১২০.
যাঁরা প্রাচীন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন এবং করেছেন, তাদের ওপর আমাদের বিপুল শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও জানাই যে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু অভিযোগ আছে। বিশেষত যাঁরা কৃষ্ণচরিত্রের ওপর গবেষণা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে। আমরা ভেবে অবাক হই–দ্বারকাবাসী তথা মহাভারতীয় কৃষ্ণের ক্ষমতা, আড়ম্বর আর মর্যাদা দেখে গবেষকরা প্রমাণ করে দিলেন যে, এই কৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল ব্রজবালক কৃষ্ণকে কখনই মেলানো যায় না। তার মধ্যে আবার যদি ব্ৰজযুবতীদের উপস্থাপনা ঘটে, তবে তো সেই রমণী-মোহন মধুর কৃষ্ণের সঙ্গে মহাভারতীয় ঐশ্বর্যশালী কৃষ্ণের কোনও মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্তত গবেষকের গো-ধরা আত্মপ্রমোদিনী গবেষণায় এই মিল প্রায় অসম্ভব। আমাদের অবাক লাগে–আমরা এমন অনেক তুখোড় রাজনীতিবিদ, মহান শিক্ষাবিদ, এমনকি অনেক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকেও চিনি, যাঁরা পূর্ব জীবনে রমণীকুলের পরম আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। একাধিক রমণীর সঙ্গে তাদের অপার যৌবন-বিলাস তথা যৌবন-স্বার্থকতার ঘটনাও আমাদের শ্রুতিগোচর হয়েছে। তাহলে কি বলতে হবে–সেই রমণীসঙ্গকার যুবক ব্যক্তিটি পরবর্তীকালের ধুরন্ধর, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ কিংবা সন্ন্যাসীটি থেকে আলাদা কোনও ব্যক্তি বিভিন্ন বয়সে তাদের সত্তা পৃথক হতে পারে কিন্তু তাতে তাদের ব্যক্তিত্বের অভিধান পালটাবে কি?
এই কথাটা মনে রাখা দরকার যে কৃষ্ণ-জীবনের বেশিরভাগ ঘটনারই উপাদান হল প্রাচীন সাহিত্য। শিলালিপিতে খোদাই করা জাদুকরী ভাষা নেই, দ্বারকার টাকশাল থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণের নামাঙ্কিত কোনও মুদ্রা নেই, নেই তাম্রশাসন বা দানপত্র। কৃষ্ণের জীবন-প্রমাণ যা আছে, তা সবই সাহিত্যে। সেখানে এক সাহিত্যে তাঁর উত্তর জীবনের ঘটনাবলীর প্রমাণ পেয়ে তাকে ঐতিহাসিকতায় মণ্ডিত করব, আর পূর্বজীবনের ঘটনাবলী যেখানে আছে, সেই সাহিত্য মহাভারতের সামান্য পরবর্তী বলে তাকে উপন্যাস বলব–গবেষকদের এমন দৃপ্ত ঘোষণা না থাকাই ভাল ছিল।
নিজেদের যাঁরা ঐতিহাসিক বলে জাহির করেন, তারা একবার ভেবে দেখলেন না যে, প্রাচীন পৌরাণিকদেরও ঐতিহাসিক ভাবা যায় কিনা। হতে পারে, রাজবংশের ইতিহাস বলতে গিয়ে তারা কিছু কাব্য করে ফেলেছেন। কিছু অতিশয়োক্তি বা অলৌকিকতাও তাঁদের রচনায় থাকতে পারে। কিন্তু এটাও তো ভাবতে হবে যে, তারা পুরাণ রচনার সময় প্রতিজ্ঞা করছেন যে–আমরা বংশ, প্রতিবংশ এবং মন্বন্তরের ইতিহাস বলব। হেরোডাটাস বা এইরকম মানের ঐতিহাসিক যাঁরা, তাদের মুখের লোকশ্রুত বিবরণও আমাদের কাছে ইতিহাস, আর পৌরাণিকরা একটু গপ্পো বলতে ভালবাসেন বলে তাদের উপাখ্যানের অন্তরে কোনও ইতিহাস নেই, একথা বলা নিতান্তই আহম্মকি।
এটা ভাবতেই হবে যে, সেই প্রাচীনকালে তাদের মতো করেই এক পৃথক ইতিহাস-বোধ পৌরাণিকদেরও ছিল। গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করেই একটা নিয়ম-বিধি তারাও মেনে চলতেন। যে ঘটনা এক পুরাণে বিবৃত হয়েছে সবিস্তারে, সে ঘটনার উল্লেখ অন্য পুরাণেও করা হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে। বিখ্যাত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা পুরাণকারের অভ্যাস, কিন্তু যে সব ঘটনা পৃথক এবং সবিস্তারে বলা প্রয়োজন, তার জন্য প্রথমেই প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করে কথা আরম্ভ করতেন পৌরাণিকরা। আপনারা হরিবংশের প্রসঙ্গেই দেখুন কুলপতি শৌনক পুরাণজ্ঞ কথক ঠাকুর, সৌতির উদ্দেশে বলছেন–মুনিবর! আপনি আমাদের মহাভারতের অমৃত-কথা শুনিয়েছেন। আপনি সেখানে সবিস্তারে জানিয়েছেন–কী করে কুরুবংশের প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু আপনি আমাদের বৃষ্ণি-অন্ধকদের কথা একটুও শোনাননি। এখন অন্তত সেই বৃষ্ণি-অন্ধকদের কথা আমাদের শোনান–ন তু বৃষ্ণন্ধকানাঞ্চ তদ্ভবা বক্তৃহসি।
এই পৃথক জিজ্ঞাসাটাই এখানে বড় জরুরী। সারা মহাভারত জুড়ে কৌরব-পাণ্ডবদের ক্রমিক প্রতিষ্ঠার খবর আমরা পেয়েছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠার অন্তরালে যে সূত্রধার মহাভারতের সমস্ত ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন সেই কৃষ্ণের কথা আমরা যাই শুনে থাকি, তার কোনও পরম্পরা নেই। তাঁর বাল্যকাল নেই, কৈশোরগন্ধী বয়সের কথা নেই, নেই যৌবনের প্রথম অভিসন্ধির কথা। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর ক্রমিক প্রতিষ্ঠার প্রথম ইতিহাসটুকুও একেবারেই নেই। কিন্তু সেটা তো শুনতে হবে। সেই শোনার তাগিদে তার কৈশোর-যৌবনের প্রথম কীর্তিকলাপের কাহিনী আমরা খানিকটা শুনিয়েছি, কিন্তু তারপরেই খানিকটা স্তব্ধ হয়ে ভণিতা আরম্ভ করেছি–কেননা, ইন্দ্ৰযজ্ঞ বন্ধ হয়ে যাবার পর আমাদের অপ্রতিম নায়ক এখন সামান্য অবসর পেয়েছেন এবং সেই অবসরে তার মনে পড়ছে বৃন্দাবনের কতগুলি রমণীর কথা, যাঁরা গোপিনী, আহিরিণী বলে পরিচিত।
গোপীদের কথায় মহামতি বঙ্কিমচন্দ্রের কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার প্রমাণ কৃষ্ণচরিত্রের পাতায় পাতায় আছে। তিনি বিবাহিতা স্ত্রীদেরই স্বীকার করেন না, তো তথাকথিতভাবে নিন্দিত গোপীপ্রেম! তবে বঙ্কিম যে কৃষ্ণজীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়টি বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের দর্শন-মনন এবং রসশাস্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তা যে ঠিক হয়নি তার জন্য বেশি তর্ক করতে চাই না এখানে। তবে জানবেন তর্কের জন্য প্রস্তুত আছি। এই অন্যায় যে কতটা তার প্রমাণ হিসেবে আমরা আরেক মহামান্য জনের সামান্য বক্তৃতার অংশ তুলে দিই খানিকটা। তিনি সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ম্যাড্রাসের এক জনসভায় বঙ্কিমকে কটাক্ষ করে তিনি লিখেছেন
গোপীপ্রেম দ্বারাই সগুণ ও নিষ্ঠুণ ঈশ্বরের সম্বন্ধে বিরোধের একমাত্র মীমাংসা হইয়াছে। কৃষ্ণ অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেওয়া এমনকি দর্শনশাস্ত্র-শিরোমণি গীতা পর্যন্ত সেই অপূর্ব প্রেমোন্মত্ততার সহিত তুলনায় দাঁড়াইতে পারে না। আমাদেরই স্বজাতি এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নির্বোধ আছে যাহারা গোপীপ্রেমের নাম শুনিলেই উহা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভাবিয়া ভয়ে দশ হাত পিছাইয়া যায়।… ভারতে এখন অনেকের মধ্যে একটা চেষ্টা দেখা যায় সেটা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা—কৃষ্ণ গোপীদের সাহত প্রেম করিয়াছেন, এটা সাহেবরা পছন্দ করেন না। তবে আর কি, গোপীদের যমুনার জলে ভাসাইয়া দাও। সাহেবদের অনুমোদিত না হইলে কৃষ্ণ টেকেন কি করিয়া? কখনই টিকিতে পারেন না। …মহাভারতের দু-একটা হল ছাড়া–সেগুলিও বড় উল্লেখযোগ্য স্থল নহে–গোপীদের প্রসঙ্গ নাই। দ্রৌপদীর স্তবের মধ্যে এবং শিশুপালের বক্তৃতায় বৃন্দাবনের কথা ছে মাত্র। এগুলি সব প্রক্ষিপ্ত। সাহেবরা যা চায় না সব উড়াইয়া দিতে হইবে। গোপীদের কথা, এমনকি কৃষ্ণের কথা পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত!
আমরা বিবেকানন্দের হতাশা আন্দাজ করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি–কৃষ্ণের এই জীবন দার্শনিকদের দার্শনিকতা পুষ্ট করে, সগুন-নির্গুণ ব্রহ্মের বিরোধ মীমাংসা করে। কিন্তু আমরা দার্শনিক নই, আমরা দর্শনের চেয়েও আপাতত ইতিহাসের প্রমাণে বিশ্বাসী। কৃষ্ণজীবনের সমস্ত ঘটনাই যেহেতু সাহিত্যের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, তাই আগে আমাদের বুঝে নিতে হবে যে, খ্রিস্টীয় শতকগুলির আরম্ভে এবং আগে-পরে কৃষ্ণের সঙ্গে গোপরমণীদের কোনও সম্বন্ধ নথিবদ্ধ হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তবে তা কৃষ্ণ-গোপীর যুগল-সম্বন্ধের ঐতিহাসিকতারও প্রমাণ হতে পারে–অথবা লোকপ্রিয়তারও প্রমাণ হতে পারে। ঐতিহাসিকতার প্রমাণ বলে মানলে আমাদের কোনও বিপদ থাকে না, আর যদি সেসব কথাকে লোকপ্রিয়তার প্রমাণ বলেই মানেন, তাহলে বলতে হবে–মানুষটিই যদি কাল্পনিক হন, গোপীরাও যদি সব কল্পলোকের নায়িকা হন, তবে এই সব কাহিনীর এত লোকপ্রিয়তা সম্ভব হয় কী করে? অতএব আমাদের মতে কৃষ্ণ-জীবনের এই অংশের লোকপ্রিয়তাই তার ঐতিহাসিকতারও প্রমাণ।
হরিবংশ এবং পুরাণগুলি তো কৃষ্ণজীবনের প্রথমাংশের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করবেই কিন্তু তার আগে আমরা সাতবাহনরাজ হালের কথা বলব। সাতবাহন হাল তার অনবদ্য প্রাকৃত কাব্য গাহাসত্তসঈর মধ্যে অন্তত চারটি লিরিক লিখেছেন যার মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যকাল এবং যৌবনের তিনটি ঘটনার উল্লেখ আছে এবং এই শ্লোকগুলি কোনওভাবেই প্রক্ষিপ্তবাদের আওতায় পড়ে না। হালের সময় খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫ শতক থেকে খ্রিস্টিয় ২২৫ শতকের মধ্যে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। সময়টা একেবারে নির্দিষ্ট না হলেও যথেষ্ট প্রাচীন। তার ওপরে কথা হল গাহাসত্তসঈর শ্লোকগুলি সবই হালের লেখা নয়, তার সংগৃহীত। হয়তো এই সংগৃহীত শ্লোক আরও প্রাচীনকালে লেখা। যাইহোক আসল কথায় আসি। একটি শ্লোকে দেখছি–স্নেহাতুরা জননী যশোমতী সামনে দাঁড়ানো ব্রজরমণীদের কথার জবাবে বলছেন–আমার দামোদর কৃষ্ণ এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু–অজ্জ বি বালো দামোদরেত্তি। কথাটা শুনে নাকি সামনে উপস্থিত ব্রজরমণীরা কৃষ্ণের দিকে একবার তেরচা করে চেয়ে নিজেরা মুখ লুকিয়ে হেসেছিল।
এই তেরচা করে তাকানো এবং মুখ লুকিয়ে হাসার মধ্যে যে অসাধারণ ব্যঞ্জনা আছে, তা প্রকাশ করলে দাঁড়ায় সেই সময়ে ব্রজরমণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সরস অভিসন্ধিগুলি আরম্ভ হয়ে গেছে ভালভাবেই। স্নেহময়ী যশোমতী সে সব যৌবনের অভিসন্ধিগুলি মাথায় না রেখে এখনও কৃষ্ণকে বালক ভাবেন বলেই যুবতীদের চাউনি এবং হাসির খোরাক জুটেছে। এই শ্লোকের মধ্যে কৃষ্ণের জীবনে গোপিনীদের সরস উপস্থিতি সালংকারে ঘোষিত হয়েছে এবং এই শ্লোকের প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী তা বোঝা যাবে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে এসে। ভেবে দেখুন কত কাল পার হয়ে গেছে তবু চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী হাল-সংকলিত ওই শ্লোকের মাধুর্য ভুলতে পারেননি। শ্রীরূপের লেখা বিদগ্ধমাধব নাটকের একটি সংলাপে দেখছি–কৃষ্ণ সখাদের নিয়ে কেবলই গোরু চরিয়ে ফিরেছেন। যশোদা তাকে আদর যত্ন করছেন, এমন সময় গোপরাজ নন্দ তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন–গিন্নি! এই গোকুল বৃন্দাবনে এমন একটি মেয়ে কি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে কৃষ্ণকে বেশ মানাবে। তাহলে এবার আমি ছেলেটার বিয়ে দিতে পারি–যামুহামো বৎসম। যশোদা স্বামীর কথায় কোন গা না করেই প্রায় যুবক কৃষ্ণকে আদর করতে করতে রায় দিলেন–বাছা আমার এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু, ওর এখনই বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি–অঞ্জ দুগ্ধমুক বৎসল্স কো খু দানীং উব্বাহে ওসরো।
নন্দ-যশোদার এই উক্তি-প্রত্যুক্তির সাক্ষী হিসেবে এখানে ব্রজরমণীরা নেই বটে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রাণপ্রিয় সখা, যিনি কৃষ্ণের তাল-মোল বনের সরসতার সাক্ষী, সেই মধুমঙ্গল দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। তিনি যশোদার কথায় একটু ফুট না কেটে পারলেন না। বললেন–ভাই কৃষ্ণ তুমি সত্যিই দুগ্ধমুখ বালক, যে দুধের লোভে ওই গোপকিশোরীরা তোমার মুখ-চুম্বন করে বারবার।
যশোদা নিশ্চয়ই কথাটা শুনতে পাননি, কিন্তু এই সংগুপ্ত সংলাপের মধ্যে সাতবাহন হালের ছায়া আছে বটে! অজানা অচেনা অনামিকা পোপকিশোরীদের কথা রাখুন, গোপিনী-সংক্রান্ত দ্বিতীয় শ্লোকে হাল একেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি রাধার নাম করে অদ্ভুত সুন্দর একটি লিরিকের জন্ম দিয়েছেন। কবির ভাষায়–কৃষ্ণ! তুমি যখন ফুঁ দিয়ে রাধার চোখে–পড়া ধুলি কণাটি উড়িয়ে দিতে চাইছিলে তখন অন্য ব্রজবধূদের গর্ব একেবারে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল–মুহ-মারুণ তং কণহ গো-রঅং রাহিআত্র অবণেন্তো।
এই শ্লোক নাকি পোট্টিস বলে এক কবির লেখা। হাল তা সর্বসমক্ষে প্রকট করেছেন মাত্র। সুপ্রাচীন এই শ্লোকের ভাব-ব্যঞ্জনা বুঝতে হলে পাঠককে অন্য সাহিত্যের বর্ণনা বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে ভাগবত পুরাণের অমানুষী ভাষায়। ভাগবতে রাস-পঞ্চাধ্যায়ীর মধ্যে একত্র দেখা যাবে কৃষ্ণ গোরমণীদের সঙ্গে রাস নৃত্যে মেতে উঠেছেন এবং সমস্ত গোপরমণীরই মনে হচ্ছে যেন কৃষ্ণ তাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করছেন। এই সম্মিলিত রমণীকুলের মধ্যে একজন আছেন, যাঁর এই ব্যবহার পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণ সেটা বুঝলেন খুব ভালভাবে। সেই বিশেষ রমণীকে বেশি মর্যাদা দেবার জন্য এবং অপরা গোপিনীদের গর্ব খর্ব করার জন্য কৃষ্ণ সেই বিশেষ রমণী রত্নকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে রাসমঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন–প্রশমায় প্রসাদায় তত্রৈবান্তরধীয়ত।
ভাগবত-পুরাণের মহাকবি এই ভাগ্যবতী রমণীটির নাম করেননি, কিন্তু তাকে একাকিনী প্রসন্ন করার মাধুর্য এবং অন্যান্য রমণীদের গর্বনাশ করার মধ্যে পোট্টিস নামে সেই অখ্যাত লোক-কবির অন্তর-ছায়া ভেসে এসেছে। অতএব এই শত গোপরমণীদেরই বা আমরা অস্বীকার করি কী করে, কী করেই বা অস্বীকার করি শ্যাম-মনোমোহিনী রাই কিশোরীকে। মহাভারতের যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পালা চলছে, তখন নাকি তিনি আপন লজ্জা বাঁচাতে কৃষ্ণকে স্মরণ করে অনেক কেঁদেকেটে ডেকেছিলেন–কৃষ্ণ গোপীজনপ্রিয়। পণ্ডিতেরা হই-হই করে জবাব দিয়ে বলেছেন–এ শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। এমনকি সম্পূর্ণ বস্ত্রহরণ-খণ্ডে দূরস্থিত কৃষ্ণকে ভগবান বলে ডাক ছাড়াটাই নাকি দ্রৌপদীর অন্যায় হয়ে গেছে। এমন অলৌকিক আবেশ তার ওপরে চাপানো দ্রৌপদীর মোটেই উচিত হয়নি বলে–ওই সমস্ত ব্যাপারটাই নাকি প্রক্ষিপ্ত।
প্রক্ষিপ্তবাদীদের সঙ্গে আবারও ঝগড়ায় নামতে চাই না। কারণ ওঁদের যুক্তি-তর্ক সবটাই মূলোচ্ছেদী পাণ্ডিত্য। বিপদে পড়লে স্বর্গস্থিত বাপকেও তারা যখন বাপ বলে ডাকেন, তখন আমাদের বলা উচিত–ওরকম বাপের অস্তিত্ব মানি না। সে যাইহোক–বিপন্না দ্রৌপদীর কাছে কৃষ্ণের গোপীজনপ্রিয়তা সত্য হলেও মহাভারতের শুদ্ধতারক্ষী পণ্ডিতবাহিনীর কানে তা পৌঁছয়নি, কিন্তু কোথাকার কোন অনামা কবি পোট্টিস তার একটি মাত্র শ্লোকে কৃষ্ণের সেই গোপীজনপ্রিয়তা এঁকে রেখে দিয়েছেন এবং শুদ্ধিবাদীদের থেকে গ্রাম্য পোট্টিসকে আমরা বেশি মূল্য দিই, কারণ সাতবাহন হাল সেই মূল্য তাকে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, হরিবংশ কিংবা পুরাণগুলি যদি উত্তর ভারতের আর্য প্রকৃতির মানুষের লেখা হয়, তবে তার সাময়িক কালে দক্ষিণ ভারতেও কিন্তু কৃষ্ণ এবং তার আহিরিণী সঙ্গিনীদের নিয়ে কাব্য লেখা হয়েছে। ফ্রিমে হার্ডি নামে এক আধুনিক গবেষক অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা করে দেখিয়েছেন প্রাচীন চঞ্চম সাহিত্যে কীভাবে গোপীজনপ্রিয় কৃষ্ণ একাত্মক হয়ে গেছেন মায়োন বা মায়াবন নামে এক যুবকের সঙ্গে। এ ছাড়া আছে সুপ্রাচীন তামিল গ্রন্থ শিলঞ্চড়িকার। খ্রিস্টীয় দু-এক শতাব্দীর মধ্যে লিখিত এই গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে গোপ আর গোপীরাই এক যুবক-যুবতীকে পূজা উপাসনা করে। এই যুবক-যুবতীর একজন অবশ্যই মায়োন কৃষ্ণ আর যুবতীটি হলেন নপ্পিনাই, যিনি অবশ্যই রাধা। তামিল কবি–একটি রাসনৃত্যের উল্লেখ করেছেন, যার অনুকরণে নৃত্য করতেন মাদুরাই-এর রমণীরা। এই রমণীদের নাচের মডেল হলেন বালিয়োন (বলরাম), মায়োন (কৃষ্ণ) এবং নপ্পিনাই অর্থাৎ রাধা।
এই অনুকৃত রাসনৃত্যের সঙ্গে যে গান আছে, সেই গানের কথা আপনাদের বস্ত্রহরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। গানের শব্দ জানিয়েছে–কেমন করে মায়োন কিশোরী নপ্পিনাই-এর কাপড় আর গয়না চুরি করেছিল আর এই ঘটনায় নগ্না-নপ্পিনাই-এর লজ্জারুণ মুখের কথাটিও গান করে বলে মাদুরাইয়ের রমণীরা। ভাগবতে যাঁরা–হেমন্তে প্রথম মাসি নন্দব্রজ-কুমারিকা স্মরণ করে বস্ত্রহরণের বৃত্তান্ত শুনবেন, তাদের পক্ষে এই নাপ্পিনাই বা গোপাঙ্গনানাঞ্চ দুকূল চৌরং কৃষ্ণকে চিনতে কোনও অসুবিধে হবে না।
সত্যি কথা বলতে কি, একটা কিছু অবশ্যই ঘটেছিল সেই শরৎকালের জ্যোৎস্না-রাতে সেটা ভাগবত–পুরাণেও বর্ণিত সালংকার কোনও রাসনৃত্য নাই হোক, কিন্তু বৃন্দাবন শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই যে সেখানে এক রসরাজ পুরুষের সঙ্গে রসতীর সঙ্গ-রঙ্গ মাথায় আসে, তা তো কালিদাসও প্রমাণ করে দিয়েছেন। ময়ূরপুচ্ছ শোভিত সেই গোপ যুবককে তো তিনি ভালভাবেই চিনতেন–বর্হেণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ–কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের কেলিভূমি বৃন্দাবনকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ–পঞ্চম শতাব্দীতেই তিনি কামনার মোক্ষধাম হিসেবে কল্পনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বৃন্দাবন কোনও সাধারণ ক্ষেত্র নয়; এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই বিশালবুদ্ধি রসিক পুরুষের জীবন।
কালিদাস তাঁর স্বয়ম্বরা নায়িকাকে উপদেশ দিয়ে বলছেন–এই শূরদেশের রাজা সুষেণকেই তুমি বেছে নাও, তারপর ঠিক কুবেরের বাগানের মতো সুন্দর সেই বৃন্দাবনের বনে প্রবেশ করে আপন যৌবন সফল করো–বৃন্দাবনে চৈত্ররথাদনে নির্বিশ্যতাং সুন্দরি যৌবনশ্রীঃ। একই সঙ্গে, একই শ্লোক পংক্তিতে শূরদেশ আর বৃন্দাবনের সহাবস্থান ঘটিয়ে কালিদাস বুঝিয়ে দিলেন যে, সেই প্রাচীন কালে শূরবংশের অধস্তন কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের যৌবন-রসিক কৃষ্ণ পৃথক কোনও ব্যক্তি নন। পুরাণের কবি ও তাঁর রাসরসিক কৃষ্ণকে বর্ণনা করেছেন শৌরি বলে অর্থাৎ শূরদেশের মানুষ বলে, শূরবংশের অধিনায়ক বলে–তাসামাবিরভূচ্ছৌরিঃ স্ময়মান-মুখাম্ভোজঃ। কালিদাসের সুষেণ যদি শূরদেশ থেকে বৃন্দাবনে যেতে পারেন যৌবনের সাফল্য কামনায়, সেখানে মহারাজ শূরের নাতি বসুদেব-পুত্র কৃষ্ণই যে বৃন্দাবনে গোপ রমণীদের সঙ্গে তার যৌবন সফল করেছেন–সে কথা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণ করা যায়।
.
১২১.
আসলে মহাভারতের সমস্ত ক্রিয়াকর্মগুলির মধ্যে কৃষ্ণের এমন একটা ঠমক-গমক আছে, তার প্রত্যেকটি উপস্থিতির পিছনে এমন সব রাজনৈতিক গভীরতা আছে যে, সেই কৃষ্ণ যে কখনও নৃত্য-গীতে মত্ত হতে পারেন, সেই কৃষ্ণ যে কখনও শারদ জ্যোৎস্নায় অভিভূত হতে পারেন, সে যেন ভাবাই যায় না। বিলাসে অনভিজ্ঞ কতগুলি গোপরমণীর রসবত্তায় মহাভারতের সূত্ৰধার সেই বীরপুরুষ যে এমন ভেসে যেতে পারেন, কঠিন-হৃদয় পণ্ডিতজনের ভাবনায়ও তা কখনও আসে না। তার ওপরে আছে ভগবদ্গীতার গাম্ভীর্য। অমন গম্ভীর তত্ত্বকথা যাঁর মুখ দিয়ে বেরতে পারে, তিনি কখনও সরলা রমণীদের সহজ ভালবাসায় ভুলে যাবেন, তা কী করে হবে!
দেখুন, বৃন্দাবন জায়গাটা তখনকার দিনের রাজা-রাজড়ার কাছে যে খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। সেখানকার মানুষজন এবং তাদের সঙ্গে বাস করাটাও যে অভিজাত পুরুষদের কাছে বেশ ঘৃণ্য ছিল সেটাও আমরা মেনে নিতে পারি। মহাভারতের উদাহরণ না হলে তো পণ্ডিতদের চলে না, তাই বলছি মহাভারতেও এমন প্রমাণ আছে যেখানে কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে অবহিত পুরুষের পক্ষে মহান মহাভারতীয় কৃষ্ণের আকস্মিক গৌরব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের শেষে যুধিষ্ঠির যখন কৃষ্ণের উদ্দেশে অর্ঘ্য প্রদান করলেন, তখন প্রবল প্রতাপান্বিত মগধরাজ জরাসন্ধ মারা গেছেন। তার অবর্তমানে কৃষ্ণের পূর্ব-কূটচারিতায় ক্ষুব্ধ শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বজীবনের নীচ-সহবাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে গালাগালি দিয়ে বলেছিলেন–আমাদের মহারাজ জরাসন্ধ এই কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের রাজসম্মান খোয়াতে চাননি। কৃষ্ণ যে দাসদের ঘরের ছেলে, ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা কি আর রাজাধিরাজ জরাসন্ধের পোষায়–যোনেন যুদ্ধং নেয়েষ দাসোয়ম্ ইতি সংযুগে।
কৃষ্ণকে এইভাবে দাস বলে সম্বোধন করার পিছনে শুধুমাত্র শিশুপালের হিংসা কাজ করছে, তা নয়। সামাজিক দিক থেকে চতুর্বর্ণের মধ্যে শূদ্রদের অবস্থান স্বীকৃত হলেও চতুর্থ বর্ণ হিসেবে তাদের সম্মান বড় ছিল না। শূদ্রদের অনেক ক্ষেত্রেই দাস সম্বোধন করাটা অভ্যাসের মধ্যে ছিল এবং গোপালক আভীর-জাতির সম্মান শূদ্রদের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বাবাস জানতেন বলেই তাকে দাস বলে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর ক্রোধ খরতর হয়ে উঠেছিল যখন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম কৃষ্ণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু এই সময়ে প্রতুত্তরে গালাগালি দেবার সময় শিশুপালের মুখে কৃষ্ণের বৃন্দাবনী ঘটনা একটার পর একটা উল্লিখিত হয়েছে। পণ্ডিতজনের তবু বিশ্বাস হয় না আর বিশ্বাস না করার জন্য তাদের চিরাচরিত প্রক্ষিপ্তবাদ তো আছেই।
শিশুপাল বলেছিলেন–কৃষ্ণের প্রশংসা করতে গিয়ে তোমার যে কেন জিভ খসে পড়ছে না, আমি তাই ভেবেই অবাক হচ্ছি। বলি, ছেলেমানুষেরা পর্যন্ত যার নাম শুনলে নিন্দে করবে, সেখানে তুমি একটা বুড়ো মানুষ হয়ে একটা গয়লার প্রশংসা শুরু করেছ–তমিমং জ্ঞানবৃদ্ধঃ সন্ গোপং সংস্তোতুমিচ্ছসি।
একটা কথা মনে রাখুন, শিশুপাল কৃষ্ণের আপন পিসির ছেলে, যে কোনও কারণেই হোক, নিজের উচ্চাশার কারণে তিনি মগধরাজ জরাসন্ধের দক্ষিণ-হস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে সব কথা আমরা পরে বলবও। কিন্তু এটা বোঝা দরকার কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপালের সম্বন্ধ অত্যন্ত নিকট বলেই, তথা তিনি তার ওপরে অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট বলেই কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে তিনি সত্য কথা বলবেন। গোপজাতির মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যকাল কেটেছে, এবং তিনি যে পুতনা-বধ, গোবর্ধন ধারণ ইত্যাদি কর্ম করে গয়লাদের মধ্যে যথেষ্ট নামও কিনেছিলেন এক সময়ে, সে সম্বন্ধেও শিশুপালের সব জানা আছে এবং সে সব ঘটনা সম্বন্ধে তার বক্তব্যও আছে।
শিশুপাল বলেছেন–শুনি নাকি শিশু বয়সে কৃষ্ণ পুতনা নামে একটি শকুনিকে মেরেছিল, তা তাতে আশ্চর্যের কী আছে–যদ্যনেন হতা বাল্যে শকুনিশ্চিমত্র কি? পুরাণগুলিতে পুতনা কোথাও বালক-ঘাতিনী রাক্ষসী, কোথাও কংসের চর, কোথাও বা শকুনি মানে একটি পাখি মাত্র। শিশুপাল কৃষ্ণের বীরত্ব খাটো করার জন্য পুতনাকে একটি পক্ষী-মাত্র বলবেন, তেই বা আশ্চর্যের কী আছে। কংসপ্রেরিত ঘোটকাসুর, কী বৃষভাসুর যত বড় শক্তিশালী মানুষই হোন, শিশুপালের কাছে, তারা ঘোড়া-ষাঁড় ছাড়া কিছু নয়। এমনকি কৃষ্ণের হাতে মারা যাওয়া সেই গাড়ি-দৈত্য শকটাসুরও একটা সামান্য খেলনা-গাড়ি ছাড়া কিছু নয় শিশুপালের কাছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল–পুরাণগুলিতে যে সব ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত এবং যা কৃষ্ণের পুর্বজীবনের ঘটনা, হীনতাসূচকভাবে হলেও আমরা তার উল্লেখ পাচ্ছি মহাভারতে।
গোবর্ধন পাহাড়ে ব্রজবাসীদের আশ্রয় বিধান করে কৃষ্ণ যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন, সে বুদ্ধিটাও শিশুপালের মুখে হয়েছে এইরকম–আরে–উইয়ের ঢিবির মতো গোবর্ধন পাহাড়টা নাকি এ ব্যাটা হপ্তাখানেক মাথার ওপরে তুলে রেখেছিল–বল্মীকমাত্রঃ সপ্তাহং যদ্যনেন ধৃতোচলঃ–তা, এতে আমার আশ্চর্য হবার কিছু নেই বাপু। এমনকি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে গয়লাদের দেওয়া রাশি রাশি খাবার যে খেয়েছিল কৃষ্ণ, তাতে অন্য লোকেরা আশ্চর্য হয় হোক–আমার তাতে কিছু যায় আসে না। সব শেষে বলি–কংসকে নাকি এই কৃষ্ণ মেরেছে শুনি। তাতেও এমন কিছু ভয়ের কথা নেই, সে কথা অদ্ভূতও কিছু নয়–স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতম্।
বস্তুত তখনকার দিনের সর্বাধিনায়ক জরাসন্ধের তুলনায় শিশুপাল কংসকে খুবই ছোট করে দেখলেও আমাদের কোনও ক্ষতি নেই আপাতত। এমনকি কৃষ্ণকে খাটো করলেও আমরা আপাতত শিশুপালের ওপর অসন্তুষ্ট নই। কিন্তু শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে, বিশেষত তাঁর বৃন্দাবন-বাসকালীন ঘটনাগুলি সম্বন্ধে যে কথাগুলি বললেন সেগুলি কোনও-না কোনওভাবে সত্য বলেই পুরাণগুলিতে স্বীকৃত এবং সেগুলি সূত্রাকারে মহাভারতেও উল্লিখিত হল। সূত্রাকারে এইজন্য যে, এখানে বৃষ্ণি-অন্ধকদের কীর্তি-খ্যাতি মূল বর্ণনার বিষয় নয়। পাণ্ডব-কৌরবরাই মহাভারতের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু কৃষ্ণের পূর্ব–জীবনের কাহিনী মহাভারতে কিছুই নেই-নেই বলে যারা ধুয়া তোলেন, সেই সমস্ত পণ্ডিতজনের স্বাত্মপ্রমোদিনী গবেষণায় আমাদের আপত্তি আছে। আপত্তি সেই সব প্রক্ষেপবাদী পণ্ডিতজনের সম্বন্ধেও যাঁরা কম্বলের লোম বাছতে বাছতে মহাভারতের মতো অত্যুষ্ণ কম্বলখানিকেই ঝাঁঝরা করে দিয়েছেন।
পুতনা, অশ্বাসুর, বৃষভাসুর, গোবর্ধন-ধারণ এমনকি গোবর্ধন পাহাড়ে সেই রাশীকৃত অন্নকূটের কথাও যেখানে মহাভারতে উল্লিখিত হল, সেখানে হরিবংশ এবং পুরাণগুলির বিস্তারিত কাহিনীগুলি অবিশ্বাস করি কোন সাহসে! তার ওপরে কৃষ্ণ যে এই সেদিনও গয়লা ব্রজবাসীদের একজন ছিলেন–শিশুপালের ভাষায় সাধারণ গোপমাত্র–এবং সেই অনভিজাত ব্যক্তিটির বিরাট রাজনৈতিক সত্তা মেনে নিতে শিশুপালের যে কষ্ট হচ্ছে–সেই কষ্ট থেকেই আরও প্রমাণিত হয় যে, কৃষ্ণ গোপজনের আপনজন ছিলেন। আর শিশুপালের বক্তব্য মেনে আমরা গোপজনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেব, অথচ গোপী-গোপিনীর অস্তিত্বে সংশয়িত হব, তা তো হয় না। অতএব গোপজনেরা যেমন বৃন্দাবনে আছেন, তেমনই আছেন আহিরিণী গোপিনীরা। তাদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধটাও আমাদের একটু দেখে নিতে হবে।
কিন্তু ওই যে বলেছি, এই গূঢ় সম্বন্ধে প্রবেশ করার আগে সেই সম্বন্ধের যথার্থতার প্রমাণ দিয়ে ভণিতা না করে উপায় নেই। আমরা সে ভণিতা করেওছি খানিকটা কিন্তু আরও কিছু বাকি আছে। আমরা কোনও তত্ত্বগত সিদ্ধান্ত করার আগে আধুনিক মিথলজিস্টদের বক্তব্যটা একটু জানিয়ে দিই। মিথলজিস্টরা বলেন–সৌর বংশলতায় যে সব দেবতার জন্ম হয়েছে, অর্থাৎ যাঁদের আমরা Solar gods বলি–সেই সব দেবতাদের চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল–তারা যেমন মহাবীর হন, তেমনি ভীষণ প্রেমিক হন তারা। বীরের ধর্ম এবং ভালবাসার ধর্ম দুটোই তাঁদের এত ভাল আয়ত্ত যে, পারিপার্শ্বিক জনেরা তথা স্তুতিগায়ক কবিরা তাদের বীরত্ব এবং হিতকারিত্বের নিরিখে তাদের প্রেমটাকে রীতিমতো প্রশ্রয় দেন।
আপনারা মহান গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর কথা স্মরণ করুন। তিনি সৌরকক্ষের দেবতা এবং সূর্যের আপন স্বরূপ। এই অ্যাপোলোর সঙ্গে কৃষ্ণের ভীষণ রকমের মিল। বৈধ এবং বিবাহিত প্রেমের ক্ষেত্রেই হোক, আর তথাকথিত অবৈধ রোমান্সের ঘটনাই হোক গ্রিসদেশীয় অ্যাপোলো যেমন মোহন প্রেমিক, ঠিকই তেমনি আমাদের অখিলরসামৃতমূর্তি কৃষ্ণ। স্বামী-পরায়ণা বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে কৃষ্ণ-প্রেয়সী রুক্মিণীর যেমন নাম, গ্রিক-সূর্যের তেমন স্ত্রী হলেন লুকোথ। আবার কৃষ্ণের যেমন নেই নেই করেও আট-আটটি পাটরানী, অ্যাপোলোর তেমন স্ত্রী আছেন ড্যাফেন অথবা বিওবিস, কীরেনি অথবা করোনিস। আর সেই শারদ রাত্রিতে কৃষ্ণ যখন তার ভালবাসা জানাতে বৃন্দাবনের সুন্দরীদের কথা স্মরণ করলেন, তখন মহামতি হেসিয়ড স্মরণ করলেন আইওনিয়ান যুবক-যুবতীদের কথা-স্মরণ করলেন অ্যালোলোর সঙ্গে মিউজদের মনোহরণ নৃত্যগীতের কথা। রাসনৃত্যের বর্ণনানিপুণ কবি শুকদেবের রাসস্তুতির সঙ্গে হেসিয়ডের নৃত্যস্তুতির পার্থক্য শুধু ভাষার। তিনি লিখেছেন–There the long-robed Ionians gather in your honour with their… shy wives, the girls of Delos, hand-maidens of the Far-shooter, Shall I sing of you as wooer in the fields of love, How you went wooing the daughters of Azan. (Hesiod, Theogony)
উপরিউক্ত স্তুতি পংক্তির মধ্যে যে সমস্ত রমণীর উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে অ্যাপোলোর নৃত্য-গীত বৈধ হয়েছে না অবৈধ হয়েছে, সে তর্কে আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু বৃন্দাবনে যে সমস্ত রমণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সংসর্গ এবং মিলন হয়েছিল, তারা আপাতদৃষ্টিতে পরস্ত্রী হলেও তাদের প্রেম এবং ভালবাসা এমনই উচ্চস্তরে পৌঁছেছে যে তা দর্শন এবং রসশাস্ত্রের বিশেষ বিচারণীয় বিষয় হয়ে পড়েছে।
ওদেশে অ্যাপোলোর যে বীরত্বের, প্রেমের যে নিদর্শন পেলেন আমাদের দেশে সৌরকক্ষের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের মধ্যেও সেই নিদর্শন পাবেন। ঋগবেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণগুলিতে ইন্দ্রের দেবরাজের ভূমিকা তথা বীরের মহিমা যেমন প্রতিষ্ঠিত, তেমনি তার প্রেমের কথাতেও বেদ-পুরাণ ছেয়ে গেছে। শুধু প্রেমই বা বলি কেন, তার চরিত্রে অবৈধ অপপ্রেমের কলঙ্কও কিছু কম নয়। অহল্যা ইত্যাদি রমণীর প্রতি তার অজিতেন্দ্রিয় ব্যবহারও অপ্রসিদ্ধ নয়। পণ্ডিতজনেরা বলেছেন–ইন্দ্ৰ-পূজার সঙ্গে কৃষ্ণপূজার বিরোধ ঘটার পর ইন্দ্রের যজ্ঞ স্তব্ধ হয়েছিল এবং গোবর্ধন পর্বতের পাদদেশে কৃষ্ণের সর্বাধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইন্দ্রের নায়কত্বের বিরুদ্ধেই। কিন্তু মিথলজির জগতে দুই দেবতার এই বিরুদ্ধতা চিরস্থায়ী হয় না। পুরাণ-কাহিনীতে ইন্দ্ৰ হেরে গিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে নিলেন বটে, কিন্তু মিথলজির জগতে এই আপসের ফল হয় উলটো রকম।
মিথলজিস্টরা বলেন ঋগবেদে বিষ্ণুর যে পরিত্রাতার ভূমিকা আছে, সেই পরিত্রাতার স্বরূপ কৃষ্ণের মধ্যে থাকায় ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। তবে বিষ্ণুর সঙ্গে কৃষ্ণের এই মেশামেশি বা স্বরূপ বিপরাবর্তনের ঘটনাটা ঘটেছে কৃষ্ণের পরবর্তী জীবনকে কেন্দ্র করে। পাণ্ডব-ভাইদের সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হওয়া থেকে একেবারে ভারতযুদ্ধ পর্যন্ত কৃষ্ণ এমনই এক পরিত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন এবং সেই পরিত্রাণের মাহাত্ম্য এতটাই যে কৃষ্ণ সহজেই বৈদিক বিষ্ণুর পরিত্রাতার ভূমিকাটি আত্মসাৎ করে ফেললেন। কোনও কোনও পণ্ডিত অবশ্য এমনও বলেছেন–যে, কৃষ্ণের সর্বাতিশায়ী মাহাত্ম্য-গুণে স্বয়ং বিষ্ণুই কৃষ্ণের তত্ত্বগত স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে–বিষ্ণুর এই তত্ত্বগত দার্শনিক স্বরূপ অধিগ্রহণের ঘটনা কৃষ্ণের পরবর্তী জীবনের পরিসর।
কৃষ্ণের পূর্বজীবনে যে বৈদিক দেবতার স্বরূপ মিশে গেছে, তিনি কিন্তু ইন্দ্র। কৃষ্ণের সঙ্গে তার বিরোধ হয়েছে, আপস-মীমাংসাও হয়েছে–সবই ঠিক আছে, কিন্তু ওই যে বললাম মিথলজির জগতে তার ফল হয়েছে অন্যরকম। সময় যত এগিয়েছে, বৈদিক সমর-দেবতা ইন্দ্রের বীরত্ব, প্রেম এমনকি অপপ্রেমের ভূমিকাও মিশে গেছে কৃষ্ণের পূর্বজীবনের সঙ্গে। ঋগবেদে অসুর–দৈত্য বধের জন্য ইন্দ্র যত বিখ্যাত হয়েছেন, তেমনটি আর কেউ নয়। একইভাবে বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে কৃষ্ণ হলেন সেই ব্যক্তি যিনি অঘাসুর, বকাসুর ইত্যাদি শতেক রকমের অসুর-দৈত্য বধের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। ইন্দ্র বধ করেছেন বৃত্রকে, কৃষ্ণ বধ করেছেন শম্বর নামে এক অসুরকে; ইন্দ্র কালোপম সর্পবিনাশ করে সপ্তসিন্ধুর গতি মুক্ত করলেন, কৃষ্ণ কালিয়-নাগকে দমন করে যমুনার জল পরিশুদ্ধ করে ব্রজবাসীদের কাছে তা মুক্ত করে দিলেন। ইন্দ্রের এই সব বীরত্বসূচক ঘটনা কৃষ্ণের পূর্ববর্তী জীবনের বীরত্ব-কাহিনীর ওপরে আরোপিত হতে হতে ইন্দ্রের স্বরূপটাই মিশে গেছে কৃষ্ণের পূর্ববর্তী জীবনে। কিন্তু শুধু বীরত্বই নয়, তার সঙ্গে আছে ইন্দ্রের অনিয়মিত প্রেমোন্মত্ততাও। ইন্দ্রের অতিরিক্ত প্রেমিক স্বভাব উপযুক্ত আধার হিসেবে কৃষ্ণের মধ্যেই সংক্রামিত হয়েছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তথাকথিত রিরংসা, নীতি-বহির্ভূত স্ত্রী-সম্ভোগ তথা মুহূর্মুহূ প্রেমে পড়ার প্রবণতা এবং পটুতা কৃষ্ণের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত এবং পণ্ডিতেরা মনে করেন কৃষ্ণের এই উত্তরাধিকার এসেছে সৌর-দেবতা ইন্দ্রের সাজাত্যে।
মিথলজিস্টরা যা বলেন বলুন–কৃষ্ণের প্রেমস্বভাব নির্ণয়ে মিথলজির বিশাল তর্ক-যুক্তি ভেসে গেছে দার্শনিকদের তাত্ত্বিক গাম্ভীর্যে। এমনকি অবতার পুরুষ হিসেবে সাধারণ পরিত্রাতার যে ভূমিকা থাকে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন পদ্ধতিতে, সেই পদ্ধতিও এখানে গৌণ হয়ে গেছে। বৈষ্ণব দার্শনিকেরা কৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদের দার্শনিক ভাবনার চরম বিন্দুতে। কৃষ্ণ সম্পূর্ণভাবেই এখানে নরলীলা অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তিনি লীলা করলেও তিনি কিন্তু পরমার্থতত্ত্ব। কংস-শিশুপাল বধ করে অথবা ভারতযুদ্ধে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে তিনি যা করেছেন, তা সামান্যভাবে তার অন্তরশায়ী বিষ্ণুর পরিত্রাতার ভূমিকা, এখানে তার কোনও ভূমিকাই নেই। দার্শনিকেরা বলেছেন স্বয়ং ভগবান যখন পূর্ণ অবতার গ্রহণ করেন, তখন অন্যান্য দেব-স্বরূপ তার সঙ্গে এসে মিশে যায়। অতএব কংস-শিশুপাল বধের ক্ষেত্রে বিষ্ণুই সে ভূমিকা পালন করেছেন, আসলে কৃষ্ণের কাজই ওটা নয়।
তাহলে অবতার হিসেবে কৃষ্ণের কাজটা কী, যার জন্যে তাকে নরলীল হয়ে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে হল? দার্শনিকরা বলেছেন–কৃষ্ণ অবতারের প্রধান উদ্দেশ্য হল রস আস্বাদন। তার নিজের ভিতরেই যে অনন্ত রস আছে, তা নিজে নিজেই অনুভব করা যায় না। নিজের রসস্বরূপতা বোঝবার জন্যও আরও একটি সত্তার প্রয়োজন। সেই রস-সত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রজের রমণীদের মধ্যে। আর রসিক হিসেবে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন সেই রস-সত্তা আস্বাদনের জন্য।
এইভাবে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা করার জন্য দার্শনিকরা তাদের বিচার আরম্ভ করেছেন একেবারে উপনিষদের বাক্য-মহাবাক্য থেকে। রসো বৈ সঃ–এইসব কথা তো আছেই, রসিক জনেরা যুক্তি দিয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদের পংক্তি উদ্ধার করে বলেন–পরম পুরুষ নাকি তার জ্যোতিলোকে একা একা বসে আর সুখ পাচ্ছিলেন না, কারণ, একা একা কি সুখ পাওয়া যায়–স বৈ নৈব রেমে, যস্মন্ একাকী ন রমতে? তিনি তাই আপন স্বরূপস্থিত রস আস্বাদনের জন্য অদ্বৈত সত্তা পরিত্যাগ করে দুই হলেন, স্বামী হলেন, স্ত্রী হলেন ইত্যাদি।
কৃষ্ণের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর এই দ্বৈত রসাস্বাদনের ভূমিকাও ম্লান হয়ে গেছে। দার্শনিকেরা বলেছেন–স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের মধ্যে যে বৈধতা আছে, যে নিয়ম আছে, একপত্নীকতার মধ্যে যে ব্রত আছে, তা কখনও পরম ঈশ্বরকে তৃপ্ত করতে পারেনি। সে প্রেমের যে তৃপ্তি, তার পরীক্ষা হয়ে গেছে রামচন্দ্রের অবতারেই। অতএব চরম রসাস্বাদনের জন্য চাই চরম প্রেম–যে প্রেমের মধ্যে সতত বাৰ্যৰ্মানতা আছে, যে প্রেম সমস্ত সামাজিক শৃঙ্খল, বাধা-নিয়ম অতিক্রম করে পরম কান্তের দিকে ধাবিত হয়, সেই প্রেম আস্বাদনের উদ্দেশ্য নিয়েই কৃষ্ণের মর্ত্যভূমিতে অবতরণ ঘটেছে।
তবে এই অবাধ অবৈধ প্রেমের কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিকেরাও ভয়ঙ্কর রকমের সাবধান হয়ে গেছেন। এ প্রেম যে সাধারণ মানব-মানবীর প্রেম নয়, এবং এ প্রেম যে সাধারণ মানব-মানবীর অনুকরণীয়ও নয়–সে ব্যাপারে তাদের সতর্কবাণীরও অন্ত নেই। দার্শনিক দিক দিয়ে পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ যখন শত-সহস্র ব্রজগোপীর প্রেমপাশে আবদ্ধ হবেন, তখন সেই ব্রজগোপিনীদের স্বরূপ মোটেই সাধারণ হবে না। ওঁরা এক্ষেত্রে একটি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে বলেন–কায়্যুহ। অর্থাৎ এই যে শত শত ব্রজরমণীরা আছেন, তারা সব পরম ভগবান কৃষ্ণের স্বরূপ। ভগবান কৃষ্ণ তার একান্ত অন্তর্গত রস আস্বাদনের জন্যই তাদের সৃষ্টি করেছেন নিজেরই স্বরূপ থেকে। যিনি নিজে নিজের মধ্যেই পরম রসাস্বাদন করতে পারেন, যিনি আত্মারাম, তিনি নিজের সেই রসস্বরূপটি পরম এবং চরমভাবে আস্বাদনের জন্যই শত-সহস্র গোপিনীর সৃষ্টি করেছেন। আর তাঁর এই লীলা-আস্বাদনে সহায়তা করছেন ভগবতী যোগমায়া। সাধারণ মায়া যেমন মানুষকে ভুলিয়ে মোহগর্তে নিক্ষেপ করে, যোগমায়া তেমনি ভগবানের ভগবত্তা ভুলিয়ে সাধারণ মানুষের মতো রস আস্বাদনে সাহায্য করেন। কারণ ভগবানের যদি পদে পদে খেয়াল থাকে যে, তিনি ভগবান, তাহলে আর তার বনতলে জ্যোৎস্নারজনীতে রাধার নামে বাঁশী বাজিয়ে বারবার প্রেমের ডাক পাঠাবার মানে থাকবে না। অতএব যোগমায়া তাকে তার ভগবদস্বরূপ ভুলিয়ে দেন, আর তিনি প্রেমে উন্মত্ত হন আপন-সৃষ্ট সহচরীদের সঙ্গ-রঙ্গ উপভোগ করার জন্য।
কৃষ্ণপ্রেমের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি লেখনীধারণ করিনি, কারণ আমার লেখনী সেখানে অপ্রতুল, ক্ষমতা সীমিত। আর সেই দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার উপযুক্ত স্থানও এটা নয়। আমরা কৃষ্ণ-জীবনের ঐতিহাসিকতার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু তবু এই দার্শনিক তত্ত্বের সামান্য সূত্রটুকু এইজন্য দিলাম যে, এও আমাদের সেই ভণিতার অঙ্গ। যাঁর প্রেম-কাহিনী উপজীব্য করে শত শত দার্শনিক গ্রন্থ লিখতে হয়েছে, যে প্রেমের প্রতিষ্ঠার জন্য মহামতি চৈতন্যদেব এবং তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত শত শত মহাসত্ত্ব ব্যক্তি সারা জীবন অতিবাহিত করেছেন, তার উল্লেখমাত্র না করে আমরা কৃষ্ণজীবনের ঐতিহাসিকতায় প্রবেশ করব, সে একরকম বাতুলতা। কিন্তু এই দার্শনিক সূত্র তথা মিথলজির সূত্র ধরে যত জ্ঞানই বিকিরণ করা যাক, আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই। ব্রজের পোপবৃদ্ধদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রিয়ত্ব সম্বন্ধ নয়, শত শত গোপজনের সঙ্গে কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও নয়, বৃন্দাবনের গোপিনী-আহিরিণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের যে প্রণয় ছিল, প্রেম ছিল, শারীর-সম্বন্ধ ছিল–সেই সম্বন্ধের ঐতিহাসিক স্থাপন করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
শ্রদ্ধেয় মহাশয় আমি আপনার লেখাগুলো খুবই পছন্দ করি এবং পড়ি। এখন আমার মনে হয় অলৌকিকতা, ঈশ্বর, ভগবান ইত্যাদি কি সত্যিই আছে একটু লিখে জানালে খুবই উপকৃত হব।