ডা. ক্লেইবন যখন হার্ডওয়্যার স্টোরের সামনে এসে গাড়ি থামালেন, তখন দেখতে পেলেন, শেরিফের গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জ্বলতে থাকা লাল-নীল আলো দেখা মাত্র, ব্রেক কষে ছিলেন তিনি। এখন গাড়ি থেকে নেমে, দরজার সামনে চলে এলেন।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। দরজার কাছে আসতেই, ছোট খাটো এক মানুষ তাকে আটকে দিল। সাথে সাথে পেশাগত দৃষ্টিতে তিনি অপরিচিত লোকটার দিকে তাকালোঃ পাতলা, চিমসে আসা চেহারা। চোখের রঙের সাথে মিলে যায় এমন হালকা বাদামী চুল, একদম নিখুঁত করে কাটা গোঁফ। কালো স্যুট পরে আছে, সেই সাথে সাদা শার্ট আর ধূসর রঙা টাই। ছোট শহরগুলোর ব্যবসায়ীরা সাধারণত এমন পোশাকই পরে থাকে। স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল ডা. ক্লেইবর্নের দেহমনে।
স্যাম লুমিস? জানতে চাইলেন তিনি।
ছোট খাটো মানুষটা মাথা নাড়ল। না, মিল্ট অ্যাংস্ট্রম। কাউন্টির শেরিফ আমি।
কথাগুলো শোনা মাত্র উধাও হয়ে গেল ক্লেইবর্নের স্বস্তিটুকু, দৃষ্টি নেমে এল নিচে। একটু আগে দেখা পরিধেয়টুকু সম্পূর্ণ হলো এবার-লোকটার পায়ে সুচালো, কালো বুট। চোখ তুলে শেরিফের দিকে তাকালেন তিনি। একটা প্রশ্ন করলেন তিনি, কিন্তু উত্তরটা কী হবে, তা-ও বুঝতে পারলেন। মি. লুমিস কোথায়? তার কি কিছু হয়েছে?
কিছু মনে না করলে বলি, এখানে সচরাচর আমিই প্রশ্ন করে থাকি। প্রতিক্রিয়াহীন চোখে ডা, ক্লেইবর্নের দিকে তাকিয়ে বললেন শেরিফ। এই যেমন, আপনি কে? এখানে কী করছেন?
ক্লেইবর্নের মনে হলো, তার পাটা আর দেহের ভার বইতে পারছে না। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে শরীর। বিশ্রাম নেবার শেষ সুযোগটা কখন পেয়েছেন, তা-ও এখন মনে করতে পারছেন না। এমনকী হাইওয়ে থেকে শহরে আসার রাস্তায় নামার পর, গাড়ি চালাতে চালাতেই তন্দ্রা মতো চলে এসেছিল। অতিরিক্ত চিন্তার কুফল। এই মুহূর্তে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে আর কিছু চান না তিনি। অনেক লম্বা কাহিনী, অবশেষে বললেন। একটু ভেতরে গিয়ে বললে
কুঁচকে এলো শেরিফের ভু। এখানে দাঁড়িয়েই বলুন।
শেরিফকে নিজের পরিচয় দিয়ে যখন হাসপাতাল আর ওই ভ্যানের ব্যাপারে বলা শেষ করেছেন, তখন ডা. ক্লেইবর্নের মনে হচ্ছিল, আরেকটু হলেই পড়ে যাবেন।
কিছুই লিখলেন না শেরিফ, কিন্তু বোঝা গেল খুব মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনেছেন। কথা শেষ হলে নড় করলেন, মনে হচ্ছে, আপনি ভেতরে এলেই ভালো হবে। ক্লেইবনকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, ঘুরে ভেতরে চলে গেলেন।
দ্রুত পায়ে এগোলেন ক্লেইবর্ন, শেরিফের কাছাকাছি আসতেই জানতে চাইলেন, লুমিস কি মত?
কাউন্টার কাছাকাছি পৌঁছে থমকে দাঁড়ালেন শেরিফ, মেঝের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আপনি ডাক্তার, আপনিই বলুন।
সামনে দিকে ঝুঁকে গেলেন ক্লেইবর্ন, শেরিফের দেখানো জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত। অ্যাংস্ট্রমকে একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, তা বুঝতে পারছে। শালা হারামী-উপভোগ করছে ব্যাপারটা! কী মনে করেছে? বমি করে ফেলব? আমি ডাক্তার, এরচেয়ে বীভৎস শত শত লাশ দেখেছি।
ডা. ক্লেইবর্ন স্যাম লুমিসকেও এর আগে দেখেছেন। আর সেজন্যই কিছুটা হলেও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। লাশটার দলা পাকিয়ে শুয়ে থাকা দেখে, তার ভেতরে কিছু একটা যেন নড়ে উঠল। নরম্যানের ফাইলে এর আগেও এমন দলা পাকানো লাশ দেখতে পেয়েছে। নরম্যানের ফাইল!
অনেক চেষ্টা করে গলায় পেশাদারী ভাব ফুটিয়ে তুললেন তিনি। ক্ষতটা বেশ বড়। বোঝাই যাচ্ছে যে বড় আকারের কোনও ছুরি দিয়ে আঘাত হানা হয়েছে। যে হারে রক্ত ঝরেছে তাতে মনে হয়, অ্যাওটা ফুটো হয়ে গিয়েছে। আমি কি পুরোপুরি পরীক্ষা করে দেখব?
শেরিফ মাথা নাড়লেন। লাগবে না। আমার লোক কাউন্টি জেনারেল হাসপাতাল থেকে আসছে, মানে যখন ওই মনট্রোসের ঝামেলা সামলে ফাঁকা হবে তখন আসবে। কয়েক পা পিছিয়ে, কাউন্টারের ওপাশে চলে গেলেন তিনি। ও আসতে আসতে আরেকটা জিনিস দেখাতে চাই আপনাকে। কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি দেখতে চাইবেন।
শেরিফকে অনুসরণ করলেন ক্লেইব। ভুল বলেছে লোকটা, এই দৃশ্য দেখার কোনও খায়েশ তার নেই। কাউন্টারের ওপাশের পরে আছে অন্তত এক ডজন ক্ষত শরীরে নিয়ে শুয়ে থাকা এক নারী দেহ। সাদাটে ত্বকের ফাঁক দিয়ে লাল রক্ত ঝরেছে। মেয়েটাকে পরিচিত মনে হলো না তার, কিন্তু তবুও চিনতে পারলেন।
লিলা লুমিস। ক্লেইবর্নের আন্দাজটাকে সত্য প্রমাণিত করলেন শেরিফ। স্যামের স্ত্রী।
ঘুরে দাঁড়ালেন ডাক্তার, গা গুলিয়ে আসছে। নিজেকে প্রথম বর্ষের ছাত্র বলে মনে হলো, যে কিনা জীবনের প্রথম শবচ্ছেদ ক্লাসে এসেছে। অনেক কষ্ট করেও, অস্ফুট কণ্ঠে কয়েকটা কথাই বলতে পারলেন কেবল, ও দুজনকেই মেরে ফেলেছে তাহলে।
ও? ও টা কে?
নরম্যান বেটস।
হয়তো।
হয়তো না, এই ঘটনার পর তো সন্দেহের আর কোনও অবকাশ রইল না। আমি ঠিক বলেছিলাম। ভ্যানে আগুন ধরাবার পরপর এখানে চলে আসে নরম্যান। একটু আগে বলেছিলাম না, রাস্তা থেকে নিশ্চয় এক পথচারীকে তুলে নিয়েছিল?
নিশ্চয়? আন্দাজে ঢিলের জায়গায় পাটকেল ছুঁড়ছেন না তো?
নাহ। সাইনটাকে সাথে করে নিয়ে এসেছি। ঘুরতে শুরু করলেন ক্লেইবর্ন। আমার সাথে আসুন। দেখাচ্ছি
পরে, বলে কাউন্টারের শেষ মাথায় চলে এলেন শেরিফ। আরেকটা জিনিস দেখাতে চাই।
ক্লেইবন শেরিফের পাশে এসে দাঁড়ালে, ক্যাশ রেজিস্টারটা খুলে দেখালেন তিনি। খালি। আজ বিকালে ওখানে নয়শ তেরাশি ডলার ছিল। এখন একটা আধুলিও নেই।
পরিমানটা জানলেন কী করে?
মেঝেতে পড়া অবস্থায় একটা কাগজ পেয়েছি, পকেট থেকে কাগজটা বের করতে করতে বললেন অ্যাংস্ট্রম। কালকে ব্যাংকে জমা দেবার জন্য হিসাব সেরে রেখেছিল স্যাম।
তাহলে নরম্যান টাকাগুলো নিয়ে নিয়েছে।
কেউ একজন নিয়েছে, বলে ঘুরে দাঁড়ালেন শেরিফ। আরও কয়েকটা জিনিস দেখাতে চাই। কাউন্টারের নিচে হাত গলিয়ে একটা ডিসপ্লে ট্রে বের করে আনলেন তিনি। ওখানে সুন্দর করে বারোটা নানা আকারের ইস্পাতের ছুরি সাজানো রয়েছে। নাহ, ভুল হলো। এক ডজন না-তাড়াতাড়ি সংখ্যাটা গুনে নিজেকে ঠিক করে নিলেন ক্লেইবন। এখন ওখানে রয়েছে এগারোটা ছুরি, শেষ মাথার ছুরিটা নেই!
একটা নেই, বলে উঠলেন শেরিফ। আমার ধারনা ওটা দিয়েই খুন করা হয়েছে।
ক্লেইবর্নকে পিছু নেবার ইঙ্গিত করে, নিজে পেছনের ঘরটায় চলে গেলেন তিনি। ডাক্তার তার পিছু নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে টের পেয়ে, হাত দিয়ে মাথার ওপর ঝুলন্ত বাতিটা দেখালেন। মিসেস লুমিসের খোঁজে যখন আমি এখানে আসি, তখন পেছনের দরজা খোলা ছিল। কিন্তু বাতি জ্বলছিল না। প্রথমে ভেবেছিলাম চলে গিয়েছে। কিন্তু পরে দেখি, কেউ ওটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছে। বাল্বটাকে আবার জায়গামতো লাগিয়ে দেখি, একদম ঠিক আছে ওটা।
বুঝতে পেরেছি। ক্লেইবর্ন ডেস্ক আর চেয়ারটাকে দেখালেন। নরম্যান চুরি করে ঢোকে ভেতরে, স্যামকে ডেস্কে বসা অবস্থায় খুন করেছে। এরপর লাশটাকে সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে লুকিয়েছে। এই যে দেখুন, রক্তের দাগ। এরপর এখানে আবার ফিরে এসে বাল্বটা খুলে ফেলেছে। অন্ধকারে অপেক্ষা করেছে মিসেস লুমিস আসার
মহিলা যে আসবেন, তা আপনার এই নরম্যান বুঝল কীভাবে?
ভেবেছিল, স্যামের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে নিশ্চয় খোঁজ নিতে আসবে। আসলে এই দুজনকে খুন করার জন্যই এখানে এসেছে ও।
ত্যাগ করলেন অ্যাংস্ট্রম। আমার কী মনে হয় বলব? বললেন তিনি। এরপর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে যোগ করলেন। আমার মনে হয়, চোর ঢুকেছিল। এখানকার কেউ হতে পারে, আবার বাইরে থেকে আসা কোনও পথচারীও হতে পারে। চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আরও কয়েকটা দোকান রেকি করেছিল। কিন্তু পারেনি। পরে এই দোকানে লাইট জ্বলতে দেখে, এখানকার পেছনের দরজা খোলার চেষ্টা করে দেখে। কপাল গুনে খোলা পেয়েও যায়। আপনি যেমনটা বললেন, চুপিসারে ঢুকে পড়ে ভেতরে। কিন্তু এছাড়া আর আপনার কথা মানতে পারছি না।
কেন? কী সমস্যা?
সমস্যা হলো, আপনি গোয়েন্দা নন। মেঝের দিকে তাকালেন শেরিফ। রক্ত আছে, কিন্তু দাগ নেই। কয়েক ফোঁটা আছে মাত্র। আমার তো মনে হয়, এই ফোঁটাগুলো ছুরির গা থেকে পড়েছে। স্যামকে ডেস্কে বসা অবস্থায় ছুরিকাঘাত করা হয়নি; ক্ষতটা ওর বুকে, পিঠে নয়। চোর যখন ভেতরে ঢোকে, তখন ওর কাছে ছুরিই ছিল না! ওটাও তো দোকান থেকে নিতে হয়েছে তাকে।
ভ্রু কুঁচকে ফেললেন ক্লেইবর্ন। আমার তা-ও মনে হয়
কথা তো শেষ করতে দিন! শেরিফ গোবরাটের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমার ধারনা স্যাম যখন দোকান বন্ধ করতে সামনের দিকে গিয়েছিল, তখন ভেতরে ঢুকেছিল চোরটা। পয়সার লোভে এসেছিল সে, খুন করার জন্য না। ভেবেছিল, স্যাম চলে না যাওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকবে। কিন্তু পেছনে লুকাবার মতো কোনও জায়গা নেই বলে, অন্ধকার কাউন্টারের পেছনে আত্মগোপন করেছিল। সমস্যা তখনই শুরু হয়। হয় স্যাম ওকে দেখে ফেলেছিল, নয়তো কোনও আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। চমকে উঠে একটা ছুরি তুলে নেয় চোরটা, বসিয়ে দেয় স্যামের বুকে।
যে কাজে এসেছিল, এরপর সেই কাজেই ব্যস্ত হয়ে পরে চোর বাবাজী। রেজিস্টার থেকে টাকা তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবার মনস্থ করে। কিন্তু ঠিক তখনই দোকানের পেছন দিকে এসে উপস্থিত হয় লিলা লুমিস। ভয় পেয়ে পেছনের দরজায় তালা দিয়ে দেয় চোর, ভেবেছিল লিলা চলে যাবে।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে সে দেখল, লিলার সাথে বাড়তি চাবী আছে! তখন একটা কাজই করার মতো সময় ছিল চোরের হাতে-মাথার উপর থেকে বাল্বটা খুলে ফেলা। তাই করল সে। এরপর হাতে ছুরি নিয়ে মেয়েটা সামনে আসার অপেক্ষায় ওঁত পেতে ছিল।
ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন ক্লেইবন। আপনি তো মেয়েটার লাশ নিজ চোখে দেখেছেন। বললেন তিনি। চোর হলে হয়তো ভয়ের চোটে একবার বা দুইবার। আঘাত হানত। কিন্তু এমনভাবে এক ডজন বার! মেয়েটাকে কেবল খুন করা হয়নি, বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে। যেভাবে এর বোনকে নরম্যান শাওয়ারে খুন। করেছিল- বলতে বলতেই থেমে গেলেন তিনি। বুঝতে পারছেন যে এসব বলে লাভ নেই। কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না। নিরেট, অকাট্য প্রমাণ ছাড়া করবেও না।
শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন, বললেন অ্যাংস্ট্রম। নরম্যান বেটস যদি বেঁচে থাকেও, খুব দ্রুতই ধরা পড়তে হবে তাকে। বেশিদূর যেতে পারবে না।
কীভাবে ধরা পড়বে? ওর হাতে এখন নগদ অর্থ আছে।
আর আমাদের কাছে আছে ওর আইডি, ছবি আর পুরো রেকর্ড। কোথায়, যাবে? কোথায় লুকাবে?
উত্তর দিলেন না ক্লেইবন। কি-ই বা বলবেন। মেঝের দিকে চলে গেল তার নজর। আচমকা পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। মেঝেতে কাগজের নীচে প্রায় চাপা পরে আছে একটা খবরের কাগজ। পুরোটা পড়া না গেলেও, হেডলাইন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেঃ হলিউড প্রডিউসার বেটস কেসের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র বানাতে চান।
নরম্যান কোথায় যাচ্ছে, তা সাথে সাথে বুঝে ফেললেন তিনি।
.
১২.
বাথরুমের আয়নায় মেকাপটা ভালোমতো দেখে জ্যান হার্পার সিদ্ধান্ত নিল, একেবারে নিখুঁত হয়েছে কাজটা। আচমকা জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটল সে। অবশেষে, ভাবল ও, এবার কাজে নেমে পড়া যাক।
কাউন্টারের উপরে রাখা পার্সটা তুলে নিয়ে, চুপিসারে দরজার দিকে এগোল ও। অবশ্য তার কোনও দরকার ছিল না। ওর সাথে এই অ্যাপার্টমেন্টে অন্য যে মেয়েটা থাকে, কনি, সে ওপাশের শোবার ঘরে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। মাঝ রাতের আগে ওর এই মরণঘুম ভাঙবে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও কতক্ষণ আগের রাতের আনন্দ-ফুর্তির রেশ থাকবে তা খোদা মালুম।
কিছুটা ঈর্ষান্বিতবোধ করল জ্যান। কনি চাইলেই বেরিয়ে পড়তে পারে ঘর ছেড়ে। এইসব মেকাপ-টেকাপের দরকার হয় না। বড় নাক আর ছোট ছোট স্তন নিয়ে মেকাপ করেই বা কী লাভ? এই ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে চাই ছোট নাক, আর বড় বড় স্তন। যেহেতু সেগুলো কনির নেই, তাই সাত সকালে উঠে মেকাপ করার তাড়াও নেই।
হঠাৎ অপরাধবোধে ভরে উঠল ওর মনে, নিজের চেহারার উপরে তো আর কনির হাত নেই! মেয়েটা চাইলেই নাকের অস্ত্রপাচার করে আর ব্রার ভেতর স্টাইরোফোম গুঁজে দিয়ে নিজের চেহারা আর দেহসৌষ্ঠব পরিবর্তন করতে পারত। কিন্তু করেনি। ভাগ্য ওকে যা দিয়েছে, তাই নিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। এজন্য তার প্রশংসা প্রাপ্য হতে পারে, উপহাস নয়।
ত্যাগ করে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল জ্যান, নিঃশব্দে সদর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন কনিকে না, ওর নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার সময়। এই জন্যই সকালের একটা ঘন্টা মেকাপের পেছনে ব্যয় করেছে মেয়েটা…এই জন্যই কারপোর্টে ওর জন্য অপেক্ষা করছে ছোট টয়োটাটা। যতবার মাসিক পেমেন্টের কথা মনে পড়ে, জ্যানের ভেতরটা যেন কেঁপে ওঠে।
কিন্তু দরজা খুলে ভেতরে বসতেই, ওর মন মেজাজ ভালো হয়ে গেল। এই গাড়িটা বিলাসিতার জন্য কেনা হয়নি। ওটা ওর পোশাকের-ই একটা প্রবর্ধিত অংশ। চলচ্চিত্র পাড়ায় উপরে উঠতে হলে, বাসে আসা-যাওয়া করলে চলবে না!
ইঞ্জিন চালু করে, সাবধানে কারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এল সে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, পূব দিকে মোড় নিয়ে মুলহল অ্যান্ড ড্রাইভের দিকে এগোচ্ছে। সোমবার সকালের কুয়াশা ঘেরা আবহাওয়ায় এখনও গোফার, কয়োট এবং অন্যান্য বুনো প্রাণিদের দেখা যাচ্ছে। ওদের দিকে না তাকিয়ে স্যান ফার্নান্দো ভ্যালির দিকে তাকিয়ে রইল সে। কুয়াশা ভেদ করে, করনেট স্টুডিওস এর সাউন্ড স্টেজ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। সিবিএস স্টুডিও সেন্টার আর ইউনিভার্সালের কালো টাওয়ারের মাঝে অবস্থিত ওটা।
টয়োটা এখন বাঁয়ে মোড় নিয়ে নিচের দিকে রওনা দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের কুয়াশার দিকে তাকাল সে। এই কুয়াশা গাড়ির বারোটা বাজিয়ে ফেলে। মানুষের ফুসফুঁসে ঢুকলে যে তার অবস্থা কি হবে, তা বোঝাই যায়! কিন্তু লক্ষ যখন চূড়ার দিকে, তখন এসব নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো। ভেনচুড়া বুলেভার্ড পার হয়ে, উত্তর দিকে রওনা দিল জ্যান। ডানেই স্টুডিওর গেট। কিন্তু জ্যানের টয়োটাকে পার হয়ে গেল একটা চকচকে রোলস। গার্ডের কিউবিকলের সামনে মাত্র একটা মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। ভেতরে বসা ড্রাইভারকে দেখা মাত্র সেঁতো হাসি হেসে প্রবেশমুখের বাঁধাটা তুলে দিল গার্ড। জ্যানের গাড়ি কিউবিকলের সামনে আসতে আসতে, আবার নেমে এল ওটা।
গার্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল ও। জ্যান হার্পার।
একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে লোকটা, চিনতে পারেনি। কার কাছে এসেছেন?
আমি কাজে এসেছি, ড্ৰিসকল ইউনিটের সাথে আছি।
এক মিনিট, দাঁড়ান।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে থাকা লিস্টটায় ওর নাম খুঁজল গার্ড। এরপর জ্যানের দিকে ফিরে বলল, নাম আছে। কিন্তু আপনার ইউনিটকে বলবেন যেন একটা স্টীকারের ব্যবস্থা করে দেয়।
ধন্যবাদ, বলব। বাঁধাটা উঠে গেলে, ভেতরে প্রবেশ করল জ্যান। হাসিতে ঠোঁটের লিপস্টিক বা চেহারার মেকাপ নষ্ট হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য গাড়ির কাঁচের দিকে তাকাল। রোলসের হারামজাদাটাকে দেখা মাত্র গার্ড যেতে দিল, অথচ ওকে এতদিন দেখা সত্ত্বেও পাত্তাই দিল না! ব্যাপার না। জ্যানেরও দিন আসবে।
ড্ৰিসকলের অফিসের পার্কিং লটের দিকে এগোল ও। প্রতিটা পার্কিং স্পেসে সুন্দর করে নাম লেখা আছে। সবগুলো নামই স্টুডিও-এর এক্সিকিউটিভদের। নিয়ম…নিয়মের দাস সবাই। স্টুডিও-এর নিয়ম যে এটাই। এক্সিকিউটিভরা অফিসের কাছাকাছি পার্কিং লটের জায়গা পায়। কর্মরত অভিনেতা-অভিনেত্রী আর ডিরেক্টরদের পার্কিং করার জায়গা নির্ধারিত থাকে সাউন্ড স্টেজের কাছে। তবে নামগুলো পরিবর্তন হতে সময় লাগে না খুব একটা। চলচ্চিত্র ব্যবসার যে অবস্থা, তাতে সম্ভবত এই নাম লেখকদের-ই কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। জ্যান ত্যাগ করে পার্কিং লটের পেছনের দিকে চলে এল। পোর্টেবল ড্রেসিং রুম। আর ট্রেইলারগুলোর ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল গাড়িটা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ন্যায় বিচারই এটা। প্রতিশোধ না। ওর জায়গায় ডা. ক্লেইবর্ন হলেও নিশ্চয় এমনটাই ভাবতেন। কেননা এই দুজনের সাক্ষ্যের কারণেই হাসপাতালে আটকা থাকতে হয়েছে ওকে। অথচ নরম্যানের ব্যাপারে মন্তব্য করার ওরা কে? মেয়েটা তো বোনের প্রেমিকের বিছানা গরম করতে ব্যস্ত। আর প্রেমিক প্রবর? তার মুখে অন্ন জোটে মানুষ বা পশু খুন করার সরঞ্জামাদি বিক্রি করে। খুনি, কসাই আর মৃত্যুর ব্যবসায়ী তো ওই স্যাম লুমিস। অথচ ভুগতে হচ্ছে। নরম্যানকে! এ কেমন বিচার!
ন্যায় বিচার চাইবার জন্য কি ওকে দোষ দেয়া চলে?
কিন্তু প্রধান সড়ক মৃতপ্রায় আর পার্শ্ব রাস্তাগুলোও অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্যাম আর। লিলা ওর কাছ থেকে আত্মগোপন করে রয়েছে নিশ্চয়। কে জানে, হয়তো পর্দার। আড়ালে লুকিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে! কিন্তু কোন বাড়িতে? কোন পর্দার। পেছনে?
শত্রুদেরকে খুঁজে পাবে কোথায়? প্রতিটা দরজায় তো আর নক করে দেখা সম্ভব না। দুই রাস্তার সংযোগ স্থলে এসে থমকে দাঁড়াল নরম্যান, ক্রু কুঁচকে আছে। এখন পর্যন্ত কারও নজরে পড়েনি ও, কিন্তু এই সৌভাগ্য যে কতক্ষণ থাকবে তা বলা মুশকিল। পলাতক এক মানুষ সে, ওকে খুঁজতে খুব শীঘ্রই অনেকের এসে পড়ার কথা। কিছু করতে চাইলে, এখনই করতে হবে। কিন্তু কী যে করবে…
ঠিক সেই মুহূর্তেই রাস্তার ওপাশের ফিলিং স্টেশনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ফোন বুথটা নজরে পড়ল ওর। পেয়ে গেছে সমাধান। প্রথমে ফোন ডিরেক্টরি খুঁজল। কিন্তু কপাল মন্দ, যেখানে বইটা থাকার কথা, সেখানে শুধুই শূন্যতা। তথ্যের জন্য এখন অপারেটরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকালকার দিনে কেউ বাড়ির ঠিকানার জন্য অপারেটরকে ফোন করে না। আর এরকম একটা ছোট শহরে খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত বেগে ছড়ায়। ও ফোন নামিয়ে রাখার এক মিনিটের মাঝে নিশ্চয় অপারেটর সরাসরি স্যাম বা লিলাকে খবরটা জানিয়ে দেবে। তাই মত পাল্টাল নরম্যান।
দুই রাস্তার সংযোগস্থলে ফিরে এলো আবার। এখানে একটা পানশালা আছে। ওটাকে পার হয়েই একদম থমকে দাঁড়াল সে। রবিবারের আইন মেনে বন্ধ হয়ে আছে পানশালাসহ প্রায় সবগুলো দোকান। তবে একটা জানালায় এখনও আলো জ্বলছে। লুমিস হার্ডওয়্যার-জ্বলজ্বল করে ধরা দিল ওর সামনে।
আছে, ভেতরে আছে কেউ একজন।
শিকারী বাঘের মতো নিঃশব্দে দোকানের দিকে এগোল নরম্যান বেটস।
পেরেছ? চোখ তুলে চাইল রয়। তাহলে তো সব জানো।
কী জানি?
খবর শোননি? নরম্যান বেটস পালিয়েছে।
হায়, ঈশ্বর।
রিপোর্টে বলছে, লোকটা আরেকবার হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। পাঁচজন ভিক্টিম পাওয়া গিয়েছে এখন পর্যন্ত। আরও বেশি হতে পারে, কর্তৃপক্ষ অবশ্য নিশ্চিত নয়। তবে কথা হচ্ছে, এখনও সম্ভবত সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
থমকে দাঁড়াল জ্যান। সেজন্যই তাহলে ড্ৰিসকল ডেকে পাঠিয়েছে! ছবি বানানো বন্ধ করে দেবে নাকি?
দিতেও পারে।
কিন্তু কাজটা- জ্যান হাত রাখল রয়ের হাতে। আমাদের ওদেরকে থামাতেই হবে। কথা দাও, আমাকে সাহায্য করবে।
ওর কথা শুনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রয়। কিছু বলছে না কেন লোকটা? দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলল, কেবল নিজেকে নিয়েই আমি চিন্তিত নই। এই ছবিটা তোমার জন্যও জরুরী। তোমার ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে এর সাথে।
রফ শীতল চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে রয়। হঠাৎ বিকৃত হয়ে গেল তার চেহারা। উঁচু গলায় বলল, সমস্যা কী তোমার, আঁ? এক বদ্ধ উন্মাদ পাঁচ পাঁচজন মানুষকে খুন করে পালাচ্ছে, আর তুমি কিনা একটা বালের ছবি নিয়ে চিন্তিত! আচমকা এমন জোরের সাথে নিজের হাতটা সরিয়ে নিল রয় যে জ্যান ভয় পেল, লোকটা মেরে না বসে।
কিন্তু তা না করে দ্রুত পায়ে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল রয়, অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল জ্যান। ঠিক আন্দাজ করতে পেরেছিল লোকটার ব্যাপারে। ওই ভদ্র ব্যবহার আর বন্ধুত্বপূর্ণ হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা নৃশংসতা আর রাগ পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে। কিন্তু কেন যেন ভয় পেল না এক বিন্দুও। তবে অবাক হয়েছে। সেই সাথে হতাশ।
ছেলেটার প্রতি অদ্ভুত এক শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছে ও।
হয়তো সত্যি সত্যি রয় ওই খুনগুলো নিয়ে চিন্তিত।
কিন্তু জ্যান এতোদূর এসে সবকিছু বাদ দিয়ে দিতে পারে না। সেই ছোটবেলা থেকে কাজ করছে সে। সেই যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রণ-ওয়ালা চেহারা দেখত, ভাবত কেউ ওকে কখনও ভালোবাসবে কিনা, তখন থেকেই একটা মাত্র লক্ষ্য…একটা মাত্র উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছি। চেয়েছে এমন একজন হতে, যার প্রতি নিবদ্ধ থাকবে সারা দুনিয়ার মনোযোগ। চলচ্চিত্র আর টেলিভিশনের অভিনেত্রীরা যেমন হয়ে থাকে। এখন বড় হয়ে গিয়েছে ও, টিভিতেও তাকে দেখিয়েছে। এখন লক্ষ্য চলচ্চিত্র। সবাই ভালোবাসবে ওকে…সবাই।
রয়কে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং-এ প্রবেশ করতে দেখে, নতুন করে দৃঢ় হলো তার সংকল্প। অপরাধবোধে ওকে আক্রান্ত করা বৃথা প্রচেষ্টা। ওই পাঁচ জন। ভিক্টিমের জন্য যদি কেঁদে কেঁদে রক্তও বইয়ে দেয় জ্যান, তাতে ভিক্টিমের কী লাভ হবে? তারা মৃত, কিন্তু ও তো জীবিত!
দুনিয়া উল্টে গেলেও, এই ছবি বাতিল হতে দেবে না জ্যান হার্পার।
.
১৩.
অনিতা কেজি সব্যসাচী। ড্ৰিসকলের বাইরে অফিসে বসে বসে আছে সে, সামনে ছড়িয়ে আছে ভ্যারাইটি আর হলিউড রিপোর্টার-এর মতো ম্যাগাজিন। দুই হাতে দুটো ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে সে। যে আর্টিকেলগুলো মনিবের ভালো লাগতে পারে বলে মনে হচ্ছে, সেগুলো একটা ফেল্ট-টিপ লাল কলম দিয়ে দাগিয়ে রাখছে। জ্যান আগেও মেয়েটাকে এই কাজটা করতে দেখেছে, কিন্তু কাজটা যে করে কীভাবে তা বুঝে উঠতে পারেনি। তবে একথা সত্যি যে মেয়েটা একটু অদ্ভুত। অবশ্য অদ্ভুত না হলে কি আর কেউ কোনও প্রযোজকের সহকারী হয়?
একদম পোকা-মাকড়ের মতো না হলে, দায়িত্বটা সামলানো যায় না। এক ধরনের পোকা আছে না? একসাথে দুই দিকে তাকাতে পারে। ভুল হলো, এই পোকাটা একসাথে তিন দিক দেখতে পায়! কেননা ম্যাগাজিনের উপর থেকে নজর না তুলেই সে বলল, ভেতরে চলে যান। মি. ড্রিসকল এখুনি আপনার সাথে যোগ দেবেন। আজ সকালে আসতে একটু দেরি করে ফেলেছেন।
জ্যান নড় করে ডেস্কের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। আজ সকালে আসতে একটু দেরি করে ফেলেছেন। এ আর নতুন কী? প্রযোজকদের সহকারীদের মতানুসারে, তারা সবসময় দেরি করেই আসে। ঠিক যেন কোনও কমদামী ঘড়ি। অবশ্য আলাদা আছেন অনেকেই। যাদের দক্ষতা, প্রতিভা আর সুরুচি ছাড়া হলিউড কখনও বর্তমান অবস্থানে আসতে পারত না।
সমস্যা হলো, আজকাল সবাই নিজেকে প্রযোজক বলে পরিচয় দিতে পারে। শুধু দরকার একটা অফিস ভাড়া নেয়া আর ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনে রাখা। সাথে সাথে দেখা যাবে, উচ্চাভিলাসী মেয়েরা দলে দলে এসে দুপা ফাঁক করে শুয়ে পড়েছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, মার্টি ড্রিসকল সেই দলে পড়ে না। পরিচয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত কোনও বাজে ইঙ্গিত দেয়নি মেয়েটা। অফিসটাও দারুণ জাঁকজমকপূর্ণ। অফিসে ঢোকা মাত্র আরেকবার মুগ্ধ হলো জ্যান। দেয়ালে দ্যমিয়ের-এর আঁকা অনুসারে ওয়াল পেপার, কাঁচের বিশাল কফি টেবিলের সামনে বড় সড় কাউচ আর দামী কাঠের ডেস্কে সাজানো। ডেস্কের উপর রয়েছে কেবল ইন্টারকমের ফোন আর একেবারে বর্তমান স্ত্রী ও দুই সন্তানের ছবি। মুগ্ধ হবার মতো, কিন্তু অতোটা প্রভাব ফেলার মতো না।
অফিসটা কেন যেন ওকে দ্বিধার মাঝে ফেলে দেয়। ড্ৰিসকলকে যতটুকু চেনে, লোকটা ফ্রেঞ্চ ছবি আর ফ্রেঞ্চ পোস্টকার্ডের মাঝে পার্থক্যও বোঝে না। দামী জিনিস দিয়ে সাজানো হলেও, একেবারে অগোছালো। যেন অফিসের সব কিছু, এমনকি স্ত্রী-সন্তানের ছবিটাও, চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো! একরাতে নিয়ে এসে সব সাজিয়ে রেখেছে। যার অর্থ, চাইলে একদিনে অফিসটা খালিও করে দেয়া সম্ভব।
সম্ভবত এই ব্যাপারটাই জ্যানকে খোঁচাচ্ছে।
তাতে কী? ভাবল মেয়েটি। ড্রিসকল অন্যদের মতো নয়, নকল নয় সে। এর আগেও অনেকগুলো ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রে প্রযোজনা করেছে। ব্যবসার নাড়ী নক্ষত্র চেনে মার্টি, জানে কোথায় হাত দিলে টাকা পাওয়া যাবে। জানে কার ক্লজিটে কয়টা লাশ লুক্কায়িত আছে!
পাঁচ…রয় পাঁচটা লাশের কথা বলেছিল।
ওসব নিয়ে ভেব না, নিজেকে শোনাল সে। ঘরের অন্যপাশে তাকাতেই দেখতে পেল রয়কে। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে লোকটা। জ্যানের নিঃশব্দ আগমন একদম টের পায়নি। সামনে ঝুঁকে পল মরগ্যানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত এখন। পল মরগ্যান ছবিতে জ্যানের সাথে অভিনয় করছে। ওর সহযোগী।
কে কার সহযোগী! পল মরগ্যানের সহযোগী হচ্ছে জ্যান হার্পার। আর হবে না-ই বা কেন, পল মরগ্যান এক জীবন্ত কিংবদন্তি! আলো ছায়া খেলায় লোকটাকে দেখতে ছবির পর্দার বড়সড় একটা প্রতিলিপি বলে মনে হচ্ছে।
লোকটা যে নরম্যান বেটসের মতো একটা চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি সে। অবশ্য লোকটাও সম্ভবত জ্যানের মতো এক অপরিচিত মেয়ের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্রে দেখে অবাক হচ্ছে। সেজন্যই হয়তো ওকে ঢুকতে দেখা সত্ত্বেও ফিরে তাকায়নি পল। কারণটা যাই হোক না কেন, অতি দ্রুত লোকটাকে নরম করতে হবে। বোঝাতে হবে, এই ছবিটা ওকে নিয়েই। জ্যান সহযোগী মাত্র।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানুষ দুজনকে দেখছিল ও, কিন্তু কোমরে একটা স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠল। সেই সাথে নাকে এসে ধাক্কা দিল বাজে একটা গন্ধ। কপাল ভালো, পল মরগ্যানের দিকে তাকিয়ে হাসছিল সে। এখন সেটা স্যান্টো ভিজিনিকে দেখাবে।
অবশ্য হাসিটা তার প্রাপ্য, হাজার হলেও সে-ই ওকে মেরি ক্রেন চরিত্রটার জন্য বেছে নিয়েছে। সমস্যা হলো, লোকটার নাকের নিচে শুয়োপোকার মতো দেখতে একটা গোঁফ আছে। ভিজিনির গায়ের গন্ধে আর সেই সাথে ওর উরুর দিকে নেমে আসতে থাকা সম্পর্শে, গা শিহরিয়ে উঠল জ্যানের। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াল সে, মুখের হাসিটা এখনও অবশিষ্ট আছে।
মি. ভিজিনি–
স্যান্টো। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁকা হতে দেখে জ্যানের মনে হলো শুয়োপোকাটা নড়ছে! এতো আনুষ্ঠানিকতার কি আছে?
নড করল জ্যান। আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। তুমি আনুষ্ঠানিকতা চাও না, চাও আন্তরিকতা। নাকি ঘেঁষাঘেঁষি করতে?
মার্টি ড্ৰিসকলের গলা বাইরের অফিসের কাছ থেকে ভেসে আসায়, সবার মনোযোগ সেদিকেই ঘুরে গেল।
আমার ফোন এলে, পরে করতে বলো। বলল সে। দেরি করে আসার মতো। এটাও একটা প্রথা, সবাইকে বোঝান যে এই মিটিঙটা কত গুরুত্বপূর্ণ। ভেতরে এসে বিশাল ডেস্কের পেছনের ততধিক বিশাল চেয়ারে বসে পড়ল মোটা সোটা, টাক পড়তে শুরু করা লোকটা। তার পিছু পিছু ছায়ার মতো প্রবেশ করেছে জর্জ ওয়ার্ড। ধূসর চুল আর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, অতি প্রাচীন এক মানুষ সে। দীর্ঘদিন ধরে ড্ৰিসকলের সাথে আছে। ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল সে, আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে।
বসে পড়ো সবাই। সামনে ঝুঁকে বলল মার্টি ড্ৰিসকল।
রয় অ্যামেস আর পল মরগ্যান ডেস্কের দিকে মুখ করে থাকা সোফায় বসল। ভিজিনি দখল করল ডানদিকের একটা লাউঞ্জ, জর্জ ওয়ার্ডের কাছেই ওটা। জ্যান বেছে নিল বাঁ দিকের একটা চেয়ারকে।
কফি চাই কারও? সচরাচর যে কথাটা বলে মিটিং শুরু করে, সেটাই বলল মার্টি।
চাইল না কেউ।
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতার পর, আচমকা কথা বলে উঠল সে। গতকাল কী ঘটেছে, তা নিশ্চয় তোমরা সবাই শুনেছ। তারপর থেকে, ছবিটার ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছি খুব।
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! শব্দটা শোনা মাত্র শক্ত হয়ে গেল জ্যান। ছবিটা বাতিল হতে যাচ্ছে, ঠিক বলেছিল রয়।
আপনি-ই একমাত্র ব্যক্তি নন যার মাঝে এমন অনুভূতি কাজ করছে! বলে উঠল রয়। পলকেও কেবল সে কথাই বলছিলাম।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না। পল মরগ্যান বলে উঠল। নরম্যান বেটসের পলায়নের সাথে আমাদের ছবির কাহিনীর কোনও সম্পর্ক নেই। চিত্রনাট্যে ভুল কোনও তথ্য লেখা না হলে–
মাথা ঝাঁকাল রয়। আমার জানা সব তথ্যই তো এখন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।
তাহলে চিত্রনাট্যেও পরিবর্তন আনলেই হয়। ভিজিনি দ্রুত বলে উঠল। কয়েক পাতা এদিক-ওদিক করলেই হবে। কাজ শুরু করতে এখনও এক সপ্তাহ বাকি আছে। আর তাছাড়া, প্রথমে যেহেতু লুমিস আর মেরি মেয়েটাকে নিয়ে কাজ করব, আরও কিছু দিন সময় পাওয়া যাবে।
এখানে কি আমরা কাহিনী নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি নাকি? অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল রয়। চিত্রনাট্যের কথা ভুলে যাও! বেটস যতক্ষণ পাগলা গারদে বন্দি ছিল, আমাদের কোনও অসুবিধা ছিল না। আমাদের ছবিটাও হতো সত্য কাহিনীর উপর নির্ভর করে লেখা এক রূপকথার গল্প। এমনকিছু একটা, যে অনেক আগে ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এখন? এখন সবকিছু রুঢ় বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
ঠিক, নড করল ড্ৰিসকল। জ্যানের মনে হলো, কেউ যেন ওর পাকস্থলী খামচে ধরেছে। প্রযোজক যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় তবে তো…নাহ, কিছু একটা করতেই হবে।
আপনারা এখন হাল ছাড়তে পারেন না! কণ্ঠস্বর উঁচু হবার সাথে সাথে জ্যান নিজেও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সচকিত চোখে সবাই ওর দিকে তাকাল, কিন্তু পাত্তাই দিল না মেয়েটা। এখন হাল ছাড়া সম্ভব না।
জ্যান, দেখ- রয়কে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখল ও। চোখে বিষাদের ছায়া, মেয়েটার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হবার সময় না–
তাহলে নিজে হচ্ছ কেন! নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জ্যান। লোকটাকে পাত্তাই দিল না ও, সম্পূর্ণ নজর এখন টোকো মাথার লোকটার দিকে। তোমাদের হয়েছেটা কী? তোমাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, আমার চারপাশে বৃদ্ধা মহিলারা বসে আছে! এখন থামাটা পাগলামি হবে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস নিয়ে বসে আছ, বুঝতে পারছ না কেন?
মার্টির হাতদুটা উঠে আসতে দেখল ও। মনে হলো, প্রার্থনা করবে যেন লোকটা। কিন্তু তা, পরমুহূর্তেই হাততালি দেবার আওয়াজ শুনতে পেল জ্যান।
অসাধারণ! বলল লোকটা। একদম যথাযথভাবে বলেছ।
একবার খালি চিন্তা করে দেখ, বলল ও। এমন পাবলিসিটি।
ওকে থামিয়ে দিল ড্ৰিসকল। থামো। আমি কী ভাবছি, সেটা বলার সুযোগ দাও। জর্জ ওয়ার্ডের দিকে মোটা আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করল সে। তুমিই বলো।
নড করল ধূসর চুলো লোকটা। যেমন মি. ড্রিসকল বললেন, তিনি পুরো চলচ্চিত্রটা নিয়ে ভেবে দেখেছেন। প্রথম প্রথম আমরাও মি. অ্যামেসের মতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সমস্যা হবে। এরপর হঠাৎ করে মিস জ্যানের কথাটা মাথায় এল। মাগনা এমন পাবলিসিটি…তাই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম আমরা-নরম্যান বেটসের এই পলায়নের চাইতে ভালো কিছু, আমাদের উন্মাদিনীর পাবলিসিটির জন্য হতে পারত না। এক ধাক্কায় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আমাদেরকে নিয়ে যাবে এই ঘটনা। সারা দেশ জানবে আমাদের চলচ্চিত্রের কথা। বেটস তো মরেই গিয়েছে, কিন্তু গল্পটা বেঁচে থাকবে আরও কিছু দিন। ওই পাঁচটা খুনের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত, গল্পটা মরবে না। এমন কিছু তো পয়সা দিয়েও কেনা যায় না। কেসটা নিয়ে কেউ কোনও কিছু বলা মানেই, আমাদের ছবির বিজ্ঞাপন করা!
জ্যানের শক্ত হয়ে আসা দেহটা আস্তে আস্তে নরম হয়ে গেল। তাহলে কি আপনারা…আপনারা ছবিটা বাতিল করছেন না?
বরং উল্টো। এখনি কাজ শুরু করতে হবে। বলল ড্ৰিসকল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শু্যটিং শেষ করে, ছবিটা বাজারে ছাড়তে চাই।
খুব ভালো! রয়ের দিকে ফিরে হাসল পল মরগ্যান। বলেছিলাম না, দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই!
নেই মানে? বলতে বলতে মরগ্যানকে অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়াল রয়। তুমি চিত্রনাট্যের কথা ভুলে যাচ্ছ। গতকাল যে হয়েছে, তা তো আমাদের গল্পের সমাপ্তি পরিবর্তন করতে হবে!
আমি ভুলছি না। বলল ডিসকল। স্যান্টো যেমন বলল, তোমার হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে। যে যে পরিবর্তন করতে হয়, করে ফেল। সোমবারের মাঝে যদি তোমার কাজ শেষ না হয় তো, আমরা আগে পুরনো সীনগুলো রেকর্ড করে ফেলব। নতুন গুলো নিয়ে নাহয় একদম শেষে কাজ করা যাবে।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি কোনও কথা দিতে চাই না—
তোমার এজেন্ট কথা দিয়ে ফেলেছে। আজকে সকালেই ফোন করেছিলাম। চুক্তিও হয়ে গিয়েছে।
হাসল জ্যান, যতটুকু দুশ্চিন্তা ছিল তা-ও উধাও হয়ে গেল।
আরে চিন্তা করো না তো, রয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল স্যান্টো ভিজিনি। কয়েক পাতার-ই তো ব্যাপার। একবার ভেবে দেখ, নতুন কতগুলো উপকরণ আমাদের হাতে চলে এসেছে! নতুন পাঁচটা খুন, নরম্যানের মৃত্যু।
ভ্রু কুঁচকে ফেলল রয়। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও কেবল। তোমাকে কে বলল যে নরম্যান মারা গিয়েছে?
.
১৪.
শুধু মরেনি, সিগারেটের ফিল্টার ডা. ক্লেইবনে ডেস্কে রাখা অ্যাশট্রেতে খুঁজতে খুঁজতে বললেন ডা, স্টাইনার। মরে ভুত হয়ে গিয়েছে। দেখ অ্যাডাম, আমি জানি তোমার মনে কী চলছে
তাই নাকি?
নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে নেয়াটা বন্ধ করবে? কেউ তোমাকে দোষ দিচ্ছে না।
ত্যাগ করলেন ক্লেইবন। এখানে দোষ কার, সেটা বড় কথা না, বললেন তিনি। যা ঘটেছে, তার জন্য কে দায় নেবে-সেটা বড় কথা।
ঘুরে ফিরে তো ব্যাপারটা একই দাঁড়াল। আরেকটা সিগারেট বের করে নিয়ে বললেন স্টাইনার। দোষ, দায়িত্ব…এসব শব্দের মাঝে পার্থক্য আসলে কতোটুকু? ওভাবে চিন্তা করলে তো এর দায় কিছুটা ওটিসের উপরেও এসে পরে।আর ক্লারাই বা বাদ যাবে কেন? নরম্যান যখন হাসপাতাল ছেড়ে বের হয়, তখন তো সে রিসেপশনেই ছিল। দেখল না কেন?
কিন্তু সবকিছুর দায়িত্বে তো ছিলাম আমি—
আর যে লোকটা তোমার ঘাড়ে সেই দায়িত্ব চাপিয়েছিল, সেই লোকটা হচ্ছি আমি। বলতে বলতে ম্যাচের খোঁজে পকেটে হাত ঢোকালেন স্টাইনার। তাহলে তো আমাকেও দায়ী বলতে হয়। সিগারেটটা ধরিয়ে, ধোঁয়া ছাড়লেন ছাদ লক্ষ্য করে। আমি এমনি এমনি বলিনি যে তোমার মনের কথা বুঝতে পারছি। খবরটা শোনার সাথে সাথে মিটিং-ফিটিং বাদ দিয়ে কেন চলে এলাম, বলো তো? প্রথমে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বিমান ভ্রমণের সময় মাথাটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। আমার খারাপ লাগছে বটে, কিন্তু অপরাধবোধটা
আমার আছে।
দেখ, সিগারেট ধরা হাতটা নাড়ালেন স্টাইনার। কেউ নিখুঁত না। আমরা সবাই ভুল করি। এই কথাটা আমরা দুজনেই অনেকবার ব্যবহার করেছি, তাই না? জীবনের প্রতিটা ভুলের জন্য অপরাধবোধে ভুগলে, সকালে কাজের জন্য বের হওয়াটাই তো অসম্ভব হয়ে যাবে। গতকালকার ঘটনাটাও অনেকের ভুলের ফলাফল। কিন্তু আমরা কেউ, মানে ওটিস, ক্লারা, তুমি বা আমি…আমরা কেউ আগে থেকে ঘটনাটা আন্দাজ করতে পারতাম না। তাই যদি আমাদেরকে দোষ। দিয়ে হয়, তাহলে কেন অদৃষ্ট-দ্রষ্টা হলাম না, সেই দোষ দিতে হবে।
এখন কে ভারী ভারী শব্দ বলে বেড়াচ্ছে? ক্লেইবন বললেন। আসল কথা হচ্ছে, আমার উপর একটা দায়িত্ব ছিল। আমি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।
ব্যর্থ হয়েছ? সামনে এসে আবারও ধোঁয়া ছাড়লেন স্টাইনার। বুঝলাম, তুমি নিজেকে দায়ী বলে মনে করছ। কিন্তু কোন অপরাধের জন্য? তুমি কেবল ওটিসকে লাইব্রেরির দিকে নজর রাখতে বলেছিলে। এই তো? ওটিস যে ওর জায়গা ছেড়ে যাবে, তা জানার কোনও উপায় তোমার ছিল না। নরম্যান যে পালাবার ফন্দি আঁটছে, তা জানারও কোনও উপায় ছিল না। এখন থেকে আমরা কথা বললে বলব অকাট্য সত্য নিয়ে। নরম্যান খুন করেছিল সিস্টার বারবারাকে, চুরি করেছিল ভ্যানটা। যখন ওটা বিস্ফোরিত হলো, তখন নিজের দোষে মৃত্যু ঘটেছে ওর আর সিস্টার কুপারটাইনের-
আমার কথাটা এবার মন দিয়ে শুনুন, উঠে দাঁড়ালেন ক্লেইবর্ন। নরম্যান ভ্যানে মারা যায়নি। ওরা এক পথচারীকে তুলে নিয়েছিল। আমি জানি, কারণ আমি ওই পথচারীর লেখা সাইনটা খুঁজে পেয়েছি। নরম্যান সিস্টার কুপারটাইন আর সেই পথচারীকে খুন করেছে। এরপর ফেয়ারভিলে গিয়ে স্যাম আর লিলা লুমিসের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। অ্যাংস্ট্রম আপনাকে বলেননি?
নড করলেন স্টাইনার। বলেছে। আজকে সকালে কথা বলার সময়, তোমার তত্ত্বও আমাকে শুনিয়েছে সে। লোকটার কিন্তু ধারনা যে, ওই দুজনকে খুন করেছে কোনও চোর। হয়তো যে পথচারীর কথা বলছ, সে-ও হতে পারে–
ধারনা? ক্লেইবন বলে উঠলেন। কীসের ভিত্তিতে এই ধারনা হলো তা-ও বলেছে কী? প্রমাণ কই? তার কথাও আরেকটা তত্ত্ব। লুমিস দম্পতির খুনটাকে কাকতালীয় ঘটনা ধরে নিলেই, সব ঝামেলা চুকে যায়, তাই না? কিন্তু আমি যে ঘটনাটাকে কাকতালীয় বলে ধরে নিতে পারছি না। আমার মতে, ওটা ইচ্ছাকৃত খুন। হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। আর নিরেট তথ্য বা প্রমাণ যদি চান তো বলি, স্যাম আর লিলা লুমিসকে শুধু খুনই করা হয়নি, আক্রোশ মিটিয়ে খুন করা হয়েছে। মোটিভ এর সাথে পদ্ধতি যোগ করে বলুন, এমন কে আছে যে এই দুজনকে অতোটা আক্রোশ নিয়ে খুন করবে?
ময়না তদন্তের পুরো রিপোর্ট আসার আগে, এই সিগারেটটাও নিভিয়ে ফেললেন স্টাইনার। কিছুই জানা যাবে না। এই সপ্তাহের শেষের দিকে
সপ্তাহের শেষের দিকে? থমকে গেলেন ডা. ক্লেইবর্ন। এই লোকগুলো এমন অলস কেন? দেখুন নিক, আমি ফরেনসিক সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করার পর, একটা ময়না তদন্তেও বসিনি। কিন্তু তবুও বলছি, আমাকে তিন ঘন্টা সময় দিন। আমি অবশ্যই তার পরিচয় বের করে আনব।
নড করলেন স্টাইনার। রিগসবিও বের করতে পারবে। সমস্যা হলো ওর হাতে এখন অনেক কাজ।
বাসের অ্যাক্সিডেন্টটার জন্য?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডা, স্টাইনার। গতকাল সাতজন নিহত হয়েছে। আহতদের মাঝে দুজন গতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। মোট হলো নয়জন।
আচ্ছা, রিগবিকে এই কাজটা আগে করার জন্য চাপ দেয়া যায় না? অ্যাংস্ট্রম চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ, কাউন্টি করোনারের পদটা কিন্তু নির্বাচনে জিতে পেতে হয়।
মানে?
মানে, অ্যাংস্ট্রম একজন মাত্র মানুষ। এদিকে অ্যাক্সিডেন্টের ফলে মৃত মানুষদের পরিবারে সদস্য একের অধিক। যাদের সবাই আবার ভোটার। রিগবি যে ওর চাইতে অন্যদের কথার বেশি গুরুত্ব দেবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালেন ডা. স্টাইনার। বেচারার জন্য আমার মায়া-ই হয়। সারা সপ্তাহ খেটে মরতে হবে বেচারাকে। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
মানব জীবনের চাইতে কী রাজনীতি বড়? আমি মানতে চাই না। আপনার তা মনে হয় বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
আমিও তা মনে করি না। ডা. স্টাইনার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। পনেরো মিনিটের মাঝে তিন-তিনটা ধরিয়ে ফেললাম! সিগারেটটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। বিশ্বাস করো, আমিও তোমার মতো নিয়ম মেনে সব কিছু করতে চাই। কিন্তু আমাদের হাতে আর কোনও উপায় নেই। চুপচাপ অপেক্ষা করতে হবে।
নরম্যান তো চুপচাপ বসে থাকবে না। শ্রাগ করলেন ডা. স্টাইনার। ঠিক আছে। যদিও আমার বিশ্বাস হয় না, তবুও ধরে নিলাম যে বেটস এখনও বেঁচে আছে। অ্যাংস্ট্রম জানালো, সে ক্যাপ্টেন বেনিং-এর সাথে মিলে কাজ করছে। অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে ওরা। কেউ কিছু জানলেই যেন জানায়, সে অনুরোধ করেছে জনসাধারণকে। সব প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। কিন্তু শক্ত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, ওদেরকে ওদের নিয়ে থাকতে দাও। তুমি তাদেরকে থামাতে পারবে না। যেমন পারবে না হলিউড স্টুডিওর ওদেরকে চলচ্চিত্র বানানো থেকে ফেরাতে
চোখ তুলে তাকালেন ক্লেইবর্ন, সেই চোখে প্রশ্ন। নড করলেন ডা. স্টাইনার। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। প্রযোজক আমাকে ফোন দিয়েছিল। যার সাথে তুমি গতকাল কথা বলেছিল, সেই লোকটাই।
মার্টি ড্ৰিসকল?
আমি ফেরার সাথে সাথে লোকটা ফোন করেছিল। বলল, গতকালের খবরটা পড়েছে। আরও তথ্য চায়।
দিয়েও দিলেন?
অবশ্যই না। জ কুঁচকে তাকালেন স্টাইনার। আমার লোকটাকে সাহায্য করার কোনও ইচ্ছা নেই। কখনও ছিল না। আমি তার পাঠানো চিত্রনাট্য পড়িনি। লেখকের সাথে কথাও বলতে চাই না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে আমার পরামর্শ ছিল, চলচ্চিত্রটা বাতিল করে দেয়া হোক।
মেনেছে?
তা আর মানে? বলেছে জাহান্নামের চৌরাস্তায় যেতে! আগামী সোমবার থেকে ওরা শুটিং শুরু করবে।
অসম্ভব! মাথা নাড়লেন ক্লেইবন। নিক, আমরা ওদেরকে একাজ করতে দিতে পারি না!
অবশ্যই পারি না। ডা. স্টাইনার চেয়ার পেছন দিকে ঢেলে দিলেন। আমি কাজে যাচ্ছি। তুমি নাহয় কয়েকদিনের জন্য বিশ্রাম নাও।
আমি ছুটি চাই না–
তোমার চাওয়া-পাওয়ার কথা বাদ দাও। এই ছুটিটা তোমার বড় দরকার। তোমার সব রোগীর দেখাশোনার ভার নাহয় আমি নিয়ে নিলাম। তুমি পরিশ্রমে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিলকে তাল বানাচ্ছ।
তিলকে তাল বানাচ্ছি?
এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে বলছি। ওরা আসলে যা মনে চায়, তাই করতে। পারে। আমরা ওদেরকে থামাতে পারব না।
হয়তো আমরা পারব না। বললেন ক্লেইবন। কিন্তু আমরা না পারলেও, নরম্যান পারবে।
.
১৫.
স্টাইনারকে কিছু বলাই উচিত হয়নি। ক্লেইবর্নের বোঝা উচিত ছিল, নিক ওর কথাকে কোনও গুরুত্ব-ই দিচ্ছেন না। তবে একবার যখন বলে ফেলেছে, তখন অবশ্য ওসব কথা ভেবে আর কোনও লাভ নেই। সমস্যা হলো, ওরা সবাই এখন তাকে হাসপাতালের ভেতরে আটকে ফেলেছে! ওকেই কিনা রোগী বানিয়ে ফেলেছে! ডায়াগনোসিস যে কী, সেটাও কেউ বলছে না। নার্স বা আর্দালিরা অবশ্য ওর সাথে কথা বলার সময় ডাক্তার বলেই ডাকছে। একদম ভদ্র আচরণ করছে সবাই। ভদ্র…তবে শক্ত। অবশ্য এমন শক্ত হবার দরকারও আছে। ওদের জায়গায় তিনি হলেও একই আচরণ করতেন।
নিজে ডাক্তার বলে, রোগী হিসেবে নিজেকে মেনে নিতে পারছেন না ক্লেইবর্ন। এই কেউ তাকে পরীক্ষা করে দেখছে তো এই কেউ তার সারা দেহে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেন ডাক্তার বা রোগী না, কোনও অপরাধী তিনি! এখানে দাঁড়াও, ওখানে বসো। কাহাতক সহ্য হয়!
অদ্ভুত এক সুর বাজছে কোথাও, সুরটা ঠিক যেন তার মাথায় গিয়ে আঘাত হানছে। মনে হচ্ছে, কানের পর্দা ফেটে যাবে। চোখ বন্ধ করে রেখেও, সুরটার হাত থেকে পালাতে পারছেন না তিনি। পালাবার কোনও উপায় নেই। হাত দিয়ে কান ঢাকতে যাবার সময় আচমকা উপলব্ধি করতে পারলেন, বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে!
আস্তে আস্তে কেঁপে উঠতে শুরু করল তার দেহ। জোর করে সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন তিনি, অনঢ় হয়ে চেপে বসা স্ট্রাপগুলো হার মানতে চাইছে না। নেই…কোনও উপায় নেই পালাবার। কিন্তু না, হার মানা চলবে না। পালাতে তাকে হবেই
হঠাৎ জেগে উঠলেন তিনি, চোখ খুলেই কোমরের দিকে চাইলেন। সীট বেল্ট বাধা আছে। শান্ত হও, নিজেকেই বললেন। বিমানে আছ তুমি। আশ্বস্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি, মুখে যে হাসি চলে এসেছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। একিসাথে অপরাধবোধ আর স্বস্তিতে ভরে উঠল তার মন।
ঠিক বলেছিলেন স্টাইনার, আসলেই অধিক পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। তিনি। বিমানে ঘুমিয়ে পড়াটাই তার প্রমাণ। এতোক্ষণ ধরে দুঃস্বপ্নে যা যা দেখছিলেন, সেসবও ব্যাখ্যা যোগ্য। যেমন বিমানবালা আর এখানকার কর্মচারীরা হচ্ছেন তার স্বপ্নের নার্স আর আর্দালি। বিমান বন্দরের সিকিউরিটি পার হবার সময় যে তার শরীর খুঁজে দেখা হয়েছে, তা হলো শারীরিক পরীক্ষা। বিমানে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে বলা, বসে থাকতে বলা, সীট বেল্ট বাঁধতে বলা এসবের ব্যাখ্যা তো বোঝাই যাচ্ছে। অদ্ভুত আওয়াজটাও বিমানের সাধারণ বাজনা। তবে কান ফেটে যাবে বলে যে অনুভূতিটা হচ্ছিল, সেটা এখনও আছে। তবে যেহেতু বিমান অবতরণ করতে শুরু করেছে, তাই তা নিয়ে বেশি ভাবলেন না তিনি। এখন চুপচাপ বসে থাকার সময়।
তার চারপাশের যাত্রীরা যার যার হ্যান্ড ব্যাগ খুঁজে বের করা নিয়ে ব্যস্ত। যতদ্রুত সম্ভব বের হবার জন্য সবাই হুড়োহুড়ি করছে। মানুষের স্বভাবটাই এমন, সব সময় যেকোনও লাইনের একদম সামনে থাকতে চায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ব্রীফকেসটা নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন তিনিও। যান্ত্রিক মুখ করে বিমানবালা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, তোতাপাখির মতো একই বুলি আওড়াচ্ছে একটু পরপর। এই বিমানে সফর করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে যাত্রীদের আর বলছে :
লস অ্যাঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-এ স্বাগতম
লবিতে এসে ডা. ক্লেইবর্ন দেখতে পেলেন, যাত্রীদের স্বাগত জানাতে এসেছে বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনরা। ক্লেইবর্ন নিজেও ভিড়ের মাঝে যেন কাকে খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু কাকে?
নরম্যান নিশ্চয় ভরা বিমান বন্দরে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাতে আসবে না। অবশ্য নিক স্টাইনারের কথা সত্য হবার একটা সম্ভাবনাও রয়ে যায়। হয়তো তার এখানে আসাটা একেবারেই পন্ড শ্রম হতে চলছে।
সামনের দিকে এগোতে শুরু করলেন ক্লেইবন। উপরের লবি থেকে বেরিয়ে নিচতলায় চলে এলেন। এবার উদ্দেশ্য একদম বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। পুরো ব্যাপারটা অদ্ভুত এক ধারনার জন্ম দিল তার মনে। সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হবার ব্যাপারটা যেন পুনরায় জন্ম নেবার মতো। একবার ওতে ঢোকা মাত্র, বের হবার জন্য সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে একদম ভিন্ন এক দুনিয়া।
তবে সত্যি সত্যি জন্ম গ্রহণ করার সম্ভবত এরচেয়ে সহজ ছিল। গাড়ি ভাড়া নেবার ব্যবস্থা করা, লস অ্যাঞ্জেলসের ম্যাপ কেনা, নিজের ব্যাগটা খুঁজে বের করে কনভেয়ার থেকে তুলে নেয়া-প্রতিটা কাজই অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ, ধৈর্যের পরীক্ষা, নেয়। সেই সাথে বাড়িয়ে তোলে বিরক্তি।
ভ্রমণ যে কবে আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা থেকে কষ্টকর একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ঈশ্বরই জানেন!
সমস্যা ক্লেইবর্নের নিজেরও হতে পারে। হয়তো বা তার ধৈর্যশক্তিই কম…হয়তো একটু বেশিই ক্লান্তি ভর করেছে তার ওপরে। বিমান বন্দরের বাইরে বেরিয়েও মেজাজ খুব একটা ভালো হলো না তার। পিপড়ার মতো ধীর গতিতে এগোচ্ছে গাড়িগুলো। এছাড়া আছে বিভ্রান্তিকর সিগন্যালগুলোর অর্থ বের করা, মাথার উপরে অগোছালোভাবে লাগিয়ে রাখা সাইনগুলোও খুব একটা সাহায্য করছে না। অনেকক্ষণ পর সেঞ্চুরি বুলেভার্ডে এসে পৌঁছালেন ক্লেইবন। তারপর এগোলেন পূর্বদিকে, ওদিকেই স্যান ডিয়াগো ফ্রি-ওয়ে।
রাস্তায় উঠে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, গাড়ি চালাতে চালাতে স্নায়ু শান্ত হয়ে আসতে শুরু করছে। আসলে নিকের দোষ ধরে লাভ নেই। লোকটা ওকে একদম বাঁধা দেননি, উল্টো আরও সমর্থন দিয়েছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন যে ক্লেইবর্নকে থামানো যাবে না, তখন যথাসম্ভব সাহায্য করেছেন। হয়তো পুরোপুরি সন্তুষ্ট মনে করেননি, তবে ঠিক ঠিক বিমানে সীট বুকিং দেয়া, ওটিসকে দিয়ে তাকে বিমান বন্দরে নামিয়ে দেয়া-সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। এ-ও কথা দিয়েছেন যে এদিকে কোনও নতুন খবর এলেই জানাবেন।
স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল তার। ওটা আসলে অবচেতন মনের নিজেকে শাস্তি দেবার এক প্রয়াস ছিল। নরম্যান পালিয়েছে, কিন্তু সেজন্য কেউ তাকে শাস্তি দেয়নি। তাই নিজেকে নিজেই শাস্তি দিচ্ছিলেন। বেটসের পালিয়ে যাবার ঘটনায়, নিজেকে সম্পূর্ণ দায়ী বলে মনে করেন ক্লেইবন।
আর তাই, ওকে পুনরায় পাকড়াও করাটাকেও নিজের দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছেন।
হ্যাঁ, নিজের এই ধারনার পেছনে যথেষ্ট শক্ত কারণ নেই তার। কিন্তু স্টাইনার বা অ্যাংস্ট্রমও যার যার ধারনার পেছনে কোনও শক্ত কারণ দেখাতে পারেননি। অন্তত এখন পর্যন্ত না। আর অমন কোনও প্রমাণ আসার আগ পর্যন্ত নিজের পেশাদারিত্ব, প্রশিক্ষণ আর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই এগোবেন তিনি।
অবশ্য নরম্যানের সাথে তার সম্পর্ক পুরোপুরি পেশাদারী না, হওয়াটা সম্ভবও না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যখন কোনও ডাক্তার এক রোগীর সাথে দেখা করেন, কথা বলেন…তখন সম্পর্কটা আর পেশাদারী থাকতে পারে না। লোকটার সবকিছু জানা তার, ওর সমস্ত গোপন কথা, সমস্ত দুশ্চিন্তা। নরম্যানের সাথে তাই তার সম্পর্কটাকে মাত্র একটা শব্দেই ঠিকঠাকভাবে প্রকাশ করা যায়-বন্ধুত্ব।
সেই বন্ধুর এখন তার সাহায্য প্রয়োজন। পেশাদারিত্ব চুলোয় যাক।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে করনেট স্টুডিওস এর কাছাকাছি চলে এসেছেন, তা নিজেও বলতে পারবেন না। ম্যাপ অনুযায়ী আর এক মাইল পরেই জায়গাটা। তবে এখনই ওখানে যাবার দরকার নেই তার। এই মুহূর্তে থাকার একটা জায়গা খুঁজে বের করা আরও বেশি জরুরী। গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। বুলেভার্ড রোডের পাশে অগণিত মোটেল দাঁড়িয়ে আছে।
তবে কোনওটাই তাকে খুব একটা প্রলুব্ধ করতে পারল না। এই মুহূর্তে গরম পানির পুল বা কালার টেলিভিশন খুব একটা দরকার নেই তার। দরকার হলো শান্ত, নিশ্ৰুপ একটা জায়গা। যেখানে গড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ তাকে খুব একটা বিরক্ত করতে পারবে না।
ডন মোটেল
একদম হঠাৎ করেই যেন মোটলটা তার চোখে ধরা দিল। ক্ষয়ে এসেছে সাইনবোর্ড, ক্ষয়েছে তার পেছনের ইংরেজি এল-আকৃতির দালানটাও। তবে প্যাটিও আর পার্কিং এরিয়া ঠিক আছে। পুল নজরে পড়ল না, অফিসে ঢোকার মতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মাত্র গাড়ি। শান্তি আর নিস্তব্ধতা পাওয়া যাবে বলে মনে
গাড়ি মোটেলের প্রবেশপথে ঢুকিয়ে, বাইরে নামলেন ক্লেইবন। পা দুটো দপদপ করছে, ক্লান্তি ভালোমতোই পেয়ে বসেছে তাকে। বিকালের আলোতে পথ থেকে অফিসের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি। ভেতরে প্রবেশ করে একনজরে সবকিছু দেখে নিলেন।
লবিটা একদম ছোট। এক কোনায় একটা ছোট, পুরাতন আর বহু ব্যবহারে জীর্ণ কফি টেবিলে বসে আছে একটা ধাতব অ্যাশট্রে। ওটার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো ম্যাগাজিন। ডানদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটা ভেন্ডিং মেশিন। একটা কার্বনেটের সাইট্রিক এসিড, একটা চকলেট ক্যান্ডি আর অন্যটা দাম বেশি রাখা সিগারেট দেখিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে।
রিসেপশন ডেস্কটা বাদ দিয়ে, কেউ নেই। ওটার পেছনে একগাদা ফ্রেমে বাঁধানো, ধূসর হয়ে আসা ফটোগ্রাফ সাজিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে একটা দেয়াল ঘড়িও। টিক টিক করে ক্লেইবর্নের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস পাচ্ছে সেটা।
ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা ছয়ের ঘরে, যদিও তার হাতঘড়ি জানাচ্ছে এখন আটটা বাজে। স্থানীয় সময় অনুসারে ঘড়িটাকে ঠিক করে নিলেন তিনি। হাতঘড়ি নাহয় ঠিক হলো, কিন্তু দেহঘড়ি কী আর এতো সহজে ঠিক হয়? রাতে ভালোমতো ঘুমিয়ে না নিলে ওটা ঠিক হবে না।
মোটেল মালিকের খোঁজে চারপাশে তাকালেন তিনি। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। ডেস্কের কাছে গিয়ে ওদিকে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন একটা বেল। তর্জনী দিয়ে টোকা দিলেন ওতে। এখন অপেক্ষার পালা।
কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে খুলে গেল প্যাটিওর দরজা, ডেস্কের পেছনে এসে দাঁড়াল কর্মচারী। বেশ লম্বা লোকটা, পাতল আর তুলোর মতো চুল। মুখের চামড়ায় রোদের ছাপ পড়েছে, রোদে খরখর করতে থাকা শুকনো নদীর তলদেশের মতো ফাটা চামড়া। তবে হাসিতে বয়সের ছাপ পড়েনি, পড়েনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ক্লেইবর্নের দিকে তাকিয়ে থাকা চাহনীতেও।
পেশাদারী দৃষ্টিতে এতোক্ষণ কর্মচারীকে দেখছিলেন ক্লেইবন। এখন ঘর ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে নজর ফেরালেন। জানালেন, প্রতি রাতের জন্য চল্লিশ ডলার ভাড়া গুনতে তার কোনও আপত্তি নেই। এ-ও জানালেন, রবিবার পর্যন্ত থাকতে চান তিনি। স্টোভ আর ফ্রিজ আছে ঘরে? ভালো তো, তবে তার দরকার পড়বে বলে। মনে হয় না। পুরোটা সময় বাইরে বাইরেই কাটবে তার। ছয় নাম্বার রুম পেছনের দিকে হলেও তার কোনও সমস্যা নেই। বরং পেছনের রুমই ভালো।
রেজিস্টারে সই করার সময়, নকল নাম ব্যবহার করতে মন চাইল তার। কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। ওর এই সফরে ঢাকঢাক গুড়গুড় করার কোনও ব্যাপার নেই। তার ওপর, এই মোটেলে থাকা অবস্থায় ওর কাছে বেশ কয়টি ফোন আসার কথা।
নিজের নামে ঘর ভাড়া নিলেও, শেষে তার ডাক্তারী পেশার পরিচয়-এম.ডি. অক্ষর দুটো লিখলেন না। ফ্রেমে বাঁধাই করা ফটোগ্রাফগুলোর দিকে নজর পড়ল তার। বুঝতে পারলেন, এরা সবাই অতীত কালের ফিল্ম-স্টার। একজনকে চিনতেও পারলেন তিনি। কার্ল ডুস না?
নড করল বয়স্ক লোকটা।
অসাধারণ অভিনেতা, বললেন ক্লেইবন। এক চেনি সিনিয়র বাদে, তার মতো হরর অভিনেতা আর হয় না।
ঠিক। কর্মচারীর সবুজাভ চোখ দুটো যেন হেসে উঠল। তবে তিনি তো মুকাভিনেতা! আপনি চিনলেন কীভাবে? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কাজ করেন?
মাথা নাড়লেন ক্লেইবন। আরে না। আপনি?
অনেক আগে করতাম। ফ্রেমগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেন বৃদ্ধ। এরা যখন এই শহর চালাত, তখন থেকেই আমি তাদের চিনি। এখন দেখুন, তারা দেয়ালে ঝোলানো কয়েক টুকরা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছেন। আর আমি? আমি এখনও এই শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সময় কী অদ্ভুত ভাবে কাজ করে, তাই না?
আপনি কি অভিনেতা ছিলেন?
হাসি ফুটে উঠল বলিরেখায় ছেয়ে যাওয়া চেহারাটায়। অভিনেতা হলে, আমার ছবিও ওখানে ঝুলতে দেখতেন। আকারে অন্যদের চাইতে বড়ই হতো! নাহ, আমি কখনও অভিনয় করিনি। তবে লিখেছি অনেক। চিত্রনাট্যকার বলতে পারেন। করনেট স্টুডিওস-এ কাজ করতাম।
মি.-?
পোস্ট। টম পোস্ট। আপনি নিশ্চয় এই ব্যবসা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, মি. পোস্ট।
এককালে হয়তো জানতাম, এখন জানি না। সাইলেন্ট মুভির দিন শেষ হবার সাথে সাথে, আমার দিনও ফুরিয়ে এসেছিল।
অবসর নেয়ায় আপনাকে অসুখী বলে তো মনে হচ্ছে না।
অসুখী হবার কী আছে! হাসি মিলিয়ে গেল পোস্টের মুখ থেকে। এই মোটেলটা বানাবার আগে আমি এনচিনোতে একটা পুরাতন গাড়ির দোকান। চালাতাম। মানছি, ডন মোটেল তেমন বড় কিছু না। তবে ব্যস্ত থাকতে হয়। কাজ ছাড়া তাকতে পারি না আমি। হাড়ের মতো সরু আঙুল তুলে বললেন তিনি, আজকালকার অবসর মানে কী জানেন? অবসর মানে হলো বুড়ো থুড়থুড়ে এক মানুষ…অবসর মানে রোগে জর্জরিত এক ফুসফস নিয়ে নোংরা পানিতে বিষাক্ত মাছ ধরা!
লেখালেখি এখনও ছাড়েননি দেখছি। হাসলেন ক্লেইবর্ন।
আরে না। আমি এমন এক বৃদ্ধ, যে এখনও মুখটাকে সামলে রাখতে শেখেনি। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একগাদা চাবী বের করে একটা ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিলেন পোস্ট। এই নিন। বাক্স-প্যাটরা কোথায়? দিয়ে আসি।
লাগবে না, আমি পারব। কয়েকটা ফোন করতে চাচ্ছিলাম।
আপনার ঘরে আলাদা ফোন আছে।
খুব ভালো।
যা কিছু লাগবে, জানাবেন।
ধন্যবাদ।
ব্যাগ-ব্রিফকেস নামাবার উদ্দেশ্যে গাড়ির কাছে চলে গেলেন ক্লেইবন। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল, বাক্স-প্যাটরা নিয়ে রুম নাম্বার ছয়-এ দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঘরটাকে একটা বড় বড় মাইক্রওয়েভ ওভেনের সাথে তুলনা দেয়া যায়, প্রচন্ড গরমে প্রাণ যেন দেহকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত। তাই থার্মোস্ট্যাট খুঁজে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। একদম সর্বোচ্চ শক্তিতে সেটাকে চালিয়ে। দিলেন। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব যন্ত্রটা শব্দ করে চালু হয়ে গেল। পরনের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে, ডাবল বেডে দেহটাকে আছড়ে ফেললেন। হাত বাড়ালেন টেলিফোনের দিকে। সাড়ে-ছয়টার বেশি বাজে। করনেটে কেউ থাকবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তবুও ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
প্রথমে অপারেটরকে ফোন করে, তার কাছ থেকে স্টুডিওর নাম্বার নিয়ে নিলেন। স্টুডিওর নাম্বারে এক মেয়ে ফোন ধরল। ড্ৰিসকলের কথা বলতেই দিয়ে দিল সংযোগ। অবাক হয়ে ক্লেইবর্ন খেয়াল করলেন, একবার রিং হবার সাথে সাথে ওপাশ থেকে কেউ রিসিভার তুলে নিল।
কে? মার্টি ড্ৰিসকলের ভরাট কণ্ঠ চিনতে পারলেন সহজেই।
অ্যাডাম ক্লেইবন বলছি, মি. ড্ৰিসকল।
কে? কণ্ঠ বিরক্তির সুর স্পষ্ট।
ডা. ক্লেইবন। আপনার সাথে গত রবিবার কথা হয়েছিল। আপনি হাসপাতালে ফোন করেছিলেন।
ওহ, ডাক্তার সাহেব। কণ্ঠ থেকে বিরক্তিটুকু উবে গেল। মনে পড়েছে। আপনি ফোন করায় খুশী হয়েছি। কী ঘটছে, না ঘটছে, সেসব ব্যাপার এখন তাহলে আপনার মুখ থেকেই শোনা যাবে।
কোনও অসুবিধা নেই। তবে ওসব কথা সাক্ষাতে হওয়াই ভাল।
সাক্ষাতে! আপনি এখানে এসেছেন নাকি?
কেবল এলাম। আগামীকাল যদি সময় দিতে পারেন—
আমি সারা দিন-ই আছি। আপনি যখন চান, আসতে পারেন।
নয়টায়?
সাড়ে নয়টায় হলে ভালো হয়। আপনার জন্য গেটে পাসের ব্যবস্থা করে রাখব।
ঠিক আছে তাহলে, নাড়ে নয়টায়।
দাঁড়ান। ক্লেইবর্ন ফোন রেখে দিচ্ছেন, বুঝতে পেরে বলে উঠল ড্ৰিসকল। আপনার ওই বস, কী যেন নাম…ডা. স্টাইনার, গতকাল খুব খারাপ ব্যবহার করল। নরম্যানের ব্যাপারে ঝামেলায় আছে নাকি?
ওই ব্যাপারেই আপনার সাথে কথা বলতে চাই। রিসিভার রেখে দিতে দিতে যোগ করলেন ক্লেইবন। আগামীকাল দেখা হবে।
ড্ৰিসকলকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ দিলেন না তিনি। এক হিসেবে কাজটা খেলো হয়ে গেল, কিন্তু ক্লেইবর্নের আশা, ঘটনাটা ড্ৰিসকলের অবচেতন মনে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। এমনিতেই লোকটা চিন্তিত হয়ে আছে। অন্য কারও মাঝে এতোটুকুও দেখতে পাননি তিনি।
সূর্যের আলো আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করেছে। এখানে এখন সাতটা বাজে…যার অর্থ, হাসপাতালে সময় নয়টা। হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। তার। কিন্তু যেহেতু স্টাইনারকে এখানে আসা মাত্র ফোন করবেন বলে জানিয়েছিলেন, তাই রিসিভার তুলে নিলেন।
প্রথমে ফোন করলেন লোকটার ব্যক্তিগত নাম্বারে। দশবার রিং হবার পরেও যখন কেউ ধরল না, তখন রেখে দিয়ে হাসপাতালের নাম্বার ডায়াল করলেন ক্লারা ধরল ফোন। জানাল, স্টাইনার বাইরে গিয়েছেন। ফেয়ারভিল রোটারী ক্লাব না কাদের সাথে যেন আজ রাতে খাবার খাচ্ছেন তিনি।
সবকিছু ঠিক আছে, এমনভাব দেখাবার চেষ্টা করছে লোকটা। রাগটাকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে, মেয়েটাকে মোটেলের ঠিকানা নাম্বার দিলেন ক্লেইবন। এ-ও জানালেন যে, আগামীকাল ডা, স্টাইনারকে ফোন করবেন। ওখানকার খবর আর জিজ্ঞাসা করলেন না। কেননা এক, কিছু ঘটলেও ক্লারার তা জানার কথা না। আর দুই, স্টাইনার যেহেতু রোটারী ক্লাবের পাছায় চুমো খেতে ব্যস্ত, তাই ধরে নেয়া যায় যে নতুন কিছুই ঘটেনি।
ফোন রেখে দিয়ে একবার ভাবলেন, বাইরে খেতে যাবেন কিনা। কিন্তু ক্লান্তি এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে ইচ্ছা করছে না। জামা-কাপড় ছেড়ে, সুন্দর করে ক্লজিটে ঝুলিয়ে রাখলেন। এরপর স্যুটকেস থেকে সব কিছু বের করে সাজিয়ে রাখলেন। রেজর, ব্রাশ ইত্যাদি বাথরুমে রাখার সময় একবার মনে হলো, গোসল সেরে নিলে মন্দ হয় না। কিন্তু ওই যে…ক্লান্তি। সকালে দেখা যাবে, ভেবে পায়জামাটা পরে নিলেন।
বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন, এমন সময় ব্রিফকেসের উপরে উন্মাদিনীর চিত্রনাট্যটা পড়ে থাকতে দেখলেন। বিমানে আসার সময় পড়ার ইচ্ছা ছিল ওটা, কিন্তু ছোঁয়াও হয়নি। এখন পড়া যেতে পারে, কিন্তু লাভ কী? এই চিত্রনাট্যের ব্যাপারে কথা বলার জন্য তো কালকে তিনি ড্ৰিসকলের অফিসে যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন এই লোকটাকে এই চিত্রনাট্য অনুসারে চলচ্চিত্র না বানাবার জন্য বোঝাতে।
থার্মোস্ট্যাটটা বন্ধ করে, বিছানার উঠে বসলেন ক্লেইবন। নাইট স্ট্যান্ডে রাখা বাতিটা জ্বালিয়ে পরেরদিনের মিটিং-এ কীভাবে ড্ৰিসকলকে কাবু করবেন, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। কীভাবে এগোলে ভালো হয়? তার সবচেয়ে শক্তিশালী যে বৈশিষ্ট্য, সেটাকেই কাজে লাগাবেন? যেভাবে কোনও রোগীর সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন, সেভাবে? ডা. ক্লেইবর্ন হবেন কর্তৃপক্ষের মতো একজন। সব ল্যাটিন আর গ্রিক শব্দ বাদ দিলে, যেকোনও থেরাপি আসলে এমন একটা পরিস্থিতির-ই সৃষ্টি করে। রোগীকে কথা বলতে দিতে হয়। এক্ষেত্রেও নাহয় তা-ই হোক। ড্ৰিসকল এই চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলুক। ডাক্তার ক্লেইবন যেভাবে অন্য সব রোগীর কথা শোনেন, সেভাবেই শুনবেন। ধরে নেবেন, দালানের কার্নিশে দাঁড়িয়ে লাফ দেবার হুমকি দিচ্ছে, এমন কোনও মানুষের কথা শুনছেন। লোকটার কথা শেষ হলে শুরু করবেন নিজের খেলা। বলবেন, নিঃসন্দেহে এই চলচ্চিত্র ভালো হবে, মানুষ জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, যেমনটা আকর্ষণ করবে কার্নিশ থেকে লাফ দেয়া। উন্মাদিনী টাকাও কামাবে প্রচুর। কিন্তু সেটা তো বীমা করানো থাকলে, লাফ দেখা লোকটাও পাবে। সমস্যা হলো, সেটা খরচ করার সৌভাগ্য তার হবে না। তাই লাফ দেবার আগে, ভালো মনে নিচের দৃশ্যটা দেখা নেয়া দরকার। কেননা নিচে ড্ৰিসকলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নরম্যান বেটস।
আমি নিশ্চিত, বলব ওকে-ভাবলেন ক্লেইবর্ন। এমন নিশ্চিত যে নিজের জীবন বাজি ধরতেও রাজি আছি। আর তাই, আপনার…মার্টি ড্ৰিসকলের জীবন নিয়ে বাজি ধরতে চাই না।
আচমকা তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন, নরম্যানকে এখনও বন্ধু হিসেবেই ভাবেন তিনি। কিন্তু নরম্যান? সে কি তাকে বন্ধু ভাবে? এই মুহূর্তে হয়তো ক্লেইবন তার কাছে শত্র। এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে, তিনি তো তা-ই!
স্বপ্নে নিজেকে নিজে শাস্তি দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে ছুটে এসেছেন লোকটাকে পাকড়াও করে শাস্তি দেবার মানসে। নরম্যান তার সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। ওই যে বইটা, নরম্যানকে নিয়ে যেটা লেখার ইচ্ছা ছিল তার, সেটা ভেস্তে গিয়েছে। পাঁচ বছরের সফল থেরাপির এক প্রমাণ হিসেবে ওটা লিখতে চেয়েছিলেন ক্লেইবন। এরচেয়ে অনেক কম সময়ের কথা লিখেও অনেকে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
জনপ্রিয়তা চুলায় যাক! এখন ওসব নিয়ে ভাববার সময় না। সামনে অবশ্যম্ভাবীভাবে যে ঘটনাগুলো ঘটবে, সেটা কীভাবে থামানো যায় তা নিয়ে ভাবার সময়। ভ্রু কুঁচকে উপরের অন্ধকারের দিকে তাকালেন ক্লেইবর্ন। নিজের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেবার সময় হয়েছে। নরম্যান তার বন্ধু না শত্রু, সে ব্যাপারেও। উন্মাদ লোকটার শিকারদের আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভাবা দরকার। তাদের সাহায্য করা দরকার। আর সেই সাহায্য করাটা ক্লেইবর্নের দায়িত্ব। নাহ, তিনি মনোবিদ, কেবল সেই কারণে না। তার মাঝে মানবিক গুণাবলি এখনও অবশিষ্ট আছে, সেই কারণে। অতীতকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকলে, করতেন তিনি। তা যখন নেই, তখন ভবিষ্যতে যেন আরও দুঃখ…আরও কষ্টের সম্মুখীন হতে না হয় তাদের, সেটা নিশ্চিত করতে নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দেবেন।
এজন্যই এই অভিশপ্ত চলচ্চিত্রটা বন্ধ করে দিতে হবে। নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও, নরম্যানকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনতে হবে।