১২. অরুণকে দেখা গেল না

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

খবরটা যখন পৌঁছল তখন অরুণকে দেখা গেল না। সে যে কোথায় লুকিয়ে বসে আছে তা কেউ জানে না। খবর সেদিন বেরোবে তা অরুণও জানত–কিন্তু কলকাতায় গিয়ে দেখে আসার সাহস হয় নি। এমনিই গত কদিনে যেন শুকিয়ে উঠেছে সে, মুখ- চোখের এমন ম্লান অবস্থা যে তাকানো যায় না। তিন-চারদিন ধরে বলতে গেলে ভাতের সামনে বসেছে শুধু। তাও সাধ্য-সাধনা করে বসানো, বুঁচি গিয়ে খুঁজে-পেতে নিয়ে আসে তাই–বাগানের কোন্ কোণে লুকিয়ে বসে থাকে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধই করে দিয়েছে এক রকম।

বুঁচি খুঁজতেও আসে–আবার সে জন্যে ফৈজতও কম নয়।

মুখের সামনে তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে বলে, ‘বলি, তুমি পেয়েছ কী আমায়? কত মাইনে দাও যে পেত্যহ এমনি করে খুঁজে পেতে সাধ্যিসাধনা করে নিয়ে যেতে হবে! ভাত খেয়ে কি আমার মাথাটা কিনবে?’

ওর সেই তিরস্কারের ভঙ্গিতে রাগ হয় না অরুণের, বরং তার সেই অপরিসীম শুষ্ক মুখেও প্রসন্ন হাসি ফোটে।

তুমি খোঁজো কেন–আমি কি বলি খুঁজতে? কৈ, আর তো কেউ খোঁজে না।’

‘তুমি বলবে কেন, তুমি যদি দুটো কথা বলতে কি একটা দুটো ফরমাশ করতে কাউকে তাহলেও তো বুঝতুম যে খানিকটা মানুষের মতো কাজ হ’ল।…. আমার যে হয়েছে যত জ্বালা। আর তো কারুর মাথাব্যথা নেই। একটা মনিষ্যি খাচ্ছে না চান করছে না, মুখ শুকিয়ে শুকিয়ে বেড়াচ্ছে তা কি কারুর হুঁশপব্ব আছে? –আচ্ছা, তাও বলি, এত ভাবনার কি আছে, ফেল তো তুমি করবে না বাপু।

তো কি বলা যায়–যদি ফেল করি! এদের এতগুলো পয়সা খরচ করালুম, ফেল করলে আর মুখ দেখাতে পারব না। একে তো এই বুড়ো বয়সে এগজামিন দেওয়া বলতে গেলে–’

‘নাও, তুমি আর হাসিও নি বাপু। আঠারো-উনিশ বছরে একটা পাস করে যাবে– সেটা কি কম কথা হল! ঐ-তো মজুমদারদের গ্যাঁড়া–ওর তো বয়সের গাছ পাথর নেই- ফি বছর এগজামিন দিচ্ছে ফেল করছে আর বিড়ি ফুঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। …. নাও, এখন ওঠো, দয়া করে নেয়ে খেয়ে আমায় উদ্ধার করবে চলো। ….তুমি যেদিন ফেল করবে সেদিন পূবের সূয্যু পশ্চিমে উঠবে।’

‘কেন আমি কি একবারে বিদ্যের জাহাজ–ফেল করতে পারি না!…. আমার তো মনে হচ্ছে কিছুতেই পাস করতে পারব না।’

‘রেখে বোস দিকি বাপু! এমন পাগলামী ছেমো কে তোমার মাথায় ঢোকালে! তুমি যদি ফেল করো তাহলে বুঝব সাক্ষেৎ মা সরস্বতীর সাধ্যি নেই এ এগ্‌জামিনে পাস করার। বিদ্যের জাহাজ কি বলছ–বাবা, যে পড়াটা তুমি পড়লে আমি তো মনে করি এক জাহাজ বিদ্যে তোমার পেটে ঢুকে গেছে।…. নাও নাও ওঠো–খেয়ে আমার মাথা কিনবে চলো, তোমার সঙ্গে এত বাজে বকবার সময় নেই আমার।’

অগত্যা অরুণকে উঠতে হয়, স্নানাহারও করতে হয়। অন্তত ভাতের সামনে বসতে হয় একবার। এই ভাবেই চলছে কদিন। স্বর্ণলতা ধরে না আনলে বোধহয় এর মধ্যে তার একবারও খাওয়া হ’ত না–খাওয়ার কথা মনেই পড়ত না। রকমসকম দেখে প্রমীলা হেসে বলত, ‘মা-লক্ষ্মীর আমার চাকরিটি হয়েছে ভাল! ও বুঝি তোমার খাস তালুকের প্রজা– হ্যাঁ-গা গিন্নীমা, তাই তুমি না বললে উঠবে না খাবে না?’

মহাশ্বেতা আড়ালে গজরাত, ‘মুয়ে আগুন মেয়ের। ঘরজ্বালানি পরভালানি। নিজের ভেয়েরা খেলে কিনা–তা একবারও খোঁজ নিস? পরের জন্যে তো মাথাব্যথার সীমে- পরিসীমে নেই একেবারে।’

‘নিজের ভেয়েদের খবর নোব কি, নিত্যি-তো চোখে দেখছি–চারবার, সদরে চারবার চুরি করে–এই আটবার খাওয়া তো বাঁধা! খবর নিতে গেলে তো চুরি-বিদ্যের খবরও রাখতে হয় গো–বাপ-কাকাকে জানাতেও হয়। সেটা কি ভাল হবে–বুঝে দ্যাখো।

ঝঙ্কার দিয়ে চলে যেত স্বর্ণলতা। মহাশ্বেতার শুধু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া উপায় থাকত না। চারবার না হোক, চুরি করে এটা-ওটা খাওয়া যে তার ছেলেদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে তা সেও জানে। বরং বলা যায়, সে-ই শিখিয়েছে।…

সেদিন খবর বেরোবে, ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দেবে–এ খবরটা রটে গিয়েছিল আগের দিনই। দুর্গাপদ অরুণকে ডেকে বলেছিল, ‘তাহলে আমি বলি কি অরুণচন্দর, আমার মান্থলী টিকিটটা নিয়ে ভোরের গড়িতে চলে যাও তুমি–দেখে সাতটার মধ্যে ফিরতে পারবে না?…. না হয় আটটার গাড়িতে এসো, আমি ইস্টিশানে টিকিটটা নিয়ে নেব’খন্ তোমার কাছ থেকে।’

কথাটা শুনে অরুণের মুখ বিবর্ণতর হয়ে উঠল। স্বর্ণলতা লক্ষ করল, তার পা দুটো ঠক্-ঠক্ করে কাঁপছে।

সে বললে, ‘খুব লোককে গিয়ে খবর নিতে বলছ ছোটকা, দেখছ না ওর অবস্থা। ….হাওড়া ইস্টিশানে পৌঁছে কোথায় ভিরমি লেগে দাঁত ছিরকুটে পড়ে থাকবে–তখন তোমার আপিস যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ও বাপু তুমিই একটু কষ্ট করে জেনে দাও–’

স্বর্ণলতা কর্তাদের সকলেরই প্রিয়। দুর্গাপদর একটু ভুরু কুচকে উঠেছিল আগে প্রস্তাবটা শুনে–কিন্তু ওর মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল শেষ পর্যন্ত, ‘আমাকেই খবরটা জেনে দিতে হবে?…. তা দেব। তবে বাছা ভোরে গিয়ে ফিরে এসে সাত-তাড়াতাড়ি বেরোনো, সে আমার দ্বারা হবে না, বরং একটা ট্রেন আগে, কি মেজদার সঙ্গেই, খেয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে যাব–খবরটা জেনে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব! কেমন?’

স্বর্ণলতা খুশি হয়ে বলে, সেই ভাল।’

তখন থেকে অরুণের অবস্থা দাঁড়িয়েছে শোচনীয়। রাত্রে নাকি ঘুমোয় নি এক বিন্দুও, যারা ওর ঘরে শোয় তারা সবাই বলেছে সে কথা; যে যখন উঠেছে রাত্রে ওকে দেখেছে বসে থাকতে। তার ওপর ভোর-না হতেই এমন উধাও হয়েছে যে বহু খুঁজেও কেউ পাত্তা পাচ্ছে না। বাগান, পুকরপাড়, ওধারের বাগান–সব নাকি দেখা হয়ে গেছে।

পাত্তা কে পাবে তা অবশ্য গিন্নীরা সকলেই জানে। প্রমীলা মুখ টিপে হেসে বলে, ‘তোদের ব্যস্ত হতে হবে না–তোরা নিজের ধান্দায় যা। আমার গিন্নীমায়ের দুধ জ্বাল দেওয়াটা শেষ হোক–এখবর সে-ই পৌঁছে দেবে এখন।’

লজ্জা পায় স্বর্ণলতা, ‘বেশ বলছ তো বাপু, কেউ খুঁজে পেলে না যেকালে সেকালে আমিই বা পাব কি করে? আমি তাকে ট্যাঁকে পুরে রেখেছি, না সিন্দুকে চাবি দে রেখেছি?’

‘কোথায় রেখেছ–কোথায় রাখো তা তুমিই জান মা–তুমিই তো খুঁজে পাও দেখি ঠিক!’ স্বর্ণলতার আরক্ত মুখের দিকে চেয়ে তরলা তাড়াতাড়ি কথাটার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, বলে, ‘আসলে ওর স্বভাবটা লক্ষ করেছে আর কি, কোথায় বসে থাকতে পারে সেটা ওর জানা হয়ে গেছে।…. তা তুই যা না বাপু, আমি দুধ দেখছি।’

‘সে বাপু আজ বলা শক্ত।’ নরম হয়ে আসে স্বর্ণ, ‘আজ সে মোক্ষম লুকোন ভ্যালা লুকিয়েছে–বেশ বুঝতে পারছি।…. তা এসো তাহলে তুমি, দুধ দেখসে।…. ভ্যালা জ্বালা হয়েছে বাপু, দেখি আবার, কোন সাপের গত্তে কি ব্যাঙের গত্তে লুকোলো!

সে কিন্তু সোজাই খুঁজে বার করলে ওকে একবারেই। সবাই সব জায়গা দেখেছে যখন–তখন আবার নতুন করে দেখতে গিয়ে লাভ নেই সেই সব জায়গাই। সে এমন কিছু দূরবীন চোখে এঁটে যাচ্ছে না যে অপরের চোখে যা পড়ে নি তা তার চোখে পড়বে। সে জানত যে পাইখানার দিকটা কেউ যাবে না, অথচ ঐখানে পগারের ধারে নোনাগাছে আর জামরুল গাছে জড়াজড়ি করা বাঁশঝাড়ের আড়ালে বেশ একটি নিরাপদ জায়গা আছে– লোকচক্ষুর আড়ালে।

আর সত্যিই সেইখানে পাওয়া গেল অরুণকে।

বলি তেমার ব্যাওরাটা কী বলো দিকি! তুমি মনিষ্যি না ভূত! বলি কাউকে খুন করে ফেরার হয়েছ নাকি যে এমন জায়গায় এই গুয়ের বনে এসে নুকোতে হবে! ধন্যি বাবা, ধন্যি!‘ ওকে দেকে অরুণ উঠে এল অবশ্য। কিন্তু ভয়ে বোধ করি তার পা অবশ হয়ে গেছে তখন–আসতে আসতে দু-তিনবার টাল খেল সে।

‘ওগো ভয় নেই–পাস করেছ! পাস করেছ! ছোট-কা নিজের চোখে দেখে খবর পাট্টেছে। খুব ভাল পাস করেছ নাকি, কী একদাঁড়ি না কি বলে–তাই পেয়েছ। একদাঁড়ি কাকে বলে গা?

‘ফা-ফার্স্ট ডিভিসন। প্রথম বিভাগ। খ-খবরটা কে দিলে বুঁচি!’

যে দিয়েছে ভাল লোক। ছেলেছোকরা কেউ নয়। মতি ভট্‌ট্চাযের ছেলেও তো এই এগজামিন দিয়েছিল, ছেলের সঙ্গে সেও গিয়েছিল দেখতে, তাকে দিয়েই বলে দিয়েছে। মতিবাবুর ছেলে নাকি তিন দাঁড়ি পেয়েছে। দুঃখ করছিল খুব। আমি তো জানি বেশি পেলেই ভাল–তা এ বাপু দেখছি তোমার এই পাসের পড়ার সবই বিপরীত!’

‘ছোট-কা–ছোট-কা ঠিক দেখেছেন তো–ভুল হয়নি?’

‘তোমার বাপু ধরনধারণ দেখলে আমার গা জ্বালা করে। এ কি ভুল দেখবার জিনিস? তার এ জ্ঞান নেই? তোমার যা কাণ্ড তা তো নিজে চোক্ষে দেখেছে সে, ভুল খবর দিলে যে তোমার ধাত ছেড়ে যাবে তা জানে না? মতিবাবুও দেখেছে–ছোটকা দেখিয়েছে তাকে। ওরা আপিসে কাজ করে–কত সায়েবের কাজ ওদের হাতে, ওদের ভুল করলে চলে না– জানো! তাহলে য়্যাদ্দিন চাকরি করে খেতে হ’ত না।’

এবার অরুণের মুখ পরিষ্কার হয়। মুখে হাসি ফোটে তার! হঠাৎ কি মনে করে– সম্ভবত ধারে-কাছে জনপ্রাণী ছিল না বলেই ভরসা হয় কতকটা–স্বর্ণলতার একটা হাত ধরে বলে, ‘তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে–না বুঁচি?’

‘তা বাপু হচ্ছে একটু মিছে কথা বলব না।… তা এ কথাটা জিগ্যেস করলে কেন হঠাৎ? তুমি এগজামিন দিয়ে পাস করেছ, আমার আনন্দ হবে কেন?

ওর মুঠির মধ্যে থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে না, শুধু একটু বিস্মিত কৌতূহলী দৃষ্টিতে চায় ওর মুখের দিকে।

কিন্তু অরুণের ভরসার পুঁজি ততক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে। সে অপ্রতিভভাবে নিজেই হাতটা ছেড়ে দেয়, অন্যদিকে চেয়ে বলে, ‘না–তুমিই তো এর মূলে,–তুমি চাড় না করলে আমার পড়াই হত না হয়ত। তোমার দয়াতেই আমার পাস করা হ’ল–সে কথা আমি ভুলব না কোনদিন।’

স্বর্ণলতা তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ধমক দিয়ে ওঠে, ‘তুমি আর ঐ সব নেকচার ঝাড়তে বসো নি বাপু!…. ঐ সব দয়া-ধৰ্ম্ম হ্যাঁনো ত্যানো–কথাগুলো শুনলে আমার রাগ ধরে যায়। চলো দিকি, এখন বাড়িতে চলো। মুখ-চোখের কী ছিরিই হয়েছে। আহা!…. দয়া করে এখন গিয়ে মুখে একটু কিছু দেবে চলো, ব্যাগত্তা করি। আমার এখন আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার ঐ নেকচার শোনবার সময় নেই–এখুনি খাড়া-খাড়া হরিট পাঠাতে হবে ঠাকুরঘরে — মানসিক রয়েছে!’

‘কে মানসিক করেছিল–তুমি? আমার পাসের জন্যে?’ যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে যায় অরুণ। তার গলার কাছে কী যেন একটা ঠেলে উঠছে, কথা বেরোতে চাইছে না ঠিকমতো।

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ! নইলে আর কার মানসিকের জন্যে মাথাব্যথা পড়ে যাবে শুনি! বলি কাউকে তো করতে হয় একটা। পাসটা কি অমনি হয় নাকি? দেবতা-ঠাকুরকে না জানালে চলে? মেজকাকীও হয়ত করতে পারে–তা জানি না। মা-মাসীরই তো করবার কথা। তবে আমি বাবার কাছ থেকে চেয়ে নে স’ পাঁচ আনা পয়সা আলাদা করিয়ে রেখেছি। সুভালাভালি ভাল খবর এলে সেই দণ্ডে হরিনুট দেব –এই মানসিক!…. নাও নাও–চলো, আবার দাঁড়ালে কেন!

‘যাচ্ছি। চলো।’ অস্পষ্ট ধরা গলায় উত্তর দেয় অরুণ। তার চোখ দুটো কে জানে কেন, ঝাপসা হয়ে গেছে! একটু মুছে নিতে পারলে হত। কিন্তু পাছে মুছতে গেলে জল বেরিয়ে যায়–জলের চিহ্ন ধরা পড়ে, সেইজন্যে সাহস হচ্ছে না তার।

কয়েক পা গিয়ে স্বর্ণলতাই দাঁড়িয়ে পড়ে।

তা এবার তাহলে তুমি কি করবে?’

তেমনি ধরা-গলায়ই অরুণ উত্তর দেয়, ‘দেখি মেসোমশাই কি বলেন। একটা চাকরি- বাকরিরই চেষ্টা দেখতে হয়।’

‘কেন–আর পড়বে না? বি-এ পাস করার অত শখ তোমার–!’

‘কত দিন আর পরের ঘাড়ে চেপে এমন বসে বসে খাব বলো? কলেজে পড়ার যে অনেক খরচা?’

‘জলপানি পাবে না? ছোট-কা বলেছিল সেদিন, ও জলপানি পেতে পারে।’

‘কী জানি, আমার কি আর অত ভাগ্য হবে?’

তারপর একটু থেমে বলে, ‘স্কলারশিপ পেলেও, হয়ত একটা দশ টাকার ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পাব। তাতে তো কলেজের খরচাই চলে যাবে। যদি ফ্রি হতে পারি তাহলেও না হয় কথা। তাতেও–ভর্তির টাকা তো আর ফ্রি হয় না, সেও একগাদা টাকা লাগবে। আর এদের ঘাড়ে এমনভাবে বসে খাওয়া কি ঠিক?’

‘দ্যাখো, এ তো নারদের গুষ্টি দেখতেই পাচ্ছ–রান্নাঘরে রাবণের চিতে জ্বলছেই –তা যেখানে এতগুনো লোক বসে খাচ্ছে সেখানে আর একটা লোককে খাওয়াতে কি আমার বাপ-কাকারা দেউলে হয়ে যাবে?… আমার ভাইগুনিকেও তো দেখছ –না পড়াশুনো না রোজগার, কোন চেষ্টাই নেই, হল্লো হল্লো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু। তারাও তো খাচ্ছে চারবেলা! তুমি অত কিন্তু হচ্ছ কেন? তুমি এ সংসারে দুটো ভাত খেলে তবু তো বুঝব ভাল কাজে গেল।.. তোমার দিন তুমি কিনে নাও। জলপানি পাও তো উত্তম কথা, না হলেও তুমি মেজ-কাকে কিছু জিগ্যেস করতে যেও নি। মেজকাকে আগে বললেই বলবে চাকরিতে, ঢুকে পড়ো, আর একবার বলে ফেললে মুশকিল।… কথা যা পাড়বার আমিই পাড়ব। এখন কলেজে ভর্তির কত টাকা লাগে চুপি চুপি আমাকে বলো–’

আবার চলতে শুরু করল ওরা। চলতে চলতেই অরুণ বলল, ‘দেখি–।’

‘না না, দেখি-টেখি নয়। ও ঠিক করেই ফ্যালো। তুমি কালই খোঁজ ক’রে আমাকে বলবে। তোমার ভত্তির টাকা–বই-খাতা–কী কী লাগবে সব বলে দিও। মেজ-কাকে বলে আমি সব আদায় করে দিয়ে যাব যাবার আগে। আমার তো আবার শিয়রে সংক্রান্তি– গোনা-গাঁথা দিন আর থাকা এখানে!’

‘তার–তার মানে? তুমি কোথাও যাবে নাকি?’ কথাগুলো উচ্চারণ করতে অরুণের যেন রীতিমতো কষ্ট হয়। উত্তরটা যেন সে আগেই আশঙ্কা করে, ‘কোথায় যাবে–কত দিনের জন্যে?’

‘কতদিন কি গো? তুমি কিচ্ছু জান না? একেবারেই তো যাচ্ছি। কোথায় আর যাব বলো, মেয়েরা কোথায় যায় বড় হলে? আমায় যে এরা বিদেয় করে দিচ্ছে এ বাড়ি থেকে।’

এতক্ষণে জিনিসটা কি মনে পড়ে তার লজ্জা হয় একটু, সে মাথা নামায়।

‘তোমার–তোমার বিয়ে হচ্ছে? আশ্চর্য। আমি কিছু শুনি নি তো!’

‘শুনবে কি ক’রে বল, তুমি কি আর মনিষ্যির সংসারে বাস করো? তুমি তো শ্যালের মতো গত্তে ঢুকে বসে থাক চৌপর দিন!… ও কি, আবার দাঁড়ালে কেন, চলো চলো—’

এবার স্বর্ণই অসহিষ্ণু হয়ে ওর একটা হাত ধরে টানে

আবার চলতে শুরু করে অরুণ–কিন্তু মনে হয় যেন পৃথিবীতে আর কোথাও কোন জিনিস সম্বন্ধে তার আগ্রহ নেই। পাস হল কিনা এখন যেন তাও তুচ্ছ হয়ে গেছে তার কাছে। এই বাড়িতে, এই পৃথিবীতে একমাত্র যে অবলম্বন ছিল,–সে চলে যাচ্ছে, অবলম্বন বলতে আশ্রয় বলতে আর কিছু রইল না, পায়ের নিচের মাটিটাই যেন সরে যাচ্ছে তার

অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে শুধু জিগ্যেস করে, ‘সে–সে কবে হবে?’

‘কী হবে, বে?…এই তো সামনের মাসের আটুই। এদের এত তাড়াতাড়ি করবার ইচ্ছে ছিল না। তারাই জোর করছে। মুয়ে আগুন! তাদের যেন ঘর চলছে না একেবারে। এ তারিখের পরই বুঝি কি অকাল পড়ছে, তার আগে সারতে চায় তারা।’

আপন মনেই বলে যাচ্ছিল, হঠাৎ অরুণের মুখের দিকে চোখ পড়ে যেন চমকে উঠল সে।

হয়ত কারণটাও আনুমান করল সে–সঙ্গে সঙ্গেই।

‘ও মা, কী হল গো তোমার? তোমার মুখ অমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল কেন আমার বের কথা শুনে? তুমি কি ভাবতে আমি চিরকাল এখানে থেকে তোমাকে আগলে আগলে রাখব? কোন কালে আমার বে-থা, ঘর-কন্না হবে না?’

তারপর গলা নামিয়ে–ছেলেমানুষকে যেমনভাবে সান্ত্বনা দেয়–তেমিনভাবে বলে, ‘ওগো বাবু, এখন থেকেই তোমাকে অত ভাবতে হবে না তা বলে! যাব বলে কি আমি সেই দিন থেকেই একেবারে চলে যাব? আটদিন বাদে ফিরে এসে তো এখন তিন-চার মাস থাকবই, সে বাবা যাচ্যেই নিয়েছে তাদের সঙ্গে–তারপরও আসব যাব। এই কাছেই তো–শিবপুরে বে হচ্ছে। তবে তুমি এবার থেকে একটু সেয়ানা-শঠ হও বাপু। চিরদিনই কি এমনি গো-বেচারা ভাল-মানুষ থাকবে?’

বাড়ির মধ্যে থেকে প্রমীলা হাঁক পাড়ে, ‘কৈ লো বুঁচি, পেলি সে ছোঁড়াকে?’

‘পৈয়েছি মেজকাকী–যাচ্ছি। …চলো চলো, ওরা ভাবছে।’

সে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে যায় অরুণকে।

।।২।।

স্বর্ণলতার বিয়ের চেষ্টা চলছে অনেকদিন ধরে। অরুণই শুধু খবর রাখত না, নইলে সবাই জানে। ইদানীং বড় দুই কর্তা ছুটির দিনেও অফিসের মতো সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়ে পড়তেন পাত্রের খোঁজে, চেনা-জানা যত ব্রাহ্মণ পরিবার আছে সকলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। বলতেন, সামনে গিয়ে না পড়লে গরজ হবে না। খিদিরপুর, বেহালা, কালীঘাট, ঢাকুরে মায় বারুইপুর, মল্লিকপুর–এদিকে এই, ওদিকে শ্রীরামপুর, গোঁদলপাড়া, বরানগর, নৈহাটী–সব চষে ফেলেছেন। একটি মেয়ে তাঁদের, ভাল পাত্রে দেবেন, তাতে কিছু খরচ হয় হোক্–এই জন্যেই এত খোঁজাখুঁজি। আবার তাঁদের পছন্দমতো পাত্রপক্ষ মেয়ে পছন্দ করে না। কটা চোখ, মানানসই যা তার চেয়েও বেঁটে এই সব আপত্তি হয় তাদের।

অনেক কাণ্ডর পর এই পাত্র ঠিক হয়েছে। পাত্র খুব সুন্দর দেখতে, শিবপুরে নিজেদের বাড়ি, দুটো পাস, কোন্ বিলিতী ফার্মে চাকরি করে। এর চেয়ে ভাল পাত্র গৃহস্থ সংসারে আশা করা যায় না। খরচ কিছু বেশিই পড়বে, সব রকম গহনা, খাট-বিছানা, আলমারী ছাড়াও তিন হাজার টাকা নগদ দিতে হবে। এটা কিছুতেই কমাতে চাইলেন না হরেনের মা। মেজকর্তা দাদাকে বললেন, ‘আমি শুনেছি ওর মার কিছু দেনা আছে, সেই জন্যেই জোর করছে টাকাটার জন্যে। মানুষটা একটু মেয়ে-কাপ্তেন গোছের আর কি!…. নগদ টাকাটা পাবার আশাতেই এক কথায় ওরা পছন্দও করেছে, নইলে অমন সুন্দর ছেলে, আমাদের মেয়ে ওর পাশে মানায় না, সে তো আমরাই বুঝছি। ওটার জন্যে এ পাত্র হাতছাড়া করো না।’

‘টাকার কথা তুমি জান’ অভয়পদ চিন্তিত মুখে উত্তর দিলে, ‘কিন্তু শাশুড়ীর যে রকম হাত–এর পরে? আবারও যদি দেনা করে? এখানে দেবে মেয়ে?’

‘এর পর দেনা করে সে বুঝবে! আমি খুব ভাল করে খোঁজ নিয়েছি–বাড়ি ছিল হরেনের বাবার নামে–চার ভাই ওরা, ছোট এখনও নাবালক, বাড়ি তো আর বাঁধা দিতে পারবে না। তাছাড়া, বুঁচিই তো হবে বড় বৌ, ছেলে-পুলে হলে ও-ই বাড়ির গিন্নী হবে তখন আর শাশুড়ীর কী জোরই বা থাকবে। ছেলে ভাল চাকরি করে–আপনার গণ্ডা আপনি বুঝে নিতে পারলেই হল!’

‘দ্যাখো যা ভাল বোঝ।’ অভয় নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় ভাইয়ের ওপর ছেড়ে দেয় সব।

সেইখানেই বিয়ে ঠিক হয়েছে, সামনের আটই বিয়ে।

ঘটা করেই বিয়ে দেবে কর্তারা। এ গ্রামের সব বাড়ি থেকেই একটি করে বলা হবে, পাড়ায় বাড়িসুদ্ধ সবাই। এ ছাড়া আত্মীয়-কুটুম্ব তো আছেই। পৈতে-টৈতে যা এর আগে হয়ে গেছে, এই বলতে গেলে প্রথম কাজ–সকলকে আনা চাই-ই, ক্ষীরোদা বার বার করে বলে দিয়েছেন। তিনি এখন আর খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু চোখ কান, দুই-ই ভাল আছে। বসে বসে তিনিই সব ফর্দ করলেন–কোথায় কোথায় বলতে হবে। সবসুদ্ধ পাঁচশ’ লোক দাঁড়াল।

মহাশ্বেতা এরই মধ্যে একদিন স্বামীকে ধরে বললে, ‘হ্যাঁ গা, তা তোমরা অত বোকা কেন?’

স্ত্রীর মুখে অপরের সম্বন্ধে বুদ্ধিহীনতার অভিযোগ এতই অভিনব যে, এই প্রথম না হলেও, অভয় বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর স্বামীর এই বিস্ময় তার নিজের বুদ্ধিমত্তার স্বীকৃতি ভেবে মহাশ্বেতা যৎপরোনাস্তি পুলকিত হয়ে ওঠে।

বলি সেই যেকালে এতটি খরচ হচ্ছে–ও পাঁচশ’ লোক ধরছ, শেষ পজ্জন্ত ছশ, সাতশ’য় দাঁড়াবে–তখন এক কাজে দুই কাজ সেরে নিলে না কেন?’

‘তার মানে?’

তবুও বুঝতে পারে না অভয়পদ।

‘একেবারে এই সঙ্গে আমাদের বুড়োর বিয়েটা দিয়ে কাজ চুকিয়ে দিলে না কেন?’

‘বুড়োর বিয়ে? বুড়োর বিয়ে দোব?’ অভয়পদ প্রায় বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ গো। ছেলের বিয়ে দিতে হবে না?’

‘তা সে এরই মধ্যে কি?’

‘ওমা, তা ওর কি বিয়ের বয়স হয় নি? তুমি তো পেরায় ঐ বয়সেই বিয়ে করেছিলে!’

‘আমি রোজগার করতুম, তাছাড়া তখন সংসারে করবার কেউ ছিল না।’

‘হাঁ তাই সাত বছরের মেয়ে এনেছিলে! আর আমিই কি আর বুড়ো ধাড়ী মেয়ে আনতে বলছি, ছোটখাটো দেখেই একটি আনতে চাই আমি। আমার এক মেয়ে যাচ্ছে আর এক মেয়ে আসবে। এই তো সোজা কথা।’

‘তা তোমার ছেলে বিয়ে করবে–বৌকে খাওয়াবে কি? না লেখাপড়া শিখল, না কোন কাজকম্ম। কিছু তো একটা করে খেতে হবে।’

‘নাও! তোমার ছেলের বৌকে তুমি দু-মুঠো ভাত দিতে পারবে না বুঝি? এ বাড়িতে যে ভাত রোজ গরুর ডাবায় যায় সে ভাতে একটা ছোট-খাট সংসার প্রিতিপালন হয়। সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না, তুমি মেয়ে দ্যাখো!’

‘আমরা না হয় এখন খেতে দিলুম। এর পর? সংসার বাড়বে না ওর?

‘সে যখন বাড়বে তখন নিজেরই জ্ঞানচৈতন্য হবে। মাথার ওপর চাপ পড়লেই বাপও বলবে।…. লেখাপড়া তো আমার কোন ছেলেই শেখে নি–তাই বলে ওদের বিয়ে হবে না? বেটার বিয়ে আবার লেখাপড়ার জন্যে আটকায়?’

যেন অকাট্য যুক্তি দিয়ে বিজয়গর্বে মুখটা ঘুরিয়ে নেয় মহাশ্বেতা।

এ লোকের সঙ্গে তর্ক করা চলে না, আপাতত প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যে অভয়পদ বলে, ‘আচ্ছা সে হবে এখন!

স্বামীর নির্বুদ্ধিতায় করুণা হয় মহাশ্বেতার, ‘ওমা, অবাক করেছে! সে হবে কি গো! এই তো আটুই বুচির বে, দিলে তো ছ তারিখেই বুড়োরটা দিতে হয়–তবে তো বে- বৌভাত এক যজ্ঞিতে হবে!’

‘তা সে তো আর মাঝে দশটি দিন বাকি–মেয়ে কোথায়? মেয়ে কিছু ঠিক করেছ?’

‘আমি ঠিক করব কি? আমি কি ঠিক করবার কত্তা? এ বাড়িতে আমার ঠিকে কিছু হয়? যাঁরা করবার কত্তা সেই আসল কত্তাগিন্নীকে বলো!’

‘তাঁদের তো আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই–এই আট-দশ দিন সময় আছে হাতে, –এখন কোথায় মেয়ে কোথায় মেয়ে খুঁজে বেড়াক!

‘কী তুমি বলো–আমার ছেলের বে দেব শুনলে পঞ্চাশ গণ্ডা মেয়ে এসে পায়ে গড়াবে–’

‘তা আগে গড়াক, মেয়ে ঠিক করো–তারপর দেখা যাবে। আর ছেলের বিয়ে দিয়ে যদি চিরকাল তার সংসার টানতে পারি তো বৌ-ভাতে দু’-একশ’ লোকও খাওয়াতে পারব। তার জন্যে তোমায় এত মাথা ঘামাতে হবে না।’

ঐখানেই ও প্রসঙ্গের পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে যায় অভয়পদ।

মহাশ্বেতা গজ-গজ করতে থাকে আপনমনেই, দেবে না তাই বলো! মহারানীদের মত নেই তাই বলো। নইলে মেয়ের আবার ভাবনা! দশ দিন কেন, তিন দিনে মেয়ে ঠিক হয়। খবরটা একবার চাউর হলে হয়–বলে কত মেয়ের বাপ হাত ধুয়ে বসে আছে এ বাড়িতে মেয়ে দেবে বলে –।’

অরুণকে সবাই মুখ-চোরা, লাজুক, ঘরকুনো বলেই জানত–কিন্তু স্বর্ণলতার বিয়েতে যেন নবকলেবর ধারণ করল সে। এ যেন সে অরুণই নয়। হঠাৎ যেন তার উৎসাহই শুধু নয়–সপ্রতিভতাও বেড়ে গেল। সে-ই খাটল সবচেয়ে বেশি, দৌড়ঝাঁপ ছুটেছুটিতেও সে কারুর চেয়ে কম গেল না। ওর কর্মক্ষমতা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।

অরুণের এই সক্রিয় সহযোগিতায় কর্তাদেরই উপকার হল সবচেয়ে বেশি। আর কোন ছেলেই মানুষের মতো নয়, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মতো তো নয়ই। সবচেয়ে যেটা বিপদের কথা–পয়সাকড়ির ব্যাপার তাদের দিয়ে আদৌ বিশ্বাস নেই। ওদের যা বয়স তাতে হাত-খরচা দরকার হবার কথা, অথচ এ বাড়িতে সে কথা কেউ চিন্তাও করে না। এই বিবাহে তাদের অনেকখানি আশা-ভরসা ছিল। যে ভাগাড়ে মড়া পড়ে কদাচিৎ, সেই ভাগাড়ের শকুনিদের মতোই ক্ষুধার্ত অবস্থা তাদের। সে সম্বন্ধে কর্তারাও সচেতন, তাই হাতে করে পয়সা খরচ করার, যা কাজ তার বেশির ভাগই এসে পড়ল অরুণের ঘাড়ে। এতে করে ছেলের দল আর একদফা বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল তার ওপর। কিন্তু কর্তারা উপকৃত হলেন।

অরুণের সেই অমানুষিক পরিশ্রম সকলেরই চোখে পড়ল। বলাবলিও করতে লাগল সকলে, ‘দ্যাখো, কার ভেতর কি গুণ থাকে কেউ বলতে পারে না! করছে তো বাপু, সময়ে খাওয়া নেই ঘুম নেই–ভূতের মতো খাটছে উদয়-অস্ত চৌপরদিন!’

স্বর্ণলতার বিয়ে–সে সম্বন্ধে তার নিজের উদাসীন থাকারই কথা, তার ছোট কাকী তাকে সে কথা বলেও দিয়েছে, ‘খবরদার, তুই কোন কথায় কথা কইতে যাস নি যেন- তাহ’লে ভারি নিন্দে হবে। বলবে মেয়ে বড় বেহায়া, পাঁচটা কুটুম-সাক্ষেৎ আসছে তো…. তোমার তো আবার সব তাতেই ফোড়ন দেওয়া স্বভাব, তাই আগে থাকতে সাবধান করে দিচ্ছি!’

তা এ কদিন মুখে ‘গো’ দিয়ে ছিলও সে। কিন্তু একটা মানুষ মুখে রক্ত তুলে মরে যাচ্ছে তার দিকে কেউ তাকাবার লোক নেই–দেখেই বা সে চুপ করে থাকে কী করে? সে ওকে আড়ালে ডেকে বলে, ‘বলি, ও কী আদিখ্যেতা হচ্ছে একটা ভারী অসুখ না বাধালে বুঝি চলছে না? এ সব আমাকে জব্দ করার মতলব আঁটা–নয়?’

আগের মতো কাঁচু-মাচু মুখে ঘাড় হেট করল না অরুণ, বেশ সপ্রতিভ হাসিমুখেই বলল, ‘কেন–কী করলুম?’

‘কী করলুম! সময়ে না হোক, দিনান্তে দুটো ভাতও তো মুখে তুলতে হয়! খাওয়া- দাওয়া যে ছেড়েই দিলে একেবারে… আর তার ওপর এই ভূতের খাটুনি। দুটো খেয়ে অন্তত আমায় কেতাত্ত করো!’

‘খাওয়া তো আছেই–রইলও; তোমার বিয়ে তো আর হবে না, এই একবার!

‘আমার বে-তে তোমার কি হাত বেরোচ্ছে শুনি যে, তোমায় ওপোস করতে হবে? আর দুটো ভাতে বসলেই বা কত দুপোর সময় নষ্ট হয়? না না, ও-সব চালাকি ছাড় বলছি, নইলে আমাকেই সেই ধরে নে গে রান্নাঘরে জোর করে বসিয়ে খাওয়াতে হবে। তা সে লোকে আমাকে বেহায়া বলুক আর যাই বলুক!’

‘ও, বেহায়া বলবার ভয়ে এই কটা দিন চুপ করে আছ বুঝি?’

‘আছিই তো, নইলে দেখিয়ে দিতুম মজা। আদিখ্যেতা করে না খেয়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে দিতুম একেবারে। তা কথা তো কেবল এইড়ে যাচ্ছ–খাবে না কি?’

‘খাব খাব।…. কিন্তু বুঁচি, তুমি যখন থাকবে না–তখন কে আমার খাওয়ার খবরদারি করবে?’

‘সে তো আমি দেখতে আসব না–কী করছ! আর সেদিন তো আমাকে কথা দিয়েছ–ঠিক ঠিক খাওয়া-দাওয়া করবে, শরীরের দিকে নজর রাখবে!’

‘কথা দিয়েছি নাকি?’

‘বা-রে ছেলে! এরই মধ্যে ভুলে মেরে দিয়েছ! তাহলে তুমি যা করবে এর পরে–তা বুঝতেই পারছি! কিন্তু আমি আসব মধ্যে মধ্যে সেটি মনে রেখো–এসে যদি দেখি অমনি শুকনো চেহারা, তাহলে কিন্তু পুঁথি-পত্তর সব টান মেরে পুকুরের জলে ফেলে দেব!’

‘দিও দিও, তাই দিও। সে রকম চেহারা দেখলে তো দেবে।’ হাসতে থাকে সে।….

অরুণ জলপানি পেয়েছে পনেরো টাকা করে। সে খবরটা পাওয়া গেছে কদিন আ-ে গই। স্বর্ণলতাকে আর কিছু বলতে হয় নি, অম্বিকাপদ নিজেই ডেকে বলেছে অরুণকে, ‘কোন্ কলেজে পড়বে এবার–কিছু ঠিক করলে?…. বিয়েটা চুকে যাক্ আর দেরি করে দরকার নেই, কোন্ কলেজে পড়বে, আই-এ না আই-এস-সি ঠিক করে ভর্তি হয়ে যাও, টাকা-পয়সা কি লাগবে জানিও, আমি দিয়ে দোব। আমি কাজে থাকি–তোমার মাসীর কাছ থেকে চেয়ে নিও, কোন লজ্জা করো না।’

পুঁথি-পত্রের কথাতেই বোধহয় কথাটা মনে পড়ে যায় স্বর্ণর, হঠাৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার জলপানির টাকা থেকে আমাকে কি দেবে অরুণদা?’

কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অরুণ, সে কোন উত্তর দেয় না। স্বর্ণর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে শুধু।

‘কৈ বললে না?’ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ঝঙ্কার দিয়েই ওঠে স্বর্ণ ‘বাব্‌বা, এরই মধ্যে পয়সায় এত টান! খরচার কথা উঠতেই মুখে কুলুপ পড়ে গেল!’

‘তোমাকে?’ অরুণের যেন হঠাৎ চমক ভাঙ্গে, ‘তোমাকে তো পুরো টাকাটাই দিতে পারি। কিন্তু তুমি কোথায় থাকবে আর আমি কোথায় থাকব–।’

‘ওমা, এই তো এ-পাড়া ও-পাড়া বলতে গেলে। কত নশ পঞ্চাশ কোশ দূরে যাচ্ছি গা?…. তা কি দেবে সেইটেই বলো না বাপু!

‘আর যদি জলপানি না পাই?’ কেমন একটা বিচিত্রদৃষ্টিতে চায় অরুণ।

‘সে আবার কি কথা! সরকারি কাগজে নাম উঠে গেল, মেজ-কা ছোট-কা–দু-দুজনে স্বচক্ষে দেখেছে–পাবে না কেন? –তোমার যত সব উদ্্যুটি কথা বাপু!…. চলো চলো– তুমি যা জিনিস দেবে তা খুব বুঝেছি, সেই থেকে হেজ্জাহিজ্জি, মুখের কথা একটা তাই বেরোল না–তা পয়সা বেরোবে! এখন দয়া করে দুটো খাবে চলো দিকি!

তুমি বেড়ে দেবে ভাত?…. বেহায়া বলবে না লোকে?’

‘ওমা ভাত-বেড়ে দিলে বেহায়া বলবে কেন? কথা কইতেই দোষ। যার বে তার সেই বে-র কথায় থাকতে নেই–বুঝলে?’….

বিয়ের রাত্রেও একা যেন দশ হাতে কাজ করল অরুণ। কোন মানুষ যে এত খাটতে পারে, বিশেষ তার মতো ঘরকুনো গ্রন্থকীট মানুষ–তা কেউ ধারণাই করতে পারে নি এর আগে। চোখে না দেখলে বিশ্বাসও করত না কেউ। শুধু বিয়ের সময় যখন পিঁড়ি ঘোরাতে বলেছিল–সে রাজি হয় নি। বলেছিল, ‘আমার যে এদিকে অনেক কাজ, তোমরা আর কাউকে দ্যাখো বরং–’। অবশ্য তারপরই কে কথা তুলিছিল, ‘যাদের বে হয়েছে–গুষ্টির জামাইরাই পিঁড়ি ধরবে। এতগুলো জামাই থাকতে আইবুড়োরা ধরবে কিসের জন্যে! তবে দেখো বাপু, যাদের বৌ মরেছে তারা যেন ধরো নি।’

সন্ধ্যের আগে থেকে, কনে সাজানোর শুরু থেকেই–আর তার দেখা পায় নি স্বর্ণ। উৎসুক চোখে দরজার দিকে তাকিয়েছে বারবার, বারবারই প্রত্যাশা করেছে তাকে। বিশেষত সাজানোর সময় অনেকেই এসে দেখে গেল, ভাইয়েরা সবাই এল–অরুণদা আসতে পারল না।’কেমন দেখাচ্ছে’ অনুচ্চারিত এই প্রশ্ন সব মেয়ের মনেই থাকে এ সময়টা, এবং সকলের মুখ থেকেই শুনতে চায় সে। অরুণ আসবে এবং প্রশংসা করবে– এটা খুবই আশা ছিল স্বর্ণর কিন্তু সে যেন এ দিক দিয়েই হাঁটল না।

শেষে আর থাকতে না পেরে ছোটভাই গুপোকে ডেকে একসময় প্রশ্ন করল সে, ‘হ্যাঁ রে, অরুণদাকে একবারও দেখতে পাচ্ছি না কেন রে? কোথায় কী করছে সে?

‘ও বাবা, তার কি কাজের অন্ত আছে আজ–সে-ই তো ম্যানেজার গো। মেজকাকা তাকেই সব বুঝ্যে দিয়েছে যে!’

–তবেই তো মাথা কিনেছে! এই শোন্ না, তোকে কাল যাবার সময় একটা পয়সা দোব, একবার ছুট্টে গে ডেকে আনবি অরুণদাকে?’

একটা গোটা পয়সার লোভেও গুপো উৎসাহিত হয়ে উঠল না তেমন। সন্দিগ্ধ সুরে বলল, আসবে কি–দেখি! তার আজ পাত্তা পাওয়াই দায়!’

সে গেল কিন্তু আর ফিরল না। বর আসাতে যখন তাকে বরের চাদরের ওপর বসিয়ে রেখে যে যার মত চলে গেল তখন একা একা বসে ভাবতে লাগল–দুপুর-বেলা ছোট কাকী ওকে ডেকে খাইয়েছিল কি না। পই-পই করে তো বলে দিয়েছিল। ও যা ছেলে, ওকে জোর করে না খাওয়ালে খাবেই না কখনও, তা সে তুমি কেন তিন-দিন শুকিয়ে রাখো না! তবু ভাগ্যিস দুপুরবেলা দুধ-সন্দেশ খাবার সময় জোর করে সে একটা সন্দেশ খাইয়ে দিয়েছিল। তাই কি খেতে চায়, কত বকা-ধমকা ক’রে খাইয়েছে সে।… হয়ত ঐ পর্যন্তই। আর কিছুই পেটে পড়ে নি।… বাবুরা সব ফোড়ন কাটতেই আছেন–একটু নজর রাখতে পারেন না কেউ। তাই সেই সন্দেশ খাওয়ানোর সময় ছোটকাকার কী কথা–বলে, ‘হ্যাঁরে, তা ওর গার্জেনতো পরের বাড়ি চলল, এখন ওকে কে দেখবে?…. তুই বরং এক কাজ কর–ওকে তোর তোরঙ্গের মধ্যে করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যা!’

শোন কথা একবার। সে নিয়ে যাবার হলে ও ঠিকই নিয়ে যেত–নিজের ভাইয়ের মতো–দোষই বা কি? কিন্তু কিছুদিন পুরনো না হলে, তাদের চিনে না নিতে পারলে কি আর সাহস করা যায়? তা সেও খুব শুনিয়ে দিয়েছে ছোট কাকাকে, ‘কেন তোমরা একটু দেখতে পার না? দেখা তো উচিত। একটা বামুনের ছেলে উপোস করে থাকলে পাপটা মন্যিটা কার লাগবে শুনি? আমি তো পরের ঘরে চললুম! পর গোত্তর হয়ে যাব আজ থেকে!’

বিয়ের সময় কোন দিকে চাইতে পারে নি স্বর্ণ, তবে অরুণ ছিল না সেখানে। থাকলে অন্তত গলা পেত সে। রাত্রে বাসর ঘরে সবাই এসে একবার করে উঁকি মেরে মেয়েদের কাছে তাড়া খেয়ে চলে গেল–অরুণ ছাড়া। তার খবরও পেলে না, বর-মিসে পাশে বসে, লজ্জায় সে কথাই কইতে পারল না করুর সঙ্গে।

একেবারে সকালে একবার খুঁজে বার করেছিল সে। কী চেহারাই হয়েছে বাবুর অসুরের মতো খেটে আর না খেয়ে। চোখ-মুখ বসে গেছে একেবারে –দৃষ্টি রক্তবর্ণ, চোখের কোলে তিন বুরুল কালি

‘বা, চেহারার তো বেশ খোলতাই হয়েছে! বলি এবার এ দেহ ত্যাগ করবে বলে মতলব এঁটেছ নাকি! কী পেয়েছ কি!’

সে কথার উত্তর দেয় নি অরুণ, ম্লান হেসেছিল একটু! অবসন্ন, ক্লান্ত হাসি।

‘বলি কাল থেকে তো কিছুই পেটে নেই, তা সকালে একটু চা-টাও কি খেতে নেই! হাঁড়ি হাঁড়ি চা ফুটছে তো দেখতে পাই, যেমন মেজকা চা দুচোক্ষে দেখতে পারত না তেমনি চায়ের রেলা হয়েছে আজকাল। তা একটু চা, দুটো মিষ্টিও তো খেতে পারো?’

‘খাবই এখন। খেতে তো হবেই। তোমারই বা চেহারার কী ছিরি হয়েছে। আয়নায় দেখেছ?’

‘দেখেছি! রুক্ষু চুল, রাতজাগা–ও অমন হয়। কাল ছিলে কোথায়–কাল যখন সাজলুম গুজলুম তখন দেখতে পারলে না?’

সে কথার উত্তর দিল না অরুণ। বলল, ‘তা তুমি কি খাবে এখন?’

‘ওমা, আমি খাব কি। এখন কুশুণ্ডিঙেয় বসতে হবে না? খাওয়া আজ যার নাম ধরো গে সেই তিনটেয়–। কিন্তু তুমি এক কাজ করো দিকি, চট্ করে দুটো পান্তুয়া নিয়ে এসো দিকি!’

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চায় অরুণ

‘কেন বলো তো? কার জন্যে?’

‘নিয়েই এসো না বাপু। আমি কি এ বাড়ির দুটো পান্তুয়াও খরচ করতে পারি না– তার জন্যে এত কৈফেৎ দিতে হবে!’

অগত্যা নিয়ে আসে অরুণ। একটা মাটির গেলাসে করে।

‘নাও, খাও।’ মুখের সামনে ধরে স্বর্ণ।

‘পাগল নাকি? আমার এখনও মুখ পর্যন্ত ধোওয়া হয় নি।

‘খাও বলছি, নইলে অনখ কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড করব। আমাকে চেন না!

অগত্যা খেতে হয়। কিন্তু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে খায় সে–স্বর্ণর মুখের দিকে চাইতে পারে না। স্বর্ণর মনে হয় ওষুধ-গেলা পাঁচনগেলা করে খাচ্ছে–তাই এদিকে চায় না।

নরম গলায় বলে, ‘মিষ্টি খেতে ভাল লাগছে না–না? দুখানা মাছ খাবে? আমিই নিয়ে আসছি নয়?’

কিন্তু অরুণ আর উত্তর দেয় না, স্বর্ণ কিছু বোঝবার কি বাধা দেবার আগেই ছুটে পালিয়ে যায় সেখানে থেকে!….

সেই যা ওর সঙ্গে দেখা। আর সারা দিনে ধারে কাছেও আসে নি স্বর্ণর।

যাত্রাকালে মেয়ে-জামাই আশীর্বাদের সময় অন্তত সে এসে দাঁড়াবে আশীর্বাদ করবে–সবাই আশা করেছিল, তাও এল না। স্বর্ণর সে সময় অবশ্য কোন জ্ঞান নেই–সে কেঁদে ভাসাচ্ছে, কিন্তু খেয়াল করেছিল মহাশ্বেতাই, কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিল, ‘অরুণটা কোথায় গেল, সে আশীব্বাদ করবে না? ওরে, তোরা কেউ দ্যাখ না!’

প্রমীলা বলেছিল, ‘হ্যাঁ, সে যা ছেলে–এই কান্নাকাটির ভেতরে সে আসবে সে যা ভালবাসে ওকে, দ্যাখো গে যাও বাগানের কোন্ কোণে সেঁদিয়ে বসে আছে–মাটি ভাসাচ্ছে সেখানকার। এমনিই তো চোখ দুটো জবাফুলের মতো হয়ে রয়েছে সকাল থেকে–’

তবু, গাড়িতে ওঠার সময় অন্তত তাকে কাছাকাছি কোথাও দেখা যাবে ভেবেছিল সকলে, তাও এল না। তারপর অবশ্য অত কারও খেয়ালও ছিল না। বড়রা কান্নাকাটি করছে তখনও, কুটুম্বিনীরা এলিয়ে পড়েছে–কর্তারা বসে গিয়েছিল পরের দিন ফুলশয্যার তত্ত্ব সম্বন্ধে পরামর্শ করতে। কী কী আছে–কী কী কিনতে হবে, ক্ষীরের ছাঁচগুলো মেয়েরা তুলতে পারবে কি না–এই নিয়েই তাদের চিন্তা।

আজ রাতটুকু পোয়ালে কালই তো তত্ত্ব গুছনো–সময়ই বা আর কই?

খেয়াল পড়ল অনেক রাত্রে, খেতে দেবার সময়ে। তরলাই সকলকে ভাত দিচ্ছিল, সে-ই বললে, ‘অরুণ? অরুণ কোথায় গেল রে?’

বুড়ো মুখ বাঁকিয়ে বললে, ‘কে জানে বাবা তোমাদের ভালছেলের খবর আমরা রাখব কেমন করে? দ্যাখো গে যাও, হয়ত বাগানে গিয়ে বসে আছে কোথাও!’

‘তা যা, কেউ খুঁজে গিয়ে নিয়ে আয় তোরা–’

‘কে যায় এই এত রাত্তিরে বাগানে খুঁজতে। সে বুঁচিরই পোষায়, আমরা কোথায় খুঁজব! কেষ্ট বললে, ‘থাক না–দুপুর রাত্তিরে যখন শ্যালে এসে ঠ্যাং ধরে টানবে তখন হুঁশ হবে বাছাধনের, বাগানে গিয়ে থাকার মজা টের পাবেন।’

‘ও কি কথা রে!’ মহাশ্বেতা ধমক দিয়ে ওঠে। এই কদিন তার মেয়ের বিয়েতে অরুণ যা অমানুষিক পরিশ্রম করেছে তা সে চোখেই দেখেছে। তারপর তার সম্বন্ধে স্নেহার্দ্র হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। মহাশ্বেতার তো বিশেষ করে, রাগ বা দ্বেষ সে কারুর সম্বন্ধেই বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারে না, দুটি লোক ছাড়া। সে বলে, ‘দ্যাখ্ খুঁজে ভাল করে, যা গাধার খাটুনি খাটল কদিন, খাওয়া নেই ঘুম নেই –হয়ত কোথাও ঘুমিয়েই পড়েছে বাছা। ছাদটা দেখে আয় দিকি, চিলেকোঠার ঘরটা আগে দ্যাখ–

ছাদ, চিলেকোঠার ঘর, উপর, নিচে, বাগান সব খোঁজা হল–অরুণ নেই। আলো নিয়ে হৈ হৈ করে একপাল ছেলে বেরিয়ে পড়ল বাগানে–শেষের দিকে অভয়পদ অম্বিকাপদও বেরোল–যেখানে যত সম্ভাব্যস্থান ছিল বসে থাকার মতো সব দেখা হল, অভয়পদ পাইখানা তার পিছনের বাঁশঝাড় সব দেখে এল নিজে–কোথাও কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া গেল না।

এবার সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল! গেল কোথায় ছোকরা?

এখন অনেকেরই মনে হল যে ওর ভাবভঙ্গিটা কদিন ধরেই খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। কিন্তু তাই বলে–এমন নিঃশব্দে কোথায় যাবে, করবেই বা কি?

কে একজন বললে, ‘বুঁচির শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল না তো? খুব ভালবাসত তো বুঁচি–দ্যাখো, হয়ত কাঁদতে কাঁদতে সেইখানেই চলে গেছে!’

‘দূর, পাগল নাকি–সে যা লাজুক!’ কথাটা উড়িয়ে দিল প্রমীলা।

হঠাৎ মনে পড়ল অম্বিকাপদর–বিকেলের দিকে, ঠিক আশীর্বাদের আগে কী একটা কাগজে-মোড়া প্যাকেট মতো ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা একটু বাক্সয় তুলে রাখবেন মেসোমশাই?’–কী জিনিস সেটা সেও বলে নি, অশিম্বকাপদও জিজ্ঞাসা করে নি। তখন জিজ্ঞাসা করার সময়ও ছিল না তার। প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে নি অবশ্য। এই কদিনেই যেন সাবালক হয়ে উঠেছিল অরুণ, ওর ওপর একটা আশ্চর্য নির্ভরতা এসেছিল সকলের। অকারণে সে কিছু বলছে না বা করছে না–সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিল অম্বিকাপদ।

এখন গিয়ে তাড়াতাড়ি বাক্স খুলে দেখল, বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন কাজ বাবদ ওকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তারই জমা খরচ–নির্ভুল হিসাব। যেখানে যা রসিদ, ক্যাশমেমো বা ফর্দ পাওয়া গেছে–তাও আছে সেইসঙ্গে একটা পিনে গাঁথা–আর বাকি টাকা পয়সা। এগারোটি পয়সা মেলে নি, তাও লেখা আছে গরমিল বলে।

এত কাজ এত ব্যস্ততার মধ্যে এমনভাবে হিসাব দিতে গেল কেন?

এই প্রথম একটা সন্দেহ দেখা দিল সকলকার মনে।

তবে কি আগে থাকতেই ছোকরার কোথাও সরে পড়বার মতলব ছিল মনে মনে?

কিন্তু এভাবে কোথায় যায়? কিছুই তো নিয়ে যায় নি। খোঁজ করে দেখা গেল–যা জামা কাপড় তার পরনে ছিল তাছাড়া বাড়তি জামা-কাপড়ও নেয় নি।…

সে রাত্রে আর কিছু করা সম্ভব নয়। সকলেই মানসিক একটা থমথমে অবস্থায় চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল। এমন কি ছেলের দলও কেমন যেন হচকিয়ে গিয়েছিল–তারাও নির্বাক হয়ে গেল। এ আবার কী হল, এরকম একটা-কিছুর জন্যে তো প্রস্তুত ছিল না তারা!

পরের দিনও একটু আধটু খোঁজ করা হ’ল পাড়াঘরে। কেউই দেখে নি। তাকে বিশেষ কেউ চিনত না, কারণ বাড়ির বাইরে যেত সে কদাচিৎ।

তার পরের দিন ডাকে একটা চিঠি এল অম্বিকাপদর নামে। হাওড়া স্টেশন থেকে ফেলা হয়েছে, হাওড়া আর, এম, এস্-এর ছাপ রয়েছে।

চিঠিতে লেখাঃ

‘শ্রীচরণেষু, মেসোমশাই, আমার জন্য কোন চিন্তা করিবেন না, আমি ভালই আছি। আপনারা আমার জন্য যাহা করিয়াছেন তাহার ঋণ শোধ হওয়ার নয়। যদি পারি তো মানুষ হইয়া সে ঋণ শোধের চেষ্টা করিব। বলিয়া আসিতে পারি নাই, অপরাধ ক্ষমা করিবেন। আপনি প্রণাম লইবেন, প্রণম্য ও প্রণম্যাদের প্রণাম দিবেন।

ইতি–সেবক অরুণ।’

এ চিঠিতে কৌতূহল বেড়েই গেল, শুধু কিছুই জানা গেল না।

কেন গেল সে–এ প্রশ্ন নিরুত্তরিতই থেকে গেল। কেন এবং কোথায় গেল।

কেন? কেন? কী দুঃখে? কী ভাবল সে, কী মনে করে এমনভাবে সরে পড়ল? সে কি কারও ওপর অভিমানে? ছেলেদের ওপর রাগ করে?

সম্ভব অসম্ভব বহু জল্পনা-কল্পনা ও বহু উত্তরেও সমস্যাটা যেমন অমীমাংসিত ছিল তেমনই রয়ে গেল।

শেষ অবধি দুর্গাপদ এক কথায় আলোচনার উপসংহার টেনে দিল, ‘গ্রহ! গ্রহ ছাড়া আর কিছু নয়। ওর জন্মলগ্নে বোধহয় সবকটা গ্রহই বিরূপ ছিল–নইলে বাপ-মাই বা এমন বাদে- ছরাদে যাবে কেন? এখানে এমন ভাল ব্যবস্থা–মেজদা কলেজে পড়াতে চাইলে, জলপানি পেয়েছিল, হয়ত ফ্রিও পড়তে পারত কলেজে–কোথায় লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি করবে ভাল দেখে–জীবনে উন্নতি করবে, তা নয় ভাগ্যাবন্ডের খাতায় নাম লেখাতে গেল। গ্রহ ছাড়া আর কী বলব! দ্যাখো, যদি দিনকতক বাদে ফিরে আসে, সুমতি হয় আবার!’….

স্বর্ণলতাকে ওখানে কেউ কিছু বলে নি, এখানে এসে শুনল। শ্বশুরবাড়ির হাজারো গল্প করবে বলে পেট ফুলছিল তার, কলকল করতে করতে নেমেছিল পাকি থেকে, খবরটা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সমস্ত আনন্দ, মনের মতো সুন্দর বর পাওয়ার সমস্ত সৌভাগ্য-বোধ যেন নিমেষে ম্লান হয়ে গেল।

অরুণদা এমন করলে! কলেজে পড়ল না। কত শখ তার বি-এ পাস করার! সেই জন্যে অমনভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, যদি জলপানি না পাই!’ এই মতলব ছিল তাহলে!

কিন্তু কেন এমন করলে সে? কেন? কেন?

তার দুই চোখের কূল ছাপিয়ে অশ্রুর ধারা নামল। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে।

আহা, কোথায় আছে, কী খাচ্ছে সে। কেউ কি তাকে ডেকে খাওয়াচ্ছে? যা লাজুক, হয়ত না খেয়েই মরে যাবে। সে যে কারুর কাছ থেকে চেয়ে কিছু খাবে তা তো মনে হয় না। ……

তবে একেবারে নিঃসম্বল যায় নি সে। দুতিন-দিন পরে মনে পড়ল স্বর্ণলতার। এক পয়সা এক পয়সা করে জমানো সাতটা টাকা ছিল ওর। ভায়েদের ভয়ে অনেক কষ্টে লুকিয়ে রাখত। বিয়ের দুদিন আগে সেই টাকা-সাতটা সে অরুণের জিম্মা করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আমি তো কদিন থাকব না, এরা সব উকে পাকে বার করে নেবে। এ কটা টাকা তুমি একটু ঠিকানা করে রেখে দাও অরুণদা–’

অরুণ বলেছিল, ‘বেশ লোকে জিম্মে করছ! কেন, তোমার তো নতুন পোর্টম্যান্ট কেনা হয়েছে–তুমি নিয়ে যাও না।’

‘না না–তুমি বোঝ না। ওরা যদি বাক্সপ্যাট্রা খুলে দেখে? শুনেছি অনেক শ্বশুরবাড়িতে বৌয়ের বাক্সে মুখদেখানি আশীব্বাদী টাকা যা থাকে বার করে নেয়। এটাও যদি সেই সঙ্গে বার করে নেয়?’

‘আর আমাকে দিচ্ছ, আমি যদি মেরে দিই? খরচ করে ফেলি?’

‘সে তো খুব ভাল। তুমি এক্ষুনি খরচ করো না–আমার কোন দুঃখ নেই!’ বলেছিল স্বর্ণ। অবশ্য তখন স্বপ্নেও ভাবে নি অরুণ প্রাণ ধরে তার টাকা খরচ করতে পারবে!

সেই টাকা সাতটাই সঙ্গে আছে নিশ্চয়। সব পাই-পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে–সেটা তো দেয় নি! হয়ত এটুকু সুমতি হয়েছে তার, হয়ত ওর টাকাতে তার জোর আছে, নিয়ে গেলেও কিছু মনে করবে না–এ বিশ্বাস হয়েছে শেষ পর্যন্ত। হে ভগবান, তাই যেন হয়, হে মা কালীঘাটের কালী, টাকা কটা যেন নিয়ে থাকে সঙ্গে, এখানে যেন না কোথাও ফেলে গিয়ে থাকে। হে বাবা তারকনাথ–তাকে দেখো।

কথাটা কিন্তু কাউকে বলে না স্বর্ণ। কী দরকার, হয়ত ভুল বুঝবে সবাই, ভায়েরা রটাবে বুঁচির টাকা ভেঙ্গে পালিয়েছে।

স্বর্ণ তো জানে–সে তেমন ছেলেই নয়।

যদি এমন হবে জানত তো তার আশীর্বাদী টাকা থেকেও আর কটা টাকা দিয়ে যেত ওকে!

॥৩॥

অভয়পদ ভেবেছিল স্বর্ণলতার বিয়ের গোলমালে বুড়োর বিয়ের হুজুগটা মহাশ্বেতা ভুলে যাবে। ভুলে গিয়েও ছিল অনেকটা–বেশ কটা মাস চুপচাপ ছিল–হঠাৎ পাড়াতে কোন্ ছেলের বিয়ে হচ্ছে শুনে আবার মনে পড়ে গেল তার।

তখনই খুঁজে খুঁজে গিয়ে স্বামীকে ধরলে, ‘বলি কৈ গো, আমার বুড়োর বে দেবার কী করলে?’

সেদিন রবিবার, বাইরের রকে বসে কী একটা হিসেব দেখছিল অভয়পদ,

অন্যমনস্কভাবে মুখ না তুলেই উত্তর দিলে, ‘মেয়ে ঠিক হয়েছে?’

পোড়া কপাল আমার। মেয়ে তোমাদের না জানিয়ে না দেখিয়ে আমরা ঠিক করে ফেলব!’

‘তা কৈ সে মেয়ে?’ সেই রকম অন্যমনস্কভাবেই আবার বলে সে।

মেয়ে কৈ তা আমরা কী জানি, মেয়ে কি আমি খুঁজব?… বাঃ, বেশ কথা তোমাদের! আমরা মেয়েছেলে মেয়ে দেখে বেড়াব পাড়ায় পাড়ায়–না?’

‘তাহলে দুদিন সবুর করো। এই তো এখনও মেয়ের বিয়ের ধাক্কাই কাটে নি, তত্ত্ব- তাবাসে জেরবার হয়ে যাচ্ছি–এরই মধ্যে ছেলের বিয়ে দেব কি করে? আর এত তাড়াই বা কি–ছেলে তো আর অরক্ষণা হয়ে যাচ্ছে না।’

‘ও মা, তা ছেলের বে’তে কি ঘর থেকে খরচ করব নাকি? সে তো ঘরে আনবে উটে!’

‘হ্যাঁ, তা আর নয়! কত গুণের ছেলে তোমার, তাই আবার একগাদা টাকা-পয়সা ঢেলে বিয়ে দেবে লোকে!

‘ছেলে যেমনই হোক, বংশটা কেমন? তোমাদের একটা নাম নেই? সবাই জানে তোমরা বড়লোক, তোমাদের অবস্থা ভাল। দেখো, এ বাড়িতে মেয়ে দিতে পারবে জানলে হন্যে হয়ে ছুটে আসবে সব–’

‘দেখি।’ বলে আবার হিসেবে মন দেয় অভয়পদ….

এবার কিন্তু আর কথাটা জুড়োতে দেয় না মহাশ্বেতা। দুদিন একদিন অন্তরই তাগাদা করে। যতই প্রতিজ্ঞা করুক ‘মহারাজ-মহারানীকে কোন দিন কোন কাজে সুপারিশ করবে না–সে নিচু হতে যাবে ওদের কাছে কিসের জন্যে গা, সে কি এ বাড়ির বড়বৌ নয়?’–সে প্রতিজ্ঞাও শেষ অবধি রাখতে পারে না। মেজবৌকে গিয়ে বলে, ‘কতদিন খেটে খেটে মরবি লো এমন করে–একটা বৌ আন!’

‘বৌ–?’ এক মুহূর্ত সময় লাগে প্রমীলার কথাটা বুঝতে, ও, বুড়োর বে’র কথা বলছ? সে তো ভাল কথা। লাগাও দিদি। সত্যি বুঁচিটা চলে গিয়ে যেন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে, অমনি একটি ছোটোখাটো মেয়ে ঘুরে বেড়াবে, তবে না!’

এবার শুরু হয়ে যায় ডবল তাগাদা। প্রমীলারও যেন উৎসাহের অন্ত নেই।

অগত্যা মেয়ে খুঁজতে বেরোন ছাড়া উপায় থাকে না কর্তাদের।

অবশ্য ওদের খুব চেষ্টা করতে হয়ও না। মহাশ্বেতাই ঠিক বলেছিল, কথাটা প্রচার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক-হাঁটাহাঁটি শুরু হয়ে গেল। সকাল বিকেল বাড়িতে বসতে পারে না কর্তারা। অনেক সময় কুটুমের সূত্র ধরে লোক আসে, তাদের জলখাবার দিতে হয়, খরচাও হয়ে যায় বিস্তর।

মহাশ্বেতা বিজয়গর্বে বলে ‘কী গো, মেয়ে দেবে কে এই ভেবে তো অস্থির হচ্ছিলে! এ তো সদরের জমি চষে ফেলছে দেখি মেয়ের বাপরা। বলি সংসারটা আমি বেশি চিনি না তুমি বেশি চেনো–এবার টের পাচ্ছ কিছু?’….

মেয়ে দেখলও এরা খুব।

মেয়ে পছন্দ হয় তো ঘর পছন্দ হয় না–আবার এদের পছন্দ তো তারা পিছিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। এদের পয়সার কথা শুনে ছুটে আসে–কিন্তু ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে বেশভূষা দেখে ভয় পেয়ে যায়। পয়সাটার নাম আছে কিন্তু ঠিক যে কত তা কেউই জানে না। কেউ কাউকে সিন্দুক খুলে দেখায় না–জিগ্যেসও করা যায় না সোজাসুজি। আর জিগ্যেস করলেই বা সত্যি কথা বলবে তার ঠিক কি? খুব পয়সা থাকলে কি কেউ এভাবে থাকে?

এদের যতই পয়সা হোক, কাপড়-জামা দেখে বোঝার উপায় নেই। বড়কর্তা বারোমাস ‘গুণচট’-এর মতো একটি ধুতি পরে, সেটাও হাঁটুর উপর উঠে থাকে সর্বদা, তার সঙ্গে একটি পুরু জিনের কোট। এ কোটগুলো নাকি রেলের–কোন্ বাবুর সঙ্গে ব্যবস্থা করে সামান্য কিছু দিয়ে কেনে, এই জামা ভারী পছন্দ অভয়পদর –কারণ এ এক-একটা জামা দুবছর করে যায়। ধোপার বাড়ি দেবার বালাই নেই, সপ্তাহে একদিন ক্ষারে কেচে নেয়। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তিনশ’ ষাট দিনই ঐ একই পোশাক। বিয়ে-পৈতে নেমন্তন্ন বাড়িতেও ঐ পোশাকেই যায় সে, তখনও ধুতিটা হাঁটুর নিচে নামানো প্রয়োজন বোধ করে না। একটা গেঞ্জিও কখনও ব্যবহার করে না কোটের নিচে। মেজকর্তা সাধারণত টুইলের হাফশার্ট পরে, তার ধুতিটাও অপেক্ষাকৃত ভদ্র। তবে সে ধুতিও হাঁটুর নিচে নামে না। লম্বা কোঁচা নাকি যতরাজ্যের পথের ধূলো ঘরে আসে–তা ছাড়া রাস্তায় লুটিয়ে কাপড়ও নষ্ট হয়। পায়ে বেঁধে পড়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে।

এদের মধ্যে ছোটকর্তাই একটু শৌখিন, ছিটের শার্ট পরে। ধুতিও তার পাতলা, শুধু তাই নয়, সামনের কোঁচা পাট করে নিচের অংশ ওপরে গুঁজলেও তার কাপড় গোছ পর্যন্ত নামে। দু’একখানা দেশী ধুতিও বেরোবে তার বাক্স খুঁজলে।

ছেলেদের মধ্যে একবারে ছোটরা এখনও পাঠশালায় বা স্থানীয় মিড্‌ল্‌ স্কুলে যায় কেউ কেউ, মেজোর ছেলেরা দু’একবার করে সব ক্লাসেই ফেল করলেও খাতায় নাম আছে তাদের হাই স্কুলেও–তাদের জামা আছে, তবু সেও যৎপরোনাস্তি সাধারণ ও সামান্য। বড়রা কোন কাজই করে না, লেখাপড়ারও কোন পাট নেই–তারা জামাও গায়ে দেয় না বিশেষ কেউ। বাড়িতে খালি গায়েই থাকে, শীতকাল হ’লে কিছু একটা গায়ে দেয়, ছেঁড়া গায়ের কাপড় কি বড়দের পরিত্যক্ত জামা–যে যা পায়। বাইরে বেরোবার জামা আছে প্রত্যেকেরই কিন্তু সেও ক্ষারে কেচে তুলে রাখা, ইস্ত্রী করা হয় না–বার করে কোনদিন পরে বেরোলে এই গ্রামের ছেলেরাও হাসে। বাড়িতে ইস্ত্রী আছে–অভয়পদ কোন জিনিসেরই অভাব রাখে নি–কিন্তু এত পরিশ্রম করার কোন প্রয়োজন বোঝে না ওরা একমাত্র ন্যাড়া এবং মেজকর্তার দুই ছেলে যতটা পারে ইস্ত্রী করে নেয়, নিজেরা, ওদের জামা ছমাসে-নমাসে ধোপার বাড়িতেও যায়। ধুতি যা পরে ওরা সবাই প্রমাণ দশহাত- চুয়াল্লিশ ইঞ্চি, কিন্তু বাড়িতে যখন থাকে চলাচলের সুবিধার জন্য কোমরের দুদিকে খানিকটা ক’রে তুলে, কোঁচা ভাঁজ করে নিয়ে কিংবা কোমরে জড়িয়ে হাঁটুর ওপরে রাখে সর্বদা। সে অবস্থায় তাদের দেখলে–আর যারা হঠাৎ এসে পড়ে তারা তো দেখেই–এদের পয়সা আছে বলে মনে হয় না, এদের কারও হাতে মেয়ে দিতেও ইচ্ছে করে না। বুড়ো যখন ছেলে-দেখা দিতে আসে তখন জামাও গায়ে দেয় একটা, একখানা কাঁচা ধুতিও পরে–তবু তাতে বিশেষ কোন উন্নতি হয় না তার আকৃতির। ফলে অনেক মেয়ের বাপই মেয়ে কাঁটা হয়ে গলায় বিঁধে থাকা সত্ত্বও–এ পাত্রে মেয়ে দিতে সাহস করে না, বৃহত্তর কাঁটা হয়ে চিরজীবন বিঁধে থাকবার ভয়ে।

অনেক খুঁজে অভয়পদ অবশেষে তার এক পুরনো বন্ধুর মেয়েকেই ঠিক করে ফেলল। অভয়ের সঙ্গেই কাজ করতেন ভদ্রলোক, অবশ্য তার চেয়ে বয়সে বড়–কিছুদিন আগে অবসর নিতে হয়েছে তাঁকে। বহুদিন একসঙ্গে কাজ করেছে–মেয়ের বাবা এসে হাতদুটো জড়িয়ে ধরতে আর ‘না’ বলতে পারল না। বিশেষ করে কী টাকা সম্বল করে বাড়িতে এসে বসতে হয়েছে তা অভয়পদ ভালই জানে। মেয়েটিও অবশ্য এদের বেশ পছন্দ হল –তিন ভায়েরই। মেয়েরা কেউ দেখতে গেল না, একবার প্রমীলা কথা তুলেছিল, ‘চল না ভাই দিদি দেখে আসি, এই তো কাছেই–?’ কিন্তু মহাশ্বেতা সেটা বলতে গিয়ে ধমক খেলে অভয়ের কাছে, ‘তোমাদের যা পছন্দর নমুনা –তা তো ছোট বৌমার বেলাই দেখেছি, আর বাহাদুরীতে কাজ নেই।… তাছাড়া আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে–কথা দেওয়া হয়ে গেছে–এখন গিয়ে কি করবে তোমরা?’

সুতরাং বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। কিছুই দিতে পারবেন না পাত্রীপক্ষরা। একশ’ একান্ন টাকা নগদ। মেয়ের চুড়ি হার, চারখানি নমস্কারী আর সামান্য কিছু দানের বাসন। এ বাসন নাকি দীর্ঘকাল সিন্দুকে তোলা ছিল, সেইগুলোই রসান দিইয়ে নেবেন–মেয়ের বাবা স্পষ্টই বলে দিলেন।

অম্বিকাপদ একটু খুঁত-খুঁত করছিল কিন্তু দাদার মুখের দিকে চেয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। যদিও বেশ বারকতকই শুনিয়ে দিল যে, ‘তাই তো, এখনই তো দেখছি তাহলে স্যাকরা ডেকে তাগা বালা গড়াতে দিতে হয়। বাড়ির বড় বৌ–মোটামুটি গা-সাজানো না হলে এদের সঙ্গে বেরোতেও তো পারবে না কোথাও–এটা তো আগেই করাতে হবে। তার ওপর লোকজন খাওয়া, গায়ে হলুদ–ধরো একটি হাজার টাকা খরচ–কম পক্ষে সবটাই তো দেখছি ঘর থেকে বার করতে হবে।’

অভয়পদ কিন্তু চুপ করেই রইল। মেজভাই দাদাকে চেনে, কথা দেওয়া হয়ে গেছে, আর সে কথার নড়চড় হবে না। অগত্যা অপ্রসন্ন মনে হলেও সব ব্যবস্থাই এ বাড়ির মাপে করতে হয় তাকে।

কন্যাপক্ষ গায়ে-হলুদ ফুলশয্যার তত্ত্ব গায়ে-গায়ে কাটাবার প্রস্তাব করেছিল, অম্বিকাপদরও খুব আপত্তি ছিল না তাতে, কারণ সে জানে তত্ত্ব যা আসে তাতে খরচের কিছু কম্‌তি হয় না, যা যায় তা নগদ টাকা বার করে নিয়ে যায়–কিন্তু প্রমীলাই ঘোরতর আপত্তি করল, ‘আমাদের প্রথম ছেলের বে, সাধআহ্লাদ কিছু মিট্‌বে না, এ আবার কি কথা? তত্ত্ব আমরা ছাড়ব না।’

অর্থাৎ তাদেরও গায়ে-হলুদের তত্ত্ব পাঠাতে হবে। খুব নমো নমো করে সারলেও কোন্ না সওয়াশ’ দেড়শ’ টাকা খরচা! মেয়েবুদ্ধি আর কাকে বলে!

মুখখানা বিকৃত করলেও স্ত্রীর মুখের ওপর বেশি প্রতিবাদ করার সাহস হল না, অবশ্য। তত্ত্বের ফর্দ করতে বসতে হল।

বুড়োর বিয়ে হয়ে গেল বেশ সমারোহ সহকারেই। স্বর্ণর বিয়ের মতো অত লোক না হলেও–শেষ পর্যন্ত চার শ’ সাড়ে চারশ’ লোক খেল। অবশ্য বৌভাতের দিনটা কী একটা ছুটির দিন পড়ায় মেজকর্তা ‘ভেতো যজ্ঞি’ করে সারল। দুপুরবেলা মাছভাত খাওয়ার ব্যবস্থা। এইটেই যা একটু মন খুঁত-খুঁত করতে লাগল মহাশ্বেতার। তার বিয়েতেও এরা এই কাণ্ড করেছিল, তখনও পছন্দ হয় নি তার। কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়েছিল বিবাহের উৎসবটা। এটুকু ছেলেবেলার সংস্কার এখনও আছে। কিন্তু মেজকর্তা অকাট্য যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, ‘পয়সা তো কিছু ঘরে আসে নি, ঘর থেকে খরচা করে আর কাঁহাতক কী করব? রাত্তিরে লুচির যজ্ঞিতে যে শুধু ঘি খরচা হয় তাই তো নয়–কুটুম-সাক্ষাতের অর্ধেক লোক রাতটা থেকে যাবে। তাদের শোবার ব্যবস্থা রে, পরের দিন খাওয়া জলখাবারের পাট রে–অনেক হাঙ্গামা। তার চেয়ে এ দিনে দিনে ঢুকে যাবে, যতই দেরি হোক্ সন্ধ্যের বেশি তো নয়–সবাইকে যে যার বাড়িতে চালান করে দেওয়া যাবে।

অগ্যতা চুপ করে যেতে হল মহাশ্বেতাকে।

তা অবশ্য তার বিয়ের যজ্ঞির মতো কিছু নয়; বেশ ভাল ব্যবস্থাই করেছিল মেজকর্তা। প্রথম পাতে শাক সুক্তো থেকে শুরু করে মুড়িঘণ্ট ছ্যাঁচড়া ভাজা–কিছু বাদ দেয় নি। মিষ্টিও করেছিল দুরকম–সন্দেশ লেডিকেনি। উপরন্তু নগদ পাঁচসের দুধ কিনে পায়েস করিয়েছিল, তাও প্রায় সবাইকে এক চামচ এক চামচ বাটা হল–শুধু যা একেবারে শেষ ‘ব্যাচ’ আর বাড়ির লোকদেরই কুলোয় নি। তা না হোক, তাতে দুঃখ নেই, শেষের দিকে কম পড়েই–এ পাড়ায় তো যত বাড়িই কাজ হয় মহাশ্বেতা দেখে–শেষের দিকে মাছই থাকে না, আলু আর কাঁটা পড়ে পাতে।

এ তো মাছের এলকেল একেবারে।

না মোটামুটি খুশিই হয়েছে মহাশ্বেতা।

শুধু একটা নিরানন্দর কথা সে কাউকে মুখ ফুটে বলতে না পারলেও কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল। এত কাণ্ড হল–এত লোক খেয়ে গেল তার বাড়ি এউ-ঢেউ করে, কেবল তার বাপের বাড়ির লোকই কেউ এল না। হেম নতুন বদলি হয়ে গেছে জামালপুরে, মধ্যে একবার ছুটি নিয়ে এসে বৌ আর ছেলেকে নিয়ে গেছে –তার পক্ষে এখনই ছুটি নেওয়া নাকি সম্ভব নয়। সে বুঁচির বিয়েতেও আসতে পারে নি। দুর্গাপদ অবশ্য বাঁকা কথা বলে। সে বলে: ‘তুমি রেখে বোস দিকি, বৌ-ছেলে আনবার পাস আর ছুটি তো গুনতির বাইরে। তার যা ছুটি পাওনা আছে তাতে তিনবার আসতে পারে ওরা। পাসও তো একগাদা পাওনা, ঢুকে এস্তক পাস তো কখনই নিলে না। তা নয়, আসল কথাটা আলাদা, পাসে না হয় গাড়ি ভাড়াটাই বাঁচল, বলি আসা-যাওয়ার আর খরচা নেই? অতদূর থেকে আসা! ওখানকার নতুন খরচ বেড়েছে, সস্তাগণ্ডার দেশ বটে–তবু তো একটা সংসার পেতে বসা, এখানে তোমার মাও তো তাঁর হোটেল খরচা ছাড়েন নি, সেটি তো ঠিক গুণে নিচ্ছেন। পাবেই বা কোথা থেকে?’

তা হয়ত হবে। তবে বিশ্বাস হয় না কথাটা ঠিক। দাদা কেন মিছে কথা লিখবে? এরা নিজেদের মতোই জগৎ দেখে!

আবার ভাবে সত্যিই, টাকা তো আর টানলে বাড়ে না, পাবেই বা অত কোথা থেকে।…

তবু তো দাদার নজর আছে। দুটো টাকা মণিঅ র্ডার করে পাঠিয়েছে –মুখ দেকানি। মা টাকার আন্ডিলে বসে থেকেও একখানা কোরা ধুতি আর কখানা চিনির পুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন আইবুড়ো ভাত! এই বড় নাতি, সবার বড় এ। তাও একদিন নাতি-নাতবৌকে নেমন্তন্ন পর্যন্ত করতে পারলেন না! কে জানে করবে কিনা –এখনও তো সে নাম মুখে আনে নি….. গজগজ করে মহাশ্বেতা আপন মনে।

তা হোক, কেউ যদি আসতও! এত মাছ এত মিষ্টি, ফেলা-ছড়া গেল। কে যে সব কোথায় রইল! সীতার শ্বশুরবাড়িতেও নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল ন্যাড়া। তারা কেউ আসে নি। সীতা আসতে পারে নি টাকার অভাবে। ন্যাড়াকে সে চুপিচুপি বলেই দিয়েছে, ‘ভিক্ষের অন্নে তো বেঁচে আছি, নৌকতা করব কী দিয়ে? যাওয়া আসার গাড়ি-ভাড়াও তো আছে! না মেজদা, সে আর হবে না। তুমি বড় মাসীকে বুঝিয়ে বলো।’

কান্তি আসতে পারত, সেও এল না। তার আবার লজ্জা। একে ঐ অবস্থা, লোকের কথা শুনতে পায় না, তার ওপর এবার যাহোক মরিবাঁচি করে এগজামিন দিয়েছিল–পাস করতে পারে নি। সেই লজ্জাই বড়। বড় অসুখটা শুধু ওর কান নিয়েই যায় নি, মাথারও সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে…. হতভাগা যারা হয়, তাদের সবদিক দিয়েই যে মারেন ভগবান।

এদিকে যা হোক–বুড়োর স্ত্রী-ভাগ্যটা খুব ভাল–তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করল। অভয়পদরও পছন্দর তারিফ করল সবাই। বৌ শুধু যে ফুটফুটে হয়েছে তাই নয়, এই তো মোটে বছর বারো তেরো বয়স, এরই মধ্যে যা ছেয়ালো গড়ন দেখা যাচ্ছে তাতে বয়সকালে বেশ ভালো চেহারাই দাঁড়াবে, রীতিমতো রূপসী হয়ে উঠবে।

মহাশ্বেতার আড়ালে প্রমীলা বললে, ‘হ্যাঁলো ও ছুটকী–এ কী করলেন বট্ ঠাকুর– বেছে বেছে মুক্তোর মালা এনে বানরের গলায় ঝোলালেন?’

তরলার নিজের একদিন এ বাড়িতে এসে যে অবস্থা হয়েছিল তা সে এখনও ভোলে নি, বুড়োর বৌ এত ভাল না হলে বোধহয় তার কিছু সান্ত্বনা থাকত–সুশ্ৰী বৌ আসাতে কোথায় যেন তার একটু আশাভঙ্গও হয়েছে মনে-মনে, বিশেষ করে বড় ভাসুরের মন্তব্যটা কাঁটার মতো খচখচ করছে–সে একটু ম্লান হেসে বলে, ‘এ বাড়ির এই ধারা যে মেজদি, নইলে আমাকে আপনারা বেছে বেছে নিয়ে এসে ঐ সুন্দর মানুষের ঘাড়ে চাপাবেন কেন?’

‘তা হোক! উত্তেজিত হয়ে ওঠে প্রমীলা, ‘ছোট কত্তার মহাভাগ্যি যে তোমার মতো বৌ পেছে। জা-দেইজী চিরকেলে শত্তুর, তবু একথা যদি গরমান্যি যাই তো মহাপাতক হবে। ও কটা রঙে কী এসে গেল। মানুষটা তো শিমুল ফুল!’

তরলা একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘দিদি, ভগবান কখনও দুটো জিনিস মেয়েদের একসঙ্গে দেন না! রূপ দিলে আর বরাত দেন না। ও মেয়ে ভাল পাত্তরে পড়বার নয়– কথাতেই তো আছে, অতিবড় রূপসী না পায় বর! তাছাড়া হাজার হোক বঠাকুরের প্রথম সন্তান তো–তিনি কি আর ছেলের বিদ্যেবুদ্ধির কথা ভেবে কুচ্ছিত মেয়ে আনবেন? তাঁর প্রথম বৌ! মানুষটা যতই চাপা হোক, বাপ তো!’

তারপর আরও একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘তবে কালোকুচ্ছিত আনলেই ভাল করতেন হয়ত; সে নিজের বরাত ফলিয়ে হয়ত ঐ বরেরই লক্ষ্মী উছলে দিত!’

‘বলা যায় না। দ্যাখ্। বড়গিন্নীর এখন পাথরে পাঁচ কীল, ঐ মেয়েই হয়ত কপাল ফলাবে দেখিস!’

ঈষৎ একটু প্রচ্ছন্ন-ঈর্ষাতুর কণ্ঠে বলে প্রমীলা। ….

বৌ মহাশ্বেতারও খুব পছন্দ হয়েছিল গোড়ায়। বেশ একটু বিজয়গর্বও অনুভব করেছিল সে। তার ছেলে অক্ষম, মূর্খ–ওর আবার মেয়ে জুটবে কি?–একথা মুখ ফুটে ঠিক সকলে না বললেও মনের ভাব যে সকলকারই এই রকম ছিল তা তো আর অজানা নেই। আর লোকেরই বা অপরাধ কি, ওর জন্মদাতাই যদি তাই বলে তো তারা বলবে না কেন? এবার তারা দেখুক–মেয়ে জোটে কি না। শুধু জোটা নয়, কী মেয়ে এনেছে ওই ছেলে তাও দেখে যাক সবাই। এ মেয়ে রাজারাজড়ার ঘর থেকে এসে সেধে নিয়ে যেত সবাই–সন্ধান পেলে।

কিন্তু সে আনন্দ আর গর্ব বেশিদিন থাকে না। নতুনের চমক কেটে গেলে তার একটু দুশ্চিন্তাই হয়। এ কী মেয়ে, একে সে সামলাবে কেমন করে?

মেয়েটা যেন দস্যি একেবারে–যেমন সদা সপ্রতিভ, তেমনি চঞ্চল-স্বভাব। কতকটা মেজগিন্নীরই ধরন। প্রথম যখন মেজবৌ আসে অমনি ছিল। অপছন্দটা হয়ত আরও বেশি সেই কারণেই। কিন্তু মেজবৌও ঠিক এতটা চঞ্চল এতটা সপ্রতিভ ছিল না। এ যেন বড় বেশি চঞ্চল। ছেলেমানুষ বলে মানিয়ে যাচ্ছে, সকলে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু বড় হয়েও যদি না শোধরায়?

মহা চেয়েছিল তার এক মেয়ে গিয়ে আর এক মেয়ে আসবে। বরং সে ছিল ঘর- জ্বালানে পর-ভালানে, মাকে মানত না, ওদের–মানে শত্রুর দের বশ হয়েছিল, এ ব্যাটার বৌ, তাকে ভয় ক’রে চলবে–মনের মতো করে গড়ে নিতে পারবে। কিন্তু এ যে এল এককাঠি সরেস! স্বর্ণর স্বভাবের বিপরীত একেবারে। সে ছিল ছেলেবেলা থেকেই যেন গিন্নীবান্নী, ঘর-সংসারের কাজে ঝোঁক বেশি, রান্নাঘরে থাকতেই ভালবাসত। এ এক মিনিট কোথাও স্থির থাকতে পারে না। এধারে খাটতে চায় না যে তা নয়–গতরও খুব, এই ছেলেমানুষ মেয়ে বোধহয় ওর চেয়ে বেশি ওজনের ঘড়া করে দমাদম জল আনে ঘাট থেকে, বড় বড় শীলনোড়া পেড়ে তাল তাল বাটনা বেটে দেয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে, কিন্তু বসে বসে ধীর কাজ একদম করতে চায় না। কড়াইশুঁটি ছাড়াতে বললে কি শাক বাছতে বললে যেন মাথায় বজ্রাঘাত হয় একেবারে, মুখ শুকিয়ে যায়–কোনমতে জোর করে এনে বসালেও একটু এদিক ওদিক দেখেই উঠে পালায়।

তা সে কাজকর্ম যাই হোক, স্বভাবটা নিয়েই বেশি চিন্তা মহার।’একটু যেন বেহায়া- মতো বাপু, যা-ই বলো। বেহায়া আর বাঁচাল। এখন তোমরা যাই বলে ঢাকো না কেন, আমাদের কালে এসব রীতি-ধরনকে বেহায়াপনাই বলত!’ এক এক সময় মনের ভাবটা প্রকাশ ক’রেই ফেলে।

মেজগিন্নী বলে, ‘ছেলেমানুষ, মেয়ের মতো। ও যে বৌ, এটা এখনও ওর মাথায় যায় নি। কীই বা বয়স। একটু সেয়ানা হোক, জ্ঞানগম্যি হোক, আপনিই শান্ত হয়ে যাবে। এখন থেকে অত ভাবতে হবে না!’

কিন্তু মহাশ্বেতা তা মানতে পারে না।

হোক্‌গে ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষ বলে কি সাতখুন মাপ নাকি? ছেলেবেলা থেকেই সহবৎ শেখাতে হয়। কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাশ ট্যাঁশ!

তাছাড়া কীই বা এমন ছেলেমানুষ? মহাশ্বেতা তো আরও ছেলেমানুষ এসেছিল এ বাড়িতে। তখন ওর শাশুড়ী বড় বড় দেওরদের সঙ্গেই কথা কইতে দিতেন না। বলতেন, ‘ভাসুরের মতো দেওর ওসব–ওদের সঙ্গে কথা কয়ো না বৌমা, পাড়াঘরে নিন্দে হবে! মেজবৌ নিজেও তো এমন কিছু বয়সে আসে নি, প্রায় এই রকম বয়সেই তো এসে ঢুকেছিল এ বাড়িতে––কৈ, হাটিপাটি পেড়ে ভাসুরের সঙ্গে গল্প করেছিল কি? আর এ মেয়ে ভাসুর তো ভাসুর–শ্বশুরদের সঙ্গেই কথা কয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ মহাশ্বেতা শাসন করবে কি, যারা বড়–শাসন করার কর্তা, তারাই কিছু বলে না। অমন যে রাশভারী লোক অভয়পদ, তা তার সঙ্গেই বসে কলকল করে এক গঙ্গা কথা বলে–সেও বেশ বসে বসে শোনে, হাসেও মধ্যে মধ্যে–শাসন করা তো চুলোয় যাক! মেজকর্তার সঙ্গেই যা আলাপটা খুব জমে না, তবে দুটো-চারটে কথা সেও যে না কয় তা নয়–ছোট কর্তা তো গলে গেছে একেবারে। আপিস থেকে ফিরে রোজ এক ঘণ্টা ধরে গল্প করা চাই ঐটুকু মেয়ের সঙ্গে। ওরাই যদি এমন ধারা করে প্রশ্রয় দেয় তো সে শাশুড়ীর শাসন মানবে কেন?

মহাশ্বেতার সত্যিই ভাবনা হয় এক এক সময়ে।

অথচ কী যে করবে তাও ভেবে পায় না। কাউকে বলবারও যো নেই। সকলেই হেসে উড়িয়ে দেয়, ওকেই বরং পাগল বলে, উপহাস করে। জায়েরা বলে, ‘দিদির যেমন কথা! এখনই যেন ছিষ্টি রসাতলে গেল একেবারে বোয়ের বেহায়াপনায়। দুদিন যাক না বাপু, তারপর ভাবতে বসো। এই তো সবে এয়েছে। এখানাকার জল গায়ে বসুক। এখনই অত কেন?’

না, ওদিকে কারও সহানুভূতি নেই। মেয়েটা যেন সবাইকে জাদু করেছে বাড়িতে পা দিতে না দিতে। সবচেয়ে রাগ হয় যখন শাশুড়ী বলেন, ‘আ বড়বৌমা, ও ছেলেমানুষ, মেয়ের মতো হেসেখেলে বেড়াচ্ছে বেড়াক না–দুটো একটা পেটে আসুক, একটু গিন্নীবান্নী হোক, আপনিই শুধরে যাবে। বলি মেজবৌও কি কম গেছো ছিল!’

ও ছেলেমানুষ, আর মহাশ্বেতা এসেছিল বুঝি তিনকেলে বুড়ি! তখন এসব বিবেচনা কোথায় ছিল!

না, শাসন করলে তাকে একাই করতে হবে। সাধারণভাবে যেটুকু করবার তা সে করেও মধ্যে মধ্যে, আবার কাছে বসিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর ক’রেও বোঝাবার চেষ্টা করে–কিন্তু মেয়েটা কোনটাই যেন গায়ে মাখে না। কথা তো শোনেই না, তার জন্যে বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা দুঃখিতও নয়। অনুযোগ করলে হেসে গড়িয়ে পড়ে

অথচ ওকে যে ভয় করে বা এড়িয়ে চলে তাও নয়। এক পেট খেয়ে উঠেও শাশুড়ীর পাতের কাছে বসে অনায়াসে টকের বড়ি চেয়ে খায়। কাসুন্দির হাঁড়ি রোদে দিলেই ধর্ণা দিয়ে পড়ে, ‘হেইমা আমাকে একটু দাও, তোমার পায়ে পড়ি!’ এ মেয়েকে শাসন করবে সে কী করে?

তড়িৎপ্রভা নাম বৌয়ের। তড়িৎ মানে নাকি আকাশে ঐ যে বিদ্যুৎ চমকায়, বিদ্যুৎ। ছোটবৌ বলেছে তাকে। তা নাম সার্থক করেছে বটে। বিদ্যুতের মতোই চঞ্চল, এই আছে এই নেই।…..

‘মুয়ে আগুন বাপ মিসের! রাখার মতো আর নাম খুঁজে পেলে না! আমাদের হাড় ভাজা ভাজা করতে ঐ নাম দিয়ে বসে রইল!’

মাঝে মাঝে তার অরুণের কথাও মনে হয়।

‘কোথায় যে গেল ছেলেটা। কী যে দুর্মতি হল! থাকলে তার কাছে বই নিয়ে বসাতুম। আজকাল তো মেয়েদের লেখাপড়া শেখা হয়েছে–তবু একটু লেখাপড়া করলে যদি শান্ত হত!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *