনার কাহিনি শুনি, সেটি সাধারণত কোনো চাক্ষুষ সাক্ষীর কাছ থেকে নয়, বরং এমন কারো কাছ থেকে, যারা এটি আবার শুনেছেন অন্য কারো কাছ থেকে, তিনি আবার সেটি শুনেছেন কারো স্ত্রীর বন্ধুর কোনো আত্মীয়ের কাছ থেকে… এবং যে-কোনো গল্প, যখন অনেক মানুষ সেটি পরস্পরের মধ্যে আদান- প্রদান করে, সেটি বিকৃত হয়ে যায়। এই গল্পের মূল উৎস প্রায়শই একটি গুজব, যা শুরু হয়েছিল বহুদিন আগে এবং বহু মানুষের দ্বারা এটি পুনরাবৃত্তি হবার কারণে সেটি এতই বিকৃত হয়ে যায়, মূল ঘটনাটি কী ঘটেছিল—যদি কিছু থেকে থাকে—যা এটির সূচনা করেছিল—সেটি অনুমান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

প্রায় যে-কোনো বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুর পর, নায়ক কিংবা খলনায়ক যাই হোক-না কেন, কেউ-না-কেউ তাদের কোথাও দেখেছে এমন গল্প সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এলভিস প্রিসলি, মেরিলিন মনরো, এমনকি অ্যাডলফ হিটলারের ক্ষেত্রে এটি সত্য। খুব কঠিন বিষয়টি জানা, কেন মানুষ এমনসব গুজব ছড়িয়ে আনন্দ পান যখন তাঁরা সেগুলো শোনেন, কিন্তু বাস্তব সত্য যে, তাঁরা সেটি করেন, আর গুজব কেনই-বা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এটি সেই কারণের একটি বিশাল অংশ। 

কিভাবে এমন গুজবের শুরু হয় সেটি বোঝার জন্যে সাম্প্রতিক একটি উদাহরণের কথা ধরা যাক : ২০০৯ সালে মাইকেল জ্যাকসন মারা যাবার অল্প কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের একদল টেলিভিশন কর্মীকে তাঁর বিখ্যাত প্রাসাদ, নেভারল্যান্ডে একটি গাইডসহ ট্যুর দেয়া হয়েছিল। এর পরিণতিতে সৃষ্ট ফিল্মের একটি দৃশ্যে, মানুষেরা ভেবেছিল তারা একটি লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় একটি অশরীরী আত্মাকে দেখেছে। পুরো সেই দৃশ্যটির রেকর্ডিং অবশ্যই পুরোপুরিভাবে আস্থা স্থাপন করার মতো যথেষ্ট ভালো মানের ছিল না, তবে, একটি উন্মত্ত গুজব ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে এটি যথেষ্ট ছিল। মাইকেল জ্যাকসনের ভূত দেখা গেছে! খুব দ্রুত বহু হুবহু মিথ্যা দাবি আসতে শুরু করে, যেখানে মাইকেল জ্যাকসনকে একাধিক জায়গায় দেখা গিয়েছে, যেমন—একজন ব্যক্তির তোলা একটি আলোকচিত্রে যেখানে তিনি বেশ পালিশ করা গাড়ির একটি পাশে ছবি তুলেছিলেন। আমার আপনার কাছে যখন আমরা ‘চেহারা’ তুলনা করি যার দুই পাশে মেঘ, আমরা যা দেখি অবশ্যই সেই একটি মেঘের প্রতিফলন, কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ কোনো ভক্তের অতি উর্বর আর উত্তপ্ত কল্পনায় কাছে এটি শুধুমাত্র মাইকেল জ্যাকসনের অশরীরী আত্মাই হতে পারে এবং ইউ টিউবে সেই ছবির মোট হিটসংখ্যা ১৫ মিলিয়ন! 

আসলেই, এখানে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে, যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। মানুষ হচ্ছে সামাজিক প্রাণী, মানুষের মস্তিষ্ক অন্য মানুষদের চেহারা দেখার জন্যে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা থাকে, যখন কোনো মানুষের মুখ সেখানে অনুপস্থিত। আর একারণে পাউরুটির একটি স্লাইসে, দেয়ালের ভেজা অংশে সৃষ্ট এলোমেলো প্যাটার্নে মানুষ প্রায়শই কোনো মুখের ছায়া দেখে। 

শিরদাঁড়ায় শিহরণ তোলা ভূতের গল্পগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগে, বিশেষ করে যদি তারা আসলেই খুবই ভীতিকর হয় এবং আরো বেশি হয় যদি আপনি দাবি করেন গল্পগুলো সত্য। যখন আমার বয়স ছিল মাত্র আট, আমার পরিবার খুব অল্পসময়ের জন্য একটি বাড়িতে বসবাস করেছিল, যার নাম ছিল কাক্কুস, প্রায় ৪০০ বছরে প্রাচীন একটি বাড়ি, নড়বড়ে কালো টুডোর বিম সহ। বিস্ময়কর নয়, এই বাড়িটি ঘিরে একটি কিংবদন্তি ছিল, আর সেটি এই বাড়ির কোনো একটি গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা বহুদিন আগেই মৃত যাজক সম্বন্ধে। একটি গল্প ছিল যেখানে আপনি তার পায়ের শব্দ শুনতে পারবেন সিঁড়িতে, কিন্তু একটি বাড়তি রহস্যময়তাসহ, আপনি একটি ধাপ বেশি উঠতে শুনবেন—ভুতুড়ে একটি ব্যাখ্যা সেটির সমর্থনে আছে যে, ষোড়শ শতাব্দীর বাড়িগুলোর সিঁড়িতে একটি বাড়তি ধাপ থাকত। আমি সেই আনন্দটি মনে করতে পারছি যখন আমি সেই গল্পটি আমার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এমন ঘটনার সপক্ষে প্রমাণগুলো কত শক্ত ছিল সেটি জিজ্ঞাসা করতে আমার কখনোই মনে হয়নি। 

বাড়িটি যে পুরনো সেটাই যথেষ্ট ছিল আমার ও আমার বন্ধুদের মুগ্ধ হবার জন্য। ভূতের গল্প ভাগাভাগি করার মাধ্যমে সবাই খুব আনন্দ অনুভব করে। একইভাবে বিষয়টি সত্য অলৌকিক গল্পগুলোর ক্ষেত্রে। যদি কোনো একটি অলৌকিক ঘটনার গুজব কোনো একটি বইয়ে লেখা হয়ে থাকে, সেই গুজবটি খুব কঠিন হয়ে পড়ে চ্যালেঞ্জ করার জন্য, বিশেষ করে বইটি যদি প্রাচীন হয়। যদি গুজবটি যথেষ্ট পুরনো হয়, এটিকে গুজবের পরিবর্তে ট্রাডিশন বা আচার হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন মানুষ এটিকে আরো বেশি বিশ্বাস করে। বিষয়টি বরং বেশ অদ্ভুত কারণ আপনি হয়তো ভাবেন যে তারা বুঝতে পারে যে বিকৃত হবার জন্য নতুন গুজবগুলোর তুলনায় পুরাতন গুজবগুলোর অনেক বেশি সময় থাকে। কারণ নতুন গুজবগুলো সেই তথাকথিত ঘটনাগুলোর কাছাকাছি সময়ের। এলভিস প্রিসলি এবং মাইকেল জ্যাকসন খুব সাম্প্রতিক সময়ে বেঁচে ছিলেন, কোনো আচার গড়ে ওঠার সময় পায়নি, সুতরাং খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস করেনি সেই গল্পগুলো, যেমন ‘এলভিসকে মঙ্গল গ্রহে দেখা গেছে’, কিন্তু হয়তো আরো ২০০০ বছর পরে…? 

সেই অদ্ভুত গল্পগুলো তাহলে কী যা অনেকেই বলেন, যেমন—তাঁরা এমন কাউকে স্বপ্নে দেখেছেন, বহু বছর ধরে যাঁদের তাঁরা দেখেননি বা তাঁদের কথা ভাবেনি। তারপর ঘুম থেকে উঠেই সেই মানুষটির কাছ থেকে আসা চিঠি তাঁরা পড়ে থাকতে দেখেন তাঁদের দরজার সামনের ম্যাটের উপর? অথবা ঘুম থেকে উঠে শোনেন বা পড়েন যে সেই মানুষটি মারা গেছে গত রাতেই? এই ধরনের অভিজ্ঞতা আপনারও হয়েছে, কিভাবে আমরা এইসব কাকতলীয় ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করতে পারি? 

বেশ, সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে সেগুলো আসলে যা সেটাই, কো- ইনসিডেন্স বা কাকতালীয় ঘটনার বেশি কিছু নয়। মূল বিষয়টি হচ্ছে শুধুমাত্র এই গল্পগুলো বলার আমরা প্রয়োজন বোধ করি, যখন যুগপৎ বিস্ময়কর ঘটনাগুলো ঘটে—যখন ঘটে না তখন নয়। কেউ কখনো বলে না যে, ‘গত রাতে আমি আমার সেই চাচাকে স্বপ্নে দেখেছি, যাঁর কথা আমি বহু বছর ধরেই ভাবিনি এবং ঘুম থেকে আবিষ্কার করেছি তিনি সেই রাতে মারা যাননি।’ 

এই যুগপৎ ঘটনাগুলো যত বেশি ভুতুড়ে হবে, ততই বেশি সম্ভাবনা থাকবে সেই খবরটি বিস্তার লাভ করার জন্য। কখনো এটি কোনো মানুষকে এতই বিচলিত করে যে তিনি খবরের কাগজে চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হয়তো তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, প্রথমবারের মতো, কোনো এক সময়ে বিখ্যাত কিন্তু বহুদিন ধরেই বিস্মৃত অতীতের কোনো নায়িকা, তারপর তিনি ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করেন সেই অভিনেত্রী সেই রাতেই মারা গেছেন। ‘স্বপ্নে শেষ বিদায়’, খুবই ভুতুড়ে অদ্ভুত ব্যাপার! কিন্তু শুধুমাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে একটু ভাবুন আসলেই কী ঘটেছিল। কোনো একটি যুগপৎ ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ হবার জন্যে শুধুমাত্র সেই পত্রিকাটির বহু মিলিয়ন পাঠকের একজনের অভিজ্ঞতা হলেই হবে, যিনি হয়তো পত্রিকায় সেই চিঠিটি পাঠাবেন। আমরা যদি শুধুমাত্র ব্রিটেনের কথাই ধরি, প্রতিদিন ২০০০ মানুষ সেখানে মারা যান, অবশ্যই সেখানে প্রতিরাতে দেখা হয় এমন স্বপ্নের সংখ্যা একশত মিলিয়ন। যখন আপনি বিষয়টি নিয়ে সেভাবে দেখবেন, আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে আশা করতে পারি যে মাঝে মাঝে কেউ কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠে আবিষ্কার করবেন যে তাঁরা সেই রাতে মারা গেছেন এমন কাউকে স্বপ্নে দেখেছেন এবং শুধুমাত্র তাঁরাই খবরের কাগজে প্রকাশ করতে তাদের গল্পগুলো পাঠাবেন 

এই গল্পগুলোয় আরো একটি জিনিস ঘটে সেটি হচ্ছে বহুবার পুনরাবৃত্তি হবার কারণে এটি কলেবরেও বাড়ে। মানুষ কোনো ভালো গল্প এতই উপভোগ করেন যে প্রথমবার যা তাঁরা শুনেছিলেন, গল্পটিকে আরো বেশি সুন্দর করে তোলার জন্যে তাঁরা এটি আরো বেশি করে অলঙ্কৃত করেন। কোনো গল্প অতিরঞ্জিত করে বলে শ্রোতাদের শিহরিত করার মজা অনেক বেশি, সামান্য কিছু অতিরঞ্জন, আরেকটু বেশি রঙিন করে তোলার জন্যে এবং এর পরের মানুষটা সেই গল্প আরেকজনকে বলবে আরো খানিকটা অতিরঞ্জিত করে এবং এভাবে চলতে থাকবে। যেমন—ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলেন যে-কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি রাতে মারা গেছেন, আপনি হয়তো অনুসন্ধান করবেন জানতে ঠিক কিভাবে তিনি মারা গেছেন। উত্তর হয়তো এমন পাবেন, ‘ওহ! ভোর তিনটার কাছাকাছি কোনো সময়ে অবশ্যই হবে।’ তারপর আপনি ভেবে বের করবেন যে আপনি হয়তো তাকে ভোর তিনটার কাছাকাছি কোনো সময়ে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং আপনি বুঝে ওঠার আগেই, কাছাকাছি বা এর আশেপাশে শব্দগুলো গল্প থেকে বের হয়ে যাবে যখন এটি এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়বে যতক্ষণ-না গল্পটি রূপান্তরিত হয়, ‘ঠিক ভোর তিনটায় তিনি মারা গিয়েছিলেন, আর ঠিক সেটাই সেই সময় যখন আমার কাজিনের বন্ধুর স্ত্রীর নাতনি তাঁকে স্বপ্নে দেখছিল।’ 

কখনো কখনো আমরা আসলেই অদ্ভুত যুগপৎ কোনো ঘটনার একটা ব্যাখ্যা শনাক্ত করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন যক্ষ্মার আক্রমণে এবং যখন তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, ঘরের একটি ঘড়ি ঠিক সেই মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! কিন্তু ড. ফাইনম্যান বিনা কারণে সেরা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচিত হননি। তিনি এর সঠিক ব্যাখ্যাটি খুঁজে পেয়েছিলেন। ঘড়িটির কিছু সমস্যা ছিল। যদি সেটি হাতে নিয়ে আপনি খানিকটা একপাশে কাত করেন, এটি বন্ধ হয়ে যায়। যখন মিসেস ফাইনম্যান মারা যান, নার্সের প্রয়োজন ছিল অফিসিয়াল ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য সঠিক সময়টি রেকর্ড করা। রোগীর রুমটি খানিকটা অন্ধকার ছিল, সুতরাং নার্স সেটি হাতে নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে কাত করেছিলেন আলোয় সেটা দেখার জন্য। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘড়িটি বন্ধ হয়ে যায়। কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, শুধুমাত্র যান্ত্রিক একটি ত্রুটি। 

যদি এমন কোনো ব্যাখ্যা না-ও থেকে থাকে, যদি ঘড়ির স্প্রিং প্যাচ দিয়ে ঠিক সেই সময়ে আসলেই বন্ধ করা হয়েছে যখন মিসেস ফাইনম্যান মারা গিয়েছিলেন, আমাদের আদৌ বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কোনো সন্দেহ নেই প্রতিটি দিন ও রাতের যে-কোনো মিনিটেই যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঘড়িই বন্ধ হতে পারে এবং প্রতিদিনই বহু মানুষও মারা যান। আমাদের আগের বক্তব্যটিকে পুনরাবৃত্তি যদি করি, আমরা তখন এমন কোনো সংবাদ ছাড়ানোর তাগিদ অনুভব করি না যে ‘আমার ঘড়িটি ঠিক বিকাল চারটা পঞ্চাশ মিনিটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল… আর [আপনি কি বিশ্বাস করবেন?] কেউই মারা যায়নি।’ 

