১২. ইসলামের প্রসার
জীবনীকার আল-ওয়াকিদীর মতে, মোহাম্মদ বলেছিলেন বলে কথিত : আরবে দুটি ধর্ম থাকতে পারে না। ইসলাম ছাড়া আরব ভূমিতে আর কোনো ধর্ম থাকবে না।
প্রফেটের মৃত্যুর পূর্বে ধর্মীয় ‘শুদ্ধি’ অভিযানের যে প্রক্রিয়া মোহাম্মদ আরম্ভ করেছিলেন তা অধিকতর গুরুত্ব লাভ করল। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রথমেই আরব ভূমি থেকে বিতাড়িত করা হলো, তাঁর যেসব বিজিত এবং ধর্মদ্রোহী আরব গোত্র বাকি ছিল তাদেরও সাইজ করা হলো। এটা সারা হলে, ইসলামের অগ্রদূত বিদেশী রাজ্যের দিকে ধাবিত হলো। এই রাজ্য বিস্তারের প্রক্রিয়া মুসলিমরা সাফল্যজনকভাবে শেষ করেন প্রথম চার খলিফা আবু বকর, ওমর ও ওসমান এবং আলী আর উমাইয়া রাজবংশের প্রথম কয়েকজন খলিফা।
১২.১ মদিনা খালিফেট (৬৩২ – ৬৬১)
আবু বকর (৬৩২-৩৪) মোহাম্মদের উত্তরাধিকারী রূপে খলিফা নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর তার প্রথম উদ্দেশ্যে হলো ইসলামের পতাকাতলে আরবদের একত্র করা। আরব গোত্রের অনেকেই যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, যখন মোহাম্মদ বেঁচে ছিলেন, তারা করেছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে মালে-গণিমতের ভাগ পাওয়ার লোভে; আর অনেকেই ছিল যারা প্রাণের ভয়ে এবং তরবারির মুখ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল।
আবু বকর যখন খলিফা হলেন তখন অনেক আরব গোত্র মনে করল, এখন আর ধর্মের দিক থেকে কোনো ভয় নেই এবং মোহাম্মদের সাথে যেসব চুক্তি সই হয়েছিল তার শর্ত পালন না করলেও চলবে। তাই তারা চুক্তি ও ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে তাদের পূর্ব ধর্মে ফিরে গেল। ইবন ইসহাক লিখছেন- যখন আল্লাহর রসূল মারা গেলেন অধিকাংশ মুসলিম ইসলাম পরিত্যাগ করতে মনস্থ করে, তাই অধিকাংশ মুসলিম ইসলাম ধর্ম ছেড়ে নিজের ধর্মে ফিরে গেল বা অনেকে নতুন প্রফেটরূপে নিজেদের ঘোষণা করল। অনেকে মুসলিম শাসন অমান্য করে গোত্র প্রধানের আনুগত্য গ্রহণ করল এবং কর দিতে অস্বীকার করল। আরবে চতুর্দিকে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়তে দেখা গেল, অসন্তুষ্টি ও ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে গেল (আল বা ইদাবী এবং অন্যেরা ধর্মদ্রোহী গোত্রের একটি লিস্ট তৈরি করেছিলেন)।
ধর্মত্যাগীদের মধ্যে অনেকেই আদিম বেদুইন গোত্রভুক্ত দুর্ধর্ষ ও বিশৃঙ্খলধর্মী এবং আদিমকাল থেকেই অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতক, হিংস্র শ্রেণীর, যাদের আবাসিক আরবরা বন্যপশুর সাথে তুলনা করত। এদের সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এমিয়ানাস মার্সেলিনাস বলেছেন : ‘আমি তাদের বন্ধু বা শত্রু বলে পেতে চাই না।’ তাদের সম্বন্ধে কোরান বলছে— “কুফরী ও কপটতায় মরুবাসীগণ কঠোরতর’ (৯ : ৯৮)।
এই সব দলত্যাগী বিরুদ্ধে খলিফা আবু বকর তাদের দলে ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন যাকে ‘ধর্ম বিরোধী’ বা রিদ্দা যুদ্ধ বলা হয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই সব বিদ্রোহীকে দমন করা হয় এবং বিক্ষুব্ধ গোত্রদের বশে আনা হয়। এই যুদ্ধের অধিকাংশ অভিযানে খালিদ ইবন ওয়ালিদ শীর্ষ ভূমিকায় ছিলেন।
প্রফেটের জীবদ্দশায় আরবের অধিকাংশ অঞ্চল কখনো মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেনি তারা ছিল প্যাগন, ইহুদি বা খ্রিস্টান। এখন এদের মধ্যে অধিকাংশ ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হলো বিশেষ করে ৬৩৪ সালে ইয়ামামার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর প্রফেটের রাজত্বকালেই ইহুদিদের আরব দেশ থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। খ্রিস্টানদেরও বেশির ভাগ বিতাড়িত করা হয় এবং বাকি যারা ছিল তাদের প্রাণের বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। এই দমননীতির ফলে দু’বছরের মধ্যে সারা আরব ভূমি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং প্রফেটের ইচ্ছা পূরণ হয় অর্থাৎ আরবে এক ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম রইল না।
এই ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় আবু বকরকে সময় সময় নিষ্ঠুর হতে হয়েছিল, যেমন একজন লুণ্ঠনকারী আল ফুজাকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং এক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় একজন সমকামী Sodomist হাবার ইবন আসওয়াদকে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা হয়। ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলা হলো এই কারণে যে এই উদাহরণের পরেও সমকামিতা আরবে বন্ধ হয়নি।
একটি বর্ণনায় বলা হয় আবু বকরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু একটি হাদিসে আছে যে তিনি বিষক্রিয়ায় মারা যান সম্ভবত তাকে ‘শহীদ’ মর্যাদা দানের কারণে। তাকে সমাহিত করা হয়, প্রফেটের কবরের পাশে।
ওমর (৬৩৪-৪৪) দ্বিতীয় খলিফারূপে অভিষিক্ত হন। মোহাম্মদের মৃত্যুর চার বৎসর পরে বিজয়ী মুসলিম বাহিনী সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী স্টেসিফোন অধিকার করেন এবং ৬৩৬ সালে কাদিশিয়ার যুদ্ধে সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের পতন হয়। ঐ একই বছরে হেরাক্লিয়াসকে পরাজিত করে বাইজানটাইনদের কাছ থেকে প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেন।
প্রথমে ওমরের ইচ্ছা ছিল ধর্মীয় সংহতি। আরবের মুসলিম জনসংখ্যা এবং প্যালেস্টাইন বিজয়ের পর তিনি খ্রিস্টানদের সাথে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল প্যালেস্টাইন দখল করা এবং ৬৩৭ খ্রিঃ তিনি তা করেন।
জেরুজালেম বিজয়ের পর মুসলিমরা এটা প্রমাণ করতে চাইল যে তারা আব্রাহামের দুই ধর্ম—জুদাইজম ও খ্রিস্টানিটি—এই দুই ধর্মের সমতুল্য জেরুজালেম বিজয়ের পর এই স্থান তিন ধর্মের কেন্দ্র স্থান রূপে পরিগণিত (মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান) হয়। জেরুজালেম দখলের পর ওমর কিছু সময়ের জন্য তার সেনাবাহিনীকে নতুন কোনো অভিযানে প্রেরণ করলেন না, এতে মনে হলো যে, মুসলিমদের রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছা আর নাই। কিন্তু বিদেশী সেনাবাহিনীর ওপর এইরূপ সহজ বিজয় মুসলিম সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করল আরো নতুন নতুন দেশ বিজয়ের জন্য, তাই ইরাক ও সিরিয়ার বাকি অংশটুকু দখলের পর ৬৪২ খ্রিঃ এই অঞ্চলে পারশিয়ানদের সমস্ত ভূমি দখল করে নিল। ৬৪১ খ্রিঃ আলেক্সান্দ্রিয়া দখল সম্ভব হয়েছিল আমর ইবন আল-আস-এর মিসর দখলের পর। আমর ইবন আল-আস পরে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ফুসতাত নগরীর পত্তন করেন যা পরবর্তীতে “কায়রো’ নামে পরিচিত।
৬৪৪ খ্রিঃ মদীনায় মসজিদে প্রার্থনা পরিচালনার সময় একজন পার্শিয়ান ক্রীতদাস আবু লালুয়া তাকে হত্যা করে। আবু লালুয়া পরে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। ওমরের মৃত্যুতে পারস্যবাসীরা অনেক দিন ধরে উৎসব পালন করেছিল।
৩য় খলিফা ওসমান (৬৪৪-৫৬) উমাইয়া বংশোদ্ভূত ছিলেন। আবু সুফিয়ান তাঁর চাচাতো ভাই। মুহম্মদ এই উমাইয়া গোত্রের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য ওসমানের সাথে তাঁর দুই বিধবা কন্যা রোকেয়া ও উম্মে কুলসুমের বিবাহ দেন।
মহানবী বলেছিলেন যে যদি তাঁর তৃতীয় আর একটি কন্যা থাকত তবে তাকেও তিনি ওসমানের হাতে তুলে দিতেন কারণ তিনি ওসমানকে খুবই ভালবাসতেন।
এই দুই স্ত্রীর নিকট থেকে ওসমান কোনো সন্তান পাননি তাই তিনি পরে এক খ্রিস্টান রমণী নাইলার পানি গ্রহণ করেন যিনি তাঁকে একটি কন্যা উপহার দেন।
আবিসিনিয়াতে যারা নির্বাসনে যান তাঁদের মধ্যে ওসমান একজন ছিলেন। ওসমান প্রথমে ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশলি ছিলেন না, তাই দেখা গিয়েছিল যে কুবাতে যখন প্রথম মসজিদ তৈরি হয় তখন তিনি প্রফেটকে এই নির্মাণে কোনো সাহায্য করেন নাই। বদরের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ না করে বসে থাকলেন এই অজুহাতে যে তার স্ত্রী অসুস্থ, তার প্রতিপক্ষরা তাকে এই জন্য ফারার-পলাতক বলে অভিহিত করত। খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হলে তিনি হজের অনুষ্ঠানে কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি কোরানের শেষ সম্পাদনা করেন এবং এই সম্পাদনে তিনি যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছিলেন বলে তাকে দোষারোপ করা হয়। বলা হয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ARIS কুপে প্রফেটের একটি আংটি ফেলে দেন যা তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছিলেন; সেই পারিবারিক আংটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রফেট মোহাম্মদ মারওয়ানের পিতা হাকামকে যে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন ওসমান তা বাতিল করেন এবং হাকামকে মদীনায় ফেরবার জন্য নির্দেশ দেন।
কাব আল-আহবার একজন ইহুদি ছিলেন। ওমরের রাজত্বকালে তিনি মক্কায় আসেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। খলিফা ওসমান কাব আল-আহবারকে অনেক দিক দিয়ে সাহায্য করেন। পরবর্তীতে ‘কাব’ এমন কতকগুলি হাদিস লিখে যান যার মধ্য দিয়ে কিছু ইহুদিতত্ত্ব ইসলামে ঢুকে যায়।
তিনি সন্ন্যাসী আবুদারকে নির্বাসনে পাঠান যিনি প্রফেটের একজন বন্ধু ছিলেন। এ কারণেও তিনি খলিফার সমালোচনা করতেন এবং তাঁরই প্ররোচনায় কাব-আল আহবার নির্যাতিত হয়েছিলেন।
তিনি তার সৎভাই আবদুল্লাহ ইবনে সাদ, যিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, তাকে আশ্রয় দান করেন এবং পরবর্তীতে মিসরের গভর্নর পদে তাকে নিযুক্ত করেন। তিনি তার আর এক ভাই ওয়ালিদ ইবনে ওকবাকে কুফার গভর্নর করেন। ওয়ালিদের পিতা ওকবা মোহাম্মদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন এবং একবার তাঁকে গলা টিপে হত্যা করতে চেষ্টা করেন (আমীর আলী, ৯৬৫, পৃ. ২৯৫)।
তিনি তাঁর কাজিন মাবিয়াকে সিরিয়ার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করেন; এই মাবিয়া আবু সুফিয়ানের পুত্র ছিলেন।
ওসমানের রাজত্বকালে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয় যা পরবর্তীতে মুসলিম ধর্মে একতাকে বিঘ্নিত করে। ৬৫৬ খ্রিঃ একটি বিদ্রোহী দল মদীনায় তারই বাসায় তাকে তরবারির কোপ দিয়ে হত্যা করে। এই সময় তিনি কোরান পড়ছিলেন এবং এই পবিত্র গ্রন্থের একটি পাতা তার রক্তে রঞ্জিত হয়। হত্যাকারীদের মধ্যে আবু বকরের পুত্র মোহাম্মদ অন্যতম।
আলী (৬৫৬-৬৬১) মহম্মদের কাজিন ও জামাতা ওসমানের মৃত্যুর পরে খলিফা হন এবং তিনি রাজধানী মদিনা হতে কুফাতে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর প্রতিপক্ষের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আয়েশা (প্রফেটের স্ত্রী) যিনি আলীর বিরুদ্ধে উটের যুদ্ধ পরিচালনা করে পরাজিত হন। আলীর আর একজন প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন সিরিয়ার গভর্নর মাবিয়া। মাবিয়া ওসমানের হত্যায় আলী জড়িত এই সন্দেহে বিদ্রোহী হন এবং ৬৫৭ খ্রিঃ সিফফিনের যুদ্ধে আলী পরাজিত হন এবং তাঁর খেলাফত আরবিট্রেশন দ্বারা স্থগিত রাখা হয়, যদিও তিনি শাসন পরিচালনা করেছিলেন ৬৬১ খ্রিঃ মৃত্যুকাল পর্যন্ত।
আলী যেহেতু Arbitration-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সেই সময় তার সৈন্যদল থেকে একদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়- এরা খারিজি নামে পরিচিত। এই খারিজিরা আবার অনেক শাখায় বিভক্ত ছিল এবং বহু বছর ধরে ইসলামী খলিফা রাজ্যে যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি করে। ৬৬১ খ্রিঃ কুফার এক সমজিদে আলী যখন প্রার্থনারত সেই সময় আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম তাকে বিষ মেশানো ছুরি দিয়ে আঘাত করলে তিন দিন পর আলী মারা যান। তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছিল জানা যায় না, তবে হাদিস মতে ধরা হয় যে, কুফার একটু দূরে তাঁর কবর হয়েছিল।
৮৫০ খ্রিঃ আব্বাসী খলিফা মুত্তাওয়াক্কেল, আলী ও তার পুত্রদের কবরের ওপর নির্মিত সৌধ ধ্বংস করে দেন।
আলীর পার্টি শিয়া আলীকে প্রথম ইমাম বা নেতা বলে গ্রহণ করে এবং প্রথম ও কেবলমাত্র সত্য খলিফা মনে করে আর তার আগের তিনজন খলিফাকে প্রতারক বলে বিবেচনা করে। ইসলাম ধর্মে শিয়া গোষ্ঠী সুন্নি গোষ্ঠীর সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে এবং এই দুই ইসলামী শাখা একে অন্যের সাথে কখনো আপোষ করেনি। কোনো কোনো শিয়া গোষ্ঠী (Sect) আলীকে উচ্চতর মর্যাদা দেয় প্রফেট মোহাম্মদ তুল্য, কখনো কখনো তার চেয়ে বেশি, সত্যি বলতে কি, শিয়া গোষ্ঠী আলীর দেবত্বে (divinity) বিশ্বাস করে (C. Hurt in SEI. 1974 P. 32)।
আলীর পুত্র হাসান (৬৬১) পঞ্চম খলিফা রূপে বোধ হয় কয়েক মাস মাত্র অধিষ্ঠিত ছিলেন; কিন্তু তিনি অন্য দিকে ব্যস্ত থাকায় খিলাফতে মন ছিল না। তিনি একশত বিবাহ করেন এবং তালাকও দেন, তাই তাকে ‘Great Divorcer’ বলা হয়েছে। রাজকার্যে দুর্বল ও অযোগ্য থাকায় তিনি মাত্র ছ’মাস পরে, তার অধিকার, মোটা পেনশনে মাবিয়ার কাছে বিক্রি করে দেন। এর পর মাবিয়া প্রথম উমাইয়া খলিফা রূপে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
আট বছর পর হাসান তার পত্নীদের মধ্য থেকে একজনের দ্বারা বিষ প্রয়োগে প্রাণ ত্যাগ করেন। এই পত্নীর নাম ছিল জাআদা। আলীর দ্বিতীয় পুত্র হোসেন ৬৮০ সালে, প্রথম ইয়াজিদের খিলাফতকালে কারবালা প্রান্তরে নিহত হন। চারজন খলিফা আবুবকর, ওমর, ওসমান ও আলী সুন্নিদের দ্বারা স্বীকৃত সম্মানিত এবং অর্থোডক্স (রাশেদিন) বলে গণ্য। পরবর্তী মুসলিম জেনারেশন এই চার খলিফার সরলতা, পবিত্রতা ও তাত্ত্বিকতার স্মৃতিচারণ করে তাদের পূর্বপুরুষ (সালাফ) বলে স্বীকৃতি দেয়। অধুনা মিসরে কতকগুলো সালাফিয়া আন্দোলন গজিয়ে উঠেছে। সিরিয়া ও ভারতে ও এই আন্দোলনের ঢেউ সমমনাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।
কিন্তু আসলে এই চার খলিফা (৫ নংসহ) অসময়ে ফুরিয়ে গেছেন ঘাতকদের হাতে কিংবা বিষক্রিয়ায় এবং তাদের রাজত্বকাল চিহ্নিত হয়েছে আত্মকলহ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং প্রায় লাগাতার বিরোধে এই সময় থেকে শুরু হয়েছে দু’টি গোষ্ঠীর (শিয়া ও সুন্নি) মধ্যে চরম গোত্র বিরোধ যা ইসলামের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত সমাধান হয়নি, হবে কিনা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
১২.২ উমাইয়া বংশ (৬৬১-৭৫০)
রাজনৈতিকভাবে আলীকে হত্যার পর উমাইয়া খিলাফত, সিরিয়ান আরব দ্বারা সাহায্যপুষ্ট হয়ে দামেস্ক প্রতিষ্ঠা পায়। আবিদ শামস এর পুত্র উমাইয়ার (আবু সুফিয়ানের দাদা) নামে এই খিলাফতের নাম। প্রথা মতে, হাশিম পরিবারের চির দ্বন্দ্ব। এই হাশিম পরিবারেই প্রফেট মোহাম্মদের জন্ম।
উমাইয়াদের রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্য অপ্রতিহত গতিতে প্রসার লাভ করেছে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে। পূর্ব দিকে মুসলিম বাহিনী আফগানিস্তান (৬৬১) ট্রান্স- অক্সিয়ানা (৭০৯) এবং ভারতে সিন্ধুদেশ (৭১২) দখল করে। পশ্চিম দিকে লিবিয়া (৬৪৩) দখল করে দ্রুতগতিতে উত্তর আফ্রিকা পার হয়ে যায়। প্রথম ওয়ালিদের (মৃত ৭১৫) রাজত্বকালে উত্তর আফ্রিকা বিজয় সম্পূর্ণ হয়ে স্পেন অভিযান শুরু হয়। যদিও ইসলামী রাজ্য পামির থেকে পিরেনিজ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল, উমাইয়া খিলাফতের সময় এই বংশের খলিফারা কিন্তু অ-ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল। আবু সুফিয়ানের বংশধর ও আত্মীয়রূপে, প্রফেট ও তাঁর উল্লেখযোগ্য আত্মীয়দের বিরুদ্ধে অন্তর্কলহ বন্ধ রাখেনি, তিক্ত সম্পর্কই বজায় ছিল এবং প্রায়ই মনে হতো তাদের বংশের ওপর প্রফেট মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা যে অত্যাচার ও অপদস্থ করেছিলেন, তার বদলা বা প্রতিশোধ গ্রহণ করছে।
উমাইয়া খলিফারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক ছিলেন না। একমাত্র দ্বিতীয় ওমর (মৃ. ৭২০) ছাড়া তারা প্রথমে ছিলেন আরব, তারপর মুসলিম। কিছু মুসলিম ঐতিহাসিক তাদের মধ্যে অর্থোডক্স খুঁজে পেতে কষ্ট স্বীকার করেছেন, কিন্তু অনেকেই তাদের দায়ী করেছেন ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার জন্য। কথিত যে, তারা ইসলামকে নতুন একটা পথে পরিচালিত করতে প্রচেষ্টা করেন এবং বিশ্বাসে আঘাত হানেন। সাধারণভাবে তারা প্রফেট মোহাম্মদের ওহিতে অল্পই গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁর মতবাদে আস্থা ছিল ক্ষীণ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, শিয়া-সুন্নির বিরোধ-মাত্রা তারাই বাড়িয়েছেন। তারা জুমার নামাজের সময় মিম্বর থেকে আলীকে অভিশপ্ত করার প্রথা প্রচলিত করেন এবং তা প্রথম দিকের কয়েক জন খলিফা নিয়মিত পালন করে গেছেন এবং লোকজনদের তা করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তারা আলীর পরিবারের অনেক সদস্যদের প্রতি অত্যাচার করেছেন যার ফলে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে আলীপুত্র হোসেনও অন্তর্ভুক্ত।
মক্কা ও মদিনার ধর্মীয় গুরুত্ব কমিয়ে দেয়ার জন্য তারা জেরুজালেমকে গৌরবান্বিত করেছেন। এমনকি তারা মদিনা থেকে প্রফেটের মিম্বর ও লাঠি দামেস্ক সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কড়া প্রতিবাদের মুখে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
মদিনাতে প্রফেট একটা বাজার করেছিলেন জনগণের ব্যবহারের জন্য, নির্দেশ ছিল সেখানে কোনো ভবন নির্মিত হবে না এবং ঐ ভূমির ওপর কোনো করারোপ করা হবে না। এই নির্দেশ অমান্য করে খলিফা মাবিয়া সেখানে দুটি ভবন নির্মাণ করেন এবং খলিফা হিশাম (মৃ. ৭৪৩) তৃতীয় একটি বিরাট ভবন নির্মাণ করেন এবং করারোপও করা হয়।
উমাইয়ারা প্রফেট মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজাকে অতি উচ্চে সম্মান দিত। মক্কাতে তার বাড়ি অনেক দিন ধরে অবহেলিত হয়ে পোড়ো পোড়ো হয়ে যায়। এই গৃহটিকে উমাইয়ারা পুনর্নির্মাণ করে উপাসনালয়ে রূপান্তরিত করে। অন্য দিকে যে বাড়িতে প্রফেট জন্মগ্রহণ করেন, তাকে সাধারণ বাসস্থান রূপে ব্যবহার করা হয়েছে। মক্কা ও মদিনাতে তারা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করেছেন, বিশেষ করে প্রাচীন চিহ্নগুলো যা প্রফেটের সাথে জড়িত ছিল সেগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় আবদুল্লাহ ইবন জুবায়েরের নেতৃত্বে, সেই বিদ্রোহ দমনের সময় মক্কার পুরানো স্মৃতি ও চিহ্ন নিশ্চিত হয়। কাবাঘরেরও ক্ষতি হয়। এই দুই শহরে (মক্কা ও মদিনা) অসংখ্য বাইজানটাইন স্থপতি, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি ও শ্রমিক লাগিয়ে পুনর্নির্মাণের বন্দোবস্ত হয় এবং তারা স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।
খলিফা ওমর প্রবর্তিত প্রথা যেখানে স্থির হয়েছিল উত্তরাধিকারী নির্বাচন শূরার মাধ্যমে হবে— সে প্রথা খলিফা মাবিয়া বাতিল করে মনোনয়ন প্রথা চালু করেন। এইভাবে উত্তরাধিকারী সূত্রে অর্থাৎ মনোনয়নের মাধ্যমে খিলাফত বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই পদ্ধতি পরবর্তী মুসলিম শাসকরা অনুসরণ করে গেছেন।
প্রফেট মোহাম্মদ জুমার নামাজের খুতবা মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে পাঠ করার নিয়ম করেছিলেন। এর বিপরীতে প্রথম দিকের উমাইয়া খলিফারা বসে খুতবা পাঠ করার প্রথা চালু করেন। এছাড়া ‘খলিফাত রসূলুল্লাহ’ পদবির পরিবর্তে ‘খলিফাত আল্লাহ’ পদবির পরিবর্তন করেন। এছাড়া তারা আরও সম্মানজনক পদবি ব্যবহার করে সন্তুষ্ট হতেন, যেমন আল্লাহর খলিফা বা এজেন্ট, পৃথিবীর দয়াময় সুলতান, আল্লাহর ছায়া (জিল্লুল্লাহ)। এই সব পদবি ব্যবহারের জন্য ধর্মীয় ব্যক্তিরা নাখোশ ছিল। এই প্রথা পরবর্তীতে অনেক সময় রাজা-বাদশা-খলিফারা ব্যবহার করেছেন ওসমানী খলিফাদের সময় পর্যন্ত।
উমাইয়া খলিফাদের জীবনধারা ছিল বাইজানটাইন সম্রাটদের মতো। তাঁদের রাজকীয় জীবনযাত্রা শতাব্দি ধরে অনুকরণ করেছিল মুসলিম শাসকরা যেমন- সুলতান, শাহ, আমির, সম্রাট যারা শাসন করেছিল ইরাক, মিসর, মরক্কো, পারস্য, তুরস্ক, ভারত ও অন্যান্য দেশে। অর্থোডক্স মুসলিম ও মোল্লারা উমাইয়া খলিফাদের এই জাগতিক শানশওকতকে ইসলামী ধারণার পরিপন্থী মনে করত।
উমাইয়া খলিফারা তাদের প্রজাদের জোর-জবরদস্তি করে ধর্মান্তর করত না। তাদের ধারণায় ইসলামের অর্থ হলো শাসকের কাছে নতি স্বীকার করা, বিশ্বাসকে গ্রহণ করা নয়। তখন সিরিয়ান আরবদের মধ্যে খ্রিস্টানরা ছিল বেশি শক্তিশালী এবং উমাইয়া খলিফারা তাদের প্রতি নমনীয় ও সহনীয় ভাব ধারণ করত যার জন্য দুইটি প্রধান খ্রিস্টান গোত্র—কালব ও কাইস উমাইয়া রাজতন্ত্রের সাপোর্টার ছিল।
অনেক উমাইয়া খলিফার খ্রিস্টান উপদেষ্টা ছিল এবং তারা খ্রিস্টান কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কেউ কেউ খ্রিস্টান চার্চের কিছু প্রথা মসজিদ সার্ভিসে আমদানি করেছিলেন। পবিত্র স্থানে গানবাজনার প্রচলন ছিল। মসজিদ সার্ভিস চলাকালে ধূপধুনা জ্বালানো হতো এবং এই প্রথা উমাইয়া রাজত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন চলেছিল।
মাবিয়া (৬৬১-৬৮০) উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা। তিনি ছিলেন আবু সুফিয়ান ও হিন্দের পুত্র এবং খলিফা ওসমানের কাজিন। প্রফেট মোহাম্মদের কোরান লেখকদের মধ্যে তিনি একজন এবং প্রফেটের ডিকটেশনে তিনি কোরানের কিছু অংশ লিখেছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, খলিফা ওসমানের সময় তিনি সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন এবং খলিফা আলীর বিরুদ্ধে, ওসমান হত্যার কারণে বিদ্রোহী হন।
পবিত্র কোরানের প্রতি মুসলিমদের শ্রদ্ধার কথা জেনেও তিনি সিম্ফিনের যুদ্ধে বর্শার আগায় কোরানের পাতা বিদ্ধ করে (৬৫৭) যুদ্ধের মোড় ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। ফলে আলীর সৈন্যরা মাবিয়ার সৈন্যদের আক্রমণ করতে অস্বীকার করে এই কারণে আলী যুদ্ধে হেরে যান এবং তার খিলাফতও চলে যায়।
এরপর মাবিয়া জেরুজালেমে নিজেকে খলিফা হিসাবে ঘোষণা দেন এবং এই উপলক্ষে তিনি গেথসেমেনে (Gethsemane) নামাজ পড়েন যেখানে যিশু শেষ ভোজের পর প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি কুমারী মেরির কবরেও প্রার্থনা করেন এবং গলগথাতে পরিদর্শনে যান, যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল (F. Buhl, in SEI, 1974, P. 290)।
তিনি সিরিয়ান খ্রিস্টানদের ডেকে সেই সব জমি চাষ করতে বলেন যা বেদুইনরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। তিনি খ্রিস্টানদের রক্ষা করেন। সাধুদের ভক্তি করেন এবং চার্চ ও কনভেন্টে দান করেন। তিনি এডেসার ক্যাথিড্রাল পুনর্নির্মাণ করেন যা ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিল।
মাবিয়ার পর তার পুত্র প্রথম এজিদ খলিফা হন (৫৮০-৮৩), যার রাজত্ব প্রধানত কারবালা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। ৬৮০ সালে শরৎকালে আলীর দ্বিতীয় পুত্র হোসেন এজিদকে অস্বীকার করে তার পরিবারবর্গ ও কিছু অনুসারী সাথে করে কুফাবাসীদের আমন্ত্রণে কুফার পথে রওয়ানা হন তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। তার এই পরিকল্পনা জানতে পেরে বসরার উমাইয়া গভর্নর ওবাইদুল্লাহ ইবন জিয়াদ একদল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে হোসেনের দলকে বাধা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন।
আত্মসমর্পণ না করে, হোসেনের দল কারবালা প্রান্তরে তাঁবু গাড়ে এবং এখানে ওবাইদুল্লাহ বাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়। এই উমাইয়া বাহিনীর কমান্ডার ছিল ওমর ইবন সাদ। বদরের যুদ্ধে প্রফেটের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ওমর ইউফ্রেটিস নদীর সাথে হোসেনের দলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ফলে পানিকষ্ট শুরু হয় হোসেনের দলে। এখানে ছয় দিন পর, মহররমের দশম দিবসে, হোসেনসহ তার দলের সকলেই নিহত হন। শিয়াদের ইতিহাসে, ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায়, এই লোমহর্ষক ঘটনা শান্ত প্রকৃতির পাঠকদেরও জাগিয়ে তোলে। সত্তরজন লোকের ছিন্ন মস্তকসহ নারী শিশুদের বন্দি করে বসরার গভর্নরের নিকট হাজির করা হয়। হোসেনের শির দামেস্ক পাঠানো হয় জনসম্মুখে প্রদর্শিত হওয়ার জন্য।
পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক (৬৮৪-৭০৫) মক্কা ও মদিনায় বিদ্রোহীদের সম্মুখীন হন। এদের দমন করার জন্য ইরাকের বিশ্বস্ত গভর্নর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফকে খলিফা প্রেরণ করেন। হাজ্জাজ পণ্ডিত মানুষ ছিলেন কিন্তু গোঁড়াবাদীরা তাঁকে পছন্দ করত না। হাজ্জাজ ছিলেন তাকিফ গোত্রের সদস্য; এই গোত্র প্রফেটের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করত অনেক দিন ধরেই। তিনি মক্কা-মদিনার বিদ্রোহীদের কড়া হাতে দমন করেন।
বসরা ও কুফার মধ্যখানে ৭০২ খ্রিঃ হাজ্জাজ ওয়াসিত নামে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে বসরা ও কুফার ওপর কড়া নজর রাখার জন্য, কারণ এই দুই শহর সব সময়েই গোলযোগ সৃষ্টি করত। এখন ওয়াসিত শহরের সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায় না।
আবদুল মালিকের পর তার পুত্র প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-১৫) খলিফা হন। তিনি কখনো আরবি ভাষা শেখার চেষ্টা করেননি, অশুদ্ধ করে বলতেন। তিনি হাজ্জাজকে ইরাকের গভর্নর পদেই বহাল রাখেন মক্কা-মদিনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। ওয়ালিদের নির্মাণ কর্মের প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি দামেস্কর একটি ক্যাথিড্রাল দখল করে তার এক অংশে তার সংস্কার সাধন করেন এবং অন্যদিকে একটি বিরাট মসজিদ নির্মাণ করেন। মক্কাতে কাবাঘরের কাছে তিনি একটি নতুন কূপ খননের আদেশ দেন এবং হাজীদের সেখান থেকে মিঠা পানি পান করার জন্য অনুরোধ করেন। তার মতে জমজমের পানি তিক্ত, লবণাক্ত ও বিস্বাদ ছিল।
হিশাম (৭২৪ – ৪৩) উমাইয়া বংশের দশম খলিফা। তিনি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাধু টিফেনাসকে মন্ত্রণাদাতা রূপে গ্রহণ করেন। পরে তাকে এন্টিয়কের বিশপের পদে অধিষ্ঠিত করেন। ইরাকের গভর্নর হিসেবে তিনি খালিদ আল-কাসরিকে নিয়োগ করেন। খালিদ একজন বন্দি গ্রিক রমণীর পুত্র, যিনি কখনো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হননি। খালিদ তাঁর মায়ের জন্য কুফাতে একটি চার্চ ও কনভেন্ট তৈরি করে দেন, যার জন্য মুসলিমদের কাছে তার জনপ্রিয়তা কমে যায়। খালিদের মৃত্যুর পর এই চার্চ ও কনভেন্ট ধ্বংস করা হয়।
প্রভুভক্ত খালিদ খলিফাকে বলেন, তাঁর অনুমতি পেলে, তিনি কাবাঘর ভেঙ্গে সেই মালপত্র দিয়ে জেরুজালেমে অনুরূপ একটি তৈরি করবেন। কিন্তু তা হয়নি। খালিদ তাঁর মায়ের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন, তাই মায়ের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন খ্রিস্টানিটি অনেক দিক দিয়ে ইসলামের চেয়ে অনেক উচ্চে।
হিশামের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় ওয়ালিদ (৭৪৩-৪) তার উপদেষ্টাদের চাপে খালেদের মৃত্যুদণ্ড দেন। ওয়ালিদ নিজে একটি কোরানের আয়াত পছন্দ করতেন না যেখানে বলা আছে, ‘প্রত্যেক বিদ্রোহী ও জেদী ব্যক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’ (১৪ : ১৮)। কোরানের এই পাতাটি ছিঁড়ে বর্শাতে গেঁথে তীর দিয়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেন এবং বলেন, ‘তুমি প্রত্যেক প্রতিপক্ষকে ভর্ৎসনা করো? দেখ, আমি সেই জেদী প্রতিপক্ষ, যখন তুমি তোমার প্রভুর সামনে হাসরের দিনে সম্মুখীন হবে, তখন বলো যে ওয়ালিদ তোমাকে এই ভেবে ছিঁড়ে দিয়েছে (Sale, 1886, P. 52)। তার পূর্বপুরুষ ওসমানের মতো ওয়ালিদ, এর কিছু দিন পরেই কোরান পাঠরতকালে খুন হন।
দ্বিতীয় মারওয়ানের (৭৪৪-৯) সাথে উমাইয়া বংশের শেষ হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আব্বাসী নেতাদের দ্বারা তাড়িত হয়ে নীল নদের তীরে যুদ্ধরত অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনি উমাইয়া বংশের চতুর্দশতম খলিফা। এদের মধ্যে দুইজন রাজ্য পরিত্যাগ করেন, দুইজনকে বিষ প্রয়োগে মারা হয় আর দুইজনকে রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হয় (assasinated)।
১২.৩ আব্বাসিয়া বংশ (৭৫০-১২৫৮)
উমাইয়া রাজত্বকালে মুসলিম রাজ্য অতি দ্রুতভাবে সংগঠিত হয় এবং আব্বাসিরা এই রাজ্যকে আরো সুসংহত করে। এই বংশের নামকরণ হয় প্রফেট মোহাম্মদের চাচা আব্বাসের নামে।
আব্বাসিয়াদের প্রথম খলিফা ছিলেন আবুল আব্বাস (৭৫০ – ৫৪), আস-সাফ্ফা উপাধি ধারণ করেন, এর অর্থ ‘রক্তপাতকারী’ বা ‘রক্তপিপাসু’। রাজ্য শুরু করেন ‘ক্ষমা ঘোষণা’র মাধ্যমে এবং উমাইয়া বংশের সব রাজপুরুষদের এক ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে জড়ো করেন এবং ইঙ্গিত দিয়েই সবাইকে হত্যা করেন।
অন্যান্য স্থানে উমাইয়াদের যেসব আত্মীয়-স্বজন ছিল, চিরুনি অভিযান দ্বারা হত্যা করা হয় এবং তাদের দেহ রাস্তার কুকুরদের প্রতি নিক্ষেপ করা হয় তাদের খাদ্য রূপে। শেষে সিরিয়াতে উমাইয়া খলিফাদের কবর খুঁড়ে (দ্বিতীয় ওমর বাদে) হাড়গোড়, পচা দেহ যা ছিল তার উপরে চাবুক মারা হয়। এরপর অবশিষ্টাংশগুলি পুড়িয়ে দিয়ে ছাইগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
আব্বাসিদের প্রাথমিক সংগ্রামে, তারা পার্সিয়ানদের যথেষ্ট সাহায্য পায়। আসলে অনেক খলিফাদের পার্সি মাতা ছিল এবং তারা আরবের চেয়ে নিজেদের পার্সি বলতে গর্ব অনুভব করত। আব্বাসি সুশীল সমাজের ভাষা ছিল পার্সিয়ান এবং সাসানিয়া সাম্রাজ্যের অনেক প্রথা আব্বাসি দরবারে চালু হয়েছে। কোনো কোনো খলিফা সাসানিয়ান প্যাটার্নে ‘শাহিন শাহ’ উপাধি ধারণ করেছে।
উমাইয়াদের মতো আব্বাসিরা খ্রিস্টানদের প্রতি সদয়প্রবণ ছিল না। আব্বাসি রাজত্বের শুরুতে সাম্রাজের পূর্ব প্রদেশগুলোতে নব্বইটি মঠের স্থাপনা এবং এগারো হাজার চার্চ ছিল— মেসোপটেমিয়া, দক্ষিণ পারস্য এবং সিরিয়াতে। নতুন রাজ্যনীতি অনুসারে এই সব খ্রিস্টান স্থাপনাগুলো বেশির ভাগ ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় আব্বাসি খলিফা মনসুর (৭৫৪-৭৫)-এর রাজত্বকালে ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থানান্তরিত করা হয়। বাগদাদ নগরী প্রাচীন পার্সিয়ান রাজধানী স্টেসিফোন (Ctesiphon)-এর ধ্বংসস্তূপের নিকটে। এই বাগদাদ নগরী নতুনভাবে নির্মিত হয়। এই নতুন নগরীর পরিকল্পনা করেছিলেন খলিফার উপদেষ্টা মাশাআল্লাহ, ইনি ইহুদি পণ্ডিত, গাণিতিক ও স্থপতি, এই নগরীর স্থান নির্ধারণ করেন। খলিফার মন্ত্রী খালিদ ইবন বারমাক এই স্থান নির্ধারণে বারমাক সৃষ্টিতত্ত্ব ও জ্যামিতিক নীতি অনুসরণ করেন।
এই মন্ত্রী বারমাক (বারমেসাইড) পরিবারভূক্ত ছিলেন। এদের পূর্বপুরুষ ছিল বুড্ডিস্ট হাই (high) প্রিস্ট। এই পুরোহিতরা অক্সাস নদীর তীরে বলখের মনাস্টারিতে ছিলেন। ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে আরবরা বলখ নগরী দখল করলে এরা ইসলামে দীক্ষিত হন। এই বারমাক পরিবার পরপর চারজন খলিফার অধীনে কাজ করেন এবং এরা তাদের মহানুভবতার জন্য পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া জনসেবা, সাহিত্য, শিল্প, দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
তৃতীয় আব্বাসী খলিফা মাহদি (৭৭৫-৮৫) সাফল্যজনকভাবে বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে কিছুদিনের জন্য তাদের কাছ থেকে কর আদায় করে সন্ধি করেন। তিনি জোরপূর্বক সিরিয়ার শেষ প্রভাবশালী খ্রিস্টান তানুখ গোত্রকে ধর্মান্তরিত করেন, কেননা এই খ্রিস্টান গোত্রের সাথে কনস্ট্যান্টিনোপলের গোপন যোগসাজশ ছিল।
পঞ্চম আব্বাসী খলিফা হারুন-অর-রশিদকে (৭৮৬-৮০৯) আরব্য রজনী খ্যাত- ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন তার গৃহ-গুরু ইয়াহিয়া (জন) ইবন খালিদ। খালিদ বারমাকের পুত্র। বারমাকদের যেমন দ্রুত উন্নতি হয়েছিল তেমনি দ্রুত পতন হয়েছে ৮০৩ খ্রিস্টাব্দে। ইয়াহিয়াকে বন্দিশালায় পাঠানো হয় এবং সেখানে তার মৃত্যু হয় এবং তার পুত্র জাফরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তাদের এই দ্রুত পতনের কারণ খ্রিস্টান ও জোরাস্ত্রিনদের প্রতি তাদের নমনীয় মনোভাব এবং ইসলামে দীক্ষা নেয়া সত্ত্বেও তাদের বুড্ডিস্ট প্রীতি ছিল। ৮০৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের জন্য আইন পাস করে তাদের ভিন্ন ধরনের পোশাক পরতে আদেশ দেন।
হারুনের রাজত্বকালে আব্বাসিদের ক্ষমতা শীর্ষে উঠেছিল। ফ্র্যাঙ্কিস ঐতিহাসিক এজিনহার্ড (Eginhard) (মৃ. ৮৪০)। উল্লেখ করেছেন যে, ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে হারুন ও শার্লমেনের মধ্যে দূত বিনিময় হয়েছিল। এই ঘটনার কথা মুসলিম ইতিহাসে নেই, যদিও পরে উপহার বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে।
হারুনের পুত্র মামুন (৮১৩-৩৩) শিক্ষা-ব্যবস্থার পোষক ছিলেন। লাইব্রেরি ও কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে বিখ্যাত জ্ঞানগৃহের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন (House of Wisdom)। তিনি বিজ্ঞান, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করেন। তিনি মোতাজেলা ডকট্রিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে আব্বাসি সাম্রাজ্যে ‘অগস্টান যুগ’- এর প্রবর্তন করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিতের একটি টিম গঠন করে গ্রিক সাহিত্য দর্শন ইত্যাদি আরবিতে তরজমা করান এবং মুসলিমদের হেলেনিক আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন (J. H. Kramers, in Amold and Guillaume, 1965, P. 84) ।
মামুনের ছোট ভাই খলিফা মুতাসিম (৮৩৩-৪১) বাগদাদ থেকে ষাট মাইল দক্ষিণে টাইগ্রিস নদীর তীরে সামারা নগরী তৈরি করে সেখানে বাগদাদ থেকে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। এই সামারা নগরী নির্মাণ করেছিল প্যাগন তুর্কিরা যারা খলিফার দরবারে কাজ করত। সামারা আব্বাসি খিলাফতের রাজধানী রূপে ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় ছিল। মামুনের মতো মুতাসিমও মোতাজিলা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কথিত আছে যে মুতাসিম যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তিনি বলেছিলেন যে তার মৃত্যুর সময় মোমবাতি ও ধূপধুনা জ্বালিয়ে খ্রিস্টানদের মতো প্রার্থনা করতে (J. Pederson, in SEI, 1974, 346)।
মামুনের ভাইপো, খলিফা আল-মোতাওয়াফিল (৮৪৭ – ৬১), তার চাচার মোতাজিলার ডিক্রি খারিজ করে দেন। তিনি হারুন-অর-রশিদের নীতি চালু করে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি প্রবর্তন করেন এবং বাগদাদের চার্চ ও সিনেগগ ভেঙে ফেলেন। তিনি শিয়াদের প্রতিও অত্যাচার শুরু করেন এবং কারবালায় হোসেনের মাজার ধুলোয় মিশিয়ে দেন। তারপর খলিফা নিজেই খুন হয়ে যান।
দশম শতাব্দি থেকে উত্তর আফ্রিকা ও অন্যান্য স্থানে অসন্তুষ্টি ও আন্দোলনের কারণে আব্বাসি রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়। এই আন্দোলনের কারণ প্রধানত অর্থনৈতিক ও সামাজিক, যদিও এর মধ্যে জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়েছিল। এই সব আন্দোলন ও বিশৃংখলার কারণে, খলিফা ফ্রন্টিয়ার প্রদেশগুলোকে অধিক পরিমাণে স্বাধীনতা দিয়ে দেন।
এর মধ্যে আরাবিয়ান পেনিসুলার অধিকাংশ আধা-ইসলামী-গোষ্ঠী কারমাতিদের অধীনে চলে গেল। এই কারমাতিদের সাথে মাজদিয়ান ও মানিকিয়েন্সদের নিকট যোগসূত্র ছিল। তাদের কাছে একটি পুস্তক ছিল, সেই পুস্তকে লেখা ছিল যে তাদের কোনো এক নেতার কাছে যিশুখ্রিস্ট আবির্ভাব হয়ে তাঁকে একটি বিশেষ নিদর্শন দিয়েছেন লোকজনদের দেখাতে। এই কারমাতিগণ দুমার খ্রিস্টান কালব গোত্র ও বাহরাইনের কাইস গোত্রের কাছ থেকে সাহায্য ও নেতৃত্ব পেয়েছে এবং তারা প্রফেট মোহাম্মদ ও ইসলামী শিক্ষার বেশির ভাগ অমান্য করে।
৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কারমাতি বাহিনী মক্কা আক্রমণ করে হজের সময় এবং কাবাঘরে হামলা চালায় মনুমেন্টের ওপর মদ ঢেলে দেয়। হাজীরা হারাম শরীফের মধ্যে আশ্রয় নিলে তাদের হত্যা করা হয়; মক্কা শহরের লোকজনসহ মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজারে পৌছে। তারপর কারমাতিরা কাবাঘর থেকে কালো পাথর উঠিয়ে নিয়ে মরু প্রান্তরে চলে যায় এবং কথিত যে, তারা সেই কালো পাথর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়, তারপর টুকরোগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দেয়।
৯৫১ খ্রিস্টাব্দে, ২০ বছর পর বিরাট এক অঙ্কের বদলে, তারা কালো পাথরের ছোট ছোট টুকরোগুলোকে আঠা দিয়ে জোড়া দেয়। সেই জোড়া দেয়া পাথর ফেরত দিয়ে বলে, এটা আসল পাথর নয়, যদিও ধার্মিক ব্যক্তিরা সেটাকে আসল বলে লোকজনকে আশ্বস্ত করেছে (Sale, 1886, P. 91)।
আব্বাসী বংশের শেষের খলিফাদের মধ্যে কয়েকজনকে হত্যা করা হয় কিংবা অন্ধ করে দেয়া হয়। একাদশ শতাব্দির শেষের দিকে খলিফাদের কোনো ক্ষমতা ছিল না, কাঠের পুতুলের মতো অবস্থা হয় এবং তার কর্মক্ষেত্র বাগদাদ শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আব্বাসী সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা স্পেন থেকে পারস্য পর্যন্ত স্বাধীন মুসলিম বংশ দ্বারা শাসিত হয়, যাদের প্রত্যেকের আলাদা ইতিহাস আছে।
আব্বাসীদের এই পোড়ো সাম্রাজ্য শেষে খতম হয়ে যায় যখন পারস্যের উত্তর- পশ্চিমে আলামুত পর্বত মঙ্গল হালাকু দখল করে নেয়। এই আলামুত পর্বতের দুর্গ ইসমাইলি গোষ্ঠী এসাসিনদের অধীনে ছিল। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকু আলামুত দখল করার পর নেমে এসে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ আক্রমণ করে দখল করে এবং শেষ খলিফা মুসতাসিমকে হত্যা করে। শুধু খলিফা নয়, চার সপ্তাহ ধরে হালাকুর সেনাদল বাগদাদ শহরে মাসাকার করে- অর্থাৎ গণহত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়।
চমৎকার রাজপ্রাসাদ, দর্শনীয় মসজিদ, স্মৃতিসৌধ এবং শিক্ষাক্ষেত্র সমস্ত কিছু ভেঙেচুরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সাহিত্য ও শিল্প-সম্পদে বাগদাদ ছিল এথেন্সের মতো পৃথিবীর কেন্দ্রভূমি। সবকিছু পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে; ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়। মুসলিম নগরী বাগদাদ এবং এর আশপাশ বিধর্মী মঙ্গলদের রাজ্যে পরিণত হয়।
আব্বাসী খিলাফতের পতনে ‘খলিফা’ পদবি সম্বন্ধে কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে যায়। একটি বর্ণনা মতে, আব্বাসি বংশের শেষ খলিফা তাঁর পদবি দান করেছিলেন তাঁর এক চাচাকে, যিনি কাইরোতে পালিয়ে যান এবং ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে এই লোকের উত্তরাধিকারী এই পদবি বদলি (Transfer) হয়ে যায় অটোম্যান সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে।
১২.৪ ফাতেমি বংশ (৯০৮ – ১১৭১)
৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আবু মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ধর্মীয় নেতা ছিলেন। শিয়া গোষ্ঠীর নেতা। আব্বাসি খলিফা তার প্রতি বিরূপ ছিলেন বলে তিনি তিউনিশিয়ায় পালিয়ে যান। এখানে এসে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় বিভিন্ন কারণে তিনি ক্ষমতা লাভ করে ফাতেমি বংশের পত্তন করেন। তিউনিশিয়া থেকে ১০০ মাইল দক্ষিণে মাহদিতে রাজধানী স্থাপন করেন। ওবাইদুল্লাহ দাবি করেন যে তিনি প্রফেট মোহাম্মদের কন্যা ও আলীর স্ত্রী ফাতেমার বংশধর, এই কারণে এই বংশের নাম হয়েছিল ফাতেমি রাজবংশ।
ওবাইদুল্লাহর আব্বাসি প্রতিপক্ষরা ফাঁস করে দেয় যে তিনি আসলে ছিলেন এক ইহুদির নাতি এবং ম্যাগি (জোরাস্ত্রিয়ান) বংশের সাথেও জড়িত। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও উপদেষ্টা ছিলেন মিসরীয় ইহুদি, পশ্চিম দেশে আইজাক জুদাউস বলে পরিচিত। আইজাকের লিখিত অনেক ফরমুলা ইসলামী ও পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। সেটা সপ্তম শতাব্দির কথা।
ওবাইদুল্লাহর নাতি মুইজ (৯৫৩-৭৫) ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিসর জয় করেন তারপর করেন প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া। দুইজন প্রখ্যাত পুরুষ তার অধীনে কাজ করেছেন একজন ইয়াকুব ইবন কিল্লিস, বাগদাদের ইহুদি পরে মুসলিম হন। তিনি একজন অর্থনীতিবিশারদ ছিলেন এবং সাম্রাজ্যের সিভিল সার্ভিস ও কর পদ্ধতিকে ঢেলে সাজান যা ফাতেমি বংশের শেষকাল পর্যন্ত চালু ছিল। এই বংশে প্রশাসন আমলাতন্ত্রের উচ্চস্তর পর্যন্ত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী দ্বারা পরিচালিত হতো। অন্যজন ছিলেন একজন সেনাপতি নাম জওহর। ইনি মূলত সাবেক গ্রিক ক্রীতদাস ছিলেন এবং এর যুদ্ধ কৌশলে মিসর বিজয় সম্ভব হয়। জওহর কাইরো নগরীর প্রতিষ্ঠাতা (আল-কাহিরা অর্থাৎ বিজয়ী)। এই শহর পুরনো ফুসতাত শহর থেকে কিছু দূরে। কাইরোতে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হয়। কাইরোর সাথে বাইজানটাইনদের বাণিজ্যের কারণে মিসর অল্প সময়েই উন্নতি লাভ করে।
একজন প্রখ্যাত প্রশাসক ছাড়া জওহর ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তিনি কাইরোতে জ্ঞানগৃহ (House of Wisdom) নির্মাণ করেন এবং ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আল-আজহার স্কুল ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আজহার নামকরণ হয় প্রফেটের কন্যা ফাতেমার অপর নাম ‘আল-জোহরা’ থেকে। পরবর্তীতে এই স্কুল শিয়া পাঠ কেন্দ্র রূপে গড়ে ওঠে। শতাব্দি পরে আল-আজহার পাঠকেন্দ্রকে অর্থোডক্সে রূপান্তরিত করা হয় এবং বর্তমানকাল পর্যন্ত সুন্নি অর্থোডক্সদের ধর্মীয় জীবন গঠনের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
আজিজ (৯৭৬-৯৬) পিতা মুইজের মৃত্যুর পর সিংহাসন আরোহণ করেন এবং একজন খ্রিস্টান রমণীকে বিবাহ করেন। তিনি তার স্ত্রীর দুই ভাইকে আলেক্সান্দ্রিয়া ও জেরুজালেমে বিশপের পদে অধিষ্ঠিত করেন, তার ভিজির বা প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন একজন খ্রিস্টান, নাম ছিল ঈসা ইবন নাসতুরিস। মুইজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানগৃহকে আরো বৃহৎ ও মর্যাদাশীল করে তোলেন নাসতুরিস।
আজিজের পুত্র হাকিম ৬ষ্ঠ খলিফারূপে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ৯৯৬ খ্রিঃ থেকে ১০২১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার চারিত্রিক স্ববিরোধিতা ছিল এবং মেজাজের ঠিক থাকত না। কখনো তিনি সদয় মহানুভব প্রশাসক, কখনো অতি কঠোর ও নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারী। ফহদ বিন ইব্রাহিম নামে এক খ্রিস্টান তার প্রধান সেক্রেটারি ছিলেন এবং তার সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন পূর্ব বর্ণিত জওহরের পুত্র হোসেন; ফহদের উপদেশে খলিফা জ্ঞানগৃহের আরো উন্নতি সাধন করেন এবং লাইব্রেরি কক্ষ চল্লিশ করে প্রত্যেক কক্ষ পুস্তক দিয়ে ভরিয়ে দেন।
হঠাৎ মেজাজের বশে উত্তেজিত হয়ে তিনি তার সামরিক উপদেষ্টা হোসেনকে হত্যার আদেশ দেন এবং খ্রিস্টানদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন এবং অসংখ্য চার্চ ভেঙে ফেলেন- এমনকি জেরুজালেমের চার্চ পবিত্র সেপালকার ১০০৯ সালে গুঁড়িয়ে দেন। এই কারণে পশ্চিমের খ্রিস্টানরা একে অন্যের নিকট আবেদন জানিয়ে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সমবেত হন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড।
হাকিমের পরবর্তী কর্মসূচি হলো, তিনি প্রথম খলিফাদের অভিশপ্ত ঘোষণা দিয়ে নিজেকে আল্লাহর ছায়া বলে দাবি করেন এবং একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। পরিশেষে বিক্ষুব্ধ প্রজাদের দ্বারা তিনি খুন হয়ে যান, যদিও প্রচার করা হলো যে তিনি রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছেন। তার দেবত্বের দাবির সূত্র ধরে লেবাননে তার অনুসারীরা দ্রজ (Druz) গোষ্ঠীর (Sect) সূত্রপাত করে।
অক্ষম খলিফা মুসতানসির (১০৩৭-৯৪) ওবাইদুল্লাহর প্রপৌত্র ছিলেন। এর সময়ে ফাতেমি সাম্রাজ্য-সীমানা ছিল সমগ্র উত্তর আরবসহ সিসিলি, সিরিয়া এবং পশ্চিম আরাবিয়া। মুসতানসিরের রাজত্বের শেষের দিকে তুর্কিরা সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন আক্রমণ করে দামেস্ক ও জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং সুদানিজ, বার্বার এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপ তার রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার সৃষ্টি করে। খলিফা তখন তার একারের (Acre) আর্মেনিয়ান গভর্নর বদর আল জামালির কাছে আবেদন জানান তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে বিদ্রোহ দমন করে যেন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সাধারণভাবে যা হয় তাই হলো। বিদেশী হিসাবে ক্ষমতায় সাহায্য করতে এসে তারাই ক্ষমতা হাতে তুলে নিল। বদর তার কন্যার পুত্র মালিক আল-ফজল খলিফার পরবর্তী উপদেষ্টা হলেন এবং খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন ।
এই অবস্থায় শাসনকার্য থেকে খলিফার কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে ফাতেমি সাম্রাজ্য আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে লাগল। এই সময় শিয়া-সুন্নির বিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এবং জাতিগত বিরোধ তুর্কি, প্যালেস্টানিয়ান ও ইরাকিদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল এবং পশ্চিম দিকে বার্বার, মুরস ও সুদানিজরাও বসে রইল না। কামড়া-কামড়ি লেগে গেল।
এই বংশের পতন ত্বরান্বিত হলো যখন ভিজিরদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এদের খলিফা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না, তাদের পদচ্যুত করতে সাহসও হলো না। ভিজিরদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষে কুর্দিশ সেনাপতি সালাহউদ্দিন (পশ্চিমে সালাদিন নামে খ্যাত) বিজয়ীর বেশে বের হয়ে এসে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে শেষ খলিফাকে সরিয়ে নিজেই মিসর দখল করেন এবং আয়ুবিদ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন (১১৭১-১২৫৪)। এরপর মিসরে শুরু হয় মামলুক (দাস) বংশ (১২৫৪-১৫১৭), শুরু হয় খলিফার সামরিক দেহরক্ষী দল থেকে। খলিফা সামরিক দেহরক্ষী গঠন করেন তুর্কি ও সিরকাসিয়ান ক্রীতদাসদের দিয়ে আর এরাই এক সময়ে রোমান প্রেটোরিয়ান-কর্তৃত্ব গ্রহণ করে শেষে রাজ্য দখল করে বসে।
মামলুক সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন বাইবারস, যিনি ১২৬০ সালে নাজারেথের কাছে আইন জালুত (The Spring of Goliath) যুদ্ধে মঙ্গলদের পরাজিত করে তাদের পশ্চিম দিকের রাজ্য বিস্তার ঠেকিয়ে দেন। মামলুকেরা রাজত্ব করেছে ১৫১৭ খ্রিঃ পর্যন্ত, যখন মিসর অটোমেন তুর্কিরা দখল করে নেয়। এরপর মিসর কালের গহ্বরে তলিয়ে যায়। তবে এই মামলুকেরা মিসরে স্বাধীন সামরিক জাতি হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল ১৮১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যখন মিসরের মোহাম্মদ আলী পাশা তাদের সমূলে উপড়ে দেন।
১২.৫ ক্রুসেড (১০৯৫-১২৯১)
বিশাল খ্রিস্টান সম্প্রদায় পবিত্র ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তুলনামূলকভাবে ইহুদি ও অন্যান্য প্যাগন প্রতিবেশীদের সাথে সুখে-শান্তিতে বাস করছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত।
যখন জেরুজালেমের আর্কবিশপ সোফ্রোনিয়াস (Sophronius) ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমরের কাছে জেরুজালেমকে সমর্পণ করতে বাধ্য হলেন, তাকে বলা হয়েছিল যে খ্রিস্টানরা তাদের চার্চে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু নতুন কোনো চার্চ জেরুজালেমে নির্মাণ করা যাবে না। খ্রিস্টানরা কাউকে তাদের ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবে না, চার্চের ওপরে ক্রস প্রদর্শন করতে পারবে না বা তাদের ধর্মের কারণে কোনো গণবিক্ষোভও করতে পারবে না।
এই বাধা-নিষেধগুলো চলে আসছিল ওমরের পরবর্তী খলিফাদের সময়েও। খ্রিস্টানরা, যারা তাদের পবিত্র স্থানে, যেমন জেরুজালেম ও বেথেলহেম, গমন করতে চাইত, তাদের অনুমতি দেয়া হতো অত্যধিক ফি প্রদানের পর। তারা কোনো আইনের আশ্রয় নিতে পারত না, কারণ, আইন তাদের পক্ষে ছিল না। দমন ও ভেদনীতি, তীর্থযাত্রীদের ওপর আক্রমণ, খ্রিস্টান মঠগুলোতে লুটপাট, খ্রিস্টান প্রার্থনালয় ভেঙে দেয়া ইত্যাদি সাধারণ ব্যাপার ছিল মুসলিম আধিপত্যের সময়ে।
দশম শতাব্দি থেকে পরিস্থিতির আরো অবনতি হলো এবং অত্যাচার গেল বেড়ে। ৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা রামলেহ, সিজরা এবং আসকালনের চার্চগুলো ধ্বংস করে দেয়। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমি খলিফা মুইজ জেরুজালেমের হলি সেপালকার চার্চের এক অংশ পুড়িয়ে দেন। ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের আর্কবিশপকে বাইজানটাইনের গুপ্তচর অভিযোগে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা হয়।
১০০৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমি খলিফা হাকিম নন-মুসলিমদের ওপর জঘন্য অত্যাচার শুরু করেন। পবিত্র ভূমিতে (জেরুজালেম) তীর্থযাত্রা বন্ধ করে দেন এবং হলি সেপালকার চার্চ ধ্বংস করেন। (এর পুনর্নির্মাণ শুরু হয় ১০২৭ সালে বাইজানটাইন সম্রাট অষ্টম কনস্ট্যান্টাইন কর্তৃক)।
১০৭১ সালে আর্মেনিয়ার মাঞ্জিকার্ট যুদ্ধে সেলজুক সুলতান আরপ্ আরসালান বাইজানটাইন সম্রাট চতুর্থ রোমানাসকে পরাজিত করেন। এই পরাজয় খ্রিস্টানদের কফিনের শেষ পেরেক। এই সময় কনস্ট্যান্টিনোপল দুর্বল হয়ে গেছে; খ্রিস্টানরা অন্য কোনো উপায় না দেখে নিরাপত্তার কারণে পশ্চিম দিকে সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়।
পশ্চিম থেকে উত্তর এল ক্রুসেডের (ধর্মযুদ্ধ) আকারে; লাগাতার আটটি যুদ্ধ খ্রিস্টান ও ‘পেনিম’, ক্রস ও ক্রিসেন্টের পূর্ব ও পশ্চিমে শুরু হয়ে গেল, যে যুদ্ধে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক ব্যবস্থা ও সভ্যতা জড়িত ছিল।
ক্রুসেড এল তরঙ্গের মতো, সংগঠনে, সজ্জায়, অস্ত্রশস্ত্রে এবং ঐক্যে দুর্বল হয়ে। বিভিন্ন বর্ণধারী (motley) খ্রিস্টান সেনাবাহিনী, যারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাদের দু’হাজার মাইল হাঁটিয়ে এনে ক্লান্ত অবস্থায় তাদের আর সংঘবদ্ধভাবে দাঁড় করানো যায়নি। এই যুদ্ধযাত্রার জোয়ার শেষে ভাটা হয়ে গেছে, কিন্তু জেরুজালেম উদ্ধারের উদ্দেশ্য ছিল প্রধান। ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা ফাতেমিদের কাছ থেকে জেরুজালেম নিয়ে শহরের নয়-ছয় করে দেয় এবং এই ধ্বংসলীলায় বহু খ্রিস্টান প্ৰাণ হারায়। খ্রিস্টানদের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা পশ্চিমে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমিরা তুর্কিদের কাছ থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে। তাদের এই বিজয় ক্ষণস্থায়ী ছিল, কারণ পরের বছর ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে সিরিয়ান কোস্টে বেশ কয়েকটি খ্রিস্টান স্থাপনা বা প্রধান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে মিসরের সালাদিন জেরুজালেম অধিকার করেন। ১২৪৪ সালে এই শহর আবার তুর্কি বাহিনীর দখলে চলে যায়। এইভাবে চলতে থাকল এবং আশপাশের শহরগুলো একার (Acre) থেকে এলেপ্পো (Aleppo) বারবার হাতবদলের পর সর্বশেষে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডারদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করা হয়।
দু’শো বছরের ক্রুসেডের যে সংঘাত তাকে আরো সমস্যা জড়িত করে তোলা হয়েছিল উভয়পক্ষের মিত্র বদলের কারণে। এই ধর্মযুদ্ধে প্রধান দুটি দল হলো খ্রিস্টান ও মুসলিম, এদের মধ্যে ছিল ধর্মীয় পার্থক্য। তেমনি ছিল গোত্র পার্থক্য। উভয় দলে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য থাকার জন্য মিত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে ধর্মের বাধা ছিল না।
দুই শতাব্দি ধরে যে ক্রুসেড চলেছে, এতে মুসলিম দলে প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র ছিল, কাইরোর ফাতেমি খিলাফত, বাগদাদের আব্বাসি খিলাফত, আইকোনিয়ামের সেলজুক সুলতানাত এবং দামাস্কের। এন্টিয়কের, এলেপ্পের, এডেসার ও ট্রিপোলির এমিরেটগণ। পবিত্র ভূমির কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করত বাগদাদ, কখনো কখনো কাইরো এবং কখনো কাইরোর কর্তৃত্ব সংরক্ষিত শহরের গেটের বাইরে ছিল না। অধীনস্ত মুসলিম প্রধানদের কেউ কেউ একদিকে যেমন খলিফাদের ঘৃণা করত, অন্য দিকে ক্রুসেডারদেরও ঘৃণা করত এবং কোনো সময়ে তাদের সাথে মিত্রতা গড়েছে বা খ্রিস্টানদের সাহায্যও করেছে।
ওদিকে ক্রুসেডারদের মধ্যে রেষারেষি ও ভেদাভেদ ছিল। যারা পশ্চিম থেকে এসেছিল তাদের ফ্যাঙ্ক বলা হতো, এরা ছিল রোমের ল্যাটিন চার্চের সাথে সংযুক্ত; অন্য দিকে পূর্বের মিত্র শক্তি ছিল বাইজানটিয়াম যা সংযুক্ত ছিল গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সাথে। এদের মধ্যে সাময়িকভাবে কোয়ালিশন থাকলেও বহুকাল ধরে এরা অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে, যখন মিসরের বিরুদ্ধে চতুর্থ ক্রুসেড চলছিল, ক্রুসেডাররা তখন মিসরকে ছেড়ে কনস্ট্যান্টিনোপলের ওপর আক্রমণ করে বসে।
১২৬০ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গল নেতা হালাকু বাগদাদ ধ্বংসের পর দামেস্ক অধিকার করেন, কিন্তু এই সময়েই তাকে দেশ থেকে পারিবারিক বংশগত সমস্যা মিটাবার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। তিনি তার প্রধান সেনাপতি কিতবোগাকে চার্জ দিয়ে যান। কিতবোগা এবং তার অধীনে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ও কর্মী ছিলেন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান। কিন্তু ক্রুসেডাররা নেস্টোরিয়ানকে হেরেটিক (বিধর্মী) মনে করত, তাই তারা মঙ্গলদের কোনো সাহায্য নিতে ইচ্ছুক ছিল না, এর চেয়ে তারা মুর ও তুর্কিদের বন্ধুত্ব কামনা করেছে, এমনকি এসাসিন গোষ্ঠীদের বন্ধু ভেবেছে।
এই সময়কালে, ভিনিস, জেনোয়া, নেপলস্, সিয়েনা (Siena) ও পিসার ধনী মার্চেন্টরা ক্রুসেডারদের একদিকে যেমন অস্ত্রশস্ত্র সাপ্লাই করেছে, অন্য দিকে তেমনি সিরিয়ান ও মিসরীয়দের সাথে বিলাসদ্রব্যের বদলে জরুরি পণ্যদ্রব্য সাপ্লাই করেছে।
ক্রুসেডের কালে ইউরোপে চরম ধর্মীয় প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে এবং ইতিহাসে শুধু এই সময়ে সারা কন্টিনেন্ট, অন্তত সাময়িকভাবে; একটা নির্দিষ্ট কর্মের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলে মনে হয়। জনসংখ্যার প্রতি স্তর থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, এই প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছে। পোপ থেকে কৃষককুল, ধনী থেকে দরিদ্র, অভিজাত সম্প্রদায় থেকে দাস শ্রেণী, ধর্মবেত্তা থেকে রোমান্টিক, দুঃসাহসী থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং একটি ক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতার কারণে শিশুদেরও পাঠানো হয়েছে এই ধর্মযুদ্ধে। (১২১২ সালে ক্রুসেডের সময় যেসব শিশুদের আলেক্সান্দ্রিয়া পাঠানো হয়েছিল তারা আলেক্সান্দ্রিয়ায় পৌঁছালে সেই শিশুদের ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করা হয়)।
ক্রুসেডের সময় যেসব রাজা বা সম্রাট অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট (মৃ. ১১৯৯)। আরবদের কাছে মালিক রিক নামে পরিচিত।
আর ছিলেন প্রথম এডওয়ার্ড (মৃ. ১৩০৭)। ফ্রান্সের ছিলেন অষ্টম লুই (মৃ. ১২২৬) এবং সেন্ট নবম লুই (মৃ. ১২৭০)। সেন্ট নবম লুইকে আরবরা বন্দি করে এবং তিনি বন্দি অবস্থায় বারো বছর ছিলেন। তৃতীয় কনরার্ড (মৃ. ১১৫২), হোহেনস্টফেনের রাজা; ‘বারবারোসা’ প্রথম ফ্রেডেরিক (মৃ. ১১৯০), হলি রোমান এমপেরর, যিনি এশিয়া মাইনরের একটি নদীতে ডুবে যান এবং দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক (মৃ. ১২৫০); হলি রোমান এমপেরর, যিনি পোপের নির্বাসন মাথায় করে ক্রুসেডে যাত্রা করেছিলেন এবং ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে সাময়িকভাবে যুদ্ধ ছাড়া জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন।
ক্রুসডের ধারণা মধ্যযুগে খ্রিস্ট-সাম্রাজ্যে এমন গভীরভাবে দাগ কেটেছিল যে, ইংল্যান্ডের রাজা আর্থার (৬০০) এবং ফ্রান্সের শার্লিমেন (৮০০) যারা ক্রুসেডের বহু পূর্বে গত হয়েছিলেন, মনে হতো তারাও যেন এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন।
ক্রুসেড দুই পক্ষের জন্য সামান্যই গৌরব বহন করে। ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, সপক্ষ ভঙ্গ খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় পক্ষেই প্রযোজ্য ছিল। ইংরেজ সংস্কারক জন ওয়াইলিফ (মৃ. ১৩৮৪) মন্তব্য করেছেন যে দু’পক্ষই সমানভাবে অসাধু ছিল। সেরুসিনদের মতো খ্রিস্টানরা ক্রীতদাসদের ব্যবহার করেছে এবং খ্রিস্টান রাজারা হেরেম পুষতেন। উভয় পক্ষেই যেমন বীরত্ব প্রকাশ করেছে তেমনি করেছে বর্বরতা। উভয় লুটপাট করেছে, ধ্বংস করেছে এবং নারী শিশু ও বেসামরিক জনগণকে ম্যাসাকার করেছে। সালাদিন ও রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট ক্রুসেডের দুই পক্ষের নায়ক ছিলেন, এরা যেমন সময় সময় উদারতা ও মহানুভবতা প্রকাশ করেছেন তেমনি সময় সময় নিষ্ঠুরতার চরমে পৌঁছেছেন। কিন্তু উভয় পক্ষ এই দুই নায়কের শুধু গুণগানই করেছে।
ক্রুসেডের সার্বিক ফলাফল ব্যাপক ছিল। ক্রুসেড ইউরোপে ফিউডাল প্রথার অবসান ঘটিয়েছে এবং কৃষকদের বন্ধনমুক্ত করেছে এবং কারিগর ও শিল্পীদের গিল্ড সৃষ্টি করেছে। আর ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে ইউরোপে বণিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সুবিধা এনে পূর্ব দিকে বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এই যুদ্ধের ফলে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন প্রসার ঘটেছে, পশ্চিম তেমন হয়নি। ম্যাক্স মায়ারহফ (Max Meyerhof) লিখেছেন- ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর ক্রুসেডের তেমন প্রভাব পড়েনি, যেমন পড়েছিল মুসলিম বিশ্বে (Arnold and Guillaume 1915, P. 347)।
ক্রুসেডাররা এবং মুসলিম উভয়ে বাইজানটাইনের সামরিক কৌশল রপ্ত করে। সেই কৌশল একে অপরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এই যুদ্ধ বাইজানটাইন সাম্রাজ্য সামরিক শক্তি ভেঙে দিয়েছে, যে শক্তি মুসলিম সাম্রাজ্যে বসবাসরত খ্রিস্টানদের প্রাণশক্তি ছিল। রোমান চার্চেরও অবস্থা ভালো ছিল না। কারণ সুদূর ভবিষ্যতে এই সংগ্রামের ফলে পোপের ক্ষমতা হ্রাস পেতে সাহায্য করেছে। তবে এটা সত্য যে ক্রুসেড নাইট টেম্পলার, নাইট হসপিট্যালারস এবং টিউটোনিক সামন্তদের শৌর্য ও বীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সংঘর্ষ থেকে উৎসারিত হয়েছে ‘আর্ট অব হেরাল্ডি’ ও ‘কোটস্ অব আর্মস,’ এর ব্যাপক ব্যবহার যা মূলত বন্ধু ও শত্রুর মধ্যে প্রভেদ এনে দিয়েছে।
এই ক্রুসেড খ্রিস্টানে খ্রিস্টানে ও মুসলিমে মুসলিমে যে ভেদাভেদ ছিল তার অতি সামান্যই উপশম করতে পেরেছে। এই দুই ধর্মে যে বিভক্তি ছিল তা রয়েই গেছে; আর খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মিলন ঘটাতেও পারেনি। মুসলিম রাজাদের সাথে সমন্বয় ও সমঝোতা করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আসিসির (Assisi) সেন্ট ফ্র্যান্সিসকে মিসরের সুলতান ১২২৩ সালে অতি ভদ্রতার সাথে স্বাগত জানান, কিন্তু পাঁচজন ফ্রান্সিসক্যান মিশনারি মরক্কোতে পাঠানো হলে তাদের হত্যা করা হয় এবং আলজিরিয়ার বেজাইয়াতে ধর্মগুরু রেমন্ড লাললিকে জনতা পাথর ছুড়ে মেরে ফেলে।
সর্বোপরি, শতাব্দি ধরে যে ক্রুসেড চলেছিল শুধু রেখে গেছে অবিশ্বাস আর সন্দেহ যা এখনও ইসলাম ও পশ্চিম দেশের মধ্যে বিরাজ করছে।
১২.৬ স্পেন দখল (৭১২ – ১৪৯২)
৭১০ খ্রিস্টাব্দে বার্বার প্রধান তারিক বিশ্বাসঘাতক ভিজিগথ জুলিয়েনের সাহায্যে আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে জিব্রাল্টার প্রণালীতে অভিযান চালিয়ে স্পেনে পদার্পণ করেন। তারিকের নাম এখনো এই প্রণালী বহন করছে জবল-উল-তারিক অর্থাৎ জিব্রাল্টার নামে।
এই অভিযানে উদ্দীপ্ত হয়ে মুসা ইবন নুসাইর একটা বড় ধরনের অভিযানের প্রস্তুতি নেন। মুসা তখন দামেস্কর উমাইয়া খলিফার অধীনে উত্তর আফ্রিকার (ইফ্রিকিয়া) গভর্নর ছিলেন। ৭১১ সালে বসন্তকালে তিনি বার্বার দাস তারিক ইবন জিয়াদকে মুক্ত করে তার অধীনে সতের হাজার বার্বার সৈন্য এবং দুই হাজার আরব সেনা পাঠান। এদিকে তার কিছু জাহাজ ঐ প্রণালী পাঠিয়ে দেন আরব সেনাদের সাহায্যে।
তারিক সৈন্যসামন্ত নিয়ে জিব্রাল্টার পর্বতে অবতরণ করলেন এবং দখলদার ভিজিগথ রাজা রডারিককে হত্যা করে প্রথমে কর্ডোভা অধিকার করে পরে দখল নিলেন টলেডোর। কর্ডোভা আরবদের রাজধানী হলো। জিব্রাল্টার-এর উত্তর অঞ্চলের ভ্যান্ডালদেশগুলোকে আন্দালুস (আন্দালুসিয়া) বলা হতো।
আর একটি মুসলিম বাহিনী ভূতপূর্ব খ্রিস্টান কাল্ব ও কাইস গোত্রের সেনাদের সহযোগে উত্তর দিকে পিরেনিজ অতিক্রম করে ফ্রান্সের দক্ষিণ কোস্ট আক্রমণ করে। এই অঞ্চলকে এখনো কোত দ্য মোর (মুরিশ কোস্ট) বলা হয়। মুরিশ সেনাবাহিনী ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে প্রায় দখলে এনেছিল, কিন্তু ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে পয়টার ও টুরস্-এর মধ্যে চার্লস মার্টেল দ্বারা প্রতিহত হয়ে পরাজিত হয়। এই স্থানটি প্যারিস থেকে মাত্র দু’শো মাইল দূরত্বে।
পয়র্টারের (Poitiers) যুদ্ধ বিশ্ব ও আরব ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। কিন্তু প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর একশো বছর পরে মুসলিম রাজ্যের পশ্চিম দিকের বিস্তৃতির সীমানা নির্ধারণ করে।
এই যুদ্ধে আরবদের জয় হলে, পশ্চিম ইউরোপ ও বিশ্বের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। গিবনের ধারণায় টেমস্ ও রাইন নদীর উপরে হয়তো আরব নৌবহর ঘুরে বেড়াত এবং অক্সফোর্ড মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরানের ব্যাখ্যা হতো যেখানে ‘her pulpil’s might demonstrate to a circumcised people the sanetity and truth of the revelation of Mahoment.”
ফ্যান্স থেকে বিতাড়িত হয়ে মুসলিমরা স্পেনে আস্তানা তৈরি করল, যদিও আরব ও বার্বারদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ তিক্ত ছিল। এই অবস্থা চলতে থাকে যতদিন না উমাইয়া শাহজাদা প্রথম আবদুর রহমান (মৃ. ৭৮৮) এখানে এসে পৌঁছান। আবদুর রহমান খলিফা হিশামের দৌহিত্র। উমাইয়া রাজত্ব (৭৫০ খ্রিস্টাব্দে) অবসান হলে আরববাসীদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য স্পেনে পালিয়ে আসেন এবং কর্ডোভায় দামেস্কর মতো উমাইয়া বংশের পত্তন করেন। এখানে উমাইয়ারা সরকারকে ন্যায় ও সহিষ্ণুতার আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই বংশ (৭৫৬-১০৩১) উন্নতির শীর্ষে ওঠে তৃতীয় আবদুর রহমানের রাজত্বকালে (মৃ. ৯৬১) যার মন্ত্রী ও রাজচিকিৎসক ছিলেন একজন ইহুদি। এই ইহুদির নাম ছিল হাসডে বেন শাপরুত। ইনি সঙ্গীত ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
একাদশ শতাব্দির শুরুতে আন্দালুসিয়া বা মুসলিম স্পেন ছোট ছোট রাজ্যে ভেঙে গেল এবং প্রত্যেক স্টেট (বা তাইফা) শাসিত হতো বার্বার আর ভ্যান্ডেল বা স্লাভ দ্বারা। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল মুর। আর কিছু ছিল খ্রিস্টান এবং প্রত্যেকে নিজেদের সুবিধামতো একে অন্যের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে। স্থানীয় খ্রিস্টানরা, যারা এই মুরদের সময় নিজের ধর্মপালন করেছে, তাদের মোজারেব (আরবীয়) বলা হতো। এরা ছিল সংমিশ্রিত রক্তের-মিক্সড ব্লাড। এই জাতীয় খ্রিস্টানরা আরবদের মতো পোশাক পরত এবং জীবনধারাও সেইরকম। এরা ছিল মুসলিম ও স্থানীয় স্পেনীয়দের মধ্যে যোগসূত্র। তারা স্পেনীয় মুসলিমদের মতো দুটো ভাষাই বলত। তারা রাষ্ট্রভাষা আরবি পড়তে ও লিখতে পারত। এছাড়া স্পেনীয় ভাষার উন্নয়নের জন্য কিছু ল্যাটিন চর্চাও করত। মোজারেবরা মুসলিম স্পেনে সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছে এবং আরবরা ও মুরগণ ও দেশ পরিত্যাগ করলে আরবি বিজ্ঞান এবং শিক্ষা স্পেনে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে স্পেনীয় অভিজাত পরিবারের কিছু অংশ আরবির ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল।
মরক্কো থেকে আফ্রিকান বার্বার কর্তৃক আরও একটি অভিযান চালানো হয়েছিল এবং তারা আল-মোরাবিদ বংশের (১০৮৫-১১৪৭) পত্তন করে এবং এর পরে অ্যাটলাস অঞ্চল থেকে আর একটি অভিযান বার্বারগণ করেছিল যারা আল মোহাদ বংশের ভিত্তি স্থাপন করে (১১৩৩-১২৭০)। এই দুই বংশের সম্মিলিত শক্তি মিলে ক্ষুদ্র (তাইফা) রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করে একটি যুক্তরাজ্য গঠন করে। এই উভয় বংশের ধারা ছিল গোঁড়ামি (অর্থোডক্স), তাই এরা অমুসলিম ও মোজারের প্রতি অসহিষ্ণু ছিল। ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে আলমোহাদ খলিফা আব্দুল মুমিন ইহুদি ও খ্রিস্টানদের যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তাদের বিতাড়িত করতে আদেশ দেন, কিন্তু এই সময় ভীষণ গোলযোগ শুরু হলে এই আদেশ বাস্তবায়িত হয়নি।
এই সময়ের গোলযোগের পর স্পেনে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা বলতে গেলে থেমে যায়। তার ওপরে দখলদার শক্তির মধ্যে জাতিগত বিরোধ শুরু হয় এবং বাড়তে থাকে। বার্বার জোয়ানরা আরব রাজনীতি ও সামাজিক নীতির বিরোধিতা করতে আরম্ভ করে। গদিচ্যুত খ্রিস্টান সামন্তরা ফ্রাঙ্কদের সাহায্যে এই গণ্ডগোল মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে তাদের হারানো রাজ্যের পুনরুদ্ধার শুরু করে।
স্পেনীয়দের নিজস্ব ভূমি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও বাধাগ্রস্ত ছিল, এক ধাক্কায় হয়ে ওঠেনি। ১০৮৫ সালে খ্রিস্টানদের দ্বারা টলেডো দখল স্প্যানিশ ইসলামের পঙ্গুত্ব এনে দেয় যা আইবেরিয়ান ক্রুসেডের প্রথম পদক্ষেপ। তারপর রে ডায়াজ দ্য বিভার নামে এক ডাকাত, সিড নামে বেশি পরিচিত, যিনি কখনো মুর সুলতান, কখনো খ্রিস্টান রাজার অধীনে কাজ করে, পরিশেষে স্পেনের পক্ষে যোগ দেয় এবং ১০৯৪ সালে ভ্যালেন্সিয়া দখল করে কিছুদিনের জন্য খ্রিস্টানদের অধীনে আনেন। সিড সম্ভবত একজন মোজারেব ছিল কিন্তু তাকে জাতে ওঠানো হয় এবং তার বীরত্ব কাহিনী নিয়ে অনেক রোমান্টিক গীতি ও ইতিহাস তৈরি হয়।
স্পেনকে খ্রিস্টানদের দখলে আনতে আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে খ্রিস্টানরা সারাগোসা (১১১৮), তারপর কর্ডোভা (১২৩৬) এবং সেভিল (১২৪৮) দখল করে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডার এগারোতম সুলতান আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ (বোয়াবদিল নামে খ্যাত)কে বিতাড়িত করে খ্রিস্টানরা গ্রানাডা উদ্ধার করে স্পেন থেকে সব নন-ক্যাথলিকদের তাড়িয়ে দেয়।
মুসলিমদের স্পেন দখল সম্বন্ধে দুটো অভিমত আছে। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি বলে থাকেন মুরিশ স্পেন ছিল এমন একটা সময়ে যখন স্পেন অন্যান্য-রাজ্যের তুলনায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করে। অন্যদের মতে, সাতশো বছরের মুরিশ প্রশাসন স্পেনে, আলহামরার মতো মুরিশ স্থাপত্য আর স্পেনীয় ভাষায় কয়েকটি বিদেশী শব্দের যোগান ছাড়া তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। মোট কথা, বলা হয় যে, স্পেনের যে উন্নয়ন তা ইউরোপীয় লোকদের অবদানের অংশ; কিন্তু ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের মুরিশ রাজত্বে তেমন প্রসার লাভ করেনি। যদি মুরিশ আধিপত্য আরো বজায় থাকত তাহলে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থাও সংস্কৃতির দিক দিয়ে নর্থ আফ্রিকার বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রের মতোই থাকত, আজকের মতো আলোকিত হতো না।
১২.৭ তুর্কি ও তুরস্ক
তুর্কিদের তুরানিয়ান’ বলা হয়। আরবরা তুর্কিদের প্রথম সাক্ষাৎ পায় এশিয়া মাইনরে। তুর্কিদের সামরিক দক্ষতা এবং অশ্বারোহী হিসাবে ক্ষিপ্রতা খলিফাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ব্যাপকভাবে তাদের আমদানি শুরু হয়। ১০৪০ সালের মধ্যে তুর্কি গোত্র ‘সেলজুক’ হিসাবে খলিফার রাজ্যে প্রবেশ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। সময়ের সাথে তারা পারস্যের অধিকাংশ অঞ্চল তারপর ইরাক এবং শেষে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন স্থানীয় মুসলিমদের কাছ থেকে জয় করে নেয়। এরপর আইকোনিয়াম (কোনিয়া), আনাতোলিয়ার (এশিয়া মাইনর) পূর্বাংশ বাজানটাইদের থেকে ছিনিয়ে নেয়।
সেলজুকদের জ্ঞাতি ভাই ‘অটোম্যান তুর্ক’ নতুন শক্তিরূপে দেখা দেয় এবং সেলজুকদের সাথে মিশে যায়। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে তারা পূর্ব আনাতোলিয়ায় অটোম্যান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং বর্বর আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করে। তাদের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা মঙ্গলদের সাথে তুলনা করা যায়।
১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুরাদ (রাজত্বকাল ১৩৬২-৮৯) তার অধীনস্ত গ্রিক সামন্তদের বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিস্টান যুবক বন্দি রূপে গ্রহণ করেন এবং এই খ্রিস্টান বন্দিদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন। এই সেনা দলের নামকরণ করা হয় ‘ইয়েনি শেরি’ বা জেনিসারি। এই জেনিসারি পরবর্তীতে তুর্কিসেনা দলের অভিজাত ‘কোর’ বলে গণ্য হয়।
১৪২০ খ্রিস্টাব্দে জেনিসারিদের ওপর খ্রিস্টান নীতির প্রভাব লক্ষ্য করে, তখনকার সুলতান প্রথম মোহাম্মদ (১৪১৩-২১) কিছু বেকতাসি তরিকার দরবেশ নিযুক্ত করেন জেনিসারিদের ‘চ্যাপলেন’ হিসাবে সেবাদান করতে। শতাব্দিকাল ধরে জেনিসারি দল যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে সুলতানী শাসন পরিবর্তন করে, ক্যুদেতার মাধ্যমে। এই ভাবে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে শাসনভার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ১৮২৬ খ্রিঃ পর্যন্ত, যখন তাদের নেতাদের হত্যা করে জেনিসারি প্রথার অবসান ঘটানো হয়।
দ্বিতীয় মুরাদের এক দাসীপুত্র দ্বিতীয় মোহাম্মদ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৪৫১-৮১)। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেন। একজন হাঙ্গেরিয়ান মাস্টার কর্মকার উরবান বিশেষভাবে ঢালাই করে বৃহদাকার কামান তৈরি করে, যে কামানের ব্যবহার তখন আর কোথাও ছিল না। মোহাম্মদ এই কামানের তোপ দেগে কনস্ট্যান্টিনোপলের দুর্গ ভেঙে দিলে, আক্রমণ চালিয়ে দুর্গ অধিকার করা সহজ হয়ে ওঠে। এতে জেনিসারিদের যথেষ্ট অবদান ছিল। এই জয়ের ফলে শেষ বাইজানটাইন সম্রাট ১১তম কনস্ট্যানটাইন ড্রাগাসেস নিহত হন। বিজয়ী মোহাম্মদ নগরে প্রবেশ করে শহরের গৌরব সেন্ট সোফিয়ায় সরাসরি পদার্পণ করে মোল্লাদের দিয়ে এই চার্চকে মসজিদে পরিণত করেন।
ইতিহাসে নিজের নাম রাখার জন্য মোহাম্মদ খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সহানুভূতি আদায়ে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চকে পুনরুদ্ধার করে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ব্যবহার্যে তুলে দেন পাদ্রিদের হাতে এবং ইহুদিদের ধর্মচর্চার জন্য একজন গ্র্যান্ড রাব্বিকে নিয়োগ করেন।
এই রাজকীয় নগরী কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের পর মোহাম্মদ রোমান সম্রাটদের মতো কাইজার-ই-রুম (সিজার অব রোম) উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি ইতালিয়ান হিউম্যানিস্ট এবং গ্রিক পণ্ডিতদের রাজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে তার লাইব্রেরির জন্য গ্রিক ও ল্যাটিন বইপত্র ও পুঁথি পাণ্ডুলিপি জোগাড় করেন; পরে ভিনিস থেকে জেন্টাইল বেলিনিকে ডেকে তার পোর্ট্রেট পেন্ট করতে ও তার প্রাসাদের দেয়ালে ফ্রেসকো আঁকতে আদেশ দেন। তিনি গুলবাহারকে বিবাহ করেন। এই গুলবাহার ফ্রান্সের সম্রাটের কন্যা বলে কথিত এবং পরাজিত রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন ড্রাগেসেসের বধূ হওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু হয়ে গেল মোহাম্মদের বধূ। তিনি মোহাম্মদের পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় বায়েজিদ (১৪৮১-১৫২২)-এর মাতা। গুলবাহার কখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি এবং খ্রিস্টান হিসাবেই মারা যান। কথিত আছে মোহাম্মদকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
প্রথম সেলিম (১৫১২-২০) মোহাম্মদের পৌত্র। তার পিতা দ্বিতীয় বায়েজিদ বিষক্রিয়ায় মারা যান (বরং বলা ভালো যে তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়) এবং সেলিমের ভাই, ভাতিজা বা সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের হত্যা করা হয়। সেলিম তার গ্র্যান্ড ভিজিরদের প্রতি বছর মাথা কেটে দেন। তিনি বুঝতে পারেন যে তুর্কিদের দিয়ে তার দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না, তাই তিনি তার পূর্বসূরিদের নীতি ত্বরান্বিত করতে তার নগরীতে গ্রিক, আর্মেনিয়ান এবং ইহুদি বিপুল পরিমাণে আমদানি করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যে কনস্ট্যান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) আগের মতো সম্পদশালী নগরীতে পরিণত হয়।
১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে সেলিম মিসর, হিজাজ, মক্কা ও মদিনা জয় করেন এবং কাইরোতে অবস্থিত শেষ আব্বাসী খলিফার কাছ থেকে খলিফা পদবি গ্রহণ করেন। এই রূপে মুসলিম শক্তি ও খলিফার কর্তৃত্ব ইতিহাসের ধারায় হস্তান্তর হয় মদিনায়; আবার খলিফাদের থেকে সিরিয়ায় উমাইয়াদের কাছে তারপর পার্সিয়ান আব্বাসিদের কাছে তারপর মিসরীয় ফাতেমিদের কাছে এবং পরিশেষে তুরানি (তুর্কি)-দের কাছে।
অটোম্যান সাম্রাজ্য গৌরবের শীর্ষে পৌঁছে প্রথম সোলেমান (১৫২০-৬৬)-এর সময়ে। তিনি প্রথম সেলিমের সন্তান। তার গ্র্যান্ড ভিজির ইব্রাহিম পাশাকে, তার ক্ষমতার কারণে ঈর্শান্বিত হয়ে, সুলতানের পাট রানী রোক্সোলানা হত্যা করান। সুলতানের প্রিয় উপপত্নী ছিল একজন রাশিয়ান ক্রীতদাসী খুররেম।
সোলেমান হাঙ্গেরি আক্রমণ করে বুদাপেস্ট দখল করেন এবং ভিয়েনা অবরোধ করেন বটে, তবে অধিকার করতে ব্যর্থ হন। খায়রুদ্দিন ‘বারবারেসা’ এক গ্রিক বিদ্রোহী ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ শুরু করে। সলেমান একে তুলে এনে অটোম্যান এডমিরাল পদে নিয়োগ দেন এবং এর সাহায্যে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, মরক্কো বাদে, জয় করে নেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তার এক নৌবহর, মালটা অধিকার করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। পরের বছর হাঙ্গেরিতে সিজেটভার শহর অবরোধকালে সলেমনের মৃত্যু হয়। প্রাচীন রীতি মতে, তার দেহ থেকে অন্তঃকরণ ও অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অংশ বের করে নিয়ে তার মৃত্যুস্থানে কবর দেয়া হয়। পরে ঐ স্থানেই একটি খ্রিস্টান চার্চ নির্মিত হয়।
অটোম্যান সাম্রাজ্য যখন শীর্ষে তখন সাম্রাজ্যের পরিধির মধ্যে এসেছিল এশিয়া মাইনর, বলকানস, মেসোপোটেমিয়া, হিজাজ, মক্কা-মদিনা, মিসর ও সিরিয়া এবং মরক্কোর সীমান্ত পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাসহ— মোট কথা সমগ্র আরবি বিশ্ব এসেছিল অটোম্যানদের অধীন।
সোলেমানের মৃত্যুর পর অটোম্যানের বিশালতা কমে গিয়ে আস্তে আস্তে রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এর পরের সুলতান আরাম-আয়াসে গা ভাসিয়ে দিয়ে মদ ও মেয়ে মানুষ নিয়ে মেতে ওঠে, ফলে শাসনের রাশ ধরে প্রাসাদের মেয়ে মানুষ ও শুরু হয় হারেম ষড়যন্ত্র, সুলতানের প্রধান স্ত্রী ও তার মায়ের মধ্যে বিরোধ লেগে থাকে প্রাসাদে, গ্র্যান্ড ভিজির ও প্রধান খোজা একে অন্যের শত্রু হয়ে যায়। দরবারে ও প্রাসাদে খুনখারাবি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দ্বিতীয় সোলেমানের (১৫৬৬-৭৪) প্রধান বেগম নূরবানু তার সতীনদের সকল সন্তানদের হত্যা করায়, যাতে তার নিজের সন্তান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারে। তার এই সন্তানের নাম মুরাদ। পিতার মৃত্যুর পর তৃতীয় মুরাদ উপাধি নিয়ে সুলতান হন। তার প্রধান স্ত্রীর নাম সাফিয়া, ভিনিসিয়ান কন্যা। মুরাদ যখন মারা যান, তখন সাফিয়া তার সতীনদের ১৯ জন পুত্রকে হত্যা করায়। তারপর তার পুত্র তৃতীয় মোহাম্মদ রূপে সুলতান হন। এক সময় সাফিয়া নিজেই মারা পড়ে তার এক সতীনের চক্রান্তে।
সুলতান প্রথম আহমেদের (১৬০৩-১৭) প্রধান ও প্রিয় স্ত্রী ছিল এক গ্রিক কন্যা নাম কোসেম। সুলতানের এক ভাইয়ের আদেশে কোসেমকে গলা টিপে মারা হয়।
এই অবস্থায়ও সুলতানের ক্ষমতা ছিল চূড়ান্ত; তারা যা খুশি তাই করতে পারত। সুলতান ইব্রাহিম (১৬৪০-৪৮) খামখেয়ালী ও বদমেজাজী মানুষ ছিলেন। প্রায় তিনশো উপপত্নীকে ছালায় পুরে বসফোরাস প্রণালীতে ফেলে দিতে আদেশ দেন। সে আদেশ পালিত হয়। তার এই বর্বরতার কোনো কারণ ছিল না এবং কেউ এর প্রতিবাদ করতে সাহসও করেনি। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দি ধরে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী থেকে আরম্ভ করে সুদূর প্রদেশ পর্যন্ত সর্বত্র শাসনকার্যে অব্যবস্থা ও গোলযোগপূর্ণ ছিল এবং অব্যবস্থার জন্য সাধারণ জনের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এই কারণে, পশ্চিমা শক্তির সাথে সংঘর্ষে তারা পরাজিত হতে লাগল, রাজ্য হারাতে লাগল। আধুনিক কূটনীতিতে অটোম্যানদের কোনো ধারণা না থাকায় পশ্চিমা দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা মুশকিল হতো; তাই ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান একজন গ্রিক পানাওটিস নিকোশিয়া নামে একজন দোভাষীকে নিয়োগ করে পশ্চিমা দেশের সাথে আলোচনা করার জন্য এবং তারপর থেকেই একজন গ্রিককে দোভাষী হিসাবে রাখতে হয়েছে।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে যখন আন্তর্জাতিক অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া জরুরি বিবেচিত হয় তখন তুর্কি সামরিক বিচার বিভাগীয় প্রধান এই প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে, কারণ কোরানে বলে যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করা নীতিবিরুদ্ধ (৬০ : ১ এবং ৫ : ৫৬)। কিন্তু শরিয়া বিশেষজ্ঞরা তার আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে হাদিসের বাণী দেখিয়ে খ্রিস্টানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি তুরস্কে শক্তি এতই কমে যায় যে সুলতানকে ইউরোপের ‘রুগ্ন মানব’ বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এই সময়ে তুরস্কের অধীনস্ত অন্যান্য- রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের কথা চিন্তা করতে লাগল। এর মধ্যে বুলগেরিয়া ও আর্মেনিয়া ছিল অন্যতম।
চতুর্দশ শতাব্দিতে তুর্কিরা বুলগেরিয়া দখল করে এবং পরবর্তী পাঁচ শতাব্দি ধরে বুলগেরিয়ার নাম বলতে গেলে মুছে ফেলা হয়েছিল কিন্তু বুলগেরিয়ার জাতীয়তাবাদ কখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি তা শুধু ঘুমিয়ে ছিল এবং বিক্ষিপ্তভাবে সময়ে সময়ে তারা স্বাধীনতা প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। স্বাধীনতা সংঘর্ষ আরম্ভ হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে লাগাতারভাবে; কিন্তু তা নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় যার জন্য সারা ইউরোপে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে এবং এই কারণে উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন এই বর্বরতার নিন্দা করে তার বিখ্যাত প্যামফ্লেট ইস্যু করেন।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিয়ান বিদ্রোহ সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ কর্তৃক কঠোর হস্তে দমন করা হয় এবং লাখ লাখ আর্মেনিয়ান মারা পড়ে, আর তাদের গ্রাম-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধেও সারা ইউরোপে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে যায় এবং আব্দুল হামিদকে ‘মহাহত্যাকারী’-গ্রেট অ্যাসাসিনেটর আখ্যা দেয়া হয়।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মহাযুদ্ধের সময় সম্ভাব্য আর্মেনিয়ান বিদ্রোহ অনুমান করে সুলতান পঞ্চম মোহাম্মদ আর্মেনিয়ায় গণহত্যার আদেশ দেন। ফলে দেড়-মিলিয়ন মানুষকে গুলি করে, জ্বালিয়ে, ডুবিয়ে এবং জোর করে সিরিয়ার মরুভূমিতে নির্বাসন দিয়ে হত্যা করা হয়। সিরিয়ায় মরুভূমিতে নির্বাসিত আর্মেনিয়ান লোকজন পিপাসা ও খাদ্যাভাবে মারা যায়। বাকি যারা ছিল তাদের কুর্দিরা মেরে ফেলে।
প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে আনাতোলিয়ার বাইরে যত ভূখণ্ড ছিল তুর্কিদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯২২ সালে তুর্কির সুলতানাত শেষ হয় এবং শেষ সুলতান ৬ষ্ঠ মোহাম্মদ একটি ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজে চড়ে মালটায় পালিয়ে যায়। সুলতানের হারেমে যত ইউরোপীয় মহিলা ছিল তাদের সংগ্রহ করে এক ব্রিটিশ নৌ অফিসারের অধীনে ও হেফাজতে দেয়া হয়। এদের মধ্যে একজন ইংলিশ মহিলা ছিল তাকে তার বাড়ি ওয়ার উইক শায়ারের লিমিংটন স্পা-তে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
৬ষ্ঠ মোহাম্মদ মারা যান ১৯২৬ সালে ইতালির সান-মো-তে চরম দারিদ্র্যের মাঝে। এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে কফিন অনুদান নিয়ে তার মৃতদেহ দামেস্কের এক অখ্যাত স্থানে কবরস্থ করা হয় (Esin, 1963, P. 193)। তার ভাই ও উত্তরাধিকারী হয় আব্দুল মজিদকে খলিফা টাইটেল ধারণ করতে অনুমতি দেয়া হয়, কিন্তু সুলতান নয়। ১৯২৩ সালে যখন তুরস্ক রিপাবলিক সরকার ঘোষিত হয়, খলিফা আবদুল মজিদ দেশ ত্যাগ করে এবং সুইজারল্যান্ড আশ্রয় গ্রহণ করে।
তারপর ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক সরকারের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেন। ধর্ম রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যায়। তিনি মুসলিম খিলাফতের অবলুপ্তি ঘটিয়ে তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিদ ও সংস্কারকরূপে কামাল আতাতুর্ক মন্তব্য করেন এই বলে- ইসলামকে রাষ্ট্রে ব্যবহার করে সুলতান-খলিফারা মুসলিম রাজ্যের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তিনি আরব শেখদের অনৈতিক কার্যকলাপ এবং মতলবি বিধান ও থিওরি পালনের মাধ্যমে মুসলিম জাতি যে পেছনে পড়ে আছে তার জন্য তাদের দোষারোপ করেন (Laffin, ‘981 P. 131)। তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সভ্যতাকে বিংশ শতাব্দির আলোকে অসামঞ্জস্য মনে করে এর সংস্কারের যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি খেদোক্তি করে বলেন, এককালে খ্রিস্টান ও ইউরোপ মুসলিম দর্শন ও বিজ্ঞানে আলোকিত হয়েছিল কিন্তু মুসলিমরা যদি পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের শিক্ষা ও বিজ্ঞান গ্রহণ করে এগিয়ে যেত তাহলে এ দুর্দশা ঘটত না (Kinross, 1964, P. 437)।
তিনি শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার বিশ্রামের দিন পরিবর্তন করেন; ইসলামী ক্যালেন্ডার বদলিয়ে পশ্চিমা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। শরিয়া আইনের বদলে ইউরোপীয় সিভিল কোড গ্রহণ করেন আর কনস্ট্যান্টিনোপলের মসজিদকে (যা আগে সেন্ট সোফিয়ার চার্চ ছিল) জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন।
আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে তিনি ল্যাটিন বর্ণমালার প্রবর্তন করেন এবং আরবি ভাষার বদলে পুরনো তুর্কি ভাষা (তুরানিয়ান) চালু করার জন্য আবেদন করেন। তিনি মোল্লাদের নির্দিষ্ট পোশাক নিরুৎসাহ করেন এবং ‘ফেজ’ টুপি ব্যবহার উঠিয়ে দেন, (পাগড়ির বদলে এই ফেজ টুপি চালু করেছিলেন ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ২য় মোহাম্মদ) এবং ইউরোপীয় পোশাক পরতে উৎসাহ জোগান। তাহলে তুর্কিদের অবরুদ্ধ চেতনার পরিবর্তন হবে এবং নিজেদের ইউরোপীয় বলে চিন্তা করতে শিখবে। তিনি ইউরোপীয় স্টাইলে নাম ও উপনাম গ্রহণ করার জন্য উৎসাহ দেন এবং ধর্মীয় বিবাহের পরিবর্তে ‘সিভিল ম্যারেজ’-এর বিধান গ্রহণ করেন। পরিশেষে তিনি বহুবিবাহ ও পর্দা প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়ে নারীদের অধিকারের, ভোট প্রদানসহ সুবিধা করে দেন।
১২.৮ মোগলগণ (১৫২৬-১৮৫৭)
ইত্যবসরে ভারতে বেসামরিক গণ্ডগোল জাতিভেদ এবং গোষ্ঠীবিবাদ হিন্দুদের মধ্যে চরম পর্যায়ে পৌঁছুলে, মুসলিমদের পরপর কয়েকবার ভারত আক্রমণ সাফল্য লাভ করে। আরবরা সিন্ধু প্রদেশ জয় করে নেয় বেশ কয়েক শতাব্দি পূর্বে তারপর অন্যান্য জাতি যেমন, আফগান, তুর্কি, পার্সিয়ান এবং মধ্যএশিয়ার ক্ষুদ্র স্বাধীন দেশগুলো ভারত আক্রমণ করে। মধ্যএশিয়া থেকে এসেছিল গজনীর ঘোর, খিলজি, তুঘলক ও লোদি— এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুঘলরা, যারা ভারতকে সুসংহত করে রাজ্য গড়ে তুলেছিল যা চার শতাব্দির বেশি সময় টিকে ছিল।
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবুর (১৫২৬-৩০)। তার পিতা ছিলেন মোঙ্গল সম্রাট তৈমুর লং-এর বংশধর, এর মাতা ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধর। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫৫৬) দিল্লির আফগান সম্রাট ইব্রাহীম লোদিকে পরাস্ত করে ভারত দখল করেন। এই যুদ্ধে ভারতে সর্বপ্রথম বাবুর ইউরোপীয় কামান ব্যবহার করেন।
বাবুরের পর তার পুত্র হুমায়ুন (১৯৩০-৫৬) সিংহাসনে আরোহণ করেন, যার রাজ্য সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল শেরশাহর দ্বারা; পরে তিনি রাজ্যোদ্ধার করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র আকবর দ্য গ্রেট (১৫৫৬-১৬০৫)। তিনি ছিলেন অতি দক্ষ ও মহানুভব সম্রাট। বিদেশে তার সমসাময়িক পারস্যের শাহ আব্বাস দ্য গ্র্যান্ড সোফি, তুরস্কে ছিলেন সলেমন দ্য ম্যাগনিফিশিয়েন্ট, রাশিয়াতে ৪র্থ ইভান দ্য টেরিবল এবং ৫ম চার্লস, দ্য হলি রোমান এমপারর। আর এক মহান সম্রাজ্ঞী ছিলেন ইংল্যান্ডের এলিজাবেথ। এর সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্য করার জন্য সনদপত্র প্রদান করা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বিভিন্ন অংশে ক্ষমতা দখল করে শাসন করতে শুরু করে এবং ১৮৫৮ সালে ইংল্যান্ডেশ্বরী সমগ্র ভারতের সর্বময় কর্তা হয়ে যায়।
অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে আকবর ইসলাম ধর্মকে অন্যান্য মহান ধর্মের সাথে মিশিয়ে একটা সার্বজনীন ঈশ্বরের ধর্ম (দীন এলাহী) প্রচলিত করার চেষ্টা করেন। এই পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার নীতি তাঁকে অমুসলিমদের কাছে প্রিয় পাত্র করে তোলে। দিল্লির পার্সি (জোরাস্ত্রিয়াম)-এর প্রধান পুরোহিত রাজকীয় দরবারে একটা বিশিষ্ট আসন ছিল এবং আকবর নিজে জোরাস্ট্রিয়ান শার্ট ও গার্ডেল পরিধান করেছিলেন।
খ্রিস্টানিতে সম্রাটের সমভাবে আগ্রহ ছিল। তিনি জেস্যুটসদের সঙ্গে লম্বা আলোচনা চালিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে একজনকে মুরাদের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। দক্ষিণ ভারতে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর আকবর ফতেপুর সিক্রিতে বিজয় চিহ্ন স্বরূপ ‘আলাই দরজা’ নির্মাণ করেন এবং সেখানে মরিয়ম পুত্র যিশু’-র নাম উৎকীর্ণ করেন এবং বলেন, ‘এই পৃথিবী একটি সেতু, পার হয়ে যাও, কিন্তু কোনো ভবন তৈরি করো না’ “This world is a bridge; pass over but build no house upon it.
আকবরের হিন্দু পত্নী জ্যেষ্ঠ পুত্র জাহাঙ্গীর (১৫০৬-২৭) দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বদমেজাজী ও আয়াসী ছিলেন। তিনি যুদ্ধ করেছেন, আবার অবসর সময় তাঁর হেরেমে অতিবাহিত করেছেন। তিনি সূরা পানে অভ্যস্ত ছিলেন।
একজন নিষ্ঠুর সম্রাট হিসাবে তিনি নির্যাতনের বহু সূক্ষ্ম টেকনিক চালু করেন। যখন তাঁর পুত্র খসরু বিদ্রোহী হয় তখন তিনি খসরুর ৩০০ জন অনুসারীকে জীবন্ত শূলে চড়িয়ে দেন এবং খসরুর দেহে ভারি শিকল চাপিয়ে তাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় অনুসারীদের তিলে তিলে মৃত্যু দেখতে বাধ্য করেন। পরে অবশ্য খসরুর দুই চোখ উপড়ে ফেলে অন্ধ করা হয়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তার চরিত্রে প্রবল ধার্মিকতাও ছিল। তিনি জেসুসদের ফেভার করতেন এবং ক্যাথলিকদের শোভাযাত্রা আগ্রার পথে পথে দেখা যেত। খ্রিস্টানদের পেন্টিং প্রাসাদের দেয়ালে টাঙানো থাকত এবং তার প্রাইভেট প্রার্থনা ঘরে মার্বেল পাথরে ভার্জিন মেরি ও যিশুর ছবি আঁকা ছিল। এতে মোল্লাদের প্রতিক্রিয়া হলেও তিনি আমল দেননি। তিনি দরবারে জেসুটস্ ও মুসলিম ধর্মবেত্তাদের নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন, মোল্লাদের আপত্তি উপেক্ষা করে। এক সময় এটা চিন্তা করা হয়েছিল যে হয়তো তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন (Rowlinson, 1954 P. 322) I
জাহাঙ্গীরের পর মসনদে এলেন শাহজাহান (১৬২৭-৫৮)। শাহজাহানের মা ছিলেন একজন রাজপুত রাজকুমারী। রাজ্য দখল করে শাহজাহানের প্রথম কাজ ছিল এক ভাইকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা, অন্যটিকে অন্ধ করা এবং বাকি পুরুষ আত্মীয়দের ম্যাসাকার করা। এইভাবে তিনি নিষ্কণ্টক করেন তাঁর রাজ্যকে। একজন গোঁড়া মুসলিম হিসাবে তিনি হিন্দুদের সব মন্দির গুঁড়িয়ে দেন অথবা আগ্রা ও লাহোরে খ্রিস্টানদের চার্চ ধুলোয় মিশিয়ে তার ভবন নির্মাণ কর্ম শুরু করেন।
শাহজাহান ৩০ বছর রাজত্ব করেছেন, যতদিন না তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করে গৃহাবদ্ধ করেন। এক অসহিষ্ণু শাসক ছিলেন আওরঙ্গজেব (১৬৫৮- ১৭০৭)। তাই পিতার মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি।
শাহজাহান বন্দি অবস্থায় আট বছর অতিবাহিত করার পরে ১৬৬৬ সালে মারা যান। বন্দি অবস্থায় তিনি আগ্রা দুর্গ থেকে তাজমহল অবলোকন করতেন। এই তাজমহল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম পত্নীর স্মৃতিসৌধরূপে তৈরি করেছিলেন। তার প্রিয়তম পত্নী মমতাজ মহল ১৬৩১ সালে চতুর্দশতম সন্তানের জন্ম দিতে মারা যান।
বন্দি সম্রাটের অসুস্থ অবস্থায় দেখাশোনা করতেন তার কন্যা জাহানারা। জাহানারা ছিলেন উচ্চ প্রতিভাসম্পন্ন মহিলা। তিনি আঠারো বছর ধরে রাজকীয় সিলের (Seal) হেফাজতকারী ছিলেন। তিনি নিজেকে যিশুর শিষ্য বলে অভিহিত করেন এবং তার জন্য একটি অতি সাধারণ কবর ইচ্ছা করেন। তিনি যখন মারা যান, তাঁর ইচ্ছামতো তার কবরের ওপর একমাত্র ঘাস ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এই কবরে কোনো সৌধ নির্মিত হয়নি।
পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে আওরঙ্গজেব তাঁর সিংহাসন মজবুত করতে যোগ্য উত্তরাধিকারী বড় ভাই দারাশিকোকে হত্যা করান। অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল যে, দারাশিকো হিন্দু ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। দারাশিকো উপনিষদের ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করান এবং ঘোষণা করেন যে উপনিষদ কোরানের চেয়ে প্রাচীন রিভিলেশন। ১৬৫৯ সালে গ্রীষ্মকালে রাজকুমার দারাশিকোকে তার ঘরেই তিনজন ব্যক্তি চেপে ধরে এবং চতুর্থ জন তার গলা কেটে ফেলে। রক্তাক্ত ছিন্ন মস্তক সম্রাট আরঙ্গজেবের কাছে আনা হলে তিনি ভালো করে ধুয়ে ফেলতে বলেন এবং যখন নিশ্চিত হন যে সেটা দারাশিকোর ছিন্ন মস্তক তখন তিনি দাফনের অনুমতি দেন।
আওরঙ্গজেব তার পঞ্চাশ বছর রাজত্বকালে হিন্দুদের ধর্মান্তর নীতি অনুসরণ করেন এবং সেই সাথে তাদের উপাসনালয় গুঁড়িয়ে দেন। মাত্র একটি বছরে (১৬৭৯) তিনি দুশো হিন্দু মন্দির এবং বেনারসে মহাপবিত্র ধর্মস্থান ভেঙে দেন এবং বেনারসের মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে মসজিদ নির্মাণ করেন।
মোঘল সাম্রাজ্যের ৬ষ্ঠতম ও শেষ প্রতাপশালী সম্রাট বলে তিনি গণ্য। তিনি সাম্রাজ্যের এমন অবস্থা করেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর অব্যবাহিত পরেই রাজ্যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) ও বিদ্রোহ দেখা দেয় চারদিকে এবং অব্যাহত থাকে এই বংশের শেষ বাদশা পর্যন্ত। আওরঙ্গজেবের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ ছিলেন অযোগ্য, যারা দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
আওরঙ্গজেবের জ্যৈষ্ঠপুত্র ১ম বাহাদুর শাহ (মৃ. ১৭১২) সিংহাসনে বসার আগে দুই ভাইকে হত্যা করেন এবং রাজ্যে এমন অবনতি ঘটে যে, তার মৃত্যু হলে শবদেহ দশ সপ্তাহ ধরে পড়ে থাকে— তারপর কবরস্থ করা হয়।
মোঘল সাম্রাজ্যের পতন আগেই শুরু হয়েছে এবং এর পতন দুঃখজনক। সম্রাটগণ এবং ছোটখাটো মোঘল রাজন্যবর্গ, নবাব, খান ও শেখ এই মোগল-যুদ্ধ চেয়ে চেয়ে দেখেন এবং বাজপাখি দিয়ে শিকার ধরেন। পরবর্তী মোঘলরা মদে চুর হয়ে থাকত, ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল এবং অনেকে যৌন রোগের রুগী ছিল। তারা ভণ্ড ফকির, জ্যোতিষী ও গণকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং রাজদরবার ভাঁড়, তোষামোদকারী, চামচা আর নর্তকীতে পরিপূর্ণ ছিল যার ফলে সুযোগ সন্ধানীরা অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছে।
বাহাদুর শাহের পর, তার উত্তরাধিকারী জাহান্দর শাহের (মৃ. ১৭১৩) কাল ছিল লাম্পট্য ও সন্ত্রাসবাদের কাল। ঐতিহাসিকরা বলেন, যখন সম্রাট মারা যান, তখন তিনি এমন দুর্দশার শিকার হন যা কহতব্য নয় (Sharma, 1947, P. 172)।
ফারুক শিয়ার (মৃ. ১৭১৯)-এর পতনের সময় তাঁকে সিংহাসন থেকে টেনে নামানো হয় মুকুটবিহীন ও জুতাবিহীন অবস্থায়, তারপর গালাগালি করে মারধর করা হয়, তারপর বন্দি করে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় এবং খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে শেষে হত্যা করা হয়।
ফারুক শিয়ারকে অনুসরণ করে, রাফিউদ দারাজাত, নেকুশিয়ার এবং রফি-উল- দৌলা (২য় শাহজাহান) যাঁদের রাজত্বকাল ছিল ১৭১৯ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
মোহাম্মদ শাহের (মৃ. ১৭৪৮) রাজত্বকালে ভাঙন আরও দৃঢ় হয় এবং সেই ভাঙন অবস্থা দ্রুত বেড়ে যায় আহমদ শাহের (মৃ. ১৭৫৪) রাজত্বকালে। এই সম্রাটের একটি হারেম (seraglio) চার স্কোয়ার মাইলব্যাপী, যেখানে তিনি আনন্দ-বিহার করতেন সপ্তাহ ধরে। পরে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে অন্ধ করা হয় এবং কারারুদ্ধ করা হয়।
তাঁর উত্তরাধিকারী ২য় আলমগীর পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার শবদেহকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হয় এবং নগ্ন অবস্থায় যমুনার তীর ধরে টানতে টানতে শেষে তাড়াহুড়ো করে পুঁতে ফেলা হয়।
তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী ২য় শাহ আলম (মৃ. ১৮০৬)-কে কারারুদ্ধ করে চাবুক মারা হয় ও পরে অন্ধ করে দেয়া হয়। পরিশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের হাতে বন্দি হিসাবে তুলে দেয়া হয়। তার পুত্র ২য় আকবরের (মৃ. ১৮৩৭) একইভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রীড়ানক হয়ে ১৮৩৭ সালে মারা যায়। তিনি প্রায় ২৯ বছর কোম্পানির অধীনে নামে মাত্র সম্রাট ছিলেন।
মোঘল বংশের শেষ সম্রাট ছিলেন ২য় বাহাদুর শাহ মোহাম্মদ জাফর (মৃ. ১৮৬২)। তিনি ১৮৫৭ সালে সিংহাসনচ্যুত হয়ে পরবর্তীকাল পর্যন্ত দিল্লিতে ইংরেজদের অধীনে ডেটিন্যু (রাজবন্দি) হিসাবে ভাতাভোগী, নামকা-ওয়াস্তে রাজা ছিলেন। কোনো কাজ না থাকায় তিনি তার কাল কাটাতেন, কবিতা লিখে, গান শোনে এবং ক্যালিগ্রাফি চর্চা করে, আশপাশে কি ঘটছে তার কোনো সংবাদ রাখতেন না। তার সব সময়ই অর্থকষ্ট ছিল এবং ইংলিশ কর্তৃপক্ষের নিকট অর্থের জন্য অনবরত পত্র দিতেন কিন্তু কোনো সাড়া পেতেন না। ১৮৫৭ সিপাহি বিদ্রোহের পর বিদ্রোহের সাথে জড়িত থাকার জন্য তাকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হয় যেখানে তিনি মারা যান।
পরবর্তী ক্ষুদ্র মোঘল বাদশারা গৃহযুদ্ধ সমস্যাকে সমাধান করতে পারেননি, আর মারাঠা, জাঠ, রোহিলা, শিখ ও রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ সামাল দিতে পারেননি। মারাঠাদের আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা ছিল না। তাই তারা রাজকীয় প্রাসাদে ঘোড়া রাখত। প্রাসাদের সিলিং-এ যে মূল্যবান দ্রব্যাদি ও রত্ন ছিল সবই খুলে নেয় এবং তাজমহলকে বাসস্থান রূপে ব্যবহার করে। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ, তাদের ক্ষমতা বাড়ার সাথে, অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং জাতীয় ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আরম্ভ করে যখন লর্ড কার্জন ভারতের ভাইসরয় হয়ে এলেন। লর্ড কার্জন ১৮৯৮ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত শাসন কার্যপরিচালনা করেন এবং তার সময়েই প্রাচীন মনুমেন্ট রক্ষা করা এবং তাজমহলকে পুনরুদ্ধার করে তার সংরক্ষণ করার জন্য নির্দেশ জারি করেন, যা এতকাল অবহেলিত ছিল।
১২.৯ পতনের কারণ
মুসলিম ও নন-মুসলিম ঐতিহাসিকগণ প্রায় সকলে মুসলিম রাষ্ট্রের পতনের কারণ যা দেখিয়েছে তা বলতে গেলে অমিল নেই এবং তা অন্যান্য জাতির পতনের সাথে ঐতিহাসিকভাবে একই প্রকার বলা যায়। মুসলিম বংশ একবার প্রতিষ্ঠিত হলে ক্ষমতা দখল প্রায়ই ঘটেছে উত্তরাধিকার সূত্রে, অন্যায়ভাবে অধিকার করে অথবা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে। সচরাচর দেখা গেছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরানো হয়েছে অন্ধ করে অথবা হত্যা করে, ছুরির দ্বারা, বিষ প্রয়োগে বা শূলে চড়িয়ে। এই প্রতিযোগিতায় যারা সাফল্য লাভ করেছে তারা নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়েছে, যতক্ষণ না সে একচ্ছত্র, স্বৈরাচারী ও সীমাহীন কর্তৃত্বের অধিকারসহ, রাজ্যভার হাতে না গ্রহণ করতে পেরেছে।
খলিফা ছিলেন প্রফেটের উত্তরাধিকারী এবং এই কারণে তিনি সকল আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন। অধিকাংশ ক্ষুদ্র শাসকরা মনে করতেন বা বিশ্বাস করতেন যে তারাও শাসন করছেন ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে। সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত পোপের মতো মোল্লাতন্ত্র ছিল না তাদের ওপর খবরদারি করার জন্য বরং পালিত ধর্মবেত্তাগণ তাদের দুষ্কৃত কর্মকে অনুমোদন দিতেন। এই খলিফা ও বাদশা বা সামন্ত এ ব্যাপারে অপ্রতিহত ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেন।
মুসলিম ইতিহাসের শুরুতে রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রাপ্য এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দমন করার কর্তৃত্ব তার হাতে। এইরূপে দেখা গেছে, মুসলিম রাষ্ট্র শাসিত হয়েছে প্রায়ই অত্যাচারী শাসক দ্বারা। সাধারণ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত না, করত ভয়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে হেরেমের চতুর ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়েরা জড়িত থাকত, তাদের সাহায্য করত প্লট পরিকল্পনায়, খোজা প্রহরী ও বিদেশী সভাসদ যারা সাধারণত বেগম বা উপপত্নীদের প্রিয়-পাত্র ছিল। বেশিরভাগ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও গুপ্ত হত্যার পেছনে কাজ করেছে হেরেমের মেয়ে মানুষ আর তার প্রিয় পাত্র রাজ-প্রহরী ও বিদেশী সভাসদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
কোনো প্রকার গণতন্ত্র ছিল না বলে সাধারণ মানুষের তাদের নিজের জন্য, কোনো অধিকার ছিল কিনা, কোনো কিছুতে প্রভাব ফেলতেও পারত না। একটা সুবিন্যস্ত গোয়েন্দা পদ্ধতি রাজ্যে কাজ করত বলে কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, কোনো অসন্তোষ বা প্রতিবাদ উঠলে তা সমূলে উপড়ে ফেলা হতো, স্তব্ধ করে দেয়া হতো অত্যাচার ও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এবং এই শাস্তির বিরুদ্ধে কোনো আপিল ছিল না। শতাব্দির অভিজ্ঞতা জনসাধারণকে স্বেচ্ছাচারীর নির্যাতন ও শাসনকে মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। তাদের এই স্বেচ্ছাচারী শাসনকে না বাধা দিতে পারত, না তেমন ইচ্ছা ছিল। তাদের এই বিশ্বাস তাদেরকে অদৃষ্টবাদী করে দেয়, ভাগ্যই তাদের জীবনযাত্রার পাথেয় ছিল।
আবার অন্যদিকে, ধর্ম যেখানে বহুবিবাহ ও অগুনতি উপপত্নী রাখার অনুমোদন দেয় এবং মৃত্যুর পরেও স্বর্গে যে অনন্ত সুখভোগ ও যৌন বিলাস, সেই কারণে রাজা- বাদশারা অপ্রতিহত কাম-লালসায় ডুবে থাকত। কয়েকজন বাদে, মুসলিম বিশ্বের খলিফা, সুলতান, পাশা এবং আমিরগণ বিলাসী ও অনৈতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন। মদের বিরুদ্ধে যে ইসলামী বিধান ছিল, মুসলিম শাসকগণ তার পরোয়া করতেন না।
সীমাহীন দুর্নীতি, রাজকার্যের প্রশাসনে শিথিলতা এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে ধস নামার জন্য রাজনৈতিকভাবে রাজ্য ছিল নড়বড়ে, ফলে বিদেশী শক্তি সুযোগ বুঝে আক্রমণ করেছে এবং মুসলিম রাজ্যকে কবজাও করেছে। বর্তমানেও ইউরোপ ও আমেরিকান মুসলিম রাজ্যের ওপর খবরদারি করে চলেছে।