১২০. প্রতিদিনের জয় অনিবার্য
বাংলাদেশ প্রতিদিনের বয়স ১০ হল। আজকাল মুদ্রিত পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টিকে থাকতে হলে অনলাইন ছাড়া গতি নেই, এমন যখন অবস্থা, তখন দশ বছর পার করেছে প্রতিদিন। করোনা ভাইরাসের থাবার নীচে বসে বিশাল উৎসব সম্ভব নয় জানি। কিন্তু মনে মনের উৎসব তো চলতেই পারে। আমি মনে মনে উড়িয়ে দিলাম সহস্র রঙিন ফানুস।
বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার কাছে কোনও খবরের কাগজ নয়, আমার কাছে এটি আরও বড় কিছু, আরও বিশাল কিছু। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ আমার কাছে আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ, যে দেশ আমাকে নিরাপত্তা দেয়, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রদীপের আলো দেয়, আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়, আমাকে থোকা থোকা স্বপ্ন দেয়। দেশের কাজই তো এই, যখন কেউ নেই পাশে, দেশ তখন মায়ের মতো পাশে থাকে, দেশের একটি নরম কোমল হাত থাকে পিঠে। যখন বিদেশ বিভুঁইয়ে ধসে গেছি বারবার, তখন আলতো করে যে তোলে আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য, সেটি দেশ।
না, এ ছাড়া কোনও দেশ নেই আমার। যখন নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যখন কট্টর মৌলবাদী সমাজ, যখন নিস্পৃহ নির্মম সরকার আমার লেখক সত্ত্বাকে হত্যা করার জন্য হেন কাজ নেই যে করেনি, তখন সেই দুঃসময়ে আমার দিকে সহানুভূতির আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। আমার লেখক সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। আজ দীর্ঘদিন আমি নিয়মিত লিখছি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’। একজন ব্রাত্য, নির্বাসিত লেখকের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
না, আমি বানের জলে ভেসে আসিনি। আশির দশক জুড়ে নারীর সমানাধিকারের জন্য আমি লড়েছি একা, নারীর বিরুদ্ধে হাজার রকম অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি একা। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দাঁত-নখ ভেঙে দিতে চেয়েছি একা। জীবন বিপন্ন, তারপরও কোনও অপশক্তির সঙ্গে আপোস করিনি। একা ছিলাম বলেই পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র আমার হাত থেকে শুধু কলম কেড়ে নেয়নি, আমাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।
‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ প্রকাশক এবং সম্পাদকের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। ওঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার লেখা প্রকাশ করেন। ওঁরা গণতন্ত্রে এবং বাকস্বাধীনতায় গভীরভাবে বিশ্বাস করেন বলেই যে মতটি অধিকাংশ মতের চেয়ে ভিন্ন, সেটি প্রকাশ করার সাহস করেন। এই সাহস বাংলাদেশের অন্য কোনও প্রচারমাধ্যমের নেই। অন্য প্রচারমাধ্যম শুধু সেই মতটি প্রকাশ করতে আগ্রহী যে মতটি সকলে পছন্দ করে, যে মত বিতর্ক তৈরি করে না। কিন্তু বিতর্ক না হলে সমাজ পালটাবে কী করে! মুক্তচিন্তার জায়গা না থাকলে সমাজ তো স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে এক জায়গায়, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শেকড় গজিয়ে ফেলবে, বিবর্তিত হবে না।
একজন লেখককে নির্বাসন দণ্ড দিলেই তাকে হত্যা করা যায় না। তার লেখা বই যদি প্রকাশ পেতে থাকে, তার লেখালেখি যদি পাঠক পাঠ করতে থাকে, তবে নির্বাসন তেমন কোনও সর্বনাশ করতে পারে না লেখকের। কিন্তু লেখকের লেখা যদি প্রকাশ না করা হয়, তাহলেই লেখকের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের মৌলবাদী সমাজ আমার মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সেই মৃত্যু থেকে ফিনিক্স পাখির মতো আমি বেঁচে উঠতে পেরেছি শুধুই ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ জন্য।
‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ যে ব্যাপারটি আমার ভালো লাগে, তা হল সব রকমের মতামতকে জায়গা দেওয়ার উদারতা। যে গুরুত্ব দিয়ে ধর্মের পক্ষে, সরকারের পক্ষে, পুরুষতন্ত্রের পক্ষে মতামত ছাপানো হয়, একই গুরুত্ব দিয়ে ওসবের বিপক্ষেও মতামত ছাপানো হয়।। শুধু একটি মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, বাকিগুলোকে তুচ্ছ করা হবে, শুরু থেকেই এই কাগজটি তেমন নয়। খবরের কাগজকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হতেই হয়।
পত্রিকার প্রকাশকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য না হলেও সম্পাদকের সংগে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। নইম নিজাম অত্যন্ত সজ্জন, সাহসী এবং স্বপ্নবান। ১০ বছর ধরে তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন এই পত্রিকা। এই পত্রিকা বেঁচে থাকতে পারে আরও ১০০ বছর। ১০০ বছর পর আমিও থাকবো না, এবং ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ বর্তমান কোনও কর্মীও থাকবে না। তাতে কী, নতুন লেখক, নতুন সম্পাদক আরও ১০০ বছর বাঁচাবে এটিকে। এভাবেই আমার দেশটি, প্রিয় দেশটি বেঁচে থাকবে।
১২ ১. নারীশিক্ষার চেয়ে পুরুষকে শিক্ষিত ও সভ্য করা বেশি জরুরি
গা রি রি করে ওঠে যখন খবরের কাগজে পড়ি বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, বহু বছর ধরেই ধর্ষণ করছে, মেয়ের পেটে বাবার বাচ্চা, বাবার বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে মেয়ে।—এমন সব কাহিনি।
একটি কন্যা-সন্তানের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা তার বাবা-মা। বাবা তার মেয়েকে নিরাপত্তা দেবে, মেয়ে সেরকমই জানে। পরিবার, সমাজ সেরকমই জানে। কিন্তু বাস্তবটা বড় কুৎসিত, বড় ভয়ংকর। বাস্তবে এগারো বারো বছর বয়সী কন্যাকে তো বটেই, তিন চার বছর বয়সী কন্যাকেও রেহাই দেয় না বাবা। নিম্নবিত্তের এইসব খবর আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু ধনী ধর্ষক পিতার খুব কম কীর্তিকলাপই বাইরে প্রকাশ পায়।
ধর্ষক-স্বামীদের খবরও আমাদের কাছে আসে না। যে সমাজের পুরুষেরা মেয়েদের কী করে ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ হিসেবে দেখতে হয়, সেটা জানে না, তারা আবার কোনও মেয়ের সঙ্গে ভালোবেসে যৌন সম্পর্ক কী করে করতে হয় জানবে কী করে! যৌনতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা উচিত প্রেম ভালোবাসার, সেখানে আমাদের সমাজে যৌনতার সঙ্গে সম্পর্ক গায়ের জোরের। মেয়েদের ওপর পুরুষের এই গায়ের জোর খাটানোকে সমাজ একরকম মেনেই নিয়েছে।
পুরুষই দেখায় এই গায়ের জোর, কারণ মেয়েদের চেয়ে গায়ের জোর সাধারণত পুরুষের বেশি। অনেক সময় পুরুষের চেয়ে গায়ের জোর, বুদ্ধির জোর মেয়েদের বেশি হলেও, পুরুষেরা ‘সম্পর্কের জোর’ দেখায়। সম্পর্কের জোরেই মেয়েদের দাবিয়ে রাখে তারা। স্বামীর জোর, ভাইয়ের জোর, বাবার জোর, মামার জোর, কাকার জোর, প্রেমিকের জোর। তারা ভেবেই নিয়েছে মেয়েদের ওপর জোর খাটানোর অধিকার তাদের আছে।
জরিপে বার বার দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের ধর্ষণ, অপমান, মারধোর ইত্যাদি পরিবারের লোক, বা কাছের পুরুষই করে। অথচ কাছের পুরুষদের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি আপন ভাবে, তারা কাছে থাকলেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে মেয়েরা, তাদের সান্নিধ্যেই সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত তারা। তবে পৃথিবীতে যে মেয়েরা এ যাবৎ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের ধর্ষকদের লিস্টে অচেনা অপরিচিত লোকের চেয়ে পরিচিত লোকের সংখ্যাই বেশি। নিজের বাবা, ভাই, মামা, কাকা, প্রেমিক, স্বামী, শ্বশুর, ভাসুর, দেবর, প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক সেই লিস্টে। কী ভয়ংকর রোমহর্ষক এইসব তথ্য।
মেয়েদের সত্যি বলতে কী, কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই। ধর্মীয় আইন তাকে নিরাপত্তা দেয় না অর্থাৎ রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দেয় না, বিদ্যালয় দেয় না, রাস্তাঘাট দেয় না অর্থাৎ সমাজ তাকে নিরাপত্তা দেয় না, ঘর তাকে নিরাপত্তা দেয় না অর্থাৎ পরিবার তাকে নিরাপত্তা দেয় না। কোথায় যাবে একটা মেয়ে? নিজের শরীরের জন্য তাকে সর্বদা লজ্জা এবং ভয় নিয়ে বাঁচতে হয়। যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গায় ঘরে অথবা বাইরে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে যে কেউ। প্রতিনিয়ত এই আশঙ্কা একটি মেয়েকে বহন করতে হয়। সব পুরুষের যৌনদাসী সে। এমনকি আপন বাবাও তাকে তার যৌনদাসি হিসেবে ভোগ করতে পারে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ মেয়েদের যৌনদাসীই মনে করে। শৈশব থেকে তাদের এই ধারণা দিয়েই বড় করা হয়েছে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে কম, বিদ্যায় কম, শক্তিতে কম, শৌর্যে কম, তাদের কাজ শারীরিক অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, পুরুষের সেবা করা, পুরুষের যৌনক্ষুধা মেটানো, পুরুষের সন্তান প্রসব করা, আর সেই সন্তানদের লালনপালন করা। নারী নামের এই ইতর শ্রেণির প্রাণীকে প্রাণী হিসেবে শ্রদ্ধা করার, বা মানুষ হিসেবে সম্মান করার কোনও কারণ তারা দেখে না। সে কারণে ধর্ষণ ঘটায়।
সে কারণে মেয়েদের কাপড়চোপড় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সে কারণে বোরখা হিজাবের ব্যবহার বাড়ে। মেয়েরা কোনও না কোনও পুরুষের সম্পত্তি। সেই পুরুষ চায় না তার সম্পত্তির ওপর লোভ করুক অন্য কোনও পুরুষ, সে কারণেই মেয়েদের হিজাব বোরখা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় নিজের শরীর। শরীরটাই মেয়েদের মূলধন। শরীরটা স্বামীর ভোগের জন্য, সুতরাং একে অক্ষত রাখতে চায় স্বামীরা। তা হলে সেই বৃদ্ধাকেও কেন শরীর ঢেকে রাখতে হয়, যার মালিক নেই, মরে গেছে? সেই মালিকের সম্মানেই ঢেকে রাখতে হয়। স্বামী মৃত হলেও স্বামী। স্ত্রী সতীত্ব বজায় রাখলে স্বামীর পুণ্য হবে। সুতরাং যা কিছু মেয়েরা করে, সবই স্বামীর আরামের জন্য, সুখের জন্য, ভোগের জন্য, মঙ্গলের জন্য।
আসলে আমাদের সংস্কৃতিটাই ধর্ষণের। ধর্ষণের বলেই রাস্তাঘাটে, অলিতে গলিতে, পাহাড়ে সমুদ্রে, বাসে-ট্রেনে-নৌকোয়, ভিড়ে নির্জনে, রাতে অন্ধকারে একা মেয়েদের দেখা মেলে না, কারণ মেয়েরা একা যায় না ওসব জায়গায়, যায় না ধর্ষণের ভয়ে। কোনও অচেনা পুরুষকে ঘরে ঢুকতে দেয় না ধর্ষণের ভয়ে। কোনও পুরুষের ঘরে একলা ঢোকে না ধর্ষণের ভয়ে। ছাত্রীনিবাসগুলোকে ছাত্রাবাস থেকে আলাদা করা হয় ধর্ষণের ভয়ে। কিছুটা বড় হওয়ার পর পরিবারের পুরুষ থেকে সরিয়ে আলাদা বিছানায় মেয়েদের ঘুমোতে দেওয়া হয়, ধর্ষণের ভয়। এই ধর্ষণের ভয় একটু একটু করে একটি মেয়ে যখন বড় হতে থাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার সমস্ত অস্তিত্বে। স্বাভাবিক জামাকাপড়ের ওপর বাড়তি কাপড়—ওড়না, হিজাব, বোরখা ইত্যাদি পরতে হয় ধর্ষণের ভয়ে। ধর্ষণের ভয়েই যে মেয়েদের চাল চলন পুরুষের চেয়ে ভিন্ন, তা, ধর্ষণ যদি সংস্কৃতির অংশ না হত, চোখে পড়তো। সংস্কৃতির অংশ বলেই ধর্ষণের হাত থেকে শরীরকে বাঁচানোর জন্য মেয়েরা যা যা পদক্ষেপ করে, তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয় সবার কাছে।
ধর্ষণ কখনও মেয়েদের সমস্যার কারণে ঘটে না। ঘটে পুরুষের সমস্যার কারণে। আজ পর্যন্ত পুরুষেরা এটি বন্ধ করতে পারেনি। অবশ্য বন্ধ করতে চাইলে করতে পারতো।
মনে আছে বাবুল মিয়া নামের একটি বিবাহিত দু’সন্তানের জনক হবিগঞ্জের কিশোরী বিউটিকে অপহরণ করে দু’সপ্তাহ ধর্ষণ করেছিল। এতে নাকি বিউটি ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে, যেহেতু নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না, তাই নিজের বাবা তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমরা কিন্তু বিউটির ধর্ষক বাবুল মিয়া আর বিউটির বাবা সায়েদ আলীরই প্রজাতি। আমরা বগুরার সেই বাবা, যে তার ১৭ বছর বয়সী কন্যাকে ধর্ষণ করে এখন জেলে গিয়েছে, তারই প্রজাতি। আমরা তো খাগড়াছড়ির রামগড়ের সেই বাবা, যে তার মাদ্রাসায় পড়া কন্যাকে ধর্ষণ করতো, আর মা তার মুখ চেপে ধরতো যেন চিৎকার না করতে পারে, তারই প্রজাতি। সেই এই অতীব কদাকার এবং ভয়ংকর মানুষ প্রজাতি নিয়ে আমরা কত কাব্য রচনা করি। আমাদের আদিখ্যেতার শেষ নেই। মানুষের যত মঙ্গলই কামনা করি না কেন, মানুষ মূলত এমন, এমন ভয়ংকর। এই প্রজাতির পুরুষেরা যতটা নারীবিরোধী, জগতে আর কোনও প্রজাতি নেই যে প্রজাতির পুংলিঙ্গ স্ত্রী লিঙ্গকে এভাবে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে করে হত্যা করে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা মনুষ্য সমাজে মেয়ে হয়ে জন্মেছি। এর চেয়ে মানবেতর জন্ম বোধ হয় প্রাণীজগতের আর কোথাও নেই।
১২২. পাপিয়া কি শুধু একাই পাপী?
বাংলাদেশের শামিমা নূর পাপিয়া কী ভয়ানক কী কুৎসিত কী বীভৎস সব কীর্তি করেছে। দেহ ব্যাবসা, জুয়ো ব্যাবসা, মাদক ব্যাবসা, অর্থ পাচার ইত্যাদি নানা ধরনের অবৈধ ব্যাবসা করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এইসব চুরি জোচ্চুরি বদমায়েশি, এইসব লুটপাট, লোক ঠকানো, অন্যায় অত্যাচার—পুরুষেরাই করে বলে লোকে বিশ্বাস করতো। এখন দেখছে সুযোগ পেলে মেয়েরাও করে এসব। প্রধানমন্ত্রী পুরুষ হলে যা করতেন, নারী হয়ে ঠিক তা-ই করছেন না কি?
এই যে গত চার দশক থেকে বলে আসছি নারী আর পুরুষে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। আমার কথা তো কেউ মানেনি। এখন মানবে তো!
নারী এবং পুরুষের শারীরিক গঠনে কিছুটা পার্থক্য আছে, এই পার্থক্য নিয়েই পুরুষেরা যা করতে পারে, নারীও করে দেখিয়েছে, নারীও পারে। নারী সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী সব বাহিনীতেই বিদ্যমান। সম্মুখ সমরেও তারা। কুলির কাজ, কৃষিকাজ, কন্সট্রাকশানের কাজ কী না করে নারী! নারী এভারেস্টের চুড়োয় গিয়েও উঠতে পারে। পারে না?
যে কাজে মস্তিষ্কের ব্যবহারই প্রধান, সেই কাজেও নারী তার পারদর্শিতা দেখিয়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করছে নারী। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈমানিক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, নভোচারী, নেত্রী, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কী না হতে পারে নারী! নারী মেধাবী, পারদর্শী, দক্ষ, বিচক্ষণ। নারী কিন্তু পুরুষের মতোই, পুরুষ যেমন খারাপ কাজ করতে পারে, নারীও পারে। অন্যায় অত্যাচার, অবৈধ ব্যাবসা, অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, মারামারি খুনোখুনি সবই নারী পারে। নারীকে এসবে ততটা দেখা যায় না, কারণ সুযোগ নেই। নারীর মনে পুরুষের মনের মতোই হিংসে, দ্বেষ, লোভ, লালসা। চতুরতা ধূর্ততা পুরুষের একার নয়, নারীরও।
পাপিয়া যে পাপাচারে লিপ্ত ছিল, তা, অনুমান করছি এতকাল ধরে সম্ভব হয়েছে, কারণ তাঁকে যেমন সহযোগিতা করার লোক ছিল, তাকে রক্ষা করার লোকও ছিল। তারা নিশ্চয়ই ছোটখাটো কেউ নয়। বড়সড় সহযোগিতা থাকলেই বড়সড় অন্যায় করা যায়। এই সহযোগী, রক্ষাকারীদের নাম নিশ্চয়ই তদন্ত করলে পাওয়া যাবে। তাঁদের নাম শেষ অবধি প্রকাশিত হবে কিনা, সংশয় থেকেই যায়। এইসব বড় খেলায় ছোট খেলোয়াড়রা ধরা পড়ে, নেপথ্যের বড় খেলোয়াড়রা ধরা পড়ে না। তারা অতি ক্ষমতাশালী বিত্তশালী বলশালী কিনা। এসব কাহিনি দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে আমরা কি ইতিমধ্যে ক্লান্ত হইনি?
শুনেছি হাজার কোটি টাকা চুরি করে লোকেরা দেশ থেকে পালাচ্ছে। এই হাজার কোটি টাকা লোকেরা কী করে উপার্জন করছে? কী করেই বা ব্যাঙ্ক লুঠ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো তা পারবে না। আমি পারবো? আমি ব্যাঙ্ক থেকে একটি টাকাও ধার নিতে পারবো? হোটেলের সুইট ভাড়া করে দিনের পর দিন কোনও হোটেলে থাকতে পারবো আমি? হোটেলে বসে সুন্দরী মেয়েদের এস্কর্ট সার্ভিশ চালিয়ে যেতে পারবো? হোটেলের ভেতরেই দেহব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারবো? মাদক ব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারবো? পারবো না। হোটেলের লোকেরা সেদিনই জেনে যাবে। এবং আমাকে সেদিনই জেলে যেতে হবে। অন্য যে কোনও সাধারণ মানুষের বেলায়ও তা-ই হবে। কিন্তু পাপিয়ার বেলায় সবাই গোপন রেখেছে তাঁর কীর্তিকলাপ। কারণ পাপিয়া যুব লীগের নেত্রী ছিলেন। তাঁর আশ্রয় ছিল, প্রশ্রয় ছিল। নিশ্চয়ই ছিল। ছিল বলেই তিনি অবৈধ অনৈতিক অন্যায় করে যেতে পেরেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। নিজের পদের তিনি অপব্যবহার করেছেন। সরকারের ছত্রছায়ায় ভয়ংকর ভয়ংকর সব অন্যায় ঘটে যেতে পারে। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বললেই যদি তাকে কাছের মানুষ, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ, নিজের মানুষ বলে ভাবা হয় তাহলে মুশকিল। অর্থলোভ মানুষকে অমানুষ করে তুলছে। এই লোভের শিকার নারী পুরুষ উভয়েই।
আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পড়শি দেশগুলো থেকে, এমনকি ভারতের থেকেও ভালো। বাংলাদেশের মোট দেশীয় পণ্য বৃদ্ধির হার এখন ৮.১, যেখানে বিশাল ভারতবর্ষের মাত্র ৬.৬। কী লাভ অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়ে, যদি অর্থকরী দেশের কাজে না লেগে ব্যক্তির ভোগ বিলাসের কাজে লাগে! রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য, কিছু মানুষের জন্য, ধনী হওয়া বা নিজের আখের গোছানো। খুব কম লোকই রাজনীতিক হিসেবে দেশ এবং দেশের মানুষের সেবা করার কথা ভাবে। একদিকে নামাজ রোজা করছে, হজ করছে, কিন্তু আরেকদিকে অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করছে, প্রতারণা করছে, মানুষের সর্বনাশ করছে। মনে হচ্ছে যত ধর্ম বাড়ছে, তত অনাচার বাড়ছে। আমার মনে হয়, অনেকে মনে করে, গুনাহ করছি তাতে ক্ষতি কি, ওপরওয়ালার কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেন, অবসর মতো ক্ষমা চেয়ে নেবো।
আমার মনে হয় পাপিয়া ততদিন তার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে পেরেছে যতদিন তাকে সেটি রক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। যেদিন থেকে তাকে আর রক্ষা করতে দেওয়া হয়নি, সেদিন থেকে তিনি পুলিশের হেফাজতে। পাপিয়ার অবৈধ ব্যবসা, অবৈধ অর্থ উপার্জন সম্পর্কে সরকারের কেউ জানতো না, যে যতই বলুক, এ বিশ্বাস করার মতো নয়।
কোনও অন্যায় করিনি, কোনও অনৈতিক কাজ করিনি, কারও কোনও ক্ষতি করিনি, কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি, কোনও চুরি ডাকাতি করিনি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করিনি, কাউকে খুন করিনি, শুধু মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চেয়েছিলাম, মানুষকে নারীর প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলাম, সমতার সমাজ চেয়েছিলাম, সেটিকে অপরাধ ভাবলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাকে তো দেশে ঢুকতে দিচ্ছেনই না আজ ২৫ বছর, আমার পাওয়ার অফ এটর্নির কাগজ সত্যায়িত না করার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকেও বলে রেখেছেন। এমন নিষ্ঠুর নির্মম প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অজস্র চাটুকার পুষছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে, যারা দেশ ও দেশের মানুষের সর্বনাশ করছে, আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করছে, সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর শাসনব্যবস্থাও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
পাপিয়া ধরা পড়েছে বলে আমরা পাপিয়ার খবর জানি। আমরা নিশ্চয়ই অনেকের খবর জানি না, যারা সরকারি দলের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার নেতা নেত্রী, কিন্তু জনগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুটতরাজ করছে। পাপিয়া হয়তো খানিকটা অদক্ষ বদমাশ ছিল, সে কারণে ধরা পড়েছে। যারা তার চেয়ে বেশি দক্ষ, বেশি ধূর্ত, তাদের ধরা সহজ নয়। সমগ্র বাংলাদেশে এক পাপিয়াই তো বদ কাজ করছিল না, বদ কাজ আরও লোক করছে। সরকারি বা ধনাঢ্য লোকদের ছত্রছায়ায় থেকে বদ কাজ করার লোকের অভাব কি কোনওদিন কোনওকালে হয়েছিল?
সরকার কিন্তু চাইলে বন্ধ করতে পারে এইসব প্রতারণা, লুটতরাজ, আর অর্থ পাচার। সরকার চাইছে না কেন সেটিই বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলে নাকি কিছু বদ লোককে রাখতে হয়। কিন্তু বদ লোককে রাখতে গিয়ে মুশকিলও হয়। বদ লোকের সংখ্যাটা খুব বেড়ে যেতে থাকে। লোভ লালসা বড় সংক্রামক। একজনের লোভ দেখে আরেকজনের লোভ বাড়ে। আদর্শের রাজনীতি আজকাল যে অল্প কজন করে, তারা অনেকে আমার মতোই অসহায়। প্রধানমন্ত্রী হয়তো তাদের পছন্দও করেন না, আমাকে যেমন করেন না।
১২৩. হিপোক্রেসি
ভারতবর্ষের ভেতরে বাইরে বিজেপিবিরোধী লোক প্রচুর। বিজেপি কারও ওপর অন্যায় করলে বিজেপিবিরোধীরা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে দেরি করে না। আমাকে বিজেপিবিরোধীরা কখনও পছন্দ করে না। কেন, আমি কি বিজেপিতে নাম লিখিয়েছি? পছন্দ করে না, কারণ বিজেপি আমার একটি বই খুব পছন্দ করে, তাই। বইটির নাম লজ্জা। বিজেপি বইটি পছন্দ করে বলে বিজেপিবিরোধীরা আমার সেই বইটির খুব বদনাম করে। বইটি জুড়ে আছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বর্ণনা। বিজেপিবিরোধীরা দাবি করে তারা সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু অবাক কাণ্ড সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানো আমাকে তাদের পছন্দ নয়। কারণ আমি যে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়িয়েছি, তারা ভারতের সংখ্যালঘু নয়, তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু। আমি তো পৃথিবীর যে কোনও দেশে যারাই সংখ্যালঘুর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে, তাদের সমর্থন করি, তাদের সঙ্গে একাত্মবোধ করি। ভারতবর্ষের বিজেপিবিরোধীরা তা করে না। তারা যেহেতু ভারতের মুসলমান সংখ্যালঘুর পক্ষ নেয়, তাই তারা অন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ-মুসলমান দ্বারা আক্রান্ত কোনও সংখ্যালঘুর জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে না।
বিজেপি যদি কারও ওপর অন্যায় করে, অথবা হিন্দু মৌলবাদীরা যখন কাউকে আক্রমণ করে, তখন, আগেই বলেছি, বিজেপিবিরোধীরা তার পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের কোনও বৈষম্য নিয়ে আমি কিছু প্রশ্ন করে যখন হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত হই, বা বিজেপি সরকার যখন আমার রেসিডেন্স পারমিট ১ বছরের জায়গায় ২ মাস দিয়ে বুঝিয়ে দেয় আমার পাশে তারা নেই, তখন কিন্তু বিজেপিবিরোধীরা আমার পাশে দাঁড়াতে আসে না। আমাকে ব্রাত্য করেছে তারা, ইসলাম এবং ইসলামি মৌলবাদের সমালোচনা করেছি বলে আমি ব্রাত্য, হিন্দুর পাশে, সে সংখ্যালঘু হলেও, নির্যাতিত হলেও, দাঁড়িয়েছি বলে ব্রাত্য। জীবনভর নারীর সমানাধিকার, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ইত্যাদির পক্ষে এবং সব রকম মৌলবাদ, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ইত্যাদের বিপক্ষে চল্লিশটিরও বেশি বই লিখলেও তারা আমাকে বিজেপির লোক, বা হিন্দু মৌলবাদের দোসর বলে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আমাকে তাদের সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান থেকে বাতিল করে, আমাকে কালো তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য তারা মনে মনে ঠিকই জানে যে আমি কারও দোসর নেই, আমার আপসহীন কণ্ঠস্বর আমার একার। তারা ঠিকই জানে যে আমার মতো তারা আসলে পৃথিবীর সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে একই রকম সরব হতে পারে না। মুসলিম মৌলবাদীদের অন্যায় তাদের গোপনে গিলে ফেলতে হয়। তারা হয়তো মনে করে সংখ্যালঘু মুসলিমের ন্যায্য অধিকার দাবি করলে তাদের ধর্মের এবং মৌলবাদের পক্ষ নিতে হয়। না নিলে সমর্থনটায় জোর থাকে না। আমি তো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছি, আমি তো তাই বলে হিন্দুধর্মের গুণগান গাইনি!
বিজেপি আমার বিরুদ্ধে গেলে বিজেপিবিরোধীরা আমার হয়ে কথা তো বলেই না, বিজেপির অমানবিক হওয়ার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। বরং বলে, ‘দেখ, দেখ বিজেপিও ওকে পছন্দ করে না’। তার মানে আমাকে বিজেপি পছন্দ না করলে বিজেপি ভালো, আর আমি মানুষটাই গণ্ডগোলে, খারাপ।
হিপোক্রেসির কিছু না কিছু সীমা থাকে। কিন্তু আমাকে যে করেই হোক অপদস্থ অপমান যারা করবে বলেই ঠিক করেছে, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে ছড়াতে আর অপপ্রচার করতে যাদের এতটুকু বাধে না, তাদের হিপোক্রেসির কোনও সীমা নেই। এইসব হিপোক্রেসি দেখতে দেখতে আমি বাঁচি। যত দেখি, তত নিজের প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বাস জন্মায়।
১২৪. ভায়োলেন্স
ব্রিটিশ মহিলা মিশেল র্যামসডেন তাঁর এক মুসলিম প্রতিবেশী পরিবারের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তারপর কী হল? নিজের নাম রাখলেন সাফিয়া আমিরা শেখ। তারপর কী হল? আইসিসের কর্মকাণ্ড পছন্দ করতে শুরু করলেন। তারপর? তারপর নিজেই সন্ত্রাসী হয়ে উঠলেন। লণ্ডনের সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন। তারপর কী হল? ধরা পড়লেন। বিচারে যাবজ্জীবন পেলেন। এই জীবনের নাম কী? অর্থই বা কী?
আমি বুঝে পাইনা পাশ্চাত্যের সভ্য শিক্ষিত সচেতন লোকেরা কেন এই নারীবিরোধী মানবতাবিরোধী ভায়োলেন্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যারা ধর্মটি গ্রহণ করে, তারা কি আসলেই শিক্ষিত বা সভ্য? আমার তো মনে হয় না। ধর্ম ত্যাগ করাই যখন সভ্য হওয়ার লক্ষণ, তখন ধর্মকে আঁকড়ে ধরা নিশ্চয়ই সভ্য হওয়ার বিপরীত।
মাঝে মাঝেই আমার জানতে ইচ্ছে হয়, মানুষ কি অবচেতনে ভায়োলেন্সকে পছন্দ করে?
১২৫. ফেয়ার এন্ড লাভলি
ফেয়ার এন্ড লাভলি নাম বদল করে হয়ে গেছে গ্লো এন্ড লাভলি। ভেতরের কেমিক্যালটা অবশ্য একই রয়ে গেছে। একই রকম ক্ষতিকর। কোম্পানিকে গালাগালি করে কী লাভ। নিজের সমালোচনা করো। তোমরা ডিম্যান্ড তৈরি করছো, তাই কোম্পানি গায়ের রঙ সাদা করার কেমিক্যাল বানাচ্ছে। কোনও মেয়ের যদি ইচ্ছে করে সাদা হতে, হবে। এ তার অধিকার। গায়ের রঙ নিয়ে মেয়েদের যা খুশি করার অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু মেয়েদের রঙ বদলের ইচ্ছেটা তৈরি করছে কারা? পুরুষেরা। তোমরা কালো মেয়ে পছন্দ করো না। তোমরা প্রেম করার জন্য, এবং বিয়ে করার জন্য ফর্সা মেয়ে চাও। তোমাদের চাওয়ার কারণে মেয়েদের সৌন্দর্যের সজ্ঞাই বদলে গেছে। রঙ কালো হওয়ার অপরাধে মেয়েদের ঘরে বাইরে হেনস্থা হতে হয়, খুব স্বাভাবিক যে মেয়েরা চায় হেনস্থা থেকে বাঁচতে।
মূল সমস্যাটা হল পুরুষের বর্ণবাদী চরিত্র। তাদের ডিম্যান্ডটা যদি বন্ধ হত, তাহলে কালো মেয়ের ফর্সা হওয়ার কোনও তাগিদ থাকতো না। ডিম্যান্ড না থাকলে সাপ্লাই থাকে না। কোম্পানিকে বন্ধ করে দিতে হত ফর্সা হওয়ার কেমিক্যাল।
১২৬. আয়ুর্বেদ
আয়ুর্বেদে যাদের আস্থা, যোগ ব্যায়ামের গুরু রামদেবে যাদের বিশ্বাস—তাদের জন্য সুখবর, তাদের করোনা সারাবার ওষুধ এসে গেছে। ওষুধের নাম করোনিল। আমি ভাবছি এই ওষুধ খেয়ে যদি করোনা না সারে, বা রোগী অসুস্থ হয়ে পড়ে আরও, যদি মারা যায়, তাহলে দায়টা কে নেবে? কারও ওপর আস্থা আর বিশ্বাস গভীর হলে তাকে গুরুতর অপরাধের জন্যও মানুষ দায়ী করে না। ঈশ্বরে মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস প্রচণ্ড। মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বরই পৃথিবীতে সবকিছু ঘটাচ্ছেন। তারপরও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নির্যাতন চলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দরিদ্ররা যে সর্বস্বান্ত হয়, অগুনতি শিশুর যে মৃত্যু হয়, তার জন্য কেউই কিন্তু ঈশ্বরকে দায়ী করে না।
১২৭. লাল বেলুন
দু’দিন হল মাথায় আমার একটি লাল বেলুন উড়ে বেড়াচ্ছে। কী করে লাল বেলুনটি মাথায় এলো, বলি। আমার প্রিয় যে কজন চলচ্চিত্র পরিচালক আছেন পৃথিবীতে, তাঁদের মধ্যে হৌ সিয়াও সিয়ান অন্যতম। তাইওয়ানের চলচ্চিত্র পরিচালক। আসলে তিনি পৃথিবীর শক্তিশালী সব পরিচালকদের গুরু। আমি চলচ্চিত্র পরিচালক না হলেও হৌকে আমি গুরু বলেই মানি, তাঁর প্রতিটি ছবি দেখার পর সব কাজ কর্ম ফেলে হৌকে নিয়েই আমাকে কয়েকদিন কাটাতে হয়। হৌ-এর যে ছবির কথা আজ বলতে চাইছি, সেটি তিনি ২০০৭ সালে বানিয়েছেন, ছবিটি হৌ-এর অন্যান্য ছবির মতো ম্যাণ্ডারিন ভাষায় নয়, ফরাসি ভাষায়, ছবির নাম লাল বেলুনের ওড়াওড়ি, ‘ল্য ভইয়াজ দ্য ব্যালোঁ রুজ’। হৌ-এর ছবি দেখলে ছবি দেখছি মনে হয় না, লুকোনো সিসিটিভি ক্যামেরায় মনে হয় সত্যিকারের জীবন দেখছি। এই ছবিটি হৌ ১৯৫৬ সালের একটি ফরাসি শর্ট ফিল্মের কথা স্মরণ করে বানিয়েছেন। শর্ট ফিল্মটি ৩৫ মিনিটের, আলবেয়ার লামোরিসের ‘ল্য ব্যালোঁ রুজ’, লাল বেলুন। যেহেতু হৌ সেই ১৯৫৬ সালে ফিরে গেছেন, আমিও ৬৪ বছর আগের প্যারিসে ফিরে গিয়ে দেখেছি লামোরিসের ‘ল্য ব্যালোঁ রুজ’। এই প্রথম আমি হৌ-এর ছবি দেখে হৌকে নিয়ে কাটাচ্ছি না, এই প্রথম আমি হৌ-এর ছবি দেখে অন্য এক পরিচালককে নিয়ে কাটাচ্ছি। আলবেয়ার লামোরিসকে নিয়ে কাটাচ্ছি। আমার মাথায় যে লাল বেলুনটি ঢুকেছে, সেটি হৌ-এর ছবির লাল বেলুন নয়, সেটি লামোরিসের ছবির লাল বেলুন। লামোরিস কী করে অত আগে, অত অসাধারণ, অত অরিজিনাল, অত নিখুঁত, অত দুর্দান্ত ছবি বানিয়েছিলেন যে হৌ-এর মতো গুরুকেও তাঁকে কুর্ণিশ করতে হয়, জানি না। মাথায় এখনও আমার লামোরিসের লাল বেলুন।
১২৮. হলদিরাম
অ্যামাজন আর বিগ বাস্কেট থেকে যা কিছু দরকার কিনি। এখন কেনাটা বেশিই হয়, কারণ করোনা এড়াতে এখন বাইরে বেরোচ্ছি না, দোকান পাটে ঢুকছি না। অনলাইনই ভরসা। মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করলো আজ, রসগোল্লা খুঁজে দেখি পাওয়া যাচ্ছে, তবে বিক্রি করছে হলদিরাম। রসমালাইও তাই। আহ, রাজস্থানীদের বানানো রসগোল্লা আর রসমালাই খেয়ে তো আমার প্রাণ ভরবে না। প্যাকেটে ডাল-চাউল ভরে বিক্রি করছে, কে? হলদিরাম। এরপর যে ইলিশ রেঁধে বিক্রি করবে না তার কোনও ঠিক আছে? হয়তো একদিন দেখবো লইট্যা শুঁটকি, চিতল মাছের মুইঠ্যা, আলুপোস্তও ওই হলদিরামই বিক্রি করছে। ভুজিয়াওয়ালাদের বানানো বাঙালি খাবার খেয়ে অনলাইন-নির্ভর বাঙালির বাঁচতে হবে!
বাঙালি করেটা কী? পরের বারোটা কী করে বাজাতে হবে সে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাহলে হলদিরামের বারোটা বাজিয়ে নিজেদের কিছু আজও করতে পারলো না কেন? না না বাঙালি কোনও অবাঙালির বারোটা বাজাবে না, বাজাবে বাঙালির বারোটা।
১২৯. চীন
মৃত্যুর ব্যাপারে চীন হয় চুপ থাকে, নয় বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলে। সত্য তথ্য না দিলেও তার চলে, কারণ গণতন্ত্র তো নেই যে তথ্য জানার অধিকার দাবি করবে! বেইজিঙ-এর তিয়ানানমেন স্কোয়ারে ১৯৮৯-এর এক রাত্তিরে ১০,০০০ প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীকে মেরে ফেলেছিল চীনের সেনাবাহিনী। চীন এ নিয়ে সবসময় চুপ থেকেছে।
করোনা ভাইরাসে, চীন যখন জানাচ্ছে, ২৫০০ মারা গেছে, আসলে চীনে তখন ৪০,০০০ এরও বেশি মানুষ মারা গেছে। মৃত্যুর সংখ্যাটা কমিয়ে বলেছে চীন।
এখন সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের বর্বরভাবে হত্যা করার পর চীন বলছে তাদের সৈন্যও মরেছে। আসলেই কি মরেছে? নাকি চীন বাড়িয়ে বলছে?