১২. অভিমান

অভিমান

টুম্পা কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না, অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, আব্বু, তুমি?

হ্যাঁ, মা। আমি।

তুমি কখন এসেছ?

সন্ধ্যেবেলা।

কার সাথে এসেছ?

কারো সাথে আসি নাই। আমি একা একা এসেছি।

টুম্পা বিস্ফারিত চোখে বলল, একা?

হ্যাঁ। আমি একা একা এসেছি।

কেমন করে এসেছ?

এই তো স্কুটারে করে। এসে জিজ্ঞেস করে করে বাসাটা খুঁজে বের করেছি।

কিন্তু টুম্পা কথা বলতে পারে না, কিন্তু—

কিন্তু কী?

তুমি তো ঘর থেকেই বের হও না আব্বু।

আব্বু হাসার চেষ্টা করলেন, সিঁড়ির কাছে আবছা আলোতে আব্বুর হাসিটাকে খুব বিচিত্র দেখালো, আব্বু বললেন, কিন্তু আমাকে তো ঘর থেকে বের হতে হবে। হবে না?

কেন?

তুই বলেছিলি মনে নেই?

কিন্তু আমি তো ভুলে বলেছিলাম। ডাক্তার সাহেব বলেছেন–

তুই ভুল বলিস নাই। ডাক্তার সাহেব ভুল বলেছে। আব্বু টুম্পার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আয় মা, টুম্পা। আমার কাছে আয়। আমি খুব কষ্টের মাঝে আছি।

টুম্পা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো, দেখলো তার পিছনে রুমি সুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আরও পিছনে গাড়ি থেকে নামতে নামতে ছোট খালা আর খালু ও থেমে গেছেন। টুম্পাকে একা কথা বলতে দিয়ে তারা সবাই খুব আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেল। আব্বু আবার ডাকলেন, বললেন, আয় মা টুম্পা, আমার কাছে আয়।

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না আব্বু। না।

আব্বু  কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলেন, কেন না?

আমি এসে তোমার খুব ক্ষতি করেছি আব্বু।

কে বলেছে?

সবাই বলেছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন।

কী বলেছেন ডাক্তার সাহেব?

বলেছেন আমি অল্প কয়দিনের জন্যে এসে তোমার সব কিছু ওলট করে দিচ্ছি– তুমি তোমার নিজের একটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে–।

আব্বু কেমন যেন অবাক হয়ে বললেন, তুই ওলট পালট করে দিচ্ছিস?

হ্যাঁ আব্বু। আমি তোমার কিছু ওলট পালট করতে চাই না কথা নাই বার্তা নেই টুম্পা হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল।

আব্বু একটু অবাক হয়ে টুম্পার কাছে এগিয়ে এলেন, তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই কাঁদছিস কেন টুম্পা?

ডাক্তার সাহেব বলেছেন তুমি আমাকে দেখে ভয় পাও! আমকে তোমার কাছে যেতে না করেছেন। আমি গেলে তোমার ক্ষতি হবে—

আব্বু আস্তে আস্তে বললেন, শোন টুম্পা, আমি অসুস্থ হতে পারি, আমি কিন্তু বোকা না। আমি সব বুঝি–কখনো কখনো ভুল জিনিষ বুঝি, যেটা বোঝার কথা না সেটাও বুঝি। কিন্তু আমি বুঝি। সবাই আমাকে বুঝিয়েছে আমার ঘরের ভেতরে বসে থাকতে হবে। ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। কারণ আমি বাইরে যেতে পারব না। কিছুতেই বাইরে যেতে পারব না! আর তুই আমাকে কী বলেছিস টুম্পা? তুই বলেছিস আমাকে বাইরে যেতে হবে! আমার ভয়টাকে নিয়ে বাঁচা শিখতে হবে। আমি বসে বসে ভেবেছি। ভেবে ভেবে কী বুঝেছি জানিস?

কী আব্বু?

ডাক্তারদের কথা ভুল। তোর কথা সত্যি। আমি চোখ খুললেই দেখি আমার চারপাশে কতো কী ভয়ের জিনিষ–কিন্তু আমি জানি সেগুলো মিথ্যা! কেন মিথ্যা জানিস?

কেন আব্বু?

কারণ তুই বলেছিস এ সব মিথ্যা। এতোদিন আমি কারও একটা কথা বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু আমি তোর সব কথা বিশ্বাস করেছি।

টুম্পা চোখ মুছে বলল, তুমি আমাকে ভয় পাও না আব্বু?

ছিঃ মা! নিজের মেয়েকে কেউ ভয় পায়? তুই আয়–আমার কাছে আয়।

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না আব্বু। ডাক্তার সাহেব বলেছেন আমি যেন তোমার কাছে না যাই। আমি গেলে তোমার ক্ষতি হবে।

আব্বু কেমন জানি আহত গলায় বললেন, তুই আমার কাছে আসবি না?

আমি আসতে চাই আব্বু, কিন্তু আমি জানি আমি যদি আসি তোমার ক্ষতি হবে। আমি যখন চলে যাব কখন তোমার অসুখটা অনেক বেড়ে যাবে। তখন তোমার অনেক কষ্ট হবে কিন্তু কেউ তোমাকে দেখার জন্যে থাকবে না। তুমি একলা একলা কষ্ট পাবে। অনেক বেশি কষ্ট পাবে– টুম্পা কথা শেষ করার আগে আবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।

আব্বু আস্তে আস্তে বলল, তুই তাহলে আমার কাছে আসবি না?

না।

আব্বু তখন আস্তে আস্তে সিঁড়ির উপরে বসে গেলেন। দুই হাত দিয়ে মুখ ডেকে কিছুক্ষণ বসে রইলেন, তারপর মুখটা তুলে দুর্বল ভাবে হাসলেন। বললেন, তুই যাবি মনে করে আমি আজকে আমার বাসাটা পরিষ্কার করেছিলাম। আমি দোকান থেকে তোর জন্যে চিকেন বার্গার কিনে এনেছিলাম।

টুম্পা ভাঙ্গা গলায় বলল, আই অ্যাম সরি আব্বু। আই অ্যাম ভেরি ভেরি সরি।

তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল।

কী সারপ্রাইজ?

মনে আছে তুই আমাকে ছবি আঁকতে বলেছিলি? আমি ছবি আঁকতে পারছিলাম না–

হ্যাঁ।

আমি শেষ পর্যন্ত ছবি এঁকেছি।

সত্যি? সত্যি আব্বু?

সত্যি। আব্বু একটু হাসার চেষ্টা করলেন, বললেন, অনেকদিন পর ছবি আঁকলাম তো তাই অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু মনে হয় শেষ পর্যন্ত যেটা আঁকতে চেয়েছিলাম সেটা আঁকতে পেরেছি। তোকে দেখিয়ে আমি অবাক করে দিতে চেয়েছিলাম!

আব্বু একটু অপেক্ষা করে বললেন, টুম্পা মা আমার, তুই সত্যি যাবি না আমার সাথে?

টুম্পা আর পারল না, আব্বুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বলল, যাব আব্বু যাব। যাব।

সিঁড়ির উপরে ছোটখালা দাঁড়িয়েছিলেন, নিচু গলায় ডাকলেন, টুম্পা! জি ছোটখালা।

যাবার আগে তোর আব্বুকে নিয়ে একটু উপরে আর, আমরা সবাই মিলে একটু গল্প গুজব করি।

টুম্পা উঠে দাঁড়িয়ে আব্বুর হাত ধরে বলল, চল আব্বু।

এক মুহূর্তের জন্যে আব্বুর মুখে এক ধরনের অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠে। আব্বু জোর করে সেটা সরিয়ে ফেলে বললেন, চল!

.

টুম্পা আব্বুর আঁকা ছবিটার দিকে হতচকিতের মতো তাকিয়ে রইলো। তার মনে হতে লাগলো তার বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে! আমেরিকার কতো আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে সে কতো অসাধারণ পেইন্টিং দেখেছে কিন্তু এই ছবিটার মতো কোনো ছবি কী তাকে এরকম অভিভূত করেছে? ছবিটার দিকে তাকালেই সে বুঝতে পারে এর মাঝে একটা মানুষের বিচিত্র একটা ভাবনার জগৎ লুকিয়ে আছে, যে জগন্টার খোঁজ অন্য কেউ কোনোদিন পাবে না। ছবিটার মাঝে এক ধরণের বিষাদ লুকিয়ে আছে, কী জন্যে লুকিয়ে আছে সে বুঝতে পারে না, শুধু অনুভব করতে পারে।

টুম্পা আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু, তুমি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পার?

আব্বু বাচ্চা ছেলের মতো খুশি হয়ে উঠে বললেন, ভালো লেগেছে

অ-স-ম্ভব ভালো লেগেছে আব্বু। অ-স-ব ভালো! তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্টিস্ট।

ধূর বোকা মেয়ে?

আমি বোকা না আব্বু! আমি ভালো ছবি আর খারাপ ছবি বুঝি। পৃথিবীতে বিখ্যাত ছবি আছে আর ভালো ছবি আছে। সব বিখ্যাত ছবি ভালো না আর সব ভালো ছবি বিখ্যাত না! তোমার এটা ভালো ছবি আব্বু অসম্ভব ভালো ছবি।

আব্বু আবার বললেন, ধূর বোকা মেয়ে।

টুম্পা বলল, আব্বু তুমি আর ছবি আঁকবে না?

আঁকব।

আঁকো আব্বু, আমি দেখি তুমি কেমন করে আঁকো।

তুই দেখবি?

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আব্বু। একটু পর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বু–

কী, মা?

তুমি আমাকে ছবি আঁকতে শেখাবে।

তুই ছবি আঁকা শিখতে চাস? 

হ্যাঁ আব্বু। আমি বড় হয়ে তোমার মতোন একজন আর্টিস্ট হতে চাই।

আব্বু টুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, দেখিস তুই আমার থেকেও বড় আর্টিস্ট হবি।

ঠিক আছে দেখব। কিন্তু এখন তুমি আরেকটা ছবি আঁকো। আমি দেখব।

.

আব্বু তখন ইজেলে একটা ক্যানভাস বসিয়ে আরেকটা ছবি আঁকতে শুরু করলেন। টুম্পা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে–আব্বুর হাতের ছোঁয়ায় সাদা ক্যানভাসটি কী অপূর্ব একটা ছবি হয়ে উঠতে থাকে। টুম্পার কাছে মনে হয় কেউ যেন তার হাত ধরে একটা স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাচ্ছে, যতই সামনে যাচ্ছে। ততই সেটা রূপকথার জগতের মতো তার সামনে খুলে যাচ্ছে।

ছবিটা শেষ করে আব্বু আরেকটা ছবি আঁকলেন, তারপর আরেকটা। তারপর আরেকটা। তারপর আঁকতেই থাকলেন।

দুই সপ্তাহ পর আব্বুর ছোট বাসার মাঝে একুশটা এক্রেলিকের ছবি জমা হয়ে গেল, একটি থেকে আরেকটা বেশি সুন্দর, বেশি রহস্যময়। টুম্পা তখন তার আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু।

আব্বু বললেন, কী মা?

তোমার ছবির একটা এক্সিবিশান করি?

আব্বু হা হা করে হাসলেন, বললেন, ধূর বোকা মেয়ে এই এক্রেলিক পেইন্টের ছবি কে দেখবে। এগুলো ছেলেমানুষী ছবি।

টুম্পা বলল, আব্বু আমাকে তুমি ছোট বাচ্চা পাও নি। আমি ভালো ছবি আর খারাপ ছবি বুঝি। তোমার এই ছবিগুলোর এক্সিবিশান করে আমরা গ্যালারিতে দিয়ে দেব।

আব্বু হাসলেন, বললেন, ধূর বোকা! এই ছবি গ্যালারিতে দিয়ে কী হবে?

.

টুম্পা অবশ্যি অসাধ্য সাধন করে ফেলল। ধানমণ্ডিতে একটা গ্যালারি ভাড়া করলো–ছোট খালু সেটার জন্যে সাহায্য করলেন। ছবি প্রদর্শনীর জন্যে একটা কার্ড ছাপানো হলো, আব্বু নিজেই সেটা ডিজাইন করে দিলেন, ছাপানোর কাজে সাহায্য করলেন ছোটখালা। টুম্পা সুমিকে নিয়ে সেই কার্ডগুলো সবার মাঝে বিতরণ করলো এখানে সাহায্য করলো ছোটখালার ড্রাইভার। খবরের কাগজের অফিসে যখন কার্ডগুলো বিলি করতে যাচ্ছিল তখন একটা মজার ঘটনা ঘটলো।

গেটে একজন দারোয়ান তাদের থামালো, জিজ্ঞেস করলো, কার সাথে দেখা করতে চায়। টুম্পা কিংবা সুমি–পত্রিকার অফিসের কাউকেই চেনে না তাই আমতা আমতা করে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করল, একটা ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে তারা তার দাওয়াতের কার্ড দিতে এসেছে। দারওয়ান বলল, তার হাতে দিয়ে যেতে সে পৌঁছে দেবে, টুম্পা দিয়ে যেতে চাচ্ছিল সুমি রাজী হলো না, সে ভেতরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেহারার কারো হাতে দিতে চায়।

যখন এসব নিয়ে একটু কথা কাটাকাটি হচ্ছে ঠিক তখন মাঝ বয়সী একজন মানুষ অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল সে থামলো, জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?

সুমি বলল, আমরা একটা দাওয়াতের কার্ড দিতে এসেছি–ইনি ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না।

দারওয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মানুষটি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিসের দাওয়াত? বিয়ে না জন্মদিন?

টুম্পা বলল, না। ছবির এক্সিবিশন।

ও! মানুষটার চোখে একটু কৌতূহল ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কার ছবি?

টুম্পা বলল, বুলবুল রায়হানের সলো এক্সিবিশান।

মানুষটা মনে হলো একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে গেল, বলল, কার ছবি?

বুলবুল রায়হান।

বুলবুল রায়হান বেঁচে আছে? শুনেছিলাম সুইসাইড করেছে—

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার আব্বু মোটেই সুইসাইড করেন নি। আব্বু  বেঁচে আছেন, ছবি আঁকছেন।

মানুষটি চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি বুলবুল রায়হানের মেয়ে।

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

আমি শুনেছিলাম বুলবুল রায়হানের ওয়াইফ তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন?

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আমি আমেরিকা থেকে এসেছি।

কিন্তু কিন্তু—

কিন্তু কী?

মানুষটা ইতস্তত করে বলল, আমি যতদূর জানতাম বুলবুল রায়হান পাগল হয়ে গিয়েছিল–

টুম্পা মুখটা শক্ত করে বলল, আব্বুর স্কিঞ্জাফ্রেনিয়ার একটু সমস্যা আছে।

তাহলে?

এবারে সুমি বলল, মেজো খালুর অনেক বড় সমস্যা ছিল, কোনো ডাক্তার ভালো করতে পারে নি। টুম্পা আপু এসে দুই সপ্তাহের মাঝে ভালো করে ফেলেছে–

কীভাবে?

সুমি রহস্যের ভান করে বলল, ম্যাজিক!

মানুষটা একবার সুমির দিকে আরেকবার টুম্পার দিকে তাকালো তারপর বলল, এটা দিয়ে অসম্ভব ভালো একটা স্টোরি হয়।

টুম্পা বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, কী হয়?

খবরের কাগজের একটা নিউজ হয়। মানুষটা টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী খুব ব্যস্ত?

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না।

তাহলে তুমি একটু ভেতরে আস। তোমার একটা ইন্টারভিউ নেই। তারপর ক্যামেরাম্যান নিয়ে যাব বুলবুল রায়হানের কাছে, তার একটা ইন্টারভিউ নেব চমৎকার একটা স্টোরি হবে। হার্ট টাচিং স্টোরি–

খবরের কাগজের এই স্টোরির জন্যেই কী না কে জানে এক্সিবিশন দেখার জন্যে সত্যি সত্যি অসংখ্য মানুষ চলে এল। পত্রপত্রিকার অনেক সাংবাদিক, তার সাথে সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান। গ্যালারির ভেতরে ছবিগুলো টানানো হয়েছে। একটা লাল ফিতে টানানো হয়েছে, সেটা কেটে সবাই ভেতরে ঢুকবে। আব্বু একটা জিনসের প্যান্টের উপর একটা ফতুয়া পরেছেন। তাকে দেখতে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে টুম্পা চোখ ফেরাতে পারে না। ছোটখালা সেজেগুঁজে এসেছেন, ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন, অতিথিদের দেখে ব্যস্ত হয়ে এসে বললেন, কতো লোক আর সাংবাদিক এসেছে দেখেছিস? দেশি মানুষ থেকে বিদেশিই তো বেশি! আর দেরি করে লাভ নেই, ফিতে কেটে ভেতরে ঢুকে যাওয়া যাক।

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, ফিতে কাটবে কে?

ছোটখালা মাথা চুলকে বললেন, একজন প্রধান অতিথি বানানো উচিৎ ছিল! প্রধান অতিথি সবসময় ফিতে কাটে!

বানাও নাই?

না, ভুলে গেছি।

সুমি বলল, তাহলে কী হবে?

টুম্পা বলল, আমার মাথায় একটু বুদ্ধি এসেছে।

কী বুদ্ধি?

তুমি আমাদের প্রধান অতিথি। তুমি ফিতে কাটবে–

ছোটখালা চোখ কপালে তুলে বললেন, ধূর গাধা! আমি ফিতে কাটব কেমন করে–

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। টুম্পা সবার সামনে গিয়ে প্রথমে বাংলায় তারপর ইংরেজিতে ঘোষণা করে দিয়েছে যে ছোটখালা ফিতে কেটে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন! ছোটখালার এতো সাংবাদিক এতো টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে ফিতে কাটলেন। সবাই গ্যালারির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল টেলিভিশনের ক্যামেরা কাঁধে একজন সবাইকে থামালো, বলল, শিল্পী কিছু বলবেন না?

আব্বু বললেন, না! আমি কিছু বলব না।

একজন সাংবাদিক বলল, না, না, শিল্পীকে কিছু বলতে হবে। সবসময় বলে। বলেন কিছু একটা।

আব্বু বললেন, কী বলব?

কেমন করে ছবি আঁকলেন এইসব।

আব্বুকে প্রথমে একটু অসহায় দেখায় কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন। হাত দিয়ে মাথার চুলকে সোজা করতে করতে বললেন, আসলে আজকে এখানে এই সলো এক্সিবিশান হওয়ার কথা ছিল না। আমি আসলে একজন অসুস্থ মানুষ। আপনারা আপনাদের চারপাশে যা কিছু দেখেন আমি সেগুলো দেখি না–আমি অন্য কিছু দেখি। সেগুলো ভয়ের, সেগুলো দুঃখের এবং মাঝে মাঝে সেগুলো আতংকের। সেই ভয় থেকে বাঁচার জন্যে আমি একটা অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে থাকতাম। সেই ভয় থেকে আমি মুক্তি পেতাম না কিন্তু আমি ভাবতাম আমার আর কিছু করার নেই!

তখন আমার মেয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করেছে। বড় বড় ডাক্তারেরা যেটা পারে নি আমার মেয়ে সেটা করতে পেরেছে। সেই ভয়টাকে মেনে নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। আবার নতুন করে ছবি আঁকতে শিখিয়েছে। তাই এই সলো এক্সিবিশানটা আসলে আমার নয়। এটি আমার মেয়ে টুম্পার। এই গ্যালারির দেয়ালে টানানো এগুলো ছবি নয়–এগুলো হচ্ছে আমার মেয়ের জন্যে আমার ভালোবাসা! আর কিছু নয়।

আব্বুর কথা শুনে টুম্পার চোখে পানি এসে গেল, অনেকগুলো টেলিভিশন ক্যামেরা তার দিকে তাক করে ছিল বলে সে তার চোখ মুছতে পারল না।

.

ঘণ্টাখানেক পর ছোটখালা খুব ব্যস্ত হয়ে টুম্পার কাছে এলেন, বললেন, সর্বনাশ হয়েছে!

টুম্পা ভয় পেয়ে বলল, কী হয়েছে?

বিদেশিগুলো ছবি কিনতে চাইছে। আমরা তো দাম বসাই নি। আমাকে দাম জিজ্ঞেস করছে?

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি কতো বলেছ?

আমি কিছু বলার আগেই বলল, এক হাজার ডলার করে দেবে। পাঁচটা কিনবে! কী মনে হয় তোর?

টুম্পা হাসল, বলল, আমি জানি না। তুমি ছোটখালুর সাথে কথা বলে ঠিক করো।

ছোটখালা বললেন, সেটাই ভালো।

ছোটখালা ভীড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। টুম্পা তার আব্বুকে খুঁজে বের করার জন্যে এদিক–সেদিক তাকালো, তার এই আব্বুটিকে সে আবিষ্কার করেছে। সে একা–আর কেউ নয়। এই আব্বুটিও এখন শুধু তার একার। আর কারো নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *