১২. অক্টোপাস

১২. অক্টোপাস

ভোররাতে জাহাজটা রওনা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম জাহাজটা থেমে আছে। আমি মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামী, জাহাজটা ছাড়বে না?”

“উঁহু।” মামী মাথা নাড়লেন, “প্ল্যান পালটানো হয়েছে। এখানে আরও দুদিন থাকব।”

“কেন?”

মামী হাসি হাসি মুখে বললেন, “তোরা যে কোরাল রিফটা আবিষ্কার করেছিস সেটাকে ভালো করে স্টাডি করতে হবে।” মামী কথাটা বলার সময় ‘তোরা’ শব্দটা অনেক জোর দিয়ে বললেন, শুনে আমার খুবই আনন্দ হলো।

সবাই যখন কোরাল রিফটা দেখতে যাবে তখন আমি আর মিতি সাথে যেতে পারব কিনা খুবই জানার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এর আগের বার আমরা যে কাণ্ড করেছি এবং সেটা নিয়ে যা যা হয়েছে সেটা চিন্তা করে আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। যদি তারা নিতে চায় নিজেরাই নিবে, আমার জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগল।

মামী আমাকে কিছু বললেন না, ব্যস্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন। সকালে নাস্তা করার সময় জহিরকে দেখলাম না। তার মাথা ন্যাড়া হওয়ার পর মনে হয় সে আর তার কেবিন থেকে বের হচ্ছে না। নাস্তা শেষ করে আমি আর মিতি ডেকে এসে বসেছি। মিতি কয়েকটা বই নিয়ে এসেছে, মনে হয় বসে বসে পড়বে। বইগুলো সবই ইংরেজি, বাংলা বই পড়তেই আমার দাঁত ভেঙে যায়, ইংরেজি বই পড়ব কেমন করে? তবু একটা বই নিয়ে ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি। বইয়ের ভেতরে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি, পড়তে না পারলেও ছবি দেখে সময় কেটে যাবে। বইটা নানারকম সামদিক প্রাণীর ওপর, সমুদ্রের নিচে এত আজব প্রাণী আছে কে জানত!

আমি যখন বইয়ের ছবি দেখা শুরু করেছি ঠিক তখন জহির অনেকটা পা টিপে টিপে এসে হাজির হলো। মাথা ন্যাড়া করায় তার যে মাথায় চুল নাই এই ব্যাপারটা সে এক সেকেন্ডও ভুলতে পারছে না, মাথায় হাত দিয়ে নিজের অজান্তে তার প্রিয় চুলগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে।

জহির কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, চুল না থাকার কারণে তাকে এখন সম্পূর্ণ অন্য একজন মানুষের মতো দেখাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকালাম, জহির তখন জিজ্ঞেস করল, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“কী কথা?”

“তোর টুপির মাঝে তুই ইচ্ছা করে আঠা লাগিয়ে রেখেছিলি তাই না? যেন আমার চুলে আঠা লাগে?”

জহির ঠিক ঠিক সন্দেহ করেছে কিন্তু আমি তো এখন সত্যবাদী জর্জ ওয়াশিংটন হতে পারি না, তাই মাথা নাড়লাম, বললাম, “কেন? আমি কেন সেটা করতে যাব?”

“আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

যদিও আমি খুব ভালো করে জানি সে কীসের জন্য প্রতিশোধের কথা বলছে তার পরও আমি খুবই সরল মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “কীসের প্রতিশোেধ?”

“এই যে তোরা সমুদ্রে হারিয়ে গেলি–”

“কেন হারিয়েছিলাম, বলো দেখি?”

জহির মুখ শক্ত করে বলল, “আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দে। আমার চুলে আঠা লাগানোর পুরোটা তোর প্ল্যান ছিল। ঠিক?”

আমি আমার মুখ আরও শক্ত করে বললাম, “তুমি যে কাজটা করেছিলে সেটা কত ডেঞ্জারাস ছিল তুমি জানো? যদি আমাদের বোটটা উলটে যেত তাহলে আমরা যে মরে যেতাম সেটা টের পাচ্ছ?”

জহির হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “হয়েছে হয়েছে বুঝেছি। এখন আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেই কথার উত্তর দে। পুরোটা তোর প্ল্যান, ঠিক?”

“যখন দড়িটা হাত থেকে ছুটে গেল তখন সাথে সাথে তোমার ভেতরে গিয়ে বড়ো কাউকে বলা দরকার ছিল।”

জহির বিরক্ত হয়ে বলল, “বড়ো বড়ো কথা বাদ দে। যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।”

আমি আমার মুখের একপাশ দিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললাম, “তুমি যে কাজটা করেছ আমি যদি সেজন্য শাস্তি দিতাম তাহলে সেটা নিয়ে তোমার কোনো সন্দেহ থাকবে না! সেটা এই ছোটোখাটো চুলে আঠা লাগানো হবে না! সেটা হবে সত্যিকারের শাস্তি

জহির তার চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “তুই কী করতি?”

“আমি বলব না।”

“বল, শুনি।”

“সত্যি শুনতে চাও?”

জহির মাথা নাড়ল। আমি বললাম, “যেরকম তোমার টয়লেট সিটে কয়েক ফোঁটা সুপার গ্লু দিয়ে রাখলাম। তুমি যখন বসবে তখন আর উঠতে পারবে না।”

জহির কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “তোর কাছে সুপার গ্লু আছে?”

“সবসময় থাকে। খুব কাজের জিনিস।”

জহির বলল, “কিন্তু কিন্তু—” শেষ পর্যন্ত বাক্যটা শেষ না করে চলে গেল।

পুরো সময়টা মিতি আমার আর জহিরের মুখের দিকে তাকিয়েছিল, আমরা কী কথা বলছি সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল। জহির চলে যাওয়ার পর মিতি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বুক থেকে তার নোট বইটা বের করে সেখানে কুট কুট করে লিখল, তোমার কাছে সত্যি সত্যি সুপার গ্লু থাকে?

আমি লেখাটা পড়ে হি হি করে হাসলাম। বললাম, “মাথা খারাপ? আমার কাছে কোনো সুপার গ্লু নাই! কেন থাকবে?”

মিতি তখন কুট কুট করে লিখল, ‘তুমি অনেক দুষ্টু।’

আমি তার হাত থেকে নোট বইটা নিয়ে ‘দুষ্টু’ শব্দটা কেটে লিখলাম ‘পাজী’।

মিতি সেটা পড়ে মাথা নেড়ে রাজী হয়ে হি হি করে হাসল।

আমি আবার সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর বইটার ছবি দেখতে শুরু করলাম। কত বিচিত্র রকম প্রাণী সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। ছবিগুলো দেখলে মনে হয় শুকনা জায়গার জগৎটা হচ্ছে ভুয়া, পানির নিচেই বুঝি আসল জগৎ। ছবিগুলো দেখতে দেখতে অক্টোপাসের ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। কী ভয়ানক ছবি, কিলবিলে পা, সেই পায়ে আবার চুষণী! চোখ দুটো কী আশ্চর্য, দেখে মনে হয় সবকিছু বুঝতে পারছে।

আমি কষ্ট করে অক্টোপাসের ওপরে লেখাটা পড়তে লাগলাম। প্রথম প্রথম ইংরেজি পড়তে গিয়ে সত্যি সত্যি দাঁত ভেঙে যাওয়ার অবস্থা, খানিকটা পড়ার পর একটু সহজ মনে হতে লাগল। আমি ধাক্কাধাক্কি করে পুরোটা পড়ে ফেললাম। পড়া শেষ করে টের পেলাম অক্টোপাস দেখতে যত আজব সে নিজে তার থেকে একশ গুণ বেশী আজব। পৃথিবীর সবার ব্রেন একটা, অক্টোপাসের ব্রেন নাকি নয়টা। আসল ব্রেন ছাড়াও আটটা কিলবিলে পায়ের জন্য আটটা আলাদা আলাদা ব্রেন। তার অর্থ অক্টোপাসের পাগুলো নিজে নিজে চলতে পারে।

আমি চিন্তা করলাম আমার হাত পায়ের যদি আলাদা ব্রেন থাকত তাহলে কী হতো? কথা নাই বার্তা নাই কাউকে আমার হাত নিজে নিজে ঘুষি মেরে দিত?

অক্টোপাসের শুধু যে নয়টা বেন তাই না, তার হৃৎপিণ্ড নাকি তিনটা। কী আজব! একটা হৃৎপিণ্ড নিয়েই মানুষের ঝামেলার শেষ নাই, দুইদিন পরে পরে হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনটা হৃৎপিণ্ড থাকলে সেগুলো সামলায় কেমন করে?

অক্টোপাসের চোখ নিয়েও আরও অনেক কিছু লেখা আছে। সেগুলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে যেটা সবচেয়ে আজব সেটা হচ্ছে অক্টোপাস নাকি খুব বুদ্ধিমান! নয়টা ব্রেইন হলে বুদ্ধিমান তো হতেই হবে, এক ব্রেইন নিয়েই মানুষের বুদ্ধির শেষ নাই, নয়টা হলে বুদ্ধিমান হবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? কে জানে পানির নিচে অক্টোপাস ঘর বাড়ি বানায় কিনা, কবিতা লিখে কিনা, ছেলেপিলেদের স্কুলে পাঠায় কিনা। হয়ত অক্টোপাসেরা গোপনে বোমা বানাচ্ছে হঠাৎ একদিন তারা সেই বোমা নিয়ে মানুষের ওপর হামলা করবে!

তবে বইটাতে লেখা আছে অক্টোপাস খুবই নিরীহ, মানুষ থেকে দূরে থাকে। বেশীর ভাগ অক্টোপাসের সাইজ ছোটো। শুধু প্রশান্ত মহাসাগরে বিশাল সাইজের অক্টোপাস আছে। আমাদের এখানে নাই, থাকলে মজাই হতো।

দুপুরবেলা আমরা যখন লাঞ্চ করছি তখন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দুপুরে কাজকর্ম নেই তো?”

আমি একটু অবাক হলাম, দুপুরে আমাদের আবার কী কাজ থাকবে? আমি বললাম, “না। কেন?”

“ফটোশুট।”

ফটোশুট কথাটা আগে শুনি নাই, মনে হলো ফটো তোলার মতো কিছু একটা। সত্যিই তাই, শুনলাম মানুষটা বলল, “তোমার আর মিতির ফটো তোলা হবে।”

“আমাদের? ফটো?”

“হ্যাঁ।”

“কোনখানে তুলবেন?”

“তোমাদের আবিষ্কার করা কোরাল রিফে।”

“কোরাল রিফে? পানির নিচে?” উত্তেজনায় আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

মানুষটা মাথা নাড়ল, “কোরাল রিফ তো পানির নিচেই হবে।”

“তাহলে তাহলে–” আমি বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করলাম, “ক্যামেরা ভিজে যাবে না?”

মানুষটা বলল, “আমাদের খুব হাই-ফাই আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা আছে। আমাদের কাজই হচ্ছে সমুদ্রের তলায় ছবি তোলা।”

মিতি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল, মোটামুটি বুঝে গেছে কী নিয়ে কথা হচ্ছে তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে হাত দিয়ে ক্যামেরার ছবি ভোলার ভঙ্গী করে জিজ্ঞেস করল আমি মাথা নাড়লাম। তখন হাত দিয়ে আমাদের দুজনকে দেখাল–জানতে চাইল আমাদের দুজনের ছবি তোলা হবে কিনা। আমি মাথা নাড়লাম, হাত ওপরে তুলে ঝাঁকুনি দিলাম আর মুখে বললাম, “ইয়েস!”

মিতি দাঁত বের করে হাসল, ডান হাত দিয়ে খাচ্ছিলাম বলে বাম হাত দিয়ে আমরা হাই ফাইভ দিলাম।

আমাদেরকে স্নর্কেল করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে ইমতিয়াজ চাচা রওনা দিয়েছিলেন, টেবিলের এক পাশে বসে খেতে খেতে আমাদের দিকে চোখ

মটকালেন, বললেন, “কী খবর? আজকে কোনো অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না।”

মামী বললেন, “এক অ্যাডভেঞ্চারেই আমাদের সবার আয়ু কমে আছে। আরও অ্যাডভেঞ্চার দরকার?”

ইমতিয়াজ চাচা বললেন, “কিন্তু সেজন্য আমরা কোরাল রিফটা পেয়েছি।”

যে মানুষটা আমাদের ছবি তোলার কথা বলছিল সে বলল, “কোরাল রিফটার নাম এই দুজনের নামে দিলে কেমন হয়? টুলুমিতি কোরাল রিফ।”

আরেকজন বলল, “বিদেশীরা ঠিক করে উচ্চারণ করবে পারবে না। বলবে টিউলোমিটি খোঁড়াল ড়িফ।”

ইমতিয়াজ চাচা বললেন, “খারাপ কী? ইয়েসোমিটির সাথে একটা মিল থাকবে ক্যালিফোর্নিয়ায় ইয়েসোমিটি, বঙ্গোপসাগরে টিউলোমিটি।”

সবাই হা হা করে হাসল। ইয়েসোমিটি কী আমি জানি না, এখন আর সেটা জিজ্ঞেস করলাম না। বুঝতেই পারছি তারা ঠাট্টা করে বলছে, তবু শুনে আমার ভালোই লাগল। সত্যি সত্যি যদি এই কোরাল রিফটার নাম দিত টুলুমিতি কী মজাই না হতো। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে হয়ত এর ওপর একটা চ্যাপ্টার থাকত। পরীক্ষায় প্রশ্ন আসত, ‘টুলুমিতি কী? ইহা কোথায় অবস্থিত এবং ইহা কীসের জন্য বিখ্যাত?’ ছেলেমেয়েরা লিখত, ‘টুলুমিতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো কোরাল রিফ। টুলু এবং মিতু ইহা আবিষ্কার করিয়াছিলেন বলিয়া তাহাদের নামানুসারে ইহার নাম দেওয়া হয় টুলুমিতি কোরাল রিফ। ইহা বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত।’ ব্যাপারটা কাল্পনিক তারপরেও এটা চিন্তা করে আমার মুখে আনন্দের হাসি আমি থামাতে পারি না।

.

দুপুরে দুটি স্পীডবোট করে বিশাল একটা টিম কোরাল রিফে রওনা দিয়েছে, সেখানে আমি আর মিতিও আছি। জহিরকেও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কিন্তু সে যেতে রাজী হয় নাই। দুটি স্পীডবোটে বেশ কয়েকজন ডাইভার, তাদের মাঝে মামীও আছে, ইমতিয়াজ চাচাও আছেন। অন্য আরও দুজন আছে। এছাড়া আরও নানারকম যন্ত্রপাতি, অনেকগুলো ক্যামেরা।

স্পীডবোট দুটি পাশাপাশি পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে। আমি চাচ্ছিলাম দুটি রেস করুক, দেখা যাক কে আগে যেতে পারে কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের সেরকম ইচ্ছা নাই। মানুষ বড়ো হলেই কেমন জানি লেবদু হয়ে যায়, তাদের ভেতরে কোনো রকম তেজ থাকে না। আমি যদি স্পীডবোটটা চালাতে পারতাম তাহলে এতক্ষণ এটাকে রীতিমতো উড়িয়ে নিয়ে যেতাম।

কোরাল রিফটাতে পৌঁছাতে আমাদের অনেকক্ষণ লাগল, আমি অবাক হয়ে গেলাম যে আমরা এতদূরে ভেসে এসেছিলাম। আমাদের যে খুঁজে পেয়েছিল সেটাই এখন মনে হচ্ছে আমাদের কপাল। পৌঁছানোর পর স্পীডবোট দুটিকে পাশাপাশি থামানো হলো তারপর সবাই কাজ শুরু করে দিল। যারা ছবি তুলবে তারা ক্যামেরা নিয়ে পানির নিচে নেমে গেছে। মনে হয় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছে। আমি আর মিতি অপেক্ষা করছি কখন আমাদের ডাকে। মামী মনে হয় আমাদের সাথে যাবেন। তাই ডাইভার স্যুট পরে অপেক্ষা করছেন। আমি মামীর সিলিন্ডারটা দেখলাম। পিছনে ব্যাকপেকের মতো আছে সেখান থেকে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য একটা টিউব আছে, সেখানে অনেক রকম যন্ত্রপাতি। সুর্কেল করার সময় যেরকম মুখে লাগিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেয় এখানেও সেরকম তবে মর্কেলের মতো এত ঠুনকি মার্কা না, অনেক কায়দার। আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস নেওয়ার এরকম টিউব দুইটা, একটা কালো অন্যটা বেশ লম্বা আর রংটা ক্যাটক্যাটে হলুদ। আমি মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “দুইটা কেন মামী?”

মামী বললেন, “কালোটা প্রাইমারী। এটা ব্যবহার করি। অন্যটা ইমার্জেন্সির জন্য, যদি অন্য কাউকে সাহায্য করতে হয়।”

“অন্য কাউকে?”

“হ্যাঁ। ডাইভারদের সবসময় দুজন করে নামার নিয়ম, একজনের বাতাস যদি শেষ হয়ে যায় তখন এভাবে অন্যজনকে সিগন্যাল দেয়।” মামী গলায় পোচ নেওয়ার মতো করে দেখালেন, “তখন ডাইভার অন্যটা তার পার্টনারকে দেয়।”

“কী আজব!”

“আজব হবে কেন? এগুলো হচ্ছে সেফটি। জীবনে হয়ত কখনোই দরকার হবে না, তবু সবার থাকতে হয়।” মামী হলুদ টিউবটা দেখিয়ে বললেন, “এই ইমার্জেন্সি টিউবটার নাম কী জানিস?”

“কী?”

“অক্টোপাস। শর্টকাটে অক্টো।”

আমি আবার বললাম, “কী আজব!” তারপর মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামী, তুমি একটা জিনিস জানো?”

“কী?”

“অক্টোপাসের প্রত্যেকটা পায়ে একটা করে ব্রেন। সেজন্য সব মিলিয়ে তাদের নয়টা ব্রেন?”

মামী মাথা নাড়লেন, বললেন, “হা জানি। এই জন্য অক্টোপাসের পা কেটে ফেললেও সেই পা যেটা করাছল সেটা করতেই থাকে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, পা কেটে ফেললেও অবশ্য অক্টোপাসের কোনো সমস্যা নাই। সেখানে নতুন পা গজায়।”

“টিকটিকির লেজের মতো?” মামী হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ, টিকটিকির লেজের মতো।”

অক্টোপাস নিয়ে মামী আরও কী একটা বলতে চাচ্ছিলেন ঠিক তখন আমাদের স্পীডবোটের পাশে একজন ডাইভার ভুশ করে ভেসে উঠল। আমি চিনতে পারলাম, যার আমাদের ফটো তোলার কথা সেই মানুষটা। মুখ থেকে টিউবটা খুলে বলল, “টুলু, মিতি ফটো তোলার জন্য রেডি?”

“হ্যাঁ, রেডি।”

“তাহলে পানিতে নেমে আমাকে ফলো করো।”

ডাইভারস গগলসটা চোখের ওপর টেনে নামিয়ে দিয়ে আমি পানিতে নামলাম। আমার পেছনে পেছনে মিতি, সবশেষে মামী। পানিতে নামতেই প্রথমে একটু ঠান্ডায় শরীরটা কেঁপে উঠল কিন্তু সাথে সাথেই শরীরটা অভ্যস্ত হয়ে গেল। ক্যামেরাম্যান আধা ডুবে আধা ভেসে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়, আমরা তার পিছু পিছু যেতে থাকি।

বেশ খানিকদূর যাওয়ার পর ক্যামেরাম্যান থামল। সেখানে চিহ্ন হিসেবে একটা লাইফবয় ভাসছে। ক্যামেরাম্যান বলল, “এটা খুবই সুন্দর স্পট। এখানে পোজ দিতে পারবে না?”

আমি বললাম, “পারব।”

“গুড। তাহলে স্নৰ্কেল লাগিয়ে ডুব দাও, যতটুকু পারো।”

আমরা যেহেতু লাইফ জ্যাকেট পরে আছি তাই ডুব দেওয়া সহজ না তবু আমরা চেষ্টা করলাম, নিচে তাকিয়ে দেখি সত্যি জায়গাটা অসাধারণ। পুরো জায়গাটাতে কোরাল, তাদের শুড়গুলো নড়ছে। মনে হলো অন্য অনেক রকম সামুদ্রিক গাছও আছে, তাদের ভেতরে মাছগুলো ঘুরছে। মাছগুলো নানারকম, কোনোটা ছোটো, কোনোটা বড়ো, বিচিত্র তাদের রং! আমাদের দেখে তাদের কোনো ভয় ডর নেই, একেবারে কাছে এসে ঘুরে যাচ্ছে।

সেখানে আমাদের ক্যামেরাম্যান আমাদের অনেকগুলো ছবি তুলল। সবশেষে অনেকগুলো ছবি তুলল যেখানে আমাদের দুই আঙুল দিয়ে ভি সাইন দেখাতে হলো। ছবি তোলা শেষ হলে আমরা সবাই ভেসে উঠলাম, ক্যামেরাম্যান তখন ডাইভারস গগলস সরিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল যেন আমাদের চেহারা দেখা যায়।

ছবি তোলা শেষ হওয়ার পর ক্যামেরাম্যান বলল, “ভেরি গুড। সুন্দর অনেকগুলো শট হয়েছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “শেষ?”

“হ্যাঁ।”

মামী বললেন, “এদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব?”

“হ্যাঁ। নিয়ে যেতে পারেন।”

মামী আমাদের বললেন, “ঠিক আছে টুলু আর মিতি। চল। এখন ফিরে যাই।”

আমি আসলে মোটেও ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম না। আরও কিছুক্ষণ জায়গাটা ঘুরে দেখতে চাচ্ছিলাম। আমি খুবই মুখ কাচুমাচু করে বললাম, “মামী, আরও কিছুক্ষণ থাকি? প্লিজ।”

মামী বললেন, “উঁহু। আমার অনেক কাজ, শুধু তোদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তোদের সাথে আছি। চল।”

“প্লিজ মামী। অল্প একটু সময় থাকি?”

“কতক্ষণ?”

“মনে করো এক ঘণ্টা।”

মামী বললেন, “পাঁচ মিনিট।”

আমি বললাম, “আধঘণ্টা।”

মামী বললেন, “দশ মিনিট।”

আমি বললাম, “পনেরো মিনিট।”

মামী বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু তার এক সেকেন্ড বেশী না। এই যে আমার ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করলাম।”

মামী তার হাতে লাগানো বিশাল একটা ঘড়িতে কীভাবে জানি অ্যালার্ম দিয়ে দিলেন। আমি তখনো জানতাম না এই পনেরো মিনিটের ভেতরে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটি হবে।

.

আমি আর মিতি ভেসে ভেসে যাচ্ছি। মিতি একটু সামনে আমি ঠিক তার পেছনে। মামী আমাদের দুজনের পেছনে, তার পুরো শরীর পানির নিচে, আমাদের মতো অর্ধেক ভেসে অর্ধেক ডুবে নয়। জায়গাটা যত না সুন্দর তার থেকে বেশী বিচিত্র, আমি জন্মেও ভাবি নাই এরকম জায়গা থাকা সম্ভব। সবচেয়ে আজব হচ্ছে মাছগুলো, সাতরে একেবারে আমাদের কাছে চলে আসে, হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলে তখন সরে যায়, মনে হয় একটু বিরক্ত হয়।

আমি আশেপাশে সবকিছু দেখতে দেখতে যাচ্ছি, কোথাও কোথাও কোরাল রিফ দেওয়ালের মতো উঠে গেছে, তার মাঝে অনেক ফাঁকফোকর। সেগুলোর ভেতরেও নানা কিছু নড়ছে, পানির সাথে দুলছে। আমি সেরকম একটা ফাটলের ভেতর তাকালাম, আমার স্পষ্ট মনে হলো ভেতর থেকে একজন আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চর্য সেই দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। আমার ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল, কিন্তু আমার সামনে মিতি পেছনে মামী তাই আমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই, তাই যেটুকু ভয় হলো কৌতূহল হলো আরও বেশী। আমি তাই আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য কাছে গেলাম, চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। এটা কার চোখ।

ঠিক তখন একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল, ফাটলটার ভেতর থেকে কী যেন একটা বের হয়ে আমাকে প্যাচিয়ে ফেলল। আমাকে টেনে পানির নিচে নামিয়ে আনে এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা অক্টোপাসের কিলবিলে পা আমার হাত আর পা’কে প্যাচিয়ে ধরে টেনে নিচ্ছে।

পানির নিচে চিৎকার করা যায় না। কিন্তু মুখ থেকে স্নর্কেল খুলে গলায় পানি ঢুকে গেছে। আমি প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারি না। সবাই বলেছে অক্টোপাস খুব নিরীহ, এরা মানুষ থেকে দূরে থাকে কিন্তু এটা মোটেই নিরীহ না, এটা আমাকে ছাড়বে না, টেনে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে।

আমার হুটোপুটির জন্য প্রথমে মিতি তারপর মামী আমাকে দেখতে পেলেন। মিতি আমার কাছে আসতে চাচ্ছিল, মামী তাকে ধাক্কা দিয়ে পানির ওপরে ঠেলে আমার কাছে এসে আমাকে ধরলেন। আমি তখন পানির নিচে এবং নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। শ্বাস নেওয়ার জন্য আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে উপরে উঠতে চেষ্টা করছি কিন্তু অক্টোপাসটা আমাকে উঠতে দিচ্ছে না। মামী সাথে সাথে আমার অবস্থাটা বুঝে গেলেন এবং আমাকে অক্টোপাসের কবল থেকে মুক্ত করে উপরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হলো না, কারণ অক্টোপাসের অনেকগুলো পা, কয়েকটা পা দিয়ে সে কোনো একটা জায়গা ধরে রেখেছে এবং কয়েকটা পা দিয়ে আমাকে ধরেছে। এখনো এক দুটি পা মুক্ত সেগুলো দিয়ে মামীর হাত কিংবা পা ধরার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে অক্টোপাসটা পুরো অবস্থাটা খুব ভালো করে জানে এবং কী করতে হবে সেটা খুব চিন্তাভাবনা করেই করছে।

মামী আরও একবার আমাকে ছোটানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। আমি স্পষ্ট টের পেলাম অক্টোপাসটা আমাকে আরও শক্ত করে প্যাচিয়ে ধরেছে, এটাকে যেরকম নরম কিলবিলে মনে হয়, এটা মোটেও সেরকম নয়। এটা দড়ির মতো শক্ত। আমি হঠাৎ করে একটা অবিশ্বাস্য আতঙ্ক অনুভব করলাম। একটুখানি বাতাসের জন্য আমার বুকটা আকুলি বিকুলি করতে লাগল, মনে হলো বুকটা বুঝি বাতাসের অভাবে ফেটে যাবে। আমি অসহায়ভাবে মামীর দিকে তাকালাম।

মামীর চোখে বিন্দুমাত্র আতঙ্ক নাই, মামী একেবারে পাথর মতো শান্ত, এতটুকু তাড়াহুড়া করলেন না। পেছন থেকে তার ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের টিউবটা বের করলেন, একটু আগে মামী আমাদের যেটা দেখিয়ে বলেছিলেন, তার নাম অক্টোপাস। মামী খুবই শান্তভাবে আমাকে সেটা দেখিয়ে মাথা নাড়লেন। আমি সাথে সাথে বুঝে গেলাম মামী এখন আমাকে এটা দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়াবেন। আমি মাথা নাড়লাম।

মামী নিজের মুখ থেকে তার টিউবটা খুলে হলুদ টিউবটা মুখে দিয়ে কিছু একটা করলেন মনে হলো ভেতরের পানিটুকু বের করলেন–তারপর সেটা আমার মুখে ঠেসে ধরলেন। আমি দাঁত দিয়ে কামড়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার বুকভরে বাতাস এলো। একবার। দুইবার। তারপর আরেকবার একটা বিশাল শ্বাস! আহা কী শান্তি! আমি তাহলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে পানির নিচে মরে যাব না? বেঁচে যাব?

মামী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি শ্বাস নিতে পেরেছি সেটা দেখে নিশ্চিন্ত হলেন, নিজের বুড়ো আঙুলটা তুলে আমাকে অভয় দিলেন আমার হাত দুটি অক্টোপাস পা দিয়ে প্যাচিয়ে রেখেছে, আমি তার ভেতরেই আমার বুড়ো আঙুল তুলে প্রত্যুত্তর দিলাম, বুঝিয়ে দিলাম আমি এখন ঠিক আছি। এখন ঠান্ডা মাথায় এখান থেকে মুক্ত হতে হবে।

মামী এখন অক্টোপাসটার দিকে নজর দিলেন হাত দিয়ে তার পাগুলো সরাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হলো না একটা সরাতেই অন্য পা দিয়ে প্যাচিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে পা বাড়িয়ে মামীকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে।

আমার ডেঞ্জারাস মামী তখন তার কোমর থেকে তার মারাত্মক ছোরাটা খুলে নিলেন তারপর কিছু বোঝার আগে সেটা অক্টোপাসটার চোখে ঢুকিয়ে দিলেন।

অক্টোপাসটার থলথলে শরীরটা কেঁপে উঠল, কুচকুচে কালো একধরনের রঙে জায়গাটা ভরে গেল। মামী এতটুকু বিচলিত হলেন না, ছোরাটা টেনে বের করে যে পাটা আমাকে ধরে রেখেছে তার গোড়ায় ঢুকিয়ে দিলেন। পাটা নড়ে উঠল–আমি আবার খুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম।

অক্টোপাসটা এবারে মামীকে ধরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল, তার পাগুলো মামীকে প্যাচিয়ে ফেলার জন্য কিলবিল করে এগিয়ে আসে। মামী সুযোগ দিলেন না–তার ধারালো ছোরা দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। এভাবে কতক্ষণ চলেছে জানি না, আমি সারাক্ষণ নিজেকে ছুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, একসময় ডান হাতটা ছুটিয়ে নিতে পারলাম–তখন ডান হাত দিয়ে অনেক কষ্টে বাম হাতটাও ছুটিয়ে নিলাম।

হঠাৎ অক্টোপাসটার কী হলো জানি না, সেটা আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর বিচিত্রভাবে পেছন দিকে পানি ছিটিয়ে পিছনে সরে যেতে শুরু করল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এটা চলে যাচ্ছে। কালো একধরনের তরল পদার্থে জায়গাটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায়, তার ভেতরে এটা কোথায় গেল আমি জানি না।

মামী আমাকে ধরে টেনে পানির ওপরে নিয়ে এলেন। আমি ওপরের বাতাসে ভেসে উঠে মুখের টিউবটা খুলে সত্যিকার বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম। মিতি আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে ধরল। তার চোখে মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক।

মামী জিজ্ঞেস করলেন, “বোটে যেতে পারবি?”

বললাম, “পারব মামী।”

“আয় তাহলে।”

আমরা বোটের দিকে রওনা দিলাম। মামী আমার আর মিতির খুব কাছাকাছি থাকলেন। বোর্টের ওপর একজন দাঁড়িয়ে ছিল, মামী হাত দিয়ে তাকে কোনো একধরনের সংকেত দিলেন সাথে সাথে মানুষটা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। কাছে আসার পর আমি চিনতে পারলাম, ইমতিয়াজ চাচা।

জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

“বলছি। আগে এদের বোটে তুলল।”

আমাদেরকে বোটে তোলা হলো। আমি বোটে হেলান দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকি। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কী হয়েছে। আমার হাতে পায়ে গোল গোল দাগ, অক্টোপাসের চুষণী থেকে এসেছে।

ইমতিয়াজ চাচা অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”

মামী বললেন, “তুমি বিশ্বাস করবে না। একটা রাক্ষুসে অক্টোপাস টুলুকে আক্রমণ করেছিল। অনেক কষ্টে ছুটিয়ে এনেছি। এই এলাকায় এত বড়ো অক্টোপাস কোথা থেকে এসেছে? অবিশ্বাস্য!”

ইমতিয়াজ চাচা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। মামী বললেন, “শুধু যে সাইজে বড়ো তা না, ভয়ংকর হিংস্র। মনে হলো আমাদের ওপর অসম্ভব রাগ। এই প্রথম আমি একটা অক্টোপাস দেখলাম যেটা মানুষ দেখে সরে যায় না।”

ইমতিয়াজ চাচা খুব আস্তে আস্তে বললেন, “ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আমিও লক্ষ করেছি এখানকার সব প্রাণীগুলো অন্যরকম, সবকিছুই রাক্ষুসে। একটা মান্টা রে, মনে হয় একটা জাহাজের মতো বড়ো।”

মামী বললেন, “ডক্টর সারোয়ার গবেষণা করার জন্য নতুন কিছু খুঁজছিলেন। মনে হয় এর থেকে বড়ো গবেষণা সহজে পাবেন না।”

ইমতিয়াজ চাচা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমিও কারণটা জানতে চাই।”

মামী বললেন, “গবেষণার অনেক সময় পাবে। এখন পুরো টিমকে খবর পাঠাও, সবাই যেন ফিরে আসে।

ইমতিয়াজ চাচা আমার দিকে তাকালেন, “তোমার কেমন লাগছে?”

আমি বললাম, “ভালো।” যদিও কেমন জানি ক্লান্তি লাগছিল। মনে হচ্ছিল শুয়ে পড়ি।

ইমতিয়াজ চাচা বললেন, “টুলুকে জাহাজে নিয়ে যাই। একটু চেক আপ করে নেওয়া ভালো।”

“হ্যাঁ। আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি টিমকে সাবধান করো।”

মামী আমার দিকে তাকালেন। এই প্রথমবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, বললেন, “তুই দেখেছিস, তোকে যেখানে নিই সেখানেই সমস্যা?”

আমিও হাসলাম, বললাম, “ঠিকই বলেছ মামী। আমি হচ্ছি কুফা।”

মামী আমার মাথার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর মতো এক দুইজন কুফা মানুষ না থাকলে জীবনটা পানসে হয়ে যায়!”

মামী স্পীডবোট চালিয়ে আমাদের জাহাজে ফিরিয়ে আনলেন। ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, কোনো সমস্যা নাই। আমি অবশ্যি পুরো রাত মড়ার মতো ঘুমালাম।

.

দুদিন পর আমরা সমুদ্র ভ্রমণ শেষ করে শুকনো মাটিতে ফিরে এসেছি।

.

শেষ কথা

আমরা স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। মিতিদের ট্রেনটা চলে এসেছে আমাদেরটা এখনো আসে নাই।

মিতির মা মিতিকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন। মিতি জানালার কাছে বসেছে। আমি প্লাটফর্মে মিতির কাছে দাঁড়িয়ে আছি। কেমন যেন মন খারাপ লাগছে। মিতি মুখটা হাসি হাসি করে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তারও একটু মন খারাপ।

সে তার বুক থেকে নোট বইটা বের করে সেখানে কুট কুট করে লিখল, ‘তুমি যখন তোমার কথা বলা বন্ধুদের কাছে যাবে তখন আমার কথা ভুলে যাবে। তাই না?

আমি মাথা নাড়লাম, আশেপাশে অনেক মানুষ তাই কথা বলতে অস্বস্তি হলো। তার নোট বইয়ে লিখলাম, “কক্ষনো না। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

লিখতে গিয়ে নিশ্চয়ই দুই চারটা বানান ভুল হলো কিন্তু আমি মাথা ঘামালাম না।

মিতি লিখল, ‘আমি তো ফোনে কথা বলতে পারি না। তুমি আমাকে চিঠি লিখবে?’ নোট বইটা আমার হাতে দিতে গিয়ে থেমে গেল, শেষে লিখল, লম্বা চিঠি?

আমি লিখলাম, ‘কিন্তু আমার যে খালি বানান ভুল হয়। তুমি হাসবে।’

মিতি লিখল, ‘আমি হাসতে চাই।’ তারপর লম্বা করে লিখল, ‘প্লি ই ই ই জ।’

আমি লিখলাম, ‘ঠিক আছে।’

মিতি তখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, আর আমার বুকের ভেতর কেমন জানি নড়েচড়ে গেল।

তখন গার্ড বাঁশী বাজিয়ে হাতের সবুজ ফ্ল্যাগটা নাড়াতে থাকে। ট্রেনটা হুইসেল দিয়ে নড়তে শুরু করে। আমি ট্রেনের সাথে সাথে হাঁটছি। খুব ইচ্ছা করছিল মিতিকে একটু ছুঁই, কিন্তু লজ্জা লাগল। মিতি তখন জানালা দিয়ে তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়, আমি তার হাতটা ধরলাম। সেও ধরল, যারা মুখে কথা বলতে পারে না তারা নিশ্চয়ই চোখ দিয়ে অনেক কথা বলতে পারে। আমি মুখেও গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, চোখ দিয়েও পারি না। তাই শুধু তাকিয়ে রইলাম। বেশীক্ষণ তাকিয়েও থাকতে পারলাম না, চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল।

একসময় আমি হাতটা ছেড়ে দিয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে গেলাম। ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। মিতি এখনো জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে ট্রেনটা দূরে চলে গেল–মিতিকে আর দেখা যাচ্ছে না। ট্রেনটা ঝাপসা হয়ে গেছে নাকি আমার চোখ?

আমি প্লাটফর্মের দিকে তাকালাম। মামী তার বিশাল ব্যাকপেকের ওপর বসে আছেন। তাকে ঘিরে বেশকিছু মানুষ। মামী একজন ঝালমুড়িওয়ালার সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো গল্প করছেন। আমি জানি চোখের কোনা দিয়ে আমাকে লক্ষ করছেন।

আমি সাবধানে চোখের কোনা মুছে ফেললাম। খোদা মনে হয় মানুষকে ঠিক করে তৈরি করে নাই।

.

একজনের ভেতর এত মায়া দিলে সে বেঁচে থাকবে কেমন করে?

——-

1 Comment
Collapse Comments
দেলোয়ার September 19, 2022 at 7:19 pm

অসাধারণ বই, অসাধারণ লেখক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *