১২০. একাকার হয়ে যাই

১২০

“কলকাতা একটা অদ্ভুত শহর। এর নিশ্চয়ই নিজস্বতা কিছু আছে। এই শহরে যারা একবার বসবাস শুরু করে তারা আর অন্য কোথাও যেতে আগ্রহ বোধ করে না। গেলেও তারা কলকাতায় ফিরে আসার কথাই বোধ হয় ভাবে। কিন্তু আমার মনে হয় লন্ডন, নিউ ইয়র্ক বা মস্কোও কি তাই নয়? এইসব শহরের অধিবাসীরা কেউ আর কারও মতো নয়, প্রতিটি শহরেরই পরিবেশ ভিন্ন, ভিন্ন তাদের ভূগোল ও ইতিহাস, ভিন্ন তাদের জীবনযাত্রা। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মস্কো বা কলকাতা কেউ কারও মতো নয়। আবার এক অর্থে ওরা সবাই সেই মহানগরী—সেই নরক, যাকে হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয় কুম্ভীপাক। যার মধ্যে হাজারো রকমের মানুষকে মিশিয়ে পাক খাওয়ানো হচ্ছে নানা জীবিকায়, নানা মতলবে, নানা আশা বা বঞ্চনায়!

“আমি এইসব শহরের চুম্বকের মতো আকর্ষণের কথা ভেবেছি। কিসের এই আকর্ষণ? জীবিকা? বৃহত্তর সুযোগ? নানা সম্ভাবনা? হ্যাঁ, এ সবই সত্যি। কিন্তু এর অতিরিক্তও কিছু আছে। মহানগর মানেই একটি জঙ্গম, চলিষ্ণুতা। এখানে সারাক্ষণ একটা জীবনের প্রবাহ চলেছে, চলেছে নানা কর্মকান্ড। এই জঙ্গমতাই কি আকর্ষণ করে মানুষকে? কলকাতায় যে ঠেলাওলা দিনরাত খেটে দেশে টাকা পাঠায় সেও কি অনুভব করে এই আকর্ষণ?”

এইভাবেই কৃষ্ণজীবন শুরু করল তার ‘হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্’। গ্রন্থটির বিষয় কলকাতা এবং কলকাতার সূত্র ধরে পৃথিবীর আরও নানা শহর।

এক জায়গায় কৃষ্ণজীবন লিখল, “সেদিন শীতের এক সন্ধ্যায় আমি একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। হিন্দু বিয়ে। হিন্দুরা বর্ণাশ্রম মানে। এই বিয়ের পাত্র-পাত্রীরাও একই বর্ণের। তাছাড়া তাদের মধ্যে পূর্বরাগও ঘটেছে। খুবই সুখী বিয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। সেই বিয়েবাড়ি আর পাঁচটা বিয়েবাড়ির মতোই হুবহু একরকম। ভাড়া করা বিয়েবাড়ি সাজানো হয়েছে ফুল আর আলোয়। বেনারসী ও গয়নার ঝিলিক চারদিকে। মৃদু হাসি, আড্ডা, ক্যাটারারের পরিবেশিত সখাদ্য সবই যেন একরকম। শুধু অবাক কাণ্ড, পাত্র-পাত্রী ও নিমন্ত্রিত ইত্যাদিদের দেখে আমার যেন মনে হচ্ছিল, এটা এর আগে একশোবার দেখা একটা বিয়েরই রিপ্লে। এই পাত্র-পাত্রীরা যেন এর আগে আরও বহুবার বিয়ে করেছে, একই নিমন্ত্রিতরা এসেছে, একই ক্যাটারার একই খাবার দিয়েছে। সেই বিয়েবাড়িতে হঠাৎ আমার মনে হল, মানুষ কি সঙ্ঘবদ্ধভাবে নিজেরই পুনরাবৃত্তি করে মাত্র?”

লিখতে লিখতে কৃষ্ণজীবন আপন মনে হাসে, কখনও মাথা নাড়ে, কখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যে বিয়েবাড়ির কথা সে লিখছিল তা তার চোখের সামনে ভিডিওতে তোলা ছবির মতো ভেসে যেতে লাগল। ঝুমকিকে একটা নীল বেনারসীতে চমৎকার দেখাচ্ছিল। পোশাক মানুষকে ততটা সুন্দর করতে পারে না, যতটা পারে অভ্যন্তরীণ আনন্দের আভা যখন বিকীর্ণ হয় তার অবয়বে। এক মনোরম গেট টুগেদারের মতো সেই বিয়ে কি বস্তুতই ছিল আরও পাঁচটা বিয়ের রিপ্লে? না, তা নয়। কৃষ্ণজীবন লিখবার জন্য লিখল। অনেক সময়ে আসল অভিজ্ঞতার ওপর একটা দার্শনিকতার প্রলেপ দিতে হয়।

সেই বিশাল বিয়েবাড়িতে অনেক আনাচকানাচ ছিল। যাকে ইংরিজিতে বলা হয় নুক্‌স্ অ্যান্ড করনারস্। একটা পামবীথি ছিল আর তার ওপাশে ছিল একটা ফুলের ঝোপ।

সে আর অনু বসেছিল পাশাপাশি।

অনু বলছিল, আচ্ছা বিয়েবাড়ি আপনার কেমন লাগে?

ভাল নয় অনু। আজকাল একদম ভাল লাগে না।

কেন ভাল লাগে না?

ভিড় আজকাল আমার সহ্য হয় না। গ্যাদারিং দেখলেই রিপালসন হয়।

যেখানে গ্যাদারিং-এ আমি আছি সেখানেও ভাল লাগে না?

তুমি খুব দুষ্ট আছ।

বলুন না!

তার হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্-এ অকপট কৃষ্ণজীবন লিখল, “এ মেয়েটা কি আমার প্রেমিকা? এর সঙ্গে আমার বয়সের তফাত পয়ত্রিশ বা ছত্রিশ বছর। আমার মেয়ের বয়সী এবং তারই বান্ধবী। মোহগ্রস্ত দুখানা চোখে যখন আমার চোখের দিকে চেয়ে আকুলভাবে একটা মৃদু ও প্রশ্রয়ী হুঁ শুনতে চাইছিল মেয়েটি তখন আমার দূরকম কথা মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে করলে আমি মেয়েটিকে এমন রূঢ় কথা বলতে পারি যাতে ওর মোহ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। আবার ইচ্ছে করলে ও যা শুনতে চাইছে তাই বলতে পারি। আমি একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ একজন তরুণীকে কী বলব? আমি যেন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এ মেয়েটির প্রতি কি আমি আসক্ত? আমি কি অন্ধ, বিচারবোধহীন, মোহগ্রস্ত কামের শিকার? এ কি গড়ানে বয়সে তরুণী-হৃদয়ের জন্য দুর্মর আকাঙ্ক্ষা? নাকি নর ও নারী এরা কোনও বয়স বা সম্পর্কের শর্তে আবদ্ধ নয়? কিন্তু আমি বহুদিন ধরে পশ্চিমী সমাজের ব্যভিচার ও যৌনবিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমার বরাবরই অপছন্দ বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক। তবু কেন এই মেয়েটির চোখের দিকে চেয়ে আমি কিছুতেই বলতে পারছি না, না!

“বরং আমি বললাম—খুব পুষ্পিত ভাষায় না হলেও—বললাম, তোমার কথা আলাদা। তোমার টানেই তো আসা।।

“এ আমি কী বললাম? এই অপরিণতবুদ্ধি, সবে বয়ঃসন্ধি পেরোনো, আবেগ-তাড়িত, উদ্বেল-হৃদয় মেয়েটি আমার প্রেমে পড়ে গিয়ে থাকলেও একদিন যে এর চৈতন্য ফিরবে। ফিরবে বাস্তববোধ। এ যে কত বড় ভুল করেছিল তা যেদিন বুঝতে পারবে সেদিন কি ছুঁড়ে আমাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে না?

“কিন্তু পূর্বাপর চিন্তা করে মানুষ ক’টা কাজই বা করে? মেয়েটি উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে চেয়ে, আমার একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠল, সত্যি বলছেন? শুধু আমার জন্য?

“আমার বড় মায়া আর করুণা হচ্ছিল। কীই বা ওর বয়স, কত সম্ভাবনা পড়ে আছে ওর জীবনে। এই পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মানুষের মুখের সামান্য স্তোকবাক্য শুনে ওর ঠোঁটে ভাঙছে বাঁধভাঙা আনন্দের হাসি, নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে আবেগে, গর্বে ভরে উঠছে বুক।

“সে আমার হাত ধরে বসে রইল অনেকক্ষণ। বিয়েবাড়ি, যে কেউ যখন তখন এসে পড়তে পারে। কিন্তু তার পরোয়া নেই। এইটেই তো বেহিসেবী হওয়ার বয়স। কিন্তু আমার বয়স তো বেপরোয়া বয়স নয়। আমার হৃদয়ে আজ অনেক হিসেব-নিকেশ, অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তবু তার হাতে হাতটি সমর্পণ করে বসে থাকা ছাড়া আর আমার কিছুই করার ছিল না।

“আমাদের এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী। —বাস্তবিক আমরা সেই সন্ধেয় বোধ হয় অমরাবতীর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম।

“সে বলল, আমি আপনাকে এত ভালবাসি, কিন্তু আপনি আমাকে একটুও না।

‘প্রেমিক প্রেমিকারা প্রলাপ বকেই থাকে। তাদের কথার কোনও মাথামুণ্ডু হয় না। হলে তা আর প্রেমের সংলাপ থাকে কি? আমিও সেই সন্ধ্যায় প্রলাপের স্রোতে ভেসে গেলাম কিছু দূর। বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও… আমিও…

“আমি—পঞ্চাশোর্ধ্ব—তিন ছেলেমেয়ের বাবা, দায়িত্বশীল একজন মানুষ কি করে ভেসে যাচ্ছি?

“উজানে ফেরে না নদী। সেই সন্ধ্যায় আমি তবু ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি আমার কৈশোরকালে। আচ্ছা, এই যে আমাদের বয়স হয়, এই যে আমরা সেকেন্ড-মিনিট-ঘন্টা-দিন-মাস-বছর পেরিয়ে আসি এটা আসলে কী? সময় বলে কিছু আছে? বয়স বলে কিছু? এ তো আমাদের মনগড়া একটা কল্পনা মাত্র। অ্যাবস্ট্রাক্ট। আসলে সত্যিই কি আমি মধ্যবয়স্ক? ওটা তো ধারণা মাত্র।

“মানুষ সবসময়েই চেষ্টা করে, তার যত দুর্বলতা, যত বৃত্তি-প্রবৃত্তির তাড়না, যত লোভ-লালসা সব কিছুকেই একটা যুক্তিসিদ্ধ ভিতের ওপর দাঁড় করাতে। সে হয়তো জানে, মনে মনে জানে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তবু নানা পাল্টা যুক্তি দিয়ে সে সেটাকে সমর্থন করার পথ খোঁজে। ভেবে দেখলাম, মানুষ নিজের দুর্বলতাকে ছাড়তে চায় না। সে নিজে দুর্বলতাগুলিকে বড় ভালবাসে। ভালবাসে বলেই তাদের গৃহপালিতের মতো পুষে রাখে।

“সেই বিয়ের রাতটি এইসব কারণেই আমি ভুলব না। সেই রাতে বাড়ি ফিরে আমি ছাদে উঠে এসেছিলাম। শীতকাল। এত রাতে ছাদে কেউ নেই। আমি গভীর রাত অবধি ছাদে বসে থেকে এই মহানগরীর আলো ও অন্ধকার দেখতে দেখতে কত দূরে যে চলে গেলাম। মন—মনই তো সব মানুষের। সর্বোত্তম পুঁজিপাটা। মন দিয়েই মানুষ সব কিছু গড়ে নেয়। মনের মতো শক্তিশালী কিছুই হয় না। মধ্যবয়স্ক আমাকে সেই পরিয়ে দিতে পারে তারুণ্যের মুকুট। মনই রচনা করে প্রেম। মনই এই শহরের দেয়ালে দেয়ালে, আকাশে-বাতাসে এঁকে দেয় নানা বর্ণের ছবি। মনই ভালবাসে, ঘেন্না করে, রাগ-আক্রোশ-বিদ্বেষ-মোহ— সবই তো মন। সে এক দুষ্টু দামাল ছেলে, শাসন মানে না, আইন মানে না, সভ্যতা মানে না। এই দামালকে কি করে যে ঘরে ফেরাই!

“অনেক রাতে আমার ছোট ছেলে দোলন উঠে এল ওপরে। সে মাঝরাতে কখনও কখনও টয়লেটে যায়। তখন সে আমার ঘরে গিয়ে একবার আমাকে দেখে একটু আদর করে আসে। সে এখন আর ছোটটি নেই। বয়ঃসন্ধি পেরোচ্ছে। দোলনের সঙ্গে আমার একটা অদ্ভূত সম্পর্ক আছে। অন্য সকলের কাছে সে বেশ পরিণত এক কিশোর। কিন্তু যখনই আমার কাছে আসে তখনই সে একেবারে শিশু হয়ে যায়। হয়তো মানুষের মধ্যে শিশু হওয়ার একটা জন্মগত প্রবণতা থাকে। আমারও আছে। দোলন আমার সঙ্গে গল্প করতে ভালবাসে। তার প্রিয় বিষয় মহাকাশ। আমরা মাঝে মাঝে টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহাবলোকন করি। কখনও তাকে নানা নক্ষত্র চিনিয়ে দিই। ওই অসীম শূন্যের প্রতি তার আকর্ষণ তীব্র। মাঝরাতে সে যখন ঘরে আমাকে খুঁজে না পেয়ে ছাদে উঠে এল তখন আমি ভূতগ্রস্তের মতো বসে আছি।

“বাবা, তুমি কি করছ?

“আমি হেসে বললাম, বসে আছি। আজ ঘরে মন টিকল না। তুমি ঘুমোওনি?

“ঘুমিয়েছিলাম। টয়লেট থেকে ফেরার সময় দেখলাম, তুমি ঘরে নেই। ভাবলাম নিশ্চয়ই ছাদে এসেছো। তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না বাবা?

“লাগছে। তবে কলকাতায় আর তেমন শীত কই?

“দোলনের সঙ্গে নেমে এলাম আমার ঘরে। দুজনে পাশাপাশি লেপের তলায় শুয়ে কিছুক্ষণ গল্প হল। তারপর দোলন ঘুমিয়ে পড়ল। আমার ঘুম এল না। আমি ওর আবছায়া মুখখানার দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, আমি যদি ব্যভিচারী হয়ে যাই তাহলে দোলন আমাকে কী চোখে দেখবে। আমি যদি ওর মাকে ডিভোর্স করে মেয়ের বয়সী একটি তরুণীকে বিয়ে করে আনি তাহলে আমার এই রচিত সম্পর্কের সংসার মিসমার হয়ে যাবে না কি? ভেঙে পড়বে সব সম্পর্ক। মানুষ এইসব ভেবেই তো সংযত রাখে নিজেকে। এইসব মূল্যবোধ অনেক সময়ে মানুষকে রক্ষা করে। অনেক সময়েই করে না। এইসব ভাঙচুর, এইসব সম্পর্কের অবসানই সারা পৃথিবীতে পরিবার-প্রথার অবলোপ ঘটাচ্ছে। মানুষ হয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন ও একা। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মানুষও হয়ে পড়ছে অনাত্মীয়। এ এক বিষম পরিস্থিতি।

“গভীর রাতে সন্তানের মুখের দিকে আমি সম্মোহিতের মতো চেয়ে ছিলাম। আমার প্রাণাধিক প্রিয় এই পুত্রটি আমি আমার বলে জানি, তাই এত ভালবাসি। কিন্তু এমন যদি হত যে, আমি জানি না যে, পুত্রটি আসলে আমার নয়, হয়তো অন্য কারও ছেলে, নার্সিং হোমে রদবদল ঘটে গেছে। সে ক্ষেত্রেও একটি বিভ্রম কাজ করবে— পুত্রটি আমার— এই বোধ। তাহলে কি আমি আসলে নিজের বলে না ভাবতে পারলে কোনও কিছুকেই তেমনভাবে ভালবাসতে পারি না। অহং-ই কি মানুষের প্রীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে? আধুনিক মানুষ হয়তো এই অধিকারবোধ থেকে, দায় ও দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাইছে। তাই তারা তুলে দিচ্ছে বিবাহ নামক বাহুল্য অনুষ্ঠানটিকে। বিলোপ করছে পরিবারপ্রথা। তারা চাইছে মানুষের সন্তান-সন্ততি আর পিতৃপরিচয় বহন না করুক। তার দরকার নেই! হয়তো এ সমস্তই পুরনো কুসংস্কারমাত্র।

“যদি পৃথিবী ক্রমে ক্রমে সেই মুক্ত সম্পর্কের সমাজে পৌছয় তাহলে কেমন হবে সমাজের চেহারা? কেমন হবে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক? কেমন হবে সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার আত্মীয়তা? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার খুব ভয় হল। আমি হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমার ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বললাম, না না, এরকম হবে না। এরকম হতেই পারে না।

“আবার ভেবে দেখেছি, আমি আঁকড়ে ধরতে চাইলেই বা কি? সন্তানসন্ততিরা তো সত্যিই আর বাবা-মায়ের সম্পত্তি হয়ে থাকে না। তারা বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে চলে যায়, বাবা-মা পড়ে থাকে। আগে শুনতাম, জাপান হচ্ছে শিশুদের স্বর্গরাজ্য—সেখানে শিশুদের সমাদর সবচেয়ে বেশি, যৌবনের কদর আমেরিকায়, আর বৃদ্ধের সম্মান ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষে একসময়ে তাই ছিল। প্রবীণরা কখনও অবহেলিত ছিলেন না এখানে। পরিবারের কতা, সমাজের মাথা, পাঁচজনের পরামর্শদাতা। কিন্তু এখন কলকাতা এবং তার আশপাশে ক্রমেই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। অবহেলিত পিতামাতার জন্য এক একটা নির্বিকার আশ্রয়। সন্তানরা আর মা বাবার জন্য সময় দিতে পারছে না, নিতে পারছে না দায়িত্ব। আমিও তো পঞ্চাশ পেরিয়ে এলাম। বুড়ো বয়সের আর বাকি কী? আজ গভীর রাতে পুত্রের প্রিয় মুখশ্রী অবলোকন করতে করতে ভাবলাম, হায় মন, তুমি কত ভুলই না রচনা করলে, সৃষ্টি করলে কত কল্পমায়া! প্রগাঢ় বিষাদে ডুবে আমি রাত কাটিয়ে দিলাম এইসব লিপিবদ্ধ করে।”

বুকের মধ্যে আজকাল একটা কষ্ট হয় কৃষ্ণজীবনের। সেটা শারীরিক কষ্ট নয়। মানসিক। সবসময়ে একটা হাহাকার যেন ধ্বনিত হচ্ছে ভিতরে। আজকাল সে প্রায়ই চলে যায় বিষ্টুপুর। স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দিগন্ত পেরোয়।।

বিষ্টুপুরে মা আছে। মায়ের কাছে চুপচাপ বসে থাকতে কিছুক্ষণ তার ভালই লাগে। সে আর শিশু কৃষ্ণজীবন নয়। বয়স্ক এক দায়িত্ববান পুরুষ। তবু কেন মায়ের কাছে এই বসে থাকা তার প্রিয়?

হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্-এ সে লিখল, “আমার এই দুঃখী ও দরিদ্র মা আমাকে কিছুই আর দিতে পারে না। তবু এই যে তার ছায়ায় এসে কিছুক্ষণ বসে থাকি সে শুধু একটা কারণেই। পৃথিবীতে বোধ হয় একদিন মা ডাকটিরও অবসান ঘটবে। লন্ডনের এক বৃদ্ধ সাহেবের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। অশীতিপর সেই বৃদ্ধ আমাকে কেবলেই বলে, ওন্ড লন্ডন কত ভাল ছিল। সেই লন্ডন আর নেই। লন্ডনের গল্প করতে করতে সে প্রায়ই বলে, তার মায়ের মতো এমন চমৎকার পাই সে জীবনে আর কখনও খায়নি। সাহেবরা ভাবাবেগপ্রবণ জাত নয়। তারা মা বাবার স্মৃতি নিয়েও পড়ে থাকে না। কিন্তু কারও কারও হয়তো এখনও কিছু বোধ আছে। মা এক মহান ও আশ্চর্য মহিলা। একজন মহিলা যখন মা হয় তখনই সে সন্তানের কাছে এক মহার্ঘ ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ। আমি এক দারিদ্র্যপীড়িত সংসারে জন্মেছি বলেই জানি, মায়েরা সন্তানের জন্য কত অনন্ত ত্যাগ করতে পারে। আমার এই মা সর্বদাই তার ভাগের খাবার থেকে এক মুঠো ভাত সরিয়ে রাখত আমার জন্য। আমার খিদে বেশি, অনেকটা পথ হেঁটে ইস্কুলে যাতায়াত করতে হয়, লাঙল চালিয়ে করতে হয় চাষবাস। মা আমার খিদে বুঝত। একমাত্র মায়েরাই যা বোঝে। মা জাতিই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে কি?”

একদিন হেমাঙ্গর ফোন এল, কৃষ্ণজীবনবাবু, আমরা রোববার একটা গেট টুগেদার করছি। আসবেন?

রবিবার? বেশ তো।

আবার হুট করে বিদেশে চলে যাবেন না তো!

না। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেখালেখির কাজ আছে। মার্চে যাবো।

এখন আপনি কী লিখছেন?

কৃষ্ণজীবন হাসল, আমার লেখার কিছু মাথামুণ্ডু নেই। আমি এখন যা লিখছি সেটা খানিকটা আত্মজীবনীর মতো। কিংবা তাও নয়। নাম দিয়েছি—হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্।

দার্শনিক লেখা নাকি?

অনেকটা। লেখাটা কিছু হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। শুধু রিফ্লেকশনস। ছোট ছোট ঘটনা। রিঅ্যাকশন।

কারা ছাপবে?

আমেরিকার পাবলিশার। ওরা বলেছে যা লিখব ছাপবে। সেই সাহসেই যা খুশি লিখছি।

লিখুন। হয়তো এটাও হবে মাস্টারপিস।

না, তা হবে না। তবে আমার ভিতরকার বিষন্নতার একটা চিত্র রেখে যাচ্ছি।

আপনি কি বিষন্ন মানুষ?

কে জানে! আনহ্যাপি, ইয়েস। কিন্তু মেলাংকলিক হয়তো নয়। এসব ভারী কথা থাক। হানিমুন কেমন হল?

আমরা গিয়েছিলাম নিশিপুর।

একটু ভেবে কৃষ্ণজীবন বলল, ওঃ, আপনার সেই গ্রাম?

হ্যাঁ। যেখানে আপনাকে আজও নিতে পারিনি। যাবেন একবার?

যাবো। নিশ্চয়ই যাবো।

হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্-এ কৃষ্ণজীবন লিখল, “আমি আজকাল সুখী লোকদের ঈর্ষা করি কিনা কে জানে। এই যে হেমাঙ্গ আর ঝুমকি এক তরুণ দম্পতি, এদের ঝলমলে মুখ, আর উজ্জ্বল সম্পর্ক আমাকে সুখী করল না। ওদের গেট টুগেদারে গিয়ে আমার কেবলই মনে হতে লাগল, এ তো মায়া। এ তো রচিত সম্পর্ক। আঠা কই? জোড় কিসের? শুধু মন, শুধু বিভ্রম জুড়ে রেখেছে এদের। “

হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্ লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে ভীষণ অস্থিরতা বোধ করে কৃষ্ণজীবন। ঘরবন্দী থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে লিখতেও ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে গভীর রাত অবধি ঘুম আসতে চায় না। মাঝে মাঝে মূক-বধিরের মতো আচরণ করে সে। দিনের পর দিন কথা বলে না কারও সঙ্গে। শুধু চুপচাপ বসে থাকে।

এক মধ্যরাতে রিয়া উঠে এল তার ঘরে। একটা ঢাকনা পরানো আলো-আধো অন্ধকার ঘরে কৃষ্ণজীবন বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো। সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞানরহিত। মাথার ভিতরে নানান চিন্তার সত্র পরস্পরের সঙ্গে নানা অন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। অনেক ছিন্ন সূত্র ঝুলে আছে অর্থহীনতায়। কত ছোট টুকরো ঘটনার স্মৃতি গহীন আবছায়ার চেতনার ভিতর থেকে উঠে আসছে। কত তুচ্ছ অর্থহীন ঘটনা। রিয়া যখন ঘরে এল তখন সে একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা ভাবছিল। ছেলেবেলায় একবার হাতে একটা বাতাসা মুঠোয় নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝরাতে অজস্র পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছিল তাকে। পিঁপড়ের কামড়ে উঠে বসে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছিল সে। আলো জ্বেলে দেখা গেল, লাল পিঁপড়েয় ভরে গেছে বালিশ এবং আশপাশ। এই ঘটনার পর সে অবাক হয়ে ভাবত, পিঁপড়েদের খবর দিল কে? কি করে তারা টের পেল কোথায় বাতাসাটা আছে? পিঁপড়েরা কি রাতে ঘুমোয় না? তারা কি অন্ধকারেও দেখতে পায়? নিজের প্রশ্নে প্রশ্নে নিজেই জর্জরিত হত সে। আজও হয়।

রিয়া দু’বার ডাকবার পর কৃষ্ণজীবন ফিরে এল বর্তমানে।

কিছু বলছ?

এত রাত অবধি বসে আছ কেন? কী হয়েছে?

কৃষ্ণজীবন তটস্থ হয়ে বলে, কিছু হয়নি তো!

আজকাল এত অন্যমনস্ক থাকো, আমার ভয় করে।

চল্লিশোর্ধ্ব স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ অপরিচিতের মত চেয়ে থাকে কৃষ্ণজীবন। কোনও কথা আসে না মুখে।

ধীরে ধীরে তুমি কিরকম হয়ে যাচ্ছ বলো তো! আগেও আনমনা থাকতে, চুপচাপও থাকতে। আজকাল যেন বাড়াবাড়ি। কী হয়েছে বলবে?

কৃষ্ণজীবন এবারও কথা বলতে পারল না। তার চোখের সামনে ভাসছে ঘোর বর্ষাকালের একটা দৃশ্য। তিনদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি। স্কুল বন্ধ, বাজারহাট বন্ধ, উঠোনে হাঁটু জল। মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই বারান্দায় বসে জল দেখছে। চুপচাপ। কারও মুখে কথা নেই। টিনের চালে শুধু বৃষ্টির ঝমাঝম। তারা চুপ করে বসে আছে। কিছু করার নেই। রান্নাঘর ভেসে গেছে বলে সেদিন রান্না হয়নি তাদের। পেটে মস্ত খিদে। তবু তারা নিশ্চেষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে আছে। শুধু বৃষ্টি পড়ছে। শুধু বৃষ্টি পড়ছে। কেন মনে পড়ছে দৃশ্যটা? কেন এই অহেতুক স্মৃতি?

কৃষ্ণজীবন অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, কি হয়েছে জানি না। কিছু জানি না।

রিয়া মুখোমুখি চেয়ারে বসল। হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করল হাতে। বলল, চুপচাপ থাকলে আরও বেশি চিন্তা হবে। ওগো, তুমি যা-খুশি কিছু কথা বলো। কথা বললে এই স্পেলটা কেটে যাবে।

কৃষ্ণজীবন বেদনার্ত চোখে রিয়ার দিকে চেয়ে থেকে শুধু মাথা নাড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কাটবে না।

কেন কাটবে না? এত মানুষ, কই কেউ তো তোমার মতো এত ভাবে না। তুমি কেন এরকম হয়ে যাও? ছেলেমেয়েরা অবধি তোমার জন্য চিন্তা করছে। দোলন বারবার জিজ্ঞেস করে, বাবার কী হয়েছে মা? আমি বলি, তোমার বাবা বই লিখছে তো! তাই ভাবছে। কিন্তু আসলে তো তা নয়। তোমার ডিপ্রেশন চলছে। কেন গো?

বিস্ফারিত দুই চোখে রিয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কৃষ্ণজীবন অস্ফুট গলায় বলল, অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।

কি বলছ?

আজ যদি স্মৃতিভ্রষ্ট হই, কি করে বুঝবো যে তুমি রিয়া? বস্তুর চতুর্থ মাত্রা হল সময়। আইনস্টাইন বলেছিলেন। কিন্তু বস্তুর আরও কত মাত্রা আছে। পঞ্চম মাত্রা হল স্মৃতি, নহলে বুঝব কি করে কোনটা কী? ষষ্ঠ মাত্রা হল ইমাজিনেশন, পারসোন্যাল ভিশন। চারদিকে এই যে এত বস্তুপুঞ্জ দেখছো, সে সবই আমাদের কল্পনার রঙে রঙিন। নইলে কিছুই নয়।

রিয়া উঠে এসে কৃষ্ণজীবনের মাথাটা বুকে চেপে ধরল, এরকম করছ কেন? কেন এরকম সব অদ্ভুত কথা বলছ? আমি যে ভয় পাচ্ছি। কেন দূরে সরে যাচ্ছ?

রিয়ালিটিকে বুঝতে পারো রিয়া?

তোমার মতো করে কি পারি? আমি আমার মতো করে দেখি, বুঝি।

বুঝতে গেলে ইউ হ্যাভ টু লাভ, ইউ হ্যাভ টু লাভ। তুমি কি জানো মানুষ কত দেউলিয়া হয়ে গেছে ভালবাসায়? কত দেউলিয়া? ভাত কাপড়ে নয়, বস্তুপুঞ্জে নয়, মেধায় নয়, দেউলিয়া শুধু ভালবাসায়।

কেন ও কথা বলছ? এই যে আমি তোমাকে এত ভালবাসি এ কি মিথ্যে? তুমি ছাড়া আমাদের যে জগৎ অন্ধকার।

কৃষ্ণজীবন নিঃঝুম হয়ে চোখ বুজে রইল। তার চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগল চোখের জল।

হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্-এ সে লিখল, “বস্তুর পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম মাত্রাতেই থেমে থাকে না তার প্রকৃত পরিচয়। আমাদের অজ্ঞাত আরও বহু মাত্রাও হয়তো রয়ে গেছে। আমরা কতটুকু জানি? অবিরত নানা মতবাদ, নানা দর্শন মানুষকে আবিল করে দেয়। মানুষের মন সব সময়েই জারিত হচ্ছে অন্যের ভাবনাচিন্তার প্রভাবে। সে যা দেখে, যা বোধ করে, যা বোঝে সবই ওই সব মতবাদ ও প্রভাবের দ্বারা চালিত হয়ে। যদি মানুষের মন রিক্ত থাকত, যদি হাঁসের পালকের মতো ঝেড়ে ফেলতে পারত সব প্রভাব তবে কি সে বস্তুর স্বরূপকে ধরতে পারত? আমি তাই প্রথম মানবের কথা ভাবি। একমাত্র সে-ই অনাবিল চোখ ও মন নিয়ে দেখেছিল এই বস্তুবিশ্বকে। আমি আজ ঠিক তার মতো মন আর চোখ চাই।”

শীতের কবোষ্ণ সোনালি রোদে ভরে আছে মাঠঘাট। মাঝে মাঝে কৃষ্ণজীবন বেরিয়ে পড়ে হারা-উদ্দেশ্যে। পায়ে হেঁটে হেঁটে দূরদূরান্তে চলে যায় অচেনা গাঁয়েগঞ্জে। কখনও অচেনা চাষীবাড়িতে ঢুকে যায়। বসে, গল্প করে। কখনও গাছের মাথায় বসে-থাকা একটি পাখির দিকে চেয়ে থাকে। কখনও হাঁ করে চেয়ে দেখে, বাঁশগাছের ডগা দুলছে উত্তুরে হাওয়ায়। এ পৃথিবী তার বড় প্রিয়। বড় প্রিয় এই মনুষ্যজীবন। মুখ নয়, তার মন নানা কথা বলে যেতে থাকে। বলে, ভালবাসা ছাড়া আর কী আছে মানুষের? মানুষ কেন ভুল মুক্তির খোঁজে নষ্ট করে ফেলছে এই মহার্ঘ জীবন?

“শীতের দুপুরে আমি বকুলপুর নামে একটা গাঁয়ে এক তাঁতঘরে বসে দেখছিলাম, অনাত্মীয় সুতো কেমন টানা-পোড়েনে পড়ে পরস্পরের সঙ্গে রচনা করছে সম্পর্ক। ফুটে উঠছে নকশা। তৈরি হচ্ছে ঘনবদ্ধ কাপড়। এই তো, কী সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা! টানা-পোড়েন, টানা-পোড়েন। দৃশ্যটা আমার এত ভাল লাগল যে কী বলব! মনটা ভরে গেল।

“ভালবাসা এক অনুশীলনসাপেক্ষ ব্যাপার। ভাবের ভালবাসা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। আমার জল-বসন্ত হয়েছিল বলে আমার এক প্রিয় বন্ধু আমার বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর আমার মা জেগে বসে থাকত আমার শিয়রে। দিনরাত সেবা করত। যাকে ভালবাসো তার জন্য কিছু করো। তাকে কিছু দাও। রোজ দাও। প্রতিদান চেও না।“

ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের হস্টেলে একদিন গোপালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কৃষ্ণজীবন। তাকে দেখে কী আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল গোপালের মুখ। ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। কৃষ্ণজীবন তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। গোপালের বুকটা ধকধক করছে আনন্দে।

কেমন আছিস রে গোপাল?

গোপাল তার মুখের দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল। মুখে হাসি, কেবল হাসি। অনেকক্ষণ ছিল কৃষ্ণজীবন। গোপালের জন্য চকোলেট, বিস্কুট, টি-শার্ট এনেছিল। দিল। যতক্ষণ ছিল কৃষ্ণজীবন, গোপাল তার মুখ থেকে চোখ সরালই না।

ছেড়ে আসতে বড় কষ্ট হচ্ছিল কৃষ্ণজীবনের। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ভাল থাকিস। আমি আবার আসব।

ছুটিতে বিষ্টুপুর গিয়ে গোপাল তার দাদুকে খুঁজেছিল এ-ঘর ও-ঘর। নানা শব্দে, ইশারায় জানতে চেয়েছিল দাদু কোথায়। মৃত্যু কী জিনিস তা সে আজও জানে না। তাকে বোঝানো যায়নি। যতদিন ছিল ততদিন দাদুকে খুঁজে বেড়াত সে। এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর।

দৃশ্যটা হোয়েন আই মিট মাইসেলফ্-এ বর্ণনা করল কৃষ্ণজীবন। লিখল, “আমিও আজ ওই মূকবধির বালকটির মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর। খুঁজতেই হবে। খোঁজাই যে আমার কাজ। খোঁজাই যে জীবন।….”

মাঝরাতে রিয়া ফের উঠে এল।

ঘুমোওনি?

কৃষ্ণজীবন তার বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে বলল, না।

রিয়া কাছে এল। নরম করে চেপে ধরল নিজের বুকে কৃষ্ণজীবনের মাথা।

শুয়ে পড়ো না গো! একটু বিশ্রাম নাও।

ঘুম আসবে না।

এসো আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।

কৃষ্ণজীবন রিয়ার মুখের দিকে শিশুর মতো চেয়ে থেকে বলল, আজ কাঁদব। আজ ঘুমোবো না।

ও মা! ও কী কথা? কাঁদবে কেন? ওরকম বোলো না, ভয় পাই।

কৃষ্ণজীবনের মুখ নয়, মন কথা বলছিল। বলছিল, এসো আমার সঙ্গে তুমিও কাঁদো, এসো কান্নায় একাকার হয়ে যাই। একাকার হয়ে যাই।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *