দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – অর্থনৈতিক অবস্থা
মুসলমান বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে পাল ও সেন রাজগণের আমলের রাজাদের নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া যায় না। সে যুগে সম্ভবত প্রাচীন কালের মুদ্রারই প্রচলন ছিল। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছোটখাট ব্যাপারে কড়িই মুদ্রার কাজ করিত।
মুসলমান যুগে প্রত্যেক স্বাধীন সুলতানই নিজ নামে মুদ্রা অঙ্কিত করিতেন। বস্তুত ইহাই তখন স্বাধীনতার প্রধান প্রতীক ছিল। বাংলার মুসলমান সুলতানেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াই নিজের নামে মুদ্রা বাহির করিতেন। এই সব মুদ্রায় তারিখ থাকিত। কয়েকজন সুলতানের অস্তিত্ব এবং অনেক স্থলে সুলতানদের সঠিক তারিখ কেবল মুদ্রা হইতেই জানা যায়। বাংলা দেশ দিল্লি সরকারের অন্ত গত হইলে দিল্লির সুলতানের মুদ্রাই চলিত। সপ্তদশ শতকের পর হইতে মুঘল সম্রাটগণের মুদ্রাই বাংলায় প্রচলিত ছিল। রূপার মুদ্রার নাম ছিল ‘টঙ্ক’-ইহা হইতেই টাকা শব্দের উৎপত্তি। প্রতি টঙ্কতে (চীন দেশীয় ১/১২ আউন্স) রূপা থাকিত। [Visvabharati Annals. Vol. I. P. 99] সাধারণ কেনা বেচায় কড়ি ব্যবহৃত হইত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে চার পাঁচ হাজার (কাহারও মতে আড়াই হাজার) কড়ি এক টাকার সমান ছিল। [K.K. Datta, History of Bengal Subah, p, 464 ff.] হিন্দু যুগের শেষ পাঁচ শত বৎসরে অনেক পরাক্রান্ত রাজা ও সম্রাট বাংলা দেশে রাজত্ব করিয়াছেন। তাঁহারা কেন নিজ নামে মুদ্রা বাহির করেন নাই এবং মুসলমান সুলতান প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত নিজ নামে কেন মুদ্রা প্রচার করিয়াছিলেন, এ রহস্যের কোন মীমাংসা আজ পর্যন্তও হয় নাই।
স্বাধীন সুলতানী আমলে অর্থাৎ দ্বাদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা দেশ ধন-সম্পদে বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। দেশের শস্য-সম্পদ, শিল্প ও বাণিজ্যই ইহার প্রধান কারণ। আর একটি রাজনীতিক কারণও ছিল।
সপ্তদশ শতকের আরম্ভেই মুঘল শাসন বাংলা দেশে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইহা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হয়। ইহার পূর্বে চারি শতাব্দীতে বাংলা দেশ অধিকাংশ সময়ই স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। এই সময় বাংলার ধন-সম্পদ বাংলায়ই থাকিত, সুতরাং বাংলা দেশ খুবই সম্পদশালী ছিল।
অপর দিকে মুঘল যুগে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হইয়া শাস্তি স্থাপন ও উৎকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থার ফলে কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতির উন্নতি হইয়াছিল। ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতি–ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি বাংলা দেশে বাণিজ্য বিস্তার করায় বহু অর্থাগম হইত। ১৬৮০-১৬৮৪ খ্রীষ্টাব্দ এই চারি বৎসরে কেবলমাত্র ইংরেজ ব্যবসায়ীরা খোল লক্ষ টাকার জিনিস কিনিয়াছিল। ওলন্দাজেরাও ইহার চেয়ে বেশি ছাড়া কম জিনিস কিনিত না। সুতরাং এই দুই কোম্পানীর নিকট হইতে প্রতি বৎসর আট লক্ষ রূপার টাকা বাংলায় আসিত। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে দ্রব্যের যে মূল্য ছিল সেই অনুপাতে প্রতি বৎসর এক কোটি ষাট লক্ষ টাকা এই দুইটি ইউরোপীয় কোম্পানী দিত। ইহা ছাড়া অন্য দেশের সহিত বাণিজ্য তো ছিলই।
কিন্তু সম্পদ যেমন বাড়িল, সঙ্গে সঙ্গে তেমন কমিবারও ব্যবস্থা হইল। মুঘল শাসনের যুগে দুই কারণে বাংলার ধন শোষণ হইত। প্রথমত বাৎসরিক রাজস্ব হিসাবে বহু টাকা দিল্লিতে যাইত। দ্বিতীয়ত সুবাদার হইতে আরম্ভ করিয়া বড় বড় কর্মচারিগণ দিল্লি হইতে নিযুক্ত হইতেন এবং অধিকাংশই ছিলেন অবাঙালী। তাঁহারা অবসর গ্রহণ করিবার সময় সৎ ও অসৎ উপায়ে অর্জিত বহু অর্থ সঙ্গে লইয়া নিজের দেশে ফিরিয়া যাইতেন।
বাংলা দেশ হইতে মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে উদ্বৃত্ত রাজস্ব গড়ে এক কোটি টাকা প্রতি বৎসর বাদশাহের নিকট পাঠান হইত। শুজাউদ্দীন প্রতি বৎসর এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা পাঠাইতেন। তাঁহার ১২ বৎসর রাজত্বকালে মোট ১৪,৬২,৭৮,৫৩৮ টাকা দিল্লিতে প্রেরিত হয়। পূর্বেকার সুবাদারগণও এইরূপ রাজস্ব পাঠাইতেন এবং পদত্যাগ করিয়া যাইবার সময় সঞ্চিত বহু টাকা সঙ্গে লইয়া যাইতেন। শায়েস্তা খা বাইশ বৎসরে আটত্রিশ কোটি এবং আজিমুদ্দীন (আজিমুসসান) নয় বৎসরে আট কোটি টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন এবং এই টাকাও বাংলা দেশ হইতে দিল্লিতে গিয়াছিল। অন্যান্য সুবাদার ও কর্মচারীরা কত টাকা বাংলা দেশ হইতে লইয়া গিয়াছিলেন তাহা সঠিক জানা যায় না। এই পরিমাণ রূপার টাকা গাড়ী বোঝাই হইয়া দিল্লিতে চলিয়া যাইত। এইরূপ শোষণের ফলে রৌপ্যমুদ্রার চলন অত্যন্ত কমিয়া যায় এবং দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাসের ইহাই প্রধান কারণ। সাধারণ লোকে টাকা জমাইতে পারিত না; ফলে, তাহাদের মূলধনও ক্রমশ কমিতে লাগিল। সম্ভবত এই কারণেই বিনিময়ের জন্য কড়ির খুব প্রচলন ছিল। অবশ্য কড়ি ইহার পূর্ব হইতেই মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হইত।
বাংলা দেশে নানাবিধ উৎকৃষ্ট শিল্প প্রচলিত ছিল। বস্ত্র শিল্প খুবই উন্নত ছিল এবং ইহা দ্বারা বহু লোক জীবিকা অর্জন করিত। বাংলার মসলিন জগদ্বিখ্যাত ছিল। এই সূক্ষ্ম শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা; এখান হইতে প্রচুর পরিমাণে মসলিন বিদেশে রপ্তানি হইত। ইরাক, আরব, ব্রহ্মদেশ, মক্কা ও সুমাত্রায় বাংলার কাপড় যাইত। ইউরোপে খুব সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের বিস্তর চাহিদা ছিল। ইহা এমন সূক্ষ্ম হইত যে ২০ গজ মসলিন নস্যের ডিবায় ভরিয়া নেওয়া যাইত। ইহার বয়ন কৌশল ইউরোপে বিস্ময়ের বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল। মসলিন ছাড়া অন্যান্য উৎকৃষ্ট বস্ত্রও ঢাকায় তৈরী হইত। ইংরেজ কোম্পানীর চিঠিতে ঢাকায় তৈরী নিম্নলিখিত বস্ত্রসমূহের উল্লেখ আছে–সরবতী, মলমল, আলাবালি, তঞ্জীব, তেরিন্দাম, নয়নসুখ, শিরবান্ধানি (পাগড়ি), ডুরিয়া, জামদানী। [K.K. Datta, op. cit. p. 419 ff] অতি সূক্ষ্ম মসলিন হইতে গরীবের জন্য মোটা কাপড় সবই ঢাকায় তৈরী হইত। বাংলার বহুস্থানে বস্ত্র বয়নের প্রধান প্রধান কেন্দ্র ছিল।
মির্জা নাথান মালদহে ৪,০০০ টাকা দিয়া একখণ্ড বস্ত্র ক্রয় করেন। সে আমলে বাংলার উৎকৃষ্ট বস্ত্রসমূহের মূল্য ইহা হইতে ধারণা করা যাইবে। বাংলাদেশে বহু পরিমাণ রেশম ও রেশমের বস্ত্র প্রস্তুত হইত। নৌকা-নিৰ্মাণ আর একটি বড় শিল্প ছিল। ট্যাভার্নিয়ারের বিবরণ হইতে জানা যায় যে ঢাকায় নদীতীরে দুই ক্রোশ স্থান ব্যাপিয়া কেবলমাত্র বড় বড় নৌকানির্মাণকারী সূত্রধরেরা বাস করিত। শঙ্খ ঢাকার একটি বিখ্যাত শিল্প ছিল। ইহা ছাড়া সোনারূপা ও দামী পাথরের অলঙ্কার নির্মাণেও খুবই উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশী লেখকদের বিবরণে লৌহ শিল্পের বহু উল্লেখ আছে। বীরভূমে লোহার খনি ছিল। রেনেল লিখিয়াছেন যে সিউড়ি হইতে ১৬ মাইল দূরে খনি হইতে লৌহপিণ্ড নিষ্কাশিত করিয়া দামরা ও ময়সারাতে কারখানায় লৌহ প্রস্তুত হইত। মুল্লারপুর পরগনায় এবং কৃষ্ণনগরে লোহার খনি ছিল এবং দেওচা ও মুহম্মদবাজারে লৌহ তৈরীর কারখানা ছিল। কলিকাতা ও কাশিমবাজারে এদেশী লোকেরা কামান তৈরী করিত। কামানের বারুদও এদেশেই তৈরী হইত। [K.K. Datta, op. cic. p. 481-3.]
শীতকালে বাংলা দেশে কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরী হইত। গরম জল সারা রাত্রি মাটির নীচে গর্ত করিয়া রাখিয়া বরফ প্রস্তুতের ব্যবস্থা ছিল। [K.K. Datta, op. cic. p. 435]
চীন পর্যটকেরা লিখিয়াছেন যে বাংলায় গাছের বাকল হইতে উৎকৃষ্ট কাগজ তৈরী হইত। ইহার রং খুব সাদা এবং ইহা মৃগ-চর্মের মত মসৃণ। লাক্ষা এবং রেশম শিল্পেরও উল্লেখ আছে।
চতুর্দ্দশ খ্রীষ্টাব্দে ইবন বতুতা লিখিয়াছেন যে বাংলা দেশে প্রচুর ধান ফলিত। সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে বার্ণিয়ার লিখিয়াছেন যে অনেকে বলেন পৃথিবীর মধ্যে মিশর দেশই সর্বাপেক্ষা শস্যশালিনী। কিন্তু এ খ্যাতি বাংলারই প্রাপ্য। এদেশে এত প্রচুর ধান হয় যে ইহা নিকটে ও দূরে বহু দেশে রপ্তানি হয়। সমুদ্রপথে ইহা মসলিনপত্তন ও করমগুল উপকূলের অন্যান্য বন্দরে, এমন কি লঙ্কা ও মালদ্বীপে চালান হয়। বাংলায় চিনি এত হয় যে দক্ষিণ ভারতে গোলকুণ্ডা ও কর্ণাটে, এবং আরব, পারস্য ও মেসোপটেমিয়ায় চালান হয়। যদিও এখানে গম খুব বেশী পরিমাণে হয় না; কিন্তু তাহা এ দেশের লোকের পক্ষে পর্যাপ্ত। উপরন্তু তাহা হইতে সমুদ্রগামী ইউরোপীয় নাবিকদের জন্য সুন্দর সস্তা বিস্কুট তৈরী হয়। এখানে সুতা ও রেশম এত পরিমাণে হয় যে কেবল ভারতবর্ষ ও নিকটবর্তী দেশ নহে সুদূর জাপান এবং ইউরোপেও এখানকার বস্ত্র চালান হয়। এই দেশ হইতে উৎকৃষ্ট লাক্ষা, আফিম, মোমবাতি, মৃগনাভি, লঙ্কা এবং ঘৃত সমুদ্রপথে বহু স্থানে চালান হয়।
মধ্যযুগে এমন কয়েকটি বিদেশী কৃষিজাত দ্রব্য বাংলায় প্রথম আমদানি হয় যাহার প্রচলন পরবর্তীকালে খুবই বেশি হইয়াছিল। ইহার মধ্যে তামাক ও আলু আমেরিকা হইতে ইউরোপীয় বণিকেরা সপ্তদশ শতকে এদেশে আনেন। বাংলার বর্তমান যুগের দুইটি বিশেষ সুপরিচিত রপ্তানী দ্রব্য পাট ও চা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমে বিদেশে পরিচিত হয়। যে নীলের চাষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল তাহাও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে আরম্ভ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ হইবার পূর্বেই নীল ও পাটের রপ্তানী আরম্ভ হয়।
অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে গুড়, সুপারি, তামাক, তেল, আদা, পাট, মরিচ, ফল, তাড়ি ইত্যাদি ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ও বাহিরে চালান যাইত। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে প্রতি বৎসর ৫০,০০০ মণ চিনি রপ্তানী হইত। মাখনও বাংলা দেশ হইতে রপ্তানি হইত। বাংলার ব্যবসায় বাণিজ্যও যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছিল। ইউরোপীয় বণিকের প্রতিযোগিতা, শাসকদের উৎপীড়ন ও রৌপ্য মুদ্রার অভাব ইত্যাদি বহু গুরুতর বাধা সত্ত্বেও বাংলার অনেক দ্রব্য ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে ও ভারতের বাহিরে রপ্তানি হইত। পূর্ব্বোক্ত শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্য ছাড়াও বাংলা হইতে লবণ, গালা, আফিম, নানা প্রকার মসলা, ঔষধ এবং খোঁজা ও ক্রীতদাস জল ও স্থল পথে ভারতের নানা স্থানে এবং সমুদ্রের পথে এশিয়ার নানা দেশে বিশেষতঃ লঙ্কা দ্বীপ ও ব্রহ্মদেশে রপ্তানি হইত। সূক্ষ্ম মসলিন বাঁশের চোঙ্গায় ভরিয়া অন্যান্য দ্রব্যসহ সওদাগরেরা খোরাসান, পারস্য, তুরস্ক ও নিকটস্থ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করিত। এতদ্ব্যতীত ম্যানিলা, চীন ও আফ্রিকার উপকূলের সহিতও বাঙালী বাণিজ্য করিত। বাঙালী সদাগরদের সমুদ্রপথে দূর বিদেশে বাণিজ্যযাত্রার কথা বৈদেশিক ভ্রমণকারীরা উল্লেখ করিয়াছেন এবং মধ্যযুগের বাংলা আখ্যানে ও সাহিত্যে তাঁহার বহু উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। বিজয়গুপ্ত ও বংশীদাসের মনসামঙ্গল এবং কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে বাঙালী সওদাগরেরা যে বহুসংখ্যক অতিবৃহৎ বাণিজ্যতরী লইয়া বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম কূল ধরিয়া সিংহলে এবং পরে উত্তর দিকে আরবসাগরের পূর্ব কূল বাহিয়া নানা বন্দরে সওদা করিতে করিতে পাটনে (গুজরাট) পৌঁছিতেন তাঁহার বিশদ বিবরণ আছে।
বাঙালী বণিকেরা বঙ্গোপসাগর পার হইয়া ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন ও ইন্দোনেশিয়াতে যাইত। চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে ই বতুতা সোনারগাঁও হইতে চল্লিশ দিনে সুমাত্রায় গিয়াছিলেন। সুদূর সমুদ্রযাত্রার বর্ণনায় পথিমধ্যে কয়েকটি বন্দরের নাম পাওয়া যায়পুরী, কলিঙ্গপত্তন, চিল্কাচুলি (চিকাকোল), বানপুর, সেতুবন্ধরামেশ্বর, লঙ্কাপুরী, বিজয়নগর। ইহা ছাড়া অনেক দ্বীপের নামও আছে।
অনেক মঙ্গলকাব্যেরই নায়ক একজন সদাগর–যেমন, চাঁদ, ধনপতি ও তাঁহার পুত্র শ্রীমন্ত। ইহাদের বাণিজ্যযাত্রার বর্ণনা উপলক্ষে বাণিজ্য-তরীর বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগরের ছিল চৌদ্দ ডিঙ্গা আর ধনপতির ছিল সাত ডিঙ্গা। প্রত্যেক নৌকারই এক একটি নাম ছিল। এই দুই বহরেরই প্রধান তরীর নাম ছিল মধুকর–সম্ভবতঃ সদাগর নিজে ইহাতে যাইতেন। নৌকাগুলি জলে ডোবান থাকিত, যাত্রার পূর্বে ডুবারুরা নৌকা উঠাইত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ডিঙ্গা নির্মাণের বর্ণনায় [কবিকঙ্কণ চণ্ডী–দ্বিতীয় ভাগ ৭৩৯ পৃ.] বলা হইয়াছে, কোন কোন ডিঙ্গা দৈর্ঘ্যে শত গজ ও প্রস্থে বিশ গজ। এগুলির মধ্যে অত্যুক্তিও আছে, কারণ দ্বিজ বংশী দাসের মনসামঙ্গলে হাজার গজ দীর্ঘ নৌকারও উল্লেখ আছে। এই সব নৌকার সামনের দিকের গলুই নানারূপ জীবজন্তুর মুখের আকারে নির্মিত এবং বহু মূল্যবান প্রস্তর গজদন্ত ও স্বর্ণ রৌপ্য দ্বারা খচিত হইত। কাঁঠাল, পিয়াল, শাল, গাম্ভারী, তমাল প্রভৃতির কাঠে নৌকা তৈরী হইত। ভারতবর্ষে মধ্যযুগে যে বৃহৎ বৃহৎ বাণিজ্য-তরী নির্মিত হইত, ‘যুক্তি কল্পতরু’ নামক একখানি সংস্কৃত গ্রন্থে এবং বৈদেশিক পর্যটকগণের বিবরণে তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে নিকলো কন্টি লিখিয়াছেন যে ভারতে প্রস্তুত নৌকা ইউরোপের নৌকা অপেক্ষা বৃহত্তর এবং বেশী মজবুৎ। সপ্তদশ শতাব্দে ঢাকা নগরীর এক বিস্তৃত অংশে নৌবহর নির্মাণকারী সূত্রধরেরা বাস করিত। [Tavernier’s Travels in India. p. 103] সম্ভবতঃ বর্তমান ঢাকার সূত্রাপুর অঞ্চল তাঁহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও চট্টগ্রামে সমুদ্রগামী নৌবহর নির্মিত হইত। সুতরাং বাংলা সাহিত্যে ডিঙ্গীর বর্ণনা অতিরঞ্জিত হইলেও একেবারে কাল্পনিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। নৌবহরের সঙ্গে যে সকল মাঝিমাল্লা প্রভৃতি যাইত মঙ্গলকাব্যে তাহাদের উল্লেখ আছে। প্রধান মাঝির নাম ছিল কড়ারী-কাণ্ডারী শব্দের অপভ্রংশ। সাবরগণ সারিগান গাহিয়া দাঁড় টানিত। সূত্রধর, ডুবারী ও কর্মকারেরা সঙ্গে থাকিত এবং প্রয়োজনমত নৌকা মেরামত করিত। ইহা ছাড়া একদল পাইক থাকিত-সম্ভবতঃ জলদস্যুদিগের আক্রমণ নিবারণের জন্য এই ব্যবস্থা ছিল।
সে যুগে ভারতে চুম্বক দিগদর্শন যন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল না। সুতরাং সূর্য ও তাঁহার সাহায্যে দিনির্ণয় করা হইত। বংশীদাসের মনসামঙ্গলে আছে :
অস্ত যায় যথা ভানু উদয় যথা হনে।
দুই তারা ডাইনে বামে রাখিল সন্ধানে ॥
তাঁহার দক্ষিণ মুখে ধরিল কাঁড়ার।
সেই তারা লক্ষ্য করি বাহিল নাওয়ার ॥
এই সমুদয় বর্ণনা সমুদ্রযাত্রার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পরিচায়ক।
কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে :
ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধারে।
রাত্রিতে বাহিয়া যায় হারমাদের ডরে ॥
হারমাদ পর্তুগীজ আবমাডা [Armada-রণতরী বহর] শব্দের অপভ্রংশ। পর্তুগীজ বণিকেরা যে বাঙালীর তথা ভারতীয়ের ব্যবসায়বাণিজ্যে বহু অনিষ্ট করিত তাঁহার প্রমাণ আছে। বস্তুতঃ পর্তুগীজ বণিকেরা ভারত মহাসাগরে ও বঙ্গোপসাগরে এদেশীয় বাণিজ্যজাহাজের উপর জলদস্যুর ন্যায় আচরণ করিত এবং তাঁহার ফলেই বাংলার জলপথের বাণিজ্য ক্রমশঃ হ্রাস পাইতে থাকে। আরাকান হইতে মগদের অত্যাচারে দক্ষিণ বঙ্গের সমুদ্রতীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চল ধ্বংস হইয়াছিল। পর্তুগীজরাও তাহাদের অনুকরণে নদীপথে ঢুকিয়া দক্ষিণ বঙ্গে বহু অত্যাচার করিত।
ইউরোপীয় বণিক ও মগ জলদস্যুরা বন্দুক ব্যবহার করিত; কিন্তু বাঙালী বণিকেরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানিত না বলিয়াই তাহাদের সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে পারিত না। বংশীদাস লিখিয়াছেন–
মগ ফিরিঙ্গি যত বন্দুক পলিতা হাত
একেবারে দশগুলি ছোটে ॥
বাঙালী বণিকেরা কিরূপে দ্রব্য বিনিময়ে ব্যবসায় করিত, কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে তাঁহার কিছু আভাস পাওয়া যায়। ধনপতি সদাগর সিংহলের রাজাকে ইহার এইরূপ বিবরণ দিয়াছেন :
বদলাশে নানা ধন আন্যাছি সিংহলে।
যে দিলে যে হয় তাহা শুন কুতুহলে ॥
কুরঙ্গ বদলে তুরঙ্গ পাব নারিকেল বদলে শঙ্খ।
বিরঙ্গ বদলে লবঙ্গ দিবে সঁটের বদলে ডঙ্ক (টঙ্ক?)
পিড়ঙ্গ (প্লবঙ্গ?) বদলে মাতঙ্গ পাব পায়রার বদলে শুয়া।
গাছফল বদলে জায়ফল দিবে বয়ড়ার বদলে গুয়া ॥
সিন্দুর বদলে হিঙ্গুল দিবে গুঞ্জার বদলে পলা।
পাটশন বদলে ধবল চামর কাঁচের বদলে নীলা ॥
লবণ বদলে সৈন্ধব দিবে জোয়ানি বদলে জিরা।
আতঙ্গ (আকন্দ) বদলে মাতঙ্গ (মাকন্দ) দিবে হরিতাল বদলে হীরা ॥
চঞর বদলে চন্দন দিবে পাগের বদলে গড়া।
শুক্তার বদলে মুক্তা দিবে ভেড়ার বদলে ঘোড়া ॥
এই সুদীর্ঘ তালিকায় অনেক কাল্পনিক উক্তি আছে। কিন্তু এই সমুদয় বাণিজ্যের কাহিনী যে কবির কল্পনা মাত্র নহে, বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, বিদেশী ভ্রমণকারীদের বিবরণ তাহা সম্পূর্ণ সমর্থন করে। ষোড়শ শতকের প্রথমে (আনুমানিক ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দ) পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা বাংলা দেশের যে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখিয়াছেন, তাঁহার সারমর্ম এই :
“এদেশে সমুদ্রতীরে ও দেশের অভ্যন্তরভাগে বহু নগরী আছে। ভিতরের নগরগুলিতে হিন্দুরা বাস করে। সমুদ্ৰীরের বন্দরগুলিতে হিন্দু মুসলমান দুইই আছে–ইহারা জাহাজে করিয়া বাণিজ্য দ্রব্য বহু দেশে পাঠায়। এই দেশের প্রধান বন্দরের নাম ‘বেঙ্গল’ (Bengal)। আরব, পারস্য, আবিসিনিয়া ও ভারতবাসী বহু বণিক এই নগরে বাস করে। এদেশের বড় বড় বণিকদের বড় বড় জাহাজ আছে এবং ইহা নানা দ্রব্যে বোঝাই করিয়া তাহারা করমণ্ডল উপকূল, মালাবার, ক্যাম্বে, পেশু, টেনাসেরিম, সুমাত্রা, লঙ্কা এবং মলাক্কায় যায়। এদেশে বহু পরিমাণ তুলা, ইক্ষু, উৎকৃষ্ট আদা ও মরিচ হয়। এখানে নানা রকমের সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরী হয় এবং আরবে ও পারস্যে ইহাদ্বারা এত অধিক পরিমাণে টুপি তৈরী করে যে প্রতি বৎসর অনেক জাহাজ বোঝাই করিয়া এই কাপড়ের চালান দেয়। ইহা ছাড়া আরও অনেক রকম কাপড় তৈরী হয়। মেয়েদের ওড়নার জন্য ‘সরবতী’ কাপড় খুব চড়া দামে বিক্রয় হয়। চরকায় সূতা কাটিয়া এই সকল কাপড় বোনা হয়। এই শহরে খুব উৎকৃষ্ট সাদা চিনি তৈরী হয় এবং অনেক জাহাজ বোঝাই করিয়া চালান হয়। মালাবার ও ক্যাম্বেতে চিনি ও মসলিন খুব চড়া দামে বিক্রয় হয়। এখানে আদা, কমলালেবু, বাতাবী লেবু এবং আরও অনেক ফল জন্মে। ঘোড়া, গরু, মেষ ও বড় বড় মুরগী প্রচুর আছে।”
বারবোসার সমসাময়িক ইতালীয় পর্যটক ভার্থেমাও (১৫০৫ খ্রীষ্টাব্দে) উক্ত বন্দরের বর্ণনা করিয়াছেন এবং ইহার বিস্তৃত বাণিজ্যসম্ভার বিশেষতঃ সূতা ও রেশমের কাপড়ের উল্লেখ করিয়াছেন।
ভার্থেমা বলেন যে বাংলা দেশের মত ধনী বণিক আর কোন দেশে তিনি দেখেন নাই। আর একজন পর্তুগীজ, জাঁয়া দে’ বারোস (১৪৯৩-১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে), লিখিয়াছেন যে, গৌড় নগরী বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। নয় মাইল দীর্ঘ এই শহরে প্রায় কুড়ি লক্ষ লোক বাস করিত এবং বাণিজ্য দ্রব্য সম্ভারের জন্য সর্বদাই রাস্তায় এত ভিড় থাকিত যে লোকের চলাচল খুবই কষ্টকর ছিল। সোনারগাঁও, হুগলি, চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামেও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল।
ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিজার ফ্রেডারিক (১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দ) সাতগাঁওকে (সপ্তগ্রাম) খুব সমৃদ্ধশালী বন্দর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু তিনি ‘বেঙ্গল’ বন্দরের নাম করেন নাই। বিশ বৎসর পরে রালফ ফিচ সাতগাঁও ও চাটগাঁও এই দুই বন্দরের বর্ণনা দিয়াছেন এবং চাটগাঁও বা চট্টগ্রামকে প্রধান বন্দর (Porto Grande) বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু তিনিও ‘বেঙ্গল’ বন্দরের উল্লেখ করেন। নাই। হামিলটন (১৬৮৮-১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দ) হুগলিকে একটি প্রসিদ্ধ বন্দর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন কিন্তু সাতগাঁও-এর উল্লেখ করেন নাই। তিনি চিটাগাং বন্দরেরও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়াছেন, কিন্তু ‘বেঙ্গল’ বন্দরের নাম করেন নাই। ১৫৬১ খ্রীষ্টাব্দে অঙ্কিত একটি মানচিত্রে বেঙ্গল ও সাতগাঁ উভয় বন্দরেরই নাম আছে।
রালফ ফিচ আগ্রা হইতে নৌকা করিয়া যমুনা ও গঙ্গা নদী বাহিয়া বাংলায় আসেন। তাঁহার সঙ্গে আরও ১৮০ খানি নৌকা ছিল। হিন্দু ও মুসলমান বণিকেরা এই সব নৌকায় লবণ, আফিং, নীল, সীসক, গালিচা ও অন্যান্য দ্রব্য বোঝাই করিয়া বাংলা দেশে বিক্রয়ের জন্য যাইতেছিল। বাংলা দেশে তিনি প্রথমে টাণ্ডায় পৌঁছেন। এখানে তুলা ও কাপড়ের খুব ভাল ব্যবসা চলিত। এখান হইতে তিনি কোচবিহারে যান। সেখানে হিন্দু রাজা এবং অধিবাসীরাও হিন্দু অথবা বৌদ্ধ মুসলমান নহে। ফিচ হুগলিরও উল্লেখ করিয়াছেন–এখানে পর্তুগীজেরা বাস করিত। ইহার অল্প একটু দূরে দক্ষিণে অঞ্জেলি (Angeli) নামে এক বন্দর ছিল। এখানে প্রতিবৎসর নেগাপটম, সুমাত্রা, মলাক্কা এবং আরও অনেক স্থান হইতে বহু বাণিজ্য-জাহাজ আসিত।
সমসাময়িক বৈদেশিক বিবরণ হইতে জানা যায় যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বণিকেরা বাংলায় বাণিজ্য করিতে আসিত। ইহাদের মধ্যে কাশ্মীরী, মুলতানী, আফগান বা পাঠান, শেখ, পগেয়া, ভুটিয়া ও সন্ন্যাসীদের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। পগেয়া সম্ভবতঃ পাগড়ীওয়ালা হিন্দুস্থানীদের নাম এবং কলিকাতা বড়বাজারের পগেয়াপটি সম্ভবতঃ তাহাদের স্মৃতি বজায় রাখিয়াছে। সন্ন্যাসীরা সম্ভবতঃ হিমালয় অঞ্চল হইতে চন্দন কাঠ, ভুর্জপত্র, রুদ্রাক্ষ ও লতাগুল্ম প্রভৃতি ভেষজ দ্রব্য আনিত। বর্ধমান সম্বন্ধে হলওয়েল লিখিয়াছেন যে দিল্লি ও আগ্রার পগেয়া ব্যাপারীরা প্রতি বৎসর এখান হইতে সীসক, তামা, টিন, লঙ্কা ও বস্ত্র প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে কিনিত এবং তাঁহার পরিবর্তে নগদ টাকা অথবা আফিম, সোরা অথবা অশ্ব বিনিময় করিত। কাশ্মীরী বণিকেরা আগাম টাকা দিয়া সুন্দরবনে লবণ তৈরী করাইত। কাশ্মীরী এবং আর্মেনিয়ান বণিকেরা বাংলা হইতে নেপালে ও তিব্বতে চর্ম, নীল, মণিমুক্তা, তামাক, চিনি, মালদহের সাটিন প্রভৃতি নানা রকমের বস্ত্র বিক্রয় করিত।
বাঙালী সদাগরেরাও ভারতের সর্বত্র বাণিজ্য করিত। ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে রচিত জয়নারায়ণের হরিলীলা নামক বাংলা গ্রন্থে লিখিত আছে যে একজন বৈশ্য বণিক নিম্নলিখিত স্থানে বাণিজ্য করিতে যাইতেন : “হস্তিনাপুর, কর্ণাট, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গুর্জর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, পঞ্চাল, কামোজ, ভোজ, মগধ জয়স্তী, দ্রাবিড়, নেপাল, কাঞ্চী, অযোধ্যা, অবন্তী, মথুরা, কাস্পিল্য, মায়াপুরী, দ্বারাবতী, চীন, মহাচীন, কামরূপ।” চন্দ্রকান্ত নামে প্রায় সমসাময়িক আর একখানি বাংলা গ্রন্থে লিখিত আছে যে চন্দ্রকান্ত নামে মল্লভূমি নিবাসী একজন গন্ধবণিক সাতখানি তরী বাণিজ্যদ্রব্যে বোঝাই করিয়া গুজরাটে গিয়াছিলেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব প্রচলন থাকিলেও, বাংলায় কৃষিই ছিল জনসাধারণের উপজীব্য। প্রাচীন একখানি পুঁথিতে আছে যে আত্মমর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন লোকের পক্ষে কৃষিই প্রশস্ত। কারণ বাণিজ্য করিতে মূলধনের প্রয়োজন এবং অনেক জাল প্রতারণা করিতে হয়। চাকুরীতে আত্মসম্মান থাকে না এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে অর্থ লাভ হয় না। নানাবিধ শস্য, ফল, শাক-সব্জীর চাষ হইত-এবং এ বিষয়ে বাঙালীর ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বহু পরিমাণে ছিল। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ হইয়াও চাষ দ্বারা জীবিকা অর্জন করিতেন। বাংলার অতুলনীয় কৃষিসম্পদের কথা সমসাময়িক সাহিত্যে ও বিদেশীয় পর্যটকগণের ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লিখিত হইয়াছে। একজন চীনা পর্যটক লিখিয়াছেন যে বাংলা দেশে বছরে তিনবার ফসল হয়–লোকেরা খুব পরিশ্রমী; বহু আয়াস সহকারে তাহারা জঙ্গল কাটিয়া জমি চাষের উপযোগী করিয়াছে। সরকারী রাজস্ব মাত্র উৎপন্ন শস্যের এক-পঞ্চমাংশ।
মধ্যযুগে বাংলার ঐশ্বর্য ও সম্পদ প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছিল। বাংলা সাহিত্যে ধনী নাগরিকদের বর্ণনায় বিস্তৃত প্রাসাদ, মণিমুক্তাখচিত বসনভূষণ, এবং স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান রত্নের ছড়াছড়ি। বৈদেশিক বর্ণনায়ও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকে চীনা রাজদূতেরা বাংলায় আসিয়াছিলেন। তাহাদের বিবরণ হইতে এদেশের সম্পদের পরিচয় পাওয়া যায়। ভোজনাস্তে চীনা রাজদূতকে সোনার বাটি, পিকদানি, সুরাপাত্র ও কোমরবন্ধ এবং তাঁহার সহকারীদের ঐ সকল রৌপ্যের দ্রব্য, কর্মচারীদিগকে সোনার ঘণ্টা ও সৈন্যগণকে রূপার মুদ্রা উপহার দেওয়া হয়। এদেশে কৃষিজাত সম্পদের প্রাচুর্য ছিল এবং ব্যবসায় বাণিজ্যে বহু ধনাগম হইত। পোশাক-পরিচ্ছদ ও মণিমুক্তাখচিত অলঙ্কারেই এই ঐশ্বর্যের পরিচয় পাইয়া চীনাদূতেরা বিস্মিত হইয়াছিলেন।
‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস সলাতীনে’ উক্ত হইয়াছে যে প্রাচীন যুগ হইতে গৌড় ও পূর্ববঙ্গে ধনী লোকেরা সোনার থালায় খাইত। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (ষোড়শ শতক) গৌড়ের লুণ্ঠনকারীদের বধ করিয়া ১৩০০ সোনার থালা ও বহু ধনরত্ন পাইয়াছিলেন। ফিরিশতা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে ঐ যুগে যাহার বাড়িতে যত বেশি সোনার বাসনপত্র থাকিত সে তত বেশি মর্যাদার অধিকারী হইত এবং এখন পর্যন্তও বাংলা দেশে এইরূপ গর্বের প্রচলন আছে।
এই ঐশ্বর্যের প্রধান কারণ বঙ্গদেশের উর্বরাভূমির প্রাকৃতির শস্যসম্পদ এবং বাঙালীর বাণিজ্য বৃত্তি। সপ্তগ্রামে বহু লক্ষপতি বণিকেরা বাস করিতেন। চৈতন্য চরিতামৃতে আছে :
হিরণ্য-গোবর্ধন নাম দুই সহোদর।
সপ্তগ্রামে বার লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর ॥
যে যুগে টাকায় ৫/৬ মণ চাউল পাওয়া যাইত সে যুগে বার লক্ষ টাকার মূল্য কত সহজেই বুঝা যাইবে। কবিকঙ্কণের সমসাময়িক বিদেশী পর্যটক সিজার ফ্রেডারিক সপ্তগ্রামের বাণিজ্য ও ঐশ্বর্যের বিবরণ দিয়াছেন। প্রতি বৎসর এখানে ৩০/৩৫ খানা বড় ও ছোট জাহাজ আসিত এবং মাল বোঝাই করিয়া ফিরিয়া যাইত।
মধ্যযুগে বাংলা দেশে খাদ্যদ্রব্য ও বস্ত্র খুব সস্তা ছিল। চতুর্দ্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইবন্ বতুতা বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন। তিনি তৎকালীন দ্রব্যমূল্যের নিম্নলিখিত তালিকা দিয়াছেন।
দ্রব্য | পরিমাণ | মূল্য বর্তমানের (নয়া) পয়সা |
চাউল | বর্তমানকালের একমণ | ১২ |
ঘি | বর্তমানকালের একমণ | ১৪৫ |
চিনি | বর্তমানকালের একমণ | ১৪৫ |
তিল তৈল | বর্তমানকালের একমণ | ৭৩ |
উত্তম কাপড় | ১৫ গজ | ২০০ |
দুগ্ধবতী গাভী | ১টি | ৩০০ |
হৃষ্টপুষ্ট মুরগী | ১২টি | ২০ |
ভেড়া | ১টি | ২৫ |
এক বৃদ্ধ বাঙালী মুসলমান ইবন্ বতুতাকে বলিয়াছিলেন যে তিনি, তাঁহার স্ত্রী ও একটি ভূত্য–এই তিনজনের খাদ্যের জন্য বৎসরে এক টাকা ব্যয় হইত। (স্বর্ণমানের হিসাবে সাত টাকা)।
ইবন বতুতা আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত টেঞ্জিয়ারের অধিবাসী। তিনি আফ্রিকার উত্তর উপকূল ও এশিয়ায় আরব দেশ হইতে ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়া হইয়া চীন দেশ পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন যে সারা পৃথিবীতে বাংলা দেশের মত কোথাও জিনিসপত্রের দাম এত সস্তা নহে।
সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে বার্ণিয়ার লিখিয়াছেন যে সাধারণ বাঙালীর খাদ্য চাউল, ঘূত ও তিনচারি প্রকার শাকসবজী–নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যাইত। এক টাকায় কুড়িটা বা তাঁহার বেশি ভাল মুরগী পাওয়া যাইত। হাঁসও এইরূপ সস্তা ছিল। ভেড়া এবং ছাগলও প্রচুর পাওয়া যাইত। শূকরের মাংস এত সস্তা ছিল যে এদেশবাসী পর্তুগীজরা কেবল তাহা খাইয়াই জীবন ধারণ করিত। নানারকম মাছও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাইত।
ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ‘দুর্বলার বেসাতি’ বর্ণনায়ও দ্রব্যের মূল্য এইরূপ সস্তা দেখা যায়। রাজধানী মুর্শিদাবাদে ১৭২৯ খ্রীষ্টাব্দে খাদ্যদ্রব্যের মুল্য এইরূপ ছিল।”[ K.K. Datta. op. cit. 463-54]
প্রতি টাকায় | খুব ভাল চাউল (বাঁশফুল) | প্রথম শ্রেণী | ১ মণ ১০ সের |
প্রতি টাকায় | খুব ভাল চাউল (বাঁশফুল) | দ্বিতীয় শ্রেণী | ১ মণ ২৩ সের |
প্রতি টাকায় | খুব ভাল চাউল (বাঁশফুল) | তৃতীয় শ্রেণী | ১ মণ ৩৫ সের |
প্রতি টাকায় | মোটা (দেশনা ও পূরবী) চাউল | ৪ মণ ২৫ সের | |
প্রতি টাকায় | মোটা (মুশসারা) | ৫ মণ ২৫ সের | |
প্রতি টাকায় | মোটা (কুরাশালী) | ৭ মণ ২০ সের | |
প্রতি টাকায় | উৎকৃষ্ট গম | প্রথম শ্রেণী | ৩ মণ |
প্রতি টাকায় | উৎকৃষ্ট গম | দ্বিতীয় শ্রেণী | ৩ মণ ৩০ সের |
প্রতি টাকায় | তৈল | প্রথম শ্রেণী | ২১ সের |
প্রতি টাকায় | তৈল | দ্বিতীয় শ্রেণী | ২৪ সের |
প্রতি টাকায় | ঘৃত | প্রথম শ্রেণী | ১০।।০ সের |
প্রতি টাকায় | ঘৃত | দ্বিতীয় শ্রেণী | ১১+১/৪ সের |
কাপাস (তুলা) প্রতি মণ ২।।০ টাকা |
মধ্যযুগের শেষভাগে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে সরকারী কাগজপত্রে বাংলা দেশকে বলা হইত ভারতের স্বর্গ। ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি, প্রাকৃতিক শোভা, কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যসম্ভার, জীবনযাত্রার সচ্ছলতা প্রভৃতির কথা মনে করিলে এই খ্যাতির সার্থকতা সহজেই বুঝা যায়।
দেশে ঐশ্বর্যশালী ধনীর পাশাপাশি দারিদ্রের চিত্রও সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কারণ দ্রব্যাদির মূল্য খুব সস্তা হইলেও সাধারণ কৃষক ও প্রজাগণের দুঃখ ও দুর্দশার অবধি ছিল না। ইহার অনেকগুলি কারণ ছিল; তাহাদের মধ্যে অন্যতম রাজকর্মচারীদের অযথা অত্যাচার ও উৎপীড়ন। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর গ্রন্থকার মুকুন্দরাম চক্রবর্তী দামিন্যায় ছয় সাত পুরুষ যাবৎ বাস করিতেছিলেন–কৃষিদ্বারা জীবন যাপন করিতেন। ডিহিদার মামুদের অত্যাচারে যখন তিনি পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়া অন্যত্র যাইতে বাধ্য হইলের তখন তিন দিন ভিক্ষান্নে জীবন ধারণের পর এমন অবস্থা হইল যে–
তৈল বিনা কৈল স্নান করিলুঁ উদক পান,
শিশু কাঁদে ওদনের তরে
ক্ষেমানন্দ কেতকদাসেরও এইরূপ দুরবস্থা হইয়াছিল। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে সতীনের কোপে খুল্লনার কষ্ট ও ফুল্লরার বার মাসের দুঃখ বর্ণনায় এই দারিদ্র-দুঃখ প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। [কবিকঙ্কণ চণ্ডী, প্রথম ভাগ ২৫৭ পৃ.] দ্বিজ হরিরামের চণ্ডীকাব্যেও খুল্লনার দুঃখ বর্ণিত হইয়াছে। শাসনকর্ত্তার অত্যাচারে সচ্ছল গৃহস্থের কিরূপ দুরবস্থা হইত মাণিকচন্দ্র রাজার গানে তাঁহার বর্ণনা পাই।
ভাটি হইতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি।
সেই বাঙ্গাল আসিয়া মুলুকৎ কৈল্প কড়ি ॥
আছিল দেড় ঝুড়ি খাজনা লইল পনর গণ্ডা।
লাঙ্গল বেচায় জোয়াল বেচায়, আরো বেচায় ফাল।
খাজনার তাপতে বেচায় দুধের ছাওয়াল ॥
রাঢ়ী কাঙ্গাল দুঃখীর বড় দুঃখ হইল।
খানে খানে তালুক সব ছন হৈয়া গেল ॥
কিন্তু সুশাসনে প্রজারা চাষবাস করিয়াও, কিরূপ সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করিত তাঁহারও উজ্জ্বল অতিরঞ্জিত বর্ণনা ময়নামতীর গানে আছে :
সেই যে রাজার রাইঅত প্রজা দুষখু নাহি পাএ।
কারও মারুলি (পথ) দিয়া কেহ নাহি যায় ॥
কারও পুষ্করিণীর জল কেহ নাহি খাএ।
আথাইলের ধন কড়ি পাথাইলে শুকায়।
সোনার ভেটা দিয়া রাইঅতের ছাওরাল খেলায়।।
[২-৪ পংক্তির অর্থ এই যে প্রত্যেকেরই নিজের নিজের পথঘাট পুকুর আছে–মূল্যবান দ্রব্য যেখানে সেখানে ফেলিয়া রাখে চোরের ভয় নাই। বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় পৃ. ৩৩৫]
বিদেশী পর্যটক মানরিক লিখিয়াছেন যে খাজনার টাকা না দিতে পারিলে হিন্দুদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিলামে বিক্রয় করা হইত। কর্মচারীরা কৃষকদের নারী ধর্ষণ করিত এবং পিয়াদারা নানা প্রকার উৎপীড়ন করিত। ইহার কোন প্রতিকার ছিল না। অথচ ইহারাই ছিল শতকরা নব্বই জন।
লোকদের দুর্দশার আর একটি কারণ ছিল যুদ্ধের সময় সৈন্যদের লুঠপাট। দুই পক্ষের সৈন্যেরাই লুঠপাট, নারীধর্ষণ প্রভৃতিতে এত অভ্যস্ত ছিল যে, সৈন্যের আগমনবার্তা শুনিলেই রাস্তায় দুই পার্শ্বের গ্রাম ছাড়িয়া লোকে দূরে পলাইয়া যাইত। যুদ্ধের বিরতির পরেও বিজয়ী সৈন্যেরা লুঠপাট করিত। প্রতাপাদিত্যের আত্মসমর্পণের পর বিজয়ী মুঘল সেনানায়ক একদিন উদয়াদিত্যকে বলিলেন “মীর্জা মক্কী তোমাদের দেশ লুঠ করিতেছে আর তোমরা তাহাকে থলে ভর্তি সোনা দিতেছ। আমি চুপ করিয়া আছি বলিয়া আমাকে একটা আম কাঁঠালও পাঠাও না। আচ্ছা, কাল ইহার শোধ নিব।” সেনানায়কের আজ্ঞায় রাত্রি দ্বিপ্রহরে জল ও স্থলের সৈন্য ঘোড়ায় চড়িয়া রাজধানী যশোহর যাত্রা করিল এবং এমন ভাবে লুঠপাট করিল যে পূর্বের কোন অভিযানে আর সেরূপ হয় নাই। উক্ত সেনানায়ক নিজেই ইহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুর অত্যাচারে দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র উপকূলের অধিবাসীরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকিত। ইহারা নগর ও জনপদ লুঠপাট করিত ও আগুন লাগাইয়া ধ্বংস করিত, স্ত্রীলোকদের উপর বহু অত্যাচার করিত এবং শিশু, যুবক, বৃদ্ধ নর নারীকে হরণ পূর্বক পশুর মত নৌকার খোলে বোঝাই করিয়া লইয়া দাসরূপে বিক্রয় করিত। ১৬২১ হইতে ১৬২৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পর্তুগীজরা ৪২,০০০ দাস বাংলার নানা স্থান হইতে ধরিয়া চট্টগ্রামে আনিয়াছিল। অনেক দাস পর্তুগীজেরা গৃহকার্যে নিযুক্ত করিত।
স্থলপথে অভিযানের সময়ও সৈন্যরা গ্রাম লুঠপাট করিয়া বহু নর-নারীকে বন্দী করিয়া দাসরূপে বিক্রয় করিত। শান্তির সময়েও সাধারণ লোককে কর্মচারীদের হুকুমে বেগার (অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে) খাঁটিতে হইত। মোটের উপর মধ্যযুগে সাধারণ লোকের অবস্থা খুব ভাল ছিল এরূপ মনে করিবার কারণ নাই। তবে ভাতকাপড়ের দুঃখ হয়ত বর্তমান যুগের অপেক্ষা কম ছিল।