ম্যাজিকের ওপর অধ্যায়টিতে প্রতারকদের একটি শ্রেণির কথা আমি উল্লেখ করেছিলাম যারা ভান করে যে তারা তাদের ‘চিন্তার শক্তি’ ব্যবহার করে কোনো ঘড়ি আবার সচল করতে পারে। সে হয়তো টেলিভিশনে তার অনেক দর্শককে আমন্ত্রণ জানাবে বাসার যে-কোনো একটি ভাঙা ঘড়ি নিয়ে সেটি শক্ত করে দুহাতে ধরতে যখন সে দূর থেকে তার চিন্তার শক্তি ব্যবহার করে এটিকে আবার সচল করতে চেষ্টা করবে। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে স্টুডিওতে ফোন বেজে উঠবে, একটি প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর অন্য প্রান্ত থেকে জানাবে, বিস্ময়ের স্বরে, যে তাদের ঘড়িটি সচল হয়েছে। 

আংশিকভাবে এর ব্যাখ্যা হয়তো মিসেস ফাইনম্যানের ঘড়ির কেসের মতো। সম্ভবত এটি অপেক্ষাকৃত কম সত্য হবে কোনো আধুনিক ডিজিটাল ঘড়ির জন্যে, কিন্তু সেইসব দিনগুলোয় যখন ঘড়িতে স্প্রিং ব্যবহার করা হত, শুধুমাত্র ঘড়িটি হাতে তুলে নিলেই কখনো কখনো এটি আবার চালু হয়ে যেত, কারণ হঠাৎ একটি নড়াচড়া ঘড়ির হেয়ার স্প্রিঙের ব্যালান্স হুইলটিকে সক্রিয় করে ফেলতে পারে। এটি দ্রুত আর সহজে ঘটতে পারে যদি ঘড়িটিকে খানিকটা উষ্ণ করে নেয়া যেতে পারে, আর কোনো ব্যক্তির হাতের উষ্ণতাই যথেষ্ট সেই কাজটি করার জন্য। যদিও প্রায়শই এমনকিছু ঘটে না, কিন্তু এটি অবশ্যই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যখন আপনার কাছে প্রায় ১০,০০০ মানুষ আছে, সারা দেশ জুড়ে, যাঁরা থেমে থাকা ঘড়ি তাঁদের হাতে ধরেছিলেন, হয়তো তাঁরা ঝাঁকিয়েছেন, তারপর তাঁদের উষ্ণ হাতের মধ্যে ধরে রেখেছেন। ঘড়ির মালিকের ফোন করে সেই উত্তেজনাপূর্ণ খবরটি দেয়া ও বাকি টেলিভিশন দর্শকদের বিস্মিত করার জন্য সেই ১০,০০০ ঘড়ির মাত্র একটিকে শুধুমাত্র চালু হতে হবে। আমরা কখনোই বাকি ৯৯৯৯ ঘড়ির কথা শুনি না, যেগুলো সচল হয়নি। 

অলৌকিক ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবার একটি উত্তম উপায় 

অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত একজন স্কটিশ চিন্তাবিদ ছিলেন ডেভিড হিউম, তিনি অলৌকিক কোনো ঘটনা সম্বন্ধে বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রস্তাব করেছিলেন। অলৌকিক হিসেবে দাবি করা ঘটনাগুলোকে প্রাকৃতিক নিয়মের ‘সীমালঙ্ঘন’ [অথবা নিয়মভঙ্গ কিংবা আইনের বরখেলাপ] হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তিনি শুরু করেছিলেন। পানির উপর হাঁটা অথবা পানিকে মদে রূপান্তরিত করা, চিন্তার শক্তি দিয়ে কোনো ঘড়ি বন্ধ করা বা চালানো অথবা কোনো ব্যাঙকে রাজকুমারে রূপান্তর করা ভালো কিছু উদাহরণ হতে পারে, যেখানে ঘটনাগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করছে। এই ধরনের কোনো অলৌকিক ঘটনা বিজ্ঞানের জন্য খুবই অস্বস্তিকর একটি বিষয় হবে নিশ্চয়ই, আর তার কারণগুলো নিয়ে আমরা ম্যাজিক বা জাদু সংক্রান্ত অধ্যায়ে আলোচনা করেছিলাম। মানে, যদি সেগুলো আসলেই ঘটে থাকে, সেগুলো বেশ অস্বস্তিকর। তাহলে এই অলৌকিক ঘটনাগুলোর প্রতি আমাদের কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত? এই প্রশ্নটি সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন হিউম এবং তাঁর উত্তর ছিল সেই বুদ্ধিমান বিষয়টি যা আমি উল্লেখ করলাম। 

হিউমের আসল বাক্যটি কী ছিল আপনি যদি সেটি জানতে চান, আমি এখানে সেটি উল্লেখ করছি আবার, কিন্তু আপনার মনে রাখতে হবে তিনি এগুলো লিখেছিলেন দু শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, আর সেই সময় থেকে ইংরেজি লেখার রীতিও বহু বদলে গেছে : 

‘কোনো একটি অলৌকিক ঘটনা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো প্ৰমাণই যথেষ্ট নয়, যদি-না সেই প্রমাণগুলো এমন ধরনের হয় যে, এর মিথ্যাভাষণ যে ঘটনাটিকে এটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে, তার চেয়েও বেশি অলৌকিকতাপূর্ণ হয়।’ 

আসুন হিউমের কথাগুলো অন্যভাবে বলা যাক। যদি জন আপনাকে অলৌকিক কোনো ঘটনার কথা বলে, আপনার সেটি বিশ্বাস করা উচিত শুধুমাত্র যদি সেটির মিথ্যা [বা একটি ভ্রান্ত ধারণা অথবা একটি বিভ্রম] হওয়ার বিষয়টি আরো বেশি অলৌকিক কোনো ঘটনা হয়। যেমন— আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘আমি আমার জীবন বাজি রেখে জনকে বিশ্বাস করতে পারি, সে কখনোই মিথ্যা কোনো কথা বলবে না। আসলেই অলৌকিক ঘটনা হবে যদি জন কখনো মিথ্যা বলে।’ বেশ, কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু হিউম এমনকিছু বলতেন, : ‘জন কখনো মিথ্যা বলতে পারে বিষয়টি যত অসম্ভাব্য হোক-না কেন, কিন্তু সেটি কি আসলেই আরো বেশি অসম্ভাব্য সেই অলৌকিক ঘটনাটির চেয়ে যা জন দেখেছে বলে দাবি করছে?’ ধরুন, জন দাবি করেছিল সে চাঁদের উপর দিয়ে একটি গরুকে লাফ দিতে দেখেছে। সাধারণভাবে জন যতই নির্ভরযোগ্য আর সৎ হোক- না কেন, সে মিথ্যা বলছে এমন ধারণাটি [অথবা একটি সৎ বিভ্রম হয়েছে চাঁদের উপর দিয়ে আক্ষরিকার্থে কোনো গরুর লাফ দেয়ার মতো ঘটনার চেয়ে কম অলৌকিক একটি বিষয় হবে। সুতরাং আপনার উচিত হবে জন মিথ্যা বলেছে [অথবা ভুল করছে] সেই ব্যাখ্যাটাকে শ্রেয়তর মনে করা। 

এটি ছিল একটি চরম আর কাল্পনিক উদাহরণ। এমনকিছু নিয়ে আলোচনা করা যাক যা আসলেই ঘটেছিল, যেন আমরা দেখতে পারি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে হিউমের ধারণা কিভাবে কাজ করতে পারে। ১৯১৭ সালে দুজন ইংরেজ জ্ঞাতিবোন, ফ্রান্সিস গ্রিফিথ ও এলসি রাইট কিছু ছবি তুলেছিলেন, যা পরীদের বা ফেয়ারিদের ছবি বলে পরে তাঁরা দাবি করেছিলেন। আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে, এই ছবিগুলো অবশ্যই নকল ছিল, কিন্তু একই সাথে, যখন আলোকচিত্র আসলেই বেশ নতুন কিছু ছিল, এমনকি বিখ্যাত লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, কোনোভাবে যাঁকে বোকা বলা যাবে না, সেই বিখ্যাত শার্লক হোমসের স্রষ্টাও বিষয়টি বিশ্বাস করেছিলেন, আর তেমনভাবে অনেক মানুষই সেটি বিশ্বাস করেছিলেন। বহু বছর পর, যখন ফ্রান্সিস আর এলসি বৃদ্ধা, তাঁরা সত্যটা স্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন যে তাঁদের তোলা ছবির ফেয়ারিরা আসলে কার্ডবোর্ড কাটআউট, কিন্তু আসুন, হিউমের মতো ভাবা যাক এবং জানার চেষ্টা করি কেন কোনান ডয়েল আর অন্যেরা, সেই বুদ্ধিমান মানুষদের চোখে কেন এই চালাকিটা ধরা পড়ল না। নিচের দুটি সম্ভাবনার মধ্যে কোনটি আপনি মনে করেন আরো বেশি অলৌকিক কিছু হবে, যদি সেটি সত্য হয়? 

[১] আসলেই ফেয়ারিরা আছে, ক্ষুদ্র ডানাওয়ালা পরীদের দল, যারা ফুলের মধ্যে উড়ে বেড়ায়। 

[২] এলসি আর ফ্রান্সিস পুরো বিষয়টি বানিয়ে বলেছেন, তাঁরা ছবিগুলোতে কারসাজি করেছেন। 

এই দুটি প্রস্তাবনার মধ্যে আসলেই সত্যিকারের কোনো প্রতিযোগিতা নেই, তাই না? শিশুরা সবসময়ই মনগড়া নানা বিষয় নিয়ে খেলে এবং খুবই সহজ সেটি করা। যদি সেটি করা খুব কঠিনও হয়, যদি আপনি অনুভব করে থাকেন যে আপনি ফ্রান্সিস আর এলসিকে খুবই ভালোভাবে চেনেন এবং তাঁরা সবসময় সত্য কথা বলেন এমন মেয়ে, যাঁরা কখনো এমন কোনো কারসাজি করার কথা কল্পনাও করতে পারবেন না, যদি মেয়েদুটিকে সত্যি কথা বলানোর কোনো ওষুধ দেয়া হয় এবং তাঁরা মিথ্যা শনাক্ত করার পরীক্ষা অনায়াসে উৎরেও যান, যদি এইসব মিলে এমন কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় যে তাঁরা যদি মিথ্যা বলেন সেটি বরং অলৌকিক কোনো ঘটনা হবে, তাহলে এখানে হিউম কী বলতেন? তিনি বলতেন তাঁদের মিথ্যা বলার ‘অলৌকিক’ ঘটনাটি তারপরও ফেয়ারিদের আসলেই অস্তিত্ব আছে এমন কোনো দাবির অলৌকিকতার চেয়েও অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার অলৌকিক ঘটনা হবে। 

এলসি এবং ফ্রান্সিস তাঁদের সেই ছলনার দ্বারা বড় কোনো ক্ষতি করেননি, বরং এটি হাস্যকর যে তাঁরা বিখ্যাত আর্থার কোনান ডয়েলকে বোকা বানিয়েছিলেন, কিন্তু কখনো কখনো অল্পবয়সীদের এই ধরনের দুষ্টুমি হাস্যকর কোনো ব্যাপার নয়, যদি হালকাভাবে বলা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডে সালেম নামে একটি গ্রামে, এক গ্রুপ অল্পবয়সী মেয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল ‘ডাইনি’দের নিয়ে এবং তারা কল্পনা করতে অথবা গল্প বানিয়ে বলতে শুরু করে ছিল নানা বিষয় নিয়ে যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সমাজে খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাপ্তবয়স্করা বিশ্বাস করেছিল। বহু প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও কিছু পুরুষকে শয়তানের সহচরী ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল বালিকাদের ওপর ডাকিনীবিদ্যার জাদুর মন্ত্র আরোপ করার জন্য, যারা দাবি করেছিল তারা তাদের বাতাসে মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছে অথবা অদ্ভুত কিছু তারা তাদের করতে দেখেছে যা সাধারণত লোকপ্রিয় ঐতিহ্যে মনে করা হয় ডাইনিরা করে থাকে। আর এর পরিণতি হয়েছিল খুবই ভয়ঙ্কর। বালিকাদের দেয়া সাক্ষ্য মোট বিশ জনের ফাঁসির কারণ হয়, একজন পুরুষকে পাথরের নিচে আনুষ্ঠানিকভাবে পিষ্ট করে হত্য করা হয়, নিরপরাধ কারোর জন্য এমনকিছু ঘটা আসলে ভয়াবহ, শুধুমাত্র তাদের অপরাধের কারণ যখন এক গ্রুপ শিশুদের বানানো গল্প। আমি না ভেবে পারছি না কেন বালিকারা এই কাজটি করেছিল। তারা কি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল? এটি কি নিষ্ঠুর সাইবার বুলি করার মতো কিছু যা প্রায়ই এখন ঘটে ই-মেইল কিংবা সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয়? অথবা তারা আসলে তাদের বানানো গল্পগুলো আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিল? 

আবার সার্বিকভাবে অলৌকিক ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসা যাক, বিশেষ করে কিভাবে তাদের সূচনা হয়। দুই বালিকার বানানো অদ্ভুত কোনো গল্প আর সেটি ব্যাপকহারে বিশ্বাস করার ঘটনাগুলোর মধ্যে হয়তো সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাটি হচ্ছে, ১৯১৭ সালের তথাকথিত ‘মিরাকল অব ফাতিমা’। ১৯১৭ সালে পর্তুগালে, দশ বছরের মেষপালিকা লুসিয়া এবং তার চেয়ে বয়সে ছোট দুই জ্ঞাতিবোন, ফ্রান্সিসকো আর জাসিন্টা, দাবি করেছিল যে পাহাড়ের উপর তারা একটি ‘বিশেষ দৃশ্য’ দেখেছে। তারা বলেছিল এই পাহাড়ে একজন রমণী ঘুরে বেড়ান, যাঁর নাম ‘ভার্জিন মেরি’, যদিও বহুদিন আগে থেকে তিনি মৃত, তবে স্থানীয় ধর্মে তাঁর দেবীসদৃশ একটি অবস্থান ছিল। লুসিয়া’র ভাষ্য অনুযায়ী, অশরীরী মেরি তার সাথে কথা বলেছিলেন, তাকে ও অন্য শিশুদের বলেছিলেন, তিনি প্রতি মাসের ১৩তম দিনে এখানে আসবেন অক্টোবরের ১৩ তারিখ অবধি, তখন তিনি একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটাবেন তিনি নিজেকে যা দাবি করছেন সেটি প্রমাণ করা জন্যে। প্রত্যাশিত অলৌকিক ঘটনার গুজব সারা পর্তুগালে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেই বিশেষ দিনে ৭০,০০০-এর বেশি মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অলৌকিক ঘটনাটি, যখন সেটি ঘটেছিল, সেটি ছিল সূর্য-সংশ্লিষ্ট, কিন্তু সূর্য সেদিন ঠিক কী করেছিল সেটি সম্বন্ধে সেখানে উপস্থিত দর্শকদের ভাষ্যে তারতম্য আছে। উপস্থিত কিছু সাক্ষীর কাছে মনে হয়েছে এটি নেচে উঠেছিল, অন্যদের কাছে এটি নাকি একটা ক্যাথেরিন হুইল [এক ধরনের আতশবাজি] বা চাকার মতো বন বন করে ঘুরেছিল। সবচেয়ে নাটকীয় দাবিটি ছিল এরকরম : ‘… মনে হয়েছিল সূর্য আকাশ থেকে মুক্ত হয়ে ছিঁড়ে বের হয়ে এসেছিল এবং ভীতসন্ত্রস্ত জনগণের উপর আছড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ঠিক যখন মনে হয়েছিল আগুনের গোলকটি তাদের উপর পড়ে তাদের ধ্বংস করে দেবে। সেই অলৌকিক কাণ্ডটি থেমে যায় এবং সূর্য আকাশে তার আগের জায়গায় ফিরে যায় এবং তারপর সেখান থেকে সেই শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আলো দিয়ে যাচ্ছে।’ 

এখন বলুন, সেদিন আসলেই কী ঘটেছিল বলে আপনি মনে করেন? ফাতিমায় কি আসলেই অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটেছিল? আসলেই কি অশরীরী মেরি সেখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন? খুবই সুবিধাজনকভাবে তিনি সেই তিন শিশু ছাড়া আর কারো চোখে ধরা দেননি, সুতরাং আমরা এই কাহিনির সেই অংশটি খুব বেশি গুরুত্বের সাথে নিতে পারব না, কিন্তু সূর্যের সেই অদ্ভুত অবস্থান পরিবর্তন করার ঘটনাটির সাক্ষী প্রায় ৭০, ००० মানুষ, এই বিষয়ে আমাদের কী ভাবার আছে? আসলেই কি সূর্য সত্যিকারভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিল [নাকি পৃথিবী নড়ে উঠেছিল সূর্যের অবস্থানের সাথে আপেক্ষিকভাবে]? হিউমের মতো করেই আসুন বিষয়টি নিয়ে ভাবি। তিনটি সম্ভাবনার কথা আমরা ভাবতে পারি—

[১] সূর্য আসলেই সেদিন আকাশে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিল এবং আতঙ্কিত জনগণের দিক বরাবর নিচে নেমে এসেছিল, আবার তার আগের অবস্থানে ফিরে যাবার আগে। [অথবা পৃথিবী তার ঘূর্ণনের ধরনটি বদলে ফেলেছিল এমনভাবে যে দেখে মনে হয়েছিল সূর্য তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে]। 

[২] সূর্য কিংবা পৃথিবী, দুটোর কোনোটাই আসলেই আদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং উপস্থিত ৭০,০০০ মানুষ একইসাথে একটি হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টি-বিভ্রমের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। 

[৩] কিছুই ঘটেনি, পুরো ঘটনাটি নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে, অতিরঞ্জিত করা হয়েছে, অথবা পুরো ব্যাপারটাই মনগড়া। 

এই তিনটি সম্ভাবনার কোনটিকে আপনি সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে করেন? তিনটি সম্ভাবনার যে-কোনোটিরই ঘটার সম্ভাবনা কম, কিন্তু নিশ্চয়ই তৃতীয় সম্ভাবনাটি ঘটার সম্ভাবনা অন্যগুলোর চেয়ে খানিকটা বেশি, এই ঘটনাটিকে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে করা দাবিটি এখানে সবচেয়ে দুর্বল। তৃতীয় সম্ভাবনাটি গ্রহণ করতে আমাদের শুধুমাত্র বিশ্বাস করতে হবে কেউ-না-কেউ মিথ্যা বলেছেন যখন রিপোর্ট করা হয়েছিল যে ৭০,০০০ মানুষ সূর্যকে নড়তে দেখেছে, আর সেই মিথ্যাটি বহু পুনরাবৃত্তি হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক যে-কোনো জনপ্রিয় আরবান লিজেন্ডের মতো যা ইদানীংকালে ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ায়। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঘটার সম্ভাবনা বেশ কম, কারণ এটি মানার জন্যে আমাদের বিশ্বাস করা দরকার যে একইসাথে ৭০,০০০ মানুষ সূর্যকে নিয়ে একটি হ্যালুসিনেশনের আক্রান্ত হয়েছিলেন। যদিও ক্ষীণ, কিন্তু যতই অসম্ভাব্য প্ৰায় অলৌকিক—দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকে মনে করা হোক-না কেন এবং প্রথম সম্ভাবনার চেয়ে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির অলৌকিক কোনো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। 

অর্ধেক পৃথিবীতে যেখানে দিনের আলো বিদ্যমান সেখানে সূর্য দৃশ্যমান, শুধুমাত্র পর্তুগালের একটি শহরে নয়। যদি এটি সত্যি তার জায়গা থেকে সরে যেত, পুরো গোলার্ধ ধরে বহু মানুষ—–শুধু ফাতিমার বাসিন্দারাই নয়—হতবাক আর দিশেহারা হয়ে যেতেন। আসলেই সম্ভাবনা ১-এর বিরুদ্ধে যুক্তি আরো বেশি শক্তিশালী। যদি সূর্য আসলেই সেই গতিতে তার অবস্থান পরিবর্তন করত, যেমনটি বলা হয়েছে—মানুষগুলোর উপর ভেঙে পড়ার মতো অথবা এমনকিছু যদি হত যা পৃথিবীর ঘূর্ণনকে যথেষ্ট পরিমাণ বদলে দেয়, যেন দেখে মনে হতে পারে অবিশ্বাস্য গতিতে সূর্য তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে—আমাদের সবার জন্য সেটি এক মহাবিপর্যয়ের পরিসমাপ্তি হত। হয় পৃথিবী ধাক্কা খেয়ে তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ত এবং এতক্ষণে সেটি মহাশূন্যে ছুটে বেড়ানো প্রাণহীন, শীতল একটি পাথরে রূপান্তরিত অথবা আমরা সূর্যের দিকে ধেয়ে যেতাম ও ভস্মে পরিণত হতাম। অধ্যায় ৫-এর আলোচনা থেকে মনে করে দেখুন প্রতি ঘণ্টায় বহু শত মাইল গতিতে পৃথিবী ঘুরছে [প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ মাইল বিষুবরেখায় যদি এটি মাপা হয়], কিন্তু তারপরও সূর্যের আপেক্ষিক গতি অনেক কম আমাদের দেখার জন্যে, কারণ এটি বহু দূরে। যদি সূর্য আর পৃথিবী হঠাৎ করে একে অপরের সাপেক্ষে খুব দ্রুত এমনভাবে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে যে, উপস্থিত মানুষেরা সূর্যকে তাদের দিকে ‘ধেয়ে’ আসতে দেখেন, আসল গতি তাহলে সাধারণ পরিস্থিতি থেকে বহু হাজার গুণ দ্রুত হতে হবে, আর আক্ষরিকভাবে এর অর্থ : পৃথিবীর ধ্বংস। 

বলা হয়ে থাকে, লুসিয়া তার দর্শকদের সূর্যের দিকে তাকাতে বলেছিল, প্রসঙ্গক্রমে, খুবই নির্বোধের মতো একটি কাজ ছিল সেটি, কারণ স্থায়ীভাবে এটি দর্শকদের চোখের ক্ষতি করতে পারত। এছাড়াও এটি সেই বিভ্রমের উদ্রেক করতে পারে যে, সূর্য আকাশে এলোমেলোভাবে দুলছে। যদি একজন মানুষও সেই বিভ্রমের শিকার হয়ে থাকেন অথবা সূর্য তার অবস্থান পরিবর্তন করছে সেটি নিয়ে মিথ্যা কথা বলে থাকেন এবং অন্য কাউকে সেটি বলে থাকেন, যিনি আরো বহু মানুষকে সেটি জানিয়ে থাকেন, যাঁদের প্রত্যেকেই আবার অন্য বহু মানুষদের সেটি বলে থাকেন, জনপ্রিয় একটি গুজব হিসেবে যাত্রা শুরু হবার জন্য যা যথেষ্ট। এক পর্যায়ে যাঁরা এই গুজবটি শুনেছেন তাঁদের একজন খুব সম্ভবত হয়তো সেটি লিখে রাখবেন। এটি আসলে আসলেই ঘটেছে কি, ঘটেনি, সেটি হিউমের কাছে বিবেচ্য নয়। যা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, ৭০,০০০ সাক্ষী ভুল বলেছেন কি কিংবা বলেননি সেটি যতই অসম্ভাব্য হোক-না কেন, তারপরও এটি অনেক অসম্ভাব্য সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের বর্ণিত ঘটনাটির চেয়ে। 

হিউম কিন্তু সরাসরি এমনকিছু বলেননি যে অলৌকিক কোনো ঘটনা অসম্ভব। বরং তিনি কোনো অলৌকিক ঘটনাকে অসম্ভাব্য ভাবতে আমাদের আহবান করেছিলেন, এমন কোনো ঘটনা হিসেবে তাদের বিবেচনা করা উচিত, যার যার অসম্ভাব্যতা হয়তো আমরা পরিমাপ করতে পারি। এই পরিমাপটি একেবারে সঠিক হতে হবে এমন নয়। কোনো একটি প্রস্তাবিত অলৌকিক ঘটনার সম্ভাবনাটিকে মোটামুটিভাবে কোনো এক ধরনের স্কেলে পরিমাপ করতে পারাই যথেষ্ট এবং তারপর এর বিকল্প কোনোকিছু, যেমন হ্যালুসিনেশন অথবা কোনো মিথ্যা প্রস্তাবনার সম্ভাবনার সাথে সেটি তুলনা করা দেখতে হবে। 

আবার সেই তাসের খেলা নিয়ে আলোচনা করা যাক, যে বিষয়ে আমি প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছিলাম। আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন, আমরা চারজন খেলোয়াড়ের কথা ভেবেছিলাম, যাদের হাতে সবচেয়ে সেরা ধরনের তাস ছিল, পুরো ক্লাব, পুরো হার্ট, পুরো ডায়মন্ড, পুরো স্পেড। যদি আসলেই এমনকিছু ঘটে, আমরা বিষয়টি নিয়ে কী ভাবব? আমরা তিনটি সম্ভাবনার কথা লিখতে পারি— 

[১] অতিপ্রাকৃত অলৌকিক কোনো একটি ঘটনা ঘটেছে, যা ঘটিয়েছেন কোনো জাদুকর বা ডাইনি বা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী কোনো দেবতা, যাঁরা বিজ্ঞানের নিয়ম ভঙ্গ করেছেন এমনভাবে যে, তাঁরা তাসের উপর ছোট হার্ট, ক্লাব, স্পেড আর ডায়মন্ডের চিহ্নগুলোকে বদলে দিয়েছেন, যেন প্রত্যেকের হাতে সেগুলো একটি পারফেক্ট আ ত্রুটিহীন হাত সৃষ্টি করে। 

[২] অবশ্যই এটি বিস্ময়কর একটি যুগপৎ ঘটনা। বণ্টনের আগে তাসের হাতসাফাই শুধুমাত্র একটি কারণ যা ঘটনাচক্রে প্রত্যেকের হাতে কেবল একই ধরনের তাস বণ্টন করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। 

[৩] কেউ হয়তো হাতসাফাইয়ের কোনো একটি বুদ্ধিমান খেলা খেলেছেন, হয়তো ইতোপূর্বেই কৌশলে সাজানো তাসের প্যাকেট দিয়ে তাসগুলোকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে, যা তিনি তাঁর হাতের আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, কারণ আমরা যে তাসের প্যাকেটটিকে শাফল হতে দেখেছি সেটি সবার সামনেই ঘটেছে। 

অবশ্যই হিউমের উপদেশটি স্মরণে রেখে, এখন আপনি কী মনে করছেন? এই তিন সম্ভাবনার যে-কোনোটিকেই বিশ্বাস করার জন্যে বেশ কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু সম্ভাবনা ৩ বিশ্বাস করার জন্যে সবচেয়ে সহজতম। সম্ভাবনা ২ ঘটতে পারে, কিন্তু আমরা এর অসম্ভাব্যতাকে পরিমাপ করেছিলাম এবং সেটি ছিল আসলেই খুব বেশি মাত্রায় অসম্ভাব্য : ৫৩,৬৪৪,৭৩৭,৭৬৫,৪৮৮,৭৯২,৮৩৯,২৩৭,৪৪০,০০০ বারে ১ বার। আমরা সম্ভাবনা ১-এর বিরুদ্ধে অসম্ভাব্যতা আর এত সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করতে পারব না, কিন্তু বিষয়টি আপনি একবার চিন্তা করে দেখুন : কোনো ক্ষমতা বা শক্তি যা কখনোই সঠিকভাবে প্রদর্শিত হয়নি, যা কেউই বোঝে না, এক প্যাকেট তাসের লাল-কালো ছাপার কালি একইসাথে পরিবর্তন করে দিতে পারে। হয়তো আপনি ‘অসম্ভবের’ মতো শক্তিশালী কোনো শব্দ ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক হতে পারেন, কিন্তু হিউম আপনাকে সেটি করতে বলছেন না : তিনি শুধু বলছেন আপনি এটির অসম্ভাব্যতাকে এর বিকল্প ব্যাখ্যার সাথে তুলনা করে দেখুন, এই ক্ষেত্রে যা হতে পারে কোনো জাদুকরি কৌশলের হাতসাফাই অথবা অবিশ্বাস্য রকমের ভাগ্য। আমরা কি সবাই এই ধরনের হাতসাফাইয়ের খেলা এর আগে কখনো দেখিনি? [প্রসঙ্গক্রমে, প্রায়শই যেগুলো তাস নিয়ে], অন্তত হতভম্ভ করে দেয়ার মতো একই রকম? অবশ্যই এর সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা শুধুমাত্র বিশুদ্ধ ভাগ্য নয়, আরো কম সম্ভাবনা হচ্ছে মহাবিশ্বের নিয়মের ওপরে কোনো অলৌকিক হস্তক্ষেপ, বরং এটি কোনো জাদুকরের কৌশল অথবা তাস খেলা নিয়ে অসৎ কোনো প্রতারণাকারীর হাতসাফাই। 

আরো একটি বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনার কাহিনি নিয়ে ভাবা যাক, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম, জিসাস নামের একজন ইহুদি ধর্মপ্রচারককে নিয়ে, যিনি পানিকে মদে রূপান্তরিত করেছিলেন। আরো একবার, আমরা তিনটি মূল ব্যাখ্যার তালিকা করতে পারি— 

[১] আসলেই ঘটনাটি ঘটেছিল। পানি আসলেই মদে রূপান্তরিত হয়েছিল। 

[২] এটি ছিল খুবই চালাক কোনো জাদুকরি কৌশল। 

[৩] এই ধরনের কোনো ঘটনাই আসলেই ঘটেনি, এটি শুধুমাত্র একটি গল্প অথবা একটি কাহিনি যা কেউ বানিয়েছিলেন, অথবা কোনো ঘটনা নিয়ে যা ঘটেছিল আর সেটি ভুল বোঝা হয়েছে এমন কোনো পরিস্থিতি। 

আমি মনে করি এখানে সম্ভাবনার মাত্রা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই। যদি ব্যাখ্যা ১ সত্যি হয়, সেটি আমাদের জানা বেশকিছু গভীরতম বৈজ্ঞানিক মূলনীতি লঙ্ঘন করবে। ঠিক সেই একই ধরনের কারণে, যে কারণগুলো আমরা আলোচনা করেছিলাম যখন কুমড়ো, ঘোড়ার গাড়ি, ব্যাঙ আর রাজকুমার নিয়ে কথা বলার সময়ে বলেছিলাম। মদ হবার জন্যে পানির বিশুদ্ধ অণুকে বেশকিছু ধরনের জটিল অণুর একটি মিশ্রণে রূপান্তরিত হতে হবে : অ্যালকোহল, ট্যানিন, নানা ধরনের শর্করা ও অন্য অনেক কিছু। বিকল্প ব্যাখ্যাগুলোকে আরো বেশি অসম্ভাব্য হতে হবে সত্যি, যদি এটিকে তাদের চেয়ে শ্রেয়তর বলে মনে করা হয়। 

একটি জাদুকরি চাল সম্ভাব্য [এর চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী জাদুর খেলা টেলিভিশন আর মঞ্চে নিয়মিত দেখা যায়], কিন্তু তৃতীয় ব্যাখ্যার চেয়ে সেটি কম সম্ভাব্য নয়। কেনই-বা অযথা এটাকে হাতসাফাই বলার দরকার আছে যখন কিনা এমন কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা তার কোনো প্রমাণ নেই? কেনই-বা আমরা এটিকে জাদু হিসেবে ভাবব, যখন ব্যাখ্যা ৩-এর সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে এতটাই বেশি? কেউ-না-কেউ গল্পটি বানিয়েছেন। মানুষ সারাক্ষণই নানা ধরনের গল্প আবিষ্কার করে, আর সেটাকেই বলে কাহিনি। যেহেতু গল্পটির কাল্পনিক কাহিনি হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি, আমাদের এটিকে জাদুর কোনো হাতসাফাইয়ের কাজ দাবি করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই; আর অবশ্যই সত্যিকারের অলৌকিক ঘটনা ভেবে তো অবশ্যই নয়, যা কিনা বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে লঙ্ঘন করে, মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে সেটি সম্বন্ধে যা-কিছুই আমরা জানি বা বুঝি, এটি সেগুলোর সবকিছুই অস্বীকার করে উল্টে দেয়। 

বাস্তবিকভাবেই, আমরা জানি যে জিসাস নামের এই ধর্মপ্রচারককে নিয়ে বহু কাহিনি বানানো হয়েছে। যেমন—একটা বেশ সুন্দর গান আছে ‘চেরি ট্রি ক্যারোল’ নামে, যা হয়তো আপনি কখনো গেয়েছেন বা শুনেছেন। এটির বিষয় একটি গল্প থেকে শুরু। সেই গল্পটি বলছে, জিসাস যখন মেরির গর্ভে ছিলেন [প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার এটি সেই একই মেরি, ফাতিমার গল্পে যে মেরি’র কথা বলা হয়েছে] এবং তিনি তাঁর স্বামী জোসেফকে নিয়ে একটা চেরি গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মেরি’র চেরি খেতে ইচ্ছা করেছিল, কিন্তু চেরিগুলো ছিল গাছের অনেক উঁচু ডালে, মেরি পারছিলেন না সেগুলো ধরতে। জোসেফেরও তখন গাছে ওঠার জন্যে ইচ্ছা হচ্ছিল না, কিন্তু … তারপর শিশু জিসাস কথা বলে উঠেছিল মেরি’র গর্ভ থেকে— 

‘নত হও, সবচেয়ে লম্বা ডাল, 
যেন আমার মা কিছু চেরি পাড়তে পারে,
 নত হও, তুমি সবচেয়ে লম্বা ডাল 
যেন আমার মা কিছু চেরি পাড়তে পারে।’
সবচয়ে লম্বা ডালটি তারপর নিচে নেমে আসে
যতক্ষণ-না সেটি মেরি’র হাত স্পর্শ না করে।
চিৎকার করে মেরি বলে, ‘ওহ, তুমি দেখ,
জোসেফ, নির্দেশের বলেই আমি চেরি হাতে পেতে পারি।’
সে চিৎকার করে বলে, “ওহ, তুমি দেখ, জোসেফ,
নির্দেশের বলেই চেরি হাতে পেতে পারি।’ 

আপনি চেরি গাছের এই গল্পটি কোনো প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থে পাবেন না। কেউই নন, আক্ষরিকার্থে কেউই নন, যাঁরা আসলেই কিছুই জানেন অথবা সুশিক্ষিত, তাঁরা একটি কল্পকাহিনি ছাড়া এটিকে আর কিছুই ভাবেন না। বহু মানুষই পানিকে মদে রূপান্তর করার গল্পটিকে সত্য মনে করেন, কিন্তু সবাই একমত যে চেরি গাছের গল্পটি মনগড়া। চেরি গাছের গল্পটি বানানো হয়েছিল মাত্র ৫০০ বছর আগে। পানিকে মদে রূপান্তরের গল্পটি আরো অনেক প্রাচীন, খ্রিস্টধর্মের চারটি গসপেলের একটিতে এটি আবির্ভূত হয়েছে [গসপেল অব জন-এ, কিন্তু বাস্তবিকভাবে বাকি তিনটিতে কোথাও এই ঘটনার বিবরণ নেই], কিন্তু মনগড়া গল্প ছাড়া এটি আর কিছু বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণই নেই, শুধুমাত্র চেরি গাছের সেই গল্পটির তুলনায় এটিকে আরো কয়েক শতাব্দী আগে বানানো হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার যে চারটি গসপেলের প্রত্যেকটি, যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করছে বলে দাবি করেছে, সেগুলো ঘটার বহুদিন পরে লেখা হয়েছিল এবং কোনোটাই চাক্ষুষ কোনো সাক্ষীর লেখা নয়। সুতরাং পানির মদে রূপান্তরের গল্পটি পুরোপুরি যে বানোয়াট, ঠিক সেই চেরি গাছের গল্পটির মতো, এমন কোনো উপসংহারে পৌঁছানোই বরং নিরাপদ হবে। 

অলৌকিক বলে দাবি করা ঘটনাগুলো, কোনোকিছু ‘অতিপ্রাকৃত’, এমন দাবিগুলোর ক্ষেত্রে, আমরা একই কথা বলতে পারি। মনে করুন এমনকিছু ঘটল, যা আমার বুঝতে পারছি না এবং আমরা বুঝতে পারছি না কিভাবে এটি প্রতারণা বা কৌশল বা মিথ্যা কিছু হতে পারে : তাহলে এটিকে অবশ্যই ‘অতিপ্রাকৃত’ বলে চিহ্নিত করা কখনো কি সঠিক হতে পারে? অবশ্যই নয়! আমি প্রথম অধ্যায়ে যেমন ব্যাখ্যা করেছিলাম, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত, পরবর্তী সব নিরীক্ষা আর আলোচনাকে থামিয়ে দেবে এবং সেই কাজটি অলসতার, এমনকি অসততার, কারণ এটি প্রায় সেই দাবির সমতুল্য যে, প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। আপনি যদি অদ্ভুত কোনোকিছুকে অবশ্যই ‘অতিপ্রাকৃত’ বলে চিহ্নিত করেন, তাহলে কিন্তু আপনি বলছেন না যে, বিষয়টি বর্তমানে আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না, হাল ছেড়ে দিচ্ছেন, বরং বলছেন যে কখনোই এটি বোঝা সম্ভব হবে না। 

আজকের অলৌকিক ঘটনা, আগামীকালের প্রযুক্তি 

কিছু বিষয় আছে যা আজকের সেরা বিজ্ঞানীরাও ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সব ধরনের অনুসন্ধান বন্ধ করে, ‘জাদু’ অথবা ‘অতিপ্রাকৃত’ কোনোকিছু কল্পনা করে আমাদের কোনো বানোয়াট, মিথ্যা ‘ব্যাখ্যার’ আশ্রয় নিতে হবে, যা আসলে কিছুই ব্যাখ্যা করে না। কল্পনা করে দেখুন, মধ্যযুগীয় একজন মানুষ কিভাবে—সেই যুগের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষটি—কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন, যখন তিনি কোনো একটি জেট প্লেন, ল্যাপটপ কম্পিউটার, মোবাইল টেলিফোন অথবা স্যাটেলাইট নেভিগেশন ডিভাইস দেখবেন। তিনি হয়তো সেগুলোকে ‘অতিপ্রাকৃত’, অলৌকিক বলে চিহ্নিত করবেন, কিন্তু এই যন্ত্রগুলো এখন সর্বব্যাপী, আমরা জানি কিভাবে সেগুলো কাজ করে, কারণ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি আর পদ্ধতি অনুসরণ করেই মানুষ সেগুলো তৈরি করেছে। ব্যাখ্যা করার জন্যে কখনোই জাদু বা অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কিছু ভাবার প্রয়োজন পড়েনি এবং আমরা এখন সহজেই বুঝতে পারি মধ্যযুগীয় মানুষটি তেমন কিছু ভেবে ভুল করেছেন। 

এই বক্তব্যটি বোঝানোর জন্যে আমাদের মধ্যযুগ অবধি কোনো সময়ে অবশ্যই যেতে হবে না। ভিক্টোরীয় যুগের আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের কোনো দলের কাছে যদি আধুনিক মোবাইল ফোন থাকত, তারা তাদের কাজ এমনভাবে সমন্বয় করতে পারত যে শার্লক হোমসের কাছে টেলিপ্যাথি মনে হতে পারত। হোমসের পৃথিবীতে, খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন একজন ব্যক্তি যে কিনা প্রমাণ করতে পারত যে লন্ডনে যে দিন ঘটনাটি ঘটেছিল সেদিন সন্ধ্যায় সে নিউইয়র্কে ছিল, সেটি তার জন্য নিখুঁত একটি অ্যালিবাই হতে পারত, কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে একই দিনে লন্ডনে আর নিউইয়র্কে থাকা অসম্ভব ছিল, সেই সময় কেউ যদি এমন কোনো দাবি করত স্পষ্টতই সেটি অতিপ্রাকৃত মনে হত, কিন্তু আধুনিক সময়ের জেট প্লেন বিষয়টি সহজ করে দিয়েছে। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক বিষয়টির সারসংক্ষেপ করেছিলেন ক্লার্কস তৃতীয় সূত্রে : যে-কোনো যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর প্রযুক্তি জাদু থেকে অশনাক্তযোগ্য। 

যদি কোনো টাইম মেশিন আমাদের ভবিষ্যতে আরো এক শতাব্দী সামনে নিয়ে যায়, আমরা এমন বিস্ময়কর কিছু দেখব যা আজ আমরা হয়তো অসম্ভব ভাবছি—অলৌকিক, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমরা যা- কিছু অসম্ভব ভাবছি তার সবকিছুই ভবিষ্যতে সম্ভব হবে। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি লেখকরা খুব সহজেই একটি টাইম মেশিন কল্পনা করতে পারেন অথবা অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি মেশিন অথবা একটি রকেট যা আমাদের আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে বহন করতে পারবে, কিন্তু তাঁরা যে এসব কল্পনা করতে পারেন, সেই বিষয়টি অবশ্যই কোনো কারণ নয় যে, ভবিষ্যতে কোনোদিন সেটি বাস্তব হতে পারে। আমরা আজ যা কল্পনা করতে পারি, তার কিছু একসময় বাস্তব হতে পারে, অধিকাংশই হবে না। আপনি বিষয়টি নিয়ে যত ভাববেন, আপনি ততই বেশি অনুধাবন করতে পারবেন, অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাখ্যার ধারণাটাই কত বেশি ভিত্তিহীন আর অর্থহীন। 

যদি এমন কোনোকিছু ঘটে যা বিজ্ঞানের কাছে ব্যাখ্যাতীত মনে হয়, আপনি নিরাপদে দুটি উপসংহারের একটিতে উপনীত হতে পারেন, হয় ঘটনাটি আসলেই ঘটেনি [যিনি দেখেছেন তিনি ভুল করেছেন অথবা মিথ্যা কথা বলছেন অথবা কোনো ছলনা করছেন] অথবা আমরা বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি পড়েছি। যদি বর্তমান সময়ের বিজ্ঞান এমন কোনো পর্যবেক্ষণের মুখোমুখি হয় অথবা কোনো পরীক্ষার ফলাফল, যা এটি ব্যাখ্যা করতে পারে না, তাহলে আমাদের উচিত হবে ততক্ষণ বিশ্রাম না নেয়া যতক্ষণ-না বিজ্ঞানকে আমরা সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে পারি, যেন এটি আমাদের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। যদি এর জন্য দরকার হয় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি বিজ্ঞান, একটি বৈপ্লবিক বিজ্ঞান— যা এতই অদ্ভুত যে পুরনো বিজ্ঞানীরা যাকে বিজ্ঞান হিসেবে আদৌ শনাক্ত করতে পারবেন না, সেটিও ঠিক আছে। এমন ঘটেছে আগে, কিন্তু কখনোই এমনকিছু বলার জন্য অলসতা করা, পরাজয়প্রিয় আর ভীতু হওয়া যাবে না যে, ‘অবশ্যই এটি ‘অতিপ্রাকৃত’ অথবা ‘অবশ্যই এটি অলৌকিক ঘটনা। এর পরিবর্তে বলুন এটি একটি ধাঁধা, এটি অদ্ভুত। এটি একটি চ্যালেঞ্জ, যা সমাধান করতে করতে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। 

কোনো পর্যবেক্ষণের সত্যতাকে প্রশ্ন করে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে আমরা সাহসী হয়ে উঠি অথবা নতুন আর উত্তেজনাপূর্ণ দিকে আমাদের বিজ্ঞানকে সম্প্রসারিত করি, এ ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার সঠিক এবং সাহসী পদক্ষেপ হচ্ছে এই চ্যালেঞ্জটিকে সরাসরি মোকাবেলা করা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেই রহস্যের একটি ‘সঠিক’ উত্তর না পাই, অবশ্যই সঠিক আছে শুধুমাত্র বলা যে, বিষয়টি সম্বন্ধে এখনো আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি। আসলেই, এই ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র সততার পথ। 

অলৌকিক ঘটনা, জাদু আর পুরাণ—উপভোগ্য হতে পারে সেগুলো, আর সেই কাহিনিগুলো নিয়ে পুরো বইতে আমরা বেশ মজা করেছি। প্রত্যেকেই ভালো কোনো গল্প শুনতে পছন্দ করেন, আমি আশা করছি যে, আপনারা সেই পুরাণ-কাহিনিগুলো উপভোগ করেছেন যেগুলো দিয়ে আমি এই বইয়ের অধিকাংশ অধ্যায়গুলো শুরু করেছি, কিন্তু এর চেয়েও বেশি আমি আশা করি, প্রতিটি অধ্যায়ে, আপনারা বিজ্ঞানকে উপভোগ করেছেন, আলোচনায় যা পুরাণের পরে এসেছে। আশা করি আপনারা আমার সাথে একমত হবেন যে, সত্যের নিজস্ব একটি জাদু আছে। সত্য আরো বেশি জাদুময়—এই শব্দটির শ্রেষ্ঠতম আর উত্তেজনাপূর্ণ অর্থে—যে- কোনো পুরাণ অথবা মনগড়া রহস্য অথবা অলৌকিক কাহিনির চেয়ে। বিজ্ঞানের নিজস্ব জাদু আছে—বাস্তবতার জাদু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *