১১.
১৯৪৫ সালের গোড়ার থেকেই ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইলেকশন হবে, সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা পাকিস্তান’ চায় কি চায় না তা নির্ধারণ করতে। কারণ, কংগ্রেস দাবি করে যে, তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। নজির হিসাবে তারা বলেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। একথা সত্য যে, কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলমান নেতা তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তাছাড়া কতগুলি প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুইটা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্থানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে একথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।
লাহোর প্রস্তাব: ২৩ মার্চ ১৯৪০
- While approving and endorsing the action taken by the Council and the Working Committee of the All-India Muslim League as indicated in their resolutions dated the 27th of August, 17th & 18th of September and 22nd of October 1939, and 3rd of February 1940 on the constitutional issue, this session of the All-India Muslim League emphatically reiterates that the scheme of Federation embodied in the Government of India Act, 1935 is totally unsuited to and unworkable in the peculiar conditions of this country and is altogether unacceptable to Muslims of India.
- It further records its emphatic view that while the declaration dated the 18th of October 1939, made by the Viceroy on behalf of His Majesty’s Government is reassuring in so far as it declares that the policy and plan on which the Government of India Act 1935, is based will be reconsidered in consultation with the various parties, interests and communities in India, Muslims India will not be satisfied unless the whole constitutional plan is reconsidered de novo, and that no revised plan would be acceptable to the Muslims unless it is framed with their approval and consent.
- Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in the country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles, viz, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute ‘independent states’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.
- That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for the minorities in the units and in the regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.
- This session further authorises the Working Committee to frame a scheme of constitution in accordance with these basic principles, providing for the assumption finally by the respective region of all powers such as defence, external affairs, communications, customs and such others matters as may be necessary.
১২.
দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ঐ একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ সহজে ছাপা হত না। মাঝে মাঝে জনাব মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক) এবং আরও দু’একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করত। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা সংবাদ ছাপাত। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ঐ পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে পুরাপুরি সমর্থন করত, তবুও ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্ৰেণী বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ঐ পত্রিকা হাশিম সাহেবকে মোটেই পছন্দ করত না। ছাত্র ও লীগ কর্মীরা হাশিম সাহেবকে সমর্থন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারার প্রচার করার জন্য। হাশিম সাহেবের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভাল ব্যারিস্টার হিসাবে কলকাতায় নামও ছিল। কলকাতায় গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালবাসতেন, মুসলমান ধনীক শ্ৰেণীকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনত। টাকা পয়সার দরকার হলে কোনোদিন অসুবিধা হতে দেখি নাই। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুইজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব, এই ধারণা অনেকেরই ছিল।
আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সাথে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভাল ভাল লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু’একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন।
মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হল। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারী করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসাবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল মিল্লাত’।
হাশিম সাহেবের গ্রুপকে অন্য দল কমিউনিস্ট বলতে শুরু করল, কিন্তু হাশিম সাহেব ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানীর একজন ভক্ত। তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার ছিলেন। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন। আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, “তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে। হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পিছন থেকে ভাগতাম, তিনি কিন্তু বুঝতে পারতেন। পরের দিন দেখা করতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, “কি হে, তুমি তো গতরাতে চলে গিয়েছিলে।” আমি উত্তর দিতাম, “কি করব, অনেক কাজ ছিল।” কাজ তো থাকতই ছাত্রদের সাথে, দল তো ঠিক রাখতে হবে।
১৩.
ইলেকশনের দিন ঘোষণা হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন হবে। কাউন্সিল সভা ডাকা হল, কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে নয়জন সদস্য থাকবে। তার মধ্যে দুইজন এক্স-অফিসিও, আর মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে একজন, আর একজন এমএলএদের মধ্য থেকে, বাকি পাঁচজনকে কাউন্সিল নির্বাচিত করবে। পূর্বের থেকেই দলে দুই গ্রুপ হয়ে গেছে। তথাপি পাকিস্তান ইস্যুর ওপর নির্বাচন, এ সময় গোলমাল না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। আমরা ভালভাবেই বুঝতাম, চারজনের মধ্যে একজন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি যথা মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, একজন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব, আর পার্লামেন্টারি পার্টি একজন প্রতিনিধি দিবেন এবং একজন আপার হাউজের মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবেন। নাজিমুদ্দীন সাহেব পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ছিলেন, এমএলএ ও এমএলসিরা তারই ভক্ত বেশি ছিল। শহীদ সাহেব ডেপুটি লিডার হওয়া। সত্ত্বেও তাঁকে প্রতিনিধি না করে নাজিমুদ্দীন সাহেব ফজলুর রহমান সাহেবকে পাঠালেন। শহীদ সাহেবকে বললেন, আপনাকে নির্বাচিত করে লাভ কি? আপনি তো কাউন্সিল থেকে ইলেকশন করে বোর্ডের মেম্বার হতে পারবেন। ফজলুর রহমান সাহেব পারবেন না, তাই তাঁকেই সদস্য করলাম। আপার হাউস মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে বোধহয় নূরুল আমিন সাহেবকে নিলেন। এইভাবে নয়জনের মধ্যে চারজন তার দলেরই হয়ে গেল। যেভাবেই হোক আর একজনকে তিনি ইলেকশনের মাধ্যমে পার করে নিতে পারবেন। এতেই গোলমাল শুরু হয়ে গেল। আমরা প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম, শহীদ সাহেবকে এমএলএদের পক্ষ থেকে কেন নেওয়া হবে না? তাকে অপমান করা হয়েছে। কারণ, তিনি ডেপুটি লিডার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির। এটা একটা ষড়যন্ত্র। শহীদ সাহেব আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন, “ঠিক আছে, এতে কি হবে!” আমরা বললাম, “আপনি আর উদারতা দেখাবেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনে রাখা উচিত ছিল যে, তিনি আজ মুসলিম লীগ পার্টির নেতা ও এমএলএ হয়েছেন একমাত্র আপনার জন্য। পটুয়াখালীতে শেরে বাংলা তাঁকে পরাজিত করে রাজনীতি থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো জেলা থেকেই তিনি হক সাহেবের সাথে ইলেকশন করে জিততে পারতেন না, যদি না আপনি তাঁকে আপনার একটা সিট থেকে পদত্যাগ করে পাস করিয়ে নিতেন। তাও আবার কলকাতা হলে আপনিও পারতেন না।”
শহীদ সাহেব ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কলকাতা থেকে দুইটা সিটে এমএলএ হন। নাজিমুদ্দীন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেন। তাঁর রাজনীতি থেকে সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, আমি নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মোকাবেলা করাতে পারেন। হক সাহেবও লোক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দীন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন, শহীদ সাহেবের দয়ায়। সেই নাজিমুদ্দীন সাহেব শহীদ সাহেবকে অপমানই করলেন। যাহোক, আমাদের পক্ষ থেকে পাঁচজনই আমরা কাউন্সিলে দাঁড় করাব, নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কাউকেও হতে দেব না। কারণ, আমাদের ভরসা ছিল কাউন্সিলে শহীদ সাহেব সংখ্যাগুরু।
মওলানা আকরম খাঁ সাহেব একটা আপোস করার চেষ্টা করলেন। মওলানা সাহেবের বাড়িতে শহীদ সাহেব ও মওলানা সাহেবের আলোচনা হল। শহীদ সাহেব নরম হয়ে গেছেন দেখলাম। তিনি বললেন, “এখন পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম, গোলমাল করে কি হবে, একটা আপোস হওয়াই ভাল। আমরা বললাম, চারজনের মধ্যে দুইজনই তো নাজিমুদ্দীন সাহেবের ছিলেন, তিনি নিজে ও মওলানা সাহেব। কেন আর দুইজনের মধ্যে একজন আপনার গ্রুপ থেকে দিলেন না, আপনাকে না দিত। আমরা বললাম, কিছুতেই হবে না।
দিন তারিখ আমার মনে নাই, তবে ঘটনাটা মনে আছে। বিকালে কলকাতা এ্যাসেম্বলি পার্টি রুমে এমএলএ, এমএলসি ও লীগ নেতাদের বৈঠক হবে, সেখানে আপোস হবে। আমরাও খবর পেলাম। বেকার হোস্টেল ও অন্যান্য হোস্টেলে খবর দিয়ে দুই তিনশত ছাত্র নিয়ে আমিও উপস্থিত হলাম। দরজা বন্ধ করে সভা হচ্ছিল। আমি দরজায় যেয়ে বললাম, “আমাদের কথা আছে, গুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত নেতারা রাজি হলেন। দরজাগুলি খুলে দিলেন। ছাত্ররা ভিতরে বসল। আমিই প্রথম বক্তা, প্রায় আধা ঘন্টা বক্তৃতা করলাম এবং শহীদ সাহেবকে বললাম, “আপোস করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আমরা বাজাদের সাথে আপোস করব না। কারণ, ১৯৪২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের ভাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবার তার বংশের থেকে এগারজনকে এমএলএ বানিয়েছিলেন। এদেশে তারা ছাড়া আর লোক ছিল না? মুসলিম লীগে কোটারি করতে আমরা দিব না। আমরাই হক সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, দরকার হয় আপনাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করব।” শহীদ সাহেবকে বাধ্য করে সভা থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার পরে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ফরিদপুরের লাল মিয়া সাহেবও আমাকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। রাতে আমাদের সভা হল। আমরা প্রায় রাতভরই শহীদ সাহেবের সাথে রইলাম। শহীদ সাহেবের কাছে জনাব নাজিমুদ্দীন সাহেব জানতে চেয়েছেন, আপোস হবে কি না তাকে জানাতে। তিনি শহীদ সাহেবকে ফোনের মাধ্যমে অনুরোধ করলেন, আমরা বুঝতে পারলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “যা হয় আগামীকাল সকাল নয়টার মধ্যে জানিয়ে দিব।” আমাদের সকাল আটটার মধ্যে তার বাসায় আসতে বলে দিলেন। এই সময় নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন, জহির, আমরা প্রায় সকল সময় একসাথেই থাকি; ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবও দলবল নিয়ে কলকাতায়ই ছিলেন। চট্টগ্রামের ছাত্রদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।
আমরা সকালে শহীদ সাহেবের বাড়িতে যথাসময়ে হাজির হলাম। তিনি রাতে অনেকের সাথে আলাপ করেছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে বসলেন, আমি তার কাছেই বসলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “বুঝতে পারছি না তোমরা পাঁচটা সিটই দখল করতে পারবে কি না?” আমি বললাম, “স্যার, বিশ্বাস করেন আমরা নিশ্চয়ই জিতব, খোদার মর্জি থাকলে আমাদের পরাজিত হবার কোনো কারণ নাই।” আমি টেলিফোন তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “বলে দেন খাজা সাহেবকে ইলেকশন হবে।” শহীদ সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবকে টেলিফোন করে বললেন, “ইলেকশনই হবে। যাই হোক না কেন, ইলেকশনের মাধ্যমেই হবে। সকলেই তো মুসলিম লীগার, আমরা কেন উপরের থেকে চাপাতে যাব।” নাজিমুদ্দীন সাহেব কি যেন বললেন। শহীদ সাহেব বললেন, “আর হয় না। আপনারা ভাল ব্যবহার করেন নাই।”
আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। রাতে জেলা প্রতিনিধিরা লীগ অফিসে আসলেন। একজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে, তিনি হলেন নোয়াখালী জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান মোক্তার সাহেব। তিনি জেলার নেতাদের কাছে একটা চমৎকার বক্তৃতা করেন। সমস্ত নোয়াখালী জেলা শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিল।
হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের অফিস ভালভাবে চলছিল। আমরা শিয়ালদহ ও হাওড়ায় লোক রাখলাম—কাউন্সিলারদের অভ্যর্থনার জন্য, থাকার জায়গারও বন্দোবস্ত করলাম। ছাত্রকর্মীরা কলেজ হোস্টেল ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে, যার যার জেলার কাউন্সিলারদের সাথে দেখা করার জন্য। দুই দিন পর্যন্ত রাতদিন ভীষণভাবে কাজ চলল। মওলানা রাগীব আহসান ও জনাব ওসমান সাহেব ছিলেন কলকাতা মুসলিম লীগের নেতা। কলকাতা মুসলিম লীগের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। তারাও গাড়ি ও কর্মী নিয়ে প্রচারে নেমে পড়ল। সভার দিন দেখা গেল, শত শত কর্মী হাজির হয়ে গেছে। আমরা যারা কাউন্সিলের সভ্য তারা হলের ভিতরে চলে গেলাম, আর কর্মীরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করতে লাগল। মাঝে মাঝে শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, আবুল হাশিম জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছিল।
শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব পরামর্শ করে পাঁচজনের নাম ঠিক করলেন: ১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ২. আবুল হাশিম, ৩. মওলানা রাগীব আহসান, ৪, আহমদ হোসেন এবং ৫. লাল মিয়া আমাদের পক্ষের, অন্য পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও পাঁচজনের নাম দিলেন। এই সময় ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ও ভীষণ ক্যানভাস শুরু করেন। আমিও তার জন্য তদ্বির করেছিলাম। শহীদ সাহেবও প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। লাল মিয়াকে বাদ দিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে নেওয়া হবে, তখনও ফাইনাল হয় নাই। এই অবস্থায় রাতে ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করলেন এবং তাকে নমিনেশন দিলে তিনি চট্টগ্রাম গ্রুপ নিয়ে তার দলে যোগদান করবেন বলে প্রস্তাব দিলেন। শহীদ সাহেব রাতেই খবর পেলেন এবং বললেন, “কিছুতেই ওকে নমিনেশন দেওয়া হবে না, কারণ এই বয়সেই ওর এত লোভ।” ওদিকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও তাকে তার দল থেকে নমিনেশন দিতে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত চৌধুরী সাহেব শহীদ সাহেবের দলকেই ভোট দিলেন। তাঁর দলের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। এম, এ, আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান চৌধুরী সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। চৌধুরী সাহেবের এই ব্যবহারে তারাও কিছুটা মনোন্নই হয়েছিলেন। এরা সবাই ছিলেন আমার ব্যক্তিগত বন্ধু।
কাউন্সিল সভা যখন শুরু হল, মওলানা আকরম খা সাহেব কিছু সময় বক্তৃতা করলেন। তারপরই আবুল হাশিম সাহেব সেক্রেটারি হিসাবে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। কিছু সময় বক্তৃতা দেওয়ার পরই নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কয়েকজন তার বক্তৃতার সময় গোলমাল করতে আরম্ভ করলেন। আমরাও তার প্রতিবাদ করলাম, সাথে সাথে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। সমস্ত যুবক সদস্যই ছিল শহীদ সাহেবের দলে, আমাদের সাথে টিকবে কেমন করে। নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কেউ কিছু বলল না। তবে তাঁর দলের সকলেরই কিছু কিছু মারপিট কপালে জুটেছিল। আমি ও আমার বন্ধু আজিজ সাহেব দেখলাম, শাহ আজিজুর রহমান সাহেব ছাত্রলীগের ফাইল নিয়ে নাজিমুদ্দীন সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ও আজিজ পরামর্শ করছি শাহ সাহেবের কাছ থেকে এই খাতাগুলি কেড়ে নিতে হবে, আমাদের ছাত্রলীগের কাজে সাহায্য হবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব যখন চলে যাচ্ছিলেন, শাহ সাহেও রওয়ানা করলেন, আজিজ তাকে ধরে ফেলল। আমি খাতাগুলি কেড়ে নিয়ে বললাম, কথা বলবেন না, চলে যাবেন। আজকাল যখন শাহ সাহেবের সাথে কথা হয় ও দেখা হয় তখন সেই কথা মনে করে হাসাহাসি করি। শাহ সাহেব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ পার্টির নেতা এবং বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার হন। তাঁর সাথে আমার মতবিরোধ ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়া পর্যন্ত চলে।
মওলানা সাহেব পরের দিন পর্যন্ত সভা মুলতবি রাখলেন এবং দশটায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে বলে ঘোষণা করলেন। ব্যালট করা হল। পাশের রুমে বাক্স রাখা হল। একজন পাঁচটা করে ভোট দিতে পারবে। আমি ভিতরের গেটে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করছিলাম, মওলানা সাহেবের কাছে কে যেন নালিশ করেছে। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি ওখানে কি করছ ছোকরা?” আমি বললাম, “আমিও একজন সদস্য, ছোকরা না।” মওলানা সাহেব হেসে চলে গেলেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট গণনা হয়ে গেল। শহীদ সাহেবের দলের পাঁচজনই জিতলেন। আমি ফুলের মালা জোগাড় করেই রেখেছিলাম, আরও অনেকেই মালা জোগাড় করে রেখেছিল। আমি যখন শহীদ সাহেবের গলায় মালা দিলাম, শহীদ সাহেব আমাকে আদর করে বললেন, তুমি ঠিক বলেছিলে। লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে আমাদের ভয় ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেককে অনুরোধ করেছিলাম, তাঁকে একটা ভোট দিতে। ফরিদপুর জেলার মাত্র সামান্য কয়েকটা ভোটই শহীদ সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেব, আমি ও আরও কয়েকজন ভোট দিয়েছি, আর সকল ভোটই তমিজুদ্দিন সাহেব, মোহন মিয়া ও সালাম সাহেবের নেতৃত্বে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেবের জন্য দুই চারটা ভোট ফরিদপুর থেকে আমি জোগাড় করেছিলাম। লাল মিয়া সাহেব মোহন মিয়া সাহেবের সহোদর ভাই হলেও তিনি লাল মিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
অন্য কথায় যাওয়ার পূর্বে আর একটা কথা না বললে অন্যায় হবে। লাল মিয়া সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের মেম্বার হওয়ার পরে ফরিদপুরের সদস্য নমিনেশনের সময় ভাইয়ের পক্ষ অবলম্বন করেন। আমাদের দলের লোককে নমিনেশন দিতে রাজি হন নাই। ফরিদপুরের ছয়টা সিটের মধ্যে অনেক ঝগড়া করে মাত্র দুইটা সিট আমরা পেয়েছিলাম। একটা রাজবাড়ীর খান বাহাদুর ইউসুফ হোসেন চৌধুরীর সিট, আরেকটা মাদারীপুরের ইস্কান্দার আলী সাহেবের। মোহন মিয়া নির্বাচনে দত্তপাড়ার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ওরফে বাদশা মিয়ার কাছে পরাজিত হন। বাদশা মিয়া ফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই ঘোষণা করলেন, আমার জয় মুসলিম লীগের জয় ও পাকিস্তানের জয়। লাল মিয়া ও মোহন মিয়া সকল সময়ই ভিন্ন দলে থাকতেন। প্রথমে লাল মিয়া সাহেব কংগ্রেস করতেন, মোহন মিয়া সাহেব মুসলিম লীগ করতেন। আবার মুসলিম লীগে যখন যোগদান করলেন, এক ভাই রইলেন শহীদ সাহেবের দলে, আরেক ভাই খাজা নাজিমুদ্দীনের দলে। আবার পাকিস্তান আমলে আইয়ুবের মার্শাল ল আসলে, এক ভাই আইয়ুব খান সাহেবের দলে, আর এক ভাই বিরোধী দলে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের ক্ষমতা ঠিকই থাকে। এই অপূর্ব খেলা আমরা দেখেছি জীবনভর! রাতেরবেলা দুই ভাই এক, নিজেদের স্বার্থের বেলায় মুহূর্তের মধ্যেই এক হয়ে যান।
১৪.
এই সময় আমাদের উপর মুসলিম লীগ থেকে হুকুম হল, জেলায় জেলায় চলে গিয়ে ইলেকশন অফিসের ভার নিতে। প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ইলেকশন অফিস ও কর্মী শিবির ভোলা হবে। জেলায় জেলায় ভাল ভাল কর্মীদের কর্মী শিবিরের চার্জ নিতে হবে। আমার কয়েকটা জেলার কথা মনে আছে। কারুন্দিন সাহেব ঢাকা জেলা, শামসুল হক সাহেব ময়মনসিংহ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ কুমিল্লা, একরামুল হক খুলনা এবং আমাকে ফরিদপুর জেলার ভার দেওয়া হয়েছিল। আমরা রওয়ানা হয়ে চলে এলাম সাইকেল, মাইক্রোফোন, হর্ন, কাগজপত্র নিয়ে। জেলা লীগ আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে। আমরা প্রত্যেক মহকুমায় ও থানায় একটা করে কর্মী শিবির খুলব। আমাকে কলেজ ছেড়ে চলে আসতে হল ফরিদপুরে। ফরিদপুর শহরে মিটিং করতে এসেছি মাঝে মাঝে, কিন্তু কোনোদিন থাকি নাই। আমাকে ভার দেওয়ার জন্য মোহন মিয়া সাহেব ক্ষেপে যান। সকলকে সাবধান করে দেন, কেউ যেন আমাকে বাড়ি ভাড়া না দেয়। তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি, কিন্তু আমাকে চান না। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্ল জালালউদ্দিনকে সকল কিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। হামিদ ও জালাল ফরিদপুর কলেজে পড়ত, তাদেরও লেখাপড়া ছেড়ে আসতে হল। শহরের উপরে কেউই বাড়ি দিতে রাজি হল না। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় শহর থেকে একটু দূরে তার একটা দোতলা বাড়ি ছিল, ভাড়া দিতে রাজি হল। বাধ্য হয়ে আমাকে সেখানে থাকতে হল। সেখানে আমরা অফিস খুললাম, কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার বন্দোবস্ত হল। সমস্ত জেলায় ঘুরতে শুরু করলাম। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে অফিস খুলে দিলাম, কাজ শুরু হল। থানায় থানায়ও অফিস করলাম। এই সময় মাঝে মাঝে আমাকে কলকাতায় যেতে হত। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব কিছুদিন পূর্বে একবার গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। বিরাট সভা করে গিয়েছিলেন। এই সময় সালাম সাহেবের দল শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবকে সংবর্ধনা দিতে রাজি হয় নাই, কারণ আমার অনুরোধে তারা এসেছিলেন। তাঁর দলবল প্রশ্ন করল, আমি মুসলিম লীগের একজন সদস্য মাত্র। অফিসিয়াল লীগের কেউই নই, এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল গোপালগঞ্জে। শহীদ সাহেব আসবার মাত্র দুই দিন পূর্বে আমি বললাম, আমি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের জন্মদাতা। শহীদ সাহেব আসবেন, তাকে সংবর্ধনা দিব, যদি কেউ পারে যেন মোকাবেলা করে। আমি রাতে লোক পাঠিয়ে দিলাম। যেদিন দুপুরে শহীদ সাহেব আসবেন সেদিন সকালে কয়েক হাজার লোক সড়কি, বল্লম, দেশী অস্ত্র নিয়ে হাজির হল। সালাম সাহেবের লোকজনও এসেছিল। তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে, শহীদ সাহেব, হাশিম সাহেব ও লাল মিয়া সাহেবের বক্তৃতা হয়ে গেলে সালাম সাহেব যখন বক্তৃতা করতে উঠলেন তখন সালাম সাহেব জিন্দাবাদ’ দিলেই আমাদের লোকেরা মুর্দাবাদ’ দিয়ে উঠল। দুই পক্ষে গোলমাল শুরু হল। শেষ পর্যন্ত সালাম সাহেবের লোকেরা চলে গেল। আমাদের লোকেরা তাদের পিছে ধাওয়া করল। শহীদ সাহেব মিটিং ছেড়ে দুই পক্ষের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তখন দুই পক্ষের হাতেই ঢাল, তলোয়ার রয়েছে। কতজন খুন হবে ঠিক নাই। শহীদ সাহেব এইভাবে খালি হাতে দাঙ্গাকারী দুই দলের মধ্যে চলে আসতে পারেন দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হাশিম সাহেব পূর্বেই আমার বাড়িতে চলে গেছেন। এই ঘটনার জন্য শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব সালাম সাহেবের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।
আবার শহীদ সাহেব মাদারীপুর হয়ে গোপালগঞ্জ এলেন জনমত যাচাই করতে। অনেক লোক ইলেকশনে দাঁড়াতে চায়, কার বেশি জনপ্রিয়তা দেখতে হবে। পূর্বেকার এমএলএ খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেবও মুসলিম লীগে চলে এসেছেন, পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা, আবদুস সালাম খান সাহেব এবং আরও দুই একজন ছিলেন। সালাম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে গোপালগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শতকরা আশি ভাগ লোকই তাকে চায়। সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না। আমার আব্বাকে শহীদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলে আব্বা বলেছিলেন, সালাম সাহেবকে লোকে চায়। তবে সালাম সাহেব ও খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব উভয়ই উপযুক্ত প্রার্থী। শহীদ সাহেব বললেন আমাকে, জনসাধারণ তো সালাম সাহেবকে চায়, তোমার আব্বাও তো তাকে সমর্থন করেন। আমি বললাম, যাকে লোকে চায়, তাকেই দিবেন, আমার কোনো আপত্তি নাই। এর পূর্বেই সালাম সাহেবের সাথেও আমার কথা হয়েছিল। কিন্তু হাশিম সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। এর কারণ জানি না। শেষ পর্যন্ত আমিও হাশিম সাহেবকে বলেছিলাম, সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে। সেজন্য আমার উপর রাগ করেছিলেন তিনি। শহীদ সাহেব রিপোর্ট দিলেন, সালাম সাহেবই সকলের চেয়ে জনপ্রিয়। তিনি সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে প্রস্তাব করেছিলেন। লাল মিয়া ও হাশিম সাহেব বেঁকে বসলেন। এই সময় কিছু টাকা পয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছিল। আমি খবর পেতাম, যদিও চোখে দেখি নাই। শেষ পর্যন্ত খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা সাহেবকে নমিনেশন দিল প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বোর্ড। কেন্দ্রীয় বোর্ড খান বাহাদুর সাহেবকে কেটে দিয়ে খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদকে নমিনেশন দিল। সালাম সাহেব ইলেকশন করলে বোধহয় নির্বাচিত হতে পারতেন, কিন্তু মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলেন না। কারণ পাকিস্তানের উপর ভোট। খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদও নমিনেশন পেতে পারেন না, কারণ মাত্র কয়েক মাস পূর্বে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি মুসলিম লীগের নমিনেশন পেলেন কারণ তার চাচাতো ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবের মেয়েকে বিবাহ করেন। তাই নাজিমুদ্দীন সাহেব, চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে বলে নমিনেশন নিয়ে আসেন।
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বার বার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।
অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।
বাঙালিরা শহীদ সাহেবকে প্রথম চিনতে পারে নাই। যখন চিনতে পারল, তখন আর সময় ছিল না। নির্বাচনের সব খরচ, প্রচার, সংগঠন তাকেই এককভাবে করতে হয়। টাকা বোধহয় সামান্য কিছু কেন্দ্রীয় লীগ দিয়েছিল, বাকি শহীদ সাহেবকেই জোগাড় করতে হয়েছিল। শত শত সাইকেল তাকেই কিনতে হয়েছিল। আমার জানা মতে পাকিস্তান হয়ে যাবার পরেও তাঁকে কলকাতায় বসে দেনা শোধ করতে হয়। আমি পূর্বেই বলেছি, শহীদ সাহেব সরল লোক ছিলেন। তিনি ধোঁকায় পড়ে গেলেন। পার্লামেন্টারি বোর্ডে তাঁর দল সংখ্যাগুরু থাকা সত্ত্বেও নিজের লোককে তিনি নমিনেশন দিতে পারলেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পরাজিত হওয়ার পরে তারা অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। ঘোষণা করলেন, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না অর্থাৎ শহীদ সাহেবই দলের নেতা হবেন। তিনি শহীদ সাহেবকে অনুরোধ করলেন যারা পূর্ব থেকে মুসলিম লীগে আছে তাদের নমিনেশন দেওয়া হোক, কারণ এরা সকলেই শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন। খাজা সাহেব যখন নির্বাচন করবেন না তখন আর ভয় কি? শহীদ সাহেব এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পুরানা এমএলএ প্রায় সকলকেই নমিনেশন দিয়ে দেন। বোধহয় তখন বাংলাদেশে একশত উনিশটা সিট মুসলমানদের ছিল। এই চাতুর্যে প্রায় পঞ্চাশজন খাজা সাহেবের দলের লোক নমিনেশন পেয়ে গেল। আবার কেন্দ্রীয় লীগে খাজা সাহেবের সমর্থক বেশি ছিলেন। লিয়াকত আলী খান, খালিকুজ্জামান, হোসেন ইমাম, চুন্দ্রিগড় সাহেব সকলেই শহীদ সাহেবকে মনে মনে ভয় করতেন। কারণ সকল বিষয়েই শহীদ সাহেব এদের থেকে উপযুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড প্রায় ত্রিশজনের নমিনেশন পাল্টিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে দুই একজন শহীদ সাহেবেরও সমর্থক ছিলেন, একথা অস্বীকার করা যায় না।
নির্বাচনের পরে দেখা গেল একশত উনিশটার মধ্যে বোধহয় একশত ষোলটা সিট লীগ দখল করল। সংখ্যা দু’একটা ভুল হতে পারে, আমার ঠিক মনে নাই। এই একশত যোজনের মধ্যে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলই বেশির ভাগ, যদিও তারা শহীদ সাহেবকে লিডার বানাতে বাধ্য হল, কিন্তু তলে তলে তাদের গ্রুপিং চলল। শহীদ সাহেব গ্রুপ করতেন না, তিনি উপযুক্ত দেখেই মন্ত্রী করলেন। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের অনেককে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও হুইপ করলেন। জনাব ফজলুর রহমানকেও মন্ত্রী করলেন।
১৫.
যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে মিস্টার চার্চিল ভারতে ক্রিপস মিশন পাঠিয়ে ছিলেন, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। যুদ্ধের পরে যখন মিস্টার ক্লিমেন্ট এটলি লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে ক্যাবিনেট মিশন পাঠাবার কথা ঘোষণা করলেন; তাতে তিনজন মন্ত্রী থাকবেন, তারা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যাতে তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে—বড়লাটের সাথে পরামর্শ করে। এই ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য ছিলেন, লর্ড পেথিক লরেন্স, সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব ট্রেড এবং মিস্টার এ, ভি, আলেকজান্ডার, ফার্স্ট লর্ড অব এডমাইরালটি (Lord Pethick Lawrence, Secretary of State for India, Sir Stafford Cripps, President of the Board of Trade, and A. v. Alexander, First Lord of the Admiralty)—এরা ভারতবর্ষে এসে বড় লাটের সাথে এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে একটা কর্মপন্থা অবলম্বন করবেন। মিস্টার এটলির বক্তৃতায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা উল্লেখ তো নাই-ই বরং সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন। মিস্টার এটলি তার বক্তৃতার এক জায়গায় যা বলেছিলেন, তাই তুলে দিলাম: “Mr. Atlee declares that minorties cannot be allowed to impede the progress of majorities.” মিস্টার এটলির বক্তৃতায় কংগ্রেস মহল সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করলেন।
ক্যাবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ তারিখে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছালেন। তারা ভারতবর্ষে এসে যে সকল বিবৃতি দিলেন তাতে আমরা একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা দলবল বেঁধে শহীদ সাহেবের কাছে যেতাম, তাকে বিরক্ত করতাম, জিজ্ঞাসা করতাম, কি হবে? শহীদ সাহেব শান্তভাবে উত্তর দিতেন, “ভয়ের কোন কারণ নাই, পাকিস্তান দাবি ওদের মানতেই হবে। আমরা দিনেরবেলা তাঁর দেখা পেতাম খুব অল্পই, তাই রাতে এগারটার সময় নূরুদ্দিন ও আমি যেতাম। কথা শেষ করে আসতে আমাদের অনেক রাত হয়ে যেত।
আমরা প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে থিয়েটার রোড থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম। দু’একদিন আমরা রিপন স্ট্রিটে মিল্লাত অফিসে এসে চেয়ারেই শুয়ে পড়তাম। মিল্লাত কাগজের জন্য নতুন প্রেস হয়েছে, অফিস হয়েছে, হাশিম সাহেব সেখানেই থাকতেন। খন্দকার নূরুল আলম তখন মিল্লাত কাগজের ম্যানেজার হয়েছেন। তখন লীগ অফিসের থেকে আমাদের আলোচনা সভা মিল্লাত অফিসেই বেশি হত। মুসলিম লীগ অফিসে এমএলএরা ও মফস্বলের কর্মীরা এসে থাকতেন। বরিশালের ফরমুজুল হক সাহেব মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি অফিসেই তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন। শহীদ সাহেব তাকে মাসে মাসে বেতন দিতেন।
১৬.
হঠাৎ খবর আসল, জিন্নাহ সাহেব ৭, ৮, ৯ এপ্রিল দিল্লিতে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডেকেছেন। বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশ ও মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলিতে মুসলিম লীগ একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করেছে। তবে অধিকাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে নাই। তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন হয়েছে। পাঞ্জাবে খিজির হায়াত খান তেওয়ানার নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট সরকার, সীমান্তে ডা, খান সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার, সিন্ধুতে জনাব আল্লাহ বক্সের নেতৃত্বে মুসলিম লীগবিরোধী সরকার গঠিত হয়েছে। চারটা মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশের মধ্যে মাত্র বাংলাদেশেই এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেছে। অন্যান্য প্রদেশে মুসলিম লীগবিরোধী দল হিসাবে আসন গ্রহণ করেছে। সমস্ত ভারতবর্ষে তখন এগারটা প্রদেশ ছিল।
শহীদ সাহেব স্পেশাল ট্রেনের বন্দোবস্ত করতে হুকুম দিলেন। বাংলা ও আসামের মুসলিম লীগ এমএলএ ও কর্মীরা এই ট্রেনে দিল্লি যাবেন। ট্রেনের নাম দেওয়া হল ‘পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল’। হাওড়া থেকে ছাড়বে। আমরাও বাংলাদেশ থেকে দশ-পনেরজন ছাত্রকর্মী কনভেনশনে যোগদান করব। এ ব্যাপারে শহীদ সাহেবের অনুমতি পেলাম। সমস্ত ট্রেনটাকে সাজিয়ে ফেলা হল মুসলিম লীগ পতাকা ও ফুল দিয়ে। দুইটা ইন্টারক্লাস বগি আমাদের জন্য ঠিক করে ফেললাম। ছাত্ররা দুষ্টামি করে বগির সামনে লিখে দিল, ‘শেখ মুজিবর ও পার্টির জন্য রিজার্ভড’; এ লেখার উদ্দেশ্য হল, আর কেউ এই ট্রেনে যেন না ওঠে। আর আমার কথা শুনলে শহীদ সাহেব কিছুই বলবেন না, এই ছিল ছাত্রদের ধারণা। যদিও ছাত্রদের নেতা ছিল নূরুদ্দিন। তাকেই আমরা মানতাম।
শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের কামরায় দুইটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দেওয়া হল। হাওড়া থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় সমস্ত স্টেশনেই শহীদ সাহেব ও তার দলবলকে সম্বর্ধনা জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে মুসলিম লীগের জয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। জহিরুদ্দিনকে হাশিম সাহেবের কামরার কাছেই থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। কারণ, তাকে সমস্ত পথে উর্দুতে বক্তৃতা করতে হবে। সেই একমাত্র বক্তা যে উর্দু, বাংলা ও ইংরেজিতে সমানে বক্তৃতা করতে পারত। কলকাতার কোনো মহল্লায় সভা হলে জহির উর্দু ও আমি বাংলায় বক্তৃতা করতাম! নূরুদ্দিন, জহিরুদ্দিন, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন, কিউ. জে. আজমিরী, আনোয়ার হোসেন (এখন ইস্টার্ন ফেডারেল ইস্যুরেন্স কোম্পানির বড় কর্মকর্তা), শামসুল হক সাহেব, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও অনেক লীগ কর্মীর মধ্যে মুর্শিদাবাদের কাজী আবু নাছের, আমার মামা শেখ জাফর সাদেক আরও অনেকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়েছিলেন, দিল্লি যাবার অনুমতিও পেয়েছিলেন। এছাড়া যে সকল ছাত্র আমাদের হাওড়া স্টেশনে বিদায় দিতে এসেছিল, তারাও স্পেশাল ট্রেনে ভাড়া লাগবে না শুনে এক কাপড়েই ট্রেনে চেপে বসল। প্রায় আটদশজন হবে, তাদের না’ বলার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তারা ভাল কর্মী। নারায়ে তকবির’, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্দাবাদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল।
সমস্ত ট্রেনে মাইক্রোফোনের হর্ন লাগানো ছিল। জহির, আজমিরী ও আমি বেশি শ্লোগান দিতাম মাইক্রোফোন থেকে। প্রত্যেক স্টেশনে আমাদের গাড়ি থামাতে হত যদিও সব জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাবার কথা ছিল না। হাজার হাজার লোক শহীদ সাহেবকে ও বাংলার মুসলিম লীগকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য হাজির হয়েছিল। সকালে যখন পাটনায় পৌঁছালাম তখন দেখি সমস্ত পাটনা স্টেশন লোকে লোকারণ্য। তারা বাংলাকা মুসলমান জিন্দাবাদ’, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, এই রকম নানা শ্লোগান দিতে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে বিহার মুসলিম লীগ এবং প্রত্যেককে একটা করে ফুলের মালা উপহার দিয়েছে। আমাদের ট্রেন যে সময় মত দিল্লিতে পৌঁছাতে পারবে না এটা আমরা বুঝতে পারলাম। অনেক দেরি হবে। আমরাও যেখানেই কিছু লোক স্লোগান দেয়, সেখানেই ট্রেন থামিয়ে দেই। এজন্য শহীদ সাহেব রাগ করলে আমি বললাম, কয়েক ঘণ্টা ধরে লোকগুলি দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে দেখার জন্য কত দূর দূর থেকে এরা এসেছে! আর আমরা এক মিনিটের জন্য। ট্রেন না থামালে কত বড় অন্যায় হবে। যাহোক, এমনি করে সারা রাত জনসাধারণ ছোট ছোট স্টেশনেও জমা হয়ে আছে। আমাদের ট্রেন দেখলেই তারা বুঝতে পারত। এলাহাবাদ স্টেশনে আমাদের সমস্ত ট্রেনটাকে নতুন করে ফুল দিয়ে তারা সাজিয়ে দিয়েছিল। পথে পথে বিহার ও ইউপি থেকে অনেক ছাত্র আমাদের ট্রেনে উঠে পড়েছিল। তাদের অনেকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল। এদের অনেকে পাকিস্তানে চলে এসেছে।
দিল্লি যখন পৌঁছালাম তখন দেখা গেল, যেখানে সকালে আমরা পৌঁছাব সেখানে বিকালে পৌঁছালাম। আট ঘণ্টা দেরি হয়েছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কনভেনশন বন্ধ করে রেখেছেন আমাদের জন্য। সকাল ন’টায় শুরু হবার কথা ছিল, আমাদের ট্রেন থেকে সোজা সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হল। দিল্লির লীগ কর্মীরা আমাদের মালপত্রের ভার নিলেন। আমরা বাংলায় শ্লোগান দিতে দিতে সভায় উপস্থিত হলাম। সমস্ত সদস্য জায়গা থেকে উঠে সম্বর্ধনা জানাল। জিন্নাহ সাহেব যেখানে বসেছেন, তাঁর কাছেই আমাদের স্থান : যখন উর্দু শ্লোগান উঠত, আমরাও তখন বাংলা স্লোগান শুরু করতাম।
জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা করলেন, সমস্ত সভা নীরবে ও শান্তভাবে তাঁর বক্তৃতা শুনল। মনে হচ্ছিল সকলের মনেই একই কথা, পাকিস্তান কায়েম করতে হবে। তার বক্তৃতার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আট তারিখে সাবজেক্ট কমিটির সভা হল। প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল।১৫ ১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক। পরে আমাদের বলা হল, এটা কনভেনশনের প্রস্তাব, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করা হয় নাই। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ঐ প্রস্তাব পেশ করতে জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অনুরোধ করলেন, কারণ তিনিই বাংলার এবং তখন একমাত্র মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী।
কাউন্সিল প্রস্তাব
Whereas in this vast subcontinent of India a hundred million Muslims are the adherents of a faith which regulates every department of their life educational, social, economic and political–whose code is not confined merely to spiritual doctrines and tenets or rituals and ceremonies and which stands in sharp contrast to the exclusive nature of Hindu Dharma and Philosophy which has fostered and maintained rigid caste system for thousands of years, resulting in the degradation of 60 million human beings to the position of untouchables, creation of unnatural barriers between man and man and superimposition of social and economic inequalities on a large body of the people of this country and which threatens to reduce Muslims, Christians and other minorities to the status of irredeemable helots, socially and economically;
Whereas the Hindu caste system is a direct negation of nationalism, equality, democracy and all the noble ideals that Islam stands for;
Whereas, different historical backgrounds, traditions, cultures social and economic orders of the Hindus and the Muslims made impossible the evolution of a single Indian Nation inspired by common aspirations and ideals and whereas after centuries they still remain two distinct major nations;
Whereas, soon after the introduction by the British of the policy of setting up political institutions in India on the lines of westem democracies based on majority rule which means that the majority of the nation or society could impose its will on the minority of the nation or society in spite of their opposition as amply demonstrated during the two and half years’ regime of ‘Congress Governments in the Hindu majority provinces under the Government of India Act, 1935, when the Muslims were subjected to untold harassment and oppression as a result of which they were convinced of the futility and ineffectiveness of the so-called safeguards provided in the constitution and in the Instruments of Instructions to the Governors and were driven to the irresistible conclusion that in a United India Federation, if established, the muslims even in Muslims majority provinces, could meet with no better fate and their rights and interests could never be adequately protected against the perpetual Hindu majority at the centre;
Whereas the Muslims are convinced that with a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themselves according to their genius, it is necessary to constitute a sovereign, independent state comprising Bengal and Assam in the North-East zone and in Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan in the NorthWest zone;
This convention of the Muslim League legislators of India, central and provincial, after careful consideration, hereby declares that the Muslim nation will never submit to any constitution for a United India and will never participate in any single constitutionmaking machinery set up for the purpose, and any formula devised by the British government for transferring power from the British to the people of India, which does not conform to the following just and equitable principles calculated to maintain intemal peace and tranquility in the country, will not contribute to the solution of the Indian problem:
- That the zones comprising Bengal and Assam in the North East and the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North West of India, namely Pakistan Zones, where the Muslims are in a dominant majority, be constituted into one sovereign independent state and that an unequivocal undertaking be given to implement the establishment of Pakistan without delay.
- That two separate constitution making bodies be set up by the peoples of Pakistan and Hindustan for the purpose of framing their respective constitutions.
- That the minorities in Pakistan and Hindustan be provided with safeguards on the line of the All India Muslim League resolution passed on March 23, 1940 at Lahore,
- That the acceptance of the Muslim League demand for Pakistan and its implementation without delay are the sine qua non for the Muslim League co-operation and participation in the formation of an interim Goverment at the centre.
This convention further emphatically declares that any attempt to impose a constitution on a United India basis or to force any interim arrangement at the centre contrary to the Muslim demand, will leave the Muslims no alternative but to resist such imposition by all possible means for their survival and national existence.
জনাব সোহরাওয়ার্দীর বক্তৃতার পরে প্রায় বিশ-পঁচিশজন নেতা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বক্তৃতা করেন এবং প্রস্তাবটা সমর্থন করেন। জনাব আবুল হাশিম সাহেবও চমৎকার বক্তৃতা করেছিলেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার পরে জনাব লিয়াকত আলী খান একটা শপথনামা পেশ করেন এবং সমস্ত প্রদেশের আইনসভার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা এতে দস্তখত করেন।
১৭.
কনভেনশন সমাপ্ত হওয়ার পরে যারা হাওড়া স্টেশনে আমাদের বিদায় জানাতে এসে ট্রেনে উঠে পড়েছিল তারা মহাবিপদের সম্মুখীন হল। কি করে কলকাতা ফিরে আসবে? স্পেশাল ট্রেন তো আর কলকাতা ফিরে যাবে না। কি করি, ভেবে আর কূল পাই না। আমরা পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম দিল্লি থেকে আজমীর শরীফে খাজাবাবার দরগাহ জিয়ারত কর, আবার আজমীর থেকে আগ্রায় তাজমহল দেখতে যাব। ১৯৪৩ সালে তাজমহল না দেখে ফিরে যেতে হয়েছিল। এবার যেভাবে হয় দেখতেই হবে। ছোটকাল থেকে আশা করে রয়েছি, সুযোগ আবার কখন হবে কে জানে? যাহোক, আমি ও আরও কয়েকজন সহকর্মী শহীদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম এবং ছাত্রদের অসুবিধার কথা বললাম। শহীদ সাহেব বললেন, “কেন, একজন ভো টাকা নিয়ে গেছে, এদের ভাড়া দেবার কথা বলে। তোমার সাথে আলোচনা করে টাকা দিতে বলেছি।” বললাম, “জানি না তো স্যার, সে তো চলে গিয়েছে। শহীদ সাহেব রাগ করলেন। তিনি ছাত্র নন, তার নাম আজ আর আমি বলতে চাই না। শহীদ সাহেব আবারও কিছু টাকা দিলেন। হিসাব করে প্রত্যেককে পঁচিশ টাকা করে, এতেই হয়ে যাবে। খন্দকার নূরুল আলম ও আমি সকলকে পঁচিশ টাকা করে দিয়ে রসিদ নিয়ে নিলাম, প্রত্যেকের কাছ থেকে। তারা বিদায় হয়ে কলকাতায় চলে গেল। আমরা আট-দশজন জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবের সাথে আজমীর শরীফ রওয়ানা করলাম। চৌধুরী সাহেব সাথে আছেন, টাকার দরকার পড়লে অসুবিধা হবে না। আবার দিল্লি শহরকে ভাল করে দেখে নিলাম। শত শত বৎসর মুসলমানরা দিল্লি থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তখন কি জানতাম, এই দিল্লির উপর আমাদের কোনো অধিকার থাকবে না। দিল্লির লালকেল্লা, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ আজও অনন্য মুসলিম শিল্পের নিদর্শন ঘোষণা করছে। পুরানা দিল্লি ও তার আশপাশে যখনই বেড়াতে গিয়েছি দেখতে পেয়েছি সেই পুরানা স্মৃতি।
আমরা দলেবলে আজমীর শরীফ যাবার উদ্দেশে ট্রেনে চড়ে বসলাম। কত গল্পই না শুনেছি বাড়ির গুরুজনদের কাছ থেকে। খাজাবাবার দরগায় গিয়ে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়, যদি চাওয়ার মত চাইতে পারো। আমরা যখন আজমীর শরীফ স্টেশনে পৌঁছালাম দেখি বহু লোক তাদের কাছে থাকবার জন্য আমাদের অনুরোধ করছিলেন। ভাবলাম, ব্যাপার কি? আমাদের এত আদর কেন? আমরা কারও দাওয়াত কবুল করছি না, কারণ চৌধুরী সাহেবই আমাদের প্রতিনিধি। তিনি যা করবেন তাই আমাদের করতে হবে। তিনি মালপত্র নিয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে নেমে আসলেন এবং একজন ভদ্রলোককে বললেন, চলুন আপনার ওখানেই যাওয়া যাবে। তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি ডেকে আমাদের নিয়ে চললেন। আমাদের জন্য কামরার অভাব নাই। গোসল করলাম, খাওয়া-দাওয়া করলাম। পরে বুঝতে পারলাম, এরাই খাদেম। আজমীর শরীফের খাদেমদের যথেষ্ট
ভদ্রতাবোধ আছে দেখলাম, তারা কিছুই চেয়ে নেয় না। থাকার বন্দোবস্ত করবে, খাবার ব্যবস্থা করবে, সাথে লোক দেবে, যে খরচগুলি করার একটা নিয়ম আছে সেগুলিই শুধু আপনাকে দিতে হবে। ফিরে আসার সময় আপনারা যা দিবেন, তাই তারা গ্রহণ করবে। শুনেছি, যে টাকা তারা গ্রহণ করে, তার একটা অংশ নাকি দিতে হয় দরগাহ কমিটিকে। কারণ, দরগাহ কমিটির যথেষ্ট খরচ আছে। খাজাবাবার দরগায় কোন লোক না খেয়ে থাকে না। পাক হতে থাকে, মানুষ খেতে থাকে।
আমরা দরগায় রওয়ানা করলাম, পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড! শত শত লোক আসে আর যায়। সেজদা দিয়ে পড়ে আছে অনেক লোক। চিৎকার করে কাঁদছে, কারো কারো বা দুঃখে দুই চক্ষু বেয়ে পানি পড়ছে। সকলের মুখে একই কথা, ‘খাজাবাবা, দেখা দে।’ খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভাল করে, তবুও মনে হত আরও শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, যাকে আমরা কাওয়ালী’ বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে। আমরা তারাগড় পাহাড়ে যাব, সেখানে কয়েকটি মাজার আছে। তারা খাজাবাবার খলিফা ছিলেন। তারাগড় পাহাড় অনেক উঁচুতে, আমাদের উঠতে হবে তার উপরে। কি করে এই পাহাড় অতিক্রম করে মুসলমান সৈন্যরা পৃথ্বীরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল? সেই যুদ্ধে, যখন হাওয়াই জাহাজের জন্ম হয় নাই।
ইতিহাসের ছাত্রদের জানা আছে, খাজাবাবা কেনই বা এই জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। সে ইতিহাসও খাদেম সাহেবের প্রতিনিধি আমাদের শোনাল। খাদেম সাহেব একজন প্রতিনিধি আমাদের সাথে দিয়েছিল। আমরা তারাগড়ে উঠলাম। অনেকক্ষণ সেখানে ছিলাম। তারাগড় পাহাড় থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় শুধু মরুভূমি। আর একদিকে আজমীর শহর। সেখান থেকে নেমে আসলাম যখন তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। আমরা খাদেম সাহেবের আস্তানায় এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম, আনার সাগরে যাবার উদ্দেশে।
বিরাট লেক, সকল পাড়েই শহর গড়ে উঠেছে আজকাল। একপাশে মোগল আমলের কীর্তি পড়ে আছে। এখানে এসে বাদশা ও বেগমরা বিশ্রাম করতেন। বাদশা শাহজাহানের কীর্তিই সকলের চেয়ে বেশি। বাদশা ও বেগম যেখানে থাকতেন সে জায়গাটা আজও আছে। সাদা মর্মর পাথরের দ্বারা তৈরি। আমরা সমস্ত সন্ধ্যা সেখানেই কাটালাম। সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে শহরের দিকে রওয়ানা করলাম। পানির দেশের মানুষ আমরা, পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব! আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন বলেছিল, রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? সত্যিই ভাল হত, কিন্তু উপায় নাই। রাতে কাউকেও থাকতে দেওয়া হয় না, এই জায়গাটায়। আবার থাকতে চেষ্টা করলে যদি পুলিশ বাহাদুররা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তবে কে এই বির্ভূই বিদেশে আমাদের হাজত থেকে রক্ষা করবে।
সন্ধ্যার পরে খাজাবাবার দরগাহে ফিরে এলাম। কিছু সময় সেখানে থেকে আবার আমাদের আস্তানায় চলে এলাম। খাদেম সাহেব আমাদের জন্য খুব ভাল খাবার বন্দোবস্ত করেছে। রাতটা খুব আরামেই ঘুমালাম।
আজমীর শরীফকে বিদায় দিয়ে আবার আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম আগ্রার দিকে, যেখানে মমতাজ বেগম শুয়ে আছেন তাজমহলকে বুকে করে। বহুদিনের স্বপ্ন তাজমহল দেখব মোগল শিল্পের ও স্থাপত্যকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই তাজ। বাদশা শাহজাহানের অমর প্রেমের নিদর্শন এই তাজ। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই তাজ। আমাদের নিজেদের মধ্যে তাজ দেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হল। দুনিয়ার বহু দেশ থেকে বহু লোক শুধু তাজ দেখার জন্য ভারতবর্ষে আসত। তাজমহলের কথা জানে না, এমন মানুষ দুনিয়ায় খুব বিরল। আমাদের দেরি আর সইছে না। মনে হচ্ছে ট্রেন খুব আস্তে আস্তে চলছে, কারণ তাজ দেখার উদগ্র আগ্রহ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমরা তো ভাবি নাই ঠিক পূর্ণিমার দিনে আগ্রা পৌঁছাব। আমরা হিসাব করে দিন ঠিক করে আসি নাই। মনে মনে পূর্ণিমাকে ধন্যবাদ দিলাম, আর আমাদের কপালকে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হত, তাই তাকেও দিলাম। আমরা আগ্রায় পৌঁছালাম সকালের দিকে। দুই দিন আমরা আগ্রায় থাকব। কোন একটা হোটেলে উঠব ঠিক করলাম। লোক তো আমরা কম না, প্রায় বার চৌদ্দজন। অনেক টাকা খরচ করতে হবে। মোসাফিরখানা হলেই আমাদের সুবিধা হত। আগ্রা স্টেশনে পৌঁছালাম, অনেক হোটেলের লোকই তাদের হোটেলে থাকতে আমাদের অনুরোধ করল। এক ভদ্রলোক এলেন, তিনি বললেন, “আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, একটা বাঙালি হোটেল আছে, সেখানেই আপনাদের সুবিধা হবে।” চৌধুরী সাহেব বললেন, “আপনাদের হোটেলে তবু আছে? আমরা অনেক লোক।” তিনি বললেন, “তাঁবু খাটিয়ে দিতে পারব।” ঠিক হল, আগ্রা হোটেলেই যাব। চৌধুরী সাহেব একটা রুম নিলেন, আমাদের জন্য দুইটা তবু ঠিক করে দেওয়া হল। আমরা খাটিয়া পেলেই খুশি। শুধু প্রয়োজন আমাদের গোসল করার পানি, আর পায়খানা। হোটেলের মালিক বাঙালি, খুব ভদ্রলোক, আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আমাদের যাবতীয় বন্দোবস্ত করতে ম্যানেজারকে হুকুম দিলেন। কত টাকা দিতে হবে চৌধুরী সাহেবই ঠিক করলেন, তিনিই দিয়েছিলেন। আমাদের কিছুই দিতে হয় নাই।
তাড়াতাড়ি আমরা গোসল করে কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, মন তো মানছে না, তাজ দেখার উদগ্র আগ্রহ। টাঙ্গা ভাড়া করে তাজ দেখতে রওয়ানা করলাম। প্রখর রৌদ্র। কি দেখলাম ভাষায় প্রকাশ আমি করতে পারব না। ভাষার উপর আমার সে দখলও নাই। শুধু মনে হল, এও কি সত্য! কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে যে এ অনেক সুন্দর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাজকে ভালভাবে দেখতে হলে আসতে হবে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাবার সময়, চাঁদ যখন হেসে উঠবে তখন। আমরা বেশি দেরি করলাম না, কারণ আগ্রা দুর্গ ও ইতমতউদ্দৌলা দেখতে হবে সন্ধ্যার পূর্বেই। যখন সূর্য অস্ত যাবে তার একটু পূর্বেই ফিরে আসতে হবে তাজমহলে। টাঙ্গাগুলিকে আমরা দাঁড় করেই রেখেছিলাম।
ইতমতউদ্দৌলা–বেগম নূরজাহানের পিতার কবর। আমরা আগ্রা দুর্গে এলাম। দেওয়ানি আম, মতি মসজিদ, মছি ভবন, নাগিনা মসজিদ সবই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দেওয়ানি খাস ও জেসমিন টাওয়ার দেখতেও ভুল করলাম না। দিল্লির লালকেল্লার সাথে এর যথেষ্ট মিল আছে। মোগল আমলের শিল্প একই রকমের, দেখলেই বোঝা যায়। যমুনার দিকে বারান্দায় কতগুলি পাথর ছিল। সেই পাথরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে তাজকে দেখা যেত। এখন আর পাথরগুলি নাই। একটা কাঁচ লাগান আছে। এই কাচের মধ্যেও পরিষ্কারভাবে তাজকে দেখা যায়। আমরা সকলেই দেখলাম, শীশ মহল দেখে রওয়ানা করলাম। আমাদের যে ভদ্রলোক ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, তিনি অনেক কথাই বলছিলেন। কিছু সত্য, কিছু গল্প, তবে একটা কথা সত্য, মোগলদের পতনের পরে বার বার লুটতরাজ হয়েছে। জাঠ ও মারাঠি এবং শেষ আঘাত হেনেছে ইংরেজ। জাঠ ও মারাঠিরা কিছু কিছু লুট করেই চলে গিয়েছিল, কিন্তু ইংরেজ সবকিছু লুট করেই নিয়ে গিয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। লর্ড স্থানীয় লোকরাই এই লুটের প্রধান কর্ণধার ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের অনেক জায়গায়ই মোগল শিল্পের অনেক নিদর্শন আছে। আমরা ইতমতউদ্দৌলা দেখে ফিরে চললাম তাজমহল দেখতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দিল্লির লালকেল্লা পূর্বেই দেখেছি, তাই আগ্রা দুর্গ দেখতে আমাদের সময় লাগার কথা না।
সূর্য অস্তাচলগামী, আমরাও তাজমহলের দরজায় হাজির। অনেকক্ষণ থাকব, রাত দশটা পর্যন্ত দরজা খোলা থাকে, তারপর দারোয়ান সাহেবরা এসে ঘণ্টা দিয়ে জানিয়ে দিবে সময় হয়ে গেছে। তাজকে ত্যাগ করতে হবে, রাতের জন্য। আমরা বসে পড়লাম, একটা জায়গা বেছে নিয়ে কয়েকজন নামাজ পড়তে গেলেন। আজানের ধ্বনি কানে এসেছে। পাকিস্তান হওয়ার পরও আজান হয় কি না জানি না। এই দিনে অনেক লোক দেশ-বিদেশ থেকে এসেছে। বাঙালি, মারাঠি, পাঞ্জাবি—মনে হল ভারতবর্ষের সকল জায়গার লোকই এসেছে। আমাদের পথপ্রদর্শককে জিজ্ঞাসা করলাম, এত ভিড় কি সকল সময়ই থাকে? বললেন, না, পূর্ণ চন্দ্রের সময়ই অনেক লোক বিশেষ করে আসে। সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রঙ আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হল, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। দারোয়ান দরোজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম।
পরের দিন সকালবেলা আমাদের যেতে হবে ফতেহপুর সিক্রিতে। চৌধুরী সাহেব একটা মোটর বাস ঠিক করেছিলেন। ফতেহপুর সিক্রি ও সেকেন্দ্রা দেখে বিকালে ফিরে আসব এবং রাতেই আমাদের রওয়ানা করতে হবে তুলার পথে। তুলা একটা জংশন। দিল্লি থেকে তুলা হয়ে ট্রেন হাওড়া যায়। হাওড়াগামী ট্রেন ধরা হবে। সকালবেলায় মোটর বাস এসে হাজির। আমরা তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। চৌধুরী সাহেব এলেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মাত্র আটাশ মাইল পথ; কত সময়ই বা লাগবে! মোগলদের স্থাপত্য শিল্পের গল্প করতে করতেই আমরা এসে পড়লাম ফতেহপুর সিক্রিতে। আকবর বাদশা নিজেই ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে সম্রাট আকবর তার রাজধানী করেছিলেন। আগ্রার দুর্গের সাথে এর বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তবে ফতেহপুর সিক্রি অনেক বড়। এই ফতেহপুর সিক্রির সামনেই যে বিরাট ময়দান দেখা যায় এর নামই খানওয়া। এখানেই ম্রাট বাবর সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। কেন যে আকবর বাদশা এখানে দুর্গ তৈরি করেন তা বলা কষ্টকর। এ বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিভিন্ন মত। আমরা আগ্রা গেট পার হয়ে ভিতরে এলাম, সামনে বুলন্দ দরোজা। এটাই হল দুর্গের প্রধান গেট। একশত চৌত্রিশ ফিট উঁচু বুলন্দ দরোজা পার হয়েই আমরা প্রথম দেখতে পেলাম সেলিম চিশতীর দরগাহ। তাঁর মাজার জিয়ারত করে আমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করব। দরগাহ জিয়ারত করলাম। সেলিম চিশতী ছিলেন বাদশাহ আকবরের পীর। আজমীরের খাজাবাবার দরগায় দেখলাম গান বাজনা চলছে সমানে, এখানেও দেখলাম সেই একই অবস্থা। আমাদের বাংলাদেশের মাজারে গান বাজনা করলে আর উপায় থাকত না। খাজাবাবা মঈনুদ্দিন চিশতী ও সেলিম চিশতী দুইজনই নাকি গান ভালবাসতেন। আমরা এক এক করে এবাদতখানা থেকে আরম্ভ করে আবুল ফজলের বাড়ি, হামামখানা, ধর্মশালা, মিনা মসজিদ, যোধাবাঈ মহল ও সেলিম গড় দেখতে শুরু করলাম।
এক একজনে এক একটা জায়গা দেখতে চায়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম তানসেনের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত তানসেনের বাড়ি দেখতে গেলাম। তার বাড়িটা প্রাসাদের বাইরে, পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি। বোধহয় সঙ্গীত সাধনায় ব্যাঘাত হবে, তাই তিনি দূরে থাকতেই ভালবাসতেন। আমার মন যেন সান্ত্বনা পেল না তানসেনের বাড়ি দেখে। যা হোক, বহুদিনের কথা, এ বাড়িতে তিনি ছিলেন কি না শেষ পর্যন্ত তারই বা ঠিক কি? ম্রাট তো এত অর্থ খরচ করে যে প্রাসাদ ও দুর্গ তৈরি করলেন, দু’বছরের বেশি থাকতে পারেন নাই, আবার আগ্রা দুর্গে ফিরে যেতে হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, পানির অভাবের জন্য। আমার মন স্বীকার করতে চায় না যে, পানির জন্য তিনি চলে যান। মনে হয় অন্য কোন কারণ ছিল। আট বর্গমাইল জায়গা নিয়ে ফতেহপুর সিক্রি, রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ গড়ে তোলেন যার মধ্যে দুই হাজার নয়শত ঘর ছিল। আগ্রা দুর্গে ছিল প্রায় পাঁচশত ঘর। ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাটের সমস্ত অমাত্যবৃন্দের থাকার জায়গা হয়েও ষাট হাজার সৈন্য থাকতে পারত। সম্রাট আকবরের শক্তি এবং সামর্থ্য ছিল। তিনি এদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারেন নাই, পানির কষ্টেই তিনি ফতেহপুর সিক্রি ছেড়ে আসেন, এটা যেন বিশ্বাস করতে মন চাইল না।
আমাদের আবার সন্ধ্যায় ট্রেন ধরতে হবে। লোকাল ট্রেন আগ্রা থেকে তুলা পর্যন্ত যায়। ফতেহপুর সিক্রির পাশেই একটা ডাকবাংলো আছে। আমরা সকলেই কিছু খেয়ে নিয়ে রওয়ানা করলাম সেকেন্দ্রায়, যেখানে ম্রাট আকবর চিরনিদ্রায় শায়িত। এই সমাধি স্থান তিনি নিজেই ঠিক করে গিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে শুরু করে অনেক রাজা-বাদশার সমাধি আমি দেখেছি, কিন্তু সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধির ভাবগম্ভীর ও সাদাসিধে পরিবেশটা আমার বেশ লেগেছিল। সমস্ত জায়গাটা জুড়ে অনেক রকমের গাছপালায় ভরা, ফল ও ফুলের গাছ! সমাধিটা সাদা পাথরের তৈরি।
আমাদের সময় হয়ে এসেছে, ফিরতে হবে। চৌধুরী সাহেব তাড়া দিলেন। আমরাও গাড়িতে উঠে বসলাম। আগ্রায় ফিরে এসেই মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলাম তুন্দলা স্টেশনে। এসে দেখি বাংলাদেশের অনেক সহকর্মীই এখানে আছেন। অনেক ভিড়। মালপত্র চৌধুরী সাহেবের প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে ফেলে আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে চেষ্টা করলাম। যখন সকলেই উঠে গেছে ট্রেনে, আমি আর উঠতে না পেরে এক ফার্স্ট ক্লাসের দরোজার হাতল ধরে দাঁড়ালাম। আমার সাথে আরেক বন্ধু ছিল। পরের স্টেশনে যে কোন বগিতে উঠে পড়ব। অনেক ধাক্কাধাক্কি করলাম, প্রথম শ্রেণীর লোক দরোজা খুললেন না। ট্রেন ভীষণ জোরে চলছে, আমাদের ভয় হতে লাগল, একবার হাত ছুটে গেলে আর উপায় নাই। আমি দুই হাতলের মধ্যে দুই হাত ভরে দিলাম, আর ওকে বুকের কাছে রাখলাম। মেলট্রেন স্টেশন কাছাকাছি হবে না। আমাদের কিন্তু অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছিল। বাতাসে হাত-পা অবশ হতে চলেছে। আর কিছু সময় চললে আর উপায় নাই। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। আমরা নেমে পড়লাম। ‘আনোয়ার’ ‘আনোয়ার’ বলে ডাকতে শুরু করলাম। মধ্যম শ্রেণীতে আনোয়ার ছিল, ওর কাছেই আমার বিছানা। আমাদের জন্য আনোয়ার খুব উদ্বিগ্ন ছিল। জানালা দিয়ে কোনক্রমে ট্রেনের ভিতর উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। পরের দিন সন্ধ্যায় আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালাম। সকলের সকল কিছুই আছে, আমার সুটকেসটা হারিয়ে গেছে। শুধু বিছানাটা নিয়ে কলকাতা ফিরে এলাম।
এরপর ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাবে। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এক বৎসর মাহিনা দেই নাই। কাপড় জামাও নতুন করে বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। দিল্লি ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠিও দিয়েছিলাম। আব্বাকে বলতেই হবে। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হল। কিছুই বললেন না। পরে বলেছিলেন, “বিদেশ যখন যাও বেশি কাপড় নেওয়া উচিত নয় এবং সাবধানে থাকতে হয়।“ টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, “কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, পাকিস্তানের আন্দোলন বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।” আব্বা, মা, ভাইবোেনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। অমঙ্গল অশ্রুজল বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।”
কলকাতা এসে মাহিনা পরিশোধ করে যে বইপত্রগুলি বন্ধুবান্ধবরা পড়তে নিয়েছিল, তার কিছু কিছু চেয়ে নিলাম। কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেন, “কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে।” আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসত। পড়তে চাইলেই কি আর লেখাপড়া করা যায়। ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবর্ষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত। মাঝে মাঝে মিটিং হয়, বক্তৃতাও করি। এই সময় ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গ্রহণ করবে। তাতে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিল। পরে কংগ্রেস চুক্তিভঙ্গ করে, যার ফলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। এমনভাবে ক্যাবিনেট মিশন আলোচনা করছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের হাতে শাসন ক্ষমতা দিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারকে ভালভাবে জানতেন ও বুঝতেন, তাই তাকে ফাঁকি দেওয়া সোজা ছিল না।
১৮.
২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা বোম্বে শহরে আহ্বান করলেন। অর্থের অভাবের জন্য আমি যেতে পারলাম না। জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি এটা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর। কোনো রকম বাধাই তারা মানবে না। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’, তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।
আমাদের আবার ডাক পড়ল এই দিনটা সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, “তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি। আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লায় সমানে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, পাকিস্তান আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ফরোয়ার্ড ব্লকের কিছু নেতা আমাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এলেন এবং এই দিনটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে পালন করা যায় তার প্রস্তাব দিলেন। আমরা রাজি হলাম। কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডার কাছে তারা টিকতে পারল না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বলে দিলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে।” তিনি ১৬ই আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। এতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরও ক্ষেপে গেল।
১৫ই আগস্ট কে কোথায়, কোন এরিয়ায় থাকবে ঠিক হয়ে গেল। ১৬ই আগস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। সমস্ত এরিয়া থেকে শোভাযাত্রা করে জনসাধারণ আসবে। কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল দশটায় জড়ো হবে। আমার উপর ভার দেওয়া হল ইসলামিয়া কলেজে থাকতে। শুধু সকাল সাতটায় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে। আমি ও নূরুদ্দিন সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হলাম। পতাকা উত্তোলন করলাম। কেউই আমাদের বাধা দিল না। আমরা চলে আসার পরে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার হয়ে আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এলাম। কলেজের দরজা ও হল খুলে দিলাম। আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি করে আমরা বউবাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুজে পেত না। ভাবসাব যে খারাপ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যখন ফিরে আসি। নূরুদ্দিন আমাকে কলেজে রেখে লীগ অফিসে চলে গেল। বলে গেল, শীঘ্রই ফিরে আসবে।
বেকার হোস্টেল থেকে মাত্র কয়েকজন কর্মী এসে পৌঁছেছে। আমি ওদের সভাকক্ষ খুলে টেবিল চেয়ার ঠিক করতে বললাম। কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী মনুজান হোস্টেল থেকে ইসলামিয়া কলেজে এসে পৌঁছেছেন। এরা সকলেই মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে হাজেরা বেগম (এখন হাজেরা মাহমুদ আলী), হালিমা খাতুন (এখন নূরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী), জয়নাব বেগম (এখন মিসেস জলিল), সাদেকা বেগম (এখন সাদেকা সামাদ) তাদের নাম আমার মনে আছে। এরা ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল কয়েকজন ছাত্র রক্তাক্ত দেহে কোনোমতে ছুটে এসে ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছেছে। কারও পিঠে ছোরার আঘাত, কারও মাথা ফেটে গেছে। কি যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ, এ জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েরা এগিয়ে এসে বললেন, “যারা জখম হয়েছে, তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পানির বন্দোবস্ত করেন। কোথায় এরা কাপড় পাবে ব্যান্ডেজ করতে? যার যার ওড়না ছিঁড়ে, শাড়ি কেটে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। কাছেই হোস্টেল, তাড়াতাড়ি খবর দিলাম। এদের ব্যান্ডেজ করেই একজন পরিচিত ডাক্তার ছিলেন তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলাম।
একজন ছাত্র বলল, দল বেঁধে আসলে হিন্দুরা আক্রমণ করছে না, তবে একজন দুজন পেলেই আক্রমণ করছে। আরও খবর এল, রিপন কলেজে ছাত্ররা পতাকা উত্তোলন করতে গেলে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে।
ইসলামিয়া কলেজের কাছেই সুরেন ব্যানার্জি রোড, তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কয়ারের জংশন। এখানে সকলেই প্রায় হিন্দু বাসিন্দা। আমাদের কাছে খবর এল, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসছে। কয়েকজন ছাত্রকে ছাত্রীদের কাছে রেখে, আমরা চল্লিশ পঞ্চাশজন ছাত্র প্রায় খালি হাতেই ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত গেলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা কাকে বলে এ ধারণাও আমার ভাল ছিল না। দেখি শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক মসজিদ আক্রমণ করছে। মৌলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তার পিছে ছুটে আসছে একদল লোক লাঠি ও তলোয়ার হাতে। পাশেই মুসলমানদের কয়েকটা দোকান ছিল। কয়েকজন লোক কিছু লাঠি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল। আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল। হিন্দুরা আমাদের সামনা সামনি এসে পড়েছে। বাধা দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। ইট পাটকেল যে যা পেল তাই নিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করে গেল। আমরা সব মিলে দেড় শত লোকের বেশি হব না। কে যেন পিছন থেকে এসে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কয়েকখানা লাঠি দিল। এর পূর্বে শুধু ইট দিয়ে মারামারি চলছিল। এর মধ্যে একটা বিরাট শোভাযাত্রা এসে পৌঁছাল। এদের কয়েক জায়গায় বাধা দিয়েছে, রুখতে পারে নাই। তাদের সকলের হাতেই লাঠি। এরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগদান করল। কয়েক মিনিটের জন্য হিন্দুরা ফিরে গেল, আমরাও ফিরে এলাম। পুলিশ কয়েকবার এসে এর মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। এখন সমস্ত কলকাতায় হাতাহাতি মারামারি চলছে। মুসলমানরা মোটেই দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না, একথা আমি বলতে পারি।
আত্রা রওয়ানা করলাম গড়ের মাঠের দিকে। এমনিই আমাদের দেরি হয়ে গেছে। লাখ লাখ লোক সভায় উপস্থিত। কালীঘাট, ভবানীপুর, হ্যারিসন রোড, বড়বাজার সকল জায়গায় শোভাযাত্রার উপর আক্রমণ হয়েছে। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন এবং তাড়াতাড়ি সকলকে বাড়ি ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। কিন্তু যাদের বাড়ি বা মহল্লা হিন্দু এরিয়ার মধ্যে তারা কোথায় যাবে? মুসলিম লীগ অফিস লোকে লোকারণ্য। কলকাতা সিটি মুসলিম লীগ অফিসেরও একই অবস্থা। বহু লোক জাকারিয়া স্ট্রিটে চলে গেল। ওয়েলেসলী, পার্ক সার্কাস, বেনিয়া পুকুর এরিয়া মুসলমানদের এরিয়া বলা চলে। বহু জখম হওয়া লোক এসেছে; তাদের পাঠাতে হয়েছে মেডিকেল কলেজ, ক্যাম্বেল ও ইসলামিক হসপিটালে। মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে, শুধু একই কথা, আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব।’ কয়েকজন ফোনের কাছে বসে আছে, শুধু টেলিফোন নাম্বার ও ঠিকানা লিখে রাখবার জন্য। লীগ অফিস রিফিউজি ক্যাম্প হয়ে গেছে, ইসলামিয়া কলেজও খুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা মাদ্রাসা যখন খুলতে যাই, তখন দারোয়ান কিছুতেই খুলতে চাইছে না। আমি দৌড়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে গেলে তিনি নিজেই এসে হুকুম দিলেন দরজা খুলে দিতে। আশেপাশে থেকে কিছু লোক কিছু কিছু খবর দিতে লাগল। বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল পূর্বেই ভরে গেছে। এখন চিন্তা হল টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই। কোন কিছুই জোগাড় হচ্ছে না। কিছু ছাত্ৰ দুপুরে চলে এসেছে। কিছু আটকা পড়েছে। বিল্ডিংটা এমনভাবে ছিল যে, একটা মাত্র গেট। চারপাশে হিন্দু বাড়ি, আগুন দিলে সমস্ত হিন্দু মহল্লা শেষ হয়ে যাবে। রাতে কয়েকবার গেট ভাঙবার চেষ্টা করেছে, পারে নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালবাজার আছেন। লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নূরুদ্দিন অনেক রাতে একটা বড় গাড়ি ও কিছু পুলিশ জোগাড় করে তাদের উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করেছিল। অনেক হিন্দু তালতলায়, ওয়েলেসলী এরিয়ায় ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক গোপনে আমাদের সাহায্য চাইল। অনেক কষ্টে কিছু পরিবারকে আমরা হিন্দু এরিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হলাম, বিপদ মাথায় নিয়ে। বেকার হোস্টেলের আশেপাশে কিছু কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, তাদেরও রক্ষা করা গিয়েছিল। এদের সুরেন ব্যানার্জি রোডে একবার পৌঁছে দিতে পারলেই হয়।
আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই, কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ি, একবার আমার ছোটবোনের বাড়ি এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো কথা বেশি শোনে না। খুবই দুষ্ট ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে! শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটা ফ্যামিলি মুসলমান।
কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়! এক এক করে খবর নিতে চেষ্টা করলাম। ছোট ভগ্নিপতি হ্যারিসন রোডে টাওয়ার লজে থাকে। সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে যেয়ে খবর নিলাম, সে চলে গেছে কারমাইকেল হোস্টেলে। নাসের মেজোবোনের কাছেও নাই, আমার কাছেও নাই। আমার সবচেয়ে ছোট ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, “নাসের ভাই ১৬ই আগস্ট আমার এখানে এসেছিল, থাকতে বললাম থাকল না, আমিও জোর করলাম না। কারণ আমার জায়গাটাও ভাল না। আমাদেরও পালাতে হবে।”
তারপরে আর খোঁজ নাই, কি করে খবর নিই! লেডী ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা, আর নিচে পুরুষরা। কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে থাকতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিন ১৬ই আগস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে। পরের দুই দিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে। পরে হাসপাতালের হিসাবে সেটা দেখা গিয়েছে।
এদিকে হোস্টেলগুলিতে চাউল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছে। কোন দোকান কেউ খোলে, লুট হয়ে যাবার ভয়েতে। শহীদ সাহেবের কাছে গেলাম। কি করা যায়? শহীদ সাহেব বললেন, “নবাবজাদা নসরুল্লাহকে (ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই, খুব অমায়িক লোক ছিলেন, শহীদ সাহেবের ভক্ত ডেপুটি চিফ হুইপ ছিলেন) ভার দিয়েছি, তার সাথে দেখা কর।” আমরা তার কাছে ছুটলাম। তিনি আমাদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গেলেন এবং বললেন, “চাউল এখানে রাখা হয়েছে তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর। আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। তবে দেরি করলে পরে গাড়ির বন্দোবস্ত করা যাবে। আমরা ঠেলাগাড়ি আনলাম, কিন্তু ঠেলবে কে? আমি, নূরুদ্দিন ও নূরুল হুদা (এখন ডিআইটির ইঞ্জিনিয়ার) এই তিনজনে ঠেলাগাড়িতে চাউল বোঝাই করে ঠেলতে শুরু করলাম। নূরুদ্দিন সাহেব তো তালপাতার সেপাই’শরীরে একটুও বল নাই। আমরা তিনজনে ঠেলাগাড়ি করে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে চাউল পৌঁছে দিলাম। এখন কারমাইকেল হোস্টেলে কি করে পৌঁছাই? অনেক দূর, হিন্দু মহল্লা পার হয়ে যেতে হবে। ঠেলাগাড়িতে পৌঁছান সম্পূর্ণ অসম্ভব। নূরুদ্দিন চেষ্টা করে একটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি জোগাড় করে আনল। আমরা তিনজন কিছু চাল নিয়ে কারমাইকেল হোস্টেলে পৌঁছে ফিরে আসলাম।
শ্রীরামপুরে কোনো গোলমাল হয় নাই শুনলাম, কিন্তু নাসের কোথায়? লোক পাঠালাম শ্রীরামপুরে খবর আনতে। দাঙ্গা ও লুটতরাজ একটু বন্ধ হয়েছে। নাসের কলকাতায় এসেছিল ১৬ই আগস্ট। হ্যারিসন রোডে এসে বিপদে পড়ে। তারপর একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে উঠে জীবনটা বাঁচায়। মাসেরের একটা পা ছোটকালে টাইফয়েড হয়ে খোড়া হয়ে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। সেই পা দেখিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ে। দিনভর এ্যাম্বুলেন্সে থাকে, সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে শ্রীরামপুর যায়। ট্রেনে তিন ঘণ্টা লাগে। কয়েকবার ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।
একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধ্যার পরে কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র শুধু গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোনো কথা নেই শুধু গুলি।
একবার আমার ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীর (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএনএ) উপর ভার পড়েছে রাতে পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝে একটা মুসলমান বস্তি আছে-প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমণ করে—তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ, বন্দুক চালানোর লোকের নাকি অভাব। আমি ও মোয়াজ্জেম বন্দুক চালাতে পারতাম। আমার ও মোয়াজ্জেমের বাবার বন্দুক ছিল। আমরা গুলি ছুঁড়তে জানতাম।
সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় খবর এল মিল্লাত অফিস থেকে ঐ এলাকায় যাবার জন্য। আমরা রওয়ানা করে তাড়াতাড়ি ছুটতে লাগলাম, কোন গাড়ি নাই। আমাদের পায়ে হেঁটেই পৌঁছাতে হবে। কেবলমাত্র লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে আমরা ছোট রাস্তায় ঢুকেছি, অমনিই কারফিউর সময় হয়ে গেছে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গাড়ির শব্দ পেলেই আমরা লুকাই, আবার হাঁটি। অনেক কষ্টে পার্ক সার্কাস ময়দানের পিছনে এলাম। ময়দান পার হই কি করে? অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টার পর ময়দানের পিছন দিয়ে সওগাত প্রেসের মালিক ও সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাড়ির কাছে পৌঁছালাম। সেখান থেকে আর একটা রাস্তা পার হয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকলাম। কিন্তু এখন কি করি? বন্ধুর বাবা ও মা আমাদের কিছুতেই বার হতে দিতে রাজি হলেন না। কারণ, রাস্তার মোড়েই মিলিটারি পাহারা দিচ্ছে। তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে। উপায় নাই। রাতে আমাদের সেখানেই কাটাতে হল। আমরা জায়গামত পৌঁছাতে পারলাম না। যদিও সে রাতে কোনো গোলমাল হয় নাই। প্রায় মাইল দেড়েক পথ অতিক্রম করেছিলাম। যে কোনো সময় গুলি খেয়ে মরতে পারতাম।
পার্ক সার্কাস এরিয়ায় বিচারপতি সিদ্দিকী, জনাব আবদুর রশিদ, জনাব তোফাজ্জল আলী (ভূতপূর্ব মন্ত্রী), আরও অনেকে ডিফেন্স পার্টির নেতৃত্ব দিতেন। আমরা ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে কেউ এসেই হিন্দু বা মুসলমান মহল্লায় না যায়। কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় এবং হিন্দুরা মুসলমান মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নাই। কলকাতায় মহিলাদের মধ্যে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লাহর মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম আক্তার আতাহার আলী, সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মনুজান হোস্টেলের ও ব্র্যাবোন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন। রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভিতর, আমাদের করতে হত পুরুষদের মধ্যে। রাতে অসুবিধা হত, তবুও হাজেরা মাহমুদ আলী, হালিমা নূরুদ্দিন আরও কয়েকজনকে সারা রাত পরিশ্রম করতে দেখেছি। কলকাতার অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে গেছে। মুসলমানরা মুসলমান মহল্লায় চলে এসেছে। হিন্দুরা হিন্দু মহল্লায় চলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল একমাত্র এ্যাসপ্লানেডে, যাকে আমরী চৌরঙ্গী বলতাম। এখন অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। বেশ কিছুদিন কোনো গোলমাল নাই। হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। শহীদ সাহে সমস্ত রাতদিন পরিশ্রম করছেন, শান্তি রক্ষা করবার জন্য। কলকাতায় চৌদ্দ-পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন মুসলমান, অফিসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কি করে? তিনি আরও এক হাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলে তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর আপত্তি তুলেছিলেন। শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজি হন। পাঞ্জাব থেকে যুদ্ধ ফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন। এতে ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল।
১৯.
কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হল নোয়াখালীতে। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করল এবং আগুন লাগিয়ে দিল। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হল বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের উপর প্ল্যান করে আক্রমণ হয়েছিল। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন দিন পরেই আমরা রওয়ানা করলাম পাটনায়। বহু স্বেচছাসেবক রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তারও কলকাতা থেকে গিয়েছিল। আমার কলকাতার এক সহকর্মী মিস্টার ইয়াকুব, খুব ভাল ফটোগ্রাফার, সে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছে। ঘুরে ঘুরে অনেক ফটো তুলেছিল বিহার থেকে। জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন ও আমি যেদিন যাই সেদিন জনাব ফজলুল হক সাহেবও পাটনায় রওনা দিলেন। শহীদ সাহেব পাটনায় মুসলিম লীগ নেতাদের খবর দিলেন যে কোন সাহায্য প্রয়োজন হলে বেঙ্গল সরকার দিতে রাজি আছে। বিহার সরকারকেও তিনি একথা জানিয়ে দিলেন। আমরা যখন পাটনায় নামলাম, অবস্থা দেখে রীতিমত ভয় লাগতে লাগল। কাউকেও চিনি না, কোথা থেকে কোথায় যাই। তবে জহির পাটনায় কয়েকবার গিয়েছে। আমরা মিস্টার ইউনুস, মন্ত্রী বিহার সরকারের, তার একটা হোটেল আছে—’গ্রান্ড হোটেল’, সেই হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে মওলানা রাগীব আহসান সাহেব অফিস খুলেছেন, বেঙ্গল মুসলিম লীগের তরফ থেকে। আবদুর রব নিশতার সাহেব সেদিন পাটনায় আসলেন। আমরা একসাথে কনফারেন্স করলাম, কি করা যায়। তিন দিন পরে, নূরুদ্দিন কলকাতায় চলে গেল। জহির পাটনায় রইল। আমরা বললাম, বিহারে আমরা কি সাহায্য করতে পারি? শহীদ সাহেব বলেছেন, ট্রেন ভরে আসানসোলে রিফিউজিদের পৌঁছে দিলে বাংলা সরকার তাদের সকল দায়িত্ব নিতে রাজি আছে। জনাব আকমল (আইসিএস) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কেমন করে শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন?” আমার অল্প বয়স দেখে তিনি বিশ্বাস করতেই চাইলেন না যে, শহীদ সাহেব আমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন। আমি তাকে বললাম, “আমি শহীদ সাহেবের মতামত জানি এবং তার পক্ষ থেকে কথাও কিছু বলতে পারি। অনেকে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি শহীদ সাহেবের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, “টেলিফোন করে দেখতে পারেন।
সকালবেলা আবার বসবার কথা। আকমল সাহেব আমাকে বললেন, “আজ থেকেই আমরা আসানসোলে লোক পাঠাব।” যে সমস্ত লোক গ্রাম থেকে শহরে আসছে তাদের জায়গা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমানে ইসলামিয়া ও আর যে সমস্ত জায়গা করা হয়েছিল সেখানে আর জায়গা নাই। সীমান্ত থেকে পীর মানকী শরীফের দল, আলীগড় থেকে আমাদের বন্ধু মোস্তফা ও সৈয়দ আহমেদ আলীসহ বহু ছাত্র কর্মী এসেছে। কলকাতা থেকে ছাত্র, ডাক্তার, ন্যাশনাল গার্ড মিলে প্রায় হাজার লোক পাটনায় জমা হয়েছে। দূর দূর গ্রাম থেকে দুর্গতদের উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। আমি হাজার খানেক রিফিউজি নিয়ে রওয়ানা করলাম আসানসোলের দিকে। আসানসোল মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ইয়াসিন সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। তিনি দুইখানা ট্রাক ও কিছু ভলানটিয়ার নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। লোকগুলিকে প্লাটফর্মেই রাখা হল। অনেক লোক জখম ছিল। নূরুদ্দিন শহীদ সাহেবকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেছে। পাটনা থেকেও খবর দেওয়া হয়েছে শহীদ সাহেবকে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এসডিওকে হুকুম দিয়েছেন, এদের জায়গা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
নূরুদ্দিন কলকাতা থেকে আমাকে সাহায্য করবার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও কিছু ডাক্তার পাঠিয়েছে। এসডিও ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান। তিনি যুবক ও খুবই ভদ্রলোক। শহীদ সাহেব হুকুম দিয়াছেন, যে সমস্ত ব্যারাক যুদ্ধের সময় করা হয়েছিল সৈন্যদের থাকবার জন্য সেগুলির মধ্যে রিফিউজিদের রাখতে। সরকার থেকে খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তার বিলি বণ্টনের জন্য এসডিও, আসানসোল মুসলিম লীগ নেতারা ও আমি একটা বৈঠক করলাম। প্রথমে ক্যাম্প খোেলা হল নিগাহ’ নামে একটা ছোট্ট গুদামে। সেখানে হাজার খানেক লোক ধরবে। পরে কান্দুলিয়া ক্যাম্প পোলা হল। এতে প্রায় দশ হাজার লোকের জায়গা হবে। আমি এই ক্যাম্পের নাম দিলাম, হিজরতগঞ্জ’। মওলানা ইয়াসিন নামটা গ্রহণ করলেন এবং খুশি হলেন। আসানসোল স্টেশনে ও পরে রাণীগঞ্জ স্টেশনে মোহাজেরদের নামানো হত, পরে ট্রাকভরে ক্যাম্পগুলিতে নিয়ে আসা হত। আমার সাথে সকল সময়ের জন্য কাজ করতেন মওলানা ওয়াহিদ সাহেব। আমরা একসাথে পড়তাম, এখন তিনি শাহজাদপুরের পীর সাহেব।
আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। মোহাজিরদের জন্য যা পাক করতাম, তার থেকেই কিছু খেয়ে নিতাম। দোকানপাট কিছুই ছিল না। শত শত লোক রোজই আসছে। দিনে একবেলার বেশি খেতে দিতে পারতাম না। একটা হাসপাতাল করেছিলাম। ময়মনসিংহের ডা. আবদুল হামিদ এবং গফরগাঁয়ের ডা, হজরত আলী এই হাসপাতালে কাজ করতেন। আসানসোলের এসডিও মিস্টার রোজ চার পাঁচ দিন পরে একজন বৃদ্ধা মেম সাহেবকে নিয়ে আসলেন। তিনি আমাদের কাজের প্ল্যান করে দিয়ে সাহায্য করবেন। কারণ, এই ভদ্রমহিলা যুদ্ধের সময় ব্রহ্মদেশ থেকে যখন লোক পালিয়ে আসছিল তখন সরকারি ক্যাম্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি যে প্ল্যান দিলেন, তাতে কাজের সুবিধাই হল।
ছয়-সাত দিন পর, বাংলা সরকার জনাব সলিমুল্লাহ ফাহমীকে বিহার মোহাজেরদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করলেন। তিনি আসানসোলে এসে আমার খোঁজ করেন। পরে ময়রা ক্যাম্পে এসে আমাকে পেলেন। তিনি ক্যাম্পগুলিকে সরকারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবকরাও কাজ করলেন। আমি ও সলিমুল্লাহ সাহেব পরামর্শ করে মোহাজেরদের থেকে সুপারিনটেনডেন্ট, এসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, রেশন ইনচার্জ, দারোয়ান ও অন্যান্য কর্মচারী নিযুক্ত করলাম।
এক জায়গায় খানা পাকানো সম্ভবপর হচ্ছে না। রেশন কার্ড করে প্রত্যেক ফ্যামিলিকে বিনা পয়সায় চাল, জ্বালানি কাঠ, মরিচ, পিয়াজ সবকিছুই সাত দিনের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। শুধু মাংস একদিন পর পর দেওয়া হবে। মোহাজেররা এই বন্দোবস্তে খুশি হলেন। এই সমস্ত ঠিক করতে এক মাস হয়ে গেল। এই সময় বিহার থেকে জাফর ইমাম সাহেব মোহাজেরদের বাংলাদেশের লোকেরা কেমন রেখেছে দেখবার জন্য এলেন। আমার সাথেও দেখা করলেন, আমাদের অফিসে। আমরা একটা অফিস খুলেছিলাম, তার পাশেই আমরা থাকতাম। আমাদের পাকের বন্দোবস্তও হয়েছিল ঐখানেই। আমাদের সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা দেখে তিনি আমাকে ও আমাদের সহকর্মীদের অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। মোহাজেরদের সাথে দেখা করে তাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
পরে ময়রা ও মাধাইগয়ে ক্যাম্প খুললাম। এই দুই ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার মোহাজের দেওয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষিত দ্র ফ্যামিলিও এসেছিলেন। মোহাজেরদের আর আসানসোল এরিয়ায় জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এর পরে বিষ্ণুপুর, অন্ডাল, বর্ধমানেও কিছু কিছু মোহাজের পাঠালাম। আমার সাথে যে সমস্ত কর্মী ছিল, আহার ন্দ্রিার অভাব ও কাজের চাপে প্রায় সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই অনেককে পূর্বেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমারও জ্বর হয়ে গিয়েছিল। এই সময় মোহাম্মদ আলী ও এ. এফ. এম. আবদুর রহমান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা বেগম সোলায়মান, ইফফাত নসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন কর্মচারীসহ আসানসোলে আসেন। আমাকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিল। আমিও আসানসোলে তাঁদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁদের নিয়ে ক্যাম্পগুলি দেখান হয়েছিল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁদের সাথেই কলকাতা রওয়ানা হয়ে আসতে বাধ্য হলাম। বেগম সোলায়মান আমার শরীর ও চেহারার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।
২০.
দেড় মাস পরে আমি কলকাতায় হাজির হলাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে। বেকার হোস্টেলে এসেই আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর মোটেই ছাড়ছিল না। শহীদ সাহেব খবর পেয়ে এত কাজের ভিতরেও আমার মত সামান্য কর্মীর কথা ভোলেন নাই। ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে আমার জন্য সিট ঠিক করে খবর পাঠিয়ে দিলেন। পনের দিন হাসপাতালে ছিলাম, তিনি ফোন করে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে খোঁজ নিতেন। সেই জন্যই প্রিন্সিপাল আমাকে দেখতে আসতেন। আমি ভাল হয়ে আবার হোস্টেলে ফিরে এলাম।
আসানসোলে ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এবং নিজ হাতে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম, পরবর্তী জীবনে তা আমার অনেক উপকার করেছিল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে। এই সময় মনস্থির করলাম, আমাকে বিএ পরীক্ষা দিতে হবে। ড. জুবেরী আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, “তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না। তুমি যদি ওয়াদা কর যে এই কয়েক মাস লেখাপড়া করব এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা, তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব।” তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি ওয়াদা করলাম, প্রফেসর তাহের জামিল, প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে। আমি অনুমতি নিয়ে আমার এক বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী—তার নাম ছিল শেখ শাহাদাত হোসেন, ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে, এখন হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায় চাকরি করে, ওর কাছে চলে গেলাম, সমস্ত বইপত্র নিয়ে।
পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোটবোনের স্বামী বরিশালের এডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন পার্ক সার্কাসে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকত, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।
শেখ শাহাদাত হোসেন দুই মাসের ছুটি নিয়ে আমাকে পড়তে সাহায্য করেছিল। পরে জীবনে অনেক ক্ষতি আমার সে করেছে। এর জন্য তাকে কোনোদিনই কিছু বলি নাই। ওর বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি।